অপত্য স্নেহ

অপত্য স্নেহ

বেলা দুটো নাগাদ একতলার চেম্বারে পেশেন্ট দেখা শেষ করে দোতলার ঘরে খাওয়া আর বিশ্রাম নেবার জন্য উঠতে যাচ্ছিলেন ডাক্তার অচিন্ত্য সেন৷ ঠিক সেই সময় চেম্বারের পর্দা ঠেলে প্রবেশ করল একজন মাঝবয়সি লোক৷ তার পরনে ধুতির ওপর শার্ট৷

তাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়েও আবার বসে পড়লেন অচিন্ত্য৷ যদিও লোকটা অসময়ে এসেছে, তবুও কোনোদিন কোনো পেশেন্টকে ফেরান না তিনি৷ অসুখ হলেই তো মানুষ ডাক্তারের কাছে আসে৷ আর অসুখ কখনও সময় মেনে আসে না৷ তাই এ লোকটাকেও পেশেন্টদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারটা দেখিয়ে অচিন্ত্য বললেন, ‘কী হয়েছে আপনার?’

লোকটা তাঁর কথা শুনে বলল, ‘আমি শিমুলবাগান থেকে আসছি৷ আমি নয়, আমার বাবু আপনার পেশেন্ট৷ তিনি আপনাকে একটা খাম পাঠিয়েছেন৷’ এই বলে লোকটা বেশ বড় খাম এগিয়ে দিল ডাক্তারবাবুর হাতে৷

খাম! মৃদু বিস্মিত হয়ে তিনি খামটা খুলতেই তার থেকে বেরিয়ে পড়ল ডাক্তার অচিন্ত্য সেনেরই লেখা একটা প্রেসক্রিপশন, এক টুকরো কাগজে লেখা একটা ছোট্ট চিঠি আর হাজার টাকার কয়েকটা নোট৷

নিজের প্রেসক্রিপশনটা প্রথমে দেখলেন অচিন্ত্য৷ পেশেন্টের নাম মণিময় গুপ্ত, বয়স পঁয়ষট্টি৷ রক্তাল্পতার কারণে বার কয়েক রক্ত দেওয়া হয়েছিল তাঁকে৷

প্রেসক্রিপশন দেখে ভদ্রলোককে মনে পড়ে গেল ডাক্তার অচিন্ত্য সেনের৷ ফর্সা, বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা ভদ্রলোকের, তবে গাউটের জন্য একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন৷ সে চিকিৎসার জন্য অবশ্য তিনি তাঁর কাছে আসেননি৷ এসেছিলেন শরীর দুর্বল হবার কারণে৷ অচিন্ত্য সেন তাঁকে স্থানীয় এক নার্সিং হোমে একবেলা ভর্তি রেখে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন৷ শেষবার তাঁকে রক্ত দেওয়া হয় মাস দুই আগে৷

প্রেসক্রিপশনটা দেখার পর অচিন্ত্য চিঠিটা পড়লেন৷ তাতে লেখা—

‘শ্রদ্ধেয় ডাক্তারবাবু,

 আমার আবার একই অবস্থা৷ সেই মাথা ঘোরা, হাত-পায়ে বল না পাওয়া, ঝিমুনি ভাব এসব শুরু হয়েছে৷ সম্ভবত আবারও সেই রক্তাল্পতার কারণেই ব্যাপারটা ঘটছে৷ তার ওপর গাউটের প্রকোপও বেড়েছে৷ সব মিলিয়ে আমার এমন অবস্থা যে আপনার চেম্বারেও যেতে পারলাম না৷ ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন৷ আপনার কাছে আমার অনুরোধ এই যে আপনি যদি আমার বাড়িতে এসে আমাকে একবার দেখে যান ও এখানেই আমাকে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করে যান তবে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকি৷ আপনার ফিজ আর গাড়ি খরচ বাবদ তিন হাজার টাকা পাঠালাম৷ আমার কর্মচারীর কাছে আরও টাকা দেওয়া আছে৷ প্রয়োজনবোধে নিঃসঙ্কোচে তার থেকে চেয়ে নিতে পারেন৷ একটাই শুধু অনুরোধ, দয়া করে একবার এসে আমাকে রক্ত দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন৷ আমার শরীর এত দুর্বল লাগছে যে মনে হচ্ছে আজ রাতেই হার্টফেল করে মারা যাব৷ আপনি আমাকে বাঁচান৷

 ভবদীয়

 মণিময় গুপ্ত৷’

ডাক্তার অচিন্ত্য সেন চিঠিটা পড়ার পর কিছুক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে কী করা যায় মনে মনে ভাবলেন৷ শিমুলবাগান জায়গাটা এই জেলা সদরে যেখানে তাঁর বাসস্থান তার থেকে তিরিশ মাইল মতো দূর হবে৷

গাড়ি আছে ডাক্তার সেনের৷ জায়গাটাতে যেতে ঘণ্টাদেড়েক মতো সময় লাগবে তাঁর৷

বিকালবেলা চেম্বারে বসেন না অচিন্ত্য৷ তবে কোনো রোগী হঠাৎ এসে উপস্থিত হলে নীচে নেমে এসে তাকে দেখে যান৷ কাজেই বিকালে রোগী দেখার চাপ নেই তাঁর৷

তা ছাড়া লোকটার কথা যদি সত্যি হয় তবে রক্তের অভাবে সত্যিই হার্টফেল করাটা অস্বাভাবিক নয়৷

তিনি সামনের লোকটাকে প্রশ্ন করলেন, ‘সত্যিই আপনার বাবু বেশ অসুস্থ?’

লোকটা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু৷ বাবু কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন৷ হাতে-পায়ে জোর পাচ্ছেন না৷ ঘরের ভেতর দেওয়াল ধরে হাঁটছেন৷ আপনি গেলে বড় ভালো হয়৷ আর ওই রক্তের ব্যাপারটা বাবু বার বার করে আমাকে বলে দিয়েছেন৷ সেটা কেনার জন্য আর দেওয়ার জন্য কোনো লোক যদি লাগে তার খরচাও আমাকে দিয়ে দিয়েছেন৷’

ডাক্তার সেন বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি যাব৷ অন্য লোকের দরকার হবে না৷ রক্ত দেওয়ার ব্যাপারটা যদিও আমি এখন নিজে করি না তবে প্রয়োজনে করতে পারি৷ এক সময় আর্মির ডাক্তার ছিলাম তো৷ তখন বহুবার এ কাজ নিজেকেই করতে হত৷ তবে রক্ত তো দোকানে বিক্রি হয় না৷ দেখি আগে সেটা এখানকার ব্লাড ব্যাঙ্কে পাওয়া যায় কিনা৷

প্রেসক্রিপশনেই ভদ্রলোকের ব্লাড গ্রুপটা লেখা আছে৷ এখানকার সদর হাসপাতালে একটা ছোট ব্লাড ব্যাঙ্ক আছে৷ তার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরিচয় আছে ডাক্তার অচিন্ত্য সেনের৷ ব্লাড গ্রুপটা একবার দেখে নিয়ে তিনি এরপর মোবাইলে ফোন করলেন ব্লাড ব্যাঙ্কে৷ জানা গেল সে গ্রুপের রক্ত পাওয়া যাবে৷ নিশ্চিন্ত হলেন অচিন্ত্য৷

তিনি পত্রবাহককে বললেন, ‘ঠিক আছে আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি তৈরি হয়ে আসছি৷’

লোকটা বলল, ‘যে আজ্ঞে স্যার৷’

ওপরে উঠে, খাওয়া সেরে পোশাক পালটে, ব্যাগটা নিয়ে নীচে নামতে আধঘণ্টার মতো সময় লাগল ডাক্তার সেনের৷ সে লোকটা চেম্বারেই অপেক্ষা করছিল৷ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দরজায় তালা দিলেন তিনি!

ডাক্তারবাবু একাই থাকেন বাড়িতে৷ পরিবার থাকে কলকাতায়৷

বাড়ির সামনেই দাঁড় করানো ছিল গাড়িটা৷ আর্মি অকশন থেকে কেনা পুরোনো একটা জিপ৷ গাড়িটা তিনি নিজেই ড্রাইভ করেন৷ গাড়িটা মাঝে মাঝে বিগড়ালেও এটাই ডাক্তার অচিন্ত্য সেনের ব্র্যান্ড মার্ক৷ এ-গাড়ি এ তল্লাটে সবাই চেনে৷ লোকটাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে একবার আকাশের দিকে তাকালেন অচিন্ত্য৷

বৈশাখ মাস৷ বাতাসে একটা গুমোট ভাব৷ মাঝে মাঝে এসময় বিকেলের দিকে ঝড়-বৃষ্টি নামে৷ অচিন্ত্য সেন মনে মনে হিসাব করে দেখলেন আসতে-যেতে ঘণ্টা- চারেক সময়, আর রক্ত দিতে ঘণ্টা-তিনেক৷ রাত দশটার মধ্যে তিনি বাড়ি ফিরে আসতে পারবেন৷

একটা কোঁ কোঁ শব্দ করে স্টার্ট হল জিপের ইঞ্জিন৷ সদর হাসপাতাল ডাক্তার সেনের বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়৷ প্রথমে সেখানে গিয়ে ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে এক পাউচ রক্ত নেওয়া হল৷ হাসপাতালের উলটোদিকের একটা মেডিক্যাল শপ থেকে রক্ত দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল কিটও কেনা হল৷ সঙ্গী লোকটাই সব খরচা মেটাল৷ তারপর তাকে নিয়ে ডাক্তার অচিন্ত্য সেন রওনা হয়ে গেলেন শিমুলবাগানের উদ্দেশে৷

শহর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে হাইওয়ে ধরল তাঁর জিপ৷ দু-পাশে বড় বড় গাছ, সবুজ ধানের খেত৷ এ সব দেখতে দেখতে এগিয়ে চললেন ডাক্তারবাবু৷

চলতে চলতে একবার তিনি শুধু জানতে চাইলেন, ‘পেশেন্টের বাড়িতে কে কে আছেন?’

লোকটা একটু চুপ করে থেকে জবাব দিল, ‘বাবু, আমি, আর তাঁর দুই ছেলে৷ তবে আমিই বাবুর সব কিছু দেখাশোনা করি৷’ এরপর আর সারা রাস্তা কোনো কথা হল না তাঁদের দুজনের মধ্যে৷ ঘণ্টা-দুয়েক লাগল তাঁদের শিমুলবাগান পৌঁছোতে৷

জায়গাটা অনেকটা গঞ্জের মতো৷ সেখান থেকে সঙ্গের লোকটার নির্দেশ মতো পাকা রাস্তা ছেড়ে গ্রামের মেঠো রাস্তা ধরল জিপ৷ পথের দু-পাশে বড় বড় প্রাচীন শিমুল গাছ৷ হয়তো বা এই গাছগুলোর জন্যই এ জায়গায় নাম হয়েছিল শিমুলবাগান৷

গ্রামের ঘরবাড়িগুলোর চাল টিনের অথবা খড়ের৷ শিমুল গাছগুলোর আড়ালে বেশ তফাতে তফাতে তারা দাঁড়িয়ে আছে৷ সে পথ ধরে এগিয়ে গাড়িটা এক সময় এসে থামল বেশ বড় একটা বাড়ির সামনে৷ দেখেই বোঝা যায় বাড়িটা বেশ প্রাচীন৷ একতলার বারান্দার বড় বড় থামগুলোর গা থেকে পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে৷ দোতলার লম্বা বারান্দার রেলিং-ও কোথাও কোথাও অদৃশ্য৷ তবে বাড়িটা দেখে বোঝা যায় যে বাড়ির মালিক সে সময় বেশ পয়সাওয়ালা লোক ছিলেন৷ গ্রামের বর্ধিষ্ণু লোকরা আগে এসব বাড়ি বানাতেন৷

জিপ থেকে নেমে লোকটার পিছনে ঢুকতে ঢুকতে ডাক্তার সেন জানতে চাইলেন, ‘আপনার বাবু আগে কী করতেন?’

লোকটা জবাব দিল, ‘জাহাজি৷ ক্যাপ্টেন ছিলেন৷ বাবুরা তিন পুরুষের জাহাজি ছিলেন৷’

বাড়ির ভেতরটা বেশ ঠান্ডা৷ একটু যেন স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশও আছে৷ ইটের চওড়া দেওয়াল, মাথার ওপরে কড়ি-বরগার ছাদ৷ একটা প্রাচীন গন্ধ লেগে আছে বাড়িটার ভেতর৷

বারান্দা পেরিয়ে লোকটা তাঁকে নিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকল বেশ বড় একটা ঘরে৷ সেখানে একটা ছত্রি লাগানো প্রাচীন আমলের খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছেন ভদ্রলোক৷ ফর্সা রং, বেশ লম্বা, চওড়া চেহারা৷ পরনে ঢোলা পাজামা আর হাতকাটা ফতুয়া৷ নেট লাগানো জানলা দিয়ে শেষ বিকালের আলো এসেছে তাঁর মুখে৷ কেমন যেন ফ্যাকাশে উৎকণ্ঠা জড়ানো সেই মুখ৷

কিন্তু ডাক্তার অচিন্ত্য সেনকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মণিময় গুপ্তর চোখের মণিদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ তিনি খাট থেকে নেমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দু-পা হেঁটে বললেন, ‘আপনি এসেছেন! কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না! রক্ত এনেছেন?’

ডাক্তার সেন বললেন, ‘হ্যাঁ, এনেছি৷ তবে আগে পরীক্ষা করে দেখি যে আপনার রক্তের দরকার নাকি অন্য কোনো সমস্যা? নিন, খাটে শুয়ে পড়ুন৷’

মণিময়বাবু তাঁর কথা শুনে আবার খাটের দিকে এগোতে এগোতে বললেন, ‘ঠিক আগের দু-বারের মতোই দুর্বল লাগছে৷ আমি নিশ্চিত আমার রক্ত লাগবে৷’ এমন ভাবে তিনি কথাগুলো বললেন, যেন তিনি নিজেই ডাক্তার৷

মণিময়বাবু খাটে উঠে শুয়ে পড়লেন৷ ডাক্তার সেন পাশে রাখা একটা চেয়ার টেনে খাটের সামনে বসে প্রথমে তাঁর ব্যাগ থেকে স্টেথিস্কোপ, প্রেশার মাপার যন্ত্র ইত্যাদি বার করে মণিময়বাবুকে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার সেন বুঝে গেলেন যে ভদ্রলোকের কথাটাই ঠিক৷ রক্তশূন্য তাঁর দেহ৷ রক্ত দিতে হবে তাঁকে৷

ডাক্তার সেন ভদ্রলোকের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনাকে রক্ত হওয়ার জন্য যে ওষুধগুলো দিয়েছিলাম সেগুলো নিয়মিত খাচ্ছেন?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, নিয়মিত খাই৷ ওই যে দেখুন না সব টেবিলে সাজানো আছে৷ তা ছাড়া যা যা খাবার খেতে বলেছেন তা-ও খাই৷ সব কথা মেনে চলি৷’

ডাক্তার সেন তাঁর কথা শুনে তাঁর আগে দেওয়া প্রেসক্রিপশনের কাগজটায় চোখ বোলাতে বোলাতে চিন্তিত ভাবে বললেন, ‘তবে এমন হচ্ছে কেন! এটা অন্য কোনো রোগের উপসর্গ৷ আচ্ছা এই প্রেসক্রিপশনে আগের বার যে পরীক্ষাগুলো করবার কথা লিখেছিলাম তা করেছিলেন নিশ্চয়ই৷ বিশেষত হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার ব্যাপারটা? পরীক্ষার কাগজগুলো দেখি?’

মণিময়বাবু একটু চুপ থেকে বললেন, ‘না, ডাক্তারবাবু, ওগুলো করা হয়নি৷ আসলে গেঁটে বাতের জন্য হাঁটতে কষ্ট হয়৷ পরীক্ষা করতে যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি!’

তাঁর জবাব শুনে ডাক্তার সেন মৃদু রুষ্টভাবে বললেন, ‘তাহলে আর আপনার আসল রোগ কীভাবে ধরা পড়বে৷ আমাকেই বা শুধু শুধু ডাকা কেন? গাউটের জন্য আপনি মরবেন না৷ কিন্তু রক্তাল্পতার জন্য হার্টফেল হতে পারে৷ আজ রক্ত দিয়ে যাচ্ছি৷ দু’দিন পর সুস্থ হলে পরীক্ষাগুলো করে আমাকে রিপোর্ট দেখাবেন৷ নইলে আমাকে আর ডাকবেন না৷’

মণিময়বাবু বললেন, ‘ঠিক আছে তাই করব ডাক্তারবাবু৷’

ডাক্তার সেন এরপর জিনিসপত্র—মেডিক্যাল কিট বার করে রক্ত দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলেন৷ খাটের ছত্রি থেকে রক্তের ব্যাগটা ঝুলিয়ে মণিময়বাবুর হাতে চ্যানেল বসাতে বসাতে ডাক্তার সেন তাঁকে বললেন, ‘শুনলাম আপনার দুই ছেলে আছেন? তাঁরা কোথায়?’

প্রশ্নটা শুনে মণিময়বাবু মুহূর্তের জন্য একবার দৃষ্টি বিনিময় করলেন ঘরে দাঁড়ানো তাঁর লোকের সঙ্গে৷ তারপর তিনি তাঁর অন্য হাতটা কড়িবরগার ছাদের দিকে তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘ওরা ওই ওপরে থাকে৷’

ডাক্তার সেন বললেন, ‘যদিও রক্ত দেওয়ার ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, তবুও একজন বাড়ির লোক থাকা ভালো৷ ওপরে তাঁরা থাকলে নীচে আসতে বলুন৷’

তাঁর কথা শুনে মণিময়বাবু একটু বিমর্ষ ভাবে বললেন, ‘তারা দুজন ওপরে আছে ঠিকই৷ কিন্তু এখন নীচে নামবে না৷’

ডাক্তার সেন একটু ইতস্তত করে প্রশ্ন করলেন, ‘কী করেন তাঁরা? আপনাকে তাঁরা দেখেন না?’

মণিময়বাবু বললেন, ‘কিছুই করে না তারা৷ শুধু খায় আর ঘুমায়৷ তাদের খাবারের ব্যবস্থাও আমাকেই করতে হয়৷ তাদের কথা ভাবতে ভাবতেই তো আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি৷ অপত্য স্নেহ বলে একটা কথা আছে জানেন নিশ্চয়ই? তাই তাদের বাড়ি থেকে বারও করে দিতে পারি না৷’

এ কথা শোনার পর এ প্রসঙ্গে মণিময়বাবুকে আর কিছু জিগ্যেস করা সমীচীন মনে করলেন না ডাক্তার সেন৷ তিনি শুধু মনে মনে বললেন, ‘কী যুগ পড়েছে! ছেলেরা বুড়ো বাপের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে৷ অথচ অসুস্থ বাপকে দেখার নাম নেই!’

যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্ত দেওয়ার কাজ শুরু করলেন ডাক্তার সেন৷ খাটে শুয়ে মণিময়বাবু৷ খাটের ছত্রি থেকে চ্যানেলের মাধ্যমে রক্ত প্রবেশ করছে তাঁর দেহে৷ মণিময়বাবুর দৃষ্টি কড়িকাঠের দিকে নিবদ্ধ৷

খাটের পাশে চেয়ারে বসে আছেন ডাক্তার সেন৷ ঘরের চারপাশে একবার তাকালেন তিনি৷ দেওয়ালে একটা ছবি ঝুলছে মণিময়বাবুর৷ জাহাজের ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি৷ তাঁর পরনে ইউনিফর্ম, মাথায় টুপি৷

সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার সেন বললেন, ‘শুনেছি আপনি জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন৷ বহু দেশ ঘুরেছেন নিশ্চয়ই? কবে অবসর নিলেন? শেষবার কোথায় গিয়েছিলেন?’

বাইরে সূর্য ডুবতে বসেছে৷ একটা ঠান্ডা বাতাস ঢুকতে শুরু করেছে ঘরের মধ্যে৷ ঘরের আলো-আঁধারিতে একটা আবছা হাসি যেন মণিময়বাবুর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল৷ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বহুদেশ ঘুরেছি আমি৷ শেষ জীবনে জাহাজের ক্যাপ্টেনও হয়েছিলাম৷ তবে প্যাসেঞ্জার শিপের নয়, কার্গো শিপের৷ অর্থাৎ মালবাহী জাহাজের৷ মুম্বাইয়ের একটা কোম্পানির জাহাজ৷ আমার শেষ ভয়েজ ছিল লাতিন আমেরিকা৷ পেরুর তুমবেজ নামের একটা ছোট বন্দরে৷ তারপর সেখান থেকে সোজা মুম্বাই ফিরে আসি৷ সেটাই আমার শেষ ভয়েজ, শেষ সমুদ্র যাত্রা৷ বছর সাতেক আগে সে জাহাজ থেকেই আমি অবসর নিই৷’

ডাক্তার সেন জানতে চাইলেন, ‘সেখানে কী মাল নিয়ে গেছিলেন?’

ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘গবাদি পশু৷ মালবাহী জাহাজগুলো সাধারণত বিভিন্ন জিনিস পরিবহণ করে৷ আমাদের দেশ থেকে রেশম আর পাট নিয়ে প্রথমে গেছিলাম উত্তর আমেরিকাতে৷ সেখানে মাল খালি করে আমাদের ছোট জাহাজটাতে তোলা হয়েছিল একপাল গরু, ষাঁড়—এসব গবাদি পশু পেরুর এক খামারের জন্য৷ সেখানে আবার সেগুলো খালি করে ফেরার পথে পেরু থেকে মুম্বাই চিড়িয়াখানার জন্য নিয়ে এসেছিলাম কতকগুলো লামা৷ লম্বা গলার ওই তৃণভোজী প্রাণী ওদেশে প্রচুর মেলে৷ এই শেষ বন্দরটা আমার খুব ভালো লেগেছিল৷ কিছু দূরেই পাহাড়-জঙ্গল দেখা যেত বন্দর থেকে৷’

মণিময়বাবুর একথা শুনতে শুনতেই হঠাৎই যেন বাইরে অন্ধকার নেমে এল খুব দ্রুত৷ বাইরে থেকে বাতাসের ঝাপটা জানলা দিয়ে প্রবেশ করতে শুরু করল ঘরে৷ কালবৈশাখী! এ ভয়টাই করছিলেন ডাক্তার অচিন্ত্য সেন৷ তবে একটা সান্ত্বনা, এ ঝড়-বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না৷

মণিময়বাবুর লোকটা তাড়াতাড়ি ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিল৷ তারপর ছুটে গিয়ে জানলা বন্ধ করে দিল৷ জানলা বন্ধ থাকলেও বাইরে ঝড়ের প্রচণ্ড দাপাদাপি শোনা যেতে লাগল৷ তারপর এক সময় যেন শুনতে পেলেন মুষলধারে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ৷

প্রকৃতির তাণ্ডব শুরু হয়েছে বাইরে৷ মাঝে মাঝে বাজ পড়ার শব্দে যেন থরথর করে কেঁপে উঠছে বাড়িটা৷ বিছানায় শোয়া মণিময়বাবুর মধ্যেও যেন একটা উৎকণ্ঠার ভাব ফুটে উঠছে৷ তিনি তাকিয়ে আছেন ছাদের দিকে৷

এক সময় ডাক্তার সেনের মধ্যেও একটু ভয় হল, কাঠের কড়িবরগা দিয়ে ধরে রাখা ছাদটা ধসে পড়বে না তো? খাটের পাশে বসে চুপচাপ ঝড়-বৃষ্টির শব্দ শুনতে লাগলেন তিনি৷

সময় এগিয়ে চলল৷ খাটের ছত্রিতে ঝোলানো রক্তের ব্যাগটা ক্রমশ খালি হয়ে যাচ্ছে৷ তার থেকে দ্রুত রক্ত টেনে নিচ্ছে মণিময়বাবুর শরীর৷

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের ঝড়-বৃষ্টিও কমে এল, রক্তের ব্যাগটাও খালি হয়ে গেল৷ রক্ত দেওয়া যখন শেষ হল তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে৷ হাসি ফুটে উঠেছে মণিময়বাবুর মুখে৷ তিনি ডাক্তার সেনকে বললেন, ‘অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে৷ কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনো ভাষা নেই৷ এর মধ্যেই শরীরটা বেশ চনমনে লাগতে শুরু করেছে৷’

ডাক্তার সেন বললেন, ‘থাক, এখন ওঠার বা বেশি কথা বলার দরকার নেই৷ চুপচাপ শুয়ে বিশ্রাম নিন৷ তবে পরীক্ষাগুলো অবশ্যই করাবেন৷’

মণিময়বাবুর হাত থেকে চ্যানেল খুলে নিয়ে তাঁকে এরপর আরও সময় লক্ষ করলেন ডাক্তার সেন৷ অনেক সময় রক্ত নেবার পর খিঁচুনি শুরু হয়৷ তেমন হলে মণিময়বাবুকে ডেকাড্রন ইঞ্জেকশন দিতে হবে৷

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব কিছু ঘটল না৷ বেশ সুস্থ বোধ করলেন মণিময়বাবু৷ ঠিক আটটা নাগাদ ব্যাগপত্তর নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন তিনি৷ মণিময়বাবুর থেকে বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন ডাক্তার অচিন্ত্য সেন৷ এবার বাড়ি ফিরতে হবে তাঁকে৷

কিছুতেই স্টার্ট হচ্ছে না জিপটা৷ এখনও পিটপিট বৃষ্টি হচ্ছে৷ বাইরে চারপাশে প্রলয়ের চিহ্ন স্পষ্ট৷ কিছুটা তফাতেই একটা বেশ বড় গাছ ভেঙে পড়েছে৷ মণিময়বাবুর লোকটা একটা ছাতা নিয়ে ডাক্তার সেনকে জিপ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এসেছিল৷ সে লোকটা দাঁড়িয়েই ছিল৷ প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টা করবার পর জিপের ইঞ্জিন যখন স্টার্ট নিল না তখন ডাক্তার সেন বাধ্য হয়ে লোকটাকে বললেন, ‘এখানে কোনো মেকানিক আছে? ডেকে আনা যাবে?’

লোকটা একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘বাজারের দিকে একটা গ্যারেজ আছে ঠিকই, সেটা এমনিতেই সন্ধ্যাবেলা বন্ধ হয়ে যায়৷ তার ওপর যা ঝড়-বৃষ্টি হল সে গ্যারেজ নিশ্চয়ই খোলা নেই৷ আর সেই গ্যারেজের মেকানিকও বাইরে থেকে আসে৷ এখন তো মেকানিক পাওয়া যাবে না৷’

তার কথা শুনে মহা মুশকিলে পড়লেন ডাক্তার সেন৷ এখন কী করা যায়? লোকটাকে তিনি বললেন, ‘দেখুন না ফোন-টোন করে যদি অন্য কাউকে এনে গাড়িটা সারাবার ব্যবস্থা করা যায়? যা টাকা লাগবে আমি দেব৷’

‘আমি বলি কী আজকের রাতটা আপনি আমার বাড়িতেই থেকে যান৷ মেকানিক যদি পাওয়াও যায়, তবে তাকে এনে গাড়ি ঠিক করতে আরও ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যাবে৷ সে চেষ্টা আমি করছি ঠিকই৷ কিন্তু তারপর এই রাতে আপনি এতটা পথ যাবেন? যা ঝড় হল! হয়তো কোথাও গাছ ভেঙে রাস্তা আটকে আছে৷’

ডাক্তার সেন অবাক হয়ে দেখলেন ইতিমধ্যে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন মণিময়বাবু৷ তিনিই কথাগুলো বললেন তাঁর উদ্দেশে৷

ডাক্তার সেন তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘এ কী! আপনি বিছানা ছেড়ে উঠেছেন কেন?’

তাঁর প্রশ্নটাকে খুব একটা আমল না দিয়ে মণিময়বাবু বললেন, ‘আসুন, আপনি আগে আমার ঘরে আসুন৷’

অগত্যা ডাক্তার সেন জিপ ছেড়ে আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবেশ করলেন সে ঘরে৷ বালিশের তলা থেকে একটা ডায়েরি আর মোবাইল ফোন বার করলেন তিনি৷ তারপর ডায়েরিতে লেখা নাম্বার দেখে মেকানিককে ডায়াল করতে গিয়ে বললেন, ‘এ মা, আমার ফোনে টাওয়ার নেই৷ ডাক্তারবাবু দয়া করে যদি আপনার ফোনটা একবার দেন৷’

ডাক্তার সেন মোবাইলটা বার করে তাঁর হাতে তুলে দিলেন৷ মণিময়বাবু মেকানিককে ফোনে পেয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু কথা শেষ করে মোবাইলটা তিনি খাটের ওপর নামিয়ে রেখে বললেন, ‘সে আসবে ঠিকই৷ কিন্তু এত রাতে সে আসতে পারবে না৷ কাল ভোরের আলো ফুটলেই সে পাশের গ্রাম থেকে মোটরবাইক নিয়ে চলে আসবে৷’

এ কথা বলার পর তিনি ডাক্তারবাবুর উদ্দেশে বললেন, ‘আজ রাতটা আপনি আমার বাড়িতে দয়া করে থেকে যান৷ বাড়িতে মুরগি আছে৷ তার ঝোল ভাতটা দয়া করে আপনাকে খাওয়াবার সুযোগ দিন৷ একটা ঘরও আছে৷ সেখানে থাকতে অসুবিধা হবে না আপনার৷’ বেশ আন্তরিকভাবেই কথাগুলো বললেন মণিময়বাবু৷

মণিময়বাবুর প্রস্তাব ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই তাঁর৷ ডাক্তার সেন অগত্যা তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, তবে তাই হোক৷ আপনাদের বিব্রত করতে হচ্ছে আমাকে৷’

মণিময়বাবু বললেন, ‘ছিঃ-ছিঃ, ডাক্তারবাবু, এ কী বলছেন! আপনি এখানে রাত্রিবাস করবেন এটা আমার কাছে পরম সৌভাগ্যের৷’

ডাক্তার সেন বললেন, ‘আপনি শুয়ে পড়ুন৷ আমার ঘরটা শুধু দেখিয়ে দিতে বলুন৷’

কিছুক্ষণের মধ্যেই মণিময়বাবুর লোকটা ডাক্তার সেনকে পৌঁছে দিয়ে গেল একটা ঘরে৷ বেশ ছিমছাম ঘর৷ আলো-পাখা-খাট-বিছানা সবই আছে৷ জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে৷ মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদ উঠতে শুরু করেছে৷ চাঁদের আকার দেখে মনে হচ্ছে আজ বোধহয় বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা৷ পোশাক ছাড়ার কোনো ব্যাপার নেই৷ জুতো খুলে বিছানায় শুয়ে পড়লেন ডাক্তার সেন৷ রাত ন’টা নাগাদ খাবার দিয়ে গেল লোকটা৷ গরম ভাত আর ধোঁয়া ওঠা মাংসের ঝোল৷ লোকটাকে ডাক্তার সেন জিগ্যেস করলেন, ‘বাবু কি খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছেন? শরীর ঠিক আছে তো?’

লোকটা জবাব দিল, ‘ঠিক আছেন৷ তবে ঘুমাননি৷ বারোটার আগে তিনি ঘুমান না৷’

এ কথা বলার পর লোকটা বলল, ‘বাবু আপনার গাড়ির চাবিটা আমাকে দিন৷ যদি মেকানিক আরও আগে চলে আসে তখন আর বিরক্ত করব না আপনাকে৷’

ডাক্তার সেন চাবিটা দিয়ে দিলেন তার হাতে৷ লোকটা চলে যাওয়ার পর বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন ডাক্তার সেন৷ রাত বারোটার আগে ঘুম আসে না তাঁর৷ অন্ধকার ঘরে শুয়ে নানা কথা ভাবতে লাগলেন৷

ঘণ্টাখানেক পর তাঁর হঠাৎ খেয়াল হল তাঁকে একটা জরুরি কাজে ফোন করতে হবে এক হাসপাতালের নাইট ডিউটিতে থাকা ডাক্তারবাবুকে৷ মোবাইলের জন্য পকেট হাতড়িয়ে যখন তিনি সেটা পেলেন না তখন তাঁর খেয়াল হল যে তিনি সেটা মণিময়বাবুর হাতে দিয়েছিলেন৷ ফোন করার পর মণিময়বাবু খাটের ওপর রেখেছিলেন৷ সেটা তাঁর ঘরেই রয়ে গেছে৷

একটা অপারেশনের ব্যাপারে ফোন করাটা খুব জরুরি৷ রেডিয়াম লাগানো ঘড়ি দেখলেন ডাক্তার সেন৷ রাত এগারোটা বাজে৷ মণিময়বাবুর লোকটা যা বলে গেল তাতে মণিময়বাবুর জেগে থাকার কথা৷ ফোনটা আনা প্রয়োজন যদি তিনি জেগে থাকেন৷ কাজেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি৷

সারা বাড়ি অন্ধকার৷ কোথাও কোনো আলো জ্বলছে না৷ কোনো শব্দও নেই কোথাও৷ অন্ধকার হাতড়ে দু-তিনটে ঘর পেরিয়ে বারান্দা দিয়ে হেঁটে মণিময়বাবুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি৷ ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ৷ তবে কি ঘুমিয়ে পড়েছেন মণিময়বাবু!

ডাক্তার সেন ফিরে আসতে যাচ্ছিলেন৷ ঠিক সেই সময় ঘরের ভিতর মণিময়বাবুর গলা শুনতে পেলেন তিনি৷ মণিময়বাবু যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন৷ দরজাটার কয়েক পা তফাতে একটা জানলার পাল্লা সামান্য খোলা৷ সেই ফাঁক গলেই তাঁর গলাটা বাইরে আসছে৷ ঘরে লোক আছে মণিময়বাবুর৷ তাঁর ছেলেরা নয়তো? তাই তাঁকে ডাকার আগে পরিস্থিতিটা একটু বুঝে নেবার জন্য একটু ইতস্তত করে দু-পা এগিয়ে ডাক্তার সেন চোখ রাখলেন জানলার ফাঁকে৷

মণিময়বাবুর ঘরে বাতি জ্বলছে৷ তবে উলটো দিকের জাল লাগানো সেই বড় জানলা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঢুকছে ঘরটাতে৷ আলো-আঁধারি পরিবেশ হলেও ডাক্তার সেন মোটামুটি দেখতে পাচ্ছেন ঘরের ভেতরটা৷ খাট ছেড়ে ঘরের ঠিক মাঝখানে চেয়ারটা টেনে বসে আছেন মণিময়বাবু৷ তাঁর ঢোলা পাজামা দু-পায়ের হাঁটুর ওপর পর্যন্ত গোটানো৷ কিন্তু ঘরে অন্য কোনো লোক নেই! টেবিলের হাতলে আঙুল দিয়ে মাঝে মাঝে ঠকঠক শব্দ করছেন তিনি৷ আর কড়িবরগার ছাদের দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘আয় বাবারা আয়৷ খাবার এনেছি, খাবার৷ নীচে নাম, নীচে নাম…৷’

ডাক্তার সেন বেশ অবাক হয়ে গেলেন মণিময়বাবুকে দেখে৷ ঘরে কেউ নেই অথচ ছাদের কড়িবরগার দিকে তাকিয়ে কার সঙ্গে কথা বলছেন তিনি? লোকটার কি মানসিক রোগ আছে?

ডাক্তার সেন শুনলেন মণিময়বাবু এরপর সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোদের জন্যই তো ডাক্তার ডাকলাম৷ সে খাবার এনেছে৷ আয় আয় নীচে আয়…’

কী পাগলের প্রলাপ বকছে লোকটা? তিনি আবার কার জন্য খাবার আনলেন? বিস্মিত ডাক্তার সেন চেয়ে রইলেন ঘরের ভিতর৷ আর মণিময়বাবু ডেকে চললেন তাদের—‘আয়, আয়, খেয়ে যা…’

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সাড়া মিলল মণিময়বাবুর আহ্বানে৷ একটা সুস্পষ্ট খরখর শব্দ শুরু হল ছাদের কড়িবরগার ফাঁক থেকে৷ তারপর সেই শব্দ দেওয়াল বেয়ে নেমে এসে মাটি বেয়ে এগিয়ে আসতে লাগল মণিময়বাবুর দিকে৷ মেঝের দিকে তাকিয়ে তাদের দেখতে পেয়ে তাঁর উন্মুক্ত পা-দুটোকে আরও ছড়িয়ে দিয়ে মণিময়বাবু উৎফুল্ল ভাবে বলে উঠলেন, ‘আয়, আয়, কাছে আয়, খেয়ে নে, খেয়ে নে…’

তারপর যে দৃশ্য ডাক্তার সেন দেখলেন তাতে তিনি বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলেন৷ মেঝে থেকে মণিময়বাবুর পায়ের পাতা বেয়ে তাঁর দু-পায়ে উঠতে শুরু করল কী যেন দুটো প্রাণী৷ আধো-অন্ধকারে তাদের স্পষ্ট বোঝা না গেলেও আকারে তারা ইঞ্চি-চারেক হবে৷ সেই ক্ষুদ্রাকৃতির কালো অবয়ব দুটো ধীরে ধীরে উঠে এসে বসল মণিময়বাবুর দুটো হাঁটুর ওপর৷ সেখানেই তারা স্থির হয়ে গেল৷

মণিময়বাবু বার-দুয়েক ‘উঃ’ বলে শব্দ করলেন৷ তারপর নিজের হাঁটুর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, ‘নে খা, প্রাণ ভরে খা৷ দু-দিন তোদের খেতে দিতে পারিনি৷ কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল, খা, যত পারিস খেয়ে নে…’

ঠিক যেন নিজের সন্তানকে খাওয়াচ্ছেন এমন ভাবে তিনি তাদের উদ্দেশে কথাগুলো বলে যেতে লাগলেন!

প্রায় আধঘণ্টা একইভাবে হাঁটুতে আটকে থাকার পর ধীরে ধীরে পা বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল প্রাণীগুলো৷ খচমচ শব্দে তারা ঘরের অন্ধকারে হারিয়ে যাবার পর টলতে টলতে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়লেন মণিময়বাবু৷

এতক্ষণে হুঁশ ফিরল ডাক্তার সেনেরও৷ তাঁর মাথার ভিতর কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে৷ নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না! এ-ও কি সম্ভব! ব্যাপারটা ভালো করে জানতে হবে তাঁকে৷ ঘরের দিকে পা বাড়ালেন ডাক্তার সেন৷

সারারাত জেগেই কাটালেন তিনি৷ মণিময়বাবুর তাঁর সঙ্গে নানা কথোপকথন আর চোখে দেখা ঘটনাটা সারারাত ধরে বিচার-বিশ্লেষণ করে ব্যাপারটার অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেল তাঁর কাছে৷ তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ফেরার আগে একবার কথা বলবেন মণিময়বাবুর সঙ্গে৷ মোবাইল ফোনটা তো নিতে যেতেই হবে তাঁর ঘরে৷

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে লোকজনের গলার শব্দ শোনা গেল৷ মেকানিক এসেছে গাড়ি সারাতে৷ বেরোবার জন্য তৈরি হয়েছিলেন ডাক্তার সেন৷ ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি গিয়ে মণিময়বাবুর দরজায় টোকা দিলেন৷

দরজা খুললেন মণিময়বাবু৷ যেন মৃদু অবসন্ন দেখাচ্ছে তাঁকে৷ ডাক্তার সেনকে দেখে মৃদু হেসে সুপ্রভাত জানালেন তিনি৷

ডাক্তার সেন তাঁকে বললেন, ‘মেকানিক গাড়ি সারাচ্ছে৷ তার আগে আপনাকে একবার পরীক্ষা করে যাব৷ ফোনটাও নেব৷’

মণিময়বাবু যেন একটু ইতস্তত করেই বললেন, ‘আসুন, ভিতরে আসুন৷’

ঘরে ঢুকলেন ডাক্তার সেন৷ জানলা দিয়ে ভোরের আলো আসছে৷ চেয়ারটা একই জায়গাতে রাখা৷ সেটা দেখিয়ে ডাক্তার সেন মণিময়বাবুকে বললেন, ‘আপনি ওই চেয়ারটাতে বসুন৷’ তাঁর কথা শুনে মণিময়বাবু বিছানায় রাখা মোবাইল ফোনটা তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার পর বেশ খুঁড়িয়ে হেঁটে গিয়ে সেই চেয়ারটাতে বসলেন৷ ডাক্তার সেন এবার তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘আপনার পাজামাটা হাঁটুর ওপর তুলে ফেলুন৷ আপনার হাঁটু-দুটো আমি পরীক্ষা করব৷’

তাঁর কথা শুনে মণিময়বাবু বলে উঠলেন, ‘সে কী! আপনি আমার হাঁটু পরীক্ষা করবেন কেন? আমার গেঁটে বাত আছে ঠিকই, তবে তার ডাক্তার অন্য৷ আমার রক্তাল্পতার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী?’

ডাক্তার সেন একটু কঠিন স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ, সম্পর্ক আছে৷ যা বলছি তাই করুন৷ খুলুন বলছি৷’

অবাক চোখে তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মণিময়বাবু ধীরে ধীরে পাজামাটা হাঁটুর ওপর উঠিয়ে ফেললেন৷ তাঁর হাঁটু দুটোতে জেগে আছে অজস্র বিন্দু বিন্দু ক্ষতচিহ্নর দাগ! তার কোনোটা পুরোনো, আবার কোনোটা একদম টাটকা৷

মণিময়বাবুকে ডাক্তার সেন প্রশ্ন করলেন, ‘এগুলো কীসের দাগ?’

তিনি আমতা আমতা করে জবাব দিলেন, ‘ওই গেঁটে বাতের জন্য আকুপাংচার চিকিৎসা করাই তো৷ এটা সেই নিডিল, অর্থাৎ সুচের দাগ৷’

ডাক্তার সেন ধমকে উঠলেন, ‘মিথ্যে বলবেন না৷ আমি ডাক্তার৷ নিডিলের দাগ আমি চিনি৷’

মণিময়বাবু তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কী বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না৷’

ডাক্তার সেন শান্ত কঠিন স্বরে বললেন, ‘আপনি সবই বুঝতে পারছেন৷ আর আমিও পারছি৷ কারণ আমি কাল জানলা দিয়ে আপনার ছেলেদের দেখেছি, যখন আপনি তাদের খাওয়াচ্ছিলেন৷ ওদের আপনি সংগ্রহ করলেন কী ভাবে?’

ডাক্তার সেনের কথা শুনে ফ্যাকাশে হয়ে গেল মণিময় গুপ্তর মুখ৷ তিনি বুঝতে পারলেন তিনি ধরা পড়ে গেছেন৷ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে মণিময়বাবু ডাক্তার সেনের দিকে তাকিয়ে থাকার পর অবশেষে বললেন, ‘আপনি যখন দেখেই ফেলেছেন তবে শুনুন—’

শান্তস্বরে বলতে শুরু করলেন মণিময়বাবু, ‘আপনাকে আমি বলেছিলাম যে একদল পশু নিয়ে আমি পাড়ি দিয়েছিলাম পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা লাতিন আমেরিকায় পেরুর তুমবোজ অঞ্চলে৷ ওই অঞ্চলের জঙ্গলেই ওদের বসবাস৷ প্রায় একমাস মাল খালাসের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হল ওই বন্দরে৷ সেই গবাদি পশুগুলো ছিল জাহাজের খোলের মধ্যে৷ মাল খালাস করে লামাগুলোকে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম আমরা৷

মাঝ সমুদ্রে এসে খোলটা পরিষ্কার করার জন্য একদিন দুজন কুলিকে নিয়ে খোলে নামি আমি৷ সেদিনই খোলের মাথায় একটা খোপের মধ্যে ওদের আবিষ্কার করল একজন কুলি৷ সে আগে বহুবার এ অঞ্চলে এসেছে৷ কাজেই সে চিনে ফেলল তাদের৷ ওরা তখন নেহাতই শিশু৷ খোলের গায়ে আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য যে ‘পোর্ট হোল’ বা গোলাকার জানলা থাকে তা দিয়েই সম্ভবত গরু-ষাঁড়গুলোর রক্ত খাবার জন্য ভিতরে ঢুকেছিল ওদের বাবা-মা৷ তারপর অফুরন্ত খাদ্যের সন্ধান পেয়ে, খোলের আধো-অন্ধকার ভালো লেগে যাওয়ায়, সেখানের সিলিং-এর অন্ধকার খোপে বাচ্চা প্রসব করে৷ কিন্তু তারপর জাহাজ চলতে শুরু করেছে বুঝতে পেরেই সম্ভবত বাচ্চাগুলোকে সেখানেই রেখে বনে ফিরে যায় তারা৷

যাই হোক, খুদে খুদে বাচ্চাগুলোকে দেখে খুব মায়া লাগল আমার৷ ছোটবেলা থেকেই পশুপাখি পুষতাম আমি৷ তাদের ওপর আমার দারুণ মায়া৷ তখন ওরা সংখ্যায় তিনজন ছিল৷ ওদের আমি বসিয়ে দিলাম লামাগুলোর গায়ে৷ কিন্তু ওঁদের দাঁত তখনও লামাগুলোর লোমে ঢাকা মোটা চামড়া ভেদ করার মতো শক্ত হয়নি৷ কাজেই রক্তপান করতে না পেরে দু-দিনের মধ্যেই মারা গেল একজন৷ অন্য দুজন ধুঁকতে লাগল অনাহারে৷ এত সুন্দর প্রাণী দুটো এভাবে মারা যাবে! যদি তাদের দুজনকে বাঁচানো যায় তবে দেশে ফিরে কোনো চিড়িয়াখানায় দেওয়া যাবে৷

কিন্তু কী ভাবে ওদের বাঁচানো যায়? হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল আমার মাথায়৷ ওদের আমি নিয়ে এলাম আমার কেবিনে৷ দরজা বন্ধ করে আমি ওদের বসিয়ে দিলাম আমার উন্মুক্ত উরুর ওপর৷ লামার মোটা রোমশ চামড়া ভেদ করতে না পারলেও মানুষের নরম চামড়া ভেদ করে রক্তপান করতে শুরু করল ওরা৷ কতটুকুই বা তারা তখন৷ ইঞ্চি-দুয়েক হয়তো হবে৷ ভাবলাম এ-ক’দিনে কতটুকুই বা রক্ত খাবে তারা? আমার তখন সুঠাম চেহারা৷ ভাবলাম দুষ্প্রাপ্য প্রাণী দুটোকে বাঁচিয়ে এদেশের চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেব আমি৷

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি তা পারলাম না৷ মুম্বাই বন্দর যখন এল ততদিনে আমি ওদের ভালোবেসে ফেলেছি৷ কাজেই ওদের এ-বাড়িতে নিয়ে চলে এলাম আমি৷ ভেবেছিলাম যে একটু বড় হলে দাঁত শক্ত হলে ওরা পশুর রক্ত খাবে৷ কিন্তু মানুষের রক্তর স্বাদ পাওয়ার জন্যই হয়তো পশুরক্ত ওদের মুখে রোচে না৷ আমি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে দেখেছি৷ তারপর থেকে এভাবেই রয়েছে ওরা৷ আগে আমার তেমন কোনো অসুবিধা হত না৷ কিন্তু এখন বয়স বাড়ছে৷ রক্তের জোর কমে আসছে…৷’

মণিময়বাবু তাঁর কথা শেষ করার পর স্তম্ভিত ডাক্তার সেন বললেন, ‘এভাবে নিজের মৃত্যু ডেকে আনছেন কেন?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘আমার আর কিছু করার নেই৷ অপত্য স্নেহ৷ ওদের ছেলেদের মতোই দেখি আমি! ওরা ছাড়া আমার আর কেউ নেই৷ ওরা আমার সন্তান৷’

তাঁর কথা শুনে একটু চুপ করে থেকে ডাক্তার সেন বললেন, ‘ওদের একটু কাছ থেকে দেখা যাবে?’

মণিময়বাবু বললেন, ‘চেষ্টা করে দেখি৷ ঘর অন্ধকার না হলে ওরা নীচে নামে না৷’

ঘরের দরজা-জানলা সব বন্ধ করে দেওয়া হল৷ আধো-অন্ধকার নেমে এল ঘরে৷ ঘুলঘুলি দিয়ে আসা সামান্য আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই ঘরে৷ মণিময়বাবু বললেন, ‘আপনি দরজার সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়ান৷ নইলে ওরা ভয় পেতে পারে৷’

ডাক্তার সেন তাঁর নির্দেশ পালন করলেন৷ মণিময়বাবু তাঁর সেই চেয়ারে বসে পাজামা হাঁটুর ওপর উঠিয়ে চেয়ারে টোকা দিতে দিতে কড়িবরগার দিকে তাকিয়ে ডাকতে লাগলেন, ‘আয়, আয়, নীচে নাম, নীচে নাম৷’

কিছুক্ষণের মধ্যেই সাড়া মিলল তাঁর ডাকে৷ কড়িবরগার আড়াল থেকে খচমচ শব্দ শুরু হল৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই মণিময়বাবুর ছেলেরা নেমে এল৷ তারপর আদুরে বাচ্চার মতো মণিময়বাবুর ডাকে মেঝে দিয়ে ছুটে এসে তাঁর পায়ের পাতা বেয়ে উঠে পড়ল মণিময়বাবুর হাঁটুর ওপর৷ চুনির মতো জ্বলছে তাদের চোখ৷ তাদের লাল জিভ আর ছোট্ট বাঁকানো দাঁতগুলোও মুহূর্তের জন্য যেন দেখতে পেলেন ডাক্তার সেন৷ লাতিন আমেরিকার ভ্যাম্পায়ার ব্যাট! রক্তচোষা বাদুড়!

তাদের দাঁত ফোটানোর যন্ত্রণাতেই সম্ভবত একবার যন্ত্রণাসূচক শব্দ করলেন মণিময়বাবু৷ তারপর ডাক্তার সেনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘অপত্য স্নেহ৷ এরা আমার সন্তান৷ এদের কি আমি অভুক্ত রাখতে পারি?’

মণিময়বাবুর দেহে দাঁত বসিয়ে রক্তপান করতে শুরু করেছে প্রাণী দুটো৷ পরম মমতায় মণিময়বাবু তাকিয়ে আছেন তাদের দিকে৷ কিন্তু এ দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলেন না ডাক্তার সেন৷ হঠাৎ বাড়ির বাইরে থেকে জিপের ইঞ্জিনের শব্দ তাঁর কানে এল৷

গাড়ি স্টার্ট হয়ে গেছে৷ শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা খুলে ফেললেন তিনি৷ একরাশ আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে৷ খোলা জানলা দিয়ে মণিময়বাবুর ঘর ছেড়ে ডাক্তার সেন ছুটলেন বাইরে যাওয়ার জন্য৷ আর ওই আলোতে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল সেই প্রাণী দুটোও৷ মণিময়বাবুর হাঁটু ছেড়ে ঘরের মধ্যে পাক খেয়ে খোলা দরজা দিয়ে তারাও বাইরে বেরিয়ে গেল৷

গাড়িতে উঠে বসার সময় ডাক্তার সেন শুনতে পেলেন মণিময়বাবুর কঠোর আর্তনাদ—‘ডাক্তারবাবু আপনি আমার এ কী সর্বনাশ করলেন! ওরে তোরা ফিরে আয়, ফিরে আয়…’

পুনশ্চ: মণিময়বাবু আর আসেনি ডাক্তার অচিন্ত্য সেনের কাছে৷ মাসখানেক পর ডাক্তার সেন একটা কাজে গেছেন সদর হাসপাতালে৷ হাসপাতালে ঢোকার মুখে হঠাৎ তিনি একটা লোককে দেখে চিনতে পারলেন৷ মণিময়বাবুর সেই লোক! লোকটাও চিনতে পারল তাঁকে৷ ডাক্তার সেন তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘বাবু কেমন আছেন? হাসপাতালে ভর্তি নাকি?’

লোকটা বিষণ্ণ ভাবে জবাব দিল, ‘তিনি দু-দিন ভর্তি ছিলেন এখানে৷ গতকাল রাতে মারা গেছেন৷ তাঁর দেহ নিতে এসেছি৷’

বিস্মিত ডাক্তার সেন বললেন, ‘কী ভাবে মারা গেলেন? রক্তাল্পতায়? তাঁর ছেলেরা আবার ফিরে এসেছিল নাকি?’

লোকটা বলল, ‘না, তারা আর ফিরে আসেনি৷ তাদের একজনের কাকে ঠোকরানো দেহ পাওয়া গেছিল একটা গাছের নীচে৷ অন্যজনের হদিশ পাইনি৷ ওরা চলে যাওয়ার পর বাবু খুব ভেঙে পড়েছিলেন৷ ওদের দাঁত থেকে বাবুর শরীরে বিষ ঢুকেছিল৷ বাবু মারা গেলেন জলাতঙ্কে৷’—কথাগুলো বলে লোকটা চলে গেল অন্যদিকে৷

তার কথাগুলো শুনে ডাক্তার অচিন্ত্য সেনের চোখে মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠল সেই দৃশ্য৷ মণিময়বাবুর সেই আধো-অন্ধকার ঘরে মণিময়বাবুর হাঁটুর ওপর দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষছে প্রাণী দুটো৷ আর মণিময়বাবু বলছেন—‘অপত্য স্নেহ৷ এরা আমার সন্তান৷ এদের কি আমি অভুক্ত রাখতে পারি?’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *