অন্য ভারতবর্ষ
আমার বন্ধু মহেশ চাপেকারের কথা আগেও লিখেছি। এবারও লিখছি।
প্রায় ষাট বছর আগে কলকাতা থেকে দণ্ডকারণ্যে গিয়েছিলাম। মহেশ এসেছিল মুম্বই থেকে।
তখন দণ্ডকারণ্যের নানা এলাকায় পাহাড় এবং সমতলের গভীর জঙ্গল কেটে জমি বের করে সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে আসা সর্বস্ব—হারানো মানুষদের জন্য ঘরবাড়ি বানিয়ে কলোনি বসানো হচ্ছিল। দেশ ছেড়ে চলে আসার পর দণ্ডকারণ্যই হবে তাদের নতুন আশ্রয়, নতুন দেশ।
জমি—টমি দিয়ে পুনর্বাসনের জন্য ভারতবর্ষের যেখানে যেখানে উদ্বাস্তুদের পাঠানো হয়েছে, আমি প্রায় সব জায়গায় গেছি। কেন গিয়েছিলাম এই গল্পের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই।
মহেশ ছিল মুম্বইয়ের একটা নামকরা ইংলিশ ডেইলির রোভিং রিপোর্টার। তার কাজ ছিল দেশের নানা জায়গায় ঘুরে তার পত্রিকার জন্য জরুরি সব খবর জোগাড় করা। তখন উদ্বাস্তুদের নিয়ে সারা দেশ তোলপাড়। দণ্ডকারণ্যে ছিন্নমূল মানুষদের পুনর্বাসনের খবরটা পেয়ে সে সেখানে চলে এসেছে।
মহেশ এক আশ্চর্য মানুষ। তার মধ্যে এমন—একটা আপন—করা ব্যাপার আছে যে ওর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার দু—এক ঘণ্টার ভেতরে আমরা বন্ধু হয়ে যাই।
মধ্যপ্রদেশ (তখনও ভাগ হয়নি), ওড়িষা এবং অন্ধ্রের অনেকটা করে অংশ নিয়ে দণ্ডকারণ্যের বিস্তার। পুনর্বাসনের জন্য অন্ধ্রকে বাদ দিয়ে ওড়িশা আর মধ্যপ্রদেশের যে অংশ ঠিক করা হয়েছে তা প্রায় পশ্চিমবঙ্গের দ্বিগুণ। সরকারি এই পরিকল্পনাকে বলা হতো ডি এন কে প্রোজেক্ট, বা দণ্ডকারণ্য প্রোজেক্ট।
কলোনিগুলো বসানো হচ্ছিল পঁচিশ—তিরিশ মাইল দূরে দূরে। পুনর্বাসন অফিস থেকে মহেশ আর আমাকে একটা গাড়ি আর ড্রাইভার দেওয়া হয়েছিল। সেই গাড়িতে রোজ মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে আমরা দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তু কলোনিগুলোতে চলে যেতাম।
একদিন কেশকাল পাহাড়ের কাছাকাছি চার—পাঁচটা কলোনিতে ঘোরাঘুরি করে অনেকটা সময় কেটে গেল। সন্ধে পার হয়ে গেছে।
আমাদের যেতে হবে মানা ট্রানজিস্ট সেন্টারে। সেখান থেকে সাত—আট মাইল দূরে রায়পুর শহর।
সেই সময় প্রায় রোজই কলকাতা থেকে মুম্বাই মেলের তিন—চারটে কামরা বোঝাই করে উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হচ্ছিল। রায়পুর স্টেশনে তাদের নামিয়ে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হত মানা ট্রানজিস্ট সেন্টারে। সেখানে একদিন রেখে পাঠিয়ে দেওয়া হত দণ্ডকারণ্যের নানা এলাকায়, উদ্বাস্তুদের জন্য নতুন নতুন উপনিবেশগুলিতে।
একটা রাত সেখানে কাটিয়ে পরদিন সকালে আমরা কোরাপুটের পথ ধরব। ওড়িষার ওই অঞ্চলে যে কলোনিগুলো বসানো হচ্ছিল, আমার দেখা হয়নি। সেখানে না গেলে কি চলে?
দণ্ডকারণ্য এক সৃষ্টিছাড়া জায়গা। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ঝপ করে এখানে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে।
একটা আঁকাবাঁকা, পাক খেতে খেতে যাওয়া পাহাড়ি রাস্তার ওপর দিয়ে চলেছি; সেটার দু—ধারে মাঝে মাঝেই খাদ। তার পর উঁচু উঁচু পাহাড়, ছোট ছোট টিলা আর আছে বিশাল বিশাল গাছ। এই ভর সন্ধেবেলায় সব কেমন যেন ছায়ামূর্তির মতো দেখাচ্ছে। যেখানে খাদ নেই, আমাদের রাস্তাটার গা থেকে সরু সরু অনেক রাস্তা বেরিয়ে গভীর জঙ্গল আর পাহাড়—টাহাড় ভেদ করে কোথায় কোন দিকে চলে গেছে, কে জানে।
আমরা চলেছি তো চলেইছি। পাহাড়, খাদ, জঙ্গল শেষই হচ্ছে না। মনে হল একটা গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছি।
কেশকাল পাহাড়ের কাছাকাছি যেখান থেকে আমরা আসছি ওই এলাকাটা থেকে আধ ঘণ্টা ড্রাইভ করলে ন্যাশনাল হাইওয়ে। সেই রাস্তাটা প্রশস্ত, মসৃণ। দু—পাশে এত পাহাড় জঙ্গল নেই। প্রায় দু—ঘণ্টা হয়ে গেল, কোথায় জাতীয় সড়ক? তাহার দেখা নাই রে, তাহার দেখা নাই।
খেয়াল ছিল না, এখন পূর্ণিমাপক্ষ। চাঁদ উঠে এল আকাশে। জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতে লাগল দণ্ডকারণ্যের পাহাড়, জঙ্গল। দু—চারটে পাহাড়ি ঝরনাও চোখে পড়ছে।
কিছুক্ষণ আগের সেই ঘন অন্ধকার আর নেই। চাঁদের আলোয় চারিদিকের সমস্ত কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আমি কয়েক মাস হল এখানে এসেছি। মহেশ এসেছে দিন কুড়ি আগে। ডি এন কে প্রোজেক্ট অর্থাৎ দণ্ডকারণ্য প্রোজেক্টের সব কলোনিতে না হলেও অনেকগুলোতে গেছি। মানা ট্রানজিট সেন্টার থেকে কতবার যে বহুদূরের কোরাপুট অবধি চষে বেড়িয়েছি, লেখাজোখা নেই। দণ্ডকারণ্যের অনেকটা এলাকাই আমার চেনা হয়ে গেছে। কিন্তু এখন যেখানে চলে এসেছি সেটা পুরোপুরি অচেনা।
আমাদের ড্রাইভারটির বয়স বেশি নয়। পঁচিশ কি ছাব্বিশ। রায়পুরের ছেলে। কেশকাল থেকে মানায় আমাকে বহুবার নিয়ে গেছে। সে কি রাস্তা ভুল করে ফেলেছে?
জিজ্ঞেস করলাম, ‘রঘুয়া, ঠিক পথে আমরা যাচ্ছি তো?’
গাড়ির স্পিড কমিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রঘুয়া। মুখচোখ দেখে মনে হয় বেশ ঘাবড়ে গেছে। বলল, ‘সাহাব, থোড়া কুছ গড়বড় হয়ে গেছে—’
আমি অবাক!—’মানে?’
‘দণ্ডকারণ্য তো অনেক বড় ইলাকা। আমি আগে কখনও এখানে আসিনি। সামকো আন্ধেরায়, তখনও চান্দা ওঠেনি, হাইওয়ের দিকে না গিয়ে অন্য দিকে চলে এসেছি মনে হচ্ছে। বহোৎ ভুল হো গিয়া—’
‘হাইওয়েতে যেতে পারবে তো?’
আকাশপাতাল হাতড়ে আমার প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজে এনে ঢোঁক গিলতে গিলতে রঘুয়া বলল, ‘কোসিস তো জরুর করেগা, লেকিন—’
‘লেকিন কী?’
‘বহোৎ মুশকিল।’
বলে কি ছোকরা! দণ্ডকারণ্যে শুধু নিরীহ প্রাণীরাই থাকে না, বিশাল এই বনভূমি মারাত্মক সব জন্তু—জানোয়ারদেরও আস্তানা। হাইওয়ের খোঁজ না পেলে আমরা কি জ্যান্ত ফিরে যেতে পারব?
মহেশ বলল, ‘জানোয়ারেরা আমাদের নিয়ে ভোজের আসর বসিয়ে দেবে যে—’
রঘুয়া বলল, ‘আমাকেও বাদ দেবে না সাহাব—’
‘তা হলে?’
‘বলেছি তো হাইওয়েতে যেতে কোসিস করব? অব রামজি ভরোসা—’ মুখ ফিরিয়ে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল রঘুয়া।
পাহাড় জঙ্গল ভেদ করে গাড়ি চলতে লাগল। কখনও এ রাস্তায়, কখনও ও রাস্তায়।
মহেশ শুকনো গলায় বলল, ‘কার একটা কবিতায় যেন পড়েছিলাম লাস্ট রাইড টুগেদার। তোর আর আমার এটাই বোধহয় লাস্ট রাইড রে। শেষ যাত্রা।’
আমি চুপ।
আরও ঘণ্টাতিনেক পর একটা ছোট পাহাড়ের কাছে চলে এল আমাদের গাড়িটা। পাহাড়ের তলার দিক বেড় দিয়ে একটা রাস্তা নীচের দিকে চলে গেছে। আমরা যেখানে রয়েছি সেখান থেকে পাহাড়ের আড়াল থাকায় নীচে কী আছে দেখা যাচ্ছে না।
রঘুয়া পাহাড়ের তলায় পাক খাওয়া রাস্তায় গাড়িটাকে নিয়ে এল। কিছুটা যেতেই পাহাড়ের আড়াল আর নেই। চোখে পড়ল বাঁ—পাশে অনেকটা নীচে অফুরান চাঁদের আলোয় একটা ছোট পাহাড়ি নদী কুল কুল আওয়াজ করে বয়ে চলেছে। তার পাশে সবুজ মখমলের মতো ঘাসের জমি। সেখানে একটি যুবক—বয়স চৌত্রিশ—পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না, এবং একটি যুবতি, সাতাশ—আটাশের মতো বয়স, নিশ্চয়ই স্বামী—স্ত্রী বসে আছে। একটি সাত—আট বছররের ছেলে আর চার—পাঁচ বছরের মেয়ে ঘাসের জমি তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। বোঝাই যায় ওই দম্পতিরই ছেলেমেয়ে।
পুরুষ আর তরুণীটি যেখানে বসে আছে তার ডান পাশে বড় বড় তিন—চারটে চটের ব্যাগ। একটা ধনুক আর সাত—আটটা তির এবং একটা বন্দুকও পড়ে আছে। যুবক যুবতির বাঁ পাশে একটু দূরে ইটের উনুনে বড় একটা হাঁড়িতে খুব সম্ভব ভাত ফুটছে। এই মাঝরাতে জনশূন্য নিঝুম নদীর ধারে ওরা কারা? দণ্ডকারণ্যে তো শুধু নিরীহ প্রাণী নেই, এখানকার গভীর জঙ্গলে অজস্র হিংস্র জন্তু—জানোয়ার। কিন্তু ওদের এতটুকু ভয়ডর আছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর থিকথিকে ভিড় আর হট্টগোল থেকে ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়েকে সঙ্গে করে ওরা যেন আনন্দভ্রমণে বেরিয়ে এখানে এসে বনভোজনটাও সেরে নেবার তোড়জোড় করছে।
গাড়ির চালক রঘুয়া ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ‘সাহাব, ওই যে নদী কিনারে আদমি আর আওরতটা বসে আছে, ওদের কাছে গেলে মনে হয় মানায় কীভাবে যাওয়া যায়, ওরা বলে দিতে পারে।’
বাকি রাতটা পাহাড় আর জঙ্গলের গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়ানোর মানে হয় না। দেখাই যাক অচেনা এই যুবক—যুবতির কাছে মানায় যাবার পথের হদিস মেলে কিনা। বললাম, ‘চল, ওদের কাছে—’
এদিকটায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তা নেমে গেছে। রঘুয়া মুখ ফিরিয়ে স্পিড আরও কমিয়ে গাড়িটাকে নীচে নামিয়ে পাহাড়ি পথটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে বাঁ দিকে গাড়িটা ঘুরিয়ে নদীর ধারে ঘাসের জমিটার পাশে এসে থামাল।
যুবক—যুবতি নদীর দিকে মুখ করে বসে গল্প করছিল। গাড়ির আওয়াজে চমকে উঠে ঘুরে আমাদের দেখতে পেয়ে পুরুষটি তার পাশের বন্দুকটা তুলে নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে মারণাস্ত্রটা আমাদের দিকে তাক করে উঠে দাঁড়াল। তার সঙ্গিনীও ঠিক তারই মতো ধনুকে তির জুড়ে উঠে পড়েছে।
আমরা তিনজন গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলাম। হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেলাম। মহেশ বলল, ‘বন্দুক নামাও, ধনুক নামাও। আমাদের বুরা মতলব নেই। রাস্তা ভুল করে এদিকে চলে এসেছি।’
ওরা দু’জন অনেকক্ষণ আমাদের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর বন্দুক আর তিরধনুক নামিয়ে বলল, ‘আইয়ে—’
ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পুরুষটি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কারা?’
নিজেদের পরিচয় এবং কোন উদ্দেশ্যে আমাদের দণ্ডকারণ্যে আসা, সব জানিয়ে দিয়ে বললাম, ‘তোমরা কারা?’
ওদের নামটামও জানা গেল। পুরুষটি ধরমবীর, আর তার স্ত্রী লছমি। সেই ছোট ছেলেমেয়ে দু’টো খেলাটেলা ছেড়ে তাদের মা—বাবার গায়ের সঙ্গে লেপটে আমাদের দিকে অনন্ত কৌতূহলে তাকিয়ে ছিল। তাদের নামও জেনে গেলাম। গণুয়া আর সীতা।
ধরমবীর জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কোত্থেকে আসছিলেন আর কোথায় যাচ্ছিলেন?’
জানিয়ে দিলাম কেশকাল পাহাড়ের দিক থেকে মানা যাচ্ছিলাম। সন্ধে নামার পর পথ হারিয়ে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরপাক খেতে খেতে এখানে চলে এসেছি। বললাম, ‘কীভাবে, কোন দিকের রাস্তা ধরলে খুব তাড়াতাড়ি মানা চলে যেতে পারব, যদি বলে দাও—’
ধরমবীর বলল, ‘সাহাব, আপনারা বিলকুল অন্য দিকে চলে এসেছেন। চান্দাকা রোশনি যদিও আছে তবু জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আপনাদের সঙ্গে হাতিয়ার আছে?’
‘না। কেন?’
আমরা তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
‘আপনারা এখানে নয়া—নয়া এসেছেন। জঙ্গলে বহুৎ খতরনাক জানবর আছে। এক কাজ করুন সাহাব—’
‘কী করতে বলছ?’
ধরমবীর বলল, ‘এখনও আধা রাত বাকি। আপনারা এখানেই থেকে যান। কাল সুবে সূরয উঠুক। তখন কোন পথে গেলে জলদি জলদি মানা পৌঁছে যাবেন, বুঝিয়ে দেব। দিনের আলোয় আসানিসে চলে যেতে পারবেন।’
খুব অবাক হলাম।—’এখানে কোথায় থাকব?’
ঘাসের জমিটা দেখিয়ে ধরমবীর বলল, ‘ওখানে। আপনাদের গাড়িতে তিন আদমি শুতে পারবেন না। ঘাসের জমিনে আমার ঘরবালী চাদর পেতে বিস্তারা করে দেবে। থোড়া কুছ তখলিফ হবে, তবু ভালো করে শুতে পারবেন। আইয়ে—’
এভাবে রাত কাটানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। ধরমবীর আর লছমি ড্রাইভার রঘুয়া, মহেশ আর আমাকে ঘাসের জমিতে নিয়ে বসিয়ে তারাও কাছাকাছি বসে পড়ল।
আমাদের সম্বন্ধে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রায় সমস্ত কিছুই জেনে নিয়েছে। কিন্তু ওদের নাম ছাড়া আর কিছুই জানা হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের বাড়ি কোথায়?’
ধরমবীর বলল, ‘রায়পুর টৌরন (টাউন)।’
‘চারদিকে জঙ্গল, পাহাড়, নদী—এত রাতে বাচ্চাদের নিয়ে কেন এখানে এসেছ?’
‘পেটের ধান্দায়—’
‘মানে?’
ধরমবীর এবার যা বলল এমন আশ্চর্য এক কাহিনি, কেউ কখনও শুনেছে কি না আমার জানা নেই। প্রতি সপ্তাহে স্ত্রী—ছেলেমেয়ে নিয়ে সে এখানে আসে। কেননা, এখানকার জঙ্গলে, পাহাড়ে এবং নদীর ধারে এমন সব গাছ আছে যেগুলোর ছাল, পাতা, শিকড়—বাকড়, ফল ছাড়াও এমন লতা, গুল্ম এবং মাটির তলায় কন্দ রয়েছে যা দিয়ে কঠিন কঠিন রোগের কবিরাজি ওষুধ তৈরি হয়। ফি সপ্তাহে একবার এসে সেসব জোগাড় করে রায়পুরে ফিরে সেখানকার কবিরাজখানায় বিক্রি করে। সেই টাকাতেই তারা বেঁচে আছে।
জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি বলেছ এই জঙ্গলে অনেক ভয়ঙ্কর জন্তু আছে। বাচ্চাদের নিয়ে আসতে ভয় করে না?’
‘কীসের ডর সাহাব। এখানে না এলে নিজেরা বাঁচব কী করে, বাচ্চা দু’টোকেও বাঁচাব কী করে? আর খতরনাক জানোয়ার?’ পাশ থেকে সেই বন্দুক আর তির ধনুক তুলে ধরে ধরমবীর।
বললাম, ‘এই হাতিয়ার দিয়ে বাঘের মতো জানোয়ারকে—’
আমাকে শেষ করতে দিল না ধরমবীর।—’শের, উনকো দাদা নানা যো কোঈ আসুক, সিনা ফোঁড় দুঙ্গা—’হঠাৎ কী খেয়াল হতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল।—’সাহাব, আপনারা তো সেই কখন থেকে জঙ্গলে জঙ্গলে চক্কর দিয়ে বেড়িয়েছেন। আপনাদের খানা—পিনা?’
পাহাড়ে জঙ্গলে পথের ধারে কোথাও ছোটখাটো হোটেল, এমনকি চায়ের দোকানও চোখে পড়েনি। খাবার কোত্থেকে জুটবে! ঠিক করা ছিল মানা ট্রানজিট সেন্টারে গিয়ে রাতের আহারটা সেরে নেব। মানা বহুদুরের কোনো গ্রহের মতো, আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সুতরাং আজকের রাতটা অনশনেই কাটুক। বললাম, ‘ও নিয়ে ভেবো না—’
‘তাই কখনও হয়! আপনারা আমাদের মেহমান—’স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বসে আছিস যে, ওঠ, ওঠ। তুরন্ত—’
স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সেই ইটের উনুনটা, যার ওপর সিলভারের হাঁড়িতে ভাত ফুটছিল, সেখানে চলে গেল ধরমবীর। ভাত হয়ে গিয়েছিল, হাঁড়িটা নামিয়ে ফেন গেলে, লোহার কড়াইতে ডাল চাপিয়ে দিল লছমি। একটু দূরে ক্ষিপ্র হাতে নতুন একটা ইটের উনুন বানিয়ে সেটার ওপরে আবার চাল ধুয়ে বসিয়ে দিল ধরমবীর।
এক ঘণ্টার মধ্যে খাবার প্রস্তুত। ঝকঝকে স্টেনলেস স্টিলের থালা বাটি ধুয়ে ভাত, আলুভাতে আর ডালের বাটি সাজিয়ে দিয়ে ধরমবীর আর লছমি হাতজোড় করে বলল, ‘সাহাব, আমরা গরিব আদমি। মেহেরবানি করকে—’বাকিটা শেষ করতে পারল না।
বললাম, ‘তোমার বাচ্চাদের খেতে বসিয়ে দাও—’
‘হাঁ সাহাব—’
নদীর স্বচ্ছ জলে হাত ধুয়ে এসে খেতে বসলাম। মোটা চালের ভাত, মসুর ডাল আর আলুভাতে। সামান্য এই ক’টি খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে কী মেশানো ছিল আজও জানি না। শুধু মনে হয় দণ্ডকারণ্যে যাবার আগে এবং ফিরে আসার পর মস্ত মস্ত পাঁচতারা হোটেল আর কলকাতা মুম্বাই বা দিল্লির বিরাট বিরাট ধনীদের প্রাসাদের মতো বাড়িতে ভোজ খেয়েছি। কিন্তু সেদিনের সেই ডাল, ভাত আলুভাতেতে যে অমৃতের স্বাদ ছিল তেমনটা আর কোথাও পাইনি।
আমাদের আর বাচ্চা দু’টোর খাওয়া হয়ে গেলে ধরমবীর আর লছমিও খেয়ে বাসনকোসন ধুয়ে একধারে রেখে একটা বড় ব্যাগ থেকে লম্বা চাদর আর তিনটে গোল গোল পুঁটলি বের করল। তারপর চাদরটা ঘাসের জমিতে টান টান করে পেতে দিয়ে, গোল পুঁটলি তিনটেকে হাতের চাপ দিয়ে দিয়ে যতটা সম্ভব ফ্ল্যাট করে বালিশের আকার দিয়ে চাদরটার ওপর পাশাপাশি রেখে দিল।
ধরমবীর বলল, ‘সাহাব, এবার শুয়ে পড়ুন।’
‘তোমরা আর তোমাদের বাচ্চারা?’
‘বাচ্চা দুটোকে শুইয়ে দিচ্ছি—’চাদরের এক কোণে সামান্য ফাঁকা জায়গা রয়েছে। আঙুল বাড়িয়ে সেদিকটা দেখিয়ে, বাচ্চা দু’টোকে ডেকে সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়তে বলল ধরমবীর।
‘আমাদের সবার তো শোওয়ার ব্যবস্থা হল। তোমরা দু’জন?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘আমরা হাতিয়ার হাতে পাহারা দেব—’
‘মানে?’
‘ওই যে খতরনাক জানবর শের—’ ধরমবীর হাসল।
মহেশ খুব ঘুমকাতুরে। সে শুয়ে পড়ল। একটু দূরে শুয়েছে রঘুয়া, তার ওপাশে গণুয়ারা। হাতে তিরধনুক আর বন্দুক হাতে আমাদের দুই পাহারাদার নদীর ধারে খোলা আকাশের নীচে ঘাসের জমিতে আশ্চর্য এক বিছানার দু—ধারে বসে পড়ল।
আমি শুতে পারিনি। বসেই আছি। ধরমবীর বলল, ‘সাহাব, পাহাড় জঙ্গল ঘুরে আপনার বহুৎ তখলিফ হয়েছে। জেগে থাকবেন না। তবিয়ত খারাপ হবে—’
‘কিছু হবে না। তোমরা জেগে থাকবে আর আমি ঘুমাব তাই কখনও হয়? আমার জেগে থাকার অভ্যাস আছে—’
‘ঠিক হ্যায়, আপনার যেমন মর্জি—’ধরমবীর হাসল।—’সাহাব, আপনি তো কলকাত্তা রহেনবালা—’
‘হ্যাঁ—’
‘আমার জান—পহেচান রায়পুরের অনেকেই কলকাত্তায় থাকে। তাদের কাছে ওই শহরের কথা অনেক শুনেছি। কলকাত্তা আর মুম্বাইয়ের মতো শহর নাকি হয় না। আমার সেখানে খুব যেতে ইচ্ছা করে।’
‘বেশ তো, চলে এসো। ঠিকানা দিয়ে যাব। আমাদের বাড়িতে থাকবে।’
ধরমবীরের মুখটা করুণ হয়ে গেল।—’গরিব আদমি। যাব যে এত্তে রুপাইয়া কঁহা মিলেগা?’
‘একবার কলকাতায় তো এসো। সব খরচ আমার।’
মুখটা আলোয় ভরে যায় ধরমবীরের।—’আপনি তো ঠিকানা লিখে দেবেন। জরুর যায়েগা।’
এরপর কলকাতায় কোথায় কী দেখার মতো আছে, একের পর এক বলে যাই। যত শোনে ততই অবাক হয় ধরমবীর আর লছমি। আমি বলছি, ওরা যেন তা শুনছে না, চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছে।
ওদের কাল্পনিক কলকাতা দর্শনের পর বলি, ‘তোমাদের নাম, রায়পুরে থাকো, জঙ্গল থেকে গাছের ছাল, শিকড়—বাকড় নিয়ে গিয়ে কবিরাজ খানায় বিক্রি করো—এর বেশি কিছু জানাওনি। তোমাদের আর কে কে আছে?’
‘কোঈ নেহী সাহাব। স্রিব হামলোগ চার আদমি অউর এক বুডঢী সাস। সে অকেলী গাঁয়ে থাকে। তাকে হর মাহিনা কুছ পাইসা পাঠাতে হয়। লছমি দিয়ে আসে।’
এরপর রায়পুর শহরের সেখানকার লোকজন, দু—চারজন নেতার ভ্রষ্টাচার, রাজনৈতিক অশান্তি, জিনিসপত্রের দাম ক্রমশ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে একটানা বলে যাবার পর ধরমবীর জানায়, ‘সাহাব, আমি তো আনপড়। আমার ইচ্ছা, ছেলেমেয়ে দুটো লেখাপড়া শিখুক, ওদের ইস্কুলে—কলেজে পড়াই।’
‘নিশ্চয়ই পড়াবে। আজকাল লেখাপড়া না শিখলে চলে?’
‘লেকিন—’ধরমবীরের মুখটা শুকিয়ে গেল। ‘এত্তে রুপাইয়া কোথায় পাব?’
এই যুবকটি কলকাতায় যাবার স্বপ্ন দেখে। সেই সঙ্গে ছেলেমেয়েকে স্কুল—কলেজে পড়িয়ে মানুষ করার স্বপ্নও। বললাম, ‘আমাকে চিঠি লিখো। আমার অনেক বন্ধু আছে। আমরা সবাই মিলে তোমাকে দরকার মতো টাকা পাঠিয়ে দেবো।’
‘নেত্রী সাহাব। আপনা কামাইয়ের পয়সায় ওদের পড়াব।’ খুব জোর দিয়েই বলল ধরমবীর।
এই যুবকটি স্বপ্ন দেখে কিন্তু প্রবল আত্মসম্মান বোধ। আমি চুপ করে রইলাম।
একটু পর কিছু খেয়াল হতে জিজ্ঞেস করি, ‘এই যে তুমি বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে আসো, এই হাতিয়ারটার লাইসেন্স আছে?’
‘জঙ্গলে কি খালি হাতে ঢোকা যায়। কবিরাজখানা থেকে আমার নামে সরকারি লাইসেন্স করিয়ে দিয়েছে।’
‘ঠিক আছে।’
কথায় কথায় ভোর হয়। পূব দিকের জঙ্গলের মাথা টপকে সূর্য উঠে আসে।
শুধু সূর্যই নয়, যারা ঘুমোচ্ছিল, উঠে পড়েছে। সবাই নদী থেকে মুখ ধুয়ে এলাম।
লছমি চটপট উনুন ধরিয়ে চা বানিয়ে আমাদের দিল। চা খেতে খেতে কীভাবে, কোন রাস্তা ধরে মানা যেতে হবে, রঘুয়াকে জলের মতো বুঝিয়ে দিল ধরমবীর।
চা—পর্ব শেষ হলে মহেশ, রঘুয়া আর আমি উঠে পড়লাম।
ধরমবীররাও উঠে দাঁড়িয়েছে। তাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ধরমবীর, আমার একটা কথা রাখতে হবে।’
‘বোলিয়ে না—’ধরমবীর আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
পকেট থেকে তিনটে একশো টাকার নোট বের করে ধরমবীরের দিকে বাড়িয়ে দিলাম।—’এটা ধরো।’
মহেশেও দু’টো একশো টাকার নোট বের করেছে।
ধরমবীরের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। গম্ভীর গলায় বলল, ‘সাহাব, আমরা বহুৎ বহুৎ গরীব। লেকিন মেহমানদারি করে পাইসা নিতে পারব না। মাফ কীজিয়ে—
‘এটা তোমাদের বাচ্ছাদের জন্যে—’
‘মাফ কীজিয়ে—’
নোট ক’টা ধীরে ধীরে আমাদের পকেটে ফিরে গেল। ধরমবীর আর লছমির মাথায় একবার হাত রেখে, বাচ্চা দুটোকে আদর করে গাড়িতে উঠলাম।
রঘুয়া স্টার্ট দিল। চোখের পলকে গাড়িটা সামনের মোড় ঘুরে ঢাল বেয়ে সেই পাহাড়ি রাস্তাটায় উঠে এল।
খোলা জানলা দিয়ে পাহাড়ের তলায় সেই নদীর পাড়ের ঘাসের জমিটার দিকে তাকিয়ে আছি। সেখানে ধরমবীর আর লছমিও হাতজোড় করে আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়ি আরেকটা মোড় ঘুরল। মুহূর্তে ধরমবীররা অদৃশ্য হয়ে গেল।
সেদিন দণ্ডকারণ্যের অচেনা নিঝুম প্রান্তে এসে যেন অন্য এক ভারতবর্ষের দেখা পেলাম।
এরপর কত বছর কেটে গেছে। ধরমবীরদের আজও ভুলিনি।
__