অন্যদ্বীপ – ৯

নয়

একটি বিমর্ষ মলিন দরজা ঠেলে বাপি ঢুকল। অন্ধকার। ভিতরে ছোট ছোট টেবিলে বিমর্ষ মলিন ব্যক্তিরা বসে আছে। একপাশে একটা বার। সেখানে উঁচু টুলের ওপরে আরও কিছু দু:খী মানুষ দাঁড়ের ময়নার মতো বসে বিয়ার পান করছে। দেওয়ালের রং দেখা যাচ্ছে না। ওয়াল পেপারের বদলে (এই রেস্তোরাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এইটে বলেই আমার মনে হল) দেওয়ালগুলো সব আপাদমস্তক সূচ্যগ্র পরিমাণ ভূমিও বাদ না দিয়ে, পোস্টারে ছাওয়া। এই পোস্টার পোশাকই দোকানটির মূল শোভা, সজ্জা, সম্পদ। বড় বড় মুখের ছবি—গাইয়ে, বাজিয়ে, ধর্মীয় প্রচারক, মুষ্টিযোদ্ধা, চিত্রতারকা, রাজনীতিক নেতা, কুস্তিগির খুনি, প্রবঞ্চক, পলাতক আসামি প্রত্যেকেই সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। নব্বই ভাগ স্প্যানিশ ভাষায় লেখা। আর কিছু চিনা ভাষায় পোস্টার। ছাপা, হাতে লেখা, স্টেনসিল—সবরকমই আছে। ইংরিজি পোস্টার খুবই কম—নেই বলাই ভালো, যা আছে প্রত্যেকটাই দ্বিভাষী, স্প্যানিশ ভাষার বিজ্ঞপ্তি সমেত। হুয়ানদের কুস্তি টুর্নামেন্টের একাধিক পোস্টার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মির্নাদের কবিতা পাঠের আসরের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল না। হাসি হাসি হুয়ানের অর্ধনগ্ন পেশিবহুল ছবিটা দেখে হঠাৎ তার দু-হাতে মুখ ঢাকা চেয়ারে বসা চেহারাটা চোখে ভেসে উঠল। ওর বন্ধু ছিল ডন পেদ্রো। চোখ ঘুরতে লাগল ভবিষ্যৎ তারিখওলা পোস্টারের ওপরে। নিকারবোকার স্ট্রিটে নিকারবোকার ডান্সিং পার্টি হচ্ছে, ‘আনডার থারটিন নট অ্যালাউড’—লিঙ্কন সেন্টারে ফেস্টিভাল অফ হিসপ্যানিক আর্টস হচ্ছে—ব্রুকলিন ওয়াই ডব্লু সি এতে রোলার স্কেটিং প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ব্রুকলিনের জিমখানাতে কুস্তিই শুধু নয় মুষ্টিযুদ্ধের ব্যবস্থাপনাও দেখা গেল। স্প্যনিশে লেখা হলে কী হবে ছবি-টবি দেখে সবই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

‘পুয়ের্তোরিকান সংস্কৃতির একটা খতিয়ান নিচ্ছে বুঝি? কী খাবে বলো।’ ‘তুমিই বলো বাপি। আমি কি জানি কোনটা ভালো? তা ছাড়া, মেনুই তো নেই।’

‘বেশ। প্রথমে কাঁচকলা ভাজা খাওয়া যাক। তারপরে চিংড়ি মাছের পোলাও। সঙ্গে কী খাবে? বিয়ার চলবে? না কোকাকোলা? আমের রসও অবশ্য খেতে পারো। দাঁড়াও, মেনু এনে দিচ্ছি।’

হইচই করে বাপি কাকে যেন ডাকল। এক বৃদ্ধ চিনে এসে দাঁড়াল। হাতে এক টুকরো ছেঁড়াছেঁড়া নোংরা মতন কার্ড। তাতে স্প্যানিশ ভাষাতে মেনু ছাপানো। তার পাশেই কালি দিয়ে হাতে চিনে জাপানি ধরনের অক্ষরে কীসব লেখা। কবিতা নাকি? ইংরিজির চিহ্ন নেই মেনুতে। অথচ জায়গাটা নিউইয়র্ক।

‘কি সব লেখা এগুলো? কবিতা নাকি? না হিসেব?’

‘কবিতা হবে কেন, মেনু! চিনে ভাষায় লেখা। এটা পুয়ের্তোরিকান প্লাস চিনেদের দোকন যে। ভীষণ মিক্সড নেবারহুড তো—প্রধানত ল্যাটিন আমেরিকান অর্থাৎ বাদামি হলেও এখানে কালোও আছে, হলদেও আছে। গরিব পাড়ায় সর্বদাই যা হয়। বেশি গরিবদের, এক রং।—এই দ্বীপেই আবার অন্যদিকে বিরাট একটা ইহুদি পপুলেশন আছে—কথায় বলে না, ব্রুকলিন অ্যাকসেন্ট? ব্রুকলিন কলেজটা আছে, শিক্ষিত পাড়াও আছে, ধনীপাড়াও। ওই ইহুদি অঞ্চলেই আছে ধনীদের পাড়া। মজার দ্বীপ এই ব্রুকলিন, সত্যি। তবে আমরা এখন যেখানে, সেইটেই সবচেয়ে দু:খীপাড়া।’

‘জাত-বেজাত গ্যাংওয়ার ফেয়ার হয় না? সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা?’

‘হয় না যে—একেবারেই, তা বলব না। তবে সেটা খুব বেশি নয়। নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই মেলামেশা এবং খুনোখুনিটা বেশি চালু।’

‘তোমাকে যে মারতে এসেছিল বলছিলে তখন।’

‘বলছি। তাহলে কী খাবে?’ কলাভাজা, চিংড়ির পোলাও আর আমের রস? ওটাই খাও। কেননা ওটা সোজা পুয়ের্তোরিকো থেকে আমদানি করা হয়—আমার তো খেতে খুব ভালো লাগে। আর তারপরে? আইসক্রিম, আর পুয়ের্তোরিকান কফি? বানানা স্প্লিটও খেতে পারো।’

‘না: মিষ্টান্ন থাক। শুধু কফি।’

দারুণ বানায় এরা কফিটা—অন্যরকম খেতে। বৃদ্ধ চিনেটি অর্ডার নিয়ে চলে গেল। আমাদের মুখে বাংলা শুনে সে বিন্দুমাত্রও অবাক বলে মনে হল না। মুখে ভাবলেশহীন বিবর্ণতা। মনে হয় হঠাৎ ছুরি বার করে আমাকে মেরে দিয়ে প্যান্টে রক্তের হাত মুছে, বিয়ার ঢালতে পারবে অনায়াসে।

‘তোমাকে যে একবার ছুরি মেরে দিচ্ছিল বললে।’

‘ও:! সে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা একটা। সেই প্রথম স্বাদ পেলুম এই পাড়ার চরিত্রের। সদ্য জয়েন করেছি, জীবনে প্রথম মাস্টারি। ভাগ্যিস, টোরেন্টাতে সেই কমিউনটাতে অতদিন ছিলুম? তাই তবু কিছু কিছু ড্রাগ-অ্যাডিকট, অ্যালকোহলিক, নানান বিচিত্র ফ্রিনজ-পিপলদের সঙ্গে চেনা হয়েছিল। হিপি-টিপিদের মুড মেজাজ ধরন-ধারণ বুঝতে শিখেছিলুম, কিছুটা আইডিয়া ছিল, তাই সেবার রক্ষে পেয়েছি।’ বাপি একটা সিগারেট ধরাল।

‘একদিন টিউটোরিয়াল পিরিয়ডে, ওই তো আমাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অফিস কুঠুরি দেখে এলে, দুটো চেয়ার দুদিকে, মাঝখানে একটা টেবিল, দেয়ালে ব্ল্যাকবোর্ড—দরজা বন্ধ না করলে উলটোদিকের চেয়ারে কেউ বসতে পারবে না। সেদিন টিউটোরিয়াল পিরিয়ডে, মারকাস রডরিগেথ আমার অফিস ঘরে ঢুকে দোর বন্ধ করেই ঝুঁকে পড়ে টেবিল থেকে আমার ফোনটা তুলে নিয়ে ওপাশে তার পায়ের কাছে নামিয়ে রাখলো। আমি অবাক হয়ে ভাবছি ফোনটা সরাচ্ছে কেন, টেবিলে কি কোনও চার্ট বা পোস্টার বিছোবে? ভাবতে-না-ভাবতেই স্যাঁৎ করে ছুরি বের করে, বোতাম টিপে তার ফলা বের করে ফেলেছেন তিনি।’

‘ছুরি? হা ঈশ্বর! কী সর্বনাশ!’

‘শোনোই না! সর্বনাশ তো হয়নি, দেখতেই পাচ্ছ।—রডরিগেথ তো ছুরি বের করেছে, সামনে কেবল চওড়া টেবিলটুকুর তফাত। একটু ঝুঁকলেই আমার বুকের নাগাল পাবে সে।’

‘কিন্তু কেন ছুরি বের করল? হঠাৎ?’

‘ঠিক সেই প্রশ্নই আমি করলুম ওকে। মার্কাস স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না। ভয় পেলেই ওরা আরও জোর পেয়ে যায়। থ্রেটটা ইগনোর করলে দুর্বল হয়ে পড়ে। আসলে তো ভিতরে ভিতরে দুর্বলই। মুখটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে, গলায় যথাসাধ্য নির্বিকার ভাব বজায় রাখতে চেষ্টা করে, আপ্রাণ চেষ্টায় ভয় লুকিয়ে সহজভাবে বললুম, ‘ছুরি কেন, মার্কাস? ব্যাপার কি? হোয়াটস দ্য ম্যাটার?’

‘দ্য ম্যাটার ইজ সিম্পল।’ রডরিগেথ বলল গম্ভীর মুখে, ‘আমি তোমাকে খুন করব আজ। শয়তান! ঈশ্বরকে স্মরণ করো। থিয়োট্রিকাল সংলাপ। হাসব না কাঁদব?’

‘কিন্তু মার্কাস, কারণটা তো তার আগে বলবে? মরতে আপত্তি নেই, একদিন তো মরবই, জগতে কেই বা অমর? কিন্তু তোমার তো কোনও ক্ষতি করিনি আমি?’

ক্ষতি  করেছ বইকি। তোমাকে হুবহু আমার শয়তান বাপটার মতন দেখতে। তোমার সামনে বসে থাকতেও আমার ঘৃণা হয়, রোজ তোমার মুখ দর্শন করা আমার পক্ষে অসহ্য জ্বালা। তোমার সঙ্গে হেসে হেসে ”সুপ্রভাত শুভরাত্রি” করা আমার স্নায়ুকে খণ্ড খণ্ড করে ফেলছে। তোমাকে আজ আমি শেষ করব। নইলে আমার মুক্তি নেই।’

‘আহা, সত্যি? খুবিই বুঝতে পারছি তোমার অবস্থাটা, মার্কাস! কিন্তু আমি তো প্রায় তোমারই সমবয়সি, আমি তো তোমার বাবা হতে পারতুম না? সুদূর ভারতবর্ষ থেকে এসেছি, তোমার বাবার সঙ্গে আমার রক্তেরও মিল নেই। তা, তোমার বাবা এখন কোথায়?’

কী জানি। সে ব্যাটার দশ বছর হল দেখা নেই। তার আগেও কি দেখা ছিল? বছরে দু-একবার চিলের মতো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত, মাকে ধরে পিটত, আমাদের মেরে শেষ করত, সংসারে আমাদের যা কিছু থাকত সর্বস্ব ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে চলে যেত, ডাকাতটা। প্রত্যেকবার ওর ভয়ে আমরা বাসা বদলাতাম। তবুও ঠিক বের করে ফেলত, ঠিক এসে মেরে ধরে কেড়ে কুড়ে নিয়ে যেত আমাদের শীতের পোশাক, গায়ের কম্বল, রান্নার বাসনপত্র, যেখানে যা পেত বাবার ভয়ে মা’র কোনও প্রেমিক পর্যন্ত ছিল না। মা আমাদের তিনজনকে একলা, প্রচণ্ড পরিশ্রমে মানুষ করেছেন। বিনা নিরাপত্তায়, বিনা ভালোবাসায় অতিরিক্ত খাটুনিতে, বিনা বিশ্রামে, বিনা যত্নে মা এখন আমার রুগ্ন; অকালবার্ধক্যে শয্যাশায়ী। সর্বদাই কাল্পনিক আতঙ্কে চমকে চমকে ওঠেন—এই বুঝি বাবা এল, কেড়ে-কুড়ে নিয়ে গেল সর্বস্ব। ছোটবেলায় আমাদের পা ধরে ঝুলিয়ে শূন্য দোলাতে দোলাতে মাকে বাবা বলত—দে সব বের করে, নইলে দেয়ালে ঠুকে মেরেই ফেলব এটাকে! এখন মা দিনের বেলাও সেই দু:স্বপ্ন দেখেন—মেরো না ওকে, দিচ্ছি দিচ্ছি বলে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন।’

‘তোমরা তিন ভাই বোন? কত বয়স তোমাদের?’

‘ভাই আঠারো, আমি বাইশ। মাঝে বোন। বছর দুয়েক হল বোনটা মারা গেছে। সেই থেকেই মা পাগল। মা’র ধারণা, বাবাই এসে ওকে ধরে নিয়ে গেছে। আসল তা নয়, ওর প্রেমিক ওকে অ্যাবরশন করাতে নিয়ে গিয়েছিল, হাতুড়ে ডাক্তার মেরে ফেলেছে। অদ্ভুত বোকা মেয়ে পিল খেত না। ধর্মভীরু ছিল।’

‘বাবাকে তুমি দশ বছরে দ্যাখোনি?’

‘না:। এপাড়ায় এসেছি আট বছর। তারও বছর দুই আগে শেষবার এসেছিল বাবা।’

‘দশ বছরে কত কিছুই তো ঘটে যায় মার্কাস। তোমার জ্যান্ত বোনটা যে বেঁচে থাকলে আজ কুড়ি বছরের হত, সে মারা গেছে। তোমার পরিশ্রমী মা পাগল হয়ে গেছেন। তোমার হতচ্ছাড়া বাবা কি এখনও বেঁচে আছেন? মনে তো হয় না। তিনি নির্ঘাত পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। নইলে দশ বছর একটানা তোমাদের শান্তিতে বাঁচতে দিতেন না। নিশ্চয়ই এসে এসে নিয়মিত অত্যাচার চালিয়ে যেতেন। আমি তোমাকে একেবারে স্থির নিশ্চিত বলছি, মার্কাস, বিশ্বাস করো তোমার বাবা কখনই বেঁচে নেই। তোমার মার উচিত বৈধব্য পালনের ব্যবস্থা করা।’

‘মানে? তুমি বলছ বাবা বেঁচে নেই? মরে গেছে?’

‘নিশ্চয়ই মারা গেছেন। মাকে তুমি বোঝাও, যে মা ফ্রি, মা মুক্ত। মা’র ভয়ের কোনও কারণ নেই।’

‘মা ফ্রি?’

‘অবশ্যই ফ্রি। বেঁচে সে নেই কক্ষনো। থাকলে এর মধ্যে ঠিক আসতই। টাকাকড়ি নিতই। এই তোমারই মতন আর কোনও ছেলের ছুরির ফলা তাকে খতম করে দিয়েছে সন্দেহ নেই। অত বেশি বজ্জাত লোককে পৃথিবী সহ্য করে না বেশিদিন। ও খুন হয়ে গেছে।’

‘মেরে ফেলেছে? খুন করে ফেলেছে? ঠিক। ঠিক বলেছ! ঠিক বলেছ তুমি। বেঁচে থাকলে ও এতদিন ছেড়ে দিত না আমাদের। ঠিক আসত। কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে খুঁজে বের করত। এতদিন কেন কথাটা মনে হয়নি আমাদের? এতদিন কেউ কেন বলে দেয়নি একথাটি? আতঙ্কে শিটিয়ে থেকে থেকে মা বেচারি পাগল হয়ে গেলেন। এই বুঝি কেউ এল, দস্যুর মতন! দরজায় কেউ টোকা দিলেই সর্বশরীর কেঁপে উঠত মার। উ:! ভগবান! তারপরেই ছুরিটা আমার টেবিলে ফেলে দিয়ে মার্কাস উঠে দাঁড়াল। ‘আমি দু:খিত, সার, খুবই দু:খিত’—বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

তখন চেয়ার ছেড়ে উঠবার ক্ষমতা নেই আমার। হাত-পা যেন জমে গেছে। ঘামে সর্ব শরীর ভিজে জবজব করছে। বাপি চুপ করল। আমিও চুপ।

‘মার্কাস এখন কোথায়, বাপি? খবর রাখো?’

‘কলেজেই আছে। এবারে ফাইনাল ইয়ার।’

‘ওর মা?

‘পুরোপুরি সারেননি। তবে আগের চেয়ে ভালো। মা-ছেলে, দুজনের জন্যেই সাইকিয়াট্রিক ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা হয়েছে।

‘ও:।

‘ভয় পাচ্ছ, নবনীতাদি? বেঁচে যে আছি, সেই তো ঢের। এই তো, ডন পেদ্রোটা আজ আর বেঁচে নেই। কালও আমার ক্লাসে এসেছিল। এই তো জীবন। অনিত্য বলে অনিত্য। ভয় পেয়ে আর কী হবে?’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *