অন্যদ্বীপ – ৮

আট

ট্রেতে তিন কাপ কফি, আর এক প্লেট কুকি নিয়ে ঘরে এল গীতা, ওলগীতা। ছোট ছোট কাপে চমৎকার কালো কফি, টার্কিশ কফির ধরনের। শুনেছি কফি জিনিসটা নাকি এশিয়া থেকেই টার্কি, গ্রিস, স্পেন হয়ে ইউরোপীয় সভ্যতায় ঠাঁই করে নিয়েছিল। এখন তো ব্রেজিলেই তার সব চেয়ে বোলবোলাও। কফি দেখে সকলের মেজাজ শরীফ হয়ে গেল। ‘হুয়ান? হুয়ানের কফি কই?’ পাবলো চেঁচায়, ‘গীতা!’ ‘হুয়ান তো এক্ষুনি চা খাচ্ছিল। আবার এক্ষুনি কফি কি খাবে?’ গীতার ধমক আসে বাইরে থেকে চেঁচিয়ে। একে তো এমন চেঁচামেচি অ্যাংলোস্যাক্সন সভ্যতায় মোটে মানানসই নয়। তায় এর যে দেখি বাঙালি দিদির মতন স্বাস্থ্যচিন্তা, স্নেহের শাসন! অবাক হয়ে যাই। না: এদের সংস্কৃতির ধাঁচাই আলদা। অ্যাংলোস্যাক্সন সমাজের মূল্যবোধ একেবারে অন্য। ঢের বেশি আড়ো-আড়ো ছাড়ো-ছাড়ো। নাগরিক বিচ্ছিন্নতাবোধের চিহ্ন তাতে। এটা যেন পল্লিসমাজ। লতায়-পাতায় পরিবারতুল্য একটা উষ্ণ গ্রাম্য যোগাযোগ। আবেগ ভরে প্রশ্ন করে বসি, ‘তোমাদের এখানে পারিবারিক বন্ধন খুব গভীর হয়, না?’

ঠোঁট উলটে কোরাসে উত্তর দেয় পাবলো আর মির্না—’কোথায় গভীর? প্রচণ্ড বিচ্ছিন্নতাবোধে না ভুগলে কখনও এত অপরাধপ্রবণতা আসে?—’

‘তবে হ্যাঁ, সুস্থ অবস্থায় স্বভূমিতে লাতিন আমেরিকান সমাজে পারিবারিক গ্রন্থি সত্যি সুদৃঢ়—’

‘কিন্তু এই শহরে তো আমাদের সমাজটা সুস্থ নয়, এতে আমাদের যথার্থ প্রতিচ্ছবি পাবে না। এখানে যত গরিব, অসার্থক ব্যর্থ বাপেদেরকে ছেলেরা মোটে মানুষ বলেই মনে করে না। তারা ‘অক্ষম পুরুষ। নামকা-ওয়েস্তা-বাবা। তাদের প্রতি যুবক পুত্রদের অসীম ঘৃণা।’

‘কেউ কেউ বুড়ো বাবাদের তবু একটু ক্ষ্যামা-ঘেন্না করুণা-টরুণা করে, আর কারুর দেখি কেবলই রাগ, প্রচণ্ড বিদ্বেষ—বাপের ওপরে।’—’বাপের ব্যর্থতার জন্যই ছেলেরও জীবনটা নষ্ট—এমন একটা ধারণায় ভোগে এসব ছেলেরা। বেশিরভাগ ক্রাইম, ভায়োলেন্সের মূলেও ওই জন্মগত ক্ষোভ।’

‘আরে বাবা, বাপের ওপর চটবে কী, বাপ থাকলে তো? কোনও বাবাই থাকে না আদ্ধেক পরিবারের! মেয়েরা এ সমাজে প্রচণ্ড অনিশ্চয়তার শিকার। কি মানসিক, কি অর্থনৈতিক, শান্তি বলে, স্বস্তি বলে কিছুই থাকে না তাদের । পুরুষ অভিভাবকরা স্ত্রীদের প্রায়ই শিশুসমেত পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায়। ব্ল্যাকদের মধ্যে অবশ্য এই সমস্যা বোধহয় আরও প্রবল। এই কারণেও পিতাদের ওপর দায়িত্বহীনতার জন্য কিশোর ছেলেদের প্রচণ্ড রাগ।’ মির্নার গলায় রাগ ঝলসে ওঠে—’অথচ বড় হয়ে তারাই আবার প্রেমিকাদের, শিশুদের ত্যাগ করে পালায়। সেই পিতৃপদাঙ্কই আবার অনুসরণ করে। যে কাজকে ঘৃণা করেছে, ঠিক তারই পুনরাবৃত্তি করে। এদিকে আমাদের তো ধর্মে ডির্ভোসও হয় না। এখানে সবাই ধর্মভীরু ক্যাথলিক তো।’

‘বড় জটিল, বড় করুণ, আমাদের এই নবীন বোরিকুয়া, বোনিটা। বড় দুর্ভাগা। পাবলোকে দু:খী দেখায়।

দু-এক মুহূর্তের স্তবদ্ধতা যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে বুকে চেপে বসে। এত কলকল করে একসঙ্গে কথা বলে এরা সবাই। হঠাৎ থামলেই মনে হয় যেন নায়াগ্রাপ্রপাত থমকে দাঁড়িয়েছে। গমগম করে ওঠে নৈ:শব্দ্য। সেই স্তব্ধতা ভাঙতেই বোধহয় হালকা সুরে কথা বলে ওঠে মির্না।

‘কফি যখন তুমি খাচ্ছ না, কবিতা তো শোনাও একটা? হুয়ান? তোমার লেখা একটা কবিতা পড়ো না, বোনিটার জন্যে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ কবিতা পড়া হোক।’ পাবলো এক মিনিটেই আবার খোশমেজাজ। —দারুণ বলেছো মির্না। বোনিটা তোমার কোনো কবিতা আছে নাকি সঙ্গে? ওই বিশাল থলিতে?’

‘আমি তো লিখি বাংলায়। সেও আবার সঙ্গে নেই। বাক্সসুদ্ধু হারিয়ে গেছে লনডনে। হুয়ানই পড়ুক।’

‘আমিও তো লিখি স্প্যানিশে। তুমি বুঝবে না।’ হুয়ান বলে সলজ্জভাবে।

‘হুয়ান, একটি কবিতা শোনাও দিখি বোনিটাকে!’ পাবলো মিলিটারি সুরে হুকুম করে। ‘তোমার সেই বরিনকুয়েন’ কবিতাটা? ঠিক বুঝবে।’

‘একটু একটু অন্তত বুঝব, ফ্রেঞ্চ তো বুঝি, তাই।’

‘সঙ্গে তো নেই এখন।’

‘একটাও নেই।’

‘দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এসো না, বাড়ি থেকে? এই তো রাড়ি। যাবে, আর আসবে।’

‘তা চেয়ে তুমিই শোনাও না মির্না, তোমার নাটকটা? এখানেই আছে তো’ হুয়ান মির্নার দিকে চেয়ে বলে। ‘জানো মির্না দারুণ একটা নাটক লিখেছে, সেটা পাড়ার সাহিত্যসভায় পড়া হবে আটাশে। পথে-পথে পোস্টার পড়েছে। দেখতে পাওনি?’

‘তুমি নাটক লেখো? মির্না? আর এতক্ষণ আমাকে বলোনি?’ শ্যামলা গাল দুটো টুকটুকে হয়ে যায়—মির্না আপত্তি করে—

‘কই? ওই তো মাত্র একটাই লিখেছি। পুয়ের্তোরিকো আর স্ত্রী স্বাধীনতা এই দুটো কমন বিষয় নিয়ে। ওটা কিছু হয়নি। নাটকই হয়নি ওটা। কেবল পড়বার জন্যে।প্লে রিডিংয়ের জন্য।’

‘দাঁড়াও বোনিটা, পোস্টারটা তোমায় দেখাচ্ছি।’ পাবলো ছুটে বেরিয়ে যায়, কোথায় কে জানে, নিশ্চয় পোস্টার আনতে। আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়েছি বাবা। লেকচার শুনতে-শুনতে কান-প্রাণ গেল। কফি ঠিক শেষ হয়েছে, এমন সময়ে আর একটি বাদামি রঙের ছেলে ঢুকল। কাঁধে বিরাট চামড়ার কিটব্যাগ। রুক্ষ মাথার চারপাশে সেই ফ্যাশানেবল সাঁইস্টাইল জ্যোতির্বলয়। ঠিক পাবলোর যেমন। মুখভরা ভারিক্কি দাড়িগোঁফ। মোটা কাচের ভারী ফ্রেমের চশমার তলার ঝকঝকে চোখ দুটি স্বতন্ত্র। দৃষ্টিতে সততা চেনা যায়। মুখখানি কচি, টুলটুল করছে। পরনে জিনস, আর জিনসের জ্যাকেট।

‘বা:। এই যে সেনগুপ্ত, এসে গেছ? এই দ্যাখো, তোমার জন্য আমরা কী সংবর্ধনা প্রস্তুত করে রেখেছি। আ পোয়েট ফ্রম ইয়োর হোমল্যান্ড।’ মির্না উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

কিন্তু আশ্চর্য কাণ্ড—নি:শব্দেও মির্নার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে একদৃষ্টিতে চেয়েই থাকে ছেলেটা আমার দিকে। খুবই অস্বস্তি হয়। এ কি রে বাবা? আমি কি মেরিলিন মনরো নাকি? না চার্লি চ্যাপলিন? তারপর একটি নাটকীয় সংলাপ শুনতে পাই—’অরে:, তুমি নবনীতাদি না? গুড গ্রেশাস। এখানে কী করে এলে? কে তোমাকে আনল?’

হায় হোরেশিও, কত কিছু আছে দ্যুলোক ভূলোকে, তুমি কী জানো? এবারে উত্তর না দিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পালা আমার। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠি, ‘মীরাদির ছেলে? বাপি না? চুলটা কী করেছে?’ তারপরেই নাটিকা ঘনতর। আহ্লাদের চোটে লাফিয়ে উঠে জাপটেই ধরেছি ছেলেটাকে।—টুটুলকে কিছুতেই ফোনে পাচ্ছি না। ওরা সব কেমন আছে রে? জোনাকি কোথায়? তুই কদ্দিন পড়াচ্ছিস?’

‘ভালো। সবাই ভালো। খুব ভালো। টুটুলরা দেশে গেছে, জোনাকি এখনও পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু তুমি কী করে আমার কলেজে এলে নবনীতাদি?’ বজ্র আলিঙ্গন মুক্ত হতে-হতে বাপি উত্তর দেয়,—’উ: কী ভয়ানক সারপ্রাইজ। কী আনন্দই যে হচ্ছে তোমাকে দেখে! সিক্সটিনাইনে শেষ দেখা!’

ইতিমধ্যে পাবলো ঘরে ফিরছে, হাতে এক বান্ডিল গোটানো কাগজ। আমাদের অপরূপ মিলন দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ায়। চমৎকৃত হয়ে বলে ওঠে—’হোয়াট! আর ইউ স্টিলিং মাই লাভলি ফ্রেন্ড? সেনগুপ্ত? দিস ইজ নট ফেয়ার।’

‘আমরা যে অনেক পুরোনো বন্ধু, পাবলো। উই আর কাজিন্স ইন ফ্যাকট, মিটিং আফটার আ ডেকেড!’

‘রিয়্যালি? ইজ ইট সো? কুড ইট বি ট্রু নোবোনীটা? হোয়াট আ স্মল ওয়ার্লড ইট ইজ! ওয়েল, লাইফ ইজ ফুল অব সারপ্রাইজেস, ডিয়ার সেনগুপ্ত! বাট থ্যাংক মি ফর দ্য রি-ইউনিয়ন।’ ‘অফকোর্স পাবলো। আর নট ইউ আ মিরাক্লওয়ার্কার?’ এরপর প্রবল বাংলা ভাষায় চলল আমাদের কুশল বিনিময়। দশ বছরের জমে থাকা সব গসিপ তো দশ মিনিটে চালাচালি করে নিতে হবে! কলকাতা—দিল্লি—লন্ডন—নিউইয়র্ক—আত্মীয় বন্ধুর সমাজটা তো আর খুব ছোটও নেই! ইতিমধ্যে পাবলো আমার চোখের সামনে বিশাল এক পোস্টার মেলে ধরল। (বোধহয় বাপির দিক থেকে আমার মনটা ওর দিকে সরিয়ে নেবার অসদুদ্দেশ্যও খানিকটা কাজ করছিল তাতে!) নীল-খয়েরি-সাদা-কালোয় ছাপা হলেও পোস্টারটি শিল্প হিসেবে বিশেষ-নজরকাড়ানি নয়। ইংরাজি ও স্প্যানিশ দুই ভাষায় তাতে বড় বড় হরফে লেখা আছে!

‘এরিনা পুয়ের্তোরিকো জিম প্রেজেন্টস-ইন বারিনকুয়োন প্লাজা।’ তারপর সারিবন্দি কুস্তিগিরদের ফোটোগ্রাফ ছাপানো এবং গোটা চারেক ভবিষ্যৎ কুস্তি প্রদর্শনীর সময়সূচী। দ্রষ্টব্য এই, যে সবই প্রদর্শনী খেলা, ফ্রেনডলি ম্যাচ—প্রতিযোগিতা নয়। এই অমানুষিক প্রতিযোগিতার রাজ্যে, প্রতিযোগিতার যুগে, একটা খেলা হচ্ছে যেটা বন্ধুত্বমূলক। হারজিতের বাজি ধরে নয়, কমার্শিয়াল নয়—এটা মার্কিন দেশে অবিশ্বাস্য। সব খেলাতেই পয়সা। সব খেলাতেই বাজি ধরা। সব খেলাই জুয়োখেলা। কিন্তু এগুলো সবই যে ফ্রেনডলি ম্যাচ’ ইংরিজি আর ইস্পানির সংযোগে এটুকু বেশ বোঝা গেল। এরই একটি ফোটোতে খালি-গায়ে, শর্টসপরিহিত সহাস্য তরুণ কবি হুয়ান কার্লোসকে দেখা যাচ্ছে। রেসলিং চ্যাম্পিয়ন-কাম-কবি জীবনে সত্যিই এই প্রথম দেখছি। আবার শুনছি লেখাপড়াতেও ভালো! তায় আমাকে বলেছে ‘বোনিটা!’ অলরাউনডার আর কাকে বলে? আমি তো মুগ্ধ বিমোহিত। ছাত্রের মতন ছাত্তর বটে! ওটা গুটিয়ে এবারে অন্যটি খুলে দেখাল পাবলো। এটা অনেক ছোট্ট, শুধু সাদা কালোয় করা শিল্পসম্মত পোস্টার। পুরোনো ফোটোগ্রাফের ঢঙে একটি মেয়ের ছায়াকালো সিলুয়েৎ মুখ আঁকা, আর ইংরেজিতে লেখা—’দ্য লাতিনো প্লেরাইটস—দ্য মিউজিক অ্যান্ড পোয়েট্রি অফ পুয়ের্তোরিকো, ফ্রম কোলোরেস—টু—ন্যুয়র্ক’—নীচে পাঁচটি মেয়ের নাম, তিনটি ইস্পানি, দুটি অ্যাংলো স্যাকসন। নাটক পাঠ, কবিতা পাঠ, গান, একদিন গল্প পাঠও আছে পাঁচ দিনের সান্ধ্য প্রাোগ্রামে। দুটি নাটকের নাম স্প্যানিশে, তিনটির নাম ইংরিজিতে লেখা। মির্নার নামও দেখলুম আছে, স্প্যানিশ নাটকের লেখক হিসাবে। সবাই এ পোস্টার পড়বে না। বেশ বোঝা যাচ্ছে এটা শিক্ষিত দর্শকদের জন্য। আমি লোভে লোভে বলেই ফেলি—’পোস্টারগুলো আমায় দেবে? আমি পোস্টার জমাই।’ পাবলো আর বাপি সমস্বরে বলে ওঠে—’কত চাই? কটা নেবে? কমনরুমে চলো। দেয়ালভরতি শুধু পোস্টার!’ হুয়ান সবিনয়ে সতর্ক করে দেয়—’তারিখটা পার না-হলে কিন্তু ছিঁড়ো না, ছাত্ররা দেখলে গণ্ডগোল করবে। দেখেশুনে নিও।’

পাবলো অধৈর্য প্রকৃতির শিল্পী মানুষ,

‘দূর দূর, অতগুলো আছে, দু-চারটের ডেট না পেরুলেই বা কী? চলো, চলো, ওপরে চলো—কিছু খাবে? দুধ, ফলের রস, সসেজ, বোলোনা, রোস্ট চিকেন, চিজ রুটি, মধু, মাখন—’

‘সব ফ্রি, সব ফ্রি! পয়সা লাগে না। এমন আদর্শ কলেজ জীবনে দেখেছ, নবনীতাদি?’ প্রবল উৎসাহে বাপি পাবলোর মুখের কথা শেষ ক’রে দেয়!—’ফ্রি খেয়ে-খেয়ে মোটা ভুঁড়িদার হয়ে গেলাম সবাই।’ আড়চোখে নিজের দিকে চেয়ে দেখে হাসি চাপে। কিন্তু আমার তো মনে মনে অন্যরকম ইচ্ছে—

‘পাবলো বলেছিল বাইরে ছোট দোকানে পুয়ের্তোরিকানদের দিশি-খাবার খাওয়াবে’—মনে করিয়ে দিতেই পাবলো হইহই করে ওঠে—’হ্যাঁ হ্যাঁ চলো তাই যাই মির্না, তুমিও চলো। মিটিংটা আজ ক্যানসেল করে দিই—পরশু শুক্রবারই হওয়া ভালো। আমরা সবাই মিলে বরং ওই ডমিনিকানদের দোকানে গিয়ে খেয়ে আসি। কী বলো?’

‘ডমিনিকান খাদ্য তো আর পুয়ের্তোরিকান খাদ্য হল না—’ মির্না আপত্তি করে।

‘যদি ডমিনিকানদের রান্নাও খুব ভালো।’

‘ভালো মানে? দা-রু-ণ! ডমিনিকানরা যা পাঁঠার মাংস রাঁধে না, উশশশ নবনীতাদি, একেবারে দেশের মতন! মশলাপাতি দিয়ে দিব্যি গরগরে করে—। আবার হলদে ভাত বলেও একটা জিনিস বানায়, একেবারে যেন পোলাও! বাপি বাংলায় জ্ঞান দেয়। পাবলো মনে করায়—’পরশু সবাই ফ্রি তো? চারটের সময়, এইখানে এই ঘরেই মিটিং। ডন পেদ্রোকে খবরটা দিয়ে দিতে হবে কেবল। সে তো কৈ এখনও এলই না।’ বাপি বলে—’হুয়ান, তোমার বাড়ির পাশেই থাকে না ডন পেদ্রো? পরশু আশা করি আসতে পারবে—ছাত্র প্রতিনিধি না থাকতে মিটিং করলে, নানান ঝামেলা। ইচ্ছে করলে ওরা গোলমাল বাধাতে পারবে পরে। হুয়ান—তুমি পেদ্রোকে বলবে এটা খুব জরুরি মিটিং নিশ্চয়ই যেন আসে। সিদ্ধান্তটা ছাত্র-শিক্ষক উভয় পক্ষে মিলেমিশেই নিতে হবে।’ বাপির কথার পিঠে পিঠেই দুষ্টু দুষ্টু হাসির সঙ্গে পাবলো বলে, ‘আর বোনিটাকে আমরা বলব নাকি’, ‘রেসিডেন্ট পোয়েট অন ক্যাম্পাস’ হয়ে এখানে থাকতে? এই মিটিংয়েই পাস করিয়ে নিই প্রস্তাবটা, কি বলো হুয়ান? সেও তো খুবই জরুরি সিদ্ধান্ত—’

‘দূর দূর! আসবেন কেন নবনীতাদি?’ বাপি বাগড়া দেয়—’উনি তো দেশেই পড়াচ্ছেন, টেনিয়র্ড পোস্ট—অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। উনি হঠাৎ ভালো চাকরিটা ছেড়ে কম মাইনেয় চলে আসবেন কেন? সমাজসেবিকা হতে?’

‘অ্যাঁ? তুমিও পড়াও? এতক্ষণ তো আমাদের কিছুই বলোনি? কী সর্বনেশে মেয়ে তুমি। অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডটা স্রেফ চেপে গেছ? আমরা দিব্যি চাল মারছি—এদিকে সবাই অ্যাসিস্টান্ট প্রফ কি ইনস্ট্রাকটর—একজনও কিন্তু অ্যাসোসিয়েট প্রফ নেই। তুমি কিছু বলছই না। এতক্ষণ আমি ভাবছি সরল ভারতীয় কবিকে বাগে পেয়ে জোর জ্ঞান দিচ্ছি। ছি ছি কী লজ্জা।—কী বিষয় তোমার?’

‘সত্যিই তো জ্ঞান দিচ্ছ। আমি কিছুই জানতুম না নিউইয়র্কের এই মিনি-পুয়ের্তোরিকোর বিষয়ে। একটা নতুন দেশ—বরিকুয়া’। ‘এখনই বা কী জানো?’ বাপি ফস করে বলে ফেলে। ‘কেবল তো কয়েকজন ছাত্র আর কয়েকজন মাস্টারকেই দেখেছ। এতে কিছুই জানা হয় না।’ ‘চলো, খেতে খেতেই জানতে পারবে।’ পাবলো বলে ‘থ্র ইওর স্টমাক—’

বাইরের ‘হলে’ একটা গণ্ডগোল শোনা গেল এই সময়ে। হঠাৎ কয়েকটি ছেলে ব্যস্তসমস্ত হয়ে প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে গড়গড় করে স্প্যানিশে কী সব বলতে থাকে। উত্তেজিত তাদের কণ্ঠস্বর, উত্তেজিত চোখ মুখ, শরীর কাঁপছে—তাদের পেছু পেছু স্টেনোটাইপিস্ট মেয়ে দুটিও ডেস্ক ছেড়ে ছুটে এসেছে। ওদের বাক্য শেষ হতেই ঘরে একটা পরিপূর্ণ বিবর্ণ স্তব্ধতা নামল। একটাই তো মুহূর্ত। কিন্তু ভয়ংকর সেই নৈ:শব্দ্য।

তারপর পাবলো স্প্যানিশে কথা শুরু করে ছেলেদের সঙ্গে। বাপিও। মির্নাও। গীতাও, লীনাও। সকলেই একসঙ্গে কথা বলতে থাকে। অন্য অন্য ঘর থেকেও ছুটে আসছে, রিনা, হুয়ানীতা, কার্লোসেরা সবাই—হুয়ান কার্লোস কেবল কথা বলে না। একটা চেয়ারে কেবল চুপ করে বসে পড়ে। বা: ইস্পানি ঐতিহ্য দেখছি এক্বেবারে বাঙালি ঐতিহ্যেরই সগোত্র। এরা সবাই বঙ্গসন্তান, কেন না প্রত্যেকে একসঙ্গে কথা বলে। কেউ কারুর কথা শোনে না। হুয়ান কার্লোসের কি শরীর খারাপ লাগছে? ও দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছে। একটুও বুঝতে পারছি না—মনে হচ্ছে নিউইয়র্কে নেই, আমি পুয়ের্তোরিকোয় বসে আছি। ইস্পানি ঝঞ্ঝার মধ্যে।

‘ব্যাপার কি বাপি? কী হয়েছে?’

‘খুন।’

‘খুন! সে কি!’

‘চমকানোর কিছু নেই। প্রতি মাসেই ঘটছে। ছাত্র খুনের ব্যাপার এ কলেজে ডাল ভাত!

‘পলিটিক্যাল মার্ডার?’

‘না:। গ্যাং ওয়ারফেয়ার—স্ট্রিট গ্যাংদের দাঙ্গা। ”ওয়েস্ট সাইড স্টোরি” সিনেমাটা দেখেছিলে? দেখনি? দেখলে বুঝতে। মাস্তানদের দলবাজি নিয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা; স্প্যানিশ ঐতিহ্যের মধ্যে ‘ভেনডেটা’র ব্যাপারটা খুব জবরদস্ত আছে এখনও। ছেলেগুলো প্রায়ই মরে। মারে, মার খায়, মরে যায়। আশ্চর্য প্রতিহিংসাপরায়ণ, জেদি জাত। মেরে পার পাবে না কেউ। মরতেই হবে। নবনীতাদি, এ ব্যাপারটা চোখে না দেখলে তুমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারবে না।—চোদ্দো থেকে বিশ-বাইশের ছেলেগুলো ফটাফট হরদম মরে যাচ্ছে। এদের প্রাণের কোনও গ্যারান্টি নেই। অল্প বয়সেই আন্ডারওয়ার্লডের ছেলে হয়ে যায় সব—শুধু তো গরিব নয়, ওয়াইলড, বুনো। ক্রিমিনাল টেনডেন্সির ছেলে এরা; মাস্তান, গুণ্ডা, ডোপ পেডলার, স্মাগলার, পিম্প, পকেটমার ছিনতাইবাজ।—আমরা এই কলেজে শুধু তো মাস্টারি করি না, প্রধানত সমাজসেবারই একটা প্রয়াস এটা। ওদের জীবনের ধারা পরিবর্তনের চেষ্টা। কিছু মূল্যবোধ গড়ে তুলে জীবনের মানে করে দেওয়ার চেষ্টা,—ওদের চরিত্র সংশোধনেরই প্রাোগ্রাম এটা আমাদের। কিন্তু এই দিন কে দিন অকারণ খুন দেখতে দেখতে আমারই বুকের ভেতরটা কেমন যেন পাষাণ হয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে।’—খুব আস্তে আস্তে বাপি কথা বলছে। ঘরে এখনও স্প্যানিশ ভাষার ঝড়। বাঙালির কানে ছাত্র খুন নতুন ভাষা নয়। তরুণদের রক্ত আমার শহরেও কম বইতে দেখিনি। কিন্তু সে মৃত্যুতে মহত্ব আছে—ঠিক এ জিনিস নয়। সে প্রাণত্যাগ অনর্থক নয়, বন্য পশুর দলাদলি নয়। সে মৃত্যুও মানুষের ইচ্ছার ঘোষণা করে। সে রক্ত কথা কয়। ‘বোনিটা ডিয়ার, অত্যন্ত দু:খের বিষয়, আমাকে এখুনি একটু থানায় যেতে হচ্ছে। হুয়ান, মির্না, যাবে তো? চলো, তবে আমরা যাই—বোনিটা, তোমাকে পুয়ের্তোরিকোয় ভোজ খাওয়াব বলে ডেকে এনেছিলাম—অথচ এভাবে চলে যেতে হচ্ছে এ দু:খ আমার নিজস্ব। সেন তুমিই বরং বোনিটাকে পুয়ের্তোরিকোর পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা জানাও, তুমি তো যাবে না,—যাবে কি—মর্গে?

‘না:।’

‘সেই ভালো। তুমিই বোনিটার দেখাশুনো করো, ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিও। ওকে জোর করে পার্টি থেকে ছিনিয়ে এনেছিলুম মিনি পুয়ের্তোরিকো দেখাব বলে, সে আর হল না।’

‘আমি খুবই দু:খিত, বোনিটা একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। ডন পেদ্রো, আমাদের আজকের মিটিঙে যে ছাত্রটির আসার কথা ছিল, সে একটু আগে স্ট্রিটফাইটে মারা গিয়েছে। বডি আইডেনটিফাই করা, বডি খালাস করা, ওর বাড়ির লোকের সঙ্গে সহায়তা করে সৎকারের ব্যবস্থা করা—এখন অনেক কাজ আমাদের। মানে,—’

‘যাও যাও বেরিয়ে পড়ো তোমরা, আমার জন্য একটুও ভেব না। আমি আর বাপি ঠিক আছি। হে ভগবান!’

‘বোনিটার জন্য ভাবতে হবে না, সে এখন থেকে আমার দায়িত্ব, পাবলো—’ বাপি বলে, ‘তোমরা মাথা ঠান্ডা করে বেরিয়ে পড়ো।’

মুহূর্তে ঘর ফাঁকা।

পুরো বিল্ডিংটাই ফাঁকা।

হঠাৎ কান্নার শব্দে তাকিয়ে দেখি টাইপরাইটারের পাশে টেবিলে মুখ নামিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে গীতা। ওলগীতা। তার মাথায় হাত রেখে মার্লিনা স্তব্ধ দাঁড়িয়ে। পেটটি উঁচু হয়ে সংবাদ দিচ্ছে আসন্ন শুভদিনের।

‘গীতা ডন পেদ্রোকে ডেট করছিল ইদানীং। কে জানে হয়তো সেই জন্যেই মরল ছেলেটা। গীতার পুরোনো বয়ফ্রেন্ড ভয়ানক হিংসুটে। এরা কথায় কথায় একেবারে খুন করে ফেলে। রক্ত দর্শন করতে চাওয়া তো মুখের কথা।’

‘চলো বাপি, বেরিয়ে পড়ি। এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।’

‘কেন? পড়াতে আসবে না এখানে? পাবলোর নেমন্তন্নে? ক্যাম্পাস-পোয়েট? এতেই কাবু?’

‘ঠাট্টা করছ?’

‘ঠাট্টা নয়। এ এক অদ্ভুত জগৎ নবনীতাদি। একদিন আমিই তো খুন হয়ে যাচ্ছিলুম আর একটু হলেই।’

‘সে কি রে? কার-সঙ্গে ডেট করতে গেছলি আবার?’

‘সে সব নয়। ডেট-ফেট-এর ব্যপারই নয়। চলো যেতে যেতে বলছি। কাছে-পিঠে যে-কোনও একটা দোকানেই খেয়ে নিই বরং। কেমন? সন্ধের পর এ পাড়াটা এমনিতেই নিরাপদ নয়। তায় একটু আগেই একটা খুন হয়ে গেছে।—আজ খুব টেনশন থাকবে রাস্তায়। দেরি করা উচিত হবে না। নাকি ও পাড়ায় চলেই যাব আগে? গিয়ে ডিনার খাব? ভালো একটা কোনও দোকানে, ঠান্ডা জায়গায় গিয়ে একটু বসবে?’

‘আমার তো এখানেই ইচ্ছে। পুয়ের্তোরিকান পাড়ায় একটু হাঁটব না? খাবার দোকানগুলো কেমন একটু দেখব না? ভালো দোকানে তো ঢের খেয়েছি।’

‘তোমার যদি ভয় না করে তো ঠিক আছে।’

‘ভয়ের সত্যি কিছু আছে কি? আমরা তো কোনও গ্যাং-এই নেই। এসব যুদ্ধ বিগ্রহে বাইরের লোকের ভয় নেই, যদি না বোমা টোমা বেমক্কা ফেটে যায়।’

‘না: বোমার তেমন চল নেই, এ অঞ্চলের ফেবারিট হল ছুরি মারা। পিস্তল কেনারও পয়সা নেই কিনা। কিন্তু, সত্যিই তোমার ভয় করছে না? খুন হয়েছে জেনেও এ পাড়ায় খাবে? আশ্চর্য মেয়ে তো?’

‘আশ্চর্য হচ্ছ কেন? কলকাতায় কি খুন হয় না? সেখানেও পাড়ায় পাড়ায় খুন হচ্ছে। বরং আরও বেশিরকম বিপজ্জনক—যখন তখন বোমা ছুড়বে, যাকে তাকে এলোপাথাড়ি মেরে ফেলবে। লক্ষ্য স্থির করতে পারে না কেউ। ট্রামের ভিতরে, বাসের ভেতরে বসেও রক্ষে নেই। পুলিশের গুলি এসে লাগবে, গুণ্ডার বোমা এসে লাগবে। শত্রুরা ভিড়ের বাসে উঠে এসে ছুরি মেরে যাবে। কেউ বাধা দেবে না। তুমি জানো না বাপি, এ পাড়া তো সেই তুলনায় নন্দনকানন। কেউ ছুটে এসে ছোরা মারবে না, আমাকে। বড়জোর ব্যাগটা ছিনিয়ে নেবে। সে তো কলকাতাতেও নিচ্ছে হরদম। কিন্তু তুমি কেন খুন হয়ে যাচ্ছিলে বললে না তো?’

‘বলব। চলো আগে খেতে বসিগে। আশ্চর্য জাত একটা বটে এরা। কী জানি, হয়তো খাস পুয়ের্তোরিকোতে এরকম নয়। এখানে এসে এত ধরনের সামাজিক অর্থনৈতিক চাপে কষ্ট পেতে পেতে এদের মনগুলো সব অষ্টাবক্র হয়ে যায়। সেই সব ট্যাড়া বাঁকা রুগ্ন মনের ছাত্রদের নিয়েই আমার কারবার। মির্না যেমন সাইকলজিস্ট, তেমনি কলেজের সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন, অ্যাডভাইজ করেন, কেরিয়ার কাউন্সিলর আছেন,—ওদের গড়ে পিটে নতুন জীবনের সুযোগ করে দেবার চেষ্টা করি সবাই মিলে। এই জন্যেই কলেজটা এ পাড়ায় রেখে দিয়েছি আমরা—ম্যানহাটনে কেনা প্রসাদ বাড়িতে যাইনি। ”সাইটে” থাকাটা জরুরি। পাড়ায় একটা প্রভাব পড়েই শেষ পর্যন্ত।…অন্তত, তাই আমাদের আশা—একদিন প্রভাব পড়বে।’

একটা অত্যন্ত নোংরা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছি। সব দোকানেই ঝাঁপ পড়ে গিয়েছে। রাস্তাটাকে এমনিতেই যুদ্ধক্ষেত্রের মতো দেখায়, এখন আরও দেখাচ্ছে। রাস্তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট জোট বেঁধে দল পাকিয়ে ছেলেরা দাঁড়িয়ে। নেহাত বালক-বালিকা, টলটলায়মান শিশুও অভিভাবকবিহীন রাস্তায় খেলছে। মানুষের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা এখানে সত্যি কম। কেবল ভ্যান, টেম্পো জাতীয় মালবাহী গাড়ি। সত্যি বড্ড গরিব পাড়া। নইলে নিউইর্যক শহরে কেউ এভাবে রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয় চাপা না-পড়ে? হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে এমন চেহারার ৫/৬ তলা বাড়িগুলির দোরগোড়ায় দল পাকিয়ে গুলতানি করছে ফ্রিস্কুল স্ট্রিটের রিকশায় বসা খুব গরিব অ্যাংলো-মেয়েদের মতো চেহারার গেরস্ত গিন্নিরা। এরা বেশ্যা নয় বলেই মনে হয়, খুব সাদাসিধে, সাজসজ্জা নেই একদম। দারিদ্র্য, মালিন্য, রুক্ষতা ও শ্রীহীনতা সর্বশরীরে ফুটে আছে—চুলে চিরুনি পড়ে না। ক্লান্তি আর তিক্ততা যৌবনকে ছাপিয়ে উপছে উঠেছে এদের মুখে। ট্যাঁকে কচি কাঁচা। ঠিক দেশের মতন।

মোড়ের একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকান থেকে প্রচণ্ড জোরে মাইক্রোফোনে দ্রুত লয়ের স্প্যনিশ গান বাজছে। বন্ধ দোকানের দরজার সামনে দুটি বালক-বালিকা। বছর বারো-তেরোর বেশি হবে না। মেয়েটি কিন্তু পুয়ের্তোরিকান নয়। স্পষ্টতই ব্ল্যাক। মাথা থেকে গোটা পঁচিশেক কেঁচোর মতো সরু সরু লিকলিকে বিনুনি ঝুলছে—আর প্রত্যেকটার শেষে তিন-চারটে করে রঙিন পুঁতি গাঁথা! মাথাটা দেখাচ্ছে ঠিক মেড্যুসার মতো (শত নাগিনীর ফণা যেন চুল হয়ে আছে মাথায়)—কিন্তু মুখে আশ্চর্য একটা ধবধবে হাসি নিয়ে মেয়েটি আপন মনে গানের ছন্দে ছন্দে নেচে যাচ্ছে। ফরসাটে বাচ্চা ছেলেটা মাথায় মাথায় ওর সমানই হবে। ঠিক আমাদের দেশের ছেলের মতোই দেখতে। সে-ও খুব সুন্দর নাচছে নিজের মতো করে, গানের তালে তালে। দর্শক নেই, কিন্তু নাচিয়েরা মশগুল। আনন্দের প্রতিমূর্তি।

আজই এই রাস্তায় খুন হয়ে গেছে একটু আগে। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।

বাপি কনুই ধরে টানে—’চলে এসো।’

‘কী সুন্দর।’

‘কী সরল কৈশোর। নিষ্পাপ, নির্ভার।’

‘কে বলেছে? সরল? জানলে কী করে, যে ড্রাগ খেয়ে নেই? নাচের ধরন দেখে তো মনে হচ্ছে না ওটা ঠিক স্বাভাবিক। মেয়েটার চোখ দেখেছ?’

সত্যিই তো। যেন শিবনেত্র হয়ে আছে! এত সুন্দর নাচ তবে মনের আনন্দে নয়, ড্রাগের ঘোরে?

ড্রাগ পায় কোথায় অতটুকু বাচ্চা? এদের মা-বাপ নেই? ‘হাসিও না। পায় কোথায় মানে? এরা নিজেরাই হয়তো পেডলার। আর বাপ-মা? থাকা-না-থাকায় তফাত নেই। এখানে ওসব কৈশোর-ফইশোর নেই নবনীতাদি। কেবল মানি অ্যান্ড সেকস। ছোট্ট বাচ্চাও এটা শিখে যায়। চলো চলো দোকানটা এসে গেছে। এখানেই আমরা আগে লাঞ্চ করতুম। কমনরুমটা হওয়ার আগে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *