অন্যদ্বীপ – ৭

সাত

এর চেয়ে অবাক আর কিছুতেই হতুম না! এ যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কেও হার মানায়। তার একতলায় গামছা বিক্রি হয় বলে কত না হাসহাসি শুনতে হয়েছে। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। আমরা ছোটোবেলায় দেখতে পেয়েছিলুম সেনেট হলের সেই সাদা থাম সাজানো গ্রিক প্যাটার্নের দালান। কিন্তু এ কী! আমেরিকায় গত বিশ বাইশ বছর ধরে একটা নিছক ভালো জিনিস দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোও অবস্থাপন্ন। অঢেল তাদের অর্থ। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক্যাম্পাস তৈরি করতে ভালোবাসে। শহরের বুকে তা সর্বদা সম্ভব না হলেও বিরাট বিরাট প্রাসাদ অট্টালিকার সদর্প অহংকারে বাগদেবীর বেদিস্থাপনা হয়।

কিন্তু এটা যে নেহাত কলকাতার সস্তা সেলুনের মতো দেখতে একটা সুইংডোর! হায়রে পুয়ের্তোরিকান আমেরিকান! এতই দরিদ্র তুমি? এত হাঘরে? সামনে খাড়া, সরু, ধুলোময়লা ভরা কার্পেটবিহীন একটু সিঁড়ি উঠেই তার মুখে আবার একটি দরজা। কাচের, বন্ধ, প্রাইভেট ফ্ল্যাটের মতো এনট্রেন্স। এ আবার কেমন ধারা কলেজ? প্রবেশদ্বার দেখেই ঘাবড়ে গেছি।

‘এখন তোমার ক্লাস আছে নাকি, পাবলো?’

‘না:, একটা মিটিং ছিল, কিন্তু ক্যানসেল করে দেব ভাবছি তোমার অনারে।’

‘মিটিং ক্যানসেল করে দেবে? সে-ও কি সম্ভব?’

আমি বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়েছি দেখে পাবলো হালকা হাসে, ‘কেন, অসম্ভব কেন? মিটিং মানুষের জন্য, না মানুষ মিটিং-এর জন্য?

‘আমরা এখানে বুরোক্র্যাসির দাসত্ব করি না।’

আমি তবুও হতভম্ব।

‘কিন্তু মিটিং-এর অন্য সদস্যরা?’

‘আজ তোমাকে নিয়েই মিটিং হবে। আমাদের অফিশিয়াল সমস্যা তো কালও থাকবে, কিন্তু তুমি তো কাল থাকবে না।’ সহজ কথাটি সহজে বলে ফেলে পাবলো। ঘরে ঢুকে আমি আরও অবাক। কলকাতায় প্রাইভেট কলেজগুলোরও এর চেয়ে ঢের ভালো চেহারা। এ যেন একটা টিউটোরিয়াল হোম! অবাক হচ্ছো? না? এরকম কলেজ আগে দ্যাখোনি বোধ হয়? অর্ন্তযামীর ভঙ্গিতে বলে ওঠে পাবলো, পকেট থেকে চাবি বের করে নিজের অফিসের দরজা খুলতে খুলতে, ‘একটা অ্যাটিক ভাড়া নিয়ে কলেজটা শুরু হয়। একটা চিলে কুঠুরিতে। এখন তবু তো চিলেকুঠুরি ছেড়ে পুরো বাড়িটায় ছড়িয়ে পড়েছি। এবার পুরো শহরে ছড়াব। দ্যাখো না কী করি! এ বাড়িটার বিভিন্ন অংশে ক্লাস হয়। অ্যাডমিশন অফিসটা হচ্ছে বেসমেন্টে। দোতলা, তিনতলা আর বেসমেন্ট। একতলাটা দোকানদারদের ভাড়া। নইলে টাকা রোজগার হবে কেমন করে? ও:! ম্যানহাটনেও অট্টালিকা কিনে ফেলেছি আমরা। উঁহু, অত ঘাবড়িও না, একেবারে খাঁটি কথা বলছি। ওয়াশিংটন স্কোয়ারের খুব কাছেই, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির খাস পাড়াতেই, আমাদের চমৎকার নিজস্ব প্রাসাদ আছে। এগোচ্ছি, ম্যাডাম, এগোচ্ছি। মার্কিন এস্টাবলিশমেন্ট অনুযায়ী সবই হবে আস্তে আস্তে। অর্থাভাব এখন আর প্রায় নেই আমাদের। অভাব কর্মীর।’

একটা চেয়ার ঠেলে দেয় আমার দিকে পাবলো। ছোট্ট ঘরটার এদিক-ওদিকে কয়েকটা চেয়ার ছড়ানো। একপাশে একটা বেশ বড় টেবিল। তাতে টেলিফোন। কিছু কাগজপত্র। কাচের দেওয়ালের বাইরে হলে অবশ্য দু-একজন সেক্রেটারি গোছের মেয়ে ডেস্কে বসে আছে। টাইপরাইটার সামনে নিয়ে গল্পগুজব করছে। আপাতত তারা কথা বন্ধ করে অবাক চোখে আমাকে দেখায় মনোনিবেশ করল।

‘অনেক ডোনেশন পেয়েছি। আরও পাচ্ছি। সাত-আট জন ছাত্র নিয়ে কলেজ শুরু হয়েছিল, এখন দুশোর বেশি ছাত্র-ছাত্রী। প্রত্যেককেই অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়। লোন স্কলারশিপ, বুকগ্রান্ট ফেলোশিপ, অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ—সবরকমই আছে।’

আমার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে পাবলো টেবিলের কাগজপত্র ঘাঁটছে, চিঠিপত্র খুলছে, আর চতুর্দিকে ‘হ্যালো’ ছুড়ে দিচ্ছে,

‘হাই, কার্লোস! হাই গীতা! হাই হুয়ান! হাই লীনা! হেল্লো নীতা!’

আমি আর থাকতে পারি না।

‘নীতা? নীতাও আছে?’

‘তোমাদের এখানে এত ভারতীয় নামের ছড়াছড়ি কেন?’

‘দেখতেই পাচ্ছি মেয়েগুলি ভারতীয় নয়। অথচ শুনতে পাচ্ছি স্পষ্ট ভারতীয় নাম।’

পাবলো প্রশ্নটাই বুঝতে পারে না।

‘তার মানে? ভারতীয় নাম আবার কোথায় পেলে?’

‘এই যে গীতা, লীনা, নীতা, সবই তো বাঙালি মেয়ের নাম। সবই খুব চেনা আমার।’

হো-হো করে হেসে উঠে পাবলো। বলে,

‘বা: বেশ মজা তো? বাঙালি মেয়েদের এরকম স্প্যানিশ নাম থাকে নাকি? এগুলো সবই তো স্প্যানিশ ডাকনাম।’

‘গীতার পুরো নাম ওলগীতা, ওলগার আদুরে সংস্করণ। লীনার নাম মালীনা, নীতার নাম হুয়ানীতা।…হাই, রিনা!’

‘রিনাও!’ এবারে হাততালি বাজিয়ে ফেলি।

পাবলো বলে, ‘ইরিনা! ইরিনার ডাকনাম।’

আমি মনে মনে বলি, ‘ভালো মজা! ছেলেদের নাম কি তবে বুড়ো, বাচ্চু, খোঁকা, বাবুল?’

পাশাপাশি তিনটে দরজায় তিনটে প্লাস্টিকের নেমপ্লেট। মির্না গনজালেস, পাবলো গিয়েন, আর ডক্টর এস সেনগুপ্ত!

‘সেনগুপ্ত? এ-ও কি তোমাদের স্প্যানিশ ডাকনাম নাকি?’

পাবলো অট্টহেসে ওঠে। ‘না-না, ওই তো, ওর কথা বললুম না তখন? আমাদের ভারতীয় সহকর্মী। ইংরেজি বিভাগের চার্জে। এটাই তার অফিস। মির্না, সেনগুপ্ত এসেছে? এখনও আসেনি? আসবে এইবার। মিটিং আছে। এ হল মির্না, দেখে নাও, খাস পুয়ের্তোরিকোর মেয়ে। ওখানেই এমএ করে এখন কলাম্বিয়ায় পিএইচডি করতে এসেছে। ওর স্বামীও পিএইচডি করছে, কর্নেলে।’

মির্না হেসে নড করে। কী মিষ্টি মুখখানা, শ্যামলা শ্রীময়ী। বড় বড় হরিণচোখ ঘেঁষে গুচ্ছ গুচ্ছ কালো চুল ঘাড়ে লুটোচ্ছে। ওই হালকা প্রিন্টেড ফ্রকের চেয়ে টাঙ্গাইল শাড়িতেই ওকে বেশি মানাত। নিজের ঘরে ডেস্কে বসে খাতা দেখছিল। দরজা খুলে রেখে অফিসে বসাটা এদেশে বড় একটা দেখা যায় না। এটা বোঝাই যাচ্ছে, গরম দেশের অভ্যেস!

‘তুমি কী পড়াও মির্না?’

‘আমার বিষয় মনস্তত্ব!’ বলেই মিষ্টি হাসল মির্না। গালে টোল পড়ল।

‘তুমি কি এখানেই থাকো?’

‘না, ওর দেশ কলকাতা। নোবোনীটা একজন ভারতীয় কবি।’ পাবলো সগৌরবে আমার পরিচয় দেয়। আমার নামটা যে কতরকম বিশ্রীভাবেই উচ্চারণ করা যায়! ‘পিকাসোর কাছ থেকে অতি কষ্টে ধরে এনেছি। কালই কলকাতায় চলে যাচ্ছে!’

‘তাই নাকি? সেই কলকাতা থেকে এসেছ এগজিবিশন দেখতে? কেমন দেখলে পাবলোর নেম সেক-এক ছবি? পাবলো তো হপ্তায় হপ্তায় ছুটছে পাগলের মত।’

‘সত্যি! শেষ করা যায়নি। অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা!’

‘আরে এটা তো হবেই! খাস ইস্পানি ঐতিহ্য বাপু। হুঁ-হুঁ, মার্কিনির মতো হালকা নয়।’ পাবলো ফোড়ন কাটে, ‘আমাদের কবি গেল কোথায়? হুয়ান? আমাদের শ্রেষ্ঠ ছাত্র হুয়ান কিন্তু ভালো কবিও। স্প্যানিশে কবিতা লেখে। বেং অতুলনীয় কুস্তি করে।

‘কী?’ আমার অবাক হওয়ার ধরনে মির্না-পাবলো দুজনেই খুব জোরে হেসে ওঠে, ‘কেন, কুস্তিগিরের কবিতা লেখা বারণ? কবিতা লেখা মানেই তো একরকমের কুস্তি করা। ভাষার সঙ্গে কুস্তি!’

‘হুয়ান! হু-য়ান? এদিকে এসো।’

একটি ছেলে প্রায় দৌড়ে চলে আসে। এরও পোশাক-আশাক নেহাত ক্যাজুয়াল। পরনে সাদা গেঞ্জি, তাতে স্প্যানিশ ভাষায় কী সব লেখা নীল-নীল হরফে। গেঞ্জির তলায় মাংসপেশির দাপট ফুটে বেরুচ্ছে। শালপ্রাংশু নয়, কিন্তু বৃষস্কন্ধ মহাভুজ বটে। দেহ প্রকাণ্ড, মুখটি নেহাত কচি। বয়স আন্দাজ করা শক্ত।

‘এই যে আমাদের ক্যাম্পাস-পোয়েট, চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগির, এবং মহান সবজি-বিক্রেতা, ব্রুকলিনের গৌরব শ্রীমান হুয়ান কার্লোস। আমাদের প্রিয় ছাত্র। ভারতীয় কবি, নোবোনীটা সেন।’

লাজুক হেসে, অল্প ‘বাও’ করে হুয়ান ‘হাই’ বলল। তারপরই স্প্যানিশে গুজ-গুজ করে কী যেন মন্তব্য করল মির্নার কাছে। মির্না আর পাবলো হেসে-হেসে বেশ উপভোগ করল সেই মন্তব্য। আমার খুব রাগ হল। কী অসভ্যতা! কারুর নামে অন্য ভাষায় তার সামনেই মন্তব্য করে, আবার হাসাহাসি করছে! সাধে আর আমরা তৃতীয় বিশ্ববাসীরা ‘অপরিণত’ এই নামে অভিহিত হই! কস্মিনকালেও রাগ পুষে রাখার স্বভাব নয় আমার। তাই রেগে-মেগে বলেই ফেলি,

‘যে ভাষাটা আমি জানি না, রসিকতা কি সেই ভাষায় করা উচিত হল?

‘রসিকতা?’ মির্না বড়-বড় চোখে অবাক হয়,

‘রসিকতা নয় তো এটা, অন্য কথা। কবি ঠিক কবির যোগ্য মন্তব্যই করেছে। কই আমরাও তো এটা বলতে পারতুম? পাবলো, তুমি শিল্পী হয়েও হেরে গেলে।’

‘আমারও আসলে মনে হয়েছিল ঠিক এই কথাটাই।’ পাবলো নির্বিবাদে মেনে নেয়, ‘হুয়ান বলে ফেলেছে। তাই ও ক্রেডিট পাচ্ছে।’

‘ব্যাপারটা কি? আমি যে কিছুই বুঝছি না? কী বলাবলি করছ তোমরা? কীসের ক্রেডিট?’

‘বলো না, হুয়ান, বলে দাও না।’ বলতে-বলতে পাবলো নিজেই বলে দেয়, ‘হুয়ান বলছে তোমার নাম যে রেখেছে, সে ভুল রেখেছে। নো-বোনিটা নয়, শুধু বোনিটা হলে ঠিক হত। স্প্যানিশে বোনিটা মানে সুন্দরী। সেটাকে নেগেটিভ করে নাম দেওয়া ঠিক হয়নি। আমিও তাই বলি।’

হায়রে ভাগ্যচক্র! শাড়ি পরে ব্রুকলিনে এসে আমিও নাকি সুন্দরী! ভাগ্যিস ঢাকার কুট্টিরা কথাটা শুনতে পায়নি! তাহলে ঠিক বলত, ঘোড়ায় হাসবে। কিন্তু ব্যাপারটাকে গুরুত্ব আর না-দিতে, মুখে বলি, ‘সর্বনাশ! জানো আমার নাম কে দিয়েছেন? তিনি ত্রিকালজ্ঞ মহাকবি রবীন্দ্রনাথ ‘টাগোরে’, বুঝেছ? মৃত্যুর পূর্বে এটাই তাঁর মহত্তম কীর্তি। ‘তাগোরে? তুমি তাঁকে চিনতে?’ পাবলো, মির্না, হুয়ানের গলার স্বরে বিস্ময়ের ঘূর্ণি উঠে যায়।

‘আমি আর চিনব কেমন ক’রে, তিনি আমাকে চিনতেন।’

‘কিন্তু তিনি তো বহুদিন আগে মারা গেছেন…।’ হুয়ান অস্পষ্ট বিস্ময়ে বলে।

‘আমিও ততদিন জন্মে গেছি। সেও তো বহুদিন হল।’

‘তা, হুয়ান, তুমিও কি মির্নার মতন পুয়ের্তোরিকোতে জন্মেছ?’ তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গন্তরে যেতে চেষ্টা করি, কেন না এই অনেককাল আগে জন্মানোর বিষয়টি একদম আমার পছন্দ হয় না।

‘না, না, এই তো এই ব্রুকলিনে। আমার বাবার এপাড়ায় ত্রিশবছরের সবজির ব্যাবসা। আজন্ম এই পাড়ারই ছেলে আমি।’

‘তাহলে তুমি স্প্যানিশে কবিতা লেখো কেমন করে? এখানে ভাষা তো ইংরিজি।’ ‘কেন, বাবা-মা বাড়িতে তো স্প্যানিশই বলেন? কাকা-মামারা পুয়ের্তোরিকো থেকে আসেন, চিঠিপত্র আসে স্প্যানিশে। তা ছাড়া আমিও মাঝে বেশ কিছুদিন ঠাকুরদা-ঠাকুমার কাছে গিয়ে পুয়ের্তোরিকোয় ছিলাম। এপাড়ার রাস্তায় ছেলেরা খেলতে খেলতেও স্প্যানিশ বলে। ছোট থেকেই দুটো ভাষা শিখে ফেলি আমরা।’ মির্না যোগ দিল, ‘এপাড়াটাই দ্বিভাষী পাড়া। মার্কিনি এথনিক গ্রুপগুলো ইদানীং খুবই আত্মসচেতন সাংস্কৃতিক শিকড়-সচেতন হয়ে উঠেছে। আগে যেমন চেষ্টা ছিল মূলের সংস্কৃতি মুছে ফেলে পুরোপুরি সংখ্যাগুরু সংস্কৃতি অর্থাৎ হোয়াইট অ্যাংলোস্যাক্সন প্রাোটেস্টান্ট চেহারা ধারণ করবার, এখন সেটা আর নেই।’ ‘তবে নিউইয়র্কে চিরটাকালই এথনিক গ্রুপগুলো আত্মসচেতন হয়ে ঘেটো বানিয়ে থেকেছে। এতেই বল-ভরসা পাই আমরা, সংখ্যালঘুরা। দল বেঁধে থাকলে, নিজের মূল-সংস্কৃতির পরিচয়টা আঁকড়ে থাকলে অন্তত নিজেদের কাছে নিজেরা মূল্যবান হয়ে ওঠা যায়। বহি:সমাজে যতই অবহেলা পাই না কেন।’

পাবলো বেশ জোর দিয়ে বলে, তা ছাড়া আমাদের ইস্পানিদের কথাটা আলাদা। স্প্যানিশ ঐতিহ্যই তো মার্কিনি মাটিতে প্রথম ইওরোপীয় সংস্কৃতি। তাই না? এই হঠাৎ নবাব অ্যাংলোস্যাক্সন সভ্যতার আর ক-দিন বয়স এ-দেশে? আমরা এসেছি সেই কবে! ইংল্যান্ডের গরিব দু:খীদের নিয়ে ‘মেফ্লোওয়ার’ জাহাজ এসে স্পেনের কূলে ভেড়বার বহুদিন আগে। ‘আমেরিকা নামটাই দ্যাখো না? ওটা কি ইংরিজি ঐতিহ্য থেকে পাওয়া? আমেরিগো ভেসপুচ্চি কি হোয়াইট অ্যাংলোস্যাক্সন প্রাোটেস্টান্ট ছিলেন? মার্কিনিদের এই রোয়াব সত্যি আমার সহ্য হয় না। ইস্পানি ঐতিহ্য কত পুরোনো, কত মহৎ! আমরা এসেছিলাম ব্যাবসা করতে, রাজত্ব করতে। খেতে না পেয়ে উদ্বাস্তু হতে নয়। ইংরেজদের মতো।’

আমি তো অবাক হয়ে পাবলোর বক্তৃতা শুনছি। সত্যই আগে এভাবে ভাবিনি। পুয়ের্তোরিকো কি মার্কিনি কলোনি?’ ভয়ে-ভয়ে মির্নাকে প্রশ্ন করি, সত্যি বলতে কি আমি কিন্তু ঠিক জানি না, ঠাহরও পাচ্ছি না, পুয়ের্তোরিকোর সঙ্গে মার্কিনিদের এই অর্থনৈতিক যোগাযোগটা কীসের?’

‘নামে ঠিক কলোনি আর নেই। আগে ছিল। তবে কাজে এখনও তাই বটে। পুয়ের্তোরিকো কি আজকের? মার্কিন দেশ গড়ে ওঠার ঢের আগে থেকেই পুয়ের্তোরিকোর অস্তিত্ব।’

‘জানো, চৌদ্দশো বিরানব্বইতে কলম্বাস আমাদের দ্বীপে নেমেছিলেন? তখন সেখানে আরাওয়াক ইন্ডিয়ানরা বসবাস করত। আর দ্বীপের নাম ছিল বরিনকুয়েন বা বরিকুয়া।’ মির্নার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পাবলোই বলতে শুরু করে দিয়েছে। বাপ রে, কে ওকে থামাবে?

‘ষোলো শতাব্দীতে ইস্পানিরা ও দ্বীপ দখল করে নেয়। বরিনকুয়েন নাম বদলে হয়ে যায় পোর্টোরিকো। দ্য রিচ পোর্ট। স্বর্ণবন্দর। ক্রমশ সেটাই পুয়ের্তোরিকো হয়েছে। বিপুল পৃথিবী-জোড়া ব্যাবসা-বাণিজ্য ছিল আমাদের। মানে পুয়ের্তোরিকোর। জানো তো, আমাদের কেমন উর্বরা শস্য দেশ? স্পেনের লোকেরা স্বপ্ন দেখত পুয়ের্তোরিকোয় এসে ভাগ্য ফেরানোর। হায় রে! ভাগ্য ফেরানোই বটে। যর্থার্থ কলোনিয়াল নিয়মমাফিক, স্থানীয় আদিবাসী আরাওয়াক ইন্ডিয়ানদের খতম করে ফেলে, তাদের দেশ দখল করে নিলুম আমরা। তারপর জাহাজ-জাহাজ কাফ্রি ক্রীতদাস আমদানি করলুম খেত-খামারে মজুরি করানোর জন্যে। ফলে আমরা পুয়ের্তোরিকানরা খানিক ইস্পানি, খানিক আরাওয়াক ইন্ডিয়ান, আরও খানিক কাফ্রি রক্তে গড়া।’

চটপট এখানে মির্না যোগ করে—’খানিক মার্কিনি বটে।’ আঠারোশো আটানব্বই তে স্প্যানিশ আমেরিকান যুদ্ধে হেরে গিয়ে মার্কিনদের কিছু রাজ্য ভেট দেওয়া হয় প্যারিস চুক্তিতে। তার মধ্যে এই আমরাও পড়েছি। পুয়ের্তোরিকো সেই থেকেই আমেরিকার সম্পত্তি। এখন কেবল শোষিত হবার জন্যেই যেন দ্বীপটা বেঁচে-বর্তে আছে আর কী।’

‘সত্যি বলতে কী মির্নার মতো আমরা ঠিক খাঁটি পুয়ের্তোরিকানও তো নই।’ এবার হুয়ান বলে। ‘মনেপ্রাণে পুয়ের্তোরিকান বটে, কিন্তু জন্মসূত্রে তো মার্কিনিই—অথচ এরাও আমাদের মার্কিনি ভাবে না, আমরাও নিজেদের মার্কিনি ভাবি না। চিরকালটা এখানে কাটিয়ে এখানে জন্মে, এখানে বেঁচে, এখানেই মরব—অথচ নামে থাকব পুয়ের্তোরিকান আমেরিকান। মির্নার মতো ভাগ্য আমাদের তো হয়নি। আমরা স্বদেশে ভূমিষ্ঠ হইনি। এই ব্রুকলিনই আমাদের জন্মভূমি।’

‘তুমি তো তবু ঠাকুর্দার কল্যাণে দেশ ঘুরে এসেছ হুয়ান।’ পাবলো বলে, ‘কিন্তু আমি তো দুর্ভাগা। কখনও দেশেই যেতে পারিনি। তেমন কেউ নেই সেখানে। যাব কার কাছে?’ তাড়াতাড়ি মির্না বলে, ‘তাতে কী হয়েছে? এবার একবার নিশ্চয়ই দেশে যাবে। নেকসট সামারেই চলে যাও। আমরা আছি।’

‘দেশ! যারা জীবনে কখনও সেদেশে পা দেয়নি তারাও ওটাকে স্বদেশ মনে করছে। যে-দেশ তোমাকে ধারণ করেছে, লালনপালন করছে, সে তোমার দেশ নয়? এ কেমন কথা? জন্মভূমিকে জননী মনে করো না তোমরা? এ হল প্রবাসভূমি—ধনী আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রিত থাকা।’ চতুর্দিকে স্প্যানিশ পোস্টার লটকানো, স্প্যানিশ বিজ্ঞাপনে সব দেওয়াল ঢাকা, ল্যাম্পপোস্টের গায়ে তার দিয়ে জড়িয়ে বাঁধা স্প্যানিশ ভাষায় পিজবোর্ডের হোডিং। পাবলো, হুয়ানের ইংরেজিতে মির্নার মতো লাতিন টানও নেই। অথচ ওরা কেমন নি:সঙ্কোচে বলছে, ‘স্প্যানিশই আমাদের মাতৃভাষা…।’ আর আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা? স্বদেশে বসেই কাঁচা কাঁচা ইংরিজি ভাষায় ন্যাকা-ন্যাকা কবিতা লেখে, ভাঙা ভাঙা বাংলায় আধো-আধো বুলি কপচায় আর ট্যাঁস ইস্কুলে গিয়ে ইংরিজিকে ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজ করে পরীক্ষা দেয়। আর এদের দ্যাখো, প্রবাসী হয়েও কেমন স্বদেশ-অন্ত প্রাণ?

‘তোমরা কী করে এমন স্প্যানিশ-ভক্ত রইলে ভেবে অবাক হচ্ছি।’

‘মাতৃভূমির অহংকার এমনই আশ্চর্য জিনিস।’ মির্না বলে, ‘এরা কেউ মাতৃভাষার গর্ব ছাড়েনি। অথচ এদেশে সেটা ঝেড়ে ফেলতে পারলেই কার্যত সবদিক থেকে উন্নতি হত। চাকরির সুবিধা, ভালো পাড়ায় বাড়ি পেতে সুবিধা, ছেলেপুলের জন্যে ভালো ইস্কুল, ভালো সঙ্গীসাথী, পরিচ্ছন্নতা।

‘খেলার সবুজ মাঠ। বসন্তের বাতাস। গাছ। ফুল।’ আমি মনে মনে যোগ করি।

‘শিক্ষিত ইস্পানিরা বড়লোক হয়ে গেলে, উচ্চমধ্যবিত্ত প্রফেশনে ঢুকে পড়লে, অনেকেই কিন্তু ব্রুকলিন ছেড়ে দেয়। গরিবপাড়ার মায়া কাটিয়ে ব্রংক্সে, পার্কচেস্টার অঞ্চলে উঠে যাওয়ার ঝোঁক হয়েছে আজকাল।’

‘ওটাই মনে হয় এবার ধনশালী পুয়ের্তোরিকানদের পল্লি হয়ে উঠবে?’

‘অনেকেই কিন্তু যাচ্ছেও না।’ পাবলো অনেকটা আপনমনেই আপত্তি করে, ‘সেধেই এই গরিবপাড়ায় আমি কিন্তু থেকে যেতেও দেখেছি, অনেককে। এটা কী কম? ভালয় মন্দয়, রক্তের মধ্যে এ-পাড়ার ইস্পানি জীবনছন্দ জড়িয়ে আছে। ছেড়ে যেতেও প্রাণ চায় না।’

এ অঞ্চলে তোমরাই বুঝি প্রথম বাস করতে শুরু করেছিলে?’

‘প্রথম? না:। প্রথম-প্রথম এটা ওলন্দাজ পাড়া ছিল। আগে এখানে দু-তিনটে ধনী ওলন্দাজ গ্রাম ছিল। ফ্ল্যাটবুশ, ব্রোয়কলেহেন। যা থেকে ব্রুকলিন নাম। কিন্তু এখন তো ওলন্দাজরা এ-পাড়ায় আর থাকেই না। তবে বর্তমান বাসিন্দা শুধু আমরাই নই, চিনে দেখছ না? ব্ল্যাক দেখছ না? এটা তো গরিব পাড়া, বিচিত্র মিশ্র ধরনের সংখ্যালঘুদের সমাবেশ হয় এখানে।’ ছেলেমানুষ হলেও হুয়ান দেখলুম নিজের পাড়া নিয়ে অনেক খবর রাখে। কুস্তিগির কবি, সাধারণ ব্যক্তি সে নয়।

—’হুয়ান তুমি কী ধরনের কবিতা লেখো? প্রেমের? রাজনীতির? দর্শনের? প্রকৃতির?

‘হুয়ান লেখে জীবনের কবিতা।’ হুয়ানের হয়ে পাবলোই উত্তর দেয়, ‘কিছু রাজনীতি, কিছু প্রেম। ব্যস। প্রকৃতি-ট্রকৃতি নেই। থাকবে কোথা থেকে? এ পাড়ায় তো শীত, গ্রীষ্ম এই দুই মাত্র ঋতু। বসন্ত, হেমন্ত যে কী বস্তু চিনিই না আমরা।’ সত্যি! এ-পাড়াটায় কোনও গাছ নেই। বাড়িগুলোতেও বাগান নেই। কলকাতা একন কৃষ্ণচূড়ায় ভরা। জারুল গাছে ফুলের রাশ। রাস্তায় বেল, জুঁই, রজনীগন্ধার পসরা। কোনও পার্কও চোখে পড়ল না। বাচ্চারা সব পিচের রাস্তায় খেলছে। তবে বাচ্চাদের খেলার জন্যে পার্ক নিশ্চয়ই আছে, মিউনিসিপ্যালিটির তৈরি। নিয়মিত দূরত্বে। ছাইরঙের ধানকলের মতো দেখতে, আপাদমস্তক সিমেন্ট বাঁধানো চত্বর। দোলনা আর ঢেঁকি লাগানো। পাইপের তৈরি গাছ বসানো। জেলখানার মতো নিরানন্দ। এই সব দরিদ্রপাড়ায় দায়সারা পার্কে গাছপালা নেই। গাছপালাওয়ালা সবুজ পার্ক ধনী পাড়ার শোভা ও সম্পত্তি। সুতরাং বসন্ত এবং হেমন্ত শুধু ধনীদের জন্যই বাঁধা।

‘ওই যে, দ্যাখো, ওই টেনেমেন্টস—ওখানেই আমরা থাকি।’ হুয়ান ঘোষণা করল, ‘আমাদের অবশ্য আলাদা টয়লেট আর কিচেনওলা অ্যাপার্টমেন্ট আছে—কিন্তু ওখানে বেশির ভাগেরই জোটে ভাগের কলঘর। আর শোবার ঘরেই রান্নাবান্না।’ আমাদের হতবাক দেখে পাবলো বললে, ‘এসব পাড়ার দারিদ্র্য তোমরা কল্পনা করতেও পারবে না। আমাদের হুয়ান তো বেশ অবস্থাপন্ন। কিছু ছাত্র আছে, তারা রাত্রে ঘরের মেঝেতে কাগজ বিছিয়ে শোয়। অনেকগুলো করে খবরের কাগজ আর ওই যে দোকানে শাকসবজি, ফলটলের কাগজের কার্টনগুলো আসে। সেই পিচবোর্ডের বাক্সগুলো ওরা কুড়িয়ে নেয়। ভেঙে, ভাঁজ করে, মেঝেয় পেতে, সপরিবারে ঘুমিয়ে থাকে ওরই ওপরে। খাট বলো খাট, বিছানা বলো বিছানা। সবই ওই বাক্স আর খবরের কাগজ। ভাবতে পারো? এই নিউইয়র্কে?’ ভাবতে সত্যিই পারি না।

‘শীতকালে? এখানে তো প্রচণ্ড শীত। শীতকালে ওরা কী করে?’ হুয়ান অদ্ভুত করে হাসল।

‘আগুন জ্বালে অনেক সময়ে মরেও যায়। কালো চামড়াওয়ালারা তো মার্কিন জাতি। ওদের নানা অধিকার আছে। আমরা তাও নই। আধা বিদেশি। না ঘরকা না ঘাটকা। যেমন আমাদের রাজনীতির অবস্থা, কংগ্রেসে প্রতিনিধি আছেন। কিন্তু প্রতীকী অস্তিত্ব মাত্র। কেন না তাঁর ভোট নেই। অথচ আমরা ভিয়েতনামে না গেলেই কিন্তু জেল!’ ‘এখানে প্রতি স্কোয়ার ফুটের হিসাবে গোটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি স্কোয়ার ফুটের যত লোকজন বাস করে, তার চেয়ে বেশি মানুষের বসবাস। সত্যি করে বলো, এই আমেরিকাকে কি তুমি জানতে?’

পাবলোর মুখের কথা কেড়ে নেয় মির্না, ‘এবং সেই মানুষগুলো সব অকেজো। তাদের কোনও কাজকর্ম নেই। এখানে যে এত ভায়োলেন্স, তার প্রধান কারণটাই হল অ্যাডাল্ট পুরুষ মানুষের বেকারত্ব। নেই কাজ তো খই ভাজ, লেগে পড়ো ক্রাইমের লাইনে। অলস পুরুষদের পৌরুষ দেখানোর সুযোগ হয় না বলেই তারা হিংস্র জন্তুর মতো হয়ে ওঠে।’

‘জন্তু কেন? এ সমস্যাটা একান্তই মানবিক!’ পাবলো চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আলস্যই বলো বা কর্মহীনতা, কিংবা অপরাধ এসব কেবলই মানুষের সম্পত্তি। কদাচ জন্তুদের সমস্যা নয়, মির্না! আসলে কী জানো, কোনটা, এই অঞ্চলের মূল সমস্যা কেবল একটাই—দারিদ্র্য। তার থেকেই বাকি সবগুলোর উৎপত্তি—এই এত রোগ, এই বুদ্ধিহীনতা।’

মির্না মাঝখান থেকে বলে, ‘জানো তো বোনিটা অত্যন্ত লো আইকিউ আমাদের এই পাড়ার গরিব ছেলেমেয়েদের। বাবা-মায়ের অশিক্ষার বুদ্ধির চর্চার অভাবই সেজন্য অনেকটা দায়ী। মনোবিজ্ঞান অন্তত তাই বলছে।’ মির্নার কথায় কান না-দিয়ে পাবলো পুরনো কথার খেই ধরে বলে ‘এই যে মাতলামি, এই অপরাধপ্রবণতা, খুনখারাপি কি চুরি ছিনতাই, ডোপ পেডলিং আর পিম্পগিরি, আর বেশ্যাবৃত্তি, এ পাড়াটা এমন কেন বলো তো? হার্লেমেও দেখবে এই জিনিস। সবাই অযত্নে ভেঙেফেলা বিনষ্ট জীবনের বিষফল। আমি অন্তত মনে করি না যে এই দুর্দশার দায়িত্ব প্রকৃতপক্ষে এই হতভাগাদের। দায়ী তো গোটা শহর, দায়ী গোটা আমেরিকার শোষকসমাজ।’

‘কিন্তু ঠিক এইরকম সমস্যা তো কলকাতাতেও আছে পাবলো। এটা কেবলই একা তোমাদের নয়। গরিব পুয়ের্তোরিকানদের জীবনযাত্রা এই ধনী সমাজের মধ্যে অবশ্য খুবই অস্বাভাবিক ঠেকে, সত্যি কথাই। কিন্তু মানুষের এই দুর্দশার দৃশ্য আমার শহর কলকাতায় নিতান্তই স্বাভাবিক। একবার কলকাতায় যেও, আমিও তোমাদের দেখাব আপন দেশ ভুঁয়ে বসে, স্বাধীন ভারতীয় নাগরিকদেরও জীবনে অবিকল এমনিই অমানুষিক যন্ত্রণা। আমাদের বস্তি, ঝোপড়ি ফুটপাথ—সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন—ও:! যদি সে দৈন্যের মুখ কোনওদিনও তোমরা দেখতে! শিশুর মুখে দু-বেলাই খাদ্য নেই, তোমরা এমন কখনও এখানে দেখেছ? রাস্তায় কুষ্ঠরোগী অষ্টাদশ শতকের পরে আর দেখেনি ইউরোপ। তোমাদের তো শেয়ার করার মতোও টয়লেট আছে, আমাদের ঝোপড়িতে তাও নেই। আমাদের গরিবদের শহরেও যে কষ্ট, গ্রামেও তাই। সর্বত্রই এই অবস্থা! দারিদ্র্যের ওপরে আবার উপরি যন্ত্রণা আছে, অস্পৃশ্যতা আছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পণপথা, নারী নির্যাতন। ভেব না কেবল মার্কিন দেশেই যত রাজ্যের সামাজিক রোগ, আমরাও ঠিক অতটাই খারাপ। বুঝলে পাবলো, এনশেন্ট কালচার হলে কী হবে, আমরা নিজেদের পায়ের তলার মাটিও চিনি না। রঙের কথা বলো? আমাদের ঘরের কালো মেয়ের বিয়ে হয় না, জানো? অনেক টাকার ঘুষ লাগে অর্থাৎ ‘ডাউরি’—অথচ আমরাই সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে সাদা-কালোর বিভেদ নিয়ে লড়াই করি। বিলেতে বসে গলা ফুলিয়ে অ্যাপারথেইড নিয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলি, ‘সাউথ আফ্রিকা নিপাত যাক।’ ‘কিংবা রোডেশিয়ার আম খাব না’—আরও কত কি। বড্ডই দ্বৈত মূল্যবোধের রোগে ভুগছি আমরা সবাই। জগৎশুদ্ধু শিক্ষিত মানুষরা সবাই একই নৌকোয় ডুবতে বসেছি।’

‘অমন ডুবলে তো চলবে না।’ পাবলো মাথা নাড়ে, আর নিশ্চিন্ত গলায় বলে, ‘ ভেসে উঠতেই হবে, আমাদের টেনে তুলতে হবে ডুবন্তদের। সাঁতার শেখাতে হবে।’ ঝলমলে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে পাবলো বলল, ‘মানুষের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা, এ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বোনিটা।’ মির্না আর হুয়ানের মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টি পাবলোর মুখে। ওদের চোখেও যেন আলোর ঝলক এসে পড়েছে পাবলোর থেকে। স্পষ্টতই ওরা স্বপ্ন দেখছে। পাবলো ওদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। এই কলেজটা তাহলে আসলে স্বপ্ন দেখতে শেখানোর কলেজ। ছাত্র শিক্ষক মিলেমিশে এরা এক নতুন জীবনের, নতুন জগতের স্বপ্ন দেখে—যার গোড়াপত্তন পুয়ের্তোরিকোয়।

আমারই কেবল কী যেন হয়েছে। এই দেশ, এখানকার আলো, আকাশ সব আমার কেমন ধাতব মনে হয়। এই বিলেত-আমেরিকার দামি ধুলোহীন যে পেট্রল মাখা ধোঁয়ার গন্ধ, দোকানে যে সিনথেটিক কাপড়ের থানের গন্ধ, রেস্তেরাঁয় যে মদ্য-মাংসের আয়েশি গন্ধ—এত বছর বাদেও সব কিছুই আমার কেমন অবাস্তব লাগে। এখানকার ঐশ্বর্যও যেহেতু আমার অবাস্তব মনে হয়, এখানকার দৈন্যও কি তাই আমার কাছে যথার্থ মূল্য পাচ্ছে না?’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *