ছয়
সত্যিই তো, এমন সুযোগ কি আর পাব পুয়ের্তোরিকান ঘেটোটা দেখার? কী হবে পার্টিতে গিয়ে, দেশোয়ালি ভাইদের সঙ্গে দিল্লি কলকাতা আর বোম্বাইয়ের হাঁড়ির খবর নিয়ে কথা বলে? বেগুনভাজা, মুরগির ঝোল আর ভাত খেয়ে? দূর…ঠিকই বলেছে পাবলো গিয়েন।
ফোনবুথ থেকে বেরিয়ে দুজনে মিলে চললুম সাবওয়ে স্টেশনের দিকে। ব্রুকলিনে যেতে হলে বাস নয়, সাবওয়ে ট্রেন ধরতে হবে। উরিব্বাবা! কী ভিড়! নিউইয়র্কের রাশ-আওয়ার শুরু হয়েছে। ট্রেনে তো উঠেও পড়লুম। ভিড়ের চাপে মাটিতে পা ঠেকল-কী-ঠেকল না কে জানে? ব্যাগ, আঁচল আর চশমা সামলাতেই প্রাণান্ত। তাও তো প্রচণ্ড গরম বলে শালটা নেই সঙ্গে। পাবলো ঠিক নজর রাখছে, কাছাকাছিই আছে, এক সময়ে ভিড় আমাদের একটা জানলার খুব কাছে এনে ফেলল। দেখি বাইরে দিনের আলো। এখন ট্রেন মাটির ওপর দিয়ে যাচ্ছে। একটা ব্রিজ পার হচ্ছি। পাবলো অস্থির হয়ে কী যেন বলতে লাগল। কিছুতেই শুনতে পেলুম না। ট্রেনের মধ্যে প্রচণ্ড আওয়াজ। আন্দাজ করলুম এই বোধহয় ব্রুকলিন ব্রিজ!
নিউইয়র্কের সাবওয়েগুলো দেখলে দেশটাকে গরিব ভিখিরির দেশ বলে মনে হবে। ইংলন্ডের স্টেশনগুলো কত ঝকঝকে-তকতকে, আধুনিক। কত পরিচ্ছন্ন, অনেক বেশি আলো ঝলমলে। এত প্রচণ্ড শব্দও তো হয় না সেখানে? এখন স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে। বাপরে! যেন একশোটা বোমা ফাটিয়ে পিলে চমকিয়ে! কর্ণপটাহ বিদারিত করে। প্যারিসের নতুন মেট্রো স্টেশনগুলো তো ইংল্যান্ডের আণ্ডার-গ্রাউণ্ডের চেয়েও ঢের সুন্দর এখন। ঠিক যেন কোন বিলাসীবাবুর বৈঠখানা। আমাদের শহরে ভূগর্ভ রেল কেমন হচ্ছে, কে জানে? এর চেয়ে ঢের বেশি দীনদরিদ্র চেহারার হবে, তা হোক। ভেঙে না পরে ছাদটা। আমাদের তো আবার গরিব দেশ। সিমেন্টের বদলে গঙ্গামাটি! শহর সুদ্ধু না তলিয়ে যায় ভূগর্ভ রেলের গর্ভে। সেতু পার হওয়ার সময়ে চোখে পড়ল একদিকে জাহাজ, বন্দর, জেটি। এটাই হয়তো ব্রুকলিন নেভাল ইয়ার্ড। অনেক শুনেছি এর কথা। খানিক পরেই চমকে উঠি। আমার হাত ধরে দূর থেকে ভিড়ের মধ্যে কে প্রাণপণে টানছে! পাবলো। এবার নামতে হবে কোনওরকমে তো ভীমভবানীর মতো মাসল ফুলিয়ে প্রচণ্ড মারামারি করতে-করতে প্রাণের দায়ে নেমে পড়লুম।…যাক, অবাক কাণ্ড!। ঝুলি, চশমা, হাত-পা, শাড়ি-টাড়ি সবই অক্ষত আছে।…কী আশ্চর্য স্টেশন! লোহার গারদ দেওয়া জেলখানার মতো দেখতে সরু প্ল্যাটফর্ম বেয়ে লোহার সিঁড়ি দিয়ে বেশ খানিকটা নীচে নেমে, দোতলা থেকে এক সময়ে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালুম।
এ কী? এ কোন শহর? কোথায় ছিল ব্রডওয়ে, লেক্সিংটন, টাইম স্কোয়ার, ম্যাডিসন, ফিফথ অ্যাভিনিউ—আর এটা? রাস্তাময় কাগজের টুকরো উড়ছে। ছেঁড়া ন্যাকড়া। ফলের খোসা। আইসক্রিমের কাঠি আর খুরি ছড়ানো। কোকাকোলার টিন গড়াচ্ছে। যেখানে-সেখানে কাদা। জল জমে ছোট-ছোট পুণ্যিপুকুর হয়ে আছে। অথচ বৃষ্টি হয়ে গেছে বলেও মনে হচ্ছে না ঠিক। জল ফেলেছে মানুষেই। ফুটপাথে সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়-চোপড়। বাসন-পত্তরের দোকানের সারি। কী সস্তা সব জিনিসের দর! আর কী খেলো, সস্তা চেহারার সব জিনিস! চতুর্দিকে যেন শাশ্বত সেল চলছে। তা ছাড়া একটা মেলাও যেন বসেছে, এমন দৃশ্য। ফুটপাথে খালি পা ছড়িয়ে বসে একটা কালো চুল বাদামি গা বাচ্চা মেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে। আহা, ওর কি কেউ নেই? বাচ্চাটাকে দেখতে ঠিক ভারতীয় বাচ্চাদের মতোই। পুয়ের্তোরিকানদের ভীষণ ভারতীয় ধরনের চেহারা। বাদামি চামড়া। আমাদের মতোই নরম কালো চুল, কালো চোখ। বিশেষত মেয়েদের মধ্যে একটা আলগা চটক আছে, দিশি-দিশি দেখায় আরও তাতেই। নয়পল যে বলেছিল, কলকাতা একটা বিরাট প্রস্রাবাগারের মতো। এখানেও গন্ধটা নেহাত অগ্রাহ্য করার মতো নয়।
রাস্তায় লাল-নীল রংদার বরফ-আইস বিক্রি হচ্ছে। সেই যেগুলো আমাদের দেশেও পাওয়া যায়। দু-আনার বরফ খেলেই জন্ডিস, টাইফয়েড কিংবা কলেরা। এখানেও খেলেই ওই একই ফল হবে বলে মনে হল। সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। ফলের খোসায় কাগজের ঠোঙায় যেন পা না পড়ে।
চারদিকে অন্যরকম মানুষ। ফুটপাথে টেবিল পেতে তাসখেলা হচ্ছে। সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে। বাচ্চারা রাস্তায় খেলছে। হঠাৎ পাবলো আবার আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান লাগাল। প্রায় হুমড়ি খেয়ে তার ঘাড়ে পড়ে যাই। জানলার ভিতর থেকে একটা আধখাওয়া কোকাকোলার টিন রাস্তায় এসে পড়ল, তরল পদার্থ ছড়াতে ছড়াতে। ঠনঠন শব্দে বাজনা বাজিয়ে সে রাস্তায় ওপারে রওনা হল, মধ্য পথে থেমে যাবে।
‘বার? হ্যাঁ, বার।’ ভিতর থেকে হা-হা অট্টহাসি ভেসে এল।
‘এই ব্রুকলিন?’
‘এই ব্রুকলিন। তোমার শাড়িতে লাগেনি তো? আমি দু:খিত।’
‘না:। লাগেনি।’
‘কেমন লাগছে? এই নিউইয়র্ক?’
‘আশ্চর্য!’
‘ভালো করিনি এখানে এনে তোমায়?’
‘খুব ভালো করেছ। খুব ভালো।’
‘আইসক্রিম খাবে? গরম হচ্ছে তোমার।’
‘না, না। ওরে বাবা।’
‘তোমার নাকে ঘাম।’
‘নাক আমার সর্বদা ঘেমেই আছে। ওর কথা ছেড়ে দাও।’
‘তোমার কপালে, গালে, ঘাম।’
‘আমি দু:খিত।’
‘ভয় করছে নাকি?’
‘দূর। ভয় করবে কেন?’
‘একটা কোকাকোলা খাবে? ঠান্ডা?’
‘তা বরং খেতে পারি।’
পথে ঠেলাগাড়ি থেকে হটডগ, হ্যাম্বার্গার বিক্রি হচ্ছে, বিক্রি হচ্ছে বাক্স থেকে আইসক্রিম-কোন, কোকাকোলা। পথের বাক্সওয়ালার কাছে একটা কোকাকোলার টিন কিনে, তাতে নল ভরে খেতে-খেতে রাস্তা দিয়ে হাঁটি। দেখলুম রাস্তা ভরতি মেয়েরা, নিগ্রো এবং পুয়ের্তোরিকান দুই-ই, খেতে খেতে দিব্যি পথ হাঁটছে। পাবলো কোকাকোলা খাচ্ছে না। ‘কোথায় তোমার কলেজ? আর কতদূর?’
‘ওই যে। সামনেই। এসে গেছি।’
রাস্তায় কতগুলি গুন্ডা-মস্তান টাইপ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে। রাস্তা জুড়ে। আমাদের দেখেও পথ ছাড়ল না। প্রত্যেকের হাতেই খবরের কাগজে মোড়া মোড়া কী সব টিন। টিনেই মুখ দিয়ে মাঝে মাঝে পান করছে। পরনে গেঞ্জি, গলায় সরু চেন, হাতেও চওড়া চেন, মুখে অবিশ্বাসের আর ঘৃণার ছাপ। একটুও না নড়ে তারা আমাদের নিরীক্ষণ করতে থাকে। এরা কারা? কী খাচ্ছে? মুখে কিন্তু প্রশ্নটা করি না। পাবলো তো বাংলা জানে না। এবং এরা তো ইংরিজি বোঝে। ওদেরই ফুটপাথ ছেড়ে দিয়ে, আমরা রাস্তায় নেমে এসে আবার ফুটপাথে উঠি। আপনিই হাতটা গলায় চলে আসে। যাক, হারটা ছিনতাই হয়নি। এবার ফিসফিস করে প্রশ্ন করি, ‘এরা সব কারা, পাবলো?’
‘কেন? এ পাড়ার বাসিন্দারা। এদেরই কেউ কেউ ভবিষ্যতে আমাদের ছাত্র হবে আশা করছি। এরা ছাত্রদেরই আত্মীয়স্বজন আর কি।’
‘এরকম ছাত্র?’ ভয়ে-ভয়ে বলি।
‘আবার কী? পথভ্রষ্টদের জন্যই এই কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা, পুয়ের্তোরিকানদের অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, অপরাধপ্রবণতা, আর অপসংস্কৃতি থেকে উদ্ধারের জন্যই তো এই কলেজ। একরকমের সোশ্যাল ওয়ার্কও বলতে পারো। কেরিয়ার কাউনসেলিংও হয়। মাস্টারদের খুব ধৈর্য লাগে। আমাদের একজন তো খুনই হয়ে যাচ্ছিল টিউটোরিয়াল ক্লাসে। এক প্রাোফেসর।’
‘খুন? খুন হয়ে যাচ্ছিল? কার হাতে?’
‘আবার কার? এক ছাত্রের হাতে!…কী? চলে আসবে নাকি আমাদের কলেজে? ইন্ডিয়া থেকে? কোর্সেস ইন ইন্ডিয়ান কালচার পড়াবে? টাগোর পড়াবে? রেসিডেন্ট পোয়েট হয়ে থাকবে? ভেবে দ্যাখো। আমরা লোক নিচ্ছি কিন্তু। উই আর একসপ্যানডিং। থিংক অ্যাবাউট ইট!’ দুষ্টু-দুষ্টু হাসিতে সোনার দাঁতটা ঝকঝক করে ওঠে। এপাশে হাওড়া হাট জাতীয় জামাকাপড়ের দোকান। ফুটপাথে আলনা সাজিয়ে চেঁচিয়ে দর হাঁকছে ব্যাপারী। ওপাশে দাগি ফলের, সস্তা, সবজিপাতির মাঝখানে একটা ছোট দরজা। সেটা ঠেলে পাবলো বলে, ‘এসো। এই আমাদের কলেজ।’ মোড়ে হরিসংকীর্তনের মতো ব্যান্ড বাজাচ্ছেন ধড়াচুড়োপরা স্যালভেশন আর্মির বৃদ্ধরা। ‘স্যালিজ।’ ওদের দিকে চেয়ে ঠাট্টা করে হাসল—পাবলো ‘গরিবদের তবু কিছু সাহায্য করে অবিশ্যি ওরা!’