অন্যদ্বীপ – ৫

পাঁচ

চা খেতে খেতে জানতে পেরেছি নিউইয়র্কে প্রধানত দরিদ্র পুয়ের্তোরিকানদের জন্য একটা নতুন কলেজ হয়েছে। ‘বরিনকুয়েন কলেজ।’ কারিগরি বিদ্যা, কমার্স এবং কলা বিভাগ আছে। দ্বিভাষিক কলেজ। ইংরিজি ও স্প্যানিশ দুটোতেই শিক্ষা চলে। এটাই তার নতুনত্ব। পাবলো গিয়েন নিজে শিল্পী, সে ওই কলেজে অধ্যাপনা করে কমার্শিয়াল আর্টের। পাবলো বলল, ‘আমি তো যাব এখন কলেজে। জানো, আমাদের একজন ইয়াং ইন্ডিয়ান কলিগ রয়েছে? ইংরিজি বিভাগের চার্জে। কাজেকর্মে খুবই উৎসাহী ছেলে। আমাদের কলেজের একমাত্র পিএইচডি সেই রেকটরকে বাদ দিলে। আমাদের রেকটরও পিএইচডি, এবং খোদ পুয়ের্তোরিকান। চমৎকার মানুষ। তাঁর চেষ্টাতেই কলেজটা গড়ে উঠেছে।’

মাত্র দুজন পিএইচডি-ওলা অধ্যাপক নিয়ে নিউইয়র্ক শহরে একটা মার্কিন কলেজ চলছে! এ-ও সম্ভব? এখানে তো ইনস্ট্রাকটর পদের জন্যেও পিএইচডি লাগে। কলেজের প্রসঙ্গ উঠলেই দেখেছি পাবলোর সব ধনতন্ত্র বিদ্বেষ, রাজনৈতিক তিক্ততা চলে গিয়ে গড়ে তোলার বিমল আনন্দ উথলে পড়ে। ভারতীয় সহকর্মী আছেন শুনে আমারও উৎসাহ জাগে, ‘তিনিও স্প্যানিশ জানেন?’

‘তা জানে বইকি। তবে তাকে তো বেশি স্প্যানিশ বলতে হয় না, সে পড়ায় ইংরিজি। তবে কাজ চালাতে পারে। তুমি কি স্প্যানিশ জানো? কিংবা পর্তুগিজ? ইন্ডিয়ার তো পর্তুগিজরা ছিল?’

‘না।’

‘কী করছ তুমি এ-দেশে? বেড়াচ্ছ? ট্যুরিস্ট বুঝি? না ছাত্রী? তোমার নাম কি? ইন্ডিয়ার কোথায় থাকো?’ এতক্ষণে সেই মোক্ষম প্রশ্নটি এল। অন্যরা প্রথমেই যা শুধোন। পাবলো নেহাত পাগল বলে এতক্ষণে খেয়াল হয়েছে। প্রশ্নটা শুনলেই মন খারাপ। রোজ রোজ আয়নায় একই মুখ দেখা, চিঠিতে একই নাম সই করা, সবসময়ে একই উত্তর দেওয়া। আমি কে। কী করি। কোথায় থাকি। আমার বুকের ভেতর কেউ চিৎকার করে উত্তর দিতে চায়, আমি কেউ না। কিছুই করি না। কোথাও থাকি না। আমার কোনও বাঁধাধরা নাম নেই। পারমানেন্ট অ্যাড্রেস নেই। আমি শুধুই আমি। আমি শুধুই আমার। এই আলো বাতাস যেমন। ফুলের গন্ধ যেমন। প্রকৃতি ছাড়া আমার কোনও নিয়ন্তা নেই। ইচ্ছে করলেই এখুনি মরে যেতে পারি, কিংবা চলে যেতে পারি পাপুয়া আয়রল্যান্ড, কি উত্তমাশা অন্তরীপে। প্রত্যেকটি দিন ফুরোলে সেটা আমার ‘পূর্বাশ্রম’ হয়ে যায়। প্রত্যেক সকালে নবজন্ম। কিন্তু এমন ইচ্ছে মাফিক কথা বলবার মতো মনের জোর এখনও হয়নি। শীর্ণকায় মানিব্যাগ আর স্ফীতকায় দায়দায়িত্বের বোঝা নিয়ে, এই দূর-বিদেশে এসেও মুক্তি আছে?

অথচ ওই কথাগুলো মিথ্যে নয়। ভয়ংকর সত্যিকথা। ওটাই সত্য। এই আমিটা নকল, মিথ্যে। মাথায় সংসারের শামলা এঁটে সং-এর মতো গম্ভীরসে ঘুরছি, যেন একটা কে না কে! ভেতরে ভেতরে, বুকের মধ্যিখানে একটা শেকল বাঁধা বাদী মানুষ চিৎকার করে অনবরত ওই কথাগুলো বলে যাচ্ছে। কেবলই বলে যায়। সে কি তবে মিথ্যে বলে? প্রাণটা কি তবে মিথ্যে বলে? বুকের মধ্যে নিজের যে একটা গোপন চেহারা আছে যেটা ছোট্টবেলা থেকে একলা হলেই ‘নবনীতা’ বলে ডাকলেই দৌড়ে বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়, সেটা কি তবে মিথ্যে? আর আসল এইটে? যেটা ছেলে পড়ায়, দাঁত মাজে, বাজারের হিসেব করে? দূর! সেই অন্য চেহারাটাই আসল।

মনে যাই বলুক, ইচ্ছের গালে থাবড়া বসিয়ে দিব্যি শুনতে পেলুম, জিব বলছে, ‘আমার নাম নবনীতা। আমি কলকাতাতে থাকি।’ জিবের আর দোষ কি? সমাজ তাকে যেমন ট্রেনিং দিয়ে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে, সে তো তাই বলবে!

‘নো—বো—নি—টা! বেশ মিউজিক্যাল নাম কিন্তু! তুমি কী করো? পড়ছ বুঝি? ছাত্রী?’

‘না:, এই লিখি টিখি।’

বলতে ইচ্ছে করল না, ছাত্রী নই, মাস্টার। কেমন যেন বেমানান শোনাত, কেমন একটা সঙ্কোচ হল।

‘লেখো?’ পাবলো তো লাফিয়ে উঠল, ‘বা:! বা:! সত্যি? তুমিও একজন শিল্পী তাহলে! অ্যাঁ? ভারতীয় লেখক? কী লেখ তুমি? কবিতা? গল্প? উপন্যাস? নাকি ডিটেকটিভ গল্প? মেয়েরা তো ডিটেকটিভ উপন্যাসের রাজা!’ ‘গল্প-উপন্যাসও লিখি, তবে সবচেয়ে বেশিদিন লিখেছি কবিতা।’

‘কবি? তুমি একজন কবি?’ পাবলোর চোখে মুখে নির্ভেজাল মুগ্ধতা ফুটে ওঠে। যা কবিতার প্রতি উদ্দিষ্ট, স্পষ্টতই আমি এখানে নিমিত্তমাত্র। এতক্ষণে তো কই এই মুগ্ধতা দেখিনি?

‘বা:! এ পোয়েট ফ্রম দি ল্যান্ড অফ টাগোর!’ পাবলো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, কী চমৎকার যোগাযোগ। চল না একটুখানি আমাদের কলেজে, একটা বক্তৃতা দেবে? লেখক আমরা কখনও পাইনি।’

‘কালই তো চলে যাচ্ছি। বক্তৃতা দেব কবে? তা ছাড়া আমি কি স্প্যানিশ জানি?’

‘কালই?’ পাবলোর গলায় দু:খ ঝরে পড়ে, ‘কালকে কখন? স্প্যানিশটা জরুরি নয়। সবাই ইংরিজি বোঝে।’

‘রাত্রের প্নে।’

‘তাহলে বিকেলে বক্তৃতা দাও? ফোর ও ক্লক?’

‘তাই কখনও হয়? বক্তৃতা দেবার মুড থাকে নাকি যাবার দিনে? প্যাকিং আছে না?’

‘আচ্ছা তোমাকে কি এখন ইউনাইটেড নেশন্সে যেতেই হবে? আগে কখনও দেখনি ইউনাইটেড নেশন্স বিল্ডিং? অবশ্য দেখার মতোই।’

‘কেন দেখব না? ওই বিল্ডিং-এ আমার স্বামীর অফিস ছিল। বহুবার দেখেছি। ওসব টুরিস্ট ইন্টারেস্ট আর নেই বাপু। আমেরিকা আমি বিশ বছর ধরে চষে ফেলেছি…।’

‘তবে কেন যাচ্ছ?’

‘কাজ আছে।’

‘কী কাজ? খুব কি জরুরি? অফিসিয়াল কিছু? চাকরি-বাকরি?’

‘না: ওসব নয়। এমনি সোশ্যাল ভিজিট। একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে।’ এ কী যন্ত্রণা? আমার ব্যাপারে তুমি কেন নাক গলাবে? ভদ্রলোকের অতিরিক্ত কৌতূহলের জন্য বড্ড বিরক্ত লাগছে। এটাই হচ্ছে লাতিন চরিত্রদোষ! বড্ড গায়ে পড়া। অ্যংলোস্যাকসনদের কাঠখোট্টা দূর-দূর পরপর স্বভাব বরং ঢের সুবিধেজনক! লাতিনদের এই জোরজুলুম, ঠিক যেন বাঙালিদের ‘আর একমুঠো ভাত দিই’ বলে পেট ফাটিয়ে দেওয়ার মতন।

‘বয়ফ্রেন্ড?’

‘ধ্যাত, অন্য ব্যাপার।’

‘তাহলে যেতে হবে না তোমার সোশ্যাল ভিজিটে।’ গম্ভীর মুখে উপদেশ দেন সদ্যপরিচিত পরমাত্মীয়টি।

‘বলে দাও তুমি, আজ খুব ব্যস্ত, আসতে পারবে না।’ তারপর হাত তুলে দেখায়, ‘ওই যে, টেলিফোন।’

দূরে একটা লাল ফোনবুথ। আমি এবার ক্ষেপে উঠি।

‘সে কী? কেন বলবে তো? আমার এখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমাকে যেতেই হবে। আচ্ছা, চলি তবে। দেখা হয়ে বেশ ভালো লাগল। গুড লাক, অ্যান্ড গুড বাই।’

পাবলো এগিয়ে এসে কাঁধে একটা আলতো বন্ধুত্বের হাত রাখে। সোনা বাঁধানো দাঁত বের করে সহজ হাসে। গুডবাই বলে না। বলে, ‘কবি হয়ে এত চটে গেলে হয়? কবিদের চাই অসীম ধৈর্য।’

‘আবার জ্ঞান? আরও জ্ঞান? আমি আরও চটে উঠি, বলি, ‘আমার তাড়া আছে, পাবলো।’

‘গোলি মারো তোমার তাড়ায়।’ একটুও না চটে হাসিমুখে পাবলো বলে, ‘বয়ফ্রেন্ড তো নয়। বরং আমার সঙ্গে গেলে একটা নতুন নিউইয়র্ক দেখাতুম আজ তোমাকে। দি আদার আমেরিকা। গরিবদের সঙ্গে মিলতে-টিলতে ইচ্ছে হয়? গরিব দোকানে ঢুকে গরিবদের সঙ্গে খানাপিনা? দেখবে নতুন আনকোরা এক নিউইয়র্ক? পুয়ের্তোরিকান ঘেটোর?’

‘কিন্তু আমার যে একজনের সঙ্গে দেখা করবার কথা। তাঁর সঙ্গে যাবার কথা এখন নিউজার্সি।’

‘দূর দূর। নিউজার্সিতে কেউ যায়? ন্যুড শো ছাড়া নিউজার্সিতে আছেটা কি? সে তো এখন এখানেও আছে।’

‘ওসব নয় ধুত্তোর। ওখানে কয়েকজন ভারতীয় আছেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করব বলে…।’

‘ওহে তাই বলো। ভারতীয়দের ভালো করে দেখবে শুনবে বলেই তুমি নিউইয়র্কে এসেছে।…কী? তাও নয়? তবে চল আমার সঙ্গে কলেজে। কত কি নতুন জিনিস দেখবে। মাইক হ্যারিংটন পড়েছ। অবশ্য ওতেও পাবে না এই ”স্প্যানিশ গরিব”-দের কাহিনি। এরা তো কালো নয়, এরা তো স্লেভ ছিল না, এদের নিয়ে বাড়াবাড়ি হয় না। এদের নিয়ে বই লেখার চাড় নেই কারুর। এদের দু:খ-দুর্দশা দৈন্য সব চাপা পড়ে যায়। এই যে ফোনবুথটা এসে গেছে। ঢুকে পড়ো দিকিনি?’

‘এই বিকেলবেলায় কলেজে গিয়ে কিছু লাভ হবে?’ আমি সামাল দিতে চেষ্টা করি, ‘সবাই তো চলে যাচ্ছে এখন।’

‘কে বললে চলে যাচ্ছে! সবাই আসছে। ইভনিং কলেজ না আমাদের? দিনভর তো ছাত্ররা রুজি-রোজগার করে। কুলিমজুরি, দোকানপাট, চুরিচামারি, পকেটমারা, খুনখারাপি সারাদিন কত ব্যস্ততা তাদের। কলেজটা যদি চব্বিশঘন্টাই করা যেত ওদের।’ আমার চোখে বোধহয় বিস্ময় ফুটেছিল। পাবলো ব্যাখ্যা করে, ‘ব্যাপারটা কি জানো, পুয়ের্তোরিকানরা এখানে একটা সাব-প্রাোলেটারিয়ান গ্রুপ, বুঝলে? মার্কিনি সাব-প্রাোলেটারিয়াট কী বস্তু একটু দেখবে না? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে হুড়মুড়িয়ে পুয়ের্তোরিকানরা নিউইয়র্কে এসেছে পেটের দায়ে, কাজের খোঁজে। তারপর আস্তে আস্তে কখন ভিখিরি হয়ে গেছে। কাজ নেই, খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। আমাদের বাবারা সব সেই সময়ের আমদানি। সুস্থভাবে বাঁচার মালমশলা আমাদের কিছুই নেই। আমাদের একটু দেখে চিনে যাবে না? কেবল তো W.A.S.P. আমেরিকাকেই তোমরা চেনো, হোয়াইট, অ্যাংলোস্যাকসন, প্রাোটেস্ট্যান্ট পাওয়ারফুল আমেরিকা। আর অপরপক্ষে ব্ল্যাকদের। আর চিনেছ হয়তো বা ইহুদিদের। তারা আবার ইন্টেলেকচুয়াল লির্ডাস অফ আমেরিকা—হিস্পানিদের চিনবে না? দি ওলডেস্ট কালচারাল গ্রুপ।’

‘ফিরতে বেশি দেরি হবে না তো?’

‘ফেরার কথা ভেবে কোথাও যাবার বয়স কি তোমার এখনই হয়েছে বন্ধু? যাও, ঢুকে পড়ো দেখি লক্ষ্মী মেয়ে? বলে দাও আজ যাওয়া হল না…।’ ছোট্ট একটা বাও করে বুথের লাল দরজা খুলে ধরে হাসে পাবলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *