অন্যদ্বীপ – ৪

চার

সত্যিই বিশাল প্রদর্শনী। সবটা একদিন একসঙ্গে দেখা যায় না। যখন রাস্তায় বেরুলুম, পা তো আর চলছে না। পা তো আর শিল্পরসগ্রাহী নয় চোখের মতো, সে বেচারি শুধু ভারবাহী। ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের ধারে নানারকম মজার কাণ্ড হচ্ছে। একটা কাগজের তৈরি মস্ত বাক্সের গায়ে লেখা, ‘হিউম্যান জুক বক্স!’ বাক্সের গায়ে স্লট কাটা। আর সাতটা গানের নাম লিখে সাতটা বোতাম আঁটা। যেটাই টানবে, স্লটে একটা ‘কোয়ার্টার’ (২৫ সেন্ট) ফেলে, ভেতরে সেই গানটা তখুনি শুরু হবে। বাইরে তিন-চারটি ছেলেমেয়ে নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে আছে। গান শুরু হলেই তারা মিউজিক দিচ্ছে। ভিতরে একটা হাত উঁচু হয়ে উঠছে মাঝে মাঝে, তাতে একটা প্যাকার্ড ধরা, ‘হেলপ মি গো থ্রু কলেজ।’

খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখলুম পাবলো ব্যাজার মুখে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ বলল, ‘হল গান শোনা? যত্তো ধনী তরুণদের খেলাধুলো। কলেজের খরচ না আরও কিছু! ওই দ্যাখো। খোলাখুলি চলছে বেআইনি জুয়ো খেলা। হয়তো এ-ও বলছে, হেল্প মি গো থ্রু কলেজ! হুঁ: যত্তো মার্কিনি কায়দা!’ দেখলুম, ফুটপাথে একটি ছেলে টেবিলে দাবার ছক পেতে বসে আছে। আশেপাশে বেশ ভিড়। তাকে দাবা খেলে হারাতে হবে বাঁধা সময়ের মধ্যে।

‘পুলিশ এলেই ধড়ফড়িয়ে পালাবে।’ পাবলো জানায়।

‘তুমি খুব একটা মার্কিনিদের ভালোবাসো বলে মনে হচ্ছে না! তুমি বুঝি আমেরিকান নও? খাস পুয়ের্তোরিকান?’

‘না:! সেটাও ঠিক নয়। আমি এই শহরেরই স্থানীয় জঞ্জাল একটি। আবার বাবা যুদ্ধের সময় পুয়ের্তোরিকো থেকে নিউইয়র্কে চলে এসেছিলেন। এখনও আত্মীয়-স্বজনেরা কেউ কেউ আসাযাওয়া করেন। অমি নিজে কখনও যাইনি পুয়ের্তোরিকোয়।’ মুখখানা দু:খী-দু:খী হয়ে যায় ভদ্রলোকের। চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন।

‘কোথায় থাকো?’

‘কেন ব্রুকলিনে? তুমি দ্যাখোনি নিউইয়র্কের পুয়ের্তোরিকান ঘাঁটি?’

‘না:। আমি এই ম্যানহ্যাটনের বাইরে বড় একটা নিউইয়র্ক দেখিনি। একবার খালি স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ফেরিতে চড়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে গিয়েছিলাম।’

‘তাহলে তুমি কেবল বড়লোকদের নিউইয়র্কটুকু দেখেছ।’

‘তা কেন? হারলেম দেখেছি না? খাস নিগ্রোপাড়া? হারলেমের পাশেই থেকেছি কিছুদিন আমি।’

‘কিন্তু নিউইয়র্কের অন্যান্য ঘেটোগুলো তো দ্যাখোনি? ইহুদিপাড়া? ইতালিয়ান পাড়া? পুয়োর্তোরিকান পাড়া? এসব দেখনি তো? বাই দ্য ওয়ে, ”নিগ্রো” শব্দটা কিন্তু দশ বছর হল আর এদেশে চলে না। ওটা অসৌজন্য। বলতে হয় ”ব্ল্যাক”। এটাই চালু টার্ম।’

‘খুব জানি সে কথা আমি! কিন্তু ব্ল্যাক শব্দটা কোন কারণে নিগ্রো শব্দর চাইতে কম আপত্তিকর, কম রেসিস্ট শব্দ বলো তো? বুঝি না, বলে ইচ্ছে করেই আমি ওই তফাতটা মানি না। নিগ্রো মানে কালো। ব্ল্যাক মানেও তাই। আমার মাতৃভাষায় দুটো শব্দে কোনও ফারাক নেই।’ রেগেমেগেই বলি।

এসব ন্যাকা পার্থক্য আমার অর্থহীন লাগে। আমাদেরও হয়েছে যেমন ‘তাঁতি নয় তন্তবায় বলবে, জেলে নয় ধীবর।’

‘ওসব এঁড়ে তর্ক রাখো তো? নিজের ভালো চাও তো নিগ্রো শব্দটা বোলো না। ওটা অমন অ্যাকাডেমিক প্রশ্ন নেই এদেশে, ইমোশনাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রশ্ন হয়ে গেছে। মার খেয়ে যাবে কাউকে ”নিগ্রো” বললে।’ প্রায় ধমকে ওঠেন ভদ্রলোক। বড় মজা! ধমকালেই হল?

‘কিন্তু আমি নিজেও তো কালোই। ব্ল্যাক। শুধু শুধু মার খাব কেন?’

‘ব্ল্যাক? বেশ তো ভালো কথা। তুমিও ব্ল্যাক। কিন্তু তুমি নিগ্রো কি? ইন্ডিয়ার লোকেরা কি নিগ্রো? নিগ্রয়েড গ্রুপ?

‘না, তা অবশ্য ঠিক নই।’

‘তবে? আর করবে এঁড়ে তর্ক? ব্ল্যাক আর নিগ্রো শব্দের তফাতটা এবারে বুঝে দেখলে তো? অস্থিমজ্জা চুলের ডগায় পর্যন্ত তফাত। ওইখানেই তো আসছে রেসিজমের প্রশ্ন। এবার বুঝলে তো? ব্ল্যাক, ব্রাউন, এসব শব্দ কেবল রঙের ব্যাপার। বর্ণভেদটা ওপর ওপর। গভীর নয়। রক্তের নয়। কিন্তু ”নিগ্রো” অন্য ব্যাপার। জাতিভেদ। সাবধানে চলবে। এসব খুব স্পর্শকাতর শব্দ এদেশে।’

হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল। বাস স্টপ এসে পড়ল। আমার গন্তব্য ইউনাইটেড নেশনস। ব্রুসটাউন বাস ধরতে হবে। বাস স্টপে পৌঁছে পাবলো গিয়েন বলল, ‘কোনদিকে যাবে? আমি কি তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি?’

‘বেশ তো, চলো না। আমি যাচ্ছি ইউএন-এ। যেতে যেতে আরও কিছুটা গল্প হবে।’

‘তোমায় কি যেতেই হবে ইউএন-এ? কী হবে ওখানে গিয়ে?’ পাবলো ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ইউএন একটা অতি বাজে র‌্যাকেট। যত্তোসব বড়লোক দেশের ষড়যন্ত্রের জায়গা। সত্যি সত্যি গরিব দের বিন্দুমাত্র কাজে লাগে না ওরা। ওখানে কী করতে যাবে?’

উত্তরে আমি কী আর বলব? কথা ঘুরিয়ে বললুম, ‘আর তুমি? এখান থেকে এখন তুমি যাবে কোথায়?’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *