অন্যদ্বীপ – ৩

তিন

প্রথমে এক নম্বর ঘরে ঢুকি, এখানে প্রধান ছবি ‘বিজ্ঞান এবং বিশ্বাস’। পিকাসোর অল্প বয়সের নানা ছবি উনিশ শতকে আঁকা ছবির মধ্যে রাখা। বিছানায় শায়িত রোগী। একপাশে পাদ্রি, একপাশে ডাক্তার, আশেপাশে উৎকণ্ঠ স্বজনবর্গ। বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের মাঝখানে আয়ু।

এই ঘরে প্রচুর পেনসিল স্কেচ। অ্যানাটমির প্র্যাকটিস। নানাদিক থেকে আঁকা একটি পায়ের ছবি। হাতের পাতার বিভিন্ন ভঙ্গি, দাঁড়ানো শরীর। সেই লিওনার্দোর নোটবুকে যেমন দেখা যায়। হাত-পায়ের পেশি সঞ্চালনের, অস্থি সঞ্চালনের ফলে যেভাবে শরীর নড়ে-চড়ে, ভঙ্গি বদলায়, তার একের-পর-এক পেন্সিল স্কেচ। শিল্পীর হাত পাকানোর এবং চোখ তৈরির প্রমাণ তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের উদাহরণ। আকৃতির ব্যাকরণটা পুরোপুরি অধিগত না হলে সেটাকে ভাঙবেন কেমন করে? ফর্মটা হাতে সম্পূর্ণ এসে যাওয়ার পরেই তো ফর্মের উত্তরণ সম্ভব? সে ব্রাকই হোন, বা পিকাসোই হোন, অথবা আমাদের যামিনী রায়ই হোন। পাকা-হাত না-হলে তো বাস্তবকে সরলীকরণ অথবা জটিলীকরণ কোনওটাই করা চলে না।

আমি অশিক্ষিত, গণ্ডমুর্খ। শিল্প জানি না, শিল্প সমালোচক নই। শিল্পরসিক কিনা সে কথা কেবল ‘আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে’—অর্থাৎ শিল্পকর্মটি। ছবি দেখতে আমি ভালোবাসি, সময় পেলেই চলে যাই প্রদর্শনীতে। জীবন অনিত্য, যত পারি দুটো চোখে ভরে নিই পৃথিবীটা।

আমি বিশ্বাস করি না, সঙ্গীত বা শিল্প বিষয়ে তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ সমালোচক ভিন্ন আর কেউ মুখ খুলতে পারবে না। মন দিয়ে গান যে শোনে, মন দিয়ে ছবি যে দ্যাখে, তারই অধিকার আছে, কেমন লাগল বলার। এই যে আমি লিখি, কেবল অধ্যাপকরা ছাড়া আমার লেখা বিষয়ে কেউ কথা বলতে, মন্তব্য করতে পারবে না, এটা কি স্বাভাবিক? মন দিয়ে যে পড়ে সেই অধিকারী। গান শুনে ভালো কী মন্দ সবাই বলতে পারে, তার জন্যে সঙ্গীত-বিশারদ না-হলেও চলে। ছবি দেখেও সব দর্শকেরই মত প্রকাশের যথেষ্ট অধিকার আছে বইকি। সব দর্শক ‘বোদ্ধা’ কিনা সেটা ঠিক করে দেবার অধিকার কিছু-কিছু মানুষ কেন যে নিজেদের মাথায় তুলে নেয়? যে যেভাবে দেখেছে, তার সেটাই বোধ। তার সেটাই দেখা। তার সেটাই চোখ। তার চোখে দেখা ছবিটা শুধু তারই। সেটা তো মিথ্যে নয়। ভুল-ঠিক অন্যে পরে বলবে কেমন করে?

এসব কথা মনে হচ্ছিল, পিকাসো প্রদর্শনীতে কানে প্রচুর মন্তব্য আসছিল বলে। সে যে কি অদ্ভুত কী প্রাণান্তকর সব কথা। এতক্ষণ লাইন বেঁধে কষ্ট করে দাঁড়িয়ে যাঁরা ভিতরে এলেন, তাঁরা অনেকেই পিকাসোর বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ! আধুনিক চিত্রকলার ধারা বিষয়েই তাঁদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। অভিজ্ঞতা হিসেবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া থেকে আমার মাথায় অনেক জিনিস ঘুরে যাচ্ছিল, যে সারল্য ছবি দেখতে দেখতে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কিউবিস্ট ছবি এখন আর আমাদের কাছে ধাঁধা নয়, আগে এক সময় যখন ধাঁধা ছিল, তখনকার কথা, সেই মনটা আমরা ভুলে গেছি। এদের কথা শুনে সেই সব আদি যুগের প্রতিক্রিয়াগুলি নতুন করে মনে পড়ে যাচ্ছিল।

যতক্ষণ ছবি প্রাচীনপন্থী, সরল, প্রচলিত ফর্মনিষ্ঠ, ততক্ষণ একরকম ‘বা:, বা:’ শুনেছি। নীল যুগ, গোলাপি যুগের পালা পর্যন্ত দশকরা রীতিমতো উৎসাহী। নীল যুগের দু:খ বোধ তাঁদের হৃদয়ে পৌঁছোচ্ছে, দু:খী আর্লেক্যাঁর আজগুবি তালিমারা সং-এর সাজপোশাক, তাঁর গরিব বউ বাচ্চা, ভবঘুরে অনাথ বালকদের কুকুর সমেত পথে পথে ঘোরার হতাশা দর্শকদের মন কাড়ছে বুঝতে পারছি। কিন্তু যেই বিশ শতকে পা পড়ল পিকাসোর ছবি পালটালো, দর্শকদের মন্তব্যও সেই সঙ্গে পালটে যেতে লাগল, ‘এমা, এটা কী? কী বিশ্রী! এর মানে কী?’ চতুর্দিকে এইরকম সব শব্দ উঠছে। আমার মনে হচ্ছিল টেপ করে দেশে নিয়ে যাই। শিক্ষিত মার্কিনি শহুরে সাংস্কৃতিক লেভেলের ছবিটা রেকর্ডেড হয়ে থাক।

ওরকম শব্দ উঠবে না কেন? গাইড নেই। টেপ করা বক্তৃতা থেকে তো কেউই কিছু শিখতে পারছে না! এরকম দারুণ একটা ঐতিহাসিক প্রদর্শনীতে কোনও বিবরণ মূলক গাইড-বুক নেই, প্রফেশনাল গাইডও নেই। আশ্চর্য! বিপুল মোটা সুভেনির বইটা গেটেই কিনেছি। পঞ্চাশ ডলারের বই ছত্রিশ ডলারে পেয়েছি মেরি দত্তর জাদুঘরের মেম্বারশিপ কার্ডের কল্যাণে। কিন্তু সে তো গাইড-বুক নয়, অন্য ব্যাপার। এই কলাম্বিয়ার অধ্যাপকমশাই যে রাম ঠকান ঠকিয়ে দিলেন সক্কলকে? সরকার এটা চলতেই-বা দিচ্ছেন কেমন করে? কানের বোতাম গুঁজে বক্তৃতা খুলে দিয়ে খানিক পরেই বোঝা গেছে বক্তৃতাটা পুরোপুরি বুজরুকি। যাঁরা ঘোরতম শিল্প অজ্ঞ, চোখ মেলে একটা ছবি দেখতে পর্যন্ত জানে না, তাদের জন্যে কেবল কিছু কিছু ছবির ভাব গদগদ বাহ্যিক বর্ণনা করা হচ্ছে। না আছে শৈল্পিক ইতিহাস, না আছে শিল্প বৈশিষ্ট্য দর্শানো, না জটিলতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ , না নিহিত ভাবের ব্যঞ্জনা নিদের্শ! দূর দূর! রাগ করে সুইচ বন্ধ করে দিয়ে কান থেকে বোতাম টেনে খুলে ফেলি।

সঙ্গে সঙ্গে আমাকে চমকে দিয়ে পাশে আর একটা গলা বেজে উঠল, ‘হল তো? আড়াই ডলার জলে গেল। এদের যত সব ধান্দাবাজি। মার্কিন ব্যবসাদারি। হরদম লোক ঠকাচ্ছে। ওসবে কিসসু উপকার হয় না।’ সেই পিকাসো-গেঞ্জি, সাঁইবাবা চুল, কিউ-এর প্রতিবেশী।

‘এই যে ছবিটা, সামনেই যেটা—ভালো করে দ্যাখো, ব্রাকের প্রভাবে আঁকা এটা। এর নাম, স্টিল লাইফ উইথ পাইপস, কফিপট, অ্যান্ড কারাফ’—অথচ সেগুলো কিছুই দেখতে পাচ্ছ না তো? বেশ, ঘাবড়িও না, একটু ভালো করে খুঁজে দেখলেই পাবে। সব আছে। দ্যাখো, ওই যে মাঝখানে কফিপটের আদল। ওই পাশে দেখা যাচ্ছে কারাফের লম্বাটে গলা আর এইদিকে ঝুলন্ত সব পাইপের সারি।’

এবার সত্যি পায়ের তলায় মাটি পেলুম। কখন যেন ওঁর সঙ্গেই একঘর থেকে অন্যঘর যেতে শুরু করেছি ছবি দেখতে দেখতে। ভদ্রলোক অনেক কিছু জানেন, ছবি বিষয়ে। পিকাসোর বিষয়েও। অনেক ব্যক্তিগত গল্প জানেন তাঁর। পিকাসোকে দারুণ ভালোবাসেন বোঝাই যাচ্ছে।

হঠাৎ বললেন, ‘স্পেনের স্পিরিটটাই আলাদা, আমারও তো স্প্যানিশ রক্ত কিনা? আমি পিকাসোকে খুব বুঝতে পারি।’ ভদ্রলোকের এই কথাটা মোটেই মনে ধরল না আমার। রক্ত-ফক্ত নিয়ে গর্ব করা ভালো লাগে না আমার।

‘পিকাসো তো ঠিক স্পেনের প্রতিভূ নন, বরং বলা যায় সমগ্রভাবে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতারই।’ সবিনয়ে বলতে গেলুম আমি।

কিন্তু ভদ্রলোক হঠাৎ ক্ষেপে উঠলেন, ‘কে বলেছে, স্পেনের প্রতিভূ নন? পিকাসোর সঙ্গে আমার যোগ পূর্বপুরুষের রক্তে। আমার পূর্বপুরুষরাও স্পেন থেকেই এসেছিলেন সেই ষোলো শতাব্দীতে—বরিনকুয়েন দ্বীপে, আজ যার নাম পুয়ের্তোরিকো। আজও আমাদের মাতৃভাষা স্প্যানিশ। আমাদের আত্মার গহনে মিল আছে। ইস্পানী রক্তের তেজের ব্যাপারটা আলাদা।’

আমি বাপু আর ওকে ঘাঁটাই না, ‘তা তো হতেই পারে!…হতেই পারে!…কিন্তু আমার যে বড্ড পা ব্যথা করছে, একটু চা-কফি খেয়ে নিলে হত না?’

চা খেতে খেতে জানা গেল ভদ্রলোকের নাম পাবলো গিয়েন।

আমি তো নেচে উঠি প্রায়।

‘দুটোই জগৎ বিখ্যাত নাম! পাবলো কাসালস, পাবলো নেরুদা, পাবলো পিকাসো—একই জগতে এতগুলো বিখ্যাত পাবলো আছে, তার ওপরে আবার গিয়েন? নিকোলাস গিয়েন এতবড় কিউবান কবি।’

‘তুমি জানো?’ পাবলো অবাক চোখ তাকায় ‘ভারতবর্ষের লোকেরাও জানে? নিকোলাস গিয়েনের কবিতা তোমরা পড়েছ?

‘বা:! পড়িনি? বাংলায় অনুবাদও হয়েছে তাঁর কবিতা। আচ্ছা, তুমি কি ওঁর আত্মীয় নাকি?’

‘না: পদবিটা এক বটে, কিন্তু আত্মীয়তা নেই। কিউবা তো অন্যদিকে। পুয়ের্তোরিকোর ইতিহাস আলাদা।’

‘কিন্তু কী করে জানলে, সম্পর্ক নেই? এক কালে হয়তো ছিল? সেই স্পেনে? পূর্বপুরুষের রক্তে হয়তো তোমরা এক ছিলে? পিকাসোর বেলায় এ কথা ভাবতে পারো আর একই পদবি নিয়েও গিয়েনের বেলায় ভাবোনি কেন? বংশধারাটা এক হবার সম্ভাবনা তো এখানেই বেশি।’

‘পিকাসো তো খাঁটি স্পেনের লোক। অফ ডিরেকট স্প্যানিশ অরিজিন। গিয়েন তো কিউবার।’

হঠাৎ বুঝতে পেরে যাই, এর মধ্যে একটা জটিল মনস্তত্বের ব্যাপার আছে। এরা চায় মূল ভূখন্ডের সঙ্গে আত্মীয়তা পাতাতে, কিন্তু অন্যান্য দ্বীপের উদ্বাস্তু স্বজাতির সঙ্গে গ্রথিত হবার স্বপ্ন এদের কাম্য নয়। কেন না সে-ও তো অন্য এক দ্বীপান্তর। সেও তো অন্য এক কান্নার ইতিহাস। কী লাভ তাদের সঙ্গে জড়িয়ে? স্পেন থেকে পুয়ের্তোরিকো। পুয়ের্তোরিকো থেকে নিউইয়র্ক। কবে থেকে শুরু হয়েছে এদের বাস্তহারানোর পালা! সূত্র বাঁধতে হলে মাতৃভুমির সঙ্গে, স্পেনের কাছেই ফিরতে ইচ্ছে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *