দুই
অল্পবয়সি একটি মেয়ে একটা ট্রাঙ্ক নিয়ে বসেছে। তার গায়েও ওই গেঞ্জি। লালের ওপর হলদেতে পিকাসোর ঢেউ-খেলানো স্বাক্ষর তার বুকে।
গেঞ্জি কিনে, এক টিন কোকাকোলাও কিনে ফেলি। এবং একটা হটডগ। এখন তো মোটে এগারোটা। আমাদের ব্যাচটাকে ঢুকতে দেবে সাড়ে এগারোটায়। মিউজিয়ামের ভিতরেই খিদে পেয়ে যাবে। খাদ্যের ব্যবস্থা অবশ্যই আছে সেখানে, দাম নিশ্চয়ই ঢের বেশি। কাঁধের শান্তিনিকেতনি ঝোলায় গেঞ্জিটি ঢুকিয়ে, কোমরে আঁচল জড়িয়ে রাস্তার ধারে কালো পাথরের চওড়া সিঁড়ির ওপরে বসে পড়ি। হটডগে এক কামড় কোকাকোলাতে এক চুমুক। আ: অস্মিন তুষ্টে জগৎ তুষ্ট, পেট জুড়োলেই জগৎ জুড়োয়। কালচার করতে গিয়ে কম কষ্ট হয়েছে নাকি? আজ মেম্বার্স ডে। অপরের মেম্বারশিপ কার্ড সংগ্রহ করে, ভোর থেকে এসে লাইন দিয়ে সেই কার্ড দেখিয়ে এতক্ষণে টিকিট জোগাড় করেছি। নেহাত স্নেহপ্রবণ অশোকদার কল্যাণেই এটা দেখতে পেলুম। তাঁর স্ত্রীর কার্ডে চুরি করে আসা। আমার নাম এখন মেরি দত্ত। ঠিকানা গ্রিনিচ ভিলেজ। কোথায় আমি থাকি আর কোথায় এই পাড়া। কিছু খেয়ে বেরুইনি তখন। নিউইয়র্ক তো একগাদা দ্বীপের সমষ্টি, লস এঞ্জেলেস যেমন একগুচ্ছ জনপদের সমষ্টি (ওরা বলে সিটি)। খেতে খেতে নিজের জায়গার দিকে কড়া নজর রাখছি। আমাকে ফেলেই মিছিল এগিয়ে না যায়। অনেকেই বসে পড়েছে আশেপাশে। এটা সেটা খাচ্ছে। আমেরিকার রাস্তাঘাটে সিগারেট খাওয়া এবং চুমু খাওয়া, দুটোই খুব কমে গেছে দেখছি। মেয়েরা তবু বরং পুরুষদের তুলনায় বেশি ধুমাবতী, নবলব্ধ স্বাধীনতার স্বাদ বলেই হয়তো।
দূর থেকে কিউটা দেখতে অন্যরকম লাগছে। কিউতে দাঁড়িয়ে বেশির ভাগ পুরুষ কিছু না কিছু পড়ছে। মেয়েরা গল্প করছে। সিগারেট খাচ্ছে। দেখতে দেখতে একটা পরিষ্কার প্যাটার্ন ফুটল। যারা একা এসেছে কেবল তারাই বই পড়ছে। মেয়েরা প্রায় কেউই একা নয়। সঙ্গিনী বা সঙ্গী সমেত এসেছে। তাদের বই পড়ার দরকার নেই। যে পুরুষরা একা নয়, তারাও বই পড়ছে না। মানুষ ফেলে বইকে সঙ্গী করেছে এমন হতভাগ্য এই কিউতে চোখে পড়ল না, সংসারে যদিও তাদের সংখ্যা কম নয়। একটা বই আনলেই হত। আমার মতো একা মেয়ে তো আর চোখে পড়ছে না। ভাবতে ভাবতে হটডগ শেষ। কোকও খতম। এখন এগুলো জঞ্জালে পরিণত হয়েছে, ফেলব কোথায়? কাছাকাছি একটিও লিটার বিন নেই। শেষে রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে একটা ডাস্টবিনে টিন আর ঠোঙাটা গুঁজে দিই।
কিউতে ফিরে আসতেই পেছনের সেই ভদ্রলোক বললেন, ‘এই যে, স্বাগত। বিদেশিরাই নিউইয়র্ক নোংরা করে এই ধারণা যে ভুল, তার আরেকটা প্রমাণ পেলাম।’
‘তার মানে?’
‘মানে? ওই যে, ওই দ্যাখো।’ ভদ্রলোকের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি এমন ঝকঝকে ফুটপাথে তকতকে বিশাল মর্মর প্রাসাদের দেওয়াল ঘেঁষে ইতস্তত গড়াগড়ি যাচ্ছে একটি দুটি সেভেন আপ-কোকাকোলার টিন, ছিটিয়ে আছে কিছু আইসক্রিমের কাঠি, সিগারেটের খাপ, চকোলেটের কাগজ, সভ্যতার চিহ্ন। এমন কিছুই নয়। দেখিয়ে না দিলে আমার চোখেও পড়ত না। কিন্তু এই দেশে এমন রাস্তার ধারে এটুকু জঞ্জালও বিসদৃশ বেমানান। নাগরিক সৌজন্য বিরোধী আচরণ।
এই কিউতে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা নেহাতই শখের খাতিরে কষ্ট করছেন। এঁদের কখনও র্যাশনের থলি বা কেরোসিনের টিন নিয়ে কিউ দিতে হয়নি, এঁরা এসেছেন, আমেরিকার ‘কালচারাল ইভেন্ট অফ দি ইয়ারে’ অংশ নিতে।
ভদ্রলোকের চোখের বিদ্রুপ দেখে লজ্জা পেয়ে বলে উঠি, ‘কর্পোরেশনের দোষ। এখানে কয়েকটা ডাস্টবিন রাখা উচিত ছিল।’
‘ডোন্ট ডিফেন্ড দ্য নিউ ইয়র্কার্স। তুমি যা করলে তারাও তাই করতে পারত। আমি তো এতক্ষণ তোমাকেই নজর করে দেখছিলুম খাওয়া হলে তুমি কী করবে। শুনেছি ইন্ডিয়ানরা পুয়ের্তোরিকান-দের মতোই গরিব। গরিব মানেই তো অমার্জিত, নোংরা। তাই দেখছিলুম। কার্যত দেখা গেল, একটা প্রাচীন সংস্কৃতির জাতীয় ইতিহাসকে ঔপনিবেশিক অর্থনীতি উলটে ফেলতে পারে না।’
ভদ্রলোকের দু-চোখে আলো জ্বলে। আমার মনে মনে খুব আহ্লাদ হলেও মুখে সত্যি কথাই বলি, ‘একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে এভাবে জেনারালাইজ করা যায় না। জঞ্জাল যথাস্থানে ফেলবার অভ্যেসটা কিন্তু আমার স্বদেশি শিক্ষা নয়। এটা নেহাতই ঔপনিবেশিক। বিলিতি শিক্ষা। আমরাও বড্ড পথঘাট ময়লা করি।’ বলতে বলতে কলকাতার বস্তিগুলোর আশেপাশে ফুটপাথের ধারে বসে থাকা অগুনতি পথবাসী শিশুর প্রাত:কালীন মূর্তি মনে ভেসে উঠল। দেওয়ালে-দেওয়ালে ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না,’ শীর্ষক কাতর অনুনয়গুলিও যেন মনশ্চক্ষে পড়ে ফেললুম। শিক্ষিত, দায়িত্ববান পুরুষদের উদ্দেশেই তো এই বিনীত অনুরোধ। আর যত্রতত্র থুথু? ফরসা শাড়িতে পানের পিক?
‘গরিবরা নোংরা হয় অভাবে।’ প্রায় অন্তর্যামীর মতোই ভদ্রলোক বললেন, ‘সাউথ আমেরিকায় অনেক সময়ে গ্রামের দিকে স্যানিটারি ব্যবস্থা না-থাকায় প্রাকৃতিক কাজগুলি বনে বাদাড়ে সারতে হয়। সরকারি টয়লেট থাকলে, বা ঘরে-ঘরে ব্যবস্থা থাকলে কি তা করতে হত?’
‘এখানেও যদি গারবেজক্যান থাকত, লোকে আর পথ ময়লা করত না।’
‘তুমি দেখছি এই শহরের নিন্দে সইতে মোটেই রাজি নও। কিন্তু তুমি আর কতটুকু আসল নিউইয়র্ক চেনো’?…
এমন সময়ে গেট খুলে দেয়। শান্তিপূর্ণভাবে দর্শকের মিছিল প্রবেশ করে প্রদর্শনীতে। ছোট বাগানটি পেরিয়ে গেটে ঢুকবার মুখে ছোট্ট ক্যাসেট রেকর্ডার পাওয়া যাচ্ছে, ভাড়া আড়াই ডলার। তাতে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিল্পকলার অধ্যাপক টেপড বক্তৃতা দিচ্ছেন, পিকাসো-প্রদর্শনীর গাইডেড-ট্যুর। চার রকমের নাকি চারটে বক্তৃতা আছে, চারটে ক্যাসেট। কিন্তু কে যে কোনটা পাচ্ছে বোঝা গেল না। ভেতরে কোনও জ্যান্ত গাইড নেই। গাইড বুকটি থেকে ঘরগুলোর মেঝের নকশা ছাড়া কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। টেপ রেকর্ডেড গাইডিং লেকচার নিলে তবু কিছুটা জানা যাবে। কানের মধ্যে ছোট্ট বোতাম গুঁজে, গলায় পৈতের মতো ঝুলিয়ে রাখতে হবে রেকর্ডার যন্ত্রটা। আপন-মনে কানে কানে গুনগুনিয়ে বক্তৃতা বাজবে। নিয়েই ফেললুম একটি যন্ত্র। বড় বড় ব্যাগ, থলি, সবই গেটে জমা রাখতে হচ্ছে, ভিতরে নেওয়া বারণ। ব্যাগ নিয়ে কুপন দিচ্ছে। এই কর্মে বেশ কয়েকটি গাঁট্টা-গোঁট্টা ভীমভবানী নিয়োজিত হয়েছে। দর্শকরা, বিশেষত মেয়েরা অনেকেই ব্যাগ ছাড়তে রাজি না। আর ভীমভবানীরা সব একধমকে কেড়ে নিচ্ছে। আমার ঝোলাটা নিয়ে কী যে করবে বুঝলাম না। আমার ওই একটাই ব্যাগ বলে বোধ হয় ছেড়ে দিল। তবে ভিতরটা দেখে নিল একটু চোখ বুলিয়ে।
লন্ডনে, বিট্রিশ মিউজিয়ামে ভাইকিংদের ঐতিহাসিক জিনিসপত্রের একটি প্রদর্শনী চলছে এখন, মনে পড়ে গেল। ঢোকবার সময়ে যেখানে ব্যাগ-চেকিং করা হচ্ছে, গোলগাল মাঝবয়সি ব্রিটিশ দারোয়ানটি হেসে হেসে চেঁচাচ্ছিল, ‘যার যা কিছু বোমা-টোমা, অ্যাসিড-গ্যাসোলিন বন্দুক-পিস্তল-ছোরাছুরি সঙ্গে আছে, আমার কাছে নির্ভয়ে জমা রেখে যাও, কুছ পরোয়া নেই, যাবার সময়ে সব ঠিকঠাক ফেরত পাবে।’ ব্যক্তিগত ব্যবহারের ব্যাগের অভ্যন্তর খুলে পরকে দেখানোর মধ্যে একটা যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন, যে অঘোষিত অবমাননা আছে, এই উদ্ভট বক্তৃতায় সেটা হাসির হাওয়ায় ভেসে উঠে যায়! অথচ এই মার্কিন দ্বারপালেরা আপন কর্তব্যনিষ্ঠার ভারে কী ভয়ানক গুরুগম্ভীর এবং রুঢ়। যদিও তারা আমার সঙ্গে কপালগুণে রীতিমতো ভদ্রতাই করে ফেলেছেন!