দশ
কলাভাজা আর আমের রস আগেই এসেছিল, এবার চিংড়ির বিরিয়ানি হাজির হল। পরিমাণে প্রচুর। টেবিলে নানা রকমের সসের বাজার বসেছে যেন। চিনে সয়াসস, চিনে চিলিসস, মেক্সিকান টাবাস্কো সস, আমেরিকান টোমাটো কেচাপ, ইংলিশ মাস্টার্ড, ভিনিগার, নুন, মরিচ, কী নেই? পোলাওতেও প্রচুর মসলা। মাঝারি চিংড়ি মাছ ভাজায় ভরা হলুদ ভাত। তাতে লঙ্কাকুচি, পেঁয়াজকুচি, টোমাটো দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, দক্ষিণ ফ্রান্সে কামার্গ অঞ্চলে খুব ক্যাস্টিলিয়ান রান্নার প্রভাব, সেখানে একটা বুনো ঘোড়া-ধরার র্যাঞ্চে গিয়ে একবার ভোজ খেয়েছিলুম—বিরাট বিরাট চ্যাপটা লোহার কড়াই এসেছিল চাকাওলা মস্ত ট্রলিতে চেপে, তাতে ছিল এমনি চিংড়িমাছ দেওয়া তেলতেলে হলুদ ভাতের রাশি, পাপরিকার লাল-সবুজ কুচি মেলানো। কিন্তু দুটোতে কত তফাত। দৃশ্যে, স্বাদে, মূল্যেও নিশ্চয়ই। সেই খাদ্যটার নাম ছিল ‘পায়েল্লা’। এও নিশ্চয় তাই।
‘জানো বাপি, কেম্ব্রিজে একটা ছোট্ট কন্টিনেন্টাল রেস্তোরাঁ ছিল। ছেলেবেলায় মাঝে মাঝে ওখানে লাঞ্চ করতে গিয়ে আমরা ঠিক এই পায়েল্লা পোলাওটা, আর সঙ্গে চিজ ছড়ানো ফ্রেঞ্চ আনিয়ন স্যুপ, তাতে ত্রুতোঁর কুড়মুড়ে কুচি ভাসানো, খেয়ে আসতুম। সস্তায় দারুণ সুখাদ্য! অথচ এখন কেম্ব্রিজে সেই দোকানটাই আর নেই!
‘ছাত্রাবস্থার এই দোকানগুলো সবই এভাবে মুছে যায়, তাই না নবনীতাদি? বেশ নিশ্চিন্ত গলায় বলে বাপি।
এই সময় একটি বাদামি মেয়ে সঙ্গে একটি বছর দু-তিনের ছেলে আর একটি ক’মাসের শিশু নিয়ে ঢুকল। পাশের টেবিলেই এসে বসে চেঁচিয়ে কাকে যেন ডাক পাড়ল। চিনেটি এল। নির্বিকার মুখে অর্ডার নিয়ে গেল। একটু পরেই পাশের টেবিলে থরে থরে সুদৃশ্য খাবার এসে জড়ো হতে লাগল। ও বাবা, এই তো রোগা টোগা মতন মেয়েটা, এত খাবার খাবে? প্রথমে বোতলে জল ভরে সে প্র্যামে শোয়া শিশুর মুখে লাগিয়ে দিল। তারপর নিজের পাত থেকে খাদ্য তুলে তুলে পাশের শিশুকে খাওয়াতে লাগল। বার থেকে একটি বয়স্ক পুরুষ গেলাস হাতে উঠে এসে মেয়েটির টেবিলে বসে। দুজনে হাসিঠাট্টা করতে লাগল, ফাঁকে ফাঁকে মেয়ে নিজেও খাচ্ছে, ছেলেকেও খাওয়াচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে গালে টোল ফেলে লাল-টিয়াপাখি-ঠোঁটে হাসল। এলো খোঁপাবাঁধা ঘাড়ের ওপরে, কালো লম্বা চুলের, পরনে বড় ঘের-ওলা কালোয় লালে ছাপা স্কর্ট, সবুজ ফুল ফুল যৌবনদর্পিত ব্লাউজ।
‘ভারী সুন্দরী না, ওই মেয়েটি?’
‘হ্যাঁ, পুয়ের্তোরিকান মেয়েরা বড় লাবণ্যময়ী। অনেকটা ”বাঙালি-বাঙালি” দেখতে হয়।’
‘আরে দ্যাখো, দ্যাখো, বাচ্চাটাকে কী সুন্দর নিজের পাত থেকে তুলে খাওয়াচ্ছে? ঠিক আমাদেরই মতন না? মেমসাহেবদের মতন নয়।
‘তাবলে আমাদের মতনও নয়।’ ওদের মেয়েদের জাতই আলাদা।
‘মেয়েদের আবার জাতিভেদ করো নাকি তোমরা?’
‘ভেদ নেই বুঝি? সব এক?’
‘কী জানি? থাকতেও পারে। তোমরাই বুঝবে।’
‘কেন পুরুষদের জাতিভেদ করো না তোমরা? বাঙালি পুরুষ আর পাঞ্জাবি পুরুষ, ফর এগজাম্পল? আফ্রিকান আর সুইড?’
‘তা বোধ হয় করি।’
‘তবে? এও তেমনি। বাপরে! যা মুশকিলে পড়েছিলুম একবার। অন্তত বাঙালি মা আর পুয়ের্তোরিকান মায়ের জাত যে কত আলাদা, তার প্রমাণ যথেষ্ট পেয়েছি জীবনে। শুনবে? কিছু মনে করবে না তো? একটু ইয়ে মতন ঘটনা কিন্তু! মানে—’
‘বলো বলো, শুনি। ইয়ে মতন আবার কি? আমরা তো এতদিন শুনেছি উলটোটাই—জগতের সব মায়েরা একজাত।’
‘ঘটনাটা বাবাকেও বলেছি। তাই তোমাকে বলতে আপত্তি নেই। তবে তুমি তো মেয়ে, যদি শক পাও?’
‘পেলে পাব। তুমি বলো। ওসব মেয়ে পুরুষ বাজে কথা, আমি তো অ্যাডাল্ট? এত শত ভাবনার কিছু নেই। বলবে তো একটা সত্য ঘটনাই।’
‘এই যে ডন পেদ্রোর শব-সংসর্গে আমি গেলুম না, এতে তুমি আমাকে খারাপ ভাবলে না?’
‘তা একটু ভেবেছিলুম অবিশ্যি, তারপর ভাবলুম হয়তো আমি এসে পড়ায় গেলে না সৌজন্যবশত।’
‘তুমি না এলেও যেতুম না। এমনিই একটি ছাত্রের ফিউনারালে গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারপর থেকে আর যাই না। আমার কোলিগরাও জানে তাই জোর করে না।
ঘটনার শুরু এই আজকের মতোই। গিলবের্তো এরনান্দেজ, বয়স উনিশ, সফোমর ক্লাসের ছাত্র, একদিন মরে গেল। স্ট্রিটফাইটিংয়ে। খবর পেয়ে গেলুম আন্ডারটেকারের আফিসে। একটা কিউবিকলে তার শব কফিনে রাখা আছে। ওর টার্ন আসবে। শবদেহের কিউ পড়েছে। ওয়েটিং লিস্টে আছে। ওর কিউবিকলে ঢুকে দেখি একলা একজন রূপসি মহিলা বসে আছেন কফিনের মাথার কাছে। নিবাত নিষ্কম্প। অন্যমনস্ক। চমকে উঠলুম। এত রূপ? সসংকোচে আমার পরিচয় জানাতেই মহিলা একগাল হেসে অভ্যর্থনা করলেন ‘আসুন। আসুন আমি গিলবের্তোর মা, লুডমিলা এরনান্দেজ। আমাকে মিলা বলেই ডাকবেন। আপনাকে দেখিনি বটে কিন্তু গিলবের্তোর কাছে আপনার গল্প অনেক শুনেছি।’ যেন এটা তাঁর বাড়ির বৈঠকখানা। মহিলা অত্যন্ত চার্মিং। এমন সহজ, উচ্ছলভাবে কথা বলছেন, যেন সামনে তাঁর পুত্রের মৃতদেহ নেই। কিন্তু আমি সহজ হতে পারছি না কিছুতেই। হুঁ-হুঁ করছি। গিলবের্তোর মা বললেন—’গিলবের্তো আমার শেষ ছেলে। অবশ্য শেষ সন্তান নয়। এখনও বাকি আছে ছোট মেয়ে কার্লা। সে থাকে পুয়ের্তোরিকোতে। আরও আছে অবশ্য একজন। মারিয়া। গিলবের্তোর এবছর উনিশ হয়েছিল।’
‘কার্লার বয়স কত?’
‘পনেরো। তার ঠিক ওপরে হল এদুয়ার্দো—তার সতেরো হত, থাকলে। সে গেছে গত বছরে।’ সহজ গলায় বললে গিলবের্তোর রূপবতী মা।
‘গেছে? কী হয়েছিল তার?’
‘কে জানে? গিলবের্তোর যা হয়েছিল, তাই! রাস্তায় খতম। আর যদি রোবের্তো বেঁচে থাকত, তার বয়স হত চব্বিশ, এই ডিসেম্বরে। সে গিয়েছে ভিয়েতনামে। হেসে হেসে সুন্দরী লুডমিলা বললেন—’সেই আমার প্রথম সন্তান, প্রথম পুত্রও। দেখে—শুনে আমি তো জিহ্বাহীন শ্রুতিসর্বস্ব জড়বস্তু হয়ে যাচ্ছি। উনি খুব সহজ। একি ভয়ংকর কাহিনি শুনছি? আর কে তার বক্তা? আর কী তার ভাষা? সুর? অথচ মহিলার এমন অসামান্য রূপযৌবন, এত প্রচণ্ড শোকের ধাক্কাতেও কিছুমাত্র নষ্ট হয়নি। দেখলে মনে হবে এই বড়জোর পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স। দিব্যি সহজ গলায় গল্প করছেন পুত্রসন্তানদের মৃত্যু কাহিনি। যেন কার-না-কার গল্প। ‘রোবের্তো আর গিলবের্তোর মধ্যে পাঁচ বছরের তফাত। তাদের মধ্যে আছে মারিয়া। ছোটবেলাতেই তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম পুয়ের্তোরিকোতে। আমার মায়ের কাছে। ওখানেই ঘরসংসার করছে সে। মারিয়ার দুটি বাচ্চা। সুখী হয়েছে ও।’ এই রূপসি কন্যার আবার নাতিনাতনিও আছে? যা ব্বাবা! আমি তো থ।’—
‘ছোট মেয়ে র্কালা বুঝি আপনার কাছেই আছে?’
‘থাকত। এখন আছে স্বামীর কাছে।’
‘সে কী? পনেরো বললেন না? এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলেন কী করে? বেআইনি তো। তা ছাড়া এত কম বয়সে বাচ্চা কাচ্চা হলে তো ভীষণ ঝামেলা। মহিলার সহজ স্বাভাবিকতা দেখে আমি হঠাৎ খুব সহজ স্বাভাবিক হয়ে গেছি। ভুলেই গিয়েছি যে স্থানটা ফিউনারাল হোম। কালটা পুত্রশোকের মুহূর্ত, আর পাত্রী সদ্য পুত্রহারা জননী।’
মহিলা অদ্ভুত এক হাসি হাসলেন।
‘প্রেমের কি বয়স আছে? সে যে প্রেমে পড়েছিল।’
‘আপনি বাধা দিলেন না?’
‘বাধা দিয়ে কী লাভ হত? বাচ্চা হচ্ছে যখন, তখন বিয়েটা সেরে ফেলাই মঙ্গল নয় কি?’
‘বাচ্চা হচ্ছে!’
‘আমার প্রেমিকটি খুবই সৎ, দেবতুল্য বলতে হবে। কার্লার মা হবার সম্ভাবনা জানতে পেরে নিজেই চার্চে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে আমার কার্লাকে। আমাকে কিছুই বলতে হয়নি।’
‘কার প্রেমিক বললেন?’
‘আমার। আমার প্রেমিক। এখন সে অবশ্য আমার জামাই।’ গলার স্বর একটা ফাঁপা প্রতিধ্বনির মতো শোনাল। এক্ষুনি যেন একটা দীর্ঘ টানেলের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলে গেছে। তার গুমগুম শব্দ ভেসে আছে বুকের মধ্যে। ভদ্রমহিলা হঠাৎ বিদ্যুতের মতো আমার গলা জড়িয়ে ধরে কোলে এসে বসলেন। গলার স্বরে জ্যামজেলি ঝালমিষ্টি আমের আচার মাখিয়ে বললেন,—’আচ্ছা, তুমিই বলো তো প্রফ, আমি কি সুন্দরী নই? দ্যাখো তো আমার দিকে তাকিয়ে, আমি কি যথেষ্ঠ সুন্দর নই? ভালো করে দ্যাখো তো প্রফেসর’—বলতে বলতে নিজের গা থেকে জামাটা খুলে ফেললেন—আমার হাতটা ধরে নিজের দেহে রাখলেন লুডমিলা। আমি কী যে করি? ওঁকে তো কোল থেকে ঠেলে ফেলে দিতে পারি না? সামনে শুয়ে আছে কফিনের বিছানায় মৃত গিলবের্তো। তাড়াতাড়ি বললুম,—’আপনি খুবই সুন্দর, ম্যাডাম, কিন্তু আমরা এখানে একা নই। প্লিজ গেট ড্রেসড। আই বেগ ইউ।’—’কেন? গিলবের্তোর কথা বলছ? গিলবের্তো এতে কিছু মনে করবে না। সে খুশিই হবে। প্লিজ, এসো না, আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি? প্লিজ, প্রফ, লেটস মেক লাভ? শ্যাল উই?’
‘আমাকে মাপ করুণ মিসেস এরনান্দেজ, এটা যে একটা পাবলিক প্লেস!’
‘কল মি লুডমিলা।’
‘ইয়েস, লুডমিলা। প্রেমের উপযুক্ত আব্রু নেই যে এখানে। প্রত্যেক কামরায় মানুষ শব আগলে জেগে রয়েছে—ধরুন কেউ যদি একটা দেশলাই চাইতে এল—কিংবা যদি টার্ন হলে আনডারটেকারই এসে পড়েন?’ কিন্তু কাকে বলছি? ইতিমধ্যে মহিলা দক্ষ হাতে আমরাই বস্ত্রহরণ শুরু করেছেন। অগত্যা আমি মরিয়া, ওঁকে ঠেলে নামিয়ে জোর করে উঠে পড়ে ফ্লাই বন্ধ করি। কাতর হয়ে বলতে থাকি’ ‘শুনুন, লুডমিলা, আমি নিশ্চয়ই যাব, কালই যাব আপনার কাছে, বাড়িতে অতি অবশ্যই যাব আমি—আপনি পরমাসুন্দরী, বিশ্বাস করুন, আপনার রূপে দৈব বিভা আছে, মানুষকে পলকহারা করে দেয়, প্লিজ, প্লিজ বিশ্বাস করুন’-ব্যাকুল হাতে আমার বোতাম আঁটছি আর আকুলস্বরে বলছি—’আপনার প্রেমিক হতে পারলে আমি কৃতার্থ বোধ করব, আমি ধন্য হয়ে যাব—এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি না—কিন্তু আজ নয়, এখানে নয়। লুডমিলা শুনুন এখানে আমি সত্যিই পারব না। আর শুনুন, যে-লোক আপনার মতো সুন্দরীকে পরিত্যাগ করে যেতে পারে সে মানুষ নয়। তার কথা ছেড়ে দিন, সে উন্মাদ পাগল, সে সুস্থ নয়।’
লুডমিলা স্থির হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছেন। আবার আমার হাতটা চেপে ধরলেন। আমি হঠাৎ ভয় পেয়ে বলে উঠি—’না না আজ আর নয়, রাত ঢের হল, আমি বাড়ি যাব এখন, আবার কাল আসব, এখন ছেড়ে দিন। বাড়িতে আমার বাবা মা অপেক্ষা করছেন।’
হাত ছেড়ে দিয়ে লুডমিলা হঠাৎ উপুড় হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়লেন। প্রচণ্ড জোরে মেঝেতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলেন—’অপেক্ষা তো আমিও করছি, এল কোথায় তারা? রোবের্তো কি ফিরল? আমার বীর রোবের্তো? এদুয়ার্দো —কি ফিরল? আমার ছোট্ট কোলের ছেলেটা? গিলবের্তো ফিরল, আমার খ্যাপা রাগি ছেলে? অপেক্ষা কি আমিও করিনি? আর কত অপেক্ষা করব? হে যীশু, হে মেরিমা, আর কত অপেক্ষা করব আমি?—বলো, বলো—বলো আমাকে—’
কী করে যে সেই রাতটা কাটিয়েছিলুম না নবনীতাদি—ওই হিস্টিরিয়া রোগীকে ফেলেও তো চলে আসা যায় না?—সে যে কেমন রাত? আমি এর পরের কথা আর তোমাকে কিছু বলতে পারব না। তুমি লেখক, তুমি মানুষের ভিতরটা জানো, তুমি আপনি বুঝে নাও।’
বাপি চুপ করে গেল।
কেউ কোনও কথা না বলে খাবারের দাম চুকিয়ে বেরিয়ে এলুম। মেয়েটিও উঠে বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে আসছে, সঙ্গে বারের সেই লম্বা প্রৌঢ় লোকটিও।
‘প্রস্টিট্যুট।’ চাপা গলায় বাপির এই কথাটা না জানলেও চলত। রাস্তায় বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গেই কীভাবে যেন মেয়েটি পালটে গেছে।
আকাশে সন্ধ্যা লেগেছে। ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হঠাৎ চারিদিকে তাকিয়ে, গায়ে শিরশির করে কাঁটা দিল। কেঁপে উঠছি দেখে বাপি তাড়াতাড়ি বললে, ‘আমার জ্যাকেটটা দিচ্ছি, গায়ে ঢাকা দিয়ে নাও।’
আমি আপত্তি করি।—’শীতে নয় বাপি, শীত করছে না। গায়ে হঠাৎ, কাঁটা দিল দেখছি। কে জানে কেন?’
এ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি? অতিকায় কোন লৌহপিঞ্জরের মধ্যে? বিপুল, দীর্ঘ লোহার থামের অরণ্য আমার চারিদিকে, মাথার ওপরে রডের দাঁড়ি টানা টানা ছাদ—পায়ের তলায় ছ’লেনের বড় রাস্তা। হেডলাইট জ্বেলে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে নৌকোর মতন গড়নের সব মার্কিন গাড়ি। দূরে চেনা যাচ্ছে ম্যানহাটানের দাম্ভিক আকাশস্পর্শী আলো। নদীর ওপারে আবছা ব্রুকলিন ব্রিজ। নদীতে অনেক স্টিমার, তাদের আলো, আশেপাশে ম্লান জীর্ণ ঘরবাড়ি, নির্জীব নিয়নবাতি আর ম্রিয়মাণ মুহ্যমান, মলিন মানুষের ক্লান্ত হাঁটাচলা। যান্ত্রিক পায়ে দুজনে স্টেশনের দিকে চলেছি। বাপি নিস্তব্ধ। আমি কিছু বলতে চাইলুম—একটা দোকানের মাথায় জ্বলছে তীব্র বেগুনি সবুজ নিওন বাতিতে ‘বারিকুয়া’—মানে পুয়ের্তোরিকো—মানে ধনের বন্দর—স্বর্ণবন্দর বারিকুয়া—’বাপি, শোনো,’ আমি বলতে শুরু করলুম। ঠিক তক্ষুনি মাথার ওপর দিয়ে বাজ পড়ার মতো শব্দ করে একটা দীর্ঘ ট্রেন ছুটে যেতে লাগল অন্তহীন কাল ধরে।—আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি নিজের ফুসফুসের বাতাসে ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করে কিন্তু বলে উঠি—’যদি তোমাদের কলেজে সত্যিই চাকরি খালি থাকে—’, আমার মুখের কথাগুলো বাপির কাছে গিয়ে পৌঁছোল না। অনেকক্ষণ ধরে বাতাসের সঙ্গে প্রবল যান্ত্রিক কলহ আমার পলকা কথাগুলোকে ঘর্ষমাণ চাকার তলায় চাপা দিতে দিতে ছেৎরে-মেৎরে রক্তাক্ত করে ছিটিয়ে ফেলে দিল, সেই আধো অন্ধকারে, সেই ঝুরো বৃষ্টির সন্ধ্যায়, স্বর্ণবন্দরের সেই দ্বীপান্তরী দারিদ্র্যের নিরাকার বে-আব্রুর মধ্যে।
প্রথম সংস্করণ—অক্টোবর ১৯৮৩