এক
সাপের মতো না, শুঁয়োপোকার মতো না, রেলগাড়ির মতোও না। কিসের মতো যে এই দীর্ঘ মনুষ্যরেখা, ভেবে পাচ্ছি না। নড়ছে, চলছে, জ্যান্ত। অগুন্তি জীবন্ত টুকরোর সমাহারে একটা গোটা জিনিস আকৃতি পেয়েছে। তার একটা গতি আছে, লক্ষ্য আছে, একটা সামগ্রিক প্রাণ আছে। মিছিল নয়, কিউ। শয়ে-শয়ে মানুষ ফিফটি সেকেন্ড স্ট্রিট থেকে ফিফটি থার্ড পর্যন্ত ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, প্রায় পুরো ব্লকটা প্রদক্ষিণ করে। পুবদিকে ফিফথ অ্যাভিনিউ, নিউ ইয়র্কের সব চেয়ে ফ্যাশনেবল রাস্তা। মাঝখানে জগন্নাথ মন্দিরের মতো শোভা পাচ্ছে ভক্ত পরিবৃত ‘মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট।
সকলের হাতেই টিকিট। বাঁধাধরা সময় মাফিক এক-একটা দলকে ঢুকতে দিচ্ছে। থিয়েটার এজেন্টদের কাছে তিন হপ্তা আগে থেকে কিনতে হচ্ছে এই টিকিট। বুধবার, অর্থাৎ আজকে, অবশ্য মেম্বার্স ডে। মেম্বার্স কার্ড হোলডার্স ওনলি! এ কি সোজা ব্যাপার? ‘টাইম’ ম্যাগাজিন বলেছে এটা আমেরিকার কালচারাল ইভেন্ট অফ দি ইয়ার নাইনটিন এইট্টি। পিকাসো রেট্রসপেকটিভ একজিবিশন। নিউইয়র্কের জনপ্রিয়তম ঘটনা। চট করে নিজের পোশাক-আশাকের দিকে এক নজর দেখে নিই। যাক শাড়ির মতো ফ্যাশনেবল পোশাক আর ত্রিভুবনে নেই। তায় দক্ষিণী সিল্ক। ইচ্ছে করেই শার্ট পেন্টুলুন পরে আসিনি আজ। সেজেগুজে যেতে হবে না? এত বড় একটা ব্যাপারে যাচ্ছি! কত না রুচিমান মানুষের ভিড় সেখানে! কিউতে দাঁড়িয়েই অবশ্য বুঝে গেছি, সকলেই যে শিল্প-পাগল তা নয়। অনেকেই এসেছে, হুজুগে মেতে। অনেকে আবার একদমই শিল্প বোঝে না। সেটা জানা গেল ভেতরে ঢুকে।
একটা শিল্পপ্রদর্শনী নিয়ে সারা শহর উন্মত্ত হয়ে রয়েছে এ ঘটনা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ঠিক এখনই লন্ডনের স্টেট গ্যালারিতে চলেছে সালভাদর দালির প্রথম রেট্রসপেকটিভ প্রদর্শনী। তাতে লন্ডন তো এমন মেতে ওঠেনি? বিনা কিউতেই টিকিট কেটে দিব্যি ঢুকেছিলাম। ঈশ পিকাসো বেঁচে থাকতে থাকতে কেন যে হল না এটা? কত আহ্লাদ পেতেন, যা একটি প্রচণ্ড ইগো ছিল! খুবই সুখী হতেন, আনন্দে নেচে নিতেন দু-পাক!
পথে যেন মেলা বসেছে। একপাশে ঠেলা গাড়িতে কাগজে মোড়া হ্যামবার্গার হটডগ বিক্রি হচ্ছে। চমৎকার গন্ধ বেরুচ্ছে ভাজা পেঁয়াজের । আরেক ঠেলায় নানা ধরনের সত্যি ঠান্ডা কোল্ড ড্রিঙ্ক। আমাদের দুর্লভ ধন ‘কোকাকোলার’ ছড়াছড়ি। আরেক ঠেলাওলা বেচছে আইসক্রিম। সবাই ‘মুখর’, কিছু না কিছু খাচ্ছে, চুষছে, চাটছে, চিবোচ্ছে, চুমুক দিচ্ছে। দিব্যি ফ্রয়েড সায়েবের মনের মতো প্রামাণ্য দৃশ্য।
আইসক্রিম-কোণ চাটতে চাটতে সামনের মহিলা তাঁর সঙ্গিনীকে বললেন, বাপরে, কী বীভৎস গরম পড়েছে এবছর। কাল রাত্রের নিউজ দেখলে? সঙ্গিনী বললেন, হ্যাঁ, ঈশ। সর্বনাশা গ্রীষ্ম! সাতশো লোক মারা গেছে। সাউথে। এখানেও মরবে এবারে। রোদটা দেখেছ?
এমন কিছুই রোদ নয়। কালকের টিভি নিউজ আমিও দেখেছি। সাউথে সাতশোজন হিট-স্ট্রোকে মরেছেন। মানুষের মৃত্যু নিশ্চয়ই খুবই শোকাবহ ঘটনা। সাতশো মানুষ, সংখ্যাটাও কম নয়, কিন্তু কেন জানি না আমার যথেষ্ট দু:খ হয়নি। ভারতবর্ষের মানুষ আমি, সেদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাতশো প্রাণ নষ্ট, তো ডাল-ভাত! এই মহিলাদের হাহাকার শুনেও তেমন সহানুভুতি হল না আমার। বরং কেমন একটা রাগই চড়ে গেল মাথায়। কিছু এমন একটা দুর্দান্ত গরম নয়। দুর্গাপুরে হামেশা একশো দশ থেকে আঠারো হচ্ছে, গয়ায় একশো কুড়ি, এখানে একশো ডিগ্রি হতে-না-হতে মানুষ ঝপাঝপ মরছে। সুখের শরীর সব জল-টল তো খাবে না, কেবল দুধ, বিয়ার, হুইস্কি, বার্বন খাবে। সবজি খাবে না, কিলো কিলো গরু শুয়োর খাবে, মরবে না?
টাকাকড়ির অভাব নেই যাদের, তারা ঠান্ডা-গরমে মরবে! দেশটা যখন যথেষ্ট গরম, তখন তার যোগ্য ব্যবস্থা করলেই হয়? শীতের বিরুদ্ধে তো এতরকম অস্ত্রশস্ত্র, অথচ গরমের জন্য পাখা পর্যন্ত নেই! গরম পড়লে ঠান্ডা ঠান্ডা খাবার খাবে তো? বেশি করে জল খাবে তো? নুন খাবে তো? এত সায়েন্টিফিক লিভিং তোদের গরমের সময় কি করতে হবে ঠাউরে উঠতে পারিস না? এমন চমৎকার মাস মিডিয়া রেডি রয়েছে—ডাক্তাররা প্রচার করে দিলেই পারে কী কী উপায়ে গরমের সঙ্গে যুঝতে হবে। এদেশে মানুষ তো মোটে মরেই না, খুনির হাতে, ক্যানসারে আর মোটর অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া। এত বড় একটা দেশে কত কোটি মানুষ—সাতশো জন সুখী লোক না হয় আশাতীত গরমে মরেই গেছে! কী বাড়াবাড়িই না হচ্ছে তাই নিয়ে। দূর-দূর আমাদের কাছে এটা আবার একটা নতূন ঘটনা নাকি। আমাদের দেশে অমন তো প্রত্যেক বছরে হচ্ছে। এই সেদিন কোলিয়ারিতে জলে ডুবেই মরল সাড়ে চারশো শ্রমিক। সরদি-গরমিতে মরছে, শীতের দাপটে মরেছে, বন্যায় ভেসে মরছে, না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরছে। মরার আর উপায়ের অভাব কীসের? সাপে-বাঘে কেটে মরছে, ডাক্তারের অভাবে মরছে, ডাক্তারের অযত্নে মরছে, চাকরি করতে না পেরে মরছে, পণ দিতে না পেরে মরছে, পুলিশের গুলিতে মরছে, গুন্ডার বোমাতে মরছে, মনের দু:খে মরছে। তাতে এদের তো কিছু এসে যায় না? পৃথিবীতে সায়েব মরলেই কেবল শোকের বান ডেকে যায়, কেবল ওদেরই প্রাণের দাম আছে। তাহলে সাহেবরাই শুধু মানুষ?
চটেমটে উঠে একবার ভাবলুম, যাই, একটা কোকাকোলা খেয়ে ঠান্ডা হয়ে আসিগে। কিন্তু লাইন ছেড়ে বেরুলে আর কি ঢুকতে পাবো? ঠিক পেছনেই যিনি আছেন, তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলে দেখি।
ভদ্রলোকের একমাথা ঝাঁকড়া চুল সাঁইবাবার স্টাইলে। এলোমেলো ঝাঁকড়া হয়ে আছে, মুখের চতুর্দিকে জ্যোতির্বলয়ের মতো মহিমা বিস্তার করে। এদেশে এর নাম অ্যাফ্রোস্টাইল। অতি আধুনিক রেবেলদের হেয়ার-স্টাইল, বিদ্রোহের সংকেত। দোকান থেকে খরচ করে করিয়ে আনতে হয় রীতিমতো। রোদে পোড়া তামাটে চামড়া, মনে হচ্ছে মূলত সাদাই। পরনে ফ্যাকাসে রং-চটা লিভাইস আর কালো একটা টি-শার্ট! টি-শার্টের বুকে সাদা হরফে পিকাসোর স্বাক্ষরটি জ্বলজ্বল করছে।
বা:! চমৎকার তো? জামাটি দেখেই কোকাকোলার প্রসঙ্গটা ভুলে গিয়ে অন্য কথা জিগ্যেস করে ফেলি, ‘মাপ করবেন, এমন চমৎকার শার্ট কোথায় পেলেন?’
ভদ্রলোক মন দিয়ে একটা পেপার ব্যাক পড়ছিলেন। চশমার ফাঁকে ব্রাউন চোখ তুলে প্রশ্নকর্তাকে দেখলেন। চোখে হাসির ঝিলিক মারল। তারপর ফিরিওয়ালা বোঝাই ফুটপাথের একদিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওইখানে।’
আমি লাফিয়ে উঠি।
তখন আরেকটু হেসে বললেন, ‘পাঁচ ডলার!’
‘অ্যাঁ? এত কম?’ আমি আরও লাফাই। তার পরেই মিইয়ে পড়ি, কিন্তু কিনতে গেলেই তো জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘কিছু নষ্ট হবে না জায়গা ঠিক থাকবে।’
‘আচ্ছা আপনি কি এক্ষুনি কিনলেন জামাটা?’
ভদ্রলোক হেসে ফেলেন।
আমি এতক্ষণে আমার প্রশ্নের মর্মটা বুঝতে পারি। আমার কথার মানে, উনি নিশ্চয় খালি গায়ে একজিবিশিনে এসেছিলেন।
আমি আরও খারাপ কিছু বলতে পারার আগেই ভদ্রলোক উত্তর দেন ‘ঠিক তা নয়, গত হপ্তায় কিনেছি। এটা আমার দ্বিতীয়বার আসা। একদিনে তো দেখে শেষ করা যায় না। এক জীবনের শিল্পকর্ম।’
হাসলে একটা সোনা-বাঁধানো দাঁত দেখা যায়। আমাদের দেশের মতো।
‘যান, কিনে আনুন। জায়গার জন্যে ভাবনা নেই।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’ বলে আমি ছুটি।