৮
১ আগস্ট ২১২৬
মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝামাঝি বিস্তীর্ণ গ্রহাণুপুঞ্জ বলয় একসময় পার্থিব বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল দুটি কারণে। প্রথমত তাদের খনিজ সম্পদের সম্ভার, এবং দ্বিতীয়ত তাদের মধ্যেকার কার্বনভিত্তিক গ্রহাণুগুলোতে খনিজ জলের বিপুল সঞ্চয়। তবে উপনিবেশ স্থাপনের অসুবিধা ও বিপুল খরচের বোঝা এই সম্পদ সংগ্রহের পথে বাধা তৈরি করছিল। প্ল্যানেটারি রিসোর্সেস এবং ডিপ স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ নামে দুটি কোম্পানি এ-বিষয়ে গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল। এঁদের ঐকান্তিক চেষ্টায় একুশ শতকের তিনের দশকে দুটি প্রধান কার্বনভিত্তিক গ্রহাণু থেকে খনিজ উত্তোলনের কাজও শুরু করা হয় পরীক্ষামূলকভাবে। গ্রহাণুদুটি মঙ্গল ও সূর্যের মধ্যবর্তী ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান বেল্টে থাকায় তাদের অবস্থান সুস্থিত। ফলে পৃথিবী থেকে তাদের কাছে পৌঁছানো অপেক্ষাকৃত সহজ ও কম বিপজ্জনক ছিল।
তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে দৃশ্যটা বদলে যায়। ভারতের অন্তরীক্ষ কর্পোরেশন ২০৫৬ সালে সৌরজগতের বৃহত্তম ইউরেনিয়াম ও প্ল্যাটিনামের সঞ্চয় আবিষ্কার করে যথাক্রমে চাঁদের প্ল্যাংক উপত্যকা ও মঙ্গলগ্রহের ওলিম্পাস পর্বতের পাদদেশে। ততদিনে এই দুটি জায়গাতেই খনিজ জলের বেশ কিছু সঞ্চয়ও নজরে এসেছে। এর পর, অপেক্ষাকৃত কম খরচে এই দুটি জায়গায় খনিজ উত্তোলন শিল্প গড়ে তোলবার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্ল্যানেটারি রিসোর্সেস এবং ডিপ স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজসহ আরও বহু কোম্পানি। একে একে অন্যান্য মূল্যবান খনিজেরও সন্ধান আসতে শুরু করে দুটি জায়গা থেকেই।
এর ফলে গ্রহাণুপুঞ্জে খনিজ উত্তোলনশিল্প গড়ে তোলবার প্রচেষ্টায় ভাঁটা আসতে শুরু করে। দ্বাবিংশ শতাব্দীর সূচনায় কার্বনভিত্তিক দুই গ্রহাণু সি১৭৬৮ এবং সি২১৩২-তে গড়ে উঠতে থাকা পরীক্ষামূলক খনিগুলোর কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। নিচু প্রতিফলন ক্ষমতার এই দুই কার্বন গ্রহাণু তাদের শরীরে বসানো উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোগুলো হারিয়ে ফের মহাশূন্যের অন্ধকারে মিশে যায়। তাদের বুকে পরিত্যক্ত খনিদের অতিকায় গর্তগুলো, তাদের পৃষ্ঠতলে বসানো জল নিষ্কাশক প্ল্যান্টগুলো, জনশূন্য ধ্বংসস্তূপ হয়ে একটি ব্যর্থ পরীক্ষার অ-দেখা অবশেষ হয়ে থেকে যায়।
মহাকাশ এক অসামান্য সংরক্ষক। এর পরবর্তী দীর্ঘ দশকগুলোতে সে জায়গাগুলো একেবারে অপরিবর্তিতই থেকে গিয়েছিল।
তবে কোনও কৌতূহলী দর্শক যদি ২১২৬ সালের সেই আগস্ট মাসের শুরুতে এই অন্ধকার ও পরিত্যক্ত গ্রহাণুদুটির বুকে কোনও অনুসন্ধানী যান পাঠাতেন, তাহলে তাদের বুকের বৃহত্তম খনিগহ্বরদুটির ভেতরে তিনি কিছু প্রাণের সন্ধান পেতেন। পুরু কার্বনস্তরের ঘোমটায় নিজেদের ঢেকে সেখানে দুটি অতিকায় মহাকাশযান স্থির হয়ে কোনওকিছুর অপেক্ষায় ছিল। সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক নীরবতা বজায় রাখা যানদুটি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখবার জন্য প্রায় তিন শতাব্দীর পুরোনো একটি প্রযুক্তির ব্যবহার করত। মর্সকোডভিত্তিক সেই আদিম বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা পৃথিবীতে বহুকাল পরিত্যক্ত। ফলে সে প্রযুক্তিতে নিজেদের মধ্যে খুব ছোটখাটো ও সাদাসিধে সাংকেতিক বার্তাবিনিময় পৃথিবীর অনুসন্ধানী যানদের পক্ষে টের পাওয়া, বা টের পেলেও তা যে কোনও বুদ্ধিমান ভাষা, তা বোঝার সম্ভাবনা ছিল না।
প্রথম প্রথম বিচিত্র অবস্থানের জন্য তাদের গ্রাহকযন্ত্রেরা পার্থিব কোনও সম্প্রচারই ভালো করে ধরতে পারত না। তবে উপস্থিত আর সে সমস্যা নেই। কারণ নিকটবর্তী মঙ্গলগ্রহে পার্থিব তথ্য সম্প্রচারের একটি শক্তিশালী রিলেকেন্দ্র বসানো হয়েছে। এর কারণ, গত এক বছর ধরে সেখানে হঠাৎ বেড়ে ওঠা পার্থিব উদ্বাস্তুর ঢল। মঙ্গল উপনিবেশ পার্থিব সরকার দখল করবার পর থেকে হঠাৎ করেই পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলে অভিবাসনের জন্য ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। সরকারি উদ্যোগে মানুষজনের পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতরের শাখা অফিস, ও কিছু কিছু কলকারখানাও সেখানে সরিয়ে আনা হচ্ছে।
এই ব্যস্ততার পেছনে যে আতঙ্কটা কাজ করছে তার ব্যাপারে লুকিয়ে থাকা যানদুটোর বাসিন্দারা ওয়াকিবহাল। তবে তাঁরা এ-ও জানেন, সাধারণ মানুষ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাব্যবস্থা ও কলকারখানা যথাসম্ভব মঙ্গলের বুকে সরিয়ে আনবার কাজেই পার্থিব কর্তৃপক্ষ বেশি ব্যস্ত। এখানকার সামরিক প্রতিরক্ষাকে জোরদার করবার অবসর বা ইচ্ছা তাঁদের নেই। কারণ, মঙ্গলের বিদ্রোহীদলকে পর্যুদস্ত করে উপনিবেশের দখল নেবার পর তাদের তরফ থেকে আর কোনও আক্রমণের ভয় তাঁরা পাচ্ছেন না।
ফলে অন্তিম দিনটির পর বিধ্বস্ত পার্থিব কর্তৃপক্ষের মঙ্গল শাখাকে এক ঝটিকা আক্রমণে পর্যুদস্ত করে দেবার জন্য তাঁদের এই দুটি সশস্ত্র যানই যথেষ্ট হবে।
২১২৬ সালের পয়লা আগস্ট, পার্থিব সময় ভোর চারটের সময় তেমনই একটি সুদীর্ঘ সম্প্রচার শুরু হচ্ছিল। সি২১৩২ এর পরিত্যক্ত টাইটানিয়াম খনিগর্ভে নিশ্চল হয়ে থাকা মালবাহী যানটির নিয়ন্ত্রণকক্ষে মৃদু একটা আলো জ্বলছিল। সেখানে অতিকায় একটি পর্দার সামনে অপেক্ষায় থাকা মানুষ দুজনের মুখে আনন্দ আর উদ্বেগ একইসঙ্গে মিশে ছিল।
‘কী মনে হয় লালপিওতে? কোনও ফল হবে আজকের পরীক্ষায়?’
অ্যাডমিরাল লালপিওতে মুখে মৃদু একটা হাসি টেনে আনলেন, ‘বিজ্ঞানটা তোমার এলাকা জেমস। আমার নয়। তুমি বলো।’
‘এই এলেনা মেয়েটা ক্রিস্টোফারের সঙ্গে না থাকলে উত্তরটা দিতে দু-বার ভাবতাম না আমি,’ জেমস আরিয়ানা মাথা নড়লেন, ‘মেয়েটার একটা ষষ্ঠেন্দ্রিয় আছে। টাইটানিয়াম ফসফেট অনুঘটকের ব্যবহার করে থার্মোনিউক্লিয়ার ডিটোনেশানের শক্তিবিচ্ছুরণের হারকে যেভাবে বাড়িয়ে তুলল, তা ওর বন্ধু ক্রিস্টোফারের সাধ্য ছিল না। আবার টিভি ইন্টারভিউতে নিজেই স্বীকার করেছে বিষয়টা আন্দাজে ঢিল ছিল।’
লালপিওতের ভুরুদুটো কুঁচকে উঠছিল, ‘তুমি বলতে চাইছ এদের আজকের এই শেষ চেষ্টাটা সুইফট টাটলকে গুঁড়িয়ে—’
‘আরে না না। সেকেন্ডে পঁয়ত্রিশ মাইল বেগে ছুটতে থাকা একটা ষোলো মাইল ব্যাসার্ধের বস্তুর জন্য ওই দু-হাজার মেগাটনের বিস্ফোরণ তো পালকে ছোঁয়া। তবে একটা আন্দাজের জোরে আণবিক ওয়ারহেডের শক্তিকে দুশো থেকে এক লাফে দশ গুণ বাড়িয়ে দিতে যে পারে, আর কিছুদিন সময় হাতে পেলে—’
‘বাস্তবে ফিরে এসো জেমস। চোদ্দো দিনের মধ্যে সেটা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তোমার সন্দেহের কারণটা কী? নাকি অকারণে—’
‘অকারণে নয় লালপিওতে। এই হিসেবগুলো দ্যাখো। এখনও প্রায় সোয়া চার কোটি মাইল দূরে রয়েছে পৃথিবীর মৃত্যুদূত। গ্রহাণুপুঞ্জ বলয় এখনও পার করেনি। আঘাতটা যদি তার গতিপথকে এক লক্ষভাগের একভাগের বেশি বদলে দেয় তাহলে পথ বদলে সেটা কাছাকাছি থাকা দু-কিলোমিটার ব্যাসার্ধের গ্রহাণু এন-ই২৬০৭ এর গায়ে ধাক্কা খাবে। এই ধাক্কাটার শক্তি আমার হিসেবমতো কিন্তু ছেলেখেলা হবে না। প্রায় পঞ্চাশ হাজার মেগাটন। সেটা ঘটলে— এর পরিবর্তিত গতিমুখের সম্ভাব্য হিসেবটা দ্যাখো—’
পর্দায় হঠাৎ বেঁকে যাওয়া দাগটার সরাসরি মঙ্গলগ্রহের বিষুব অঞ্চলের দিকে এগিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে লালপিওতে চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘সম্ভাবনা?’
‘শতকরা দশ ভাগ।’
‘কোনওভাবে—’
জেমস আরিয়ানার মুখে একটু বিষণ্ণ হাসি খেলে গেল, ‘না। প্রজেক্ট টাটল ব্লাস্টারের মূল গবেষণাটা আমারই করা লালপিওতে। আমি সব দিক ভেবে দেখেছি। এই মুহূর্তে এদের এই শেষ চেষ্টাটা ব্যর্থ হবার প্রার্থনা ছাড়া আমাদের আর কিছু করবার নেই।’
পর্দার দিকে খানিকক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন লালপিওতে। এতদিনের একটা পরিকল্পনা, একটা স্বপ্ন শেষ মুহূর্তে এসে এইভাবে একটা সূক্ষ্ম সুতোয় ঝুলে থাকবে তা হয়তো তিনি কল্পনা করেননি।
তবে বেশিক্ষণ সেভাবে বসে থাকার কোনও ইচ্ছে তাঁর ছিল না। আপাদমস্তক বাস্তববাদী মানুষটা, যার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই তেমন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার কোনও অর্থ খুঁজে পান না।
‘সেক্ষেত্রে ব্যারণ, দীর্ঘ একটা সময় পাব আমরা এই আস্তানায় বসে ভাববার। এত সহজে আমাদের উপস্থিতি টের পাবে না ওরা। হয়তো অন্য কোনও পথ বের হবে আপনাদেরই হাতে। আমার আসল শক্তি— আপনি, গ্রোভার, জালাল— আপনারা আমার সঙ্গেই রইলেন তো! আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখব আমরা। তবে আর নয়। হাতের তির ছুড়ে দেওয়া হয়েছে। আসুন দেখা যাক।’
পর্দা থেকে হঠাৎ করে মুছে গেছে আরিয়ানার হিসেবনিকেশের অঙ্ক আর রেখাচিত্রের দল। তার অর্ধেক জুড়ে মার্স চ্যানেলে মঙ্গলের উৎক্ষেপণক্ষেত্রে কমলা আগুনের রেখা জেগে উঠেছে অতিকায় একটা ক্ষেপণাস্ত্রযানের রকেটে। পর্দার বাকি অর্ধেক জুড়ে অজস্র পার্থিব চ্যানেলের সম্প্রচার ছোট ছোট দৃশ্যের টুকরো হয়ে ভাসছিল। ভীত আতঙ্কিত মানুষের দল সেখানে পৃথিবীর নানান প্রান্তে আকাশের দিকে মুখ তুলে হিরের টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করতে থাকা সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের দিকে দেখছে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় ভেসে আসা ধারাবিবরণীগুলো সব আশঙ্কাকে গোপন করে আশার বাণী শোনাচ্ছিল তাদের। দুই তরুণ বৈজ্ঞানিক ক্রিস্টোফার ও এলেনার শেষতম আবিষ্কার, সুইফট টাটলের বিরুদ্ধে সভ্যতার শেষ উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ হয়তো তাদের রক্ষা করবে মহাকাশ বেয়ে ধেয়ে আসা ওই রাক্ষসের হাত থেকে।
***
‘প্রার্থনা করো ক্রিস। ও ছাড়া আমাদের হাতে এখন আর কোনও অস্ত্র নেই।’
পর্দার সামনে একত্র হওয়া মানুষগুলো নিঃশব্দে বসে ছিল। ঠিক চার মিনিট আগে পৃথিবী থেকে শেষ নির্দেশ ধেয়ে গেছে মঙ্গলের উৎক্ষেপণক্ষেত্রে অপেক্ষায় থাকা ক্ষেপণাস্ত্র ডি-১২২ এর গণকমস্তিষ্কে। যে কোনও মুহূর্তে এখন—
‘প্রার্থনা আমরা সবাই করছি এলেনা,’ ঘরটার চারদিকে ছড়িয়ে থাকা অজস্র সম্প্রচার পর্দার দিকে হাত ঘুরিয়ে একবার দেখাল ক্রিস। সেখানে পৃথিবীর প্রত্যেকটা প্রধান শহরের পথে বের হয়ে এসেছে হাজার হাজার মানুষ। রাস্তাগুলো জুড়ে বসানো বড় বড় পর্দার বুকে একেকবার ভেসে উঠেছে শক্তিশালী দূরবিনে ধরা দেওয়া অতিকায় ধূমকেতুটার শরীর। সূর্যের উত্তাপ পেয়ে শরীর থেকে লক্ষ মাইল লম্বা উজ্জ্বল বাষ্পের ধারা ছড়িয়ে সে ধেয়ে আসছে পৃথিবীকে লক্ষ করে। আবার প্রতি মুহূর্তে মঙ্গলের উৎক্ষেপণক্ষেত্রে অপেক্ষায় থাকা শেষ আশার আলো ডি-১২২ এর ছবিটা ভেসে আসতে উল্লাসে ফেটে পড়ছে তারা।
‘কিন্তু সে প্রার্থনায় যদি কোনও ফল না হয়—’
‘সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা দশ ভাগ। গত এক বছর ধরে করা সব ক-টা চেষ্টার সাফল্যের মিলিত সম্ভাবনার চাইতেও বেশি ক্রিস।’
‘সে সাফল্যের অর্থও তো মঙ্গল উপনিবেশের ধুলো হয়ে উড়ে যাওয়া। আমাদের হিসেব ঠিক হলে—’
‘একটাও প্রাণ যাবে না ক্রিস। আজকের পরীক্ষাটা সফল হলে মঙ্গলের গায়ে ওর ইমপ্যাক্টের আগে প্রায় পাঁচ দিন সময় মিলবে। ইভ্যাকুয়েশান প্ল্যান সম্পূর্ণ তৈরি আছে,’ তার হাতদুটো ধরে নীল চোখের মেয়েটা বলে উঠল, ‘আর যদি ব্যর্থ হই তাহলে, আমাদের যান—’
নিঃশব্দে হাতদুটো ছাড়িয়ে নিয়ে মাথা নাড়ল ক্রিস্টোফার, ‘ব্যর্থ হলে ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের মঙ্গলে সরিয়ে নেবার পরিকল্পনাটা একদম সঠিক, আমি মানছি এলেনা। কিন্তু আমি— আমার বোধ হয় যাওয়া হবে না। একটা শেষ চেষ্টা করতে হবে আমাকে।’
‘এর পরেও— কী চেষ্টা করবে তুমি? তুমি না যুক্তির পূজারি একজন বৈজ্ঞানিক? পাগলামো কোরো না ক্রিস। তা ছাড়া তোমাকে এখানে এভাবে রেখে—’
নীরবে মাথা নাড়ল ক্রিস্টোফার, ‘আমি জানি না। শুধু জানি আমার কিছু একটা রহস্য আছে। সে রহস্যের চাবিকাঠি আছে আমার বাবার কাছে। আজ সকালে টাইকোর কাছ থেকে একটা নির্দেশ পেয়েছি আমি। পরীক্ষা ব্যর্থ হলে আমাকে অন্য কোথাও যেতে হবে।’
‘কোথায়?’
‘আমি সেকথা—’
‘ইগনিশান!’ স্পিকারে ড. বাজপেয়ীর গম্ভীর গলাটা ভেসে আসতে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে পর্দার দিকে ফিরে তাকাল তারা। সেখানে ভেসে থাকা ছবিতে অতিকায় ক্ষেপণাস্ত্রযানটার তলায় প্লাজমার উত্তপ্ত ঢেউ জেগে উঠেছে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপর মঙ্গলের সামান্য অভিকর্ষকে অবহেলায় ছিঁড়েখুঁড়ে তার আকাশের দিকে ধেয়ে গেল দানব অস্ত্র। পর্দায় বদলে যাওয়া ছবিতে তখন মঙ্গলকে ঘিরে বিভিন্ন দূরত্বে পাক খেয়ে চলা কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটদের পাঠানো ছবিদের মিছিল চলেছে। সেখানে তৃতীয় স্টেজের থ্রাস্টারের বাঁধন কাটিয়ে সংরক্ষণ চেম্বারের দেয়াল খুলে গিয়ে মহাকাশের অন্ধকারে মুখ বাড়িয়েছে মৃত্যুমুখী ডি-১২২।
অ্যাটিচুড নিয়ন্ত্রক ছোট ছোট থ্রাস্টারের ধাক্কায় কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিজের গতিমুখকে স্থির করে নিল সে। তারপর প্লাজমার সুতীব্র বিচ্ছুরণে অন্ধকার মহাকাশের বুকে একটা নীলচে-সাদা রেখে টেনে দিয়ে সে ধেয়ে গেল তার শিকারকে লক্ষ করে।
১০ আগস্ট ২১২৬
‘আর চারদিন, তাই না এলেনা?’
ইনসটিটিউটের এই দিকটা ভারী নির্জন। সাধারণত এখান থেকে রাতের এই সময়টায় ক্যাম্পাসের কিছু দূর দিয়ে বয়ে যাওয়া নয়াদিল্লি-ভোপাল এয়ার-ওয়েতে ব্যস্ততার সীমা থাকে না। এখন তা একেবারে নির্জন। একটা উড়ন্ত ইঞ্জিনের শব্দও তার নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিচ্ছে না।
এলেনা জবাব দিল না কোনও। আকাশের দিকে চোখদুটো তুলে ধরে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসে ছিল সে। সেখানে মধ্যরাতের অন্ধকারে জ্বলন্ত একটা চোখের মতো স্থির হয়ে আছে আলোর একটা টুকরো। এলেনা জানে এই মুহূর্তে তা আসলে স্থির নয়। বিদ্যুৎগতিতে মহাশূন্য সাঁতরে ষোলো মাইল ব্যাসার্ধের ওই মৃত্যুদূত এখন ছুটে আসছে তার লক্ষ্যের দিকে।
ডি-১২২ এর আক্রমণ বস্তুটার গতিমুখকে বদলে দিয়েছিল বইকী। তবে যেটুকু বদল তা আনতে পেরেছিল তাতে তার আঘাতবিন্দু পৃথিবীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে সরে গিয়ে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের দিকে ঘুরে গিয়েছে।
কেঁদে ফেলেছিল এলেনা। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল পাশে দাঁড়ানো ক্রিস্টোফারের কাঁধে মুখটা রেখে। আগস্টের এক তারিখে উৎক্ষেপণের পর, মঙ্গলের কাছাকাছি গভীর মহাকাশে পৃথিবীর শেষ আশা, ডি-১২২ ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে সুইফট টাটলের সংঘর্ষের ছবি দেখে পৃথিবী জুড়ে নতুন আশার ঢেউ জেগেছিল। কিন্তু তার তিন দিন পরে, এই ঘরে দাঁড়িয়েই ওই সর্বনাশা ধূমকেতুর বদলে যাওয়া গতিপথের যাবতীয় টেলিমেট্রির বিশ্লেষণ শেষ হতে পর্দায় যখন তার ফলাফল ভেসে ওঠে তখন নিজেকে আর সামলাতে পারেনি সে।
ক্রিস্টোফার একটা কথাও বলেনি। কোনও সান্ত্বনা দেয়নি তাকে। শুধু হাতে ধরা কমিউনিকেটরের পর্দায় একটা নির্দিষ্ট ছবির গায়ে মৃদু চাপ দিয়েছিল শুধু। কোড-এক্স। প্রজেক্ট এক্সোডাসের সূচনা সংকেত।
পৃথিবীর জনসংখ্যা গত এক শতাব্দীতে অনেকটাই কমে এসেছে। তবু প্রায় পাঁচশো কোটি মানুষের মধ্যে মাত্রই কয়েক মিলিয়নকে এ-গ্রহের বুক থেকে সরিয়ে বিভিন্ন মহাকাশ আশ্রয় আর চাঁদ ও মঙ্গলের উপনিবেশে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে গত এক বছরে।
বাছাই প্রক্রিয়াতে পেশার বিভিন্নতাতে জোর দেওয়া হয়েছিল। জোর দেওয়া হয়েছিল সমস্ত নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীরই কিছু কিছু প্রতিভুকে বেছে নেবার ওপরে। সরকারি-বেসরকারি সমস্ত মহাকাশে যাবার যোগ্য যানকেই অধিগ্রহণ করা হয়েছে এর জন্য। হয়তো সে-কাজে বাদ যায়নি কা-পোনের মালবাহী যানও। তবে সে-খবর ক্রিস্টোফার সঠিক জানে না। বছরখানেক আগে মঙ্গল উপনিবেশের সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েও সে ছাড়া পেয়ে যাবার পর থেকে কোনও অজ্ঞাত কারণে তার সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি।
প্রজেক্ট এক্সোডাসের উদ্দেশ্য অন্য ছিল। ক্রিস্টোফারের কমিউনিকেটরের সংকেত ভেসে গিয়ে বুদ্ধ-এর একটা নির্দিষ্ট প্রোগ্রামকে চালু করে দিয়েছে এবারে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে গিয়ে পরবর্তী ব্যাচের সমস্ত সাধারণ যাত্রীর মহাকাশযাত্রার অনুমতি বাতিল করে দিয়েছে। তার বদলে খবর পৌঁছে গেছে আগে থেকে তৈরি করে রাখা একটা বিশেষ তালিকার মানুষের কাছে। এ-গ্রহের সমস্ত সেরা শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, দেশনেতা এবং সেনাবাহিনীর বাছাই যোদ্ধাদের তৈরি হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সিদ্ধান্তটা আগে থেকেই নেওয়া হয়েছিল। ডি-১২২ ব্যর্থ হলে, শেষ আঘাতের আগে দশ দিনের মধ্যে এ-গ্রহের শ্রেষ্ঠ মানবসম্পদকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে যে কোনও মূল্যে। বন্যার মুখে দাঁড়িয়ে খেতের ফসলের বদলে সঞ্চয়ের সেরা বীজগুলোকে রক্ষা করবার মতো। সেখানে করুণা বা দয়ার কোনও স্থান নেই।
প্রজেক্ট এক্সোডাস চালু হবার পর সেই নিয়ন্ত্রণকক্ষে দাঁড়িয়ে তার হাজারো পর্দায় এরপর থেকে তারা দেখেছে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের সামনে অসহায় সাধারণ মানুষের আকুতি। দেখেছে কোথাও কোথাও বিদ্রোহী মানুষজনের আক্রমণকে সামাল দিতে সেনাবাহিনীর ছোড়া ঘুমপাড়ানি গ্যাসের আক্রমণে জ্ঞান হারানো লক্ষ লক্ষ মানুষের ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকবার দৃশ্যকে। দেখেছে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা ভুখণ্ডে মাটির তলায় ছড়িয়ে থাকা পাতাল-যোগাযোগের সুড়ঙ্গের জালের ভেতর অসংখ্য অসহায় মানুষের ইঁদুরের মতো আত্মগোপন করে বাঁচবার শেষ চেষ্টাকে।
মণিবন্ধে বাঁধা ছোট যন্ত্রটায় তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ উঠল হঠাৎ। আকাশ থেকে মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে একনজর দেখে চোখের জল মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়াল এলেনা। তারপর ক্রিস্টোফারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘চলো। সময় হয়েছে।’
‘হ্যাঁ। চলো।’
উঠে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ র্যাম্প বেয়ে তারা নেমে আসছিল ইনস্টিটিউটের নিজস্ব উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের দিকে। সেখান দাঁড়িয়ে থাকা ভোঁতা চেহারার যানটা এবার ইনস্টিটিউটের বাকি সদস্যদের নিয়ে দীর্ঘ একটা যাত্রার শেষে পৌঁছে যাবে মঙ্গল উপনিবেশের নিরাপদ আশ্রয়ে।
মহাকাশযানের খোলা সিঁড়ির মুখে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে এলেনাকে তুলে আনতে গিয়ে হঠাৎ একমুহূর্তের জন্য থমকে গেল ক্রিস্টোফার। তার পকেটের মধ্যে রাখা কমিউনিকেটরটা হঠাৎ মৃদু কেঁপে উঠেছে একবার। এই সময়ে, কে…
তাড়াতাড়ি থমকে দাঁড়িয়ে কমিউনিকেটরটা বের করে আনল ক্রিস্টোফার। হাতে টান পড়তে এলেনাও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার কৌতূহলী চোখ ক্রিস্টোফারের কমিউনিকেটরের দিকে ধরে। সেখানে তখন একটা শূন্য আর এক-এর একটা দীর্ঘ সারি ভেসে উঠেছে।
এলেনার দৃষ্টিতে সে সংখ্যার সারির কোনও অর্থ ছিল না। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ ক্রিস্টোফারের শরীরটা শক্ত হয়ে উঠল। সিঁড়ি তুলে আনা হয়েছে ততক্ষণে। এসে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসছিল যানের দরজা। অটোপাইলট জেগে উঠেছে যানের। পৃথিবীর আকর্ষণকে কাটিয়ে নিরাপদে যানকে কক্ষে পৌঁছে দেওয়া একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সে-কাজে এখন মানুষ আর নিজের দক্ষতায় বিশ্বাস রাখে না।
কমপিউটারের যান্ত্রিক গলার গণনা তখন আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছিল শূন্যের দিকে। হঠাৎ একটা ঝটকা দিয়ে এলেনার হাত ছাড়িয়ে বন্ধ হয়ে আসতে থাকা দরজাটার এগিয়ে গেল ক্রিস্টোফার।
যেন তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়েই আগামী ঘটনাটার একটা আভাস পেয়েছিল এলেনা। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে সে চেপে ধরেছে ক্রিস্টোফারকে। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠেছে, ‘ক্রিস না… কেউ সাহায্য করুন…’
ভেতরের করিডোর থেকে দ্রুত এগিয়ে আসছিল দুজন অস্ত্রধারী প্রহরী। একমুহূর্তের জন্য সেদিকে ঘুরে তাকাল ক্রিস্টোফার। এলেনার বজ্র আলিঙ্গন ছাড়িয়ে নেবার সময় নেই আর। যা করবার এখনই করতে হবে। হঠাৎ এলেনাকে দু-হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মেঝেতে গড়িয়ে গিয়ে দরজার ফাঁকটুকু দিয়ে ছিটকে গেল সে অনেকটা নীচে উৎক্ষেপণক্ষেত্রের জমির দিকে।
তীব্র হাওয়ার একটা ধাক্কা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের জমি থেকে তুলে নিয়ে ছুড়ে দিয়েছিল অনেকটা দূরত্বে। উৎক্ষেপণের আগে যান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া ঘনীভূত বাতাসের এই ঝড় প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চালু আছে। একটা নিরাপত্তামূলক বন্দোবস্ত। উদ্দেশ্য, ইঞ্জিন চালু হবার সময় তার আশপাশের শ-দুয়েক মিটার ব্যাসার্ধের একটা এলাকাকে একেবারে ফাঁকা করে নেওয়া। প্রযুক্তিটা আসবার আগে, চালু হওয়া ইঞ্জিনের প্লাজমার প্রথম বিচ্ছুরণ, ফেলে যাওয়া কোনও বস্তু বা অসতর্ক গ্রাউন্ড স্টাফকে মুহূর্তে জ্বালিয়ে দিয়ে বহুবারই মর্মান্তিক কিছু দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
মাটিতে আছড়ে পড়ে দূর থেকে তারা দেখেছিল যানের পেছন থেকে হঠাৎ ছিটকে আসা উত্তপ্ত প্লাজমার ধারা। তার ধাক্কায় ধীরে ধীরে মাটি ছেড়ে আকাশের দিকে মুখ বাড়াল সুবিশাল আন্তর্গ্রহ যান। তারপর গতি বাড়িয়ে ধেয়ে গেল বায়ুমণ্ডলের বাধা পেরিয়ে।
এলেনার হাত ধরে পাশের জনশূন্য হ্যাঙারটার দিকে ছুটতে ছুটতেই তীব্র উত্তপ্ত প্লাজমার ঝড়ে তাদের চোখমুখ ঝলসে যাচ্ছিল। হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে রেখে এলেনা হঠাৎ বলল, ‘তুমি উন্মাদ। এভাবে নিজের জীবনকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া…’
‘ভুল এলেনা। আমি পাগল নই।’ মাথা নাড়ল ক্রিস্টোফার, ‘হঠাৎ একটা আশা…’
‘তার মানে?’
হাতের কমিউনিকেটরটা তার দিকে তুলে ধরল ক্রিস এবারে, ‘এর অর্থ জানো?’
ছুটতে ছুটতেই সেদিকে তাকিয়ে দেখল একবার এলেনা। তারপর মাথা নাড়ল।
‘স্বাভাবিক। চোরাচালানকারীদের নিজস্ব কোড ল্যাঙ্গুয়েজ তোমার জানবার কথা নয়। একটা বিশেষ শ্রেণীর অক্টাডেসিমেল কোডিং।’
‘তুমি…’
সুদীর্ঘ সংখ্যার সারিটাকে দ্রুত পড়তে পড়তেই মাথা নাড়ল ক্রিস, ‘আমি নই। আমার বাবা, কা পোন চি। এই প্রথম সারিটা বাবার নামের তিনটে শুরুর অক্ষরকে বোঝাচ্ছে। তার সঙ্গে কয়েকটা শব্দ, লাফাও। লুকোও। দ্রুত।’
‘তোমার বাবা… চোরাচালানকারীদের ভাষা…’
হ্যাঙারের অন্ধকার গহ্বরটার ভেতরে ততক্ষণে পৌঁছে গেছে তারা। তার দেয়ালের সুইচবোর্ডে দরজাটা বন্ধ করবার বোতামটায় চাপ দিতে দিতেই ক্রিস বলল, ‘সে অনেক লম্বা কাহিনি এলেনা। শুধু একটা কথা জেনে রেখো, কা পোন চি বিনা কারণে কোনও নির্দেশ দেন না।’
‘কিন্তু এরকম একটা আদেশ…’
হ্যাঙারের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই একটা মৃদু, মরাটে আলো জ্বলে উঠেছে তার ভেতরে। সেই আলোয় তাদের লম্বা লম্বা ছায়াগুলো অশরীরির মতো ছাদের গা থেকে ঝুঁকে থাকে। সেইদিকে চোখ ধরে রেখে ক্রিস বলল, ‘কারণটা আমি জানি না। তবে নির্দেশ পাঠাবার সময় নির্বাচনটা বলছে, তিনি কোথাও থেকে নজর রেখেছেন আমাদের গতিবিধির ওপর। আর, কাউকে তিনি বোঝাতে চান, আমরা ওই যানে করে রওনা হয়ে গেছি ইনস্টিটিউটের সমস্ত বিজ্ঞানীর সঙ্গে।’
‘বুঝিয়ে বলো ক্রিস। তোমার কথার পেছনে কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না আমি।’
‘বলছি। ইনস্টিটিউটের সমস্ত বিজ্ঞানী যানে ওঠবার পর তার অটোপাইলট চালু হয়েছে। সে-খবর যানের কমপিউটার আন্তর্জাতিক আইন মেনে সম্প্রচার করে দিয়েছে সমস্ত কম্পাঙ্কে। অর্থাৎ এর ওপর কোনও নজরদারী চালু থাকলে নজরদার নিশ্চিত হবে যে আমরা সকলেই যানে উঠেছি।
‘এরপর একেবারে শেষমুহূর্তে লাফ দেবার পরেই যানের প্লাজমার জ্বালানির ঝড় মহাকাশ থেকে যে কোনও ইলেকট্রনিক নজরদার যন্ত্রের চোখে একটা অস্বচ্ছ আবরণ গড়ে দেবে কয়েক মিনিটের জন্য। সেই সময়টুকুর সুযোগ নিয়ে বাবা আমাদের কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে যাবার নির্দেশ পাঠিয়েছেন একেবারে শেষমুহূর্তে।
‘কিন্তু কেন?’
‘বোধহয় এখন তা অনুমান করতে কোনও সমস্যা হবে না এলেনা। আকাশের দিকে দ্যাখো,’ বলতে বলতেই হঠাৎ কাঁপা কাঁপা আঙুলে হ্যাঙারের পোর্টহোল দিয়ে উঁকি মারা আকাশের দিকে দেখাল ক্রিস। সেখানে, স্থির হয়ে ভাসতে থাকা সুইফট টাটলের আগুনের গোলার আলোয় কোনও তারা চোখে পড়ে না আর। কিন্তু সেই উজ্জ্বল আলোর বুকেও হঠাৎ করেই তখন জেগে উঠেছে একটা উজ্জ্বলতর আলোর ঝরনা। এক মুহূর্তের জন্য চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যে জ্বলে উঠে তার আগুনের ফুলকিগুলো ফের ধেয়ে আসছিল পৃথিবীর দিকে।
‘সবাই শেষ হয়ে গেছে এলেনা। কক্ষপথে পৌঁছোবার আগেই কোনও চোরা আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে যানটা। এর যাত্রীদের মধ্যে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই…’
এর সামান্য সময় বাদে, নয় আলোকমিনিট দূরত্বে অন্ধকার শূন্যে ভাসমান দুটো কার্বণ গ্রহাণুর বুকে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার যানদুটোর একটাতে একটা উত্তেজিত শব্দ জেগে উঠল। টেবিলে হাতের আঘাত করে উঠে দাঁড়িয়েছেন অ্যাডমিরাল লালপিওতে। সেখানে তখন ভেসে উঠেছে কমান্ডার জালালের মুখ। তার পাশে, ছুটন্ত যানের জানালা দিয়ে ক্রমশ বড় হয়ে উঠছিল পৃথিবীর আবহমণ্ডল ছেড়ে উঠে আসতে থাকা ভোঁতা চেহারার একটা অতিকায় যান। সরাসরি তার দিকে নিজের আত্মঘাতী যানের মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটে চলেছেন তিনি। ইশারায় সেদিকে দেখিয়ে জালাল বলে উঠলেন, ‘মিশন…’
তাঁর কথাটা শেষ হবার আগেই হঠাৎ তীব্র আগুনের একটা ঝলক পর্দা জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েই অন্ধকার হয়ে গেল পর্দাটা। হাতটা নিজের অজান্তেই একবার কপালে উঠল লালপিওতের। ঠিক ন-মিনিট আগে মঙ্গল উপনিবেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে আত্মবলি দেওয়া সৈনিক জালাল আর তার দলের সম্মানার্থেই সম্ভবত। ক্রিস্টোফারসহ ইনস্টিটিউটের সমস্ত বিজ্ঞানীকে নিয়ে মঙ্গলযানের রওনা হবার পরিকল্পনার খবর তাঁর কাছে আসবার পর থেকে এই মুহূর্তটার জন্যই গ্রহাণুপুঞ্জ বলয় ছেড়ে চাঁদের পেছনে কয়েকদিন ধরে অপেক্ষায় ছিল জালালের আত্মঘাতী যান।
ওই ক্রিস্টোফার যদি লালপিওতের কাছে অজানা কোনও রহস্যকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি দেবার চেষ্টা করেও থাকে, তাহলে এই মুহূর্তে তার ছাই ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর কক্ষপথ জুড়ে। কিছু নিরীহ মানুষও মারা গেল সঙ্গে এই যা। তবে সে-নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই লালপিওতের। এটা যুদ্ধ। এখানে ন্যায়নীতির কোনও ভূমিকা নেই।
‘আরও একবার!’
হঠাৎ পাশে বসা জেমস আরিয়ানার গলাটা পেয়ে তাঁর দিকে ঘুরে দেখলেন লালপিওতে।
‘আরও একবার… কী, জেমস?
জেমসের চোখদুটো দ্বিতীয় একটা পর্দার দিকে স্থির হয়ে রয়েছে তখন। সমস্ত পার্থিব বেতার সম্প্রচারের ওপর নজরদারি করবার পর্দাটায় অজস্র তথ্য ভেসে চলেছে। প্রশ্নটা করে অলসভাবে সেদিকে একবার ঘুরে তাকালেন লালপিওতে। ও তথ্যে আর কোনও আগ্রহ বেঁচে নেই তাঁর এখন। মিশন সাফল্যের গোড়ায় এসে পৌঁছেছে এবার। আর কোনও বাধা নেই সামনে। শেষ একটা বাধার যে ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল, প্রফেসর বোসের ওই শয়তান ছেলেটাকে শেষ করবার পর সেটুকুও সরে গেছে।
পর্দার দিকে চোখ ধরে রেখে আরিয়ানার ভ্রূদুটো কুঁচকে রয়েছে তখন। লালপিওতে সেদিকে ঘুরে তাকাতে আঙুলের ইশারায় অন্য তথ্যগুলোকে মুছে দিয়ে দুটো সংখ্যার সারিকে সামনে টেনে এনেছেন তিনি সেখানে।
‘একটা ছোট্ট ধাঁধা অ্যাডমিরাল। যানটা উৎক্ষেপণের ঠিক আগের মুহূর্তে পৃথিবীর আয়নমণ্ডল থেকে একটা বেতারসংকেত তার দিকে ভেসে গিয়েছিল। তার কিছুক্ষণ বাদে ফের এই দ্বিতীয় সংকেতটা।’
সংখ্যাগুলোর দিকে একনজর তাকিয়ে দেখলেন লালপিওতে। একেবারেই এলোমেলো। পরিচিত কোনও কোডের সঙ্গে তার মিল নেই কোনও।
‘গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হচ্ছে না জেমস। সম্ভবত আয়নমণ্ডলে কোনও বৈদ্যুতিক ক্ষরণ বেতার তরঙ্গটার জন্ম দিয়েছে। যন্ত্রগণ তাকে সংখ্যার চেহারা দিতে তাই অর্থহীন সংখ্যাগুলোর জন্ম হয়েছে। তবে গ্রোভারকে এটা পাঠাও। বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেলে যেন আমাকে জানায়।’
বলতে বলতেই নিজের পর্দায় সুইফট টাটলের টেলিমেট্রির দিকে নজর ঘোরালেন লালপিওতে। একপাশে চালু একটা কাউন্ট ডাউন ঘড়ি দেখাচ্ছিল, আর ছিয়ানব্বই ঘণ্টা…
***
সেখান থেকে অনেক দূরে পৃথিবীর বুকে একটা অন্ধকার হ্যাঙারের ভেতরেও পৌঁছেছিল দ্বিতীয় সংকেতটা। তাকে অনুবাদ করে নিয়ে এলেনার মুখের দিকে একটু বিস্ময়ের চোখে তাকিয়েছিল ক্রিস্টোফার, ‘তাবিজে স্মৃতি পান করো…’
‘এর মানে কী? তাবিজ… আমি কিছু…’
‘ক্রিস!’ হঠাৎ এলেনার উত্তেজিত গলাটা তাকে থামিয়ে দিল। তার একটা হাত তখন ক্রিস্টোফারের গলার কাছে উঠে এসে টান দিয়ে খুলে এনেছে সেখানে ঝোলানো ধাতুর তাবিজটা। সেটাকে হাতে ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল সে।
তার হাত থেকে তাবিজটা নিজের হাতে নিল ক্রিস। দীর্ঘদিন ধরে গলায় পরে থাকতে থাকতে একটা অভ্যাসের মতোই দাঁড়িয়ে গেছে তার জিনিসটাতে। হঠাৎ করে তার আলাদা অস্তিত্বের কথা তার মাথায় আসে না।
‘এটা… এটা কোথা থেকে পেয়েছিলে তুমি?’
‘জানি না এলেনা। তোমাকে তো আমি আমার পরিচয় সমস্তই খুলে বলেছি। যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে জঙ্গলের ভেতরে তখন থেকেই দেখেছি এটা আমার গলায় পরানো। খুলে ফেলতে গিয়েছিলাম। কা পোন মানা করেছিলেন। বলেছিলেন, হয়তো ওই আমার আসল জীবনের একমাত্র স্মৃতি। ব্যাপারটা সেন্টিমেন্টাল, কিন্তু তবু কখনও প্রাণে ধরে ওটাকে খুলে ফেলতে পারিনি আমি। কিন্তু কা পোনের এই মেসেজটা…’
হঠাৎ নিজের ব্যাকপ্যাকটা থেকে বের করে আনা ধাতব দণ্ডটার গায়ের একটা বোতামে চাপ দিল এলেনা। তার মাথায় একটা সরু লেজার কাটারের আলো জ্বলে উঠেছে।
‘মাটিতে রাখো ওটাকে। সূক্ষ্ম কাজ। সাবধানে করতে হবে। তোমার কাজ নয় এ। আমাকে করতে দাও।’
প্রায় মিনিটকয়েকের চেষ্টায় শিল্পীর দক্ষতায় একটু একটু করে তাবিজটার মাথাটাকে কেটে ফেলে ছুরির আলোটা বন্ধ করল এলেনা। তারপর সেটাকে উলটো করে হাতের তেলোয় সামান্য ঠুকে তার ভেতর থেকে স্ফটিকের চ্যাপটা, ছোট্ট শিশিটা বের করে এনে ক্রিস্টোফারের হাতে তুলে দিল সে।
শিশিটার মধ্যে জমে থাকা ঘন গোলাপি তরলটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ক্রিস্টোফার।
‘স্মৃতি পান করো… তাহলে কী…’
‘না ক্রিস। একটা অজানা রাসায়নিক। এখানে কেউ আমাদের সাহায্য করবার নেই। তোমার কোনও বিপদ হলে…’
তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ম্লান হাসল ক্রিস্টোফার, ‘কা পোনকে আমি বিশ্বাস করি। তা ছাড়া ডুবন্ত মানুষ, খড়কুটো ধরেও তো বাঁচতে চায় এলেনা! ঝুঁকিটা নিয়েই দেখা যাক। যদি বিপদ হয় তা হলে মৃত্যুটা ছিয়ানব্বই ঘণ্টা এগিয়ে আসবে এই যা।’
বলতে বলতেই শিশির তরলটুকু নিজের মুখে ঢেলে দিয়েছে ক্রিস্টোফার। আর তারপর মাথায় তীব্র একটা যন্ত্রণার বিস্ফোরণ নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সবকিছু অন্ধকার হয়ে এল তার সামনে।
১৩ আগস্ট ২১২৬। পার্থিব সময় সন্ধ্যা আটটা জিএমটি।
মনিটর থেকে ভেসে আসা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দটা তাঁর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলল এবার।
‘আর সতেরো ঘণ্টা জেমস। বাহিনী…’
‘সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে আছে অ্যাডমিরাল। গ্রহাণু বলয়ের এই ইঁদুরের গর্ত ছেড়ে আর তেরো ঘণ্টার মধ্যে রওনা হব আমরা। ঠিক সংঘাতমুহূর্তে মঙ্গলের অস্থায়ী পার্থিব হেডকোয়ার্টারে আঘাত হানা হবে। তারপর…’
সামনের পর্দায় ভেসে থাকা গোলকটার শরীর প্রায় ছুঁয়ে ফেলা উজ্জ্বল আলোকবিন্দুটা আপাতদৃষ্টিতে স্থির। কিন্তু লালপিওতে জানেন, অবশেষে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের অন্তিম আকর্ষণ তাকে আকাশচ্যূত করে পৃথিবীর মহাকর্ষ কূপের দিকে ঠেলে দিয়েছে এইবারে। এইবার তীব্রবেগে একটা দানবিক স্ক্রুয়ের মতো পৃথিবীকে ঘিরে ক্ষয়িষ্ণু কক্ষপথে তার শেষ যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অবশেষে… দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান।
হ্যাঁ। প্রজাতি হিসেবে মানুষের বেশির ভাগটাই শেষ হয়ে যাবে ওতে। কিন্তু তাতে কোনও আক্ষেপ নেই অ্যাডমিরাল লালপিওতের। চাঁদ ও মঙ্গল উপনিবেশ কিংবা ওদের অন্যান্য মহাকাশঘাঁটিগুলোতে এই মুহূর্তে যে মানুষদের সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, তাদের মধ্যে এই প্রজাতিকে নতুন করে গড়ে তোলবার সমস্ত উপাদানই মজুত রয়েছে।
আর শেষ পর্যায়ে এসে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে ওদের চালু করা প্রজেক্ট এক্সোডাস তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে এ-গ্রহের শ্রেষ্ঠ মানবসম্পদের একটা বড় অংশকে। ধ্বংসের পালা শেষ হয়ে গেলে তাদের দিয়েই ফের তিনি গড়ে তুলবেন তাঁর সাম্রাজ্য। তারপর একদিন, সৌরজগৎ ছেড়ে তাঁর সেনাবাহিনী হয়তো…
‘আপনার পাঠানো সিগন্যালগুলোর প্রাথমিক বিশ্লেষণ যন্ত্রগণক শেষ করেছে অ্যাডমিরাল,’ হঠাৎ সামনের পর্দায় ভেসে ওঠা গ্রোভারের মুখটা তার চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে দিল, ‘তবে তা কোনও প্রাকৃতিক রেডিয়ো নয়েজ নয়।’
হঠাৎ মুখটা শক্ত হয়ে উঠল লালপিওতের, ‘তুমি নিশ্চিত?’
গ্রোভারের মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল ফের, ‘সাইফার আমার প্রিয় গবেষণার বিষয় ছিল একসময়। আমি নিশ্চিত, সিগন্যালের সংখ্যার সারটা অক্টাডেসিম্যাল ভিত্তিতে দাঁড়ানো দুই বা তিন স্তরীয় কোডিং-এর ফল।’
মাথায় ঝিকিয়ে ওঠা অসংখ্য সম্ভাবনার ভিড়টাকে সযত্নে সরিয়ে দিলেন লালপিওতে। এখন সে নিয়ে ভাববার সময় নেই। যুক্তির কঠিন পথে কেবল পরের ধাপটাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে তাঁকে। চিন্তাভাবনাগুলোকে খানিক সাজিয়ে নিয়ে যখন ফের মুখ খুললেন তিনি তখন তাঁর গলায় উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও নেই আর, ‘ডি-কোডিং করতে কত সময় লাগবে তোমার?’
‘নির্ভর করছে মূল অক্টাডেসিম্যাল সিরিজটাকে ঠিক কতগুলো স্তরে রি-কোডিং করা হয়েছে ও কোন স্তরে কী পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তার ওপর। প্রাথমিক বিশ্লেষণে এর চরিত্র বুঝতেই প্রায় দু-দিন লেগেছে আমাদের। কাজেই এর অর্থ উদ্ধারের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে আরও কিছুদিন…’
‘আঃ গ্রোভার। অভিজ্ঞতা থেকে আনুমানিক একটা সময় বলতে পারবে কি?’
একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেন গ্রোভার। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, ‘দুঃখিত অ্যাডমিরাল। আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী গণককে কাজে লাগালেও অন্তত কয়েকদিন সময় আমার এতে লাগবেই। এর চেয়ে নিখুঁত পূর্বাভাস দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এখন ধাঁধার উত্তর খোঁজবার সময় নয় অ্যাডমিরাল। আগে মিশন সম্পূর্ণ হোক, তারপর না হয়…’
পাথরের মতো স্থির মুখে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন অ্যাডমিরাল লালপিওতে। গ্রোভারের কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, ‘সংকেতটার উৎস বলো গ্রোভার।’
‘ভুসমলয় কক্ষপথ মাইনাস ১২৭ দ্রাঘিমা। কিন্তু…’
‘এখান থেকে সর্বোচ্চ গতিতে ওখানে পৌঁছোতে কত সময় নেবে?’
‘আমাদের সর্বোচ্চ গতির যান আপনার ব্যক্তিগত ফ্রিগেট মিসিয়ারি। তাতে অন্তত ছ-ঘণ্টা সময় লাগবে। কিন্তু…’
‘বেশ। চল্লিশজন কম্যান্ডোর একটা দল নিয়ে তুমি ঠিক আধঘণ্টার মধ্যে এই যানের দু-নম্বর এয়ারলক-এ মিসিয়ারি যুদ্ধযানে পৌঁছাবে।’
হঠাৎ আসন ছেড়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালেন জেমস আরিয়ানা, ‘অ্যাডমিরাল লালপিওতে, নির্দিষ্ট সময়ের আগে আত্মগোপনের জায়গা ছেড়ে একটা যান কেন এভাবে…’
পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে গণকের ফিঙ্গারপ্যাডে নিজের আঙুলগুলো ছুঁইয়ে নিলেন লালপিওতে। তারপর সেখানে ভেসে ওঠা ফাঁকা জায়গাটায় দ্রুত কিছু সংকেত টাইপ করতে করতেই জবাব দিলেন, ‘ষষ্ঠেন্দ্রিয় জেমস। দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছি আমি। আমার মন বলছে এটা কোনও অঘটন নয়। এখানকার মিশনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আপনি নেবেন এবারে। আমি কমপিউটারে কর্তৃত্ব বদলের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি।’
‘তুমি…’
‘আমি নিজে ওখানে যাব জেমস। শেষ পার্থিব যানটা উৎক্ষেপণের সময় পরপর দুটো সংকেত ওখান থেকে পৃথিবীর দিকে পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে দ্বিতীয়টা ওদের যান ধ্বংস হবার বেশ কিছুক্ষণ পরে। আমার মন বলছে, সত্যব্রত বোসের আস্তিনের শেষ তাসটা এইবার খেলা হয়েছে ওখানে।’
***
‘টাইমার চালু করো টাইকো।’
‘কতক্ষণ সময় দিতে চান?’
মাইনাস ১২৭ দ্রাঘিমার ভুসমলয় কক্ষপথ ছেড়ে থ্রাস্টারের তীব্র ধাক্কায় পৃথিবীর অভিকর্ষ কূপের আরও গহনে তলিয়ে যাচ্ছিল কার্তাং। তার তাপ প্রতিরোধক আবরণ আস্তে আস্তে গণগণে হয়ে উঠছিল ক্রমশ ঘন হয়ে ওঠা বায়ুমণ্ডলের ঘষায়।
‘মাইনাস ১২৭ দ্রাঘিমায় মিসিয়ারির পৌঁছোবার আনুমানিক সময় বলো।’
পর্দায় টাইকোর মুখটা ভাবলেশহীনভাবে ঝুলে আছে। একটুক্ষণ থেমে থেকে সে জবাব দিল, ‘ওরা গ্রহাণু বলয় ছেড়ে রওনা হয়েছে ছ-ঘণ্টা আগে। আমার হিসেবমতো আর ঠিক একঘণ্টা।’
‘সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায়, ওখানে ছেড়ে আসা রেডিয়ো বিকন লাগানো পাথরের টুকরোটা দেখে ওরা প্রথমে সাবধান হবে। তারপর ধীরে ধীরে ওটার কাছে এগোবে পরীক্ষা করবার জন্য। আনুমানিক কতটা সময় তাতে লাগতে পারে টাইকো?’
পর্দায় ভেসে থাকা অতিকায় কুকুরের ছবিটা ফের একবার তার দু-পায়ের থাবায় মুখ গুঁজল। কা পোন সেদিকে তাকিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন। ওই ছবিটার পেছনে আত্মগোপন করে থাকা অতিকায় যন্ত্রমস্তিষ্ক মানুষের চিন্তার চেয়েও দ্রুতগতিতে সম্ভাবনাতত্ত্বের অসংখ্য চলরাশিকে বিশ্লেষণ করে গড়ে নিতে পারে যে কোনও পূর্বাভাস মডেল। চোরাচালানকারীর অনিশ্চয়তা ভরা জীবনে সম্ভাব্য পূর্বাভাসের এই জুয়ায় বহুবারই কা পোনকে জিতিয়ে এসেছে টাইকো।
সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ মুখে একটা মৃদু হাসি খেলে গেল কা পোনের। অদৃষ্টের পরিহাসে, আজ বাঁচবার জন্য পৃথিবীর শেষ ভরসা হয়ে উঠেছে এক চোরাচালানকারির যানের যন্ত্রমস্তিষ্ক আর তার পূর্বাভাসের আলগরিদম।
‘অন্তত একঘণ্টা। সম্ভাবনা শতকরা আশি ভাগ।’
‘আরও একটু বেশি সময় দাও। এখন থেকে ঠিক আড়াই ঘণ্টা ব্যবধানে ডিটোনেশন পয়েন্ট স্থির করো।’
‘জো হুকুম।’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের দিকে ছুটন্ত কার্তাং থেকে ধেয়ে গেল একটা বেতার সংকেত। তার লক্ষ্য মাইনাস ১২৭ দ্রাঘিমার ভুসমলয় কক্ষপথে কার্তাং-এর ছেড়ে আসা পাথরের টুকরোটার গায়ে আটকানো যন্ত্রটার গ্রাহক মডিউল। সযত্নে ঢেকে রাখা ছোট্ট যন্ত্রটাকে দেখলে দূর থেকে পাথরেরই অংশ বলে ভুল হয়। তবে সেই ছদ্মবেশের আড়ালে তখন সেই সংকেত পেয়ে জেগে উঠেছে একটা বিস্ফোরকের টাইমার। বিস্ফোরকটার শক্তি খুব কম। দূর থেকে কোনও সেনসরের পক্ষে তার উপস্থিতি আঁচ করা মুশকিল। কিন্তু পাথরের খণ্ডটার ভেতরে পুরু সিসের খোলের ভেতর লুকিয়ে রাখা দু-খণ্ড বিশুদ্ধ প্লুটোনিয়ামের পিণ্ডের মাঝখানের রক্ষা আবরণকে গুঁড়িয়ে দিয়ে মুহূর্তে তাকে বিস্ফোরক সংকট ভরে পৌঁছে দেবার জন্য সেটুকু শক্তিই যথেষ্ট।
***
‘ক্রিস… ক্রিস্টোফার…’
ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছিল এলেনার। নির্জন হ্যাঙারের অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে তার। আবছা আলোয় শুয়ে থাকা শরীরটার ওপর ঝুঁকে পড়ে বারবার তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগাবার চেষ্টা করতে করতে শরীরটার ওপরেই হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। এইবারে একেবারে একা হয়ে গিয়েছে সে। গত তিনটে দিন ধরে জ্ঞানহীন ওই শরীরটাকে কতভাবেই তো জাগাবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু ফল হয়নি কোনও। যেন এক অনন্ত ঘুমে তলিয়ে গেছে ক্রিস। বারবার একটা আক্ষেপ কুড়ে কুড়ে খায় এলেনাক। কেন সে তাকে ওই অজানা ওষুধ খেতে দিল! কেন সে বাধা দিয়ে বলল না…
কয়েকদিন ধরে স্নায়ুর ওপর চলতে থাকা ঝড়কে আর সে বইতে পারে না।
‘এলেনা…’
হঠাৎ কানের কাছে হালকা একটা শব্দ জেগে উঠল তার।
‘ক্রিস!! তুমি…’
আস্তে আস্তে চোখদুটো খুলে গেল ক্রিসের। আবছা অন্ধকারে টলটলে দুটো চোখ এলেনার মুখের দিকে ধরা। তারপর সামান্য ক্লান্ত গলায় সে বলল, ‘ক্রিস নয় এলেনা। আমি জিষ্ণু। প্রফেসর সত্যব্রত বোস-এর ছেলে জিষ্ণু বোস।’
হঠাৎ আস্তে আস্তে উঠে বসতে থাকা শরীরটাকে ছেড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ছিটকে গেল এলেনা। গলাটা বদলে গেছে ক্রিসের। রাসায়নিকটা খাবার পর তিন দিনের ওই মরণ ঘুম থেকে জেগে উঠে বদলে গেছে ছেলেটার শরীরের ভাষাও। আর… ওর বলা ওই নামটা…’
‘স-সত্যব্রত বোস! দ্য গ্রেট মার্টার অব দ্য ডেস্ট্রয়েড একাঘ্নি প্রজেক্ট! তুমি…’
‘ডেস্ট্রয়েড, হ্যাঁ। শহীদ তাও সত্যি,’ জিষ্ণুর গলায় ক্লান্তির ছাপ ছিল, ‘কিন্তু একাঘ্নি মরেনি এলেনা। এইবার সবকিছু মনে পড়ে গেছে আমার। আমাদের শেষ আশা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সাড়ে আটাশ ডিগ্রি উত্তর—পঁচানব্বই ডিগ্রি পূর্ব। হ্যাঁ, সেখানেই সব রহস্যের উৎস রয়েছে। আমাদের সেখানে পৌঁছোতে হবে। আঘাত মুহূর্তের অন্তত কয়েক ঘণ্টা আগে।’
‘সাড়ে আটাশ ডিগ্রি উত্তর— পঁচানব্বই ডিগ্রি পূর্ব!’ নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল এলেনা, ‘তার মানে অরুণাচলপ্রদেশের ভেতরে!’ হঠাৎ করেই একটা অবুঝ আশা ফের জেগে উঠেছে তার বুকের ভেতর।
কিন্তু পরমুহূর্তেই আশার আলোটুকু ফের নিভে গেল তার, ‘কিন্তু কী করে? আমাদের কাছে কোনও…’
‘যান নেই। কিন্তু ভেবো না এলেনা। কা পোন সংকেত যখন পাঠিয়েছেন তখন…’ বলতে বলতেই বাইরের দিকে তাকিয়ে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল হঠাৎ, ‘তৈরি হও এলেনা। কা পোন আসছেন।’
সেখানে স্পেসপোর্টের আকাশের গায়ে তখন অন্ধকার ছিঁড়েখুঁড়ে দ্রুত ধেয়ে আসছিল একটা জ্বলন্ত আগুনের বিন্দু।
***
‘লক্ষ্যবস্তু রেডারে ধরা পড়েছে অ্যাডমিরাল।’
‘যার যার আসনে ফিরে যাও। আমরা থামছি,’ বলতে বলতেই পাইলটিং পর্দার সামনে আঙুলের একটা জটিল মুদ্রা গড়ে তুললেন অ্যাডমিরাল লালপিওতে। ইশারা পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেছে মিসিয়ারির পেছনের জোড়া ইঞ্জিন। তার শরীরের সামনের দিকে বিভিন্ন জায়গায় লাগানো থ্রাস্টারগুলোর সম্মিলিত জেট, মুহূর্তের মধ্যে থামিয়ে আনছিল তার অকল্পনীয় সম্মুখগতিকে। তীব্র গতিজাড্যের চাপে আসনের সঙ্গে পিষে যাচ্ছিল যানের সৈনিকদের শরীর।
‘দূরত্ব?’
‘দশ হাজার মাইল।’
‘শক্তিচিহ্ন?’
‘শূন্য। কাছাকাছি এলাকায় হালকা প্লাজমাস্রোতের স্বাক্ষর রয়েছে তবে তা একেবারেই নগণ্য। প্রাকৃতিক হতে পারে। কেবল নির্দিষ্ট সময় পর পর দুর্বল একটা বেতারসংকেত ছাড়া… আশ্চর্য…’
‘কী?’
‘এ-এটা একটা পোলারাইজড সিগন্যাল অ্যাডমিরাল।’
হঠাৎ লালপিওতের ভ্রূদুটো কুঁচকে উঠল সামান্য। পোলারাইজড সংকেত সাধারণত একটা নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয়। অন্য কোনও অঞ্চল থেকে তার অস্তিত্ব টের পাওয়া কঠিন। তাহলে…
‘অভিমুখ?’
‘আ-আমরা অ্যাডমিরাল। সরাসরি আমাদের যানকে লক্ষ করে ছুটে আসছে ওই পাথরে টুকরো থেকে ভেসে আসা বেতার সংকেতগুলো।’
‘অসম্ভব। কোনও ভুল…’ বলতে বলতেই কী মনে হতে নিয়ন্ত্রক গণকের ক্যামেরার সামনে ফের একটা সংকেত করলেন লালপিওতে। যানের বাঁ-দিকের দুটো থ্রাস্টার হঠাৎ জেগে উঠেছে তাঁর ইঙ্গিত পেয়ে। তাদের তীব্র ধাক্কায় ডানদিকে সটান ছিটকে গেল মিসিয়ারি। সামনের মনিটরে ভেসে ওঠা সংখ্যাগুলো দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। মিসিয়ারির সরণের পরিমাণ মেপে চলেছে তা।
প্রায় একশো মাইল ডানদিকে সরে গিয়ে ফের স্থির হল মিসিয়ারি। প্রায় পাশে বসা সামিরা রেড্ডির দিকে ফিরে লালপিওতে বললেন, ‘রিডিংস্?’
‘এ অ-অসম্ভব! সংকেতটা দিক বদলে ফের আমাদের দিকেই ধেয়ে আসছে অ্যাডমিরাল। অথচ আমি নিশ্চিত এটা একটা পোলারাইজড বিম!’
হাতের ইশারায় ইঞ্জিন থামিয়ে দিলেন লালপিওতে। তাঁর ভ্রূদুটো একটা গিঁট পাকিয়ে উঠেছে কপালে। দ্রুত চিন্তা করছিলেন তিনি। পৃথিবীর ভূসমলয় কক্ষপথের যে অবস্থান থেকে পৃথিবীমুখী রহস্যময় সংকেতগুলো ছুটে গিয়েছিল, সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসছে একটা লক্ষ্যসন্ধানী রেডিয়ো তরঙ্গ। তাঁর যানের প্লাজমা সিগনেচারের সঙ্গে এক সুরে বাঁধা থেকে তা অনুসরণ করে চলেছে তাঁর যানকেই। কী করে তা সম্ভব?
যানের টেলিস্কোপ তখন বস্তুটার একটা আবছা ছবি গড়ে তুলছে তাঁর সামনের পর্দায়। একটা পাঁচ মিটারের কাছাকাছি ব্যাসের পাথরের টুকরো!
‘আদেশ পেলে এখান থেকেই ওটাকে…’
‘না সামিরা,’ মৃদু মাথা নেড়ে কম্যান্ডো দলের প্রধান সামিরা রেড্ডিকে থামিয়ে দিলেন লালপিওতে, ‘ঠান্ডা মাথায় ভেবে নিতে হবে প্রথমে। অজানা একটা বস্তু। তার সাহায্যে মিসিয়ারিকে লোভ দেখিয়ে কেউ টেনে এনেছে এখানে। কাছাকাছি এসে পৌঁছুলে তার লক্ষ্যসন্ধানী পোলারাইজড বিম-এর বিষয়টা যে কোনও যানের নজরে পড়বেই এটা একেবারেই সাধারণ সত্য। তার মানে, ধরে নিতে হবে, যে সেটা রেখেছে তার উদ্দেশ্যই ছিল কাছাকাছি এসে পৌঁছোবার পর মিসিয়ারি বিষয়টা যাতে টের পায়।’
‘কিন্তু এমন অযৌক্তিক কাজ… আমি এর কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না অ্যাডমিরাল।’
মেয়েটি তরুণ। এখনও যুদ্ধ তার কাছে অ্যাড্রিনালিনের ধাক্কায় হত্যা আর আগুনবৃষ্টির একটা উৎসব ছাড়া আর কিছু নয়। উৎসুক মুখটার দিকে তাকিয়ে একবার নিজের মনেই মাথা নাড়লেন লালপিওতে। একদিন তিনি নিজেও অমন ছিলেন। উৎসাহী, অনভিজ্ঞ এক তরুণ তুর্কি।
কিন্তু অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে, যুদ্ধ একটা দাবাখেলার মতন। অস্ত্রের জোরের পাশাপাশি, শত্রুর চালকে কে কতটা অগ্রিম পড়ে নিতে পারে তার ওপর হারজিত নির্ভর করে। শত্রুর চিন্তাস্রোতকে সফলভাবে অনুসরণ করতে পারাই একজন অ্যাডমিরালকে যুদ্ধে জয়ের পথ দেখায়।
‘ভাবো সামিরা। শত্রুকে ছোট করে দেখো না। বিকনটা এখানে যে-ই রেখে থাকুক, পৃথিবীর দিকে রহস্যময় সিগন্যালদুটোও সে-ই এখান থেকে পাঠিয়েছে সেটা অনুমান করে নেওয়া যায়। কিন্তু তারপর, কেন সে এই টোপটা রেখে গেল এখানে? মিসিয়ারি টের পাবার পর কী পদক্ষেপ সে নিতে পারে বলে আন্দাজ করেছে অজানা শত্রু? এক্ষেত্রে সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য পথটা হল তোমার প্রস্তাব। গোলা মেরে উড়িয়ে দেওয়া জিনিসটাকে। তার অর্থ সে সেটাই চায়। চায় স্বাভাবিক যুক্তিকে ব্যবহার করে আমরা যেন এটাকে ধ্বংস করে দিই। কেন?’
একটুক্ষণ স্থির হয়ে রইল সামিরা। তারপর সামান্য ইতস্তত করে বলল, ‘পাথরটার সঙ্গে হয়তো এমন কিছু তথ্য রয়ে গেছে যা তাদের এখান থেকে সরে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই হয়তো… কিন্তু অ্যাডমিরাল, সেক্ষেত্রে ওরা নিজেরাই তো ওটাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে…’
‘জানি না সামিরা। এর কাছাকাছি যাওয়া যাক প্রথমে। যুক্তি বলছে, আগে একে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। হয়তো তাতেই কারণটাও জানা যাবে! তারপর প্রয়োজন হলে…’
অতিকায় পাথরের টুকরোটা নিতান্তই সাধারণ চেহারার। বৈশিষ্ট্যহীন। কোনও ধরনের বিকিরণের চিহ্ন নেই তার শরীরে। মিসিয়ারির যান্ত্রিক হাত তাকে সাবধানে ধরে ঢুকিয়ে আনছিল তার পেটের ভেতর। যানের মাথার নিয়ন্ত্রণকক্ষের পর্দায় তখন তার ছবিটা বিরাট আকার নিয়ে ভাসছে। কমান্ডোদের দলটার একটা অংশ তার শরীর থেকে বিকনটাকে খুলে এনেছে। অন্য একটা বড় অংশ, যানের মেঝেতে আস্তে আস্তে স্থির হতে থাকা বস্তুটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে ধরা যন্ত্রগুলো তখন বস্তুটার অন্দরমহলের খবর নিতে শুরু করেছে।
‘বস্তুটা পাথর নয় অ্যাডমিরাল,’ নিজের পর্দায় ভসে ওঠা সংকেতগুলোর দিকে ইশারা করছিল সামিরা রেড্ডি। উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে তার মুখটা, ‘কোনও একধরনের প্লাস্টিক। থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিতে তৈরি। সফ্ট এক্স রে-র ছবি আসছে…’
লালপিওতের চোখে সামনে পাথরের টুকরোটার ছায়া ছায়া ছবিটার ভেতরে ফুটে উঠছিল একটা ধাতব গোলকের ছবি।
‘মেটাল আইডেন্টিফিকেশন?’
‘সীসা। আধ মিটার পুরু। নিউট্রিনো রেডিয়েশন ফোটোগ্রাফি শুরু হচ্ছে…’
পর্দায় ভেসে ওঠা বেঁটে যন্ত্রটাকে তখন ভাসিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে জিনিসটার গা ঘেঁষে। সেদিকে একনজর তাকিয়ে দেখলেন অ্যাডমিরাল লালপিওতে। সীসার আবরণ! কোনও পারমাণবিক কোর? বুবি ট্র্যাপ?
পর্দায় এবার সিসের গোলকের ভেতরের ছবিটা ফুটে উঠছিল। ঝাপসা, কাঁপা কাঁপা ছবিটায় দুটো পাশাপাশি ক্যাপসুলের ভেতর কোনও ধাতুর দুটো পিণ্ড রাখা আছে। তাদের গায়ে ভেসে ওঠা লেখাগুলোর দিকে চোখ আটকে গেছে তখন তাঁর। বিশুদ্ধ প্লুটোনিয়াম!
তাদের মাঝখানের আবরণের ওপর লাগানো ছোট্ট যন্ত্রটার গায়ে একটা ডায়াল। তাতে ভেসে ওঠা সংখ্যাগুলো তখন দ্রুত শূন্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন লালপিওতে। দীর্ঘ সামরিক জীবনে এমনভাবে ঠকে যাবার মুহূর্ত তাঁর আসেনি বিশেষ। অজানা শত্রু তাঁর চেয়ে আরও একধাপ আগে এগিয়ে ভেবেছিল। তাঁকে সে চেনে! তাঁর চিন্তাপদ্ধতি কীভাবে এগোবে সেটা আগে থেকেই নিখুঁত অনুমান করে নিয়েছিল সে। তারপর সেই পথেই ফাঁদ পেতে রেখে গিয়েছে সে।
দেরি করবার সময় ছিল না। ক্যাবিনেটের তলায় হাত বাড়িয়ে একটা বোতামে চাপ দিলেন তিনি। তারপর হঠাৎ সচল হয়ে ওঠা এমার্জেন্সি থ্রাস্টারের ধাক্কায় নিয়ন্ত্রণ ক্যাপসুলসহ পৃথিবীর দিকে ছিটকে যেতে যেতেই তাঁর অসহায় চোখের সামনে পর্দায় ভেসে উঠল নিঃশব্দ একটা বিস্ফোরণের ছবি। সেখানে তখন মহাশূন্যের অন্ধকারে সাতরঙা আলোর ঝলক ছড়িয়ে বিস্ফোরণে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে মিসিয়ারির মূল শরীর।
***
‘কতজন অবশিষ্ট রয়েছে?’
‘একুশজন অ্যাডমিরাল। বাকিরা…’ সামিরার গলায় কাঁপুনি লেগেছে তখন। তার চোখে জলের ছোঁয়া ছিল। এখনও তার মন যুদ্ধের আগুনে পুড়ে শক্ত হয়নি।
বিস্ফোরণের জায়গাটা থেকে প্রায় পাঁচশো মাইল দূরে এসে স্থির হয়েছে মিসিয়ারির কন্ট্রোল ক্যাপসুল। পর্দায় চোখ আটকে রেখেই লালপিওতে মাথা নাড়লেন, ‘দুঃখ করবার সময় এ নয় সামিরা। ওরা শহিদ হয়েছে। তবে এ-কাজ যে করেছে তাকে আমি ছাড়ব না। নরকে পালিয়ে গেলেও তার সন্ধান আমি বের করবই। এখন এসো। বস্তুটা প্রথম যখন নজরে এল তখন তুমি একটা কথা বলেছিলে, ‘ওর কাছাকাছি হালকা প্লাজমা স্রোতের স্বাক্ষর রয়েছে।’
‘হ্যাঁ অ্যাডমিরাল। তবে তা একেবারেই ক্ষীণ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণেই তা…’
‘হতে পারে। তবে সেইসঙ্গে অন্য কিছুও হতে পারে সামিরা। স্বাক্ষরগুলোকে আলাদা করে অ্যামপ্লিফাই করতে পারবে?’
‘হয়তো পারব অ্যাডমিরাল। তবে তার অনেকটাই গাণিতিক অনুমান হবে। অত্যন্ত ক্ষীণ… বলতে বলতেই সামিরার দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় গণকের মস্তিষ্ক থেকে বের করে আনা প্রাথমিক স্ক্যানের তথ্য থেকে আলাদা হয়ে পর্দায় ভেসে উঠছিল কয়েকটা প্রায় অদৃশ্য আলোর বিন্দু।
বিন্দুগুলোর জ্যামিতিক নকশা বিশ্লেষণ করো সামিরা। এদের মিলিত সম্ভাব্য চেহারা…
হঠাৎ শিকারের গন্ধ পাওয়া শ্বাপদের মতোই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল সামিরার চোখদুটো। তার দ্রুত নড়তে থাকা আঙুলের ইশারায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বিন্দুগুলোর মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠছিল একটা উপবৃত্তাকার দাগ।
‘ট্র্যাজেকটরি! কার? আনুমানিক গণনাসূত্র প্রয়োগ করো। এইবার… হ্যাঁ…
পর্দায় এইবার একটা পরিষ্কার দাগ ফুটে উঠছিল। -১২৭ ডিগ্রি দ্রাঘিমা থেকে বের হয়ে তা সোজা ঝাঁপ দিয়েছে পৃথিবীর গভীরতর আবহমণ্ডলের দিকে।
‘এটা একেবারেই আনুমানিক অ্যাডমিরাল। বিশ্লেষণের মতো যথেষ্ট তথ্য নেই আমাদের হাতে। ভুল হবার সম্ভাবনা শতকরা আটানব্বই…’
হঠাৎ হাতের ইশারায় সামিরাকে থামিয়ে দিলেন লালপিওতে। মুখে একটা বিচিত্র ভাব ফুটে উঠছিল তাঁর, ‘ভুল সামিরা। ওই স্থানাঙ্ক আমি চিনি। এই তথ্যের সঙ্গে আমার সেই জ্ঞানটুকুকে যোগ দিলে তোমার কমপিউটার একটা নতুন হিসেব দিতে পারত। তাতে ভুল হবার সম্ভাবনা শূন্য।’
‘বুঝলাম না অ্যাডমিরাল।’
পর্দায় ভেসে ওঠা স্থানাঙ্কগুলোর দিকে বোকার মতো তাকিয়ে কিশোরীটি বলে উঠল।
‘গ্লোবাল মানচিত্রে স্থানাঙ্কগুলোকে বসিয়ে ছবিটা দেখাও সামিরা।’
পর্দায় ভেসে ওঠা বিশাল মহাকাশবন্দরটা নির্জন। তার একপাশে যশপাল স্পেস রিসার্চ সেন্টারের অতিকায় বোর্ডটা তখনও আলো জ্বালিয়ে কোনও অদৃশ্য অতিথির অপেক্ষায় মূক হয়ে আছে।
হাতের একটা ইশারায় হঠাৎ ক্যাপসুলের মুখটা ঘুরে গেল পৃথিবীর দিকে। থ্রাস্টারের তীব্র ধাক্কায়, সেই স্পেসপোর্টকে লক্ষ করে তার আবর্তনপথকে ততক্ষণে বেঁধে দিয়েছে যানের গণক।
‘বাহিনীকে তৈরি করো সামিরা। হাতে সময় বেশি নেই আর। ওখানে যে-ই থাক, এইবার তার বাঁচবার অধিকার শেষ হয়ে গেছে…’
***
‘কেন আপনি তিনটে দিন এভাবে দেরি করলেন কা পোন? ক্রিস মারা যাচ্ছিল। আমি একা ওকে নিয়ে এখানে…’
এলেনা নামের মেয়েটার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। কা পোনের মুখে এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও একটুকরো হাসি ফুটে উঠল, ‘জিষ্ণুকে তুমি খুব ভালোবাসো, তাই না এলেনা?’
অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটার সামনে ধরা পড়ে গিয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়েই মাথা নামাল সে। পর্দায় টাইকোর সঙ্গে ইশারায় কিছু আলোচনা করতে করতেই জিষ্ণু হঠাৎ এদিকে তার দিকে ঘুরে তাকিয়েছে। ভারী লজ্জার বিষয়।
‘প্রশ্নটা আমি অন্য কারণে আপনাকে করেছি কা পোন,’ তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাল এলেনা। আসলে সত্যি সত্যিই তার প্রশ্নটা করবার অন্য কারণ ছিল। জিষ্ণুর বিষয়টা মুখ ফসকে বের হয়ে এসেছে প্রায় নিজেরই অজান্তে।
‘যতটুকু শুনেছি তাতে একমাত্র ক্রি… মানে জিষ্ণুই একাঘ্নির নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বিষয়ে ওয়াকিবহাল। এক্ষেত্রে গত তিনটে দিন তাকে এভাবে একা ফেলে রেখে আপনার অপেক্ষা করবার কারণটা আমি বুঝতে পারছি না কা পোন। আমাদের উচিত ছিল এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে অরুণাচলের দিকে এগিয়ে যাওয়া… সেখানে…’
‘জিষ্ণুর মুখে যতটুকু তুমি জেনেছ তাতে তোমার মনে প্রশ্নটা জাগা স্বাভাবিক এলেনা। সেটা জিষ্ণুরও জেগে থাকতে পারে। তবে একটা বিষয় তোমাদের একজনও জানো না। তা হল, মৃত্যুর আগে আমাকে প্রফেসরের লেখা চিঠিতে জানিয়ে যাওয়া একটা ছোট্ট কথা। একাঘ্নির নির্মাণে একটা সমস্যা থেকে গিয়েছিল। জ্বালানির সমস্যা। এই মিসাইলের বিস্ফোরক মহাশক্তিধর প্রতিবস্তু। কিন্তু মিসাইলের রকেট ফুয়েল প্রফেসরকে ওই অরণ্যের ভেষজ উপাদান থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছিল। উৎক্ষেপণের পর পৃথিবীর আয়নমণ্ডল অবধি পৌঁছোতে পারবে তা বড়জোর। ফলে তাকে উৎক্ষেপন করতে হবে সংঘাতমুহূর্তের ঠিক কয়েক মিনিট আগে। ওই ধূমকেতু আবহমণ্ডলে ঢুকে আসবার সামান্য আগে।
‘মহাকাশে লালপিওতের মতো একজন সাঙ্ঘাতিক শত্রুকে জীবন্ত অবস্থায় রেখে আমি তাই আসল সময়ের এতটা আগে তোমাদের কাছে আসতে চাইনি। সাহস করিনি নিজেকে সামনে আনবারও। একেবারে শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা আমাকে করতে হয়েছে এলেনা। এ ছাড়া তাই আমার আর কোনও উপায় ছিল না। তাকে ফাঁদ পেতে একেবারে শেষমুহূর্তে এখানে টেনে এনে ধ্বংস করেছি। ওর যুদ্ধযানের ধ্বংস হবার সংকেত পাবার পর এবার সামনে আর কোনও বাধা রইল না। এখন আর দেরি নয়। সংঘাতমুহূর্ত আর মাত্রই একঘণ্টা দূরে। আকাশের দিকে দ্যাখো…’
‘এক মিনিট কা পোন…’
হঠাৎ জিষ্ণুর কাঁপা কাঁপা গলাটা কা পোনের কথায় বাধা দিল। পর্দার দিকে চোখ রেখে তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে তখন।
‘জিষ্ণু…’
‘কেউ আসছে কা পোন। একটা ছোট লাইফবোট।’ পর্দার গায়ে দ্রুত নড়তে থাকা একটা সবুজ বিন্দুর দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করছিল জিষ্ণু, ‘বিস্ফোরণের জায়গাটা ছেড়ে আবহমণ্ডলে ঝাঁপ দিয়েছে ওটা… ট্র্যাজেকটরি ক্যালকুলেশান দেখাচ্ছে ঠিক এগারো মিনিটের মাথায়…’
পর্দায় ছুটে আসা বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে দ্রুত চিন্তা করছিলেন কা পোন। তাঁর ইশারায় তখন মাটি ছেড়ে সর্বোচ্চ ত্বরণে বাতাস বেয়ে ছুট দিয়েছে বিশ্বস্ত কার্তাং।
‘যানের ম্যানুয়াল কন্ট্রোল রিলিজ করো টাইকো,’ নিচুগলায় পর্দায় ভাসমান কুকুরের ছবিটাকে নির্দেশটা দিতে দিতে একটা দাঁতচাপা হাসি খেলে যাচ্ছিল কা পোনের মুখে, ‘আজ আমি শিকারে যাব। ইউরোপার সমুদ্রের টারমক শিকারি কা পোন আজ আর একবার তার ভেলকি দেখাবে। একবার অরুণাচলের জঙ্গল এলাকায় ঢোকবার অপেক্ষা… তারপর…’
***
তীব্র ঘর্ষণে তাদের চারপাশে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে আয়নীভূত বাতাস। সামনের পর্দায় ক্রস ওয়্যারে স্থির হয়ে আছে যশপাল ইনস্টিটিউটের মহাকাশবন্দরের টারম্যাকে স্থির হয়ে থাকা অজানা যানটা।
‘আর কয়েক সেকেন্ড! তারপর… দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করছিলেন লালপিওতে। রেট্রো রকেটের ধাক্কায় তখন দ্রুত কমে আসছিল মাটির দিকে ধেয়ে যাওয়া ভেলার গতি…..আর তারপর হঠাৎ, আসুরিক শক্তিতে ছুটন্ত যানের চাপকে উপেক্ষা করে টলতে টলতে আসন থেকে সরে এলেন তিনি। কথা বলবার সময় ছিল না। তাঁর হাতদুটো পাইলটের আসনে বসা সামিরাকে বাতাসে তুলে ছুড়ে ফেলেছে পেছনদিকে। আছড়ে পড়ে খাবি খেতে থাকা মেয়েটার দিকে চোখ না দিয়ে কোনওমতে সরে এলেন তিনি পাইলটের আসনে। হঠাৎ ক্রসওয়্যারের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে গিয়েছে লক্ষ্যবস্তু। অকল্পনীয় ত্বরণ নিয়ে তা ছুটে চলেছে সটান পুবের দিকে।
একটা অজানা ভয় হঠাৎ ছেয়ে ফেলছিল লালপিওতেকে। অঙ্কটা মিলছে না কেন? কার যান ওটা? মিসিয়ারিকে ধ্বংস করে, যশপাল ইনস্টিটিউটের বুকে কেন নেমে এল তা? তার আগে, ওখানে কাকে সংকেত পাঠাচ্ছিল সে?
ও পুবের দিক লক্ষ করে ছুটছে… ওদিকেই তো প্রফেসর বোসের…
একেবারে শেষমুহূর্তে এসে কোনও অজানা তাস খেলেনি তো ওরা? কিন্তু এই ‘ওরা’ কারা হতে পারে? প্রফেসর বোসের ছেলে তো… নাঃ তা হতে পারে না। সে তো ইনস্টিটিউটের বাকি সদস্যদের সঙ্গেই জালালের আত্মঘাতী আক্রমণে…
যানের গতিমুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পালাতে থাকা যানটাকে লক্ষ করে নতুন যাত্রাপথের ইশারাগুলো করতে করতে নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন লালপিওতে, ‘যে-ই হোস তুই… আমি তোকে ওখানে কিছুতেই…’
***
অকল্পনীয় বেগে ছুটতে ছুটতেই আকাশের গায়ে বিচিত্র কিছু নকশা গড়ে এলোমেলো উড়ছিল কার্তাং। পদ্ধতিটা পুরোনো। পিছু নেওয়া উন্নতমানের সরকারি পুলিশযানের আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানো কা পোনের পেশায় একটা প্রধান শিক্ষা। সেটা এখন এই শেষমুহূর্তের দৌড়বাজিতে কাজে আসছে। কার্তাং-এর নীচে, মেঘের ফাঁক দিয়ে এইবার অরুণাচলের আদিম বনাঞ্চল দেখা দিচ্ছিল।
‘লক্ষ্যবস্তুর তিন মাইলের মধ্যে এসে পৌঁছোবার আর ঠিক এক মিনিট বাকি,’ টাইকোর গলার শব্দটা শুনে হঠাৎ জিষ্ণুদের দিকে মুখ ঘোরালো কা পোন, ‘তৈরি হও। পেছনের ক্যাবিনেটে এক জোড়া করে ফ্রগ লিপার পাবে। সম্পূর্ণ অটোমেটেড। জাঙ্গল ওয়ারফেয়ারে ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটারেরও বেশি গতিতে লাফ দিয়ে এগোতে পারে।’ বলতে বলতেই পেছন থেকে লাফিয়ে আসা আরও একটা লেজার আক্রমণের লাল আলোর রেখাকে বোকা বানিয়ে হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ করে খাড়া নীচের দিকে নেমে যাচ্ছিলেন কা পোন।
‘কিন্তু… আমরা দুজন…’
‘ফ্রগ লিপারের ডিরেকশন ফাইন্ডারে একাঘ্নির লোকেশন কোডেড আছে। ও যন্ত্রই তোমাদের ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে। মূল পাহাড়ে পৌঁছোবার আগে নদীর জলে নামবার সময় ওদের খুলো না। যন্ত্রগুলো উভচর। শুধু, জঙ্গলের আড়াল থেকে ফাঁকা জায়গায় এসো না। আমি যান নিয়ে ওদের ফায়ারপাওয়ারকে অন্যদিকে সরিয়ে রাখছি।’
পায়ের নীচে অরণ্যের মাথা দ্রুত উঠে আসছিল তাদের। শরীরে ফ্রগ লিপারের বেল্টগুলো আটকে নিতে নিতেই একনজর কা পোনের দিকে ঝাপসা চোখে চেয়ে দেখল জিষ্ণু। এত সহজে একটা মানুষ নিজেকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে টোপ বানিয়ে জীবনকে নিয়ে খেলতে পারে?
‘জিষ্ণু, এলেনা… রেডি…’
নিম্নমুখী যাত্রার শেষবিন্দুতে পৌঁছে দুটো বিরাট গাছের ফাঁকে একপলকের জন্য স্থির হয়ে গেল কার্তাং। আর পরের মুহূর্তেই গতি বাড়িয়ে একটা পাখির মতো উড়ে গেল সটান পুবের দিকে…
পায়ের তলায় খুলে যাওয়া হ্যাচ বেয়ে বাতাসে বেরিয়ে এসে প্রায় চল্লিশ ফুট নীচের মাটির দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল দুটো শরীর। তাদের শরীরের সঙ্গে বাঁধা ফ্রগ লিপারের সেন্সর আসন্ন অবতরণের আভাস পেয়ে শরীরদুটোকে ঘুরিয়ে সোজা করে নিল এবার। তারপর ছোট ছোট রকেটের নিখুঁত হিসেবি ধাক্কায় পতনের বেগ কমিয়ে আনল…
মাটি ছোঁবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফের বাতাসে লাফ দিয়ে উঠল তারা। জেগে উঠেছে ফ্রগ লিপারের প্রোগ্রাম। তার অতিকায় যান্ত্রিক পা-গুলো নিজেদের দৈর্ঘ্যকে বাড়িয়ে কমিয়ে বড় বড় লাফে অরণ্যের আড়াল দিয়ে তখন ছুটে চলেছে সামনের দিকে।
জিষ্ণুর চোখ ফের একবার ঝাপসা হয়ে আসছিল। এই অরণ্য তার বড় চেনা। তাদের আশ্রয়দাতা সরল আদিবাসী মানুষগুলোর সঙ্গে কত দিনরাতই তো সে খেলে বেড়িয়েছে এখানে। এর প্রতিটি গাছ, পাতা, পশুপাখি তার বড় আপনজন…
***
মৃদু একটা হাসি খেলে গেল লালপিওতের মুখে। যানটা সম্ভবত, তাঁর আক্রমণের থেকে বাঁচা অসম্ভব জেনে মাটির দিকে ছুটেছিল। অবতরণ করলে অবশ্য তাঁর সুবিধা হত। একুশজন প্রশিক্ষিত কম্যান্ডোর সামনে কয়েক মিনিটের বেশি পালিয়ে থাকতে পারত না ওই অজানা হানাদার, তা সে যত কুশলী যোদ্ধাই হোক না কেন। এরা সম্ভবত নিজেরাও সেটা জানে। তাই শেষমুহূর্তে মত বদলে ফের উঠে এসেছে বাতাসে।
হাতের ঘড়িটার দিকে একবার দেখে নিলেন লালপিওতে। আর ত্রিশ মিনিটও বাকি নেই। আকাশে জ্বলন্ত বিরাট আগুনের গোলাটার গতি হালকা টের পাওয়া যায় এখনও। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আয়নমণ্ডলে ঢুকে আসবে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত ওই সুইফট টাটল… সংঘাত মুহূর্তে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে হলে আর দশ মিনিটের মধ্যে আবহমণ্ডল ছাড়তে হবে তাঁকে। ক্রসওয়্যারের গায়ে সরে যেতে থাকা বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে এইবার যানের গতি বাড়ালেন লালপিওতে। একে আকাশের বুকে রেখে তিনি নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারেন না।
* * *
সামনে দ্বীপটার মাঝখানে মাথা উঁচু করে থাকা পাহাড়টার চূড়া এগিয়ে আসছিল। সেদিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল কা পোন। ওই তার জন্মভূমি। ওর পেটের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গুহাশ্রেণীতে একদিন তার প্রথম চোখ মেলা। আজ সেখানে মানুষ নেই। তার প্রিয়জনরা সেখানে এক ভয়াল ঘাতক অস্ত্রকে জায়গা দিয়ে সরে গেছে পাহাড়ের আরও গভীরে অন্য ঠিকানায়।
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের ক্ষণস্থায়ী ভাবালুতাকে সরিয়ে দিল কা পোন। এখন প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। হিসেবের সামান্য ভুলের দামও নিজের প্রাণ দিয়ে চোকাতে হতে পারে তাকে।
এগিয়ে আসা পাহাড়চূড়াটার দিকে লক্ষ্য স্থির রেখে কার্তাং-এর নিয়ন্ত্রণ টাইকোর হাতে ছেড়ে দিল কা পোন। মণিবন্ধে একটা ছোট ধাতব ক্যাপসুল বেঁধে নিয়েছে সে। ওতে টাইকো ঘুমিয়ে আছে। টাইকোর যাবতীয় ডেটা, তার ব্যাক্তিত্বের অ্যালগরিদম।
‘এইবার… টাইকো…’
‘ইয়েস বস… তাহলে বিদায়, অন্তত কিছুদিনের জন্য…’ পাহাড়ের চূড়াটার একেবারে সামনে পৌঁছে, হঠাৎ যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এলোমেলো একটা ডিগবাজি খেলো কার্তাং।
চূড়াটার সঙ্গে সংঘাতের ঠিক আগের মুহূর্তে পলকের জন্য খুলে যাওয়া হ্যাচটা বেয়ে কা-পোনের শরীরটা গড়িয়ে পড়েছিল। তারপর অসহায়ভাবে পাহাড়ের অন্য ঢাল বেয়ে গড়িয়ে যেতে যেতেই কানফাটা একটা বিস্ফোরণ তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, টাইকোর এই সংস্করণ তার শেষ কাজটা নিখুঁতভাবেই সেরেছে।
* * *
‘অ্যাডমিরাল…’ পায়ের নীচে লাফিয়ে ওঠা আগুনের লেলিহান জিভগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে সামীরা কখন যেন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন লালপিওতে। বেসামাল উড়ানের পথে ওই পাহাড়ের চুড়োটাই তাঁর কাজটা নিখুঁতভাবে সেরে দিয়েছে। ওই যানে যে-ই থাকুক তার আর বেঁচে থাকবার কোনও সম্ভাবনা নেই।
‘যানের নিয়ন্ত্রণ নাও সামীরা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবহমণ্ডল ছেড়ে গভীর মহাকাশে ফিরে যেতে হবে আমাদের। আজ সেখানে নিরাপদ দূরত্বে বসে আমি আমার এতদিনের সাধনার ফলাফল দেখতে চাই। মঙ্গল উপনিবেশ দীর্ঘজীবী হোক…’
একটা আশ্চর্য প্রশান্তি ছড়িয়ে যাচ্ছিল লালপিওতের গলায়। তীব্র ত্বরণ নিয়ে তাঁর ভেলা তখন ফের একবার মাথা উঁচিয়েছে ঊর্ধ্বাকাশের দিক।
১৪ আগস্ট। মাইনাস একুশ মিনিট মঙ্গল উপনিবেশ। পার্থিব হেডকোয়ার্টার।
‘ওরা আসছে অ্যাডমিরাল গুপ্ত।’
তাঁর সামনের পর্দার ঠিক কেন্দ্রে একরাশ উজ্জ্বল বিন্দু দেখা দিয়েছে হঠাৎ। বিন্দুগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা বিষণ্ণ হাসি খেলে গেল অ্যাডমিরাল বৈশ্বানর গুপ্তের ঠোঁটে। ঠিক দু-ঘণ্টা আগে, গ্রহাণু বলয় থেকে হঠাৎ দুটো অতিকায় বিমানবাহী যান প্রকাশ্য মহাকাশে ভেসে আসবার পর থেকেই পাশার দান উলটে গিয়েছিল।
যানগুলোর শক্তি বিচ্ছুরণে বৈদ্যুতিন স্বাক্ষর ছিল না কোনও। সেটা মহাকাশচারণের নিয়মবিরোধী।
গ্রহাণু বলয়ে সদ্য গড়ে তোলা আর্থ শেল্টারগুলোকে এদের পরিচয় জানবার জন্য নির্দেশ পাঠানো শুরু করবার আগেই অবশ্য তাদের রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর নিকট কক্ষপথ থেকে ভেসে আসা একটা ভিডিয়ো ট্রান্সমিশানে।
দীর্ঘ আত্মগোপনের পর হঠাৎ করে পৃথিবীর কক্ষপথে ফের আবির্ভূত হওয়া বিদ্রোহী মঙ্গল উপনিবেশের নেতা অ্যাডমিরাল লালপিওতের সেই ট্রান্সমিশন শুধু তাঁকে উদ্দেশ্য করে ছিল না। সমস্ত প্রচার তরঙ্গে একই সঙ্গে তা ছড়িয়ে দিচ্ছিল একটাই কথা, ‘স্বৈরাচারী পার্থিব সরকার মঙ্গল উপনিবেশকে বে-আইনিভাবে দখল করেও মঙ্গল উপনবেশকে ধ্বংস করতে পারেনি। বহু শতাব্দীর অবিচারের প্রতিফল হিসেবে ঈশ্বরের রোষ এবার পৃথিবীর ওপর নেমে আসছে। জাতি হিসেবে মানুষের সামান্য অংশই রক্ষা পেয়েছে মঙ্গল উপনিবেশ, গ্রহাণুপুঞ্জ বলয় ও চাঁদের অস্থায়ী শেলটারগুলোতে। আমাদের দুটি বাহক যানে মোট দুশোটি আণবিক ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত ফ্রিগেট ক্লাস রণতরী এইবার প্রতিটি উপনিবেশের দিকে তার দখল নেবার জন্য এগিয়ে যাবে। আমরা জানি, পৃথিবীর বিভিন্ন অস্ত্রাগারে আমাদের ধুলো করে দেবার মতো অস্ত্রসম্ভার রয়েছে। আমরা জানি, মঙ্গলের পার্থিব উপনিবেশ দূরনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই অস্ত্রদের পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম। কিন্তু মাত্র দু-ঘণ্টা সময়ের মধ্যে তারা চাঁদের দিকে এগিয়ে যাওয়া ফ্রিগেটদের ধ্বংস করতে পারলেও মঙ্গল ও গ্রহাণু বলয়ের পার্থিব শেল্টারগুলোর কাছে এসে পৌঁছোতে পারবে না। আমরা এই জায়গাগুলোয় অবশিষ্ট মানুষের একজনকেও ধ্বংস করতে চাই না। কিন্তু পার্থিব সরকার কোনও ধরনের প্রতি আক্রমণ না করলে আমাদের আণবিক মিসাইলগুলো বাধ্য হয়েই…’
নাঃ। এর পরে আর কোনও প্রতিরোধের চেষ্টা করেননি অ্যাডমিরাল বৈশ্বানর গুপ্ত। পৃথিবীকে ঘিরে ক্ষয়শীল কক্ষপথে অন্তিম পাক দিতে থাকা অতিকায় আগুনের গোলাটাই তাঁর সব প্রতিরোধকে শেষ করে দিয়েছিল। আর দু-ঘণ্টার মধ্যে ওর ধাক্কায় পৃথিবী থেকে সভ্যতার সব চিহ্ন মুছে যাবে। কয়েক হাজার বছরের জন্য বাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে পৃথিবী। এই উন্মাদ উগ্রপন্থী নিজের জিঘাংসা পরিতৃপ্ত করতে, পৃথিবী থেকে সরিয়ে আনা মানব সভ্যতার শেষ আলোর বিন্দুগুলোকে অবহেলায় ধ্বংস করে দিতে পারে। সেটা কোনও মূল্যেই হতে দেওয়া যায় না। মঙ্গল বা গ্রহাণু বলয়ের প্রতিটি শেল্টারকে ঘিরে যে শক্তিবলয় রয়েছে তা হয়তো এদের আক্রমণকে কয়েক ঘণ্টার জন্য রুখে দিতে পারবে। কিন্তু সে-সময়টুকু এই মুহূর্তে যথেষ্ট নয়। সৌরমণ্ডলে সামান্য কিছু মানুষই তো অবশিষ্ট থাকবে আর ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে। কী হবে শুধু শুধু তাদের অধিকাংশকে এক জিঘাংসু উন্মাদের শিকার বানিয়ে সভ্যতার কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে!
মাত্রই পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছিলে বৈশ্বানর তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবার জন্য। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।
‘আপনার জন্য ট্রান্সমিশন।’
‘পর্দায় আনুন।’
পর্দায় দ্রুতবেগে ছুটে আসতে থাকা কুড়িটা ফ্রিগেটের দলটার ছবি মুছে গিয়ে সেখানে জেমস আরিয়ানার মুখটা ভেসে উঠেছে।
‘হ্যালো অ্যাডমিরাল।’ পরিতৃপ্তির একটা হাসি চিকমিক করছিল আরিয়ানার মুখে, ‘অ্যাডমিরাল লালপিওতে অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন উপস্থিত। যথাসময়ে আপনাকে তিনি ডেকে পাঠাবেন। উপস্থিত তাঁর আদেশ, বিজয়ী যানদের অবতরণের জন্য প্রতিটি শেলটারের প্রতিরক্ষা আবরণ সরিয়ে নেবার আদেশ দিন। এখন থেকে ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় প্রতিটি কেন্দ্রে আমাদের রণতরীরা…’
অপমানটাকে নীরবে হজম করলেন বৈশ্বানর। পাশে বসা কর্নেল ফ্লিন্টের মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠছিল। সাধারণত আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে সম-পদমর্যাদার সেনানায়কদের মুখোমুখি হবার কথা। এক্ষেত্রে সম্ভবত ইচ্ছা করেই বৈশ্বানরকে অপমান করবার জন্য অ্যাডমিরাল লালপিওতে তাঁর অধীনস্থ একজন সেনানায়ককে পাঠাচ্ছেন।
কিন্তু তিনি কিছু বলবার আগেই পর্দার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বৈশ্বানর বলে উঠলেন, ‘আমরা প্রস্তুত আছি ব্যারণ আরিয়ানা।’ তারপর ট্রান্সমিশন বন্ধ করে ফ্লিন্টের দিকে ঘুরে তাঁর কাঁধ ধরে মৃদু চাপ দিলেন একবার।
‘আপনি…’
‘উপায় ছিল না ফ্লিন্ট। এই মুহূর্তে এদের একটা বিমানও যাতে কোনও শেলটারের উদ্দেশে আক্রমণ না শানায় তা নিশ্চিত করবার জন্য যে কোনও অপমান আমি সহ্য করতে রাজি। এই মুহূর্তে ক্ষতির পরিমাণ সর্বনিম্ন রাখাই আমাদের একমাত্র স্ট্র্যাটেজি।’
হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন ফ্লিন্ট, ‘তাহলে সমস্ত শেলটারের প্রতিরক্ষা বলয়…’
একটা মরীয়া আবেগে ঘন ঘন দুদিকে মাথা নেড়েছিলেন বৈশ্বানর, ‘না ফ্লিন্ট। এখনই নয়। আরও একুশ মিনিট বাদে। আগে আমি নিজের চোখে আমাদের আশার শেষ বিন্দুটাকেও ধ্বংস হয়ে যেতে দেখতে চাই। তারপর… নাঃ। তারপর আর কোনও প্রতিরোধের কোনও অর্থ থাকবে না। পৃথিবীটাই যদি না রইল…’
কঠোর মানুষটার দু-চোখে দু-ফোঁটা জল চিকমিক করছিল। এক ঝলক সেদিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন ফ্লিন্ট। সামনের পর্দায় পৃথিবীর একটা বিবর্ধিত ছবি ভাসছে। তার একেবারে গা ঘেঁষে নড়তে থাকা আগুনের গোলাটা আর একুশ মিনিটের মাথায়…
বুকের ভেতর তাঁরও মোচড় লাগছিল একটা। যুদ্ধ তাঁরও পেশা। মৃত্যু তিনি কম দেখেননি। কিন্তু… শুধু ক্ষমতার লোভে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ডেকে আনবার মতো নারকীয় একটা ষড়যন্ত্র এতদিন ধরে চালিয়ে যেতে পারে যে, তার হাতে মানুষের ভবিষ্যৎ তুলে দিতে…
সামনের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের দিকে ঝাপসা চোখদুটো মেলে ধরে রেখে মনে মনে তিনি কোনও অলৌকিক শক্তির কাছেই তিনি প্রার্থনা জানাচ্ছিলেন… ঈশ্বর… শুধু একবার… একটা সুযোগ…
* * *
ঠিক সেই একই প্রার্থনা তখন করে চলেছিল পৃথিবীর অজস্র ভূগর্ভ শেলটারে ইঁদুরের মতো লুকিয়ে থাকা কোটি কোটি মানুষ। না। আর কোনও আশা তখন তাদের সামনে নেই। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সর্বশক্তিমান পার্থিব সরকার সকলেই ব্যর্থ হয়েছে। শেলটারগুলোর বড় বড় পর্দায় তখন পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে চলা উপগ্রহের দল ফুটিয়ে তুলছে কালান্তক ঝড়ে মতো ধেয়ে আসা মৃত্যুদূতের ছবিকে। আবহমণ্ডলের প্রথম স্পর্শে তার শরীরে তখন জেগে উঠছিল মৃত্যু-অগ্নির শিখা… সেইদিকে নজর রেখে কোটি কোটি মানুষ তখন তাদের অদেখা, বহুকাল আগে পরিত্যক্ত কোনও অজানা ঈশ্বরের কাছে শেষ প্রার্থনা জানিয়ে চলেছে। একবার… শুধু একবার কোনও অলৌকিক পথে যদি…
***
‘ঘড়ি দ্যাখো, এলেনা।’
‘আমি জানি। আয়নমণ্ডল ছুঁতে আর ঠিক আঠারো মিনিট বাকি জিষ্ণু। দশ মিনিটের মধ্যে…’
ফ্রগ লিপারগুলো জলের স্পর্শ পেয়ে নিজে থেকেই চেহারা বদলে নিয়েছে। তাদের প্রসারিত নীচের অংশ থেকে বের হয়ে আসা বাতাসের জেট বিচিত্র কায়দায় ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের তিরবেগে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছিল নদীর স্রোতকে উপেক্ষা করে।
সামনে বড় হয়ে উঠতে থাকা পাহাড়টার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে দাঁড়িয়েছিল জিষ্ণু।
ঠিক কোথায় ছিল গুহায় ঢোকবার দরজা তা এখন আর তার পক্ষে আর বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের পরিকল্পনাটা ঠিক মতো কার্যকরী হলে…
লাফিয়ে পাড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে বাঁধা কমিউনিকেটরটাকে চালু করল জিষ্ণু। সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠে এলেনা বাধা দিতে এসেছিল একবার। শঙ্কিত মুখে বলে উঠেছিল, ‘রেডিয়ো সাইলেন্স বজায় না রাখলে ওরা…’
তার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু হাসল জিষ্ণু, ‘আর তার প্রয়োজন হবে না এলেনা। এবার শেষ লড়াই। আর কোনও গোপনীয়তা নয়।’ বলতে বলতেই জেগে ওঠা কমিউনিকেটরে কথা বলে উঠল সে, ‘কো-অর্ডিনেট কা পোন…’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মৃদু একটা কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল দু-জোড়া ফ্রগ লিপারেই। দূর পাহাড়ের কোনও গোপন জায়গা থেকে ভেসে আসা একটা বেতার সংকেত ফ্রগ লিপারদের যন্ত্রমস্তিষ্কে পাঠিয়ে দিয়েছে গুহামুখের নিখুঁত স্থানাঙ্কের নির্দেশ।
নির্দেশটা পাঠিয়ে দিয়েই তৈরি হলেন কা পোন। বাকি কাজটা ফ্রগ লিপাররা নিজেরাই করে নিতে পারবে। তাঁকে এখন তৈরি হতে হবে অন্য একটা যুদ্ধের জন্য। একটা হিসেব চুকোবার আছে তার। হয়তো নিজে ওদের সঙ্গে গিয়ে নিঃশব্দেই কাজটা সারতে পারতেন তিনি। কিন্তু এই লড়াইটা লড়বার জন্যই তা তিনি করেননি। এত সহজে লালপিওতেকে ছেড়ে দেবেন না তিনি। আর তাই স্থানাঙ্কগুলো ফ্রগ লিপারদের রিসিভারের নিচু শক্তির কম্পাঙ্কে পাঠাবার বদলে সমস্ত কম্পাঙ্কের চ্যানেলেই একসঙ্গে সম্প্রচার করেছেন তিনি।
আকাশের দিকে ক্ষুধিত চোখদুটো তুলে ধরলেন কা পোন। তাঁর কাঁধে উঠে আসা অ্যান্টিক্র্যাফট ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষেপকের যান্ত্রিক চোখ তখন খুঁজে চলেছে তার শিকারের পারমাণবিক ইঞ্জিনের বিকীরণের স্বাক্ষর।
থরথর করে একবার কেঁপে উঠেই একটা গুঞ্জন উঠল ফ্রগ লিপারদের আণবিক মোটরে। তারপর পাথুরে ঢাল বেয়ে বিদ্যুৎবেগে পাহাড়টা বেয়ে উঠে গিয়ে একটা প্রাচীন ধ্বসের সামনে গিয়ে স্থির হল তা।
ধ্বসে পড়ে থাকা পাথরগুলোর দিকে মণিবন্ধে বাঁধা ঘড়িটা এক মুহূর্তের জন্য ঘুরিয়ে ধরে তার গায়ে ভেসে ওঠা রিডিংটা দেখে নিয়ে মুখে একটুকরো হাসি ফুটল জিষ্ণুর। এলেনার দিকে মুখ ঘুরিয়ে সে বলল, ‘অ্যান্টিম্যাটার সিগনেচার। কা পোন ভুল করে না।’
হাতে উঠে আসা খুদে ব্লাস্টারটা নিয়ে এলেনা শান্ত মুখে বলল, ‘সরে দাঁড়াও…’
***
নিস্তব্ধ হয়ে গেছে পৃথিবী। একসময় অগণিত বেতার যন্ত্রের তীব্র, কর্কশ শব্দের বন্যা ভেসে আসত তার কক্ষপথে কোনও অল চ্যানেল রিসিভার খোলা রাখলে। অথচ এই মুহূর্তে তা একেবারে শান্ত। নিস্তব্ধ হয়ে গেছে পৃথিবী। মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়িয়ে আর কোনও কিছুই বলবার নেই তাদের।
আর তারপর, হঠাৎ সেখানে একটা ছোট্ট সংকেত ভেসে উঠল। চমকে উঠে একবার পর্দায় ভেসে ওঠা সংকেতগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। একটা স্থানাঙ্ক। তাঁর পরিচিত। বহুকাল আগে, ওই অরণ্যের বুকে একবার… আজ, সাফল্যের একেবারে তুঙ্গমুহূর্তে পৌঁছোবার কয়েকটা মিনিট আগে প্রেতাত্মার মতো তা জেগে উঠেছে তাঁর মনিটরে।
হঠাৎ সামনের নিয়ন্ত্রক কমপিউটারের রিসিভারের দিকে হাতের একটা ইশারা করলেন লালপিওতে। ছোট্ট যানটা হঠাৎ তার মুখ ঘুরিয়ে ধরেছে পৃথিবীর দিকে। আণবিক ইঞ্জিন পূর্ণশক্তিতে জেগে উঠেছে তার।
‘অ্যাডমিরাল… আপনি…’
পাশে বসে থাকা মানুষটার ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে মৃদু হাসলেন লালপিওতে, ‘প্রাণের চাইতে মিশন অনেক বড় হে জওয়ান। আজ মঙ্গল উপনিবেশের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেব, কিন্তু মিশনকে ব্যর্থ করবার সামান্যত্যম সম্ভাবনাকেও জীবিত রাখতে আমি রাজি নই… কমপিউটার… ভার্টিক্যাল এনট্রি… সম্প্রচারে পাওয়া স্থানাঙ্ক…’
‘ভার্টিক্যাল থ্রাস্টার চালু হচ্ছে। নির্দিষ্ট স্থানাঙ্কে ফোর্স ল্যান্ডিং এক মিনিট… উনষাট সেকেন্ড… আটান্ন… সাতান্ন…’
তীব্র বেগে আবহমণ্ডলকে ছিন্নভিন্ন করে ধেয়ে যেতে থাকা যানটাকে ঘিরে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে উঠল…
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ভুপৃষ্ঠে, সেই স্থানাঙ্কের কয়েকশো মিটার দূরে অপেক্ষায় থাকা এক শিকারির কাঁধের লঞ্চারের ভেতরে জেগে উঠল একটা ছোট আণবিক মিসাইল। তার সেনসর উর্ধ্বাকাশের বায়ুমণ্ডলে ঢুকে আসতে থাকা শিকারের গন্ধ পেয়েছে।
***
ব্লাস্টার থেকে বের হয়ে আসা চুলের মতো সরু আগুনের শিখাটা সামনের পাথরের স্তূপের গায়ে একটা গর্ত কেটে ফেলছিল। কয়েক মুহূর্ত বাদে সেখান থেকে একরাশ উত্তপ্ত পাথর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে তার পেছনে খুলে যাওয়া গোল গর্তটার দিকে ইশারা করে একগাল হাসল সে, ‘লঞ্চ উইন্ডো এখনও সাত মিনিট দূরে। আশা করি…’
কিন্তু কথাটা শেষ হল না তার। হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়েছে জিষ্ণু। আর তারপর দ্রুত হাতে ফ্রগ লিপারের গণককে কিছু নির্দেশ দিতে দিতে সে বলে, ‘অ্যান্টিম্যাটার সিগনেচারের সঙ্গে ফ্রগ লিপারের ডেস্টিনেশন সিকারকে সিনক্রোনাইজ করো এলেনা। সময় নেই আর…’
বলতে বলতেই সচল হয়ে উঠেছে তার ফ্রগ লিপারজোড়া। প্রকাণ্ড একটা লাফে তাকে নিয়ে সামনের পাথরের স্তূপ পেরিয়ে গুহার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা। তার পেছন পেছন লাফিয়ে ঢুকে যেতে যেতেই এক মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে এলেনা দেখেছিল সেখানে স্থির হয়ে জ্বলতে থাকা মৃত্যুদূতের মতো ধূমকেতুটার অগ্নিগোলকের পাশ দিয়ে তিরবেগে নেমে আসা আলোর বিন্দুটার দিকে। কাছাকাছি অরণ্য থেকে উঠে আসা একটা আলোর রেখা তখন ছুটে চলেছে বিন্দুটাকে লক্ষ করে।
তবে সে নিয়ে তখন আর মাথা ঘামাবার সময় ছিল না তার। ছুটতে ছুটতেই তার হাতের অস্ত্রের একটা তীব্র শক্তির ঝলক গুহার মুখটাকে আঘাত করে খসে পড়া পাথরের স্তূপে ঢেকে দিয়েছে।
তারপর গুহার ভেতরে হারিয়ে যেতে যেতেই তার কানে এসেছিল একটা মৃদু গুমগুম আওয়াজ। থরথর করে কেঁপে উঠেছিল পাহাড়টা সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই। গুহার ফের খুলে যাওয়া মুখটা থেকে ছুটে এসেছিল মৃদু আলোর একটা ঝলক। আর তার পরমুহূর্তেই দূরাগত একটা বিস্ফোরণের শব্দতার কানে এসেছিল। ফ্রগ লিপার ততক্ষণে তাকে পৌঁছে দিয়েছে মাটির অনেক নীচের একটা সুবিশাল ঘরের একেবারে মাঝখানে, একটা পাটাতনের ওপর বসানো একটা নিয়ন্ত্রক প্যানেলের সামনে দাঁড়ানো জিষ্ণুর পাশে। সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের নির্দিষ্ট একটা জায়গায় তখন হাত রেখেছে জিষ্ণু।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুহার অন্ধকার কেটে গিয়ে ম্লান একটা আলো জ্বলে উঠল। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও তার ফিরে আসা মালিককে চিনতে ভুল করেনি সেখানে অপেক্ষায় থাকা যন্ত্রগণক।
‘স্বাগত জিষ্ণু।’ প্যানেলের মাথায় ভেসে ওঠা একহাত লম্বা ত্রিমাত্রিক ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখ জলে ভরে এল জিষ্ণুর।
প্রফেসর বোসের প্রতিবিম্বের মুখে কোনও আবেগের চিহ্ন ছিল না। তিনি তখন বলে চলেছেন, ‘গণকের যন্ত্রের হিসেব অনুযায়ী আর ঠিক ছ-মিনিট সময় আছে একাঘ্নির লঞ্চ উইন্ডোর। স্থির হয়ে বসো…’
কথাটা শেষ হবার আগেই মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল গোটা পাটাতনটা। তারপর তাদের নিয়ে তা তিরবেগে উঠে চলল গুহার ছাদের দিকে ছোট একটা ঘরের দিকে।
‘কাজটা সরল,’ প্রফেসর বোসের প্রতিবিম্ব কথা বলে চলেছিল, ‘এই ঘরটা তিন ফুট পুরু টাইটানিয়াম অ্যালয় দিয়ে ঢাকা। উৎক্ষেপণের তীব্র আগুনের ঝাপটায় এইখানে তোমরা নিরাপদে থাকবে… তোমার সামনে প্যানেলের কিবোর্ডে এই কোডটা টাইপ করো…
‘. -.- .- —. …. -. .. —. —- ‘
‘কী এটা?’
এলেনার প্রশ্নের জবাবে কি বোর্ডে আঙুল ঠেকিয়ে মৃদু হাসল জিষ্ণু, ‘প্রাচীনতম যান্ত্রিক কোডিং। উনিশ শতকের আবিষ্কার। মর্স কোড। ওর অর্থ ‘Ekaghni go’।’
* * *
নেমে আসতে আসতেই কমপিউটার নিয়ন্ত্রিত কামান একটা ঝলক ছুড়ে দিয়েছিল নির্দিষ্ট স্থানাঙ্কটাকে লক্ষ করে। পর্দায় ফুটে উঠেছে সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া গুহার মুখ থেকে ফের খসে পড়া পাথরের স্তূপ। তার কালো গর্তটার দিকে তিরবেগে ধেয়ে যেতে যেতেই চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠছিল লালপিওতের। এইবার… এত সহজে তিনি…
কিন্তু চিন্তাটা পুরোপুরি শেষ হবার আগেই হঠাৎ একটা তীব্র ধাক্কায় দুলে উঠল তাঁর যানটা। ভারসাম্য হারানো যন্ত্র তার ইঞ্জিনের শক্তি হারিয়েছে জঙ্গল থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে উঠে আসা কোনও অস্ত্রের আঘাতে।
কিছু করবার ছিল না তাঁর। যানের চূড়ান্ত বিপদের মুখে তার যন্ত্রমস্তিষ্ক নিজেই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাচীন অথচ কার্যকরী এই প্রোগ্রামিং যেকোনও আধুনিক যানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আগুন ধরে যাওয়া আহত যানটা থেকে ছিটকে বের হয়ে আসা তাঁদের আসনগুলো আকাশের বুকেই একে একে খুলে ধরছিল ছাতার মতো কিছু প্যারাসুট। ছোট ছোট থ্রাস্টারের নিখুঁত আঘাত আসনগুলোকে নামিয়ে আনছিল পূর্বনির্ধারিত সেই স্থানাঙ্কে হাঁ করে থাকা গুহাটার মুখে।
সেদিকে একনজর তাকিয়ে দেখে একটা তৃপ্তির হাসি হাসলেন কা পোন। তারপর কোমরে আটকানো জেট বেল্টের সুইচে আঙুল ঠেকালেন। তাঁর কানে ভেসে আসছিল বহু নীচে সেই গুহার গভীর থেকে কি বোর্ডে জিষ্ণুর আঙুলের স্ট্রোকগুলোর শব্দ। তার হাতের ট্রানসিভার চালু করে রেখেছে জিষ্ণু। তিরবেগে নিরাপদ দূরত্বে ভেসে যেতে যেতেই মণিবন্ধে বাঁধা যন্ত্রটা মুখের কাছে তুলে ধরলেন তিনি, ‘বেস্ট অব লাক জিষ্ণু…’
পায়ের নীচে ক্রমশ বড় হয়ে উঠতে থাকা গুহামুখটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন লালপিওতে। আর কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর… ওখানে নেমে এসে… আজ ওর ভেতরে স্বয়ং শয়তান থাকলেও তাকে লালপিওতের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাঁকে…
চিন্তাটা সম্পূর্ণ শেষ করতে পারলেন না তিনি। হঠাৎ পায়ের নীচের গোটা পাহাড়টা কেঁপে উঠল থরথর করে। তারপর তার অতিকায় পাথরের চাঙড়গুলোকে পালকের মতো আকাশের দিকে ছিটকে দিয়ে সেখান থেকে মুখ বাড়াল অর্ধচন্দ্র আকারের একটা কুচকুচে কালো দানবিক জিনিস।
মাত্রই ক-টা মুহূর্তের জন্য তাকে দেখেছিলেন লালপিওতে। আর তারপর আগুনের তীব্র একটা ঝলকে তাঁকে ও সেই পাহাড় ও জঙ্গলকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে তাঁর পাশ দিয়ে দূরত্বকে গিলে খেতে খেতে আকাশের দিকে ধেয়ে গেল অতিকায় একাঘ্নি…
***
পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরতে থাকা সমস্ত উপগ্রহগুলো সেই মুহূর্তে সচেতন হয়ে উঠেছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতের অজ্ঞাত জঙ্গল থেকে হঠাৎ মুখ বের করে ধেয়ে আসা একটা আগুনের রেখা ছুটে চলেছে আয়নমণ্ডল ছুঁতে চলা অতিকায় মৃত্যুদূতেকে লক্ষ করে।
ষোলো মাইল ব্যাসার্ধের দানবের তুলনায় তাকে একটা তুচ্ছ পাথরের টুকরোর মতোই দেখায়।
তবু, নিছক কৌতূহলবশেই রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইটদের রিসিভারকে তার দিকে ঘুরিয়ে ধরবার নির্দেশ দিয়েছিলেন বৈশ্বানর। আর তারপরেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে দ্রুত নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন তখনও চালু থাকা পার্থিব যুদ্ধকেন্দ্রগুলোতে। প্রতিটি পার্থিব শেল্টারকে লক্ষ করে উড়তে থাকা বিদ্রোহী ফ্রিগেটগুলোকে লক্ষ করে উৎক্ষেপনের আদেশ। কারণ ততক্ষণে তাঁর যন্ত্রে একটা অবিশ্বাস্য খবর ধরা পড়েছে। যে স্বপ্নের প্রযুক্তি নিয়ে এতকাল কাজ করেও তাকে ছুঁতে পারেননি পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা, সেই অ্যান্টিম্যাটারের একটা এক কিলোগ্রাম পিণ্ড বুকে নিয়ে ছুটে চলেছে ওই তুচ্ছ পাথরের টুকরো…
উপসংহার
‘ফ্যান্টাস্টিক!’ এলেনা হাসছিল। মনিটরে চলতে থাকা সংঘর্ষের আলোর রোশনাইয়ের ছবিটা তারা একসঙ্গে বসে অন্তত একশোবার দেখেছে এই তিন দিনে। এখনও আকাশের গায়ে রাতের অন্ধকারে ওই মৃত্যুদূতের টুকরোটাকরা নজরে পড়ে। শ’খানেক স্ক্যাভেঞ্জার স্যাটেলাইট মিলেও এই তিন দিনে তার সমস্ত টুকরোকে ঊর্ধ্ব আবহমণ্ডল থেকে সাফ করে দিতে পারেনি। কিন্তু সে-সব দৃশ্য, সংঘাত মুহূর্তের এই দশ মিনিটব্যপী ছবিটার কাছে একেবারেই তুচ্ছ। অন্তত সাতটা স্যাটেলাইটের রেকর্ড করা ছবি একত্র করে এই মুভিটা এলেনা নিজেই বানিয়েছে।
একপাশে একটা সোফা জুড়ে বসে কা পোন হাসছিলেন তাদের দুজনের দিকে চোখ রেখে। খানিক বাদে হঠাৎ হাতের রিস্টব্যান্ডটায় মৃদু কাঁপুনি উঠতে তাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাতে একটু চাপ দিলেন তিনি। তারপর সামনে বাতাসে ভেসে ওঠা কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বল টাইকো।’
‘কার্তাং টু রেডি মালিক। মেইল এসেছে।’
‘ডেলিভারি?’
‘ছাদের ওপর অপেক্ষা করছে।’
‘এত তাড়াতাড়ি?’ জিষ্ণু হঠাৎ ঘুরে তাকাল তাঁর দিকে।
কা পোন মৃদু হাসলেন, ‘যথেষ্ট টাকা থাকলে পৃথিবীর ইঞ্জিনিয়াররা অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে রে। আর এ তো একটা টাইটান ক্লাস মালবাহী জাঙ্ক। শুধু ফিটিংগুলো যা করবার দরকার ছিল। এবার শুধু টাইকোর প্রোগ্রামটা ওতে ট্রান্সফার করলেই…’
‘না কা পোন। আরও ক-টা দিন আমাদের সঙ্গে থেকে একটু বিশ্রাম নিয়ে…’
একটা অট্টহাসির শব্দ উঠে এলেনার বাকি কথাগুলোকে ঢেকে দিল এসে। হাসতে হাসতে উঠে এসে তাদের দুজনকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে কা পোন ছদ্ম রাগে বলছিলেন, ‘কেন রে? আমি কি বুড়ো হয়েছি ভেবেছিস? এখনও তোদের দুটোকে দু-হাতে চেপে ধরে পোকার মতো…’
‘উফ্। ছাড়ো ছাড়ো শিগগির,’ তাঁর বজ্র আলিঙ্গনের মধ্যে ছটফট করছিল জিষ্ণু, ‘ক-দিন একটু আমাদের সঙ্গে…’
‘তোদের সঙ্গে? অসম্ভব। সারাটা দিন দুটোয় মিলে আলফা বিটা ডেল্টা পাই করছিস, আর লম্বা লম্বা অঙ্ক কষে যাচ্ছিস। তোদের সঙ্গে থাকা আমার পোষাবে না বস।’
‘তাহলে যাবে কোথায়? আবার সেই…’
মৃদু হেসে মাথা নাড়োলেন কা পোন, ‘নাঃ। আর ব্যাবসাপাতি নয়। অনেক তো হল। এবার আমি রিটায়ার করেছি বুঝলি? এখান থেকে বেরিয়ে সোজা ইউরোপা। অনেকদিন ওর সমুদ্রে টারমকের মুখোমুখি হইনি। তারপর সেখান থেকে…’
বলতে বলতেই হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, ‘তোদের তো অনেক নামডাক হয়েছে। কিন্তু এই বুড়োর একটা কথা মিলিয়ে নিস। আজ থেকে একশো বছর পরে তোদের ওসব সায়েন্সটায়েন্সের কথাবার্তা শুধু বইয়ের পাতাতেই থেকে যাবে। লোকের মনে কী থেকে যাবে জানিস?’
‘কী?’
‘দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আতসবাজির খেলাটা দেখিয়েছিল প্রফেসর সত্যব্রত বসুর ছেলে জিষ্ণু আর তার বন্ধু এলেনা মিলে। এই যে ছবিগুলো দেখছিস এখন, এগুলো পৃথিবীর মানুষ কোনওদিন ভুলবে না দেখিস। চলি রে! ভালো থাকিস তোরা। আর মাঝে মাঝে এই বুড়োটার ছেলেমেয়ের আদর খাবার ইচ্ছে হলে…’
তাঁর দু-গালে তখন দু-জোড়া ঠোঁট এসে জুড়ে বসেছে।
সমাপ্ত