অন্তিম অভিযান – ৭

২১২৪ খ্রিস্টাব্দ

টেবিলের ওপরে ছোট বাক্সটা মৃদু সিঁ-ই-ই করে একটা আওয়াজ করে উঠল একবার। বাবার কল নিশ্চয়। সেই কলেজে যাবার পর থেকে এতগুলো বছর কেটে গেল, কিন্তু আজও সকালবেলা এই ঘুম ভাঙানোর কাজটা বাবা করবেই। পৃথিবীর যেখানে থাকুক না কেন, এ ফোনের বিরতি নেই। একবার সকালে ডাকল, তখন ক্রিস্টোফার দেখে কমিউনিকেটরের পর্দায় গভীর জঙ্গল। জিজ্ঞাসা করতে বাবা বলে, ‘আমাজনে ক্র্যাশল্যান্ড করেছি আজ ভোরে।’ তবু ভোরবেলা তাকে ডাকার রুটিনে অদলবদল হয়নি।

ঘুম চোখে হাত বাড়িয়ে সেটাকে কাছে টেনে আনতে আনতেই ক্রিস্টোফার সটান উঠে বসল এবারে। মৃদু বিকর্ষণক্ষেত্রের অদৃশ্য গদিটা নিজের অবস্থান বদলে তার পিঠের কাছে হেলে উঠেছে।

আরাম করে তাতে হেলান দিয়ে বসে চারপাশে একবার ভালো করে চেয়ে দেখল সে। সুনীলের ঘুমন্ত শরীরটা বাতাসে ভাসতে ভাসতে এদিক-ওদিক দুলছে। সেদিকে তাকিয়ে একটু হাসল ক্রিস্টোফার। ঘুমের মধ্যে দোল খাওয়াটা সুনীলের অনেককালের অভ্যাস। কলেজে দু-বছরের সিনিয়র ছিল সে তার। সেখানেও সেই একই অভ্যাস দেখেছে। তারপর, এতটা বড় হয়ে, যশপাল মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের একজন নামি গবেষক হয়েও সে অভ্যেসটা গেল না তার। জিষ্ণু এখানে ইন্টারভিউ দিতে আসছে শুনে আগে থেকেই নিজের রুমে তার জন্য বেড ঠিক করে রেখেছিল সুনীল। দিনদুয়েক আগে এখানে এসে প্রথম রাতেই জিষ্ণু দেখে, নিজের গদিটাকে সেই কলেজ জীবনের মতোই রিপ্রোগ্রাম করে নিয়েছে সে ঘুমের মধ্যে বাতাসে দোল খাবার জন্য।

আওয়াজটা পেয়ে সুনীলও জেগে উঠেছিল। ভাসতে ভাসতে তার কাছে এসে বলে, ‘মাঝরাত্তিরে অ্যালার্ম বাজাচ্ছিস কেন রে?’

‘মাঝরাত? মানে?’ বলতে বলতেই কমিউনিকেটরের এক কোণে জ্বলতে থাকা ঘড়িটার দিকে চোখ গিয়েছে ক্রিস্টোফারের। সেখানে দেখাচ্ছিল রাত দুটো। বাবার আজ হল কী? কোনও অ্যাক্সিডেন্ট-টেন্ট—

একটু উদ্বিগ্ন হয়েই বাক্সের গায়ের বোতামটা টিপে ধরল জিষ্ণু, ‘কী হল বাবা? এত রাতে—’

কিন্তু পর্দায় তখন কা পোনের বদলে টাইকোর মুখটা ভেসে উঠেছে। গম্ভীর হয়ে তাকিয়েছিল সে জিষ্ণুর দিকে।

‘নে। তোর মাস্টারমশাই এসেছেন। কথা বলতে থাক। আমি ঘুমুই গিয়ে—’

মুচকি হেসে হাতের একটা ইশারা করতেই বিছানাটা সুনীলকে নিয়ে ভেসে গিয়ে একেবারে ছাদের কাছাকাছি ঝুলে রইল। সেদিকে তাকিয়ে একটু হাসল ক্রিস্টোফার। ছোটবেলায় সে যে কোনও স্কুলে যায়নি সেকথা সকলেই জানে। বছরচারেক আগে, বর্ধমানের মহাকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হতে যাবার সময় ফর্মে এ তথ্যটা দেবার পর তার বাবাকে ডাকাও হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের তরফে। কোনওদিন স্কুলের শিক্ষা না পাওয়া কোনও ছাত্র নিজের চেষ্টায় পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষাটায় একশো শতাংশ নম্বর পেয়েছে তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। মিস্টার কা পোন নিজে এসেও সে তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে গিয়েছেন।

তার পড়াশোনাটা যে ঠিক কার কাছে হয়েছে সে খবরটা কলেজে এসে জিষ্ণু শুধু সুনীলকেই জানিয়েছিল কিছুদিন বাদে। সুনীল ততদিনে তার প্রাণের বন্ধু। কিন্তু তবু খবরটা শুনে সে অনেকক্ষণ হো হো করে হেসেছিল। বলে, ‘একটা যন্ত্রকুকুরের প্রোগ্রাম তোকে পড়িয়েছে? ধুস!’

তবে তারপর আস্তে আস্তে টাইকোর কাছ থেকে বেশ কিছু মুশকিল আসান হবার পর সে-ও টাইকোকে একটু সমীহই করে চলে। বিশেষ করে পরীক্ষাগুলোর আগে তার কাছে টাইকোর খাতির যথেষ্টই বেড়ে উঠত। তবে মজাটা সে এখনও করতে ছাড়ে না।

‘এত রাত্রে আমায় ডাকলে কেন টাইকো?’

পর্দায় টাইকো মৃদু গরগর করে উঠল একবার, ‘কয়েকটা জরুরি কথা তোমাকে জানানো দরকার জুনিয়র পোন। তোমার কালকের ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারে। মালিকের একটা ইচ্ছে তিনি তোমাকে জানাতে বলেছেন।’

‘বাবার? কী ইচ্ছে?’

‘তুমি সুইফট টাটল ধূমকেতুর বিষয়ে কী জান?’

ক্রিস্টোফার মৃদু হাসল। গত বছরদুয়েক ধরেই এই গুজবটা চলছে। সুইফট টাটল নাকি পৃথিবীর সঙ্গে সরাসরি ধাক্কার গতিপথে রয়েছে। ব্যাপারটা অবশ্য গুজব, কারণ—

‘তুমি কী ভাবছ আমি জানি ক্রিস। তবে জেনে রাখো, বিষয়টা গুজব নয়।’

ক্রিস্টোফার একটু অবাক হচ্ছিল। কা পোন নিজের ব্যাবসাবাণিজ্য নিয়ে থাকেন। মহাকাশবিদ্যা তাঁর এলাকা নয়। তবুও তিনি তাকে একরকম জোর করেই বর্ধমানে পাঠিয়েছিলেন বিষয়টা নিয়ে পড়াশোনার জন্য। হয়তো কোনও অধরা স্বপ্ন ছিল তাঁর, তাই পূরণের চেষ্টা করছেন ছেলেকে দিয়ে। কথাটা ভেবে ক্রিস্টোফার তাঁর ইচ্ছেয় কোনও বাধা দেয়নি। সেখান থেকে এই যশপালে পিএইচ ডি করতে আসাটা অবশ্য খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘটেছিল। সুনীল আগে থাকতেই এখানে ছিল। তার মুখে এখানকার খবরাখবর জিষ্ণু আগে থেকেই জানত। তারপর, তার রেজাল্ট দেখে এখান থেকেই অফারটা গেল যখন, জিষ্ণু আর দ্বিধা করেনি।

কিন্তু আজ হঠাৎ একটা গুজব নিয়ে কী ইচ্ছে জানাতে বসলেন কা পোন? সে মাথা নেড়ে বলল, ‘ভুল করছ টাইকো। গ্লোবাল কমপিউটার বুদ্ধকে দিয়ে সমস্ত তথ্য বারেবারে পরীক্ষা করা হয়েছে। ওটা গুজব। পৃথিবীর এক মিলিয়ান মাইল দূর দিয়ে ভেসে যাবে সুইফট টাটল।’

টাইকো কোনও কথা বলল না। পৃথিবীর প্রধান গণকযন্ত্রগুলোর নেটওয়ার্কে ক্রমাগত গোয়েন্দাগিরি করে চলা তার একটা প্রধান কাজ। তথ্যের চোরাচালান আজকাল কা পোনের প্রধান রোজগার হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো সে তথ্য যথেষ্টই দাম দিয়ে কেনে। সে কাজটা করতে গিয়েই বুদ্ধর নেটওয়ার্কে কিছু সন্দেহজনক প্রোগ্রাম প্যাচ এর সন্ধান পেয়েছিল টাইকো।

কা পোনের প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল সেগুলো সরকারি গুপ্তচর প্রোগ্রাম কি না। কিন্তু সেগুলোকে নিয়ে অনুসন্ধান করে যখন সে টের পায় প্রোগ্রামগুলো নিয়মিত মঙ্গল উপনিবেশের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে চলেছে তখন সে বিষয়টা নিয়ে উৎসাহিত হয়ে ওঠে, এবং বুদ্ধ-র স্মৃতিতে সুইফট টাটল সংক্রান্ত গণনা মডিউলটিকে পরীক্ষা করে সে। উচ্চ নিরাপত্তার এই মডিউলে গোপনে ঢোকবার জন্য যথেষ্ট খরচ করতে হয়েছে তাকে। তবে কা পোন তার পরোয়া করেনি, এবং ফলও এসেছে হাতেনাতে। সুইফট টাটল নিয়ে পাওয়া তথ্যগুলোকে বুদ্ধ প্রসেসিং করবার আগেই তাদের মধ্যে সামান্য, প্রায় অদৃশ্য কিছু বদল ঘটানো হচ্ছে নিয়মিত।

তবে এত কথা এই ছেলেটিকে খুলে বলা এ মুহূর্তে উচিত নয়। ওকে নিজেকে বিষয়টা বের করতে দিতে হবে।

‘কী হল টাইকো? চুপ করে গেলে যে!’ ক্রিস্টোফার তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে।

টাইকো গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি শুধু তোমার বাবার ইচ্ছের কথাটুকু জানাতে এসেছি। আগামীকাল তুমি ডিফেন্স মিসাইল রিসার্চ অর্গানাইজেশনে ইন্টারভিউ দিতে চলেছ। সুযোগটা যে তুমি পাবে তার ব্যাপারে তোমার শিক্ষক হিসেবে আমার কোনও সন্দেহ নেই। আমার ছাত্রকে আমি চিনি। তোমার বাবার ইচ্ছা, সেখানে তুমি আন্তর্গ্রহ ক্ষেপণাস্ত্র বিভাগে যোগ দেবার চেষ্টা করবে। সফল হলে, বুদ্ধর স্মৃতিতে জমা থাকা সুইফট টাটলের গতিপথের তথ্য ও পূর্বাভাসের সঙ্গে নজরদার উপগ্রহের থেকে পাওয়া মূল তথ্যগুলো বুদ্ধের সাহায্য ছাড়া নিজে হাতে মিলিয়ে দেখবে। তারপর, কেন তোমাকে এ বিভাগে যোগ দিতে বলেছেন তিনি তা তুমি নিজেই বুঝে নিতে পারবে বলে তোমার বাবার বিশ্বাস।’

‘হাতে? নেটওয়ার্কের বাইরে— পুরোনো স্ট্যান্ড অ্যালোন কমপিউটারে?’

‘হ্যাঁ। সেটাই তোমার বাবার ইচ্ছা। বুদ্ধর কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কে থাকা কোনও যন্ত্রগণক ব্যবহার করলে চলবে না।’

‘এরকম পাগলামোর কারণ?’

‘ক্রিস, তিনি আমার মালিক। তোমার পালকপিতা। তাঁর বিষয়ে এমন অসম্মানকর মন্তব্য করাটা আমি ভালোভাবে নিচ্ছি না। এ-ও জেনে নাও, তোমার শিক্ষক হিসেবে আমারও ইচ্ছা তুমি এ কাজটা করে দেখ। আমার বিশ্বাস তুমি চমকে উঠবে।’

ক্রিস্টোফার একটু অবিশ্বাসের গলায় বলল, ‘কিন্তু বাবা এসব বিষয়ে কী করে—’

‘একসময়ে তুমি সবই জানবে ক্রিস। তবে আজ নয়। উপস্থিত আমার কাজ ছিল তোমাকে এই কথাগুলো জানানো। আমার কাজ শেষ। তুমি তা মানবে কি মানবে না তা তোমার ইচ্ছে।’

ক্রিস্টোফার মাথা নাড়ল। সুইফট টাটলের বিষয়টা পণ্ডিতমহলে গুজবের জায়গাই নিয়ে রেখেছে এখন। এমন কিছু গোপন বিষয় নয় তার গতিপথের তথ্যগুলো। ধূমকেতু আর অ্যাস্টেরয়েডদের গতিপথের নজরদারির কাজটা আন্তর্গ্রহ ক্ষেপণাস্ত্র বিভাগের জিম্মায় রয়েছে। সেখানে যোগ দিলে এ কাজটুকু সহজেই করে ফেলতে পারবে সে।

***

‘তোমার পিএইচ ডির নির্দেশক হবার জন্য তিনজন বৈজ্ঞানিক দাবি জানিয়েছেন,’ ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রধান জেমস উইলিয়াম হাতের ট্যাবলেটটার দিকে তাকিয়ে একবার মাথা নাড়লেন, ‘আন্তর্গ্রহ প্লাজমা ড্রাইভ ক্ষেপণাস্ত্র প্রোগ্রামের ধীরেন্দ্র বাজপেয়ী, ভূগর্ভ ফুঁড়ে চলা শব্দোত্তর আন্তর্মহাদেশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রোগ্রামের যশজিত হেনা এবং হ্যাঁ, পরীক্ষামূলক অতি আলোকগতি মডিউল প্রোগ্রামের ওয়াং হেন্‌স। এখন পছন্দটা তোমার ইয়ংম্যান। তোমার সৌভাগ্যকে আমি ঈর্ষা করি।’

‘অতি আলোকগতি মডিউল?’ সামনে বসা তরুণটির চোখে ঝলসে ওঠা আলোটা নজর এড়াল না জেমসের। ঠিক এইটেই তিনি আশা করছিলেন।

‘কিন্তু এটা তো ডিফেন্স মিসাইল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের গবেষণাপ্রকল্প নয়?’

‘ইয়ংম্যান, যশপাল শুধু প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণার কাজ করে না। এখানে আরও কিছু গবেষণাকেন্দ্র আছে। তার বিজ্ঞানীরাও কেউ কেউ তোমার কাজে উৎসাহী। যদিও তোমার আবেদনপত্র ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণাকেন্দ্রের জন্য পেয়েছি আমরা, তবু তুমি হেনস-এর কাছে কাজ করতে চাইলে আমি তা বিবেচনা করব।’

জেমসের হাতে ধরা ট্যাবলেটের পর্দাটার দিকে একনজর দেখে মাথা নাড়াল ক্রিস্টোফার। তারপর মাথা নিচু করেই বলল, ‘আমার নিজের পছন্দটা আমি জানাতে পারি কি?’

‘আরে সেইটাই তো বলছি। এই তিনটে প্রোগ্রামের যে কোনওটাতে সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কোনটা তুমি বেছে নেবে তা একেবারেই তোমার ইচ্ছের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি আমরা। তবে যদি আমাদের উপদেশ চাও তাহলে বলব, অতি আলোকগতি মডিউল প্রোগ্রামে যাও তুমি। ওই পথেই মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। তোমার মতো প্রতিভাকে আমরা চাইব—’

‘আমারও তা-ই ইচ্ছা স্যার। কিন্তু—’

তার মুখের দিকে স্থির চোখে তাকালেন উইলিয়াম। ওয়াং তাঁর প্রিয় ছাত্র। ক্রিস্টোফারের মাস্টার্সের বিষয় ছিল বস্তু-প্রতিবস্তু জ্বালানির উন্নতিসাধন। এই বয়সেই সে এলাকায় সে আশ্চর্য প্রতিভার সাক্ষর রেখেছে। অতি মহাকাশ গবেষণায় এই জ্বালানির প্রয়োগেই একমাত্র সাফল্য পাওয়া যে সম্ভব সে কথা ওয়াং তাঁকে বহু আলোচনাতেই বলেছেন। সেটা জানতেন বলেই কিছুদিন আগে এ বিষয়ে ক্রিস্টোফারের স্টুডেন্ট রিসার্চ প্রোগ্রামের কাজগুলো দেখে উইলিয়াম তাকে এখানে আসবার জন্য নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন।

একজন ভালো ছাত্রকে নিজের গবেষণা প্রোগ্রামে নেবার জন্য কাড়াকাড়ি থাকেই। সেখানে ওয়াং-এর প্রতি পক্ষপাতিত্ব সামনাসামনি দেখানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তবু তাঁর বিশ্বাস ছিল ইন্টারভিউ বোর্ডে ক্রিস্টোফার ওয়াং-এর অফারটাই নেবে। তার কাজের সরাসরি প্রয়োগ সেখানেই সম্ভব। এখন এই ছোট ‘কিন্তু’টা হঠাৎ তাঁর ভ্রূতে কুঞ্চন জাগিয়ে তুলেছে।

‘কিন্তু— কী?’

দ্রুত চিন্তা করছিল ক্রিস্টোফার। টাইকোর কাল রাত্রের কথাগুলো তার কানে বাজছে এখনও। বাবা কোথায় কী শুনেছেন তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে তার সন্দেহ আছে যথেষ্ট। কিন্তু তাঁর ইচ্ছেটাকে মর্যাদা না দিলে তিনি দুঃখ পাবেন। সেটা তার কাছে সবার ওপরে। জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটা স্মৃতিভোলা অনাথ ছেলেকে এতদূরে তুলে এনেছেন তিনি। বারংবার বলেন, ‘আমার পেশায় সারাটা জীবন চোরপুলিশ খেলে গেলাম। আমার ছেলে তা করবে না। সে সবার সেরা বিজ্ঞানী হবে।’ তাকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন।

একটু বাদে সে মুখ তুলল সে। মনস্থির করে নিয়েছে ক্রিস্টোফার। একবার শুধু বাবা আর টাইকোর ইচ্ছেটাকে পূরণ করে দেওয়া। তারপর সে তার নিজের স্বপ্নের কাজে যাবে। কেন বাবা বুদ্ধর বিশ্লেষণ অনুযায়ী সুইফট টাটলের গতিপথ আর উপগ্রহ নজরদারির মূল তথ্যকে মিলিয়ে দেখতে চাইছে সে জানে না। টাইকোরও বক্তব্য সেখানে আশ্চর্য কিছু পাওয়া যাবে। একজন সাধারণ ব্যবসায়ী আর একটা যন্ত্রমস্তিষ্কের এহেন শখের কথা শুনলে তা এই বিজ্ঞানীদের হাসির খোরাক হবে। নিজের পালকপিতা এবং প্রথম শিক্ষককে সবার সামনে হাস্যাস্পদ হতে দিতে সে চায় না। আসল কথাটা বলা যাবে না এখানে।

‘আমাকে একটা ছোট প্রজেক্টের কাজ শেষ করে নেবার অনুমতি দেবেন স্যার?’

‘খুলে বলো।’

‘বস্তু-প্রতিবিস্তু জ্বালানি নিয়ে আমার মূল গবেষণা। ড. ওয়াং-এর কাছে সেইটাই আমার প্রধান কাজ হবে। কিন্তু এর সঙ্গে প্লাজমা জ্বালানির মিশ্র ইঞ্জিন অনেক বেশি কার্যকর হবে বলে আমার ধারণা। মূল কাজে যাবার আগে আমি তাই প্লাজমা জ্বালানির বিষয়ে ড. ধীরেন্দ্র বাজপেয়ীর কাছে কিছু কাজ করতে চাই।’

‘ইমপসিবল। এই দুই জ্বালানি সম্পূর্ণ দু-রকম। এদের কোনও মিশ্রিত ব্যবহার—’

‘আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব স্যার। কিন্তু তা সম্ভব হলে, যে কোনও যান একইসঙ্গে আন্তর্গ্রহ আর আন্তর্নক্ষত্রযান হিসেবে কাজ করতে পারবে।’

‘হাঃ। প্রফেসর ডিমাক-এর স্বপ্ন!’

‘হ্যাঁ, স্যার। আজ যা স্বপ্ন, কাল তাকে আমি বাস্তব করে তুলতে চাই। প্লাজমা জ্বালানির বিষয়ে ডক্টর বাজপেয়ী পৃথিবীতে এক নম্বর। প্রথমে তাঁর কাছে কাজ করে—’

জেমস উইলিয়ামের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা তার ভেতর অবধি পড়ে নিতে চাইছিল। তাঁর চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে রইল জিষ্ণু। আসল কারণটা এঁকে বলা যাবে না।

‘অর্থাৎ তুমি বাজপেয়ীর আন্তর্গ্রহ ক্ষেপণাস্ত্র প্রোগ্রামে যোগ দিতে চাইছ।’

‘হ্যাঁ, স্যার। এ প্রজেক্টটা করে নেবার পর ডক্টর ওয়াং এর প্রজেক্টে যোগ দিলে কাজটা আমি আরও ভালোভাবে করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।’

খানিকক্ষণ চুপ করে অবাধ্য ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন উইলিয়াম। দুঃসাহস বটে। প্রতিষ্ঠানের প্রধানের ইচ্ছেকে এত অবলীলায় উড়িয়ে দিল। রাগ হচ্ছিল তাঁর। আবার মজাও লাগছিল। দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, অনুগত ভালো ছাত্রেরা চিরকাল মাঝারি মাপের কাজেই আটকে থাকে। সীমা ভাঙা দুঃসাহসী কাজ করতে পারে একমাত্র এই দুঃসাহসী তরুণরাই।

নিজের মনের ভাবটা চেপে রেখে মাথা নাড়লেন তিনি, ‘বেশ। আমার এতে সম্মতি আছে। বেস্ট অব লাক ইয়ংম্যান। যশপালে স্বাগত।’

***

‘হাই ক্রিস। তোমার স্টোন এজ খেলনা নিয়ে ব্যস্ত নাকি?’

এলেনার হাসিমুখটা কমিউনিকেটরের পর্দায় ফুটে উঠেছে। ইউক্রেনের মেয়ে। সতেরো বছর বয়সে পিএইচডি করেছিল ডিপ স্পেস ন্যাভিগেশনে।

তার সামনে দাঁড়ানো পুরোনো দিনের যন্ত্রগণকটাকে এলেনা ওই নামে ডাকে। অবশ্য ইনস্টিটিউটের গোডাউন থেকে খুঁজেপেতে জিনিসটাকে জুটিয়ে দিয়েছিল এই এলেনাই। অবসর সময়ে এ যন্ত্রটা নিয়ে জিষ্ণুর খেলা করবার নেশাটা বেশ উপভোগই করে সে।

টার্মিনালে ভেসে চলা সংখ্যার স্রোতগুলোর থেকে চোখ ঘোরাল ক্রিস্টোফার। গত এক বছর ধরে, ড. বাজপেয়ীর কাছে তার মূল কাজটার পাশাপাশি এ কাজটা চালিয়ে চলেছে সে। বুদ্ধর স্মৃতিভাণ্ডার থেকে জোগাড় করা সুইফট টাটল বিষয়ক সমস্ত মূল তথ্যকে বিশ্লেষণ করে খুব ধীরে ধীরে একটা সুদৃশ্য নকশা গড়ে উঠছিল যন্ত্রটার পর্দায়।

এ যন্ত্রটা প্রায় একশো বছরের পুরোনো। জিষ্ণু তাকে যথাসম্ভব সারিয়ে নিলেও, হাজারো টেরাবাইট তথ্যের ভারে একেবারে ধীর হয়ে পড়েছে তার গতি। যতক্ষণ না তার কাজ শেষ হয়, ততক্ষণ আর কিছু করবার নেই ক্রিসের। কমিউনিকেটরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে সে বলল, ‘বলো।’

‘ঘড়ির দিকে দ্যাখো।’

‘দেখবার দরকার নেই। আমি জানি। সন্ধে ন-টা।’

‘আজ কমিউনিটি হল-এ সাপ্তাহিক খাওয়াদাওয়া আছে। মনে আছে তো?’

ক্রিস্টোফার এলেনার চোখে চোখ রেখে একটুকরো হাসল, ‘মনে আছে। কিন্তু আজ আমি আমি যে যেতে পারছি না এলেনা!’

‘ওসব বললে শুনছি না। আজ তোমাকে আসতেই হবে। একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।’

‘সারপ্রাইজ? মানে?’

‘আজকের তারিখটা দ্যাখো একবার। ২২ আগস্ট ২১২৫। কিছু মনে পড়ছে? হ্যাপি বার্থ ডে ক্রিস।’

মৃদু হাসল ক্রিস্টোফার। এলেনা তার গল্পটা জানে না। এ প্রতিষ্ঠানের কেউই তা জানে না। কা পোনের তৈরি করে দেওয়া জন্মদিনটাই এখন—’

‘ক্রিস! ওঠো বলছি!’

পর্দার বুকে আস্তে আস্তে গড়ে ওঠা নকশাটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল ক্রিস্টোফার। লাল রঙের একটা রেখা গড়ে উঠছে সেখানে ধীরে ধীরে। গভীর মহাকাশ থেকে উঠে এসে তা সরাসরি এগিয়ে চলেছে পৃথিবীর দিকে। এখনও তা ঠিক কোনখানে গিয়ে শেষ হবে বোঝা যায় না। যন্ত্রের গণনা শেষ হয়নি। কী মনে হতে হঠাৎ সে আরও কিছু কম্যান্ড দিল কিবোর্ডের বুকে। একই উৎস থেকে উঠে আসা একটা নীল রঙের রেখা এইবার দ্রুত এগিয়ে এল লাল রেখাটার পাশাপাশি। তারপর মঙ্গল পেরিয়ে আস্তে আস্তে তা লাল রেখার পথ ছেড়ে সরে গিয়ে, পৃথিবীর কিছু দূর দিয়ে উধাও হল মহাকাশের গভীরে।

‘এবার কিন্তু আমি রেগে যাচ্ছি ক্রিস,’ কমিউনিকেটরে এলেনার অধৈর্য গলা ভেসে এল ফের।

‘এই যাই,’ হাসিমুখে বলে উঠল ক্রিস। কা পোনের সন্দেহটা আরও বাস্তব ঠেকছে এখন। কিন্তু একজন বৈজ্ঞানিক অনুমানের ভিত্তিতে কোনও কাজ করতে পারেন না। গণনার কাজটা আগে শেষ করতে দিতে হবে একে। অর্থাৎ আরও ঘণ্টাদুয়েকের ধাক্কা। সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে—

‘তবে ঠিক দু-ঘণ্টার বেশি থাকব না বলে রাখছি আগে থেকেই। ততক্ষণে ডেটা প্রসেসিং শেষ হয়ে যাবে। ফিরে এসে রেজাল্টগুলো—’

‘জানি জানি। এখন এসো তো।’

ডেটা সেন্টারের বাইরের স্কাইওয়াকের ঠিক সামনেটায় এলেনা দাঁড়িয়েছিল। ক্রিস্টোফারকে বেরিয়ে আসতে দেখে একগাল হাসল, ‘চলো। সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।’

এ স্কাইওয়াকটা নতুন। গবেষণাকেন্দ্রের উঁচু বাড়িগুলোর মাথা ছাড়িয়ে সটান উঠে গেছে ওপরের দিকে। একপাশ দিয়ে চলমান এসকালেটারটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল ক্রিস্টোফার। তারপর এলেনার হাতটা ধরে বলল, ‘উঁহু। হেঁটে যাব। ঠান্ডা হাওয়ায় হাঁটতে ভালো লাগছে বেশ।’

‘সে চলো। কিন্তু একটা প্রশ্ন করব?’

‘হুম।’

‘ডক্টর বাজপেয়ী পরশুদিন আমার পেপার রিভিউয়ের সময় কথায় কথায় তোমার কথা বলছিলেন। তুমি নিজের প্রজেক্টের রিসার্চের চাইতে তোমার ওই স্টোন এজ খেলনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকছ আজকাল। কথাটা কি সত্যি?’

চুপ করে হাঁটছিল ক্রিস্টোফার। কথাটা সত্যি। কিন্তু সে কথা একে বলে লাভ নেই কিছু। কেউ বিশ্বাস করবে না তার কথা এখনও। সে নিজেও পুরোপুরি বিশ্বাস করে না নিজেকে। যখন শুরু করেছিল তখন কাজটা যে এত লম্বা হয়ে উঠবে তা তার আন্দাজ ছিল না। বুনো হাঁসের খোঁজে সময়টা নষ্ট করল না তো সে? কিন্তু প্রাথমিক গণনাগুলো যে হদিশ দিতে শুরু করেছে তাতে—

‘তোমার নিজের প্রজেক্ট রিভিউ তো পরশুদিন। তার জন্য তৈরি হয়েছ কি?’

স্কাইওয়াকের মুখটা এইবারে নিচু হয়ে এগিয়ে গিয়েছে কমিউনিটি হলের আলোজ্বলা দরজার দিকে। সেখান থেকে লোকজনের মৃদু গুনগুন ভেসে আসছিল। সেইদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্রিস্টোফার। প্লাজমা ড্রাইভের সঙ্গে প্রতিবস্তু ইঞ্জিনের হাইব্রিড তৈরির প্রস্তাব! সেটা যে সম্ভব নয় তা সে গোড়া থেকেই জানে। আগামী পরশুর রিভিউতে সে নিজের প্রজেক্ট নিয়ে কী বলবে তা সে এখনও জানে না। গত একটা বছর ধরে সে কাজের বিশেষ কিছুই এগোয়নি তার। দিনরাত এক করে সে কা পোনের সন্দেহের বিষয়ে তথ্য একত্র করে গিয়েছে। আজকের রাতটা গুরুত্বপূর্ণ। কী রায় দেবে তার যন্ত্র তার সব তথ্যকে বিশ্লেষণ করে?

যদি কা পোনের সন্দেহ মিথ্যে হয়— তাহলে গত এক বছরের সব চেষ্টা বিফল হবে তার। হয়তো এ প্রতিষ্ঠান থেকে সরে যেতে হবে তাকে অক্ষমতার বোঝা মাথায় নিয়ে। আর যদি সত্যি হয়? তাহলে যে এই সমস্ত গবেষণা, এই গোটা প্রতিষ্ঠানটার অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে উঠবে? হাতে থাকবে মাত্রই একটা বছর। না না। সে নিজেকে ব্যর্থ দেখতে চায় এবারে।

‘এই যে বার্থডে বয় এসে গেছে। হ্যাপি বার্থডে ক্রিস।’ চারপাশ থেকে নানা ভাষায় নানারঙের মুখগুলো এগিয়ে এসে চমকটা ভেঙে দিল ক্রিস্টোফারের। কমিউনিটি হলের মাঝখানে একটা টেবিলে একটা ছোট কেক রাখা। দেয়ালে হলোগ্রাফিক ছবিতে ক্রিস্টোফারের মুখের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল প্রতিষ্ঠানের ব্যানার— ‘যশপাল পরিবারের সদস্য ক্রিস্টোফারের জন্মদিনে আমাদের শুভেচ্ছা—’

***

হঠাৎ কমিউনিকেটরের মৃদু কাঁপুনি তাকে সতর্ক করে তুলল। ঘরজোড়া রামধনুর রং ছড়াচ্ছে প্রজেক্টরগুলো। চঞ্চল, উদ্দাম একটা গানের সুরে পা মিলিয়েছে সবাই। কেউ তাকে এ মুহূর্তে খেয়াল করছে না।

হইহইয়ের মধ্যেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে একটা কোণায় গিয়ে হাতের কমিউনিকেটরটা বের করে আনল সে। তার পুরোনো গণকের সঙ্গে জুড়ে রাখা যন্ত্র সংকেত দিয়েছে, তার দিয়ে আসা গণনার কাজ শেষ হয়েছে। কমিউনিকেটরের পর্দায় প্রতিফলিত হচ্ছিল মূল গণকের পর্দার ছবিটার একটা ছোট রূপ। লাল ও নীল রঙের দুটো রেখা। লাল রেখাটা সরাসরি এসে বিঁধে রয়েছে পৃথিবীর বুকে। তার কিছুদূর দিয়ে মহাকাশে হারিয়ে গিয়েছে এতদিন ধরে সুইফট টাটলের গতিপথ বলে দেখানো নীল রঙের রেখাটা।

এদিকওদিক একবার তাকিয়ে দেখল সে। কেউ খেয়াল করছে না তাকে। তারপর কমিউনিকেটরে একটা সংখ্যা টাইপ করে মৃদু গলায় ডাকল, ‘টাইকো?’

তার যন্ত্র থেকে রেখাদুটোর ছবিটা তখন ভেসে গিয়েছে বহু দূরের কোন আকাশে উড়তে থাকা একটা চোরাচালানকারি যানের কমপিউটারে। কয়েক মুহূর্ত বাদে সেখানে ছবিটা মুছে গিয়ে টাইকোর মুখটা ভেসে উঠল, ‘এবার তুমি নিশ্চিত তো ক্রিস?’

ফ্যাকাশে মুখে মাথা নাড়াল ক্রিস্টোফার। টাইকোর কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। আস্তে আস্তে তার মুখটা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে তখন কা পোনের মুখ ভেসে উঠছে। স্থির চোখে ক্রিস্টোফারের দিকে তাকিয়ে রইল সে কিছুক্ষণ। তারপর যখন কথা বলল, তখন তার গলায় উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও ছিল না, ‘আমরা আগে থেকেই এটা জানতাম ক্রিস। শুধু তোমার প্রমাণটা খুঁজে বের করা দরকার ছিল, যাতে সবাই বিশ্বাস করে।’

‘কিন্তু— কী লাভ? মাত্র এক বছর সময় বাকি আছে আর। এর মধ্যে—’

‘চেষ্টা করো। আপ্রাণ চেষ্টা করো এবার। আমি জানি এইবার পৃথিবীর সেরা মস্তিষ্কেরা এ নিয়ে চেষ্টা করবেন। হয়তো তাতে ফল হবে। যদি না হয় তাহলে একটা আরও পথ থাকবে ক্রিস। একটা অস্ত্র আছে। একেবারেই অপরীক্ষিত। তাই তার ওপর ভরসা রাখবার সাহস আমার নেই। আমি তোমার এবং দুনিয়াজোড়া বৈজ্ঞানিকদের প্রতিভার ওপর ভরসা রাখব তাই। তাতে ব্যর্থ হলে শেষ চেষ্টা হিসেবে—’

আপনমনে কথাগুলো বলতে বলতেই হঠাৎ নিজেকে সামলে নিলেন কা পোন, ‘তোমার কমিউনিকেটরের ফায়ার ওয়াল সরিয়ে নাও। একটা স্নিফার প্রোগ্রাম ইনস্টল করে দেব এতে। ঠিক কোন প্রোগ্রামটা নজরদার উপগ্রহদের পাঠানো তথ্যে বদল এনে বুদ্ধর বিশ্লেষকের কাছে সুইফট টাটলের গতিমুখের বিষয়ে ভুল খবর দিচ্ছিল সেটাকে খুঁজে বের করতে হবে তোমায়। একমাত্র তাহলেই এ রহস্যের সঠিক ব্যাখ্যা তুমি তুলে দিতে পারবে প্রতিরক্ষা বিভাগের হাতে।’

উৎসবরত মানুষজনের নজর এড়িয়ে ততক্ষণে কমিউনিটি হলের বাইরে বের হয়ে এসেছে ক্রিস্টোফার। বড় বড় পায়ে স্কাইওয়াকের এসকালেটরে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই তার আঙুল খুলে দিয়েছে তার কমিউনিকেটরের দরজা। সেখান দিয়ে শূন্যতা বেয়ে ভেসে এসে একটা ছোট্ট কিন্তু শক্তিশালী প্রোগ্রাম ফের ভেসে যাচ্ছিল বুদ্ধের প্রসেসিং কোরের ভেতরে। একটা বৈদ্যুতিন জীবাণু সংক্রমণের মতোই সে তখন ছড়িয়ে পড়ছে অমিত শক্তিধর পার্থিব সেন্ট্রাল প্রসেসর ‘বুদ্ধ’র মস্তিষ্কে, তার সমস্ত প্রোগ্রামের সাব-রুটিনের ভেতরে। খুঁজে চলেছে কোনও লুকিয়ে থাকা নিয়মভাঙা ম্যালওয়ারের সংকেত—

***

এখন এখানে রাত। কাচের ডোমের বাইরে অন্ধকার আকাশে মৃদু সঞ্চরমাণ ফোবসের আলোর বিন্দুটা আস্তে আস্তে মাথার ওপরে উঠে আসছিল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ প্যানেল থেকে জেগে ওঠা তীক্ষ্ণ শব্দটা চমক ভাঙিয়ে দিল নজরদার মানুষটার। মুখ ঘুরিয়ে পর্দার দিকে একনজর তাকিয়ে সে বুঝে নিতে চাইল ব্যাপারটা। আর তারপরেই বিপদজ্ঞাপক বোতামটার গায়ে আঙুল ছুঁইয়ে সে ডাকল, ‘ড. গ্রোভার।’

প্রায় মিনিটখানেক পর পল গ্রোভারের আধাঘুমন্ত মুখটা ভেসে উঠল কমিউনিকেটরের পর্দায়, ‘কী হয়েছে জালাল?’

‘বুঝতে পারছি না। বুদ্ধের সঙ্গে আমাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে হঠাৎ। কী করে—’

‘আমরা আসছি। কোনও কিছুতে হাত ছোঁয়াবে না। আশা করব তোমার কোনও ভুলে—’

ফ্যাকাশে মুখে মাথা নাড়াল জালাল নামের বিজ্ঞানীটি। সর্বাধিনায়িকা লালপিওতের এই টাটল ব্লাস্টার প্রজেক্টে কাজ করবার সম্মান যেমন আছে তেমনই আছে সামান্যতম ত্রুটিবিচ্যূতিতে কঠোর শাস্তির ভয়।

দু-ঘণ্টা বাদে, নিয়ন্ত্রণকক্ষের প্রধান প্যানেলের সামনে থেকে যখন মাথা তুললেন পল গ্রোভার, তখন চোখদুটো জ্বলছে তাঁর। পাশে সদ্য এসে বসা লালপিওতে উদ্বিগ্নমুখে তার দিকে দেখছিলেন। সেদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন পল, ‘একটা স্নিফার প্রোগ্রাম। বুদ্ধের ভেতরে ইনস্টল করা হয়েছে এখন থেকে তিন ঘণ্টা আগে। আমাদের ম্যালওয়ার চিহ্নিত হয়েছে অ্যাডমিরাল। আমাদের এতদিনের সমস্ত চেষ্টা—’ বলতে বলতেই হঠাৎ লালপিওতের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু বিস্মিত হলেন তিনি। সেখানে প্রত্যাশিত রাগের বদলে একটা অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে পড়েছে।

‘একটু আগেই ব্যাপারটা ঘটল তাহলে পল। আমার নিজের পরিকল্পনা ছিল আর একমাস বাদে আমরা নিজেরাই নিঃশব্দে, সবার চোখের আড়ালে ম্যালওয়ারটাকে সরিয়ে নেব।’

‘তার মানে?’

‘তুমি বৈজ্ঞানিক, গ্রোভার। অসামান্য প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিক। কিন্তু রাজনীতির তুমি কিছু বোঝ না। যেটা বোঝ সেই বিষয়ের একটা প্রশ্ন করি তোমায়। আজ যদি তুমি হঠাৎ জানতে পারতে, ওই ধূমকেতুটা এই মঙ্গলের সঙ্গে ধাক্কা খাবে ঠিক এক বছর বাদে তাহলে এক বছরের মধ্যে, আমাদের সমস্ত শক্তিকে কাজে লাগিয়েও তুমি তাকে রোখবার মতো অস্ত্র বানাতে পারতে কি?’

মাথা নাড়লেন গ্রোভার, ‘সেটা সম্ভব নয়। এ ধরনের গবেষণায় অনেক বেশি সময় লাগে। অন্তত চার-পাঁচ বছরের প্রজেক্ট হতে হবে সমস্ত, তত্ত্ব, রূপরেখা ও বাস্তবায়ন শেষ করতে।’

‘ঠিক। তাহলে এখন পার্থিব সরকার খবরটা পাবার পর কী হবে বুঝতে পারছ? আতঙ্ক ছড়াবে গ্রোভার। নিশ্চিত ধ্বংসের আতঙ্ক। কুড়ি বিলিয়ন মানুষ। কোথায় পালাবে? আনন্দ করো গ্রোভার। এতদিনে— এক স্বৈরাচারী গ্রহ বুঝবে, মৃত্যুর অসহায় আতঙ্ক কাকে বলে।’

‘কিন্তু অ্যাডমিরাল, আপনার পরিকল্পনার থেকে একটাই তফাত হয়ে গেছে এখানে। এরা নিজে থেকে, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আমাদের ম্যালওয়ারটাকে খুঁজে পেয়েছে। ওরা প্রতিশোধ নেবে অ্যাডমিরাল। আমরা আর নিরাপদ নই।’

তাঁর কথাটা শেষ হবার আগেই পর্দায় একটা মুখ ভেসে উঠল হঠাৎ। লালপিওতের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কপালে হাত ঠেকালেন সামরিক পোশাক পরা মানুষটি, ‘আপনাদের পরিবহন তৈরি আছে অ্যাডমিরাল। আশ্রয়ঘাঁটিতে খবর পাঠানো হয়েছে।’

‘ধন্যবাদ হোমাজ। ওভার অ্যান্ড আউট,’ বলতে বলতেই গ্রোভারের কাঁধ ছুঁয়ে কাচের ডোমের বাইরের দিকে ইশারা করলেন একবার লালপিওতে। সেখানে তখন ফ্লাডলাইটের আলোয় দুটো বিশাল মালপরিবহনযান এসে দাঁড়িয়েছে।

‘এ আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে আমি বহুদিন আগেই তৈরি হয়েছি পল। মঙ্গলের ওপর পার্থিব সামরিক হানা হলেও আমার প্রশাসনকে ছুঁতে পারবে না তারা। কিছু সাধারণ মানুষই মরবে কেবল। আক্রমণের অনেক আগেই গ্রহপৃষ্ঠ থেকে সরে যাবার জন্য আমি তৈরি। এখন সময়টা এগিয়ে এসেছে শুধু।’

‘আমাকে এই প্রস্তুতির খবর আগে জানানো হয়নি কেন?’ পল গ্রোভারের মুখে একইসঙ্গে অনেকগুলো অনুভূতি খেলা করে যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে মুখের হাসিটি একইরকম রেখে লালপিওতে বললেন, ‘আমাকে প্রশ্ন করবার সাহস আমি একবারের বেশি ক্ষমা করি না পল। তোমাকে আমি হারাতে চাই না। তোমার জন্য একটা কাজ আছে আমার। সুইফট টাটল-এর উড়ানপথ সংক্রান্ত অন্তর্ঘাতে আমাদের ভূমিকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পার্থিব সরকারের নজরে আসা এখন মাত্রই কয়েকটা দিনের ব্যাপার। এই সময়টুকুর মধ্যে, কে এ কাজটা করতে সক্ষম হয়েছে তার হদিশ আমার চাই।’

‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি— কী করে—’

‘যে প্রোগ্রামটা আমাদের ম্যালওয়ার খুঁজে বের করল তা আকাশ থেকে আসেনি। কোন পথে তা এল, সেটা খুঁজে বের করবার চেষ্টা করো পল। যদি তা বাইরে থেকে কেউ পাঠিয়ে থাকে তবে তা সরাসরি বুদ্ধের নিরাপত্তাকে ভেঙে ঢুকবে না। ওখানে কাজ করেন এমন কারও যন্ত্র বেয়ে তা আসবে। তার চিহ্ন থাকবে কোথাও না কোথাও। খোঁজো পল, খোঁজো। সে মানুষটাকে আমার চাই। আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছে সে। আমি তো তাকে ছেড়ে দেব না—’

***

ব্যস্ত এই এয়ারওয়ে নয়াদিল্লি থেকে বের হয়ে এসে যশপাল গবেষণাকেন্দ্রের ক্যাম্পাসের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে মধ্য ভারতের দিকে। ভাসমান গাড়িগুলো অন্ধকার বাতাস কেটে তিরবেগে ছুটে যায় তার বুক চিরে। তাদের উন্নত ন্যাভিগেশান এখন পৃথিবীকে ফের ফিরিয়ে দিয়েছে তার রাতের প্রাকৃতিক অন্ধকার। ২০৮৮ সালের প্রকৃতিসংরক্ষণ আইনের ১৮৫ তম ধারা, কিছু নির্দিষ্ট এলাকা বাদে রাতের প্রাকৃতিক আলো-আঁধারিকে ফিরিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর বাকি সমস্ত অঞ্চলে। মাটির ওপর থেকে সভ্যতার কৃত্রিম চিহ্নদের সরিয়ে ফেলবার কাজও এখন প্রায় শেষ। পৃথিবী ফের ফিরে গেছে তার গাছপালায় ছাওয়া আদিম স্বর্গের রূপটাতে।

আকাশে ঘন মেঘ ছিল। তার অন্ধকারের আড়ালে, মূল এয়ারওয়ে ছেড়ে যশপাল গবেষণাকেন্দ্রকে ঘিরে থাকা জাতীয় উদ্যানের মাটির কাছাকাছি ভাসতে থাকা ছোট যানটা পথচারী যানদের স্ক্যানারে ধরা পড়লেও সে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি বিশেষ। জায়গাটা ভারী সুন্দর। দিনে বা রাতে তার বন্য সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য মাঝে মাঝেই কোনও ভাবুক মানুষ সেখানে যান থামিয়ে একটু সময় কাটিয়ে যান।

ছোট যানটার তিনজন আরোহী তাদের একজনের হাতে ধরা পর্দাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। সেখানে ধূসর পটভূমিকায় একটা ছোট সাংকেতিক শব্দের পাশে একটা উজ্জ্বল লাল আলোর বিন্দু দপদপ করছিল।

‘অবশেষে! পোকাটা তাহলে এখানেই—’ সেদিকে চোখ স্থির রেখে যানের চালক কথা বলে উঠল।

‘তাহলে আমার অনুমানটাই শেষ পর্যন্ত ঠিক হল গ্রোভার,’ যানের যাত্রীদুজনের মধ্যে একজন চাপা গলায় দ্বিতীয়জনকে বলল, ‘যশপাল ইনস্টিটিউট থেকেই তাহলে—’

‘নিজের পিঠ চাপড়ানোর কাজটা অন্য সময়ের জন্য তুলে রাখো জালাল,’ গ্রোভারের জবাবে উত্তেজনার ছোঁয়া ছিল, ‘হাতে সময় বেশি নেই। যে আইডেন্টিফিকেশান নম্বরের কমিউনিকেটর থেকেই প্রোগ্রামটা বুদ্ধের মস্তিষ্কে গিয়েছে সেটা যে এখনও এই ইনস্টিটিউটেই রয়েছে সেটা আমাদের সৌভাগ্য। এবার বাকি রইল কমিউনিকেটারটা যাকে ইস্যু করা হয়েছে, তার খবর বের করা।’

বলতে বলতেই তার হাতে একটা অস্ত্র উঠে এসেছে। সেটাকে একবার পরীক্ষা করে নিয়ে ফের পোশাকের মধ্যে রেখে দিয়ে সে বলল, ‘চলো। এদের রিসেপশনের টার্মিনাল থেকে—’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যানের চালক তাকে মাটির বুকে নামিয়ে এনেছে। তারপর সামনের বাক্স থেকে দুটো অস্ত্র তুলে নিয়ে তার একটা বাড়িয়ে ধরেছে জালালের দিকে।

সেটা হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে ফের ফিরিয়ে দিল জালাল। তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলা করে যাচ্ছিল, ‘রিসেপশানের টার্মিনালের দখল নিলে কোনও না কোনও বিপদসংকেত বাজবেই। তারপর বেশিক্ষণ সময় পাব না আমরা। ইঁদুরটাকে ধরবে কেমন করে?’

‘ভয় পাচ্ছ জালাল?’ গ্রোভারের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি খেলে যাচ্ছিল, ‘এটা একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিন-তিনটে ব্লাস্টারের সামনে কিছু বইপোকা—’

‘ভুল গ্রোভার। ভুলে যেও না, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা যশপালের প্রধান কাজ। এদের নিরাপত্তাবিভাগ যথেষ্ট শক্তিশালী হবার কথা কিন্তু,’ জালাল হাসছিল, ‘টের পেয়ে গেলে একটা আধাসামরিক রক্ষীবাহিনীর সামনে দশ মিনিটও টিকব না আমরা।’

‘ওই দশ মিনিটের মধ্যেই যা করবার—’

‘সেটা বিপজ্জনক হবে।’

‘বিপজ্জনক জেনেই তো এ পেশায় এসেছি আমরা জালাল। এই মিশনের গুরুত্ব আমাদের প্রাণের চেয়ে—’

‘অনেক বেশি,’ মৃদু হাসল জালাল, ‘আর ঠিক সেইজন্যই ব্যর্থ চেষ্টা করে না-হোক প্রাণটা দেবার বদলে মিশনটাকে সফল করবার জন্য একটু বুদ্ধি ব্যবহার করাটাই ভালো নয় কি? মনে হয় তাতে অ্যাডমিরাল লালপিওতে খুশিই হবেন।’

লালপিওতের নামটা গ্রোভারের উত্তেজনায় একটু রাশ টানল বোধ হয়। একটু থেমে থেকে সে বলল, ‘কীভাবে করতে চাইছ কাজটা?’

‘বলছি। হ্যাকিং আমার পেশা ছিল তা জানো বোধহয়। আমার দক্ষতায় যথেষ্ট ভরসা না থাকলে অ্যাডমিরাল লালপিওতে আমাকে পার্থিব জেল থেকে বের করে নিয়ে মঙ্গল উপনিবেশের তথ্য উপদেষ্টার পদে বসাতেন না। আর এ অভিযানটাতেও তোমার সঙ্গে আমায় পাঠাতেন না। চেয়ারটা ছাড়ো। আমায় টার্মিনালে বসতে দাও। এপথে আসবার আগে, ছেলেবেলায় যখন সরকারি প্রোগ্রামারের চাকরি করতাম তখন যশপালের ডেটাবেস তৈরির টিম-এ ছিলাম। ও-ডেটাবেসের হাড়হদ্দ আমার জানা।’

অন্ধকারে নিঃশব্দে আসন বদলাবদলি করে যানের গণকের টার্মিনালে এসে বসল জালাল। পর্দার সামনে তার আঙুলের নড়াচড়ার নির্দেশে গড়ে উঠছিল একটা ছোট্ট প্রোগ্রাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে রাতের অন্ধকার বেয়ে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা গবেষণাকেন্দ্রের তথ্যকেন্দ্রের গণকের মস্তিষ্কের উদ্দেশে ভেসে গেল তার তৈরি একটা জীবাণুপ্রোগ্রাম—

তাদের সামনের পর্দায় ভেসে উঠছিল একটা তরুণ মুখ। তার একপাশে তার সম্পূর্ণ পরিচয়— তার রুম নম্বর—

‘যাওয়া যাক এবার।’

‘আর কয়েক মিনিট গ্রোভার।’ বলতে বলতেই তথ্যকেন্দ্রের অন্য একটা ফোল্ডারের ঠিকানায় আঙুল ছোঁয়াল জালাল। সেখানে ভেসে ওঠা তিনজন কর্মীর পরিচয়তথ্যগুলো একত্র করে নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল সে তথ্যকেন্দ্রের সঙ্গে।

তারপর পর্দার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় নির্দেশ দিল, ‘প্রোগ্রাম সংকেত গামা ২৭৬৫।’

কিছু নির্দেশ ফুটে উঠেছে পর্দায়। স্ক্যানারের নীচে নিজের হাতটা রেখে সেগুলো ধরে ধরে জালাল বলে চলেছে তখন—‘নাম হেইন্স অ্যাকোরা। বয়স সাতচল্লিশ। পেশা সাফাইকর্মী—’

‘আমি তৈরি। এবারে তোমার হাতটা এখানে রাখো গ্রোভার,’ বলতে বলতেই উঠে দাঁড়িয়ে গ্রোভারকে স্ক্যানারের সামনে এগিয়ে দিল জালাল। মৃদু গলায় সে তখন বলে চলেছে গ্রোভার নামে মানুষটার নতুন পরিচয়—‘নাম রঞ্জিত পল। পেশা সাফাইকর্মী—’

খানিক বাদে যানটা থেকে নেমে আসা তিনজন মানুষ পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ইনস্টিটিউটের প্রধান দরজায়। একে একে তিনটে হাত তারা মেলে ধরল প্রহরী গণকের লেন্সের তলায়।

‘রাত্রির শিফটে স্বাগত সাফাইকর্মী অ্যাকোরা, পল ও চ্যাং,’ গণকের যান্ত্রিক, সুরেলা গলা কথা বলে উঠল এবার, ‘সাফাইয়ের এলাকা বলুন।’

‘রিসার্চ স্কলার হোস্টেল, চতুর্থ তল,’ গ্রোভার মৃদু গলায় জবাব দিল।

***

‘সাড়ে আটাশ ডিগ্রি উত্তর— পঁচানব্বই ডিগ্রি পূর্ব—’ তার স্বপ্নে বারংবার ঝনঝন করে শব্দদুটো বেজে উঠছিল। একটা গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা বেলুনে উড়ে চলেছে সে। তার সঙ্গে আরও কেউ একজন আছে। পায়ের তলায় গুম গুম শব্দ তুলে ছুটে যাওয়া পাহাড়ি নদীটার ভেতরের একটা দ্বীপের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে সে স্থানাঙ্কদুটো আবৃত্তি করে চলেছিল বারবার।

ছুটন্ত বেলুনের তলার দোলনায় দাঁড়িয়ে ভিজে হাওয়ার ঝাপটা লাগছিল তার চোখেমুখে। পেছনদিকে ঘুরে মানুষটার দিকে একবার তাকাল সে। তার মুখটা ধোঁয়ায় ঢাকা। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল সে। হঠাৎ করে কোনও এক ভুলে যাওয়া শৈশবে ফিরে গেছে তার শরীর। তার ভয় লাগছিল, উত্তেজনা হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। বেলুনটা নামছে এবার। তিরবেগে ছুটে চলেছে দ্বীপটার ওপরে মাথা জাগিয়ে থাকা একটা গুহার অন্ধকার মুখ লক্ষ করে—

‘সাড়ে আটাশ ডিগ্রি উত্তর— পঁচানব্বই ডিগ্রি পূর্ব—’ ফের একবার বলে উঠল ধোঁয়ায় মুখ ঢাকা মানুষটা।

এইবার চমকে উঠল ক্রিস। তার মনে পড়ে গেছে। সুইফট টাটল এর আঘাতবিন্দুর স্থানাঙ্ক এরা! কিন্তু— এ কে?

—ঘন অন্ধকারের মধ্যে একটা গভীর নির্জন গুহার মেঝেতে হাঁটছে সে। তার একপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্ধকার পাতালনদীটার জল ছলছল শব্দ তুলছিল। তার সামনে অন্ধকার মেঝের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে— ওটা কী? ওর পরিচয় সে জানে— কিন্তু—

—ঘণ্টি বেজে উঠেছে— বিপদজ্ঞাপক ঘণ্টা— প্রক্সিমিটি সেনসর সাক্ষাৎ মৃত্যুর উপস্থিতি টের পেয়ে মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে হঠাৎ। গুহার নৈঃশব্দ খানখান হয়ে যাচ্ছিল সেই শব্দে— তাকে ঘিরে ভেঙেচুরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল গুহার অন্ধকার— হারিয়ে যাচ্ছে তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা চির চেনা অথচ একদম অচেনা সেই মানুষটা— তুমি— আ-আপনি কে—’

ঘণ্টার শব্দটা একটানা বেজে যাচ্ছিল তার কানের কাছে। চোখ মেলে হালকা আলোয় চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল ক্রিস। অনেকটা উঁচুতে সুনীলের বিছানাটা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। পাশে টেবিলের ওপর থেকে তার বাজারটা শব্দ তুলছিল একটানা। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে রাত তিনটে বেজে চার। এত রাতে— ভিজিটর? কে এল তার কাছে?

আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলল সে। সেখানে দাঁড়ানো মানুষ তিনজনের দিকে এক নজর দেখেই মাথার মধ্যে কোনও বিপদসংকেত বেজে উঠেছিল তার। কিন্তু সামান্যতম শব্দ তোলবার আগেই তাদের সবচেয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিক থেকে ধেয়ে আসা একটা প্রায় অদৃশ্য ছুঁচ তার চামড়ায় ছুঁল এসে।

মুহূর্তের মধ্যে এলিয়ে পড়া শরীরটাকে সোজা করে ধরে রেখেছিল পেছন থেকে এগিয়ে আসা অন্য দুজন মানুষ। সামান্যতম শব্দও ওঠেনি। ততক্ষণে প্রথমজনের হাতে উঠে আসা দূরনিয়ন্ত্রক যন্ত্রের নির্দেশ মেনে প্রতিষ্ঠানের পাঁচিলের ওপর দিয়ে উড়ে এসে নিঃশব্দে অলিন্দের পাশে ভাসছে তাদের যানটা। তার পরিবর্তিত বৈদ্যুতিন পরিচয় পড়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের গণক স্বয়ংক্রিয় সাফাই যান ক-২০২কে ভেতরে ঢোকবার ছাড়পত্র দিতে আপত্তি করেনি। সাফাইকর্মীদের কাজ শেষ হবার পরে আবর্জনা সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তাদের যানের প্রতিষ্ঠান চত্বরে ঢুকে আসাটাই দস্তুর—

***

‘ক্রিস্টোফার?’

‘কে?’

তার চোখের সামনে জমে থাকা ধোঁয়ার স্তূপ দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছিল। তীক্ষ্ণচোখে একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল ক্রিস। তীব্র একটা আলো এসে তার চোখে পড়েছে। আলোর পেছনে ছায়া ছায়া তিনজন মানুষকে চোখে পড়ে।

‘আমি কোথায়?’

‘মাটি থেকে আড়াইশো কিলোমিটার ওপরে। নিকট মহাকাশে।’

এইবার সে সতর্ক হয়ে চারপাশে চাইল একবার। তার অর্থ এটা কোনও ধাতব ঘর বা পরীক্ষাগার নয়। একটা যান। যানটা জানালাহীন। ছোট। নিকট মহাকাশে পৌঁছেছে তাকে নিয়ে। অর্থাৎ ফেরিযান। সামনের দিকটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে সরু হয়ে গেছে। তেকোণা এই গড়নটা তীব্রগতিতে ছোটবার উপযুক্ত। এখনকার পার্থিব ফেরিযানগুলো সাধারণত পিরিচের মতো গড়নের হয়। ধীরগতি। জোরে ছোটবার মতো গড়ন নয় তাদের।

মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল ক্রিসের ঠোঁটের কোণে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগছে এরা। অবস্থান সংক্রান্ত তথ্যটুকু তাকে না জানালে কোনও সমস্যা ছিল না। সম্ভবত তাকে ভয় দেখাবার জন্যই কথাটা শুনিয়েছে। পৃথিবী ছাড়া আর একটা জায়গাতেই মহাকাশযান গড়বার মতো পরিকাঠামো আছে। এটা মঙ্গল উপনিবেশের যান!

সাবধান হয়ে গেল ক্রিস। মঙ্গল উপনিবেশের একটা ফেরিযান এতটা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কেন তাকে—

‘এটা তোমার?’

উলটোদিকে একেবারে সামনে দাঁড়ানো লোকটার হাতে একটা কমিউনিকেটর ধরা। চমকে উঠে নিজের পকেটে একবার হাত দিয়ে দেখল সে। পাউচটা সেখানে নেই।

অস্বীকার করে লাভ নেই কোনও। মাথার মধ্যে দ্রুত কিছু হিসেব কষে নিচ্ছিল ক্রিস। বাবার কাছে এদের সর্বাধিনায়কের নাম একাধিকবার শুনেছে সে। অ্যাডমিরাল লালপিওতে। মুখোমুখি কখনও এ বিষয়ে কথা না হলেও কা পোনের আসল ব্যাবসার কথা তার অজানা নয়। মঙ্গল উপনিবেশের ক্রমবর্ধমান পার্থিব নিউক্লিয় জ্বালানির চাহিদার অনেকটাই চোরাই পথে মেটে তাঁর মাধ্যমে। চলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় রসদের সরবরাহও। তাঁর নামটা এদের কাছে অজানা না-ও হতে পারে।

‘এতে একটা ম্যালওয়ার আছে ক্রিস। সেটা তুমি কোথা থেকে পেয়েছ?’

একেবারে নির্বোধের মতো মুখ করে মাথা নাড়ল ক্রিস, ‘আমি জানি না। এমন কোন কিছু—’

‘বোকা সাজবার চেষ্টা করো না। জিনিসটা আমাদের অনেক ক্ষতি ঘটিয়েছে। আমাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব না পেলে—’

হঠাৎ সোজা হয়ে বসল ক্রিস। তার কপালে ভ্রূকুটি ফুটে উঠেছে, ‘একটা ভুল করছেন আপনারা। ঠিক দু-দিন আগে আমার কমিউনিকেটর র‍্যান্ডম সিকিউরিটি চেক-এর নমুনা হিসেবে পরীক্ষা করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা উইং-এ। সেখানে এমন কোনও ম্যালওয়ারের চিহ্ন মেলেনি। তা ছাড়া মঙ্গল উপনিবেশের কোনও ক্ষতি চাওয়া আমার পক্ষে—’

‘মঙ্গল উপনিবেশ? তুমি তা কী করে—’

মুখের সামনে হাতটা একবার অলসভাবে নাড়ল ক্রিস। ভেতরে জমে ওঠা দুরদুরানিটার একটা ঝলকও এখন প্রকাশ করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

‘আপনাদের কর্মপদ্ধতি দেখে আমার অনুমান আপনারা সেখানকার গোপন গোয়েন্দা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। মাপ করবেন, আপনাদের এই স্ট্রাইক টিমের দক্ষতার মান সম্পর্কে আমার সন্দেহ হচ্ছে। একটা সাধারণ বিশ্লেষণ মহোদয়। ভূপৃষ্ঠের আড়াইশো কিলোমিটার ওপরে ভেসে থাকা একটা মহাকাশফেরি। তার গড়ন একেবারেই পার্থিব নয়। পৃথিবীর বাইরে একমাত্র মঙ্গলেই নিজস্ব মহাকাশযান গড়বার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অতএব বিষয়টা অনুমান করে নিতে খুব বেশি মস্তিষ্কের পরিচয় লাগে কি?’

কথাগুলো বলে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। তারপর ফের বলল, ‘এবারে যা বলতে চাইছিলাম সেটা শুনুন। মঙ্গল উপনিবেশের কোনও ক্ষতি চাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় তার কারণ আমাদের পরিবারের উপার্জনের বেশির ভাগটাই সেখান থেকে আসে। আমার বাবার নাম কা পোন চি। সোনার ডিম পাড়া হাঁসের পেট নিজেরাই চিরে ফেলব— মাপ করবেন, এটা একটা প্রাচীন পার্থিব প্রবাদ; মানেটা বোঝা কঠিন নয়— সেরকম কোনও কাজ আমার দ্বারা হবে তা আপনারা ভাবলেন কী করে?’

নামটা শুনে একটু থমকে গেল মানুষগুলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল ক্রিস। খুব সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এখন তার নিরাপত্তা।

একটা একটা করে মুহূর্ত কেটে যাচ্ছিল একটা একটা ঘণ্টার মতন। কয়েক মুহূর্ত পরে হঠাৎ তীব্র আলোটা নিভে এল। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা একটা ছোট স্ক্যানার বের করে এনে তার হাতের আইডেনটিফিকেশান চিপটার ওপরে ঠেকাল একবার। তারপর তার পর্দায় ফুটে ওঠা তথ্যগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ইশারা করতেই আস্তে আস্তে তীব্র আলোটা নিভে গিয়ে ঘরের সাধারণ আলো জ্বলে উঠল।

সামনে একটা কনসোলের গায়ে তার কমিউনিকেটরটাকে বসিয়ে পর্দায় কিছু একটা নিবিষ্টভাবে দেখছিল ওদের একজন। তার দিকে এগিয়ে গিয়ে স্ক্যানারটা টেবিলে রেখে লোকটা মৃদু গলায় বলল, ‘জালাল?’

‘দিনটা মিলে যাচ্ছে গ্রোভার। অ্যাডমিনিস্ট্রেটর স্তরের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে একটা ডায়াগনস্টিক চালানো হয়েছে সেদিন যন্ত্রটায়। ওইদিনই তো ম্যালওয়ারটা—’

গ্রোভার নামের মানুষটা ফের একবার তার দিকে ফিরলেন, ‘ঠিক কতটা সময়ের জন্য এই টেস্টটা হয়েছিল ক্রিস?’

ভেতরে জেগে উঠতে থাকা স্বস্তির ভাবটাকে আটকে রেখে মুখে একটা চাপা উৎকণ্ঠার ভাবকে ফুটিয়ে রাখছিল ক্রিস। ‘যে সময় হয়। দিনের কাজের শেষে নির্বাচিত কমিউনিকেটরগুলো জমা করে দিই আমরা। পরদিন সকালে পরীক্ষানিরীক্ষা সেরে সেগুলো আমাদের ফেরত দেওয়া হয়।’

‘তার মানে পরশু রাতে তোমার কমিউনিকেটরটা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ল্যাবে ছিল, তাই তো?’

‘আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’ জুয়াটা খেলেই দিল ক্রিস। কথাটা সে মিথ্যে বলেনি। রুটিন পরীক্ষার জন্য তার যন্ত্রটা সত্যিই সেদিন বিকেলে ঘণ্টাখানেকের জন্য জমা পড়েছিল নিরাপত্তাবিভাগে। তার প্রমাণ যন্ত্রে থাকে। তবে পরীক্ষার সময়সীমা যন্ত্রের স্মৃতিতে থাকবার কথা নয়।

‘তার প্রয়োজন হবে না। সেদিন পরীক্ষাগারের দায়িত্ব কার কাছে ছিল তা তুমি বলতে পারবে?’

‘একজন সামান্য জুনিয়র গবেষককে সে তথ্য প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিভাগ জানাবে বলে আপনি মনে করেন কি?’

ধীরে ধীরে একচিলতে হাসি ফুটে উঠছিল মানুষটার মুখে। উঠে এসে হঠাৎ তার কাঁধে হাত রাখলেন তিনি, ‘তোমার বাবার পরিচয়টা শোনবার পরেই আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম, মঙ্গল উপনিবেশের সঙ্গে কোনও বিশ্বাসঘাতকতা তুমি করতে পার না। সম্ভবত অন্য কেউ— পার্থিব গোয়েন্দা দফতরের কোনও কর্মী তোমার যন্ত্রটাকে ব্যবহার করে নিজের পরিচয়—’

‘ঠিক কী কাজে এটাকে ব্যবহার করা হয়েছে তার কোনও আন্দাজ আমি পেতে পারি কি?’

মানুষটা হেসে মাথা নাড়লেন একবার, ‘না। এ তথ্যগুলো যত কম জানবে তত নিরাপদে থাকবে জুনিয়র পোন। উপস্থিত তোমাকে বিরক্ত করবার জন্য আমরা দুঃখিত। আমরা তোমাকে ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে দিয়ে আসব।’

বলতে বলতেই তার আঙুলের নির্দেশে হঠাৎ তীব্র গতিতে পায়ের নীচে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকার গোলকটার দিকে ধেয়ে গেল যানটা।

‘ইমপ্ল্যান্টটা ঠিক করে বসানো হয়েছে কি?’

‘আমার দক্ষতায় তোমার কোনও সন্দেহ আছে জালাল?’ তীব্রবেগে চাঁদের বিপরীত কক্ষে অপেক্ষায় থাকা মূলযানের দিকে ধেয়ে যেতে থাকা ফেরিটার চারপাশে বাতাসের ধাক্কায় দাউ দাউ অগ্নিশিখা জ্বলে উঠেছে। পুরু স্বচ্ছ আবরণের বাইরে সেই আগুনের আভার দিকে চোখ রেখেই গ্রোভার বলছিলেন, ‘দাবাখেলার বোড়ে। এর যন্ত্রটাকে ব্যবহার করেছে ওরা জালাল। এবার ও আমাদের বোড়ে হবে।’

তাদের সামনের পর্দায় তখন একটা ছোট বিন্দু এগিয়ে চলেছে পর্দার বাঁ-দিকের কোণের দিকে। তাকে ঘিরে ছড়িয়ে থাকা ম্যাপটায় প্রতিমুহূর্তে তার পেরিয়ে যাওয়া ল্যান্ডমার্কগুলোর নাম ফুটে উঠছিল। না, অন্য কোথাও নয়। নিজের ঘরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। কাছাকাছি অন্য কোনও মানুষ নেই। ওর রুমমেটের আইডেন্টিফিকেশন চিপের উপস্থিতি টের পাচ্ছিল শুধু তার গলার কাছে অলক্ষ্যে আটকে দেওয়া আণুবীক্ষণিক বিকনটা। পর্দায় রুমমেটের পরিচয়ও ভেসে উঠছে তখন। সেদিকে চোখ রেখে গ্রোভার মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, ‘এখন থেকে কয়েকটা দিন ও যেখানে যার সঙ্গে যোগাযোগ করবে তাদের সবার খবর আমার চাই। যদি ওকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে কেউ ব্যবহার করতে চায়, অথবা ও যদি নিজেই—’

‘দ্বিতীয় সম্ভাবনাটার বিষয়ে তুমি বোধহয় খুব সিরিয়াস নও গ্রোভার, তাই না?’

‘সে সম্ভাবনা কম। কা পোন চি-র সন্তান—’

হঠাৎ মৃদু হাসলেন জালাল, ‘একটা আকর্ষণীয় জিনিস দেখবে?’ বলতে বলতেই তাঁর ইশারায় পর্দায় পাশাপাশি দুটো আঁকাবাঁকা দাগের ছবি ভেসে উঠেছে।

‘চেন?’

‘আমার সময় নষ্ট কোরো না জালাল। স্কুলস্তরের বিজ্ঞানের প্রশ্নোত্তর করবার জন্য আমরা এখানে আসিনি। দুটো ডিএনএ তন্তুর ছবি—’

‘সময় নষ্ট নয় গ্রোভার। আমাদের সঙ্গে ব্যাবসা করে এমন প্রতিটি পার্থিবের জেনেটিক পরিচয়ের ডেটাবেস আমাদের কাছে রয়েছে তা তুমি জান। ক্রিসকে অজ্ঞান করবার জন্য ব্যবহার করা ছুঁচটাতে তার ডিএনএ-র সামান্য নমুনা রয়েছে। তার আইডেনটিফিকেশন চিপ থেকে তার পিতৃপরিচয় পাবার পর ডেটাবেস থেকে কা পোন চি-র ডিএনএ সংক্রান্ত তথ্য ডাউনলোড করেছি আমি। পাশাপাশি তাদের দুজনের ডিএনএ-র ছবি দেখছ তুমি মনিটরে।’

‘কিন্তু তা থেকে—’

‘ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসবার পথে দুটোকে গণকযন্ত্রে তুলনা করে দেখেছি আমি খানিক আগে। এই হল তার ফলাফল—

পর্দায় ছবিদুটো মিলিয়ে গিয়ে একটা লাইন শুধু ভেসে উঠেছে সেখানে, ‘নো ম্যাচ ফাউন্ড!’

‘বিশ্বাসঘাতক! এটা জানবার পরেও তুমি ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে এলে? তুমি—’

‘হাতটা নামাও গ্রোভার,’ মৃদু হাসল জালাল। তার গলায় বরফের শীতলতার ছোঁয়া ছিল, ‘তুমি বড়মাপের বিজ্ঞানী হলেও স্ট্র্যাটেজির খেলায় তুমি এখনও শিশুই রয়ে গেছ। অ্যাডমিরাল ঠিকই বুঝবেন। একটু অপেক্ষা করো। তাঁর কাছেও এ খবরটা পৌঁছে গেছে এতক্ষণে।’

‘তার মানে?’

‘শোনো—’

* * *

‘তার মানে?’

গ্রহাণুপুঞ্জ বলয়ের কোনও গোপন এলাকায় আত্মগোপন করে ভেসে থাকা দুটো অতিকায় যানের প্রথমটির মধ্যেও গ্রোভারের প্রশ্নটাই উচ্চারিত হচ্ছিল সেই মুহূর্তে। জেমস আরিয়ানা খানিকটা অবাক হয়েই তাকিয়েছিলেন পর্দার দিকে। সেখানে জালাল-এর কাছ থেকে সদ্য এসে পৌঁছনো তথ্যস্রোতটার ছবি ফুটে উঠেছে।

‘এটা জানা সত্ত্বেও ছেলেটাকে আরও অনুসন্ধান করবার জন্য ধরে না রেখে ওরা ছেড়ে দিল? এর দায়িত্ব জালালকে নিতে হবে। ওদের ফের একবার ক্যাম্পাসে ঢুকে যে কোনও মূল্যে—’

সেদিকে তাকিয়ে লালপিওতের চোখদুটোয় একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠছিল, ‘শাস্তি নয় জেমস। জালাল একদম সঠিক পদক্ষেপটাই নিয়ে নিয়েছে। হয়তো শুধু এই পদক্ষেপটার জন্যেই আমাদের এতদিনের সাধনা শেষমুহূর্তে এসে ব্যর্থ হয়ে যাবার সম্ভাবনা কমে আসবে জেমস।’

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছিলেন লালপিওতে। খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়লেন জেমস আরিয়ানা, ‘আমি বুঝতে পারছি না অ্যাডমিরাল। আপনি—’

‘বুঝতে পারছ না জেমস? তাহলে শোনো। পার্থিব প্রজেক্ট একাঘ্নির কথা তোমার মনে আছে আশা করি!’

‘প্রফেসর সত্যব্রত বোস?’

‘হ্যাঁ। দীর্ঘকাল আত্মগোপন করে থাকবার পর উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গলে আমি তাকে শেষ করেছিলাম। কিন্তু কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমার মেলেনি। পালিয়ে থাকবার সময়টা সে কোন কাজে লাগিয়েছিল?

যেখান থেকে তাকে আমরা ধরি সে জায়গাটা সভ্যতা থেকে বহু দূরে। সেখানে একমাত্র মনুষ্যবসতি বলতে ছিল একটা গুহাবাসী উপজাতিগোষ্ঠী। সেক্ষেত্রে প্রফেসর বোস সেখানে থাকবার সময় তাদের সহায়তা পেয়েছিলেন সেটা ধরে নেওয়া যায়। ঘটনাটা ঘটবার পর তারা সে অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যায়। তাদের গুহা আবাসের মুখ আমরা হাজার চেষ্টাতেও খুঁজে পাইনি। কেন?

প্রফেসর বোস যখন চাঁদ থেকে পালান তখন সঙ্গে তাঁর ছেলে ছিল। বেঁচে থাকলে সে এই ক্রিসের বয়সি হত। তার কোনও হদিশ আমরা আর পাইনি। কেন?

আমাদের রসদের পার্থিব সরবরাহকারীদের প্রত্যেকের বিষয়ে যাবতীয় অনুসন্ধান আমরা করি। কা পোন চি-র বিষয়ে অনুসন্ধানে আমরা জেনেছি, সে এই গুহাবাসী সম্প্রদায়েরই একজন বিতাড়িত সদস্য।

এই চারটে প্রশ্নকে একত্র করে দ্যাখো জেমস। আর, তার সঙ্গে জালালের পাঠানো তথ্যটা মিলিয়ে দ্যাখো। কা পোন চি-র তথাকথিত সন্তানের ছবিটা দ্যাখো। সম্পূর্ণ বাঙালি চেহারা। এবার সব ক-টা তথ্যকে একত্র মিলিয়ে দ্যাখো জেমস! জালাল এ পরীক্ষাটা না করলে এ সম্ভাবনাটার দিকে আমাদের নজর কখনওই পড়ত না।’

‘অথচ জালালের তাকে ছেড়ে দেওয়াকে আপনি সমর্থন করছেন অ্যাডমিরাল। আমার পরামর্শ, ছেলেটাকে ফের ধরে এনে—’

মৃদু হাসলেন লালপিওতে, ‘কোনও লাভ হবে না জেমস। গ্রোভার এবং জালাল, আমার সেরা দুজন কাউন্সিলর ওকে জেরা করেছে। তাদের দক্ষতায় আমার বিশ্বাস আছে। সত্যকে আড়াল করতে গেলে সেটা তাদের চোখে ধরা পড়ত।’

‘সেক্ষেত্রে ওকে এখানে এনে—’

‘জেমস,’ ক্লান্ত গলায় বললেন অ্যাডমিরাল লালপিওতে, ‘তুমি একজন যোদ্ধার মতো কথা বলছ। কেন বুঝতে পারছ না, ছেলেটা নিজেকে কা পোন চি-র সন্তান হিসেবে বিশ্বাস করে। ওকে ধরে এনে আমাদের কোনও লাভ হবে না। অথচ, কিছু একটা রহস্য আছে এর মধ্যে। সেটা আমার সামনেই আছে। ছুঁতে পারছি না কেবল। প্রফেসর সত্যব্রত বোসের ছেলের সঠিক সময়ে এভাবে ফিরে আসা— তার কমিউনিকেটর থেকে তার অজান্তে আমাদের প্রোগ্রামকে ধরবার ম্যালওয়ার চালু হওয়া, এর পেছনে কোনও একটা পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে আছে।

‘ছেলেটা কোনও জটিল খেলার বোড়ে জেমস। এটুকু এতক্ষণে আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছ। খেলাটা কী আমরা তা জানি না। তবে এইটুকু জানি, দশটা বছর ওই অজানা পাহাড়ের আশ্রয়ে সত্যব্রত বোস চুপচাপ বসে থাকেননি। এই মানুষটাই সব জানতেন। একমাত্র এই মানুষটার হাতেই পৃথিবীর অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের প্রতিষেধক ছিল। বুকের মধ্যে এই একটামাত্র দুশ্চিন্তা লুকিয়ে নিয়ে এতগুলো বছর আমি চলেছি। আজ ভাগ্য হঠাৎ করেই একটা নতুন সুতো আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে।

‘কী করে রেখে গেছেন প্রফেসর বোস ওই পাহাড়ের বুকে তা জানবার জন্য এই ছেলেটা হয়তো আমাদের একমাত্র সূত্র। কিছু একটা পরিকল্পনা তাঁর নিঃসন্দেহে ছিল। এ ছেলেটা হয়তো নিজের অজ্ঞাতে সে পরিকল্পনার কোনও অংশ। একে খাঁচায় ভরে রাখলে শেয়ালের গর্তের সন্ধান পাওয়া যাবে না।

‘সমস্ত পার্থিব এজেন্টদের খবর দাও। আজ থেকে প্রত্যেকটা মুহূর্ত এর প্রতিটা গতিবিধিকে অনুসরণ করে চলবে তারা। এই মুহূর্ত থেকে তাদের আর সমস্ত অপারেশান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল। আমাদের হাতে সময় বড্ড কম জেমস। বড্ড কম। আজ ২৩ আগস্ট ২১২৫। সংঘাতমুহূর্ত ১৪ আগস্ট ২১২৬ মাঝরাত। একটা বছরও আর বাকি নেই।’

জেমস আরিয়ানা মাথা নাড়লেন একবার, ‘একেবারেই সামরিক প্রশাসকের মতো কথা বললে লালপিওতে। উপনিবেশের সাধারণ প্রশাসন আমাকে চালাতে হয়। খাদ্য ট্যাবলেট থেকে পাওয়ার স্টেশনের জ্বালানি, এই প্রত্যেকটা জিনিসের জন্য আমরা—’

‘তার আর বেশি দিন প্রয়োজন হবে না জেমস,’ মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন লালপিওতে, ‘সুইফট টাটল-এর গতিপথের খবর পার্থিব সরকার জানবার পর বুদ্ধের ডেটাবেস থেকে মঙ্গল উপনিবেশের সঙ্গে গোটা বিষয়টার সম্পর্কের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কেবল খানিকটা সময়ের ব্যাপার। সেটা আমার হিসেবের মধ্যে রয়েছে। মঙ্গল উপনিবেশ আমাদের হাতছাড়া হবে। নিজে ধ্বংস হবার আগে পর্যন্ত পার্থিব সরকারই তার সব দায়িত্ব নেবে। সুন্দর হিসাব, তাই না?’

* * *

‘সাড়ে আটাশ ডিগ্রি উত্তর— পঁচানব্বই ডিগ্রি পূর্ব—’ বেলুনটা ধীরে ধীরে নেমে আসছিল গুহাটার মুখের কাছে—

একটা সরু অন্ধকার পথ— তার একপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্ধকার পাতাল নদীটার জল ছলছল শব্দ তুলছিল। তার সামনে অন্ধকার মেঝের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে— ওটা কী? ওর পরিচয় সে জানে— এ-একাঘ্নি—

—ঘণ্টি বেজে উঠেছে— বিপদজ্ঞাপক ঘণ্টা— প্রক্সিমিটি সেনসর সাক্ষাৎ মৃত্যুর উপস্থিতি টের পেয়ে মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে হঠাৎ। গুহার নৈঃশব্দ খানখান হয়ে যাচ্ছিল সেই শব্দে— তাকে ঘিরে গমগম করে উঠছিল একটা গলা— জিষ্ণু—

‘ক্রিস—’

চমকে উঠে চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল সে। ধীরেন্দ্র বাজপেয়ীর কঠোর মুখটা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

‘আমরা অপেক্ষা করছি। গত এক বছরে তুমি তোমার কাজে—’

আস্তে আস্তে কমপিউটার কনসোলের মধ্যে তার ডেটা চিপটা গুঁজে দিল ক্রিস্টোফার। পর্দায় ফুটে উঠতে থাকা সৌরজগতের স্কেমাটিকটার দিকে তাকিয়ে ড. বাজপেয়ী কিছু বলে উঠতে গিয়েছিলেন। তাঁকে ইশারায় থামতে বলল সে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘যে গবেষণার জন্য আমার এখানে সুযোগ পাওয়া, গত এক বছরে আমি তার সামান্যই করে উঠতে পেরেছি স্যার। তবে সে নিয়ে বলবার আগে—’

টেবিলে অপেক্ষায় থাকা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল একটা। ড. বাজপেয়ীর হতবুদ্ধি মুখটা ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছিল। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে গিয়েও ফের বসে পড়তে হল তাঁকে। পর্দায় ফুটে উঠতে থাকা লাল আর নীল দুটো দাগের দিকে দেখিয়ে ক্রিস তখন বলে চলেছে, ‘এটা পৃথিবীর অস্তিত্বের প্রশ্ন স্যার। আমাকে ঠিক দশ মিনিট সময় দিন আপনারা—’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *