অন্তিম অভিযান – ৬

২১১৮ খৃষ্টাব্দ

হাতের কমিউনিকেটরটা মৃদু টিঁ টিঁ করে শব্দ করে উঠল একবার। হাত ঘুরিয়ে ঘড়িটার পর্দায় আঙুল ছোঁয়ালো জিষ্ণু।

‘সাড়ে আটটা বাজে।’ ঘড়ির পর্দায় প্রফেসর বোসের মুখে বিরক্তির স্পর্শ ছিল। জিষ্ণু একটু অস্বস্তিভরে মাথা নাড়ল, ‘শেষ হয়নি এখনও বাবা।’

‘শিডিউল অনুযায়ী আজ সন্ধে সাড়ে ছ-টার মধ্যে কনটেইনমেন্ট চেম্বার তৈরি থাকবার কথা জিষ্ণু। কা পোন যে কোনও সময় এসে পৌঁছোবে। আর কতক্ষণ সময় নেবে তুমি?’

ঘড়ির ডায়াল থেকে প্রফেসর বোসের মুখটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। জিষ্ণুর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল একটু। বাবা একটু বুড়ো হয়ে গেছে। একটু বেশি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে আজকাল।

উঠে দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেওয়ালের একটা জায়গা ছুঁল জিষ্ণু। একখণ্ড টাইটানিয়াম টাইল নিঃশব্দে সরে গিয়ে একটা ফোকর তৈরি হয়ে গেল সেখানে। পায়ের নীচে সটান নেমে গেছে দানবিক যানটার অতিকায় দেহ। অনেক নীচে, গুহার মেঝের কাছে পিঁপড়ের সারের মতন মানুষজনের যাওয়া আসা। স্তূপাকৃতি টাইটানিয়াম আকরিক জমা হয়ে আছে কিছু দূরের ফার্নেস রুমের কাছে। সাতটা বছর! ওর মধ্যে ধীরে ধীরে তিলতিল করে সে গড়ে উঠতে দেখেছে এই অতিকায় দানব ক্ষেপণাস্ত্রকে। যত্ন করে শিখেছে তার কলাকৌশল। আর তারপর শিখতে শিখতে কখন যে নিজেই তার বাবার হাত থেকে একে গড়ে তোলবার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে তা সে নিজেই ভালো করে খেয়াল করেনি।

ঘুরে এসে ঘরের মধ্যেকার অতিকায় ধাতব গহ্বরটার দিকে চোখ চালাল জিষ্ণু। দানবিক চৌম্বক কয়েলগুলো অমিত শক্তির সম্ভাবনা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওর একেবারে কেন্দ্রস্থলে রাখা রয়েছে একটা ছোট্ট পাত্র। এই অতিকায় যানের প্রাণভোমরা, তার বিস্ফোরক পে-লোড আজ সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে।

অ্যালার্ম সুইচটা একবার টিপে দিল সে। এখান থেকে দেখা না গেলেও হাজারবার দেখা দৃশ্যটা কেমন তা সে মনের চোখে দিব্যি দেখতে পায়। গোটা গুহাক্ষেত্রটার সমস্ত আলো নিভে যাচ্ছে আলার্মের শব্দ পাবার সঙ্গেসঙ্গে। কর্মব্যস্ত বিরাট এলাকাটা ডুবে যাচ্ছে নিবিড় অন্ধকারে। স্বয়ংক্রিয় সুইচেরা একে একে পাতালনদীর ওপর তিন জায়গায় বসানো তিনটে অতিকায় টারবাইন থেকে জন্মানো বিপুল তড়িৎশক্তিকে সংহত করছে তার পায়ের নীচে ঘুমিয়ে থাকা চৌম্বক কয়েলগুলোর মধ্যে।

কন্ট্রোল প্যানেলের লাল রঙের বড় সুইচটা এইবার চেপে ধরল জিষ্ণু। জেগে উঠেছে অতিকায় চৌম্বক কয়েলরা। মৃদু থরো-থরো কাঁপুনি জেগেছে গোটা যানটিতেই। কয়েলের মধ্যে ছুটে চলা সুতীব্র তড়িৎপ্রবাহ তার কেন্দ্রস্থলে রাখা ছোট্ট ফাঁকা অঞ্চলটাকে ঘিরে গড়ে তুলছে নিশ্ছিদ্র চৌম্বক আবরণ। সেই বিদ্যুতের ছোঁয়ায় আয়নিত বাতাস চৌম্বক কুণ্ডলীগুলোকে ঘিরে একটা অপার্থিব প্রভা তৈরি করছিল।

ক্যালিব্রেটরে রিডিং আসা শুরু করছিল একে একে। কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর যন্ত্রের মতো আঙুলগুলো ঘোরাফেরা করে চলেছিল জিষ্ণুর। তড়িৎপ্রবাহের মান ও অভিমুখে বিভিন্ন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটিয়ে চৌম্বকক্ষেত্রের আবরণটিকে নিখুঁত করে না তোলা অবধি ওর কেন্দ্রটি তার ভয়াল জ্বালানিকে সঞ্চিত রাখবার উপযুক্ত হয়ে উঠবে না।

কাজটা জটিল। সময়সাপেক্ষ। প্রায় এক কিলোগ্রাম প্রতিবস্তু সঞ্চিত থাকবে ওর ভেতরে আগামী আট বছর ধরে। চৌম্বক বন্দিশালার গঠনে এতটুকু ত্রুটি থেকে গেলে যে কোনও মুহূর্তে প্রলয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে।

সাতটা ইন্ডিকেটরের প্রত্যেকটা একে একে নির্ধারিত সবুজ চিহ্নগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেইদিকে সতর্ক চোখ রেখে হাতের ঘড়িটা সামনে তুলে এনে তাতে কয়েকটা সংকেতশব্দ উচ্চারণ করল জিষ্ণু। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার ডায়ালটা কালো হয়ে গিয়ে কা পোনের হাসি হাসি মুখটা ভেসে উঠল সেখানে।

‘খবর বলো।’

‘মিশন সাকসেসফুল। খরচ হয়েছে মন্দ নয়। আমি জীবনে—’

তার কথা মাঝপথে কেটে দিয়ে জিষ্ণু বলল, ‘পুরো পরিমাণটা জোগাড় হয়েছে? কতক্ষণ লাগবে তোমার এসে পৌঁছোতে?’

হঠাৎ ঘড়ির মধ্যে থেকে কা পোনের মুখটা সরে গিয়ে সেইখানে তার যানের ভেতরটা ভেসে উঠল। আড়াল থেকে তার গলা ভেসে আসছিল- ‘টেম্পোরারি কনটেইনমেন্ট চেম্বারটা আমার গোটা জাহাজটাকে জুড়ে নিয়েছে। মাত্র এক কিলোগ্রাম জ্বালানির জন্য—’

‘কতক্ষণ লাগবে তোমার পৌঁছোতে?’ জিষ্ণু অসহিষ্ণু গলায় ফের প্রশ্ন করল। পর্দায় কা পোনের মুখটা ভেসে উঠেছে আবার। তার দিকে চোখ টিপে সে বলল, ‘তুমি একেবারে তোমার বাবার মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছ দিন দিন। শোনো ছোকরা, কা পোন মিষ্টি হাসির চাকর। ভুরু কোঁচকানো না কমালে গোটা রাতটা লেগে যাবে আসতে আসতে। আর একটুখানি হাসো যদি, তাহলে আর দু-ঘণ্টা। ভারত মহাসাগরের ওপরে আছি।’

কা পোনের চুলদাড়িতে দু-একটা সাদার ঝলক দেখা যায় আজকাল। চেহারাটা অবশ্য বিশেষ কিছু বদলানি। মুখের কঠিন দাগগুলো সামান্য নরম। জিষ্ণু জানে, কেবলমাত্র তার দিকে তাকালেই কা পোনের মুখের সে পাথুরে দাগগুলো এইটুকু নরম হয়ে ওঠে।

হেসে ফেলল জিষ্ণু। তারপর বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা। প্লিজ আংকল। শিগগির চলে এসো। এইবার হল তো?’

‘হল মানে? আমার জিষ্ণু বেটা আমায় প্লিজ বলেছে। এইবার আমার বুড়ো ঘোড়া কেমন ছুট দেয় দেখো। ঘড়ি মিলিয়ে নাও। ঠিক দেড় ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব আমি।’

‘উঁহু, অত ব্যস্ত হতে হবে না। বাত্তিকলোয়ার কাস্টমস এলাকা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ঢুকবে এসে বুঝতে পারছি। ওদের কাস্টমস ভেসেলগুলো কিন্তু সুপারসনিক। সেই সেবারে গাইডেন্স সিস্টেম আনবার সময়— মনে আছে?’

‘ফুঃ। ওই একবারই ওরা কা পোনকে একটু অস্বস্তিতে ফেলেছিল। আর একবার লাগতে এসে দেখুক শুধু, আমার কার্তাং ভি এস দেখতেই পুরোনো মডেল। এমন ভেলকি দেখাব— যে ব্যাটারা—’

সংযোগ কেটে যাবার মুখে কা পোনের সেই বিখ্যাত ঠোঁটচাপা হাসিটার শব্দ জিষ্ণুর কানে এসে পৌঁছোল ঠিক। মাসছয়েক আগের কথা। মিসাইলের গাইডেন্স সিস্টেমের জন্য দরকারি ইলেকট্রনিকসের একটা চালান উত্তর কোরিয়ান চোরাচালানকারীদের কাছ থেকে জোগাড় করে নিয়ে এই এয়ারস্পেস দিয়ে আসবার পথেই শ্রীলংকার কাস্টমস ভেসেলের হাতে প্রায় ধরা পড়বার উপক্রম হয়েছিল তার। কোনওমতে রক্ষা পেয়েছিল সে যাত্রা। ফিরে আসবার পর এ নিয়ে প্রফেসর বোসের কাছে তাকে কম কথা সহ্য করতে হয়নি। সেই থেকে ওই এলাকার আইনরক্ষকদের ওপরে রেগে আছে কা পোন। ফের একটা কিছু হলে তার হাতে ওদের বিলক্ষণ দুঃখ যে আছে সেটা বোঝা যাচ্ছিল তার সেই হাসিটার থেকে।

জিষ্ণু অবশ্য বেশ নিশ্চিন্তেই তার কাজে ফিরে গেল। এক ফাঁদে দু-বার ধরা দেবে না কা পোন। এ প্রজেক্টের গুরুত্বও সে বোঝে। নিতান্ত নিরুপায় হলে তার ওপর নির্দেশ আছে গোটা যানটাকে উড়িয়ে দেবার। সে সম্ভাবনা যাতে না তৈরি হয় সেটা নিশ্চিত করবার মতো বুদ্ধি আছে এই শৃগালধূর্ত মানুষটির।

কয়েক মিনিট বাদে রিডিংগুলো আরও একবার দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে সামনের দেয়ালজোড়া পর্দাটাকে জাগিয়ে তুলল সে। প্রফেসর বোসের ত্রিমাত্রিক প্রতিবিম্বটা ভাসছিল সেখানে। সামনে অন্য একটা পর্দায় ক্রমাগত বয়ে চলা সংখ্যার সারির দিকে চোখ রেখে মগ্ন হয়ে রয়েছেন তিনি।

‘বাবা—’

‘কথা বোলো না। জাইরোটেলের নতুন রিডিং আসছে।’ চাপা গলায় জবাব দিলেন প্রফেসর। জিষ্ণু চুপ করে গেল। গত প্রায় বছরদুয়েক তার হাতে ওয়ার্কশপের সব দায়িত্ব দিয়ে প্রফেসর বোস নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছেন তাঁর জাইরোটেল অবজারভেটরি নিয়ে। সৌরজগতের পাঁচটি বিভিন্ন স্থানে ভেসে চলা বিভিন্ন দেশের আলাদা আলাদা মহাকাশযানের ট্রান্সপন্ডার সংকেতকে এই জাইরোটেল যন্ত্রটা দিয়ে গোপনে ব্যবহার করে ক্রমাগত সংগ্রহ করে চলেছেন এগিয়ে আসা কালান্তক ধূমকেতুটার গতিবিধি। বড় সূক্ষ্মভাবে তার পথ বদলে চলেছে সুইফট টাটল। সে তথ্যগুলো নিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রের অনবোর্ড যন্ত্রগণক গড়ে তুলছে শেষ আঘাতের যাত্রাপথের নিয়ন্ত্রণ অ্যালগরিদম।

‘পোর্ট খুলে দাও, মেইনফ্রেমে তথ্যগুলো পাঠাব এবারে।’

জিষ্ণু নিঃশব্দে একটা বোতাম টিপে ধরল। তারপর বলল, ‘ঘণ্টাদেড়েকের মধ্যে কা পোন পৌঁছোচ্ছে। কনটেইনমেন্ট চেম্বার তৈরি। তুমি কি আসবে?’

‘দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছচ্ছি আমি। তুমি তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে বেরোতে হবে।’

‘আ-আমায় বেরোতে হবে— মানে?’

‘কা পোন এসে পৌঁছোবার পর তোমাকে নিয়ে তাকে ফের উড়ে যেতে হবে। কমপক্ষে শ-পাঁচেক মাইল দূরে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেবে তোমরা। তোমাদের কাছ থেকে সংকেত পাবার পর আমি কনটেইনমেন্ট চেম্বারে বিস্ফোরক ভরা শুরু করব।’

‘কিন্তু বাবা—’

‘কোনও কিন্তু নয় জিষ্ণু। এ ক্ষেপণাস্ত্রের জনক আমি। এর ভেতরে প্রতিবস্তু বিস্ফোরক ঠিকভাবে সংরক্ষণের ব্যাপারে এ গ্রহে এক আমি ছাড়া আর কোনও অভিজ্ঞ কারিগর নেই। এ কাজ আমি বিশ্বাস করে এমনকী তোমার হাতেও ছেড়ে দেব না। তৈরি হয়ে নাও—’

‘কিন্তু বাবা—’

‘আহ্‌! কোনও কিন্তু নয় এখন। কনটেইনমেন্ট চেম্বার প্রতিবস্তু সংরক্ষণের প্রযুক্তি এখনও অনুন্নত। কাজটা করতে গিয়ে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায় সেক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে অন্তত একজনকে বেঁচে থাকতে হবে ফের একে গড়ে তোলবার জন্য। কিন্তু আর নয়। তুমি কাজ করো। আমি কা পোনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠিয়ে দিয়ে তোমার কাছে আসছি…

***

‘কার্তাং-এ স্বাগত। আমি টাইকো, কার্তাং-এর নিয়ন্ত্রক গণক। কোড ভি এস ১৯৭৪৫৬। সঙ্গে নতুন লোক দেখছি কা পোন? কে হে?’

পর্দার বুকে ভেসে থাকা কুকুরটা হাসি হাসি মুখে কথা ক-টা বলে দু-বার মৃদু ভুক ভুক করে ডাক দিয়ে উঠল। বেশ মোটা কিন্তু সুরেলা গলা। সেদিকে চোখ রেখে জিষ্ণুর মুখে হাসি ফুটল একটু।

কা পোন সতর্ক চোখে তার মুখটার দিকে দেখছিল। ঘণ্টাকয়েক আগে গুহাগ্রামে যান নিয়ে এসে পৌঁছোবার পর থেকে জিষ্ণুর মুখে হাসি দেখেনি সে একবারও। যন্ত্রচালিতের মতন যান থেকে ওয়ার্কশপে জ্বালানির বাক্স সরিয়ে নেবার কাজ সেরেছে তার দলের সঙ্গে। তারপর প্রফেসর বোসকে একলা রেখে এসে তার সঙ্গে যানে উঠেছে।

‘উফ্‌ আংকল, অনেক রকম কমপিউটার ইনটারফেস দেখেছি, কিন্তু অ্যানিমেটেড কুকুর—’

কা পোনের চোখদুটো হাসিতে কুঁচকে উঠল, ‘অ্যানিমেটেড বটে আবার আসল কুকুরও বটে। ওর নাম টাইকো। আমার ছোটবেলার বন্ধু। একটা শিকার অভিযানে গিয়ে মারা গেল। বেশ কিছু ভিডিয়ো ছবি ছিল ওর। সেগুলো কাজে লাগিয়ে ইনটারফেসটা বানিয়ে নিয়েছি। টাইকো এখন আমার ফ্রেন্ড ফিলজফার গাইড যা বলবে। যান চালায়, দরকারে তথ্য জোগায়, অবস্থা বিশ্লেষণ করে কী করা উচিত সে নিয়ে পরামর্শও দেয়। টাইকো খুব ভালো লোক, তাই না রে টাইকো?’

টাইকো গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল একবার। তারপর ফের জিষ্ণুর দিকে ঘুরে দেখে নিয়ে বলল, ‘তোমার বন্ধুটি তো বেজায় অভদ্র হে কা পোন। নিজের নামটাও বলল না এখনও!’

বিস্মিত চোখে ছবিটার দিকে দেখছিল জিষ্ণু। গম্ভীর হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অপেক্ষা করছে টাইকো। চাঁদে থাকতে যে শিক্ষাগণকদের কাছে সে পড়াশোনা করত তাদের থেকে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে এখন যন্ত্রগণকের প্রযুক্তি। ভিএস শ্রেণীর এই যন্ত্রগণকগুলোতে কৃত্রিম চেতনা রয়েছে। ব্যক্তিত্বও আছে এদের। সে খবর তার অজানা নয়। কিন্তু তা যে এতটা উন্নত সে কথা জিষ্ণু ভাবতে পারেনি।

তার মনের কথাটা বুঝে ফেলেছিল কা পোন। মুচকি হেসে বলল, ‘লেটেস্ট প্রোগ্রাম আপগ্রেড। সবে কয়েক সপ্তাহ হল সেট আপ করেছি। এখনও এটা বাজারে আসেনি। তবে খরচ করতে পারলে কোনও কিছুই নাগালের বাইরে থাকে না সে তো জানোই।’

‘আমার নাম জিষ্ণু। জিষ্ণু বসু।’ পর্দায় ভাসন্ত ছবিটার দিকে তাকিয়ে জিষ্ণু বলে উঠল।

‘আলাপ করে ভালো লাগল,’ টাইকো গরগর করে উঠল। এখনও তার রাগ পড়েনি পুরোপুরি।

‘থ্যাংক ইউ টাইকো,’ কা পোন একবার হাত নাড়াল তার দিকে, ‘তুমি এবারে যেতে পার। যানের নিয়ন্ত্রণ নাও। আমরা কোথায় যাব তা তো তোমায় আগেই জানিয়েছি।’

‘জানালা দিয়ে একবার দেখুন,’ বলে পর্দা থেকে মিলিয়ে গেল কুকুরটা।

বাইরে তীব্র সার্চলাইটের আলোয় শ’খানেক ফুট নীচে সমুদ্রের জলে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। তীব্র গতিতে ক্রমশই পেছনে ছুটছে তা। সেদিকে দেখতে দেখতে কা পোন মাথা নাড়ল একবার, ‘মাঝে মাঝে এই নতুন কন্ট্রোল প্রোগ্রামটা আমাকেও চমকে দেয় বুঝলে? কোন ফাঁকে জমি ছেড়ে উঠে এতটা পথ পার হয়ে এসেছে টেরও পাইনি।’

‘তার মানে আপনার নির্দেশ ছাড়াই টাইকো—’

‘আমাদের বিস্ফোরক নামিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবার যে নির্দেশটা পাঠিয়েছিলেন প্রফেসর বোস, সেটা টাইকোই রিসিভ করেছিল জিষ্ণু। যান আর তার আরোহীর জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত থাকলে এরা নির্দেশের অপেক্ষা করে না। নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়।’

হঠাৎ করেই নির্জন সেই গুহার ছবিটা ফের ঝাঁপিয়ে এল জিষ্ণুর চোখের সামনে। সেখানে অতিকায় একটা ক্ষেপণাস্ত্রের পেটের ভেতরে তীব্র শক্তিপ্রবাহে এতক্ষণে ঝলমল করে উঠেছে চৌম্বক কয়েলের বন্দিশালা। একলা একজন বৃদ্ধ যন্ত্রের সামনে বসে তার মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে চলেছেন প্রাণঘাতী প্রতিবস্তুর পিণ্ড দিয়ে। এতটুকু ভুল, সামান্য একটা হিসেবের গরমিল হলেই—

‘কাজ কতদূর এগোল একবার দেখে নিতে চাই কা পোন—’ বলতে বলতে হঠাৎ কন্ট্রোল প্যানেলের ডানদিকের যোগাযোগ সার্কিটের বোতামগুলোর ওপরে হাত রাখতে গেল জিষ্ণু। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র একটা যন্ত্রণার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তার গোটা শরীরে। পর্দায় টাইকোর মুখটা ভেসে উঠেছে ফের। রাগে গরগর করছে সে। দাঁতগুলো বের হয়ে এসেছে আক্রমণের পূর্বমুহূর্তের ঢং-এ। জানে ত্রিমাত্রিক ছবি একটা, তবু বুকের ভেতরটা ভয়ে কেঁপে উঠল জিষ্ণুর একবার।

‘যান নিয়ন্ত্রণে অননুমোদিত হস্তক্ষেপ। কন্ট্রোল প্যানেলের ম্যানুয়াল নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা হয়েছে। শত্রুকে সাবধানতামূলক আঘাত দেওয়া হল—’ টাইকো গর্জন করছিল।

‘হাতটা সরিয়ে নাও জিষ্ণু, শিগগির—’ বলতে বলতে একটা আলতো ঠেলা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে টাইকোর দিকে ফিরল কা পোন, ‘অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আছে টাইকো। কন্ট্রোল প্যানেলের নিয়ন্ত্রণ আমাকে ফিরিয়ে দাও।’

‘কিন্তু কা পোন, এই আগন্তুক যানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় হাত দিতে চলেছিল। এই অবস্থায়—’

‘আঃ! কথা শোন টাইকো। না হলে—’ কা পোন এইবার উঠে দাঁড়াল পর্দার সামনে, ‘আমি, কমান্ডার কা পোন, তোমাকে আদেশ করছি, তুমি যানের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দাও।’

জবাবে টাইকো ফের কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে সে সুযোগ না দিয়ে কা পোন ফের বলে উঠল, ‘ওভাররাইডিং কমান্ড কোড, ক-৩১৪৭।’

টাইকোর মুখটা কালো হয়ে গেল যেন একটু। বিড়বিড় করে বলল, ‘চরম আদেশ। জো হুকুম প্রভু।’

কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরে আঙুল চালাতে চালাতে কা পোন আপনমনেই বলল এবার, ‘আমারই ভুল। শুরুতেই তোমার অনুমোদন দিয়ে দেওয়া দরকারি ছিল। এখন এসো।’

কন্ট্রোল প্যানেলের গায়ে বসে থাকা ছোট একটা লেন্সের গায়ে জিষ্ণুর বাঁ-হাতের মণিবন্ধটা চেপে ধরল কা পোন। পর্দায় দ্রুত কিছু তথ্য ভেসে উঠছিল। পরিচয়-চিপ থেকে তার যাবতীয় খবর জেনে নিচ্ছে কার্তাং-এর যন্ত্রগণক।

তথ্য বিনিময় শেষ হতে প্যানেলের বোতামগুলোয় আঙুল চালিয়ে দ্রুত কিছু নির্দেশ দিল কা পোন। তারপর হাসিমুখে জিষ্ণুর দিকে ফিরে বলল, ‘একবার টাইকোকে ডাকবে নাকি?’

জিষ্ণু একটু ইতস্তত করছিল, ‘মানে-আমি-টাইকোকে—’

‘ডেকে দেখোই না?’

একটু ভয়ে ভয়েই জিষ্ণু ডাক দিল, ‘টাইকো?’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সামনের পর্দায় একটা লাফ দিয়ে এসে দাঁড়াল টাইকো। তার হাবভাব বদলে গিয়েছে একেবারে। জিষ্ণুর সামনে পর্দার গায়েই চার হাত-পা ছড়িয়ে বসে বলল, ‘অভিবাদন ফার্স্ট মেট জিষ্ণু। কার্তাং-এ ফের একবার আপনাকে স্বাগত জানাই। আদেশ পালনের জন্য বান্দা হাজির—’

‘ধন্যবাদ টাইকো। আশা করি এরপর থেকে তুমি জিষ্ণুর সমস্ত আদেশ আমার আদেশ হিসেবেই পালন করে চলবে এবং আমার মতন, যানে থাকাকালীন তার নিরাপত্তার দায়িত্বও নেবে।’ কা পোনের গলায় কর্তৃত্বের সুর ছিল।

‘নিশ্চয় ক্যাপ্টেন। আনন্দের সঙ্গে। আদেশ করুন জিষ্ণু।’

‘আমার বাবার ওয়ার্কশপের সঙ্গে যোগাযোগ করো। আমি একবার—’

এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল টাইকো। তারপর বলল, ‘তিনি ভালো আছেন। তাঁর কাজ সুন্দরভাবে এগিয়ে চলেছে। রাত্রি শেষ হবার কিছু আগেই তা শেষ হবে বলে তাঁর গণকের অনুমান।’

‘আমি একবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

টাইকো একটু গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, ‘আপনার আদেশ শিরোধার্য জিষ্ণু। কিন্তু ভিডিয়ো সংযোগস্থাপনের আগে একটি নিবেদন ছিল।’

‘বলো।’

‘আমার স্মৃতিভাণ্ডারে প্রফেসর বোসের এই মুহূর্তের কাজ সম্পর্কে যা তথ্য এসেছে তা সঠিক হলে এখন তিনি একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ করছেন। তাঁর সঙ্গে এই সময়ে যোগাযোগ করতে গেলে মনঃসংযোগ নষ্ট হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা বেশি। তাঁর নিরাপত্তা বিষয়ে আপনার উদ্বেগ লক্ষ করে আমি তাঁর গণকের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে যোগাযোগ রেখে চলেছি ও আমার গণনাশক্তিকে তার কাজে ব্যবহার করবার অনুমতি দিয়েছি। এতে কাজটি আরও দ্রুতগতিতে এগোতে পারবে। পরিস্থিতির ওপরে আমরা দুজন নজর রেখে চলেছি।’

‘থামো। এটা বিপজ্জনক হতে পারে। যোগাযোগ চ্যানেলের ওপরে কেউ নজর রাখলে তারা একাঘ্নির বিষয়ে—’

‘নিশ্চিন্ত থাকুন মালিক। ভি এস ১৯৭৪৫৬-এর সাংকেতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এই মুহূর্তে যে কোনও পরিচিত প্রযুক্তির চোখে সম্পূর্ণ অদৃশ্য। আমার নিবেদন, এখন প্রফেসর বোসের সঙ্গে কোনও ভিডিয়ো সংযোগ না করাটা উচিত হবে।’

‘উফ্‌ফ্‌। ঠিক আছে। নিবেদন গৃহীত হল। তুমি এখন যেতে পার।’

জিষ্ণুর মুখে হাসি ফুটে উঠছিল। টাইকো পর্দা থেকে মিলিয়ে গেছে। মনের ভেতর একটা আশ্চর্য ভরসা গড়ে উঠছিল তার। আর পাঁচটা পোষা কুকুরের মতন টাইকোও তার পরিচিতদের মনে ভরসা জাগিয়ে তুলতে পারে। তাছাড়া তার কথাগুলোতে যুক্তি রয়েছে।

‘মুখ নিচু করে কী এত ভাবছ বলো দেখি নতুন ফার্স্ট মেট? তার চেয়ে জানালা দিয়ে দ্যাখো একবার বাইরে—’

কা পোন কখন যেন তার আসন ছেড়ে উঠে গেছে। যানের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছিল সে। জিষ্ণু উঠে জানালার ধারে গেল।

‘পৃথিবীর যে সামান্য কিছু জায়গায় শহর এখনও থাবা বসায়নি এটা তারই একটা। দেখে নাও। এর পরে হয়তো আর কখনও এ চেহারা দেখতে পাবে না ব্যারেন আইল্যান্ডের।’

শেষরাত্রের চাঁদের আলোয় অতিকায় ওলটানো বাটির মতো দ্বীপটা তাদের পায়ের তলায় ঘুমিয়েছিল। তার শরীরের জমাটবাঁধা পাথুরে আগ্নেয়ভস্মের মধ্যে মিশে থাকা আকরিক কণাদের গায়ে ঝিলিক দিচ্ছিল চাঁদের আলো। যানটা নিঃশব্দে ভাসছিল মাত্র ত্রিশ ফুট উঁচুতে।

‘বেশি দিন আর এ দশা থাকবে না হে। লাজলোর নজর পড়েছে দ্বীপটার ওপরে। শক্তি উৎপাদন শিল্পে মোটা লগ্নী করতে চলেছে লোকটা। এ দ্বীপে আগ্নেয়গিরির কল্যানে অঢেল ভূ-তাপশক্তি মিলবে। লাজলো একে ছেড়ে দেবে না। আজ না হোক কাল—’

***

জানালার পাশে দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসেছিল ওরা দুজন। কতক্ষণ যে কেটে গেছে তাদের এইভাবে বসে তারা নিজেরাও তা জানে না। দেখতে দেখতে চাঁদ মাঝ আকাশ থেকে পশ্চিমে ঢলে পড়ল। তাদের পায়ের নীচে জোয়ারের জল বেড়ে উঠে ঢেকে দিয়েছে দ্বীপের খানিকটা এলাকা। জল আর বালিতে পড়ন্ত চাঁদের চিকিমিকি—

পুবের আকাশে যখন সবে হালকা লালের ছোঁয়া লেগেছে তখন ভরাট একটা নিচু গলার শব্দে তন্দ্রা কেটে গেল জিষ্ণুর। কা পোনও চোখ খুলে ফেলেছে গলার শব্দটা শুনে।

পর্দায় বাবার ছবিটা ভাসছিল। হাসছেন প্রফেসর বোস। বহুদিন পরে সেই পুরোনো ঝকঝকে হাসিটা ফের ছেয়ে আছে তাঁর বয়োজীর্ণ মুখে। তাদের ঘুরে তাকাতে দেখে চশমাটা খুলে একবার মুছে নিয়ে ফের চোখে পরলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘কাজ শেষ। কোনও ত্রুটি হয়নি। এবং কা পোনকে আরও একবার ধন্যবাদ। তোমার জাহাজের গণকের সাহায্য না পেলে এত জটিল একটা কাজ এত নিখুঁতভাবে শেষ করা কঠিন হত।’

জিষ্ণু হাসিমুখে বলল, ‘থ্যাংক ইউ টাইকো।’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পর্দায় সত্যব্রত বোসের ছবিটার পাশে টাইকোর ছবিটা ফুটে উঠল। ঘনঘন লেজ নড়ছে তার।

‘এবার তোমরা ফিরে আসতে পার,’ সত্যব্রত ফের কথা বলে উঠলেন, ‘এবারে বিশ্রামের সময়। আজ এই আনন্দের দিনটা আমি বিশেষভাবে উদযাপন করতে চাই। আমরা আজ বনভোজনে যাব জিষ্ণু। কতকাল পরে, ফের একবার খোলা আকাশের তলায়— কা পোন তুমিও যাবে আজ আমাদের সঙ্গে।’

মৃদু হেসে মাথা নাড়ল কা পোন, ‘ধন্যবাদ প্রফেসর বোস। কিন্ত সেটা সম্ভব হবে না। পলিনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে একটা ভালো দাঁও মারবার সুযোগ এসেছে। এবারে আমি দিনপনেরোর জন্য নিজের ব্যাবসাপাতি দেখে তারপর ফিরে আসব। জিষ্ণুকে পৌঁছে দিয়ে আমি আর অপেক্ষা করব না ওখানে।’

তার কথা চলতে চলতেই দ্বীপের আকাশ থেকে উড়ান দিয়েছে কার্তান। মেঘ ছাড়িয়ে অনেকটা উচ্চতায় পৌঁছে শব্দের চেয়ে বহুগুণ বেশি গতিতে দূরত্বকে গিলে খাচ্ছিল সে। পায়ের নীচে বাংলার অদৃশ্য সমতলভূমি ছাড়িয়ে গিয়ে এগিয়ে আসছিল পাহাড়—

***

কর্মীদের শেষ দলটাও অনেকক্ষণ হল চলে গেছে। গুহাটা আবার সেই প্রথমদিকের দিনগুলোর মতোই নিঃশব্দ। সে সময়টা পাতালগুহার এক কোণে আছড়ে পড়তে থাকা জলপ্রপাতটার ঝরঝর শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজই আসত না জিষ্ণুদের কানে। তারপর, আস্তে আস্তে একাঘ্নির ওয়ার্কশপ গড়ে ওঠবার পর থেকে আলোয়, শব্দে গুহাটা একেবারে জমজমাট থেকেছে গত কয়েকটা বছর।

আজ ফের নতুন করে নৈঃশব্দ এসে ঘিরে ধরেছে তাকে। ছাদ থেকে একটা তীব্র আলোর ধারা দানবিক ক্ষেপণাস্ত্রটাকে আলোকিত করে রেখেছে। বাকি সমস্ত আলো এখন নেভানো। গ্রামবাসীদের তা-ই ইচ্ছা ছিল।

কথাটা খেয়াল হতে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠল প্রফেসর বোসের মুখে। তাঁর পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ গ্রামপ্রধানের দেখা গেল সেটা নজর এড়ায়নি। তীক্ষ্ণধী মানুষটা যেন খোলা খাতার মতোই পড়ে নিতে পারেন তাঁর পরিচিত মানুষদের চিন্তাকে। নিচু গলায় বললেন, ‘সরল মানুষের বিশ্বাসকে নিয়ে হেসো না সত্যব্রত। ওর মধ্যে সত্যি লুকিয়ে থাকে।’

প্রফেসর বোসের চোখের সামনে খানিকক্ষণ আগের দৃশ্যগুলো ভাসছিল। অস্ত্রনির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ প্রযুক্তিটাই এখনও অপরীক্ষিত। কাজেই ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরক কেন্দ্রীয় অংশটা স্থাপনের পরে তার কাছাকাছি এলাকায় এক নিজেকে ছাড়া আর কাউকে রাখতে সাহস পান না প্রফেসর। এমনকী জিষ্ণুকেও চলে যেতে হবে। তবে সে কথা এখন তাকে বলা যাবে না। বেঁকে বসবে সে। এ নিয়ে কা পোনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে প্রফেসরের। প্রথমবার জিষ্ণুকে সরিয়ে দেবার কথাটা শুনে একটু অবাকই হয়ে তাঁর দিকে দেখেছিল কা পোন। তারপর মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘তাহলে আপনারও হৃদয় বলে কোনও বস্তু আছে প্রফেসর!’

প্রফেসর বোস উত্তরে মাথা নেড়েছিলেন, ‘জিষ্ণুকে আমি ভালোবাসি কা পোন। সে আমার একমাত্র ছেলে। কিন্তু তাকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিতে চাইছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে। সে এই প্রজেক্টের ফল ব্যাক মেকানিজম। আমি ছাড়া একমাত্র সে জানে কেমন করে একাঘ্নিকে গড়ে তুলতে হয়, কেমন করে তাকে সঠিক সময়ে চালু করতে হয়। সে জটিল বিজ্ঞান আমি তাকে হাতে ধরে শিখিয়েছি। যদি এখানে অপেক্ষা করবার সময়ে আমার কিছু হয়ে যায় তাহলে তাকে তুমি এইখানে ফিরিয়ে আনবে। এ কাজ সম্পূর্ণ করবার দায়িত্ব তাকে নিতে হবে তখন। আর তাই তাকে আমি আমার সঙ্গে রাখতে চাই না। এ মিশনের দুটো প্রাণ। সে দুটো আলাদা আলাদা জায়গায় রাখাই সঠিক কৌশল হবে।’

‘কিন্তু, সে কি রাজি হবে আপনাকে ছেড়ে যেতে? জিষ্ণু আপনাকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে। ঈশ্বরের চেয়েও বেশি ভক্তি করে।’

‘রাজি তাকে হতে হবে কা পোন,’ প্রফেসরের চোখের কোনে দু-ফোঁটা জল চিকমিক করে উঠেছিল বুঝি। তারপর তা মুছে ফেলে দৃঢ় গলায় বলেছিলেন, ‘তোমাকে সে অনেকটাই মানে, ভালোও বাসে। তাকে বোঝাবার দায়িত্ব তোমার। আগামী আট বছর তাকে সাবধানে রাখার, জীবনের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলবার দায়িত্বও তোমাকে নিতে হবে। এ গুহার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়ে আমি এর ভেতরে ওই মিসাইলকে নিয়ে একেবারে হারিয়ে যেতে চাই এই সময়টা। শেষ আঘাতবিন্দু আসবার আগে যেন কোনওমতেই আর আমার বা একাঘ্নির কোনও সন্ধান না পায় ওরা। সম্পূর্ণ পৃথিবীর ভাগ্য নির্ভর করছে এর ওপর। তার কাছে আমাদের ছোট ছোট ভালোবাসা, চাওয়াপাওয়ার দাম কতটুকু কা পোন?’

এর কোনও উত্তর কা পোনের কাছে ছিল না। উত্তর দেবার চেষ্টাও সে করেনি। শুধু মনে মনে বলেছিল, ‘তুমি মানুষ নও প্রফেসর। হয় তুমি পাথর, নয় ঈশ্বর।’

খানিক বাদে প্রফেসর ফের মুখ খুলেছিলেন, ‘কিন্তু তাকে মানুষ করে তুলবে তোমার পথে নয়, তাকে—’

কা পোনের মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল এক মুহূর্তের জন্য। কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘আমার পেশা নিয়ে এমন সরাসরি কিছু না বললেও হত। আপনার ছেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা পাবে। দশজনের মধ্যে একজন হয়ে সে ফিরে আসবে আপনার কাছে আপনি বিজয়ী হবার পর। দেখে নেবেন প্রফেসর। কা পোন চি-র শপথ রইল আপনার কাছে।’

গ্রামবাসীদের সরিয়ে দেবার কাজটা অবশ্য অনেক সরল ছিল। সব কথা বুঝিয়ে বলতে তাঁর ইচ্ছাকে অমান্য করেনি গ্রামের মানুষজন। গুহামণ্ডলের গোলকধাঁধার মধ্যে পথ খুঁজে খুঁজে ভেতর দিয়ে এগিয়ে পাহাড়ের একেবারে শেকড়ের কাছে তাদের নতুন আস্তানা তারা গত কিছুকাল ধরেই গড়ে তুলেছে ধীরে ধীরে। আজ এ গ্রাম ছেড়ে সেই নতুন গ্রামে চলে যাবার আগে একাঘ্নিকে পুজো করেছে তারা। গুহার সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়ে শুধু একটি আলোকে একাঘ্নির ওপরে জ্বালিয়ে রেখে সমবেত গলায় দুর্বোধ্য কিন্তু সুরেলা উচ্চারণের মন্ত্রপাঠ করেছে প্রযুক্তির দেবতা জাওগির উদ্দেশে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, জাওগিই পৃথিবীকে রক্ষা করবার জন্য প্রফেসরকে পাঠিয়েছিলেন তাদের মধ্যে। এ অস্ত্রও তাঁরই দান।

‘এবার আমাকে উঠতে হবে সত্যব্রত।’ বলতে বলতে বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন এইবার।

‘হ্যাঁ জোরাম। আপনি এগিয়ে গেলে আমাকে পরের কাজগুলো শেষ করতে হবে। আর দেরি করা ঠিক নয়।’

‘জাওগি তোমার সহায় হোন।’

তাঁর ন্যুব্জ শরীরটা একটা লাঠিতে ভর করে, বয়ে যাওয়া জলস্রোতটাকে ধরে ধরে এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধ। এ পাহাড়ের কেন্দ্রীয় শিকড়কে ঘিরে এক গভীর পাতাল হ্রদে গিয়ে মিশেছে এই নদী। সে পথ একা একা খুঁজে নিতে তাঁর কোনও অসুবিধে হবে না। গুহার দূরতম কোণে যেখানে নদীটা একটা সুড়ঙ্গ বেয়ে বয়ে চলেছে নীচের দিকে, সেইখানে পৌঁছে এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ। তারপর একটুকরো অন্ধকারের মতোই এগিয়ে গিয়ে মিশে গেলেন তার গাঢ় অন্ধকার অন্দরমহলে।

***

‘বাবা, খেয়ে নেবে? কাল থেকে কিছু মুখে তোলোনি তো!’

জিষ্ণু তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে ডাকছিল। তার হাতে একটা পুঁটুলি থেকে সদ্য তুলে আনা নানান রঙের একরাশ ছত্রাক উঁকি মারছিল।

সেইদিকে তাকিয়ে একটু হাসি ফুটে উঠল প্রফেসরের মুখে। এখন শুধু ছেলেটাকে নিয়ে দিনপনেরো একটু আনন্দ করা, একটু তার সঙ্গে থাকা, আর একটু একটু করে তাকে তৈরি করে তোলা আসন্ন লম্বা বিচ্ছেদটার জন্য।

জিষ্ণুর হাত থেকে পুঁটুলিটা নিয়ে তার থেকে একটা লাল রঙের রসালো বলের মতো দেখতে ছত্রাকে ছোট একটা কামড় বসিয়ে চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘খাব, তবে এ দিয়ে পেট ভরাব না আজ আর। আজ ফ্রেশ মাংস খাব। এখানকার জঙ্গলে বুনো এলাচ আর লেমন গ্রাস হয় একজাতের। সেই দিয়ে পাখির মাংস রোস্ট করলে যা খেতে হয় বুঝলি?’

‘পাখি— মানে—’

‘সে কী রে? এর মধ্যেই ভুলে গেলি? আজ আমাদের বনভোজনের দিন যে!’

সামনে পড়ে থাকা ছোট পর্দাটার গায়ে আঙুল ছুঁইয়ে তাকে জাগিয়ে তুলল জিষ্ণু। তার স্পিকার থেকে রিমঝিম গুরুগুরু শব্দ আসছিল। সেখানে ঘন ইস্পাতনীল মেঘের ছায়া পড়েছে।

‘বাইরে কিন্তু বৃষ্টি নেমেছে বাবা। এই দ্যাখো।’

‘শ্রাবণ মাস। বৃষ্টি তো নামবেই। তাতে কী? বৃষ্টির একটা বড় সুবিধে কী জানিস? পাখিগুলো সব যার যার আস্তানায় ঢুকে বসে থাকে। চোখকান খুলে বাসাগুলো ধরতে পারলেই সহজ শিকার।’

‘বুঝলাম। কিন্তু মারবে কী দিয়ে? পাথর ছুড়ে? বাইরে তো লেজার পিস্তল চালানো চলবে না। ভুলে গেছ?’

‘উঁহু ভুলিনি। আকাশে লালপিওতে ইয়াব্বড় চোখ মেলে চেয়ে আছে— সে আমি ভুলব কেমন করে? লেজার ব্লাস্ট হলেই চেপে ধরবে এসে।’

আশ্চর্য তরল হালকা গলায় কথা বলছিলেন প্রফেসর বোস। ভয়ানক আতঙ্কের বিষয়টাকে কত সহজভাবে বলে চলেছেন। জিষ্ণু অবাক হয়ে দেখছিল তাঁর দিকে। এতগুলো বছরের মধ্যে এই প্রথমবার নিজের বাবাকে যেন চিনতে পারছিল না সে। যেন নতুন করে নিজের কিশোর বয়সটা ফিরে পেয়েছেন তিনি কোন জাদুমন্ত্রে।

কথা বলতে বলতেই প্রফেসর তাঁদের ঘরটার মধ্যে ঢুকে গিয়ে একজোড়া বড়সড়ো গুলতি বের করে নিয়ে এসেছেন। টাইটানিয়ামের তৈরি হাতলগুলোর ধাতু ইস্পাতের চেয়ে শক্ত অথচ নমনীয়। তাতে লম্বা চামড়ার ফিতে লাগানো। একটা থলের থেকে ধাতুর তৈরি ছোট একটা গুলি বের করে এনে তার একটায় বসাতে বসাতে বলছিলেন, ‘বড় মিসাইলের সঙ্গে সঙ্গে এই ছোট মিসাইল লঞ্চারদুটোও আমি বানিয়ে রেখেছি বহুকাল আগে থেকে, আজকের দিনটার জন্য, বুঝলি? এবারে দ্যাখ শুধু এর শক্তিটা। দূরে পাথরের গায়ে ওই হলদে রঙের প্যারাসোল মাশরুমের থোকাটা ঝুলছে দেখেছিস? এইবারে—’

বলতে বলতেই তাঁর গুলতি থেকে অব্যর্থ লক্ষ্যে ধেয়ে গিয়েছে একটা গুলি। ঠং করে শব্দ উঠল একটা। মাশরুমের থোকাটা থরথর করে কেঁপে উঠে ছিটকে পড়ল নীচের দিকে। জিষ্ণু উঠে গিয়ে সেটাকে কুড়িয়ে আনতে আনতে বিস্মিত চোখে দেখছিল সেটার দিকে। থোকাটায় কোনও চোট আসেনি। শুধু নমনীয় টাইটানিয়াম হ্যান্ডেলের স্থিতিস্থাপক ধাক্কায় তৈরি তীব্র শক্তির আঘাতে তার গোড়ার বেলেপাথরের একটা অংশ ভেঙে মাশরুমের থোকাটাকে সঙ্গে নিয়ে নেমে এসেছে নীচে।

‘কীরে, কী মনে হয়? পাখি মরবে?’

‘হুম। শুধু পাখি নয়, চাইলে মানুষও মারা যাবে ওতে। চালায় কেমন করে?’

‘আয় দেখিয়ে দি। এই যে এইখানটা চেপে ধর—তারপর ফিতেয় গুলিটা বসিয়ে— এই যে এইভাবে টেনে ধর— এক চোখ বন্ধ করে নিশানা কর— হ্যান্ডেলটা যেন টানের চোটে বেঁকে যায়। কী মারছিস তার ওপরে নির্ভর করবে কতটা বাঁকাবি— মানে কতটা শক্তি দিবি তুই তোর মিসাইলকে— হ্যাঁ— এইবার মার—

‘টং-টং-টং’— শব্দ ওঠে বারংবার গুহার চারদিক ঘিরে। প্রৌঢ় মানুষটা আজ শিশুর মতো উচ্ছল হয়ে উঠেছেন। শক্তি ও অভিজ্ঞতার মধ্যে বিচিত্র এক শেখা ও শেখাবার প্রতিযোগিতা চলতে থাকে সেই নির্জন গুহার ভেতরে। সে খেলার সাক্ষী থাকে শুধু এক নির্বাক দানবিক মিসাইল।

***

‘বাবা, ট্র্যাগোপান।’

দূরবিনে চোখ লাগিয়ে জিষ্ণু আস্তে আস্তে ডাকছিল। প্রফেসর নীচ থেকে জিষ্ণুর দিকে চোখ তুলে তাকালেন একবার। গুহামুখ ছেড়ে শ-দুয়েক মিটার সরে এসেছেন ওঁরা এখন। তাঁবুর কাছেই পায়ের বেশ খানিকটা নীচে বর্ষায় ফুলে ওঠা নদীটার লালচে ঘোলাটে জল খলখল করে ছুটে চলেছে। সর্বক্ষণের সঙ্গী যন্ত্রপাতির বাক্সটা থেকে একটা লেজার পিস্তল কোমরে গুঁজে নিয়ে, হাতের মৃদু চাপড়ে জেটবেলোটাকে একবার পরখ করে নিয়ে প্রফেসর বের হয়ে এলেন। এমনিতে একে এখানে কাজে লাগানো যাবে না। কিন্তু এ পাহাড়ে নিরস্ত্র হয়ে তিনি খোলা আকাশের নীচে কোথাও যেতে রাজি নন।

‘সাবধানে উঠো। পাহাড়ের গায়ের মাটি নরম হয়ে আছে।’

‘তুই সাবধান। ওয়েট কর আমি আসছি।’

প্রায় সত্তর ডিগ্রি নতিতে পাহাড়ের মাটি জড়ানো পেছল ঢালটা ওপরের দিকে উঠে গেছে। সাবধানে বুকে হেঁটে একটু একটু করে জিষ্ণুর কাছে উঠে আসতে আসতে পেছনের পকেট থেকে গুলতিটা হাতে বের করে নিলেন প্রফেসর। প্রাথমিক জড়তাটুকু কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। শরীরের যাবতীয় প্রতিবর্ত ক্রিয়াগুলো জানান দিচ্ছে এককালের দুরন্ত পর্বতারোহণের শিক্ষা পাওয়া শরীর কিছুই ভোলেনি। বয়সের জড়তাকে কাটিয়ে তুলে সেই শিক্ষাই তাঁকে প্রতি মুহূর্তে আরও সাবলীল করে তুলছিল পেছল পাহাড়ের গায়ে।

‘ক্লাইম্বটা বেশ টেকনিক্যাল কিন্তু জিষ্ণু। তুই অত সহজে—’ বলতে বলতেই অবশ্য রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল প্রফেসর বোসের কাছে। কা পোন! যে শিক্ষাগুলো ছেলেটাকে দেবার সময় তিনি পাননি কখনও, কা পোন সে অভাবের জায়গাগুলো পূরণ করে দিয়েছে ঠিক তাহলে। বুকের ভেতরটা ফুরফুরে হয়ে উঠছিল প্রফেসর বোসের। জিষ্ণু ভালো থাকবে।

‘কোথায়?’

দূরবিনটা তাঁর হাতে দিয়ে একটু সরে ঢালটার গায়ে তাঁকে জায়গা করে দিল জিষ্ণু। কাদার মধ্যে মুখ জাগিয়ে থাকা একটুকরো পাথরকে গ্রিপ করে নিজেকে প্রায় ঝুলিয়ে রেখেছে ঢালের কিনারায়। তার দিকে প্রশংসার চোখে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে দূরবিনে চোখ লাগালেন প্রফেসর। ভুল দেখেনি ছেলেটা। প্রায় শ-দুয়েক মিটার ওপরে একটা গাছের গোড়ায় ঝোপের মধ্যে লাল-কালোর একটা আভাস পাওয়া যায়। ট্র্যাগোপানই বটে। একটা পাখিকে কাবু করতে পারলে দুজনের মতো পেটভরা মাংসের জোগাড় হয়ে যাবে।

‘ট্রেলটা কিন্তু সুবিধের নয় জিষ্ণু। পাথরের গায়ে মাটি বৃষ্টিতে আলগা হয়ে আছে। আরও অনেকটা এগোতে হবে। যাবি? না ছেড়ে দিবি এটাকে?’

‘উঁহু। এটার গায়ে আমাদের ডিনারের নাম লেখা হয়ে গেছে বাবা। আমি এগোচ্ছি।’

‘গুলতিতে আমার হাত কিন্তু তোর চাইতে পাকা।’

‘তা হোক। আমি আগে দেখেছি। এ আমার শিকার।’

পাখিটা বোধহয় দূর থেকে তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়েছে। মাথা উঁচু করে সন্দিগ্ধ চোখে এদিক-ওদিক দেখছিল সে। তারা দুজন কাদামাখা ঢালের গায়ে মাথা নিচু করে স্থির হয়ে রইল। এ শিকার ধৈর্যের খেলা। পাশাপাশি শুয়ে থাকতে থাকতে প্রফেসর হঠাৎ নিচু গলায় বললেন, ‘জিষ্ণু?’

‘বলো।’

‘একটা কথা। তোকে কিন্তু এইবার অন্য জায়গায়—’

‘না।’ তাঁর কথাটা শেষ হবার আগেই জিষ্ণু বলে উঠল, ‘তোমাকে একা রেখে আমি—’

‘জিষ্ণু, এটা ইমোশনাল হবার সময় নয়। ঠিক আট বছর বাদে, ২১২৬ সালের চোদ্দই আগস্ট রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিটে ওই ধূমকেতু পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়বে। তার ঠিক চোদ্দো মিনিট আগে কয়েকটা সুনির্দিষ্ট কমান্ড জাগিয়ে তুলবে একাঘ্নির ইঞ্জিনকে। শুরু হবে বোমার ডিটোনেশনের কাউন্টডাউন। সে কাজটা শুধু পৃথিবীতে দুজন করতে পারে। আমি আর তুই। আমাদের দুজনের একসঙ্গে থাকার মানে হল, এখানে কোনও অ্যাটাক হলে, বা দুর্ঘটনা ঘটলে দুজনের একসঙ্গে—’

অনেকক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল জিষ্ণু। মাথাটা কাদামাটিতে গুঁজে দিয়েছে। পিঠটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল বারবার। অমোঘ যুক্তিটাকে অস্বীকার করবার ক্ষমতা নেই তার।

কিন্তু— বুকের ভেতর একটা দলা পাকিয়ে উঠছিল তার। হঠাৎ পাশ ফিরে বাবার দিকে ফিরে চাইল সে। সে-চোখে শীতল একটা প্রতিজ্ঞার ছাপ ছিল। মাথা নেড়ে ধীর গলায় কেটে কেটে বলল, ‘এই একটা ব্যাপারে তুমি শত যুক্তি দিয়েও আমাকে নাড়াতে পারবে না বাবা। জানি তুমি ঠিক। একটা যন্ত্রের মতো নিখুঁত তোমার হিসেব। কিন্তু তবু, গোটা পৃথিবীর নিরাপত্তার খাতিরেও, তোমাকে এখানে ওই গুহায় একলা কবর দিয়ে আমি চলে যেতে পারব না বাবা। তার ফলে যদি এ-গ্রহ ধ্বংস হয় তাতেও আমার কিছু যাবে আসবে না।’

দাঁত চেপে শেষের কথাগুলো বলতে বলতেই গুলতিটা হাতে চেপে ধরে বুকে হেঁটে সে পেছল ঢালটা বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ওপরের দিকে।

তার ছোট হয়ে আসতে থাকা শরীরটার দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। এই ভয়টাই তিনি করে এসেছেন এতগুলো দিন। এই শেষ মুহূর্তটার জন্য নিজেকে নানাভাবে প্রস্তুত করেছেন অনেকদিন ধরে। এখন কা পোনের ওপরে ভরসা করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা থাকল না তাঁর। এক সে যদি পারে ছেলেটাকে বুঝিয়েসুজিয়ে—

গুরগুর শব্দটা ঠিক তখনই ভেসে এল পাহাড়ের মাথার দিক থেকে। শরীরের নীচে মাটির ভেতর তিরতিরে কাঁপন উঠছিল। হঠাৎ ফ্যাকাশে মুখে ওপরের দিকে চেয়ে দেখলেন প্রফেসর।

সেখানে পাহাড়ের গায়ের পুরু কাদার স্তরে ভাঁজ পড়ছে। প্রাগৈতিহাসিক কোন দানবজীবের মতোই নড়েচড়ে সচল হয়ে উঠছে যেন তা। সেখানে গজিয়ে ওঠা প্রাচীন মহীরুহের দল হঠাৎ করেই পায়ের তলার শেকড়ের বাঁধন আলগা হয়ে এলোমেলো দুলছে, তারপর মুখ থুবড়ে পড়ছে কাদার চলমান স্তরের ওপরে। এক দানবিক জলপ্রপাতের মতোই ধেয়ে আসছে সেই কাদার স্তর তাঁদের লক্ষ করে।

জিষ্ণুও ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। তীক্ষ্ণ নজর চালিয়ে ছুটে আসতে থাকা ধ্বসের গতিপথের একটা আন্দাজ করে নিল সে। তারপর পাহাড়ের ঢালের থেকে উঠে আসা একটা গাছের ডাল ধরে তরতর করে নেমে গেল বাঁদিকের ঢালের নিরাপদ আশ্রয়ে। খানিক নীচে ওপর থেকে সামনে ঝুঁকে পড়া একটা বড় পাথরের ছাতার তলার আশ্রয় থেকে প্রফেসর সতর্ক চোখে নজর রাখছিলেন ধেয়ে আসা মৃত্যুদূতের দিকে। তার তীব্র ধাক্কায় শেকড় উপড়ে নেমে আসা অতিকায় গাছগুলো একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কানফাটানো শব্দ তুলছিল নির্জন পাহাড়ের গায়ে।

দশমিনিট কেটে গেল প্রায়। পাহাড়ের মাথা থেকে বিপুল কাদার স্তূপেরা এখনও ক্রমাগত ঝরে পড়ছে পায়ের অনেক নীচে ছুটন্ত নদীর বুকে। মাথার ওপরের পাথরের ছাতার সঙ্গে তার ঘষার তীব্র শব্দ কানে তালা ধরায়। সাবধানে তার একপাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন প্রফেসর একবার। এখান থেকে জিষ্ণুর আশ্রয় নেওয়া গাছটাকে পরিষ্কার দেখা যায়। গাছের গায়ে তার মাথাটুকু শুধু দেখা যাচ্ছে ঢালের আড়াল থেকে। মাথার ওপরে পাহাড়চূড়ার অরণ্যের একটা লম্বাটে টুকরো পুরো সাফ হয়ে গেছে ছুটন্ত ধ্বসের ধাক্কায়—

—আর ঠিক তখনই গুড়গুড় গুমগুম শব্দটা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। উপড়ে পড়া একটা গাছের শেকড়ের টানে পাহাড়ের গা থেকে খসে এসেছে একটা অতিকায় পাথরের চাঁই। তার গতিপথের দিকে একনজর দেখেই আতংকে হিম হয়ে গেল প্রফেসরের বুকটা। ছুটন্ত ধ্বসের শব্দকে উপেক্ষা করেই প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলেন তিনি, ‘জিষ্ণু— সাবধান—’

জিষ্ণুও দেখেছে তার দিকে সোজা ছুটে আসতে থাকা পাথরের বিরাট চাঁইটাকে। অসহায়ভাবে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে সেদিকে তাকিয়ে আছে সে। খাদের ভেতরে একটা গাছের ডালকে আশ্রয় করে ঝুলতে থাকা ছেলেটার পালিয়ে যাবার কোনও জায়গা নেই—

নিজের কর্তব্য স্থির করে নিলেন প্রফেসর। গত সাত বছর ধরে প্রতি মুহূর্তে আক্রমণের আশংকা মাথায় নিয়ে কেটেছে তাঁর। সন্তর্পণে নিজেকে লুকিয়ে রেখে কাজ করে গিয়েছেন তিনি। আজ সাফল্যের মুখে পৌঁছে এভাবে—

মনের ভেতরটা হঠাৎ একেবারে শান্ত হয়ে এল তাঁর। যা ঘটবার তা ঘটবেই। তাঁকে তাঁর কর্তব্য পালন করে যেতে হবে তবুও। বড় হয়ে জিষ্ণু নিশ্চয় সব বুঝবে। ক্ষমা করবে নিশ্চয় তাঁকে।

কোমর থেকে লেজার পিস্তলটা বের করে আনলেন তিনি। কয়েকটা সেকেন্ড সময় পাওয়া যাবে। কর্তব্য স্থির হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত উত্তেজনা, সমস্ত ভয় যেন ছেড়ে গিয়েছে তাঁকে। পাথরের ছাতার নিরাপদ আশ্রয়ে বসে তার ছোট্ট খোলা এলাকাটা দিয়ে নিশানা স্থির করলেন তিনি। একটাই সুযোগ পাওয়া যাবে—

সিঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ—

তীক্ষ্ণ একটা শব্দ উঠল অস্ত্র থেকে বের হয়ে সামনে ধেয়ে যাওয়া লাল আলোর সুতোটাকে ঘিরে। তার তীব্র উত্তাপে কেঁপে ওঠা বাতাসের আর্তনাদ—

খাদের প্রায় কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে ছুটন্ত পাথরের চাঁইটা। ঠিক তখনই তার বুকে এক মুহূর্তের জন্য স্থির হল লাল আলোর রেখা। আর তারপরেই একটা বিস্ফোরণ হয়ে গুঁড়ো হয়ে উড়ে গেল পাথরের চাঁই।

ধ্বস থেমে গেছে। পাহাড়ের ঢাল ঘন কাদার স্তূপে ঢাকা। তার ওপরে বারবার পিছল খেতে খেতে জিষ্ণু এসে দাঁড়াল প্রফেসর বোসের সামনে। মুখটা ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার।

‘গুহায় ফিরে চলো বাবা। তাড়াতাড়ি— সময় নেই বেশি হা—’

কথাটা সম্পূর্ণ হল না তার। প্রফেসরের ডানহাতটা নিখুঁত লক্ষে উঠে এসে আঘাত করেছে তার খুলির গোড়ায় তৃতীয় ও চতুর্থ কশেরুকার সন্ধিস্থলে। একটা কাটা গাছের মতন কাদার ওপরে যখন আছড়ে পড়ছে জিষ্ণু তখনও তার ঝাপসা হয়ে আসা চোখের দৃষ্টিতে বিস্ময় মাখানো ছিল।

আকাশ বাতাস চুপ হয়ে গেছে। সন্ধে নেমে আসছিল দ্রুত। চুপ করে কাজ করে চলেছিলেন প্রফেসর। সর্বক্ষণের সঙ্গী ঝোলাটা থেকে বের করে এনেছেন স্বচ্ছ তরলে ভরা একটা ছোট শিশি—

—জিনিসটা গ্রামপ্রধানকেই একবার ব্যবহার করতে দেখেছিলেন প্রফেসর। একাঘ্নির তৈরি হবার প্রথমদিকে দুর্ঘটনা যে দু-একবার ঘটেনি তা নয়। টাইটানিয়াম নিষ্কাশন প্ল্যান্টের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে উম জং-এর মৃত্যু তার মধ্যে একটা। তার ছোট ছেলেটা নিজের চোখে সে দৃশ্য দেখেছিল। তার মা নেই। মানসিক আঘাতটা বড় তীব্র হয়ে লেগেছিল ছেলেটার। খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার।

নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে যখন অনাথ ছেলেটা, তখন একদিন গ্রামপ্রধান তার ঘুমন্ত, দুর্বল শরীরটার পাশে এসে বসেছিলেন। যত্ন করে তার মুখটা খুলে সেখানে ঢেলে দিয়েছিলেন কোনও এক ছত্রাকের নির্যাস।

খানিক বাদে ছেলেটা যখন ঘুম ভেঙে উঠে বসল, তখন তার মুখ থেকে সব দুঃখের চিহ্ন মিলিয়ে গেছে। মিলিয়ে গেছে তার আগের জীবনের সব স্মৃতিও। নতুন একটা নাম দিয়ে তাকে দত্তক নেয় গ্রামেরই অন্য এক নিঃসন্তান পরিবার।

‘আপনি হয়তো ওর মঙ্গলের জন্যই এ কাজটা করেছেন মান্যবর,’ প্রফেসর পরে একদিন বৃদ্ধকে বলেছিলেন, ‘কিন্তু নিজের সব স্মৃতিকে হারিয়ে বসা, সে-ও তো মৃত্যুই হল একরকম। তাহলে?’

জবাবে মৃদু হেসে বৃদ্ধ জবাব দিয়েছিলেন, ‘এ-ওষুধের প্রতিষেধকও আছে আমাদের কাছে। আঠারো বছর বয়স হলে তাকে সব কথা জানিয়ে, সে ইচ্ছে করলে তার সব স্মৃতিকে ফের ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’

ওষুধ ও তার প্রতিষেধক দুটিরই সামান্য কিছুটা নিজের সঙ্গে রেখে দিয়েছিলেন প্রফেসর। তেমন কোনও দুর্ভাগ্যের দিন এলে কাজে লাগাবার জন্য। তবে সে দিনটা যে সত্যিই এভাবে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াবে তা তিনি কখনও ভাবেননি। আস্তে আস্তে, বড় যত্নে অজ্ঞান ছেলেটার মুখ খুলে তার মধ্যে হাতে ধরা শিশিটা উপুড় করে দিলেন তিনি। তারপর ঝোলা থেকে একটা ছোট তাবিজ বের করে এনে সেটা তার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন।

অন্ধকার নেমে এসেছে। অবশ্য আলো থাকলেও লাভ হত না কিছু চোখের জলে এমনিতেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে তখন তাঁর। ঝোলা থেকে একটুকরো কাগজ বের করে খসখস করে তাতে কয়েকটা কথা লিখে কাগজটা জিষ্ণুর পকেটে রেখে দিলেন তিনি। তারপর তাকে দু-হাতে জড়িয়ে কোলে তুলে নিয়ে কোমরের জেটবেল্টের বোতামে চাপ দিলেন। লেজার রশ্মির সংকেত চিনে নিতে ভুল করবে না লালপিওতের দলের সদাজাগ্রত সেন্সর। ওরা আসবে। আসবেই এখানে। এখন তা শুধু খানিক সময়ের অপেক্ষা। সেই সময়টাকেই কাজে লাগাতে হবে প্রথমে। লুকিয়ে প্রাণ বাঁচানো যাবে না আর। একাঘ্নিকে রক্ষা করা দরকার সবার আগে। পৃথিবীর জন্য।

জিষ্ণুর অজ্ঞান শরীরটা কোলে নিয়ে অরণ্যের সবুজ আবরণের মাথা দিয়ে তিরবেগে উড়তে উড়তে প্রফেসরের চোখের সামনে দিয়ে ছবির মিছিল ভেসে চলেছে তখন। সেই ছোট্ট জিষ্ণু— মায়ের হাত ধরে প্রথম হাঁটা— তার মায়ের মৃত্যু— জিষ্ণুকে নিয়ে চাঁদের বুকে— তারপর আস্তে আস্তে তার বড় হয়ে ওঠা— কত ছবি— কত স্মৃতি—

পাহাড়ের চূড়া পেরিয়ে বেশ কয়েক মাইল এগিয়ে গিয়ে বাতাসে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন প্রফেসর। তারপর কবজিতে বাঁধা গ্রাহক যন্ত্রের নিশানা মেনে নেমে চললেন পায়ের নীচের গভীর জঙ্গলের একটা বিশেষ এলাকার দিকে। কা পোনের যানের গোপন ঘাঁটি। গুহাগ্রামে এলে এইখানেই সে তার যানকে লুকিয়ে রাখে।

***

পায়ের নীচে ঘন সবুজ আবরণ অন্ধকার হয়ে গেছে। ওইখানেই কোথাও শুয়ে আছে জিষ্ণু। থাক। তাঁর সামনে এখন অনেক কাজ। হাওয়া কেটে দ্রুত গুহাগ্রামের দিকে ফিরে চলেছিলেন প্রফেসর। কা পোনের কাছে বার্তা গেছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সে ঠিকই উদ্ধার করে নিয়ে যাবে জিষ্ণুকে। তারপর—

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিলেন প্রফেসর। কবজিতে বাঁধা ছোট সংকেতজ্ঞাপক যন্ত্রটায় তীক্ষ্ণ শব্দ উঠছে। কাছাকাছি এলাকায় আবহমণ্ডলে ঢুকে আসছে কোনও মহাকাশযান। ওরা আসছে।

যেখানে প্রথম জিষ্ণুকে বাঁচাবার জন্য লেজার পিস্তলটা চালানো হয়েছিল সেখানটায় দ্রুত ফিরে যেতে যেতেই তাঁর বেতার সংকেতের নির্ভুল নির্দেশে তখন গুহাগ্রামে ঢোকবার মুখটার কিছু ভেতরে ছোট একটা বিস্ফোরণে পাথরের স্তূপ এসে ঢেকে দিয়েছে তার প্রবেশপথ। সেখানে কেউ ঢুকে এলেও পাথরের স্তূপের পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে তার আন্দাজ পাবে না কোনও।

‘আমি— এখন শুধু আমি জানি ওখানে ঢোকবার রাস্তার কথা। জীবন্ত ওদের হাতে ধরা দেব না আমি—’

পুবের আকাশ বেয়ে তাঁর দিকে দ্রুত ছুটে আসতে থাকা আলোর বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে প্রতিজ্ঞাটা বারবার বলে চলেছিলেন একলা মানুষটা। নিজের শরীরে তিনি তখন দ্রুতহাতে বেঁধে চলেছেন পাথর ফাটানো বিস্ফোরকের পুঁটুলিগুলো—

বহু দূরে, মঙ্গলের বুকে একটা নিয়ন্ত্রণকক্ষের পর্দায় তখন ধরা পড়েছে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা একলা মানুষটার ছবি। সেদিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন লালপিওতে, ‘এইবার প্রফেসর বোস। ফের দেখা হল আমাদের। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়—’ বলতে বলতেই মাইক্রোফোনে নিচু গলায় নির্দেশ দিলেন তিনি, ‘একে আমার জীবন্ত দরকার। ওকে সঙ্গে নিয়ে—’

কথাটা শেষ হবার আগেই পর্দার ছবিটা কেঁপে উঠে মিলিয়ে গেল। সেখানে তখন ভেসে উঠেছে এঁকেবেঁকে ছুটন্ত যানের ক্যামেরায় ধরা পড়া রাতের প্রকৃতির এলোমেলো ছবি।

‘রিপোর্ট দিন লেফটেন্যান্ট।’

জবাবে যান থেকে কিছু এলোমেলো কথার টুকরো ভেসে এল শুধু—‘লোকটা আমাদের দিকে উড়ে আসছে অ্যাডমিরাল— নিশানায় আনবার চেষ্টা করছি আমরা— দূরত্ব কমছে—’

তারপর স্ট্যাটিকের খরখর ছাড়া আর কোনও শব্দ এল না নিয়ন্ত্রণকক্ষের স্পিকার থেকে।

পৃথিবীর বুকে, ভারতের উত্তর-পশ্চিমের ঘন অরণ্যের ভেতরে তখন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসছে অতিকায় একটা আগুনের গোলা। চারপাশে বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে পড়ছিল বিস্ফোরণে ছিটকে যাওয়া যানটার টুকরোটাকরা—

***

‘ওয়েলকাম জিষ্ণু। টাইকো ফের একবার আপনার সেবায় হাজির—’

ছেলেটা অবাক চোখে সামনের পর্দায় ভাসতে থাকা কুকুরটার ছবির দিকে দেখল একবার। পাশে বসা মানুষটা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার দিকে দেখছেন।

‘জিষ্ণু— কে?’

তিনি মাথা নেড়ে মৃদু হাসলেন, ‘টাইকোর প্রোগ্রামিং এর গলদ। আগে এ যানে জিষ্ণু নামে আমার এক সহকারী ছিল। তোমার সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলেছে। সেটা সমস্যা নয়। রি-প্রোগ্রাম করে দেব।’

‘আপনি—’

‘আমি কা–পোন। এই যানটার মালিক। তুমি এই গভীর জঙ্গলে একা একা শুয়ে কী করছিলে? ঠিক সময়ে আমি যান নিয়ে এখানে নেমে না এলে—’

‘আ-আমি ঠিক জানি না। আমি—’

কা পোন তার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন একবার, ‘তোমার নামটা মনে করতে পার?’

খানিক চুপ থেকে বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল ছেলেটা। নিজের নামটা তার মনে নেই। এখানে, এই গভীর জঙ্গলে সে কী করে এল তা-ও সে জানে না। আজ সকালে প্রথম যখন তার চেতনা ফিরল, এই মানুষটা তাঁর ওপরে ঝুঁকে ছিলেন। চোখে দু-ফোঁটা জল উপচে উঠল তার, ‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমি—’

হা হা করে দিলখোলা হাসির শব্দে হঠাৎ ভরে উঠল কেবিনটা, ‘আরে, ধন্যবাদ তো আমি দেব ভগবান জাওগিকে। সারাটা জীবন শুধু কাজ করে গেলাম আর বিপদের সঙ্গে লড়াই করে গেলাম। ঘরসংসার আর করা হল না। এখন জাওগির দয়ায় বনের মধ্যে থেকে এমন একটা সুন্দর ছেলে কুড়িয়ে পেয়েছি সে তো আমার সৌভাগ্য রে। আয়, হাতটা বাড়িয়ে দে দেখি, তোর সঙ্গে টাইকোর আলাপ করিয়ে দি—’

পর্দার নীচের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের ওপর একটা লেন্সের গায়ে তার ডানহাতটা নিয়ে চেপে ধরলেন একবার তিনি। চামড়ার নীচে বসানো পরিচয় চিপটা থেকে পর্দায় তার যাবতীয় বিবরণ ভেসে উঠছে অঙ্কের জটিল ভাষায়। ছেলেটা সে ভাষা বোঝে না। সেদিকে একঝলক তাকিয়ে দেখে নিয়ে কা পোন হাতের একটা সংকেত করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই স্থির হয়ে দাঁড়াল ভাসমান অঙ্কের ধারা।

ছেলেটা অবাক চোখে সেদিকে দেখছিল। একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে কা পোন ফের পর্দার দিকে ফিরে মৃদু গলায় বললেন, ‘প্রোগ্রাম সংকেত গামা ২৭৬৫।’

পর্দা থেকে এক নিমেষে সংখ্যাগুলো মুছে গেল। তার বদলে সেখানে ফুটে উঠেছে কিছু নির্দেশ।

নির্দেশগুলো ধরে ধরে কা পোন বলে চলেছেন তখন, ‘নাম ক্রিস্টোফার পোন। বয়স ষোলো। পিতা কা পোন। নিবাস—’

বদলে যাচ্ছে পর্দায় ভেসে থাকা অঙ্কগুলো। পরিচয় চিপে ধরে রাখা ছেলেটার আসল পরিচয়ের তথ্যকে আড়াল করে তার ওপরে এসে বসছে নতুন নামধাম পিতৃপরিচয়। নিজের পকেটে হাত দিয়ে একবার কাগজের টুকরোটাকে ছুঁয়ে দেখলেন কা পোন। প্রফেসরের শেষ নির্দেশ সেইরকমই ছিল।

ওর প্রকৃত পরিচয় এখন কিছুদিন আড়ালে থাকা প্রয়োজন। পরিচয় চিপের তথ্য বদলানোর এই বেআইনি প্রোগ্রামটার দাম কালোবাজারে এক টন প্ল্যাটিনামের চেয়েও বেশি। কিন্তু তার মতো আরও অনেক বে-আইনি চোরাচালানকারির জীবনেই টিকে থাকবার জন্য এ-প্রোগ্রামটা অপরিহার্য। প্রায় প্রতিটি অপারেশনের সময়ই নিজের পরিচয় বদলে নিয়ে কাজ সারতে হয় তাকে। তারপর কাজ শেষ হবার পর সেই অস্থায়ী পরিচয়কে মুছে দিয়ে পরিচয় চিপ-এ সঠিক তথ্যকে ফিরিয়ে আনতে একটি ছোট কম্যান্ডই যথেষ্ট। সঠিক সময় এলে এ-ছেলেকেও সে পরিচয় ফিরিয়ে দেওয়া যাবে।

***

‘যানে স্বাগত জুনিয়র পোন,’ টাইকো ফের একবার কথা বলে উঠেছে।

‘জবাব দে ক্রিস্টোফার। তোকে বলছে।’ কা পোন ছেলেটার মাথায় মৃদু হাত বুলিয়ে দিলেন একবার। দুর্ভাগা ছেলেটা জানে না যে আজ ও সত্যিই অনাথ হয়েছে। প্রফেসর বোসের ধুলো হয়ে যাওয়া শরীরটা এখন মিশে আছে কয়েক মাইল দূরের ওই পাহাড়ের মাটিপাথরের গায়ে।

কথাটা মনে হতে বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল কা পোনের। ছেলেটা জানে না, কত কঠিন কাজ রয়েছে তার সামনে। ওই কিশোর মানুষটার ওপরেই পৃথিবীকে রক্ষা করবার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন প্রফেসর। আর ওকে বড় করে তুলে নির্দিষ্ট সময়ে তার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেবার কাজ প্রফেসর তার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছেন। ওর পকেট থেকে পাওয়া কাগজের টুকরোটায় প্রফেসরের চিঠির শেষ লাইনগুলো তার চোখের সামনে ভাসছিল—

‘—মহাকাশবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষা যেন পায় ও। তারপর নির্দিষ্ট সময় এসে হাজির হলে ওর গলার তাবিজে সংরক্ষিত প্রতিষেধক খাইয়ে ওর স্মৃতি ফিরিয়ে দেবে তুমি। মনে রেখো তারপর ওকে যে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে তার ওপরে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। জিষ্ণু আমাদের শেষ অস্ত্র। তাকে রক্ষা করবার, গড়ে তোলবার সমস্ত দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম—’

‘আ-আমাকে?’

‘হ্যাঁ রে ব্যাটা। তোকে। কোন দুর্ঘটনায় কীভাবে তুই নিজের পরিচয় খুইয়েছিস কে জানে। আজ থেকে তুই আমার ছেলে ক্রিস্টোফার। এই পরিচয়েই তোকে সবাই জানবে এখন থেকে।’

ছেলেটা চুপ করে বসে রইল। ওর মনের মধ্যে কী চলছে তার আন্দাজ করতে পারছিলেন কা পোন। হঠাৎ খোলা গলায় ফের হেসে উঠে তার পিঠে একটা চাপড় মেরে তিনি বললেন, ‘আরে এত গোমড়া মুখে বসে থাকলে হবে? জীবনটা তো একটা খেলা রে! নতুন জীবন, নতুন কাজ! তবে হ্যাঁ। বসে থাকা চলবে না তোর। সব তো ভুলে বসেছিস। তাহলে চলবে কী করে? পড়াশোনা করতে হবে তোকে নতুন করে। আয় দেখা যাক কতটুকু কী জানিস তুই। টাইকো কিন্তু কুকুর হলেও খুব ভালো শিক্ষক। ওর হাতেই শুরু হোক তবে। টাইকো—’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *