৫
রাত গভীর হয়েছে। মানুষ দুজন জলধারাটির পাশে শুয়ে ঘুমোয়। বেশ কিছুদিন ধরে ক্রমাগত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে লড়তে পালিয়ে চলা মানুষদুটির চোখে নিশ্চিন্ত ঘুম ছিল না। আজ অবশেষে সমস্ত পরিচিত শত্রুর চোখের আড়ালে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে এসে তারা আর সতর্কতা বজায় রাখতে পারেনি। জিষ্ণুকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে প্রফেসর বোস তার পাশে বসে সতর্কভাবে জেগে থাকবার চেষ্টা করেছিলেন কিছুক্ষণ। আলো নিভিয়ে দিয়েছেন। এই গুহার রাজত্বে অন্য মানুষের উপস্থিতির যে ইঙ্গিত দিয়েছে জিষ্ণুর খুঁজে পাওয়া পাথরের অস্ত্রটা, তা দেখবার পর বিশ্রামের সময়ে আলো জ্বেলে রেখে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে সাহস হয়নি প্রফেসর বোসের।
সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের আড়ালে কখন যে তাঁর চোখদুটো জুড়ে এসেছে নিজেই টের পাননি তিনি। হঠাৎ সেই অন্ধকারের নৈঃশব্দ ভেঙে ছোট্ট একটা নুড়িপাথর এসে টুপ করে পড়ল তাঁর পাশে। ক্ষীণ শব্দটুকু তাঁর ঘুমে কোনও ব্যাঘাত ঘটাল না। তারপর আরও কয়েকটা নুড়ি পাথর এসে পড়ল চারপাশে। অবশেষে, তাঁরা যে ঘুমিয়ে রয়েছেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর আস্তে আস্তে অন্ধকারের মধ্যে থেকে কতগুলো ছায়া ছায়া শরীর এগিয়ে এল তাঁদের কাছে। জীর্ণ চেহারার একটি অবয়ব ঝুঁকে পড়ে মানুষ দুজনকে পরীক্ষা করল কিছুক্ষণ। ততক্ষণে তাঁর ইশারায় আরও কয়েকজন মানুষ এসে পাশে পড়ে থাকা জিনিসপত্রের পুঁটুলিগুলোকে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
এইবার বৃদ্ধ তাঁর কোমরের ছোট একটি পুঁটুলি থেকে একটি সদ্য তুলে আনা ছত্রাকের কন্দ বের করে আনলেন। হাতের তেলোয় নিঃশব্দে সেটিকে থেঁতো করে নিয়ে তা এগিয়ে ধরলেন ঘুমন্ত মানুষদুটির নাকের কাছে।
মিনিটখানেক সেটি সেইভাবে ধরে থাকবার পর নিচু হয়ে একবার তাদের নিঃশ্বাস পরীক্ষা করে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইশারা করলেন বৃদ্ধ। একটা মশাল জ্বলে উঠল কাছেই কোথাও। তার ধিকিধিকি আলোতে কাঠ ও লতাপাতা দিয়ে তৈরি দুটি সরু মাচা নিয়ে এগিয়ে এল একদল মানুষ। নিঃশব্দে, সুশৃংখল দক্ষতায় নিঃসাড় মানুষদুটির দেহ মাচাদুটির ওপর শুইয়ে নিয়ে তারা এগিয়ে গেল সেই জলধারার উজানের দিকে।
গুমগুম শব্দটা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এইখানে পাতাল জলধারাটি অনেক উঁচুতে থাকা একটি ফুটো বেয়ে এসে প্রবলবেগে নীচে আছড়ে পড়ে নদী হয়ে বয়ে চলেছে। সেই আছড়ে পড়া জলধারার দিকে সটান এগিয়ে গিয়ে তার মধ্যে ঢুকে পড়ল মানুষের দলটা। জলধারার উলটোদিকে একটা গভীর সুড়ঙ্গের মুখ। এককালে এই পথেও হয়তো বয়ে আসত কোনও জলস্রোত। আজ ভূপ্রকৃতির বদলের সঙ্গে সঙ্গে সে জলধারা শুকিয়ে গেছে। পড়ে আছে তার পাতাল খাতটি।
সেই সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলল দলটা। আস্তে আস্তে জলের শব্দ থেমে আশ্চর্য একটা নৈঃশব্দ এসে ছেয়ে ফেলল তাদের। গলিপথটা অসংখ্য শাখাপ্রশাখায় ভেঙে ছড়িয়ে গেছে চারদিকে, সেই অতিকায় পাহাড়ের শ্রেণীর পেটের ভেতর। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে অনায়াসে তাদের মধ্যে থেকে সঠিক পথগুলি বেছে নিয়ে তারা এগিয়ে চলল সেই গোলকধাঁধার পথে—
***
—ঠান্ডা ঠান্ডা ঠেকছিল জিষ্ণুর। গায়ের চাদরটা কখন যেন সরে গিয়েছে পায়ের ওপর থেকে। মাথার নীচে নরম বালিশে মুখ গুঁজে চোখ পায়ের ওপর চাদরটা ফের টেনে নিয়েই চমকে উঠে বসল সে। পাথরের পাটার ওপর পাতা একটা নরম বিছানায় শুয়ে আছে সে। ছোটমতন একটা ঘর। ঘর না বলে ছোট একটা গুহাই বলা উচিত হবে। তার দেয়ালগুলো আবছা আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছে। আলোর উৎস ঠিক কোথায় বোঝা যায় না। তাড়াতাড়ি পাথরের পাটাটার থেকে নেমে আসতে গিয়েছিল সে এমন সময় একটা হাত এসে তাকে বাধা দিল, ‘উঠো না জিষ্ণু।’
‘বাবা-আমরা—’
‘ভয় পেয়ো না। ভয় মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু জিষ্ণু। আমাদের অজ্ঞান করে কেউ ধরে এনেছে এখানে—’
স্বল্প আলোয় ততক্ষণে চোখ সয়ে এসেছে জিষ্ণুর। প্রফেসর বোসের শান্ত মুখটা চোখে পড়ছিল তার। তাঁর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে চোখ ফেলে সে একটু অবাক হয়েই বলল, ‘আলো জ্বলা দেয়াল! কিন্তু সে কী করে—’
সেদিকে চোখ ফেলে একটু হাসলেন প্রফেসর বোস, ‘আহা! প্যানেলাস স্টিপটিকাস! মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার কোনও শেষ নেই জিষ্ণু। কোনও উন্নত টেকনোলজি নয়, এ একধরনের ছত্রাক। আলো দেওয়া এ জাতের ছত্রাকের চাষ করেছে এরা গুহার দেয়াল জুড়ে। তাতেই আলোর সমস্যা মিটেছে। সম্ভবত এদের গোটা বসতির দেয়াল জুড়েই এ বন্দোবস্ত রয়েছে।’
জিষ্ণু উঠে এসে দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গোটা দেয়াল জুড়েই খণ্ড খণ্ড ভেজা কাঠের টুকরো আটকানো রয়েছে। তার ওপরে গজিয়ে ওঠা ছত্রাকের দল আলো ছড়চ্ছিল। সেইদিকে দেখতে দেখতেই অন্যমনস্কভাবে সে বলল, ‘কিন্তু আমাদের এভাবে ধরে এনে—’
প্রফেসর বোসের শক্তপোক্ত হাতটা জিষ্ণুর কাঁধে এসে ঠেকল, ‘বুঝতে পারছি না। তবে এরা মনে হয় কোনও ক্ষতি করতে চায় না আমাদের। নইলে ধরে এনে এইভাবে নরম বিছানায় আরাম করে শুইয়ে রাখত বলে মনে হয় না। তা ছাড়া, আমাদের জিনিসপত্র কিছুই খোয়া যায়নি। ওই দ্যাখো।’
প্রফেসরের আঙুলের ইশারা অনুসরণ করে জিষ্ণু দেখল, তাদের জিনিসপত্রের পুঁটুলিগুলো সযত্নে ঘরটির মেঝের ওপরে রাখা রয়েছে।
‘কিন্তু— কেন—’
‘জানি না জিষ্ণু। তবে আমাদের আটকে যে রাখা হয়েছে সেটা পরিষ্কার,’ বলতে বলতে হাতে ধরা টর্চের আলো ফেলে ঘরের একপাশে দেখালেন প্রফেসর বোস। সেখানে গুহামুখটা একটা পাথরের চাঁই দিয়ে বন্ধ করা আছে, ‘আমি ওটায় ধাক্কা দিয়ে দেখেছি। শক্ত করে আটকানো।’
‘কিন্তু এরা যদি আমাদের কোনও ক্ষতিই না চাইবে তাহলে এইভাবে আমাদের আটকে রাখবার প্রয়োজনটা কী?’
‘সেটা এদের সঙ্গে কথা না বললে বোঝা যাবে না। আর তার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতেও হবে না আমাদের,’ বলতে বলতে হাতে ধরা একটা ছোট্ট যন্ত্রের পর্দাটা জিষ্ণুর দিকে ঘুরিয়ে ধরলেন প্রফেসর বোস, ‘পর্দাটা দ্যাখো জিষ্ণু। জীবনসংবেদী এই যন্ত্রটা পুরু পাথরের আবরণের অন্যদিক থেকেও একশো মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে যে কোনও জীবন্ত বস্তুর উপস্থিতি ধরতে পারে।’
পর্দার বুকে তখন সবুজ আলোর পটভূমিতে কয়েকটি আলোকবিন্দু ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছিল।
‘একদল মানুষ। এদিকে আসছে। তৈরি হও,’ বলতে বলতে একটি ছোট লেজার বন্দুক বের করে জিষ্ণুর দিকে এগিয়ে ধরতে ধরতেই প্রফেসর বোস সাবধানবাণী দিচ্ছিলেন, ‘যতটুকু বোঝা গেছে এরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমরা এদের এলাকায় ঢুকে এসেছি, তবুও আমাদের ধরে এনে অতিথির মতোই আচরণ করেছে এতক্ষণ। একেবারে নিরুপায় না হলে অস্ত্রের ব্যবহার করবে না। আমি ওর শক্তি মৃদু আঘাতে বেঁধে দিয়েছি। আমার নির্দেশ না পাওয়া অবধি ওকে কখনই মারণ আঘাতের জন্য বাঁধবে না। যতক্ষণ না আমি সংকেত দিই অস্ত্রটা পকেটের বাইরে বেরও করবে না।’ বলতে বলতেই নিজের হাতে ধরা লেজার বন্দুকটার বোতাম টিপে সেটিকে মৃদু আঘাতের জন্য তৈরি করে নিয়ে কোমরে গুঁজে রাখলেন প্রফেসর। আলোকবিন্দু্গুলি ততক্ষণে বড় হয়ে যন্ত্রের পর্দা ছেয়ে ফেলেছে প্রায়। মৃদু গুমগুম শব্দ উঠছিল পাথরের দরজায়। তারপর তা আস্তে আস্তে একপাশে গড়িয়ে যেতে শুরু করল—
দরজার সামনে যে মানুষটি এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর বয়স আন্দাজ করা সহজ নয়। জীর্ণ শরীরটি, অথচ মেরুদণ্ড একেবারে টানটান। কোমরে জড়ানো একখণ্ড সাদা কাপড় ছাড়া শরীরে আর কোনও পোশাক নেই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দুটি সামনে করে নিচু গলায় বলে উঠলেন, ‘হিন ইন্ন, কিয়াউক—’
বলতে বলতে লম্বা লম্বা পায়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে এলেন মানুষটি। দরজার বাইরে তাঁর পেছনে আরও অনেক মানুষের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। সম্ভবত তারা বৃদ্ধের আদেশের অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রফেসর বোস নিচু হয়ে তাঁর পুঁটুলির থেকে একটা ছোট যন্ত্র বের করে এনে সেটিকে সামনে বাড়িয়ে ধরেছিলেন। ততক্ষণে তাঁর একেবারে সামনে চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছেন বৃদ্ধ। সে দৃষ্টিতে কোনও রাগ বা ভয় ছিল না। ফের তিনি বলে উঠলেন, ‘হিন ইন্ন, কিয়াউক মেইক সোয়ে—’
প্রফেসরের হাতের শব্দসংবেদী যন্ত্রটির পর্দায় ততক্ষণে ভাষাটির পরিচয় ভেসে উঠেছে। বার্মিজ ভাষায় কথা বলছেন বৃদ্ধ। সেইদিকে একনজর দেখে যন্ত্রটিকে একটি নির্দেশ দিয়ে প্রফেসর শান্ত গলায় বাংলায় বললেন, ‘আমরাও বন্ধু। কোনও ভয় নেই—’
যন্ত্রটির থেকে একেবারে তাঁর মতো একটি গলা বলে উঠল, ‘ডোঃ মেইক সোয়ে। হিন ইন্ন—’
বৃদ্ধ বিস্মিত চোখে যন্ত্রটির দিকে একবার চেয়ে দেখলেন। আর তার পরই তাঁর চোখদুটিতে হাসি ঝিলমিল করে উঠল। হাত বাড়িয়ে প্রফেসর বোসের থেকে যন্ত্রটি নিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন একবার। তীক্ষ্ণধী মানুষটি ধরে ফেলেছেন যন্ত্রটি কী করছে। সেটিকে মুখের কাছে তুলে ধরে ফের বলে উঠলেন, ‘হ্সান সেত।’
যন্ত্র থেকে এইবার বাংলা ভাষায় তাঁর জরাজীর্ণ কিন্তু পরিষ্কার গলাটিই ভেসে এল, ‘অদ্ভুত যন্ত্র।’
তারপর প্রফেসর বোসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাইরের পৃথিবীর মানুষ, আমাদের সন্ধান পেলে কীভাবে?’
‘নিতান্তই হঠাৎ করে মান্যবর,’ প্রফেসর বোস উত্তর দিলেন, ‘আপনাদের অস্তিত্বের কথা আমরা আগে থেকে জানতাম না।’
বৃদ্ধের মুখ গম্ভীর হল, ‘মিথ্যা বলবে না যুবক। এই পাতালদেশে মিথ্যা বলার শাস্তি বড় ভয়ংকর। আবার প্রশ্ন করছি, আমাদের সন্ধান তুমি পেলে কী করে?’
প্রফেসর বোস শান্ত মুখে জবাব দিলেন, ‘আমি মিথ্যা কথা বলি না মান্যবর, আমরা সত্যিই আপনাদের অস্তিত্বের কথা আগে থেকে জানতাম না। নিতান্তই পথ ভুল করে—’
‘পথ ভুল করে? তোমার পোশাকআশাক, চেহারা থেকে অনুমান করা যায় তোমরা কোনও দূর শহরের বাসিন্দা। সেখান থেকে এই জঙ্গলে কেন এলে? দুর্গম পথ পার হয়ে এই পাহাড়ে এসে পৌঁছোলে— সে-ও কি ভুল করে?’
প্রফেসর সত্যব্রত বোস নিঃশব্দে মানুষটির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। বৃদ্ধের হাসিমাখা চোখদুটিতে গভীর অবিশ্বাসের স্পর্শ লেগেছে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নেড়ে বললেন, ‘আপনার সন্দেহ করবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে মান্যবর। আপনার জায়গায় হলে আমিও এই একই সন্দেহ করতাম। কিন্তু অনুরোধ করব, আপনি আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন।’
‘কেন বিশ্বাস রাখব?’
‘রাখবেন, তার কারণ, আমরা ইচ্ছা করলে আপনাদের সমস্ত বাসস্থানটিকে ধ্বংস করে দেবার ক্ষমতা রাখি। কিন্তু তা আমরা করিনি, করতে চাইও না। এর সামান্য একটু প্রমাণ আমার সঙ্গের এই বালকটি আপনাকে দেখাবে। মান্যবর, আপনারা আমাদের এই ঘরে বন্দি রেখেছেন এর দরজায় একটি বিরাট পাথরের খণ্ড চাপিয়ে। কোনও একা মানুষের পক্ষে তা খোলা অসম্ভব। আমি অনুরোধ করব, আপনার সঙ্গে আসা সৈন্যদের ওই পাথরের দরজাটি বন্ধ করে দিয়ে তাদের নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবার আদেশ দিন।’
বৃদ্ধ প্রফেসর বোসের মুখের দিকে তাকিয়ে কী একটা ভাবলেন, তারপর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আদেশ দিলেন, ‘কাং সিক, ভেতরে এসে বন্দিকে বাইরে নিয়ে যাও। এই ঘরে এখন আমি আর ওই বালকটি থাকব। তারপর দরজা বন্ধ করে সকলে নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়াও।’
‘বুদ্ধিমানের মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মান্যবর,’ বলতে বলতেই প্রফেসর বোস পকেট থেকে ছোট্ট লেজার বন্দুকটি বের করে এনে তাঁকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই ছোট্ট যন্ত্রটি আমার সঙ্গে থাকল। এ’রকম আরেকটি যন্ত্র আমার ছেলের কাছেও রইল।’
ততক্ষণে বাইরে থেকে দুজন যোদ্ধা ঘরের ভেতর এসে প্রফেসর বোসকে দু-পাশ থেকে ধরে বাইরের দিকে রওনা দিয়েছে। চলতে চলতেই জিষ্ণুর দিকে একবার ঘুরে দেখলেন প্রফেসর। তারপর বললেন, ‘ভয় পাবে না জিষ্ণু। এত পুরু পাথরের স্তরের নীচে থেকে লেজারের বিচ্ছুরণ টের পাবে না বাইরের দুনিয়া। আমরা এখানে নিরাপদ। সেইসঙ্গে খেয়াল রাখবে কোনও প্রাণহানি না হয়। এটি একটি প্রদর্শনীমাত্র। কারও প্রাণ নেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়।’
ঘড়ঘড় শব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল ফের। জিষ্ণু পকেট থেকে ছোট্ট মারণাস্ত্রটি বের করে এনে তার বোতাম টিপছিল একমনে। সর্বোচ্চ শক্তিতে বাঁধতে হবে একে এইবার। একটু পরে খেলনার মতো দেখতে যন্ত্রটি হাতে করে উঠে দাঁড়িয়ে সে ইশারায় সরে দাঁড়াতে বলল বৃদ্ধকে। তারপর হঠাৎ তার হাতে ধরা যন্ত্রটা থেকে ছিটকে বের হয়ে এল গনগনে লাল একটা আলোর রেখা। মুহূর্তে বিকট শব্দ করে ভেঙে চৌচির হয়ে উড়ে গেল গুহার পাথরের দরজা।
***
‘মান্যবর, এমন বহু অস্ত্রই আমাদের সঙ্গে আছে। অথচ ভেবে দেখুন, আপনারা আমাদের বন্দি করে এনেছেন, তুচ্ছ পাথরের খণ্ড দিয়ে আমাদের আটকে রেখেছেন, কিন্তু আমরা একবারও তার প্রতিবাদ করিনি। ক্ষমতা থাকলেও আপনাদের কারাগার থেকে বের হয়ে যাইনি।’
প্রশস্ত সভাগুহাটিও বন্দিকক্ষের মতোই ছত্রাকের আলোতে মৃদু আলোকিত। কথা শেষ করে সামনে সাজানো পাথরের পাত্র থেকে একখণ্ড ছত্রাক তুলে মুখে দিলেন প্রফেসর। বড় সুস্বাদু এই ছত্রাকগুলি। একেকটি হাতের মুঠোর মতো বড় বড়, গাঢ় কমলা রঙের ফলের মতো দেখতে।
‘বেশ। তোমার যুক্তি আমি মেনে নিলাম,’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। খানিক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির স্মৃতি তখনও তাঁর চোখের সামনে ভাসছে, ‘অবশ্য অকারণে আমরাও হিংসা করি না।’
‘আপনার এই কথাটিতে আমি বিশ্বাস করি মান্যবর। আমাদের বন্দি করলেও, অতিথির মতোই আপ্যায়ন করেছেন আপনারা।’
বৃদ্ধ একটু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘এবারে বলো, কেন এসেছ তোমরা এখানে? পথ ভুলে শহর থেকে যে আসোনি তা তো পরিষ্কার। তাহলে?’
‘না মান্যবর। আমরা কোনও শহর থেকে আসিনি। শুধু বলতে পারি যে ভয়ংকর বিপদ মাথায় নিয়ে আমি এই অরণ্যে এসে আশ্রয় নিয়েছি তা শুধু আমাদের একার নয়। সে বিপদে আপনাদের অস্তিত্ত্বও একইরকমভাবে বিপন্ন হতে চলেছে।’
বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, ‘বৃথাই চিন্তা করছ যুবক। শোনো, আজ থেকে বহুকাল আগে ঐরাবতক নদীর মহাপ্রলয়ে পৃথিবী জনশূন্য হয়ে গেলে আমাদের পূর্বজরা তার তীর পরিত্যাগ করে পৃথিবীর এই গর্ভদেশে আশ্রয় নেন। স্বয়ং পৃথিবী মাতা আমাদের রক্ষাকর্ত্রী। যতদিন আমরা এই প্রস্তরদুর্গে আছি, তোমাদের দুনিয়ার কোনও শক্তিই আমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রফেসর বোস বললেন, ‘না মান্যবর। যে দুর্যোগের সংবাদ নিয়ে আমরা এখানে এসেছি, তা একবার ঘটলে এই পাথরের আবরণও আপনাদের রক্ষা করতে পারবে না। তার কাছে আপনার ঐরাবতক নদীর মহাপ্লাবনও তুচ্ছ হয়ে যাবে।’
বৃদ্ধের চোখে অবিশ্বাসের ছায়া পড়ছিল। সেটি লক্ষ করে প্রফেসর বোস দৃঢ় গলায় বললেন, ‘আমাকে একটা সুযোগ দিলে আমি আপনাকে তার প্রমাণ দেখাতে পারি।’
‘কী প্রমাণ দেখাবে তুমি?’
‘অকাট্য চাক্ষুষ প্রমাণ মান্যবর। কিন্তু তার জন্য আমাদের কিছু যন্ত্রাদি সাজাবার প্রয়োজন হবে। আপনি কি তার অনুমতি দেবেন আমাদের?’
‘কী করতে চাও?’
প্রফেসর বোস নিচু হয়ে তাঁর কাছে রাখা পুঁটুলিটির থেকে একটি ছোট্ট গোলক বের করে এনে বললেন, ‘এই যন্ত্রটি বহুদূর অবধি দৃষ্টিক্ষেপণে সক্ষম। যন্ত্রটি বুদ্ধিমান। নিজে নিজেই তা গুহা থেকে বাইরে যাবার পথ খুঁজে নেবে। তারপর খোলা আকাশের নীচে পৌঁছে আমার নির্দেশ মেনে এর পেছনে সংযুক্ত ধাতব রজ্জুটি দিয়ে এ আমার প্রয়োজনীয় দৃশ্যগুলিকে এই ঘরে পাঠিয়ে দিলে আসল ঘটনাটি আপনাকে বোঝাতে সুবিধে হবে আমাদের—’
***
পাহাড়ের গায়ের একটা ছোট গর্ত বেয়ে বাইরে ভেসে বের হয়ে এল ছোট্ট গোলকযন্ত্রটা। দুটো হাতের মুঠো একত্র করলে যতটুকু আয়তন হয় ঠিক ততটাই বড় একটা ধাতব গোলক। তার সামনের দিকটায় ছোট ছোট ফুটো। পেছনদিক থেকে একগোছা ধাতুর তৈরি তার চলে গেছে তাদের পেছনে দাঁড়ানো গুহার হাঁ মুখ দিয়ে পাতালের দিকে। মৃদু একটা শোঁশোঁ শব্দ করে হালকা নীলচে রঙের আলোর শিখা ছড়িয়ে বাতাসে ভেসে এদিক-ওদিক ঘুরে অবশেষে স্থির হয়ে ভাসতে লাগল সে এক জায়গায়। তারপর তারের মধ্যে দিয়ে ভেসে আসা নির্দেশ মেনে সামান্য এদিক-ওদিক ঘুরে সামনের ফুটোওয়ালা দিকটা রাতের আকাশের একটা নির্দিষ্ট দিকে ঘুরিয়ে ধরল।
তারের অন্যপ্রান্তে মাটির অনেক নীচের সেই গুহায়, প্রফেসর বোসের হাতে ধরা একটা ছোট প্রক্ষেপক যন্ত্র থেকে সামনের পর্দায় তখন আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে একটি পাহাড়চূড়ার ছবি। সেইদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখে একটা বিস্ময়ের শব্দ বের হয়ে এল বৃদ্ধের গলা থেকে, ‘এ তো আং সাই-এর গিরিশৃঙ্গ। ওই তো সেই হাতির পিঠের মতন বাঁকানো গিরিশিরা! কিন্তু—’
‘সেটি একেবারে দিগন্তের কাছে, এখান থেকে খালিচোখে তাকে একটা দাগের মতন দেখায়, তাই তো মান্যবর?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু তোমার এই অলৌকিক যন্ত্র—’
‘অলৌকিক নয় মান্যবর। এটি মানুষের বিজ্ঞানের দান। এর শক্তিতে আমাদের দৃষ্টি কেবল আং সাই নয়, তার থেকেও দূরে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। দেখুন—’
আং সাই এর গিরিশিরার মাথায় তখন সবে পুরন্ত চাঁদের কলাটি দেখা দিয়েছে। পর্দায় সেটি একমুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে রইল, তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড গতিতে যেন এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল পর্দার বুকে। বিবর্ধিত হতে হতে গোটা পর্দাটাকেই ঢেকে ফেলছিল তা। যন্ত্রের বোতামগুলোর ওপর হাত চালাতে চালাতেই প্রফেসর কথা বলছিলেন, ‘দূরদর্শক যন্ত্রটি আমাদের চাঁদের গায়ের একটি নির্দিষ্ট এলাকার ছবি বিবর্ধিত করে দেখাতে চলেছে। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করুন মান্যবর—’
পর্দার গায়ে তখন ফুটে উঠেছে ছাইরঙের ধুলোয় ঢাকা একটি উপত্যকার ছবি। তার বুকে ছোট ছোট কিছু কালো বিন্দু এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে দেখা যায়। সেইদিকে তাকিয়ে নিজের মনেই মাথা নাড়ছিলেন বৃদ্ধ। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর একেবারেই যে যোগাযোগ নেই তা নয়। এমনিতে গুহাদেশের বাইরে ওপরের পৃথিবীর গ্রামশহরে যাবার চেষ্টা করাটা এখানকার বাসিন্দাদের কাছে আইনবিরুদ্ধ কাজ। আজীবন কারাবাস করে তার শাস্তি পেতে হয় আইনভঙ্গকারীকে। তবু, মাঝে মাঝে এখানকার দু-একজন বাসিন্দা হারিয়ে যায়। এ পাহাড়ের পেটের ভেতরটা ফাঁপা। অজস্র অলিগলির গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে তাদের কেউ কেউ ভুল করে পৌঁছে যায় বাইরের জগতে। কিন্তু তারা ফিরে আসে না। এই গোলকধাঁধার মধ্যে পথ খুঁজে এখানে ফিরে আসা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া ফিরে এলে কী শাস্তি তার জন্যে অপেক্ষা করছে সে কথা তাদের অজানা থাকে না। শুধু— কা পোন চি—
—তাঁর একমাত্র ছেলে। এই মানুষটিরই বয়সি। দশ বছর বয়সে সে-ও এমনি করেই হারিয়ে গিয়েছিল সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায়। প্রায় কুড়ি বছর বাদে একদিন পথ খুঁজে খুঁজে সেই গোলকধাঁধা পেরিয়েই সে ফিরেও এসেছিল তাঁর কাছে এক রাত্রে। বৃদ্ধ নিজের ছেলের ওপরে সেই কঠোর দণ্ড চাপিয়ে দিতে পারেননি। তাকে ফিরে যেতে দিয়েছিলেন। সেই থেকে কালেভদ্রে, রাতের গভীর অন্ধকারে সবার চোখের আড়ালে সে এসে দেখে যায় তার বুড়ো বাবাকে। বাইরের দুনিয়ার অনেক কথাই তার মুখে শুনেছেন তিনি। কিন্তু, এই মানুষটি— তার সঙ্গের এইসব বিচিত্র যন্ত্রপাতি— এই সবকিছু তাঁর কল্পনারও বাইরে ছিল এতদিন।
‘এইবার এদিকে দেখবেন মান্যবর—’ প্রফেসর বোস ডাকছিলেন। চমক ভেঙে পর্দার দিকে চোখ ফেললেন বৃদ্ধ। সেখানে একটা অতিকায় বাসস্থানের ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে আছে।
‘এই জায়গায় আমার বাস ছিল মান্যবর। একে ধ্বংস করা হয়েছে মাত্রই কয়েকদিন আগে। এই যে দেখুন—’
‘বলতে বলতেই পর্দায় মহাকাশের দৃশ্য মুছে গিয়ে ফুটে উঠছিল প্রফেসরের রেকর্ড করে আনা গবেষণাকেন্দ্রটি ধ্বংস হবার ছবি—
—প্রায় আধঘণ্টা ধরে সেই ধ্বংসলীলা দেখতে দেখতে মুখটা বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল। মানুষ যে এত ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর হতে পারে তা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না।
‘কে করেছে? কেন?’ ছবি থামলে প্রায় বুজে আসা গলায় প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধ।
‘যারা করেছে তারা অন্য গ্রহের বাসিন্দা। বলতে বলতেই তাঁর হাতের নির্দেশে বাইরের গোলক দূরবিন নিশানা ঘুরিয়েছে। পর্দা থেকে চাঁদের ছবি উধাও হয়ে গিয়ে ভেসে উঠেছে মহাকাশের মখমলি কালো রং। সেখানে হিরেমানিকের মতো জ্বলতে থাকা অজস্র তারাদের ভিড়ে এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে তার দৃষ্টি একসময় এসে স্থির হল একটা লাল বিন্দুর ওপরে।
‘এটি হল পৃথিবীর প্রতিবেশী মঙ্গলগ্রহ।’
নামটা শুনে সচকিত হয়ে উঠলেন বৃদ্ধ। কা পোন চি-র কাছে তিনি এই জায়গাটির কথা শুনেছেন। সঠিক কোথায় তা তাঁর বোধগম্য না হলেও এটুকু বুঝেছেন সেখানে একটি শত্রুজাতির বসবাস রয়েছে।
দূরবিনের দৃষ্টি তখন মঙ্গলের ভুপৃষ্ঠের ওপরের একটা নির্দিষ্ট এলাকায় দৃষ্টিস্থাপন করেছে। সেখানে একটা মহাকাশবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা সার সার হিংস্র চেহারার রণপোতের ছবি পড়ছিল সামনের পর্দায়।
‘পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এরা মান্যবর। কিন্তু তার চাইতেও ভয়ংকর একটা কাজ করেছে এরা—’
বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে প্রফেসর বোসের কথা শেষ হল। জিষ্ণু কখন বৃদ্ধের পাশেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। গোটা গল্পটাই গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনেছেন বৃদ্ধ। তার অনেক জায়গাই তাঁর বোধগম্য হবার কথা নয়। সে জায়গাগুলোতে প্রফেসরকে থামিয়ে দিয়ে বারবার প্রশ্ন করে বুঝে নিতে চেয়েছেন তাঁর কল্পনারও বাইরের সেই গল্পের যাবতীয় খুঁটিনাটি। বারে বারে প্রমাণ চেয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছেন প্রফেসরকে।
পর্দার বুকে ভাসমান সুইফট টাটল ধূমকেতুর জমাটবাঁধা ধুলো আর ছাইয়ের পিণ্ডটার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই তিনি এবার বললেন, ‘তুমি যা যা বললে তাকে সম্পূর্ণ বোঝা আমার ক্ষমতার বাইরে যুবক। তবে তোমার কথা থেকে এইটুকু বুঝতে পারছি যে একটি দানবিক পাথর পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়তে চলেছে আর পনেরো বছর পরে। তার জন্য দায়ী মঙ্গলগ্রহবাসী শত্রুরা। তুমি এই দুর্ঘটনা থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে চাও। কী করে?’
‘ওই একাঘ্নি নামের অস্ত্রটিকে এইখানে ফের একবার তৈরি করে মান্যবর। একমাত্র তাহলেই পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব। এইখানে, এই পাথরের আবরণের আড়ালে তা তৈরি করলে শত্রুদের নজরের আড়ালে থাকবে। বাইরের পৃথিবীকে না জানিয়ে—’
‘আমাদের কী করতে হবে, বলো—’
‘আমাদের আশ্রয় দিন। আর প্রয়োজনে বাইরের দুনিয়ায় যাওয়া আসা করবার অনুমতি—’
‘কিন্তু তুমি যা বললে তাতে বাইরের দুনিয়ায় যাতায়াত করা তোমাদের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। একটা ছোট্ট অসাবধানতায় সমস্ত চেষ্টাটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে—’
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। কাজটার আসল সমস্যাগুলো এইবারে সামনে আসছে। খানিক বাদে মুখ তুলে বললেন, ‘জানি মান্যবর। কিন্তু ঝুঁকিটা আমাকে নিতেই হবে যে। সেক্ষেত্রে একটা ক্ষীণ আশা থাকবে সবকিছু রক্ষা করবার। আর তা না হলে ধ্বংস তো একেবারেই নিশ্চিত।’
মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ। তারপর বললেন, ‘অনেক পরিশ্রম করেছ যুবক। তুমি ক্লান্ত। ক্লান্ত মানুষ ভুল করে। এখন বিশ্রাম নাও। তারপর কালকে ফের ঠান্ডা মাথায় এ ব্যাপারে চিন্তা করা যাবে’খন।’
***
নিজের ছোট্ট বাসগুহাটিতে ফিরে এসে পাথরের পাটার ওপর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন বৃদ্ধ। তারপর দেয়ালের গায়ে একটা কুলুঙ্গিতে সযত্নে লুকিয়ে রাখা একটা ছোট্ট সাদা রঙের ঘনক বের করে আনলেন। তার গায়ের একটামাত্র বোতাম রয়েছে। কা পোনের রেখে যাওয়া যন্ত্র। কখনও একান্ত কোনও প্রয়োজন হলে যাতে তার কাছে একটা খবর পৌঁছানো যায় সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা। আজ অবধি এ কাজটা তাঁকে কখনও করবার কথা ভাবতে হয়নি। কিন্তু আজ তা করতে হবে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে একবার বোতামটা ছুঁয়েও আঙুল সরিয়ে নিলেন বৃদ্ধ। হঠাৎ এসে পৌঁছনো আগন্তুকের গল্পটার অধিকাংশই তিনি বোঝেননি। তার মুখ দেখে মনে হয় সে সত্যি কথাই বলছে। কিন্তু তবু— বাইরের পৃথিবীর মানুষের ব্যাপারে চিরকালই বড়রা শিখিয়ে এসেছেন এরা হিংস্র আর প্রবঞ্চক হয়। এত সহজে এদের কথায় বিশ্বাস করা যায় না।
কা পোনই ঠিক বুঝতে পারবে হয়তো। বাইরের জগতে তার অনেক চলাফেরা। একটা গভীর দ্বিধায় তাঁর মনটা দুলছিল। এদের কথা সত্যি হলে এদের সবরকম সাহায্য করা প্রয়োজন। আর মিথ্যে হলে, শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্রধারী এই মানুষ দুজনকে কাবু করতে গেলে অনেক মানুষের প্রাণ যেতে পারে। কথাটা ভাবতেই একবার শিউরে উঠলেন বৃদ্ধ। তারপর মন স্থির করে বোতামটায় মৃদু চাপ দিলেন একবার—
***
মুখের ওপর হালকা ছোঁয়াটা পেতেই তাড়াতাড়ি চোখ মেললেন প্রফেসর বোস। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। দু-চোখের মাঝখানে তাক করা লেজার বন্দুকের মাথার লেন্সটা চকচক করছিল পেছন থেকে আসা একটা আলোর রেখার স্পর্শ পেয়ে। আলোটা তাঁর মুখের দিকে সরাসরি ধরা।
‘নড়বার চেষ্টা করবেন না প্রফেসর বোস অথবা যে-ই হন আপনি,’ আলোর রেখার পেছনে দাঁড়ানো অতিকায় অন্ধকারের স্তূপটার থেকে মৃদু গলায় একটা সাবধানবাণী বের হয়ে এল, ‘আমি এ যন্ত্রটার ব্যবহার জানি।’
অন্য একজন মানুষ তখন দক্ষভাবে তাঁকে বেঁধে ফেলছে বিছানার সঙ্গে। এইবার হাতে ধরা আলোটা গুহার ছাদের দিকে মুখ করে মেঝেতে নামিয়ে রাখল মানুষটা। মৃদু, অনুজ্জ্বল একটা আলো ছড়িয়ে গেল গোটা গুহা জুড়ে। সেই আলোয় সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে মনে মনে জরিপ করে নিচ্ছিলেন প্রফেসর।
‘জিষ্ণু— আমার ছেলে— তাকে—’
আলোটা হঠাৎ ঘুরে গেল একপাশে। সেখানে বালিশে মাথা রেখে অঘোরে ঘুমোচ্ছে জিষ্ণু। গভীর নিঃশ্বাসের তালে তালে তার বুকের ওঠাপড়া পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল।
‘ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের ছত্রাক কোনও স্থায়ী ক্ষতি করে না। ঘণ্টাকয়েক পরে ওর ঘুম ভাঙবে। ততক্ষণে আমার কিছু প্রয়োজনীয় কথা জানবার আছে আপনার কাছ থেকে।’
মানুষটার মুখের পরিশীলিত বাংলার মধ্যে একটা হালকা অচেনা টান ছিল। প্রফেসর চুপ করে রইলেন। ঘরের মধ্যেটা এইবারে বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। টর্চ ও দেয়ালের ছত্রাকের মিলিত আলোয় চোখ সয়ে এসেছে ততক্ষণে প্রফেসরের।
সামনে দাঁড়ানো মানুষটার বয়স প্রায় চল্লিশ। গায়ের তাপনিয়ন্ত্রক পোশাকটা পুরোনো, কিন্তু শক্তপোক্ত। একমনে সে হাতে ধরা প্রফেসরের লেজার অস্ত্রটিকে দেখছিল।
‘হুম। মডেল এক্স্ ৮। প্রতিরক্ষা বিভাগের একেবারে আনকোরা নতুন আবিষ্কার। একবার চার্জ করে নিলে সাত হাজার বার ফায়ার করা যায়। বাজারে এর এক-একটার জন্য সমান ওজনের হিরের চেয়েও বেশি দাম দিতে রাজি খদ্দেরের অভাব নেই। আপনার আর ওই বাচ্চাটার কাছে দেখছি দু-দুখানা রয়েছে। পেলেন কার থেকে? কত পড়ল বলুন তো?’
বলতে বলতেই প্রফেসরের মুখে আটকানো আঠালো কাগজের টুকরোটা একটা হ্যাঁচকা টানে খুলে দিল মানুষটি।
‘এ যন্ত্রটা বাজারে বিক্রি হয় না।’
‘কী যে বলেন প্রফেসর! বাজারে সবকিছুই বিক্রি হয়। শুধু ঠিকঠাক জোগানদার খুঁজে বের করতে পারলেই হল। কিন্তু কা পোন চি এখনও যে জিনিস জোগাড় করতে পারল না, প্রতিরক্ষা বিভাগের সেই নতুন মডেলের অস্ত্র বাজারে কোন খেলোয়ার নিয়ে এল সেইটেই জানতে চাইছি।’
‘আপনার নামটা কোথাও শুনেছি।’
মৃদু হাসল মানুষটা, ‘শোনবার কথা। সমস্ত পার্থিব প্রচারমাধ্যমেই আমার নামে সতর্কবার্তা দেওয়া আছে।’
প্রফেসর বোসের ভুরুদুটো কুঁচকে উঠল, ‘হ্যাঁ। মনে পড়েছে। এই মুহূর্তে পূর্ব গোলার্ধের সবচেয়ে নামকরা চোরাকারবারী। টাকার জন্য না পারে এমন কাজ নেই।’
‘বাজে কথা রাখুন। আপনি কাদের হয়ে কাজ করছেন সেটা বলবেন কি?’
কোনও জবাব দিলেন না প্রফেসর। একটু বাদে লোকটা ফের মুখ খুলল, ‘আপনি লাজলো ক্লদিয়াসের লোক?’
‘সে কে?’
‘বোকা সাজবেন না প্রফেসর। চারখানা টাইটানিয়াম খনির মালিক লাজলোকে চেনে না এমন মানুষ কেউ নেই। টাকার কুমির। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মহাকাশ প্রমোদতরীর মালিক। ওর টাইটানিয়ামের লোভের শেষ নেই।’
হঠাৎ চোখদুটি চকচক করে উঠল প্রফেসর বোসের, ‘কিন্তু আমি যে লাজলোর হয়ে কাজ করছি, হঠাৎ এ সন্দেহ আপনার হল কেন?’
‘প্রশ্নগুলো আমি করব প্রফেসর, আপনি উত্তর দেবেন।’
‘আমার বাঁধনটা খুলে দেবেন কি?’
‘যতক্ষণ না আপনার ব্যাপারে নিশ্চিত হচ্ছি ততক্ষণ নয়।’
‘আমার অস্ত্র তো আপনার কাছে। তবুও ভয় পাচ্ছেন?’
‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিন প্রফেসর। আপনি কি লাজলোর লোক?’
প্রফেসর বোসের মুখটা কঠিন হল এবারে, ‘অস্ত্রটায় পুরো চার্জ রয়েছে। আপনি চাইলে ওটা আমার ওপর ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু, বাঁধন না খোলা অবধি আমি আপনার কোনও প্রশ্নের জবাব দেব না।’
‘হুম। সাহস আছে। আচ্ছা বেশ—’
বলতে বলতেই জিষ্ণুর দিকে এগিয়ে গিয়ে হাতের অস্ত্রটা তার মাথার দিকে ঘুরিয়ে ধরল কা পোন। তারপর একটা ছোট ছুরি নিখুঁত লক্ষ্যে ছুড়ে দিল প্রফেসর বোসের হাতের কাছে—
‘এবারে বলুন—’
ততক্ষণে নিজের বাঁধনগুলো কেটে ফেলেছেন প্রফেসর বোস। জবাবে নিজের বাঁ-হাতটা তুলে ধরলেন তিনি। তারপর মনিবন্ধে একটা মৃদু টোকা মেরে বললেন, আপনার কাছে পরিচয়-চিপ স্ক্যানার আছে কী? আমার পরিচয়-চিপ এইখানে রয়েছে।
জিষ্ণুর দিকে এক হাতে অস্ত্রটা ধরে রেখেই মানুষটা অন্য হাতে তার পোশাকের পকেট থেকে একটা ছোট যন্ত্র বের করে এনে সেটাকে ছুড়ে দিল প্রফেসরের দিকে।
বাঁ-হাতের মণিবন্ধে সেটাকে ছুঁইয়ে ফের কা পোনের কাছে তা ফেরত পাঠালেন প্রফেসর।
‘প্রয়োজন হলে আমার রেটিনা স্ক্যান করে পরিচয় চিপের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন কা পোন,’ খানিক পরে ফের কথা বললেন প্রফেসর।
‘উঁহু। প্রয়োজন হবে না,’ হাতে ধরা যন্ত্রটার পর্দার দিকে দেখতে দেখতে জবাব দিল লোকটি, ‘আপনি লাজলোর লোক নন। আমি নিশ্চিত। ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা দফতরের পরিচয় চিপ নকল করবার প্রযুক্তি এমনকী লাজলোরও নাগালের বাইরে।’
‘বেশ। এবারে বলবেন কি, আপনি কেন আমায় লাজলোর লোক ভেবেছিলেন প্রথমে?’
প্রফেসরের কথার উত্তর না দিয়ে কা পোন চি একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে। হঠাৎ করেই এক মুহূর্তের জন্য একটা লুব্ধ ভাব খেলে গেল তার মুখে, ‘লালপিওতে আপনার জন্য কত দর দিয়েছে জানেন?’
‘আপনি—’
‘সারা পৃথিবীর সমস্ত অপরাধীদল এই মুহূর্তে আপনাকে খুঁজছে, আর সেই হিরের খনি আমার হাতের মুঠোয় নিজে থেকেই এসে ঢুকে বসে আছে—’
‘তুমি যা জানতে চেয়েছিলে তা জেনেছ কা পোন। এইবার এই অতিথির প্রশ্নের উত্তর দাও।’
বলতে বলতে দেয়ালের কাছ থেকে এইবারে আলোর বৃত্তের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন সন্ধ্যাবেলার সেই বৃদ্ধটি। তারপর প্রফেসর বোসের দিকে হাত তুলে মৃদু গলায় বললেন, ‘এইভাবে আপনাকে ব্যতিব্যস্ত করবার জন্য মার্জনা চাইছি হে অতিথি। কা পোন আমার একমাত্র সন্তান। সে আপনাকে সাহায্য করবার জন্যই এসেছে।’
প্রফেসর বোস সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাটকায় মানুষটির দিকে ফের তাকিয়ে দেখলেন একবার। তারপর বললেন, ‘কিন্তু—’
‘আপনার সমস্ত কৌতূহলের জবাব আপনি পাবেন প্রফেসর,’ কা পোনের মুখে মৃদু হাসি ফুটেছে এবার। লেজার পিস্তলটা প্রফেসরের দিকে ছুড়ে দিয়ে সে মেঝের ওপর নিচু হয়ে বসে পড়ল তাঁর সামনে, ‘তবে প্রথম কৌতূহলটার জবাব প্রথমে দিয়ে নেওয়া যাক। এই গুহাক্ষেত্রটির নীচে পৃথিবীর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট টাইটানিয়ামের ভাণ্ডার রয়েছে। এই এলাকায় এই ধাতুর উপস্থিতির আন্দাজ তার থাকলেও খনির সঠিক অবস্থানটা লাজলো নির্ণয় করতে পারেনি এখনও। সঠিক সন্ধানটা প্রথম পাবার জন্য সে যে কোনও পথ ধরতে, যে কোনও পরিমাণ অর্থ খরচ করতে তৈরি।’
‘তাহলে আপনি এতদিন তাকে সে সন্ধান দেননি কেন?’
কা পোনের ছোট ছোট চোখদুটো আরও ছোট হয়ে উঠল কয়েক মুহূর্তের জন্য। খানিক বাদে মাথা নেড়ে সে বলল, ‘বাইরের দুনিয়া আমার ব্যাপারে একটা ভুল তথ্য জানে প্রফেসর। টাকার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি তা ঠিক, কিন্তু এই পাহাড়টাকে আমি কিছুতেই বিক্রি করে দিতে পারি না। এই গুহাক্ষেত্রে আমি প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম। লাজলোর মাটি খোঁড়ার যন্ত্ররা এই পাহাড়কে ধ্বংস করে দিক তা আমি চাই না।’
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর নৈঃশব্দ ভাঙলেন সেই বৃদ্ধ, ‘তোমার ওপর সে বিশ্বাস আমার আছে বলেই আমি তোমাকে এই অতিথিদের খবর দিতে সাহস পেয়েছি।’
‘তার মানে এই খনির খবর আপনিও—’
‘এই সুকঠিন ধাতুর অস্তিত্ব আমরা জানি। এই গুহাগ্রামের গভীরতম অঞ্চল থেকে তুলে আনা ওই ধাতুমিশ্রিত পাথর দিয়েই আমাদের অস্ত্রাদি তৈরি হয়। কিন্তু সে-কারণে আমি কথাটা বলিনি।’
‘তাহলে কেন—’
‘এই গ্রহের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রের কথা তুমি বলেছ, তা যদি সত্য হয় তাহলে এই গুহাগ্রামও রক্ষা পাবে না তার হাত থেকে। তাকে আটকাবার জন্য কা পোন যথাসাধ্য সাহায্য করবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম বলেই আমি তাকে তোমাদের খবর দিয়েছি।’
‘ক্ষমা করবেন প্রফেসর বোস,’ কা পোন হঠাৎ মাথা নিচু করে বলল, ‘কিন্তু আশা করি আপনি বুঝবেন, কেন আপনাকে ভালো করে আগে পরীক্ষা করে নেবার প্রয়োজন ছিল। এই এলাকার প্রতি এখন শুধু লাজলোই আগ্রহী তা নয়। অস্বীকার করব না, মঙ্গল উপনিবেশকে অস্ত্র ও অন্যান্য রসদের বে-আইনি সরবরাহ করাটা আমার মতো চোরাইচালানকারীদের কাছে লাভজনক ব্যাবসা। কিন্তু এই এলাকায় কোনও অপরিচিত মানুষের যে কোনও খবরের জন্য যে চড়া মূল্য দেবার প্রতিশ্রুতি তারা কয়েকদিন থেকে দিয়ে চলেছে পৃথিবীর সমস্ত গুপ্তসংস্থাকে, তার পরিমাণের কাছে সে ব্যাবসার লাভের পরিমাণও তুচ্ছ হয়ে যায়। আমি নিজেও তাই কিছুকাল ধরে চোখকান খোলা রেখে চলেছি। কিন্তু আমার নিজের গ্রামেই যে—’
‘আপনি কি তাহলে আমাদের—’ প্রফেসর হাতের অস্ত্রটি শক্ত করে চেপে ধরলেন।
‘না। এইখানে আজ এসে পৌঁছোনর আগে অবধি সে লোভ আমার মনে ছিল, তা আমি অস্বীকার করব না। কিন্তু, কেন তারা এ মূল্য দিতে প্রস্তুত হয়েছে তার কোনও আন্দাজ আমার ছিল না। কিছুক্ষণ আগে বাবার কাছে সমস্ত ঘটনাটা আমি শুনেছি। আমি চোরাচালানের কাজ করে বেঁচে থাকি, কিন্তু আমার এই গ্রামকে, আমার গ্রহকে আমি ভালোবাসি প্রফেসর। কা পোন চি আপনাকে সমস্ত সহায়তা করবার জন্য তৈরি। বলুন, কী করতে হবে?’
একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন প্রফেসর বোস, ‘একটা খবর দিয়ে আপনি আমার কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছেন কা পোন চি। এইখানে টাইটানিয়ামের অফুরন্ত উৎস রয়েছে। আমার পরিকল্পনা সফল করে তোলবার জন্য এই ধাতুটিই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে। তবে প্রথমে একটা ছোট কর্মীদল প্রয়োজন হবে আমার। আপনি—’
মৃদু হেসে মাথা নাড়ল কা পোন, ‘আমাকে সে দলের মধ্যে ধরবেন না প্রফেসর। আমি যা করব তা গোপনেই করতে হবে। এ গ্রামের মানুষজনকে না জানিয়ে। আমি এখানে—’
‘না কা পোন। কাল থেকে তুমি আর এ গ্রামের পলাতক বাসিন্দা থাকবে না,’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, ‘সময় বদলেছে। অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনে যে আইন আমাদের পূর্বজরা তৈরি করেছিলেন, আজ সেই অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনেই সে আইন আমাদের বদলাতে হবে। আমি নিজে এই গ্রামের প্রধান হিসেবে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল কা পোনের মুখটা। সেখান থেকে নিষ্ঠুরতা আর ধূর্ততার মুখোশটা এক মুহূর্তে কে যেন সরিয়ে নিয়ে গেছে। ছোট চোখদুটি খুশিতে চিকমিকিয়ে শক্তিশালী হাতের ভেতর প্রফেসর বোসের হাতদুটোকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, ‘ইউরোপার অন্ধকার সমুদ্রের টারমক শিকার করেছি আমি। কিন্তু সেদিনও এত আনন্দ আমি পাইনি। এতগুলো বছর বাদে আরও একবার সবার সামনে এই গ্রামের পথে আমি— শুধু আপনার জন্য— আপনাকে ধন্যবাদ প্রফেসর। কা পোন আপনার কাছে চিরকাল ঋণী হয়ে থাকবে।’
তার গলার গমগমে আওয়াজ গুহার ভেতরে প্রতিধ্বনি তুলছিল। হঠাৎ সেই আওয়াজে চোখ মেলে লাফ দিয়ে উঠে বসল জিষ্ণু। তারপর প্রফেসর বোসের হাত ধরে থাকা অতিকায় মানুষটাকে দেখে একটা চিৎকার করে এসে লাফ দিয়ে পড়ল তার পিঠের ওপর।
মুহূর্তের মধ্যে অতবড় শরীরটাকে আশ্চর্য নমনীয়তায় বেঁকিয়ে নিয়ে হাতদুটো পেছনদিকে ঘুরিয়ে তাকে আলতো করে কোলের ওপর টেনে আনল টারমক শিকারি দুর্ধর্ষ মানুষটা, তারপর তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ফের যখন কথা বলল, তখন তার কর্কশ গলায় এক আশ্চর্য কোমলতা ছিল, ‘তোমার নাম তো জিষ্ণু। আমি জানি। আমার কা পোন চি। আজ থেকে আমি তোমার বন্ধু। আমি একজন ভালো শিকারি। আমার সঙ্গে পাখি ধরতে যাবে নাকি?’