অন্তিম অভিযান – ৪

‘সিটবেল্ট বেঁধে নাও জিষ্ণু, আমরা আবহমণ্ডলে ঢুকতে চলেছি।’ কথা বলতে বলতেই লাইফবোটের চারপাশে তীব্র উজ্জ্বল একটা আলোর বলয় তৈরি হচ্ছিল। বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘষা লেগে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে লাইফবোটের রক্ষাকবচ। তীব্র ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠছিল যানের ভেতরটা।

নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের স্পিকারটা হঠাৎ খড়খড় শব্দ করে সচল হয়ে উঠল, ‘প্রফেসর সত্যব্রত বোস, আমি অ্যাডমিরাল সেন কথা বলছি। ইগল স্কোয়াড্রনের দুটি স্পেস প্লেন স্ট্র্যাটস্ফিয়ার থেকে আপনার অবস্থান লক্ষ করছে। পালাবার চেষ্টা করবেন না। ধরা দিন। কথা দিচ্ছি আপনি উপযুক্ত বিচার পাবেন।’

প্রফেসর বোস চমকে উঠে তাড়াতাড়ি স্পিকারের সুইচ অন করতেই যন্ত্রগণকের সুরেলা গলা ভেসে এল, ‘যানের সম্প্রচার তরঙ্গ পৃথিবী থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রফেসর। আপনার যান থেকে কোনও বেতার সম্প্রচার সম্ভব নয়।’

জিষ্ণু অন্য একটি চ্যানেলে কিছু দেখছিল। এইবারে নীরবে হেডফোনটা প্রফেসর বোসের দিকে এগিয়ে দিল সে। দূরদর্শনের জাতীয় চ্যানেলে তখন উত্তেজিত মুখে ঘোষক বলে চলেছেন, ‘এই ভয়াবহ বিস্ফোরণটি ঘটাবার পেছনে প্রফেসর বোসের সঙ্গে কিছু কিছু উগ্রপন্থী সংস্থার যোগাযোগ আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। পৃথিবীর দিকে ফিরতে থাকা তাঁর যানটির ওপর সতর্ক নজরদারী রেখে চলা হচ্ছে। তিনি—’

পায়ের নীচে মহাদেশীয় উপকূলরেখাগুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। সামনের স্ক্যানারের পর্দায় কিছু ছোট ছোট বিন্দু দেখা দিয়েছে। একটা নিখুঁত বর্গক্ষেত্রের চেহারা নিয়ে তারা তিরবেগে উঠে আসছিল লাইফবোটটার দিকে। মাইক্রোফোনে বারবার ভেসে আসা সতর্কবার্তাগুলোর দিকে কান না দিয়ে প্রফেসর তাঁর কিপ্যাডটিতে যান্ত্রিক দক্ষতায় আঙুল চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ জানালার বাইরে তাকিয়ে জিষ্ণু চিৎকার করে উঠল, ‘আরও একটা লাইফবোট। ঠিক আমাদেরটার মতো— ওরা রশ্মিকামান বের করছে বাবা—’

‘ভয় পেয়ো না জিষ্ণু । ওটা এই যানটার একটা ত্রিমাত্রিক ছবি। আসল যান নয়—’ বলতে বলতেই পাশে ভাসতে থাকা দ্বিতীয় লাইফবোটটার দিকে একঝলক তাকিয়ে একটি বোতামে প্রফেসর হাত ছোঁয়াতেই সেটা তীব্র বাঁক নিয়ে পায়ের নীচে বড় হয়ে উঠতে থাকা আমেরিকান ভূখণ্ডের দিকে ধেয়ে গেল। তার পেটের তলা দিয়ে বের হয়ে আসা রশ্মিকামান থেকে তখন ঘন ঘন আগুন ছুটে যাচ্ছে পায়ের নীচে ছড়ানো ভূখণ্ডটার দিকে।

স্পেসপ্লেনগুলো মুখ বদলে তীব্র গতিতে ধাওয়া করছিল দ্বিতীয় লাইফবোটটাকে। সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মনিটরে খুলে যাওয়া একটা উপগ্রহ মানচিত্রের বুকে কিছু একটা খুঁজছিলেন প্রফেসর বোস। মিনিটখানেক পর শান্ত গলায় বললেন, ‘উপস্থিত নিরাপদ একটা জায়গার খোঁজ পাওয়া গেছে। ব্যাটারিতে যতটা শক্তি আছে তাতে বড়জোর মিনিটদশেক ওদের রেডারের চোখে অদৃশ্য থাকতে পারব আমরা। তবে সেটুকু সময়ই যথেষ্ট। আর ভয় নেই জিষ্ণু—’

বলতে বলতেই যানটা তীব্রগতিতে একটা বাঁক নিয়ে ছুটে গেল পৃথিবীর অন্য গোলার্ধের দিকে। পায়ের নীচে দ্রুত বদলে যাচ্ছিল ভূপৃষ্ঠের মানচিত্র। সমুদ্রের নীল জল আর উজ্জ্বল স্থলভূমির জায়গায় পায়ের নীচে ধেয়ে আসছে রাত্রির অন্ধকার। তার মধ্যে এখানে-ওখানে শহরগুলোর আলোর ঝিকিমিকি। মিনিটকয়েক সেইভাবে ছোটবার পর সেই একই গতিতে লাইফবোট সটান ঝাঁপ দিল নীচের দিকে। ঘন মেঘমণ্ডল ভেদ করে একখণ্ড পাথরের মতো তা দ্রুতগতিতে নেমে চলেছিল পায়ের নীচে ছড়িয়ে থাকা একটা গভীর অরণ্যকে লক্ষ করে।

মাটি থেকে দশ হাজার ফুট ওপরে এসে হঠাৎ তার পেছন থেকে একটা প্যারাসুট খুলে গিয়ে অবতরণের গতিকে কমিয়ে আনল। কিন্তু তবুও সেই তীব্র গতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করবার সাধ্য ছিল না প্যারাসুটটির। সামনের প্যানেলগুলো থেকে আপৎকালীন হাওয়াবালিশ বের হয়ে এসে ততক্ষণে যাত্রী দুজনকে নিরাপত্তার মোড়কে ঢুকিয়ে নিয়েছে। আসন্ন বিপদের সংকেত পেয়ে যানের যন্ত্রগণকের নির্দেশে যাত্রীদের আসনদুটো এইবার তাদের নিয়ে মাথার ওপর খুলে যাওয়া ছাদের ভেতর দিয়ে ছিটকে উঠল বাতাসে। দুলতে দুলতে তারা যখন মাটিতে নেমে আসছে ততক্ষণে তাদের যানটি ঘন অরণ্যের ডালপালা ভেদ করে সশব্দে এসে আছড়ে পড়েছে বৃষ্টিভেজা নরম মাটিতে।

‘এটা কোন জায়গা বাবা?’

অন্ধকারের মধ্যেই দ্রুত জিষ্ণুর আসনের দড়াদড়ি খুলে তাকে বের করে আনতে আনতে প্রফেসর জবাব দিলেন, ‘এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন অরণ্যের দেশ। এককালে এই এলাকার নাম ছিল অরুণাচলপ্রদেশ।’

‘আমরা— এখানে—’

‘হ্যাঁ জিষ্ণু। কী ঘটেছে, কেন পৃথিবীর কর্তৃপক্ষ একাঘ্নি ধ্বংস হবার দায় আমার ওপরে চাপিয়েছে তার ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত এখানেই লুকিয়ে থাকতে হবে আমাদের।’

‘কিন্তু এইখানে আমরা কোথায়—’

‘জায়গা আমি একটা মহাকাশ থেকেই বেছে রেখেছি জিষ্ণু। এখান থেকে কিলোমিটার বিশেক দূরে একটা নদী আছে। আগে সেইখানে পৌঁছোতে হবে আমাদের। এখন উঠে এস। হাতে সময় বেশি নেই। আমাদের তৈরি হতে হবে।’

অন্ধকার অরণ্যের মধ্যে ছোট্ট একটি জায়গায় লেজারের তীব্র আলোর দুটো রেখা বারবার এদিক-সেদিক জ্বলে উঠছিল। মড়মড় করে দুটি প্রাচীন গাছ একসময় ভেঙে পড়ল তাদের কামড়ে। তারপর তাদের লোহার মতো শক্ত, পুরোনো কাণ্ডগুলোকে অক্লেশে ফালি ফালি করে চিরে ফেলল শক্তিশালী লেজারছুরি দুটি। ঘণ্টাকয়েকের মধ্যে বিভিন্ন আকার আর আয়তনের বেশ কয়েকটা তক্তার স্তূপ গড়ে উঠল সেখানে। পুবের আকাশে তখন ভোরের প্রথম আলো ফুটে উঠেছে।

একটা কাঠের স্তূপের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া জিষ্ণুর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন একবার প্রফেসর। ঘুমোক ছেলেটা। একটু শক্তি সঞ্চয় করে নিক। সামনে এখন অনেক লড়াই রয়েছে তার।

রেডার প্রতিরোধক বর্মের কল্যাণে অন্যের চোখে অদৃশ্য অবস্থাতেই এখানে এসে নেমেছেন তিনি। কিন্তু তারপর সারারাত তাঁদের লেজার ছুরিগুলো কাজ করেছে। তার শক্তির তীব্রতা বেশি নয়, কিন্তু আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একটা গোটা দ্বীপ জুড়ে বসানো পৃথিবীর কেন্দ্রীয় কম্পিউটার বুদ্ধ-র দূরসংবেদী উপগ্রহের নজরদারিকে তা এড়াতে পারবে না। মানুষের বসতিহীন এই গভীর অরণ্যে ইলেকট্রনিক শক্তির ক্ষীণ বিচ্ছুরণ দেখে কারও সন্দেহ হলে তাঁদের খুঁজে বের করে ফেলতে তারপর মাত্রই কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে আর। ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর। গায়ের জামাটা খুলে ফেলেছেন। কাঠের নানা আকারের তক্তাগুলোকে তুলে এনে এনে একের পর এক জুড়ে দিতে দিতে তাঁর সুগঠিত শরীরের পেশিগুলো ফুলে ফুলে উঠছিল।

***

‘এটা কী বাবা?’

ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে সত্যব্রত দেখলেন জিষ্ণু কখন যেন ঘুম ভেঙে উঠে এসে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছিল। সেইদিকে একঝলক দেখে নিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে প্রফেসর বোস বললেন, ‘এটা একধরনের গাড়ি জিষ্ণু। বহুকাল আগে মানুষ যখন যন্ত্রের ব্যবহার জানত না, তখন তারা নিজের হাতে এইরকম গাড়িতে করে জিনিসপত্র টেনে নিয়ে যেত।’

‘তখন মানুষ প্লাজমা ড্রাইভের কথাও জানত না?’

‘না জিষ্ণু। সত্যি বলতে কি, মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও প্লাজমা ড্রাইভের ব্যবহার জানতাম না আমরা।’

‘তাহলে তখন মানুষ বুঝি এইরকম গাড়ি চালাত?’

প্রফেসর বোস হেসে মাথা নাড়লেন, ‘না। তখন আমরা পেট্রোল নামে এক ধরনের জিনিস পুড়িয়ে তাই দিয়ে গাড়ি চালাতাম। কিন্তু আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে মানুষ যখন প্রথম বুদ্ধিমান হয়ে উঠল, তখন তারা এইরকম গাড়ি বানাতে শিখেছিল।’

‘কিন্তু বাবা, আমরা তো লাইফবোটের প্লাজমা ড্রাইভটা দিয়েই—’

‘না জিষ্ণু। খোলা আকাশের তলায় আর কোনও ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রই আর চালাব না আমরা। প্লাজমা ড্রাইভটাকে আমি খুলে এনেছি। ওটা আমাদের কাজে আসবে। যানের পাশে রাখা আছে। তুমি সেটা নিয়ে আসবে?’

জিষ্ণু মাথা নেড়ে চলে গেল। খানিক বাদে দু-হাতে ধরে একটা বাক্স এনে নামিয়ে রাখল সে মাটিতে। জিনিসটা হালকা। বেশি ওজন নয় তার। প্রফেসর বাক্সটাকে যত্ন করে তুলে সাজিয়ে রাখলেন সদ্য তৈরি হওয়া ঠ্যালাগাড়িটার ভেতরের দিকে এক কোণে। যান থেকে নামিয়ে রাখা স্তূপাকৃতি যন্ত্রপাতিগুলো থেকে ছোট ছোট জিনিসপত্র জিষ্ণু তখন হাতে হাতে নিয়ে আসছে ঠেলাগাড়ির দিকে। প্রফেসর বোস তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে তার সঙ্গে কাজে হাত লাগালেন।

***

‘অ্যাডমিরাল সেন, কোনও সন্ধান পেলেন প্রফেসর বোসের?’

পর্দা থেকে অ্যাডমিরাল সেন ভুরু কুঁচকে একবার তাকালেন লালপিওতের দিকে। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, ‘আপনার সহযোগিতার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ অ্যাডমিরাল। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব নিজে আপনার সঙ্গে কথা বলে ধন্যবাদ জানাবেন আজ বিকেলে। কিন্তু, এই ঘটনার ব্যাপারে আর আপনার মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। বাকি ব্যাপারটার দায়িত্ব নিয়েছে পার্থিব কর্তৃপক্ষের একটি বিশেষজ্ঞ দল। এখন বিদায়।’

‘লোকটা আমাদের নাগাল থেকে বেরই হয়ে গেল শেষে। আধুনিকতম যন্ত্র ব্যবহার করেও গত চব্বিশ ঘণ্টায় কোনও সন্ধান মেলেনি যখন, তখন ধরে নেওয়া যায় যানটা কোনও কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। তুমি বরং এইবারে একটু বিশ্রাম নাও।’ পেছন থেকে জেমস আরিয়ানার গলা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন লালপিওতে। বৃদ্ধের মুখে উদ্বেগের স্পর্শ ছিল। পাশে এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে ফের বললেন, ‘গত একদিনের বেশি সময় তুমি এই আসন ছেড়ে একবারও ওঠনি। এবারে বরং—’

তাঁর কথাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে লালপিওতে বললেন, ‘না জেমস। আমার বিশ্রামের সময় নেই এখন। ধ্বংস ও হয়নি। পার্থিব বায়ুমণ্ডলে কোনও যান ধ্বংস হলে বুদ্ধর কোনও-না-কোনও সেনসরে সে শক্তিবিচ্ছুরণের খবর থাকত। তেমন কোনও খবর আমার কাছে আসেনি। কাজেই—’

বলতে বলতেই তাঁর সংযোগযন্ত্রটি ফের সচল হয়ে উঠছিল। পর্দায় ফুটে ওঠা সংকেতসংখ্যাগুলোর দিকে এক নজর দেখে লালপিওতে চাপা গলায় বললেন, ‘ঝুং জিয়ানের সংকেত।’

জেমস আরিয়ানা কৌতূহলি চোখে মনিটরের দিকে তাকিয়েছিলেন। অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘ঝুং জিয়ান! ‘বুদ্ধ’ গণনাকেন্দ্রের—’

‘হ্যাঁ জেমস। ঠিক ধরেছেন। গণনাকেন্দ্রের প্রধান কমুনিকেশন অফিসার। একে কিনতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমায়,’ বলতে বলতেই দ্রুত কয়েকটি বোতামে হাত ছুঁইয়ে যাচ্ছিলেন লালপিওতে। সেটা শেষ হতেই পর্দার বুকে দপদপ করতে থাকা লাল চিহ্নটা একমুহূর্তের জন্য সবুজ হয়ে উঠেই নিভে গেল একেবারে। সেই মুহূর্তের খণ্ডাংশে বুদ্ধ থেকে ভেসে আসা ঘনীভূত বিপুল তথ্যের চোরাস্রোত এসে আশ্রয় নিয়েছে তাঁর গণকযন্ত্রে।

পর্দার দিকে চোখ রেখেই জেমস আরিয়ানা বিস্মিত গলায় বললেন, ‘সাতশো টেরাবাইট! সে তো প্রচুর তথ্য। কী আছে ওতে?’

‘খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজছি জেমস। ধ্বংস যখন হয়নি তখন কোথাও না কোথাও অবতরণ নিশ্চয় করেছে এরা। নকল লাইফবোটের ছবিটাকে পাঠিয়েছিল পশ্চিম গোলার্ধের দিকে। কাজেই ধরে নেওয়া যায় এরা পূর্ব গোলার্ধেই কোথাও নেমেছে এসে। সেদিককার নির্জন এলাকাগুলোতে গত কয়েক ঘণ্টায় ইলেকট্রনিক যন্ত্রের যত শক্তিবিচ্ছুরণ ঘটেছে তার সমস্ত তথ্য একত্র করে আনিয়ে নিলাম এখানে। বাকি কাজটা গ্রোভারের বিশ্লেষক দলের।’

সংযোগযন্ত্রে সংকেত আসছিল ফের। সৈয়দ আব্রাহামের মুখ ভাসছে সেখানে। সেইদিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি ফুটে উঠল লালপিওতের মুখে। ছুরির মতো ধারালো গলায় বললেন, ‘স্বাগত বিজয়ী বীর। নিরীহ মানুষের গণহত্যা আর বুদ্ধিমান শত্রুর মোকাবিলা করা যে এক ব্যাপার নয় সে শিক্ষাটুকু আশা করি আপনার হয়েছে এইবার।’

সৈয়দ আব্রাহামের চোখদুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। কিন্তু কোনও প্রত্যুত্তর না দিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। তারপর ধীর গলায় বললেন, ‘আর একটা সুযোগ আমায় দিন অ্যাডমিরাল। আমি এর—’

‘বদলা নেবে, তাই তো? সে সুযোগও তুমি পাবে। তবে এবারে আমি নিজে তোমার সঙ্গে থাকব। এখন তৈরি হও। আমরা পৃথিবীতে যাচ্ছি।’

সৈয়দ আব্রাহামের চোখদুটো ঝিলিক দিয়ে উঠল, ‘তার মানে সরাসরি আক্রমণ! চমৎকার। সে উপদেশ আপনাকে আগেই একবার দিয়েছিলাম অ্যাডমিরাল। আমি সমস্ত বাহিনীকে—’

‘তুমি একটি মূর্খ সৈয়দ আব্রাহাম। সরাসরি আক্রমণ! হাঃ। পৃথিবীর একটা ছোট প্রদেশের অস্ত্রভাণ্ডারেও আমাদের গোটা উপনিবেশের চেয়ে বেশি অস্ত্র জমা থাকে সে তুমি জানো না?’

‘জানি অ্যাডমিরাল। সেই সঙ্গে এ-ও জানি যে, এরা আসলে ভীরু আর অপদার্থ, আরামপ্রিয় জানোয়ারের দল। একটা জোরদার আক্রমণ করতে পারলেই ভয় পেয়ে যাবে। আমার পরিকল্পনা হল, একসঙ্গে পৃথিবীর চারটে প্রতিরক্ষাকেন্দ্রে হামলা করা। আমাদের শক্তি কম হতে পারে অ্যাডমিরাল, কিন্তু—’

‘থামো তুমি,’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ধমক দিয়ে উঠলেন লালপিওতে, ‘অর্থহীন কথায় সময় নষ্ট করো না। এলিট কমব্যাট দলের থেকে সেরা সাতজন যোদ্ধাকে বেছে নাও। পাঁচজন পুরুষ, দুজন মহিলা। একটা ছোট হানাদার যানের অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে নিয়ে চেহারায় কিছু পরিবর্তন করে সেটিকে ‘জি’ শ্রেণীর আন্তর্গ্রহ প্রমোদতরণীর চেহারা দেবে। সেটির নাম হবে ‘প্র ত মিসিয়ারি। যানের প্রয়োজনীয় বৈধ নথিপত্র যথাসময়ে তোমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। ছ-ঘণ্টা সময় পাবে। পার্থিব সময় ভোর চারটেয় যাত্রার জন্য তৈরি থাকবে। সাধারণ নাগরিক পোশাকে। বাকি ব্রিফিং যাত্রাপথে দেওয়া হবে তোমাদের।’

সৈয়দ আব্রাহামের মুখে বিভ্রান্তি আর রাগের বিচিত্র একটা মিশ্রণ খেলা করে যাচ্ছিল। বহু কষ্টে নিজের আবেগকে দমন করে তিনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই তাঁর সংযোগ কেটে দিয়ে অন্য একটি পর্দার দিকে মুখ ঘুরিয়ে লালপিওতে উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘বলো গ্রোভার। কিছু পেলে?’

গ্রোভারের মুখে কম উত্তেজনার চিহ্ন ছিল না। শান্ত গলায় জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ অ্যাডমিরাল। আপনার হিসেবে ভুল হয়নি। তথ্য বিশ্লেষণ করে অরুণাচলের জঙ্গলের একটা এলাকা থেকে কিছু ক্ষীণ ইলেকট্রনিক সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। আমার বিশ্লেষণ বলছে, ওগুলো কম শক্তির কিছু লেজার বিচ্ছুরণ। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ নির্ধারিত করা হয়েছে। ত্রুটির পরিমাণ কুড়ি বর্গমিটার।’

‘লেজার বন্দুক?’

‘সম্ভবত তা-ই অ্যাডমিরাল। আরিয়ানা অ্যালগরিদমের বিশ্লেষণ বলছে ওগুলো মানুষের তৈরি কৃত্রিম শক্তিবিচ্ছুরণ হবার সম্ভাবনা শতকরা পঁচানব্বই।’

লালপিওতে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে জেমস আরিয়ানার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ জেমস। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে তোমার আবিষ্কৃত যে অ্যালগরিদম দিয়ে মহাশূন্য থেকে ভেসে আসা ইলেকট্রনিক শক্তিবিচ্ছুরণের চরিত্র নির্ণয়ের পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল, আজ সেই তুচ্ছ আবিষ্কারটাই সম্ভবত আমাদের বিপ্লবের পথের সবচেয়ে বড় বাধাটাকে সরিয়ে দিতে চলেছে। আমি চলি—’

‘হ্যাঁ। এইবার একটু বিশ্রাম নাও। সেটা তোমার এখন প্রয়োজন।’

মৃদু হেসে লালপিওতে বললেন, ‘না জেমস। বিশ্রামের সময় এখন নয়। এখন শিকারে যাবার সময়। তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আমার সাফল্য কামনা করো।’

***

‘নাম?’

‘সিমোন ভার্গিস মিথরান।’

অভিবাসন দফতরের কেরানিটি পরিচয়পত্রের ছবির সঙ্গে সামনে দাঁড়ানো অভিজাত চেহারার উপজাতীয় মহিলাটির মুখ মিলিয়ে নিলেন। সামনের গণকযন্ত্রে পর্যটকটির যাবতীয় তথ্য ভেসে উঠছে। পরিচয়পত্রের তথ্যগুলোর সঙ্গে সেগুলো মিলিয়ে নিতে নিতেই প্রশ্ন করছিলেন তিনি, ‘পৃথিবীতে আসবার উদ্দেশ্য?’

‘এশিয়া মহাদেশের অরুণাচল এলাকায় পূর্বপুরুষের জন্মভিটা দেখেতে এসেছি।’

‘সঙ্গে লোক আছেন আটজন। এত মানুষ নিয়ে এলেন কেন?’

মহিলাটি অলস ভঙ্গীতে হাতের আঙুল মটকালেন একবার। মুখে বিরক্তির চিহ্ন। তারপর বললেন, ‘সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচারক ও দেহরক্ষী নিয়েই আমি পথ চলি অফিসার। সেটাই আমার সমাজের দস্তুর। তা ছাড়া এই যানটি চালাবার জন্য একজন অভিজ্ঞ পাইলট ও একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞও রয়েছেন। এই প্রমোদতরণীর সঙ্গে সঙ্গে এঁদের সবারই মঙ্গল কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা বৈধ কাগজপত্র রয়েছে।’

অফিসার সম্বোধন শুনে কেরানিটি খুশি হয়েছেন দেখা গেল। টুরিস্ট মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজকাল মঙ্গলে বোধ হয় আপনার মতো অনেক অভিজাত মানুষ পাকাপাকি বাস করতে আরম্ভ করেছেন, তা-ই না ম্যাডাম?’

‘হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। জায়গাটা অনেক বদলে গেছে। বিয়ে হয়ে প্রথম যখন গিয়ে পৌঁছালাম, সেসময় তো কৃত্রিম পার্থিব অভিকর্ষের বন্দোবস্তও ছিল না। একেবারে আদিম জায়গা ছিল। গত চল্লিশ বছরে কত যে বদল হল! আমার স্বামীর মতো কিছু উদ্যোগী মানুষের ক্রমাগত চেষ্টায় সেটা সম্ভব হয়েছে। ছুটি কাটাতে চলে আসুন-না একবার মঙ্গলে! আমাদের অতিথি হবেন। অসাধারণ সুন্দর সব প্রমোদক্ষেত্র তৈরি করছে আজকাল সেখানে আমাদের ‘মিথরান এন্টারটেইনমেন্ট।’ ভালো লাগবে দেখবেন। এই যে আমার কার্ড রেখে দিন একটা।’

কেরানিটির কাগজপত্র পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছিল। হাসিমুখে একটি ছোট্ট নমস্কার করে তিনি বললেন, ‘আপনার যাত্রা আনন্দময় হোক ম্যাডাম। আপনার যানটিকে অভিবাসন স্টেশন ছেড়ে আবহমণ্ডলে ঢোকবার ছাড়পত্র দেওয়া হল। তিন নম্বর এয়ারলক-এ আপনার যান ‘প্রমোদ তরণী মিসিয়ারি’ অপেক্ষা করছে। শুভ সন্ধ্যা।’

‘শুভ সন্ধ্যা অফিসার।’ ছোট্ট একটি নমস্কার করে মহিলাটি একপাশের এয়ারলকের দিকে এগিয়ে গেলেন ধীর পায়ে। তাঁর পেছন পেছন মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী জন আব্রাহাম মুখতার।

***

‘কো-অর্ডিনেট পাওয়া গেছে অ্যাডমিরাল। লক্ষ্যবস্তু আর ত্রিশ কিলোমিটার দূরে।’

‘ইঞ্জিন বন্ধ করুন। সব আলো নিভিয়ে দিন। প্রতিরক্ষাকবচ ও কম্পিউটার নিয়ন্ত্রক চালু করুন। লক্ষ্যবিন্দুর ঠিক পাঁচ মিটার ওপরে নিয়ে যানকে স্থির করুন। পাইলট বাদে বাকি কমব্যাট ফোর্সের সদস্যরা আমার সঙ্গে নীচে নামবার জন্য তৈরি হন।’

যানের বাইরের আবরণটি তখন বাতাসের সঙ্গে ঘষা খেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেই আবছা আলো ছড়িয়ে, ঘন মেঘের রাশি ছিন্নভিন্ন করে নীচের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল ছদ্মবেশী হানাদার যান।

***

‘বাবা, কাল রাত্রের আলোটা আবার—’ জিষ্ণু ফিসফিস করে ডাকছিল।

‘দেখেছি। প্লাস্টিকের থেকে মাথা বের কোরো না জিষ্ণু।’ তীব্র একটা আলোর রেখা একটা তীক্ষ্ণ ছুরির মতো আকাশ থেকে নেমে গাছগুলোর মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। ডালে ঝুলন্ত তড়িৎপ্রতিরোধী প্লাস্টিকের থলেদুটিকেও ছুঁয়ে দেখল একসময় তা। তারপর এগিয়ে গেল সামনের দিকে।

‘প্লাস্টিকের বাইরে শরীরের কোনও অংশ বের হয়ে ছিল না তো তোমার জিষ্ণু?’ খানিক বাদে চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন প্রফেসর বোস।

‘উঁহু। আইপিসের মধ্যে দিয়ে দেখেছি।’

‘ভালো। বায়োস্ক্যান করছিল এরা। মোমমাখানো প্লাস্টিকের আবরণের মধ্যে থেকে আমাদের জৈব-বৈদ্যুতিক সংকেত ধরতে পারবে না।’

‘ধরতে পারলেই বা কী হত? জঙ্গলে তো অনেক জীবজন্তু আছে। স্ক্যানারে আমাদের আলাদা করে বুঝতে পারত নাকি?’

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রফেসর বোস বললেন, ‘পারত। অনুমান করো তো কেমন করে?’

‘মানুষের শরীরের জৈব বৈদ্যুতিক সংকেত অন্যদের চেয়ে আলাদা বলে?’

‘শরীরের নয়, মস্তিষ্কের। শারীরিক জৈব বৈদ্যুতিক তরঙ্গে মানুষ আর পশুর তফাতটা সূক্ষ্ম। তাকে ধরবার ক্ষমতা এখনও কোনও স্ক্যানারের হয়নি। কিন্তু ওরা আমাদের মস্তিষ্কতরঙ্গ টের পেত জিষ্ণু। মানুষের মস্তিষ্ক থেকে ক্রমাগত যে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বের হয়ে চলে তার বৈশিষ্ট্য আর সব জীবের চেয়ে একেবারে আলাদা।’

আলোটা আবার বহুদূর থেকে এঁকেবেঁকে ফিরে আসছিল। কথা বন্ধ করল মানুষদুটি। জঙ্গলে নৈঃশব্দ নেমে এসেছে ফের। মাথার ওপর যানটি এইবার অনেকটা নিচুতে নেমে এসেছে। প্রাগৈতিহাসিক কোনও উড়ুক্কু রাক্ষসের মতো ধীরে ধীরে উড়ে চলেছে গাছগুলোর একেবারে মাথার কাছ ঘেঁষে তার শিকারের খোঁজে।

তার যন্ত্র চোখে অবশ্য কোন মানুষের চিহ্ন ধরা পড়ল না। এইখানে অরণ্য একেবারে আদিম। মানুষের পা পড়েনি এখনও সম্ভবত এই অঞ্চলটিতে। কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে শয়ে শয়ে অতিকায় মৌচাক ঝুলে আছে গাছগুলো থেকে। তাদের মধ্যে মিশে থাকা দুটো ঝুলন্ত মোমজড়ানো প্লাস্টিকের থলেকে মানুষবাহী হ্যামক বলে চিনতে পারার সাধ্য ছিল না যানের স্ক্যানারের।

বেশ কয়েকঘণ্টা গোটা এলাকাটার ওপর ঘুরে ঘুরে তারপর ভোররাতের দিকে হঠাৎ গতি বাড়িয়ে তিরবেগে যানটা ছুটে গেল পেছন দিকে। খানিক বাদে বহু দূর থেকে আগুনের আকাশছোঁয়া আলো জেগে উঠল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই অগ্নিকুণ্ডের থেকে একটা আগুনের শিখা তিরের মতো সটান ওপরের দিকে উঠে অন্ধকার আকাশের গায়ে মিলিয়ে গেল।

প্রফেসর সাবধানে থলের মুখের বাঁধন খুলে মুখ বাড়িয়ে সেইদিকে তাকিয়েছিলেন। এইবার মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘বাইরে বের হতে পার জিষ্ণু। গত দু-রাত ধরে যে ভয়টা পেয়ে এইভাবে লুকিয়ে থাকতে হল সে ভয় এবারে কেটে গেছে।’

পুবদিকের আকাশ ফরসা হয়ে আসছিল। গাছ থেকে নীচে নেমে এসে প্লাস্টিকের হ্যামকদুটোকে গুটিয়ে রেখে একটা বড়সড়ো ঝোপের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রফেসর বোস। তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ছুরির ছোট্ট একটা টান দিতে লতাপাতায় বোনা ঢাকনাটা খুলে পড়ল মাটিতে। ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা ঠ্যালাগাড়িটাকে বের করে আনতে আনতে প্রফেসর বোস বললেন, ‘আর সময় নষ্ট নয়। সকালের খাওয়া সেরে নটার মধ্যে রওনা হয়ে গেলে আজ সূর্যাস্তের আগেই নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাব আমরা।’

‘কিন্তু বাবা, ওরা যদি আবার—’

‘সে ভয় নেই জিষ্ণু। যানটা পার্থিব নয়। এই জাতের পুরোনো মডেলের জি শ্রেণীর প্রমোদতরণী বহুকাল হল এ গ্রহ থেকে বাতিল হয়ে গেছে। মঙ্গল উপনিবেশে এখনও এর ব্যবহার হয়। ওখান থেকেই এসেছে এটা। মঙ্গলের কোনও প্রমোদযানকে দু-দিনের বেশি ভিসা দেওয়া হয় না জিষ্ণু। যানটা কাল থেকে এইখানে ঘোরাঘুরি করছে। তার মানে আজকের পরে তার আর এখানে থাকবার উপায় নেই। আমাদের পুলিশ এ ব্যাপারে কড়াভাবে নিয়ম মেনে চলে। এখন তৈরি হয়ে নাও। আমি দেখছি কিছু তাজা খাবারের বন্দোবস্ত করা যায় কিনা।’

খানিক বাদে কাছের একটা জলধারা থেকে হাত মুখ ধুয়ে জিষ্ণু ফিরে এল। প্রফেসর বোস একটা ছোট জীবের ছাল ছাড়াচ্ছিলেন হাতের ছুরিটা দিয়ে। জিষ্ণু একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ‘বাবা, এটা—’

‘এই প্রাণীটাকে বলে গোধিকা। এর মাংস খুব সুস্বাদু হয়। আমাদের আজকের খাবার।’

‘খাবার? আমরা এটাকে—’

‘খাব জিষ্ণু। কৃত্রিম প্রোটিন সংশ্লেষণ খুব বেশিদিনের পুরোনো নয়। মাত্রই পঞ্চাশ-ষাট বছর হল আমরা প্রাকৃতিক মাংস খাওয়া ছেড়েছি। তার আগে— ও কী? কোথায় যাচ্ছ তুমি?’

জিষ্ণু ততক্ষণে একছুটে খানিক দূরে গিয়ে উপুড় হয়ে বসে পড়েছে অন্যদিকে মুখ করে।

হাতের ছুরিটা নামিয়ে রেখে আস্তে আস্তে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রফেসর বোস। তার পিঠে হাত রেখে নরম গলায় ডাকলেন, ‘জিষ্ণু! উঠে এস। এই জঙ্গলে আমাদের সামনে এখন অনেক লড়াই পড়ে আছে। এ লড়াইয়ের শেষ অঙ্কের অভিনয় হবে আজ থেকে পনেরো বছর পরে। আমি তখন বেঁচে থাকব কি না জানি না। তোমাকে অনেক বড় দায়িত্ব নিতে হবে যে। হয়তো এই পরিচিত পৃথিবীটাকে বাঁচাবার ভার থাকবে তোমার ওপরেই। তোমাকে খুব শক্তপোক্ত মানুষ হয়ে উঠতে হবে। এইখানে প্রকৃতি যতটুকু দেবে তাই নিয়ে বহুদিন বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। ওঠো।’

প্রফেসর বোসের গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। আস্তে আস্তে মুখ ঘুরিয়ে তাঁর দিকে তাকাল জিষ্ণু। তার দশ বছরের মুখটাতে অনেক বিচিত্র আলোছায়া খেলে যাচ্ছিল। একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বাবার হাত ধরল সে। বলল, ‘চলো। আর আমি কখনও এমন করব না।’

***

জ্বলন্ত আগুন থেকে একে একে বাঁশের চোংগুলো বের করে এনে ছুরি দিয়ে কেটে তাদের ভেতর থেকে ধোঁয়া ওঠা মাংসের খণ্ডগুলো বের করে আনছিলেন প্রফেসর বোস। একটা টুকরো হাতে তুলে নিয়ে একটু অস্বস্তিভরা চোখে দেখল জিষ্ণু। তারপর একরকম জোর করেই সেটাকে মুখে ঢুকিয়ে দিয়েই চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার।

‘ভালো লাগছে?’

মুখভরা খাবার নিয়ে ঘাড় নাড়ল জিষ্ণু। দশ বছরের জীবনে এই প্রথম প্রাকৃতিক মাংসের স্বাদ পেয়েছে সে। যন্ত্রের সংশ্লেষিত কৃত্রিম প্রোটিনখণ্ডে অভ্যস্ত জিভে বড় ভালো লাগছিল সেই স্বাদ।

‘তোমার মা-ও খুব ভালোবাসতেন আসল মাংস বা প্রাকৃতিক ভাত খেতে।’

কথাটা শুনে হঠাৎ মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল জিষ্ণুর। মা-কে সে কখনও দেখেনি। তার মা মহাকাশবিজ্ঞানী ছিলেন। তার জন্মের এক বছর পর একটা মহাকাশ ফেরি দুর্ঘটনায় ইউরোপার আকাশে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকেই সে বাবার সঙ্গে চাঁদের গবেষণাগারে এতটা বড় হয়ে উঠেছে। কখনও কখনও পৃথিবীতে এলে কলকাতা বা দিল্লি বা নিউ ইয়র্কের মতো শহরেই কয়েকদিন ঘোরাফেরা করে ফিরে গেছে সে। সেইসব শহরের বাইরে পৃথিবীটা যে এত বড় আর এত অদ্ভুত হতে পারে সে নিয়ে কোনও ধারণাই ছিল না তার এতদিন।

***

গভীর মহাকাশের অন্ধকার রাজত্ব পেরিয়ে যানটা ছুটছিল। পৃথিবীর আকর্ষণক্ষেত্র পার হয়ে নিশ্চল মহাকাশ সাঁতরে তীব্রগতিতে তা এগিয়ে চলেছে মঙ্গলের ক্রমশ বড় হয়ে উঠতে থাকা গোলকটার দিকে।

‘এবারও ফাঁকি দিল আমাদের শয়তানটা।’ হাত মুঠো করে আপন মনেই বিড়বিড় করছিলেন লালপিওতে।

যানের কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে থেকে একটা নিচু ব্যঙ্গভরা গলা ভেসে এল, ‘আমরা কি যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম অ্যাডমিরাল?’

‘কী বলতে চাইছ তুমি সৈয়দ?’

‘বলতে চাইছি, একটা নিশ্চিত রাস্তা ছিল একে নিকেশ করবার। আমরা সেটা নিজেদের দোষেই হাতছাড়া করলাম না কি?’

‘কোন রাস্তার কথা বলছ তুমি?’

সৈয়দ আব্রাহাম ঘুরে বসে ঠান্ডা চোখে তাকালেন অ্যাডমিরাল লালপিওতের দিকে। তারপর বললেন, ‘লোকটা পায়ে হেঁটে ছাড়া অন্য কোনও যানবাহনে পালায়নি সেটা তো নিশ্চিত জানতাম আমরা। যেখানে ওর যানটা ভেঙে পড়েছে সেখানে ছড়িয়ে থাকা কাঠকুটোর টুকরোগুলো, আর যানটার দুটো চাকার একটাও না থাকা— এ থেকেই তো বোঝা যাচ্ছিল ও একটা হাতে টানা প্রাচীন যান তৈরি করে সঙ্গে নিয়ে গেছে। তার মানে জায়গাটার বিশ-পঁচিশ মাইলের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে ছিল ও। কোনও একটা নিচু শক্তির আণবিক বোমা জায়গাটায় বিস্ফোরণ করালে অন্তত চল্লিশ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে সমস্ত জীবিত প্রাণী তাতে ঝলসে মারা যেত। কিন্তু আমি বারংবার বলা সত্ত্বেও আপনি সে সিদ্ধান্তটা নিতে ভয় পেলেন।’

লালপিওতের হাতের আঙুলগুলো কোমরে আটকানো আগ্নেয়াস্ত্রটার ওপরে চেপে বসছিল। ঠান্ডা গলায় কেটে কেটে বললেন, ‘আমি— ভয় পেয়েছি? মূর্খ, ওখানে ওই বিস্ফোরণ ঘটালে আমরা কেউ ছাড়া পেতাম? পৃথিবীর জেলখানায় থাকবার শখ তোমার আজও মেটেনি সৈয়দ, তাই না?’

হঠাৎ ছোট একটা লাফ দিয়ে উঠে এসে তাঁর সামনে দাঁড়াল সৈয়দ। মুখটায় তার একটা অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে গেছে। নিচু গলায় বলল, ‘জেলখানায় আটকালে সেখান থেকে পালাবার ব্যবস্থা করতে আমার বেশি সময় লাগত না অ্যাডমিরাল। কিন্তু আপনি ভয় পেয়ে গেলেন। পৃথিবীর জেলখানা থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য এতবড় একটা সুযোগ—’

কথাটা শেষ করা হল না সৈয়দ আব্রাহামের। তার আগেই অ্যাডমিরালের হাতে উঠে আসা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শক্তির একটা নীলাভ ঝলক ছুটে এল তাঁর দিকে।

যানের দুর্ঘটনাকালীন বায়ুপরিশোধক যন্ত্রগুলো পোড়া গন্ধমাখা ধোঁয়ার কুণ্ডলীটাকে দ্রুত বাইরের শূন্যতার দিকে ছুড়ে দিচ্ছিল। একটা নীলাভ ধোঁয়ার গোলক হয়ে সেটা তখনও যানটার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলেছে। সেইদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিয়ে ফের শান্ত গলায় লালপিওতে বললেন, ‘মঙ্গলের সঙ্গে যোগাযোগ করো। আমি গ্রোভারের সঙ্গে কথা বলতে চাই। এখুনি—’

***

গুম গুম শব্দটা অনেকক্ষণ ধরেই শোনা যাচ্ছিল। নিচু একটা টিলার জঙ্গলঘেরা মাথাটা পার হতেই এইবার নদীটাকে চোখে পড়ল। কূলহীন একটা সুবিশাল জলধারা, বর্ষার জল পেয়ে ফুলেফেঁপে উঠে তিরবেগে ছুটে চলেছে। সন্ধের আধো অন্ধকারে তার আবছায়া চেহারাটা একটু একটু বোঝা যায় শুধু। সেইদিকে তাকিয়ে জিষ্ণু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘এই নদীটা আমাদের পেরোতে হবে?’

‘হ্যাঁ এবং না।’

‘তার মানে?’

‘মানে হল আমরা নদীটাকে পার হব, কিন্তু গোটা নদীটা নয়। এই দূরবিনটা নিয়ে সামনের দিকে দ্যাখো। কিছু দেখতে পাচ্ছ?’

অবলোহিত সংবেদী দূরবিনের সবজেটে পটভূমিতে ছুটন্ত জলের সেই স্রোতটাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। তার একেবারে মাঝখানে কালো একখণ্ড দ্বীপ দাঁড়িয়ে আছে। জিষ্ণু ফের একবার ভালো করে সেদিকে দেখল। না, দ্বীপ নয়, একটা পাহাড়। নদীটার বুক ভেদ করে ওপরের দিকে উঠে গেছে।

‘দ্বীপটা দেখতে পেয়েছ তো? আমরা ওইখানেই আজ রাতে ঘুমোব জিষ্ণু। ওই আমাদের আস্তানা হবে এখনকার মতো।’

‘আজ রাতে— ওই নদীটা পেরিয়ে—’

তার গলার কাঁপুনিটা কান এড়াল না প্রফেসর বোসের। মৃদু হেসে তার পিঠে ছোট একটা চাপড় মেরে বললেন, ‘আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগের মানুষও কিন্তু এই নদীটা পার হবার কৌশল জানত। সামান্য একটা যন্ত্র লাগে তার জন্য। এইবারে আমরা সেটা তৈরি করব। যানের ভেতর যে অগ্নিনিরোধক পলিমারের কাপড় রয়েছে তার বাক্সটা বের করো—’

***

টুলবক্স থেকে কিছু স্টিলনের সুতো নিয়ে নিয়ে বিরাট কাপড়ের টুকরোটার চারপাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেলাই শেষ করে স্টিলনের প্রান্তদুটো আগুন জ্বেলে একসঙ্গে গলিয়ে মিশিয়ে দিলেন প্রফেসর বোস। তারপর জিষ্ণুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এটা কী তৈরি করেছি বুঝতে পারছ?’

‘উঁহু।’

‘এটা একটা উড়োযান।’

জিষ্ণু একটু অবাক হয়ে তার বাবার মুখের দিকে চাইল। তিনি রসিকতা করছেন কিনা তা-ই বোঝবার চেষ্টা করছিল সে।

প্রফেসর বোস জিষ্ণুর চাউনি দেখে তার মনের কথাটা ধরতে পেরেছিলেন বোধ হয়। মৃদু হেসে বললেন, ‘অন্যপাশটা ধরো। এটাকে আমাদের গাড়ির ওপর বিছিয়ে দিতে হবে প্রথমে।’

গাড়ির ওপর কাপড়টাকে ছড়িয়ে দিয়ে জিষ্ণুকে তার দড়ির পাশগুলো গাড়ির চারপাশে ভালো করে বাঁধতে বলে প্রফেসর বোস গাড়ির ওপরে উঠে স্পেসস্যুটের বাক্স থেকে উচ্চচাপে রাখা হিলিয়ামের কয়েকটা ক্যান বের করে আনলেন। জিষ্ণুর কাজ ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। কাপড়ের ঢাকনার তলায় উঁকি মেরে বাবার হাতে ক্যানগুলো দেখে সে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘ওগুলো তো স্পেসওয়াকের সময় বিপরীত ধাক্কা তৈরি করে এদিক ওদিক চলবার কাজে লাগে! এখানে—’

‘দেখতে পাবে জিষ্ণু। সন্ধে হয়ে আসছে। এখনই পাহাড় থেকে বাতাসের ঢল নামবে নদীর দিকে। একটু অপেক্ষা করো শুধু।

নির্জন অরণ্যে সন্ধে গভীর হচ্ছিল। মাথার ওপরে তখনও রংবেরঙের অজস্র পাখি বাতাসে ভেসে বাসায় ফিরে যাচ্ছে। সেইদিকে তাকিয়ে জিষ্ণুর চোখ ফিরছিল না। এতদিন এদের শুধু সে চাঁদের স্টেশনের মহাগণক চিত্রক ৪ এর তৈরি ত্রিমাত্রিক প্রক্ষেপণেই দেখেছে। কিন্তু তাতে তো মুখের ওপর এই হাওয়ার স্পর্শ, বনের এমন সুন্দর গন্ধ মাখা থাকত না!

‘হাওয়া বইতে শুরু করেছে জিষ্ণু। গাড়ির ওপর উঠে বসো তাড়াতাড়ি।’ বাবার ডাকের সঙ্গে সঙ্গেই একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দে সম্বিত ফিরে এল জিষ্ণুর। শব্দটা কাপড়ে ঢাকা গাড়িটার ভেতর থেকে আসছিল। তাড়াতাড়ি কাপড়ের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে তার চোখে পড়ল, একটা হিলিয়ামের ক্যানের মুখ খুলে ধরেছেন প্রফেসর। তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ করে স্বচ্ছ সেই গ্যাসের একটা ধারা ক্যান থেকে ছাড়া পেয়ে মাথার ওপরে বাঁধা বিশাল কাপড়ের টুকরোটাকে ফুলিয়ে তুলছে তখন। জিষ্ণু তাড়াতাড়ি গাড়ির ওপর বাবার পাশে উঠে বসল।

ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করছিল হিলিয়ামে ভরা পলিমার কাপড়ের ঢাকনা। গাড়ির ধারে বাঁধা দড়িগুলো টানটান হয়ে উঠছে ক্রমশ। তারপর একসময় আস্তে আস্তে নড়ে উঠল গোটা গাড়িটা। মাথার ওপর তখন বিরাট একটা অর্ধগোলকের মতো ফুলে উঠেছে সেই আদিম উড়োযান, কয়েক শতাব্দী আগে যাতে চেপে মানুষ প্রথম মাটি ছেড়ে আকাশের পথে অভিযান শুরু করেছিল।

তারপর, পাহাড় থেকে বয়ে আসা সন্ধ্যার বাতাস তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল পাহাড়ের কোল ছাড়িয়ে খরস্রোতা সেই নদীর বুকের দিকে।

অবলোহিত সংবেদী দূরবিনের পর্দায় আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছিল দ্বীপটা। অতিকায় একটা চুনাপাথরের পাহাড়কে ঘিরে সরু একটু সমতল জমি। অতিকায় বেলুনটা তার ওপরে গিয়ে পৌঁছুতে একটা ছুরি বের করে বেলুনের কাপড়ের গায়ে কয়েকটা বড় বড় ফালা করে দিলেন প্রফেসর। আটকে থাকা গ্যাস হু হু করে বের হয়ে যাচ্ছিল সেইখান দিয়ে। আস্তে আস্তে ছোট হয়ে এল অতিকায় বেলুন। বাতাসে ভাসবার ক্ষমতা হারিয়ে এইবারে সে ধীরে ধীরে নেমে এল সেই সমতল জমির গায়ে।

বিশ-পঁচিশ হাত চওড়া ঝোপঝাড়ে ঘেরা জমি পেরিয়েই মাথা উঁচু করে ছিল বিরাট পাহাড়টা। চাঁদ উঠেছে আকাশে। তার আলোয় পাহাড়ের সাদাটে শরীর চকচক করছিল। সেইদিকে তাকিয়ে জিষ্ণু হঠাৎ বলল, ‘কিন্তু এইখানে এই জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থেকে— কী লাভ হবে বাবা?’

প্রফেসর বোস গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছিলেন। জিষ্ণুর কথা শুনে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে খানিকক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘খুব বড় একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে আমাদের জিষ্ণু এই জঙ্গলে বসে। তুমি যদিও এখনও সবটা বুঝবে না, তবু সহজ করে বলি, সুইফট টাটল ধূমকেতুটার মুখ কয়েকটা বিস্ফোরণে খুব সূক্ষ্মভাবে ঘুরে গেছে পৃথিবীর দিকে। এই মুহূর্তে সেটা এতটাই সূক্ষ্ম যে হঠাৎ করে কারও নজরে না পড়লে তাকে কেউ খেয়াল করবে না। আমি একরকম হঠাৎ করেই সেটা জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু সে খবর পৃথিবীকে জানাবার আগেই মঙ্গল উপনিবেশ আমাদের গবেষণাকেন্দ্রে আঘাত করল—’

‘কিন্তু বাবা, আমরা তো দিল্লির কেন্দ্রীয় সংস্থাকে সব তথ্যপ্রমাণ দেখিয়ে—’

‘না জিষ্ণু। ভেবে দেখো, আমাদের যানের ইলেকট্রনিক বিচ্ছুরণ একমাত্র বুদ্ধ-র দূরসংবেদী উপগ্রহের চোখেই ধরা পড়তে পারে। সেই তথ্যও ওরা চুরি করতে পেরেছে সামান্য সময়ের মধ্যে, তারপর যেভাবে ওরা আমাদের অনুসরণ করে পৃথিবীর সুরক্ষাবলয়কে এড়িয়ে এই জঙ্গলে এসে হানা দিয়েছিল তা থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার। পৃথিবীতে ওদের হাত অনেক লম্বা। এমনকী বুদ্ধর চালকমণ্ডলীতেও নিঃসন্দেহে ওদের লোকজন আছে। পার্থিব কাউন্সিলকে সব বলতে গেলে আমাদের প্রকাশ্যে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে ওরা আমাদের ছাড়বে না। হয়তো সব কথা খুলে বলবার আগেই—না, না সে ঝুঁকি আমি কোনও মূল্যেই নিতে রাজি নই।’

জিষ্ণু একটু অবাক হয়ে প্রফেসর বোসের দিকে চাইল। তারপর বলল, ‘তুমি— ভয় পাচ্ছ বাবা?’

‘না জিষ্ণু, ভয় নয়। আমাদের প্রাণের দাম আর কতটুকু। পৃথিবীকে রক্ষা করবার জন্য প্রাণ দিতে আমার কোনও ভয় নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে পৃথিবীকে বাঁচাবার একটা চেষ্টা করবার সুযোগ আর আমি পাব না। এই মুহূর্তে মানুষের হাতে যে অস্ত্রশস্ত্র আছে, অতবড় একটা ধূমকেতুকে ধ্বংস করবার জন্য তা যথেষ্ট নয়। প্রতিরক্ষা বিভাগের ভবিষ্যৎ কর্মপ্রণালী ও প্রযুক্তি উদ্ভাবণের পরিকল্পনাও আমার অজানা নয়। আগামী বিশ বছরের মধ্যে সেইরকমের শক্তিশালী কোনও অস্ত্র বানাবার পরিকল্পনা আমাদের শান্তিপ্রিয় বৈজ্ঞানিকদের নেই। সে ক্ষমতা আছে শুধু আমার নতুন আবিষ্কার এই একাঘ্নির। বস্তু-প্রতিবস্তুর সংঘর্ষে যে শক্তিবিচ্ছুরণ করতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র, তাকে সহ্য করবার ক্ষমতা থাকবে না ওই ধূমকেতুর। শোনো জিষ্ণু, সবাই জানুক আমরা হারিয়ে গেছি। তারপর এইখানে, সবার অলক্ষ্যে বসে আমরা দুজন মিলে ফের গড়ে তুলব আমার একাঘ্নিকে। তারপর অপেক্ষায় থাকব। যেদিন প্রয়োজন হবে—’

‘কিন্তু বাবা, এখানে, এই খোলা আকাশের নীচে— কেমন করে—’

‘খোলা আকাশের নীচে নয় জিষ্ণু। দূরসঞ্চার উপগ্রহদের নজর খুব তীক্ষ্ণ। কোনও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলেই তার ইলেকট্রনিক ঝলক ওদের চোখে ধরা পড়ে যাবার বিরাট সম্ভাবনা থেকে যাবে ওতে। আমরা কাজ করব— ওই পাহাড়ের ভেতরে। পুরু পাথরের আস্তরণের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়।’

‘পাহাড়ের ভেতরে— কিন্তু—’

‘কাল সকালের জন্য অপেক্ষা করো জিষ্ণু। মাথার ওপরে তাকিয়ে দ্যাখো! পাহাড়টার গায়ে একটা বিরাট গর্তের মুখ দেখছ? চুনাপাথরের পাহাড়। ওর ভেতরে উপযুক্ত চেহারার কোনও প্রাকৃতিক গুহার খোঁজ আমরা পাবই। না পেলে এই এলাকার অন্য কোথাও, অন্য কোনও পাহাড়ে খুঁজে দেখতে হবে আমাদের। জায়গা আমরা খুঁজে বের করবই জিষ্ণু। সবার চোখের আড়ালে নিরাপদে কাজ করবার জন্য উপযুক্ত জায়গা—’

***

‘সাবধানে এগোবে। ঝুঁকি নেবে না। কথা বলবার জন্য রেডিয়ো ব্যবহার করবে। পুরু পাথরের আস্তরণের বাইরে ওর সংকেত পৌঁছোবে না। কোনও অবস্থাতেই হেলমেট খুলবে না। এসব গুহায় বিষাক্ত গ্যাসের অস্তিত্ব থাকে অনেক সময়।’ জিষ্ণুর মাথায় মহাকাশের পোশাকের হেলমেট আটকে দিয়ে পিঠের অক্সিজেনের ক্যানটা তার সঙ্গে জুড়তে জুড়তে প্রফেসর বোস বলছিলেন। তাঁর নিজের হেলমেটের উঁচু করে রাখা ভাইসরের ভেতর থেকে মুখটা ভারী ক্লান্ত দেখাচ্ছিল প্রফেসরের। আগের রাতটা তাঁর একেবারে বিনিদ্র কেটেছে। কিন্তু বিশ্রাম নেবার অবকাশ এখন নয়।

‘আর একটা কথা। যদি কোনও কারণে দড়ি খুলে দুজন দু-দিকে চলে যাই, উত্তেজিত হবে না। বুদ্ধি না হারিয়ে এক জায়গায় বসে অপেক্ষা করবে। রেডিয়ো ব্যবহার করবে।’ বলতে বলতে জিষ্ণুর কোমরের দড়িটার সঙ্গে নিজের কোমরের বেল্ট হুক দিয়ে আটকে নিয়ে জিষ্ণুকে সামনে এগিয়ে দিয়ে পেছন পেছন রওনা হলেন প্রফেসর বোস। অতিকায় গুহার হাঁ মুখটা তাঁদের সহজ শিকারের মতোই মুহূর্তের মধ্যে গিলে ফেলল যেন।

‘সাবধান বাবা, সামনে নুড়ি পাথর—’ বেশ খানিকটা সামনে থেকে রেডিয়োতে জিষ্ণুর গলা ভেসে এল। দড়িতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে থামবার নির্দেশ দিলেন প্রফেসর বোস। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সামনে খাড়া নেমে যাওয়া ঢালটার দিকে হেলমেটের আলো ফেললেন। মাটি থেকে প্রায় দুশো ফুট নীচে এই জায়গাটায় গুহার ছাদ একদম মাথার কাছে নেমে এসেছে। তীব্র, ভ্যাপসা গরমে ঘামে ভিজে যাচ্ছে শরীর।

ঢালটা কতটা গভীর কে জানে। প্রায় ষাট ডিগ্রি কোণ করে নেমে গেছে একেবারে যেন পাতালের দিকে। তার গায়ে বিপজ্জনকভাবে আটকে রয়েছে অজস্র ছোটবড় নুড়িপাথর। পায়ের সামান্যতম ধাক্কাতেও তা অবরোহণকারীকে নিয়ে হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়তে পারে নীচের দিকে।

ধীরে ধীরে উপুড় হয়ে শুয়ে বুকে হেঁটে তার মুখটার কাছে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর বোস। জিষ্ণুও একই ভঙ্গীতে শুয়ে ছিল সেখানে। জোড়া হেডল্যাম্পের আলোয় বেশ খানিকটা নীচে অবধি দেখা যায়।

‘গরমটা একটু কম লাগছে না বাবা?’

হঠাৎ জিষ্ণুর কথায় ব্যাপারটার দিকে খেয়াল হল প্রফেসর বোসের। ঢালটার তলা থেকে একটা ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত উঠে এসে সারা শরীরে লাগছে তাঁদের। তবে কি—

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে খুব আস্তে আস্তে হেলমেটের ভাইসরটা একটু উঁচু করলেন প্রফেসর। ঠান্ডা, ভেজা ভেজা একটা হাওয়ার স্রোত এসে লাগল মুখে। একটু সোঁদা গন্ধ আছে তাতে কেবল। কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে হঠাৎ এক টানে মাথার হেলমেটটা খুলে ফেলে জিষ্ণুর হেলমেটটাও খুলে দিলেন প্রফেসর। মাটিতে রাখা হেলমেটদের আলোয় হাসি হাসি মুখে তার পিঠটা চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘আর চিন্তা নেই রে! সঠিক জায়গা পেয়ে গেছি। শুধু এই খাদটা পার করবার যা দেরি।’

‘তার মানে?’

‘প্রথম কথা হল এখানে বাতাসটা ভালো। আর তার চেয়েও বড় কথা, যেরকম হাওয়ার স্রোত উঠে আসছে তাতে ওখানে খুব বড় আকারের কোনও পাতাল গুহা থাকবেই। নইলে এমন হাওয়ার স্রোত এই গভীরতায় তৈরিই হতে পারত না। আর বাতাসটা যেমন ভেজা ভেজা আর ঠান্ডা তাতে মনে হচ্ছে ওখানে জলের একটা উৎসও রয়েছে। চুনাপাথরের পাহাড়ে পাতাল নদী থাকাটা খুব অস্বাভাবিক নয় জিষ্ণু।’

‘তাহলে চলো, এগোই।’ বলতে বলতেই সামনে এগোতে যাচ্ছিল জিষ্ণু। প্রফেসর বোস তাকে বাধা দিলেন। তারপর তার পিঠ থেকে অক্সিজেনের ক্যানটা খুলে নিয়ে একপাশে রাখতে রাখতে বললেন, ‘না। এবারে আমি যাব আগে। তুমি পেছনে আসবে। আর, হেলমেটটা পরে নাও।’

‘কিন্তু তুমি তো আমাদের ক্যানদুটো খুলে রাখলে—’

‘সে ঠিক। কিন্তু হেলমেটটা না পরলে হেডল্যাম্প আর রেডিয়োর সুবিধেটা থাকবে না যে! আর একটু কষ্ট করো শুধু,’ বলতে বলতে নিজের মাথাতেও হেলমেটটা ফের চাপিয়ে নিলেন প্রফেসর। সামনের খোলা ভাইসর দিয়ে নীচে থেকে উঠে আসা পরিষ্কার বাতাসের ঝাপটা লাগছিল। পাতালগুহার অজানা দেশটা যেন স্বাগত জানাচ্ছিল দুই অতিথিকে।

ঢালু মেঝেতে পেরেক পুঁতে দড়ি আটকে তা-ই ধরে ধরে নীচের দিকে এগোতে হল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর ঢালটার নতি খানিকটা কমে আসতে পেরেক থেকে দড়ি খুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর। জিষ্ণু একপাশে দু-হাতে হাঁটুদুটো জড়িয়ে ধরে বসে ছিল।

‘ক্লান্ত লাগছে?’

‘একটু একটু,’ তাঁর দিকে মুখ তুলে হাসল জিষ্ণু, ‘তবে চলতে অসুবিধে নেই। যাবে?’

প্রফেসর একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে পথটাকে দেখছিলেন। হেডল্যাম্পের আলোয় চারপাশের পুরু, এবড়োখেবড়ো দেয়ালে ভৌতিক সব ছায়া নড়াচড়া করছে। চারপাশে কানে তালা ধরানো নৈঃশব্দ।

রাস্তাটা এইবারে একেবারে সমতল হয়ে এঁকেবেঁকে উঁচু হয়ে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। সেইদিকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন প্রফেসর বোস। ওপরের দিকে এগোচ্ছে পথটা। হাতের যন্ত্র দেখাচ্ছিল গভীরতা প্রায় তিনশো মিটার। নীচের দিকে না গিয়ে ফের ওপরের দিকে অন্য কোনও ফোকর দিয়ে বাইরের দুনিয়ায় বের হয়ে যাবে না তো রাস্তাটা? তাহলে—

‘কোমরের দড়িদড়াগুলো খুলে ফেলি বাবা?’ জিষ্ণু কোমরের ধাতব ক্ল্যাম্পে হাত দিচ্ছিল।

‘উঁহু। এখনই নয়। চলো এগোন যাক।’

এ পথটা দিয়ে দূর অতীতে কখনও জল বয়ে গিয়েছিল। পাথরগুলো মসৃণ। তাদের গায়ে প্রাচীন শ্যাওলাদের ধূলিধূসরিত অবশেষচিহ্ন লেগে আছে। উঠতে উঠতে গভীরতা কমে এখন দুশো সত্তর মিটারে দাঁড়িয়েছে।

দেয়ালের পাথরগুলোকে হাত দিয়ে ছুঁতে ছুঁতে চলেছিল জিষ্ণু। হঠাৎ এক জায়গায় আলো পড়তে সেদিকে তাকিয়ে সে উত্তেজিত গলায় বলল, ‘বাবা, ফুল!’

‘ফুল? এখানে? বলতে বলতে এগিয়ে এসে প্রফেসর জিষ্ণুর হেডল্যাম্পের আলোর বৃত্তে ধরা গুহার দেয়ালের ওপরের দিকে একটা জায়গার দিকে তাকালেন।

ভালো করে দেখে তাঁর মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল, ‘ফুল বটে, তবে গাছের নয়। ও হল স্টোন ফ্লাওয়ার। পাথরের ফুল। চুনাপাথরের পাহাড় তো। ক্যালশিয়াম কার্বোনেট জমে জমে প্রকৃতির খেয়ালে ওরকম গোলাপ ফুলের পাপড়ির মতো হয়েছে।’

সত্যিকার ফুল না হলেও জিনিসগুলো দেখতে সত্যিই আকর্ষণীয়।

‘উঠে একটু ছুঁয়ে দেখব বাবা?’

চেষ্টাটা বিপজ্জনক হতে পারে। চুনাপাথর গ্রানাইটের মতো শক্ত নয়। কোথায় কী নড়বড়ে হয়ে রয়েছে কে জানে। কিন্তু, জিষ্ণুর কৌতূহলভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে আপত্তি করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন প্রফেসর বোস। তারপর বললেন, ‘বেয়ে উঠতে পারবে তো?’

‘পারব। দেয়ালের গায়ে কত খোঁচা খোঁচা পাথর বেরিয়ে রয়েছে দেখছ না?’ বলতে বলতেই হেলমেটটা খুলে রেখে জিষ্ণু গিয়ে দেয়ালের অমসৃণ গা থেকে মুখ বাড়িয়ে থাকা পাথরের ধারালো টুকরোগুলোকে আঁকড়ে ধরে তার হালকা শরীরটা ওপরের দিকে টেনে তুলতে শুরু করে দিল, আর তারপরেই কোনও আগাম সতর্কতা না দিয়ে হুড়মুড় করে তাকে নিয়ে উলটোদিকে ভেঙে পড়ল দেয়ালের খানিকটা অংশ। কালো গহ্বরটা একটা আদিম জন্তুর মতো তাকিয়ে ছিল প্রফেসরের দিকে।

‘মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে—’ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বারংবার এই কথাটাই নিজেকে বোঝাচ্ছিলেন প্রফেসর বোস। গহ্বরের ওপাশে জিষ্ণু পড়ে গেলেও তার কোমরে বাঁধা দড়িটা এখনও তাঁর কোমরের সঙ্গে আটকানো রয়েছে। সন্তর্পণে নিজের কোমর থেকে দড়িটা খুলে নিয়ে একখণ্ড বড় পাথরের সঙ্গে সেটাকে আঁটোসাঁটো করে বেঁধে নিলেন তিনি প্রথমে। তারপর সন্তর্পণে পাথরের গা বেয়ে বেয়ে উঠে এলেন গহ্বরটার মুখের কাছে। অন্ধকারের মধ্যে নেমে যাওয়া দড়িটাকে অনুসরণ করে নীচের দিকে হেডল্যাম্পের আলো ফেলে দেখা গেল বেশ খানিকটা নীচে দড়ির অন্যপ্রান্তে জিষ্ণুর শরীরটা দোল খাচ্ছে।

‘জিষ্ণু, শুনতে পাচ্ছ?’

তাঁর গলার শব্দে হঠাৎ করে গমগম করে উঠল গোটা এলাকাটা।

দড়িতে মৃদু ঝাঁকুনি এল না একটা? আবার একটা ডাক দিলেন প্রফেসর বোস। এবারে দড়িতে মৃদু ঝাঁকুনির সঙ্গে ক্ষীণ একটা শব্দও ভেসে এল তলা থেকে। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললেন প্রফেসর। সাড়া দিচ্ছে যখন তখন জ্ঞান আছে ছেলেটার। তার মানে বেশি চোট লাগেনি আশা করা যায়। ধীরে ধীরে, খুব সাবধানে দড়ি ধরে টেনে তাকে ওপরে তুলতে শুরু করলেন তিনি।

একটু কেটেছড়ে যাওয়া ছাড়া বিশেষ কোনও চোট লাগেনি জিষ্ণুর। ভয়ে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল এই যা। খানিক ধাতস্থ হবার পর সে বলল, ‘পায়ের নীচে থেকে জলের শব্দ আসছিল বাবা। বেশি নীচে থেকে নয় বলেই মনে হল।’

সামনের রাস্তাটার দিকে একবার চেয়ে দেখলেন প্রফেসর। খসে পড়া পাথরের স্তূপে পথটা প্রায় সম্পূর্ণ ঢেকে গিয়েছে। ওদিক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গেলে ওই পাথরের স্তূপ সরাতে হবে। খানিক বাদে কী মনে হতে একখণ্ড পাথর হাতে নিয়ে ফের গহ্বরটার মুখের কাছে গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। গহ্বরের ভেতর থেকে গুমগুম করে একটা ক্ষীণ শব্দ আসছিল সত্যিই। কান পেতে সেই শব্দ খানিক শুনে তারপর মণিবন্ধে বাঁধা ঘড়িটার স্টপওয়াচ চালু করে দিয়ে পাথরটাকে তিনি ফেলে দিলেন নীচের দিকে। খানিক বাদে তলা থেকে পাথরটা আছড়ে পড়বার শব্দটা পেতে স্টপওয়াচের সময়টা দেখে নিয়ে কিছু হিসেব করে তাঁর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। জিষ্ণুর দিকে ফিরে বললেন, ‘গুহাটার গোলকাকার ছাদের ওপর দিয়ে আমরা ঘুরে চলেছিলাম জিষ্ণু। এইবারে একটা সিধে পথ পাওয়া গেছে। আর চিন্তা নেই। এইখান থেকে বড়জোর সত্তর মিটার নীচে গুহার মেঝে।’

দড়ির মাথায় বাঁধা মালপত্রের বড় পুঁটুলিটা সাবধানে নীচের দিকে ঠেলে দিয়ে আস্তে আস্তে দড়ি ছাড়তে ছাড়তে হিসেব রাখছিলেন প্রফেসর বোস। পুঁটুলির সঙ্গে একটা ছোট্ট আণবিক ব্যাটারির সঙ্গে একটা উজ্জ্বল আলো আটকে দিয়েছেন। তার তীব্রতায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

উজ্জ্বল আলোকখণ্ডটি দুলতে দুলতে নীচে নামতে নামতে চারপাশে আলো ছড়াচ্ছিল। সেইদিকে তাকিয়ে জিষ্ণু একটু ভীত গলায় প্রশ্ন কর, ‘কিছু দেখা যাচ্ছে না তো চারপাশে বাবা!’

‘সেটাই ভালো জিষ্ণু। তার মানে গুহাটা বিশাল বড়। এর দেয়ালগুলো অনেক দূরে দূরে। ছাদটা অন্তত এই জায়গায় সত্তর মিটার উঁচু। একাঘ্নিকে বানিয়ে দাঁড় করাবার জন্য এইরকমই একটা জায়গার প্রয়োজন আমাদের ছিল। ভগবান সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আজ তুমি অ্যাক্সিডেন্টটা না ঘটালে এর খোঁজ আমরা আদৌ পেতাম কি না কে জানে।’

আলোশুদ্ধ পুঁটুলিটা ততক্ষণে একেবারে নীচে গিয়ে পৌঁছেছে। দড়ির হিসেব দেখে প্রফেসরের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল, ‘পঁচাত্তর মিটার। খুব বেশি ভুল হয়নি হিসেবে জিষ্ণু।’

মালপত্রের পুঁটুলিগুলো একে একে নামানো হয়ে গেলে জিষ্ণুকে দড়ি বেঁধে নীচে নামিয়ে দিয়ে সবার শেষে নিজে নীচে নেমে এলেন প্রফেসর বোস।

জিষ্ণু গুহাটার চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল। মিটার পঞ্চাশেক ব্যাসার্ধের একটা বৃত্তাকার এলাকা আলোকিত হয়ে আছে বাতিটাতে। খানিক দূর দিয়ে বয়ে চলা জলধারাটাতে স্রোত তত তীব্র নয়। তার উজানে গভীর অন্ধকারের ভেতর থেকে গুমগুম করে জল আছড়ে পড়বার শব্দ আসছে। জলের ধারাটা গুহার কোনও এক প্রান্তে উঁচু থেকে আছড়ে পড়ছে।

‘ঈশ্বরের আশীর্বাদ জিষ্ণু। বিদ্যুতের অভাব হবে না আমাদের এখানে,’ বলতে বলতে ধারার থেকে খানিক জল তুলে এনে একটা ছোট যন্ত্রের মুখে তার ক-ফোঁটা রাখলেন প্রফেসর। একটা তীব্র লাল আলোর রশ্মি গিয়ে পড়ল জলের ফোঁটাটার ওপরে। সামান্য ফেনা তুলে বাষ্পীভূত হয়ে গেল জলটা। যন্ত্রের পর্দায় কিছু তথ্য ভেসে উঠছিল। সেইদিকে একবার দেখে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে আঁজলা করে জল তুলে নিয়ে প্রাণভরে জল খেলেন প্রফেসর। তারপর জিষ্ণুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হাতমুখ ধুয়ে জল খাও। চমৎকার স্বাদ। এ জলে কোনও ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি বিশ্লেষণে।’

জিষ্ণু জলের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল তার পাশে। জলধারাটা অগভীর। আঁজলা করে জল তুলে মাথায় দিতে দিতে হঠাৎ কী মনে হতে জলের মধ্যে একবার পা বাড়িয়ে দেখল সে। তারপর পেছন ফিরে বলল, ‘জলের নীচে পরিষ্কার বালি বাবা। নেমে স্নান করি?’

‘করো, কিন্তু সাবধানে। উজানের দিকে বেশিদূর এগিও না। বিপদ হতে পারে—’ বলতে বলতে আলোটা হাতে নিয়ে জলধারার ধার ধরে তার উজানের দিকে এগিয়ে চললেন প্রফেসর বোস।

বিচিত্র কিছু পাতাবিহীন গাছ ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। তাদের ফাঁকে ফাঁকে গজিয়ে থাকা অজস্র জাতের ছত্রাকের সমারোহের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের মনেই বলছিলেন, ‘যতদিন না কৃত্রিম আলোয় হাইড্রোপনিক ক্ষেত গড়ে তুলতে পারি বা অন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারি ততদিন খাদ্যের অভাব আমাদের এখানে হবে না জিষ্ণু। এদের মধ্যে অন্তত তিনটে প্রজাতি আমার এখনই চোখে পড়ছে যেগুলো সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। তা ছাড়া—’

বলতে বলতেই হঠাৎ তাঁর কথাটা থেমে গেল জিষ্ণুর দিক থেকে ভেসে আসা একটা আওয়াজে। দু-হাতে কিছু একটা ধরে নিয়ে সে জল ছেড়ে উঠে আসছিল দ্রুত। তাড়াতাড়ি তার কাছে ফিরে গিয়ে জিনিসটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলেন প্রফেসর। একটা ধারালো পাথরের ফলা। জিষ্ণুর পায়ের নীচেটা একটু কেটে গিয়েছে ফলাটা লেগে।

জিনিসটা হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখে প্রফেসরের মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। ফলাটা সরু। ঘসে ঘসে তীক্ষ্ণ করে তোলা হয়েছে। গোড়ার দিকে খাঁজ কাটা। বোঝা যায় কোনও লাঠির সঙ্গে তাকে আঁটোসাঁটো করে বাঁধবার বন্দোবস্ত সেই খাঁজগুলো।

‘জিনিসটার গায়ে শ্যাওলা ধরেনি। তার মানে বেশি দিন জলের তলায় পড়ে নেই এটা।’

‘জিনিসটা কী বাবা?’

‘এটা একধরনের আদিম অস্ত্র জিষ্ণু। প্রাচীন পৃথিবীতে এই অস্ত্র দিয়েই মানুষ শিকার করত। এটা সম্ভবত এই জলধারায় মাছ শিকারের কাজে কেউ ব্যবহার করেছিল এখানে।’

‘কিন্তু এইখানে কেউ এসে এমন আদিম জিনিস দিয়ে—’

‘কেন? সেটাই তো ধাঁধা। প্রথমত এখানে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে এমন মানুষ এল কোথা থেকে? আর দ্বিতীয়ত, তারা এমন আদিম অস্ত্র ব্যবহার করেছে তার অর্থ একটাই হয়, বাইরের দুনিয়া থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। সভ্যতা যে এগিয়ে গেছে তার খবর তারা এখনও পায়নি। আমাদের একটু সাবধান হতে হবে জিষ্ণু—’

জিষ্ণু একটু সচকিত হয়ে চারদিকটা একবার চেয়ে দেখল। মাঝখানে জ্বলতে থাকা আলোটা বাদে চারপাশে নিরন্ধ্র অন্ধকারের বেষ্টনী ঘিরে রয়েছে তাঁদের। হাতের ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছিল রাত দুটো।

‘ফিরে যাবে বাবা? এখানে আমরা দুজন মিলে একা একা—’

প্রফেসর মৃদু হাসলেন। চিন্তাটা তাঁরও মাথায় এসেছে। যে আবিষ্কারটা এইমাত্র করেছে জিষ্ণু তার থেকে সে চিন্তার জবাবও একটা গড়ে উঠছে তাঁর মনে। এই গুহার রাজত্বে তাঁরা একলা নন। আরও কেউ আছে এখানে। কেমন মানুষ তারা? কীভাবে নেবে তারা তাঁদের দুজনকে? তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়েছে কি তারা? খানিক দূরে ঝুলন্ত দড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন তিনি। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে উপস্থিত ওই একটাই যোগসুত্র তাঁদের। কিন্তু সেখানে যারা তাঁদের জন্য ওঁত পেতে অপেক্ষায় আছে, এখানকার অজানা, পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করা বাসিন্দাদের মারণাস্ত্র অন্তত তাদের চেয়ে কম শক্তিশালী হবে।

মুখে সে সব কিছু না বলে একটু হাসি টেনে এনে বললেন, ‘সে সব নিয়ে এখন ভেবো না। এখন প্রথমে তুমি কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। তারপর তোমাকে তুলে দিয়ে আমি শুতে যাব। বিপদ-আপদের কথা এখন না ভাবলেও চলবে জিষ্ণু। উপস্থিত খাওয়া ও বিশ্রাম। এসো তোমার পা’টাকে পরিষ্কার করে দিই প্রথমে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *