অন্তিম অভিযান – ৩

‘আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে, ২০১১ সালে, পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে একটা বিরাট পদক্ষেপ সম্পূর্ণ হয়েছিল। সেটা কী, কে বলতে পারে?’

‘লীলা মিস আজকে ফের বাদামি চামড়া করেছে, দেখেছিস?’ পাশে বসা সুহানার গায়ে ডেস্কের তলা দিয়ে একটা খোঁচা মেরে জিষ্ণু বলল।

সুহানা সামনের দিক থেকে চোখ না ঘুরিয়েই ফিসফিস করে বলল, ‘চুপ।’

জিষ্ণু মুখ গোমড়া করে বলল, ‘তোদের সবার কেমন মজা। ইচ্ছেমতো লম্বা, বেঁটে, ফর্সা, কালো হয়ে যেতে পারিস! আমিই শুধু—’

‘জিষ্ণু, উঠে দাঁড়াও। ক্লাশের মধ্যে কী কথা বলছ এত?’ তীক্ষ্ণ, মিষ্টি গলায় লীলাদিদিমণির ডাক ভেসে এল।

‘কি-কিচ্ছু না,’ বলতে বলতে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াল জিষ্ণু। গোটা ইশকুলে এই একজনকেই ভয় করে চলে সে। গত ইভ্যালুয়েশনে প্রিন্সিপ্যাল ডি এক্স প্রাইম তাকে নিয়মানুবর্তিতায় ‘সি মাইনাস’ দেবার পর থেকে লীলা দিদিমণিকে বাবা নিয়ে এসেছেন ক্লাস টিচার করে। খুব কড়া।

‘তোমায় আমি অনেকবার বলেছি ক্লাস চলবার সময় কারও সঙ্গে কথা বলবে না। আমি কী প্রশ্ন করেছি সেটা কি শুনতে পেয়েছ?’

‘হ্যাঁ, মিস। ২০১১ সালে পৃথিবীর প্রথম স্পেস স্টেশনের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল।’

‘ঘটনাটা ঠিকই বলেছ, কিন্তু সঠিক উত্তর এটা নয়। সঠিক উত্তরটা আমি গতকাল তোমাদের বলে দিয়েছিলাম।’

জিষ্ণু একটুক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর ফের একবার চেষ্টা করল, ‘ওই বছরে প্রথম নিউট্রিনো কণার অতি আলোকগতির প্রমাণ পাওয়া যায়—’

এইবারে গোটা ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল একসঙ্গে। জিষ্ণু একটু অস্বস্তিভরা মুখে এদিক-ওদিক তাকাল একবার। দিদিমণি তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি বোধ হয় ভুলে গেছ এটা ইতিহাসের ক্লাস, বিজ্ঞানের ক্লাস নয়। ঠিক উত্তরটা কে বলতে পারে?’

বেশ কয়েকটা গলা একসঙ্গে জবাব দিয়ে উঠল ক্লাসের চারপাশ থেকে, ‘ওই বছরে পৃথিবীর চারটে দেশের খারাপ রাজাদের দেশের লোকেরা মিলে তাড়িয়ে দিয়েছিলো।’

‘গুড। দেশ কাকে বলা হত?’

‘সে সময় মানুষেরা একসঙ্গে থাকত না। একেকটা এলাকা জুড়ে আলাদা আলাদা দল বেঁধে থাকত। একেকটা দলকে দেশ বলা হত—’

‘ভালো। জিষ্ণু, তোমার তিন দিন খেলার সময়ে ইতিহাসের গোটা সিলেবাসটা পড়ে নিয়ে একটা আলাদা পরীক্ষা দিতে হবে। এখন বসো। ক্লাসওয়ার্কের ফাইল খোল সবাই—’

তাদের সামনের ডেস্কের উপরিতলটা স্বচ্ছ হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। এইবারে তাতে ধীরে ধীরে একটা মানচিত্র ফুটে উঠল। প্রাচীন পৃথিবীর মানচিত্র। তাতে একেকটা এলাকায় লাল নীল রং ফুটে উঠেছে। এগুলো সে সময়কার সেই ‘দেশ’। মানচিত্রের নীচের দিকে খানিকটা খালি জায়গায় অনেকগুলো নাম একত্র হয়ে নড়াচড়া করছে। জিষ্ণু মনযোগ দিয়ে তাদের একেকটাকে আঙুলের টানে নিয়ে নিয়ে একেকটা রঙিন এলাকার ওপরে বসাতে লাগল। সুদান, ফ্রান্স, বাংলাদেশ—

লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে আসছিল আস্তে আস্তে। জিষ্ণু টের পাচ্ছিল তার চোখদুটো জলে ভরে উঠেছে।

‘জিষ্ণু!’

লীলা মিস কখন যেন পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রেখেছেন। সে মুখ গুঁজে তাড়াতাড়ি আঙুল চালাতে লাগল ডেস্কের ওপরে।

‘তুমি পড়াশোনায় এত ভালো! অঙ্ক আর পদার্থবিজ্ঞানে তোমার এই বয়সেই এত ভালো দখল, তুমি তো একটু চেষ্টা করলেই ইতিহাসটা শিখে নিতে পারো। তাহলে কেন তুমি—’

‘আমার ভালো লাগে না যে!’ জিষ্ণুর গলা বুঁজে আসছিল প্রায়।

‘তা-ই বললে কী হয়! সব কিছু শিখতে হয় যে! নইলে কেমন করে তুমি সত্যিকারের বড় হবে, বলো! লোকে তোমায় কেমন করে ভালো বলবে তাহলে?’

‘কই বাবা তো এসব জানে না! বাবা তো অনেক বড়। সবাই বাবাকে ভালো বলে—’

‘ওঁর সঙ্গে নিজের তুলনা কোরো না জিষ্ণু। উনি অনেক উঁচুতলার মানুষ। আমাদের সবার সৃষ্টিকর্তা। উনিই তো আমায় তোমার জন্য—’

একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ উঠল ডেস্কের পাশের স্পিকার থেকে। আজকের মতো ক্লাসের সময় শেষ হয়ে গেছে। সোজা হয়ে উঠে বসল জিষ্ণু। ওর মাথায় হাত রাখা লীলা মিস আস্তে আস্তে স্বচ্ছ হয়ে মিলিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে বলে গেলেন, ‘মনে থাকে যেন, আজ থেকে খেলার সময়—’

‘মনে আছে মিস। কাল ঠিক পড়ে আসব…’

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ডেস্কের একপাশের বোতামে হাত ছুঁইয়ে পর্দাটাকে নিভিয়ে দিল জিষ্ণু। ক্লাসের বাকি সবাই মিলিয়ে গিয়েছে এর মধ্যেই। ফাঁকা ক্লাসরুমটার চেয়ার টেবিল, দরজা জানালা সব মিলিয়ে গিয়ে ক্রোমিয়ামের পাত লাগানো ফাঁকা ঘরটা জেগে উঠল তার সামনে। সেখানে একটাই মাত্র ধাতব চেয়ার রাখা রয়েছে। জিষ্ণুর চেয়ার। মৃদু একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে খুলে যাওয়া দরজাটা দিয়ে বের হয়ে যেতে যেতে জিষ্ণু একপাশে দেয়ালের গায়ে লাগানো কালো রঙের চৌকো শিক্ষাগণক ডি এক্স প্রাইমের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। বাবার তৈরি যন্ত্র। ওর স্মৃতিতে এখন আগামিকাল অবধি ঘুমিয়ে থাকবে তার ক্লাসের পঁচিশজন বন্ধু আর লীলা দিদিমণি।

* * *

ঘর থেকে বের হয়ে লম্বা করিডোরটা ধরে তিন নম্বর মডিউলের দিকে পা বাড়াল জিষ্ণু। বাবা এই সময়টা ওইখানে গবেষণাগারেই থাকেন সাধারণত। এই করিডোরটা দিয়ে হাঁটতে ভারী ভালো লাগে তার। দু-পাশের দেওয়াল আর ছাদ জুড়ে আজ সৌরজগতের ত্রিমাত্রিক ছবি ফুটে আছে। একেবারে সত্যিকারের আকাশের মতোই মনে হয়। হাত বাড়ালেই গ্রহগুলোকে ছোঁয়া যাবে যেন। করিডোরের মাঝামাঝি এসে নেপচুনের কালচে-নীল গোলকটার পাশে দাঁড়িয়ে জিষ্ণু নিচুগলায় ডাকল, ‘চিত্রক ৪!’

‘বলো বন্ধু,’ তার কানের কাছে মৃদু, ভরাট গলায় জবাব ভেসে এল।

‘আজকে আমার মহাকাশের ছবি ভালো লাগছে না।’

‘কী চাও?’

‘পৃথিবীর ছবি দেখাও। আজ থেকে একশো বছর আগে ভারতবর্ষ নামের দেশের পুবদিকে যেখানে আমরা থাকতাম সেখানকার ছবি।’

‘নিশ্চয়। এই যে—’ ভরাট গলাটার আওয়াজ শেষ হতে না হতেই তার চারপাশের ছবি বদলে গেল। মাথার ওপরে ফটফটে নীল আকাশে সূর্য জ্বলছে। চারপাশে যতদূর চোখ যায় সবুজ সমুদ্রের মতো ঘাসের বন হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে।

‘গোটা পৃথিবী জুড়েই কি তখন এমন ঘাসবন ছিল?’

মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এল একটা, ‘ঘাসবন নয় বন্ধু। ওকে বলা হত ধানখেত। ওই গাছের বীজ ছিল তখন মানুষের খাদ্যের প্রধান উৎস।’

‘ঘাসের বীজ—’

‘হ্যাঁ। ওই গাছেরা সালোকসংশ্লেষ করে সূর্যের শক্তি খাদ্যে আবদ্ধ করত। তারপর মানুষ সেই খাদ্য থেকে শক্তি পেত—’

‘দূর, তাই হয় নাকি? সালোকসংশ্লেষ যন্ত্র থাকতে—’

‘চিরকাল মানুষের কাছে এই যন্ত্র ছিল না। তোমার বাবা যখন ছোট ছিলেন তখন তিনিও ওই ঘাসের বীজ খেয়েই বেঁচে থেকেছেন। ত্রিশ বছর আগে আমার শ্রেণীর শক্তিধর জৈব যন্ত্রগণক আবিষ্কার হবার পর, আমাদের ব্যবহার করে মানুষ সালোকসংশ্লেষের যন্ত্রের নকশা তৈরি করতে পেরেছে,’ চিত্রক-৪-এর গলায় মৃদু অহংকারের ছোঁয়া ছিল। এই চিত্রক শ্রেণীর জৈবগণকেরা মানুষের মতোই অনুভূতিসম্পন্ন। বাবা মাঝে মাঝেই তাকে এইজন্য সাবধান করে দিয়ে এর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে বলেন।

সামনেই করিডোরের শেষপ্রান্তে বাবার গবেষণাগারের দরজা দেখা যাচ্ছিল। সেই দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জিষ্ণু মুখ তুলে বলল, ‘ধন্যবাদ চিত্রক-৪। তুমি প্রোগ্রাম বন্ধ করে দিতে পার। আমি এখন বাবার কাছে যাব।’

‘না বন্ধু। এখনই বন্ধ করব না। আমার এই দৃশ্যটি দেখতে এখন খুব ভালো লাগছে। তুমি এসো—’

জিষ্ণু কোনও জবাব না দিয়ে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেনসরে হাতের বুড়ো আঙুলটা ছোঁয়াল।

* * *

‘বাবা!’

‘কে জিষ্ণু? আয়। স্কুল শেষ হয়ে গেল?’ সামনের মনিটরে চোখ আটকে রেখেই চাপা গলায় ডাকলেন প্রফেসর বোস।

তাঁর সামনে কাচের স্বচ্ছ অর্ধগোলকাকৃতি ঘেরাটোপের বাইরে, চাঁদের নিষ্প্রাণ বুকে একটা গভীর খাদ দেখা যাচ্ছিল। তার ভেতর থেকে অর্ধচন্দ্রাকার মাথাওয়ালা একটা অতিকায় যন্ত্রের ওপরের অংশটা চোখে পড়ে। তাকে ঘিরে কাজ করে চলেছে কয়েকটা হাত-পা-ওয়ালা যন্ত্র। সেইদিকে দেখতে দেখতে জিষ্ণু বলল, ‘একাঘ্নি তৈরি শেষ হয়ে গেল বাবা?’

‘হ্যাঁ। আজ শেষ সিমুলেশনটা চালালাম। সব ঠিক আছে। পরীক্ষামূলক উড়ানটা কাল হয়ে গেলে আমার এখানকার কাজ শেষ। এবারে ভাবছি বছর কয়েকের জন্য পৃথিবীতে পোস্টিং নেব। তোকে সত্যিকারের একটা স্কুলে ভরতি করে দেব এবারে।’

জিষ্ণুর মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল, ‘আমি ইশকুলে যাব না।’

‘অ্যাঁ? সে কী রে? বড় হতে হবে না?’

‘না। আমি বড় হব না,’ ঘাড় গোঁজ করে জিষ্ণু বলল।

‘বুঝেছি। লীলা দিদিমণি ফের বকেছে বুঝি?’

‘হ্যাঁ। বকেছে। খুব বকেছে। আমি কিচ্ছু করিনি। ইতিহাসের ক্লাসে ২০১১ সালের সেরা ঘটনা বলতে বলল, তারপর—’

তড়বড় করে সারাদিনের জমে থাকা গল্পগুলো বলতে বলতে জিষ্ণু এসে প্রফেসর বোসের চেয়ারের পেছনটা ধরে দাঁড়াল। খানিক বাদে তার কথার স্রোত একটু কমতে মনিটরের সুইচটা বন্ধ করে ঘুরে বসলেন প্রফেসর বোস, ‘নতুন দিদিমণি বেশ কড়া, না রে?’

‘হ্যাঁ। এমনি করে রোজ রোজ আমাকেই বকে শুধু সারাদিন। আর কাউকে বকে না।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল জিষ্ণুর, ‘বাবা, তুমি দিদিমণিকে একটু কম রাগি করে দাও না! ডি এক্স প্রাইমকে বললেই তো—’

‘না জিষ্ণু। ডি এক্স প্রাইমের প্রোগ্রামিং তোমার শিক্ষার জন্য ঠিক যা যা প্রয়োজন সেই অনুযায়ী তৈরি করে দেওয়া আছে। সে জানে তোমার ঠিক কেমন টিচার দরকার। তোমার ভালোর জন্যই আমি—’

‘ছাই ভালো। জানো, আমার তিন দিন খেলা বন্ধের শাস্তি হয়েছে আজ। খেলার সময়ে ইতিহাস পড়তে হবে বসে বসে! আমি কাল থেকে আর ইশকুলে যাব না।’

‘ছি ছি, এমন কথা বলতে নেই ইয়ংম্যান। দিদিমণির ভয়ে ইশকুল ছেড়ে পালায় তো ভিতু ছেলেরা! তুমি কি—’

হঠাৎ সামনে লাগানো যোগাযোগ মডিউলটা পিঁ পিঁ করে সংকেত দিল দু-বার।

‘এখন আবার কে ফোন করল,’ বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে যন্ত্রের পর্দায় আঙুল ছোঁয়ালেন প্রফেসর বোস। সেখানে তখন আস্তে আস্তে এলোমেলো দাড়িগোঁফে ঢাকা একটা বয়স্ক মুখ ভেসে উঠছে।

‘কী ব্যাপার অঁরি? অসময়ে যোগাযোগ করলে যে! এখন তো তোমার ঘুমোবার সময়? এখন হঠাৎ—’

হাতের একটা অধৈর্য ভঙ্গী করে প্রফেসর বোসকে থামিয়ে দিলেন মিশেল অঁরি। তারপর উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘তুমি একেবারে ঠিক কথা বলেছিলে বোস। আশ্চর্য ব্যাপার। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না; কী করে—’

‘কী হয়েছে?’

‘রেকর্ডিংটা দ্যাখো। আমি ট্রান্সফার করছি—’ সামনের কনসোলের গায়ে দ্রুত আঙুল চালাতে চালাতে কথা বলছিলেন অঁরি।

‘বহিরাগত ভিডিয়ো সংযোগ। পরিচিতি সংকেত—’

‘পরিচিতির প্রয়োজন নেই। লাইনটা দাও,’ চিত্রকের কথাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন প্রফেসর বোস।

তাঁদের ঘিরে থাকা স্বচ্ছ কাচের ছাউনিতে দ্রুত অন্ধকার নেমে এল। অন্ধকার আকাশের পটভূমির ঠিক মাঝখানে থাকা একটা আলোকবিন্দু দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছিল। তাকে ঘিরে থাকা সুবিশাল বলয়গুলোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল এইবারে বড় হয়ে উঠে গোটা পটভূমিটিকে ঢেকে ফেলল।

‘শনির চতুর্থ বলয়ক্ষেত্রের সেক্টর জি থ্রি-তে জুম করছি। এবারে খেয়াল করো বোস—’ মিশেল অঁরির গলা ভেসে আসছিল স্পিকার থেকে।

পর্দাজোড়া বলয়ের ধূসর পটভূমিতে ছোট একটি বস্তুখণ্ড আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। বিশেষত্বহীন এলোমেলো চেহারার ধুলো ও বরফের একটা পিণ্ড। সেটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে প্রফেসর বোস বললেন, ‘সুইফট টাটল! অঁরি তুমি—’

‘হ্যাঁ বোস। গতকাল তোমার সঙ্গে কথা হবার পর থেকে আমিও জিনিসটার ওপরে নজর রাখছিলাম। মিনিট পাঁচেক আগে এই ব্যাপারটা নজরে এল। শনির থেকে চাঁদ অবধি আলো এসে পৌঁছোবার সময়ের তফাত একঘণ্টা দশ মিনিট ধরলে ঠিক একঘণ্টা পঁচিশ মিনিট আগে ঘটনাটা ঘটেছে। দ্যাখো—’

সূর্যের থেকে তখনও বহু দূরে, মহাশূন্যের তুহিন শীতলতায় ছুটতে থাকা বস্তুপিণ্ডটার গায়ে হঠাৎ করে একটা আলোর স্ফুলিঙ্গ দেখা দিল। তার পরেই তার গা থেকে বের হয়ে এল লম্বাটে চুরুট আকারের একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী।

‘বিস্ফোরণটাকে বিশ্লেষণ করেছি আমি বোস। কম শক্তির পারমাণবিক বোমা ফেটেছে একটা ওর গায়ে। আর তারপরেই—’

পর্দায় মহাকাশের ছবি বদলে গিয়ে ততক্ষণে ফুটে উঠেছে সৌরজগতের একটা মানচিত্র। তার গা বেয়ে বিস্ফোরণবিন্দু থেকে শুরু হয়ে একটা লাল দাগ এসে পৃথিবীর চিহ্নটাকে ছুঁয়েছে। সেইদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে নিচু গলায় প্রফেসর বোস বলে উঠলেন, ‘এইবারে গতিমুখটা পুরোপুরি ঘুরে গেছে পৃথিবীর দিকে। ঠিক যেমনটা আমি—’

বলতে বলতেই কী যেন ভেবে তিনি ফের প্রশ্ন করলেন, ‘বোমাটা কোথা থেকে এল? ওর গতিপথ কিছু বিশ্লেষণ করতে পেরেছ?’

‘এখনও নয়। বিস্ফোরণের আগের মুহূর্ত অবধি জিনিসটা সম্পূর্ণ অদৃশ্য ছিল। কাজেই অঙ্কটা জটিল। ছিটকে ওঠা ধোঁয়ার কুণ্ডলীর কৌণিক অবস্থান থেকে ওর গতিপথের যেটুকু আন্দাজ পেয়েছি তা থেকে দেখা যাচ্ছে পৃথিবী ওর উৎস হবার সম্ভাবনা দশ লক্ষে এক। গোটা গতিপথটার সম্ভাব্য ছবি তৈরি করতে কম্পিউটার একটু সময় নেবে।’

***

চাঁদের কক্ষপথ থেকে দু-লক্ষ কিলোমিটার দূরে, মহাকাশে ভেসে থাকা একটি টাইগার ক্লাস ফ্রিগেটের নিয়ন্ত্রণকক্ষেও অঁরির কথাগুলো সেই মুহূর্তে বাজছিল। সামনে ভেসে থাকা চন্দ্রপৃষ্ঠের ত্রিমাত্রিক হলোগ্রামের গায়ে একটা লাল আলোকবিন্দু দপদপ করছে। তার পাশে ভেসে ওঠা সংখ্যাগুলোর দিকে এক নজর তাকিয়ে নিয়ে কম্পিউটারে দ্রুত কিছু নির্দেশ ভরতে ভরতে সৈয়দ আব্রাহাম মাউথপিসে হিসহিস করে বললেন, ‘ট্রান্সমিশনটার উৎস স্থানাংক নির্ধারিত হয়েছে অ্যাডমিরাল। মেয়ার মস্কোভিয়েন্স আগ্নেয়খাতের পার্থিব গবেষণাকেন্দ্র ভেইনু বাপ্পু অবজার্ভেটরি থেকে কেউ টাটল ব্লাস্টার ফোর-এর বিস্ফোরণটা লক্ষ করেছে। তবে ক্ষেপণাস্ত্রের উৎস সম্বন্ধে এখনও ওরা—’

‘অবস্থান বদলাও সৈয়দ। মস্কোভিয়েন্স চাঁদের অন্য পিঠে। অবজার্ভেটরিকে দৃষ্টিরেখায় এনে রশ্মি কামান ব্যবহার করো,’ স্পিকার থেকে লালপিওতের চাপা গলার নির্দেশ ভেসে এল।

‘না। লোকটাকে আমি জ্যান্ত ধরতে চাই অ্যাডমিরাল। পনেরো মিনিট সময় দিন আমায়। লোকটা হঠাৎ সুইফট টাটলের দিকে কেন নজরদারি করছিল সেটা জানা জরুরি—’ বলতে বলতেই নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে আঙুলের অভ্যস্ত স্পর্শে সাড়া দিয়ে যুদ্ধযানটি সুতীব্র ত্বরণে উড়াল দিল সামনের দিকে।

‘অবস্থান বদলে রশ্মি কামান ব্যবহার করো মূর্খ,’ স্পিকারে লালপিওতের গলা এবারে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, ‘পনেরো নয়, তিন মিনিটের বেশি সময় আমি তোমায় দেব না। তার মধ্যে আমার আদেশ পালিত না হলে—’

বহুদূরে, মঙ্গল উপনিবেশের নিয়ন্ত্রণকক্ষে ড. আরিয়ানার কপালের ভাঁজগুলো গভীর হচ্ছিল। হঠাৎ পাশে বসা লালপিওতের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তিনি বললেন, ‘লোকটাকে জ্যন্ত ধরে এনে, পৃথিবী এ ব্যাপারে ঠিক কতটা জেনেছে সেটা বের করা করাটা প্রয়োজন অ্যাডমিরাল। আমাদের প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ হয়তো নির্ভর করবে ওর জবাবের ওপরে।’

সামনের মনিটরের দিক থেকে মুখ না ঘুরিয়েই লালপিওতে জবাব দিলেন, ‘ভুল জেমস, ভুল। পনেরো মিনিট অনেক সময়। তার মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্রের উৎস জেনে গিয়ে মিশেল অঁরি পৃথিবীকে তা জানিয়ে দিতে পারে। তখন আর তাকে প্রশ্ন করে বা না-করে কোনও লাভ থাকবে না। পৃথিবীর সরাসরি আক্রমণের মুখোমুখি হবার ক্ষমতা মঙ্গলের এখনও হয়নি।’

জেমস আরিয়ানা একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি মিশেল অঁরির নাম জানো?’

একচিলতে হাসি খেলে গেল লালপিওতের মুখে, ‘জানি। অনেক খবরই আমাকে রাখতে হয় জেমস। আমি এ-ও জানি, এককালে অঁরি তোমার শ্রেষ্ঠ ছাত্র ছিল লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে তোমার দ্বিধা থাকতে পারে, কিন্তু আমার কাছে মঙ্গলের স্বাধীনতা তার চেয়েও অনেক মূল্যবান। সত্যি বলতে কি, তোমার মূল্যবান জীবনের দামও তার কাছে কিছুই নয়।’

জেমস আরিয়ানা হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন একবার। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞ সৈনিক লালপিওতে ভুল বলেনি। অঁরিকে মরতেই হবে। মিশেল অঁরি! এক মাথা সোনালি চুল। বুদ্ধিতে ঝকমকে দুটি গভীর নীল চোখ। বাইশ বছর বয়সে অ্যান্ড্রোমিডা তারামণ্ডলের কেন্দ্রীয় ব্ল্যাকহোলটির গাণিতিক অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিল স্রেফ কাগজ পেনসিলে অঙ্ক কষে। তখনও কুখ্যাত ‘সেলমাক এক্সপেরিমেন্ট’-এর দায়ে মানবদ্রোহী বলে ঘোষিত হননি জেমস আরিয়ানা। অঁরি তাঁকে দেবতার মতো শ্রদ্ধা করত—

***

পৃথিবীর ভূতুড়ে নীল আলো গায়ে মেখে তীব্রবেগে নিজের অবস্থান বদলে চলেছিল যুদ্ধযানটি। তার সামনে, চাঁদের অতিকায়, আলোকিত গোলকটার গায়ে একটা আড়াআড়ি, তীক্ষ্ণ ছায়া একপাশ থেকে উঠে এসে ক্রমশই ঢেকে ফেলছিল তাকে। নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রপাতি ছাড়া বাকি সমস্ত যন্ত্রেই শক্তির ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তখন যানের মধ্যে। আলোহীন, জনশূন্য যানের মধ্যে ইঞ্জিনের চাপা ধ্বক ধ্বক শব্দ পাওয়া যায় শুধু। তার যাত্রী সৈন্যদলটি, ফ্রিগেটের দু-পাশে সারি দিয়ে আটকানো ছোট ছোট আক্রমণযানগুলিতে উঠে সংকেতের অপেক্ষায় রয়েছে।

অন্ধকার অর্ধের আকাশে পৌঁছে স্থির হয়ে দাঁড়াল যানটি। তার দূরসংবেদী যন্ত্রে লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান ধরা পড়েছে। ছুঁচলো সম্মুখভাগের ধাতব আবরণ নিঃশব্দে সরে গেল এইবার। তার ভেতরে বসানো একগুচ্ছ স্ফটিকের শীর্ষবিন্দুটি ধীরে ধীরে লালচে-কমলা রঙের আলোয় ভাস্বর হয়ে উঠছিল। তারপর, এক বিন্দুতে সংহত শক্তির পরিমাণ দশ মেগাটন ছাড়ালে হঠাৎ স্ফটিকের মুখ থেকে ছুরির মতো ধারালো একটা অগ্নিবর্ণ আলোকরেখা অন্ধকার আকাশকে চিরে ধেয়ে গেল তার লক্ষ্যের দিকে—

***

হঠাৎ পর্দাটা দপদপ করে একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। স্পিকারে অঁরির গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়ে স্ট্যাটিকের কর্কশ শব্দ ভেসে আসছে শুধু। তারপর সে শব্দটাও থেমে গেল। তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে গিয়ে স্পিকারটাকে নিয়ে দু-একবার নাড়াচাড়া করতে করতেই প্রফেসর বোসের সতর্ক কানে চারপাশ থেকে ওঠা মৃদু গুণগুণ শব্দটা ধরা পড়ল। কান পেতে শব্দটা একটুক্ষণ শুনে প্রফেসর বোস নিচু গলায় ডাকলেন, ‘চিত্রক! ব্যাখ্যা করো—’

মৃদু, ভরাট গলায় জবাব এল, ‘ভেইনু বাপ্পু অবজার্ভেটরির কোনও অস্তিত্ব আর নেই। নিরাপত্তার কারণে এই গবেষণাকেন্দ্রের শক্তি-আচ্ছাদন চালু করা হচ্ছে।’

ছাদের গায়ে লাগানো স্পিকারটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে প্রফেসর বোস প্রশ্ন করলেন, ‘কারণ ব্যাখ্যা করো।’

কিন্তু চিত্রকের কাছ থেকে তার উত্তর ভেসে আসবার আগেই জিষ্ণুর চিৎকারে চমক ভাঙল তাঁর। সামনের প্রক্ষেপণক্ষেত্রটির সঙ্গে চাঁদের কক্ষপথে বসানো দূরবিনের সংযোগ স্থাপন করেছে চিত্রক। গভীর মহাকাশে ভেসে থাকা অতিকায় একটি যানের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শকুনের ঝাঁকের মতো চাঁদের দিকে উড়ে আসছে একদল যুদ্ধযান—

সেইদিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত গলায় জিষ্ণু ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছিল, ‘ওরা কারা বাবা? অঁরি আংকলের কী হয়েছে? ওরা আমাদের মারবে না তো?’

তারপর হঠাৎ তার সেই তীক্ষ্ণ গলার শব্দকে ডুবিয়ে দিয়ে ভেসে এল কানে তালা ধরানো গুমগুম আওয়াজ। কাচের আবরণের বাইরে গোটা গবেষণাকেন্দ্রের ওপর ছেয়ে থাকা শক্তি-আচ্ছাদন অসংখ্য বিস্ফোরণের শক্তিকে নিজের মধ্যে শুষে নিয়ে বারে বারে সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। তার থেকে ভেতরে ছুটে আসা তাপতরঙ্গের অভিঘাতে বাজের মতো শব্দে বারবার ফেটে পড়ছিল গবেষণাকেন্দ্রের ভেতরে ধরে রাখা কৃত্রিম বায়ুমণ্ডল।

হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে, নরম গলায় তিনি জিষ্ণুকে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না জিষ্ণু। কিচ্ছু হবে না। এখান থেকে এবার আমরা বের হয়ে যাব। সে রাস্তা আমার জানা আছে।’

‘আর একাঘ্নি?’ তাঁর কোলে মুখ লুকিয়ে জিষ্ণু জিজ্ঞাসা করল।

এত আতঙ্কের মধ্যেও মৃদু একটা হাসি খেলে গেল প্রফেসর বোসের মুখে।

ছেলের চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে তিনি বললেন, ‘তুমি সরে দাঁড়াও বাবা। একাঘ্নিকে আগে ধ্বংস করতে হবে আমায়। আক্রমণকারী শত্রু যে-ই হোক না কেন, এ অস্ত্রটা আমি তাদের হাতে কিছুতেই তুলে দেব না।’ বলতে বলতেই সামনের কিবোর্ডে দ্রুত হাত চলছিল তাঁর।

‘বহিরাগত ভিডিয়ো সংকেত। আপনার অনুমতির অপেক্ষায়,’ চিত্রকের ভরাট যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর জানান দিল হঠাৎ।

কোনও উত্তর না দিয়ে প্রফেসর বোস নীরবে সামনের প্যানেলটিতে আঙুল ছোঁয়ালেন একবার। সামনের উজ্জ্বল হয়ে ওঠা পর্দায় ভেসে উঠেছে বৃত্তাকার একটা অতিকায় গর্ত।

‘শুভ সন্ধ্যা প্রফেসর বোস,’ স্পিকার থেকে হঠাৎ একটা কর্কশ গলার শব্দ ভেসে এল, ‘আশা করি গর্তটির নিখুঁত গড়ন থেকে আপনার স্তরের একজন অস্ত্রগবেষক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন এটি একটি লেজার আক্রমণ। ভেইনু বাপ্পু অবজার্ভেটরিকে নিশ্চিহ্ন করতে আমার সময় লেগেছে ঠিক দশ সেকেন্ড। আমার অস্ত্রের পরবর্তী লক্ষ্য আপনার এই গবেষণাকেন্দ্র।’

‘আপনি কে?’

‘কামানের ট্রিগারটা কিন্তু আমার হাতে প্রফেসর। অতএব আপনার প্রশ্নের কোনও উত্তর দেবার প্রয়োজন আমার নেই। এতক্ষণে আপনি নিশ্চয় এ-ও জেনে গিয়েছেন যে আমার কিছু সৈন্য আপনার গবেষণাকেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। আপনার রক্ষাবর্ম কয়েক মিনিটের বেশি তাদের আক্রমণ সহ্য করতে পারবে না। আপনাকে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, নিজের কোনও ক্ষতি করতে আপনি দেবেন না। আত্মসমর্পন করুন। গুণীর উপযুক্ত সম্মান আমরা দিতে পারি। রক্ষা আবরণ সরিয়ে নিন। আমার সৈনিকদের ভেতরে আসবার অনুমতি দিন। না হলে আমি বাধ্য হব—’

দ্রুত হাতে সামনের প্যানেলের গায়ের কয়েকটি বোতামের গায়ে আঙুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে প্রফেসর বোস ভীত গলায় জবাব দিলেন, ‘আ-আমি একজন সামান্য বৈজ্ঞানিক। দয়া করে আমার কোনও ক্ষতি করবেন না। দশ মিনিট সময় দিন আমায়। দরকারি কয়েকটা—’

মৃদু একটা হাসির শব্দ ভেসে এল স্পিকার থেকে, ‘দশ মিনিটের বদলে আধঘণ্টা সময় নিন প্রফেসর। আমার যানেরা আপনার প্রতিরক্ষা বর্মের বাইরে অপেক্ষা করবে। তবে কোনও কৌশল করবার চেষ্টা করবেন না। আপনাদের সম্পূর্ণ ঘিরে রাখা হয়েছে। আমাদের প্রতিরক্ষাবলয় ভেঙে বের হবার মতো অস্ত্র আপনার কাছে মজুত নেই।’

প্রফেসর বোসের আঙুলের ছোঁয়ায় চিত্রকের যন্ত্রমস্তিষ্কে সঞ্চিত আপৎকালীন একটি প্রোগ্রাম ততক্ষণে চালু হয়ে গেছে। ঘরটির কাচের ঘেরাটোপ ধীরে ধীরে অস্বচ্ছ হয়ে উঠল। একপাশের দেয়ালের প্যানেলগুলো নিঃশব্দে সরে গিয়ে একটা সুড়ঙ্গের মুখ দেখা দিল। সেখানে, ছোট্ট একটি চুরুটের আকারের লাইফবোটের পেছনদিকে একটা গোলাকার হ্যাচ খুলে গিয়েছে।

একটা ছোট্ট তথ্যগ্রাহক স্ফটিক যন্ত্রগণকের গায়ের নির্দিষ্ট খোপে ভরে দিতে দিতে প্রফেসর বোস নিচু গলায় বললেন, ‘জিষ্ণু তুমি লাইফবোটটার ভেতরে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমার মিনিটকয়েক সময় লাগবে এখানে। তারপর—’

জিষ্ণু তাঁকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে যন্ত্রগণকের সামনে তখন ধ্যানস্থ হয়ে গিয়েছেন তিনি। পর্দায় ভেসে উঠেছে গবেষণাগারের ঘেরাটোপের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অতিকায় একাঘ্নির ছবি। তাকে ঘিরে সুরক্ষাবর্মের বাইরে ভাসছে ছোট ছোট যুদ্ধযানগুলো। হঠাৎ গুমগুম করে চাপা একটা শব্দ ভেসে এল বাইরের থেকে। তারপর তীব্র আলোর ঝলক দিয়ে ফেটে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল ক্ষেপণাস্ত্রের অতিকায় শরীরটা।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গবেষণাকেন্দ্রকে ঘিরে থাকা আক্রমণকারী যানগুলো ফের সক্রিয় হয়ে উঠল। রক্ষাবর্মের গায়ে আছড়ে পড়ছে শ্বেততপ্ত আগুনের স্রোত। দ্রুত হাতে যন্ত্রগণকের খোপ থেকে স্ফটিকটা বের করে পোশাকের ভেতরে তাকে ভরে নিতে নিতে সুড়ঙ্গের দিকে ছুটে এলেন প্রফেসর বোস। স্বয়ংক্রিয় যানটি ততক্ষণে সচল হয়ে উঠেছে।

হঠাৎ একটা তীব্র বিস্ফোরণের ধাক্কায় থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা গবেষণাকেন্দ্রটা। ক্রমাগত আক্রমণের মুখে তার সুরক্ষা আচ্ছাদন ভেঙে পড়েছে। যন্ত্রগণকের প্যানেল থেকে আগুনের লকলকে শিখাগুলো লাফ দিয়ে ছাদের দিকে মাথা তুলছিল। সেইদিকে একবার বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে, লাইফবোটের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এলেন প্রফেসর বোস। সঙ্গে সঙ্গেই, নীচে পেতে রাখা অতিপরিবাহী লাইনটি ছেড়ে ইঞ্চিখানেক ওপরে ভেসে উঠল লাইফবোট। তারপর মসৃণভাবে গতি বাড়িয়ে হারিয়ে গেল সুড়ঙ্গের মধ্যে।

‘ভয় করছে জিষ্ণু?’

হেডলাইটের চোখ ধাঁধানো আলোয় দ্রুত পেছন দিকে ছুটতে থাকা সুড়ঙ্গের দেওয়ালগুলোর দিকে দেখতে দেখতে জিষ্ণু মাথা নাড়ল।

‘গুড। ভয় পাওয়া ভালো ব্যাপার। ওতে সাবধানতা বাড়ে। কিন্তু ভয় পেয়ে হেরে যাওয়া ভালো নয়।’

জিষ্ণু হঠাৎ মুখ তুলে উজ্জ্বল চোখে চাইল বাবার দিকে, ‘আমরা হেরে যাইনি?’

সামনের ছোট্ট প্যানেলটাতে দ্রুত আঙুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে প্রফেসর বোস বললেন, ‘না জিষ্ণু। গবেষণাকেন্দ্রের চারপাশে প্রতিরক্ষাকবচ চালু থাকায় পৃথিবীতে জানাতে পারিনি তখন। কিন্তু এইবার খবরটা পাঠাব। ওরা যে-ই হোক, যেখান থেকেই আসুক, ওদের খুঁজে বের করে ধ্বংস করবই আমরা। একাঘ্নিকে আমরা আবার তৈরি করব দেখে নিও। এইবারে তা হবে পৃথিবীর বুকে বসে—’

বলতে বলতেই তাঁর হাতের ছোঁয়ায় ট্রান্সমিটারের থেকে ইথার চিরে পৃথিবীর দিকে ছুটে গেল খানিক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার একটা সংক্ষিপ্ত ভিডিয়ো রেকর্ডিং।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অজান্তে চাঁদের কক্ষপথ থেকে, গোটা উপগ্রহটাকে ঘিরে ফেলা প্রতিফলক তরঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আটকে পড়া সেই বেতার সংকেতকে ধরে নিয়ে একটি বিশেষ কম্পাংকে মঙ্গলের দিকে ছুড়ে দিল আক্রমণকারী টাইগার ক্লাস ফ্রিগেটটি। সেটিকে পর্দায় দেখতে দেখতে মঙ্গলের নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে থাকা অ্যাডমিরাল লালপিওতের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল এইবার। সৈয়দের গলা ভেসে আসছিল স্পিকারে, ‘ইঁদুরটার অবস্থান ধরা গেছে অ্যাডমিরাল।’

সামনের পর্দায় ততক্ষণে ভেসে উঠেছে চাঁদের শরীর থেকে ছিটকে বের হয়ে আসা ছোট্ট লাইফবোটটার ছবি। পেছন পেছন ছুটে আসা যুদ্ধযানগুলোকে গতির প্রতিযোগিতায় অনায়াসে পেছনে ফেলে রেখে তা উল্কার মতো ধেয়ে যাচ্ছিল পৃথিবীর দিকে। যুদ্ধযানগুলোর লেজার কামানের আঘাত নির্বিষভাবে ছিটকে যাচ্ছিল তার প্রতিরক্ষাকবচে বাধা পেয়ে। সেইদিকে তাকিয়ে দেখে দ্রুতহাতে একটা সংযোগকারী যন্ত্রের মাইক্রোফোন হাতে তুলে নিলেন লালপিওতে, ‘কাউন্সেলর গ্রোভার, আশা করি পার্থিব যানের থেকে পৃথিবীর দিকে পাঠানো এই বিপদসংকেতজ্ঞাপক ভিডিয়ো ট্রান্সমিশনটি আপনি দেখেছেন। যানটি পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছোতে সময় নেবে আরও আধঘণ্টা। পনেরো মিনিটের মধ্যে এতে প্রয়োজনীয় বদল এনে ফাইলটা আমার কম্পিউটারে ফেরত পাঠাবেন। মনে রাখবেন, সময় পনেরো মিনিট। কী বদল করতে হবে তা আশা করি—’

‘—আমি জানি। কাজ শুরু হয়ে গেছে। দশ মিনিটে পাবেন,’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে অন্য ধার থেকে সংযোগ কেটে দিলেন পল গ্রোভার।

***

‘খবরটা কি আর একবার পৃথিবীর দিকে সম্প্রচার করবে বাবা?’

সামনের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই প্রফেসর নিচু গলায় জবাব দিলেন, ‘সম্ভব হবে না জিষ্ণু। প্রতিরক্ষা বর্ম চালু রয়েছে। এ অবস্থায় আর কোনও যোগাযোগ সম্ভব নয়। তবে, আর মাত্র দশ মিনিট। তারপরই আমরা পৃথিবীর আবহমণ্ডলে পৌঁছে যাব। তুমি ভেবো না।’

বহু দূরে, মঙ্গলের নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে সামান্য বদলে দেওয়া ভিডিয়ো ট্রান্সমিশনটি দেখতে দেখতে মৃদু হাসি ফুটে উঠছিল লালপিওতের মুখে। বাইরের আকাশে ভেসে থাকা যুদ্ধযানগুলোর ছবি মুছে গেছে সেখানে। শুধু ল্যাবরেটরির মধ্যে প্রফেসর বোস আর তাঁর ছেলের ছবিটুকুই দেখা যাচ্ছে। তাঁদের কথাবার্তা থেকে বের করে আনা কিছু অংশ বাজছে মাইক্রোফোনে, ‘—একাঘ্নিকে আগে ধ্বংস করতে হবে আমায়— তুমি লাইফবোটটার ভেতরে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমার মিনিটকয়েক সময় লাগবে এখানে—’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণে গুঁড়ো হয়ে যেতে থাকা ক্ষেপণাস্ত্রের ছবিটা দেখতে দেখতে দ্রুত নয়াদিল্লির পার্থিব প্রতিরক্ষামন্ত্রকের সংকেতসংখ্যাগুলো স্পিকারে বলে যাচ্ছিলেন তিনি। নির্দিষ্ট সংকেতগুলো বলা শেষ হতে সৈনিকের পোশাক পরা একজন প্রৌঢ়ের কঠোর মুখ ভেসে উঠল পর্দায়। লালপিওতের চোখে চোখ রেখে তিনি বললেন, ‘শুভ সন্ধ্যা অ্যাডমিরাল। হঠাৎ আমাদের সঙ্গে সংযোগ করবার কারণ জানতে পারি কি?’

‘অ্যাডমিরাল সেন, একটা গুরুতর খবর আছে। আপনাদের চাঁদের ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণা প্রকল্পের—’

পর্দার মানুষটি ভ্রূকুঞ্চিত করে বললেন, ‘আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন অ্যাডমিরাল লালপিওতে। চাঁদে আমাদের ওরকম কোনও—’

‘আঃ অ্যাডমিরাল সেন, আমার কথাটা শেষ করতে দিন। এটা তর্কাতর্কি করবার সময় নয়। চাঁদের কাছাকাছি উড়তে থাকা আমাদের একটি গবেষণাযান খানিক আগে এই ভিডিয়ো রেকর্ডিংটি করে পাঠিয়েছে। পৃথিবীর উপনিবেশ হিসেবে আমাদের কর্তব্য আপনাদের কাছে তা পাঠানো। তাই পাঠাচ্ছি। আপনাদের প্রফেসর বোস এখন পৃথিবীর দিকে রওনা হয়েছেন। তাঁর সম্ভবত কোনও উগ্রপন্থীদলের হয়ে এই নাশকতাটি তিনি করেছেন বলে আমাদের মনে হয়। ক্লিপিংটি দেখবার পর যা উচিত মনে করবেন, করবেন।’ বলতে বলতেই ক্লিপিংটি দেখা গেল অ্যাডমিরাল সেনের মনিটরে চলতে শুরু করেছে। তাঁর কঠোর হয়ে ওঠা মুখটির দিকে তাকিয়ে ট্রান্সমিশন বন্ধ করতে করতে অ্যাডমিরাল লালপিওতের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল আবার, দাঁত চেপে নিচু গলায় বললেন, ‘এইবার প্রফেসর বোস— খেলা জমবে—’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *