২
সামনে ভাসমান অতিকায় ত্রিমাত্রিক প্রক্ষেপণক্ষেত্রটিতে অতিকায় বাড়িগুলোকে লাল পটভূমিতে ছোট ছোট পাথরের টুকরোর মতো দেখায়। কৃত্রিম উপগ্রহের বিহঙ্গমদৃষ্টিতে শ্রেণীবদ্ধ, সার সার বাড়িগুলো অতিকায় এক চাকার অজস্র স্পোকের মতো কেন্দ্রীয় প্রশাসণিক এলাকা থেকে বের হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে একশো মাইল বিস্তৃত বৃত্তাকার বসতি অঞ্চলের পরিধির দিকে। এককোণে, দ্রুত বদলাতে থাকা কয়েকটি ভাসমান সংখ্যার ছবি ধীরে ধীরে শূন্যের দিকে এগোচ্ছিল। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। অ্যাডমিরাল লালপিওতে কন্ট্রোল প্যানেলের আলোজ্বলা খোপগুলির দিকে চোখ ফেলে ধ্যানস্থ হয়ে রয়েছেন। ভাসমান সংখ্যাগুলো কমতে কমতে কুড়ির ঘর ছুঁতেই তাঁর আঙুলের আদেশে বদলে গেল সামনে ভাসমান ত্রিমাত্রিক প্রক্ষেপণের ছবি। ভূসমলয় কক্ষ থেকে চিত্রপ্রক্ষেপক যন্ত্র তার শক্তি বাড়াল এক লহমায়। দ্রুতবেগে মাটির দিকে ধেয়ে আসা একটি যানের জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্যের মতোই ছবিটি ধেয়ে এল আরও কাছে। ক্রমেই বড় হয়ে উঠতে উঠতে একসময় কেন্দ্রীয় প্রশাসণিক ভবনটির ছবি ছেয়ে ফেলল গোটা প্রক্ষেপণক্ষেত্রটাকে। তার একপাশে, একটি উৎক্ষেপণসুড়ঙ্গের মুখে ফোকাস করল চিত্রপ্রক্ষেপক। ভাসমান সংখ্যাগুলো ততক্ষণে শূন্য ছুঁয়েছে। কাউন্টডাউনের শেষ সীমানা ছুঁয়ে যেতেই সেই অন্ধকার গহ্বরটার ভেতরে একটা তীব্র নীলচে আভা জেগে উঠল। তারপর সেই নীল আলোর মধ্যে থেকেই মুখ জাগাল একটা কুচকুচে কালো গোলক। ধীরে ধীরে বাইরে বের হয়ে এসে একমুহূর্ত থেমে দাঁড়াল সে। তারপর, সেই নীল রঙের অতিউত্তপ্ত প্লাজমার ধারার ধাক্কায় মুহূর্তে গতিবেগ বাড়িয়ে আলোর এক তৃতীয়াংশ গতিতে ধেয়ে গেল অন্ধকার মহাকাশের দিকে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রক্ষেপণক্ষেত্রের ছবিটা বদলে গিয়ে সৌরজগতের একটি মানচিত্র দেখা দিল। সেখানে মঙ্গল গ্রহ থেকে একটি সুদীর্ঘ লাল রঙের রেখা ধনুকের মতো বাঁক নিয়ে সৌরজগতের একেবারে শেষ সীমার কাছাকাছি একটি তারকাচিহ্নিত নিশানায় মিশেছে। সেই রেখাটি ধরে, এদিক-ওদিক একচুলও বিচ্যূত না হয়ে তখন এগিয়ে চলেছে একটি ঘন নীল বিন্দু।
অ্যাডমিরাল লালপিওতে উঠে দাঁড়িয়ে সেই নীল বিন্দুটির দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘সমবেত কাউন্সিলরগণ, আমাদের চতুর্থ তথা শেষ টাটল ব্লাস্টারের উৎক্ষেপণ সফল হয়েছে। মাত্রই কুড়ি ঘণ্টা পরে রেডারের চোখে অদৃশ্য এই ক্ষেপণাস্ত্রের ধাক্কায় ধূমকেতু সুইফট টাটলের গতিমুখ পুরোপুরি ঘুরে যাবে পৃথিবীর দিকে।’
সমবেত সহর্ষ হাততালির শব্দে নিয়ন্ত্রণকক্ষের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল। গ্যালারির কোণের দিকে কিছু তরুণ কাউন্সিলর মিলে জিগির দিতে শুরু করেছে ততক্ষণে। সে জিগিরের মূল বক্তব্য হল, শক্তিমান পৃথিবীর উপনিবেশ হিসেবে বেঁচে থাকা আর নয়। এইবারে তার ধ্বংসই মহান মঙ্গল উপনিবেশকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে। অ্যাডমিরাল লালপিওতে পরম তৃপ্তিতে পাশে বসা জেমস আরিয়ানার দিকে চাইলেন একবার। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর আগে মঙ্গলগ্রহে প্রতিষ্ঠিত এই প্রিজন কলোনিতে নির্বাসিত প্রথম দলটির সদস্যদের মধ্যে তাঁরা দুজনই মাত্র বেঁচে আছেন এখনও। সময় বদলেছে। শুধুমাত্র নির্বাসিত অপরাধীর দল ছাড়াও পৃথিবীর সমাজ থেকে পালিয়ে আসা আরও বহু মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছেন এই উপনিবেশে। তাঁদের নিদারুণ পরিশ্রমে এক সময়ের সেই প্রিজন কলোনি আজ বদলে গেছে এক সমৃদ্ধ উপনিবেশে। পৃথিবীর শাসনের হাত থেকে তারা মুক্তি চায়। সরাসরি যুদ্ধে সে স্বপ্ন পূরণ হবার উপায় নেই। তীক্ষ্ণধী বৈজ্ঞানিক জেমস আরিয়ানার সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সাধনার ফল এই প্রজেক্ট!
‘আর মাত্রই পনেরোটা বছর জেমস। কেউ টের পাবে না। কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করবে না। তারপর, ২১২৬ সালের ১৪ আগস্ট, আকাশ থেকে বজ্রের মতো এসে পৃথিবীর বুকে ভেঙে পড়বে ওই ধূমকেতু—’
‘কিন্তু একটা সমস্যা আছে অ্যাডমিরাল। একটাই বাধা—’
জেমস আরিয়ানার হাসিমুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল। ভ্রূকুঞ্চিত করে তিনি তাকালেন লালপিওতের দিকে। গলার আওয়াজটা এসেছিল পেছনের সারির থেকে। সেইদিকে ফিরে তাকিয়ে লালপিওতে প্রশ্ন করলেন, ‘কে? কোন বাধার কথা বলছেন?’
পেছনের সারি থেকে একটু তরুণ উঠে দাঁড়িয়েছে। সেইদিকে তাকিয়ে লালপিওতের মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠল। পল গ্রোভার! কাউন্সিলের তরুণতম সদস্য। ক্ষেপণাস্ত্র সম্পর্কিত গবেষণায় মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল সে পৃথিবীর বিজ্ঞানীমহলে।
অনেক চড়া মূল্যে তাকে কিনে এনেছেন লালপিওতে। সে মূল্যের একটা ছোট অংশ ছিল এই কাউন্সিলারের পদ। অহংকারী, দুর্বিনীত যুবকটি কোনও কিছুকেই সহজে মেনে নেয় না। অথচ যখনই সে কোনও ব্যাপারের প্রতিবাদ করেছে, তার সুতীক্ষ্ণ যুক্তির কাছে মাথা নত করতে হয়েছে গোটা কাউন্সিলকেই। তার ঔদ্ধত্ব কাজেই যতই অসহ্য হোক তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। একটু বিরক্ত ভঙ্গীতে হাত নাড়িয়ে তিনি বললেন, ‘বলুন ড. গ্রোভার, আপনার কী বলবার আছে।’
ড. গ্রোভার তাঁর হাতে ধরা ছোট্ট চিপটিকে ডেস্কের কম্পিউটারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাধা এই নতুন আবিষ্কারটি।’ সামনের ত্রিমাত্রিক পর্দায় তখন মহাকাশ ম্যাপ মুছে গিয়ে ভেসে উঠেছে একটা অতিকায় ক্ষেপণাস্ত্রের ছবি। তার একপাশে আলোর অক্ষরে দ্রুত লেখা হয়ে চলেছে তার নানান মাপজোকের খবর।
‘ভিডিয়ো ক্লিপিংটা পৃথিবীর চন্দ্রপৃষ্ঠের গবেষণাকেন্দ্র থেকে ঠিক দু-দিন আগে তুলে পাঠিয়েছে আমাদের গুপ্তচর উপগ্রহ। এর নাম একাঘ্নি।’
জেমস আরিয়ানা মাথা নাড়লেন, ‘বুঝলাম। পৃথিবীর তৈরি আরেকটি মারণাস্ত্র। সৌরমণ্ডলের স্বাধীনতাকামী একাধিক উপনিবেশকে বশে রাখবার জন্য আরও একটি উপকরণ। কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের প্রজেক্টের বাধা কোথায় কাউন্সিলর গ্রোভার? আমার মনে হয় এই নিয়ে আলোচনায় আমরা আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট—’
হঠাৎ জেমস আরিয়ানার ধীরস্থির গলাটিকে ডুবিয়ে দিয়ে গ্রোভারের গলা জেগে উঠল ফের, ‘না প্রফেসর আরিয়ানা। আমরা সময় নষ্ট করছি না। মাপজোকগুলো একবার দেখুন ভালো করে। একটা কুড়ি কিলোমিটার ব্যাসার্ধের গ্রহাণুকে গুঁড়িয়ে দেবার ক্ষমতা ধরে ওই ক্ষেপণাস্ত্র। আর, সুইফট টাটলের কেন্দ্রীয় অংশের ব্যাসার্ধ মাত্রই পনেরো কিলোমিটার। ভেবে দেখুন, এই ক্ষেপণাস্ত্রটি পৃথিবীর হাতে থাকলে—’
একটা সমবেত হিসহিস শব্দ উঠল গোটা ঘরটি জুড়ে। তার মধ্যে থেকেই ফের জেগে উঠল জেমস আরিয়ানার গলার স্বর, ‘কিন্তু, এই দানবিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরক শক্তির উৎস কী? মানুষের জানা কোনও শক্তির উৎস থেকেই এর—’
‘মানুষের নয়, বলুন, আপনার জানা এমন কোনও শক্তির উৎস নেই, তাই না প্রফেসর?’ গ্রোভারের গলায় ব্যঙ্গের স্পর্শ ছিল, ‘আপনি এ বিষয়ে আধুনিকতম গবেষণার খবর রাখেন কি? পৃথিবীর প্রতিরক্ষা গবেষণামন্ত্রকের প্রফেসর সত্যব্রত বসুর গবেষণার বিষয়ে আপনি ঠিক কতটা খবর রাখেন বলুন তো? তাঁর ক্ষেপণাস্ত্র পরিচালন গবেষণার সমস্ত ফলাফলই তো চূড়ান্ত গোপনীয়! এমনকী পৃথিবীর কেন্দ্রীয় কম্পিউটার বুদ্ধ, যার স্মৃতিভাণ্ডারে গোটা গ্রহটির যাবতীয় তথ্য জমা থাকে, সেখানেও আমি প্রফেসর বোসের গবেষণাসংক্রান্ত কোনও ফলাফল খুঁজে পাইনি। তাহলে?’
জেমস আরিয়ানা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁকে হাত তুলে থামতে বলে গ্রোভার বলল, ‘আরও একটু কথা বাকি আছে আমার প্রফেসর। এর বিস্ফোরক শক্তির উৎসের খবর জানা না থাকলেও এ-খবর আমাদের কাছে আছে যে, দীর্ঘ কুড়ি বছরের গবেষণার ফসল এই ক্ষেপণাস্ত্রের যাবতীয় তথ্য প্রফেসর বোস একমাত্র নিজের কাছেই জমা রেখেছেন। আর, দু-নম্বর খবরটা হল, আর ঠিক এক পার্থিব দিন পরে চাঁদের শান্তিসাগর উপত্যকায় প্রথম পরীক্ষামূলক উড়ান হবে এই ক্ষেপণাস্ত্রের। আর, তা সফল হলে—’
হাতের ইঙ্গিতে গ্রোভারকে থামিয়ে দিলেন লালপিওতে। সৈয়দ আব্রাহাম নিজের আসন ছেড়ে ততক্ষণে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিচু গলায় তিনি বললেন, ‘পরীক্ষামূলক উড়ানটা বন্ধ করতে হবে সৈয়দ। ক্ষেপণাস্ত্রটার কোনও অস্তিত্ব যেন অবশিষ্ট না থাকে। আর প্রফেসর বোসকে আমার চাই। জ্যান্ত। তার সমস্ত গবেষণার তথ্যের সঙ্গে। জিনিসটা একবার হাতে পেলে—’
সৈয়দ মানুষটি কথা কম বলেন। উত্তর পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তান অঞ্চলের মানুষ। পরপর তিনটি গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসে মঙ্গল উপনিবেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন দশ বছর আগে। এখন অ্যাডমিরাল লালপিওতের যুদ্ধ উপদেষ্টা দলের প্রধান। নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে তিনি বের হয়ে গেলেন কাউন্সিল কক্ষ থেকে।