অন্তিম অভিযান – ১

১.

একটি ভয়াবহ আবিষ্কার

‘বোস, কদিন ধরে ভাবছি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? মানে, যদি ব্যাপারটা জানাতে তোমার কোনও আপত্তি না থাকে!’

মনিটর থেকে চোখ না সরিয়েই সত্যব্রত বোস নিচু গলায় বললেন, ‘বলো অঁরি।’

‘কদিন ধরেই এই যে গভীর মহাকাশ পর্যবেক্ষণের এত তথ্য নিয়ে যাচ্ছ আমার কম্পিউটার থেকে, ও দিয়ে তুমি করবেটা কী?’

তীক্ষ্ণ একটা শিসের শব্দ উঠল মনিটরের থেকে। তারপর একটা সুরেলা গলা ঘোষণা করল, ‘তথ্য আদানপ্রদান সম্পূর্ণ হয়েছে।’

হাতে ধরা ছোট্ট যন্ত্রটার পর্দায় সদ্য পাওয়া তথ্যগুলোতে চোখ বোলাতে বোলাতে সত্যব্রত বললেন, ‘সে তো আমার চিঠিতেই বলেছি—মহাকর্ষকণিকা গ্র্যাভিটন অনুসন্ধান—’

‘এবং সেই দিয়ে গ্র্যাভিটিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা— এই বলবে তো? সে তো ফাইলেই আছে। আমি তা জানতে চাইনি। সত্যি কথাটা জানতে চেয়েছি।’

চাঁদের অন্ধকার অর্ধে মেয়ার মস্কোভিয়েন্স নামের গভীর আগ্নেয়খাতের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা এই অতিকায় অবজার্ভেটরির গোটাটাই স্বচ্ছ, প্রায় অদৃশ্য টেফলো সিলিকনের আবরণে ঢাকা। চেয়ারটা পেছনে হেলিয়ে মাথার ওপর ঝুঁকে থাকা তারাদের দিকে চোখ রেখে সত্যব্রত মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কী বলতে চাইছ অঁরি? আমি মিথ্যে বলছি?’

ড. অঁরি উঠে গিয়ে দু-পাত্র কফিশুদ্ধ একটা ট্রে এনে প্রফেসর বোসের সামনে নামিয়ে রেখে নিজে একটা কাপ তুলে নিয়ে লম্বা চুমুক দিলেন। তারপর, স্বভাবমাফিক শান্ত, নিচু গলায় বললেন, ‘ব্যাপারটা একরকম তাই।’

সত্যব্রত হাতে তুলে নেওয়া কফির কাপটা নামিয়ে রাখলেন ফের, ‘যা বলছ, ভেবে বলছ তো অঁরি? প্রতিরক্ষা বিভাগের স্বীকৃত একটা প্রজেক্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে জিনিসটা অন্য চেহারা নেবে কিন্তু। তুমি বা তোমার জ্যোতির্বিদ্যা বিভাগ কি তার জন্য তৈরি?’

ড. অঁরির হাবভাবে কোনও তাপউত্তাপ দেখা গেল না। বললেন, ‘প্রমাণ নয় ডিয়ার বোস। যুক্তি, বিশুদ্ধ যুক্তি! প্রমাণ নকল করা যায়। যুক্তির সে ভয় নেই। অনেকগুলো যুক্তি আছে আমার, তোমার প্রজেক্টের সত্যতার বিরুদ্ধে। আমি শুধু তার একটা বলছি।

‘এই নিয়ে তুমি গত তিন মাসে কুড়িবার রিডিং নিয়েছ আমার এখানে। প্রত্যেকবারই ১৬.৫ ডিগ্রি পূর্ব থেকে ১৬.৭ ডিগ্রি পূর্ব এলাকাটুকুরই রিডিং নিয়েছ তুমি। গ্র্যাভিটনের অনুসন্ধান করতে মহাকাশের এই ছোট্ট অংশটুকুকেই কেন বেছে নিলে তুমি বোস?’

‘নমুনা সমীক্ষা অঁরি। সবটা আকাশের তথ্য একবারে নিয়ে তো আর কাজ করা যাবে না! কাজেই—’

ড. মিশেল অঁরি মৃদু হাসলেন, ‘অত্যন্ত ভারী মহাজাগতিক বস্তু যে এলাকায় থাকে, যেমন ধরো কোনও বড় নক্ষত্রপুঞ্জ, সেইখানেই তো গ্র্যাভিটনের ঘনত্ব বেশি হয়, তাই না বোস? তোমার নির্বাচিত এলাকাটার মহাকাশ ম্যাপ দ্যাখো,’ বলতে বলতে অঁরির আঙুলের চাপে সামনের একটা বড় প্যানেল আলোকিত হয়ে উঠল। সেখানে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের বুকে একটামাত্র ছোট্ট আলোর ফোঁটা। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, এই সেক্টরটাতে অন্তত একশো আলোকবর্ষের মধ্যে কোনও বড় নক্ষত্রপুঞ্জ নেই। থাকবার মধ্যে রয়েছে কেবল ওই ধূমকেতুটা। কী যেন নাম? উম্‌ম্‌—সুইফট টাটল। ধূমকেতু! মহাকাশের সবচেয়ে হালকা বস্তু! তার চারপাশে তুমি গ্র্যাভিটন খুঁজছ বোস? এ প্রশ্নটা যদি আমি তুলি তাহলেও প্রতিরক্ষা বা জ্যোতির্বিদ্যা, কোনও বিভাগই কি সেটাকে অস্বীকার করতে পারবে?’

নিঃশব্দে বসেছিলেন প্রফেসর সত্যব্রত বোস। সত্য কখনও চাপা থাকে না। বিশেষ করে মিশেল অঁরির মতো বৈজ্ঞানিকের কাছে। তাঁর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে যেন তাঁর মনের কথাটা পড়তে চেষ্টা করছিলেন অঁরি। খানিক বাদে ফের নিচু গলায় বললেন, ‘তোমার প্রতিরক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর স্মৃতিরেখা গণেশন আমার পুরোনো সহকর্মী। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম আমি, তোমার প্রজেক্ট নিয়ে। না না, উত্তেজিত হয়ো না। তাঁকে আমি তোমার এই ‘গ্র্যাভিটি মিসাইল গবেষণা’র কথা কিচ্ছু বলিনি। শুধু জানতে চেয়েছিলাম, চাঁদে তোমার মূল প্রজেক্টটা কী? উত্তরে তিনি জানিয়েছেন, তোমার কাজ চলছে ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটার মিসাইল নিয়ে। গ্র্যাভিটি মিসাইল সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন, ওটা এখনকার বিজ্ঞানের নাগালের বাইরের একটা অসম্ভব ব্যাপার। হয়তো শখানেক বছর পরে ও নিয়ে তোমার মন্ত্রক ভাবনাচিন্তা শুরু করবে। এইবারে আমায় সত্যি কথাটা বলবে?’

খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে প্রফেসর বোস যখন ফের কথা বললেন, তখন তাঁর গলায় খানিক আগের উত্তেজনার ছিঁটেফোঁটাও নেই আর, ‘বুঝতে পারছি, তোমার কাছে আর কিছু লুকোনো সম্ভব নয়। কিন্তু, কী হবে সত্যি বলে? তুমি বিশ্বাস করবে? কেউ বিশ্বাস করবে?’

‘চেষ্টা করে দেখো। আমি বিজ্ঞানী। মন্ত্রালয়ের নির্বোধ প্রশাসক নই যে, আইনের বইয়ের পাতার একচুল বাইরে গেলেই রে রে করে ছুটে আসব। তোমার কথার যুক্তি থাকলে নিশ্চয় বিশ্বাস করব, প্রতিরক্ষা বিভাগকে লুকিয়ে একটা নিজস্ব গবেষণা চালাবার উপযুক্ত কারণ তোমার আছে।’

কফির কাপটা নামিয়ে রেখে মিশেল অঁরির দিকে ঘুরে বসলেন এইবারে প্রফেসর বোস, ‘সত্যিটা হল আমি ওই ধূমকেতুটার গতিপথ মাপবার চেষ্টা করছি কিছুদিন ধরে। আমি ধূমকেতু বিশেষজ্ঞ নই। নিতান্তই একজন অস্ত্রগবেষক। মন্ত্রালয়কে জানালে তারা নিজের কাজ ছেড়ে এই বুনো হাঁসের পিছনে দৌড়বার অনুমতি না-ও দিতে পারত।’

‘কেন বোস? ওর নিখুঁত গতিপথ মাপবার কাজ তো গত শতাব্দীতেই শেষ হয়ে গেছে। নতুন আর কী খুঁজে পাবে তুমি ওতে?’

‘বলছি। মার্সডেন ক্যালকুলেশনের কথা তো তোমার জানা আছে? ২১২৬ সালের ১৪ আগস্ট—’

‘জানি। সেদিন ওর পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খাবার একটা সম্ভাবনা আছে। দশ হাজারে এক—’

‘ওইখানেই ভুল করলে অঁরি। দশ হাজারে এক নয়,’ বলতে বলতে আঙুলের দ্রুত চাপে যন্ত্রগণকের টার্মিনালে কিছু নির্দেশ টাইপ করছিলেন সত্যব্রত বোস, ‘গত তিনমাস ধরে সেটা আস্তে কমে এসে একশোয় এক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিসেবগুলো দ্যাখো।’

মিনিট দশেক ধরে টার্মিনালের পর্দায় ভেসে চলা হিসেবগুলো খুঁটিয়ে দেখে অঁরি যখন মাথা তুললেন তখন তাঁর মুখের ভাব পালটে গেছে। খানিক অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু— তা কী করে সম্ভব? পৃথিবীর দিকে প্রায় এক ডিগ্রি সরে গেছে ধূমকেতুটার মুখ! বাইরে থেকে কোনও তীব্র অভিকর্ষীয় টান কিংবা ধূমকেতুটার ভেঙে গিয়ে তার ভরের বদল—’

‘—কিংবা ওর গায়ে নিখুঁত হিসেব করা কিছু বিস্ফোরণ! কী বলো অঁরি?’

মিশেল অঁরি হেসে মাথা নাড়লেন, ‘ব্যাপারটা রহস্যময়। কিন্তু তাই বলে ওর গায়ে হিসেব করে কিছু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গতিমুখ বদল? না বোস। তুমি চিরটাকালই কল্পনাপ্রবণ রয়ে গেলে। একটা ধূমকেতুকে দিয়ে টার্গেট প্র্যাকটিশ করবে এমন বোকা কোনও বিজ্ঞানী হতে পারে না। তত্ত্বটা পালটাও বরং তুমি।’

সত্যব্রত বোস গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, ‘তত্ত্ব আমার ঠিকই আছে অঁরি। ধূমকেতুর গতিপথের গ্রাফটা একবার দেখো ভালো করে। তিনটে জায়গায় তিনটে তীক্ষ্ণ বাঁক দেখতে পাচ্ছ? ওই জায়গাগুলোতে এসে ধূমকেতুটা হঠাৎ মোচড় মেরে তার গতিমুখ পালটেছে। বড় কোনও ধাক্কা না খেলে একটা বিরাট বরফ আর ধুলোর চাঁই নিজে থেকে বারবার দিক পালটাবে না। বিস্ফোরণ না হয় যদি, তাহলে সে ধাক্কাটা দিচ্ছে কীসে? না অঁরি, গোলমাল কিছু একটা আছে এর ভেতরে।’

বৃদ্ধ ফরাসিটি চিন্তিত মুখে মাথা নাড়লেন একবার। তারপর বললেন, ‘কথাটা তুমি কাউকে জানাওনি কেন?’

‘কারণটা বোঝা কঠিন নয় অঁরি। কিছু রহস্যময় বিস্ফোরণে একটা ধূমকেতুর মুখ আস্তে আস্তে পৃথিবীর দিকে ঘুরে যাচ্ছে! ব্যাপারটা প্রায় অবিশ্বাস্য। অতএব, একেবারে নিশ্চিত প্রমাণ হাতে না নিয়ে এই ব্যাপারে মুখ খুলে কেরিয়ার সুইসাইড করতে রাজি নই আমি। আরও দু-একটা রিডিং নিতে হবে আমায়।’

‘সে নাও-না যত খুশি,’ বলতে বলতে হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটালেন ড. অঁরি, ‘তা তোমার মিসাইল প্রজেক্টের কদ্দূর?’

‘এই রে, একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম,’ অপ্রস্তুত গলায় কথাটা বলতে বলতেই পকেট থেকে একখণ্ড প্লাস্টিক বের করে এনে মিশেল অঁরির হাতে সেটি তুলে দিয়ে প্রফেসর বোস বললেন, ‘পরশু সন্ধেবেলা একাঘ্নির প্রথম টেস্ট ফ্লাইট আছে। অথরাইজেশন চিপ দিয়ে গেলাম। আসবেন মনে করে!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *