অনুভব – প্রণয় খীসা ঝিমিত
সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশে কালো মেঘগুলি কুণ্ডলী পাকিয়ে বন্য হাতির মত এলোপাথারি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাহিরে বেরুনো সম্ভব নয়। এ রকম আকাশে সবারই মন কিছুটা উদাসীন থাকে। বাড়ীর বারান্দায় বসে মণিকা আনমনে সমরেশ মজুমদারের “সাতকাহন” পড়ছে। কিছুতেই মন বসছে না। যদিও দীপাবলীর করুণ কাহিনী বেশ মর্মস্পর্শী এবং বেদনাদায়ক। মনে করে, বাঙলাদেশের প্রতিটি মেয়ের আদর্শ হিসেবে দীপাবলীর চরিত্রকে মেনে নেওয়া উচিত।
এমনি সময়ে ডেক্স ক্যালেন্ডারের উপর চোখ পড়তেই মনটা আরো বেশী খারাপ ও ভারী লাগছে মণিকার। জুন মাসের ১০ তারিখ। মানে আরও একদিন পরই কল্পনাদির অপহরণের এক বছর। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘৯৬-এর ফলাফল কি হবে এসব ভাবনায় বাঙলাদেশের জনগণ যখন অধীর হয়ে প্রতীক্ষা করছিলো, তখনি হঠাৎ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের নজর কেড়ে কল্পনা’দিকে অপহরণ করে নেয়া হল। এসব ভাবতে ভাবতে গায়ে ঘাম বের হচ্ছে মণিকার। এমনি সময় হঠাৎ পল্লব উপস্থিত হয়ে বললো, “এই মণি, কী এমন ভাব-গম্ভীর হয়ে বসে আছিস, কবি হয়ে যাবি নাকি?… সে যাকগে, আসল কথাটা বলি শোন, হিল উইমেন্স ফেডারেশন থেকে তোর চিঠি এসেছে। ১২ তারিখ থানা মাঠে প্রতিবাদ সভা। তোকে অবশ্যই যেতে হবে বলেছে।”
— ‘ঠিক আছে যাবো। তো আজ কলেজে যাচ্ছিস তুই?’
—সম্ভবতঃ যাওয়া হবে না। খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছি।
—আচ্ছা, তুই অত অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে পড়াশুনা করবি কখন? নাকি একেবারে গোল্লায় যাচ্ছিস্?
—আসলে মণি, তুই বুঝতে চেষ্টা করছিস্ না কেন, এ রকম অস্থিতিশীল পরিবেশে কি পড়াশুনা করা যায়?
সর্বাগ্রে তাকে দেখা যেত। অথচ ওর বাবাজী আন্দোলনের প্রতি ছিলেন যথেষ্ট বিমূখ। অর্থোপার্জন ছাড়া কিছুই বোঝেন না। যেন টাকা উপার্জনের জন্যই এই পৃথিবীতে জন্মেছেন।
বলা যায়, তাদের পরিবারটা রক্ষণশীল পরিবার। এধরণের পরিবারের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে মণিকা জুম্ম জাতির আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
ঘড়িতে ন’টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকী। দশটায় প্রতিবাদ সভা। তাই তাড়াতাড়ি রিক্সা চেপে প্রতিবাদ সভার দিকে রওনা হলো পল্লব। মাঝপথে এক আর্মি চেক পোষ্টে তার রিক্সাকে থামানো হলো। একজন মাঝ বয়সী বাঙালী ভদ্রলোক বললেন, “পল্লব সাহেব, সব সময় ঝামেলা বাধানোর ধান্ধায় থাকেন কেন?”
পল্লবতো একেবারে হতবাক। রিক্সা থেকে নেমে সে বলল, “আমিতো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কি ব্যাপার?”
—বুঝতে তো পারবেন না। গত ২৭ শে জুনের কথা ভুলে গেছেন? মনতোষ, রূপন, সমর বিজয়, সুকেশের মত করে…। আপনারা খুব সহজে ভুলে যান। মনে রাখতে চেষ্টা করবেন। নইলে পরিণাম অশুভও হতে পারে।”
পল্লব বেশ আনমনা হয়ে পড়ল। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। প্রতিবাদ সভায় পৌঁছতে প্রায় ত্রিশ মিনিট লেট হয়ে গেল। প্রায় হাজার চারেক ছাত্রছাত্রী ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়েছেন। খুব ভালো লাগলো। ইচ্ছে হলো চিৎকার করে বলি, ‘আমাদের জুম্ম জাতির স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়িত হবেই।
প্রতিবাদ সভায় স্বয়ং কল্পনা’দির মা’ও উপস্থিত ছিলেন। তার চোখ দু’টো অশ্রুতে ভিজে রোদ্রে-জ্বলে-ওঠা শিশিরের মতো চিক চিক করছে। ভাবলাম, আর কতদিন কত মায়ের চোখে দেখতে হবে কান্নার অশ্রু, হাহাকার! আর কতকাল শুনতে হবে স্বজনহারা নিপীড়িত মানুষের আর্তচিৎকার? কতকাল দেখতে হবে ইজ্জ্বত লুণ্ঠিতা বোনের অসহায় মুখ? কবে শেষ হবে লাঞ্ছনা বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস?
ভাবতে ভাবতে কখন যে কবিতা’দির বক্তৃতা শেষ হয়ে যাচ্ছে তা ঠার কত পারলাম না। একটু পরেই সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো। সবাই সভাস্থল থেকে উঠে দাঁড়াতে শুরু করছে। এমন সময় কলেজের একটা জুনিয়র ছেলে এসে পল্লবকে বললো, “পল্লব’দা আপনার একটা চিঠি আছে”।
চিঠিটি পড়ার পরেই খেয়াল হলো যে মণিকা আসেনি। চিঠিটা তারই লেখা। ও লিখেছে, পল্লব’দা,
শুভেচ্ছা নিস্। আশাকরি ভালোভাবেই প্রতিবাদ সভা শেষ হয়েছে। আমি আসতে পারলাম না। তবে এ জন্য দুঃখ বোধ করছি না এই ভেবে যে, আমি আসতে না পারলেও হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটবে।
যদিও বাবা আমাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে, আন্দোলনকে তো তারা মেরে রাখতে পারবে না। আমার প্রতিটি শিরায় উপশিরায় তুই যে আন্দোলনের স্বপ্ন প্রবাহিত করেছিস, তা কোনদিন ফুরিয়ে যাবে না। আসলে যদি তোর মত সবাই আন্দোলনকে বেগবান করার প্রচেষ্টায় থাকে তবে জুম্ম জনগণের স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়িত হবেই।
আর আমাদের মেয়েদের কথা কি আর বলবো। আমাকে ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ রাখা হয়েছে বলে আজ আমি তোমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু মেয়েদের মধ্যে অনেকে আছে এখনো যারা নিজের মনের ঘরে নিজেকে নিজে কুলুপ এঁটে রেখেছে। বাইরের বিশাল জগতটা তারা দেখতে পাচ্ছে না। মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনের মাঝে সামিল হবার যে কী আনন্দ তা তারা উপলব্ধি করতে পারছে না। উত্তোলিত মুষ্টিবদ্ধ হাতে সারিবদ্ধ মানুষের দূর্বার মিছিলে নতুন দিনের সৌন্দর্য্য যে কী উদ্দীপনাময়, হাজারো মানুষের এককণ্ঠে উচ্চারিত শ্লোগান যে কত ছন্দময়, তা তারা জানে না। তারা এখনো যেন অন্তপুরে অবরোধবাসিনী। পল্লব’দা, তুমি তাদের মনের দুয়ারে আঘাত হানো। তাদেরকে বাইরে টেনে নিয়ে এসো। তোমার মণি।”
কাচালং কলেজ
স্বাধিকার : বুলেটিন নং—সাত, ২০ আগস্ট ‘৯৭