অধ্যায় সাত – যেখানে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয় মোটকু চার্লিকে
চোখ কুঁচকে মোটকু চার্লির আমেরিকান পাসপোর্টের দিকে চেয়ে রইল ইমিগ্রেশন অফিসার। ভাবখানা এমন, পাসপোর্টটা অন্য কোনো দেশের হলেই সে খুশি হতো; এমন কোনো দেশের যার নাগরিককে চাইলেই সে তার দেশে ঢুকতে বাধা দিতে পারে। তারপর, দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে, হাত নেড়ে এগিয়ে যেতে বলল ওকে।
কাস্টমস থেকে বেরিয়ে কী করবে, তাই ভাবল মোটকু চার্লি। একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে, ভাবল সে, এবং পেটপুজোও সেরে নিবো।
ট্রাম থেকে নেমে, সিকিউরিটি ব্যারিয়ার অতিক্রম করল সে। পা রাখল অরল্যান্ডো বিমানবন্দরের কেনাকাটার জায়গায়। মিসেস হিগলারকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন পড়ল আকাশ থেকে! যাত্রীদের মাঝে কাকে যেন খুঁজছে মহিলা। দুজনের চোখাচোখি হলো প্রায় একই সময়ে, ওর দিকে এগোল মিসেস হিগলার।
‘খিদে পেয়েছে?’ জানতে চাইল মহিলা।
জবাবে কেবল ওপর-নিচে মাথা নাড়ল ছেলেটা।
‘আশা করি,’ বলল মিসেস হিগলার। ‘টার্কি তোমার ভালো লাগে।’
মোটকু চার্লি একবার ভাবল, মিসেস হিগলারের লাল স্টেশন ওয়্যাগনটা কি সেই একই গাড়ি, যেটা ওর ছোটোবেলায় মহিলা চালাত? সম্ভবত একই। যুক্তি বলে, কোনো এক কালে নিশ্চয়ই নতুন ছিল; হাজার হলেও, সবকিছুই শুরুতে নতুন থাকে। সিটে ফাটল ধরে গেছে, চামড়ার কাভারেও। ড্যাশবোর্ডটাকে এখন ধুলোপড়া কাঠের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায় খুব সহজেই।
ওদের দুজনের মাঝে, সিটের ওপর, বসে আছে বাদামি কাগজের শপিং ব্যাগ।
মিসেস হিগলারের অতিপ্রাচীন গাড়িতে কাপ হোল্ডার নেই, তাই কফির প্রকাণ্ড মগটাকে গাড়ি চালাবার সময় দুই পায়ের ফাঁকে গুঁজে রাখে মহিলা। সম্ভবত এসি আবিষ্কারের আগের যুগের গাড়ি ওটা, তবে জানালা নামানো। মোটকু চার্লির অবশ্য তাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না; ইংল্যান্ডের স্যাঁতস্যাঁতে শীতলতার পর, ফ্লোরিডার গরম ভালোই ঠেকছে। দক্ষিণে, টোল রোডের দিকে এগোচ্ছে মহিলা; আর কথা বলছে। প্রসঙ্গ: শেষ হারিকেনের ধাক্কা, ভাতিজা বেঞ্জামিনকে নিয়ে সি-ওয়ার্ল্ড আর ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা, আর পর্যটকদের জন্য বানানো রিসোর্টগুলো দেখে আশাহত হবার গল্প নিয়ে। সেই সঙ্গে যোগ করল দালান বানানোর নানা আইন-কানুন, তেলের দাম, হিপ রিপ্লেসমেন্টের পরামর্শ দেওয়ায় ডাক্তারকে সরাসরি শুনিয়ে দেওয়া কথা, পর্যটকরা কেন বোকার মতো অ্যালিগেটরদের খেতে দেয় সেই কারণ। কেন যে নবাগতরা সৈকতে বাড়ি বানায়, আর যখন বাড়ি গিলে নেয় সমুদ্র কিংবা তাদের পোষা কুকুরকে গলাধঃকরণ করে অ্যালিগেটর, তখন অবাক হয়—সেই প্রশ্নও তুলল। চুপচাপ বসে সব শুনল মোটকু চার্লি, বুঝতে পারছে যে এসবই বলার জন্য বলা।
গতি কমিয়ে টিকেট কাটল মিসেস হিগলার, টোল রোড ধরে যেতে পারবে এখন। তবে মুখ এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয়নি, সেই সঙ্গে বন্ধ হয়নি চিন্তার ট্রেনও।
‘তো,’ অবশেষে বলল সে। ‘ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে?’
‘তুমি কিন্তু,’ অনুযোগ জানাল মোটকু চার্লি। ‘চাইলে আমাকে সাবধান করতে পারতে।’
‘সে যে দেবতা, সেই কথা তো জানিয়েছিলাম, নাকি?’
‘কিন্তু এটা তো বলোনি যে মানুষকে জঘন্য রকমের শূলবেদনা দিয়ে অভ্যস্ত আমার ভাই!’
নাক টানল মিসেস হিগলার, চুমুক দিল মগে।
‘কোথাও থেমে একটু খেয়ে নেওয়া যায় না?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। ‘বিমানে শুধু সিরিয়াল আর কলা ছিল। চামচও দিতে পারেনি। আমার কাছে আসার আগেই দুধ ফুরিয়ে গেছে। ক্ষমা প্রার্থনা করে, ফুড ভাউচার দিয়ে কাজ সেরেছে।’
মাথা নাড়ল মিসেস হিগলার।
‘তাহলে তো বিমানবন্দর থেকেই ভাউচার দেখিয়ে হ্যামবার্গার নিয়ে নিলে ভালো করতাম!’
‘একটু আগেই না বললাম,’ মুখ খুলল মিসেস হিগলার। ‘লোয়েলা ডানউইডি তোমার জন্য টার্কি রান্না করছে? যদি তুমি ম্যাকডোনাল্ডসে খেয়ে- দেয়ে ভরা পেটে হাজির হও, তাহলে তার কেমন লাগবে, বলো?’
‘কিন্তু খিদেয় যে আমার নাড়িভুঁড়ি হজম হবার জোগাড়। তাছাড়া পৌঁছতে এখনো কমপক্ষে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে।’
‘আমি যেভাবে চালাই,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল মহিলা। ‘তাতে এত সময় লাগবে না।’
কথা শেষ করেই অ্যাক্সিলেটরে পা বসিয়ে দিল সে। ফ্রিওয়ে ধরে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি; এরইমাঝে চোখ বন্ধ করে নিজের বাঁ পা দিয়ে কাল্পনিক ব্রেক চেপে ধরতে লাগল মোটকু চার্লি। ওকে দ্রুতই ক্লান্ত করে দিল কাজটা।
তবে দুই ঘণ্টারও অনেক কম সময়ের মাঝে টোল রোড পেরিয়ে স্থানীয় একটা মহাসড়কে এসে পড়ল ওরা। শহরের দিকে যাচ্ছে, বার্নস অ্যান্ড নোবল ও অফিস ডিপো অতিক্রম করল গাড়িটা। সাত-অঙ্ক মূল্যের বাড়িগুলোর সামনে দিয়েও গেল ওরা, যেগুলোতে আলাদা সিকিউরিটি গেট লাগানো হয়েছে। এরপর পুরাতন রেসিডেনশিয়াল এরিয়ার রাস্তায় উঠে এলো গাড়ি, ছোটোবেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেল মোটকু চার্লির; তখন অবশ্য এই রাস্তাগুলোর যত্ন নেওয়া হতো। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান টেকঅ্যাওয়ে আর জ্যামাইকান পতাকাঅলা জানালার রেস্তোরাঁটাও ফেলে এলো পেছনে; কাচের ওপর হাতে লেখা হয়েছে বিভিন্ন খাবারের নাম।
জিভ থেকে জল গড়াতে লাগল মোটকু চার্লির, পেট গুড়গুড় করে ডাকছে।
আচমকা ঝাঁকি খেল গাড়িটা। এখানকার বাড়িগুলো অনেক বড়ো, এবং তুলনামূলক অনেক বেশি পরিচিত।
গোলাপি রঙের প্লাস্টিকের ফ্ল্যামিংগো এখনও বসে আছে মিসেস ডানউইডির সামনের প্রাঙ্গণে। তবে সূর্যের তাপে অনেক আগেই ঝলসে প্রায় সাদা হয়ে গেছে ওগুলো। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে আয়না দিয়ে বানানো একটা বল, যা সাধারণত ভবিষ্যৎ দেখার জন্য ব্যবহৃত হয়। এক মুহূর্তের জন্য মোটকু চার্লিকে ভয় পাইয়ে দিল সেটা, জীবনে এরচেয়ে বেশি ভয় অন্য কিছুকে পায়নি সে।
‘স্পাইডার কেমন যন্ত্রণা দিচ্ছে?’ জানতে চাইল মিসেস হিগলার, মিসেস ডানউইডির সদর দরজার দিকে এগোচ্ছে তারা।
‘এক কথায় জবাব দিই,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘সম্ভবত আমার বাগদত্তার সঙ্গে শুচ্ছে সে…যে কাজটা করা আমার দ্বারাও এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি!’
‘ওহ,’ বলল মিসেস হিগলার, বাজাল ডোরবেল।
.
ম্যাকবেথের সঙ্গে মিল আছে পরিস্থিতির, ভাবল মোটকু চার্লি। এক ঘণ্টা পরের কথা হচ্ছে কিন্তু এখন। সত্যি বলতে কী, যদি ম্যাকবেথের ডাইনিগুলো চারজন ছোটোখাটো বুড়ি মহিলা হতো, আর যদি তারা কেতলির তরল না নাড়িয়ে এবং ভয়ানক মন্ত্রোচ্চারণ না করে ম্যাকবেথকে আমন্ত্রণ জানিয়ে টার্কি, ভাত আর সবজি খেতে দিত চীনে মাটির সাদা থালা লাল-সাদা নক্সা কাটা প্লাস্টিকের টেবিলক্লথে সাজিয়ে — মিষ্টি আলুর পুডিং আর ঝাল-ঝাল বাঁধাকপির কথা নাহয় বাদই থাক—এবং জোর করত দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয়বার থালা ভরে খাবার নিতে, যা শুনে ম্যাকবেথ ঘোষণা করত যে ‘আর সম্ভব না, এক লোকমা খেলেই পেটে ফেটে যাবে’, আর তারপরও ডাইনিরা জোর করে যার যার বানানো বিশেষ রাইস-পুডিং ও মিসেস বাস্টামন্টের বিখ্যাত আনারসের কেক খাইয়ে দিত…তাহলে একদম অবিকল ম্যাকবেথের মতো হতো দৃশ্যটা।
‘তো,’ মুখের কোনায় লেগে থাকা আনারসের কেকের অংশ মুছল মিসেস ডানউইডি। ‘তোমার ভাই তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে?’
‘হ্যাঁ, আমি একটা মাকড়শার সঙ্গে কথা বলেছিলাম… তারপরেই এসে হাজির। হয়তো দোষটা আমারই। ভাবিনি এমন কিছু হবে।’
টুট-টুট আর টাট-টাট শব্দে ভেসে এলো টেবিলে উপস্থিত সবার মুখ থেকে। মিসেস হিগলার আর মিসেস ডানউইডি এবং মিসেস বাস্টামন্টে ও মিস নোলস একসঙ্গে জিভ দিয়ে শব্দ করে মাথা দোলাল। ‘সবসময় বলত, তুমি আসলে দুজনের মাঝে বোকা,’ বলল মিস নোলস। ‘তোমার বাবার কথা বলছি…তবে কখনও বিশ্বাস করিনি ওর কথা!
‘আমি কীভাবে জানব যে এত কিছু হয়ে যাবে?’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি। ‘বাবা-মা তো আর আমাকে কাছে বসিয়ে বলেনি, ‘ভালো কথা, বাছা, তোমার একটা ভাই আছে; যদিও তার ব্যাপারে তুমি কিচ্ছু জানো না। ওকে যদি আমন্ত্রণ জানাও, তাহলে পুলিস তোমার পেছনে লাগবে, সে তোমার বাগদত্তাকে বিছানায় নেবে, তোমার বাড়িতে পা রেখে বাড়তি কামরাটায় আস্ত একটা বাড়ি ঢুকিয়ে দেব। সেই সঙ্গে তোমার মগজ-ধোলাই এমন ভাবে করবে যেন তুমি যতক্ষণ সম্ভব মুভি দেখে, তারপর সারা রাত বাড়ি ফেরার পথের খোঁজে মাথা কুটে মরো। আর—’ বলতে বলতে থেমে গেল মোটকু চার্লি।
বুড়ো মহিলাদের চোখের দৃষ্টি নিজের ওপর টের পেয়ে।
টেবিলের সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মিসেস হিগলার শুরু করল, তারপর একে-একে মিস নোলস থেকে মিসেস বাস্টামন্টে হয়ে মিসেস ডানউইডিও। নাড়া খাবার মতো একটা অভিজ্ঞতা যাকে বলে। কিন্তু ঢেকুর তুলে আবহটা নষ্ট করে দিল মিসেস বাস্টামন্টে।
‘এখন বলো, তুমি কী চাও?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস ডানউইডি। ‘নিজের মুখেই বলো।’
এবার নিজের চাহিদা ভাবতে বসল মোটকু চার্লি, মিসেস ডানউইডির ছোট্ট খাবার ঘরে বসে। বাইরে, দিনের আলো গলে গিয়ে গোধূলির রূপ নিচ্ছে। ‘আমার জীবনকে একেবারে দুর্যোগে পরিণত করেছে ও,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘চাই—স্পাইডার চলে যাক, শুধু চলে যাক। সম্ভব?’
তুলনামূলক কমবয়সী তিন মহিলা কিছুই বলল না, চুপচাপ চেয়ে রইল মিসেস ডানউইডির দিকে।
‘আসলে, আমরা ওকে চলে যেতে বাধ্য করতে পারব না,’ জানাল মিসেস ডানউইডি। ‘আমরা এরই মধ্যে একবার…’ থামিয়ে দিল সে নিজেকেই। যোগ করল, ‘যাক, আমাদের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, করে ফেলেছি। বুঝলে?’
প্রশংসা করতেই হবে মোটকু চার্লির। মনে মনে খুব করে চাইলেই, বাইরে শক্ত করে রাখল নিজেকে; কান্নায় ভেঙে পড়তে দিল না। কেবল মাথা নেড়ে বলল, ‘তাহলে আরকী, তোমাদেরকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ডিনারটা ভালো ছিল, ধন্যবাদ।’
‘আমরা হয়তো ওকে তাড়াতে পারব না, বলল মিসেস ডানউইডি, পুরু চশমার পেছনে থাকা বাদামি চোখের মণিটাকে এখন কালো দেখাচ্ছে। তবে এমন কারও কাছে পাঠাতে পারব, যে হয়তো…’
.
ফ্লোরিডায় সন্ধ্যা হয়েছে সবে, তারমানে লন্ডনে তখন মাঝরাত। রোজির বিশাল বিছানাটায়, যেখানে পিঠ ছোঁয়াবার সৌভাগ্য চার্লির কখনও হয়নি, শুয়ে কেঁপে উঠল স্পাইডার।
রোজি কাছিয়ে এলো অনেকটা, চামড়ার স্পর্শ পেল চামড়া। ‘চার্লস,’ বলল মেয়েটা। ‘তুমি ঠিক আছ?’ যুবকের বাহুর ফুটি ফুটি ফুসকুড়ির স্পর্শ পেল সে।
‘ঠিক আছি আমি,’ জানাল স্পাইডার।
‘একটু কেমন কেমন যেন লাগল।’
‘কেউ বোধহয় তোমার কথা মনে করছে, জানাল রোজি।
।নিজের কাছে মেয়েটাকে টেনে নিলো যুবক, চুমু খেল তারপর।
ডেইজি সেই মুহূর্তে বসে আছে হেনডনের বাড়ির ছোট্ট কমন রুমে, পরনে উজ্জ্বল সবুজ নাইটড্রেস আর আঁশ-আঁশ, উজ্জ্বল গোলাপি কার্পেট স্লিপার। একটা কম্পিউটারের পর্দার সামনে বসে আছে মেয়েটা, মাথা নাড়ছে আর মাউসে ক্লিক করছে।
‘আরও দেরি হবে?’ জিজ্ঞেস করল ক্যারোল। ‘আমাদের একটা আস্ত কম্পিউটার ইউনিট আছে এই কাজগুলো করার জন্য, জানা আছে তো?’
জবাবে কেবল একটা শব্দ করল ডেইজি। যেটা না ‘হ্যাঁ’ আর না ‘না’। কেউ-কিছু-বলেছে-কিন্তু-আমি-শব্দ-করলে-চলে-যাবে’ এমনটা বোঝাতে আমরা একটা শব্দ করি না? তেমনই শোনাল এটাও।
ক্যারোল আবার এই আওয়াজের সঙ্গে পূর্ব-পরিচিত।
‘ওই,’ বলল সে। ‘মোটা নিতম্বওয়ালি। আরও সময় লাগবে? আমি ব্লগ লিখব।’
শব্দগুলো ভাসা ভাসা ভাবে শুনল ডেইজি, তবে দুটো শব্দ কানে লেগে গেল ওর। ‘তুমি বলতে চাইছ, আমার পাছা মোটা?’
‘না,’ জানাল ক্যারোল। ‘বলছি যে দেরি হয়ে যাচ্ছে, ব্লগটা সারতে চাই।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডেইজি। ‘ঠিক আছে,’ জানাল সে। তবে কিছু একটা মিলছে না, এই যা সমস্যা।’
‘কী মিলছে না?’
‘তহবিল তছরুপ, অন্তত আমার সেটাই মনে হচ্ছে। যাক গে, আমি সিস্টেম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। যা মন চায় করো। তবে একটা কথা বলে রাখি-রাজ পরিবারের সদস্য হবার যে ভান ধরছ, তাতে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে!’
‘চুপ করো।’
ক্যারোল ব্লগিং করে ব্রিটিশ রাজপরিবারের এক যুবকের ভড়ং ধরে, যার ওপর কারও কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যাপারটা বেশ আলোচিতও হয়েছে, খবরের কাগজ মাতামাতি করে ওকে নিয়ে; কারও মতে ওর অস্তিত্ব আছে, আবার কেউ কেউ তা মানতে রাজি না। প্রথম পক্ষের যুক্তি হলো, ব্লগে ক্যারোল যা-যা লেখে তা কেবলমাত্র ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সদস্যই জানতে পারে। আর দ্বিতীয় পক্ষের কথা: সেসব তো গ্লসি কাগজের গসিপ ম্যাগাজিন পড়লেও জানা যায়!
কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠল ডেইজি, এখনও মাথা থেকে গ্রাহাম কোটস এজেন্সির লেনদেন সংক্রান্ত জটিলতা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
আরামসে নিজের শোবার ঘরে শুয়ে ঘুমুচ্ছে গ্রাহাম কোটস, পার্লির বাড়িটা বিশাল হলেও জাঁকালো বলা যায় না। যদি পৃথিবীতে সুবিচার বলতে কিছু থাকত, তাহলে হয়তো ঘুমের মাঝে গুঙিয়ে উঠত দুঃস্বপ্ন দেখে… ঘামে ভিজে যেত সারাটা দেহ। বিবেকের দংশনে নীল হয়ে যেত ব্যাটা। তাই এই কথা বলতে খারাপই লাগছে যে গ্রাহাম কোটস ঘুমুচ্ছে পেট ভরে দুধ খাওয়া শিশুর মতো, আর স্বপ্নে ওকে কিছুই জ্বালাচ্ছে না!
গ্রাহাম কোটসের বাড়ির কোনো এক কোণ থেকে ভদ্রভাবে বেজে উঠল গ্রান্ডফাদার ক্লক, এক-এক করে বারো বার। লন্ডনে, মাঝরাত উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু ফ্লোরিডাতে তখন সন্ধ্যা সাতটা।
যেটাই হোক না কেন, ডাইনিদের জাদু চালাবার আদর্শ সময় ওটাই।
.
মিসেস ডানউইডি প্লাস্টিকের লাল-সাদা টেবিলক্লথ সরিয়ে ফেলল।
‘কালো মোম কার কাছে আছে?’ জিজ্ঞেস করল সে।
মিস নোলস জানাল, ‘আমার কাছে,’ মহিলার পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা শপিং ব্যাগ, সেটা হাতড়ে ভেতর থেকে চারটা মোম বের করে আনল সে। পুরোপুরি কালো না হলেও, কাজ চলে যাবে। তাদের মাঝে একটা লম্বা নক্সা-টক্সা নেই। বাকি তিনটা সাদা-কালো কার্টুনে দেখা পেঙ্গুইনের আকৃতির, সলতে বেরিয়ে আছে মাথার দিক থেকে। ‘এছাড়া কিছু পেলাম না,’ ক্ষমা- প্রার্থনার সুরে বলল সে। ‘তাও আবার তিন-তিনটা দোকান ঘুরতে হয়েছে!’
জবাবে কিছুই বলল না মিসেস ডানউইডি, কেবল মাথা নাড়ল। মোম চারটাকে বসাল টেবিলের চার কোনায়, তবে অ-পেঙ্গুইন মোমটা রাখল টেবিলের মাথায় যেখানে সে নিজে বসল। প্রত্যেকটা মোমই দাঁড়িয়ে আছে চারটা প্লাস্টিকের পিকনিকের থালায়। মিসেস ডানউইডি এবার বের করল কোসার লবণের[১৯] একটা বড়োসড়ো বাক্স, ভেতরে থাকা সব লবণ ঢেলে স্তুপ করল টেবিলে। তারপর ওগুলোর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে, শুকিয়ে হাড় হয়ে যাওয়া তর্জনী দিয়ে নাড়তে আর ঘাঁটতে শুরু করল স্তূপটা।
[১৯. টেবিলের লবণের তুলনায় রুক্ষ একপ্রকার লবণ যা মূলত কেবল রান্নায় ব্যবহৃত হয়।।]
রান্নাঘর থেকে ফিরে এলো মিস নোলস, হাতে তার কাচের একটা বড়ো পাত্র। টেবিলের ঠিক মাঝে বসিয়ে দিল সে ওটাকে। শেরির একটা বোতলের মুখ খুলে, ইচ্ছেমতো ঢালল পাত্রে।
‘এখন দরকার হলো, বলল মিসেস ডানউইডি। ‘দূর্বা ঘাস, সন্ধ্যামালতীর শেকড়, আর বিলাই-চিমটি।’
মিসেস বাস্টামন্টে তার শপিং ব্যাগ হাতড়িয়ে এবার বের করে আনল কাচের একটা ছোট্ট বয়াম। ‘এখানে জড়িবুটির মিশ্রণ আছে,’ জানাল সে। ‘কাজ হয়ে যাবার কথা।’
‘জড়িবুটি!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মিসেস ডানউইডি। ‘জড়িবুটি!’
‘অসুবিধে হবে?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস বাস্টামন্টে। ‘রেসিপিতে এটা-ওটা থাকলে তো আমি সবসময় এটাই ব্যবহার করি, দারুণ জিনিস।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিসেস ডানউইডি। ‘কী আর করা, মেশাও।’
শেরিতে এবার ঢালা হলো বয়ামের অর্ধেকটা জড়িবুটি, শুকনো পাতাগুলো ভাসতে লাগল তরলের ওপরে।
‘এবার দরকার,’ বলল মিসেস ডানউইডি। ‘চার ধরনের মাটি। আশা করি,’ বলেই পেটের ওপর হাত বেঁধে বেছে বেছে শব্দ চয়ন করল মহিলা। ‘ওই জিনিস মেলেনি বলে এখন নুড়ি, মরা জেলিফিশ, ফ্রিজে লাগানোর চুম্বক আর সাবানের টুকরো ব্যবহার করতে হবে—এই কথা খবরদার কেউ বলবে না।’
‘আমি এনেছি,’ জানাল মিসেস হিগলার। বাদামি একটা কাগজের ব্যাগ বের করে আনল সে, ভেতর থেকে বের হলো চারটে জিপলক ব্যাগ প্রত্যেকটায় বালু অথবা শুকনো কাদা দেখা যাচ্ছে, একেকটার রং অন্যগুলোর চাইতে আলাদা। টেবিলের চারকোনায় এক-একটা করে ব্যাগ উপুড় করে ধরল সে
‘যাক, কেউ তো আমার কথা মন দিয়ে শুনেছে,’ বলল মিসেস ডানউইডি।
মোমবাতি ধরাল মিস নোলস, কাজটা করার সময় বলল: খুব সহজেই আগুন ধরে গেছে ওগুলোয়, আর দেখতেও কী ভীষণ সুন্দর!
অবশিষ্ট শেরি একটা করে গ্লাসে ঢেলে চার মহিলাকে দিল মিসেস বাস্টামন্টে।
‘আমি পাবো না?’ জানতে চাইল মোটকু চার্লি, যদি শেরি পছন্দ করে না বলে আসলে চায় না ও।
‘না,’ বলল মিসেস ডানউইডি। কড়া স্বরে যোগ করল, ‘পাবে না। মাথা স্থির রাখতে হবে তোমার।’ এরপর পার্সে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল একটা ছোট্ট, সোনালি-রঙা, বড়ি রাখার কেস।
বাতি নিভিয়ে দিল মিসেস হিগলার।
পাঁচজনে মিলে বসে রইল টেবিলে, মোমের আলোয় উজ্জ্বল প্রত্যেকের চেহারা।
‘এবার কী?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। ‘সবাই হাত ধরাধরি করে মন্ত্র জপ?’
‘নাহ,’ ফিসফিসিয়ে জানাল মিসেস ডানউইডি। ‘একদম চুপ মেরে বসে থাকো, একটা শব্দও যেন তোমার মুখ থেকে না শোনা যায়।’
‘দুঃখিত,’ বলেই আফসোসে পড়ে গেল মোটকু চার্লি, কথা বলে ফেলেছে।
‘শোনো,’ বলল মিসেস ডানউইডি। ‘যেখানে যাচ্ছ, সেখানে সাহায্য পেলেও পেতে পারো। কিন্তু আগবাড়িয়ে কিছু দান কোরো না, এবং অবশ্যই…কোনো ধরনের প্রতিজ্ঞা করবে না। বুঝতে পারলে আমার কথা? যদি কাউকে কিছু দিতেই হয়, তাহলে বিনিময়ে সমান কিছু একটা পাওয়া নিশ্চিত করবে। ঠিক আছে?’
আরেকটু হলেই ‘হ্যাঁ’ বলে বসত মোটকু চার্লি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে কেবল মাথা দোলাল।
‘তাহলে তো খুবই ভালো,’ বলেই বেসুরো গলায় গুনগুন করতে লাগল মিসেস ডানইউডি, তার বুড়োটে কণ্ঠ কাঁপছে।
গুনগুন শুরু করল মিস নোলসও, তবে সুরেলা কণ্ঠে, ক্রমেই উঁচু হচ্ছে তার কণ্ঠ।
মিসেস বাস্টামন্টে গুনগুন না করে, হিসিয়ে উঠতে লাগল…তবে নির্দিষ্ট বিরতি মেনে। সাপের মতো শোনাল সেই হিসহিসানি, গুনগুনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
ঝট করে সোজা হলো মিসেস হিগলার। গুনগুন করল না সে, এমনকী হিসিয়েও উঠল না। বরঞ্চ বন্ধ জানালার পাশে যেভাবে গুঞ্জন করে মাছি ওড়ে, সেভাবে গুঞ্জন করতে লাগল। জিভ আর দাঁতের সাহায্যে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করল সে, মনে হলো যেন ক্ষিপ্ত একদল মৌমাছি মুখে পুড়ে রেখেছে; দাঁতের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে ছোট্ট পোকাগুলো, বেরোতে চাইছে সেগুলো।
মোটকু চার্লি বুঝতে পারছে না, ওর এই মহিলাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া উচিত কি না। কিন্তু দিলেও যে কী করবে, সেটাই তো বুঝতে পারছে না। তাই মন দিল বসে থেকে, অদ্ভুত এই সব আওয়াজে বিভ্রান্ত না হওয়ার প্রচেষ্টায়।
মিসেস হিগলার আচমকা এক চিমটি লাল মাটি ছুড়ে দিলে শেরি আর জড়িবুটি মিশ্রিত তরলে। মিসেস বাস্টামন্টে ছুড়ল এক চিমটি হলদে মাটি। মিস নোলসের ছুড়ে দেওয়া মাটিটা বাদামি রঙের। এদিকে মিসেস ডানউইডি খুবই ধীরে ধীরে ঝুঁকল সামনে, কালো মাটির একটা দলা ফেলল একই পাত্রে।
মিসেস ডানউইডি চুমুক দিল শেরিতে। তারপর আর্থরাইটিসে আক্রান্ত আঙুল দিয়ে কোনোক্রমে বড়ির কেস থেকে কিছু একটা বের করে নিয়ে ফেলল মোমের শিখায়। এক মুহূর্তের জন্য কামরা ভরে উঠল লেবুর সুগন্ধে, পরক্ষণেই কিছু একটা পোড়ার ঘ্রাণ দখল করল সেটাকে স্থান।
মিস নোলস এবার শুরু করল টেবিলের ওপর তবলা বাজানো। মোমের আলো কেঁপে উঠল, বিশাল কিছু ছায়া নাচতে শুরু করল দেওয়ালে। মিসেস হিগলারও যোগ দিল তাতে; তবে তালটা ভিন্ন, অনেকটাই দ্রুততর এবং অনেকটা টোকা মারার মতো। দুটো তাল মিলে তৈরি হলো নতুন একটা তাল।
মোটকু চার্লির মনে গুনগুন, হিসহিসানি, গুঞ্জন আর তবলার আওয়াজ এক হয়ে নতুন একটা শব্দের জন্ম দিল। মাথাটা হালকা হয়ে আসছে। সব কিছুই মনে হচ্ছে হাস্যকর, সব কিছুই যেন অবাস্তব। মহিলাদের আওয়াজ ছাপিয়ে শুনতে পাচ্ছে সে বনের বুনো পশু-পাখির শব্দ, শুনছে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের গর্জন। ওর আঙুলগুলো যেন লম্বা হয়ে যাচ্ছে, পরিণত হচ্ছে রবারে; পাগুলো যেন অনেক দূরে কোথাও চলে গেছে।
যেন অনেকটা ওপরে কোথাও আছে সে, সব কিছুর ওপরে… তার নিচে আছে একটা টেবিলকে ঘিরে বসে থাকা পাঁচ জন মানুষ। আচমকা চার নারীর একজন নড়ে উঠে, টেবিলের মাঝখানে থাকা পাত্রে ফেলল কিছু একটা। এত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল আভা যে মোটকু চার্লি মুহূর্তখানেকের জন্য প্রায় অন্ধ হয়ে গেল! চোখ বন্ধ করে ফেলল সে, কিন্তু আবিষ্কার করল—তাতে হিতে আরও বিপরীত হচ্ছে। চোখ বন্ধ অবস্থাতেও সবকিছু এত উজ্জ্বল যে একেবারেই স্বস্তি পাচ্ছে না।
চোখ কচলে তাকাল চারপাশে।
ঠিক পেছনেই পাথুরে একটা দেওয়াল যেন আকাশের সমান উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে: একটা পাহাড়ের পার্শ্বদিক হবে। সামনে গভীর খাদ, একটা ক্লিফ ওখানে। হেঁটে সেই ক্লিফের ধার পর্যন্ত গেল ও, ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিচের দিকে চাইল। সাদা কিছু জিনিস ধরা পড়ল ওর নজরে, ভাবল ওগুলো মেষ হতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝে গেল, আসলে ওগুলো মেঘ! বড়ো বড়ো, সাদা, ফোলা মেঘ; ওর অনেকটা নিচে রয়েছে। মেঘেরও নিচে? কিচ্ছু নেই। নীল আকাশটাকে দেখা যাচ্ছে শুধু, মনে হলো তাকিয়ে থাকলে তার পরে মহাকাশ দেখা যাবে। তারও পরে হয়তো তারকা রাজির নির্মল, ঠান্ডা আলো।
খাদের ধার থেকে পিছিয়ে এলো সে এক ধাপ।
তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল পাহাড়ের দিকে, ওটা এতটাই লম্বা যে চোখ পিটপিট করে তাকিয়েও চূড়া দেখা গেল না। মনে হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে বুঝি পাহাড়টা ভেঙে পড়বে ওর ওপরে; চিরতরে কবর হয়ে যাবে তার। নিজেকে তাই বাধ্য করল সে নিচের দিকে তাকাতে, যেন মাটির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে।
এবার পায়ের নিচের মাটির কাছে, পাহাড়ের পার্শ্বে আবিষ্কার করল ছোটো ছোটো গর্ত; গুহামুখের মতো দেখতে।
পাহাড়ের পার্শ্ব আর খাদের মধ্যবর্তী স্থান, যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে, টেনেটুনে পৌনে এক মাইলও হবে না লম্বায়। বড়ো বড়ো পাথরে ভর্তি বালুময় পথও বলা যায় ওটাকে, যার এখানে সেখানে সবুজ ঝোপ দেখা যাচ্ছে; হয়তো একটা-দুটো ধুলোময় বাদামি গাছও। পথটা পাহাড়ের পাশ ধরে চলে গেছে তো গেছেই, দিগন্তে হারিয়ে যাবার আগে ফুরোয়নি।
কেউ একজন দেখছে আমাকে, ভাবল মোটকু চার্লি। ‘হ্যালো?’ মাথা পেছনে হেলে ডাকল সে। ‘হ্যালো, কেউ আছে?’
একদম কাছে থাকা গুহামুখের ভেতর থেকে বাইরে পা রাখল একজন মানুষ। লোকটার ত্বক মোটকু চার্লির তুলনায় কালো হবে, এমনকী স্পাইডারের চেয়েও। কিন্তু লম্বা চুলগুলো ময়লা বাদামি, কেশরের মতো দুলছে চেহারার সামনে। কোমরের সঙ্গে পেঁচিয়ে রেখেছে হলদে রঙা, সিংহের চামড়া; মাঝখান থেকে ঝুলছে সিংহের লেজ, পেছনে আরকি। কাঁধের কাছে ভনভন করতে থাকা একটা মাছি তাড়াল লেজটা।
সোনালি চোখ পিটপিট করে ওর দিকেই তাকিয়ে রইল।
‘কে তুমি?’ গমগমে কণ্ঠে যেন গর্জে উঠল লোকটা। ‘কার অনুমতিতে এখানে পা রেখেছ?’
‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘মাকড়শা আনানসি আমার বাবা ছিল।’
বিশাল মাথাটা দুলে উঠল। ‘তাহলে এখানে কেন এসেছ? আমার বন্ধু আনানসির সন্তান?’
আর কেউ নেই আশপাশে, অন্তত মোটকু চার্লির জানামতে নেই। তারপরও মনে হচ্ছে যেন অনেকেই শুনতে ওদের কথা, অনেকগুলো কান পেতে আছে এদিকেই। উচ্চ কণ্ঠে বলল মোটকু চার্লি, তাই যেন সবাই পরিষ্কার শুনতে পায়। ‘আমার ভাই, আমার জীবন একেবারে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ওকে তাড়াবার সামর্থ্য আমার নেই।’
‘তাই তুমি আমাদের সাহায্য প্রার্থনা করছ?’ জিজ্ঞেস করল সিংহ।
‘হ্যাঁ।’
‘তা তোমার এই ভাই…তার দেহেও কি আনানসির রক্ত বইছে?’
‘ও একদম আমার মতো না,’ মোটকু চার্লি জানাল। ‘সে তোমাদের একজন।’
তরল সোনা নড়ে উঠল যেন, মানব-সিংহ লাফিয়ে একটু সামনে এগিয়ে এলো। আলসে ভঙ্গিতে নড়লেও, এক ঝটকায় পেরিয়ে গেল পঞ্চাশটা গজ। এখন ও দাঁড়িয়ে আছে মোটকু চার্লির পাশে, অধৈর্য ভঙ্গিতে নড়ছে লেজটা।
হাত ভাঁজ করে মোটকু চার্লির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘তা এই ব্যাপারটা নিজে সামলাচ্ছ না কেন?’
শুকিয়ে গেল মোটকু চার্লির মুখ, গলার ভেতর যেন একগাদা ধুলো ঢুকে গেছে। সামনে দাঁড়ানো প্রাণিটা, মানুষের চাইতে অনেক লম্বা হলেও, মানুষের মতো গন্ধ একদম নেই দেহে। শ্বদন্তগুলোর সুচালো ভাগ খোঁচাচ্ছে নিচের ঠোঁটটাকে।
‘পারছি না তো,’ কোনোক্রমে জানাল মোটকু চার্লি।
ঠিক পাশের গুহামুখ থেকে উঁকি দিল প্রকাণ্ড এক লোক। ত্বক তার বাদামি-ধূসর, একেবারে কুঁচকানো; পাগুলো গোল। ‘যদি ভাইয়ের সঙ্গে তুমি ঝগড়া করো,’ বলল লোকটা। ‘তাহলে সেই বিচার করবে তোমাদের বাবা। পরিবারের যে মাথা, তার হাতে বিচারের দায়িত্ব তুলে দাও। সেটাই তো আইন।’ মাথা পেছনে হেলিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করল সে। গলার ভেতর, নাকের পেছন থেকে বেরিয়ে আসা শব্দটা শুনেই বুঝে গেল মোটকু চার্লি-সে এখন হাতির দিকে তাকিয়ে আছে।
ঢোক গিলল সে। ‘আমার বাবা মারা গেছে,’ আশাতীত পরিষ্কার শোনাল ওর গলা। পাহাড়ের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো ওর কণ্ঠ। হাজারো গুহামুখ থেকে যেন ওর কথা ওকেই শুনিয়ে দিল সবাই। মারা গেছে মারা গেছে-মারা গেছে-মারা গেছে, জানাল সেই প্রতিধ্বনি। ‘সেজন্যই আসতে হয়েছে আমাকে।’
সিংহ বলল, ‘মাকড়শা আনানসির প্রতি আমার বিন্দুমাত্র দুর্বলতা নেই। অনেক অনেক দিন আগে, আমাকে একটা ডালের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল সে; তারপর ধুলোর মাঝে টানিয়েছে গাধাকে দিয়ে; মাওউ, যিনি সব কিছুর স্রষ্টা, একদম তার আসন পর্যন্ত!’ স্মৃতিটা মনে পড়ে যাওয়ায় গর্জে উঠল যেন, মোটকু চার্লির মনে হলো: এই মুহূর্তে অন্য কোথাও থাকলেই ভালো হতো হয়তো।
‘এগোতে থাকো,’ বলল সিংহ। ‘হয়তো এমন কাউকে পাবে, যে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। তবে আমি সেই সাহায্যকারী নই।’
হাতি জবাব দিল, ‘আমিও না। তোমার বাবা ধোঁকা দিয়ে আমার পেটের চর্বি খেয়ে ফেলেছিল। বলেছিল, আমার পরার জন্য কিছু জুতো বানাবে। তারপর আমাকেই রান্না করে হাসতে হাসতে খেয়েছে। আমি এসব ভুলি না!’
তাই করল মোটকু চার্লি।
পরবর্তী গুহার মুখে দাঁড়িয়ে আছে চটকদার সবুজ স্যুট আর হ্যাট পরা এক লোক। হ্যাটটাকে গোল করে পেঁচিয়ে রেখেছে সাপের চামড়ার ব্যান্ড। পরনেও একই রকম বুট আর সাপের চামড়া দিয়ে বানানো কোমরবন্ধনী। মোটকু চার্লি কাছাকাছি এলে হিসিয়ে উঠল সে। ‘হাঁটতে থাকো, আনানসির বাচ্চা,’ বলল সাপ, কণ্ঠটা শুষ্ক। ‘তোমার পুরো পরিবারটাই যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু না। তোমাদের ঝামেলায় আমি জড়াচ্ছি না বাবা।’
পরের গুহামুখ থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েটা খুবই সুন্দর, চোখ কালো তেলের ফোঁটার ন্যায়। গোঁফ আছে, তবে তুষারের মতো সাদা; ঠিক তার ত্বকের মতোই। বুকে দুই সারি স্তন।
‘তোমার বাবাকে আমি চিনতাম,’ জানাল সে। ‘অনেক অনেক দিন আগে, হো-ই।’ স্মৃতিটা মনে করে মাথা নাড়ল একবার। মোটকু চার্লির মনে হলো, এইমাত্র যেন ব্যক্তিগত কোনো চিঠি পড়ে ফেলেছে। ওকে উড়ন্ত চুমু উপহার দিল মেয়েটা, কিন্তু মাথা নেড়ে কাছে আসতে মানা করল। জানাল, আনানসির জন্য অনেক ভুগতে হয়েছে তার পরিবারকে।
হাঁটতে লাগল মোটকু চার্লি। মরা একটা গাছ পড়ল সামনে, মাটিতে পোঁতা। একগাদা ধূসর, পুরাতন হাড়ের মতো দেখাচ্ছে। ছায়াগুলো এখন আরও লম্বা হচ্ছে, সূর্য ধীরে ধীরে নেমে আসছে অসীম আকাশ ধরে। সূর্যটাকে দেখে মনে পড়ে যায় বিশাল কোনো সোনালি-কমলা গোলকের কথা। তার ঠিক নিচেই থাকা ছোট্ট সাদা মেঘগুলোকে যেন সে ভরিয়ে তুলছে সোনালি আর বেগুনি রঙে।
নেকড়ের মতো করে অ্যাসাইরিয়ানরা আছড়ে পড়ল জমায়েতের ওপর, ভাবল মোটকু চার্লি। বহুদিন আগে পড়া এই লাইনটা ভুলে ছিল এতদিন। তার কোহর্টরা জ্বলজ্বল করছে সোনালি আর বেগুনি পোশাকে। কোহর্ট[২০] মানে কী, তা মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। সম্ভবত, ভাবল, কোনো এক রকমের রথ হবে।
[২০. দল, এখানে সেনাবাহিনীর এক অংশকে বোঝানো হচ্ছে। সাধারণত ৪৮০ জন থাকে সেই দলে।]
নড়ে উঠল কিছু একটা, ঠিক ওর কনুইয়ের কাছে। টের পেল, একটু আগে যেটাকে মরা গাছের তলে থাকা বাদামি পাথর ভেবেছিল সেটা আসলে একটা মানুষ। বালু-রঙা ত্বক, পিঠটা চিতাবাঘের মতো দাগকাটা। চুল বড়ো বড়ো, ঘন আর কালো। হাসল যখন তখন বেরিয়ে এলো বিশাল, বিড়ালের মতো দাঁত। তবে হাসিটার স্থায়িত্ব হলো খুবই অল্প, সেই হাসিতে কোনো উষ্ণতা বা আমোদ কিংবা বন্ধুত্ব ছিল না। বলল সে, ‘আমি বাঘ, তোমার বাবা শত শত
বার আমাকে আহত করেছে। আর অপমান তো করেছে হাজারো বার। বাঘরা কিস্যু ভোলে না।’
‘আমি দুঃখিত,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘তোমার সঙ্গে হাঁটব আমি,’ জানাল বাঘ। ‘অন্তত কিছুটা পথ হলেও হাঁটব। তা বলছ যে আনানসি মারা গেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ, বেশ, বেশ। বহুবার আমাকে বোকা বানিয়েছে সে। একদা সব কিছুর মালিক ছিলাম আমি—গল্প, চাঁদ-তারা… সবকিছুর। কিন্তু আমার কাছে থেকে সব চুরি করেছে সে। মারা যখন গেছে, তখন আশা করি মানুষ তার বানানো ওই জঘন্য গল্পগুলো ভুলে যাবে। বন্ধ হবে আমার দিকে তাকিয়ে উপহাসের হাসি হাসা।’
‘আমারও তাই মনে হয়,’ মোটকু চার্লি বলল। ‘আমি কখনও হাসিনি আপনাকে উপহাস করে।’
লোকটার সবুজ-রঙা চোখ জ্বলে উঠল আচমকা। ‘রক্ত রক্তই,’ জানাল সে। ‘আনানসির বংশধর মানে…সেই আনানসিই।’
‘আমি আমার বাবা নই,’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি।
দাঁত খিঁচাল বাঘ, খুবই তীক্ষ্ণ সেই দাঁতগুলো। ‘সবাইকে হাস্যকর কথা বলে বেরানোই কি তোমার কাজ?’ প্রশ্ন করল বাঘ। ‘এই বিশাল, গম্ভীর দুনিয়াতে হাসার মতো কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু না। তাই বাচ্চাদেরকে ভয় পাওয়া শেখাতে হবে, শেখাতে হবে আতঙ্কে কেঁপে ওঠা। ওদেরকে শেখাও, কীভাবে নৃশংস হতে হয়, শেখাও কীভাবে অন্ধকারে ওঁত পেতে থাকে বিপদ। নিজেকে লুকাতে শেখাও ছায়ায়, শেখাও কীভাবে সুযোগ বুঝে সবসময় ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যা করতে হয়। জীবনের সত্যিকার অর্থ জানো?’
‘উম,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘একে-অন্যকে ভালোবাসা?’
‘জীবনের অর্থ হলো শিকারের উষ্ণ রক্তের স্বাদ নিজের জিভে পাওয়া। তার মাংস টেনে ছেঁড়া দাঁতে আটকে, শত্রুর লাশ সূর্যের আলোতে ফেলে আসা শকুন হায়েনার খাবার হতে। এই হলো জীবনের অর্থ। আমি বাঘ, আনানসির চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী আমি; বিশাল, বিপজ্জনক, শক্তিশালী, জ্ঞানী, নৃশংস…
এইখানে, মানে বাঘের সঙ্গে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই মোটকু চার্লির। নাহ, বাঘ যে একেবারে বদ্ধ পাগল, সেজন্য না; কারণটা হলো: যা বলছে, তা বাঘ অন্তর থেকে বিশ্বাস করে বলেই বলছে। আর সেই বিশ্বাসের প্রত্যেকটাই সমান বাজে। তাছাড়া ওর দিকে তাকাতেই যেন কার কথা মনে পড়ে মোটকু চার্লির। কার কথা, তা ঠিক বলতে না পারলেও জানে, মানুষটাকে সে অপছন্দ করে। ‘আমার ভাইকে তাড়াতে সাহায্য করবে?’
কাশল বাঘ। হতে পারে একটা পালক, কিংবা হয়তো পুরো একটা পাখি আটকে গেছে ওর গলায়।
‘পানি এনে দেব?’ জানতে চাইল মোটকু চার্লি।
সন্দেহের দৃষ্টিতে বাঘ চাইল মোটকু চার্লির দিকে। ‘শেষ যখন আমাকে আনানসি পানি খাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, সেবার পুকুরে ডুবে থাকা চাঁদ গেলার চেষ্টা করতে গিয়ে ডুবে যাই!’
‘আমি তো কেবল সাহায্য করতে চাচ্ছিলাম আপনাকে।’
এই একই কথা তো বলেছিল তোমার বাবাও!’ মোটকু চার্লির দিকে ঝুঁকল বাঘ, চোখ রাখল ওর চোখে। কাছ থেকে বাঘকে দেখে কোনোভাবেই মানুষ মনে হবার কোনো কারণ নেই—নাক মাত্রাতিরিক্ত সমতল, চোখ অপ্রতিসাম্য ভাবে বসানো, গা থেকে চিড়িয়াখানার খাঁচার গন্ধ ভেসে আসে। কণ্ঠে যেন মেঘের গর্জন। ‘আমাকে সাহায্য করতে পারো মাত্র একটা উপায়ে, আনানসির সন্তান। তোমার বংশের সবার জন্যই কথাটা প্রযোজ্য। দূরে থাকো আমার কাছ থেকে, বুঝলে? যদি হাড়ে মাংস লেগে থাকুক, এটা চাও তো আমার কথা শোনো।’ আবার ঠোঁট চাটল সে, জিভটা লাল হয়ে আছে সদ্য শিকার করা পশুর মাংসে। যেকোনো মানুষের চাইতে লম্বা সেই জিভ।
ঝট করে পিছিয়ে গেল মোটকু চার্লি, নিশ্চিত ভাবেই জানে–এখন দৌড়াবার চেষ্টা করা মাত্র ওর ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দেবে বাঘ। ওটার সঙ্গে এখন মানুষের ছিটেফোঁটাও মিল নেই: আকারেও বলতে গেলে জলজ্যান্ত বাঘের সমান। বিশাল একটা বাঘ সামনে হাজির হয়েছে নরখেকো হয়ে, ইঁদুরের ঘাড় যেভাবে কামড়ে ভেঙে ফেলে সেভাবে মানুষের ঘাড় ভাঙতেও তার বিন্দুমাত্র কষ্ট হবে না।
আর তাই, বাঘের ওপর একটা চোখ স্থির রেখে, সরে আসতে লাগল ধীরে ধীরে। খানিকক্ষণের মাঝেই ওটা ফিরে গেল মরা গাছের কাছে, হারিয়ে গেল ডাল-পাতার মাঝে; শুধুমাত্র অধৈর্য হয়ে লেজ নাড়ার কারণে ধরা পড়ছে চোখে।
‘ওকে নিয়ে ভেবো না,’ আরেকটা গুহার মুখ থেকে ভেসে এলো এক নারী-কণ্ঠ। ‘এদিকে এসো।’
সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মোটকু চার্লি—মেয়েটা সুন্দর, নাকি কুৎসিত? আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ওই গুহার মুখের দিকে।
‘ভাব তো ধরে যেন ব্যাটা হর্তা-কর্তা-বিধাতা, কিন্তু আসলে নিজের ছায়াকেই ভয় পায়! তোমার বাবাকে তো পেত আরও বেশি। চোয়ালে জোরও নেই একদম।’
মেয়েটার চেহারায় কুকুর-কুকুর একটা ভাব আছে। উঁহু, ঠিক কুকুর না…
‘কিন্তু আমার কথা আলাদা,’ চার্লি মুখের কাছে পৌঁছানো মাত্র বলল মেয়েটা। ‘আমি একেবারে হাড় পর্যন্ত চিবিয়ে তুষ বানিয়ে ফেলি! আর কে না জানে, আসল জিনিস তো হাড়ের মাঝেই লুকিয়ে থাকে। মিষ্টি, রসালো জিনিস কই পাওয়া যাবে তা কেবল আমিই জানি।’
‘আমি এমন কাউকে খুঁজছি, যে আমাকে আমার ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারবে।’
মাথা পেছনে হেলিয়ে হেসে ফেলল মেয়েটা; লম্বা, উঁচু কণ্ঠে পাগলাটে হাসি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনে ফেলল মোটকু চার্লি।
‘সাহায্য তো পাবে না, নিজের সাহায্য নিজেকেই করতে হবে।’ জানাল মেয়েটা। ‘এদের প্রত্যেকে তোমার বাপের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে ভুগেছে। তোমার বংশের নাম শুনলেই পিত্তি জ্বলে যায় বাঘের। কিন্তু তোমার বাপ বেঁচে থাকতে সে কিচ্ছু করার সাহস পায়নি। তাই শোনো আমার কথা—এগোতে থাকো সামনে। নিঃসন্দেহে বলতে পারি, একটা খালি গুহা খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত, এমন কাউকে পাবে না যে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। যাও, ওখানে যাকে পাবে তার সঙ্গে কথা বোলো। বুঝতে পারছ?’
‘তেমনটাই তো মনে হচ্ছে।’
হাসল মেয়েটা, হাসিটা ঠিক সুখকর নয়। ‘আমার সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে চাচ্ছ নাকি? আমি কিন্তু অনেক কিছুই শেখাতে পারি। প্রবাদ তো শুনেইছ—হায়েনার চাইতে খারাপ, নৃশংস কিংবা জঘন্য আর কিছুই হতে পারে না!’
মোটকু চার্লি মাথা নেড়ে হাঁটা অব্যাহত রাখল। পৃথিবীর শেষ মাথায় অবস্থিত, পাথুরে দেওয়াল ঘেঁষে অবস্থিত গুহামুখগুলোর প্রত্যেকটায় উঁকি দিল একবার করে। নানা আকারের আর নানা আকৃতির মানুষে ভরতি ওগুলো; ছোট্ট মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে বড়োসড়ো মানুষও; আছে নারী, আবার আছে পুরুষও। ওর চোখের সামনেই, ছায়া থেকে আলোতে আসায় তাদের পাখনা, আঁশ, শিং কিংবা নখর ধরা পড়ল তার নজরে।
মাঝে-মধ্যে তো ওকে দেখেই উলটো ভয় পেয়ে গেল গুহাবাসীরা, একেবারে পেছনের দেওয়ালের সঙ্গে সিটিয়ে গেল তারা। কেউ-কেউ আবার এগিয়েও এলো, চোখে-মুখে যুদ্ধংদেহী ভাব কিংবা কৌতূহল নিয়ে তাকাল ওর দিকে।
গুহার মুখের ওপর থেকে কিছু একটা বাতাসে ভেসে পড়ল মোটকু চার্লির ঠিক পাশেই। ‘হ্যালো,’ অনেকটা দম আটকেই বলল সেটা।
‘হ্যালো,’ জানাল মোটকু চার্লি।
নবাগত বেশ উত্তেজিত, এবং লোমশ। হাত-পাগুলোকে কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে। আসলে সে কে, তাই বুঝতে চাইল মোটকু চার্লি। অন্য মানব- পশুগুলোও আসলে পশু ছিল…সেই সঙ্গে মানুষও। কিন্তু তাদের মাঝে তেমন অদ্ভুত কিংবা প্রথম দর্শনে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতো অসামঞ্জস্য ছিল না; জেব্রার দেহে যেমন সাদা-কালো দাগ দারুণ মানিয়ে যায়, তেমনি মানিয়ে গেছিল তাদের মাঝে মানুষে-পশুতে। কিন্তু এই জিনিসটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন মানুষের সঙ্গে মেশানো হয়েছে প্রায়-মানুষকে।
আচমকা চিনে ফেলল মোটকু চার্লি।
‘বানর,’ বলল সে। ‘তুমি বানর।’
‘জাম আছে?’ জিজ্ঞেস করল বানর। ‘আম? কিংবা ডুমুর?’
‘নাহ, দুঃখিত।’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘খাওয়ার মতো কিছু একটা দাও,’ অনুরোধ করল বানর। ‘তোমার বন্ধু বনে যাবো।’
মিসেস ডানউইডি এই ব্যাপারে আগেই সাবধান করে দিয়েছে ওকে। আগবাড়িয়ে কিছু দান কোরো না, ভাবল সে। এবং অবশ্যই…কোনো ধরনের প্রতিজ্ঞা করবে না।
‘তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারব না, দুঃখিত।’
‘তা তুমি মানুষটা কে হে?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল বানর। ‘উঁহু… তুমি আসলে কী? আধা-মানুষ মনে হচ্ছে। এখানে থাকো? নাকি ওখান থেকে এসেছ?’
‘আনানসি আমার বাবা,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘এমন কাউকে খুঁজছি যে আমার ভাইকে তাড়িয়ে দিতে সাহায্য করতে পারবে।’
‘তাতে কিন্তু আনানসি খেপে যেতে পারে,’ শিউরে উঠল বানর। ‘একদম উচিত হবে না ওকে খেপানো…তাহলে কিন্তু আর কখনও কোনো গল্প পাবে না!’
‘আনানসি মারা গেছে,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘ওখানে মরেছে,’ পালটা জবাব দিল বানর। ‘কিন্তু এখানে মরেছে কি? দুটোর মাঝে আকাশ-পাতাল ফারাক!’
‘মানে, সে এখানে থাকতে পারে?’ ক্লান্ত চোখে চোখ তুলে মোটকু চার্লি চাইল পাহাড়ের দিকে: ওই পাহাড়ের কোনো একটা গুহায় দুম করে বাপের সামনে পড়ে যেতে পারে, ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। কল্পনার চোখে বাপকে দেখতে পেল সে রকিং চেয়ারে বসা অবস্থায়, মাথায় সবুজ ফেডোরা হ্যাট, আরাম করে পান করছে ব্রাউন এল, হাই ঢাকছে লেবুর মতো হলদে দস্তানা দিয়ে।
ভাবতেই শিউরে উঠল বেচারা।
‘কে? কী?’
‘মানে, সে এখানে থাকতে পারে?’
‘কে?’
‘আমার বাবা।’
‘তোমার বাবা?’
‘আনানসি!’
সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে লাফিয়ে একটা পাথরের ওপর উঠে পড়ল বানর, তারপর ভয়ার্ত কণ্ঠে তাকাল এপাশ থেকে ওপাশ। ‘আনানসি? এখানে আছে?’
‘এই প্রশ্নটা তো আমি তোমাকে করছিলাম,’ বলল মোটকু চার্লি।
আচমকা দোল খেল বানর, পা ওপরে আর মাথা নিচে দিয়ে সরাসরি মোটকু চার্লির দিকে তাকিয়ে ঝুলছে সে। মাঝে-মধ্যে ফিরে যায় দুনিয়ার বুকে,’ জানাল বানর। ‘এসো হে চালাক বানর, এসো। আমাদের সঙ্গে বসে জাম খাও। তোমার জন্য এনেছি আমরা বাদাম, আর সবজি…আর ডুমুর।’
‘আমার বাবা এখানে আছে?’ ধৈর্য ধরে জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি।
‘ওর কোনো গুহা নেই,’ জানাল বানর। ‘থাকলে জানতাম, সম্ভবত জানতাম। হয়তো আছে, আমিই ভুলে গেছি। তবে যদি আমাকে একটা জাম দাও, তাহলে মনে পড়তেও পারে।’
‘আমার কাছে কিছুই নেই,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘জাম নেই?’
‘কিচ্ছু না।’
পাথরের ওপরে থাকা বানর এবার আরও ওপরে উঠে হারিয়ে গেল।
পাথুরে পথ ধরে এগোতে লাগল মোটকু চার্লি। সূর্য অনেকটা ডুবে গেছে, পথের সঙ্গে একই তলে চলে এসেছে এখন; উজ্জ্বল কমলা দেখাচ্ছে গোলকটা। আলো সরাসরি পাঠিয়ে দিচ্ছে গুহায়, প্রতিটায় রয়েছে কেউ-না-কেউ। দেখা গেল গণ্ডার, কাছের জিনিস দেখার শক্তিও বেচারার চোখের নেই; তবে ধূসর ত্বক দেখা যাচ্ছে। আর ওই যে, অগভীর পানিতে ভাসছে গাছের পচা কাণ্ড; কুমির ওটা, চোখজোড়া কাচের মতো কালো।
আচমকা পেছন থেকে ভেসে এলো কিছু একটা নড়ার শব্দ, পাথরে পা রেখেছে কেউ। চমকে পিছু ফিরে চাইল মোটকু চার্লি। বানর তাকিয়ে আছে ওর দিকে, পাথুরে পথে ঘষা খাচ্ছে তার আঙুলের গাঁট।
‘সত্যি বলছি, আমার কাছে কোনো ফল-টল নেই,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘নইলে সত্যি সত্যি দিতাম।’
বানর বলল, ‘তোমার জন্য মায়া হচ্ছিল। এক কাজ করো, ফিরে যাও বাড়িতে। এখানে আসার ফন্দিটা একদম, একদম, একদম ভালো ছিল না। বুঝলে? যাবে ফিরে?’
‘না,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘আহ,’ বলল বানর। ‘বেশ তাহলে, বেশ, বেশ বেশ।’ নড়া-চড়া থেমে গেল ওর, তারপর চোখ ধাঁধানো গতিতে ছুটে গেল মোটকু চার্লির পাশ দিয়ে; থমকে দাঁড়াল খানিক দূরের একটা গুহার সামনে।
‘ভেতরে যেয়ো না,’ ডাকল সে। ‘খারাপ জায়গা।’ ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল গুহার মুখ।
‘কেন?’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘ভেতরে কে আছে?’
‘কেউ নেই,’ গর্বের সঙ্গে জানাল বানর। ‘তাই নিশ্চয়ই এই গুহা তোমার লক্ষ্য না?’
‘হ্যাঁ,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘এটাই আমার লক্ষ্য।’
কিচির-মিচির করে লাফাতে লাগল বানর। মোটকু চার্লি পাত্তা না দিয়ে পাথর বেয়ে উঠতে লাগল, গুহামুখের সামনে পৌঁছুবার আগে থামল না। ওকে চমকে দিয়ে ঠিক তখনই পৃথিবীর শেষ প্রান্তে, পর্বতের ওপাশে ডুব দিল রক্ত- রাঙা সূর্য।
পৃথিবীর শুরুতে যে পাহাড়গুলো আছে তার সামনে থাকা পথ ধরে এগোতে গিয়ে (একমাত্র উলটো দিক থেকে আসলে সেই পাহাড়গুলো পৃথিবীর শেষে অবস্থিত মনে হয়), বাস্তবতা বড়োই অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য ঠেকে। এই পাহাড়-সারি এবং তাদের গুহাগুলো নির্মিত হয়েছে পুরাতন গল্পের মাধ্যমে (মানুষের আবির্ভাবের অনেক আগেকার গল্প এগুলো; কেন যে ভাবছেন, মানুষের কাছ থেকেই জন্ম হয়েছে গল্পের তা কে জানে?)। পথ ছেড়ে গুহায় পা রাখতেই মোটকু চার্লির মনে হলো, যেন অন্য কারও বাস্তবতায় এসে উপস্থিত হয়েছে। গুহাটা গভীর; মেঝে সাদা হয়ে আছে পাখির মলে। সেই সঙ্গে আছে পালকও, এখানে-সেখানে পড়ে আছে পাখির মরদেহ; শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
গুহার ভেতরটায় অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই।
‘কেউ আছে?’ ডাকল মোটকু চার্লি। গুহার ভেতর থেকে ফিরে এলো প্রতিধ্বনি। আছে-ছে-ছে-ছে শোনা গেল চারপাশে। হাঁটা অব্যাহত রাখল সে, গুহার ভেতরের অন্ধকার স্পর্শ করা যাবে মনে হচ্ছে। অন্ধকার, পাতলা কিছু একটা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে তার চোখ। ধীরে ধীরে পা ফেলল সামনে, একেক বারে একেক পা। হাত বাড়িয়ে দিল সামনে।
আচমকা নড়ে উঠল কিছু একটা।
‘হ্যালো,’ হালকা আলোতে সয়ে এলো ওর চোখ, কিছু একটা দেখতে পাচ্ছে। কিচ্ছু না আসলে, পালকঅলা চামড়ার ঝোলা কেবল। আরেক পা এগোতেই বাতাসে নড়ে উঠল পালক, চামড়াটা বাড়ি খেল মেঝেতে।
কিছু একটা উড়ছে ওর আশপাশে, কবুতরের পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ হচ্ছে বাতাসে।
ঘূর্ণি জন্ম নিলো। চোখে-মুখে সূচের মতো বিঁধল ধূলিকণা। ঠান্ডা বাতাসে পিটপিট করে চাইল মোটকু চার্লি, সামনেই ঘূর্ণি দেখে পিছিয়ে গেল এক পা। ঝড়ের মূল দেহটাকেই জন্ম দিয়েছে ধুলো, চামড়া আর পালক।
পরক্ষণেই উধাও হয়ে গেল ঝড়, সেখানে দেখা দিল মানব-সদৃশ একটা অবয়ব, হাত বাড়িয়ে মোটকু চার্লিকে ইঙ্গিতে ডাকল।
ভয়ে পেয়ে পিছিয়েই যেত মোটকু চার্লি, কিন্তু অবয়বটা ওর শার্টের হাতা টেনে ধরল। হালকা আর শুকনো ঠেকল সেই হাতের স্পর্শ। নিজের দিকে টানল ওকে অবয়বটা…
গুহার ভেতর আরও এক পা এগোল মোটকু চার্লি—
–পরক্ষণেই নিজেকে আবিষ্কার করল খোলা একটা তৃণভূমিতে; গাছের বালাই নেই চারপাশে, মাটি তামাটে; আকাশের রং দেখে টকে যাওয়া দুধ বলে মনে হয়।
প্রাণিভেদে চোখ কিন্তু ভিন্ন হয়! মানুষের চোখ (বিড়াল কিংবা অক্টোপাসের চোখের থেকে যা ভিন্ন) এমন ভাবে বানানো হয়েছে যেন তা একটা সময়ে কেবল একটাই বাস্তবতা দেখতে পায়। চোখ দিয়ে একটা বাস্তবতা দেখছে মোটকু চার্লি, কিন্তু মন দিয়ে দেখছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেক বাস্তবতা। আর এই দুইয়ের মাঝে অপেক্ষা করছে পাগলামি। টের পাচ্ছে সে—ওর বুকের ভেতর ফুঁপিয়ে উঠছে এক ধরনের বুনো ভয়। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দম আটকে রাখল ছেলেটা, পাঁজরের হাড়ের সঙ্গে হৃৎপিণ্ডের বাড়ি খাওয়া পরিষ্কার টের পাচ্ছে। চোখকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করল নিজেকে, মনকে না।
নিজেকে বোঝাল: যদিও মনের চোখে পাচ্ছে একটা পাখিকে; যার চোখগুলোতে ভর করেছে পাগলামি, পালক উসকোখুসকো, যেকোনো ইগলের চাইতে যে আকারে বড়ো, উচ্চতায় হার মানাবে অস্ট্রিচ পাখিকে, ঠোঁটগুলো অস্ত্রের চাইতে কম ভয়াবহ নয়, স্লেট পাথরের মতো রং তার পালকের, তার ওপরে যেন কেউ আলগা একটা উজ্জ্বল আভা মাখিয়ে দিয়েছে, ফলে বেগুনি আর সবুজের অদ্ভুত এক রঙধনুর জন্ম দিয়েছে সেই পালক…তবে চোখে দেখতে পাচ্ছে—সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে যার চুল দাঁড়কাকের মতো কালো; যেখানে পাখি দাঁড়িয়ে থাকার কথা, সেখানে আছে এক নারী। পাখি- মানবী যুবতী না, আবার তাকে বুড়িও বলা যাবে না। যে চেহারাটা দেখা যাচ্ছে, সেটা সুদূর অতীতে অবসিডিয়ান পাথরে খোদাই করাও হতে পারে; যখন পৃথিবী তরুণ ছিল, হয়তো তখনকার সময়ের।
একদৃষ্টিতে মোটকু চার্লিকে দেখছে পাখি-মানবী, একদম নড়ছে না। টকে যাওয়া দুধ-রঙা আকাশে ভাসছে মেঘ
‘আমি চার্লি,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘চার্লস ন্যান্সি। কেউ কেউ…মানে অনেকেই…আমাকে মোটকু চার্লি বলে। চাইলে তুমিও সেই নামেই ডাকতে পারো।’
ওপাশ থেকে জবাব এলো না।
‘আনানসি আমার বাবা ছিল।’
তারপরেও কোনো জবাব এলো না, এমনকী নড়ল না পর্যন্ত পাখি-মানবী; এক বিন্দুও না।
‘তোমার সাহায্য চাই, ভাইকে তাড়াতে।’
কথা শুনে এক পাশে মাথা কাত করল পাখি-মানবী। বুঝিয়ে দিল যে সে শুনছে, সেই সঙ্গে নিশ্চিত করল যে বেঁচেই আছে!
‘পারছি না কাজটা করতে। জাদুর ক্ষমতা-টমতা আছে ওর। একটা মাকড়শার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তারপরই কোত্থেকে কী যেন হয়ে গেল! পরদিনই দেখি, আমার ভাই এসে উপস্থিত! এখন আর ওকে তাড়াতে পারছি না।’
মেয়েটার কণ্ঠ কাকের মতো কর্কশ আর রুক্ষ। ‘তো? আমার কাছে কী চাই?’
‘সাহায্য?’
ভাবতে বসল পাখি-মানবী।
পরে অনেক চেষ্টা করেও মোটকু চার্লি মনে করতে পারেনি যে পাখি- মানবীর পরনে কী ছিল। কখনও মনে হয়, সম্ভবত পালকের চাদর ছিল; কখনও মনে হয় কোনো এক ধরনের চামড়ার আলখাল্লা হবে। এমনকী জীর্ণ রেইনকোটের কথাও মাথায় এসেছে একবার, পরে যখন পিকাডেলিতে আবার দেখা হয় তখনকার মতো…মানে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়তে শুরু করার সময়। তবে একটা বিষয়ে নিঃসন্দেহ সে—নগ্ন ছিল না পাখি-মানবী।
নগ্ন থাকলে কি আর মনে থাকত না?
‘সাহায্য,’ শব্দটারই পুনরাবৃত্তি করল পাখি-মানবী।
মাথা নেড়ে সায় জানাল মোটকু চার্লি।
‘তারমানে, আনানসির বংশ নির্বংশ করার কাজে সাহায্য চাইছ?’
‘নাহ, চাই যে আমার ভাইকে চলে যাক; আমাকে বিরক্ত না করুক। ওর কোনো ক্ষতি আমি চাই না।’
‘তাহলে কথা দাও, আনানসির বংশধর আমার হবে।’
বিশাল, তামাটে রঙা তৃণভূমিতে দাঁড়িয়ে রইল মোটকু চার্লি। কিন্তু ওটা যে আসলে পৃথিবীর শেষ মাথার পাহাড়ের গুহার ভেতরে, তা জানে সে। এদিকে আবার পুরো বিশ্বটাই এঁটে গেছে মিসেস ডানউইডির ধুনোর সুগন্ধিতে ভরে থাকা বসার ঘরে। পাখি-মানবী কী চাইছে, তা বোঝার প্রয়াস পেল সে।
‘আমি কিছুই দিতে পারবো না, কিংবা কোনো ওয়াদা করতে পারবো না।’
‘তুমিই তো তাড়াতে চাইছ,’ বলল পাখি-মানবী। ‘যাই হোক, সিদ্ধান্ত দাও। নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই,’ হাত ভাঁজ করে উন্মাদের দৃষ্টি মোটকু চার্লির দিকে চেয়ে রইল সে। ‘আনানসিকে আমি ডরাই না।’
মিসেস ডানউইডির পরামর্শ মনে পড়ে গেল ছেলেটার। ‘উম,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আমি কোনো ধরনের কথা দিতে পারব না, আর কিছু দিতে চাইলে বিনিময়ে আমারও সমমূল্যের কিছু পেতে হবে। মানে সমানে-সমান লেন-দেন চাই আমার।’
মনে হলো, পাখি-মানবী বিরক্ত হয়েছে; তবে মাথা দোলাল বটে। ‘তাহলে তাই পাবে। তোমাকে আমি কথা দিলাম,’ মোটকু চার্লির হাতে এমন ভাবে হাত রাখল যেন কিছু একটা দিচ্ছে; তারপর চাপ দিয়ে বন্ধ করে দিল মুঠি। ‘এখন বলো।’
‘আনানসির বংশধরকে তোমায় দিলাম,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘এতেই হবে,’ বলল একটা কণ্ঠ, তারপর আক্ষরিক অর্থেই খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেল পাখি-মানবী।
একটু আগেও যেখানে একজন নারী দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে পাখির ঝাঁক; উড়ছে সবগুলো, তবে একেকটা একেক দিকে…যেন এই মাত্র গুলির আওয়াজ শুনে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। আকাশ এখন পাখিতে ভরা, এত পাখি মোটকু চার্লি কখনও কল্পনার চোখেও দেখেনি। বাদামি-কালো পাখিগুলো এমন ভাবে ঘুরছে আর ছুটছে যে জন্ম দিয়েছে কালো একটা মেঘের, যে মেঘের বিশালত্ব ধরার ক্ষমতা নেই মানব-মনের।
‘স্পাইডারকে তাড়াতে পারবে তো?’ জানতে চাইল মোটকু চার্লি। চেঁচিয়ে উঠল ক্রমশ কালো হতে থাকা আসমানের দিকে চেয়ে। পাখির ঝাঁক ওঠা-নামা করছে ওটার বুকে, তবে উড়ছে তো উড়ছে। আচমকা ওর সামনে দেখা দিল একটা চেহারা, যা এঁকেছে ওই ঝাঁকটাই। চেহারাটাও, মেঘের মতোই, প্রকাণ্ড।
হাজারও পাখি একসঙ্গে চেঁচিয়ে, গুঞ্জন করে, ডেকে উচ্চারণ করল ওর নাম। আকাশে দেখা গেল ঠোঁট, যার আকার টাওয়ারের চাইতে কম হবে না!
পরক্ষণেই উন্মাদনা আর বিশৃঙ্খলা গ্রাস করে নিলো চেহারাটাকে। পাখির ঝাঁকটা এখন নিচের দিকে ধেয়ে আসছে…
…এক মুহূর্ত পরেই নিজেকে শুধরে নিলো মোটকু চার্লি। আসলে নিচের দিকে না, ধেয়ে আসছে ওরই দিকে! হাত তুলে চেহারা ঢাকল সে, রক্ষা করতে চাইল নিজেকে।
গালে যে ব্যথাটা অনুভব করল, সেটা যেমন রুক্ষ তেমনি তার জন্মও আচমকা। ভাবল, নিশ্চয়ই ঝাঁকের কোনো সদস্য ওকে ঠোকর দিয়েছে। কিংবা আঁচড়ে দিয়েছে নখর দিয়ে। তারপর চারপাশে পড়ল ওর নজর, বুঝল যে ফিরে এসেছে মিসেস ডানউইডির কামরায়।
‘আর মেরো না আমাকে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আমি ফিরে এসেছি।’
টেবিলে ওপর থাকা পেঙ্গুইনের মোম প্রায় নিঃশেষিত, মাথা আর কাঁধ অনেক আগেই গলে গেছে। একদা যেটা পেট ছিল, সেই সাদা-কালো আকৃতিহীন তুলতুলে জায়গাটা জ্বলছে এখন। গলে যাওয়া কালো মোম জমাট বেঁধেছে পায়ের কাছে, এদিকে তিন বুড়ি তাকিয়ে আছে মোটকু চার্লির দিকে।
মিস নোলস এক গ্লাস পানি ছুড়ে মারল বেচারার চেহারায়।
‘এক কাজটাও করার দরকার ছিল না,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আমি তো এখন এখানেই আছি!’
কামরায় পা রাখল মিসেস ডান উইডি। হাতে ধরে আছে একটা ছোট্ট, বাদামি কাচের বোতল। ‘স্মেলিং সল্ট,’ ঘোষণা করল সে। ‘জানতাম, কোথাও না কোথাও তো অবশ্যই আছে। এগুলো কিনেছিলাম এই ধরো, সাতষট্টি কি আটষট্টির দিকে। এখনও কাজ করবে কি না, তা অবশ্য জানি না।’ পরক্ষণেই মোটকু চার্লির ওপর চোখ পড়ায় ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল। ‘জেগে গেছে। কে জাগাল?’
‘শ্বাস নিচ্ছিল না,’ জানাল মিসেস বাস্টামন্টে। ‘তাই থাপ্পড় মারতে হলো।’
‘পরে আমি পানিও ঢেলেছিলাম,’ যোগ করল মিস নোলস। ‘ফলে পুরোপুরি জেগে ওঠে।’
‘স্মেলিং সল্টের আমার দরকার নেই,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘এরইমাঝে ভিজে গেছি, ব্যথাও করছে গালে।’ কিন্তু বুড়ো হাতে ততক্ষণে বোতলের ঢাকনি খুলে ফেলেছে মিসেস ডানউইডি, খোলা মুখটা ঠেসে ধরেছে বেচারার নাকের নিচে। মাথা পেছনে সরাতে সরাতেই শ্বাস টানল সে একবার, অ্যামোনিয়ার ঝাঁঝালো গন্ধ একেবারে মগজে খোঁচা মারল। চোখ থেকে পানি গড়াতে শুরু করল তার, মনে হলো যেন নাকে কেউ ঘুসি বসিয়ে দিয়েছে।
‘এই তো, কাজ শেষ।’ বলল মিসেস ডানউইডি। ‘এখন ভালো লাগছে?’
‘কটা বাজে?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি।
‘ভোর পাঁচটা হবে,’ জানাল মিসেস হিগলার; প্রকাণ্ড মগটা কাছে টেনে চুমুক দিল। ‘আমরা তো তোমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাতেই পড়ে গেছিলাম। কী হয়েছে না হয়েছে, বলো সব।’
মনে করতে চাইল মোটকু চার্লি। স্বপ্নের মতো সব ভুলে গেছে, ব্যাপারটা কিন্তু এমন না। বরঞ্চ মনে হচ্ছে: গত কয়েক ঘণ্টায় যা হয়েছে, তা আসলে ওর সঙ্গে হয়নি। অন্য কেউ গেছিল ওই গুহায়, অন্য কারও সঙ্গে চুক্তি হয়েছে পাখি-মানবীর। সেই অন্য ‘কেউ’ এখন পুরোপুরি সাড়া দিচ্ছে না ওর ডাকে। মনের ভেতর সব ঘোঁট পাকাচ্ছে, অন্য জগতের নানা রঙের মিশেল আস্তে
আস্তে ধূসর-কালো বাস্তবতার রং ধরছে। ‘অনেকগুলো গুহা দেখলাম। সবার কাছে চাইলাম সাহায্য, অনেক প্রাণিই ছিল ওখানে। প্রাণিগুলো আবার মানুষও ছিল। কিন্তু কেউ সাহায্য করতে সম্মত হলো না, সবাই বাবাকে ভয় পায়। তারপর একজন মহিলা বলল যে আমাকে সাহায্য করবে।
‘মহিলা?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মিসেস বাস্টামন্টে।
‘ওই মানব-পশুগুলোর অনেকে ছিল নারী, অনেকে আবার পুরুষ।’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘যার কথা বলছি, সে নারীই ছিল।’
‘কিন্তু আসলে কী ছিল? কুমির? হায়েনা? ইঁদুর?’
জবাবে শ্রাগ করল ছেলেটা। ‘তা মনে নেই। হয়তো তোমরা আমাকে মারতে আর আমার গায়ে পানি ঢালতে শুরু না করলে মনে থাকত! আর আমার নাকের নিচে ওই…ওই বাজে জিনিস ঠেসে না দিলে! কিন্তু গন্ধ শুঁকেই তো মাথা থেকে বেরিয়ে গেল সব।।’
মিসেস ডানউইডি বলল, ‘যা বলেছিলাম, তা মনে রেখেছিলে? দেনা- পাওয়া সমান রাখার কথাটা?’
‘হ্যাঁ,’ মোটকু চার্লি গর্বই বোধ করল নিজেকে নিয়ে। ‘হ্যাঁ, একটা বানর অনেক কিছু চাচ্ছিল আমার কাছে, কিন্তু কিচ্ছু দেইনি। তবে পরের ঘটনাগুলো বলার আগে, আমার কিছু একটা গেলা দরকার।’
টেবিলের ওপর থেকে কিছু একটায় ভরতি একটা গ্লাস তুলে নিলো মিসেস বাস্টামন্টে। ‘আগেই ধরে নিয়েছিলাম, তুমি কিছু একটা পান করতে চাইবে। ছাঁকনি দিয়ে শেরি ছেঁকেছি। তারপরও কিছু জড়িবুটি থাকতে পারে। তবে অসুবিধে হবে না।’
কোলের ওপর পড়ে আছে মোটকু চার্লির হাত। ডান হাতটা এগিয়ে দিল বুড়ো মহিলার কাছ থেকে কাচের গ্লাসটা নিতে। পরক্ষণেই থেমে চেয়ে রইল হাতের দিকে।
‘কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস ডানউইডি। ‘কোনো সমস্যা?’
হাতের তালুতে দেখা যাচ্ছে একটা কালো, প্রবল চাপে আকৃতি হারানো, ঘামে ভেজা একখানা পালক। ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল ওর… সব কিছুই!
‘পাখি-মানবী সাহায্য করতে চেয়েছে আমাকে,’ বলল সে।
.
মোটকু চার্লি যখন মিসেস হিগলারের স্টেশন ওয়াগনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে, তখন দিনের ধূসর আলো ফুটতে শুরু করেছে।
‘ঘুম ধরেছে?’ জানতে চাইল মহিলা।
‘ঠিক ঘুম না…কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে।’
‘কোথায় যাবে? আমার বাড়িতে, নাকি তোমার বাবার? মোটেলে নিয়ে যাবো?’
‘আ-আমি জানি না।’
গিয়ার টেনে, গাড়িটাকে রাস্তায় নামাল মহিলা।
‘আমরা যাচ্ছি কই?’
জবাব দিল না মিসেস হিগলার। প্রকাণ্ড মগে চুমুক দিল একটা। তারপর খুলল মুখ, ‘হয়তো আজ রাতে আমরা যা করলাম, তা করাটাই ঠিক ছিল…আবার হয়তো ছিল না। পারিবারিক ব্যাপার-স্যাপার, আসলে পরিবারেরই সামলানো উচিত। তুমি আর তোমার ভাই, পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই এক। হয়তো সেজন্যই এতো দ্বন্দ্ব।’
‘নিশ্চয়ই ‘অনেকটাই এক’ বলতে ‘পুরোপুরি উলটো’ বোঝাচ্ছ? ওয়েস্ট ইন্ডিয়ায় হয়তো এভাবেই কথা বলা হয়!’
‘আমার সামনে ইংরেজ হবার ভড়ং ধোরো না। যা বলার তা বুঝে শুনেই বলছি। তুমি আর ও, এক গাছের ফল; স্বভাবও একই রকমের। তোমার বাবা আমাকে বলত: কেলিঅ্যান, আমার ছেলেরা, ওরা আসলে অ্যাত্তো বোকা যে-বাদ দাও তোমার বাপের কথা। আমার যুক্তি হলো, সে-ও তোমাদেরকে একই স্বভাবের বলে মনে করত।’ আচমকা একটা ভাবনা এলো তার মাথায়। ‘আচ্ছা, তুমি যেখানে গেলে, সেখানে তো প্রাচীন দেবতাদের বাস… তা তোমার বাবাকে দেখতে পেয়েছ?’
‘নাহ, পাইনি। পেলে মনে থাকত।’
মাথা নাড়ল মহিলা, চুপচাপ চালাতে লাগল গাড়ি।
উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে, পার্ক করল সে স্টেশন ওয়াগনটাকে। তারপর নেমে এলো নিচে।
ফ্লোরিডার শীতল প্রভাত দেখা দিয়েছে। দ্য গার্ডেন অভ রেস্টকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো চলচ্চিত্র থেকে উঠিয়ে আনা সেট: মাটি প্রায় কামড়ে ভাসছে কুয়াশা। কোনো কিছুই পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে না। ছোট্ট ফাটকটা খুলল মিসেস হিগলার, তারপর তারা পা রাখল গোরস্তানে।
কদিন আগেও যেখানে ওর বাবার কবরের ওপর আলগা মাটি ছিল, সেখানে এখন ঘাস জন্মেছে। কবরফলক হিসেবে দেখা যাচ্ছে একটা ধাতুর খণ্ড, তাতে বসানো হয়েছে ধাতুর ফুলদানি। সেই ফুলদানিতে আছে কেবল একটা ফুল: একটা হলদে গোলাপ।
‘এই কবরবাসীর ওপর খোদা রহম করুক, বলল মিসেস হিগলার, আন্তরিকতার সঙ্গে। ‘আমেন, আমেন, আমেন।’
দর্শকও আছে উপস্থিত: মোটকু চার্লি আগের বার যে দুটো লাল মাথার বক ছিল, সেগুলোই। মাথা দোলাতে দোলাতে ওদের দিকে এগিয়ে এলো তারা, ভাবখানা এমন যেন অভিজাত বংশের কেউ জেলখানা পরিদর্শন এসেছে!
‘ভাগ!’ বলল মিসেস হিগলার। পাখিগুলো মহিলার দিকে তাকাল বটে, তবে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে। ‘ভাগার’ তো প্রশ্নই আসে না।
তাদের মাঝে একটা মাথা ডুবিয়ে দিল ঘাসের ভেতর, যখন তুলল তখন তার চঞ্চুতে দেখা দিল একটা সরীসৃপ। ঢোক গিলে ওটাকে গলায় পাচার করে দিল পাখিটা, কণ্ঠে একটা ফোলা অংশ হয়ে গেল বেচারা সরীসৃপ।
ভোরের আওয়াজ শুরু হয়েছে: দ্য গার্ডেন অভ রেস্টের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে মকিংবার্ড, গ্রাকল আর অরিয়োল পাখির কিচিরমিচির। ‘বাড়ি ফিরতে পারলে ভালো হতো,’ মোটকু চার্লি। ‘কপাল যদি ভালো হয়, তাহলে হয়তো পাখি-মানবী আমি পৌছুবার আগেই স্পাইডারকে ভাগাতে সক্ষম হবে। তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে সব। রোজির সঙ্গে আবার মিলমিশ করে নেব।’
ভালো লাগার একটা অনুভূতি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে ওর ভেতরে। মনে হচ্ছে, দিনটা ভালোই কাটবে!
.
আগেকার গল্পগুলোতে, আনানসিকে আমরা দেখতে পাই তার নিজের ঘরে বাস করতে…যেমনটা আপনি-আমি করি। সে যে লোভী, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে ধূর্ত এবং এক হিসেবে লোলুপও বলা যায়। তবে একই সঙ্গে সে সাচ্চা মনের, সৌভাগ্যবান এবং অনেকক্ষেত্রে সৎ-ও! তাই বলা যায়, কখনও সে ভালো…কখনও না খারাপ। তবে অশুভ কিংবা শয়তান কখনওই না। গল্প শোনার সময়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ আনানসিরই পক্ষে থাকে। কেন? কারণ আনানসি সব গল্পের মালিক। মাওউ তাকে সব গল্পের অধিকারী বানিয়েছিলেন, বাঘের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে…তাও অনেক অনেক দিন আগে।
আর কথার জাল বুনে কীভাবে গল্প ফাঁদতে হয় তা আনানসির চাইতে ভালো আর কেউ জানে না!
সেই গল্পগুলোয় আনানসি একটা মাকড়শা, আবার একই সঙ্গে মানুষও। এই দুটো ব্যাপার একই সময়ে মাথায় রাখতে কষ্ট হবার কথা না। একটা বাচ্চাও তা পারবে!
আনানসির গল্পগুলো বলত দাদিরা, খালারা, ফুফুরা। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল এবং পুরো ক্যারিবিয়ান জুড়ে প্রচলিত ছিল এই গল্প; আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। গল্পগুলো বাচ্চাদের বইতে স্থান পায়। সমস্যা হলো, দাদিরা-খালারা-ফুফুরা… সেই সঙ্গে বাচ্চাদের বইয়ের লেখকরাও…অনেক কিছুই বাদ দিয়ে যায়। কেননা বাদ না দিলে, সেই গল্পগুলো ঠিক বাচ্চাদের উপযোগী থাকে না।
তেমনই একটা গল্প শোনাবো আজ আপনাদের, নার্সারির কোনো বইতে এই গল্প পাবেন না। আমি তার নাম দিয়েছি: পাখির মুখোমুখি আনানসি।
পাখিকে একদম পছন্দ করে না আনানসি। কেন? কারণ যখন খিদে লাগে, তখন ইচ্ছেমতো পেটপুরে খায় পাখি। আর সেই খাদ্যের তালিকায় আছে মাকড়শাও। ঝামেলা হলো, পাখি সর্বদাই যেন ক্ষুধার্ত থাকে!
আগে ওরা বন্ধুই ছিল, কিন্তু সেই বন্ধুত্বের ছিটেফোঁটাও আজ আর অবশিষ্ট নেই।
একদিন হাঁটতে বেরিয়েছে আনানসি। আচমকা মাটিতে একটা গর্ভ নজরে পড়ল তার, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেল বুদ্ধি। গর্তের একদম নিচে স্থাপন করল সে কাঠ, তারপর তাতে আগুন ধরিয়ে গর্তের ওপর রেখে দিল রান্না করার পাত্র। তার ভেতরে ফেলল কিছু শেকড় আর এটা-সেটা। এরপর মহানন্দে দৌড়াতে শুরু করল পাত্রটাকে ঘিরে দৌড়াচ্ছে, নাচছে আর চেঁচিয়ে বলছে: দারুণ লাগছে আমার, সত্যি বলছি। খুব ভালো লাগছে। শরীরের সব ব্যথা, সব কষ্ট উধাও হয়ে গেছে নিমিষে। আগে কখনও এতটা ভালো বোধ করিনি!
চেঁচানি কানে গেল পাখির। আকাশ থেকে ছোঁ মেরে নিচে নেমে এলো সে, এত চিল্লাপাল্লা কেন— সেটাই জানতে চায়। জিজ্ঞেস করল, কেন এতো চেঁচাচ্ছ…আর কেনই বা নাচছ পাগলের মতো, আনানসি?
জবাবে আনানসি বলল, বহুদিন হলো ঘাড়ের ব্যথায় ভুগছিলাম, আজ সেরে গেছে। পেটে কামড় দিত, সেটাও আর নেই। হাড়ের গিঁটে গিঁটে জং পড়ে গেছিল, কিন্তু এখন আমি একেবারে তরুণদের মতোই চটপটে। আমার ত্বক দেখ, সাপের খোলস ছাড়ার মতোই মসৃণ। আমি শক্তিশালী, আমি খুশি। আর সর্বদা এমনই থাকব…
কারণ সেই রহস্য আমি জেনে গেছি! অথচ আর কেউ জানে না।
রহস্য? কীসের রহস্য? প্রশ্ন ছুড়ে দিল পাখি।
আমার গোপন রহস্য, জানাল আনানসি। এখন সবাই ছুটে আসবে, আমাকে তাদের পছন্দের জিনিস দিয়ে দেবে; দেবে সবচাইতে দামি বস্তুগুলো। কেন? সেই রহস্যটা জানার জন্য। কী মজা! কী আনন্দ!
আরেকটু কাছিয়ে এলো পাখি, এক পাশে মাথা কাত করে জিজ্ঞেস করল, আমাকে বলবে সেই রহস্য?
চোখে-মুখে সন্দেহ নিয়ে আনানসি চাইল পাখির দিকে। তারপর গর্ভের ওপরে বসানো পাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে ওটাকে আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে জানাল, সেটা হচ্ছে না। সবাইকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ নেই আমার কাছে। তাই খালি খালি সেই চিন্তা মাথায় এনো না!
পাখি বলল, শোনো আনানসি, আমি জানি যে আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব সবসময় ছিল না। তবে একটা কথা দিচ্ছি: যদি রহস্যটা আমাকে জানাও, তাহলে আর কখনও কোনো পাখির খাদ্য হতে হবে না কোনো মাকড়শাকে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবার আগপর্যন্ত আমরা বন্ধু হয়েই থাকব।
চিবুক চুলকালো আনানসি, মাথা নাড়ল পরক্ষণেই। রহস্যটা অনেক বড়ো, জানাল সে। সেই অনুসারে কাজ করলে বয়েস তো কমবেই, সেই সঙ্গে শরীর থেকে বিদায় নেবে সব ধরনের ব্যথা।
পাখি গজগজ করতে লাগল। জানাল, আনানসি, তোমাকে যে আমি সবসময় সুদর্শন ভেবে এসেছি, তা তুমিও জানো। এসো এক কাজ করা যাক: আমরা কিছু সময় একত্রে কাটাই, তাহলেই তোমার সব আপত্তি উবে যাবে।
বলাই বাহুল্য, আনানসি যেমন পুরুষের রূপ ধরে থাকত, তেমনি পাখি ধরত নারীর রূপ। যাই হোক, একসঙ্গে বেশ খানিকটা সময় একান্তে কাটাল ওরা। তারপর পাখি বলল, এবার আনানসি, আমাকে তোমার গোপন রহস্য বলো।
আনানসি জানাল, আসলে অন্য কাউকে বলার ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু তোমাকে বলতে আপত্তি নেই। এই যে গর্ত দেখছ, তাতে আমি গোসল করার জন্য পানির সঙ্গে বেশ কিছু জড়িবুটি মিশিয়েছি। এই যে দেখো, তোমার সামনেই পানিতে ফেলছি সব কিছু। এখন যে-ই এতে গোসল করবে, সে-ই চিরদিন বেঁচে থাকবে। নিজেও করেছি, আর দেখতেই তো পেলে আমি কতটা সুস্থ এখন। আর কাউকে এই পানিতে গোসল করতে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু….
ততক্ষণে ফুটতে থাকা পানির দিকে এগিয়ে গেছে পাখি, আনানসির কথা শেষ হবার আগেই নেমে পড়েছে পাত্রে।
মারাত্মক গরম, আনানসি, জানাল সে।
জড়িবুটির ভেতর থেকে রস নিংড়ে বের করে আনার জন্য পানি তো গরম থাকতেই হবে। জানাল আনানসি। তারপর পারের ডালা হাতে নিয়ে, মুখটা বন্ধ করে দিল। মারাত্মক ভারী ওই ডালা, তারপরেও নিশ্চিত হবার জন্য একটা পাথর রেখে দিল ওটার ওপরে।
ব্যাম! ব্যাম! ব্যাম!
পাত্রের ভেতর থেকে ভেসে এলো আওয়াজ।
যদি এখন বেরিয়ে আসো, জানাল আনানসি বাইরে থেকে, তাহলে কিন্তু বিন্দুমাত্র লাভ হবে না। শান্ত হও, দেখবে খানিকক্ষণের মাঝেই নিজেকে সুস্থ মনে হচ্ছে।
পাখি ওর কথা শুনেছে কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। কিন্তু শুনলেও বিশ্বাস করেনি, তাই বারবার সে পাত্রের ভেতর থেকে কিল বসাতেই লাগল। তবে অচিরেই, থেমে গেল সেই আওয়াজও।
সেদিন সন্ধ্যায় পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে দারুণ সুস্বাদু, পাখির সুপ আর মাংস খেল আনানসি। এতটাই পেট পুরে খেল সেদিন যে পরবর্তী অনেকগুলো দিন ওদের খাওয়া-দাওয়া করারই প্রয়োজন হয়নি!
সেদিনের পর থেকে, সুযোগ পেলেই মাকড়শা ধরে মুখে পুড়ে দেয় পাখি। আর নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মাকড়শা ও পাখির মধ্যে বন্ধুত্ব কখনওই সম্ভব না!
.
অবশ্য এই গল্পের আরেকটা রূপও পাওয়া যায়, তাতে আনানসি নিজেই ঢুকে পড়েছিল পাত্রে। পৃথিবীর সব গল্পই আনানসির। কিন্তু সব গল্পে, দিন শেষে হাসি যে ওর মুখেই ফোটে…সে কথা কে বলল?