অধ্যায় বারো – যেখানে অনেক কিছুই জীবনে প্রথমবারের মতো করতে হলো মোটকু চার্লিকে

অধ্যায় বারো – যেখানে অনেক কিছুই জীবনে প্রথমবারের মতো করতে হলো মোটকু চার্লিকে 

দ্য ডলফিন হোটেলে একজন কনসিয়ার্জ‍ আছে। বয়েস তার কমই, চশমা পরে। এই মুহূর্তে ব্যস্ত একটা পেপারব্যাক নিয়ে, ওটার প্রচ্ছদে গোলাপ আর বন্দুক দেখা যাচ্ছে। 

‘একজনকে খুঁজছি আমি,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘এই দ্বীপেই তার থাকার কথা।’ 

‘কাকে খুঁজছেন?’ 

‘কেলিঅ্যান হিগলার নাম তার। ভদ্রমহিলা ফ্লোরিডাতে থাকে, আমার পারিবারিক বন্ধু।’ 

চিন্তিত ভঙ্গিতে বইটা বন্ধ করল যুবক, তারপর চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল মোটকু চার্লির দিকে। পেপারব্যাক বইয়ের পাতায় যখন মানুষকে এমন কিছু করতে দেখা যায়, তখন ধরে নেওয়া হয় সেই ব্যক্তি পরম মনোযোগ দিচ্ছে হাতের কাজে। কিন্তু বাস্তবে করতে দেখে মনে হলো, ছেলেটা বোধহয় ঘুম তাড়াচ্ছে! বলল সে, ‘আপনিই কি লেবুঅলা?’ 

‘কী?’ 

যে ভদ্রলোক শুধু লেবু নিয়ে হোটেলে উঠেছেন?’

‘উম, হ্যাঁ। বলতে পারেন।’ 

হোটেল ম্যানেজারের মতো যার কাজ অতিথির হোটলের ভেতরের-বাইরের সব চাহিদা মেটানো। 

‘দয়া করে দেখান তো।’

‘আমার লেবু?’ 

আগ্রহের সঙ্গে মাথা নাড়ল যুবক। 

‘নাহ, দেখানো যাবে না। কামরায় ফেলে এসেছি।’ 

‘কিন্তু আপনিই তো সেই লেবুঅলা!’ 

‘মিসেস হিগলারের খোঁজ পেতে সাহায্য করতে পারবেন? এই দ্বীপে হিগলার নামের কেউ বাস করে? আপনার কাছে ফোনবুক আছে? আমার কামরায় থাকবে ভেবেছিলাম, পাইনি।’ 

‘নামটা খুবই প্রচলিত, বুঝলেন?’ বলল যুবক। ‘ফোন বুক ঘেঁটে ফায়দা নেই।’ 

‘কতটা প্রচলিত?’ 

‘এই যেমন ধরুন, জানাল যুবক। ‘আমার নাম বেঞ্জামিন হিগলার। রিসেপশনে যে বসেছে সে আমেরিলা হিগলার।’ 

‘ওহ, দ্বীপে তাহলে হিগলারের অভাব নেই। বুঝতে পেরেছি।’ 

‘গানের অনুষ্ঠানের জন্য এসেছেন সেই ভদ্রমহিলা?’ 

‘কীসের জন্য?’ 

‘সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান চলবে,’ বলেই একটা লিফলেট সে বাড়িয়ে দিল মোটকু চার্লির দিকে। জানাল উইলি নেলসন (বাতিল) আসার কথা ছিল সেন্ট অ্যান্ড্রুজের গানের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ হতে। 

‘তাহলে বাতিল লেখা যে? কেন বাদ গেল?’ 

‘যে কারণে গার্থ ব্রুকস বাদ দিয়েছেন। আসলে তাদেরকে কেউ দাওয়াতই দেয়নি!’ 

‘মনে হয় না আমার মিসেস হিগলার সেজন্য এসেছে। যাই হোক, তার খোঁজ পাওয়াটা খুবই জরুরি। তার কাছে একটা জিনিস আছে, আমার লাগবে। আপনি যদি আমার জায়গায় থাকতেন, তাহলে কোথায় যেতেন খুঁজতে?’ 

ডেস্কের ড্রয়ার থেকে দ্বীপের একটা মানচিত্র বের করে আনল বেঞ্জামিন হিগলার। ‘আমরা আছি এখানে, উইলিয়ামসটাউনের ঠিক দক্ষিণে…’ শুরু করল সে, কাগজে ফেল্ট কলম দিয়ে দাগ দিল। সেখান থেকে শুরু করে মোটকু চার্লির জন্য পথচলার ও খোঁজাখুঁজির একটা রূপরেখা এঁকে দিল সে: দ্বীপটাকে বেশ কয়েকটা ভাগে ভাগ করল, চাইলেই একজন মানুষের পক্ষে বাইসাইকেল নিয়ে এক দিনে এক ভাগ খুঁজে দেখা সম্ভব। ছোটো ছোটো ক্রসের সাহায্যে আলাদা করে দিল মদের দোকান আর ক্যাফেগুলোর অবস্থান। প্রতিটা পর্যটন কেন্দ্রের পাশে আঁকল বৃত্ত। 

তারপর একটা বাইসাইকেল ভাড়া দিল মোটকু চার্লিকে। 

প্যাডেল চালিয়ে দক্ষিণে রওয়ানা দিল বেচারা। 

সেন্ট অ্যান্ড্রুজে তথ্য পাবার বেশ কিছু জায়গা আছে, যার অস্তিত্বের কথা মোটকু চার্লি কল্পনাও করতে পারেনি। মুখে না বললেও মনে বিশ্বাস করে, সেলুলার ফোন আর নারিকেলের গাছের সারি… দুটোই একই সময়ে একই জায়গায় থাকা উচিত না; হয়তো কল্পনার ব্যর্থতা সেজন্যই। যার সঙ্গেই কথা বলুক না কেন, চাই সে হোক—ছায়ায় বসে বাদ্য বাজানো বুড়ো… কিংবা তরমুজের মতো স্তন, আর্মচেয়ারের মতো নিতম্ব আর মকিংবার্ডের মতো হাসি হাসা নারী…টুরিস্ট অফিসে কর্মরত সুবিবেচক যুবতী… সবুজ, লাল আর হলদে রঙা টুপি আর উলের মিনি স্কার্ট পরা রাস্তাফারি—প্রথম যে প্রশ্নটা করল সেটা হলো একই: ‘আপনি বা তুমিই কি সে লেবুঅলা?’ 

‘তাই তো মনে হচ্ছে!’ 

‘দেখি লেবুটা।’ 

‘হোটেলে ফেলে এসেছি। আমি কেলিঅ্যান হিগলার নামের এক মহিলাকে খুঁজছি। বয়েস ষাটের ঘরে হবে, আমেরিকান। হাতে কফির বড়ো মগ থাকে সবসময়।’ 

‘চিনি না, জীবনেও দেখিনি।’ 

সাইকেল চালিয়েই দ্বীপটা ঘুরে দেখল মোটকু চার্লি। অচিরেই টের পেল, কাজটা একেবারে বিপদমুক্ত না। এই দ্বীপে চলাফেরার মূল উপায় হচ্ছে মিনিবাসের ব্যবহার। কিন্তু ওগুলো লাইসেন্সবিহীন, বিপজ্জনক, অতিরিক্ত যাত্রীবাহী… রাস্তা খারাপ বলে ব্রেক কষলেই তীব্র আওয়াজ কানে আসে, চাকাও ঠিকমতো দাঁত বসাতে পারে না রাস্তায়। প্রায়শই দেখা যায় বাহনগুলো দুই চাকার ওপর দাঁড়া হয়ে গেছে, চালকের ভাবনা থাকে—নিশ্চয়ই যাত্রীর ওজনের কারণে ভারসাম্য পেয়ে যাবে তার মিনিবাস। প্রথম দিন সকালেই কয়েকবার মরতে বসেছিল মোটকু চার্লি, বাসের সাউন্ড সিস্টেমকে ছাপিয়ে ভেতরে বাজতে থাকা ড্রামের ধাম-ধাম শব্দ না থাকলে হয়তো সেটাই হতো। এমনকী ইঞ্জিনের আওয়াজ কানে আসার আগেই পাকস্থলীতে অনুভব করতে পারছিল সেই কম্পন। তাই সাইকেলসহ রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে জান বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে সে! 

যাদের সঙ্গে কথা হলো, তাদের কারও কাছ থেকেই বলতে গেলে কোনো সাহায্য পেল না মোটকু চার্লি; তবে নিঃসন্দেহে তাদের প্রত্যেকেই বন্ধুসুলভ আচরণ করল ওর সঙ্গে। দক্ষিণে খোঁজাখুঁজি চালাবার সময় বেশ কয়েকবার পানির বোতল ভরতে হলো ওকে, সেজন্য থামল ক্যাফেতে আর ব্যক্তি মালিকানাধীন বাড়িতে। সবাইকে খুশিই মনে হলো তাকে দেখে, যদিও কেউই মিসেস হিগলারের ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারল না। রাতের খাবার খাওয়ার আগে ফিরে এলো দ্য ডলফিন হোটেলে। 

পরেরদিন মোটকু চার্লি গেল উত্তর দিকে। উইলিয়ামসটাউনে ফেরার পথে, মানে বিকেলের দিকে, থামল একটা খাড়া পাহাড়ে। সাইকেল থেকে নেমে, ওটাকে ঠেলে নিয়ে গেল একাকীত্বের মাঝে আশ্রয় নেওয়া একখানা বিলাসী দালানে। বাড়িটার সামনে আছে কেবল একটা উপসাগর। স্পিকার- ফোনের কাছে গিয়ে, বোতাম চেপে ‘হ্যালো’ বলল সে, কিন্তু জবাব পেল না ওপাশ থেকে। গাড়িপথে বসে আছে একটা বড়োসড়ো, কালো গাড়ি। একবার ভাবল, হয়তো কেউ নেই বাড়িতে। কিন্তু ওপরের তলার একটা জানালা পর্দা নড়ে উঠে ওকে বুঝিয়ে দিল যে ধারণাটা সঠিক নয়। 

আরেকবার বোতাম চাপল ও। ‘হ্যালো,’ বলল সে। ‘পানি ভরার অনুমতি চাইছি। 

এবারও জবাব পেল না। মনে হতে লাগল ওর: হয়তো পর্দার নড়ন-চড়ন দেখাটা ওর দৃষ্টিভ্রম। আজকাল প্রায়শই এমন উলটোপালটা জিনিস দেখে বেড়াচ্ছে সে; কেবলই মনে হচ্ছে যেন কেউ একজন নজর রাখছে ওর ওপরে। নাহ, বাড়ির অধিবাসী না; নজর রাখছে রাস্তার পাশে থাকা ঝোপের আড়ালে থাকা কেউ একজন। ‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত,’ স্পিকারে বলল সে, তারপর চড়ে বসল সাইকেলে। উইলিয়ামসটাউনে যাবার পথটা কেবলই উৎরাই, তাই খুব একটা কঠিন হবে না। আর তাছাড়া, পথে একটা-দুটো ক্যাফে তো পড়বেই… 

…হয়তো বন্ধুবৎসল বাড়িও পড়তে পারে। 

পথ ধরে নিচে নামার সময় — সাগরের দিকে খাড়া হয়ে গেছে দেওয়াল- পেছন থেকে গর্জন করতে করতে ছুটে এলো একটা কালো গাড়ি। মোটকু চার্লি বুঝতে পারল, ঘটনা এবার ঘটেই যাবে। চালক ওকে দেখতে পায়নি। 

হলোও তাই…গাড়ির দেহে দেখা গেল সাইকেলে হ্যান্ডেলবারের ছাপ, মোটকু চার্লি নিজেকে সাইকেলসহ পাহাড় থেকে পড়ন্ত অবস্থায় আবিষ্কার ।করল! এদিকে কালো গাড়িটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, সেটা ছুটেই যাচ্ছে সামনে। 

পাহাড়ের অর্ধেকটা গড়িয়ে পড়ার পর, নিজেকে কোনোমতে সামলাতে পারল মোটকু চার্লি। ‘আরেকটু হলেই গেছিলাম,’ উচ্চকণ্ঠেই বলল সে। হ্যান্ডেলবার বেঁকে গেছে। ওটাকে আবার রাস্তায় নিয়ে এলো সে, পেছন থেকে ভেসে আসা কম্পন ওকে জানিয়ে দিল—একটা মিনিবাস আসছে। হাত নেড়ে থামাল ওটাকে। 

‘আমার সাইকেলটা পেছনে নেওয়া যাবে?’ 

‘জায়গা নেই,’ জানাল চালক। তবে সিটের নিচ থেকে কিছু বাঞ্জি কর্ড বের করে এনে, সেগুলো দিয়ে সাইকেলটাকে বেঁধে ফেলল বাসের ছাদের সঙ্গে। তারপর হাসল, ‘তুমি নিশ্চয়ই লেবুঅলা ইংরেজ?’ 

‘আমার সঙ্গে নেই এই মুহূর্তে, হোটেলে রেখে এসেছি।’ 

কোনোক্রমে মোটকু চার্লি গুটিসুটি মেরে ঢুকে পড়ল ভেতরে। বসার মতো জায়গা পেল বটে, তবে পাশেই রয়েছে দশাসই এক মহিলা; সে আবার বসে আছে কোলে একটা মুরগি নিয়ে। ওদের পেছনে বসেছে দুই শ্বেতাঙ্গ মেয়ে, আগের রাতে যে পার্টিতে যোগ দিয়েছে সেটার ব্যাপারে আলোচনা করছে; সেই সঙ্গে ছুটির এই সময়টায় যে অস্থায়ী প্রেমিক জোগাড় করেছে তাদের কমতি নিয়েও 

কালো গাড়িটাকে দেখতে পেল মোটকু চার্লি—একটা মার্সিডিজ-ফিরে আসছে রাস্তা ধরে। একপাশে লম্বা একটা দাগ দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার ভাবে। অপরাধ বোধ জন্ম নিলো মোটকু চার্লির মনে, ভাবল যে গাড়ির রং ঠিক করতে আবার যেন বেশি খরচ হয়ে না যায় মালিকের। জানালাগুলো এতটাই কালো যে মনে হচ্ছে: গাড়িটা বুঝি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে… 

সাদা যুবতীদের একজন টোকা দিল মোটকু চার্লির কাঁধে, জিজ্ঞেস করল—রাতের কোনো জমজমাট পার্টির হদিস দিতে পারবে কি না সে। যখন ছেলেটা জানাল: এমন কিছু সে জানে না, তখন নিজে থেকেই দুই রাত আগে গুহায় করা পার্টির গল্প শোনাল। ওতে ছিল একটা সুইমিং পুল, সাউন্ড সিস্টেম, আলো আর এটা-সেটা সব কিছু। তাই কালো মার্সিডিজটা যে মিনিবাসের পিছু পিছু আসছে তা টের পেল না মোটকু চার্লি। গাড়িটা বিদায় নিলো ওকে সাইকেলটা মিনিবাসের ছাদ থেকে খুলে (‘পরেরবার, লেবু সঙ্গে নিয়ে বের হবে কিন্তু’) হোটেল লবিতে ওটাকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকতে দেখে। 

 গাড়িটা যে পাহাড়ের ওপরের প্রাসাদে ফিরে গেল, সেটাও জানা হলো না তার।

বেঞ্জামিন নামের কনসিয়ার্জ সাইকেলটাকে ভালোভাবে পরখ করে দেখল, তারপর জানাল মোটকু চার্লিকে: ভাবনার কোনো কারণ নেই, কালকের মাঝে সব মেরামত করা হয়ে যাবে। 

হোটেলের কামরায় ফিরে গেল মোটকু চার্লি। সেখানেই, কাউন্টারটপের ওপরে, পানির তলের রং ধারণ করে, ছোট্ট একটা সবুজ বুদ্ধ মূর্তির মতো বসে আছে লেবুটা। 

‘তোমাকে দিয়ে লাভটা কী হলো?’ লেবুকে বলল সে। কাজটা একেবারেই অহেতুক হয়ে গেল, লেবুটা একেবারেই সাধারণ; অনন্য কিছু নেই ওটার মাঝে। লেবুটার যা করার কথা, তাই করছে সে। 

.

গল্পের সঙ্গে সহজেই তুলনা করা যায় মাকড়শার জালের। একটা সুতোর সঙ্গে আরেকটা সুতোর সম্পর্ক থাকে ভালো ভাবেই। তাই প্রত্যেকটা গল্পকে অনুসরণ করে পৌঁছানো যায় তার কেন্দ্রে, কেননা গল্পের সমাপ্তি থাকে সেই কেন্দ্রেই। 

আর প্রতিটি মানুষ হচ্ছে এক-একটা সুতো। 

এই যেমন, ডেইজি। 

এতগুলো বছর পুলিস ফোর্সে টিকে থাকতে পারত না মেয়েটা, যদি না ওর মাঝে কাণ্ডজ্ঞান থাকত; অধিকাংশ মানুষ অবশ্য ডেইজির মাঝে সেটাই খুঁজে পায়। আইনকে সম্মান করে সে, সম্মান করে নিয়মকে। জানে, অনেক নিয়মই আসলে ধূসর—এই যেমন কোথায় গাড়ি পার্ক করা হবে, কিংবা কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখবে–কিন্তু এই নিয়মগুলোই দুনিয়াকে সচল রাখে, নিরাপত্তা দেয় সমাজকে। 

দূর করে সব ঝুঁকি আর বিপদাশঙ্কা। 

এদিকে ওর ফ্ল্যাটমেট, ক্যারোলের মতে— পাগল হয়ে গেছে ডেইজি! 

‘এভাবে কাজ ফাঁকি দিয়ে সেটাকে ছুটি বলে চালিয়ে দিতে পারবে না। এভাবে কিছু হয় নাকি? টিভির কপ শোয়ের নায়িকা যে নও, সেটা ভুলে গেছ? একটা সূত্রের খোঁজে পৃথিবীর এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতে চাচ্ছ!’ 

‘আরে না, সেটা কে বলল?’ বিদ্রুপের সঙ্গে বলল ডেইজি। ‘আমি যাচ্ছি ছুটি কাটাতে।’ 

এমন দৃঢ়তার সঙ্গে বলল কথাটা যে ডেইজির মগজের পেছনের অংশে লুকিয়ে থাকা বিবেচনাবোধ-সম্পন্ন পুলিস অফিসারটা চমকে চুপ হয়ে গেল। তবে সেটার স্থায়িত্ব হলো মাত্র এক মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই বোঝাতে লাগল ওকে: ভুল করছে। অনুনোমোদিত ছুটিতে যাচ্ছে সে–যার অর্থ দায়িত্বে ফাঁকি দেওয়া, জানাল সেই অফিসার—সেই সঙ্গে কাউকে না জানিয়ে দেশ ছাড়ার অপরাধ তো আছেই। 

বিমানবন্দরে যাবার পথেও চুপ করল না কণ্ঠটা, করল না আটলান্টিক পেরোবার সময়ও। বুঝিয়ে দিল: কোনোভাবে যদি ওর ফাইলে চিরস্থায়ী কালো দাগ পড়ে নাও যায়… এবং কোনোভাবে চাকরি বাঁচাতে পারে… এবং গ্রাহাম কোটসকে যদি খুঁজেও পায়…তারপরেও কিচ্ছু করতে পারবে না। এমনকী খোদ অপরাধীকেও বিদেশের মাটি থেকে অপহরণ করাটা সম্রাজ্ঞীর পুলিসবাহিনী ভালো নজরে দেখবে না। তাকে গ্রেফতার করার কোনো উপায় নেই…আর গ্রাহাম কোটসকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে যুক্তরাজ্যে ফিরিয়ে আনতে পারে—এমন সম্ভাবনাও শূন্যের কোঠায়। 

জ্যামাইকায় পৌঁছে ছোট্ট বিমান থেকে বেরোবার এবং সেন্ট অ্যান্ড্রুজের ভেজা, ঝাঁঝাল, সোঁদা… প্রায় মিষ্টি বাতাসের স্বাদ পাওয়ার পর ওর ভেতরের বিবেচক অফিসারটি ওকে পাগলামিটার কথা বলা বন্ধ করল। কারণ তার কণ্ঠ ঢাকা পড়ে গেল আরেকটা কণ্ঠের নিচে। ‘অপরাধীরা সাবধান!’ বলছে সেটা। ‘সাবধান! সতর্ক থাকো! চারিদিকে শয়তান আর শয়তান!’ সেই তালে তালে পা ফেলছে ডেইজি। গ্রাহাম কোটস তার অলডউইচের অফিসে এক মহিলাকে হত্যা করেছে, তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে গেছে কোনো সাজা না পেয়ে! 

এবং সবই করেছে ডেইজির নাকের নিচে। 

মাথা নেড়ে ব্যাগটা বুঝে নিলো ডেইজি। তারপর হেসে ইমিগ্রেশন অফিসারকে জানাল যে ছুটি কাটাতে এসেছে। তারপর এগিয়ে গেল ট্যাক্সির সারির দিকে। 

‘হোটেল দরকার। খুব বেশি খরুচে যেন না হয়, কিংবা একেবারে বাজেও চাই না।’ চালককে জানাল সে। 

‘আপনার জন্য উপযুক্ত হোটেলেই নিয়ে যাবো,’ জানাল চালক। ‘উঠে বসুন।’ 

.

চোখ খুলতেই স্পাইডার আবিষ্কার করল: হাত-পা বেঁধে কেউ ঝুলিয়ে রেখেছে ওকে। উলটো হয়ে পড়ে আছে সে, হাত বেঁধে রাখা হয়েছে মাটিতে গুঁজে রাখা একটা বিশাল গজালের সঙ্গে; গজালটা ওটার ঠিক সামনেই। পা নাড়াতে পারছে না; ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে কে আছে তা দেখবে, সেটার উপায়ও নেই। তবে বাজি ধরে বলতে পারবে, হাতের মতো পা-ও বেঁধে রাখা হয়েছে ওর। নিজেকে মাটির ওপর থেকে উঠিয়ে পেছন দিকে তাকাবার চেষ্টা করতেই জ্বলে উঠল কাটা-ছেঁড়া করা জায়গাগুলোতে। 

মুখ খুলল ও, সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে আছড়ে পড়ল কালো রক্ত; ভিজিয়ে দিল মাটি। 

একটা শব্দ শুনে সেদিকে ঘাড় ঘোরাবার প্রয়াস পেল স্পাইডার, দেখল : এক শ্বেতাঙ্গ মহিলা চোখে কৌতূহল নিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। 

‘ঠিক আছ? যাহ, প্রশ্নটাই বাজে। তোমার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছি। আরেকটা ডাপ্পি নাকি তুমি? ঠিক বললাম তো? 

ভাবল স্পাইডার। নিজেকে ওর ডাপ্পি মনে হচ্ছে না, দুই পাশে মাথা নাড়ল তাই। 

‘হলেও তাতে কী? আমি নিজেই তো ডাপ্পি। এই শব্দের সঙ্গে আগে পরিচয় ছিল না, কিন্তু পথ চলতে গিয়ে এক মজাদার ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সেই বয়স্কা মানুষটিই এই শব্দের ব্যাখ্যা আমাকে বললেন। দেখা যাক, তোমার কোনো সাহায্যে আসতে পারি কি না।’ 

স্পাইডারের পাশে উবু হয়ে বসে, হাত বাড়াল বাঁধন খুলতে। 

কিন্তু ওর হাতটা ভেদ করে গেল যুবকের দেহ। মহিলার আঙুলের ছোঁয়া অনুভব করল বটে স্পাইডার, অনেকটা কুয়াশার মতো… 

‘তোমাকে স্পর্শ করতে পারব বলে মনে হয় না, জানাল মহিলা। ‘সেটাও শাপে বর। এর মানে—তুমি এখনও মারা যাওনি। খুশি হও।’ 

অদ্ভুত এই ভূতুড়ে নারী যত দ্রুত চলে যায় এখান থেকে, ততই ভালো- ভাবল স্পাইডার। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারছে না একদম। 

‘যাই হোক, সব কিছু বুঝে নিতে চাই প্রথমে। তবে আমার খুনির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নিয়ে দুনিয়া ছাড়ব না। মরিসকে বুঝিয়ে বলেছি সব— সেলফ্রিজেসের একটা টেলিভিশনের পর্দায় — অবশ্য আমাকে বলছিল যে পর্দার ওপারে যাওয়ার ব্যাপারটাই নাকি আমি ধরতে পারছি না। তবে বলে দিচ্ছি: এক গালে থাপ্পড় খেলে আরেক গাল পেতে দেবো, এই আশা করলে হতাশ হতে হবে। আগেও তার প্রমাণ দেখিয়েছি। সুযোগ পেলে আমিও ব্যাঙ্কো বনে যেতে পারব। কথা বলতে জানো না?’ 

স্পাইডার মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে জানে, কিন্তু তা করতে গিয়ে কপাল একটা থেকে রক্তের ফোঁটা এসে পড়ল চোখে; জ্বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। নতুন জিভ গজাতে কত সময় লাগবে, ভাবল একবার। প্রতিদিন একটা করে নতুন কলিজা গজাত প্রমিথিউসের, স্পাইডার মোটামুটি নিশ্চিত যে কলিজা গজানোটা জিভ গজানোর চাইতে অনেক বেশি কঠিন। হাজারো জিনিস থাকে কলিজায় — বিলিরুবিন, ইউরিয়া, এনজাইম। মদ পর্যন্ত ভেঙে যায় কলিজায় গিয়ে, তাই অনেক কিছু করতে হয় শরীরের ওই অঙ্গটাকে। আর জিভ? তার একটাই কাজ—কথা বলা। অবশ্য চাটাও আছে… 

‘আমার এত কথা বলার সময় নেই।’ হলদে চুলো প্রেত-নারী বলল। ‘অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে বলেই মনে হচ্ছে।’ হাঁটতে শুরু করল সে, যতই দূরে যাচ্ছে ততই যেন মিলিয়ে যাচ্ছে অবয়ব। মাথা তুলে মহিলার আত্মাকে এক বাস্তবতা থেকে অন্য বাস্তবতায় মিশে যেতে দেখল স্পাইডার; অনেকটা সূর্যের আলোয় ঝলসে যেতে শুরু করা ছবির মতো। তাকে ডাকার চেষ্টা করল বেচারা, কিন্তু জিভ ছাড়া মুখ থেকে বেরোল শুধু অসংলগ্ন কিছু শব্দ। 

দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে পাখির চিৎকার। 

আরেকবার চেষ্টা করে দেখল স্পাইডার, কিন্তু বাঁধন আলগা করতে পারল না। 

আরও একবার ভাবতে শুরু করল সে রোজির বলা গল্পটা, যে গল্পে পাহাড়ি সিংহের হাত থেকে মানুষকে বাঁচিয়েছিল একটা দাঁড়কাক। গল্পটা ওর মাথায় খোঁচাচ্ছে শুধু, চেহারা আর বুকে থাকা নখের আঘাতের চাইতে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। মনোযোগ দাও। লোকটা শুয়ে আছে মাটিতে, বই পড়ছে কিংবা রোদ পোহাচ্ছে। এদিকে গাছে বসে চেঁচাচ্ছে দাঁড়কাক। নিচে অপেক্ষা করছে একটা বড়োসড়ো বিড়াল… 

যেন ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে সাজিয়ে নিলো গল্পটা। কিছুই বদলায়নি…উপাদানগুলোকে কী চোখে দেখা হচ্ছে, তার ওপরেই নির্ভর করছে সব কিছু। 

যদি, ভাবল সে, ধরে নিই—পাখিটা আসলে মানুষকে সাবধান করে বলতে চাচ্ছে না যে একটা বিশাল সিংহ ওর জন্য ওঁত পেতে আছে; বরঞ্চ পাহাড়ি সিংহটাকে সাবধান করে দিতে চাইছে যে মাটিতে শুয়ে আছে একটা মৃত, ঘুমন্ত কিংবা মরণাপন্ন মানুষ— তাহলে? সিংহের করণীয় তখন শুধু একটাই মানুষটাকে শেষ করে দেওয়া। সেক্ষেত্রে লাশের যতটুকু অবশিষ্ট থাকবে সিংহের পেটপুজোর পর, সেটা যাবে দাঁড়কাকের ভোগে। 

গোঙানোর জন্য মুখ খুলল স্পাইডার। রক্ত ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এসে দানাদার মাটিতে জমাট বাঁধতে শুরু করল 

পাতলা হয়ে এলো বাস্তবতা; সময় বয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বাস্তবতা বদলে যাচ্ছে ওই দৃশ্যের আদলে। 

জিভহীন, ক্ষিপ্ত স্পাইডার মাথা তুলে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতে চাইল চারপাশে ঘুরপাক করতে থাকা ভূতুড়ে পাখিগুলোকে। ক্রমাগত চেঁচিয়েই চলছে ওগুলো। 

কোথায় পড়ে আছে, তা বোঝার প্রয়াস পেল সে এরপর। পাখি-মানবীর তামাটে রঙা বিশ্বে যে নেই, কিংবা নেই তার গুহায়—এতটুকু পরিষ্কার। আগে যে স্থানটাকে আসল দুনিয়া বলে ভাবত, নেই সেখানেও। হ্যাঁ, সেই দুনিয়ার কাছাকাছি কোথাও আছে। এত কাছে যে তার উপস্থিতি টের পাচ্ছে স্পাইডার, মুখে রক্তের ধাতব স্বাদ না পেলে হয়তো তার স্বাদও পেত! আর মাটিতে গজাল পুঁতে বেঁধে রাখা না হলে, সেই দুনিয়াকে স্পর্শ করতেও অসুবিধে হতো না। 

নিজের মানসিক স্থিরতা নিয়ে যদি শতভাগ নিশ্চিত না হতো—যে নিশ্চয়তা সাধারণত যেসব মানুষ নিজেকে পৃথিবীর উদ্ধারকর্তা, জুলিয়াস সিজার ভাবে—তাহলে পাগল হয়ে যেত। প্রথমে দেখতে পেল এক সোনালি- চুলো মহিলা যে নিজের পরিচয় দিল ডাপ্পি বলে, এখন শুনতে পাচ্ছে অদ্ভুত সব কণ্ঠ। 

আসলে সব কণ্ঠ না, একটা কণ্ঠ…যেটার মালিক রোজি! 

মেয়েটা বলছে। ‘ঠিক জানি না। ভেবেছিলাম ছুটি কাটাবো। কিন্তু ওই বাচ্চাগুলোকে দেখার পর, তাও আবার ওই অবস্থায়, নিজেকে সামলে রাখা কঠিন। কত কী থেকে বঞ্চিত বেচারারা।’ স্পাইডার কথাগুলোর ওজন আঁচ করতে পারার আগেই যোগ করল। ‘আরও কতক্ষণ যে গোসলে খরচ করবে, তাই ভাবছি। কপাল ভালো যে আপনার এখানে গরম পানির অভাব নেই।’ 

রোজির কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ কি না, তাই ভাবতে বসল স্পাইডার। হয়তো এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে মেয়েটার কথার মাঝেই। সন্দেহ আছে ওর। তারপরেও কান পেতে শুনতে লাগল, ভাবছে: বাতাসের ডানায় ভেসে অন্য দুনিয়া থেকে ওর কানে আর কোনো শব্দ আসবে কি না। সমুদ্রের তটে ঢেউ আছড়ে পড়ার আওয়াজ বাদে আর কিছুই শুনতে পেল না অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও। আছে তো কেবলই নীরবতা, সেই নীরবতাও বিশেষ এক ধরনের। 

মোটকু চার্লি যেমনটা ভাবত: নীরবতা আছে অনেক প্রকারের। কবরস্থানের আছে তার নিজস্ব নীরবতা, তেমনি আছে মহাকাশেরও; আবার পাহাড়ের শীর্ষে গেলে পাওয়া যায় তার নীরবতা। ভয়ংকর এক প্রকাশের নীরবতাও আছে, যা পিছু ছাড়তে চায় না। তেমনি আছে শিকারের নিস্তব্ধতা। সেই নীরবতার মাঝে কিছু একটা নড়া-চড়া করছে ভেলভেটের মতো থাবার ওপর ভর দিয়ে, তার নরম লোম-চামড়ার নিচে সঙ্কুচিত হয়ে আছে ইস্পাতের মতো কঠিন মাংসপেশি। লম্বা ঘাসের ভেতর হাঁটছে ছায়া, বোঝা যাচ্ছে যে ইচ্ছে করে নিজের উপস্থিতি জানান না দিলে শিকারের বোঝার কোনো উপায় নেই। যেন নীরবতাই ওর সামনে এদিক থেকে ওদিকে ঘোরাফেরা করছে, ধীর পায়ে কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। প্রতি মুহূর্তে কাছিয়ে আসছে স্পাইডারের। 

নীরবতার মাঝেও সেটা শুনতে পেল স্পাইডার, ঘাড়ের পেছনের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। মুখ পরিষ্কার করল সে থুতুর সঙ্গে রক্ত বের করে দিয়ে, তারপর শুরু হলো অপেক্ষা। 

.

পাহাড়-শীর্ষের বিলাসী বাড়িটায় পায়চারী করছে গ্রাহাম কোটস। শোবার ঘর থেকে হেঁটে যাচ্ছে স্টাডিতে, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে রান্নাঘর হয়েই আবার ওপর তলার লাইব্রেরিতে; টহল শেষ হচ্ছে আবার শোবার ঘরে এসে নিজের ওপরেই রেগে আছে: রোজির আগমন কাকতালীয়, সেটা ভাবার মতো বোকামি করল কীভাবে? 

ঘণ্টি বাজানোর পর যখন ক্লোজড সার্কিট টিভির পর্দার দিকে তাকাল, তখন মোটকু চার্লির চেহারা দেখেই বুঝে গেছিল যা বোঝার। ভুল করার কোনো উপায়ই নেই। ষড়যন্ত্র হচ্ছে ওর বিরুদ্ধে। 

বাঘের মতো আচরণ করেছে গ্রাহাম কোর্টস, গাড়িতে বসে ভেবেছিল খুব সহজেই মোটকু চার্লিকে পিষে ফেলতে পারবে চাকার নিচে: সাইকেল চালকের থেঁতলানো লাশ দেখতে পেলে সবাই সেটাকে মিনিবাসের কাজ বলেই ধরে নেবে। কপাল মন্দ যে ছেলেটা রাস্তার এতটা ধারে গিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল। বেশি কাছে গেলে ওর নিজের গাড়িই খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এখন আফসোস হচ্ছে। সন্দেহ নেই, মোটকু চার্লিই ওই দুই নারীকে পাঠিয়েছে ভাঁড়ারে, ওর ওপর টিকটিকিগিরি চালাতে। এমনকী তার বাড়ির ভেতরেও ঢুকে পড়েছিল মেয়ে দুজন। নিজেকে বাঁচাবার জন্য সময়মতো যে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে, সেজন্য ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। প্রথম দেখাতেই বুঝে গেছিল: কোথাও কোনো কিন্তু আছে। 

মহিলাদের কথা ভাবতেই মনে পড়ল: তাদেরকে এখনও খেতে দেওয়া হয়নি। কিছু একটা তো দিয়ে আসা দরকার। আর একটা বালতিও, চব্বিশ ঘণ্টা পর তাদের বালতির দরকার হতে পারে। আর যা-ই হোক, কেউ ওকে জানোয়ার বলে গালি দিতে পারবে না। 

গত সপ্তাহে উইলিয়ামসটাউনে একটা হ্যান্ডগান কিনেছিল গ্রাহাম কোটস। 

সেন্ট অ্যান্ড্রুজে বন্দুক কেনা খুব একটা কঠিন কিছু না, দ্বীপটাই এমন। অবশ্য অধিকাংশই বন্দুক-টন্দুক কেনা নিয়ে মাথা ঘামায় না… দ্বীপটা অমনও। বিছানার পাশের স্ট্যান্ডের ড্রয়ার থেকে অস্ত্রটা বের করে চলে এলো রান্নাঘরে। সিঙ্কের নিচ থেকে একটা প্লাস্টিকের বালতি বের করে তাতে ভরে নিলো কিছু টমেটো, একটা ইয়াম, আধ-খাওয়া পনির আর এক কার্টন কমলার রস। তারপর, ভেবেছে বলে নিজেকে নিয়ে গর্বে বলীয়ান হয়ে টয়লেট রোল হাতে তুলে নিলো। 

ভাঁড়ারে চলে এলো গ্রাহাম কোটস, দরজার ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ ভেসে আসছে না। 

‘আমার কাছে অস্ত্র আছে,’ জানাল সে। ‘ব্যবহার করতে দ্বিধা করব না। দরজা খুলতে যাচ্ছি। দরজার দিকে পিঠ দিয়ে, ওপাশের দেওয়ালের সঙ্গে গা ঠেকিয়ে রাখো। হাতও এমন জায়গায় থাকবে যেন পরিষ্কার দেখতে পাই। খাবার এনেছি। কথা শুনলে বিনা ঝামেলায় মুক্তি পেয়ে যাবে; কারও কোনো ক্ষতি হবে না। অর্থাৎ,’ অন্য কোথাও ব্যবহার করতে পারবে না, এমন একগাদা নাটকীয় ডায়লগ ঝেড়ে নিজের ওপরেই খুশি হয়ে উঠেছে। ‘কোনো হাঙ্কি-পাঙ্কি চলবে না।’

ঘুরে কামরার বাতি জ্বালিয়ে দিল গ্রাহাম কোটস, তারপর ছিটকিনি ধরে টান দিল। কামরার দেওয়ালগুলো ইট আর পাথরের তৈরি, ছাদ থেকে ঝুলছে মরচে পড়া শিকল। 

মেয়েরা ওপাশের দেয়ালের সঙ্গে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের দিকে তাকিয়ে আছে রোজি। ওর মায়ের দৃষ্টিতে আতঙ্ক, ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে গ্রাহাম কোটসকে; আতঙ্কের পাশাপাশি তাতে মিশে আছে ঘৃণা, ভাবভঙ্গি ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো। 

বালতিটা নামিয়ে রাখল গ্রাহাম কোটস, তবে অস্ত্র নামাল না। ‘খাবার মন্দ না,’ জানাল সে। ‘আর না পাওয়ার চাইতে দেরি করে পাওয়া ভালো। বালতিও দিলাম একটা, বোঝা যাচ্ছে তোমরা একটা কোনা ব্যবহার করছিলে এতক্ষণ। আমি সঙ্গে টয়লেট পেপারও এনেছি। বোলো না যে তোমাদের জন্য কখনো কিছু করিনি।’ 

‘আমাদেরকে হত্যা করবে তুমি,’ জিজ্ঞেস করল রোজি। ‘তাই না?’ 

‘ওকে খেপিয়ে না, বোকা মেয়ে, থুতু ছিটিয়ে বলল ওর মা। তারপর হাসার চেষ্টায় মুখ বিকৃত করে বলল, ‘খাবারের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’ 

‘আরে নাহ, তোমাদেরকে খুন করার ইচ্ছে আমার নেই।’ বলল গ্রাহাম কোটস। কিন্তু কথাটা নিজের মুখে উচ্চারণ করে এবং সেটা নিজের কানে শোনা মাত্র বুঝতে পারল: এই দুজনকে মেরে ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই ওর সামনে। তাই নয় কি? ‘মোটকু চার্লি যে তোমাদেরকে পাঠিয়েছে, তা বলোনি কেন?’ 

জবাব দিল রোজি। ‘আমরা একটা ক্রুজ শিপে করে এসেছি। আজ দুপুরে আমাদের মাছ ভাজি খাওয়ার জন্য বারবাডোজে থাকার কথা। মোটকু চার্লি আছে ইংল্যান্ডে। আমরা কই আছি, সেটাও ও জানে বলে মনে হয় না। অন্তত আমি বলিনি।’ 

‘যা মন চায় বলো,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘অস্ত্র যে আমার হাতে।’ 

দরজা বন্ধ করে, ছিটকিনি টানল সে। দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো রোজির মায়ের কণ্ঠস্বর। ‘ওই পশুটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে না যে?’ 

‘কারণ তুমি সব কল্পনা করছ, মা। বারবার বলছি, এখানে কোনো পশু- টশু নেই। যাই হোক, লোকটা পাগল। বললে হয়তো তোমার সঙ্গে একমত হয়ে যেত। আমার তো মনে হয়, সে-ও অদৃশ্য বাঘ দেখতে পাচ্ছে সবখানে।’ 

কথাটা শুনে আঁতে ঘা লাগল গ্রাহাম কোটসের। তাই রাগ করে বন্ধ করে দিল বাতি। রেড ওয়াইনের একটা বোতল বের করে, উঠে এলো ওপরে; পেছনে বন্ধ করে ভাঁড়ারের দরজা। 

ভূগর্ভস্থ কামরার অন্ধকারে বসে, পনীরের টুকরোটাকে চার ভাগে ভাগ করল রোজি; তারপর একটা টুকরো মুখে পুড়ে ধীরে-ধীরে চাবাতে লাগল। 

‘মোটকু চার্লির ব্যাপারে কী বলল? কী মনে হয়?’ পনীরের টুকরো মুখে গলে যাবার পর জিজ্ঞেস করল তার মাকে। 

‘তুমি আর তোমার মোটকু চার্লি উচ্ছন্নে যাও। আমি এই ব্যাপারে কিছু শুনতে চাই না।’ জানাল মহিলা। ‘ওর জন্যই এখানে আটকে পড়ে থাকতে হচ্ছে।’ 

‘নাহ, আটকে থাকতে হচ্ছে কারণ এই কোটস মানুষটা আসলে পাগল। তাও আবার অস্ত্রধারী পাগল। দোষটা মোটকু চার্লির না।’ 

বারবার চেষ্টা করছে রোজি, যেন মন থেকে মোটকু চার্লিকে দূরে রাখতে পারে। কেননা ওর ব্যাপারে ভাবা মানেই, কোনো-না-কোনো ভাবে স্পাইডারের কথা মনে করা… 

‘ফিরে এসেছ,’ আচমকা বলে উঠল ওর মা। ‘পশুটা ফিরে এসেছে। শুনতে পাচ্ছি শব্দ, গন্ধও পাচ্ছি নাকে।’ 

‘ঠিক আছে, মা।’ বলল রোজি। ভাঁড়ারের কংক্রিট মেঝেতে বসে, স্পাইডারের কথা ভাবতে লাগল সে। যুবকের কথা মনে পড়ছে খুব করে। গ্রাহাম কোটস যখন এবং যদি—ওদেরকে চলে যেতে দেয়, তখন স্পাইডারকে খুঁজে বের করবে—সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটা। চেষ্টা করে দেখবে, নতুন করে শুরু করা যায় কি না। জানে, দিবাস্বপ্ন দেখছে…তবে স্বপ্নটা দারুণ। স্বস্তি দিচ্ছে ওকে। 

একবার ভাবল, গ্রাহাম কোটস কী আগামীকাল মেরে ফেলবে ওদের? 

.

মোমের আগুনের সমান দূরত্বে থেকে, স্পাইডারকে পশুর খাবার হবার জন্য ফেলে দেওয়া হয়েছে। 

সন্ধে হতে শুরু করেছে, সূর্য ডুবতে বসেছে অনেকটাই। 

নাক আর ঠোঁট দিয়ে কিছু একটা ঠেলছে স্পাইডার: ওর থুতু আর রক্ত মিশে যাবার আগে মাটি শুষ্কই ছিল। এখন পরিণত হয়েছে কাদার একটা বলে, অনেকটা লালচে রঙের সেই কাদা। চেপে চুপে মোটামুটি গোলকে পরিণত করা হয়েছে ওটাকে। কাজ শেষে ওটার নিচে নাক সেঁধিয়ে মাথা ঝট করে উঁচু করছে যাতে গোলকটা খানিক দূরে গিয়ে পড়ে। হলো না কিছুই, যেমন হয়নি আগের বহু বারেও। কত বার হলো চেষ্টাটা? বিশ? একশো? হিসেব রাখছে না, শুধু কাজ করে যাচ্ছে। চেহারাটা কাদার ভেতর আরও গুঁজে দিল স্পাইডার, নাকটা সেঁধিয়ে দিল আরও ভেতরে… 

হলো না কিছুই, কখনো কিছু হবে বলে মনে হয় না। 

অন্য পথ ধরতে হবে। 

গোলকটাকে ঠোঁট দিয়ে আটকে নিলো স্পাইডার, নাক দিয়ে যতটা সম্ভব গভীরভাবে নিশ্বাস নিচ্ছে। তারপর মুখ দিয়ে এক ঝটকায় বের করে দিল ফুসফুসের সব বাতাস। শ্যাম্পেনের ছিপির মতো মুখ থেকে ছিটকে গেল গোলকটা, পড়ল প্রায় আঠারো ইঞ্চি সামনে। 

এবার ডান হাত ভাঁজ করল সে, কবজির কাছে শক্ত করে দড়ি বাঁধা। অন্য মাথা টানটান হয়ে গেঁথে আছে গজালের সঙ্গে। শরীরটাকে বাঁকিয়ে চেষ্টা করল গোলকটা ধরার। কিন্তু খুব কাছে গিয়েও পারল না। 

নাগালে মধ্যে থেকেও… কত দূরে! 

আরেকবার বুক ভরে শ্বাস নিতে গিয়ে নাকে-মুখে ধুলো ঢোকাল স্পাইডার, কেশে উঠল খক খক করে। চেষ্টা করল আবার, মাথা এক পাশে সরিয়ে ফুসফুস ভরাতে চাইল। তারপর আবার মাথা ঘুরিয়ে সর্বশক্তিতে ফুঁ দিতে লাগল গোলকটাকে লক্ষ্য করে। 

গড়ান খেল কাদার গোলকটা–এক ইঞ্চির চাইতেও কম হবে, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হলো। শরীরটা টান টান করতেই হাতের ভেতর চলে এলো ওটা। এবার তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে পিষতে লাগল ওটাকে। তারপর ওটাকে উলটে আবারও…এভাবে আটবার করল কাজটা। 

আরও একবার পিষল সে গোলকটাকে, এবার আরও একটু জোরের সঙ্গে। চিমটি কাটার মতো করে চাপ দিচ্ছে বলে গোলকের একটা ছোট্ট অংশ খসে পড়ে গেল মাটিতে, তবে যা অবশিষ্ট আছে তা দেখে মনে হলো— বাচ্চাদের বানানো সূর্যের মতো একটা গোলক, যা থেকে বেরিয়ে আছে সাতটা সুচালো অংশ। 

স্পাইডার গর্বের সঙ্গে দেখল ওর হাতের কাজ: এই পরিস্থিতিতে ওটাকে নিয়ে গর্ব করাই যায়। 

কিন্তু কথা বলাটাই হবে কঠিন। রক্ত আর থুতুমাখা কাদা ব্যবহার করে মাকড়শা বানানো সহজ। দেবতারা, এমনকী স্পাইডারের মতো ছোটোখাটো দুষ্টু দেবতাও তা করতে জানে। কিন্তু সৃষ্টির শেষ অংশটাই সবচাইতে কঠিন। নির্জীব কোনো বস্তুতে প্রাণ সঞ্চার করতে হলে শব্দের দরকার হয়, দরকার পড়ে ওটাকে নাম দেওয়ার। 

মুখ খুলল সে। ‘হুররররর, ‘ জিভহীন মুখ দিয়ে কেবল এতটুকু উচ্চারণ করতে পারল। 

কিন্তু কাজ হলো না। 

আরেকটা চেষ্টা করল স্পাইডার। ‘হুরররর!’ কাদার দলাটা ওভাবেই পড়ে রইল ওর হাতে। 

মাটিতে আছড়ে পড়ল বেচারার মুখ। ক্লান্ত বোধ করছে খুব। নড়াচড়া করতেই চেহারা আর বুকের শুকনো ক্ষতে আঁচড় লাগছে। রক্ত ঝরতে শুরু করছে জায়গাগুলো থেকে, সেই সঙ্গে জ্বলে। তবে বেশি কষ্ট হচ্ছে ওগুলো চুলকাতে শুরু করেছে বলে। ভাবো! বলল সে নিজেকে। কাজটা করার উপায় অবশ্যই আছে…জিভ ছাড়াই কথা বলতে হবে ওকে… 

ঠোঁটের ওপরে কাদার একটা স্তর জমে গেছে, সেটাই চুষতে লাগল ও। জিভ নেই বলে কাজটা সহজ হলো না। 

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে দিল। চেষ্টা করল যতটা সম্ভব দক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করার। এমন নিশ্চয়তার সঙ্গে উচ্চারণ করল শব্দটা যে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডও আপত্তি করলে তা ধোপে টিকবে না। ওর হাতে যে জিনিসটা আছে, সেটার নাম দিল সে; উচ্চারণ করল নিজের নাম, জাদুর সর্বোচ্চটা ব্যবহার করে: ‘হহসস্পাররিইইভাআআর।’ 

পরক্ষণেই দেখা গেল, হাতে একটু আগেও যেখানে ছিল রক্তমাখা কাদার দলা, সেখানে বসে আছে একটা মোটাসোটা মাকড়শা; রং ওটার লাল, পা সাতখানা। 

সাহায্য করো আমাকে, ভাবল স্পাইডার। কাউকে খুঁজে আনো। 

ওর দিকে চেয়ে রইল মাকড়শাটা, সূর্যের আলোতে চোখ জ্বলজ্বল করছে। পরক্ষণেই ওর হাত থেকে নেমে পড়ল সেটা মাটিতে। দুলতে দুলতে, টলতে টলতেও বলা চলে, চলতে লাগল ঘাসের ভেতর দিয়ে। 

দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়া পর্যন্ত লাল মাকড়শাটার দিকে চেয়ে রইল স্পাইডার। তারপর মাথা মাটির ওপর রেখে, চোখ মুদল। 

আচমকা বদলে গেল বায়ুপ্রবাহের দিক, বাতাসে ভাসতে লাগল পুরুষ বিড়ালের মূত্রত্যাগের অ্যামোনিয়া-মাখা ঝাঁঝাল গন্ধ। পশুটা নিজের এলাকা চিনিয়ে দিচ্ছে… 

আর আনন্দে চিৎকার করছে স্পাইডারের মাথার অনেক ওপরে ভাসতে থাকা পাখির ঝাঁক। 

.

গড়গড় করে চাহিদার কথা জানিয়ে দিল মোটকু চার্লির পাকস্থলী। পয়সা-কড়ি সঙ্গে থাকলে কোথাও যেত খাবার খেতে, আর কিছু না হলেও নিদেনপক্ষে এই হোটেল থেকে দূরে সরার জন্যই। তবে স্বীকার করতেই হচ্ছে, কপর্দকহীন হয়ে গেছে সে। এদিকে হোটেলের ভাড়ার মাঝেই খাবারের খরচ ধরা আছে। তাই সাতটা বাজতে না বাজতেই পা রাখল রেস্তোরাঁয়। 

প্রধান ওয়েট্রেস আকর্ণ-বিস্তৃত উজ্জ্বল হাসি হেসে স্বাগত জানাল ওকে। মেয়েটা ওকে জানাল, খানিকক্ষণের মাঝে রেস্তোরাঁর কার্যক্রম শুরু হবে। ব্যান্ডের প্রস্তুতি বাকি আছে একটু, সেটা শেষ হলেই। তারপর যেন মেয়েটার পূর্ণ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মোটকু চার্লির ওপর। তার চাহনিতে থাকা প্রশ্নটা ততক্ষণে পরিচিত হয়ে উঠেছে মোটকু চার্লির কাছে।’ 

‘আপনিই কি…?’ মেয়েটা শুরু করল প্রশ্ন। 

‘হ্যাঁ, আমিই সে,’ হাল ছেড়ে দিয়েছে বেচারা। ‘সঙ্গেই আছে।’ বলে পকেট থেকে লেবু বের করে দেখাল মেয়েটাকে। 

‘দারুণ তো,’ বলল মেয়েটা। ‘হাতে তো লেবুই দেখা যাচ্ছে। যাই হোক, আপনি কি মেন্যু থেকে কিছু পছন্দ করবেন? নাকি ব্যুফে বেছে নেবেন?’ 

‘ব্যুফে,’ জানাল মোটকু চার্লি। মাগনা ওটাই খাওয়া যাবে। হাতে লেবু ধরে রেস্তোরাঁর ঠিক বাইরের হলের লাইনে দাঁড়াল সে। 

‘দাঁড়ান একটু,’ বলল প্রধান ওয়েট্রেস। 

এক ছোটোখাটো মেয়ে এসে দাঁড়াল মোটকু চার্লির পেছনে। ওয়েট্রেস মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, হেসে বলল, ‘খোলেনি এখনও? পেটে ছুঁচোর নাচন চলছে।’ 

শেষ বারের মতো ব্লুম-থাং-থাডাম শব্দ করে প্রস্তুত হয়ে গেল বেজ গিটার, সেই সঙ্গে ইলেকট্রনিক পিয়ানোও প্রস্তুত…প্লাঙ্ক একটা শব্দ হলো শুধু। বাদ্যযন্ত্র নামিয়ে রেখে প্রধান ওয়েট্রেসকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল তারা। ‘খুলেছি,’ জানাল মেয়েটা। ‘ভেতরে আসুন।’ 

ছোটোখাটো মেয়েটা চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে তাকাল মোটকু চার্লির দিকে। ‘হ্যালো, মোটকু চার্লি,’ জানাল সে। ‘লেবু কীসের?’ 

‘সে এক লম্বা গল্প।’ 

‘সমস্যা কী?’ বলল ডেইজি। ‘খেতে খেতে সবটা আরামসে শোনা যাবে।’ 

.

রোজি ভাবনায় পড়ে গেছে: আচ্ছা, উন্মাদনা কি ছোঁয়াচে হতে পারে? পাহাড়- শীর্ষের বাড়িটার ভূগর্ভস্থ ভাঁড়ারের অন্ধকারে থাকা অবস্থায় টের পেল, কিছু একটা ছুটে গেল ওর পাশ দিয়ে। খুবই নরম আর নমনীয় কিছু একটা। বিশালও হবে আকৃতিতে। এমন কিছু যেটা ওদেরকে ঘিরে পাক খেতে খেতে নম্র কণ্ঠে গর্জে উঠল। 

‘শুনতে পেলে?’ জিজ্ঞেস করল সে। 

‘অবশ্যই পেয়েছি, বোকা মেয়ে কোথাকার।’ জবাব দিল মেয়েটার মা। তারপর যোগ করল, ‘কমলার রস অবশিষ্ট আছে?’ 

অন্ধকারেই জুসের কার্টনের খোঁজে হাতাতে লাগল রোজি। পানীয় পানের আওয়াজ শুনতে পেল সে খানিক পরেই। ওর মা বলল, ‘আমাদেরকে এই পশুটা হত্যা করবে না, করবে ওই লোকটা।’ 

‘গ্রাহাম কোটস? হ্যাঁ।’

‘লোকটা বাজে প্রকৃতির। কিছু একটা যেন ভর করেছে ওর ওপর, ঘোড়ার মতো করে চালাচ্ছে ব্যাটাকে। তবে লোক যেমন বাজে, বাহন হিসেবেও বাজেই হবে।’ 

মায়ের কঙ্কাল হাত নিজের হাতে নিলো রোজি। মহিলা কিচ্ছু বলল না। আসলে বলার মতো কিছু তো নেই-ও। 

‘সত্যি বলতে কী,’ খানিকক্ষণ পর বলল ওর মা। ‘তোমাকে নিয়ে আমি গর্বিত। মেয়ে হিসেবে তুমি খুবই ভালো।’ 

‘ওহ,’ বলল রোজি। মাকে হতাশ করেনি, এই ভাবনাটা ওর ভেতর নতুন একটা অনুভূতির জন্ম দিল; আসলে সত্যি বলতে কী, কেমন অনুভব করছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। 

‘হয়তো তোমার মোটকু চার্লিকেই বিয়ে করা উচিত ছিল,’ বলল ওর মা। ‘তাহলে আমরা এখানে থাকতাম না।’ 

‘না,’ রোজি আপত্তি জানাল। ‘ওকে বিয়ে করা উচিত ছিল না। মোটকু চার্লিকে আমি ভালোবাসি না, তাই এই একটা ব্যাপারে তোমার কোনো ভুল হয়নি।’ 

ওপর তলায় দড়াম করে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনতে পেল ওরা। ‘বাইরে গেল,’ বলল রোজি। ‘তাড়াতাড়ি করো, এই সুযোগ। আমাদের সুড়ঙ্গ খুঁড়তে হবে।’ 

প্রথমে খিল খিল করে হাসতে শুরু করল মেয়েটা… 

…তারপর শুরু হলো কান্না। 

.

ডেইজি এই মুহূর্তে এখানে কী করছে, তা বুঝতে চাচ্ছে মোটকু চার্লি। ডেইজিও একই ভাবে বোঝার চেষ্টা করছে, মোটকু চার্লি ওই দ্বীপে কী করছে? দুজনের কেউই সফল হচ্ছে না কাজে। লম্বা, লাল আর চকচকে পোশাক পরে ভেতরে ঢুকল এক গায়িকা। এরকম একটা হোটেলের ‘ফ্রাইডে নাইট ফান’-এর তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ সে। কামরার অন্য পাশে অবস্থিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে গাইতে শুরু করল সে, ‘আই হ্যাভ গট ইউ আন্ডার মাই স্কিন’। 

ডেইজি বলল, ‘শৈশবে যে মহিলা তোমার প্রতিবেশী ছিল, তাকে খুঁজছ। কেননা তোমার ধারণা—সে তোমার ভাইকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে পারবে!’ 

‘আমাকে একটা পালক দেওয়া হয়েছিল। যদি মিসেস হিগলারের কাছে এখনও সেটা থেকে থাকে, তাহলে তার বিনিময়ে নিজের ভাইকে মুক্ত করতে পারব। চেষ্টা করে তো দেখা যায়।’ 

চোখ পিটপিট করল ডেইজি, কথাটা শুনে একদমই প্রভাবিত হয়নি। সালাদ খাচ্ছে না, খুঁটছে শুধু। 

এবার মোটকু চার্লি বলল, ‘আর তুমি এখানে এসেছ কারণ তোমার ধারণা—মেইভ লিভিংস্টোনকে হত্যা করার পর, গ্রাহাম কোটস এই দ্বীপে লুকিয়েছে। কিন্তু পুলিস হিসেবে আসোনি, এসেছ স্বেচ্ছায় ও এই ভরসায় যে তাকে খুঁজে পাবে। অথচ পেলেও কিচ্ছু করতে পারবে না।’ 

ঠোঁটের কোনায় লেগে থাকা টমেটোর বিচি জিভ দিয়ে চেটে নিলো ডেইজি, খানিকটা অস্বচ্ছন্দ দেখাচ্ছে ওকে। ‘আমি পুলিস অফিসার হিসেবে আসিনি,’ বলল সে। ‘এসেছি পর্যটক হিসেবে।’ 

‘কিন্তু তাই বলে কাজে ফাঁকি দিয়ে লোকটার পেছন-পেছনে চলে এলে? এই অপরাধে তোমাকে হয়তো জেলেই পাঠিয়ে দেবে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া অন্য কোনো সাজাও হতে পারে।’ 

‘তাহলে তো,’ শুষ্ক কণ্ঠে বলল মেয়েটা। ‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বন্দি-বিনিময় চুক্তিতে সই করেনি বলে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তাই না?’ 

নিচু কণ্ঠে বলল মোটকু চার্লি। ‘হায় ঈশ্বর!’ 

মোটকু চার্লির এই ‘হায় ঈশ্বর’ বলার কারণ-গায়িকা মঞ্চ থেকে নেমে, রেডিয়ো মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে ঘোরাঘুরি করছে। দুই জার্মান পর্যটককে সে জিজ্ঞেস করছে, তারা এসেছে কোত্থেকে? 

‘কিন্তু এখানে লোকটা আসবে কেন?’ মোটকু চার্লি প্রশ্ন ছুড়ে দিল। 

‘গোপন ব্যাংকিং, কম দামি জমি-জমা; বন্দি-বিনিময় চুক্তিও নেই। তাছাড়া হয়তো টক-টক ফলমূল পছন্দ তার।’

‘দুটো বছর ওই লোকটার ভয়ে কেঁপেছি।’ মোটকু চার্লি জানাল। ‘এই মাছ-আর-সবুজ-কলার খাবারটা আরও কিছু নেব। তুমি?’ 

‘আমার লাগবে না,’ ডেইজি জানাল। ‘ডেজার্টের জন্য পেটে খানিকটা জায়গা ফাঁকা রাখতে চাই।’ 

ব্যুফের কাছে হেঁটে গেল মোটকু চার্লি, গায়িকার চোখে যেন পড়তে না হয় সেজন্য ঘুরে গেল অনেকটাই। মেয়েটা খুবই সুন্দর, লালচে পোশাকটা নড়া- চড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলো প্রতিফলিত করছে। তার মিষ্টি কণ্ঠের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যান্ডটা বাজাতে পারছে না। তবে মোটকু চার্লির মনে হলো: মেয়েটা ছোট্ট মঞ্চে ফিরে গিয়ে গান গাইলেই ভালো হতো। মেয়েটার ‘নাইট অ্যান্ড ডে’ আর অন্তর থেকে গাওয়া ‘স্পুনফুল অভ সুগার’ এখনও কানে লেগে আছে…রেস্তোরাঁর খদ্দেরদের সঙ্গে কথা-বার্তার দরকার কী? অন্তত মোটকু চার্লি কামরার যে পাশে আছে, সে পাশে না আসলেই হয়। 

প্রথম বার যেটা খেয়ে ভালো লেগেছিল, সেটাই আবার প্লেট ভরে নিলো সে। সাইকেল চালিয়ে দ্বীপ-জুড়ে ঘুরে বেড়ালে, খিদে ভালোই পায়। 

টেবিলের কাছে ফিরে এসে দেখে, চোয়ালের নিচের দিকে দাড়ির মতো কিছু একটাসহ গ্রাহাম কোটস বসে আছে ডেইজির পাশে। প্রচণ্ড উত্তেজিত নেউলের মতো হাসছে ব্যাটা। ‘মোটকু চার্লি,’ বলল গ্রাহাম কোটস, অপ্রস্তুত হাসি যোগ করল সঙ্গে। ‘দারুণ না ব্যাপারটা? তোমার খোঁজে, একটু গল্প করার জন্য এসেছিলাম এখানে। কী পেলাম? এই অসাধারণ সুন্দরী পুলিস অফিসারকে! দয়া করে বোসো, নাটক করতে যেয়ো না কিন্তু।’ 

মোমের মূর্তির মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মোটকু চার্লি। 

‘বসো,’ আবার বলল গ্রাহাম কোটস। ‘মিস ডে-এর পেটে অস্ত্র ঠেকিয়ে রেখেছি।’ 

অনুনয়ের দৃষ্টিতে ডেইজির দিকে তাকাল মোটকু চার্লি, সেই সঙ্গে মাথা নাড়ল। টেবিলক্লথের ওপর রেখেছে হাতজোড়া, ছড়িয়ে। 

বসল মোটকু চার্লি। 

‘হাত এমন জায়গায় রাখো, যাতে দেখতে পাই। ছড়িয়ে রাখো টেবিলে, মিস ডেয়ের মতো।’ 

আদেশ পালন করল মোটকু চার্লি। 

নাক টানল গ্রাহাম কোটস। ‘প্রথম থেকেই জানতাম যে তুমি সাদা পোশাকের পুলিস, ন্যান্সি।’ বলল সে। ‘স্পাই, তাই না? আমার অফিসে এসে, ধোঁকা দিয়ে চুরি করেছ আমারই কাছ থেকে।’

‘আমি কখনও—’ বলতে চাইল মোটকু চার্লি, তবে গ্রাহাম কোটসের চোখে চোখ পড়তেই থেমে গেল। 

‘ভেবেছিলে, দারুণ চালাকি করেছ।’ গ্রাহাম কোটস যোগ করল। ‘তোমরা সবাই আমাকে বোকা বানাতে পেরেছিলে ভেবে গোঁফে তা দিচ্ছিলে। সেজন্যই ওই দুজনকে পাঠিয়েছ, তাই না? আমার বাড়িতে? ক্রুজ শিপে করে ঘুরতে ঘুরতে আচমকা এসে উপস্থিত হয়েছে—এই গপ্পো আমি বিশ্বাস করব, তা ভাবলে কী করে? আমাকে বোকা বানাতে হলে এত অল্পে কাজ হবে না, বুঝলে? আর কে কে এসবের সঙ্গে জড়িত? কাকে বলেছ? কে জানে?’ 

‘গ্রাহাম, তুমি যে কী বলছ, কিছুই বুঝতে পারছি না,’ জানাল ডেইজি।

গায়িকা এখন ‘সাম অভ দিজ ডেজ’ গাইছে; মেয়েটার কণ্ঠ দারুণ, লোকসঙ্গীতের জন্য নিখুঁত। ওদের সবাইকে যেন মখমলের স্কার্ফের মতো ঘিরে ধরল। 

হয়তো কোনো একদিন, 
মনে পড়বে আমার কথা,
হয়তো কোনো একদিন,
একাকীত্বের ছোবল দেবে ব্যথা।
আমার আলিঙ্গনের কথা পড়বে মনে। 
আমার চুমুর স্পর্শ পেতে চাইবে তনে… 

‘বিল-টিল চুকাবে,’ নির্দেশ দিল গ্রাহাম কোটস। ‘তারপর আমার আর এই যুবতীর সঙ্গে গিয়ে বসবে গাড়িতে। আমার বাড়িতে ফিরে গিয়ে সত্যিকারের আলোচনায় বসব। একটু এদিক-সেদিক হলেই, গুলি করে ফুটো করে দেব দুজনকেই। বোঝা গেল কথা?’ 

মোটকু চার্লি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল যে কানে গেছে। কালো মার্সিডিজটা কে চালাচ্ছিল, সেটাও ধরতে পারছে এখন। সেদিন মরণের কতটা কাছাকাছি পৌঁছে গেছিল, সেটা উপলব্ধি করতেও বেগ পেতে হচ্ছে না। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছে—গ্রাহাম কোটস কতটা পাগল, এবং জান নিয়ে এই পরিস্থিতি থেকে ডেইজির আর ওর নিজের ফিরতে পারার সম্ভাবনা কতটা ক্ষীণ। 

গায়িকা গান শেষ করল। রেস্তোরাঁয় ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খদ্দেররা হাততালি দিয়ে স্বাগত জানাল। মোটকু চার্লি টেবিলের ওপর হাত ছড়িয়ে রেখেছে তখনও। গ্রাহাম কোটসের কাঁধের ওপর দিয়ে গায়িকার দিকে তাকিয়ে রইল সে, প্রাক্তন বসের নজরের বাইরে থাকা চোখটা টিপে দিল তাকে লক্ষ্য করে। উপস্থিত সবাই সচেতন ভাবেই গায়িকার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে চাইছিল, তাই মোটকু চার্লির চোখ টিপুনিকে সানন্দে স্বাগত জানাল সে। 

‘গ্রাহাম, আমার এখানে আসার কারণ তুমিই,’ জানাল ডেইজি। কিন্তু চার্লি তো কেবলই—’ বলতে বলতেই থেমে গেল বেচারি। ওর চেহারার সেই দশা হলো, যা শুধু পেটে পিস্তলের নলের খোঁচা খেলেই হয়! 

মুখ খুলল গ্রাহাম কোটস। ‘আমার কথা শোনো। এখানে যেসব নিরীহ খদ্দেররা আছে, তাদের কাছে আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বন্দুকটা পকেটে ভরছি, কিন্তু সেটা তোমার দিকেই তাক করা আছে। আমরা উঠে দাঁড়াব, যাবো আমাদের গাড়ির কাছে। তারপর আমি—’ 

থমকে গেল লোকটা। লাল পোশাক পরিহিত মেয়েটা হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে এগিয়ে আসছে তাদের টেবিলের দিকেই, মুখে আ-কর্ণ-বিস্তৃত হাসি। মোটকু চার্লি লক্ষ্য মেয়েটার, মাইক্রোফোনে বলল, ‘নাম কী তোমার, সোনা?’ মোটকু চার্লির মুখের কাছে ধরল সে মাইক্রোফোনটা। 

‘চার্লি ন্যান্সি,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। কেঁপে উঠল ওর কণ্ঠ। 

‘কোত্থেকে এসেছ, চার্লি?’ 

‘ইংল্যান্ড। আমি আমার বন্ধুরা, সবাই ইংল্যান্ডের।’ 

‘পেশা কী তোমার, চার্লি?’ 

থমকে গেল যেন সময়…সেই সঙ্গে অন্য সব কিছু। ব্যাপারটার সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায় পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফিয়ে সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ার সঙ্গে। কিন্তু আর কোনো পথ যে খোলা নেই ওর সামনে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘এখন কিছুই করছি না।’ পরক্ষণেই যোগ করল। ‘তবে আসলে আমি গায়ক। তোমার মতোই গান গাই।’ 

‘আমার মতো? কোন ধরনের গান গাও?’ 

ঢোক গিলল মোটকু চার্লি। ‘তুমি কোনটা শুনতে চাও?’ 

মোটকু চার্লির টেবিলে বসা অন্যান্যদের দিকে তাকাল মেয়েটা। ‘তোমাদের কি মনে হয়, ও আমাদেরকে গেয়ে শোনাবে একটা গান?’ মাইক্রোফোনের দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল সে। 

‘মানে, মনে হয় না। নাহ, পুবশ্যই না।’ বলল গ্রাহাম কোটস। এদিকে ডেইজি শুধু শ্রাগ করল, হাত দুটো ওভাবেই রেখেছে টেবিলের ওপর। 

লাল পোশাক পরা মেয়েটা এবার কামরার অন্যান্যদের দিকে তাকাল। ‘তোমাদের কী মনে হয়?’ এবার তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিল সে। 

অন্যান্য টেবিলের খদ্দেররা মৃদু হাততালি দিয়ে ধারণাটাকে স্বাগত জানাল। কিন্তু রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা চেঁচিয়ে উঠল উৎসাহের সঙ্গে। বারম্যান তো চেঁচিয়ে বলেই বসল, ‘গেয়ে শোনাও!’

মোটকু চার্লির দিকে ঘুরে, মাইক হাত দিয়ে চেপে বলল গায়িকা, ‘এমন কোনো গানের কথা বলো যেটা ব্যান্ড বাজাতে পারবে। 

মোটকু চার্লি জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা ‘আন্ডার দ্য ব্রডওয়াক’ বাজাতে পারবে?’ মাথা নেড়ে সায় জানল মেয়েটা। তারপর সেই গানেরই ঘোষণা দিয়ে মাইক ধরিয়ে দিল ওকে। 

বাজাতে শুরু করল ব্যান্ডটা। মোটকু চার্লিকে পথ দেখিয়ে ছোট্ট মঞ্চের দিকে নিয়ে গেল গায়িকা। বুকের ভেতর হৃদয়টা লাফাচ্ছে পাগলা ঘোড়ার মতো। 

গাইতে শুরু করল মোটকু চার্লি… 

…শুনতে লাগল শ্রোতারা। 

ও চেয়েছিল, নিজেদের জন্য কিছু বাড়তি সময় যোগাড় করবে গান গেয়ে। কিন্তু গাইতে শুরু করার পর কেমন যেন স্বচ্ছন্দ বোধ করতে শুরু করেছে। কেউ কিছু ছুঁড়ছে না ওকে লক্ষ্য করে, সেই সঙ্গে গান গাইবার পাশাপাশি ভাববার মতো ক্ষমতাও অবশিষ্ট আছে ওর মস্তিষ্কের। কামরায় যারা আছে, তাদের উপস্থিতিও টের পাচ্ছে পরিষ্কারভাবে: পর্যটক আর কর্মচারীর দল, বারে আসা খদ্দের। সব কিছু দেখতে পাচ্ছে: মেপে মেপে ককটেল বানাচ্ছে বারম্যান, এক বৃদ্ধা বসে আছে কামরার পেছন দিকে… প্লাস্টিকের মগ ভরতি করছে কফি দিয়ে। ভয় তখনও অবশিষ্ট আছে মোটকু চার্লির মনে, রাগও আছে; কিন্তু সেই রাগ আর আতঙ্ক ঢেলে দিল সে গানে, দেখা গেল ওটা পরিণত হয়েছে স্বস্তিমাখা ভালোবাসার গানে। গাইতে গাইতেই ভাবল সে 

এই পরিস্থিতিতে স্পাইডার কী করত? কী করত আমার বাবা? 

মন খুলে গাইছে মোটকু চার্লি। গান গেয়ে শোনাচ্ছে, ব্রডওয়াকের নিচে ও কী করতে চায়; অবশ্য সেসব কাজের অধিকাংশই ভালোবাসা-বাসির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। 

লাল পোশাকের গায়িকা হাসছে, সেই সঙ্গে তুড়ি বাজাচ্ছে সুরের তালে তালে; দেহটাকেও নাড়াচ্ছে নাচের ভঙ্গিতে। কি-বোর্ড বাদকের মাইক্রোফোনের ওপর ঝুঁকে তাল মেলাল গানে। 

একদল শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে গাইছি! ভাবল মোটকু চার্লি। এ আমার কী হলো! গ্রাহাম কোটসের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখেছে অবশ্য। 

যখন কোরাসের জায়গায় এলো, তখন মাথার ওপর হাত তুলে করতালি দিতে লাগল সে। অচিরেই দেখা গেল — কামরার সবাই যোগ দিয়েছে ওর সঙ্গে…খদ্দের, সঙ্গে… খদ্দের, ওয়েটার আর রাঁধুনি—সবাই! একমাত্র গ্রাহাম কোটস টেবিলক্লথের নিচে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে বলে যোগ দেয়নি। আর অবশ্যই ডেইজিও, যার হাত পড়ে আছে টেবিলের ওপর। এমন ভাবে ওর দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা, যেন বদ্ধ কোনো উন্মাদকে দেখছে…যে কি না একেবারে অদ্ভুত মুহূর্তে খুঁজে পেয়েছে নিজের ভেতরে থাকা ভ্রাম্যমাণ গায়ককে। 

হাততালি দিয়েই যাচ্ছে শ্রোতারা। হেসে গান চালিয়ে গেল মোটকু চার্লি, গাইতে গাইতেই টের পেল— শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে যে সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনো ক্ষতিই হবে না ওদের। ওদের মানে ওর নিজের আর স্পাইডারের আর ডেইজির এবং রোজির…তা মেয়েটা যেখানেই থাকুক না কেন। কী করতে হবে, সেটা বুঝতে পারছে: যদিও কাজটা বোকামিতে ভরা এবং হবে অর্বাচীনের মতোই। তবে উদ্দেশ্য হাসিল হবে তাতে। গানের শেষ কলিগুলোর রেশ মিলিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আমি যে টেবিলে বসে ছিলাম, সেখানে আমার সঙ্গে ছিল এক যুবতী। তার নাম ডেইজি ডে, সে-ও ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। ডেইজি, সবার উদ্দেশ্যে হাত নাড়বে একটু?’ 

চোখ-মুখ পাকিয়ে ওকে একবার দেখল ডেইজি, তারপর টেবিলের ওপর থেকে হাত তুলে নাড়ল একবার। 

‘ডেইজিকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। কিন্তু কী সেই প্রশ্ন, সেই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই মেয়েটার।’ যদি কাজ না হয়, অস্ফুট স্বরে কেউ একজন বলল ওর মাথায়, তাহলে বেচারি মরবে—সেটা জানো তো? ‘আশা করি আমার প্রশ্নের জবাবে ‘হ্যাঁ’-ই বলবে সে। ডেইজি, বিয়ে করবে আমাকে?’ 

কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এলো কামরায়। ডেইজির দিকে চেয়ে রইল মোটকু চার্লি, মনে মনে প্রার্থনা করছে—যেন ব্যাপারটা সে ধরতে পারে, সেই অনুপাতে আচরণও করে। 

মাথা নাড়ল ডেইজি, করবে বিয়ে। 

করতালিতে ফেটে পড়ল রেস্তোরাঁর সবাই। কামরার ভেতরের সবাই ছুটে এলো টেবিলের দিকে। গায়িকা, প্রধান ওয়েট্রেসসহ অন্য মেয়েরা যেন আছড়ে পড়ল ওই টেবিলে। ডেইজিকে একরকম টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল কামরার মাঝখানে। মোটকু চার্লির পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো ডেইজিকে। ব্যান্ডটা ততক্ষণে ‘আই জাস্ট কলড টু সে আই লাভ ইউ,’ বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটাকে আলিঙ্গন করল মোটকু চার্লি। 

‘আংটি কই?’ জিজ্ঞেস করল গায়িকা। 

পকেটে হাত দিল মোটকু চার্লি। ‘এই নাও,’ ডেইজিকে বলল সে। ‘তোমার জন্য উপহার।’ তারপর আবার মেয়েটাকে আলিঙ্গন করে চুমু খেল একটা। গুলি যদি গ্রাহাম কোটস করেই, তাহলে বোধহয় এখনই করবে-ভাবল সে। 

চুম্বন শেষ হলে, একের-পর-এক মানুষ এগিয়ে এসে করমর্দন করল ওর সঙ্গে; জড়িয়ে ধরল তাকে। এক লোক, যে এখানে এসেইছে গানের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, ওকে ধরিয়ে দিল তার কার্ড। এদিকে ডেইজি দাঁড়িয়ে আছে হাতে লেবু নিয়ে, মেয়েটার চেহারায় অদ্ভুত একটা অনুভূতির ছাপ। যে টেবিলে বসে ছিল এতক্ষণ, সেটার দিকে তাকাতেই মোটকু চার্লি আবিষ্কার করল: গ্রাহাম কোটস ওখানে আর নেই! 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *