অধ্যায় দুই – যেটা মূলত শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো নিয়ে

অধ্যায় দুই – যেটা মূলত শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো নিয়ে 

ফ্লোরিডার সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় চোখ পিটপিট করতে করতে, মোটকু চার্লি পৌঁছল দ্য মেমোরিয়াল গার্ডেন অভ রেস্ট-এ। স্যুটে ছড়িয়ে পড়ছে ঘামের দাগ, শুরু হয়েছে বগল আর বুকে। এমনকী চেহারাটাও ঘামে জবজব করছে। 

দ্য মেমোরিয়াল গার্ডেন অভ রেস্ট দেখতে-শুনতে বাগানের মতোই। তবে বড়োই অদ্ভুত সেই বাগান; কেননা ওটার ফুলগুলো নকল… মাটির ওপর থাকা ধাতব খণ্ডের ওপর রাখা ধাতব ফুলদানীতে জন্মেছে। একটা সাইনবোর্ডের পাশ দিয়ে সামনে এগোল মোটকু চার্লি যাতে লেখা: সম্মানের সঙ্গে অবসর নেওয়া সৈনিকদের বিনামূল্যে কবরস্থ হবার স্থান। বেবিল্যান্ড অতিক্রম করল সে, ওখানে নকল ফুলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নানা রঙা বায়ু-কল আর নীল- গোলাপি টেডি বিয়ার। নীলচে আকাশের দিকে ঘোরলাগা ভঙ্গিতে চেয়ে আছে একটা খেলনা উইনি দ্য পু। 

শেষকৃত্যানুষ্ঠানের জন্য সমবেত হওয়া জনতার ভিড় এখন দেখতে পাচ্ছে মোটকু চার্লি। একটা পথ খুঁজে নিলো সে, সেই ভিড়ের কাছে যাওয়া যায় যাতে। জনা তিরিশেক লোক, বেশিও হতে পারে, কবরটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাদের পরনে কালো পোশাক, বড়ো বড়ো কালো হ্যাট মাথায় যার কিনারায় কালো লেইস লাগানো। পুরুষদের পরনে স্যুট, তাতে অন্তত ঘামের দাগ লেগে নেই। বাচ্চাদেরকেও মনমরা দেখাচ্ছে। গতি কমিয়ে, শ্লথ পায়ে হাঁটতে লাগল মোটকু চার্লি; যেন তাতেও শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। দ্রুত হাঁটতে চাইছে, কিন্তু এটাও চাচ্ছে না যে কেউ ওর সেই প্রচেষ্টা ধরতে পারুক। শোক- প্রকাশকারীদের কাছে পৌঁছে, নিজের ওপর কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইল সে। কিন্তু প্রবলভাবে হাঁপাচ্ছে বেচারা, যেভাবে সিঁড়ি ভেঙে কখনও কোনো সিন্ধুঘোটক ওপরে উঠতে পারলে হাঁপাত! সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে ঘামের বন্যা, তাছাড়া এগোতে গিয়ে বেশ কয়েকজনের পা-ও মাড়িয়েছে সে। 

তাই সব মিলিয়ে, নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ না করার প্রচেষ্টাটা পর্যবসিত হলো ব্যর্থতায়! 

চোখ পাকিয়ে অনেকেই তাকাচ্ছে ওর দিকে, তবে সেগুলোকে অগ্রাহ্য করার ভান ধরল মোটকু চার্লি। একটা গান সবার মুখে, এদিকে ওটা জানে না সে। সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা দোলাল, অভিনয় করল গানটা গাইবার। সুযোগ পেয়ে একবার উঁকি দিল শবাধারের ভেতর। ওটার ডালা বন্ধ দেখে খুশিই হলো। 

তবে শবাধারটা দেখার মতো জিনিস বটে। অস্ত্র-শস্ত্র যে ধূসর-রঙা ধাতু দিয়ে তৈরি হয়, সেটার মতো রং; ইস্পাতের বানানো বলেই মনে হচ্ছে। শেষ বিচারের দিনে – ভাবল মোটকু চার্লি —যখন দেবদূত গ্যাব্রিয়েল তার শিঙা বাজিয়ে মৃতদেরকে জাগ্রত করবেন, সেদিনও ওর বাবা আটকে থাকবে তার কবরে। ভারী ডালাটা খুলতে চাইবে, কিন্তু পারবে না। নিশ্চয়ই ভাববে-ইস, সঙ্গে যদি একটা ক্রো-বার অথবা একটা অক্সিঅ্যাসেটিলিন টর্চ থাকত! 

বিষণ্ণ গলায় ‘হ্যালেলুইয়াহ’ বলার মাধ্যমে শেষ হলো গান। এরপর নেমে আসা নীরবতা ছাপিয়ে শোনা গেল মেমোরিয়াল গার্ডেনের অন্য পাশ থেকে ভেসে আসা চিৎকারের শব্দ; ওদিক দিকেই ভেতরে ঢুকেছে মোটকু চার্লি। 

যাজক বললেন, ‘আমাদের কাছ থেকে বিদেয় নেওয়া প্রিয় এই মানুষটির ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে চান?’ 

কবরের কাছে দাঁড়ানো মানুষগুলোর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ওদের মাঝে বেশ কয়েকজন কিছু কথা বলতে চায়। কিন্তু মোটকু চার্লি উপলব্ধি করতে পারল—এখনই সময়। বাবার প্রতি সব রাগ-গোস্বা ঝেড়ে ফেলার উপযুক্ত সুযোগ আর আসবে না। 

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সামনে এগোল সে, পৌঁছল কবরের ঠিক ডান পাশে। বলল, ‘উম, কিছু মনে করবেন না। আমার কিছু কথা বলার আছে।’ 

দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকারের শব্দ আরও জোরালো হচ্ছে। সমবেত মানুষদের অনেকেই পিছু ফিরে চাইছে সেদিকে। বাকিরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে মোটকু চার্লিকে। 

‘বাবার সঙ্গে কখনওই ঠিক ঘনিষ্ঠ ছিলাম না আমি,’ শুরু করল মোটকু চার্লি। ‘আসলে কীভাবে ঘনিষ্ঠ হতে হয়, তা আমাদের কারোই জানা ছিল না। গত বিশ বছর ধরে তার জীবনে ছিলাম না আমি, আর না সে আমার জীবনে ছিল। এমন অনেক কিছুই ঘটেছে যা ভুলে যাওয়া খুব কঠিন। কিন্তু এভাবেই দিন কাটাতে থাকলে একসময় আবিষ্কার করবেন, পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই!’ কপালটা মুছল সে হাত দিয়ে। ‘জীবনে কখনও ‘তোমাকে ভালোবাসি, বাবা’ বলেছি বলে মনে হয় না। উপস্থিত সুধী, আপনারা সম্ভবত বাবাকে আমার চাইতে ভালোভাবে চেনেন। কেউ কেউ হয়তো ভালোও বাসেন ওকে। আপনারা তার জীবনের অংশ ছিলেন, আমি ছিলাম না। তাই গত বিশ বছরের মাঝে এই প্রথমবারের মতো আমি যা বলতে যাচ্ছি আপনারা শুনলেও লজ্জা পাবো না।’ শবাধারের ইস্পাতের তৈরি ডালার দিকে তাকাল সে। ‘ভালোবাসি তোমাকে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘কখনও ভুলব না তোমার কথা!’ 

চিৎকারের আওয়াজ ক্রমেই জোরাল হচ্ছে; মোটকু চার্লির কথা বলা শেষ হলে যে নীরবতা নেমে এলো, তার মাঝে পরিষ্কার ভাবে শোনা গেল কথাগুলো। পুরো দ্য মেমোরিয়াল গার্ডেনের কেউই শুনতে বাকি রইল না: ‘মোটকু চার্লি! ওই ভালোমানুষদের বিরক্ত করা বাদ দিয়ে, এখুনি এখানে এসো!’ 

অপরিচিত চেহারাগুলোর দিকে তাকাল মোটকু চার্লি; প্রত্যেকের চোখে- মুখে ফুটে আছে ধাক্কা খাওয়া, হতবাক হওয়া, রাগ আর আতঙ্কের অনুভূতি; লজ্জায় লাল হয়ে গেল ওর কান… সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরে। 

‘উম, দুঃখিত। ভুল অনুষ্ঠানে চলে এসেছি,’ বলল সে। 

বড়ো বড়ো কানঅলা এক ছোট্ট বাচ্চা, আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে গর্বের সঙ্গে বলল, ‘ওটা আমার দাদি!’ 

মোটকু চার্লি বিড়বিড় করে অর্থহীন কিছু শব্দের সাহায্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে পেছাতে শুরু করল। এই মুহূর্তে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলে, বিন্দুমাত্র আপত্তি করত না ও। জানে, দোষটা ওর বাবার না; তবে এটাও জানে—এই মুহূর্তে বাবা থাকলে হেসে গড়াগড়ি খেত। 

রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে এক বিশালদেহী রমণী; চুল তার ধূসর, চোখে-মুখে রাগের ছোঁয়া, উভয় হাত রেখেছে কোমরে। এমনভাবে সেদিকে এগিয়ে গেল মোটকু চার্লি, যেন কোনো মাইনফিল্ডে পা রাখছে; সেই নয় বছর বয়সী বাচ্চায় পরিণত হয়েছে আবার! 

‘এতক্ষণ ডাকলাম, শুনতে পাওনি?’ জানতে চাইল মহিলা। ‘ঠিক আমার পাশ দিয়েই হেঁটে গেছ। কী একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললে নিজেকে!’ কড়া টান তার কণ্ঠে। ‘এদিকে এসো,’ ইঙ্গিতে রাস্তা দেখিয়ে দিল সে। ‘মূল অনুষ্ঠান ফুরিয়ে গেছে। তবে এখনও এক বেলচা ভরতি মাটি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।’ 

গত দুই দশকে মিসেস হিগলারকে পরিবর্তন স্পর্শও করতে পারেনি বলা যায়: আগের চাইতে একটু মোটা, একটু ধূসর। ঠোঁটজোড়া আরও শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে একটা আরেকটার ওপর। আগে আগে চলছে সে, পেছনে মোটকু চার্লি। ছেলেটা বুঝতে পারছে, প্রথম দর্শনে মহিলাকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে সে। পথ দেখাচ্ছে মহিলা, অপমানিত মোটকু চার্লি অনুসরণ করছে তাকে। 

মেমোরিয়াল গার্ডেনের ধাতব বেড়ার পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটা সরীসৃপ। একটা কাঁটার ওপর অবস্থান নিলো সে, গ্রহণ করল ফ্লোরিডার ভারী বাতাসের স্বাদ। মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে সূর্য, কিন্তু তাতে যেন আরও উষ্ণ হয়েছে বিকেলটা। গলা ফুলিয়ে উজ্জ্বল কমলা বেলুনের জন্ম দিল সরীসৃপটা। 

লম্বা পাঅলা দুই সারসকে অলংকার ভেবেছিল মোটকু চার্লি। কিন্তু ওকে পাশ দিয়ে যেতে দেখে, চোখ তুলে চাইল তারা। একটা তো মাথা নিচু করে ঝট করে দৌড়ুল সামনে। পরক্ষণেই মাথা উঁচু করতে দেখা গেল—ওটার চঞ্চুতে ছটফট করছে হৃষ্টপুষ্ট একখানা ব্যাঙ। তারপর ঢোক গিলতে শুরু করল পাখিটা, ব্যাঙের নিষ্ফল ঠ্যাঙ ছোড়াছুড়িকে কাঁচকলা দেখিয়ে বেচারাকে চালান দিতে লাগল পাকস্থলীতে। 

‘দ্রুত হাঁটো, বলল মিসেস হিগলার। ‘ হেলদোল কোরো না। এমনিতেই বাপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারোনি!’ 

সেদিনই যে চার হাজার মাইলের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে, সেটা জানাবার ইচ্ছেটাকে গলা টিপে মারল মোটকু চার্লি। অরল্যান্ডোয় নেমে, একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে অতিক্রম করেছে বাকি পথটা। তাও আবার ভুল রাস্তায় চলতে হয়েছে কিছুক্ষণ। শহরের একদম কোনায়, একটা ওয়াল-মার্টের পেছনে কে এমন কবরস্থান বানায়? 

কিন্তু কিচ্ছু বলল না সে, হাঁটতে লাগল চুপচাপ। বড়ো একটা কংক্রিটের দালান পড়ল পথে, ওটার গা থেকে ফরমালডিহাইডের গন্ধ আসছে। গার্ডেনের একদম শেষ দিকের কোনায় পাওয়া গেল একটা খোলা কবর। ওটার পরে উঁচু বেড়া বাদে বলতে গেলে কিছুই নেই, তারও ওপাশে সবুজ গাছ-গাছড়ার বুনো জংলামতো। কবরের মাঝে শুয়ে আছে, মাঝারি মানের একখানা কাঠের কফিন। এরিমধ্যে কয়েক মুঠো বালি ফেলা হয়েছে তাতে। কবরের পাশে পড়ে আছে একটা বেলচা, তার পাশে মাটির স্তূপ। 

বেলচাটা তুলে, মোটকু চার্লির দিকে এগিয়ে দিল মিসেস হিগলার। 

‘অনুষ্ঠান খারাপ হয়নি,’ বলল সে। ‘তোমার বাবার পুরনো দিনের বন্ধু এসেছিল কিছু, একসঙ্গে মদ গিলত তারা। আমাদের প্রতিবেশী কিছু মহিলাও এসেছিল। এখান থেকে চলে যাওয়ার পরেও, তোমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আমাদের। সন্দেহ নেই, তাদের দেখতে পেলে খুশিই হতো তোমার বাবা! আর হ্যাঁ, তুমি যদি সময়মতো উপস্থিত হতে, তাহলে ওর আত্মা আরও বেশি শান্তি পেত!’ মাথা দোলাল মহিলা। ‘যাক সে কথা, এখন কবর ভরার কাজে লেগে পড়ো।’ 

‘আমার তো জানা ছিল—এক কি দুইবার মাটি ফেলাই যথেষ্ট,’ জানাল ছেলেটা। ‘মানে প্রথা মানা আরকী।’

‘কাজটা যার ছিল, তাকে তিরিশ ডলার দিয়ে ভাগিয়েছি,’ জানাল মিসেস হিগলার। ‘বলেছি, হিংল্যান্ড[৬] থেকে তার ছেলে উড়ে এসেছে। নিশ্চয়ই বাবাকে সে নিজ হাতে কবর দিতে চাইবে…যেটা উচিতও। শুধু প্রথা মানতে চাইবে না!’ 

[৬. জ্যামাইকার অধিবাসীরা ইংল্যান্ডকে এভাবে ডাকে।]

‘ঠিক বলেছ,’ একমত হলো মোটকু চার্লি। ‘বিলকুল ঠিক। এখুনি কাজে নামছি।’ স্যুটের জ্যাকেট খুলে, বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখল সে। তারপর টাই আলগা করে, খুলে নিলো গলা থেকে; ওটার স্থান হলো জ্যাকেটের পকেটে। অতঃপর কাজে নেমে পড়ল, বেলচা ভরতি করে মাটি নিয়ে ফেলছে কবরে। এদিকে ফ্লোরিডার বাতাস যেন ঘন স্যুপের মতো ভারী হয়ে আছে! 

খানিকক্ষণ পর, শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। অদ্ভুত ধরন এই বৃষ্টির— ঝরবে না কি ঝরবে না, সেটা সে নিজেও জানে না! কেউ যদি এহেন বর্ষণের সময় গাড়ি চালায়, তাহলে ধন্ধে পড়ে যায়—ওয়াইপার চালু করবে, নাকি বন্ধই রাখবে! কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই বৃষ্টিতে গা ভেজানো, বেলচা ভরে মাটি ফেলা—এসব আরও বেশি অস্বস্তিকর। তবে সেসব গ্রাহ্য না করে মোটকু চার্লি নিজের কাজ চালিয়ে যেতে লাগল। পাশেই দাঁড়িয়ে রইল মিসেস হিগলার, দুই প্রকাণ্ড স্তনের ভার বুকের নিচে বেঁধে রাখা হাতের ওপর দিয়ে। যে প্রায়-বৃষ্টি ঝরছে, তার প্রভাবে কালো পোশাকটা থেকে যেন কুয়াশা জন্ম নিয়েছে। মাথায় থাকা খড়ের হ্যাট—যাতে লাগানো আছে একটা মাত্র কালো, সিল্কের গোলাপ—একবারের জন্যও না দুলিয়ে দেখল সে মোটকু চার্লির হাতের কাজ। 

মাটি পরিণত হলো কাদায়। আশ্চর্যের কথা, যেন আগের চাইতেও ভারী হয়ে গেল তা ওজনে! 

প্রায় একটা…চরম অস্বস্তিকর…জনমের পর, বেলচা ভরে শেষ মাটিটুকুও কবরে ফেলল মোটকু চার্লি। 

ওর দিকে এগিয়ে এলো মিসেস হিগলার। বেড়া থেকে জ্যাকেটটা তুলে, এগিয়ে দিল সামনে। 

‘একেবারে কাকভেজা হয়ে গেছ; ঘামে আর কাদায় মেখে আছে শরীরটা, তবে বেড়ে উঠেছ এই খানিকক্ষণের মাঝেই। বাড়িতে স্বাগতম, মোটকু চার্লি, বলে হাসল মহিলা, ছেলেটাকে টেনে নিলো বুকের ওপর। 

‘আমি কাঁদছি না,’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি। 

‘চুপ করো,’ নরম কণ্ঠে বলল মিসেস হিগলার। 

‘চেহারায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে,’ আবারও বলল মোটকু চার্লি। 

কিছুই বলল না মিসেস হিগলার, শুধু ধরে রইল ওকে। আস্তে আস্তে দুলছে এপাশ থেকে ওপাশে। বেশ কিছুক্ষণ পর জানাল মোটকু চার্লি, ‘ছাড়ো এবার, আমি ঠিক আছি।’ 

‘আমার বাড়িতে চলো,’ নির্দেশ দিল যেন মহিলা। ‘কিছু মুখে দেবে।’ 

পার্কিং লটে এসে জুতো থেকে কাদা মুছল ছেলেটা; তারপর চড়ল ধূসর, ভাড়া করা গাড়িটায়। মিসেস হিগলারের মেরুন-রঙা স্টেশন ওয়াগনকে অনুসরণ করে এমন কিছু রাস্তা অতিক্রম করল, যা বছর বিশেক আগে ছিল না। 

পাগলের মতো গাড়ি চালাচ্ছে মিসেস হিগলার। যদি কোনো মহিলা আচমকা তার বহু আকাঙ্ক্ষিত কফির বিশাল বড়ো একটা মগ খুঁজে পায়…গাড়ি যত দ্রুত সম্ভব চালাবার সময় যত বেশি সম্ভব কফি গেলার শর্তে, তাহলেই কেবলমাত্র এভাবে গাড়ি চালানো সম্ভব। মোটকু চার্লি বাধ্য তাকে অনুসরণ করতে, যতটা সম্ভব গতি বজায় রাখতে হচ্ছে তাকেও। চোখের পলকে একের-পর-এক ট্রাফিক লাইট পেরোচ্ছে ওরা, বুঝতেও পারছে না: কোথায় আছে! 

আচমকা একটা রাস্তায় ঢুকে পড়ল ওদের গাড়ি। টের পেল মোটকু চার্লি—চিনতে পারছে! ছেলেবেলায় এখানেই বাস করত। এমনকী বাড়িগুলোকেও কম-বেশি আগের মতোই দেখাচ্ছে। যদিও অধিকাংশেরই সামনের প্রাঙ্গণে দেখা যাচ্ছে তারের জালের বেড়া। 

মিসেস হিগলারের বাড়ির সামনে এরিমধ্যে বেশ কয়েকটা গাড়ি পার্ক করে রাখা। একটা বয়সী, ধূসর ফোর্ডের পেছনে নিজের গাড়ি রাখল মোটকু চার্লি। মিসেস হিগলার সদর দরজার সামনে গিয়ে, চাবি দিয়ে তালা খুলল। 

নিজের দিকে তাকাল মোটকু চার্লি; ভিজে একসা, সেই সঙ্গে কাদা আর ঘাম তো আছেই। ‘এই বেশে ভেতরে যাওয়াটা ঠিক হবে না।’ 

‘এরচাইতেও খারাপ বেশ দেখেছি,’ বলল মিসেস হিগলার। তারপর নাক টেনে যোগ করল, ‘তবে এক কাজ করো— সরাসরি বাথরুমে চলে যাও। হাত- মুখ ধুয়ে নিজেকে কিছুটা পরিষ্কার করে নাও। তারপর সরাসরি রান্নাঘরে চলে এসো।’ 

বাথরুমে পা রাখল মোটকু চার্লি। ভেতরে জেসমিনের সুগন্ধের রাজত্ব, সবকিছুই যেন দখল করে আছে। কর্দমাক্ত শার্টটা খুলে ফেলল প্রথমেই; তারপর ছোট্ট একটা ওয়াশবেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো জেসমিনের সুগন্ধিঅলা সাবানে। একটা কাপড় হাতে নিয়ে, বুক মুছে ফেলল সে। তারপর ট্রাউজার্সে লেগে থাকা কাদার স্তূপটা পরিষ্কার করার প্রয়াস পেল। শার্টের দিকেও তাকাল একবার, সকালে যখন পরেছিল তখন সাদাই ছিল। তবে এখন কেমন যেন বাদামি মনে হচ্ছে। ঠিক করল—আজ আর ওটা গায়ে চড়াবে না। ব্যাগে আরও শার্ট আছে, আর ব্যাগটা আছে ভাড়া করা গাড়ির পেছনের সিটে। চুপচাপ বাড়িটা থেকে বেরিয়ে, একটা পরিষ্কার শার্ট পরে ফিরে আসবে আবার। 

বাথরুমের দরজা খুলে ফেলল সে। 

চারজন বয়স্কা রমণী দাঁড়িয়ে আছে করিডোরে, দেখছে ওকেই। চারজনের প্রত্যেককে চেনে মোটকু চার্লি। 

‘আবার কী হলো?’ জিজ্ঞেস করলেন মিসেস হিগলার। 

‘শার্টটা পালটাবো,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘গাড়িতে আছে, ফিরছি এখুনি।’ 

চিবুক উঁচু করে, করিডোর ধরে এগিয়ে গেল সে; তারপর বাইরে পা রাখল সদর দরজা দিয়ে। 

‘কেমন একটা অদ্ভুত টানে কথা বলল না?’ ওর পেছন থেকে ভেসে এলো মিসেস ডানউইডির কণ্ঠ। 

‘এমন দৃশ্যও সচরাচর দেখা যায় না,’ যোগ করল মিসেস বাস্টামন্টে। অবশ্য ফ্লোরিডার এমন এক স্থানে আছে যেখানে ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, এমন মানুষ অহরহ দেখা যায়। অবশ্য তাদের সবার পরনে কর্দমাক্ত স্যুট ট্রাউজার্স থাকে না! 

গাড়ির কাছে এসে পোশাক বদলে নিলো মোটকু চার্লি, তারপর ফিরে গেল বাড়িতে। রান্নাঘরে অপেক্ষা করছে চার বয়স্কা মহিলা, প্লাস্টিকের বাক্সে ভরছে খাবার। 

মিসেস বাস্টামন্টের চাইতে বয়সে বড়ো মিসেস হিগলার। তাদের দুজনের চাইতেই ছোটো মিস নোলস। তবে কেউই মিসেস ডানউইডির চাইতে ছোটো না। বয়স্কা নারী মিসেস ডানউইডি, সেটা তার চেহারা থেকেই প্রতীয়মান হয়। এমনকী কেউ যদি বলে, মিসেস ডানউইডি তাম্র-যুগ কিংবা লৌহ-যুগের চাইতেও প্রাচীন, তাহলে তার কথা ফেলে দেওয়া যাবে না। 

ছেলেবেলায় ভদ্রমহিলাকে প্রায়শই বিষুবরেখার আশপাশের কোনো আফ্রিকান এলাকায় কল্পনা করত মোটকু চার্লি। কল্পনার চোখে দেখত—নাক- মুখ কুঁচকে মহিলা তার চশমার পুরু কাচের পেছন থেকে সদ্য খাড়া হওয়া হোমিনিডদের দেখছে। ‘আমার বাড়ি থেকে দূরে থাক্,’ বিবর্তনের মইয়ের আরেক সিঁড়ি ওপরে ওঠা, ভয়ার্ত এক হোমো হবিলিসকে বলছে সে। ‘নইলে চড়িয়ে তোর কানের পর্দা ফাটাবো।’ ধুনোর গন্ধ আসে মিসেস ডানউইডির দেহ থেকে। তবে সেটাও বয়স্কা নারীর দেহের গন্ধ পুরোপুরি ধামাচাপা দিতে পারেনি! ছোট্ট এক বুড়ি সে, যে চাইলে চোখ পাকিয়ে বজ্রঝড়েরও পিলে চমকে দিতে পারবে। মোটকু চার্লি, যে প্রায় দুই দশকেরও আগে টেনিস বলের খোঁজে মহিলার প্রাঙ্গণে ঢুকে সাজাবার সরঞ্জাম ভেঙে ফেলেছিল, ভয়টাকে পুরোপুরি ভুলে যায়নি! 

অবশ্য এই মুহূর্তে একটা ছোট্ট বাক্স থেকে আঙুল দিয়ে পুছে, খাসির মাংসের তরকারি তুলে খাচ্ছে মিসেস ডানউইডি। ‘নষ্ট করে লাভ কী?’ বলল সে, হাড়ের টুকরো ফেলল চীনে মাটির একটা থালায়। 

‘খিদে পেয়েছে, মোটকু চার্লি?’ জিজ্ঞেস করল মিস নোলস। 

‘একদম না,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘সত্যি বলছি।’ 

চারজোড়া চোখ সঙ্গে সঙ্গে তাকাল ওর দিকে, চারজোড়া চশমার ওপাশ থেকে। ‘শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দেবার দরকার কী? তাতে শোক কমবে?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মিসেস ডানউইডি, আঙুল চেটে খাচ্ছে খাসির মাংস। 

‘খিদে পায়নি একদম, নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি না।’ 

‘শোক মানুষকে শুকিয়ে হাড়-মাংসে পরিণত করে তোলে,’ বিষণ্ন মুখে বলল মিস নোলস। 

‘মনে হয় না আমার ক্ষেত্রে তা হবে।’

‘ওই টেবিলে খাবার বেড়ে দিচ্ছি,’ মিসেস হিগলার বলল। ‘তুমি গিয়ে বসো ওখানে। আর একটা কথাও শুনতে চাই না। খাবারের অভাব নেই, তাই পেট ভরে খাও।’ 

মহিলার নির্দেশিত স্থানে বসে পড়ল মোটকু চার্লি। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে ওর সামনে দেখা গেল থালা ভরতি মটরশুঁটি আর ভাত; সেই সঙ্গে আছে মিষ্টি আলুর পুডিং, শুয়োরের মাংস, খাসির গোশতের তরকারি, মুরগি, ভাজা সবজি এবং আচার দেওয়া গোরুর পায়া। মোটকু চার্লির মনে হলো, খাবার দেখেই ওর বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে; এমনকী মুখে দেওয়ারও দরকার হয়নি। 

‘আর সবাই কই?’ জিজ্ঞেস করল সে। 

‘তোমার বাবার মাতাল বন্ধুরা… মদ গিলতে গেছে। তার স্মৃতির সম্মানে সেতুতে মাছ ধরার আয়োজন করবে বলে ঠিক করেছে তারা।’ বালতি-আকৃতির কফির মগ থেকে অবশিষ্ট তরলটুকু সিঙ্কে ঢালল মহিলা। তারপর মগটা আবার ভরে নিলো নতুন করে বানানো, ধোঁয়া ওঠা কফি দিয়ে। 

মিসেস ডানউইডি ছোট্ট, বেগুনি জিহ্বা দিয়ে আঙুল পরিষ্কার করল চেটে। তারপর এগিয়ে এলো যেখানে মোটকু চার্লি বসে আছে, সেখানে। সামনে থালা ভরতি খাবার থাকলেও, তা ছোঁয়নি এখনও ছেলেটা। কমবয়সে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করত চার্লি : মিসেস ডানউইডি আসলে ডাইনি। তাও আবার মন্দ ডাইনি, ওই যে বাচ্চাদেরকে চুলোয় ঠেসে দেয় না অনেকে? তেমন। বিশ বছরেরও বেশি সময় পর, মহিলাকে দেখছে সে। কিন্তু এখনও মনের একটা অংশ চাইছে, ভয়ে চিৎকার করে উঠে টেবিলের নিচে গিয়ে সেঁধাতে! 

‘অনেক মানুষকেই মরতে দেখেছি,’ জানাল মিসেস ডানউইডি। ‘বুড়ো হও, তুমি নিজেও দেখবে। একদিন-না-একদিন সবাইকেই মরতে হবে, কালের কাছে হার মানতে হবে প্রত্যেককে!’ একটু বিরতি দিল সে। ‘তারপরও কখনও ভাবিনি, তোমার বাবা মারা যাবে।’ উভয় পাশে মাথা নাড়ল মহিলা। 

‘কেমন ছিল বাবা?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। ‘মানে, যখন ওর বয়েস কম ছিল, তখন?’ 

মিসেস ডানউইডি তার দিকে তাকাল, পুরু চশমার আড়ালে। ঠোঁটে ঠোঁট চাপিয়ে মাথা নাড়ল উভয় পাশে। ‘সে আমার আগেকার সময়ের কথা,’ আর কিছু এই প্রসঙ্গে না বলে বলল। ‘পায়া খাও।’ 

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোটকু চার্লি, মন দিল খাওয়ায়। 

.

শেষ বিকেলের কথা, বাড়িতে আর কেউ নেই। 

‘আজ রাতে কই ঘুমাবে?’ মিসেস হিগলার জিজ্ঞেস করল। 

‘মোটেলের কামরা ভাড়া করব বলে ভাবছিলাম।’ মোটকু চার্লি বলল। 

‘আমার বাড়িতে কামরার অভাব আছে? তাছাড়া রাস্তা ধরে একটু সামনে গেলে, আরেকটা ভালো বাড়ি পাবে। নিজের বাড়িই বলা যায়, কিন্তু এখনও যাওনি ওখানে! তোমার বাবা বেঁচে থাকলে চাইত—ওখানে থাকবে তুমি।’ 

‘তারচেয়ে বরং একাই থাকি। বাবার বাড়িতে রাত কাটানোর ইচ্ছেও নেই।’ 

‘তোমার ইচ্ছা। আমার টাকা তো আর জলে যাচ্ছে না,’ মিসেস হিগলার বলল। ‘তবে তোমার বাপের বাড়ির ব্যাপারে কোনো একটা সিদ্ধান্ত তো নিতে হবেই। সেই সঙ্গে তার সব জিনিসপত্রও।’ 

‘আমার কিস্যু যায় আসে না,’ মোটকু চার্লি বলল। ‘গ্যারেজ সেলের ব্যবস্থা করো, নইলে ই-বেতে তুলে দাও। চাইলে সব ফেলেও দিতে পারো। 

‘এ কেমন ধরনের কথা হলো?’ ভদ্রমহিলা রান্নাঘরের একটা ড্রয়ার হাতড়ে বের করে আনল সামনের দরজা খোলার চাবি; একটা বড়ো কাগজের লেবেল লাগানো আছে তাতে। ‘চলে যাবার সময় আমাকে অতিরিক্ত এই চাবিটা দিয়েছিল তোমার বাবা,’ জানাল মহিলা। ‘যদি হারায়, কিংবা ভেতরে রেখে দরজা আটকে ফেলে—এই ভয়ে! বলত, ধড়ের সঙ্গে লাগানো না থাকলে মাথাও খুইয়ে বসত। পাশের বাড়িটা বিক্রির সময় আমাকে বলেছিল, দুশ্চিন্তা কোরো না, কেলিঅ্যান। খুব বেশি দূরে যাবো না। যদ্দূর মনে পড়ে, ওই বাড়িতেই থাকত সে। কিন্তু আচমকা সিদ্ধান্ত নিলো, বাড়িটা নাকি প্রয়োজনের চাইতে বেশি বড়ো…’ বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতেই মোটকু চার্লিকে নিয়ে এলো সে ফুটপাতে। মেরুন স্টেশন ওয়াগনে করে কয়েকটা বাড়ি পেরোল সে, তারপর দাঁড়াল এক-তলা কাঠের বাড়ির সামনে। 

সদর দরজা খুলে, ভেতরে পা রাখল ওরা। 

গন্ধটা পরিচিত: হালকা মিষ্টি, মনে হয় যেন চকলেট চিপ কুকি বানানো হয়েছিল রান্নাঘরে; তবে অনেক আগে। ভেতরে মারাত্মক গরম। মিসেস হিগলার পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো ওকে বসার ছোট্ট ঘরটায়, চালু করে দিল জানালায় লাগিয়ে রাখা এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিট। চালু হবার আগে কেঁপে উঠল ওটা, ভেজা কুকুরের মতো গন্ধ ছড়াল চারপাশে। 

একটা জীর্ণ সোফার ওপর স্তূপ করে রাখা হয়েছে বই। মোটকু চার্লির মনে পড়ে গেল ওটার কথা, সেই ছোটোবেলায় দেখেছে। বাঁধাই করা বেশ কিছু ছবিও দেখা গেল: একটায়, সাদা-কালো ছবিতে দেখা যাচ্ছে মোটকু চার্লির মাকে, তখন যুবতী ছিল সে। চুল বেঁধে রেখেছে মাথার ওপরে, চকচক করছে ওগুলো। পরে আছে জাঁকালো পোশাক। 

তার পাশের ছবিটায় দেখা যাচ্ছে খোদ মোটকু চার্লিকে, বয়েস তখন ওর পাঁচ কি ছয় হবে। একটা আয়নাঅলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চাটা, দেখে মনে হয় যেন দুটো ছোট্ট মোটকু চার্লি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওখানে; ছবির ভেতর থেকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে উভয়ে! 

স্তূপের একদম ওপরের বইটি তুলে নিলো মোটকু চার্লি, ইতালিয়ান আর্কিটেকচারের ওপর লেখা। ‘বাবার আগ্রহ ছিল এসবে?’ 

‘দারুণ আগ্রহ ছিল।’ 

‘জানতাম না তো!’ 

জবাবে কেবল শ্রাগ করল মিসেস হিগলার, চুমুক দিল কফির মগে। 

বইটি খুলতেই প্রথম পাতায় বাবার লেখা নাম পরিষ্কার হস্তাক্ষরে দেখতে পেল মোটকু চার্লি। বন্ধ করে রাখল আবার। ‘বলতে গেলে,’ জানাল সে। ‘বাবাকে একদমই চিনতাম না আমি।’ 

‘ওকে ঠিকভাবে চেনাটা সহজ কাজ না,’ জানাল মিসেস হিগলার। ‘প্রায় ষাট বছর হলো ওর সঙ্গে পরিচয়, কিন্তু চিনতাম কি? মনে হয় না।’ 

‘যখন বাবা বাচ্চা ছিল, তখন থেকে চেনো তাহলে?’ 

জবাব দিতে ইতস্তত করল মিসেস হিগলার। মনে হলো যেন স্মৃতি হাতড়াচ্ছে। অতঃপর বলল, ‘আমি যখন খুকি ছিলাম, তখন থেকে চিনি তোমার বাবাকে।’

মোটকু চার্লির কেন যেন মনে হলো, প্রসঙ্গটা পালটানো দরকার। তাই মায়ের ছবির দিকে ইঙ্গিত করল সে। ‘মার ছবি কাছে রাখত দেখি,’ বলল ছেলেটা। 

কফিতে চুমুক দিল মিসেস হিগলার। ‘একটা জাহাজে তোলা ছবিটা, ‘ জানাল সে। ‘তোমারও জন্মের আগের কথা বলছি। অনেক জাহাজ এমন থাকে না, যেখানে খাবার-দাবার পাওয়া যায়? তারপর মাইল তিনেক জলপথ পাড়ি দিয়ে চলে যায় আন্তর্জাতিক জলসীমায়। জুয়াও খেলা হতো আগে। তারপর আবার ফিরে আসত জেটিতে। এখনও ওসবের চল আছে কি না, জানা নেই। তবে তোমার মা বলত, সেদিনই নাকি জীবনে প্রথম স্টেক খেয়েছিল!’ 

ওর জন্মের আগে বাবা-মা কেমন ছিল, তা কল্পনা করার প্রয়াস পেল মোটকু চার্লি। 

‘যখন তোমার বাবাকে প্রথম দেখি, তখন থেকেই সে সুদর্শন ছিল,’ বলল মিসেস হিগলার, যেন ওর মনের কথা আঁচ করতে পেরেই। ‘মারা যাবার সময়ও তাই। এমন মিষ্টি করে হাসত যে দেখা মাত্র পটে যেত যেকোনো মেয়ে। পোশাক-আশাকেও ছিল ফুলবাবু। মেয়েরা দারুণ পছন্দ করত ওকে।’ 

প্রশ্নটা করার আগেই উত্তর আঁচ করতে সক্ষম হলো মোটকু চার্লি। ‘তুমিও কি…?’ 

‘একজন সম্মানিত, বিধবা মহিলাকে কেউ এমন প্রশ্ন করে?’ কফির কাপে চুমুক দিল সে। এদিকে জবাবের অপেক্ষায় চুপ করে আছে মোটকু চার্লি। ‘একবার চুমু খেয়েছিলাম ওকে; সে অনেক দিন আগের কথা…তোমার মা ওর জীবনে আসারও আগেকার। দারুণ চুমু খেতে পারত তোমার বাবা। আশায় ছিলাম–হয়তো আবার যোগাযোগ করবে, আমাকে নিয়ে যাবে নাচের অনুষ্ঠানে। কিন্তু না, সেরেফ হাওয়া হয়ে গেল সে। এক…নয়তো দুই বছর আর দেখা পাইনি তার। যখন ফিরে এলো, ততদিনে আমি মি. হিগলারকে বিয়ে করেছি। সে-ও সঙ্গে করে তোমার মাকে নিয়ে এলো। কোনো একটা দ্বীপে দেখা হয় ওদের।’ 

‘মন খারাপ হয়েছিল?’ 

‘ততদিনে আমি বিবাহিতা,’ আরেক চুমুক কফি পান করল মহিলা। ‘আর তাছাড়া, তোমার বাবার ওপর রাগ পোষা যায় না। ঘৃণা করার তো প্রশ্নই ওঠে না। চোখে যে দৃষ্টি নিয়ে তোমার মায়ের দিকে তাকাত… অমনি করে আমার দিকে তাকালে আনন্দে মারাই যেতাম। জানো, বিয়েতে আমি ছিলাম তোমার মায়ের নিতকনে?’ 

‘নাহ, জানতাম না।’ 

এসিটা এতক্ষণে ঠান্ডা বাতাস ছাড়তে শুরু করেছে, তবে ভেজা কুকুরের মতো গন্ধটা এখনও মিলিয়ে যায়নি। 

জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। ‘তোমার কি মনে হয়, ওদের সংসার সুখের হয়েছিল?’ 

‘শুরুতে হয়েছিল অন্তত,’ বিশাল মগটা হাতে নিলো মহিলা, মনে হলো চুমুক দেবে। কিন্তু পরক্ষণেই পালটে ফেলল সিদ্ধান্ত। ‘তবে শুরুর কিছু দিনই কেবল। এমনকী তোমার মা-ও ন্যান্সির মনোযোগ আটকে রাখতে পারেনি। খুবই ছটফটে স্বভাবের ছিল তোমার বাবা, সেই সঙ্গে ব্যস্তও।’ 

মিসেস হিগলার ঠাট্টা করছে কি না, তা বুঝতে চাইল মোটকু চার্লি। তবে পরিষ্কার ধরতে পারল না, কথাটা যেভাবেই বলা হোক না কেন…মহিলার মুখে হাসি নেই। 

‘ব্যস্ত? কোন কাজে? সেতুতে বসে মাছ ধরতে? নাকি পোর্চে বসে ডমিনো সাজাতে? ক্যারিয়োকির আসর মাতাতে নিশ্চয়ই? ব্যস্ত ছিল না বাবা। আমার তো মনে পড়ে না যে একটা দিনও তাকে কাজ করতে দেখেছি!’ 

‘নিজের বাপের ব্যাপারে এসব বলাটা ঠিক হচ্ছে না।’ 

‘ঠিক-বেঠিক জানি না, কিন্তু সত্যিটাই বলছি। বাজে লোক ছিল সে…জঘন্য বাবা তো বটেই, সেই সঙ্গে জঘন্য স্বামীও।’ 

‘তা বলাই বাহুল্য!’ জোর দিয়ে বলল মিসেস হিগলার। ‘কিন্তু গড়পড়তা মানুষকে যেভাবে বিচার করা হয়, সেভাবে তাকে বিচার করা যাবে না। মনে রেখো, মোটকু চার্লি, তোমার বাবা দেবতা ছিল!’ 

‘মানুষের মাঝে দেব-সম—এটাই তো বোঝাতে চাচ্ছ?’ 

‘উঁহু…দেবতা!’ তেমন একটা জোর না দিয়েই এবার কথাটা বলল মহিলা। এমন নিস্পৃহ ভঙ্গিতে যেন বলছে— সে ডায়াবেটিসের রোগী ছিল…কিংবা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ! 

ঠাট্টা করতে চাইল মোটকু চার্লি, কিন্তু মিসেস হিগলারের চোখের দিকে তাকিয়ে উবে গেল ওর রসবোধ। নরম কণ্ঠে বলল কেবল, ‘দেবতা ছিল না বাবা। দেবতারা আলাদা, অনন্য, কিংবদন্তির চরিত্র। তারা অলৌকিক সব কাজ করে!’ 

‘ওহ, বুঝতে পেরেছি,’ বলল মিসেস হিগলার। ‘যত দিন তোমার বাবা বেঁচে ছিল, ততদিন কথাটা তোমাকে জানাবার উপায় ছিল না। কিন্তু এখন সে আর নেই, তাই বললেও ক্ষতি নেই।’ 

‘দেবতা ছিল না সে, ছিল আমার বাবা।’ 

‘দুটোই একসঙ্গে হতে বাধা কোথায়?’ পালটা যুক্তি ছুড়ল মহিলা। ‘অনেকের বাবা কিন্তু দেবতাও।’ 

পাগলের সঙ্গে তর্ক করছি, ভাবল মোটকু চার্লি। বুঝতে পারল, ওর উচিত হবে এই মুহূর্তেই মুখে ঢুলি আঁটা। কিন্তু তা না করে বলেই চলছে তো বলেই চলছে। ওর মুখ বলছে, ‘আজব! বাবা যদি দেবতাই হতো, তাহলে তার দৈব- শক্তি থাকত না?’ 

‘ছিল তো, তবে খুব একটা ব্যবহার করত না। বয়স হয়ে গেছিল। যাই হোক, কাম-কাজ না করেও বেঁচে ছিল কীভাবে…বলো তো? যখনই টাকা লাগত, লটারি খেলত অথবা কুকুর বা ঘোড়ার ওপর বাজি ধরত। খুব বেশি জিতত না কখনওই, যেন কারও মনোযোগ না আকর্ষিত হয়। কাজ চলার মতো জিতত আরকী।’ 

মোটকু চার্লি তার এক জীবনে কখনও কিচ্ছু জেতেনি। একেবারে কিস্যু না! অফিসের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে, তবে শুরুতেই জানত যে লাভ হবে না। যে ঘোড়ার ওপর বাজি ধরত, ওটা দৌড়ই শুরু করত না…কিংবা যে দলকে বেছে নিত সেটা অজানা কোনো বিভাগে নেমে যেত খুব দ্রুতই। 

‘যদি আমার বাবা দেবতা হতো – যা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না–তাহলে আমি নিজেও কেন দেবতা নই? তোমার কথা সত্যি ধরে নিলে, আমি তো দেবতারই ছেলে হলাম, তাই না?’ 

‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’ 

‘তাহলে আমি কেন জেতা ঘোড়ার ওপর বাজি ধরতে পারি না…কিংবা জাদু দেখাতে অথবা অলৌকিক কিছু করতে পারি না?’ 

নাক টানল মহিলা। ‘তোমার ভাই সব ক্ষমতা পেয়েছে।’ 

মোটকু চার্লি আবিষ্কার করল, সে হাসছে। দম ছাড়ল বড়ো করে, স্বস্তি পেয়েছে। ভাবছে, যাক বাবা, ঠাট্টা করছিল ভদ্রমহিলা। 

‘আহ, তুমি তো জানো, মিসেস হিগলার, আমার কোনো ভাই-টাই নাই।’

‘অবশ্যই আছে। ছবিতেই তো দেখা যাচ্ছে… দুজনকে এক সঙ্গে।’

মোটকু চার্লির ভালো করেই মনে আছে ওই ছবির কথা, তারপরেও সেদিকে তাকাল একবার। মহিলা আসলেই পাগল হয়ে গেছে, একেবারে বদ্ধ পাগল। ‘মিসেস হিগলার,’ বলল সে, যতটা ভদ্র ভাবে সম্ভব। ‘আমার ছবি ওটা, যখন ছোটো ছিলাম তখনকার। একটা আয়নাঅলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে আমার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে।’ 

‘তোমার ছবি—মেনে নিলাম। সেই সঙ্গে তোমার ভাইয়ের ছবিও।’

‘আমার ভাই নেই!’ 

‘অবশ্যই আছে। যদিও জীবন থেকে ও চলে গেলেও আফসোস নেই। তুমি সবসময়ই নম্র-ভদ্র ছিলে। কিন্তু তোমার ভাই…নাভিশ্বাস তুলে দিত!’ মোটকু চার্লি কিছু বলার আগেই যোগ করল, ‘দূরে কোথাও চলে গেছিল তোমার সেই ভাই, তুমি তখন এক্কেবারে ছোট্ট।’ 

সামনে ঝুঁকল মোটকু চার্লি, নিজের বড়োসড়ো পাঞ্জাটা রাখল মিসেস হিগলারের হাড় জিরজিরে হাতে; তবে যেটা ফাঁকা আছে, সেটায়। ‘কথাটা ভুল, বলল সে।’

‘লোয়েলা ডানউইডি বাধ্য করেছিল ওকে বিদেয় নিতে,’ জানাল মহিলা। ‘তোমার ভাই খুব ভয় পেত ওকে। তবে আসত ফিরে, মাঝে-মধ্যে। যখন দরকার পরে, তখন খুব মিষ্টি আচরণ করতে জানত।’ কফি শেষ করল মিসেস হিগলার। 

‘সেই ছোটো বেলা থেকেই একটা ভাই চাইতাম,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘যাতে দুজনে মিলে খেলতে পারি।’ 

উঠে দাঁড়াল মিসেস হিগলার। ‘যাক সে কথা, এই বাড়িটা তো আর আপনা-আপনি পরিষ্কার হবে না,’ বলল মহিলা। ‘গাড়িতে ময়লা ফেলার থলে আছে। আগেই ধরে নিয়েছিলাম, প্রচুর পরিমাণে লাগবে।’ 

‘হুম,’ একমত হলো মোটকু চার্লি। 

.

সে রাতটা ও কাটাল একটা মোটেলে। সকাল বেলা আবার দেখা করল মিসেস হিগলারের সঙ্গে, ওর বাবার বাড়িতে। ময়লা সব গুছিয়ে ফেলল বড়ো, কালো ময়লার থলেতে। যেসব বস্তু দান করবে গুডউইলে, সেগুলো থলেতে ভরে একপাশে রেখে দিল। এক বাক্সে এমন কিছু জিনিস ভরা হলো, যেগুলোর অন্যরকম মূল্য আছে মোটকু চার্লির কাছে। অধিকাংশই ছেলেবেলার ছবি, কিছু আছে ওর জন্মের আগেকারও। 

একটা পুরাতন ট্রাঙ্কও পাওয়া গেল, দেখতে অনেকটা জলদস্যুদের গুপ্তধনের সিন্দুকের মতো। ভেতরটা ভরতি পুরাতন কাগজপাতি দিয়ে। মেঝেতে বসে, সেগুলো দেখল মোটকু চার্লি। শোবার ঘর থেকে আরেকটা কালো থলে নিয়ে বেরোল মিসেস হিগলার। ওটা ভরতি পোকায় খাওয়া কাপড় দিয়ে। 

‘ওই ট্রাঙ্কটা উপহার দিয়েছিল তোমার ভাই,’ আচমকা বলল মিসেস হিগলার। এই প্রথম বারের মতো গত রাতে তোলা প্রসঙ্গটার অবতারণা করল সে। 

‘ভাই থাকলে কতই না ভালো হতো,’ বলল মোটকু চার্লি। টেরও পায়নি যে কথাটা উচ্চকণ্ঠে বলেছে। কিন্তু মিসেস হিগলারের কথা শুনে বোঝা গেল, সে কাজটাই করে বসেছে সে! 

‘বললাম তো, একটা ভাই আছে তোমার।’ 

‘তাই নাকি?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি। ‘তা আমার এই কাল্পনিক ভাই এই মুহূর্তে আছেটা কই?’ পরে বহুবার ভেবেছে, প্রশ্নটা করতে গেছিল কেন? মহিলাকে বিদ্রূপ করছিল? নাকি কষ্ট দিতে চায়নি বলে করেছে? হতেও তো পারে, নীরবতা যেন নেমে না আসে সেজন্য কিছু একটা বলতে হবে ভেবে বলেছিল? কারণ যেটাই হোক না কেন, প্রশ্নটা করে বসে সে। 

জবাব দেবার আগে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল মিসেস হিগলার। মাথা 

নেড়ে বলল, ‘নাহ, ব্যাপার তোমার জানা থাকা দরকার। হাজার হলেও, এটা তোমার প্রাপ্য, তোমার উত্তরাধিকার!’ ছেলেটার কাছাকাছি এসে আঙুল বাঁকাল মহিলা। সামনে ঝুঁকে গেল মোটকু চার্লি। ওর কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলল বুড়ো মহিলা, ‘…ওকে দরকার হলে…সেটা বোলো একটা… 

‘কী?’ 

‘বললাম,’ এবার স্বাভাবিক কণ্ঠেই কথা বলল মহিলা। ‘ওকে তোমার দরকার হলে, তা বোলো একটা মাকড়শাকে। দেখবে, ছুটে আসবে তোমার ভাই।’ 

‘মাকড়শাকে বলব?’ 

‘সেটাই তো বললাম! কী ভেবেছিলে, বুড়ি পাগল হয়ে গেছে? এমনি এমনি কথা বলছি? কখনও মৌমাছিকে সব কিছু বলার কথা শোনোনি? এখানে বাবা-মা আসার আগে, আমি যখন সেন্ট অ্যান্ড্রুজে ছিলাম, তখন মৌমাছিদেরকেই গিয়ে সব শুভ সংবাদ বলতাম। ছোট্ট মেয়ে ছিলাম তখন। যাই হোক, এই ব্যাপারটাও তেমনি। মাকড়শার সঙ্গে কথা বলো। তোমার বাবা যখন আচমকা উধাও হয়ে যেত, তখন এভাবেই তার কাছে খবর পাঠাতাম।’ 

‘…আ-আচ্ছা।’ 

‘ওভাবে বোলো না।’ 

‘কীভাবে?’ 

‘এমন ভাবে যেন বোঝাতে চাইছ—আমি বুড়ি, মাথা খারাপ মহিলা যে কিনা মাছের বাজারে গিয়েও ঠিকমতো দরদাম করতে অক্ষম। কী ভাবছ, সব তালগোল পেকে গেছে?’ 

‘উম, সত্যি বলছি…এমন কিচ্ছু ভাবিনি!’ 

মিসেস হিগলারকে ঠান্ডা করা যাচ্ছে না। মারাত্মক খেপে গেছে সে। কফির মগটা টেবিলের ওপর থেকে তুলে, বিরক্তির সঙ্গে মাথা নাড়ল। মোটকু চার্লি দোষ করেছে, আর সেটা মিসেস হিগলার তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবে। 

‘তবে কাজটা আমার করার কথা না, বুঝলে?’ বলল মহিলা। ‘তোমাকে আমার সাহায্য করার কথা না। কিন্তু করছি একমাত্র তোমার বাবার জন্য, অনন্য ছিল সে; আর করছি তোমার মায়ের জন্য, দারুণ এক নারী ছিল। অনেক বড়ো বড়ো কথা বলে ফেলছি তোমাকে, দিচ্ছি গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য। আমার কথা মন দিয়ে শোনো, অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করো।’ 

‘বিশ্বাস করছি তোমার কথা,’ কণ্ঠে যতটা সম্ভব আন্তরিকতা ঢালল মোটকু চার্লি। 

‘এখন তো বুড়ো এক মহিলার মন রক্ষার জন্য কথাটা বলছ!’ 

‘নাহ!’ মিথ্যে বলল ছেলেটা। ‘সত্যিই বলছি আমি।’ শব্দগুলোয় পরিষ্কারভাবে শোনা গেল সততা, আন্তরিকতা আর…সত্যতা! বাড়ি থেকে হাজারো মাইল দূরে, নিজের সদ্য-মৃত পিতার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে সে; সামনেই এক পাগলা-বুড়ি, যেকোনো মুহূর্তে হয়তো হাত-পা ছোড়া শুরু করে দেবে! চাঁদ আসলে এক ধরনের ফল, বিষুবীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়—এই কথা বললে যদি বৃদ্ধা শান্ত হতো, তাহলে তাই বলত। 

নাক টানল মহিলা। 

‘তোমাদের, মানে কমবয়সীদের নিয়ে এই একটাই সমস্যা,’ বলল সে। ‘নাক টিপলে দুধ পড়ে, কিন্তু ভাব এমন যেন সব জেনে বসে আছ! আমি জীবনে যত কিছু ভুলেছি, তত কিছুর জ্ঞান কোনোদিন অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। বাবার ব্যাপারে তুমি কিছুই জানো না, পরিবারের ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ। তোমাকে বললাম, তোমার বাবা দেবতা…অথচ জানতেও চাইলে না, কেমন দেবতা সে?’ 

দেবতাদের নাম স্মরণ করতে চাইল মোটকু চার্লি। ‘জিউস?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল সে। 

এমন আওয়াজ করল মিসেস হিগলার, যেটার সঙ্গে ফুটন্ত পানিকে আটকে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত কেতলির আওয়াজের সঙ্গে তুলনা করা যায়। বুঝে ফেলল মোটকু চার্লি, ভুল জবাব দিয়েছে। 

‘কিউপিড?’ 

আরেকটা আওয়াজ করল মহিলা, ধীরে ধীরে শুরু হলেও শেষ হলো তা খিলখিল হাসির শব্দে। ‘তোমার বাবাকে কল্পনা করছিলাম, পরনে ফোলা ফোলা ডায়পার ছাড়া কিচ্ছু নেই…হাতে একটা বড়ো ধনুক আর তির!’ আরও খানিকক্ষণ হাসল মহিলা। তারপর গলায় ঢালল খানিকটা কফি। 

‘যখন ও দেবতা ছিল, মোটকু চার্লিকে জানাল সে। ‘তখন ওকে সবাই ডাকত আনানসি বলে।’ 

.

হয়তো আপনি আগেই আনানসিকে নিয়ে দুয়েকটা গল্প শুনেছেন। সত্যি বলতে কী, দুনিয়াতে মনে হয় না এমন কাউকে পাওয়া যাবে, যে আনানসির কোনো গল্প শোনেনি! 

আনানসি ছিল আসলে একটা মাকড়শা, জগতের বয়েস তখনও ছিল অল্প, এবং গল্পের জন্মই হয়েছে সদ্য। নানা ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ত সে, আবার ঝামেলা থেকে বেরিয়ে আসত নিজে-নিজেই। কে না শুনেছে আলকাতরা-বাবুর আখ্যান, ওরফে জনাব খরগোশের গল্প? সেটা আগে ছিল আনানসির আখ্যান। অনেকে ভাবে, আসলে বুঝি ও খরগোশ। কিন্তু না, ও খরগোশ ছিল না… ছিল মাকড়শা। 

মানুষজন যতদিন হলো গল্প বলছে, ততদিনই বয়েস আনানসির গল্পের। আফ্রিকায়, যেখানে সব কিছুর শুরু, মানুষজন গুহার দেয়ালে সিংহ আর ভালুক আঁকতে শুরু করারও পূর্বে, বলাবলি করত বানর, সিংহ আর মোষের গল্প। স্বপ্নে দেখা সেই ঘটনাগুলো গল্পের ছলে অন্যকে বলা মানুষের সহজাত স্বভাব। ওদের যে দুনিয়া, সেটার একটা অর্থ খাড়া করার জন্য এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তাই যা কিছু দৌড়ায়, অথবা বুকে হাঁটে, অথবা গাছে ঝোলে, কিংবা মাটিতে হেঁচড়ে চলে…সবই কীভাবে যেন ঢুকে পড়ত গল্পে। বিভিন্ন গোত্র তখন বিভিন্ন প্রাণিকে পবিত্র মনে করত। 

সিংহ হলো পশুরাজ, তখনও তাই ছিল। গ্যাজেল হরিণ সবচাইতে দ্রুতগতি সম্পন্ন প্রাণী, বানর সবচাইতে বোকা। কিন্তু সবচেয়ে জঘন্য হলো বাঘ। 

ভালো কথা: তাদের ব্যাপারে গল্প কিন্তু শুনতে চাইত না ওরা। 

আনানসি তার গল্পগুলোর নাম দিত। প্রত্যেকটা গল্পই ছিল আনানসির। তার আগে, মানে সব গল্প আনানসি হবার আগে, ছিল বাঘের (বিড়াল- প্রজাতির বড়োসড়ো সব প্রাণিকে দ্বীপবাসীরা তখন এ নামেই ডাকত)। সেসময় গল্পগুলো ছিল ভয়ানক, অশুভও বলা চলে। তাতে ছিল ব্যথা আর কষ্টের প্রাধান্য, কখনওই মধুর সমাপ্তি হতো না। 

তবে সেসব অনেক…অনেক দিন আগের কথা। এখন সব গল্পই আনানসির। 

 .

আমরা যেহেতু খানিক আগেই একটা শেষকৃত্যানুষ্ঠান হয়ে এলাম, তাই আনানসিকে নিয়ে একটা গল্প শোনাই আপনাদের। সেবার ওর দাদি মারা গেছিল (জন্মিলে মরিতে হইবে…তাছাড়া বয়েস হয়েছিল অনেক, ঘুমের মাঝেই মারা যায় বেচারি। এমনটা হয় মাঝে মধ্যে)। কিন্তু মারা যায় যখন তখন ছিল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। তাই আনানসিকে দ্বীপটার অন্য পাশে গিয়ে, হাতে টানা গাড়িতে তুলে ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল দাদির লাশ। গাড়িতে দেহটাকে তুলে, টেনে ফিরতে লাগল সে বাড়ির দিকে। ঠিক করেছে: কুটিরের পেছনে যে বট গাছটা আছে, সেটার পাশেই কবর দেবে দাদিকে। 

গ্রামের ভেতর দিয়ে যখন যাচ্ছে, তখন ভাবল (ওকে দোষ দেওয়া যায় না ভাবার জন্য, সারা সকাল লাশবাহী গাড়ি টানতে হয়েছে যে)—হুইস্কি হলে মন্দ হয় না। 

সরাসরি দোকানে চলে গেল সে, ওই গ্রামে একটাই মদের দোকান। আসলে শুধু মদের না, সবকিছুরই দোকান ওটাই। দোকান মালিক আবার রগচটা মানুষ। আনানসি ভেতরে গিয়ে হুইস্কি ঢালল গলায়। তারপর ঢালল আরও একটু। অতঃপর ভাবল, এই লোকটার সঙ্গে চালাকি করলে কেমন হয়? 

যা ভাবা তাই কাজ। দোকানিকে বলল, দাদির জন্য একটু হুইস্কি নিয়ে যাও; বুড়ি ঘুমাচ্ছে বাইরে, গাড়িতে। একবার ঘুমালে আর হিসেব থাকে না, তাই ডেকে তুলতে হতে পারে। 

দোকানি সাত-পাঁচ না ভেবে রওনা দিল, বাইরে গেল ও বোতল হাতে। গাড়িতে শুয়ে থাকা বুড়ো মানুষটাকে ডেকে বলল, ‘এই নাও, তোমার হুইস্কি।’ 

কিন্তু বুড়ি কিছু বলল না! 

আবার ডাকল দোকানি, এবারও জবাব পেল না। মেজাজ চড়তে শুরু করল ওর। অবশেষে হমকি ছেড়ে বলল, ওঠ বুড়ি, তোর হুইস্কি গেল! কিন্তু তবুও বুড়ো মহিলার মুখে রা নেই। এরপর এমন একটা কাজ করল সে, যেটা গরমের দিনে মরা লাশ প্রায়শই করে: পাদ ছাড়ল শব্দ করে। দোকানি এতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, মেরেই বসল বুড়িকে। তারপর আবার… আরও একবার। তৃতীয় আঘাতে পর, গাড়ি থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ল বেচারির লাশ। 

দৌড়ে বেরিয়ে এলো আনানসি, চিল্লিয়ে-চেঁচিয়ে নরক নামিয়ে আনল মাটিতে। বিলাপ করতে লাগল: আমার দাদি, মারা গেছে! উঁহু, তুই মেরে ফেলেছিস! খুনি, পাপী! 

দোকানি ভয় পেয়ে আনানসিকে বলল, চুপ, চুপ। কাউকে কিছু বোলো না। তারপর ঘুস হিসেবে পাঁচ বোতল হুইস্কি দিল সে আনানসিকে; সঙ্গে সোনায় ভরতি একটা ব্যাগ, সবজি-আনারস-আমে ভরা থলে। অনুরোধ করল যেন সব কিছু নিয়ে এখুনি চলে যায়। 

(হয়তো ধরে ফেলেছেন, তার ধারণা—আনানসির দাদিকে সে-ই খুন করেছে!) 

তাই আনানসি তার হাতেটানা গাড়িটা নিয়ে ফিরে এলো বাড়িতে, দাদিকে কবর দিল বট গাছের নিচে। 

পরের দিনের কথা, আনানসির বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল বাঘ। গন্ধে টের পেল, ভেতরে কিছু একটা রান্না হচ্ছে। বিনা দাওয়াতের অতিথির মতো ভেতরে চলে গেল সে। দেখতে পেল ভোজের আয়োজন করেছে আনানসি। এদিকে আর কোনো উপায় না দেখে আনানসিও আমন্ত্রণ জানাল বাঘকে, ওর সঙ্গে খাবারে সঙ্গী হতে। 

বাঘ বলল আনানসি, ভাই আমার, এমন দারুণ খাবার পেলে কই? মিথ্যে বলো না আবার। কোথায় পেলে এমন সুস্বাদু মদের বোতল? আর ওই সোনায় ভরা বড়ো খলে, সেটাই বা এলো কোত্থেকে? যদি মিথ্যে বলো…তাহলে কামড়ে গলা ছিঁড়ে ফেলব! 

তাই আনানসি জবাব দিল: মিথ্যে তো আর তোমাকে বলা যায় না, বাঘ ভাই। আমার মৃতা দাদিকে গ্রামের ভেতর দিয়ে হাতে টানা গাড়িতে করে আনছিলাম। পরে লাশটা দোকানির কাছে নিয়ে গেলে, সে আমাকে এসব দিয়েছে। 

শুনে লোভে চকচক করে উঠল বাঘের চোখ। কিন্তু ঝামেলা হলো—ওর নানি-দাদি কেউই বেঁচে নেই। তবে হ্যাঁ, শাশুড়ি আছে একটা। তাই বাড়ি ফিরে শাশুড়িকে ডেকে বলল, বেরিয়ে এসো বুড়ি, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। ডাক শুনে বাইরে এসে, চারপাশে তাকাল বাঘের শাশুড়ি। জানতে চাইল, কী সমস্যা? কথা না বাড়িয়ে তাকে মেরে ফেলল বাঘ, অথচ মাকে খুবই ভালোবাসত ওর স্ত্রী। 

যাই হোক, লাশটাকে একটা হাতেটানা গাড়িতে তুলল সে। 

এরপর গ্রামের ভেতর দিয়ে টেনে আনতে লাগল সেই গাড়ি, তাতে পড়ে আছে শাশুড়ির লাশ। লাশ নিবেন, লাশ? হাঁক ছাড়ল সে। কে চায় বুড়ির লাশ? এদিকে গ্রামবাসী হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে তাকে, সেই সঙ্গে হাসছে আর বিদ্রূপও করছে। কিন্তু যখন বুঝতে পারল, আসলেও লাশ বিক্রি করতে চায় বাঘ বাবাজী, তখন পচা ফল ছুঁড়তে লাগল ওকে লক্ষ্য করে; বাঘ পালিয়ে যাবার আগে থামল না। 

আগেও বহুবার আনানসি বোকা বানিয়েছে বাঘকে, তেমনি বানিয়েছে পরেও। এদিকে মাকে হত্যা করেছে বলে বাঘের স্ত্রী তাকে কখনওই ক্ষমा করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে! স্বামীর জীবনের এই হাল করে সে, যে বাঘ মাঝে মধ্যে ভাবে: কোনোদিন না জন্মালেই ভালো হতো। 

.

এই যে, আনানসির একটা গল্প আপনারা শুনলেন। 

তবে বলাই বাহুল্য, সব গল্পেরই মালিক আনানসি। এমনকী এই মাত্র যেটা শুনলেন, সেটারও। 

আগেকার দিনে, সব পশু আর প্রাণিই চাইত, তাদের নামানুসারে গল্পের নাম রাখা হোক; অর্থাৎ তারাই হোক গল্পের মালিক। যে গান শুনে জন্ম নিয়েছিল জগত, সেই গান তখনও গাওয়া হতো; তখনও গান গেয়ে গড়ে তোলা হচ্ছিল আকাশ, রঙধনু আর সমুদ্রকে। সেই সময়ের কথা বলছি, যখন পশুরা পশু হবার পাশাপাশি ছিল মানুষও। আনানসি দ্য স্পাইডার তখন সবাইকে বোকা বানাত। বিশেষ করে ওর চালাকির শিকার হতো বাঘ, কেননা বাঘও চাইত সব গল্পের মালিক হতে। 

গল্প কিন্তু অনেকটা মাকড়শার মতোই। লম্বা লম্বা পা আছে তাদের। গল্প কিন্তু আবার মাকড়শার জালের মতোও। মানুষ তাতে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে, তবে সুন্দর দেখায় তাকে… তাছাড়া যেভাবে তারা একে-অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তাকে অনন্য না বলে উপায় নেই! 

কী বললেন? আনানসি দেখতে মাকড়শার মতো কি না? 

অবশ্যই মাকড়শার মতো… কিন্তু আবার মানুষের মতোও। 

নাহ, রূপ পালটাত না সে কখনও। আসলে পুরোটাই নির্ভর করছে আপনি কীভাবে গল্পটা বলছেন, তার ওপর… 

…ব্যস, এই তো। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *