অধ্যায় দশ – যেখানে বিশ্বকে তার স্বরূপে দেখল মোটকু চার্লি এবং মেইত লিভিংস্টোন অসন্তুষ্ট হলো
মোটকু চার্লি ধাতব বিছানার কম্বলের ওপর বসে অপেক্ষা করছে… কিছু একটা ঘটার জন্য। কিন্তু কিচ্ছু ঘটছে না! মনে হচ্ছে যেন অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেছে এরইমাঝে, তবে খুব ধীরে। ঘুমুতে চাইছে, কিন্তু কীভাবে ঘুমাতে হবে সেটাই যেন গেছে ভুলে।
দরজায় ধাক্কা দিল সে।
চেঁচিয়ে উঠল কেউ, ‘চুপ করো!’ কিন্তু এই কেউটা আসলে পুলিস অফিসার নাকি সহকয়েদি, তা বুঝতে পারল না মোটকু চার্লি।
পায়চারি করতে লাগল সে সেলের ভেতর। কতক্ষণ? কমিয়ে হিসেব করলেও কমপক্ষে দুই কি তিন বছর তো হবেই। তারপর বসে পড়ল বিছানায়, অপেক্ষা করতে লাগল অনন্তের। দেওয়ালের ওপরের দিকে থাকা পুরু কাচের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে সূর্যের আলো; ওটাকে জানালাও বলা চলে। তবে মনে হচ্ছে, সেদিন সকালে ও জেলখানায় ঢোকার সময় যে উজ্জ্বলতা ছিল আলোর এখনও সেটাই আছে।
কয়েদিরা কীভাবে সময় কাটায়, তা মনে করতে চাইল মোটকু চার্লি। কিন্তু মাথায় এলো শুধু গোপন ডায়েরি আর নিতম্বের ফুটোয় জিনিস লুকিয়ে রাখার কথা। লেখার মতো কিছু নেই হাতের কাছে, আর নিজের নিতম্বে কিছু একটা ঢুকিয়ে রাখার মতো বাজে কাজের কথা ভাবতেও পারছে না।
কিচ্ছু ঘটছে না, ঘটার সম্ভাবনাও নেই। কিছু না ঘটাটাই অব্যাহত রইল, তারপর আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল কিছু না ঘটে। আরও কিছু না, কিছু না-এর ফিরে আসা, কিছু না-এর পুত্র, আবার পথে নামল কিছু না। কিছু নার সঙ্গে দেখা হলো নেকড়ে-মানবের…
ঠিক তখনই ঝট করে খুলে গেল দরজা, আনন্দে আরেকটু হলেই চেঁচিয়ে উঠত মোটকু চার্লি।
‘চলো, ব্যায়ামের জন্য উঠোনে যাবার সময় হয়েছে। চাইলে সিগারেট নিতে পারো একটা।’
‘আমি ধূমপান করি না।’
‘অভ্যাসটা এমনিতেও বাজে।’
ব্যায়ামের জায়গাটা খোলা, পুলিস স্টেশনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। চারপাশে দেওয়াল, তার ওপরে কাঁটাতার বসানো। চারপাশটা ঘুরে মোটকু চার্লি সিদ্ধান্ত নিলো, যদি একটা জিনিস ওর মারাত্মক অপছন্দ হয় তা হলো: পুলিসি হেফাজতে থাকা। আসলে পুলিসকে খুব একটা পছন্দই করে না মোটকু চার্লি, কিন্তু আজকের আগপর্যন্ত একটা বিশ্বাসকে লালন করত মনে—কোনো এক ধরনের ক্ষমতা আছে, যাকে হয়তো ভিক্টোরিয়ান যুগে নিয়তি বলা হতো, যা নিরপরাধের মুক্তি আর অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করে। সেই বিশ্বাস মুখ থুবড়ে পড়েছে গত কিছুদিনের অভিজ্ঞতায়, আজ ছিল কফিনের শেষ পেরেক। মোটামুটি বিশ্বাস জন্মেছে মনে, বাকি জীবনটা কেটে যাবে একগাদা অসহিষ্ণু বিচারক আর অত্যাচারীর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে (কল্পনার চোখে সেই অত্যাচারীদের অনেকের চেহারাই কেন যেন ডেইজির মতো দেখাচ্ছে!)। কে জানে, আগামীকাল সকালে ছয় নম্বর সেলে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করবে—রাতের বেলায় সে পরিণত হয়েছে বিশাল একটা তেলাপোকায়। নিঃসন্দেহে ও কোনোভাবে এমন এক অশুভ মহাবিশ্বে চলে এসেছে যেখানে মানুষ রাতের আঁধারে তেলাপোকায় পরিণত হয়…
আচমকা ওপর থেকে কিছু একটা ধপ করে নেমে, কাঁটাতারের ওপর আছড়ে পড়ল। কালো একটা পাখি নিস্পৃহতার সঙ্গে দেখছে ওকে। খানিক পরেই শোনা গেল আরও ডানা ঝাপটানি, বেশ কিছু চড়ুই এবং সম্ভবত একটা সারিল পাখিও এসে যোগ দিল ওটার সঙ্গে।
প্রত্যেকটাই চেয়ে চেয়ে দেখছে ওকে…একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মোটকু চার্লিও।
আরও অনেকগুলো পাখি উপস্থিত হলো খানিকক্ষণের মধ্যেই।
কাঁটাতারের ওপর বসা পাখির ওই দঙ্গলটাকে দেখে ভয় পেয়েছিল মোটকু চার্লি, নাকি অবাক হয়েছিল তা ঠিক মতো বলে বোঝাতে পারবে না। তবে মনের ভেতরে যে অনুভূতিগুলো খেলা করছিল সেই মুহূর্তে, তার প্রথম একশোটার মাঝে ওই দুটো থাকবে। সবচেয়ে বেশি অদ্ভুত লাগছিল পাখিগুলোর আচরণ: ওগুলো না কিচির করছে, না মিচির, না গাইছে আর না করছে গুঞ্জন। চুপচাপ বসে আছে শুধু তারের ওপর, দেখছে ওকে
‘ভাগ্,’ বলল মোটকু চার্লি।
একটাও ভাগল না, কিন্তু… কথা বলে উঠল সবগুলো…একত্রে। ডাকল ওর নাম ধরে।
কোনার দরজার সামনে গিয়ে জোরে জোরে তাতে কিল বসাতে লাগল মোটকু চার্লি। বলল, ‘কেউ শুনছে?’ কয়েকবার এই কথা বলে শুরু করে দিল চিৎকার। ‘সাহায্য করো আমাকে!’
ক্ল্যাঙ্ক করে একটা শব্দ হলো, তারপর খুলে গেল দরজা। চোখ পিটপিট করতে করতে হার ম্যাজেস্টি’স কনস্ট্যাবুলারির এক সদস্য বেরিয়ে এসে বলল, ‘চেঁচাচ্ছ কেন? কারণটা যদি ফালতু হয়…’
ওপরের দিকে ইঙ্গিত করল মোটকু চার্লি, কিছুই বলল না। আসলে বলার দরকারই হলো না। হাঁ হয়ে গেল বেচারা কনস্ট্যাবুলারের মুখ, রইল ওভাবেই। মোটকু চার্লির মা এই অবস্থায় দেখলে তাকে মুখ বন্ধ করতে বলত, নইলে কিছু একটা মুখের ভেতর ঢুকে পড়তে পারে!
হাজারো পাখির ওজনে কাঁটাতারের অবস্থা খারাপ। ছোট্ট ছোট্ট, পাখির চোখগুলো নিষ্পলক চেয়ে আছে ওদের দিকে।
‘আয় হায়,’ বলল পুলিসের লোকটি, তারপর বিনা বাক্য ব্যয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো মোটকু চার্লিকে।
.
প্রচণ্ড কষ্টে আছে মেইভ লিভিংস্টোন, মেঝেতে পড়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে। জ্ঞান ফিরে পেতেই মনে হয়েছে, চেহারা আর চুল যেন ভেজা আর গরম লাগছে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। এরপর চোখ খুলতেই মনে হয়েছে, চেহারা-চুল ঠান্ডা আর আঠা আঠা। বারবার চেতন আর অচেতনের দুনিয়ায়
যাওয়া-আসা করতে লাগল সে; দেখতে লাগল স্বপ্ন। জেগে উঠতেই মাথার পেছনে ব্যথাটা টের পেল খুব করে। ঘুমানোই সহজ বলে মনে হলো তার কাছে, আর ঘুমানোর সময় ব্যথা পাওয়া যায় না বলে নরম, আরামদায়ক কম্বলের মতো করে জড়িয়ে ধরল ঘুমের রাজ্যকে।
স্বপ্নে দেখতে পেল, একটা টেলিভিশন স্টুডিয়োর ভেতর দিয়ে হাঁটছে সে; খুঁজছে মরিসকে। মাঝে-মধ্যে মনিটরে দেখা যায় তার স্বপ্নপুরুষের প্রতিফলন; সবসময় কেমন যেন চিন্তিত দেখায় লোকটাকে। বেরোবার পথ খুঁজে পাবার চেষ্টা করল বটে মেইভ, কিন্তু প্রত্যেকবার ফিরে এলো স্টুডিয়োর মেঝেতে
‘খুব শীত-শীত করছে,’ ভাবল মেইভ। টের পেল, আবার জেগে উঠেছে। ব্যথাটা অবশ্য মিলিয়ে গেছে অনেকটাই। সব মিলিয়ে, ভাবল সে, খারাপ লাগছে না এখন এতটা।
তবে একটা ব্যাপার খেপিয়ে তুলছে ওকে, ব্যাপারটা কী—তা অবশ্য ধরতে পারছে না। হয়তো স্বপ্নের অন্য কোনো অংশ হবে।
কোথায় আছে তা জানে না। তবে যেখানেই থাকুক, জায়গাটা ঝাড়ু রাখার ক্লজিট বলেই মনে হচ্ছে। অন্ধকারে কোনো কিছুর সঙ্গে ঠোক্কর যেন না খায়, সে জন্য হাত বাড়িয়ে চলতে হচ্ছে ওকে। ভয়ে ভয়ে, আর হাত বাড়িয়ে কয়েকটা কদম ফেলল সে; তারপর এতক্ষণ বন্ধ করে রাখা চোখটা খুলল। নিজেকে আবিষ্কার করল একটা কামরায়, যেটাকে সে চেনে। একটা অফিস ওটা।
গ্রাহাম কোর্টসের অফিস।
ঠিক তখনই ওর মনে পড়ে গেল সব। সদ্য ঘুম থেকে উঠলে খানিকটা আচ্ছন্ন লাগে—সে কারণেই পরিষ্কার মাথায় ভাবতে পারছে না। আর মেইভের মাথা তো এক কাপ কফি গেলার আগে কখনওই পরিষ্কার হয় না—তারপরেও মনে পড়ে গেল সব গ্রাহাম কোর্টসের বিশ্বাসঘাতকতা, তার প্রতারণা, লোকটার অপরাধপ্রবণতা, এবং তার…
আরে, ভাবল সে। ও তো আমাকে আক্রমণ করেছিল! আঘাত করেছিল আমাকে। তারপর আরও ভাবল। পুলিস, আমার পুলিসে খবর দেওয়া উচিত।
টেবিলের ওপর রাখা ফোনটার ওপর উবু হলো সে, হাতে তুলে নিলো ওটা…মানে, চেষ্টা করল আরকী। কিন্তু ফোনটাকে খুব ভারী আর পিচ্ছিল, অথবা দুটোই মনে হচ্ছে। ঠিক মতো ধরতেই পারল না! কেন যেন অন্যরকম ঠেকল হাতে।
যতটা ভেবেছি, আসলে তার চাইতেও বেশি দুর্বল হয়ে গেছি, ভাবল মেইভ। পুলিসের পাশাপাশি ডাক্তার পাঠাতেও বলতে হবে।
জ্যাকেটের পকেটে একটা ফোন আছে ওর, ছোট্ট আর রূপালি।
ফোন এলে ‘গ্রিনস্লিভস’ গানের সুরটা বাজে। ওই ফোনটা এখনও জায়গামতোই আছে আবিষ্কার করে স্বস্তি পেল মহিলা, সেটা ধরতেও বেগে পেতে হচ্ছে না। ইমার্জেন্সি সার্ভিসেসের নম্বর ডায়াল করল ফোনে, তারপর অপেক্ষা করতে লাগল ওপাশ থেকে কেউ জবাব দেওয়ার। ভাবতে লাগল— আজও কেন বলা হয় যে নম্বর ‘ডায়াল’ করছে? ওই জিনিসের চল তো উঠে গেছে অনেক আগেই, তখন সে নিজেই কমবয়সী ছিল। ডায়ালঅলা ফোনের পর এলো পাতলা-সাতলা ফোন, যেগুলোতে বোতাম টিপতে হয়; ফোন এলে বিরক্তিকর সুরে বাজত সেগুলো। যখন মেইভ টিনেজার, তখন ওর এক প্রেমিক ছিল; বিরক্তিকর সেই সুর ক্রমাগত নকল করে যেতে পারত ছেলেটা। এখন ভাবতে গেলে মহিলার মনে হয় – সম্ভবত জীবনে বলার মতো ওই একটা কাজই করতে পেরেছিল ছেলেটা। কী অবস্থা তার? ভাবল একবার। ফোনের বিশেষ একটা রিংটোন নকল করতে পারে—এই গুণের অধিকারী মানুষ বর্তমান দুনিয়ায় কী করছে? যেখানে টেলিফোন সবধরনের আওয়াজ করতে সক্ষম…
‘অনাকাঙ্ক্ষিত দেরির জন্য আমরা দুঃখিত,’ যান্ত্রিক একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘দয়া করে লাইনে থাকুন।’
নিজেকে অদ্ভুত রকমের শান্ত ঠেকল মেইভের, যেন খারাপ কিছু কখনও ওর সঙ্গে হওয়া সম্ভবই না।
হঠাৎ ওপাশে শোনা গেল একটা পুরুষ কণ্ঠ। ‘হ্যালো?’ বলল সে। দক্ষতা যেন কণ্ঠস্বরেই উপচে পড়ছে।
‘আমার পুলিসকে দরকার,’ জানাল মেইভ।
‘আপনার পুলিসকে দরকার নেই।’ জবাব দিল কণ্ঠটা। ‘সব ধরনের অপরাধের বিচার করবেন যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ, যাকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় নেই।’
‘মনে হচ্ছে,’ বলল মেইভ। ‘ভুল নম্বরে কল করে ফেলেছি।’
‘একই ভাবে বলা যায়,’ জানাল কণ্ঠটা। ‘সব নম্বরই আসলে সঠিক নম্বর। কেননা নম্বর তো নম্বরই, তার আর ঠিক-বেঠিক কী?’
‘দর্শনটা হয়তো ভালোই ঝেড়েছেন,’ বলল মেইভ। ‘কিন্তু আমার আসলেও পুলিসকে দরকার। সম্ভবত দরকার একটা অ্যাম্বুলেন্সও। আর যেটা ডায়াল করেছি, সেটা ভুল ছাড়া কিছু হতেই পারে না।’ কল কেটে দিল মহিলা। হয়তো, ভাবল সে, ৯৯৯ নম্বরটা সেলফোন থেকে ডায়াল করলে কাজ করে না। অ্যাড্রেস বুক বের করে, বোনকে কল করল এরপর। ‘পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিই একটা কথা: আমি বলছি না জেনে-বুঝে আপনি ভুল নম্বরে কল করেছেন। আমি বলতে চাচ্ছি, সত্তাগত কারণেই প্রতিটা নম্বর সঠিক। একমাত্র পাই বাদে, যা বলাই বাহুল্য। ওটার ব্যাপারে ভাবলেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। চলতে থাকে তো চলতেই থাকে তো চলতে থাকে তো চলতে থাকে…’
লাল বোতাম চেপে কল কেটে দিল মেইভ, এরপর বেছে নিলো ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের নম্বর।
ওপাশ থেকে ভেসে এলো কণ্ঠ, ‘কী সব যে বকছি, এখন কি আর নম্বরের সঠিকত্ব নিয়ে কথা বলার সময়? সব কিছুর উপযুক্ত স্থান, কাল, পাত্র লাগে…’
কেটে দিয়ে এবার মেইভ ফোন করল তার সবচাইতে কাছের বান্ধবীকে।
‘—এই মুহূর্তে আমাদের আলোচনা করা উচিত আপনার অন্তিম গন্তব্য নিয়ে। আজ বিকেলে আত্মার সংখ্যা অনেক বেশি, তাই যেখানে আছ সেখানেই খানিকক্ষণ অপেক্ষা করুন। আপনাকে নিতে কাউকে পাঠানো হবে…’ কণ্ঠে তার আশ্বস্ত করার সুর, অনেকটা রেডিয়োতে প্রচারিত ধর্মপ্রচারকের কণ্ঠের মতো।
মেইভ যদি মানসিকভাবে স্থবির হয়ে না থাকতো, তাহলে তখনই ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু তা না করে, ভাবতে বসল সে। ফোনটাকে বোধহয় কী যেন বলে এটাকে, হ্যাক? – হুম, হ্যাকই করেছে কেউ। তাই রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে খুঁজে বের করতে হবে পুলিস অফিসারকে। আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করতে হবে তাকে। কিন্তু লিফটের বোতাম চাপার পরেও কিচ্ছু হলো না, দেখে হেঁটে নেমে গেল নিচে। ভাবল, এমনিতেও দরকারের সময় ধারে- কাছে পুলিস অফিসার খুঁজে পাওয়ার কথা না। তারা সবসময় গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, সাইরেন বাজায় নে-নর-নি-নর শব্দে। পুলিসের উচিত, ভাবল মেইভ, জোড়া বেঁধে ঘুরে বেড়ানো। ওদের কাজ হবে মানুষকে সময় জানানো আর ড্রেন পাইপের নিচে বসে অপেক্ষা করা, যেন পালাতে উদ্যত ছিঁচকে চোরদের পাকড়াও করতে পারে…
সিঁড়ির একেবারে নিচে, হলওয়েতে, দাঁড়িয়ে আছে দুজন পুলিস অফিসার—একজন নারী এবং অন্যজন পুরুষ। সাদা পোশাকে থাকলেও তাদের পেশা আন্দাজ করতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না। ভুল হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। লোকটা শক্তপোক্ত, চেহারাটাও লাল হয়ে আছে; মেয়েটা ছোটোখাটো, অন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে তাকে সুন্দরীও বলা যেত। ‘এখানে যে এসেছিলেন ভদ্রমহিলা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই,’ বলছে মেয়েটা। ‘রিসেপশনিস্টও সেই কথা বলেছে। লাঞ্চের খানিক আগে উপস্থিত হন তিনি। কিন্তু রিসেপশনিস্ট ফিরে এসে আবিষ্কার করে—দুজনের কেউই অফিসে নেই।’
‘তোমার কি মনে হয় মেইভ লিভিংস্টোন আর গ্রাহাম কোটস হাতে হাত ধরে পালিয়ে গেছে?’ জিজ্ঞেস করল পোক্ত লোকটা।
‘ছিহ, এসব কী কথা?’ ভদ্রভাবেই বলল মেইভ।
‘হতে পারে। সহজ কোনো একটা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে গ্রাহাম কোটসের অন্তর্ধান আর মেইভ লিভিংস্টোনের অন্তর্ধানের পেছনে। কপাল ভালো যে অন্তত ন্যান্সিকে আমরা গ্রেপ্তার করতে পেরেছি।’
‘আমরা পালাইনি,’ বলল মেইভ, কিন্তু ওকে অগ্রাহ্য করল পুলিস দুজন।
পুলিস অফিসার দুজন লিফটে উঠে, দরজা বন্ধ করে দিল। ওদেরকে একেবারে ওপর তলার দিকে যেতে দেখল মেইভ। হাতে তখনও ধরে আছে ফোনটা, আচমকা কেঁপে উঠে ‘গ্রিনস্লিভস’-এর সুর বাজতে শুরু করল ওটা থেকে। ফোনের দিকে তাকাল মহিলা, মরিসের চেহারা ভরিয়ে রেখেছে পর্দাটাকে। নার্ভাস ভঙ্গিতে জবাব দিল মহিলা, ‘হ্যালো?’
‘হ্যালো সোনা, কী খবর?’
‘ভালো আছি, ধন্যবাদ,’ জানাল মেইভ। ‘মরিস?’ একটু পরেই যোগ করল, ‘নাহ, আসলে ভালো নেই।’
‘হুম,’ ওপাশ থেকে ভেসে এলো কথাটা। ‘আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন তো আর করার কিছু নেই; সময় হয়েছে…জীবনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবার।’
‘মরিস, ফোন করছ কোত্থেকে?’
‘ব্যাপারটা একটু জটিল,’ জানাল মরিস। ‘মানে, আমি আসলে ফোন করিনি। তোমাকে সাহায্য করার জন্যই করছি এসব।’
‘গ্রাহাম কোটস,’ ক্ষোভ ঝরল মহিলার কণ্ঠে। ‘একটা প্রতারক।’
‘জানি, সোনা,’ বলল মরিস। তবে এখন ওসব ভুলে যাওয়ার সময়। সব পেছনে ফেলে সামনে এগোও।’
‘আমার মাথার পেছনে বাড়ি মেরে,’ স্বামীকে অভিযোগ করল মহিলা। ‘আমাদের সব টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়েছে!’
‘এসবই পার্থিব সম্পদ, সোনা,’ বোঝাবার ভঙ্গিতে বলল মরিস। ‘অথচ তুমি চলে এসেছ পর্দার ওপাশে…’
‘মরিস,’ বলল মেইভ। ‘ওই জঘন্য কীটটা তোমার স্ত্রীকে খুন করতে চেয়েছিল। তোমার কি উচিত না আরেকটু সমবেদনা জানানো?’
‘সেই পথে হেঁটো না, সোনা। আমি তো শুধু ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে…’
‘তুমি যদি এসব বেহুদা কথা বলতে থাকো, মরিস, তাহলে ব্যাপারটা আমি নিজেই সামলাবো। ভোলার তো প্রশ্নই ওঠে না; তুমি মারা গেছ, তাই তোমার কিছু যায় আসে না। পার্থিব ব্যাপার-নিয়ে ভাবতে হয় না তোমাকে।’
‘তুমিও মারা গেছ, সোনা।’
‘সেটা আসল ব্যাপার না,’ বলল বটে মহিলা। পরক্ষণেই অবাক হয়ে যোগ ‘কী বললে? আমি কী?’ মরিস কিছু বলার আগেই যোগ করল, ‘শোনো, বললাম তো যে আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে লোকটা। সফল হয়েছে, তা তো বলিনি।’
‘উম,’ মৃত মরিস লিভিংস্টোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। ‘মেইভ, সোনা, জানি কথাটা শুনে ধাক্কা খাবে। কিন্তু আসলে তুমি—’
আচমকা ‘ব্লিপ ব্লিপ’ করে উঠল ফোনটা, ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ার ছবি ভেসে উঠল পর্দায়।
‘কী বললে? শুনতে পাইনি, মরিস,’ স্বামীকে বলল সে। ‘টেলিফোনের ব্যাটারি মরতে বসেছে।’
‘তোমার ফোনে ব্যাটারি নেই,’ ওকে জানাল মরিস। ‘আসলে তোমার কোনো ফোনই নেই, সবই ভ্রম। সেটাই তো বলতে চাচ্ছি–তুমি এখন পা রেখেছ পর্দার ওপাশে, এখন পরিণত হচ্ছ…ওই যে বলে না, পোকা থেকে প্রজাপতিতে? অনেকটা সেরকম আরকী।’
‘শূককীট থেকে প্রজাপতিতে…’ শুধরে দিল মেইভ
‘হুম, সেটাই।’ ফোনে মরিসের কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘শূককীটই বলতে চেয়েছি। কিন্তু পোকা তাহলে কী সে পরিণত হয়?’
‘কিছুতেই না, মরিস,’ খানিকটা বিরক্তির সঙ্গেই বলল মেইভ। ‘ওগুলো নিছকই পোকা।’ রূপালি ফোনটা ছোট্ট একটা শব্দ করে উঠল, অনেকটা ঢেকুর তোলার মতো। আবার দেখা দিল ব্যাটারি ফুরিয়ে আসার ছবি, তারপর বন্ধই হয়ে গেল।
যন্ত্রটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল মেইভ। তারপর একদম কাছের দেওয়ালটার সামনে দাঁড়িয়ে, পরীক্ষার করার জন্যই একটা আঙুল দিয়ে খোঁচা দিল তাতে। মনে হলো যেন জেলির মতো কিছু একটায় আঙুল সেঁধিয়ে দিচ্ছে। আরেকটু চাপ দিতেই পুরো হাতটা ঢুকে গেল ভেতরে, তারপর বেরিয়ে এলো ওপাশে!
‘হায় খোদা,’ বলল মেইভ। ভাবল—বহুবারের মতো আরও একবার- মরিসের কথা মন দিয়ে শুনলে খারাপ হতো না। হাজার হলেও লোকটা, নিজের কাছে স্বীকার করল মেইভ, মরার ব্যাপারে অন্তত তার নিজের চাইতে অনেক বেশি জানে। যাক সে কথা, ভাবল সে। মরে যাওয়াটা, বেঁচে থাকার মতোই কিছু একটা হবে: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিখে যাবে যা শেখার, বাকিটা আন্দাজেই করতে হবে।
সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল মহিলা, পরক্ষণেই নিজেকে আবিষ্কার করল আবার দালানটাতেই; পেছন দিকের দেওয়াল গলে উপস্থিত হয়েছে হলে। আবার চেষ্টা করল মেইভ, ফলাফল হলো একই। এরপর দালানের নিচতলায় থাকা ট্রাভেল এজেন্সিতে পা রাখল সে চেষ্টা করল পশ্চিম দিকের দেওয়াল গলে বাইরে বেরোবার।
দেওয়ালের ওপাশে যেতে সফল তো হলো, কিন্তু নিজেকে আবিষ্কার করল আবার সামনের হলে। তবে এবার পূর্বদিক থেকে ঢুকেছে। মনে হচ্ছে, এই অফিস বিল্ডিঙটাই ওর ব্রহ্মাণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে!
ওপর তলায় চলে গেল মেইভ, গোয়েন্দারা কী করছে তা দেখছে। ডেস্কের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে মানুষ দুজন; সুটকেস প্যাক করার সময় নোংরার জন্ম দিয়েছে গ্রাহাম কোটস।
‘আমি কিন্তু,’ আশাবাদী হয়ে বলল মেইভ। ‘পড়ে আছি ওই বুককেসের পেছনে।’
কিন্তু ওকে পাত্তা দিল না পুলিস অফিসাররা।
মেয়ে অফিসারটি উবু হয়ে আছে ময়লার বাক্সের ওপর। ‘বিঙ্গো,’ বলল সে, তারপর বের করে আনল পুরুষের একটা সাদা শার্ট। শুকনো রক্ত লেগে আছে তাতে। প্লাস্টিকের একটা ব্যাগে সেটা ফেলল ও, এদিকে পোক্ত লোকটা পকেট থেকে বের করল ফোন।
‘ফরেনসিক পাঠাও,’ বলল সে।
.
নিজের সেলটাকে এখন আর কয়েদখানা মনে হচ্ছে না মোটকু চার্লির, মনে হচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়। সেলগুলোকে স্থাপন করা হয়েছে দালানের একদম ভেতরে, তাই সবচাইতে উদগ্রীব পাখিটারও এখানে আসতে বেগ পেতে হবে। ছয় নম্বর সেলে কিছু ঘটছে না দেখে আর মন খারাপ হচ্ছে না ওর। কল্পনার চোখে যেসব ঘটনা ঘটতে দেখছে, তার তুলনায় কিছুই না ঘটাও মন্দ না। দুর্গ, তেলাপোকা আর ‘কে’ অক্ষর দিয়ে নাম এমন মানুষে ভরতি একটা ব্রহ্মাণ্ডও আপাতত একযোগে ওর নাম ধরে ডাকতে থাকা পাখির চাইতে ভালো মনে হচ্ছে।
আচমকা খুলে গেল দরজাটা।
‘নক করা শেখোনি?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি।
‘না,’ জবাব দিল পুলিস অফিসার। ‘কয়েদখানায় ঢুকতে আমাদের নক করতে হয় না। তোমার উকিল এসেছে।’
‘মিস্টার মেরিম্যান?’ জিজ্ঞেস করেই থমকে গেল মোটকু চার্লি। লিয়োনার্ড মেরিম্যান মোটাসোটা এক ভদ্রলোক, চোখে ছোট্ট ও সোনার চশমা পরেন। কিন্তু অফিসারের পেছনে লুকিয়ে থাকা মানুষটা না মোটা… আর না তার চোখে চশমা আছে।
‘এবার আপনি যেতে পারেন,’ মোটকু চার্লির উকিল না যে লোকটা, সে জানাল পুলিস অফিসারকে। ‘বাকিটা আমি সামলাচ্ছি।’
‘কাজ শেষে ঘণ্টা বাজাবেন,’ বলে দরজা বন্ধ করে দিল পুলিস অফিসার।
মোটকু চার্লির হাত ধরে বলল স্পাইডার, ‘তোমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবো।’
‘কিন্তু আমি তো পালাতে চাই না। আমি নিরপরাধ।’
‘সেজন্যই তো পালাতে হবে।’
‘কিন্তু পালালে তো একটা অপরাধ করে বসব। পরিণত হবো জেল- পালানো কয়েদিতে!’
‘তুমি কয়েদি নও,’ হাসিখুশি কণ্ঠে বলল স্পাইডার। ‘তোমাকে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়নি। আসলে পুলিসের অনুসন্ধানে সহযোগিতা করছ কেবল। খিদে পেয়েছে?’
‘একটু।’
‘কী চাই? চা? কফি? গরম চকলেট?’
গরম চকলেট হলে খারাপ হতো না, মনে হলো মোটকু চার্লির। ‘গরম চকলেট দাও,’ বলল সে!
‘বেশ তাহলে,’ বলল স্পাইডার। তারপর মোটকু চার্লির হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ‘চোখ বন্ধ করো।’
‘কেন?’
‘তাহলে সহজ হবে!
চোখ বন্ধ করল মোটকু চার্লি, যদিও সহজ হওয়ার ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছে না। আচমকা যেন প্রসারিত হলো দুনিয়াটা, পরক্ষণেই আবার কুঁচকে গেল। মোটকু চার্লি মোটামুটি নিশ্চিত, অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পরক্ষণেই শান্ত হয়ে গেল তার মন, চেহারায় পেল উষ্ণ বাতাসের স্পর্শ।
চোখ খুলল সে।
খোলা বাতাসে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, বিশাল একটা বাজারের মাঝখানে। জায়গাটা কোনো ভাবেই ইংরেজ বলে মনে হচ্ছে না।
‘কোথায় এনে ফেললে?’
‘সম্ভবত জায়গাটার নাম স্কোপসি, ইতালির কোথাও হবে। বহু বছর আগে থেকেই এখানে যাওয়া-আসা করি। অসাধারণ এদের চকলেট, এতটা ভালো অন্য কোথাও পাইনি।’
একটা ছোট্ট, কাঠের টেবিলে বসল ওরা; দমকলের গাড়ির মতো লালে রাঙানো হয়েছে ওটা। এগিয়ে এলো এক ওয়েটার, অদ্ভুত ভাষায় কিছু একটা বলল সে; ভাষাটাকে কোনোভাবেই ইতালিয়ান বলে মনে হলো না মোটকু চার্লির। স্পাইডার বলল, ‘দোস চকোলাটোস, বন্ধু।’ শুনে মাথা নেড়ে চলে গেল ওয়েটার।
‘এবার তাহলে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আমাকে আরও বড়ো গাড্ডায় ফেললে তুমি! পেছনে নিশ্চয়ই পুলিসের লাইন লেগে যাবে, সবগুলো খবরের কাগজে ছাপা হবে আমার পলায়নের খবর!’
‘কর্তৃপক্ষ কী করবে?’ হেসে জিজ্ঞেস করল স্পাইডার। ‘তোমাকে জেলে পাঠাবে?’
‘পাঠাতেও পারে!’
গরম চকলেট চলে এলো, ছোটো কাপে তা ঢালল ওয়েটার। গলিত লাভার মতো তাপমাত্রা ওটার, চকলেট সুপ আর চকলেটের কাস্টার্ডের মাঝামাঝি কিছু একটা মনে হচ্ছে দেখে। দারুণ সুগন্ধ ছড়াচ্ছে ওটা থেকে।
বলল স্পাইডার, ‘দেখো, পারিবারিক পুনর্মিলনির ব্যবস্থা করতে গিয়ে আমরা ঘোঁট পাকিয়ে ফেলেছি, তাই না?’
‘আমরা? আমরা পাকিয়েছি?’ রাগ বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ করতে জানে মোটকু চার্লি। ‘আমি আমার বাগদত্তাকে ভাগাইনি, আমি চাকরি থেকে নিজেকে বের করে দিইনি, এবং আমি আমাকে গ্রেফতার করাইনি—’
‘না,’ বলল স্পাইডার। ‘কিন্তু এই ঝামেলায় পাখিদেরকে জড়ানোর পেছনে তো তোমারই হাত ছিল, নাকি?’
ছোট্ট করে গরম চকলেটে চুমুক দিল মোটকু চার্লি। ‘আউ, জিভ পুড়ে গেছে!’ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই আবিষ্কার করল: স্পাইডারও উদ্বিগ্ন, ভয়ার্ত আর ক্লান্ত চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে। ‘হুম, এসবে আমিই পাখিদেরকে জড়িয়েছি। এখন কী করতে বলো?’
বলল স্পাইডার, ‘এখানে নুডলসের মতো একটা খাবার বানায় ওরা, জানিয়ে রাখলাম আরকী।’
‘আমরা আসলেই ইতালিতে আছি তো?’
‘নাহ।’
‘একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
মাথা নাড়ল স্পাইডার।
কীভাবে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করবে, তা মনে মনে গুছিয়ে নিলো মোটকু চার্লি। ‘পাখিদের ব্যাপারেই; আচমকা সবাই একসঙ্গে দেখা দিয়ে এমন ভাব ধরছিল যেন আলফ্রেড হিচককের ছবির সেট থেকে উঠে এসেছে! এমন কিছু কি শুধু ইংল্যান্ডেই হয়?’
‘কেন?’
‘কারণ আমার মনে হচ্ছে, ওই কবুতরগুলো দেখছে আমাদেরকে।’ বাজার চত্বরের শেষ মাথার দিকে ইঙ্গিত করল সে।
সাধারণত কবুতররা যা করে, সেসব করার দিকে মোটকু চার্লির দেখানো কবুতরদের একদম মন নেই। স্যান্ডউইচের টুকরো ঠোকরানোয়, কিংবা মাথা দোলাতে দোলাতে পর্যটকদের ফেলে দেওয়া খাবারের খোঁজ করছে না ওরা। একেবারে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে দেখছে ওকে আর স্পাইডারকে। পাখা ঝাপটানির আওয়াজ এলো কানে, একটু পরেই ওদের সঙ্গে যোগ দিল আরও প্রায় একশো পাখি; অধিকাংশই নামল চত্বরের মাঝখানে অবস্থিত এক বিশাল হ্যাট পরা মোটা ব্যক্তির মূর্তির ওপর। কবুতরদের দিকে তাকাল মোটকু চার্লি, পাখিগুলোও তাকাল ওর দিকে। ‘কী আর করবে,’ স্পাইডারকে বলল সে। ‘বড়োজোর পায়খানা করবে আমাদের মাথার ওপরে এসে।’
‘আমার তো মনে হচ্ছে, আরও ভয়ানক কিছুও করে বসতে পারে। কথা না বাড়িয়ে, তোমার গরম চকলেট শেষ করে ফেল।’
‘গরম না তো!’
‘কয়েক বোতল পানিরও দরকার পড়বে আমাদের, তাই না? গারকোন[২৫]?’
[২৫ ফরাসি রেস্তোরাঁ বা হোটেলে এই নামেই ওয়েটারদের ডাকা হয়।]
পাখির ডানা ঝাপটানোর নিচু শব্দ শোনা গেল আচমকা, তারপর আরও এক ঝাঁক পাখির উপস্থিত হবার আওয়াজ; সব কিছুর গোড়ায় আছে গোপনীয়তায় ভরা ‘কু-কু’ ডাক।
পানির বোতল নিয়ে উপস্থিত হলো ওয়েটার। স্পাইডার এখন আবার পরে আছে তার কালো-লাল চামড়ার জ্যাকেট; মোটকু চার্লির চোখের সামনে বোতলটা পকেটে ভরল সে।
‘নিছক কবুতরই ওগুলো,’ বলল মোটকু চার্লি। কিন্তু বলার সময়ই টের পেল যে কথাটা ঠিক না। ওগুলো নিছক কবুতর নয়, আসলে ওই পাখিগুলো একটা বাহিনী। মোটা মানুষের মূর্তি এখন ধূসর-বেগুনি পালকের তলে প্রায় হারিয়ে গেছে!
‘আমাদেরকে আক্রমণ করার আগে কিন্তু পাখি-টাখি আমার ভালোই লাগত।’
স্পাইডার বলল, ‘চারপাশে অভাব নেই ওদের!’ বলেই মোটকু চার্লির হাত ধরল সে। ‘চোখ বন্ধ করো।’
সবগুলো পাখি মিলে যেন জন্ম নিলো একটা মাত্র বিশাল পাখি, চোখ বন্ধ করে ফেলল মোটকু চার্লি।
নেকড়ের পাল যেভাবে ঝাঁপ দেয় শিকারের ওপর, সেভাবে ছোঁ মারল কবুতরগুলো।
নীরবতা নেমে এলো চোখের পলকে, অনেক দূরে কোথাও চলে গেল সে…মোটকু চার্লি ভাবল, ওভেনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাকে! চোখ খুলে আবিষ্কার করল, ভাবনাটা ভুল ছিল না: তবে এই ওভেনে রয়েছে লাল বালিয়াড়ি, দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে ওটা; মাদার-অভ-পার্ল-রঙা আকাশের সঙ্গে গিয়ে মিলেছে দিগন্তে।
‘মরুভূমি,’ বলল স্পাইডার। ‘ভাবলাম, জায়গাটা খারাপ হবে না। অন্তত পাখির হাত থেকে তো মুক্তি পাবো! শান্তিতে শেষ করা যাবে আমাদের আলোচনা। এই যে,’ মোটকু চার্লিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল সে।
‘ধন্যবাদ।’
‘এবার বলো, এই পাখিদের আগমন ঘটল কোত্থেকে?’
জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘একটা জায়গা আছে, বুঝলে? ওখানে গেছিলাম। অনেকগুলো পশু-মানব দেখেছি সেখানে। ওরা সবাই, উম, বাবাকে চিনত। তাদের মাঝে একজন ছিল নারী, পাখি-মানবী আরকী।’
ওর দিকে তাকাল স্পাইডার। ‘তা এই জায়গাটা কই? তোমার কথা শুনে কিছুই বোঝা গেল না!’
‘একটা পাহাড়ের পাশে জায়গাটা, পাহাড়ের দেওয়ালে আবার অনেকগুলো গুহামুখ আছে। ঠিক তার ওপাশেই খাদ, অন্য কিচ্ছু নজরে পড়ে না। মনে হচ্ছিল যেন দুনিয়ার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি।’
‘শুরুর প্রান্তে আসলে, শুধরে দিল স্পাইডার। ‘গুহাগুলোর কথা আমি শুনেছি, পরিচিত এক মেয়ে বলেছিল। তবে যাইনি কখনও। তা পাখি-মানবীর সঙ্গে দেখা হলো, এরপর…?’
‘প্রস্তাব দিল, তোমাকে ভাগিয়ে দেবে। তাই আমি, মানে, উম, রাজি হয়ে গেলাম।’
‘কাজটা,’ চলচ্চিত্র অভিনেতার মতো করে হাসল স্পাইডার। ‘চরম বোকার মতো কাজ হয়েছে।’
‘তোমার কোনো ক্ষতি করতে মানা করেছিলাম।’
‘আর কীভাবে আমাকে ভাগাত বেটি? চিঠি লিখে?’
‘তা জানি না, ভেবে দেখিনি। মন-টন খারাপ ছিল অনেক।’
‘অসাধারণ। যাক গে, পাখি-মানবী তার ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারলে তোমার মন আরও খারাপ হবে…আর আমি? মরব। আমাকে অনুরোধ করলেই তো পারতে, চলে যেতাম!’
‘করেছিলাম তো!’
‘অ্যাঁ? জবাবে কী বলেছিলাম?’
‘বলেছিলে আমার বাড়ি তোমার পছন্দ হয়েছে, তাই অন্য কোথাও যাচ্ছ না!’
পানি পান করল স্পাইডার। ‘তা পাখি-মানবীকে ঠিক কী বলেছিলে তুমি?’
মনে করার চেষ্টা করল মোটকু চার্লি। এখন ওর বলা কথাটা অদ্ভুত ঠেকছে নিজের কাছেই। ‘বলেছিলাম যে আনানসির বংশধর তাকে দেব,’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও জানাল সে।
‘কী?’
‘পাখি-মানবী আমাকে সেটাই বলতে বলেছিল।’
হতভম্ব দেখাল স্পাইডারকে। ‘কিন্তু আনানসির বংশধর শুধু আমি একা নই, তুমিও!’
আচমকা শুকিয়ে গেল মোটকু চার্লির মুখ। মনে মনে আশা করল, তার কারণ যেন মরুভূমির বাতাস হয়! তারপর নিজের বোতল থেকে পানি পান করল।
‘কিন্তু…’ প্রশ্ন করল সে। ‘মরুভূমিতে নিয়ে এলে কেন?’
‘এখানে পাখি নেই, বললাম না একটু আগেই!’
‘তাহলে ওগুলো কী?’ ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল সে। প্রথমে দেখা গেল ছোট্ট কিছু বিন্দু; পরে বোঝা গেল, আসলে ওগুলো অনেক ওপরে আছে বলে ছোটো দেখাচ্ছে। চক্কর কাটছে পাখিগুলো, টলছে প্রবলভাবে।
‘শকুন,’ স্পাইডার জবাব দিল। ‘ওরা জীবিত প্রাণিকে আক্রমণ করে না।’
‘ঠিক ঠিক, আর কবুতর তো খুব করে?’ বিদ্রূপ করল মোটকু চার্লি। আকাশের বিন্দুগুলো আরও নিচে নেমে এলো, ক্রমেই বড়ো হচ্ছে পাখিগুলো।
এবার মুখ খুলল স্পাইডার। ‘কথা সত্য,’ পরক্ষণেই যোগ করল। ‘আরে ধুর!’
ওরা একা নেই এখানে, দূরের একটা বালিয়াড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে কেউ একজন দেখছে ওদেরকে। অন্য কেউ দেখলে হয়তো সেই কেউ একজনকে কাকতাড়ুয়া ভাবত!
চেঁচিয়ে উঠল মোটকু চার্লি। ‘ভাগো এখান থেকে!’ মরুর বালি গিলে খেল ওর কণ্ঠ। ‘সব ফিরিয়ে নিলাম, চুক্তি বাতিল! একা থাকতে দাও আমাদেরকে!’
উষ্ণ বাতাসে কেঁপে উঠল একটা ওভারকোট, বালিয়াড়ি শূন্য হয়ে গেল।
বলল মোটকু চার্লি, ‘চলে গেছে বেটি। কে ভেবেছিল যে কাজটা এত সহজ হবে?’
ওর কাঁধ স্পর্শ করল স্পাইডার, তারপর ইঙ্গিতে দেখাল দূরের একটা জায়গা। বাদামি ওভারকোট পরে থাকা খানিক আগের মহিলাটাই এখন দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা বালিয়াড়ির ওপরে। এতটাই কাছে যে তার চোখের কালো, ঘষা কাচের দৃষ্টি পরিষ্কার দেখতে পেল মোটকু চার্লি।
শকুনগুলো খানিকক্ষণ কালো ছায়া ফেলে, অবশেষে ল্যান্ড করল মাটিতে। পালকহীন, উজ্জ্বল বেগুনি বর্ণের গলা ও মাথা—পালকহীন কেননা মরা লাশে ঠোঁট বসিয়ে দিতে সহজ হয় তাতে—বাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল দুই ভাইয়ের দিকে। মনে হলো যেন ভাবছে—মানুষ দুটোর মরার জন্য অপেক্ষা করবে, নাকি ব্যাপারটা তরান্বিত করার জন্য কিছু করবে?
জবাব দিল স্পাইডার। ‘আর কিছু ছিল চুক্তির শর্ত?’
‘উম?’
‘আর কিছু ছিল? চুক্তি চূড়ান্ত, তার প্রমাণ হিসেবে তোমাকে কিছু দেয়নি? সাধারণত লেন-দেনের ক্ষেত্রে এমনটা করা হয়।’
আস্তে আস্তে, এক কদম এক কদম করে এগিয়ে আসছে শকুনের দল; বৃত্তটাকে সঙ্কুচিত করে আনছে। আকাশে দেখা দিল আরও অনেকগুলো কালো বিন্দু, ক্রমশই বাড়ছে আকৃতিতে। মোটকু চার্লির হাত শক্ত করে ধরল স্পাইডার।
‘চোখ বন্ধ করো।’
এবার ঠান্ডাটা একদম ঘুসির মতো আঘাত হানল মোটকু চার্লির পেটে। লম্বা একটা শ্বাস নিতেই মনে হলো, কেউ বুঝি ওর ফুসফুসে বরফ ঢুকিয়ে দিয়েছে। কাশতে কাশতে উবু হয়ে গেল বেচারা, এদিকে বাতাস তখন প্রকাণ্ড কোনো দানবের মতো গর্জন করে চলেছে।
চোখ খুলল সে। ‘এবার কোথায় এসে পড়েছি, তা জানতে পারি?’
‘অ্যান্টার্কটিকা,’ জবাব দিল স্পাইডার। লেদার জ্যাকেটের জিপ টেনে দিল সে, যদিও মনে হলো না ঠান্ডা তার ওপর প্রভাব ফেলেছে। ‘একটু ঠান্ডা অবশ্য।’
‘ধূসর কিছু কল্পনা করতে পারো না? সাদা থেকে সরাসরি কালোতে?’
‘এখানে পাখি নেই,’ জানাল স্পাইডার।
‘এরচেয়ে বরং এমন কোনো দালানে বসলে ভালো হতো না, যেখানে
পাখি ঢুকতে পারবে না? দুপুরের খাবারটাও হয়ে যেতো।’
স্পাইডার বলল, ‘আরে! একটু নাহয় ঠান্ডা, তাই বলে এত গরম হচ্ছ কেন?’
‘একটু না, শূন্যের নিচে পঞ্চাশ ডিগ্রি হবে। যাই হোক, দেখো।’
আকাশের দিকে ইঙ্গিত করল মোটকু চার্লি। একটা ধূসর রেখা, অনেকটা ইংরেজি এম অক্ষমের মতো, দেখা দিয়েছে আকাশে। ঠান্ডা বাতাসে নিশ্চল হয়ে ভেসে আছে বলা চলে। ‘অ্যালবাট্রস,’ বলল সে।
‘ফ্রিগেট,’ বলল স্পাইডার।
‘কী?’
‘ওটা অ্যালবাট্রস না, ফ্রিগেট। সম্ভবত এখনও আমাদেরকে দেখেনি।’
‘তা হতে পারে,’ মেনে নিলো মোটকু চার্লি। ‘তবে ওগুলো দেখেছে।’ ঘুরে দাঁড়াল স্পাইডার, কিছু একটা বলল যা শুনে ‘ফ্রিগেট’-এর কাছাকাছি কিছু একটা বলে মনে হলো। প্রায় এক মিলিয়ন পেঙ্গুইন দুলতে দুলতে এগোচ্ছে দুই ভাইয়ের দিকে। অন্তত দেখে সংখ্যাটা সেটাই মনে হলো। প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে, পেঙ্গুইনদের আসতে দেখলে ভয় পাওয়ার কথা কেবল ছোট্ট মাছের; কিন্তু ঝাঁকটা এত বড়ো হলে…
… প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগা সত্ত্বেও মোটকু চার্লি হাত বাড়াল স্পাইডারের দিকে, তারপর বন্ধ করে ফেলল চোখ।
এরপর যখন খুলল, তখন নিজেকে আবিষ্কার করল খানিকটা উষ্ণ আবহাওয়ায়; যদিও চোখ খুলে আলাদা কিছু দেখতে পেল না। সব কিছুই মেখে আছে রাতের রং। ‘অন্ধ হয়ে গেলাম নাকি?’
‘পরিত্যক্ত একটা কয়লা খনিতে আছি আমরা এখন,’ জানাল স্পাইডার। ‘কয়েক বছর আগে একটা ম্যাগাজিনে ছবি দেখেছিলাম। অন্ধ ফিঞ্চের দল যদি কয়লার টুকরো খাওয়ার অভ্যাস করে এখানে ডেরা না বাঁধে, তাহলে আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।’
‘ঠাট্টা করলে? অন্ধ ফিঞ্চ?’
‘তা বলা যায়।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোটকু চার্লি, ভূগর্ভস্থ খনির এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত শোনা গেল সেই আওয়াজ। ‘সত্যি বলতে কী,’ বলল সে। ‘যদি আমার কথা শুনে তখনই চলে যেতে, তাহলে এই ঝামেলায় পড়তে হতো না আমাদেরকে।’
‘এখন আর সে কথা বলে কী লাভ?’
‘এত কিছু হবে, তা তো তখন বুঝিনি। খোদাই জানে, রোজিকে এসব কীভাবে বোঝাব!’
গলা খাঁকারি দিল স্পাইডার। ‘সেই দুশ্চিন্তা বোধহয় আর করতে হবে না।’
‘কেন? হবে না কেন?’
‘ও আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছে।’
অনেকক্ষণ নীরবতার পর মোটকু চার্লি বলল, ‘তা তো করবেই।’
‘পরিস্থিতি ওই অংশটায় আমিই গোলমাল পাকিয়েছি,’ অস্বস্তি ভরা কণ্ঠে বলল স্পাইডার।
‘আমি বুঝিয়ে বললে কাজ হবে না? মানে, যদি বলি যে আসলে তুমি আমি হবার ভান ধরেছিলে–’
‘তা বলেছি তো। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমাদের কারও সঙ্গেই সে
দেখা করতে চায় না।’
‘আমার সঙ্গেও না?’
‘সেটাই তো বলল।’
‘দেখো,’ অন্ধকারে শুধু স্পাইডারের কণ্ঠ শোনা গেল। ‘আমার কখনও ইচ্ছে ছিল না তোমাকে…মানে যখন দেখতে এসেছিলাম, তখন শুধু হাই- হ্যালো বলার ইচ্ছেই ছিল। কিন্তু, মানে, এত কিছু যে হয়ে যাবে তা কখনও ভাবিনি!’
‘দুঃখ প্রকাশ করতে চাচ্ছ?’
নীরবতা। তারপর, ‘সম্ভবত…হ্যাঁ।’
আরও খানিকক্ষণের নীরবতা। মোটকু চার্লি বলল, ‘তাহলে আমি দুঃখিত, পাখি-মানবীকে তোমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিলাম বলে।’ একে-অন্যকে দেখতে পাচ্ছে না বলে, কথা বলাটা তুলনামূলক সহজ হয়ে গেছে।
‘হুম, ধন্যবাদ। এখন ওকে ভাগাতে পারলে বাঁচি!’
‘একটা পালক!’ আচমকা চেঁচিয়ে উঠল মোটকু চার্লি।
‘কী? বুঝতে পারলাম না।’
‘জিজ্ঞেস করেছিলে না, চুক্তি চূড়ান্ত বোঝাতে আমাকে সে কিছু দিয়েছিল নাকি? দিয়েছিল, একটা পালক।’
‘সেটা কই?’
মনে করতে চাইল মোটকু চার্লি। ‘খেয়াল করতে পারছি না। মিসেস ডানউইডির বসার ঘরে যখন ঘুম থেকে উঠি তখন হাতেই ছিল। কিন্তু বিমানে যখন চড়ি, তখন সঙ্গে ছিল না। মহিলার বাড়িতেই থাকার কথা।’
এরপরের নীরবতাটুকু যেমন লম্বা, তেমনি অন্ধকার আর স্থির। মোটকু চার্লি তো ভয়ই পেয়ে গেল, ভাবল: স্পাইডার চলে যায়নি তো? হয়তো অন্ধকার এই ভূগর্ভস্থ জায়গায় ফেলে গেছে ওকে। অবশেষে বলল, ‘এখনও আছ?’
‘আছি।’
‘শান্তি পেলাম। এখানে যদি ফেলে যাও, তাহলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। বেরোবার পথ খুঁজে পাবো না।’
‘পাগলকে সাঁকো নাড়াতে বলতে হয় না!’
আবারও নীরবতা।
‘আমরা কোন দেশে আছি?’ জানতে চাইল মোটকু চার্লি।
‘পোল্যান্ডে…খুব সম্ভবত। যা বলেছিলাম, ছবি দেখেছিলাম শুধু আগে।
তবে সেই ছবিতে বাতি জ্বলছিল।’
‘কোথাও যাওয়ার দরকার হলে, তার ছবি দেখতে হয় তোমাকে?’
‘জায়গাটা কোথায়, তা আমার জানতে হয়।’
খনির ভেতরটা কী পরিমাণ নীরব, ভাবল মোটকু চার্লি, তা আসলেই বিস্ময়কর। বিশেষ একধরনের নীরবতা জমে আছে এখানে। নীরবতা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিল সে। কবরস্থানের নীরবতার সঙ্গে কি মহাবিশ্বের নীরবতার পার্থক্য আছে?
বলল স্পাইডার। ‘মিসেস ডান উইডির কথা আমার মনে আছে। ধুনোর গন্ধ পাওয়া যায় তার কাছ থেকে।’ কিন্তু হতাশা ভরা কণ্ঠে। আর আশা নেই, মরতে আমাদের হবেই–এই কথা বলার সময়ও বক্তার কণ্ঠে আগ্রহ বেশি থাকে।
‘হ্যাঁ, সে-ই।’ বলল মোটকু চার্লি। ‘ছোটোখাটো, পাহাড়ের মতো বয়স্কা। চোখে পুরু কাচের চশমা থাকে। তার কাছে গিয়ে পালকটা নিয়ে আসতে হবে আরকী। তারপর সেটা তুলে দেব পাখি-মানবীকে, এই দুঃস্বপ্নের একটা ইতি টানা যাবে।’ বোতলের পানির শেষটুকুও গলাধকরণ করল মোটকু চার্লি, ইতালির সেই বাজার থেকে এই পর্যন্ত বয়ে এনেছে ওটাকে। বোতলের মুখ লাগিয়ে, খালি বোতলটাকে অন্ধকারেই ফেলে দিল; ভাবল: কেউ যদি না দেখে, তাহলে যত্র-তত্র ময়লা ফেলাটাকে কি অপরাধ বলা চলে? ‘তাই হাতে হাত ধরে চলো মিসেস ডানউইডির সঙ্গে দেখা করতে যাই।’
আওয়াজ করল স্পাইডার, যদিও সেটাকে খুব একটা বীরোচিত মনে হলো না। বরঞ্চ ছেলেটার অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তাই পরিষ্কার হলো তাতে। অন্ধকারে কল্পনা করল মোটকু চার্লি, স্পাইডার ধীরে ধীরে চুপসে যাচ্ছে…অনেকটা বুলফ্রগ কিংবা এক হপ্তা আগে ফোলানো বেলুনের মতো। স্পাইডারের উচিত শিক্ষা দেখার অপেক্ষায় ছিল মোটকু চার্লি, কিন্তু ওর কাছ থেকে ছয় বছর বয়সী ভীত বাচ্চার মতো আচরণ পাওয়ার আশা করেনি। ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। মিসেস ডানউইডিকে ডরাও নাকি?’
‘তা-তার কাছে যাওয়ার সাহস হয় না।’
‘অন্তত এই একটা ব্যাপার ভালো লাগল। আমিও তাকে ভয় পাই! পাই মানে পেতাম, সেই কম বয়সে। পরে আবার দেখা হলো শেষকৃত্যানুষ্ঠানে, তখন আর তাকে অতটা ভয়ংকর লাগেনি। মানে আগের মতো না। তিনি বয়স্কা এক নারী বাদে আর কিছু না।’ মনের চোখে দেখতে পেল, মহিলা পেঙ্গুইনের মতো দেখতে কালো মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। ‘খানিকটা অন্যরকমও। তবে তার সঙ্গে দেখা হলে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।’
‘আমাকে তিনিই তাড়িয়ে দিয়েছিলেন,’ বলল স্পাইডার। ‘আমি যেতে চাইনি। তার বাগানে বল ফেলেছিলাম, ক্রিসমাসের গাছ সাজাবার অলংকারের মতো বড়ো ছিল ওটা।’
‘আমি করেছিলাম কাজটা, মহিলা খেপে গেছিল!’
‘জানি আমি,’ অন্ধকার থেকে ভেসে আসা কণ্ঠটার মালিককে দুর্বল আর বিভ্রান্ত বলে মনে হলো। ‘একই সময়ের কথা বলছি আমরা… সব কিছুর শুরু ওখান থেকেই।’
‘দেখো, কাজটা করা মানে তো আর দুনিয়া ধ্বংস হওয়া না। ফ্লোরিডাতে নিয়ে যাবে আমাকে, আমিই নাহয় মিসেস ডানউইডির কাছ থেকে পালকটাকে ফিরিয়ে আনব। তাকে আমি ভয় পাই না, তোমার ধারে-কাছে যাওয়ার দরকার নেই।
‘পারব না। তিনি যেখানে আছেন, সেখানে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।’
‘মানে কী? কী বলতে চাচ্ছ? জাদুর রেস্ট্রেইনিং অর্ডারের[২৬] ব্যবস্থা করেছে নাকি তোমার নামে?’
[২৬. আদালত-কর্তৃক প্রদত্ত নিষেধাজ্ঞা, যার কারণে কারও কাছ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকতে হয়।]
‘অনেকটা তেমনই, হ্যাঁ।’ জানাল স্পাইডার। তারপর যোগ করল, ‘রোজির অভাব খুব করে বোধ করছি। ওই ব্যাপারটা নিয়ে আমি দুঃখিত। আশা করি তুমি তা জানো।’
রোজির কথা ভাবল মোটকু চার্লি। মেয়েটার চেহারা মনে করতেই বেগ পেতে হচ্ছে ওকে। রোজির মাকে নিজের শাশুড়ি হিসেবে না ভাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল সে। ভুলতে চাইল পর্দায় দেখা দুটো অবয়বের এক হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটাকেও। বলল, ‘মন খারাপ করে লাভ কী? অবশ্য চাইলে করতে পারো, কেননা আস্ত একটা হারামির মতো আচরণ করেছ! তবে হয়তো সেটাই সবার জন্য ভালো হয়েছে।’ মোটকু চার্লির অন্তরের একটা অংশ খানিকটা মোচড় খেল বটে, তবে জানে যে কথাটা মিথ্যে বলেনি। অন্ধকারে সত্যি কথাটা বলে ফেলা সহজ।
স্পাইডার বলল, ‘একটা জিনিস পরিষ্কার ধরতে পারছি না। সেটা কী, জানো?’
‘সব কিছু?’
‘নাহ, একটা বিশেষ ব্যাপার। পাখি-মানবী কেন যোগ দিল এসবে, সেটাই বুঝতে পারছি না।’
‘বাবার কারণে খেপে ছিল—’
‘বাবার ওপর সবাই খেপা ছিল। কিন্তু কারণ সেটা না। যদি আমাদেরকে খুন করার ইচ্ছেই ওদের থাকে, তাহলে সরাসরি সেই চেষ্টা কেন করছে না?’
‘ওকে আনানসির বংশধর আমিই দিয়েছি।’
‘সে তো বললেই। কিন্তু এখানে কোনো কিন্তু আছে, যেটা আমি ধরতে পারছি না।’ খানিকক্ষণের নীরবতার পর যোগ করল, ‘আমার হাত ধরো।’
‘চোখ বন্ধ করতে হবে?’
‘করলেই তো ভালো হয়।’
‘এবার কই যাচ্ছি? চাঁদে?’
‘নিরাপদ কোথাও নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে,’ জানাল স্পাইডার।
‘ভালো,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘নিরাপত্তা আমার পছন্দ। কিন্তু কোথায়?’ কিন্তু পরক্ষণেই, চোখ না খুলেই মোটকু চার্লি জেনে গেল সেই প্রশ্নের উত্তর। গন্ধেই পরিষ্কার হয়ে গেল সব: আধোয়া দেহ আর ফ্ল্যাশ না করা টয়লেট, জীবাণুনাশক, পুরাতন কম্বল আর ঔদাসীন্য।
‘বিলাসবহুল হোটেলের কামরাতেও আমি সমান নিরাপত্তা পেতাম।’ উচ্চকণ্ঠে আপত্তি জানাল সে। কিন্তু ওর কথা শোনার মতো কেউ যে নেই আশপাশে! ছয় নম্বর সেলের শেলফের মতো বিছানায় বসে পড়ল সে, হালকা কম্বলটা দিয়ে কাঁধ জড়াল। এখান থেকে যে খানিকক্ষণের জন্য চলে গিয়েছিল তা বোঝার কোনো উপায়ই নেই!
আধ-ঘণ্টা পর, একজন এসে ওকে জিজ্ঞাসাবাদের কামরায় নিয়ে গেল।
.
‘হ্যালো,’ বলল ডেইজি, হাসিমুখে। ‘চা দিতে বলব?’
‘দরকার কী? আর এত কষ্ট না করলেও চলবে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘টেলিভিশন আমি কম দেখি না। কীভাবে কী করা হয়, তাও জানি। ভালো- কপ আর খারাপ-কপের নাটক তো? তুমি আমাকে চা দেবে, দেবে কেক; তারপর বড়োসড়ো কোনো রুক্ষ স্বভাবের পুলিস এসে আমাকে চেঁচিয়ে ভয় দেখাবে; তারপর চা ঢেলে ফেলে আমার কেক নিজের মুখে পুরে ভাব করবে মারার। তুমি তখন তাকে থামাবে, ফিরিয়ে দেবে চা-কেক। কৃতজ্ঞতাবশত আমি তোমার সব প্রশ্নের জবাব দিতে থাকব!’
‘সেসব নাহয় অন্য কোনো দিনের জন্য তোলা থাক,’ বলল ডেইজি। ‘আমরা যা জানতে চাই, সরাসরি বলে দাও সব। তাছাড়া চা থাকলেও, কেক নেই আমাদের কাছে।’
‘যা আমার জানা আছে, সব বলে দিয়েছি আগেই,’ জানাল মোটকু চার্লি ‘শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আমাকে দুই হাজার পাউন্ডের একটা চেক দিয়ে গ্রাহাম কোটস দুই হপ্তার ছুটি দিয়ে দেয়। বলেছিল, লেনদেন-সংক্রান্ত কিছু ঘাপলা তাকে দেখিয়েছি বলে সে খুশি। তারপর আমার পাসওয়ার্ড জানতে চাইল। বলে দিতেই বিদেয় জানাল আমাকে। গল্প শেষ।’
‘মেইভ লিভিংস্টোনের অন্তর্ধানের ব্যাপারে কিচ্ছু জানো না—এই দাবি এখনও করে যাচ্ছ?’
‘আমার সঙ্গে আসলে তার কখনও ঠিকঠাক মতো দেখাই হয়নি। একবার বোধহয় অফিসে এসেছিল, ব্যস। ফোনে কয়েকবার কথা-বার্তা হয়েছে। তিনি গ্রাহাম কোর্টসের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আমাকে বলতে হবে, ডাকে আছে চেক–বসের নির্দেশ এটাই ছিল।’
‘কথাটা কি সত্যি?’
‘জানি না। তখন ভাবতাম যে সত্যি। আচ্ছা, তুমি কি আসলেই বিশ্বাস করো যে তার অন্তর্ধানে আমার হাত আছে?’
‘না,’ আনন্দচিত্তে বলল মেয়েটা। ‘তা আমি মনে করি না।’
‘কারণ আমি আসলেই জানি যে কেন—কী বললে?’
‘আমার মনে হয় না মেইভ লিভিংস্টোনের পেছনে তোমার হাত আছে। দ্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সির অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণও তুমি বলে আমি বিশ্বাস করি না, যদিও অনেকে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তোমাকে ফাঁসাবার জন্য। তবে হিসেব রক্ষণের অদ্ভুত ধরন আর টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া তোমার ওখানে চাকরি নেবার আগে থেকেই বলবত আছে। আর তোমার চাকরির বয়েস তো ঠিক দুই বছরও হয়নি!’
‘প্রায় দুই বছরই।’ জানাল মোটকু চার্লি। টের পেল হাঁ হয়ে আছে চোয়াল, তাই বন্ধ করে দিল।
ডেইজি বলল, ‘বই আর মুভিতে যে পুলিসকে দেখানো হয় তারা যে মূলত বলদ—তা আমি জানি; বিশেষ করে যদি তাতে অপরাধের সঙ্গে লড়াই করা কোনো নায়ক কিংবা রুক্ষ স্বভাবের গোয়েন্দা থাকে তো। কেক-টেক নেই, সেজন্য অন্তর থেকে ক্ষমা চাইছি। তবে একটা কথা জেনে রাখো, আমরা একেবারে কাঠ-বলদ নই!’
‘সে কথা তো আমি বলিনি,’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি।
‘বলোনি,’ বলল মেয়েটা। ‘তবে ভাবছিলে তো। তুমি মুক্ত, চাইলে চলে যেতে পারো। এমনকী চাইলে আমরা ক্ষমা প্রার্থনাও করব।’
‘কিন্তু ভদ্রমহিলা, মানে, গেছেন কই?’ মোটকু চার্লি জানতে চাইল।
‘মিসেস লিভিংস্টোন? শেষ তাকে দেখা গেছে গ্রাহাম কোটসের সঙ্গে অফিসে ঢুকতে।’
‘আহ।’
‘চায়ের প্রস্তাব কিন্তু সত্যি সত্যি দিয়েছি। পান করবে?’
‘অবশ্যই, খুশি মনে। উম, গ্রাহাম কোটসের অফিসে যে গোপন কামরাটা আছে, ওখানে খুঁজেছ তো? বুককেসের পেছনের কামরাটা?’
ডেইজি নিজের ওপর পরম নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ রেখে শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘মনে হয় না খুঁজে দেখেছে।’
‘অবশ্য কারও ওটার খোঁজ জানারও কথা না,’ মোটকু চার্লি জানাল। ‘তবে আমি একবার গেছিলাম অফিসে। দেখি—বুককেসটা পেছনে সরানো, ভেতরে আছে গ্রাহাম কোটস। দেখেই বেরিয়ে আসি,’ যোগ করল সে। তার ওপর নজর রাখছিলাম না কিন্তু।’
ডেইজি জানাল, ‘যাওয়ার পথে কেক কিনে নেওয়া যাবে।’
.
মোটকু চার্লি বুঝতে পারছে না, স্বাধীনতা ওর পছন্দ হচ্ছে কি না। চারপাশে এত খোলা জায়গা ঠিক হজম করতে পারছে না।
‘ঠিক আছ?’ জিজ্ঞেস করল ডেইজি।
‘আছি।’
‘একটু তটস্থ মনে হচ্ছে।’
‘তা একটু আছি। শুনলে হাসবে কিন্তু আমি–আসলে পক্ষীকুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না।’
‘মানে? ফোবিয়া?’
‘অনেকটা তেমনিই।’
‘পাখিদের প্রতি অযৌক্তিক ভয়ের নাম তো ওটাই।’
‘যৌক্তিক ভয় হলে, তাকে কী নামে ডাকা হতো?’ কেকে কামড় বসাল সে।
ক্ষণিক নীরবতার পর ডেইজি বলল, ‘যাই হোক, এই গাড়িতে পাখি-টাখি নেই।’
দ্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সির ঠিক বাইরের জোড়া হলদে লাইনে গাড়ি পার্ক করল মেয়েটা, তারপর মোটকু চার্লিকে সঙ্গে নিয়ে পা রাখল অফিসে।
.
একটা কোরিয়ান ক্রুজ শিপের[২৭] অ্যাফট ডেকে রোদ পোহাচ্ছে রোজি। চেহারা ঢেকে রেখেছে ম্যাগাজিন দিয়ে, পাশেই শুয়ে আছে তার মা। মনে করতে চাইছে মেয়েটা, মায়ের সঙ্গে ছুটি কাটাতে আসার এই বুদ্ধিটা কেন ভালো মনে হয়েছিল?
[২৭. কদিন আগেও জাহাজটার নাম ছিল দ্য সানি আর্কিপেলাগো, কিন্তু যাত্রী ও কর্মীদের মধ্যে আচমকা উদরাময় দেখা দেওয়ায় তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মুখরোচক খবরে পরিণত হয়। নামের আদ্যক্ষর (ইংরেজিতে এস আর এ) ঠিক রেখে নতুনভাবে জাহাজটাকে পানিতে নামার সিদ্ধান্ত নেয় বোর্ডের চেয়ারম্যান। কিন্তু নিজেকে সে ইংরেজির জাহাজ মনে করলেও, আসলে তার ইংরেজি জ্ঞান খুবই খারাপ। তাই নতুন ভাবে জাহাজের নাম হয়: দ্য স্কুইক অ্যাটাক (লেখক)।]
ক্রুজ শিপে ইংরেজি খবরের কাগজ নেই, অবশ্য রোজি সেগুলোর অভাবও বোধ করছে না। কিন্তু বাকি সব কিছুর অভাব খুব করে বোধ করছে। রোজির কাছে ক্রুজটা আসলে পানিতে ভাসতে থাকা পারগেটরির[২৮] মতো, একদিন পরপর দ্বীপে পা রাখতে হয় বলে কোনোক্রমে সহ্য করতে পারছে।
[২৮. ক্যাথলিক ধর্মমত অনুসারে, আত্মাকে স্বর্গে প্রবেশের আগে যে স্থান দিয়ে অতিক্রম করতে হয়।]
অন্যান্য যাত্রীরা দ্বীপে গিয়ে এটা-সেটা কেনাকাটা করে, আর উপভোগ করে প্যারাসেইলিং। কেউ কেউ হয়তো ভাসমান জলদস্যু জাহাজে চড়ে পানিতেও ভাসে। রোজি অবশ্য সেসব না করে হাঁটতে বেরোয়, কথা বলে মানুষের সঙ্গে। দেখতে পায় মানুষের কষ্ট, তাদের ক্ষুধা আর দুর্ভোগ। তাদেরকে সাহায্য করতে চায় সে, ওর কাছে সবই সমাধান করার মতো সমস্যা…
…শুধু দরকার এমন একজনকে, যে আগ্রহের সঙ্গে সেটা করার দায়িত্ব নেবে।
.
মরণকে অনেক বিশেষণেই ভূষিত করা যায়…অন্তত মেইভ লিভিংস্টোনের সেটাই মত। কিন্তু বিরক্তিকর তাদের মধ্যে নেই। অথচ বিরক্তি পেয়ে বসেছে তাকে। দেওয়াল ভেদ করে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বিরক্ত, সবাই অগ্রাহ্য করছে বলে বিরক্ত…তবে সবচাইতে বেশি বিরক্ত, অলডউইচের এই অফিস বিল্ডিঙটা থেকে বেরোতে না পেরে।
‘ভূত হয়ে যদি কোথাও আছর করতেই হয়,’ রিসেপশনিস্টকে বলল সে। ‘তাহলে সমারসেট হাউজে কেন না? রাস্তার ওপাশেই তো! দালানটাও সুন্দর, থেমসের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়। নকশার দিক থেকেও বেশ দারুণ। কয়েকটা ভালো, ছোটো রেস্তোরাঁও আছে। খাবার খাওয়ার দরকার না পড়লেও, অন্যকে খেতে দেখতে খারাপ লাগে না।’
রিসেপশনিস্ট অ্যানি, যার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রাহাম কোটস উধাও হবার পর ফোন ধরে ‘আমি দুঃখিত, জানা নেই’ বলে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, এবং ফাঁকা সময়ে উত্তেজিত, নিচু কণ্ঠে বন্ধু-বান্ধবদের ফোন দিয়ে এই রহস্য নিয়ে কথা বলা, মেইভের কথার পিঠে কিছু বলল না; অবশ্য মহিলার আগে বলা কোনো কথারও জবাব দেয়নি মেয়েটা।
একঘেয়েমিতে ছেদ পড়ল মোটকু চার্লি ন্যান্সির আগমনে, সঙ্গে এসেছে সেই নারী-পুলিস অফিসার। ছেলেটাকে পছন্দই হয়েছে মেইভের। যদিও তার একমাত্র কাজ ছিল, ডাকযোগে অচিরেই চেক এসে পৌঁছাবে—এ কথা বারবার মেইভকে জানানো। তবে এখন এমন অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছে মহিলা যা আগে দেখেনি: মোটকু চার্লির ওপর কীসের যেন ছায়া পড়েছে, খানিকটা দূরে দূরে থেকে অনুসরণ করছে ওকে; নিশ্চয়ই বাজে কিছু অপেক্ষা করছে ওর জন্য। মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা থেকে পালাচ্ছে ছেলেটা; ব্যাপারটা মেইভকে চিন্তায় ফেলে দিল।
গ্রাহাম কোটসের অফিসে চলে এলো সে ওদের পিছুপিছু, মোটকু চার্লিকে সরাসরি গোপন কামরার দিকে এগোতে দেখে খুশি হয়ে গেল সে।
‘গোপন প্যানেলটা কই?’ জিজ্ঞেস করল ডেইজি।
‘প্যানেল না, দরজা। ওই বুকশেলফের পেছনেই আছে। কিন্তু কীভাবে খুলতে হয়, তা জানি না। গোপন কোনো বোতাম-টোতাম থাকতে পারে।’
বইয়ের তাকের দিকে তাকাল ডেইজি। ‘গ্রাহাম কোটস কখনও আত্মজীবনী লিখেছিল?
‘আমার জানামতে তো লেখেনি।’
হাত বাড়িয়ে আমার জীবন, গ্রাহাম কোটস নামধারী বইটায় চাপ দিল ডেইজি, সঙ্গে সঙ্গে দেওয়াল থেকে সরে গেল বুকশেলফ; তার পেছন থেকে উঁকি দিল একটা তালাবন্ধ দরজা।
‘আমাদের একটা তালা-চাবিঅলা দরকার, জানাল মেয়েটা। ‘তোমাকে আর এখানে থাকতে হবে না, মি. ন্যান্সি।’
‘ঠিক আছে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘অভিজ্ঞতাটা,’ বলল সে। ‘অবিস্মরণীয়!’ তারপর যোগ করল। ‘আশা করি…আমার সঙ্গে… কোনো একদিন…খেতে যেতে আপত্তি নেই?’
‘নাহ, নেই,’ জবাব দিল মেয়েটা। ‘রবিবার দুপুরে, ডিম সামের[২৯] লাঞ্চে যাওয়া যায়। সাড়ে এগারোটার দিকে দরজা খোলে, তখনই উপস্থিত থাকতে হবে। নইলে বিশাল লম্বা লাইনে পড়ে যাবো।’ রেস্তোরাঁর ঠিকানা লিখে মোটকু চার্লিকে দিল মেয়েটা। ‘বাড়ি ফেরার পথে, পাখি থেকে সাবধান!’ বলল সে।
[২৯. চাইনিজ ডিশ যা নাস্তায় আর দুপুরে খাওয়া হয়।]
‘তা থাকব,’ জবাব দিল ছেলেটা। ‘তাহলে রবিবার দেখা হচ্ছে।’
.
কালো কাপড়ের একটা ওয়ালেটের ভাঁজ খুলে, বেশ কয়েকটা পাতলা ও ধাতব যন্ত্র বের করে আনল তালা-চাবিঅলা।
‘মানুষ আসলে এত্ত বোকা যে কী বলব,’ শুরু করল সে। ‘এতদিনে তো শিক্ষা হওয়া উচিত। ভালো তালার দাম তো এতো বেশি না! এটার কথাই ধরুন। দরজাটা দেখুন না, ভালো জিনিস। একেবারে নিরেট। ব্লো-টর্চ নিয়ে কাজে নামলেও কমপক্ষে আধা দিন লেগে যাবে ফুটো করতেই। কিন্তু তালা লাগিয়েছে এমন একটা যেটা পাঁচ বছর বয়সী শিশুই খুলে ফেলতে পারবে একটা চামচ ব্যবহার করে…যাক গে, কাজ শেষ…একেবারে জলবৎ তরলং!’
দরজা ধরে টান দিল লোকটা। ওটা খুলে যেতেই ভেতরের দৃশ্যটা দেখে চমকে গেল সবাই।
‘হায়রে কপাল,’ বলল মেইভ লিভিংস্টোন। ‘ওটা আমি হতেই পারি না।’ ভেবেছিল, নিজের দেহের প্রতি আরেকটু হলেও ভালোবাসা থাকবে; কিন্তু তা নেই। বরঞ্চ মেঝের লাশটা দেখে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মৃত প্রাণির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার।
কামরাটা অচিরেই ভরে উঠল মানুষে। মেইভ আগে কখনওই ডিটেকটিভ ড্রামা দেখত না, ধৈর্যেই কুলাতো না। এখনও দ্রুত বিরক্ত হয়ে গেল। তবে আগ্রহের সঙ্গে আবিষ্কার করল, নীলচে ব্যাগে ভরে যখন তার লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন তার প্রতি নিঃসন্দেহে একটা টান অনুভব করছে…
… মনের টান না, আক্ষরিক অর্থেই টের পাচ্ছে ওটার টান।
‘এই না হলে কথা,’ বলল মেইভ লিভিংস্টোন।
ঝট করে চলে এলো বাইরে।
অন্তত অলডউইচের অফিসটা থেকে তো বেরোতে পারল!
ভূত হবারও যে একটা আইন কিংবা নিয়মনীতি আছে, তা জানে সে। জানে না শুধু ওই নিয়মগুলো!
বেঁচে থাকতে ধর্ম-কর্মে আরেকটু মন দিলে মন্দ হতো না, ভাবল সে; কিন্তু কেন যেন তা করে ওঠা হয়নি। যখন বয়েস কম ছিল, তখন এমন খোদায় বিশ্বাস করতে মন চায়নি যিনি সবাইকে এতটাই অপছন্দ করেন যে অনন্তকালের জন্য নরকে ভরে দেবেন। আবার বড়ো হবার পর দেখা গেল, অবিশ্বাসটুকু আরও কঠোর হয়ে গেছে—ধরেই নিয়েছিল জীবন-মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নেই; বাকি সব কিছুই কল্পনা। এই অবিশ্বাসের ব্যাপারটা নিজেকে সামলে রাখতে সাহায্য করেছিল তাকে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে…
অবশ্য, একেবারে সঠিক চার্চে সারাজীবন ঘড়ি ধরে আর নিয়ম মেনে গেলেও এই অভিজ্ঞতার জন্য সে প্রস্তুত হতে পারত কি না, তাতে সন্দেহ আছে। মেইভের ক্রমশই মনে হচ্ছে: বিশ্বটার গোছানো হওয়া উচিত; আর জীবনের পরের জীবনটাকে হতে হবে খরুচে একটা বিলাসবহুল ছুটির মতো। একেবারে শুরুতেই হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে টিকেট, ডিসকাউন্ট ভাউচার, শিডিউল আর অনেকগুলো ফোন নম্বর; কোনো ধরনের ঝামেলায় পড়লেই যেন তাতে ফোন দেওয়া যায়।
হাঁটে না মহিলা, আবার ওড়েও না। অনেকটা বাতাসের মতো যায় একস্থান থেকে অন্যস্থানে; শরতের শীতল বাতাস প্রবাহিত হবার সময় যেমন মানুষকে কাঁপিয়ে তোলে, তার অবস্থাও অনেকটা তেমনি।
লন্ডনে পা রাখলেই সবার প্রথমে যেখানে যায়, সেখানেই গেল ভদ্রমহিলা: অক্সফোর্ড স্ট্রিটের সেলফ্রিজেস নামের দোকানটায়। ওখানকার কসমেটিকস ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছে সে, অনেক কমবয়সে। সুযোগ পেলেই যেত দোকানে, কিনত দামি কসমেটিকস। কেননা যখন অবস্থা খারাপ ছিল, তখন চাকরি করার সময় কাজটা করার প্রতিজ্ঞা করেছিল নিজের কাছেই।
একঘেয়েমি জন্ম নেবার আগ পর্যন্ত মেকআপ ডিপার্টমেন্টেই ঘুর ঘুর করল মহিলা, তারপর গেল ঘরোয়া আসবাবের বিভাগে। খাবার ঘরের জন্য আরেকটা টেবিলের দরকার ওর পড়বে না আর কখনও, কিন্তু দেখতে অসুবিধে কী?
এরপর চলে এলো সে হোম এন্টারটেইমেন্ট ডিপার্টমেন্টে; চারপাশে এখন শুধু টেলিভিশন আর টেলিভিশন, নানা আকারের ও নানা আকৃতির। কয়েকটা পর্দায় খবর দেখাচ্ছে। একটা থেকেও আওয়াজ বেরোচ্ছে না, তবে প্রত্যেকটা দখল করে আছে গ্রাহাম কোটসের চেহারা। অপছন্দের বেলুন দ্রুতই ফুলতে শুরু করল তার মাঝে। আচমকা পর্দা থেকে গ্রাহাম কোটসের চেহারা সরে সেটা দখল করে নিলো তার নিজের চেহারা— মরিসের পাশে থাকা অবস্থায়। চিনতে পারল সে ওটাকে। মরিস লিভিংস্টোন, আই প্রিজিউম অনুষ্ঠানের ‘গিভ মি এ ফাইভার অ্যান্ড আই উইল স্নগ ইউ রটেন’ পর্বের একটা অংশ।
ফোনটাকে রিচার্জ করার উপায় পেলে খুশি হতো মেইভ। ফোন যাকেই করুক না কেন, তোলে সেই বিরক্তিকর কণ্ঠের অধিকারী লোকটা। কিন্তু এই মুহূর্তে তাতেও আপত্তি ছিল না ওর। তবে ইচ্ছে হচ্ছে মরিসের সঙ্গে কথা বলার। ও নিশ্চয়ই জানবে, কী করতে হবে! তবে এবার, ভাবল মেইভ। কথা বলতে দেবো ওকে। আর এবার, শুধু শুনব।
‘মেইভ?’
মরিসের চেহারা তাকিয়ে আছে তার দিকে, শত শত টেলিভিশন পর্দা থেকে। এক মুহূর্তের জন্য ভাবল, হয়তো ভুল দেখছে। তারপর ভাবল, হয়তো খবরের অংশ হবে। কিন্তু ওর দিকে উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছে লোকটা…পরক্ষণে আবার ডাকল তার নাম ধরে। তখন বুঝতে পারল, ভুল হয়নি ওর।
‘মরিস…?’
বিখ্যাত হাসিটা হাসল মরিস, আশপাশের সবগুলো পর্দা থেকে তার চেহারা তাকাল মেইভের দিকে। ‘হ্যালো, সোনা। এত দেরি করলে কেন, তাই ভাবছিলাম। যাই হোক, এবার চলে এসো।’
‘চলে আসব? কোথায়?’
‘এপাশে, পর্দার ওপারে। যাই হোক, এসো।’ একশো পর্দার ভেতর থেকে হাত বাড়িয়েছে লোকটা।
মেইভ জানত, এখন শুধু নিজের হাত বাড়িয়ে স্বামীর হাতটা ধরলেই হবে। কিন্তু অবাক হয়ে গেল নিজের কথাই শুনে, ‘না, মরিস। এখনই না।’
একশোটা একই রকম দেখতে চেহারায় বিভ্রান্তি খেলে গেল। ‘মেইভ, সোনা। পার্থিব জীবনটাকে পেছনে ফেলে দিতে হবে তোমাকে।’
‘তা তো অবশ্যই। একসময় ফেলে দেবও। কিন্তু যখন সময় হবে তখন।’
‘মেইভ, তুমি মারা গেছ। আর কবে হবে সময়?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহিলা। ‘এপাশে এখনও করার মতো কিছু কাজ বাকি আছে।’
‘যেমন?’
সোজা খাড়া হলো মেইভ। ‘আসলে,’ বলল সে। ‘এই গ্রাহাম কোর্টস নামের জন্তুটাকে খুঁজে বের করতে চাই আমি। তারপর সেটাই করবো যা…মানে ভূতরা করে। ভয় দেখাবো আরকি।’
অবিশ্বাসের হাসি হাসল মরিস। ‘গ্রাহাম কোটসকে ভয় দেখাতে চাও? কিন্তু কেন?’
‘কারণ,’ জবাব দিল মেইভ। ‘আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি।’ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে, চিবুক উঁচু করে তাকাল সে।
মরিস লিভিংস্টোন একসঙ্গে একশো টেলিভিশনের পর্দা থেকে তাকাল ওর দিকে। তারপর মাথা নাড়ল, খানিকটা সম্ভ্রমের সঙ্গে আর অনেকটা অসহিষ্ণুতা মিলিয়ে। মেইভকে বিয়েই করেছে সে তার দৃঢ় মানসিকতার জন্য, ভালোও বাসত সে কারণেই। কিন্তু হায়, যদি অন্তত এই একটা বারের জন্য হলেও স্ত্রীকে কিছু একটা করতে বাধ্য করতে পারত। তা না করে সে বলল, ‘আমি কোথাও যাচ্ছি না, সোনা। তুমি যখন প্রস্তুত, তখন চলে এসো।’
বলেই মিলিয়ে যেতে ধরল লোকটা।
‘মরিস, হারামিটাকে কীভাবে খুঁজে পাবো, সেই ব্যাপারে কোনো বুদ্ধি দিতে পারো?’ জানতে চাইল মহিলা। কিন্তু জবাব দেওয়ার আগেই পর্দা থেকে হারিয়ে গেল তার স্বামী। এখন ওখানে আবহাওয়ার খবর দেখাচ্ছে।
.
ডিম সামের জন্য ডেইজির সঙ্গে দেখা করল মোটকু চার্লি, লন্ডনের ছোট্ট চায়নাটাউনের একটা রেস্তোরাঁয়।
‘দেখে দারুণ লাগছে,’ প্রশংসা করল সে।
‘ধন্যবাদ,’ বলল মেয়েটা। ‘আমার অবশ্য খুবই খারাপ লাগছে। গ্রাহাম কোর্টসের কেসটা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাকে। এখন ব্যাপারটা পুরোদস্তর হত্যা মামলায় পরিণত হয়েছে। এতদিন যে দায়িত্বে ছিলাম, সেটাই বেশি।’
‘তবে একটা কথা সত্যি,’ উজ্জ্বল চেহারা বানিয়ে বলল মোটকু চার্লি। ‘তুমি যদি দায়িত্ব না পেতে, তাহলে আমাকে গ্রেফতার করার আনন্দ তোমার কপালে জুটত না।’
‘তা বটে,’ ঠাট্টা করল মেয়েটা।
‘কোনো সূত্র আছে?’
‘সূত্র থাকলেও,’ বলল মেয়েটা। ‘তোমাকে সে ব্যাপারে কিছুই বলতাম না।’ ওদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল একটা ছোট্ট কার্ট, সেখান থেকে খাবার বাছল ডেইজি। ‘এক তত্ত্ব মতে, গ্রাহাম কোটস কোনো একটা ফেরি থেকে লাফ দিয়ে মরেছে। ক্রেডিট কার্ড অনুসারে, ডিপে যাওয়া একটা টিকেট কেটেছিল সে। ওটাই শেষ লেন-দেন।’
‘তোমার কী মনে হয়, সেটা হতে পারে?’
চপস্টিক ব্যবহার করে থালা থেকে একটা ডাম্পলিং তুলে নিলো ডেইজি, মুখে পুড়ে চিবুলো খানিকক্ষণ।
‘না,’ জানাল সে। ‘আমার ধারণা সে এমন কোথাও গেছে যেখানে বন্দি- বিনিময় আইন নেই; সম্ভবত ব্রাজিলেই। মেইভ লিভিংস্টোনকে হয়তো ক্ষণিকের উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে মেরে ফেলেছে, কিন্তু বাকি সব কাজই ছিল গোছানো। টাকা আসত মক্কেলদের অ্যাকাউন্টে, সেখান থেকে প্রথমেই নিজের পনেরো শতাংশ কেটে রাখত ব্যাটা। আরও অনেক টাকা সরাতো অ্যাকাউন্টে ঢোকার পর। বিদেশ থেকে আসা অনেক চেকই খদ্দেরদের অ্যাকাউন্টে ঢোকার সুযোগ পায়নি। তবে বিস্ময়কর ব্যাপারটা হলো: লম্বা সময় ধরে কারও মনে সন্দেহ না জাগিয়ে কাজটা করেছে সে!’
‘রাইস বল’-এ কামড় দিল মোটকু চার্লি, ভেতরে মিষ্টি কিছু একটা দেওয়া। বলল, ‘কোথায় আছে গ্রাহাম কোটস, তা তুমি জানো বলেই মনে হচ্ছে।’
ডাম্পলিং চিবুনো বন্ধ করে দিল ডেইজি।
‘ব্রাজিলে যাবার কথাটা যেভাবে বললে, তা শুনে সেটাই মনে হলো। মানে তুমি জানো, লোকটা ওই দেশে যায়নি।’
‘পুলিসি কাজকর্মের ব্যাপারে তোমাকে কিছু জানানো সম্ভব না, দুঃখিত।’ বলল মেয়েটা। তারপর যোগ করল, ‘তোমার ভাই কেমন আছে?’
‘জানি না। মনে হয় চলে গেছে সে। যখন বাড়িতে যাই, তখন ওর কামরায় কিচ্ছু পাইনি।’
‘ওর কামরা? কিচ্ছু পাওনি? মানে?’
‘ওর জিনিসপত্র। পুরো খালি ছিল কামরাটা। তারপর থেকে আর দেখা হয়নি।’ জেসমিন টি-এর কাঁপে চুমুক দিল মোটকু চার্লি। ‘আশা করি সে ভালোই আছে।’
‘না থাকার কোনো কারণ?’
‘আমার যে ভয়, সেটা ওরও আছে।’
‘পাখির ভয়? ওহ।’ সহানুভূতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ডেইজি। আর তোমার বাগদত্তা, আর হবু শাশুড়ি?’
‘উম, বর্তমানে দুটো বিশেষণের একটাও প্রযোজ্য না।’
‘ওহ।’
‘ওরা চলে গেছে।’
‘গ্রেফতার হয়েছিলে বলে?’
‘আমার জানামতে, না।’
চেহারায় সহানুভূতি নিয়ে, পরীর মতো চাইল মেয়েটা। ‘শুনে খারাপই লাগল।’
‘আসলে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘এই মুহূর্তে আমার চাকরি নেই, প্রেমিকা নেই, আর–তোমার কারণেই— প্রতিবেশীদের বিশ্বাস: আমি ঘাঘু অপরাধী। অনেকে তো আমাকে এড়ানোর জন্য রাস্তার উলটো পাশ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করা শুরু করে দিয়েছে! এদিকে আমার খবরের কাগজঅলা অনুরোধ করছে, ওর মেয়ের পেট বাঁধানো লোকটাকে যেন উচিত শিক্ষা দিই!’
‘কী বললে ওকে?’
‘সত্যিটাই। যদিও মনে হয় না আমার কথা সে বিশ্বাস করেছে। এমনকী আমাকে চিজ-অ্যান্ড-অনিয়ন ক্রিস্পস আর পোলো মিন্টসের একটা করে ব্যাগও দিয়েছে। বলেছে, কাজ শেষ করলে, আরও অনেকগুলো ব্যাগ দেবে!’
‘এত ভেবো না তো, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মোটকু চার্লি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘কিন্তু অপেক্ষার সময়টাই তো কষ্টকর!’
‘তারপরও,’ বলল ডেইজি। ‘দুনিয়া তো আর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না।’
বিলটা ভাগাভাগি করে দিল ওরা, ওয়েটার খুচরো পয়সার সঙ্গে এনে দিল দুটো ফরচুন কুকি।
‘তোমারটায় কী লেখা?’ মোটকু চার্লি জানতে চাইল।
‘দিনশেষে অধ্যবসায়েরই জয় হয়,’ পড়ল মেয়েটা। ‘তোমারটায়?’
‘একই কথা,’ ছেলেটা জবাব দিল। ‘অধ্যবসায়ের জয় হোক।’ কাগজটাকে একটা ছোট্ট বলের আকৃতিতে মুচড়িয়ে, ফেলে দিল পকেটে। তারপর ডেইজিকে এগিয়ে দিল লেইচেস্টার স্কয়ার টিউব স্টেশন পর্যন্ত।
‘আজ দেখি তোমার সৌভাগ্যদের দিন।’ বলল ডেইজি।
‘তা কেন?’
‘আশপাশে পাখি-টাখি নেই।’
কথাটা শোনা মাত্র মোটকু চার্লি উপলব্ধি করল, মেয়েটা ভুল বলেনি। কবুতর নেই আশপাশে, নেই কোনো স্টার্লিং পাখি। এমনকী চড়ুইও দেখা যাচ্ছে না। ‘কিন্তু…লেইচেস্টার স্কয়ারে তো সবসময় পাখি থাকে!
‘আজ নেই,’ জানাল মেয়েটা। ‘হয়তো ওরা ব্যস্ত অন্য কোথাও।’
টিউবের কাছে এসে থামল ওরা। একটা মুহূর্তের জন্য মোটকু চার্লির বোকা মন আশা করল— হয়তো মেয়েটা চুমু খাবে ওকে। কিন্তু সেটা করল না ডেইজি, শুধু বলল ‘ভালো থেকো’। আনমনে ওর দিকে হাত নাড়াল মোটকু চার্লি। ওটাকে হাত নাড়ানো না বলে, অনিশ্চিত কোনো ভঙ্গিও বলা চলে! তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল ডেইজি।
লেইচেস্টার স্কয়ার অতিক্রম করে, পিকাডেলি সার্কাসের দিকে হাঁটা ধরল মোটকু চার্লি। পকেট থেকে ফরচুন কুকির কাগজটা বের করে ভাঁজ খুলল। ‘এরোসে দেখা করো’, লেখা আছে ওটায়। তারপাশে হাতে আঁকা একটা কিছু, যেটা তারকা চিহ্ন হতে পারে… আবার মাকড়শাও হতে পারে!
চলতে চলতে আকাশ আর আশপাশের দালানের ওপর নজর বুলালো মোটকু চার্লি। পাখি-টাখির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, ব্যাপারটা অদ্ভুতই। লন্ডনে সাধারণত পাখির কোনো অভাব হয় না। সবসময় থাকেই।
স্ট্যাচুর নিচে বসে আছে স্পাইডার, পড়ছে নিউজ অভ দ্য ওয়ার্ল্ড। মোটকু চার্লিকে আসতে দেখে সে চোখ তুলে চাইল।
‘এই মূর্তি আসলে এরোসের না,’ ভাইকে জানালো মোটকু চার্লি। ‘খ্রিষ্টান দানশীলতার সম্মানে বানানো হয়েছিল।’
‘তাহলে মূর্তি ন্যাংটো কেন? আর হাতেই বা তির-ধনুক ধরে আছে কেন? এর মাঝে দানশীলতার কিছু আছে, না আছে খ্রিষ্টানত্বের।’
‘যা পড়েছি, তাই বললাম,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘কোথায় ছিলে তুমি? আমি তো দুশ্চিন্তায় পরে গেছিলাম!’
‘আমি ঠিক আছি, পাখির দঙ্গল এড়াতে চাইছি আরকী। বুঝতে চাইছি, আসলে এখানে হচ্ছেটা কী?’
‘আজ যে কোথাও পাখির প-ও দেখা যাচ্ছে না, সেটা টের পেয়েছ?’
‘পেয়েছি। জানি না, কেন। তবে ভাবছিলাম বসে বসে। হয়তো তুমিও বুঝতে পারছ,’ স্পাইডার বলল। ‘এখানে কোনো কিন্তু আছে?’
‘পুরো ব্যাপারটাই একটা বড়ো কিন্তু!’
‘নাহ, মানে বোঝাতে চাইছি—ওই পাখি-মানবী যে আমাদের ক্ষতি করতে চাইছে, তার পেছনে কোনো ভিন্ন কারণ আছে।’
‘হুম। কাজটা একেবারেই অনুচিত হয়েছে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?’
‘অনুচিত বোঝাচ্ছি না। বোঝাতে চাচ্ছি—নিজেই ভেবে দেখো। হিচককের বানানো মুভি ছাড়া, অন্য কোথাও সাধারণ পাখিরা মানুষকে আক্রমণ করে না। হয়তো পোকা খাওয়ার জন্য জান বাজিতে লাগায়, কিন্তু মানুষের পেছনে? অসম্ভব। হাজার হাজার বছরে অন্তত এটা জেনেছে: মানুষকে খাওয়ার আগে, মানুষই তাকে খেয়ে ফেলবে। তাই তাদের প্রবৃত্তিই বলে আমাদের থেকে দূরে থাকতে।’
‘সবাই কিন্তু থাকে না,’ এবার পালটা যুক্তি দিল মোটকু চার্লি। ‘শকুন না, বা দাঁড় কাকও এত ভয় পায় না। তবে যুদ্ধ শেষ হলে তাদের দেখা মেলে। অপেক্ষা করে মানুষ মরার।’
‘কী?’
‘বললাম, দাঁড়কাক আর শকুন বাদে আরকী। কিছু বোঝাতে চাচ্ছি…’
‘নাহ,’ মন দিল স্পাইডার। ‘মাথায় আসি আসি করেও আসছে না। তোমার কথা শুনে কিছু একটা ভাবতে শুরু করেছিলাম, আরেকটু হলে মনে করেও ফেলতাম। মিসেস ডানউইডির সঙ্গে কথা হয়েছে?’
‘মিসেস হিগলারকে ফোন করেছিলাম, কিন্তু জবাব পাইনি।’
‘তাহলে চলো, দেখা করে আসি।’
‘তুমি তো বলতেই পারো, কিন্তু আমি ঝামেলায় আছি। পকেটে ফুটো পয়সাও নেই, ব্যাঙ্কেও না। চাইলেই আটলান্টিকের এপার-ওপাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব না। এমনকী চাকরিও নেই। আমি—’
কালো-লাল জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ওয়ালেট বের করে আনল স্পাইডার। ভেতর থেকে নানা দেশের অনেকগুলো নোট বের করে গুঁজে দিল মোটকু চার্লির হাতে। ‘এই নাও, যাওয়া-আসার খরচ হয়েও বাঁচবে। শুধু ওই পালকটা এনে দাও।’
আচমকা বলল মোটকু চার্লি, ‘আচ্ছা, একবারও কি ভেবেছ যে বাবা মারা নাও গিয়ে থাকতে পারে?’
‘কী?’
‘ভাবছিলাম, হয়তো ঠাট্টা করছে আমাদের সঙ্গে। এমন কিছু করা তার দ্বারা খুবই সম্ভব, তাই না?’
জবাব দিল স্পাইডার। ‘বলতে পারছি না, হতেও পারে।’
‘আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে তাই হয়েছে। প্রথমেই এই কাজটা করব, ওর কবরে গিয়ে—’
কথা শেষ করতে পারল না বেচারা, তার আগেই আক্রমণ চালালো পাখির ঝাঁক। শহুরে পাখি ওগুলো; চড়ুই আর স্টারলিং, কবুতর আর কাক; হাজারে হাজারে ছুটে আসছে। বাতাসে উড়তে থাকা কাপড়ের মতো ঢেউ খেলছে তাদের মাঝে, রিজেন্ট স্ট্রিটে বসে থাকা দুই ভাইয়ের দিকে এগোচ্ছে দেওয়ালের রূপ নিয়ে। পালকঅলা ওই বাহিনীটা একেবারে আকাশছোঁয়া দালানের মতোই সমতল, নড়া-চড়ায় বিন্দুমাত্র অপটুতা নেই। মোটকু চার্লি দেখল সব, কিন্তু মনের ভেতরে তার বর্ণনাকে স্থান দিতে পারল না; যদিও এই দৃশ্যটা ক্রমেই পাখ খেতে খেতে পুরো মাথা দখল করে নিতে চাইছে। আসলে কী দেখছে, সেটাই বুঝতে পারছে না ওর মন।
ভাইয়ের কনুই ধরে টান দিল স্পাইডার। তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘দৌড়াও!’
ঘুরে দাঁড়াল মোটকু চার্লি। স্পাইডার তখন ব্যস্ত খবরের কাগজটা সাবধানে ভাঁজ করে, ময়লার বাক্সে ফেলতে।
‘তুমিও দৌড়াও!’
‘এখনও তোমার পেছনে লাগেনি এই পাখিরা। অন্তত এখন পর্যন্ত না, ‘ বলেই হাসল স্পাইডার; যে হাসিটা আগে এত বেশি মানুষকে প্রভাবিত করেছে যা কল্পনারও বাইরে, তাদের বাধ্য করেছে এমন কিছু একটা করতে যা তারা করতে অনিচ্ছুক ছিল। মোটকু চার্লির মনেও দৌড়ে পালাবার ইচ্ছেটা তীব্র হয়ে উঠল। ‘পালকটা উদ্ধার করো। যদি পারো তো বাবাকেও নিয়ে এসো। এবার যাও!’
তাই করল মোটকু চার্লি।
কেঁপে উঠে রূপ বদল করল পাখির দেওয়ালটা। ঘূর্ণির রূপ নিয়ে যেন গিলে ফেলল এরোসের মূর্তি আর তার নিচে বসে থাকা মানুষটাকে। একটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আত্মরক্ষা করল মোটকু চার্লি। ওর চোখের সামনেই ঘূর্ণিঝড়ের নিচের অংশটা ধাক্কা খেল স্পাইডারের সঙ্গে। কল্পনা করল সে, ভাইয়ের আর্ত-চিৎকার শুনতে পাচ্ছে পাখার ঝাপটানির আওয়াজকে ছাপিয়ে…
…কে জানে, হয়তো কল্পনা ছিল না ওর এই শোনা!
পরক্ষণেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল পাখির ঝাঁক, রাস্তাটা খালি পড়ে রইল। ধূসর পেভমেন্টে কয়েকটা পালক রয়ে গেল ঘটনার সাক্ষী হয়ে।
হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মোটকু চার্লির মনে হলো যেন অসুস্থ হয়ে পড়বে। পথচারীদের কেউ যদি ওই দৃশ্য দেখেও থাকে, তবুও কোনো প্ৰতিক্ৰিয়া দেখাল না। কেন যেন মনে হলো ওর: আসলে আর কেউ এই ঝটিকা আক্রমণ দেখেইনি!
মূর্তির নিচে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা, ওর ভাই খানিক আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার পাশে। মহিলার জীর্ণ, বাদামি কোট বাতাসে পতপত করছে। তার দিকে এগিয়ে গেল মোটকু চার্লি। ‘শোনো,’ বলল সে। ‘ওকে ভাগাতে বলার অর্থ ছিল, আমার জীবন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু যা করলে, তা তো করতে বলিনি!’
ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল মহিলা, বলল না কিছুই। কিছু কিছু শিকারি পাখির চোখে এক রকমের উন্মাদনা থাকে, থাকে এমন এক নৃশংসতা যা অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। সেই দৃষ্টি নিজের ওপর আবিষ্কার করলে ভয় পেয়ে যাবে যে কেউ। কিন্তু মোটকু চার্লি ভয় না পাওয়ার চেষ্টা করল। ‘ভুল হয়েছে আমার,’ বলল সে। ‘তার সাজা ভুগতে রাজি আছি। আমাকে নিয়ে যাও, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দাও।’
তারপরও সেভাবেই চেয়ে রইল মহিলা। বলল, ‘তোমার পালাও আসবে, আনানসির সন্তান। সঠিক সময়ে…’
‘ওকে তোমার দরকার কেন?’
‘আমি ওকে চাই না,’ জানাল পাখি-মানবী। ‘ওকে দিয়ে আমার কী হবে? আমি আসলে অন্য একজনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ওকে তার হাতে তুলে দিলে, আমার দায়ভার ফুরোবে।’
কেঁপে উঠল খবরের কাগজ…
…মূর্তির নিচে নিজেকে একা আবিষ্কার করল মোটকু চার্লি।