অধ্যায় তেরো – যেটাকে কয়েক জনের জন্য দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে

অধ্যায় তেরো – যেটাকে কয়েক জনের জন্য দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে 

উত্তেজনা পেয়ে বসেছে পাখিগুলোকে। গাছের ওপর বসে চেঁচাচ্ছে আর চিল্লাচ্ছে তারা। আসছে তাহলে জন্তুটা, ভাবল স্পাইডার, নিজের দুর্ভাগ্যকে গাল দিল নিজেই। শরীরে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই, শেষ বিন্দুটাও খরচ করে ফেলেছে। ক্লান্তি আর পরিশ্রান্তি বাদে আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না নিজের ভেতরে। 

মাটিতে শুয়ে থাকবে কি না, তাই ভাবল সে। জন্তুটা খেয়ে ফেললে খাক। তবে কিনা, মরার এই উপায়টা ঠিক সুবিধাজনক ঠেকছে না। কলিজা নতুন করে গজাতে পারবে কি না, তা নিয়েই সন্দেহ আছে; আর এই জন্তুটা শুধু কলিজা খেয়েই সন্তুষ্ট থাকবে বলে মনে হয় না। 

মোচড়া-মুচড়ি শুরু করে দিল স্পাইডার। তিন পর্যন্ত গুনল ও, তারপর যতটা সম্ভব শক্তি খাটিয়ে দুই হাত টেনে নিলো নিজের দিকে। ফলে দড়ি টানটান হয়ে চাপ ফেলল গজালের ওপর। বারংবার একই কাজ করে চলল সে। 

পাহাড়ের সঙ্গে দড়ি বেঁধে, সেটাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে যতটুকু লাভ হতো…এক্ষেত্রেও তাই হলো। এক, দুই, তিন…টান। তারপর আবার। তারপর আবার। 

পশুটা আসতে কতক্ষণ দেরি করবে, তা একবার ভাবল ও। 

এক, দুই, তিন…টান। এক, দুই, তিন… টান। 

দূরে কোথাও, কোনো এক স্থানে, গাইছে কেউ। গান পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে সে। গানটা হাসি ফোটাল স্পাইডারের মুখে। জিহ্বা থাকলে হয়তো শিস বাজিয়ে যোগ দিত গানে: বাঘটা দর্শন দিলে তাকে দেখিয়ে দিত, ওর সাহসের কমতি নেই কোনো। ভাবনাটাই যেন শক্তি যোগাল ওর দেহে। 

এক, দুই, তিন…টান। 

অবশেষে গজালটা হার মেনে নড়ে উঠল। 

আরেকটা টান দিতেই ওটা উঠে এলো মাটি থেকে! 

দড়িগুলো নিজের দিকে টান দিল সে, গজালটাকে শক্ত করে ধরল হাত দিয়ে-লম্বায় ওটা ফুট তিনেক হবে। একটা প্রান্ত সুচালো, ওটাই পোঁতা ছিল মাটিতে। প্রায় অসাড় হাত ব্যবহার করে দড়ির পাকগুলো খুলে ফেলল, কবজি থেকে এখন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঝুলছে দড়িটা। ডান হাতে ওজন মেপে নিলো গজালটার, কাজ হবে মনে হচ্ছে। বুঝতে পারছে, নজর রাখা হচ্ছে ওর ওপর: ইঁদুরের গর্ত যেভাবে বিড়াল দেখে, সেভাবে দেখছে ওকে। 

নীরবে…উহু, প্রায় নীরবে ওর দিকে এগোতে লাগল জন্তুটা, দিনের আলোয় ছায়া পড়ল তার। তবে একমাত্র ওটার লেজই নজরে পড়ল স্পাইডারের, অধৈর্য ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ করছে। নইলে ওটাকে মূর্তির সঙ্গেও তুলনা দেওয়া যেত; নয়তো একদলা বালুর সঙ্গে, যেটা আলোর খেলার কারণে, দেখাচ্ছে প্রকাণ্ড একটা পশুর মতো…কেননা ওটার গায়ের চামড়ার রং বালু-বালুই। অপলক চোখগুলো মধ্য-শীতের সমুদ্রের মতোই সবুজ। চেহারা প্রশস্ত, প্যানথারের নিষ্ঠুর চেহারার মতো। দ্বীপপুঞ্জগুলোতে বিড়াল-প্রজাতির যেকোনো বড়োসড়ো সদস্যকেই ‘বাঘ’ নামে ডাকা হয়। আর এই নমুনাটা ইতিহাসের যে কোনো বিড়ালের চাইতে অনেক বড়ো—বড়ো, নৃশংস, হিংস্র… বিপজ্জনক। 

স্পাইডারের গোড়ালির অবস্থা ভালো না, বলতে গেলে হাঁটতেই পারছে না সে। হাতে-পায়ে খাচ্ছে খোঁচা। তারপরও খোঁড়াতে লাগল সে। কিন্তু ব্যাপারটা এমনভাবে উপস্থাপন করতে চাইল- যেন ইচ্ছে করে করছে কাজটা, অবশ্যই ভয় দেখাতে; দাঁড়াতেই যে পারছে না, তা বাঘটার তো আর জানার দরকার নেই। 

উবু হয়ে বসে, গোড়ালি মুক্ত করতে চাইছে মন। কিন্তু পশুটার ওপর থেকে নজর হটাবার সাহস জোগাতে পারছে না। 

গজালটা ভারী, এবং পুরুও; কিন্তু বর্শা হিসেবে ব্যবহার করার মতো বড়ো না। আবার অন্য কোনো অস্ত্র বলেও ভাবতে পারছে না। ওটার সরু, সুচালো প্রান্ত ধরে আছে স্পাইডার; ইচ্ছে করেই পশুটার লুকিয়ে থাকার জায়গা থেকে নজর হটিয়ে তাকাল সাগরের দিকে। আশা করছে, নড়া-চড়া ধরার জন্য চোখের কোণই যথেষ্ট হবে। 

কী যেন বলেছিল মহিলা? তুমি ভয়ে ভ্যা ভ্যা করে ছাগলের মতো কাঁদবে, গোঙাবে, আর তোমার আতঙ্ক উত্তেজিত করবে তাকে। 

আসলেও গোঙাতে শুরু করেছে স্পাইডার, তারপর ডাক ছাড়ল আহত ছাগলের মতো। সেই ছাগলটা আবার পথহারা ছাগল, একাকী হলেও নাদুস- নুদুস! 

বালু-রঙা নড়া-চড়া দেখা গেল এক লহমার জন্য। এতটাই স্বল্প-সময় স্থায়ী হলো তা যে কেবল নিজের দিকে ছুটে আসতে থাকা থাবা আর শ্বদন্তই দেখতে পেল স্পাইডার। গজালটাকে বেসবল ব্যাটের মতো করে গায়ের শক্তিতে ঘোরাল সে; পশুটার নাকের ওপর থ্যাচ করে বসে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেয়ে খুশি হলো। 

থমকে গেল বাঘ, এমন ভাবে চেয়ে আছে যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর তার গলার গভীর থেকে বেরিয়ে এলো একটা গর্জন। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে, যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকেই ফিরে চলল। ভাবখানা এমন যেন কোনো কাজ ফেলে এসেছে, এখুনি করতে হবে। ঘাড়ের ওপর দিয়ে ঘৃণার সঙ্গে একবার চাইল স্পাইডারের দিকে। আহত পশুটা দৃষ্টি দিয়েই বুঝিয়ে দিল—অচিরেই ফিরে আসবে সে। 

ওটাকে যেতে দেখল স্পাইডার। 

তারপর বসে পড়ে খুলে ফেলল গোড়ালির বাঁধন। 

খাদের ধার ঘেঁষে হাঁটল কিছুক্ষণ, তারপর নামতে শুরু করল ঢাল বেয়ে নিচে। অচিরেই একটা নালা মতো পড়ল সামনে, পাহাড়ের ঢালের মাথা থেকে নিচে পড়া ঝরনার দ্বারা সৃষ্ট। হাঁটু গেঁড়ে বসে, অঞ্জলি বানিয়ে পান করতে লাগল পানি। 

তারপর মন দিল পাথর জড়ো করায়। মোটামুটি বড়ো আকৃতির পাথর চাই ওর, হাতের মুঠোর সমান হলে ভালো হয়। বরফের সময় বানানো তুষার- গোলকের মতো স্তূপাকারে সাজিয়ে রাখল নিজের কাছেই। 

.

‘তুমি তো কিছুই মুখে দাওনি!’ বলল রোজি। 

‘তুমি খাও, শক্তি সঞ্চয় করো,’ জবাব দিল ওর মা। ‘ওই পনির একটু খেলাম তো, তাতেই চলবে।’ 

ভাঁড়ারটা বেশ ঠান্ডা, সেই সঙ্গে অন্ধকারও। এই ঘন অন্ধকার চোখে সয়ে আসে না। আলোর রেশ মাত্র নেই। ভাঁড়ারের পুরোটা ঘুরে দেখেছে রোজি, আঙুলে ঠেকেছে শুধু পাথর আর গুঁড়িয়ে যাওয়া ইট। কাজে আসতে পারে, এমন কিছু খুঁজছিল; কিন্তু লাভ হলো না। 

‘আগে তো খেতে,’ স্মৃতি রোমন্থন করল রোজি। ‘বাবা বেঁচে থাকতে।’ 

‘তোমার বাবাও কিন্তু,’ জানাল ওর মা। ‘খেতে বেশ পছন্দ করত। লাভ কী হলো? হার্ট অ্যাটাকে মরল, তাও মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে। দুনিয়ার এ কেমন নিয়ম?’ 

‘বাবা তো খেতে ভালোবাসত বলেই খেত।’ 

‘কী ভালোবাসত না তোমার বাবা?’ তিক্ত কণ্ঠে বলল ওর মা। ‘খাবার ভালোবাসত, মানুষজনকে ভালোবাসত, ভালোবাসত তার মেয়েকে। রান্না করতে ভালোবাসত। আমাকেও ভালোবাসত। তা এত ভালোবাসা কোন কাজে এসেছে? সেই অল্পবয়সেই তো কবরে সেঁধাতে হয়েছে ওকে। এভাবে মন চাইল আর ভালোবাসলাম—তা হয় না। তোমাকেও বলেছি কথাটা।’ 

‘হুম,’ একমত হলো রোজি। ‘তা বলেছ।’ 

মায়ের কণ্ঠ অনুসরণ করে সেদিকে এগোল মেয়েটা, হাত সামনে রেখেছে যাতে ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা ধাতব শেকলগুলো এড়ানো যায়। মায়ের হাড়সর্বস্ব কাঁধটা খুঁজে পেয়ে, জড়িয়ে ধরল সে। 

‘আমি ভয় পাচ্ছি না,’ অন্ধকারেই বলল রোজি। ‘তাহলে তুমি বোকার হদ্দ।’ জানাল ওর মা। 

মহিলাকে ছেড়ে, আন্দাজে ঘরের মাঝখানে চলে এলো রোজি। আচমকা আওয়াজ হলো কিছু একটা ভাঙার। ধুলো আর প্লাস্টারের গুঁড়ো খসে পড়ল ছাদ থেকে। 

‘রোজি? কী করছ?’ জানতে চাইল রোজির মা। 

‘শিকল দোলাচ্ছি।’ 

‘সাবধানে। শিকল খসলে ফাটা মাথা নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে হবে তোমাকে, জ্যাক রবিনসন উচ্চারণ করারও সুযোগ পাবে না।’ মেয়ের কাছ থেকে জবাব না পেয়ে যোগ করল মিসেস নোয়াহ। ‘তুমি দেখি আসলেই পাগল।’ 

‘নাহ,’ জানাল রোজি। ‘তা আমি নই। আমি এখন আর ডরাচ্ছি না—এই যা।’ 

ওদের মাথার ওপরে, অর্থাৎ বাড়ির ভেতর, দড়াম করে কেউ বন্ধ করে দিল মূল দরজা। 

‘উন্মাদটা ফিরেছে,’ বলল রোজির মা। 

‘বুঝতে পেরেছি, আওয়াজটা শুনেছি আমিও,’ বলল রোজি। ‘তারপরেও ডরাচ্ছি না!’ 

.

মানুষজন মোটকু চার্লির পিঠে চাপড় বসিয়েই চলছে তো বসিয়েই চলছে। কিন্তু দিচ্ছে ড্রিঙ্ক, ওগুলোর গ্লাসে আবার ছাতা বসানো। সেই সঙ্গে পকেটে বহন করছে আরও পাঁচটা বিজনেস কার্ড। সবগুলোই গানের দুনিয়ার মানুষের, অনুষ্ঠান উপলক্ষে এসেছে দ্বীপে। 

কামরার সবাই হাসছে ওর দিকে চেয়ে। ডেইজিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আছে সে, টের পাচ্ছে মেয়েটার কম্পন। মেয়েটা ওর কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে বলল, ‘তুমি যে বদ্ধ পাগল, সেটা জানো?’ 

‘কাজ তো হয়েছে, তাই না?’ 

ওর দিকে তাকাল মেয়েটা। ‘রহস্যের ঝাঁপি আজ খুলে বসেছ মনে হচ্ছে? 

‘এ তো কেবল শুরু!’ জানাল মোটকু চার্লি। 

প্রধান ওয়েট্রেসের কাছে গিয়ে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না…গান গাইবার সময় এক মহিলাকে দেখতে পেলাম। বারের কাছে গিয়ে সে তার কফির পট ভরে নিয়েছিল। কোথায় গেছে, বলতে পারেন?’ 

চোখ পিটপিট করে শ্রাগ করল মেয়েটা। ‘জানি না…’ 

‘অবশ্যই জানো,’ বলল মোটকু চার্লি, কেন যেন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠেছে সে; নিজেকে চালাক-চতুরও মনে হচ্ছে। তবে জানে, এই অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। অচিরেই আবার আগের মোটকু চার্লিতে পরিণত হবে সে। কিন্তু একদল শ্রোতার সামনে একটু আগেই গান গেয়েছে ও, মজাও পেয়েছে। ডেইজির জীবন, সেই সঙ্গে নিজের জীবন বাঁচাতেই করেছে কাজটা; সফলও হয়েছে উদ্দেশ্য অর্জনে। ‘চলো, ওদিকে গিয়ে কথা বলি।’ সব কৃতিত্ব বোধহয় গানটারই। ওটা গাইবার সময় সব পরিষ্কার মনে হচ্ছিল। এখনও তাই আছে। হলওয়ের দিকে এগোল সে, ডেইজি আর প্রধান ওয়েট্রেস অনুসরণ করছে ওকে। 

‘নাম কী তোমার?’ ওয়েট্রেসকে জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। 

‘আমি ক্লারিসা।’ 

‘হ্যালো, ক্লারিসা। পুরো নাম?’ 

পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটল ডেইজি, ‘চার্লি, আমাদের কি পুলিসে খবর দেওয়া উচিত না?’ 

‘একটু পরে দিচ্ছি। ক্লারিসা… কী?’ 

‘হিগলার।’ 

‘বেঞ্জামিন, মানে কনসিয়ার্ডের সঙ্গে সম্পর্ক আছে?’ 

‘আমার ভাই ও।’ 

‘মিসেস হিগলার, মানে কোরিঅ্যান হিগলারের সঙ্গে কী সম্পর্ক তোমাদের? 

‘ওরা আমার ভাতিজা-ভাতিজি, মোটকু চার্লি।’ দরজার কাছ থেকে জবাব দিল মিসেস হিগলার। ‘এখন তোমার বাগদত্তার কথা শোনো, পুলিসে খবর দাও। বুঝলে?’ 

.

নালার পাশে বসে আছে স্পাইডার, পাহাড়ের শীর্ষেই বলা চলে। খাদটা পেছনের দিকে, সামনে একগাদা পাথর; চাইলেই ছুড়ে মারতে পারবে। আচমকা লম্বা ঘাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা লোক। নগ্ন সে, শুধু কোমরে বালুরঙা পশম দিয়ে বানানো একটা নেংটি বেঁধে রেখেছে। পেছন থেকে ঝুলছে একটা লেজ, গলায় দাঁত দিয়ে বানানো মালা; তীক্ষ্ণ, সাদা আর সুচালো সেই দাঁতগুলো। চুল লম্বা, কালো। স্পাইডারের দিকে আলসে ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল লোকটা, যেন সকালে পেট খালি করতে যাচ্ছে! স্পাইডারকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বেচারা চমকে গেছে এহেন আচরণ দেখে। 

আঙুরের সমান একটা পাথর হাতে নিয়ে ছোড়ার ভঙ্গি করল স্পাইডার। 

‘দাঁড়াও দাঁড়াও, আনানসির সন্তান,’ বলল অচেনা লোকটা। ‘আমি তো কেবল এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখতে পেলাম তোমাকে। ভাবলাম গিয়ে দেখি, সাহায্য দরকার কি না ছেলেটার।’ লোকটার নাক বেঁকে আছে, সেই সঙ্গে আহতও। 

মাথা নাড়ল স্পাইডার, জিহ্বার অভাব খুব করে বোধ করছে। 

‘তোমাকে এখানে দেখে ভাবছিলাম, আনানসির বেচারা সন্তান…নিশ্চয়ই তার ক্ষুধা পেয়েছে খুব,’ একটু বেশিই বিস্তৃত দেখাল অচেনা লোকটার হাসি। ‘এই নাও, খাবার সঙ্গেই এনেছি।’ কাঁধে একটা থলে ঝুলিয়ে রেখেছে সে, ওটা খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল। সদ্য শিকার করা একটা কালো লেজঅলা ভেড়া বের করে আনল লোকটা, ঘাড়টা ধরে রেখেছে বলে মাথা এদিক-ওদিক কাত হচ্ছে। ‘আমি আর তোমার বাবা মিলে একত্রে অনেক বারই খাওয়া- দাওয়া করেছি। তাহলে তুমি-আমি কেন পারব না? আগুনটা তুমি জ্বালাও, রান্নার ব্যবস্থা আমি করছি। কি, জিভে জল চলে আসছে না?’ 

খিদের চোটে মাথা ঘুরছে স্পাইডারের। জিহ্বা যদি থাকত, তাহলে হয়তো ‘হ্যাঁ’ বলে দিত। আত্মবিশ্বাস থাকত নিজের ওপর, যে চাইলে যেকোনো পরিস্থিতিতে কথা বলেই বিপদ কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ওই একটা অঙ্গই যে নেই, তাই বাঁ-হাতে আরেকটা পাথর তুলে নিলো। 

‘এসো, একসঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করি বন্ধুর মতো; আশা করি আমাদের মাঝে আর ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না,’ জানাল অপরিচিত লোকটা। 

হুম, তারপর শকুন-দাঁড় কাকের খাদ্য হবে আমার দেহ, তাই তো? ভাবল স্পাইডার। 

স্পাইডারের দিকে আরেক ধাপ এগোল অচেনা লোকটা, তাই সরাসরি একটা পাথর ছুড়ে দিল সে। তাক স্পাইডারের ভালোই, তাই যেখানে লাগাতে চেয়েছিল সেখানেই লাগল: অচেনা লোকটির ডান হাতে। ভেড়াটাকে ফেলে দিল লোকটা, কিন্তু পরের পাথরটার হাত থেকে বাঁচাতে পারল না নিজেকে; ওর মাথার একটা পাশে লাগল ওটা। স্পাইডার চেয়েছিল ফাঁকে-ফাঁকে বসা দুই চোখের মাঝখানে লাগাতে, কিন্তু লোকটা মাথা সরিয়ে নেওয়ায় পারল না। ঠিক তখনই দৌড়তে শুরু করল লোকটা, লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে; লেজ একদম সোজা হয়ে আছে। কখনো ওকে দেখাচ্ছে মানুষের মতো, আবার কখনো বা অবিকল পশু! 

অচেনা লোকটা পালিয়ে গেলে, স্পাইডার এগিয়ে গেল তার ফেলে যাওয়া ভেড়াটার দিকে। অবাক হয়ে আবিষ্কার করল কাছে গিয়ে, নড়ছে ওটা! এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, জান আছে বোধহয় ভেড়াটার দেহে। কিন্তু না, মাংসপেশির ওই সংকোচনের কারণ আসলে পোকা। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে লাশটা, এতটাই যে গন্ধ নাকে ধাক্কা মারতেই ক্ষিধের কথা ভুলে গেল স্পাইডার… 

…অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও। 

খাদের কাছে নিয়ে এসে, নিচের সাগরে লাশটাকে ফেলে দিল সে। তারপর হাত ধুয়ে নিলো নালায়। 

কতক্ষণ হলো এখানে আছে, তা জানে না। সময়ের গতি যেন থমকে যায় এই জায়গায়। সূর্য দিগন্তরেখার কাছে ক্রমেই নিচে নেমে আসছে। 

সূর্য ডোবার পর, চন্দ্র ওঠার আগে, ভাবল স্পাইডার। ফিরে আসবে পশুটা! 

.

সেন্ট অ্যান্ড্রুজ পুলিস ফোর্সের হাসিখুশি প্রতিনিধি বসে আছে হোটেলের অফিসে, সঙ্গে আছে ডেইজি আর মোটকু চার্লি; ওদের কথা শুনছে আরোপিত একটা হাসি মুখে ধরে রেখে। মাঝে-মধ্যে অবশ্য আঙুল তুলে চুলকে নিচ্ছে গোঁফ। 

পুলিস অফিসারকে জানাল ওরা: গ্রাহাম কোটস নামের এক অপরাধী আচমকা ওদের খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়ে ডেইজিকে বন্দুক দেখিয়ে হুমকি দিচ্ছিল। যদিও অস্ত্রটাকে ডেইজি বাদে আর কেউ দেখেনি। এরপর কালো মার্সিডিজের ঘটনাটা তাকে জানাল মোটকু চার্লি, সেদিন বিকেলেরই কথা। তবে স্বীকার করতে বাধ্য হলো, চালককে দেখতে পায়নি সে। কিন্তু গাড়িটা এসেছে কোত্থেকে, তা নিঃসন্দেহে বলতে পারবে – পাহাড়ের শীর্ষে থাকা বাড়িটা থেকে। 

রূপোর প্রলেপ লাগা গোঁফ স্পর্শ করল পুলিস অফিসার। তারপর চিন্তা- ভাবনা করে বলল, ‘হুম, ওখানে একটা বাড়ি আছে বটে। কিন্তু সেটার মালিক আপনাদের এই…কোটস না। আসলে ওটার মালিক বাসিল ফিনেগান, বেশ সম্মানিত একজন মানুষ। বহু বছর ধরে দেশের আইন-শৃঙ্খলা শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে আসছেন তিনি। স্কুলে দান করেছেন…আর তারচেয়ে বড়ো কথা, নতুন পুলিস স্টেশনটা গড়ে ওঠার পেছনেও তার অবদান আছে।’ 

‘আমার পেটে বন্দুক চেপে ধরেছিল,’ জানাল ডেইজি। ‘হুমকি দেয়, তার সঙ্গে না গেলে গুলি করবে!’ 

‘যদি কাজটা মি. ফিনেগান করেও থাকে, লিটল লেডি,’ জানাল পুলিস অফিসার। ‘তাহলে নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল বলেই করেছেন।’ ব্রিফকেস খুলে ভেতর থেকে এক তাড়া কাগজ বের করে আনল সে। ‘একটা প্রস্তাব দিই—আপনারা আরও ভাবুন। এক রাত সময় দিন নিজেকে, যদি সকালেও মনে হয় না ব্যাপারটা ভুল বোঝাবুঝির চাইতে বেশি কিছু ছিল তো এই ফর্মটা পূরণ করবেন। স্টেশনে তিন কপি জমা দিতে হবে। সিটি স্কয়ারের পেছনে নতুন পুলিস স্টেশনটার খোঁজ করবেন। সবাই জানে ওটা কোথায়।’ 

উভয়ের সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় নিলো সে। 

‘ওকে জানানো উচিত ছিল যে তুমি নিজেও পুলিস, জানাল মোটকু চার্লি। ‘তাহলে হয়তো আরেকটু সিরিয়াসলি নিত ব্যাপারটাকে।’

‘মনে হয় না তাতে কোনো লাভ হতো,’ জানাল মেয়েটা। ‘কেউ যখন কাউকে ‘লিটল লেডি’ বলে ডাকে, তখন সে বেচারিকে আগেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে।’ 

হোটেলের রিসেপশন রুমে পা রাখল ওরা 

‘ভদ্রমহিলা গেল কই?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি। 

বেঞ্জামিন হিগলার জিজ্ঞেস করল, ‘কেলিঅ্যান আন্টি? কনফারেন্স রুমে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।’

.

‘কাজ শেষ,’ খুশি মনে জানাল রোজি। ‘জানতাম, পারব। শুধু ক্রমাগত দুলিয়ে গেলেই হবে।’ 

‘তোমাকে লোকটা মেরে ফেলবে!’ 

‘এমনি বুঝি খুব বাঁচিয়ে রাখত?’ 

‘ফন্দিটা কাজে আসবে না।’ 

‘মা, তোমার মাথায় আর কোনো চিন্তা আছে?’ 

‘দেখে ফেলবে তোমাকে।’ 

‘মা, এত নেতিবাচক কথা বলা বন্ধ করবে? যদি সাহায্য করার মতো কোনো পরামর্শ থাকে, তাহলে সেটা বলো। নইলে চুপ থাকো। ঠিক আছে?’ 

নীরবতা নেমে এলো কামরায়। 

তারপর, ‘ওকে আমার পাছা দেখাতে পারি।’ 

‘কী?’ 

‘ঠিকই শুনেছ।’ 

‘মানে…অন্য কোনো ফন্দি নেই?’ 

‘আপাতত এ-ই।’ 

আবার খানিকক্ষণের নীরবতার পর রোজি বলল, ‘চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই!’ 

.

‘হ্যাল্লো, মিসেস হিগলার,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘পালকটা ফেরত চাই।’ 

‘তোমার পালক আমার কাছে আছে, সেটা কে বলল?’ পালটা প্রশ্ন করল মহিলা, ভারী বুকের ওপর বাঁধল হাত। 

‘মিসেস ডানউইডি।’ 

এই প্রথমবারের মতো হতবাক দেখাল মিসেস হিগলারকে। ‘লোয়েলা বলেছে যে পালক আমার কাছে?’ 

‘হুম, বলেছে যে ওটা তুমি নিয়েছ।’ 

‘নিরাপদে রাখার জন্যই নিয়েছি।’ মিসেস হিগলার ডেইজির দিকে ইঙ্গিত করল, হাতে ধরা কফির মগ দুলিয়ে। ‘ওর সামনে কথা বলব, সেই আশা করতে পারো না। একে আমি চিনি না!’ 

‘ওর নাম ডেইজি। আমাকে যা বলবে, তা ওর সামনেও বলতে পারো।’ 

‘শুনলাম তো,’ মিসেস হিগলার বলল। ‘তোমার সঙ্গে বাগদান হয়েছে।’

মোটকু চার্লি টের পাচ্ছে যে তার গাল লাল হয়ে আসছে। ‘ও আমার বাগদত্তা না–মানে আসলে আমাদের বাগদান হয়নি। অস্ত্রধারী লোকটার কাছ থেকে মেয়েটাকে নিরাপদে সরিয়ে আনার জন্য কিছু একটা তো বলতে হতো। এটাই সবচাইতে সহজ পন্থা মনে হচ্ছিল।’ 

মোটকু চার্লির দিকে তাকাল মিসেস হিগলার। পুরু কাচের ওপাশে থাকা চোখগুলো ঝকঝক করতে শুরু করেছে। ‘সেটা আমিও জানি,’ জানাল মহিলা। ‘তোমার গানের সময়ই টের পেয়েছি, শ্রোতাদের সামনে গাইলে।’ মাথা নাড়ল সে দুপাশে—বয়স্ক মানুষরা অনেকসময় যুবক-যুবতীদের বোকামি দেখলে যেভাবে নাড়ে। কালো পার্সটা খুলে, ভেতর থেকে একটা খাম বের করে সেটা এগিয়ে দিল মোটকু চার্লির দিকে। ‘লোয়েলাকে কথা দিয়েছিলাম, নিরাপদে রাখব।’ 

মোটকু চার্লি খামের ভেতর থেকে বের করে আনল একটা পালক, প্ৰায় থেঁতলে গেছে; এই পালকটাই ধরে রেখেছিল সেই রাতে অন্য দুনিয়া থেকে ঘুরে এসে। ‘বেশ বেশ,’ জানাল ও। ‘পালক, দারুণ। এবার বলো,’ মিসেস হিগলারকে জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। ‘এই জিনিস দিয়ে করবটা কী?’ 

‘জানো না?’ 

মোটকু চার্লির মা ওকে শিখিয়েছিল, সেই কম বয়সে, রেগে গেলে এক থেকে দশ পর্যন্ত গোণা। ধীরে ধীরে, নীরবে গুনতে লাগল সে। কিন্তু দশে আসতেই রাগে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল পুরোপুরি। ‘কী করতে হবে তা জানব কীভাবে? বোকা বুড়ি কোথাকার! গত দুই হপ্তায় আমরা গ্রেফতার হয়েছি, বাগদান ভেঙে গেছে, চাকরি হারিয়েছি, আমার আধা- কাল্পনিক ভাইকে নিজের চোখের সামনে হতে দেখেছি পাখির খাবার… তাও পিকাডেলি সার্কাসে। পাগলের মতো আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিচ্ছি পিং-পং বল হয়ে। আজকে শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইতে হলো, কেন গাইলাম? কেননা যে মেয়ের সঙ্গে খাবার খাচ্ছি তার পেটে বন্দুক চেপে ধরেছিল আমার উন্মাদ, প্রাক্তন-বস। তুমিই বলেছিলে, আমার উচিত ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা। তারপর তো জীবনটাই তছনছ হয়ে গেল, সেটাই আবার সাজাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। তাই না, জানি না এই বালের পালক নিয়ে আমি কী করব! আগুনে পোড়াবো? কেটে গিলব? পাখির বাসা বানাবো? নাকি নাকের সামনে ধরে জানালা দিয়ে লাফ দেব?’ 

গাল ফোলাল মিসেস হিগলার। ‘সেটা তো তোমার লোয়েলা ডানউইডিকে জিজ্ঞেস করতে হবে। 

‘সেই সুযোগ পাবো বলে তো মনে হচ্ছে না। শেষবার যখন দেখা হলো, তখন তাকে ঠিক সুস্থ মনে হচ্ছিল না। তাছাড়া আমাদের হাতে সময়ও বেশি নেই।’ 

ডেইজি বলল, ‘ভালো, খুব ভালো! পালকটা তো পেলে। এবার আমরা গ্রাহাম কোটসকে নিয়ে আলোচনা করতে পারি?’ 

‘এইটা যেন-তেন পালক না। ভাইয়ের বিনিময়ে এই পালক পেয়েছি।’

‘তাহলে আবার ফিরিয়ে দিয়ে কাজে নামো। কিছু একটা তো আমাদেরকে করতেই হবে।’ 

‘ব্যাপারটা এত সহজ না,’ জানাল মোটকু চার্লি। পরক্ষণেই থমকে গেল, ওর কথা আর মেয়েটার কথা মনে মনে আবার আওড়াচ্ছে। সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাল ডেইজির দিকে। ‘খোদা, কী বুদ্ধিমান তুমি!’ বলল সে। 

‘চেষ্টা করি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে,’ জানাল মেয়েটা। ‘কিন্তু এখন আবার কী করলাম?’ 

চারজন বয়স্কা মহিলা নেই হাতের কাছে…কিন্তু আছে মিসেস হিগলার, বেঞ্জামিন আর ডেইজি। খাওয়ার সময়ও শেষ প্রায়, তার মানে প্রধান ওয়েট্রেস ক্লারিসাও যোগ দিতে পারবে ওর সঙ্গে। চারটি আলাদা আলাদা রঙের মাটিও নেই বটে, কিন্তু হোটেলের পেছন থেকে পাওয়া যাবে সৈকতের সাদা বালু; কালো মাটি আসবে সামনের ফুলবিছানা থেকে, হোটেলের পাশে আছে লাল মাটি আর গিফট শপে গেলেই মিলিবে নানা-রঙা বালু। পুলের পাশের বারটা থেকে ছোটো আর সাদা মোমবাতি পাওয়া যাবে; লম্বা আর কালো না যদিও। মিসেস হিগলার ওদেরকে আশ্বস্ত করল: যে যে জড়িবুটি দরকার হবে তা এই দ্বীপেই পাওয়া যাবে। কিন্তু মোটকু চার্লি রান্নাঘর থেকে ব্যুকে গার্নির[৩৩] একটা থলে নিয়ে আসতে বলল ক্লারিসাকে। 

[৩৩. রান্না করার মশলা।]

‘আমার মনে হয়, পুরোটাই আত্মবিশ্বাসের খেলা,’ ব্যাখ্যা করল মোটকু চার্লি। ‘ছোটোখাটো ব্যাপারগুলো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না, দামি হলো জাদুময় আবহাওয়া।’ 

কিন্তু জাদুময় আবহাওয়ায় বাগড়া বাধাল থেকে থেকে বেঞ্জামিন হিগলারের চারপাশে তাকিয়ে হাসিতে ভেঙে পড়া, কিংবা ডেইজির বারংবার পুরো কাজটাকে হাস্যকর বলতে থাকা। 

সাদা ওয়াইন ঢালা পাত্রের ওপর ব্যুকে গার্নির ভেতরের জিনিসগুলো ছড়িয়ে দিল মিসেস হিগলার। অতঃপর শুরু হলো গুঞ্জন, হাত তুলে উৎসাহ দিল সে অন্যদেরকে। তাই দেখে অন্যরাও শুরু করে দিল মন্ত্রপাঠ, অনেকটা মাতাল মৌমাছির মতো করে। কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায় রইল মোটকু চার্লি। 

কিন্তু হলো না কিছুই। 

‘মোটকু চার্লি,’ বলল মিসেস হিগলার। ‘তুমিও যোগ দাও।’ 

ঢোক গিলল মোটকু চার্লি। ভয় পাবার মতো কিছু হয়নি। নিজেকেই শোনাল: কামরা ভরতি শ্রোতার সামনে সে গান গেয়েছে। এমনকী অজানা-অচেনা একদল লোকের সামনে এমন এক মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে যে বলতে গেলে অপরিচিতই। সেসবের তুলনায় গুনগুন তো একেবারেই তুচ্ছ। 

মিসেস হিগলারের সুরটা নিজের গলায় তুলল সে, তারপর গলাটাকে কাঁপতে দিল… 

হাতে ধরে আছে পালক, মনোযোগ দিয়ে আবার গুঞ্জন শুরু করল ও। 

হাসা বন্ধ করে দিল বেঞ্জামিন, চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে। চেহারায় ফুটে আছে ভয়ের একটা চিহ্ন, মোটকু চার্লি গুনগুন বন্ধ করে দিতো হয়তো…কিন্তু ততক্ষণে তালটা ওর ভেতরে ঢুকে গেছে। মোমের আলোও কাঁপছে প্রবলভাবে… 

‘দেখো, ওকে দেখো!’ বলল বেঞ্জামিন। ‘মানুষটা তো—’ 

মোটকু চার্লি ভাবল, মানুষটা…মানে ওর নিজের কী হয়েছে? কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। 

চোখের সামনে থেকে দূর হয়েছে কুয়াশা। 

একটা সেতু ধরে হাঁটছে মোটকু চার্লি, ধূসর পানির বিশাল একটা আধারের ওপর অবস্থিত ওই লম্বা, সাদা সেতু। ঠিক মাঝখানে বসে আছে এক লোক, ছোট্ট একটা কাঠের চেয়ারে; মাছ ধরছে এক মনে। মাথার সবুজ ফেডোরা টুপির কারণে চোখ দেখাই যায় না। মনে হচ্ছে যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে সে, মোটকু চার্লিকে আসতে দেখেও ভাবান্তর হলো না। 

লোকটাকে চিনতে পারল মোটকু চার্লি, এগিয়ে গিয়ে একটা হাত রাখল তার কাঁধে। 

‘আমি জানতাম,’ বলল যুবক। ‘তুমি আসলে মরার ভান ধরেছ, কখনো ভাবিনি যে সত্যি সত্যি তুমি আর বেঁচে নেই।’ 

চেয়ারে বসা মানুষটা নড়ল না বটে, তবে হাসল। ‘তোমার জ্ঞান যে কত অল্প, এতে সেটাই প্রমাণিত হয়,’ বলল আনানসি। ‘আমি শতভাগ মৃত।’ আলস্যে ভরা আড়মোড়া ভাঙল সে একটা, কানের পেছন থেকে কালো চুরুট বের করে এনে গুঁজে দিল নিজের দুই ঠোঁটের ফাঁকে। আগুন ধরিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি মারা গেছি। আরও কিছুদিন হয়তো এভাবেই থাকব। মাঝে-মধ্যে না মরলে, মানুষের কাছে দাম থাকে, বলো?’ 

মোটকু চার্লি বলল, ‘কিন্তু—’ 

ঠোঁট আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে চুপ করতে বলল ওকে আনানসি। বড়শি তুলে নিয়ে সুতো গোটাতে শুরু করল সে, ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল একটা ছোট্ট জাল। মোটকু চার্লি তুলে নিলো সেটা, ওর বাবা তাতে একটা লম্বা, ছটফট করতে থাকা রূপালি মাছ ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত ধরেই রইল। মুখ থেকে বড়শির হুক ছাড়িয়ে নিয়ে, এরপর একটা সাদা বালতিতে রাখল মাছটাকে। ‘এই নাও,’ বলল সে। ‘আজ রাতের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’ 

এই প্রথম বারের মতো মোটকু চার্লি আবিষ্কার করল: ডেইজি আর হিগলারদের সঙ্গে যখন আসনে বসেছিল তখন গভীর রাত হলেও, এখন যেখানে আছে সেখানকার সূর্যটা ডুবতে বসেছে! এখনও সূর্যাস্ত হয়নি। 

চেয়ার ভাঁজ করে ফেলল ওর বাবা। মোটকু চার্লিকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল চেয়ার আর বালতি বহন করার কথা। তারপর পাশাপাশি, ওই সেতুর ওপরেই হাঁটতে লাগল ওরা। ‘একটা কথা কী জানো, বলল মি. ন্যান্সি। ‘সবসময় ভেবেছি, যদি কখনো আমার সঙ্গে কথা বলতে আসো তাহলে অনেক কিছু শোনাব তোমাকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তার দরকার পড়বে না। যাই হোক, এখানে এসেছ কেন?’ 

‘ঠিক জানি না। পাখি-মানবীকে খুঁজছিলাম। ভেবেছিলাম, ওকে তার পালকটা ফিরিয়ে দেব।’ 

‘কাজটা একদম ঠিক করোনি,’ হাসিমুখেই বলল ওর বাবা। ‘এসব করে কখনওই ভালো কিছু হয় না। পাখি-মানবীকে ঘৃণার ডিপো বললেও অত্যুক্তি হবে না। তবে সাহস নেই একদম।’ 

‘আসলে স্পাইডারকে—’ বলতে চাইল মোটকু চার্লি। 

‘সেই দোষটাও তো তোমারই। ওই বুড়ো মহিলাকে কেন করতে দিয়েছিলে কাজটা? কেন তোমার অর্ধেক সত্তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার অনুমতি দিলে?’ 

‘তখন তো ছোটো বাচ্চা ছিলাম! তুমি কেন কিছু করলে না?’ 

মাথার টুপিটা একপাশে কাত করাল আনানসি। ‘যদি তুমি করতে না দিতে, তাহলে বুড়ি ডানউইডি কিছুই করতে পারত না,’ জানাল সে। ‘হাজার হলেও, তুমি আমার সন্তান!’ 

কথাটা নিয়ে ভাবল মোটকু চার্লি। তারপর বলল, ‘কিন্তু আমাকে কখনও কেন বলোনি?’ 

‘অসুবিধে হতে দেখিনি যে, ঠিকঠাক মতোই তো জীবন কাটাচ্ছিলে। হাজার হলেও, গানের মাহাত্ম্য তো একা-একাই ধরে ফেলেছ, তাই না?’ 

মোটকু চার্লির মনে হলো, আগের চাইতেও অনেক বেশি মোটা আর অপটু হয়ে গেছে সে। এমনকী বাবাকে হতাশ করার অনুভূতিও পেয়ে বসেছে ওকে। কিন্তু সেরেফ ‘না’ বলে কাজ চালাল না। উলটো বলল, ‘তোমার কী মনে হয়?’ 

‘পুরোপুরি না ধরতে পারলেও, কাছাকাছি গেছ। গানের ব্যাপারে একটা কথা মাথায় রাখতেই হয়—ওগুলো গল্পের মতোই। মানুষ যদি মন দিয়ে না শোনে, তাহলে কোনোটা দিয়েই লাভ হয় না।’ 

সেতুর প্রায় শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে ওরা। মোটকু চার্লি জানে এবং কারও ওকে বলে দিতে হয়নি—যে আর কখনও পিতা-পুত্রের কথা-বার্তা হবে না। কিন্তু জানার যে আছে অনেক কিছু, দরকারও অনেক জ্ঞান আহরণে। বলল, ‘বাবা, যখন আমি ছোটো ছিলাম, তখন কেন আমাকে কেবল লজ্জা দিতে? লজ্জায় ফেলতে?’ 

কুঁচকে গেল বয়স্ক লোকটার ভ্রু। ‘লজ্জা দিতাম? তোমাকে ভালোবাসতাম আমি!’ 

‘প্রেসিডেন্ট ট্যাফটের সাজে স্কুলে পাঠিয়েছিলে আমাকে…এই তোমার ভালোবাসা?’ 

তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চিৎকারটা বুড়ো মানুষটার হাসিও হতে পারে। যাই হোক, এক মুহূর্ত পরেই চুরুট টানায় মন দিল সে। ভূতুড়ে বেলুনের মতো তার ঠোঁট থেকে বেরোতে লাগল ধোঁয়া। ‘তোমার মা-ও এই ব্যাপারে কিছু কথা শুনিয়েছিল,’ বলল সে। তারপর যোগ করল, ‘আমাদের হাতে সময় বেশি নেই, চার্লি। সেই খানিকক্ষণও কি ঝগড়া করে কাটাতে চাও?’ 

মাথা নাড়ল মোটকু চার্লি, ‘একদম না।’ 

সেতুর শেষ মাথায় পৌঁছে গেল ওরা। ‘ভালো কথা,’ বলল ওর বাবা। ‘ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে, আমার তরফ থেকে একটা জিনিস পৌঁছে দিয়ো।’ 

‘কী?’ 

হাত বাড়িয়ে, মোটকু চার্লির মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিল ওর বাবা। তারপর আস্তে করে কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘এটা।’ 

সোজা হয়ে দাঁড়াল মোটকু চার্লি। এমন দৃষ্টিতে তার বাবা তাকিয়ে আছে ওর দিকে, যেটাকে অন্য কারও চোখে দেখলে গর্ব-মিশ্রিত বলেই মনে করত। ‘পালকটা দেখি,’ বলল বয়স্ক লোকটা। 

পকেটে হাত ঢোকাল মোটকু চার্লি। পালকটা আছে ওখানেই, তবে আগের চাইতে অনেক বেশি দলা পাকানো আর ধ্বংস-প্রায় মনে হচ্ছে। 

জিহ্বা দিয়ে টুট টুট আওয়াজ করে আলোতে উঁচু করে পালক ধরল ওর বাবা। ‘দারুণ তো পালকটা,’ বলল সে। ‘কিন্তু এই দশা দেখতে ভালো লাগছে না। পাখি-মানবী সেটা ফেরতও নেবে না।’ মি. ন্যান্সি হাত বুলালো ওটার ওপর, সঙ্গে সঙ্গে আবার নিখুঁত হয়ে গেল পালকটা। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘লাভ কী? আবার আগের দশাই বানাবে এটার।’ নখে ফুঁ দিয়ে, জ্যাকেটের সঙ্গে ঘষল ওগুলো। মনে হলো, কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ফেডোরাটা খুলে, সেটার ব্যান্ডের ভেতর গুঁজে দিল পালক। ‘এই নাও, পাগল-দর্শন একটা হ্যাট তোমার দরকার হয়ে পড়েছে।’ মোটকু চার্লির মাথায় পরিয়ে দিল ফেডোরাটা। ‘মানিয়েছে বেশ,’ বলল সে। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোটকু চার্লি। ‘বাবা, আমি হ্যাট পরি না। দেখতে বোকার মতো লাগবে, হাসবে সবাই। আমাকে লজ্জায় ফেলার চেষ্টা কেন করো সব সময়?’ 

মরতে বসা আলোতে, ছেলের দিকে চাইল বৃদ্ধ লোকটা। ‘তোমার ধারণা, আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলব? শোনো বাছা, হ্যাট পরার জন্য যা দরকার তা হলো ভাবভঙ্গী। সেটা তোমার যথেষ্টই আছে। যদি না মানাত, তাহলে মিথ্যে কথা বলতাম? বুদ্ধিমান দেখাচ্ছে তোমাকে। বিশ্বাস করো না আমার কথা?’ 

সাফ জবাব দিল মোটকু চার্লি, ‘নাহ!’ 

‘দেখো,’ বলল ওর বাবা, সেতুর এক ধার দিয়ে পানি দেখাল সে। ওদের পায়ের নিচে থাকা পানিতে ঢেউ নেই, একেবারে স্থির… আয়নার মতোই। পানির ভেতর থেকে যে লোকটা উঁকি দিল, তাকে সবুজ হ্যাটে বুদ্ধিমান ও স্মার্ট দেখা যাচ্ছে। 

হয়তো ভুল বলেনি, বলার জন্য বাপের দিকে তাকাল মোটকু চার্লি; কিন্তু বৃদ্ধ লোকটা ততক্ষণে হাওয়ায় উবে গেছে। 

সেতু থেকে নেমে, সূর্যাস্তের দিকে রওনা দিল ও। 

.

‘বেশ, এবার বলো: ঠিক কোথায় আছে ও? গেছে কই? ওর কী হাল করেছ তোমরা?’ 

‘আমি কিছুই করিনি। শোনো বাছা, বলল মিসেস হিগলার। ‘আগেরবার এটা হয়নি।’ 

‘দেখে মনে হচ্ছিল, মাদারশিপে কেউ টেনে নিয়ে গেছে ওকে,’ জানাল বেঞ্জামিন। ‘দারুণ, বাস্তব জীবনেই স্পেশাল ইফেক্টস!’ 

‘ওকে ফিরিয়ে আনো,’ বলল ডেইজি, রাগত ভঙ্গিতে। ‘এখুনি ফিরিয়ে আনো!’ 

‘কোথায় গেছে, তাই তো জানি না,’ জানাল মিসেস হিগলার। ‘আর আমি কাউকে কোথাও পাঠাইনি, সে নিজেই গেছে।’ 

‘যাই হোক,’ বলল ক্লারিসা। ‘হয়তো যেটা করতে চাচ্ছিল, সেই কাজেই লেগে আছে এখন। ওকে এখন ফিরিয়ে আনলে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে!’ 

‘ঠিক বলেছ,’ জানাল বেঞ্জামিন। ‘মিশন অর্ধেক পথে রেখেই অভিযাত্রী ফিরিয়ে আনার মতো হবে ব্যাপারটা।’ 

ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল ডেইজি, কথাটা যুক্তিযুক্ত ধরতে পেরে খানিকটা বিরক্তই হলো—আজকাল অবশ্য অদ্ভুত অনেক কিছুই যুক্তিযুক্ত লাগতে শুরু করেছে। 

‘যদি আর কিছু ঘটার সম্ভাবনা না থাকে,’ জানাল ক্লারিসা। ‘তাহলে রেস্তোরাঁয় ফিরে যাই? আশা করি সব ঠিকই আছে।’ 

কফির মগে চুমুক দিল মিসেস হিগলার। ‘মনে হয় না কিছু ঘটবে,’ জানাল সে। 

টেবিলে চাপড় বসাল ডেইজি। ‘এক্সকিউজ মি, বাইরে একটা খুনি ঘোরাফেরা করছে। এদিকে মোটকু চার্লিকে মাস্টারশিপে তুলে নেওয়া হয়েছে।’ 

‘মাদারশিপ,’ বলল বেঞ্জামিন। 

চোখ পিটপিট করল মিসেস হিগলার। ‘বেশ তাহলে,’ বলল সে। ‘কিছু একটা করা তো দরকার। কিন্তু কী করা যায়?’ 

‘আমি জানি না,’ মেনে নিলো ডেইজি, কথাটা বলতে হচ্ছে বলে নিজের ওপরেই বিরক্ত। ‘সময় নষ্ট করা ছাড়া তো আর কিছু করার নেই।’ মিসেস হিগলার উইলিয়ামসটাউন কুরিয়ার-এর যে কপিটা পড়ছিল, সেটার পাতা ওলটাতে লাগল সে। 

গল্পটা লেখা হয়েছে হারানো পর্যটকদের নিয়ে, তিন নম্বর পাতায় ছাপা হয়েছে যে মেয়েরা তাদের ক্রুজ শিপে ফেরেনি তাদের নিয়ে একটা লেখা। সেজন্যই ওই দুজনকে পাঠিয়েছ, তাই না? আমার বাড়িতে? ডেইজির মাথার ভেতরে ঢুকে যেন বলল লোকটা। ক্রুজ শিপে করে ঘুরতে ঘুরতে আচমকা এসে উপস্থিত হয়েছে—এই গপ্পো আমি বিশ্বাস করব, তা ভাবলে কী করে? 

দিন শেষে, ডেইজি তো পুলিসই! 

‘আমাকে ফোনটা দাও,’ বলল সে। 

‘কাকে ফোন করবে?’ 

‘প্রথমে পর্যটন মন্ত্রী আর পুলিস চিফকে দিয়ে শুরু করব। তারপর দেখা যাক, আর কাকে কাকে করা যায়…’ 

.

লালচে সূর্য ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে। স্পাইডার, যদি স্পাইডার না হতো, তাহলে হতাশায় ডুবে যেত। দ্বীপে, মানে ওই স্থানে, দিন আর রাতের পার্থক্য একেবারে পরিষ্কার। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল সে-সূর্যের শেষ অংশটুকুও গিলে নিচ্ছে সাগর। এদিকে ওর কাছে আছে শুধু পাথর আর দুটো গজাল। 

আগুন হলে ভালো হতো। 

ভাবতে লাগল, চাঁদ কখন উঠবে। চাঁদ উঠলে, হয়তো আত্মরক্ষার একটা উপায় পাবে সে। 

ডুবে গেল সূর্য—কালো সাগরে ডুব দিল লালের শেষ বিন্দুটাও। রাত নেমে এলো। 

‘আনানসির সন্তান,’ অন্ধকার থেকে ভেসে এলো একটা কণ্ঠ। ‘অচিরেই পেট পুরে খাবো আমি। ঘাড়ে আমার শ্বাসের ছোঁয়া পাবার আগে, আমার উপস্থিতি ধরতেও পারবে না! যখন হাত-পা বেঁধে তোমাকে ফেলে রাখা হয়েছিল, তখনও তোমার ওপরে ছিলাম আমি। চাইলে সেই মুহূর্তেই কামড়ে ঘাড় ভেঙে ফেলতে পারতাম। কিন্তু ভাবলাম, রসিয়ে রসিয়ে করা যাবে কাজটা। ঘুমের মাঝে তোমাকে হত্যা করে তৃপ্তি মিলত না। তোমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে—সেটা আমি অনুভব করতে চাচ্ছিলাম। চাচ্ছিলাম তুমি জানো—কেন মরতে হচ্ছে তোমাকে।’ 

কণ্ঠটা যেখান থেকে আসছে মনে হচ্ছে, সেদিকে পাথর ছুড়ল স্পাইডার। টের পেল: কারও ক্ষতি না করে একটা ঝোপে গিয়ে পড়ল সেটা। 

‘তোমার আছে পাথর আর হাত,’ বলল কণ্ঠটা। ‘কিন্তু আমার নখরগুলো ছুরির চাইতে তীক্ষ্ণ ও ধারাল। দুটো পা আছে তোমার, কিন্তু আমার চার পায়ে ক্লান্তি ভর করে না; তোমার স্বপ্নের চাইতেও দশগুণ গতিতে দৌড়াতে পারি। তোমার দাঁত মাংস ছিঁড়তে পারে বটে, কিন্তু তার জন্য দরকার হয় সেটাকে আগুনে পুড়িয়ে নরম আর স্বাদহীন বানানোর। তোমার দাঁতগুলো বানরের দাঁতের মতো, নরম ফল আর কীটপতঙ্গ বাদে অন্য কিছু খাওয়ার জন্য তা যথেষ্ট না। কিন্তু আমার দাঁত হাড় থেকে মাংস টেনে ছিঁড়তে সক্ষম। রক্ত গরম আর প্রবাহিত থাকা অবস্থায় গলাধঃকরণ করি সেটা।’ 

ঠিক তখনই একটা আওয়াজ করল স্পাইডার; এমন এক আওয়াজ যা করার জন্য জিহ্বা লাগে না, এমনকী লাগে না ঠোঁটও। বিরক্তি প্রকাশ করার মতো ‘মেহ’ শোনাল আওয়াজটা। তুমি যা বলছ, তার সবটাই সত্যি, বাঘ। বলল যেন সেই আওয়াজ। কিন্তু তাতে কী? সব গল্প আনানসির, এখন কেউ বাঘের গল্প বলে না! 

অন্ধকারের বুক চিরে ভেসে এলো একটা গর্জন, রোষ আর হতাশা মিশে আছে সেই গর্জনে। 

গুনগুন করতে লাগল স্পাইডার, ‘টাইগার র‍্যাগ’ নাম গানটার। পুরাতন একটা গান, বাঘদেরকে বিদ্রূপ করার জন্য ভালো: ধরে রাখো বাঘটাকে, গেল কই ওটা? 

পরেরবার যখন কণ্ঠটা অন্ধকার থেকে ভেসে এলো, তখন অনেক বেশি কাছাকাছি মনে হলো তার উৎসটাকে 

‘তোর প্রেমিকা আমার মুঠোয়, আনানসির সন্তান। তোর একটা ব্যবস্থা করার পর, ওর হাড় থেকে মাংস ছিঁড়ে খাবো আমি। সন্দেহ নেই, তার মাংস তোর চেয়ে বেশি সুস্বাদু হবে।’ 

‘হুম্ফ!’ আওয়াজ করল স্পাইডার, বোঝাতে চাইল যে সে মিথ্যেটা ধরে ফেলেছে! 

‘ওর নাম—রোজি।’ 

অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে এলো স্পাইডারের। 

অন্ধকারেই গা ঢাকা দিয়ে হেসে উঠল কেউ একজন। ‘চোখের কথা আর কী বলব,’ বলল কণ্ঠটা। ‘তোমার চোখ শুধু তাই দেখে যা দিনের আলোতে দেখা যায়, তাও যদি কপাল ভালো হয় তবেই। কিন্তু আমার প্রজাতির সদস্যরা এখানে থাকলে তোমার হাতের ছোটো ছোটো লোমগুলোও দেখতে পেত। তোমার চোখ-মুখের আতঙ্ক, এমনকী এই রাতের অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার। আমাকে ভয় পাও, আনানসির সন্তান; যদি কারও কাছে প্রার্থনা করার মতো কিছু থাকে, তাহলে এখনই বলো।’ 

তেমন কোনো প্রার্থনা নেই স্পাইডারের। তবে হাতের কাছে পাথর আছে, সেগুলো ছুঁড়তে পারে চাইলে। কপাল ভালো থাকলে হয়তো ওটা কোনো ক্ষতি করলেও করতে পারে। স্পাইডার ভালো মতোই জানে, ব্যাপারটা হবে অলৌকিক। তাতে কী? আজীবন তো অলৌকিক কাণ্ডই ঘটিয়ে এসেছে। 

আরেকটা পাথরের দিকে হাত বাড়াল সে। 

কিন্তু ওর হাতের পিঠটা স্পর্শ করল কিছু একটা। 

হ্যালো, ওর মনের মাঝে বলল কাদার তৈরি ছোট্ট মাকড়শাটা। 

হাই, ভাবল স্পাইডার। দেখো, আমি একটু ব্যস্ত আছি। চাচ্ছি, যাতে কেউ আমাকে খেয়ে না ফেলে। যদি আপাতত শান্তিতে থাকত দাও, তাহলে হয়তো… 

কিন্তু ওদেরকে নিয়ে এসেছি যে, ভাবল মাকড়শাটা। যেমনটা তুমি করতে বলেছিলে। 

আমি বলেছিলাম? 

বলেছিলে, সাহায্য আনতে। নিয়ে এসেছি। আমার ফাঁদা জাল অনুসরণ করে এসেছে তারা। এই জগতে মাকড়শা নেই, তাই ওই জগতে গিয়ে জাল পেতে ওদেরকে নিয়ে এসেছি এখানে। সাহসীদের, ধনীদের এনেছি নিজের সঙ্গে। 

‘ভাবছ কী?’ অন্ধকার থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল বিশাল বিড়ালটা। তারপর খানিকটা আমোদের সঙ্গে বলল, ‘কী হলো? বিড়াল জিভ খেয়ে ফেলেছে?’ 

মাকড়শা নীরব প্রজাতি। তারা নীরবতা ঘনিয়ে তোলে। যেগুলো আওয়াজ করে, সেগুলোও সাধারণত যতটা সম্ভব স্থিরই থাকে; থাকে অপেক্ষায়… 

…স্পাইডারও তাই করছে। 

আস্তে আস্তে রাতের নীরবতাকে দূর করে সেই স্থান দখল করে নিচ্ছে নরম একটা আওয়াজ। 

নিজের রক্ত আর থুতু মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যে সাত পাঅলা মাকড়শাটা বানিয়েছিল, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা আর গর্ব অনুভব করল স্পাইডার। মাকড়শাটা ওর হাতের পেছন থেকে কাঁধে উঠে এলো। 

দেখতে না পেলেও স্পাইডার জানে: আছে ওগুলো–বড়ো মাকড়শা, ছোটো মাকড়শা, বিষাক্ত মাকড়শা, বিশাল বিশাল সব লোমশ মাকড়শা, সেই সঙ্গে চিটিনদেহী মাকড়শাও। এমনিতে আলোর দিকে নজর ওদের পড়ে বটে, কিন্তু দেখে পা দিয়ে। চারপাশের দুনিয়া থেকে কম্পন শুষে তাকে কল্পনা করে। 

এবং ওকে সাহায্য করার জন্য পুরো একটা বাহিনী চলে এসেছে। 

অন্ধকার থেকেই আবার মুখ খুলল বাঘ। ‘যখন তুমি মারা যাবে— যখন আনানসির বংশের সবাই মারা যাবে—তখন সব গল্প আবার আমার হবে। আরও একবার, মানুষ শোনাবে বাঘের গল্প। সমবেত হয়ে আমার শক্তি আর বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করবে। শোনাবে আমার নৃশংসতা আর আমার আনন্দের আখ্যান। সব গল্প হবে আমার, সব গানের মালিকও আমিই হবো। আগে যা ছিল, দুনিয়া আবার সেটাই হবে: রুক্ষ একটা জায়গা, অশুভ একটা স্থান।’ 

বাহিনীর নড়া-চড়ার আওয়াজ শুনতে পেল স্পাইডার। 

কারণ আছে বলেই পাহাড়ের শীর্ষের একদম ধারে বসে আছে সে। পালাবার পথ নেই—সেকথা সত্য। কিন্তু এখানে থাকার মানে: বাঘও চোখ বন্ধ করে ছুটে আসতে পারছে না। এমনকী আড়াল নিয়ে ওর কাছাকাছিও হতে পারছে না। 

হাসতে শুরু করল স্পাইডার। 

‘হাসছ কেন, আনানসির সন্তান? মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ 

কথাটা শুনে স্পাইডারের হাসি আরও বেড়ে গেলে, হলো জোরাল। 

অন্ধকার থেকে ভেসে এলো নেকড়ের গর্জনের মতো আওয়াজ। স্পাইডারের বাহিনীর সামনে পড়ল বাঘ। 

মাকড়শার বিষের রূপ একাধিক। কামড়ের ফলাফল অনুভব করার জন্য কখনও কখনও অনেকক্ষণ লেগে যায়। প্রকৃতিবিদরা বহুদিন হলো এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে: এমন অনেক মাকড়শা আছে যাদের কামড় দেওয়া স্থানটা পচে যায়, যাকে কামড় দেওয়া হয়েছে তার মরতে বছরখানেকও লেগে যায় অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু মাকড়শা এমনটা কেন করে? এই প্রশ্নের জবাব একেবারে সোজা: তাদের কাছে ব্যাপারটা মজার মনে হয়…আর তারা চায় না, কেউ কখনও তাদের কথা ভুলে যাক। 

বাঘের আহত নাকে কামড় বসাল ব্ল্যাক উইডো, কানে বসাল টরেন্টুলা: কয়েক মুহূর্তের মাঝে বাঘের স্পর্শকাতর সব স্থান জ্বলতে আর দপদপ করতে লাগল, সেই সঙ্গে চুলকাচ্ছেও প্রচণ্ড ভাবে। বাঘ বুঝতেই পারছে না, কী হচ্ছে ওর সঙ্গে! শুধু টের পাচ্ছে, ওর দেহের নানা অংশ ব্যথায় জ্বলছে… 

…আর টের পাচ্ছে: ওর অন্তরে স্থান করে নিয়েছে আতঙ্ক। 

হাসল স্পাইডার, এবার আগের চাইতেও জোরে, আরও বেশিক্ষণ ধরে। বিশাল প্রাণিটার ঝোপের ভেতর ছুট লাগাবার আওয়াজ শুনল কান পেতে; ভয়ে আর যন্ত্রণায় গজরাচ্ছে। 

তারপর বসে বসে করতে লাগল অপেক্ষা। বাঘ ফিরবেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই নাটকের যবনিকাপাত হতে দেরি আছে। 

সাত পাঅলা মাকড়শাটাকে কাঁধের ওপর থেকে নামিয়ে, আদর করে দিল পিঠে হাত বুলিয়ে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিছুটা নিচে দেখা যাচ্ছে নরম, ঠান্ডা সবুজ আলো। দপদপ করছে ওটা, যেন ছোট্ট কোনো শহর থেকে ভেসে আসা আলো। আসছে ওরই দিকে! 

দপদপানির উৎস যে আসলে লাখখানেক জোনাকি পোকা। সেই আলোর ঠিক মাঝখানে দেখা যাচ্ছে একটা মানুষের অবয়ব। ধীর কিন্তু স্থির বেগে উঠছে সে পাহাড় বেয়ে। 

পাথর হাতে তুলে নিলো স্পাইডার, ওর মাকড়শা-বাহিনীকে মনে মনে নির্দেশ দিল আরেকটা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে। পরক্ষণেই থেমে গেল সে। জোনাকির আলোয় দেখতে পাওয়া অবয়বটার কিছু একটা পরিচিত মনে হচ্ছে। 

চিনতে বেগে পেতে হলো না ওকে। পরিচিত জিনিসটা আসলে একটা সবুজ ফেডোরা! 

.

রান্নাঘরে আধ বোতল রাম খুঁজে পেয়েছিল গ্রাহাম কোটস, সেটার প্রায় পুরোটাই শেষ করে ফেলেছে ও। মদ আনতে নিচে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি বলেই রামের বোতলটা খুলেছিল সে। তাছাড়া ওয়াইনের চাইতে রামের প্রভাব দ্রুততর হবার কথা। কপাল মন্দ, তা হলো না। মাতলামির লক্ষণও নেই তার দেহে। মানসিক ভাবে অবশ হবার যে উদ্দেশ্যে রামটাকে হাতে নিয়েছিল, সেটাও হলো না। 

এক হাতে বোতল আর অন্য হাতে আধ-ভরতি একটা গ্লাস নিয়ে পায়চারি করছে সে। থেকে থেকে একটায় চুমুক দিচ্ছে, আবার খানিক পরে অন্যটায়। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি নজরে পড়ল তার, ঘামছে প্রবলভাবে; সেই সঙ্গে চেহারাটাও বিধ্বস্ত। ‘মন খারাপ করার কিছু নেই,’ উচ্চকণ্ঠে বলল সে। ‘হয়তো কখনও কিছুই হবে না। শাপের মাঝেই বর থাকে, কালো মেঘে থাকে বৃষ্টি।’ রাম ততক্ষণে প্রায় শেষই বলা চলে। 

রান্নাঘরে ফিরে গেল গ্রাহাম কোটস। শেরির বোতলটা খুঁজে পেতে, বেশ কয়েকটা কাপবোর্ড খুলতে হলো ওকে। বোতলটা হাতে নিয়ে, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ওটাকে আদরই করল বলা যায়। যেন আকারে খুবই ক্ষুদ্র এক বন্ধু ওটা, যে বহু বছর সাগরে কাটাবার পর ফিরে এসেছে আবার। 

বোতলের ছিপি খুলল সে। রান্না করার কাজে ব্যবহৃত হয় এমন মিষ্টি শেরির বোতল ওটা। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে, লেবুর রসের মতো মদ ঢালতে লাগল গলায়। 

রান্নাঘরে মদ খোঁজার সময়, আরও কয়েকটা জিনিস নজরে পড়েছে গ্রাহাম কোর্টসের। এই যেমন, বেশ কিছু ছুরি আছে ওখানে; কয়েকটা তো মারাত্মক তীক্ষ্ণ। একটা ড্রয়ারে একটা ছোট্ট, ইস্পাতের তৈরি হ্যাকস-ও আছে। গ্রাহাম কোর্টসের পছন্দ হয়েছে ওটা, ভাঁড়ারে যে দুই সমস্যা আটকে রেখেছে তাদের একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে হ্যাকসটা দিয়ে। 

‘হেবিয়াস করপাস[৩৪],’ বলল সে। ‘কিংবা হেবিয়াস ডিলেকটি[৩৫]… দুটোর কোনো একটা হবে। যদি লাশ না পাওয়া যায়, তাহলে অপরাধ হয়েছে তা প্রমাণ করার উপায়ও থাকবে না। তাই, কুয়োড এরাট ডেমোনস্ট্রানডাম‍[৩৬]!’ 

[৩৪. আদালতের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রকে আসামী গ্রেফতার পেছনে যুক্তি উপস্থাপনের নির্দেশ। 
৩৫. অপরাধ যে হয়েছে, তার পক্ষে নিরেট প্রমাণ উপস্থাপন। 
এই ক্ষেত্রে গ্রাহাম কোটস বোঝাতে চাইছে, লাশ গুম করে দিলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করার পেছনে কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো নিরেট যুক্তি বা প্রমাণ থাকবে না। 
৩৬. যা প্রমাণ করতে হবে।]

জ্যাকেটের পকেট থেকে অস্ত্র বের করে রেখে দিল রান্নাঘরের টেবিলের ওপর। তারপর ছুরিগুলোকে চাকার স্পোকের মতো করে সাজালো। ‘এবার, ‘ বলল সে, অবিকল সেই কণ্ঠে যে কণ্ঠ ব্যবহার করে নিরীহ বাচ্চা ছেলেদের ব্যান্ডকে বোঝাতো সময় এসেছে ওর সঙ্গে চুক্তি সই করে খ্যাতির সাগরে গাঁ ডোবানোর। ‘সময়ের এক ফোঁড়… ‘ 

বেল্টে গুঁজে নিলো তিনটে ছুরি, হ্যাকস গেল ওর জ্যাকেটের পকেটে। তারপর অস্ত্র হাতে নেমে গেল সেলারের দিকে। বাতি জ্বালিয়ে, চোখ পিটপিট করে দেখে নিলো উভয় পাশের র‍্যাকে থাকা সারিবদ্ধ মদের বোতলগুলোকে; ধুলো জমেছে ওগুলোয়। সব শেষে দাঁড়াল ভাঁড়ার ঘরের দরজার সামনে। 

‘জেনে খুশি হবে,’ চেঁচিয়ে উঠল সে। ‘সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না। উভয়কেই ছেড়ে দেব। সবই ভুল বোঝাবুঝির ফল, আশা করি রাগ পুষে রাখবে না। যা হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে। ওপাশের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াও, আগে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলে। চালাকির চেষ্টা কোরো না।’ 

ছিটকিনি টানার সময় ভাবছিল, অস্ত্রধারীর চেঁচিয়ে বলার মতো অতি- নাটকীয় কত বাক্যই না আছে! গ্রাহাম কোটসের মনে হলো, তারই দুয়েকটা ব্যবহার করে একটা দলে নাম লিখিয়েছে সে। কপস নামের টিভি শোতে সেই দলের অন্যান্য সদস্যরা—এই যেমন ক্যাগনি ও অন্যরা—একই বাক্যগুলো আওড়ায়। 

বাতি জ্বালিয়ে দরজা ধরে টান দিল একটা। দূরের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রোজির মা, ওর দিকে পিঠ দিয়ে। গ্রাহাম কোটস ভেতরে পা রাখতেই স্কার্ট তুলে ধরে হাড়সর্বস্ব, নগ্ন নিতম্বটা দোলাতে লাগল মহিলা! 

হাঁ হয়ে গেল গ্রাহাম কোর্টসের মুখ। ঠিক পরক্ষণেই ভারী শিকলটা দিয়ে ওর কবজিতে আঘাত হানল রোজি। হাত থেকে ছিটকে কামরার অন্য পাশে চলে গেল অস্ত্র। 

রোজির মা গ্রাহাম কোটসের ঊরুসন্ধিতে যে লাথিটা বসাল, তেমন নিখুঁত তাক আর আগ্রহ কমবয়সী মেয়েদের সঙ্গেই বেশি মানায়। আহত স্থান চেপে ধরে, উবু হয়ে গেল গ্রাহাম কোটস। ওর কণ্ঠ থেকে যে উচ্চ তরঙ্গের আওয়াজ বেরোল তা শোনার জন্য কুকুর কিংবা বাদুরের কান লাগবে। 

সুযোগ বুঝে ভাঁড়ার থেকে পালাতে লাগল রোজি আর ওর মা 

দরজা বন্ধ করে দিল বাইরে বেরিয়েই, ছিটকিনি টেনে লাগিয়ে দিল রোজি। এরপর মাকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। 

সব বাতি যখন নিভে গেল, তখনও ওরা সেলারেই আছে। 

‘ফিউজ জ্বলে গেছে,’ মাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল রোজি, যদিও নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা। তবে এছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যাও যে আসছে না মাথায়। 

‘দুটো ছিটকিনিই লাগিয়ে দিতে হতো,’ বলল ওর মা। পরক্ষণেই যোগ করল, ‘আউ!’ পায়ের বৃদ্ধাঙুল বাড়ি খেয়েছে কিছু একটার সঙ্গে। 

‘ভালো একটা দিকের কথাও বলি,’ জানাল রোজি। ‘ওই লোকটাও অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না। আমার হাত ধরো, সিঁড়ি বোধহয় এদিক দিয়ে।’ 

গ্রাহাম কোটস ভাঁড়ারের মেঝেতে হাতে-পায়ে ভর করে উবু হয়ে আছে; অন্ধকারে, আলো হঠাৎ করেই নেই হয়ে গেছে। পা বেয়ে গরম কিছু একটা গড়িয়ে পড়ছে। অস্বস্তির সঙ্গে এক মুহূর্ত ভাবল–প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছে হয়তো। পরক্ষণেই টের পেল, যে ছুরিগুলো এনেছিল সেগুলোরই একটার ফলা ওর বেল্ট কেটে পায়ের ওপরের অংশে কামড় বসিয়েছে। 

নড়া-চড়া বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে রইল গ্রাহাম কোটস। সিদ্ধান্ত নিলো, এমন মাতাল হয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ই দিয়েছে সে: এক হিসেবে চেতনানাশক ওষুধ-ই বলা যায় ওটাকে। তাই ঘুমিয়ে পড়াই ভালো হবে। 

ভাঁড়ার ঘরে একা নেই সে। এখানে কেউ একজন আছে ওর সঙ্গে। এমন কিছু একটা যেটা চার পায়ে হাঁটছে। 

গর্জে উঠল কেউ একজন, ‘উঠে দাঁড়াও!’ 

‘পারব না, আমি আহত। বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে চাই। 

‘জঘন্য একটা জানোয়ার তুমি, যা স্পর্শ করো তাই নষ্ট হয়ে যায়। এখন উঠে বসো।’ 

‘পারলে তো ভালোই হতো,’ মাতালের মতো কণ্ঠে বলল গ্রাহাম কোটস। ‘কিন্তু পারব না। মেঝেতেই খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। যাই হোক, মেয়েটা দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি টেনে দিয়েছে। আওয়াজ শুনেছি।’

দরজার অন্য পাশ থেকে ভেসে এলো আঁচড়ানোর আওয়াজ, যেন কেউ আস্তে আস্তে টেনে খুলছে ছিটকিনি। 

‘দরজা এখন খোলা। এখন শোনোঃ যদি এখানে থাকো, তাহলে আমি মারা যাবো।’ অধৈর্যের সঙ্গে নড়ে উঠল কেউ; শোনা গেল লেজ নাড়াবার আওয়াজ; তারপর একটা গর্জন, গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ওটা। ‘তোমার হাত আমাকে দাও, মেনে নাও আমার আনুগত্য। আমাকে আহ্বান করো নিজের ভেতরে।’ 

‘বুঝতে পারছি না—’ 

‘আমাকে তোমার হাত দাও, নইলে রক্তপাতেই মরবে।’ 

ভাঁড়ার ঘরের অন্ধকারে, হাত বাড়িয়ে দিল গ্রাহাম কোটস। কেউ একজন——অথবা কিছু একটা—ওটা নিজের হাতে নিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে চাপ দিল। ‘এবার বলো, আমাকে আহ্বান জানাবে তোমার ভেতরে?’ 

ঠিক তখনই এক মুহূর্তের জন্য যেন নিজেকে পুরোপুরি ভাবে ফিরে পেল গ্রাহাম কোটস। তবে ততক্ষণে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। এখন আর যা-ই করুক না কেন, পরিস্থিতি এর চাইতে বাজে তো আর হবে না… তাই না? 

‘পুবশ্যই,’ ফিসফিসিয়ে বলল গ্রাহাম কোটস। শব্দটা পুরোপুরি উচ্চারিত হবার আগেই বদলে যেতে শুরু করল সে। এমনভাবে দেখতে পাচ্ছে অন্ধকারে, যেন এখন দিন। ভাবল, মাত্র একমুহূর্তের জন্য, পাশে কিছু একটাকে দেখতে পাচ্ছে। মানুষের চাইতে বড়ো সেটা আকারে, তীক্ষ্ণ দাঁতঅলা। পরক্ষণেই উধাও হয়ে গেল সেই কিছু একটা, দারুণ বোধ করতে শুরু করল গ্রাহাম কোটস, পা থেকেও আর রক্ত ঝরছে না। 

অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। বেল্ট থেকে ছুরিগুলো খসিয়ে, ফেলে দিল মেঝেতে। এমনকী জুতোও খুলে ফেলল। এখানেই কোথাও আছে অস্ত্রটা, কিন্তু সেটারও খোঁজ করল না। যন্ত্রপাতির দরকার হয় বানর, কাক আর দুর্বলদের। 

গ্রাহাম কোটস বানর না… 

…সে শিকারি। 

হাতের পাঞ্জা আর হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে হেঁটে, সেলারে চলে এলো সে।

মেয়েদেরকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। মূল বাড়িতে যাওয়ার সিঁড়িটা খুঁজে পেয়েছে ওরা, অন্ধের মতো হাত ধরাধরি করে উঠে যাচ্ছে ওপরে। 

তাদের মাঝে একজন বয়স্কা, মাংস-টাংস নেই হাড়ে; অন্যজন যুবতী, মাংসও নরম মনে হচ্ছে। তাই জিভ থেকে জল ঝরতে শুরু করল… 

…এমন কিছু একটার মুখ থেকে যার মধ্যে গ্রাহাম কোটসের কেবলমাত্র অংশবিশেষই অবশিষ্ট আছে বলা চলে। 

.

সেতু থেকে নামল মোটকু চার্লি, মাথায় ওর বাবার সবুজ ফেডোরা। হাঁটতে শুরু করল সূর্যাস্তের দিকে লক্ষ্য করে। পাথুরে সৈকত ধরে এগোচ্ছে যুবক, পিচ্ছিল পাথরে হোঁচট খাচ্ছে থেকে থেকে; বেখেয়ালে পা ফেলছে পানি ভরতি ছোটো ছোটো গর্তে। আচমকা এমন কিছু একটার ওপর পা পড়ল, যেটা নড়তে-চড়তে সক্ষম। হোঁচট খেয়ে সরে গেল সে। 

পায়ের নিচে পড়া জিনিসটা বড়ো হতে শুরু করল, তারপর বড়ো হতেই থাকল তো হতেই থাকল। ওটা যাই হোক না কেন, বিশাল যে তাতে সন্দেহ নেই। প্রথমে ভেবেছিল, মানে আকার দেখে আরকি, হাতি হবে। কিন্তু না, আকারে ওটা আরও বড়ো। 

আলো, ভাবল মোটকু চার্লি। গাইল উচ্চ কণ্ঠে, সঙ্গে সঙ্গে ওই খানে থাকা সবগুলো জোনাকি ছুটে এসে ঘিরে ধরল ওকে। তাদের শীতল, সবুজ আলোতে দেখতে পেল ছেলেটা – সরীসৃপের চেহারায় বসানো দুটো চোখ, আকারে খাবারের থালার মতো হবে, চেয়ে আছে ওর দিকে। 

পালটা তাকাল মোটকু চার্লি। ‘শুভ সন্ধ্যা,’ হাসি-মুখে বলল সে। 

মাখন মিশ্রিত তেলের মতো মসৃণ কণ্ঠে প্রাণিটা বলল, ‘হ্যাল্লো। ডিং-ডং! তোমাকে দেখে রাতের খাবারের মতো লাগছে!’ 

‘আমি চার্লি ন্যান্সি,’ নিজের পরিচয় জানাল সে। ‘তুমি কে?’ 

‘আমি ড্রাগন,’ জবাব দিল ড্রাগন। ধীরে ধীরে, কিন্তু এক লোকমায় খাবো তোমাকে, হে হ্যাট পরা ছোট্ট মানুষ।’ 

চোখ পিটপিট করল চার্লি। এই অবস্থায় থাকলে আমার বাবা কী করত? ভাবল সে। স্পাইডারই বা কী করত? আবিষ্কার করল, এই দুই প্রশ্নের জবাব ওর জানা নেই। আরে ধুর, হাজার হলেও, স্পাইডার তো আমারই অংশ ছিল। ও যা করতে পারে, আমিও তা পারি। 

‘উম, আমার সঙ্গে কথা বলে তুমি বিরক্তি বোধ করছ; তাই আমার কোনো ক্ষতি না করেই যেতে দেবে,’ বলল সে ড্রাগনটাকে, যতটা সম্ভব দৃঢ়তা ঢালল কণ্ঠে। 

‘বাহ, চেষ্টা ভালোই করেছ। কিন্তু দুঃখিত, সেটি হচ্ছে না,’ জানাল ড্রাগন, আগ্রহের সঙ্গেই। ‘আসলে, তোমাকে আমি খেতে যাচ্ছি।’ 

‘লেবু ভয় পাও নাকি?’ জিজ্ঞেস করল চার্লি, পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল যে ওটা ডেইজিকে দিয়েছে। 

হাসল ড্রাগন, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে। ‘আমি,’ জানাল সে। ‘কিছুই নেই… যা আমি ভয় পাই।’ 

‘কিছুই নেই?’ 

‘হুম, কিছুই নেই।’ জানাল ড্রাগনটা। 

চার্লি বলল, ‘তুমি ‘কিছুই নেই’-কে মারাত্মক ভয় পাও?’ 

‘হ্যাঁ, আমাকে তীব্র আতঙ্কে ফেলে দেয়,’ স্বীকার করতে বাধ্য হলো ড্রাগন। ‘আমার পকেটে কী আছে জানো?’ বলল চার্লি। ‘কিছুই নেই। দেখতে চাও?’ 

‘না, অস্বস্তি ভরে জবাব দিল ড্রাগন। ‘একদম দেখতে চাই না।’ 

পালের মতো বড়ো বড়ো পাখা নাড়িয়ে, চলে গেল ওটা। চার্লি নিজেকে একাকী আবিষ্কার করল সৈকতে। ‘কাজটা,’ বলল সে। ‘একটু বেশিই সহজে হয়ে গেল!’ 

হাঁটা অব্যাহত রাখল ও, এই উপলক্ষে নতুন গানও বেঁধে ফেলল! সবসময় গান বাঁধতে চেয়েছে চার্লি, কিন্তু কখনও করেনি কাজটা। কেননা সবসময় ভেবেছে, গান যদি লিখেও ফেলে, তাহলে ওকে গাইতে বলা হবে। ব্যাপারটা কারও জন্যই ভালো হবে না। এর চাইতে বোধহয় ফাঁসিতে ঝোলাও সহজ হবে। কিন্তু এখন এত কিছু ভাবছে না, কেয়ারও করে না। জোনাকিকে শোনাল ওর গান, যারা ওকে অনুসরণ করে উঠছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। গানের কলিতে শোনাচ্ছে পাখি-মানবীর সঙ্গে দেখা করে ভাইকে খুঁজে পাবার ইচ্ছের কথা। আশা করছে, জোনাকিদের হয়তো গানটা পছন্দ হবে: সুরের তালে তালে জ্বলছে-নিভছে তাদের আলো। 

পাখি-মানবী ওর জন্য পাহাড়ের ওপরে অপেক্ষা করছিল। 

হ্যাট খুলল চার্লি, ব্যান্ড থেকে খুলে নিলো পালক। 

‘এই যে, নাও। জিনিসটা তোমার, তাই না?’ 

পালক নেবার কোনো আগ্রহ দেখাল না মহিলা। 

‘আমাদের চুক্তি বাতিল,’ জানাল চার্লি। ‘তোমার পালক নাও, ফিরিয়ে দাও আমার ভাইকে। তুমি ওকে অপহরণ করেছ, আমি ফেরত চাই। আনানসির বংশধরকে তোমার হাতে তুলে দেওয়ার অধিকার আমার ছিল না কখনও।’ 

‘যদি তোমার ভাই এখন আর আমার কাছে না থাকে?’ 

জোনাকির আলোয় দেখা কঠিন হলেও মোটামুটি নিশ্চিত চার্লি, মহিলার ঠোঁট নড়েনি। তবে ওর শব্দগুলো শুনতে পেল পরিষ্কার ভাবে, কানে ভেসে এলো রাতের পাখির গর্জন আর পেঁচার ডাকের রূপ নিয়ে। 

‘আমি আমার ভাইকে ফেরত চাই,’ মহিলাকে বলল সে। ‘অক্ষত ও সুস্থ অবস্থায়, চাই এখুনি। নইলে তোমার আর আমার বাবার মাঝে যা কিছু হয়েছে এতগুলো বছরে, তা কেবল নাটকের মুখবন্ধ বলে মনে হবে! মনে হবে অপেরার শুরুর দিককার যন্ত্র-সংগীত।’ 

আজকের আগে কখনও কাউকে হুমকি দেয়নি চার্লি। এমনকী যে হুমকিটা এই মাত্র দিল, তা কীভাবে বাস্তবায়ন করবে সেটাও জানে না—তবে মনের মাঝে সন্দেহ নেই, করবে বটে। 

‘আমার কাছেই ছিল ও,’ জানাল পাখি-মানবী। ‘কিন্তু ওর জিহবা ছিঁড়ে ফেলে, বাঘের দুনিয়ায় ফেলে এসেছি। তোমার বাবার রক্তের ক্ষতি করার ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু সাহস জোগাতে পারলে বাঘ তা করতে পারে।’ 

ক্ষণিকের জন্য নেমে এলো নীরবতা। স্তিমিত হয়ে গেল সব ব্যাং আর পাখির ডাক। নিস্পৃহ চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে মহিলা, চেহারা ছায়ায় ঢাকা। কোটের পকেটে হাত ঢোকাল সে। ‘পালকটা দাও।’ 

ওর হাতে পালকটা রাখল চার্লি। 

সঙ্গে সঙ্গে হালকা বোধ করতে লাগল চার্লি। মনে হলো যেন নিছক একটা পালক ওর হাত থেকে নেয়নি পাখি-মানবী…নিয়েছে আরও ভারী কিছু। তারপর ওর হাতে কিছু একটা দিল মহিলা, ঠান্ডা এবং ভেজা একটা কিছু। মনে হলো যেন মাংসের টুকরো ধরিয়ে দিয়েছে, ওটাকে একপাশে ছুড়ে ফেলার ইচ্ছে দমাতে হলো চার্লিকে। 

‘ফিরিয়ে দিয়ো ওকে, বলল মহিলা, রাতের আওয়াজকে কণ্ঠ বানিয়ে। ‘আমার সঙ্গে ওর আর কোনো ঝগড়া নেই।’ 

‘বাঘের দুনিয়ায় যাবো কীভাবে?’ 

‘এখানকার পথ কীভাবে খুঁজে পেয়েছ?’ পালটা প্রশ্ন করল মহিলা, বিস্ময় খেলে গেল তার কণ্ঠে। রাতের আওয়াজ আবার নতুন করে শুরু হলো। চার্লি নিজেকে একাকী অবস্থায় আবিষ্কার করল পাহাড়ে। 

হাত খুলে তাতে থাকা মাংসের টুকরোটা দেখল একবার। মনে তো হচ্ছে, জিহ্বা; ওটার মালিক কে সেটাও বুঝতে পারছে। 

ফেডোরাটাকে আবার পরে নিলো চার্লি, ভাবল—বুদ্ধি যোগাবার টুপিটা পরে নেওয়া যাক। কিন্তু নিজের কাছেই মনে হলো, ঠাট্টাটা খুব একটা জমেনি। সবুজ ফেডোরাটা বুদ্ধি যোগায় না, তবে এই জিনিস একমাত্র তার মাথাতেই সাজে…যে ভাববার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করে না। 

দুনিয়াগুলোকে একটা জালের রূপে ভাবল সে ওর মনের ভেতর জ্বলজ্বল করল যেন জালটা; যত জনকে চেনে, সবার সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন হয়ে গেল। স্পাইডারের সঙ্গে ওকে যে সুতোটা যুক্ত করেছে, সেটা যেমন শক্তিশালী তেমনই উজ্জ্বল। হালকা আলো ছড়াচ্ছে ওটা, যেন তারকার মতো। 

একদা ওর একটা অংশ ছিল স্পাইডার। এই তথ্যটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল সে, মনের ভেতরটা করে দিল উন্মুক্ত যাতে জাল পুরোটা মন দখল করে নেয়। হাতে ধরে রেখেছে ভাইয়ের জিভ: যেটা এই খানিক আগেও স্পাইডারের অংশই ছিল এবং ঐকান্তিক ভাবে আবার তাই হতে চায়। 

জ্যান্ত সব কিছুই… স্মৃতি ধরে রাখে বটে। 

জালের আলো জ্বলছে এখন ওর চারপাশে। চার্লির শুধু ওটাকে অনুসরণ করলেই হবে… 

তাই করল সে, জোনাকিগুলোও সঙ্গী হলো ওর।

‘ওই’ বলল চার্লি। ‘আমি এসেছি।’ 

অস্ফুট, ভয়ানক আওয়াজ করল স্পাইডার। 

জোনাকির আলোয় বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে স্পাইডারকে: ভয়ে-আতঙ্কে সিঁটিয়ে আছে মনে হলো, আহতও দেখাচ্ছে। চেহারা আর বুকে দেখা যাচ্ছে শুকিয়ে আসতে থাকা ক্ষত। 

‘সম্ভবত তুমিই এই জিনিসের মালিক,’ বলল চার্লি। 

হাত বাড়িয়ে জিহ্বাটাকে ভাইয়ের হাত থেকে নিলো স্পাইডার, তারপর হাত-পা-চোখ নেড়ে ধন্যবাদ বুঝিয়ে ওটাকে সেঁধিয়ে দিল মুখের ভেতর; বাইরে বেরোতে দিল না। অপেক্ষা করতে লাগল চার্লি। 

স্পাইডার সন্তুষ্ট হলো খানিকক্ষণের মাঝে — পরীক্ষামূলক ভাবে জিহ্বা নাড়াতে লাগল, মুখের এই পাশ থেকে ওই পাশে। তারপর হাঁ করে নাড়াতে লাগল জিভ। মুখ বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল অতঃপর। অবশেষে খানিকটা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাটটা বেশ তো!’ 

.

সিঁড়ির মাথায় প্রথম হাজির হলো রোজি। সেলারের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল সে। তারপর পা রাখল বাড়িতে। মায়ের জন্য অপেক্ষা করল, মহিলা এপাশে চলে আসতেই ছিটকিনি লাগিয়ে দিল সেলারের দরজার। অন্ধকারে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আসা পাণ্ডুর চন্দ্রালোককে মনে হতে লাগল যেন ফ্লাডলাইট। 

ছেলেরা মেয়েরা, বেরিয়ে এসো খেলতে, ভাবল রোজি। চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল এই রাতে… 

‘পুলিসকে ফোন দাও,’ নির্দেশ দিল ওর মা। 

‘তা এই ফোনটা পাবো কোথায়?’ 

‘আমি কীভাবে বলব? এখনও নিচে আটকে আছে ব্যাটা, এটাই সুযোগ।’ 

‘ঠিক,’ বলল রোজি। ভাবল এখন পুলিসে খবর দেওয়ার জন্য ফোন খুঁজবে? নাকি বাড়ি থেকে পালাবার উপায়? কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারার আগেই, যা হবার তা হয়ে গেল! 

শব্দটা এত জোরাল যে কানে ব্যথা করতে লাগল ওর, পরক্ষণেই ভেঙে পড়ল সেলারের দরজা। 

একটা ছায়া বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। 

তাহলে…জন্তুটা আসলেই আছে! এখন আর কোনো সন্দেহ নেই, কেননা দেখতে যে পাচ্ছে নিজের চোখেই। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব: বিশাল একটা বিড়াল আকৃতির ছায়া ওটা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, ওটার ওপরে চাঁদের আলো পড়তেই যেন আরও অন্ধকার হয়ে গেল সেই ছায়া। ওটার চোখ দেখতে পাচ্ছে না রোজি, তবে নিশ্চিতভাবেই জানে যে সরাসরি ওর দিকেই চেয়ে আছে জন্তুটা… 

…চেয়ে আছে পেট ভরতি ক্ষুধা নিয়ে। 

ওকে খুন করতে যাচ্ছে জন্তুটা… আর এভাবেই যবনিকা নামবে রোজির জীবনের। 

রোজির মা বলল, ‘তোমাকে চায় সে, রোজি।’ 

‘বুঝতে পারছি।’ 

ধারে-কাছে থাকা সবচাইতে বড়ো জিনিসটা তুলে নিলো রোজি, কাঠের একটা টুকরো। ওটায় আগে ছুরি সাজিয়ে রাখা হতো। ছায়ার দিকে গায়ের জোরে টুকরোটা ছুড়ে মারল রোজি। তারপর, লক্ষ্যভেদ করতে পেরেছে কি না তা দেখার জন্য অপেক্ষা না করে, যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে; পা রাখল হলওয়েতে। সদর দরজা কোথায়, তা জানা আছে ওর… 

অন্ধকার, চার পায়ে চলতে অভ্যস্ত কিছু একটা ওর চাইতেও দ্রুত গতিতে নড়ে উঠল। এক লাফে রোজিকে টপকাল সেটা, প্রায় নিঃশব্দে নামল ওর সামনে। 

ভয়ে দেওয়ালের সঙ্গে সিটিয়ে গেল রোজি, মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেছে।

ওদের আর সদর দরজার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এখন জন্তুটা। আস্তে আস্তে এগোচ্ছে রোজির দিকে, ভাবখানা এমন যেন কোনো তাড়া নেই। 

ঠিক সেই মুহূর্তে রান্নাঘর থেকে ছুটে গেল ওর মা, রোজির পাশ দিয়ে এক ছুটে আছড়ে পড়ল যেন চন্দ্রালোকে উজ্জ্বল করিডরে থাকা অন্ধকার ছায়াটার ওপর, হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে। তারপর সেই হাত দিয়ে বানানো মুঠি ঘুসি বসাল জন্তুটার পাঁজরে। 

থমকে গেল সময়… 

… থমকে গেল সারা দুনিয়া…তবে মাত্র এক মুহূর্তের জন্য। তারপর আস্তে আস্তে বয়স্কা মহিলার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল জন্তুটা। এত দ্রুত নড়ে উঠল যে ঝাপসা দেখাল, পরক্ষণেই মেঝেতে আছড়ে পড়ল রোজির মা। ছায়াটা এমন ভাবে কামড়ে দোলাতে লাগল দেহটাকে…যেভাবে পুরাতন খেলনা নিয়ে খেলে কুকুর। 

আচমকা বেজে উঠল দরজার ঘণ্টি। 

সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে চাইল রোজি। চিৎকার বেরোচ্ছে বটে ওর কণ্ঠ থেকে, কিন্তু তার ওপর বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই মেয়েটার। আচমকা বাথটাবে মাকড়শা দেখতে পেলে বি-ক্লাস মুভির অভিনেত্রী- যে প্রথমবার মতো রবারের স্যুট পরিহিত কোনো আক্রমণকারীর সামনে পড়েছে-তার মতো চেঁচাতে পারে রোজি। কিন্তু এখন আছে একটা অন্ধকার বাড়িতে, সঙ্গে আছে ছায়াশরীরের একটা বাঘ এবং সম্ভবত একটা সিরিয়াল কিলার! তাদের মাঝে একজন, কিংবা হয়তো উভয়ে, এই মাত্র আক্রমণ করেছে ওর মাকে। কী করা যেতে পারে, তাই ভাবছে বেচারি; কয়েকটা বুদ্ধি এসেছে মাথায় (অস্ত্র: কিন্তু ওটা আছে সেলারে, নিতে হলে নিচে নামতে হবে। কিংবা ছুটতে পারে দরজার দিকে—মা এবং ওর ওপর ঝুঁকে থাকা পশুটার পাশ দিয়ে ছুটে সদর দরজা খুলতে পারে)। কিন্তু ওর ফুসফুস আর মুখ কেবল চিৎকার ছাড়া আর কিছু করতে পারছে না। 

কিছু একটা সদর দরজায় আছড়ে পড়ল। কেউ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে চাইছে, ভাবল সে। কিন্তু দরজাটা ভাঙার মতো না। একেবারে নিরেট! 

চাঁদের আলোয় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে ওর মায়ের দেহ। ছায়াটা উবু হয়ে আছে তার ওপরে, মাথা পেছনে ছুড়ে গর্জন করল সে; একসঙ্গে ভয়, চ্যালেঞ্জ আর দাবি খেলে গেল সেই গর্জনে। 

ভ্রম হচ্ছে আমার, নিজেকেই নিশ্চিত করতে চাইল রোজি। দুই দিন হলো আটকে ছিলাম সেলারে, তাই এখন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আশপাশে কোনো বাঘ-টাঘ নেই। 

সেই একই কারণে এটাও বুঝতে পারছে যে চাঁদের আলোয় যে পাণ্ডুর মহিলাকে দেখতে পাচ্ছে, সেটাও ওর ভ্রম। করিডর ধরে হেঁটে আসছে মহিলা, চুল সোনালি; পা আর সরু কোমর দেখেই নর্তকী মনে হয়। বাঘের ছায়ার কাছে পৌঁছে থমকে গেল সে। বলল, ‘হ্যালো, গ্রাহাম।’ 

ছায়া-জন্তুটা তার বিশাল মাথা উঁচু করে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে হাঁক ছাড়ল। 

‘ওই পশুর কস্টিউম পরে আমাকে বোকা বানাতে পারবে না,’ বলল মহিলা। খুব একটা সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে না তাকে। 

রোজি টের পেল, মহিলার দেহের ঊর্ধ্বাংশ ভেদ করেও জানালাটা দেখতে পাচ্ছে, একেবারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার আগপর্যন্ত পেছাতে লাগল। 

আবার গর্জে উঠল জন্তুটা, এবার খানিকটা দ্বিধার ছোঁয়া পাওয়া গেল কণ্ঠে। 

মহিলা বলল, ‘ভূত-প্রেতে আমি বিশ্বাস করি না, গ্রাহাম। জীবনটা—মানে পুরোটাই—কাটিয়ে দিয়েছি ভূতে অবিশ্বাস করে। তারপর দেখা হলো তোমার সঙ্গে, মরিসের ক্যারিয়ারটা ধসে গেল তোমার কারণে। আমাদের কাছ থেকে চুরি করলে, খুন করলে আমাকে। তারপর, ক্ষতে লবণ ঘষার মতো করে, বাধ্য করলে ভূতে বিশ্বাস আনতে।’ 

প্রকাণ্ড বিড়ালের ছায়াময় অবয়বটা পেছাতে শুরু করেছে এখন। 

‘এভাবে আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে, সেই চিন্তা কোরো না। জঘন্য মানুষ কোথাকার। যত ইচ্ছে বাঘ সাজার ভড়ং ধরতে পারো। কিন্তু আসলে তুমি বাঘ নও, একটা নগণ্য ইঁদুর। নাহ, ভুল হলো ইঁদুরের সঙ্গে তুলনা দিয়ে তাদের অপমান করা হচ্ছে। ছুঁচো তুমি, একটা নেউলে!’ 

হল ধরে ছুটতে লাগল রোজি। 

ছায়া-জন্তুটার পাশ দিয়ে, মেঝেতে পড়ে থাকা মাকে অতিক্রম করে ছুটল সে; পাণ্ডুর মহিলার ভেতর দিয়ে। মনে হলো যেন কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছুটছে। সদর দরজার কাছে পৌঁছে গেল অচিরেই, ছিটকিনির খোঁজে হাতাতে লাগল। 

মাথার ভেতর, এবং আশপাশের দুনিয়া জুড়ে, একটাই ঝগড়া হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে রোজির। কেউ একজন বলছে: 

ওকে পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই, ডাপ্পি সে। তোমাকে স্পর্শও করতে পারবে না। মেয়েটাকে থামাও, ধরো ওকে! 

অন্য কেউ জবাব দিচ্ছে: 

যুক্তি আছে তোমার কথায়, তবে সব দিক বিবেচনা করে কথাটা বলছ বলে মনে হয় না। জানোই তো: ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার চাইতে, সেটাকে এড়ানোই উত্তম… 

আমি বলছি কী বলতে হবে। তুমি শুধু অনুসরণ করো। 

কিন্তু… 

‘আমি একটা ব্যাপার জানতে চাই,’ বলল পাণ্ডুর মহিলা। ‘তুমি এই মুহূর্তে কতটা ভূতুড়ে। মানে— মানুষজন তো দূরে থাক, কোনো বস্তুকে স্পর্শও করতে পারি না। পারি শুধু ভূতকে স্পর্শ করতে।’ 

পশুটার চেহারা তাক করে কড়া একটা লাথি হাঁকাল পাণ্ডুর মহিলা। ছায়া- জন্তু হিসিয়ে উঠে পিছিয়ে গেল এক পা, তাই এক ইঞ্চিরও কম দূরত্বের জন্য লাগল না লাথিটা। 

তবে পরেরটা লাগল, ককিয়ে উঠল জন্তুটা। আরেকটা লাথি, এবার ঠিক নাক বরাবর। একসঙ্গে ভয়, রাগ, লজ্জা আর পরাজয় মিশিয়ে আবার ককাল ওটা। 

মৃত নারীর হাসির আওয়াজে ভরে উঠল করিডরটা। আনন্দ আর উত্তেজনা মিশে আছে সেই হাসিতে। ‘নেউলে,’ বলল মহিলা। ‘গ্রাহাম নেউলে।’ 

শীতল বাতাসের একটা দমকা নেচে বেড়াতে লাগল ঘরের ভেতর। 

শেষ ছিটকিনিটাও খুলে ফেলল রোজি, এরপর খুলল তালা। সামনের দরজা খুলে গেল হাঁ করে। ফ্ল্যাশলাইটের আলো সঙ্গে সঙ্গে পড়ল ওর চোখে, অন্ধ করে দেওয়ার মতো তার তীব্রতা। মানুষ, গাড়ি। একটা নারী কণ্ঠ বলল, ‘ওই যে, হারিয়ে যাওয়া পর্যটকদের একজন।’ তারপর যোগ করল, ‘হায় ঈশ্বর!’ 

ঘুরে তাকাল রোজি। 

ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় মাকে পরিষ্কার দেখতে পেল রোজি; লাশটা দলা পাকিয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। তার পাশে জুতোহীন পা নিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ… গ্রাহাম কোটস। ওদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে লাল তরল, খয়েরি রঙের মতো। রোজি যেন এক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেল, কী হয়েছে খানিক আগে! 

এক মেয়ে কথা বলছে ওর সঙ্গে। বলছে, ‘তুমি রোজি নোয়াহ? আমি ডেইজি। চলো, কোথাও গিয়ে তোমার সঙ্গে বসা যাক। বসতে চাও?’ 

হয়তো ফিউজের বাক্সটা খুঁজে পেয়েছে কেউ, কেননা সারা বাড়ির সবগুলো আলো জ্বলে উঠেছে। 

বিশালদেহী এক লোক, পুলিস ইউনিফর্ম পরিহিত, ঝুঁকল লাশ দুটোর ওপর। মাথা তুলে বলল, ‘মি. ফিনেগান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শ্বাস নিচ্ছে না।’ 

রোজি বলল, ‘অবশ্যই। চলো, কোথাও গিয়ে বসি।’ 

.

পাহাড়ের শীর্ষে, একদম ধারে স্পাইডারের পাশে বসে আছে চার্লি। চাঁদের আলোয় পা দুটো ঝুলছে খাদের ওপর। 

‘জানো নাকি?’ বলল সে। ‘আসলে আমার একটা অংশ তুমি। সেই ছেলেবেলায় আলাদা হয়ে গেছিলাম।’ 

এক পাশে মাথা কাত করল স্পাইডার। ‘তাই নাকি?’ 

‘আমি তো সেটাই জানি।’ 

‘যাক, অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম কথাটা শুনে,’ বলে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিল স্পাইডার: ওর আঙুলের ওপর বসে আছে সাত পাঅলা মাকড়শাটা, স্বাদ নিচ্ছে বাতাসের। ‘এখন কী করতে চাও? আমাকে ফিরিয়ে নেবে তোমার মাঝে?’ 

ভ্রু কুঁচকে গেল চার্লি। ‘আমার সঙ্গে থাকলে যে হাল তোমার হতো, তার চাইতে অনেক ভালো আছ। বোঝাই যাচ্ছে, অনেক আনন্দ করেছ জীবনে।’ 

স্পাইডার বলল, ‘রোজি, বাঘ জানে মেয়েটার ব্যাপারে। কিছু একটা আমাদেরকে করতেই হবে।’ 

‘অবশ্যই করতে হবে, করবোও।’ জানাল চার্লি। ব্যাপারটা অনেকটা হিসেব রক্ষার মতো: ভাবল সে। এই পাশে যোগ করতে হয়, অন্য পাশ থেকে বিয়োগ। হিসেব ঠিক থাকলে, পাতার নিচে এসে সব মিলে যায়। ভাইয়ের হাত নিজের হাতে নিলো সে। 

উঠে দাঁড়িয়ে…এক পা ফেলল সামনের শূন্যতায়— 

–সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সবকিছু– 

দুই দুনিয়ার মাঝে বইতে লাগল শীতল একটা বাতাস। 

চার্লি বলল, ‘তুমি আসলে আমার ভেতরের জাদুর অংশ নও।’ 

‘তাই নাকি?’ আরেক পা সামনে ফেলল স্পাইডার। ওর চারপাশে একের- পর-এক তারার পতন হচ্ছে, অন্ধকার আকাশ জুড়ে ছুটে যাচ্ছে ওগুলো। কেউ একজন, কোনো এক খানে, বাঁশিতে তুলছে মনোলোভা সুর। 

আরেক পা ফেলতেই কানে এলো দূর থেকে ভেসে আসা সাইরেনের আওয়াজ। ‘নাহ,’ বলল চার্লি। ‘তুমি তা নাও। যদিও মিসেস ডানউইডি সেটাই ভেবেছিল। তবে আমাদেরকে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছিল সে, অথচ বুঝতেও পারেনি যে আসলে কী করছে। আমরা আসলে একই স্টারফিশের দুটো অংশ। আমাকে ছাড়াই পুর্ণাঙ্গ সত্তা পেয়েছ তুমি। তেমনই পেয়েছি,’ বলতে গিয়ে টের পেল যে অন্তর থেকে বিশ্বাস করে বলছে কথাটা। ‘আমিও।’ 

ভোরের আলোয়, পাহাড়ের শীর্ষের ধারে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। একটা অ্যাম্বুলেন্স এগিয়ে আসছে চূড়ার দিকে, তার পেছনে আরেকটা। রাস্তার ধারে একটার পাশে আরেকটা পার্ক করা হলো, একগাদা পুলিসের গাড়ির পেছনে। 

কাকে কী করতে হবে, সেই নির্দেশনা দিতে ব্যস্ত ডেইজি। 

‘এখানে, এই মুহূর্তে আমাদের করার তেমন কিছু নেই,’ জানাল চার্লি। ‘চলো, যাই।’ জোনাকির দল ছেড়ে গেছে এখন ওকে। 

দিনে প্রথম যে মিনিবাসটা ছাড়ল, সেটায় চড়ে উইলিয়ামসটাউনে ফিরে গেল ওরা। 

.

মেইভ লিভিংস্টোন বসে আছে গ্রাহাম কোর্টসের বাড়ির ওপরের তলার লাইব্রেরিতে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে গ্রাহাম কোটসের কেনা শিল্পকর্ম, বই আর ডিভিডি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে, নিচে কাজে ব্যস্ত দ্বীপের ইমার্জেন্সি সার্ভিসেস। রোজিকে একটা অ্যাম্বুলেন্সে, আর গ্রাহাম কোটসকে তোলা হচ্ছে অন্যটায়। 

ভেবে দেখেছে সে গ্রাহাম কোটস যে পশুতে পরিণত হয়েছিল, তাকে লাথি মেরে দারুণ আনন্দ পেয়েছে। খুন হবার পর, এমন আনন্দদায়ক কাজ আর একটাও করেনি। তবে হ্যাঁ, নিজের কাছে হলেও স্বীকার করতেই হয়: মি. ন্যান্সির সঙ্গে নাচাটা তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকবে, প্রথম স্থানের সঙ্গে খুব একটা দূরত্বও থাকবে না। বয়স হলেও মানুষটা বেশ চটপটে ছিল, নাচও জানত ভালোই। 

ক্লান্ত বোধ করছে মহিলা। 

‘মেইভ?’ 

‘মরিস?’ চারপাশে তাকাল সে, কিন্তু কামরায় আর কেউ নেই। 

‘যদি ব্যস্ত থাকো, তাহলে তোমাকে আর বিরক্ত করব না, সোনা।’ 

‘আহ, খুব ভালো কথা,’ বলল মহিলা। ‘তবে আপাতত আর কোনো ব্যস্ততা নেই আমার।’ 

লাইব্রেরির দেওয়ালগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে, হারাচ্ছে তাদের রং আর আকার। দেওয়ালের পেছনের দুনিয়া আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে; সেই আলোতে দেখতে পাচ্ছে, স্মার্ট স্যুট পরিহিত ছোট্ট একটা অবয়ব অপেক্ষা করছে তার জন্য। 

লোকটার হাত ধরল মহিলা। বলল, ‘আমরা যাচ্ছি কই, মরিস?’ 

স্ত্রীর প্রশ্নের জবাব দিল লোকটা। 

‘ওহ, তাহলে তো ভালোই হবে,’ বলল মেইভ। ‘ওখানে যাওয়ার একটা ইচ্ছা আমার মাঝে সবসময়ই ছিল।’ 

হাত ধরাধরি করে, হাঁটতে লাগল ওরা। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *