অধ্যায় তিন – যাতে ঘটে পারিবারিক পুনর্মিলন
বিমানে করে ইংল্যান্ডে ফিরে এলো মোটকু চার্লি। বাড়িতে আরকী…
কাস্টমস হলে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল রোজি; হাতে একটা ছোট্ট সুটকেস আর কার্ডবোর্ডের টেপ দিয়ে আটকানো বাক্স নিয়ে বেরোল ছেলেটা। ওকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরল রোজি। ‘কী খবর?’
জবাবে শ্রাগ করল মোটকু চার্লি। ‘এর চাইতেও অনেক বাজে হতে পারত।’
‘হুম,’ বলল মেয়েটা। ‘অন্তত এখন ভদ্রলোক তোমার বিয়েতে এসে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন – এই ভয় করতে হবে না।’
‘মন্দের ভালো আরকী।’
‘আমার মা বলছে, সম্মান দেখাবার খাতিরে আমাদের বিয়েটা কয়েক মাস পিছিয়ে দেওয়া উচিত।’
‘তোমার মা আসলে আমাদের বিয়েটাই বাতিল করে দিতে চায়।’
‘বাজে কথা বোলো না তো। তার ধারণা—ছেলে হিসেবে তুমি দারুণ!’
‘তোমার যে মা, তাতে ব্র্যাড পিট, বিল গেটস আর প্রিন্স উইলিয়ামকে ঘুঁটে জোড়া দিয়ে বানানো কোনো পুরুষ মানুষকেও দারুণ বলবে না। দুনিয়ার বুকে এমন কেউ নেই, যাকে সে তার মেয়েজামাই হবার যোগ্য মনে করে।’
‘তোমাকে পছন্দ করে সে,’ বলল রোজি। তবে বলার জন্য বলা। কণ্ঠে বিন্দুমাত্র জোর নেই।
রোজির মা মোটকু চার্লিকে পছন্দ করে না, আর সেটা সবাই জানে! ভদ্রমহিলা খুবই নাক-উঁচু স্বভাবের, সেই সঙ্গে দারুণ শুচিবায়ুগ্রস্তও। পূর্বসংস্কার, দুশ্চিন্তা আর রাগ পুষে রাখতে জানে সে। উইমপোল স্ট্রিটের একটা অসাধারণ ফ্ল্যাটে থাকে সে, কিন্তু সেটার ফ্রিজ ভরতি করে রাখে ভিটামিন মেশানো পানি আর রাই ক্রাকার্স দিয়ে। অ্যান্টিক সাইডবোর্ডে থাকে মোমের ফল, যেগুলো হপ্তায় দুবার মোছা হয়।
রোজির মায়ের বাড়িতে প্রথম যেবার যায়, সেবার তো ওই মোমের ফলেই কামড় বসিয়েছিল মোটকু চার্লি। মারাত্মক নার্ভাস ছিল সেদিন, এতটাই যে আপেলটা তুলে নিয়ে—আত্মরক্ষার্থে পরে বলত সে, দেখতে বিলকুল আসল ফলই মনে হচ্ছিল—তাতে কামড় বসিয়ে দেয়। পাগলের মতো হাত-পা নেড়ে ওকে ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল রোজি। মোমের টুকরো থু মেরে হাতে ফেলেছিল মোটকু চার্লি, ভেবেছিল স্বাদটা ভালো লাগার অভিনয় করবে কি না। নাকি এমন আচরণ করবে যে আগে থেকেই জানত সেই ব্যাপারে? কাজটা করেছে মজা করতে?
কিন্তু রোজির মা এক ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ায়, নিষ্কম্প পায়ে হেঁটে যায় মোটকু চার্লির কাছে। বাকি আপেলটুকু ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে জানিয়ে দেয়, আজকাল সত্যিকারের মোমের ফল কিনতে কত খরচ হয়; আসল জিনিসটা খুঁজে পাওয়াই তো কঠিন। তারপর আধ-খাওয়া মোমের আপেল ফেলে দেয় সে ময়লার বাক্সে।
অবশিষ্ট বিকেলটা মোটকু চার্লি কাটিয়ে দেয় সোফায় বসে, মুখের ভেতরটা মোমের বাজে স্বাদে ভরে ছিল। আর রোজির মা কড়া নজর রাখছিল ওর ওপর, এই ভয়ে যে যদি তার দামি মোমের আরেকটা ফলে কামড় বসায় ছেলেটা? কিংবা চিপেনডেলের চেয়ারের পায়া চিবুতে শুরু করে?
রোজির মায়ের ফ্ল্যাটের একপাশের দেয়াল ঘেঁষে ঝোলে অনেকগুলো রূপালি ফ্রেম, তাতে শোভা পায় বড়োসড়ো রঙিন ছবি: কোনোটায় বাচ্চা রোজি একা, কোনোটায় আবার বাবা-মায়ের সঙ্গে। মোটকু চার্লি মন দিয়ে দেখেছিল ওগুলো, রোজি নামের রহস্যটাকে ভেদ করার প্রয়াস বলা চলে। মেয়েটার বাবা বিশালদেহী ছিল, মারা যায় যখন তখন রোজির বয়েস মাত্র পনেরো বছর। পেশাজীবন শুরু করেছিল রাঁধুনি হিসেবে, এরপর ক্রমাগত উন্নতি করতে করতে রেস্তোরাঁর মালিকই হয়ে যায়। প্রতিটা ছবিতে ভদ্রলোককে দারুণ দেখাচ্ছে; মনে হয় যেন ছবি তোলার আগে পোশাক নির্বাচন করে দিয়েছিল দক্ষ কেউ; সবগুলোতেই নিপাট ভদ্রলোক সে, মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে, হাত বাঁকিয়ে রেখেছে যাতে রোজির মা ধরতে পারে।
‘অসাধারণ ছিল তার রান্নার হাত,’ একবার বলেছিল রোজি। ছবিতে ওর মাকে হাস্যরতা দেখাচ্ছিল, সেই সঙ্গে বেশ সুন্দরীও। কিন্তু প্রায় এক যুগ পর সেই দেহের বাঁধন আর নেই, আর চার্লিও কখনও তার মুখে হাসি দেখেনি।
‘তোমার মা রান্না পারে?’ জিজ্ঞেস করেছিল মোটকু চার্লি, প্রথম বার দেখা হওয়ার পর।
‘তা জানি না। কখনও করতে দেখিনি।’
‘তাহলে খায় কী? ক্রাকার্স আর পানি খেয়ে তো আর কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।’
জবাব দিয়েছিল রোজি, ‘সম্ভবত বাইরে থেকে কিনে আনায়।’
রাতের বেলা বাদুরের রূপ ধরে বাইরে বেরিয়ে, ঘুমন্ত মানুষদের রক্ত চুষে খায় বেটি-সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিল না মোটকু চার্লি। একবার সেটা শুনিয়ে ছিল রোজিকে, কিন্তু মেয়েটা কথার মাঝে লুকিয়ে থাকা কৌতুক ধরতে পারেনি।
রোজির মা সরাসরিই বলেছে তার মেয়েকে—মোটকু চার্লি যে পয়সার লোভে ওকে বিয়ে করছে, তা মহিলা শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারে।
‘কীসের পয়সা?’ জিজ্ঞেস করে রোজি।
তখন অ্যাপার্টমেন্টটা দেখিয়ে দেয় রোজির মা। সেই সঙ্গে মোমের ফল, অ্যান্টিক আসবাব, দেয়ালে ঝুলতে থাকা পেইন্টিং-ও আছে। এরপর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘কিন্তু এসবই তো তোমার,’ বলল রোজি। লন্ডন ভিত্তিক এক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে মেয়েটা, চলে সেই বেতনে। খুব একটা মোটা নয় সেই অঙ্ক। তাই রোজিকে মাঝে মধ্যেই বাবার রেখে যাওয়া টাকা-পয়সা থেকে কিছু খরচ করতে হয়। সেই টাকায় ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটের মালকিন হতে পেরেছে, যেখানে ওরই সঙ্গে থাকে অস্ট্রেলিয়ান আর নিউ জিল্যান্ড থেকে আগত দুই মেয়ে; সেই সঙ্গে কিনেছে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ভোক্সওয়্যাগন গলফ।
‘আমি তো আর কেয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকব না,’ নাক টেনে বলে ওর মা, যদিও কথার স্বরে পরিষ্কার বোঝা যায়—বেঁচে থাকতে পারলে আপত্তি করবে না সে! দরকার হলে আস্তে আস্তে কমিয়ে দেবে খাওয়া, পাতলা হতে হতে পরিণত হবে পাথরের মতো একটা কিছুতে। তখন হয়তো বাতাস, মোমের ফল আর লোকজনের ঘৃণা বাদে আর কোনো খাবার না পেলেও চলবে।
হিথরো থেকে তুলে, মোটকু চার্লিকে নিয়ে তার বাড়ির দিকে রওনা দিল রোজি। সিদ্ধান্ত নিলো, প্রসঙ্গ পালটানো দরকার। বলল সে, ‘আমার ফ্ল্যাটের পানি চলে গেছে। বিল্ডিঙের কারো ফ্ল্যাটেই আসছে না।’
‘কেন?’
‘মিসেস ক্লিঙ্গারের কারণে। নিচ তলায় থাকেন, পাইপে কীভাবে কীভাবে যেন ফুটো হয়ে গেছে বলছেন।’
‘সম্ভবত মিসেস ক্লিঙ্গারের কারণেই হবে।’
‘চার্লি! যাই হোক, ভাবছিলাম—তোমার বাড়িতে গোসল সারলে কিছু মনে করবে?’
‘সাবান মাখিয়ে দিতে হবে?’
‘চার্লি!’
‘আমার আপত্তি নেই কিন্তু।’
ঠিক সামনে যে গাড়িটা আছে, ওটার পেছন দিক দেখল রোজি। তারপর গিয়ার থেকে হাত সরিয়ে, চাপ দিল মোটকু চার্লির বিশাল হাতে। ‘আমাদের বিয়ের বেশি দেরি নেই।’ বলল সে।
‘জানি আমি,’ মোটকু চার্লি বলল।
‘বোঝাতে চাইছি,’ যোগ করল মেয়েটা। ‘ওসবের জন্য অনেক সময় সামনে পরে আছে, তাই না?’
‘তা আছে,’ মোটকু চার্লি বলল।
‘আমার মা একবার কী বলেছিল, জানো?’ রোজি জিজ্ঞেস করল।
‘উম, নাকের সামনে মুলো ঝোলানো টাইপ কিছু?’
‘নাহ, তেমন কিছু না। বলেছিল: যদি কোনো বিবাহিত দম্পতি প্রথম
বছরে যত বার ভালোবাসা-বাসি করে, ততবার একটা পাত্রে পয়সা ফেলে, আর এরপরের বছরগুলোতে যত বার করে ততবার একটা করে বের করে আনে, তাহলে ওই পাত্র কখনও খালি হবে না।’
‘তার অর্থ…?’
‘তেমন কিছুই না,’ জবাব দিল মেয়েটা। ‘তবে ব্যাপারটা মজার, তাই না? রাত আটটার দিকে আমার জিনিসপাতি নিয়ে চলে আসব। তোয়ালের কী
খবর? আছে তো?’
‘আসলে…’
‘তোয়ালে নিয়েই আসব নাহয়।’
বিয়ের আগেই পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় যদি একটা-দুইটা পয়সা পাত্রে ফেলা হয়, তাহলে দুনিয়া উলটে যাবে বলে মোটকু চার্লির মনে হয় না। কিন্তু রোজি যা বলে তাতে স্থির থাকে। তাই প্রসঙ্গের সেখানেই ইতি।
থাকুক, পাত্রটা খালিই থাকুক।
.
সমস্যাটা মোটকু চার্লি উপলব্ধি করতে পারল বাড়িতে পা রাখার পর। স্বল্প সময়ের একটা সফরের পর লন্ডনে ফিরে মনে হয়: ভোরে ভোরে পৌঁছানো গেছে। অথচ বাকি দিনটায় আর করার কিছু নেই!
ও নিজে এমন একজন মানুষ, যে কাজ করাটা পছন্দ করে। সোফায় শুয়ে শুয়ে কাউন্টডাউন দেখে নিজেকে বেকারদের একজন হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ভাবল একবার। সিদ্ধান্ত নিলো – তার চাইতে এক দিন আগে কাজে যাওয়াটাই ভালো হবে। গ্রাহাম কোটস এজেন্সির অলডউইচ অফিসটা ষষ্ঠ তলায়, ওটার ওপরে আর কোনো তলা নেই। অফিসে গেলে, আবার নিজেকে মনে হবে কর্মস্রোতের অংশ। চা খাবার কামরায় অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে গল্পও করা হবে। জীবন তার সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেবে তার সামনে; অপ্রশম্য ইন্ডাস্ট্রি উপস্থাপন করবে তার জটিল জালিকা। মানুষজন খুশি হবে ওকে দেখে।
‘তোমার তো আগামীকাল ফেরার কথা, অ্যানি নামের রিসিপশনিস্ট মোটকু চার্লিকে ঢুকতে দেখে বলল। ‘সবাইকে তো সেটাই বলেছি, যে ফোন করেছে তাকেই।’ বিরক্ত দেখাল মেয়েটাকে।
‘দূরে থাকতে পারিনি,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘তা তো বুঝতেই পারছি,’ নাক টানল মেয়েটা। ‘আগে মেইভ লিভিংস্টোনকে ফোন কোরো, ভদ্রমহিলা প্রতিদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেন তোমার কথা।’
‘আমি তো জানতাম, গ্রাহাম কোটস ওনার অ্যাকাউন্ট সামলায়।’
‘হুম, সে-ই চাচ্ছে যে তুমি মহিলার সঙ্গে কথা বলো। একটু দাঁড়াও।’ বলে ফোন তুলে নিলো মেয়েটা।
গ্রাহাম কোটস-কে ডাকতে হলে ওভাবেই ডাকতে হয়—মিস্টার কোটস বললে চলবে না, তেমনি শুধু গ্রাহামও চলবে না। এজেন্সির মালিক সে, বিভিন্ন পেশার মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। সেই সঙ্গে তাদের ইনকামের একটা অংশ রেখে দেয় নিজের জন্য।
নিজের অফিসে ফিরে গেল মোটকু চার্লি। অফিস বলতে ছোট্ট একটা কামরা, যা ও ভাগাভাগি করে নিয়েছে কিছু ফাইলিং ক্যাবিনেটের সঙ্গে। কম্পিউটারের পর্দায় একটা হলদে ‘পোস্ট-ইট’ নোট লেগে আছে। তাতে লেখা—’দেখা করো, জিসি’। তাই সরাসরি হলের শেষ মাথায় চলে এলো ও, গ্রাহাম কোর্টসের বিশাল অফিসটা ওখানেই। দরজা বন্ধ দেখে নক করল একবার। ভেতর থেকে কোনো জবাব এসেছে কি না, বুঝতে না পেরে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দরজা খুলে মাথা সেঁধাল ভেতরে।
কামরা খালি, কেউ নেই। ‘উম, হ্যালো?’ বলল মোটকু চার্লি, তবে খুব একটা জোরাল কণ্ঠে না। এবারও কোনো জবাব এলো না। কামরাটা অবশ্য একটু অবিন্যস্ত মনে হচ্ছে—বইয়ের তাকটা দেওয়ালে একটু অদ্ভুত ভাবে ঝুলছে, পেছন থেকে ভেসে আসছে একটা শব্দ, যেটাকে হাতুড়ির বাড়ি বলেই মনে হচ্ছে।
চুপচাপ দরজা বন্ধ করে নিজের ডেস্কে ফিরে এলো সে।
আচমকা বেজে উঠল ওর ফোন, রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল মোটকু চার্লি।
‘গ্রাহাম কোটস বলছি, আমার অফিসে এসো।’
এবার গ্রাহাম কোটস বসে আছে তার ডেস্কের পেছনে, বইয়ের তাকটাও সোজা হয়ে দেয়ালের সঙ্গে লেগে আছে। মোটকু চার্লিকে বসার আমন্ত্রণ জানালো না মাঝবয়সী শ্বেতাঙ্গ লোকটি; চুলে পাক ধরেছে, টাকও পড়তে শুরু করেছে। গ্রাহাম কোটসকে দেখে কারও যদি দামি স্যুট পরিহিত আলবিনো নেউল মনে হয়, তাহলে একই ধারণা পোষণকারী ব্যক্তিদের তালিকায় আরও একটা নাম যোগ হবে কেবল।
‘আবার কাজে যোগ দিয়েছ দেখি,’ বলল গ্রাহাম কোটস।
‘হ্যাঁ,’ বলল মোটকু চার্লি। তারপর যোগ করল, ‘দুঃখিত।’ কেননা গ্রাহাম কোটসকে দেখে মনে হচ্ছে না যে ওর কাজে যোগ দেওয়ায় লোকটা খুশি হয়েছে।
দুই ঠোঁট একে-অন্যের ওপর চেপে ধরল গ্রাহাম কোটস, ডেস্কের ওপর থাকা একটা কাগজের দিকে তাকিয়েই আবার নজর তুলল ওপরে। ‘আমাকে বলা হয়েছিল, তুমি নাকি আগামীকালের আগে ফিরছ না। একটু আগেই চলে এসেছ, তাই না?’
‘আমরা—মানে, আমি—আজ সকালেই ফিরেছি, ফ্লোরিডা থেকে ভাবলাম, চলেই আসি। অনেক কাজ বাকি। আশা করি ভুল করিনি?’
‘পুবশ্যই করেছ,’ বলল গ্রাহাম কোটস। শব্দটা পুরোপুরি এবং অবশ্যই এর সংমিশ্রণে গঠিত—সবসময়ই মোটকু চার্লিকে বিরক্ত করেছে। ‘তবে তোমার সময়, তোমার ইচ্ছা।’
‘আমার বাবার শেষকৃত্যানুষ্ঠান ছিল।’
নেউলের মতো ঘাড়টা একটু বাঁকল। ‘ছুটির হিসেব থেকে কিন্তু দিন কাটা যাবে।’
‘অসুবিধে নেই।’
‘মেইভ লিভিংস্টোন, মরিসের বিধবা; চিন্তায় পড়ে গেছে, তাকে আশ্বস্ত করা দরকার। রোম তো আর একদিনে তৈরি হয়নি, সেটা বোঝাতে হবে মিষ্টি শব্দ ব্যবহার করে আর নানা ওয়াদা করে। মরিস লিভিংস্টোনের সম্পত্তি বণ্টনের ঝামেলা চুকিয়ে তাকে টাকা-পয়সা দেওয়ার কাজ আগের মতো একই গতিতে চলছে। প্রতিদিন আমাকে ফোন করে। যাই হোক, তোমাকে তার দায়িত্ব দিচ্ছি।’
‘ঠিক আছে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘মানে, বলছিলাম আরকী, পরিশ্রান্তের জন্য এক দিনের বিশ্রাম নেবার সুযোগও নেই!’
‘এক দিন মানেই, এক ডলার, আঙুল নাড়িয়ে বলল গ্রাহাম কোটস।
‘চোখ বন্ধ করে কাজ করে যেতে বলছেন?’
‘উঁহু, আন্তরিকতার সঙ্গে করতে বলছি,’ জানাল গ্রাহাম কোটস। ‘যাই হোক, তোমার সঙ্গে কথা বলে বড়োই প্রীত হলাম। এবার যাও, দুজনেরই অনেক কাজ বাকি।’
গ্রাহাম কোর্টসের আশপাশে থাকলেই, কী যেন হয়ে যায় মোটকু চার্লির। এক. সে বাগধারার ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়। আর দুই, কেন যেন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে বিশাল কালো হেলিকপ্টারের ঝাঁক প্রথমে গুলি করে, তারপরে বালতি ভরতি নাপাম বোমা ফেলে গ্রাহাম কোটস এজেন্সির অফিসে। মোটকু চার্লি অবশ্য সেসময় অফিসে থাকে না; তখন ও বসে থাকে অলডউইচের অন্য মাথার একটা ছোটো ক্যাফেতে, রাস্তায় বসে ফেনা ওঠা কফি পান করতে আর দক্ষ ভাবে ছোড়া নাপাম দেখে আনন্দে চিৎকার করতে ব্যস্ত।
এই কথা থেকে অবশ্য বুঝতে পারার কথা আপনাদের, মোটকু চার্লির কাজের ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানার দরকার নেই। এতটুকু জানলেই চলবে যে বেচারা চাকরি করে সন্তুষ্ট না। আসলে সংখ্যা আর গণিতের প্রতি আলাদা একটা টান আছে মোটকু চার্লির, তাই কাজ করে যাচ্ছে এখনও। সেই সঙ্গে ওর মধ্যে কাজ করে একধরনের লজ্জা ও ভদ্রতা বোধ, তাই ঠিক কী ওর দায়িত্ব তা কাউকে বলতে পারে না। কতটুকু কাজ করে, সেটাও না। চারপাশে যত মানুষ আছে, তারা অযোগ্যতা সত্ত্বেও তরতর করে উঠে যাচ্ছে ওপরে। অথচ সে নিজে রয়ে গেছে সেই একেবারে নিচু পদে, মাথা নত করে করে চলছে কাজ; অচিরেই আবার একদিন চাকরি হারাবে, বেকার হয়ে বসে বসে দেখবে টেলিভিশন। তবে কখনওই বেশিদিন চাকরিছাড়া থাকতে হয়নি ওকে। অবশ্য এতবার চাকরি হারাতে হয়েছে যে কোথাও ঢুকেই মানসিক ভাবে শান্তি পায় না বেচারা।
ব্যাপারটাকে নিজের ওপর প্রভাব ফেলতেও দেয় না।
মেইভ লিভিংস্টোনকে ফোন করল ও। মরিস লিভিংস্টোন একজন বিখ্যাত কমেডিয়ান ছিলেন, ছোটোখাটো এই ইয়র্কশায়ারিয়ান দীর্ঘদিন গ্রাহাম কোটস এজেন্সির মক্কেল ছিলেন। ‘হ্যালো,’ ভদ্রলোকের বিধবা স্ত্রীকে বলল মোটকু চার্লি। ‘আমি চার্লস ন্যান্সি, গ্রাহাম কোটস এজেন্সির অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে বলছি।’
‘ওহ,’ ওপাশ থেকে এক নারীর কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘আমি তো ভেবেছিলাম, গ্রাহামই আমাকে ফোন করবে।’
‘তিনি একটু ব্যস্ত আছেন। তাই কাজের দায়িত্বটা আমাকে দিয়েছেন, ‘ বলল মোটকু চার্লি। ‘দয়া করে বলুন, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
সেটা তো আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। ভাবছিলাম—আসলে আমি না, ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলছিল আরকী – মরিসের সম্পত্তি থেকে যে বাকি টাকাটা পাওয়ার কথা, সেটা কবে জমা হবে? গ্রাহাম কোটস গতবার আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিল—গতবারই হবে, আমাদের ফোনে যখন কথা হয় আরকী—টাকা নাকি কোথায় লগ্নি করেছে। আমি জানি এসব ক্ষেত্রে টাকা নগদ করতে কিছু সময় লাগে। এখনই তুললে নাকি অনেক ক্ষতি হবে—’
‘আসলে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আমি জানি যে তিনি ব্যাপারটা সামলাচ্ছেন। তবে হ্যাঁ, আসলেও এসব ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়।’
‘হুম,’ বলল মহিলা। ‘আমারও তাই মনে হয়। বিবিসি-কে ফোন করেছিলাম। ওরা বলেছেন, মরিসের মৃত্যুর পরেও বেশ কয়েকবার নাকি রয়্যালটির টাকা পাঠিয়েছেন। তুমি বোধহয় জানো, মরিস লিভিংস্টোন, আই প্রিসিউম-এর পুরো ভিডিয়ো ওরা ডিভিডিতে ছেড়েছে। শর্ট ব্যাক আর সাইডস- ও ছাড়তে যাচ্ছে ক্রিসমাস উপলক্ষে।’
‘নাহ, জানা ছিল না।’ স্বীকার করে নিলো মোটকু চার্লি। ‘তবে গ্রাহাম কোটস নিশ্চয়ই জানেন। এসব বিষয় তার নখদর্পণে থাকে।
‘নিজের জন্য একটা আমাকেও কিনতে হয়েছে,’ ভাবুক শোনাল মহিলার গলা। ‘তবে অনেক পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে জিনিসটা। মেকআপের ঝলক, বিবিসি ক্লাবের গন্ধ… পাদপ্রদীপটার অভাব খুব করে বোধ করছিলাম, সেটা নিশ্চয়তার সঙ্গেই বলতে পারি। মরিসের সঙ্গে আমার কিন্তু ওখানেই দেখা হয়েছিল, বুঝলে? আমি নাচতাম, নিজেরও একটা ক্যারিয়ার ছিল।’
মোটকু চার্লি তাকে জানাল, গ্রাহাম কোটসের কাছে তার ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের দুশ্চিন্তার ব্যাপারটা পৌঁছে দেবে। তারপর রেখে দিল ফোন।
ভাবল, পাদপ্রদীপের আলোর অভাব কীভাবে মানুষ বোধ করে?
যদি প্রশ্ন করা হয়, তোমার জীবনের সবচাইতে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন কোনটি? তাহলে মোটকু চার্লি জবাব দেবে : একটা প্রশস্ত মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়, অন্ধকার আকাশ থেকে ওর ওপর ঠিকরে ফেলা হচ্ছে পাদপ্রদীপের আলো। দেখা যায় না, এমন সব অবয়ব বাধ্য করছে ওকে সেই আলোর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে গান গাইতে। যতই জোরে দৌড়াক না কেন, যত দূরেই যাক না কেন…ওকে ধরে এনে আবার ঠেলে দেওয়া হয় মঞ্চে, সামনে থেকে তাকিয়ে থাকে ডজনকে ডজন উৎসুক চেহারা। গান গাইতে শুরু করার ঠিক আগে আগে ভেঙে যায় ওর ঘুম, নিজেকে ঘর্মাক্ত আর কম্পনরত অবস্থায় আবিষ্কার করে সে। বুকের ভেতর হৃদয়টা যেন ধপাধপ লাফাতে চায়!
আরেকটা কর্মদিবস শেষ হয়ে গেল। এখানে প্রায় বছর দুয়েক হলো কাজ করছে মোটকু চার্লি। একমাত্র গ্রাহাম কোটসই ওর চাইতে বেশিদিন হলো এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। এই এজেন্সির কর্মচারী বদলাবার ব্যাপারে দুর্নাম আছে। কিন্তু তারপরেও, ওকে অফিসে দেখে কেউ খুশি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
মাঝে মাঝে ডেস্কে বসে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল মোটকু চার্লি। কখনও কখনও নীরস, নিরানন্দ ধূসর বৃষ্টি আছড়ে পড়ে কাচের ওপর। তখন নিজেকে কল্পনার চোখে সে দেখতে চায় গ্রীষ্মমণ্ডলের কোনো সৈকতে। যেখানকার অস্বাভাবিক রকমের নীলচে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে একই রকমের তীব্র হলদে বালুর ওপর। প্রায়শই ভাবে: আচ্ছা, ওর কল্পনার সৈকতে যে মানুষগুলো ঢেউয়ের সাদা আঙুলের দিকে তাকিয়ে সৈকত ধরে হেঁটে যায় তাল গাছে বাসা বাঁধা পাখিদের কলতান শুনতে শুনতে, তারা কি কখনও ইংল্যান্ডে আসার কথা কল্পনা করে? ভাবে এই বৃষ্টিস্নাত দিনে, ষষ্ঠতলার কাপবোর্ড আকৃতির একটা কামরায় বসে থাকার কথা? যে ইংল্যান্ড রয়েছে ওই সোনালি বালির রাজত্ব থেকে, আর সেই সঙ্গে এতই নিখুঁত একটা একঘেয়ে দিনের সম্ভাবনা থেকে অনেক দূরে?… যে একঘেয়েমি কাটাবার জন্য একটু বেশি রাম দিয়ে বানানো ককটেলও হয়তো যথেষ্ট না!
ভাবনাটা ওকে শান্ত করে তোলে।
.
বাড়ি ফেরার পথে একটা দোকানে থেমে, নিজের জন্য এক বোতল জার্মান সাদা ওয়াইন কিনল সে, পাশের সুপারমার্কেট থেকে নিলো পাচৌলির গন্ধমাখা মোমবাতি। সবশেষে বাড়ির কাছের পিজ্জার দোকান থেকে কিনল একটা পিজ্জা।
সাড়ে সাতটার দিকে যোগ ব্যায়ামের ক্লাস থেকেই ওকে ফোন করল রোজি। জানাল যে আসতে একটু দেরি হবে। তারপর আটটার দিকে খবর দিল, গাড়িতে বসে আছে; আর গাড়ি বসে আছে ট্রাফিক জ্যামের মাঝখানে। সোয়া নয়টায় নিশ্চিত করল, একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এদিকে ততক্ষণে সাদা ওয়াইনের বোতল প্রায় পুরোই খালি, এবং পিজ্জারও অবশিষ্ট আছে মাত্র একটা স্লাইস।
পরে বহুবার ভেবেছে, কথাটা কি ওয়াইনের কারণেই বেরিয়ে এসেছিল ওর মুখ থেকে?
ন’টা বিশে উপস্থিত হলো রোজি। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তোয়ালে আর টেসকসের ব্যাগে ভরতি শ্যাম্পু, সাবান আর বড়ো এক পাত্র ভরতি মেয়োনেজ… চুলের জন্য। সাদা ওয়াইন আর পিজ্জার স্লাইস খাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল মেয়েটা, তবে সেই প্রত্যাখ্যানে রাগ নেই। জানাল, জ্যামে বসে থাকার সময়ই খেয়ে নিয়েছে। তাই রান্নাঘরে বসে রইল মোটকু চার্লি, নিজের জন্য ঢালল বোতলের অবশিষ্ট সাদা ওয়াইনটুকু। ঠান্ডা পিজ্জার ওপর থেকে পনির আর পেপারোনি তুলে নিলো সে। রোজি ততক্ষণে চলে গেছে বাথরুমে…
…এবং, একেবারে আচমকা…শুরু করে দিয়েছে তারস্বরে চিৎকার।
চিৎকারের প্রথম ধাক্কাটা মিলিয়ে যাবার আগেই বাথরুমে চলে এলো মোটকু চার্লি। রোজি তখন ফুসফুসে বাতাস ভরে নিচ্ছে আরেকবার চিৎকার করবে বলে। মোটামুটি নিশ্চিত ছিল মোটকু চার্লি, প্রেমিকাকে রক্তের ডোবায় পড়ে থাকতে দেখবে। কিন্তু অবাক হয়ে, এবং স্বস্তির সঙ্গে, আবিষ্কার করল: মেয়েটার শরীরের কোথাও থেকে রক্ত ঝরছে না। নীল ব্রা-প্যান্টি পরে আছে রোজি, আঙুল তাক করে দেখাচ্ছে বাথটাব। সেটার ঠিক মাঝখানে বসে আছে একটা বিশাল, বাদামি রঙের মাকড়শা।
‘দুঃখিত,’ অনেকটা বিলাপের সুরে বলল মেয়েটা। ‘অবাক হয়ে গেছিলাম।’
‘মাকড়শার স্বভাবই ওটা, অবাক করে দেয়,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘আমি পানি ঢেলে দিচ্ছি।’
‘ওই কাজ করতে যেয়ো না,’ কড়া স্বরে আপত্তি জানাল রোজি। ‘ওটাও প্রাণী! বাইরে ফেলে দিয়ে এসো।’
‘ঠিক আছে,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘আমি রান্নাঘরে অপেক্ষা করছি,’ বলল মেয়েটা। ‘কাজ শেষে বোলো।’
সাদা ওয়াইনের পুরো একটা বোতল গেলার পর, চঞ্চল প্রকৃতির একটা মাকড়শাকে সাদা পানপাত্রে ভরা যে কী কষ্টের কাজ, তা একমাত্র ভুক্তভোগীই জানে। হাতে অস্ত্র বলতে আছে কেবল বার্থডে কার্ড; এদিকে অতগুলো মদ গলায় ঢালার পর, হাতের সঙ্গে চোখের যেন কোনো রকমের সংযোগই স্থাপিত হতে চায় না! হিস্টিরিয়ার ঠিক আগপর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া, প্রায় নগ্ন প্রেমিকা যে রান্নাঘরে থাকবে বলা সত্ত্বেও কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে একের-পর-এক পরামর্শ দিয়েই যাচ্ছে—কাজটাকে মোটেই সহজ করে না।
তবে একসময়, সাহায্য ব্যতিরেকেই, মাকড়শাটাকে পানপাত্রে তুলে ফেলতে পারল মোটকু চার্লি। ওটার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হলো স্কুলের এক পুরনো বন্ধুর পাঠানো কার্ড ব্যবহার করে যাতে লেখা: মনের বয়েসই আসল বয়েস (ভেতরে আরও মজা করে লিখেছে: তাই হে সেক্স ম্যানিয়াক, মনটাকে লাগাম পরাও—শুভ জন্মদিন)।
প্রথমে নিচতলায়, তারপর একেবারে বাড়ির বাইরের ছোট্ট বাগানে মাকড়শাসহ চলে এলো মোটকু চার্লি। বাগান বলতে একটা ঝোপ—যেটা মানুষজন বমি করতে ব্যবহার করে—আর কয়েকটা বড়ো বড়ো ফ্ল্যাগস্টোন; পাথরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ঘাস জন্মেছে। পান পাত্রটাকে উঁচু করে ধরল সে, সোডিয়ামের হলদে আলোতে মাকড়শাটাকে কালো দেখাচ্ছে। মনে হলো, যেন সরাসরি ওর দিকেই চেয়ে আছে প্রাণিটা।
‘দুঃখিত,’ বলল সে মাকড়শাটাকে। সাদা ওয়াইন ততক্ষণে কাজ করা শুরু করে দিয়েছে বলে কথাটা জোরেশোরেই বলে ফেলল।
কার্ডসহ পান পাত্রটাকে একটা ভাঙা পাথরের ওপরে নামিয়ে রাখল মোটকু চার্লি, তারপর পান পাত্রটাকে তুলে নিয়ে মাকড়শার বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় রইল। কিন্তু তা না করে, ওভাবেই বসে রইল মাকড়শাটা, এক বিন্দুও নড়ল না; ঠায় হয়ে রইল বার্থডে কার্ডে আঁকা হাসিখুশি টেডি বিয়ারের ঠিক চেহারার ওপর।
মানুষ এবং মাকড়শা তাকিয়ে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দেখে একে-অপরকে।
মিসেস হিগলারের বলা একটা কথা তখনই মনে পড়ে গেল ওর। শব্দগুলো তাই আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো, থামাতে পারল না মোটকু চার্লি। হয়তো ভূতে পেয়েছিল ওকে তখন, হয়তো অ্যালকোহলই সেই বোকামির জন্য দায়ী।
‘যদি আমার ভাইকে দেখো,’ মাকড়শাটাকে বলল মোটকু চার্লি। ‘তাহলে ওকে জানিয়ো, আমি দেখা করতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
যেখানে যেভাবে ছিল, সেখানে সেভাবেই রইল মাকড়শাটা। তবে একটা পা তুলল শুধু, যেন ভাবছে। তারপর পাথরের ওপর দিয়ে এগিয়ে গেল ঝোপের দিকে…
…নিমিষে হয়ে গেল উধাও।
.
গোসল শেষে, মোটকু চার্লির গালে রেশ রেখে যাওয়া একটা চুমু খেল রোজি। তারপর রওনা দিল বাড়ির দিকে।
টিভি চালু করল মোটকু চার্লি, কিন্তু ঘুম ধরেছে দেখে বন্ধ করে দিল। বিছানায় শুতেই লেগে এলো চোখ। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমন অদ্ভুত, কিন্তু পরিষ্কার একটা স্বপ্ন দেখল যে সেটার কথা আজীবন মনে থাকবে।
স্বপ্নের মাঝেই সেটাকে স্বপ্ন ধরতে পারার একটা উল্লেখযোগ্য উপায় হলো, নিজেকে এমন কোথাও দেখা যেখানে আপনি জীবনেও পা রাখেননি। যেমন মোটকু চার্লি কখনও ক্যালিফোর্নিয়ায় যায়নি, বেভারলি হিলসে পা রাখার প্রশ্নই ওঠে না। তবে দেখেছে বহুবার, টিভি আর চলচ্চিত্রে। তাই চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না।
একটা পার্টিতে উপস্থিত হয়েছে সে।
লস অ্যাঞ্জেলসের আলো তাদের নিচে কোথাও জ্বলজ্বল আর দপদপ করছে।
পার্টিতে উপস্থিত মানুষগুলো নিখুঁত ভাবে দুটো দলে বিভক্ত হয়ে আছে: এক দলে আছে এমন মানুষ যাদের হাতে রূপোর থালা, কিন্তু সেটা নিখুঁত ক্যানাপে দিয়ে ঢাকা। আর অন্য দলে আছে যারা রূপোর থালা থেকে খাচ্ছে…অথবা অস্বীকৃতি জানাচ্ছে খেতে।
যারা খাচ্ছে, তারা আবার ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশাল ওই বাড়িটায়। গল্প- গুজবে, হাসিতে, কথায় মত্ত। প্রত্যেকেই হলিউডের দুনিয়ায় নিজের আপাত গুরুত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট, ভাবখানা এমন যেন ওরা প্রাচীন জাপানি রাজসভার সভাসদ! আর ঠিক সেই সময়ের মতোই, এরাও মোটামুটি নিশ্চিত যে সফলতা অপেক্ষা করছে মইয়ের মাত্র একটা ধাপ ওপরে! ওখানে পৌঁছতে পারলেই…তারা নিরাপদ হয়ে যাবে। এমন অনেক অভিনেতা উপস্থিত এখানে, যারা স্টার হতে চায়। স্টাররা চায় স্বাধীন প্রযোজক হতে, যারা স্বাধীন প্রযোজক তাদের স্বপ্ন কোনো একটা স্টুডিয়োর নিরাপদ আশ্রয়; ডিরেক্টররাও স্টার হতে চায়, স্টুডিয়োর বসরা বসতে চায় তাদের বসের আসনে; তবে স্টুডিয়োর হয়ে কাজ করা উকিলরা চায়—সবাই তাদেরকে, তাদের জন্যই পছন্দ করুক। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে নিদেনপক্ষে পছন্দ তো করুক!
স্বপ্নে মোটকু চার্লি নিজেকে দেখতে পাচ্ছে; দেহের ভেতর থেকে, আবার বাইরে থেকেও; সেটাও আবার একই সঙ্গে। আচরণটা কোনোভাবেই নিজের সঙ্গে মেলাতে পারছে না। স্বপ্নে সাধারণত সে দেখে, ডাবল-এন্ট্রি পদ্ধতি হিসেব সংরক্ষণ-সংক্রান্ত কোনো একটা পরীক্ষা দিতে বসেছে। কিন্তু পড়তে ভুলে গেছে পরীক্ষার জন্য। সেই সঙ্গে নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারছে, উঠে দাঁড়ালে দেখতে পাবে—ভুলে গেছে সকাল বেলা পরীক্ষা দেবার জন্য বেরোতে গিয়ে প্যান্ট পরতেও।
স্বপ্নেও মোটকু চার্লি…মোটকু চার্লিই থাকে, তবে অপটুতা বেড়ে যায় বহুগুণে।
কিন্তু এই স্বপ্নের কথা আলাদা।
এই স্বপ্নে মোটকু চার্লি ‘চখাম’… উঁহু, চখামের চাইতেও বেশি কিছু। ও দারুণ, ও বুদ্ধিমান, ও স্মার্ট, পার্টিতে ওই একমাত্র মানুষ যাকে কেউ আমন্ত্রণই জানায়নি! আর তা সত্ত্বেও (মোটকু চার্লি ঘুমের মাঝেই লজ্জা পেল, কেননা বিনা আমন্ত্রণে সে কোথাও যাবার কথা কল্পনাও করতে পারে না) সময়টা দারুণ উপভোগ করছে।
যাকে পাচ্ছে, তাকেই ধরে নিজের পরিচয় ও পার্টিতে আসার কারণ শোনাচ্ছে; কিন্তু প্রত্যেকবারই বদলে যাচ্ছে পরিচয় ও কারণ…দুটোই! আধ ঘণ্টার মাঝে দেখা গেল, অভ্যাগতরা সবাই বিশ্বাস করে বসেছে যে ও আসলে বিদেশি একটা অর্থলগ্নিকারী সংস্থার প্রতিনিধি। এখানে এসেছে কোনো একটা স্টুডিয়ো পুরোপুরি কিনে নেবার জন্য। আরও আধ ঘণ্টা যাবার পর পার্টির সবাই এটাও যেনে গেল—প্যারামাউন্ট স্টুডিয়ো পছন্দ হয়েছে তার!
যুবকের হাসি যেমন প্রাণখোলা, তেমনি সংক্রামক। অন্য যে কারও চাইতে যে পার্টিটা বেশি উপভোগ করছে, তা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। বারম্যানকে নির্দেশ দিয়ে বানিয়ে নিলো নিজের জন্য ককটেল যার নাম ‘ডাবল আন্টান্ড্রে’! ওটার মূলে আছে শ্যাম্পেন, যেটা — অন্তত যুবকের ভাষ্যমতে – বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নন-অ্যালকোহলিক বলা চলে। সঙ্গে এক চিমটি এটা, এক চামুচ ওটা মিলিয়েই গেল বারটেন্ডার; পাত্রের তরলের রং উজ্জ্বল বেগুনি হবার আগে থামল না।
[৭. কার্বন ডাই-অক্সাইড মেশানো পানি।]
যুবক যে শুধু নিজের জন্য বানাল ককটেলটা, তা কিন্তু না। আরও অনেকগুলো বানিয়ে ধরিয়ে দিল পার্টির অভ্যাগতদের হাতে, অচিরেই দেখা গেল: একটু আগেও যারা ফিজি ওয়াটার’ পান করছিল সাবধানতার সঙ্গে, তারা গ্লাসের পর গ্লাস বেগুনি তরল উড়িয়ে দিচ্ছে আনন্দের সঙ্গেই!
ঠিক তখনই, আর স্বপ্নের জগতের সব যুক্তি মেনেই, দেখা গেল ওকে পুলের দিকে এগিয়ে যেতে; নেতৃত্ব দিচ্ছে বাকি সবাইকে! প্রস্তাব দিল মোটকু চার্লি: পানিতে কীভাবে হাঁটতে হয়, তা শেখাবে। ব্যাপারটা পুরোটাই আসলে নির্ভর করে আত্মবিশ্বাসের ওপর, জানাল সে। নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গি, আক্রমণাত্মক মানসিকতা এবং কাজটা কীভাবে করতে হবে তা জানতে পারার ওপর। অভ্যাগতদের দেখে মনে হচ্ছে, পানিতে হাঁটার এই জ্ঞানটা জানা থাকলে মন্দ হয় না বলেই ভাবছে। ভাবখানা এমন যেন অনেক আগে থেকেই জানে তারা এই বিদ্যে…তবে অন্তরের একেবারে গহীনে লুকিয়েছিল এত দিন—এই যা। এই লোকটা ওদেরকে আবার সেই বিদ্যা মনে করিয়ে দেবে।
জুতো খুলে ফেলো সবাই, নির্দেশ দিল যুবক। বিনা বাক্য ব্যয়ে পালিত হলো সেই আদেশ। সার্জিয়ো রোসি, ক্রিশ্চিনা লিউবোটিন আর রেনে ক্যাউভিলাস ব্র্যান্ডের জুতো চুপচাপ এই লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নাইকি আর ডক মার্টেনস কোম্পানির জুতোর পাশে; সেই সঙ্গে অজ্ঞাতনামা ব্র্যান্ডের চামড়ার জুতোও। অতঃপর যুবক নেতৃত্ব দিল তাদের, কংগা নাচের মতো এক লাইনে খাড়া হতে বলল সবাইকে। সুইমিং পুলের ধার ধরে একটা চক্কর দিয়ে, আলগোছে নেমে এলো পানিতে।
বেশ ঠান্ডা পানি, কেঁপে উঠল ওপরের তল। তবে পায়ের নিচে যেন ঘন, থকথকে জেলির রূপ নিয়েছে। বেশ কিছু নারী, আর অল্প কজন পুরুষও, বোকার মতো ফিক করে হেসে ফেলল ব্যাপার-স্যাপার দেখে। দুজন কমবয়সী এজেন্ট নিজেদেরকে ধরে রাখতে পারল না, বাচ্চাদের মতো লাফাতে লাগল পানির ওপর। ওদের অনেকটা নিচে তখনও জ্বলছে লস অ্যাঞ্জেলসের আলো, যেন দূরের কোনো ছায়াপথ।
অচিরেই দেখা গেল, পুলের প্রতিটা ইঞ্চি তরে গেছে; অভ্যাগতদের কেউ দাঁড়িয়ে আছে তো কেউ নাচছে; কেউ কাঁপছে তো কেউ লাফাচ্ছে ইচ্ছেমতো। মানুষের ভিড় এত বেশি যে যুবক, যাকে স্বপ্ন-চার্লিও বলা যায়, সরে এসে দাঁড়াল কংক্রিটের মেঝের ওপর। একটা রূপালি থালা থেকে তুলে নিলো ফালাফেল-সাসিমি বল।
জেসমিনের গাছ থেকে আচমকা স্বপ্ন-চার্লির কাঁধে এসে পড়ল একটা মাকড়শা। তরতরিয়ে তার বাহু বেয়ে নেমে এলো হাতের তালুতে। দেখতে পেয়ে ওকে হেইইই বলে আনন্দের সঙ্গে সম্ভাষণ জানাল স্বপ্ন-চার্লি।
তারপর চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, ভাবখানা এমন যেন মাকড়শাটা কিছু বলছে আর স্বপ্ন-চার্লি তা শুনছে; তারপর সে জিজ্ঞেস করল, চাইলেই পাবে… তাই না?
সাবধানে মাকড়শাটাকে একটা জেসমিন-পাতার ওপর নামিয়ে দিল যুবক।
ঠিক সেই মুহূর্তে, পানির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকের যেন একসঙ্গে মনে পড়ে গেল: পানি আসলে তরল, কঠিন বা জেলির মতো পদার্থ না। আর একটা কারণ আছে, যার জন্য সাধারণত মানুষ পানির ওপর দিয়ে হাঁটে না— নাচা বা লাফানো তো দূরের কথা—তার তা হলো, সেটা অসম্ভব!
লাখো মানুষের স্বপ্ন থাকে এই মানুষগুলোর হাতের মুঠোয়; কিন্তু চার্লির স্বপ্নে, সবাই একদম একসঙ্গে, পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই ঝপ করে পড়ে যেতে লাগল চার থেকে বারো ফুট গভীর পানির ভেতরে; ভিজে সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠল।
এদিকে স্বপ্ন-চার্লির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কিছুই হয়নি, এমন ভাব করে মানুষের হাতে-কাঁধে মাথায় পা দিয়ে দিয়ে অতিক্রম করল সে সুইমিং পুল। একবারের জন্য ভারসাম্য হারালো না! পুলের দূর প্রান্তে পৌঁছে গেল সে, ওটার পর খাড়া পাহাড়ের ঢাল আর খাদ বাদে কিছুই নেই! কিন্তু না থেমে লম্বা একটা লাফ দিয়ে সে, মাথা নিচু করে ঝাঁপ দিল লস অ্যাঞ্জেলসের আলোর দিকে…
..সমুদ্রের মতো থেকে থেকে কেঁপে উঠে হাতছানি দিয়ে ডাকছে যে আলো।
হাঁচরে-পাঁচরে পুল থেকে বেরোতে চাইল অভ্যাগতরা। ভিজে একশা, সেই সঙ্গে রাগে কাঁপছে। আবার বিভ্রান্তও… কয়েকজনের হলো পানিতে ডোবার অভিজ্ঞতা…
.
দক্ষিণ লন্ডনে এখন ভোর বলা চলে। আকাশে রং নীলচে-ধূসর।
বিছানা ছাড়ল মোটকু চার্লি, স্বপ্নটা ভাবাচ্ছে ওকে। জানালার কাছে হেঁটে গেল, পর্দা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সূর্যের আলো উঁকি দিতে শুরু করেছে দিগন্তে, দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কার। রক্তলাল, কিংবা কমলা একটা প্রকাণ্ড সূর্যকে ঢেকে রাখতে গিয়ে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে ধূসর মেঘ। এই রকম আকাশ দেখেই, একেবারে নীরস মানুষও তৈলচিত্র আঁকতে বসে যায়!
সূর্যোদয়ের দিকে চাইল মোটকু চার্লি। দিনের শুরুতেই আকাশ লাল, ভাবল সে। নাবিকরা একেই সতর্কবাণী মনে করে।
স্বপ্নটা যেকোনো বিচারেই অদ্ভুত। হলিউডে একটা পার্টি! পানিতে হাঁটার বিদ্যে! আর ওই লোকটা, মানে ও নিজে…যে আবার ঠিক পরিচিত চার্লি না…
মোটকু চার্লি আচমকা আবিষ্কার করল, স্বপ্নের ওই চার্লিকে সে চেনে, কোথাও দেখেছে আগে। কোথায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করলে, ব্যাপারটাই সারাদিন জ্বালাবে ওকে। দুই দাঁতের মাঝে ডেন্টাল ফ্লসের অংশবিশেষ যদি লেগে থাকে, অথবা কামুক এবং রমণাভিলাষীর মধ্যে পার্থক্য যেমন ক্রমশ মগজে খোঁচাতে থাকে…তেমনি বিরক্ত করতে থাকবে ওকে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ও।
ভোর ছয়টা এখনও বাজেনি, পৃথিবী এখনও চুপচাপ। ভোরে ওঠা এক লোক, কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে রাস্তার শেষ মাথায়। পমেরেনিয়ান কুকুরটাকে মলত্যাগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে চাইছে লোকটা। আরেক পোস্টম্যান এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাচ্ছে, তারপর ফিরে আসছে নিজের লাল ভ্যানের কাছে। আচমকা দেখতে পেল, বাড়ির নিচের পেভমেন্টে কিছু একটা নড়ে উঠেছে। এবার মন দিয়ে তাকাল সেদিকে।
ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। যখন সেই লোকটা দেখতে পেল যে মোটকু চার্লি পাজামা পরে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে, তখন হেসে হাত নাড়ল। তাকে চিনতে পারার মুহূর্তটা চরমভাবে নাড়া দিয়ে গেল মোটকু চার্লিকে: ওই হাসি আর হাত নাড়ার সঙ্গে পরিচিত সে, যদিও কীভাবে পরিচয় হলো তা বুঝতে পারছে না। স্বপ্নের একটা অংশ এখনও ওর মাথায় ঘোরাফেরা করছে, অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে তাকে! পৃথিবীটাকে ঠিক বাস্তব মনে হচ্ছে না। চোখ ঘষল একবার, ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে আর দেখতে পেল না! আশা করল, হয়তো চেনা কিন্তু অচেনা মানুষটা চলে গেছে রাস্তা ধরে সামনে। কুয়াশার শেষ ছাপ, সেই সঙ্গে বিরক্তি আর পাগলামিটুকুও নিয়ে গেছে সামনে।
ঠিক তখনই বেজে উঠল দরজার ঘণ্টি।
ড্রেসিং গাউন গায়ে দিয়ে, নিচ তলায় চলে এলো মোটকু চার্লি। আগে কখনও দরজা খোলার আগে সেফটি চেইন লাগায়নি, জীবনে কখনও না। কিন্তু এবার হ্যান্ডেল ঘোরাবার আগে চেইনটা লাগিয়ে নিলো। সদর দরজাটা ইঞ্চি ছয়েক খুলে উঁকি দিল কেবল।
‘শুভ সকাল?’ ক্লান্ত শোনাল বেচারার কণ্ঠ।
দরজার ফাঁক দিয়ে যে হাসিটা ভেসে এলো, সেটা আস্ত একটা গ্রামের আলোর অভাব দূর করার জন্য যথেষ্ট।
‘আমাকে ডেকেছিলে, এসে পড়েছি,’ বলল অচেনা যুবক। ‘এখন দরজা তো অন্তত খুলবে, মোটকু চার্লি!’
‘কে তুমি?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি। তবে চিনতে পেরেছে যুবককে কোথায় দেখেছে আগে সেটাও মনে পড়ে গেছে—ওর মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে, ছোট্ট চ্যাপেলে। সেবারই প্রথম দেখেছিল হাসিটা। আর এবার… প্রশ্নের জবাব যুবক দেওয়ার আগেই আঁচ করতে পারছে সত্যটা।
‘আমি তোমার ভাই,’ জানাল যুবক।
ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল মোটকু চার্লি। সেফটি চেইন খুলে এবার পুরোপুরি উজাড় করে দিল দরজা। যুবক তখনও সেভাবেই দাঁড়িয়ে।
আগে যে ভাইয়ের অস্তিত্বই বিশ্বাস করত না, সেই কাল্পনিক ভাই বাস্তব হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালে কী বলতে হয়, তা জানে না মোটকু চার্লি। তাই ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল ওরা, একজন দরজার এপাশে আর অন্যজন ওপাশে। অবশেষে ওর ভাই বলল। ‘আমাকে তুমি স্পাইডার নামে ডাকতে পারো। ভেতরে আসতে বলবে না?’
‘অবশ্যই বলব। মানে, অবশ্যই, এসো ভেতরে।’
ওপরের তলায় যুবককে নিয়ে এলো মোটকু চার্লি।
এমন তো আর না যে অসম্ভব ঘটনা দুনিয়াতে ঘটেই না। যখন ঘটে, তখন সেটাকে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই সামলাবার চেষ্টা করে। আজকের দিনটায়, অন্য সব দিনের মতোই, পৃথিবীর বুকে প্রায় হাজার পাঁচেক লোকের প্রায় অসম্ভব কোনো ঘটনা দেখার বা করার বা শোনার সৌভাগ্য হবে; যেগুলো ঘটার সম্ভাবনা হয়তো দশ লাখে-এক! তাদের কেউই ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব বলে তা অবিশ্বাস করতে দৃঢ়কল্প হবে না। অধিকাংশই যার যার ভাষায় বলবে: ‘দুনিয়াটাই অদ্ভুত’। তারপর আবার লেগে পড়বে কাজে।
তাই মোটকু চার্লির মনের একটা অংশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য যৌক্তিক, বোধগম্য আর সঠিক একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাইছে। মনের বড়ো একটা অংশ চাইছে এই অজানা ভাই, যে কিনা ওরই পিছুপিছু সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, তার অস্তিত্বের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে।
রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল দুই ভাই।
‘চা দেবো?’
‘কফি হবে না?’
‘ইনস্ট্যান্ট ছাড়া নেই যে, দুঃখিত।’
‘আমার চলবে।’
কেতলির দিকে ফিরল মোটকু চার্লি। ‘অনেক দূর থেকে এসেছ?’
‘লস অ্যাঞ্জেলসে ছিলাম।’
‘বিমান যাত্রা কেমন হলো?’
রান্নাঘরের টেবিলে বসে পড়ল যুবক, কাঁধ ঝাঁকাল শুধু। আক্ষরিক অর্থেই শ্রাগ বলা চলে আচরণটাকে, যার অর্থ যেকোনো কিছুই হতে পারে।
‘উম, অনেকদিন থাকবে?’
‘সেসব নিয়ে এখনও ভাবিনি আসলে,’ যুবক—মানে স্পাইডার – মোটকু চার্লির রান্নাঘরে এমন ভাবে চোখ বোলাচ্ছে যেন কখনও কোনো রান্নাঘরে পা- ই রাখেনি!
‘কীভাবে নেবে কফি?’
‘রাতের মতো কালো…আর পাপের মতো মিষ্টি করে।’
ভাইয়ের সামনে মগটা নামিয়ে রাখল মোটকু চার্লি, তারপর এগিয়ে দিল চিনির একটা পাত্র। ‘নিজের মতো করে নিয়ে নাও।’
স্পাইডার যখন চামচের পর চামচ চিনি মগে ঢালতে ব্যস্ত, তখন চুপচাপ বসে তাকে দেখতে লাগল মোটকু চার্লি।
দুজনের মাঝে মিল আছে, যেমনটা পরিবারের সদস্যদের মাঝে থাকে— তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই একটা যুক্তি দিয়ে স্পাইডারকে দেখার পর মোটকু চার্লির মনে পরিচিতির যে অনুভূতিটা হচ্ছে তা ব্যাখ্যা করা যায় না। নিজেকে মনে মনে যে রূপে দেখতে চায়, প্রতিদিন চুপি চুপি বাথরুমের আয়নায় প্রতিফলন দেখে যে মানুষটা হতে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ভাইকে দেখে তেমন মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। স্পাইডার তুলনামূলক লম্বা, পাতলা আর এককথায়—দারুণ। পরনে একটা কালো খয়েরি চামড়ার জ্যাকেট, কালো চামড়ার প্যান্ট; দারুণ স্বচ্ছন্দ লাগছে যুবককে ওই পোশাকে। সেই স্বপ্ন-চার্লির পরনে কী ছিল, তাই মনে করার প্রয়াস পেল মোটকু চার্লি। বাস্তবের-থেকেও- বিশাল ধরনের একটা আবহ সৃষ্টি করেছে স্পাইডার। তার মুখোমুখি এক টেবিলে বসে আছে ভাবতেই নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে মোটকু চার্লির, সেই সঙ্গে অনেকটাই বিব্রতও। নাহ, স্পাইডারের পোশাকের জন্য না। এই উপলব্ধির জন্য যে ও নিজে সেই একই পোশাক পড়লে ওকে কতটা কিম্ভূতকিমাকার দেখাবে। স্পাইডারের প্রাণখোলা, মনছোঁয়া হাসিও তার কারণ না…কারণ মোটকু চার্লির ইস্পাত কঠিন বিশ্বাস যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেয়ামত পর্যন্ত অনুশীলন করেও এমন সুখপ্রদ, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী আর ঝকঝকে হাসি হাসতে পারবে না।
‘মায়ের লাশ পোড়াবার দিন এসেছিলে তুমি,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘একবার ভেবেছিলাম, কাজ শেষে তোমার সঙ্গে কথা বলব,’ জানাল স্পাইডার। ‘কিন্তু পরে মনে হলো, কাজটা সুবুদ্ধির পরিচায়ক হবে না।’
‘ইস, বললে ভালোই হতো,’ একটা চিন্তা ভেসে এলো মোটকু চার্লির মাথায়। বলল সে, ‘আমি তো ভেবেছিলাম, বাবার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে দেখা যেতে পারে তোমায়।’
‘কী?’ আঁতকে উঠল যেন স্পাইডার।
‘বাবাকে কবর দেওয়ার সময়…কয়েকদিন আগে, ফ্লোরিডায় সেরেছি অনুষ্ঠান।’
মাথা নাড়ল স্পাইডার। ‘সে মরেনি,’ বলল ও। ‘মরলে আমি জানতে পারতাম।’
‘মারা গেছে, নিজ হাতে কবর দিয়েছি ওকে। চাইলে মিসেস হিগলারকে জিজ্ঞেস করতে পারো।’
জানতে চাইল স্পাইডার, ‘মারা গেল কীভাবে?’
‘হার্ট ফেইলিওর।’
‘তাতে কিছু যায় আসে না। এর মানে—সে মারা গেছে!’
‘মানে…আসলে…আমিও তো সেটাই বলছি এতক্ষণ ধরে।’
হাসি বন্ধ হয়ে গেছে স্পাইডারের। এখন একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে কফির মগের দিকে, যেন ওর যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে ওতে। ‘আগে একটু
খোঁজ-খবর করে নিই,’ বলল স্পাইডার। ‘বলছি না যে তোমাকে অবিশ্বাস করছি। কিন্তু প্রশ্ন যখন তোমার বাপের…এবং যখন তোমার বাপ আমারও বাপ, তখন…’ চেহারা বিকৃত করল যুবক। এহেন আচরণের কারণটা জানে মোটকু চার্লি। নিজেও বহুবার করেছে, বাপের প্রসঙ্গ উঠলে। ‘ভদ্রমহিলা এখনও ওখানেই থাকে? আমরা যেখানে বড়ো হয়েছি, তার পাশের বাড়িতে?’
‘মিসেস হিগলার? হ্যাঁ, এখনও ওখানেই আছে।’
‘ওখানকার কিছু আছে সঙ্গে? ছবি-টবি জাতীয়?’
‘একটা বাক্সে ভরে কিছু ছবি নিয়ে এসেছি,’ এখনও কার্ডবোর্ডের বড়ো বাক্সটা খোলেনি মোটকু চার্লি, ওটা হলে বসে বসে ধুলো জমাচ্ছে। এখন ভেতরে এনে, রাখল টেবিলের ওপর। একটা ছুরি বের করে কেটে ফেলল প্যাকিং করার টেপ। নিজের লম্বা, পাতলা আঙুলগুলো বাক্সের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল স্পাইডার, ছবিগুলো এমন ভাবে দেখছে যেন তাস ফেটাচ্ছে। অবশেষে ওদের মা আর মিসেস হিগলারের একটা ছবি বের করে আনল। বছর পঁচিশেক আগে তোলা ওটা, দুই রমণী বসে আছে মিসেস হিগলারের বাড়ির সামনের রোয়াকে।
‘রোয়াকটা এখনও আছে?’
মনে করতে চাইল মোটকু চার্লি। ‘আছে মনে হয়,’ জবাব দিল সে।
এরপর কী হলো, তা মনে করতে কষ্ট হয় তার। হয়তো ছবিটা প্রকাণ্ড আকার ধারণ করল, আর নয়তো একেবারে ছোটো হয়ে গেল স্পাইডার। কিন্তু কসম কেটে বলতে পারে মোটকু চার্লি, আসলে দুটোর একটাও ঘটেনি; সে যাই হোক, স্পাইডার যে ছবির ভেতরে ঢুকে গেল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর ওটা কেঁপে উঠে, আন্দোলিত হয়ে গিলে ফেলল জলজ্যান্ত যুবকটাকে!
চোখ ঘষল মোটকু চার্লি। ভোর ছয়টার সময় রান্নাঘরে একাকী আবিষ্কার করল নিজেকে। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে একটা বাক্স, সেটা আবার ভর্তি ছবি আর কাগজ-পত্র দিয়ে। একটা খালি মগও আছে, যেটাকে সিঙ্কে রেখে দিল সে।
তারপর হল ধরে চলে এলো নিজের শোবার ঘরে, বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সোয়া সাতটায় অ্যালার্ম বাজার আগে আর ঘুম ভাঙ্গল না তার।