অধ্যায় ছয় – যে অধ্যায়ে মোটকু চার্লি ঘরে ফিরতে ব্যর্থ হয়, এমনকী ট্যাক্সি নেওয়ার পরেও
অ্যালার্মের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙল ডেইজির। বিড়ালের মতো ভঙ্গিমায় আড়মোড়া ভাঙল সে। বাথরুম থেকে শাওয়ার চলার আওয়াজ ভেসে আসছে, তার মানে—উঠে পড়েছে ওর ফ্ল্যাটমেট। গোলাপি একটা আঁশ-আঁশ গাউন পরে পা রাখল হলে।
‘পরিজ খাবে?’ বাথরুমের দরজার ফাঁক দিয়েই জানতে চাইল ও।
‘ইচ্ছা তো নেই। কিন্তু তুমি যদি বানাও, তাহলে খাবো।’
‘মেয়েমানুষের দাম কীভাবে বাড়িয়ে দিতে হয়, তা তো ভালোই জানো!’ বলল ডেইজি। কিচেনেটের কাছে গিয়ে রান্না করার জন্য পরিজ রাখল তার ওপরে।
তারপর ফিরে এলো শোবার ঘরে, পরে নিলো কাজে যাওয়ার পোশাক। আয়নায় দেখল নিজেকে, ভেঙচি কাটল নিজেকেই। চুল খোপা করে বাঁধল মাথার পেছনে।
ওর ফ্ল্যাটমেট, ক্যারোল, প্রেসটন থেকে এসেছে। সরু চেহারার মেয়েটা মাথা ঢোকাল শোবার ঘরে; জোরেশোরে মুছছে মাথার চুল। ‘বাথরুমের সবটাই এখন তোমার। পরিজের কী অবস্থা?’
‘এক-আধবার নেড়ে দিলেই হয়ে যাবে।’
‘কয়েক রাত আগে ছিলে কই? বলেছিলে, ফূর্তি করতে সিবিলার জন্মদিনের পার্টিতে যাচ্ছ। কিন্তু রাতে যে ফেরোনি, সেটা জানি।’
‘নিজের চরকায় তেল দিন, জনাবা।’ রান্নাঘরে প্রবেশ করে পরিজের পাত্র নেড়ে দিল ডেইজি। এক চিমটি লবণ ঢেলে আবার নাড়ল খানিকক্ষণ। তারপর দুটো পাত্রে পরিজ ঢেলে, কাউন্টারে রাখল।
‘ক্যারোল? ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।’
ডাক শুনে চলে এলো ক্যারল, তাকাল খাবারের দিকে। পোশাক পুরোপুরি পরেনি এখনও। ‘নাস্তা হিসেবে আদর্শ বলা যায় না, তাই না? আমার মতে আদর্শ নাস্তা হলো—ডিম ভাজা, সসেজ, কালো পুডিং আর গ্রিলড টমেটো।’
‘তুমি রাঁধো,’ জানাল ডেইজি। ‘আমি আনন্দের সঙ্গেই খাবো।’
পরিজের ওপর বলতে গেলে ইচ্ছেমতো চিনি ঢালল ক্যারোল। পাত্রের দিকে তাকিয়ে, তারপর যোগ করল আরেক চামচ চিনি। ‘তা খাবে না। বলছ বটে, কিন্তু খাওয়ার আগেই কোলেস্টেরলের অজুহাত দিয়ে পিছিয়ে যাবে; হয়তো বলবে, ভাজা খাবার খেয়ে তোমার কিডনির কী হাল হয়েছে!’ এমনভাবে পরিজের স্বাদ নিলো মেয়েটা, যেন পালটা ওকেই কামড় দিয়ে বসবে পাত্রের খাবার। একটা কাপে চা ঢেলে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল ডেইজি। ‘তুমি আর তোমার কিডনি। অবশ্য ওটার তরকারি পেলেও মন্দ হতো না, মুখের স্বাদ বদলানো যেত। কখনও কিডনি খেয়েছ, ডেইজি?’
‘একবার,’ জানাল ডেইজি। ‘আমার তো মনে হয়, আধ পাউন্ড কলিজাকে গ্রিল করে, তাতে পেশাব করে দিলে একই স্বাদ পাওয়া যাবে!’
নাক টানল ক্যারোল। ‘বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?’
‘পরিজ গেলো।’
নাস্তা শেষে যার যার পাত্র ডিশওয়াশারে ভরে রাখল ওরা। কিন্তু এখনও ময়লা পাত্র দিয়ে যন্ত্রটা ভরে ওঠেনি বলে, চালু হলো না। এরপর কাজে বেরিয়ে গেল ওরা। ক্যারোল, নতুন ইউনিফর্ম পরে, গাড়ি চালাতে শুরু করল।
ডেস্কের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ডেইজি, কামরার অধিকাংশ ডেস্কই খালি।
কিন্তু চেয়ারে বসার আগেই বেজে উঠল ফোন। ‘ডেইজি, চলে এসেছ?’
ঘড়ির দিকে তাকাল মেয়েটা। ‘না,’ বলল সে। ‘এখনও আসিনি, স্যার।
তা আজ এই সুন্দর সকালে আপনার জন্য কিছু করতে পারি?’
‘অবশ্যই পারো। কোটস নামের এক ভদ্রলোককে ফোন করতে পারো, তিনি আবার পুলিস সুপারের বন্ধু মানুষ; ক্রিস্টাল প্যালেসের আরেক সমর্থক। সকাল থেকে এরই মাঝে বার দুয়েক মেসেজ পাঠানো শেষ! আমি জানতে চাই, পুলিস সুপারকে মেসেজ পাঠানো শেখালোটা কে?’
বিস্তারিত বিবরণ টুকে নিলো ডেইজি, তারপর ফোন করল নম্বর ঘুরিয়ে। দক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব কণ্ঠে ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডে বলছি, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘আহ,’ ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠে জবাব এলো। ‘গত রাতে চিফ সুপারিন্টেনডেন্টের সঙ্গে কথা বলছিলাম, অনেক দিনের পুরনো বন্ধু আমরা; ভালো একজন মানুষ। সে-ই বলল আপনাদের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। একটা রিপোর্ট লেখাতে চাই। সত্যি বলতে কী, আমি আসলে নিশ্চিত নই যে কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। হয়তো যে কারণে রিপোর্ট করতে চাইছি, তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে। কিছু গোঁজামিল ধরা পরেছে আমার দৃষ্টিতে। এদিকে আমার হিসেবরক্ষক…বলেই দিই আপনাকে, কয়েক হপ্তার ছুটিতে আছে সে। আছে বলতে, আমিই দিয়েছি। বুঝতে চাইছি, আসলেই কোনো গোলমাল করেছে নাকি লোকটা… মানে আমার আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ব্যাপারে।’
‘আগে আমাদের বিস্তারিত নাম-পরিচয় জানান। আপনার পুরো নাম কী, স্যার? আর আপনার হিসাবরক্ষকের নাম?
‘আমার নাম গ্রাহাম কোটস, ওপাশ থেকে জবাব এলো। ‘গ্রাহাম কোটস এজেন্সির মালিক। আর আমার হিসেবরক্ষকের নাম ন্যান্সি, চার্লস ন্যান্সি।’
দুটো নামই লিখে রাখল মেয়েটা, একটাও পরিচিত ঠেকল না।
.
স্পাইডার ঘরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে দেবার ইচ্ছা ছিল মোটকু চার্লির। মাথার ভেতরে বহুবার যুক্তি সাজিয়েছে। প্রত্যেকবার জয় ওরই হয়েছে, প্র ত্যে-ক-টা বা-র।
কিন্তু স্পাইডার যে গত রাতে বাসাতেই ফেরেনি! টেলিভিশন দেখতে দেখতে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ে মোটকু চার্লি। ঘুম থেকে উঠেও নিজেকে আবিষ্কার করে সোফাতেই। তবে ঘুম ভাঙে স্পাইডার পর্দা সরালে। ‘দারুণ একটা দিন,’ জানাল স্পাইডার।
‘তুমি!’ বলল মোটকু চার্লি। ‘গতকাল রোজিকে চুমু খাচ্ছিলে। অস্বীকার করার চেষ্টাও কোরো না!’
‘বাধ্য হয়েছি বলতে পারো,’ জানাল স্পাইডার।
‘বাধ্য হয়েছ মানে? চুমু খেতে কেউ কীভাবে বাধ্য হয়?’
‘মেয়েটা ভেবেছিল, আমি আসলে তুমি।’
‘তা ভাবুক। কিন্তু তুমি তো জানতে যে তুমি আসলে আমি না! চুমু খেয়ে ঠিক করোনি।’
‘কিন্তু যদি অস্বীকার করতাম, তাহলে মেয়েটা ধরেই নিত যে তুমি ওকে চুমু খেতে চাচ্ছ না!’
‘কিন্তু ওটা তো আমি ছিলামই না।’
‘মেয়েটা তো আর তা জানত না। আমি শুধু তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছিলাম।’
‘সাহায্য করতে চাচ্ছিলে?’ সোফায় বসা মোটকু চার্লি বলল। ‘সাধারণ কেউ কাউকে সাহায্য করতে চাইলে, তার প্রেমিকাকে চুমু খায় না। দাঁতে ব্যথার কথা বলে এড়াতে পারতে।’
‘তাহলে তো,’ নিষ্পাপ ভঙ্গিতে বলল স্পাইডার। ‘মিথ্যে বলা হতো।’
‘মিথ্যা তো আগে থেকেই বলছিলে! আমার চরিত্রে অভিনয় করছিলে তুমি!’
‘মিথ্যেটাকে আরও জটিল করা হতো তাতে,’ ব্যাখ্যা করে শোনাল স্পাইডার। ‘যেহেতু তোমার অফিসে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না, তাই আমাকে কাজটা করতে হয়েছে। আর না,’ সাফ জানিয়ে দিল সে। ‘আরেকটা মিথ্যে বলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। খুব খারাপ লাগত তাহলে।’
‘কিন্তু…রোজিকে তোমার চুমু খাওয়ার দৃশ্য দেখে আমারও তো খারাপ লাগছিল, তাই না?’
‘আহ,’ বলল স্পাইডার। ‘কিন্তু সে ভাবছিল যে তোমাকে চুমু খাচ্ছে!’
‘বারবার একই কথা বোলো না তো!’
‘তোমার তো উলটো ভালো বোধ করার কথা ছিল,’ জানাল স্পাইডার।
‘লাঞ্চ খাবে?’
‘না, খাবো না। কটা বাজে?’
‘দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে,’ জানাল স্পাইডার। ‘তুমি আজকেও দেরি করে ফেলবে কাজে যেতে। কিন্তু তোমার ঝামেলা সমাধান করার বদলায় যদি এই রকমের ধন্যবাদ কপালে জোটে, তাহলে আমার সাহায্যের আশা বাদ দিতে পারো।’
‘অসুবিধে নেই,’ মোটকু চার্লি বলল। ‘দুই হপ্তার ছুটি পেয়েছি, বোনাসসহ।’
ভ্রু কুঁচকে গেল স্পাইডারের।
‘দেখো,’ বলল মোটকু চার্লি, আরেকবার ঝগড়া করার সময় হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি আসলে তোমাকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছি না; তবে কৌতূহল হচ্ছিল আরকি। যাবে কবে?’
জবাব দিল স্পাইডার। ‘যখন এসেছিলাম, তখন তো ইচ্ছে ছিল এক দিন থেকেই চলে যাবো। বড়োজোর দুই দিন। ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেই, আবার নামবো পথে। হাজার হলেও, আমি ব্যস্ত মানুষ।’
‘তাহলে কি আজই চলে যাবে?’
‘পরিকল্পনা তো সেটাই ছিল,’ জানাল স্পাইডার। ‘কিন্তু তারপর দেখা হলো তোমার সঙ্গে। বিশ্বাসই হতে চাইছে না যে প্রায় পুরো একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম আমরা একে-অন্যের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে!’
‘আমার হচ্ছে।’
‘রক্তের বন্ধন বলে কথা,’ স্পাইডার বলল। ‘পানির চেয়ে অনেক কড়া।’
‘পানি তো কড়া না।’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি।
‘তাহলে ভদকার চেয়ে কড়া, কিংবা আগ্নেয়গিরির চাইতে…আর নয়তো অ্যামোনিয়ার চেয়ে। দেখো, আমি বলতে চাচ্ছি—ব্যাপারটাকে আমি আশীর্বাদ হিসেবে নিয়েছি। আমরা আগে একে-অন্যের জীবনের অংশ ছিলাম না, কিন্তু সে অতীতের কথা। চলো, আজ থেকেই নতুন একটা ভবিষ্যৎ লিখি। গতকালকে পেছনে রেখে, আমরা নতুন বন্ধন গড়ে তুলি—ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।
‘তুমি রোজিকে পটাতে চাচ্ছিলে,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘তাতে কোনো সন্দেহ নেই,’ একমত হলো স্পাইডার। ‘কিন্তু তুমি এখন কী করবে?’
‘কী করব? কিছু করার দরকার আছে? আমার বাগদত্তা সে।’
‘কিচ্ছু ভেবো না, ওর ধারণা—আমি তো আসলে তুমিই।’
‘ওই কথাটা বলা বন্ধ করবে?’
সন্তের ভঙ্গিতে হাত নাড়াল স্পাইডার, কিন্তু তারপরেই ঠোঁট চেটে নষ্ট করে ফেলল আবহ।
‘তাহলে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘এখন কী করবে? আমার চরিত্রে অভিনয় করতে করতেই বিয়ে করে ফেলবে ওকে?’
‘বিয়ে?’ একটু থেমে ভাবল স্পাইডার। ‘কী-ভয়ানক-কথা!
‘আমার তো বিয়ের তর সইছে না।’
‘স্পাইডার বিয়ে করে না, সে ওই ধাতুতেই গড়া না!’
‘তাহলে বলতে চাচ্ছ, আমার রোজি তোমার যোগ্য না?’
জবাব দিল না স্পাইডার, বেরিয়ে গেল কামরা ছেড়ে।
মোটকু চার্লির মনে হলো, তর্কে বিজয় ওরই হয়েছে। সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল সে, বিছানায় থাকা খালি কার্টনগুলো গুছিয়ে ফেলল ময়লার বাক্সে; আগের রাতে ওতে ছিল চিকেন চাউমিন আর পর্ক-বল। শোবার ঘরে চলে গেল ও, বাসি পোশাক বদলে নতুন কাপড় পরে নিতে চাইল। কিন্তু আবিষ্কার করল পরক্ষণেইঃ লন্ড্রি করেনি বলে পরিষ্কার কাপড়ই নেই কোনো। তাই আগের দিনের পোশাকটাই ভালো মতো ঝেড়ে—কাজটা করতে গিয়ে মুক্ত হলো চাউমিনের কয়েকটা তন্তু—তারপর আবার পরে নিলো ওগুলোই।
তারপর পা রাখল রান্নাঘরে।
টেবিলের পাশে বসে আছে স্পাইডার, আরাম করে খাচ্ছে বড়োসড়ো একটা স্টেক; এতটাই বড়ো যে দুজনের খাওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো।
‘ওটা পেলে কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি, যদিও জবাবটা ওর জানা।
‘লাঞ্চ খাবে কি না, জিজ্ঞেস করেছিলাম তো,’ নম্র কণ্ঠে বলল স্পাইডার। ‘স্টেকটা কই পেলে?’
‘ফ্রিজে।’
‘ওটা,’ অন্তিম সংলাপের সময় উকিলরা যেভাবে আঙুল নাড়ায়, সেই ভঙ্গিতে বলল মোটকু চার্লি। ‘আজ ডিনারের জন্য কিনেছিলাম। আমার রোজির জন্য রাতে রান্না করার কথা ছিল। আর ওই স্টেকের টুকরোটাই বসে বসে খাচ্ছ! আর…আর—’
‘এটা কোনো সমস্যাই না!’ জানাল স্পাইডার।
‘সমস্যা না মানে?’
‘সকালে ফোন করেছিলাম রোজিকে,’ জানাল স্পাইডার। ‘ডিনার একসঙ্গে খাচ্ছি আমরা। তাই স্টেকটার তোমার এমনিতেও দরকার পড়ত না।’
কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল মোটকু চার্লি, তারপর বন্ধ করল আবার। ‘বেরিয়ে যাও,’ বলল সে।
‘বামন হয়ে চাঁদ ধরার মানুষের যে ইচ্ছা, আশা বা আকাঙ্ক্ষা যেটাই বলো না কেন…দারুণ।’ মোটকু চার্লির স্টেক ধ্বংস করার ফাঁকে ফাঁকে আনন্দের সঙ্গে বলল স্পাইডার।
‘মানে কী কথাটার?
‘মানে এই যে আমি কোথাও যাচ্ছি না। জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে।’ স্টেকের বড়ো আরেকটা টুকরো কেটে মুখে পুড়ে বলল স্পাইডার।
‘বের হয়ে যাও,’ বলল মোটকু চার্লি। ঠিক সেই মুহূর্তেই বেজে উঠল হলের টেলিফোন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হলে চলে এলো সে, ফোন তুলে বলল, ‘কী?’
‘আহ, চার্লস। তোমার কণ্ঠ শুনে খুশি হলাম। আমি জানি, তুমি তোমার প্রাপ্য ছুটিটা কাটাচ্ছ। কিন্তু যদি সম্ভব হয়, মানে খুব বেশি কষ্ট না হয় তো, আগামীকাল সকালে আধ-ঘণ্টার জন্য আসতে পারবে? এই ধরো দশটার দিকে।’
‘অবশ্যই,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘কোনো অসুবিধে নেই।’
‘শুনে খুশি হলাম। কয়েকটা কাগজে তোমার সই দরকার। ঠিক আছে, কাল দেখা হবে।’
‘কে ফোন করেছিল?’ জিজ্ঞেস করল স্পাইডার। প্লেট পরিষ্কার ফেলেছে ততক্ষণে, এখন মুখ মুছছে টিস্যু দিয়ে।
‘গ্রাহাম কোটস, আগামীকাল যেতে বলেছে।’
স্পাইডার জানাল, ‘লোকটা আসলে হারামি।’
‘সমস্যা কী? তুমিও তো হারামি।’
‘হুম, কিন্তু আমি অন্য রকমের। লোকটা ভালো না, অন্য কোনো চাকরি খুঁজে নাও।’
‘এখন যা করছি, সেটাকে ভালোবাসি!’ আন্তরিক ভাবেই বলল মোটকু চার্লি। ভুলেই গেছে, আসলে কাজটা কত অপছন্দ করে সে, অপছন্দ করে গ্রাহাম কোটস এজেন্সিকে, এবং প্রত্যেকটা দরজার পেছনে ওঁত পেতে থাকা জঘন্য গ্রাহাম কোটসকে ঘৃণা করার মাত্রাও।
উঠে দাঁড়াল স্পাইডার। ‘স্টেকটা দারুণ ছিল,’ বলল সে। ‘তোমার বাড়তি কামরায় আমার জিনিসপত্র রেখে দিয়েছি।’
‘কীহ?’
দ্রুত হলের শেষ মাথায় চলে এলো মোটকু চার্লি; ওর ফ্ল্যাটে টেনে-টুনে দুটো শোবার ঘর আছে বলা যায়। দ্বিতীয়টা একেবারেই ছোটো, সেজন্যই ‘টেনে-টুনে’ বলা। ভেতরে ছিল কয়েকটা বইয়ের কার্টন, একটা রেসিং সেটের বাক্স, হট হুইলসের খেলনা গাড়িতে ভরতি একটা টিনের বাক্স (অধিকাংশেরই চাকা নেই) এবং মোটকু চার্লির ছেলেবেলার স্মৃতিচিহ্নবাহী আরও অনেক কিছু। বামন কিংবা ওই সাইজের কারও জন্য শোবার ঘর হিসেবে একদম নিখুঁত। কিন্তু অন্য যেকারও জন্য জানালাঅলা ক্লজেট ছাড়া কিছু না।
অন্য ভাবে বলতে গেলে: আগে তাই ছিল। কিন্তু এখন আর নেই।
দরজা খুলে ফেলল মোটকু চার্লি, দাঁড়াল হলঘরে এসে। চোখ পিটপিট করছে।
কামরা একই আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এখন ওটা আকারে বিশাল। শুধু যে বিশাল তাই না, অসাধারণও বলা চলে। দূরের একটা কোনায় জানালা দেখা যাচ্ছে, বড়োসড়ো একটা জানালা। ওটা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে একটা ঝরনা। ঝরনার মাথায় নিচু হয়ে ঝুলে আছে গ্রীষ্মমণ্ডলের সূর্য, সোনা-রঙা আলোয় মাখিয়ে রেখেছে চারপাশে। আরেক কোনায় যে বিশাল ফায়ারপ্লেসটা দেখা যাচ্ছে, তাতে একজোড়া ষাঁড় একত্রে রোস্ট করা যাবে; তাতে এই মুহূর্তে দেখে যাচ্ছে জ্বলন্ত তিনটি কাঠের টুকরা; ফট ফট শব্দ করে ফাটছে ওগুলো। এক কোণে ঝুলছে একটা হ্যামক, কামরায় সেই সঙ্গে জায়গা হয়েছে একটা সাদা সোফা আর বড়োসড়ো বিছানারও। ফায়ারপ্লেসের কাছে যেটা আছে, সেটাকে মোটকু চার্লি এর আগে কেবল ম্যাগাজিনেই দেখেছে— কোনো এক ধরনের জ্যাকুজি হবে। জেবরার চামড়ার গালিচাও আছে একটা, ভালুকের চামড়া ঝুলছে দেওয়ালে। যে উচ্চমানের অডিয়ো ইকুইপমেন্ট দেখা যাচ্ছে, তা অতি সাম্প্রতিককালের। কদিন আগেও কামরার যে প্রশস্ততা ছিল, তার সমান সাইজের একটা ফ্ল্যাট টেলিভিশন দেখা যাচ্ছে কামরায়। জিনিসপত্র আছে আরও…
‘করেছটা কী?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি। ভেতরে পা রাখল না।
‘হয়েছে কী,’ পেছন থেকে বলল স্পাইডার। ‘যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি যে এখানেই কিছুদিন থাকব, তাই ভাবলাম আমার সব জিনিসপত্রও নিয়ে আসা যাক।
‘জিনিসপত্র? জিনিসপত্র আনার অর্থ হলো কয়েকটা ব্যাগে করে জামা- কাপড়, কিছু প্লে-স্টেশন গেম আর বড়োজোর একটা গাছ-টাছ সঙ্গে আনা। কিন্তু এসব…এসব…’ ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন বেচারা।
পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় মোটকু চার্লির কাঁধে ধাক্কা দিল স্পাইডার। ‘যদি আমাকে কখনও দরকার হয়,’ বলল সে ভাইকে। ‘তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে তা তো জানাই থাকল।’ ধড়াম করে লাগিয়ে দিল সে দরজাটা।
ডোর নব ধরে নাড়ল মোটকু চার্লি, কিন্তু দরজা এখন বন্ধ।
টিভি যে ঘরে রেখেছে, সেখানে গেল ও। যাবার পথে হল থেকে ফোনটা তুলে নিলো হাতে, ঘোরাল মিসেস হিগলারের নম্বর।
‘এত সকালে কে রে?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘আমি, মোটকু চার্লি। দুঃখিত।’
‘তো কী হয়েছে? ফোন করেছ কেন?’
‘তোমার পরামর্শ দরকার ছিল। আমার ভাই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে।’
‘তোমার ভাই?’
‘স্পাইডার, যার কথা আমাকে বলেছিলে। দেখা করতে চাইলে, মাকড়শাকে জানাতে বলেছিলে না? সেটাই করেছি, আর সে এসে হাজির!’
‘তাহলে তো,’ নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল মহিলা। ‘ভালোই হলো।’
‘নাহ, ভালো না।’
‘কেন? ও তো তোমার আত্মীয়, তাই না?
‘বিস্তারিত বর্ণনা এখন দিতে পারব না। শুধু চাই, ও এখন চলে যাক।’
‘ভালোভাবে বলে দেখেছ?’
‘সেই চেষ্টা করে দেখেছি, কথা শুনছে না। কুবলাই খানের প্রমোদভবনের মতো কিছু একটা সাজিয়ে নিয়েছে আমার বক্স রুমে। এখানে বাড়িঘরে হালকা-পাতলা পরিবর্তন আনতে চাইলেও কাউন্সিলের অনুমতি লাগে। অথচ ছেলেটা আস্ত ঝরনা খাড়া করে দিয়েছে! এখানে না ঠিক, জানালার অন্য পাশে। আমার বাগদত্তার পেছনেও লেগেছে।’
‘তা তুমি কীভাবে জানলে?’
‘নিজের মুখেই বলেছে।’
মিসেস হিগলার বলল, ‘কফি গলা দিয়ে নামার আগে আমার মাথা ঠিক হবে না।’
‘কী করলে ও চলে যাবে, সেটা জানা দরকার।’
‘তা আমি জানি না,’ বলল মিসেস হিগলার। ‘ব্যাপারটা নিয়ে মিসেস ডানউইডির সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
মোটকু চার্লি করিডরের শেষ মাথায় ফিরে গিয়ে, দরজায় টোকা দিল।
‘কী হলো?’
‘কথা বলতে চাই।’
ক্লিক শব্দ করে খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল মোটকু চার্লি। স্পাইডার আরাম করে বসে আছে জ্যাকুজিতে, তাও নগ্ন হয়ে। একটা লম্বা, বরফে পূর্ণ গ্লাস ভরতি বিদ্যুৎ-রঙা তরল পান করছে। বিশাল জানালাটা খোলা, ভেসে আসছে ঝরনার আওয়াজ। কামরার কোথাও লুকিয়ে রাখা স্পিকার থেকে
ভেসে আসছে জ্যাজ গানের সুর।
‘দেখো,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘একটা ব্যাপার তোমাকে বুঝতে হবে, এটা আমার বাড়ি।’
চোখ পিট পিট করল স্পাইডার। ‘এইটা?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘এইটা তোমার বাড়ি?’
‘উম, আসলে পুরোপুরি না। কিন্তু যা বলতে চাইছি, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। আমরা বাড়তি কামরায় আছি, আর এখানে তুমি অতিথি ছাড়া আর কিছু নও।’ গ্লাসে চুমুক দিয়ে, আরামদায়ক গরম পানিতে গা আরও এলিয়ে দিল স্পাইডার। ‘লোকে বলে,’ জানাল সে। ‘অতিথি আর মাছের মাঝে পার্থক্য নেই; দুটোই দিন তিনেক পর গন্ধ ছড়াতে শুরু করে।’
‘কথাটা ভুল না,’ মোটকু চার্লি জবাব দিল।
‘কিন্তু জীবন কঠিন হয়ে যায়,’ বলল স্পাইডার। ‘যখন প্রায় পুরোটা কেটে যায় নিজের আপন ভাইকে না দেখে। কঠিন হয় যখন সে জানেও না যে তার ভাইয়ের অস্তিত্ব আছে। আর সবচেয়ে বেশি কঠিন হয় যখন তার সঙ্গে দেখা হবার পর জানা যায়, ভাইকে সে মরা মাছ মনে করে!’
‘কিন্তু,’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি।
বাথটাবে লম্বা হয়ে আড়মোড়া ভাঙল স্পাইডার। ‘একটা কথা তোমাকে বলি, অনন্তকাল থাকার জন্য তো আর আসিনি। শান্ত হও, চোখের পলক ফেলার আগেই ফুরিয়ে যাবে সময়; চলে যাবো আমি। আরেকটা কথা বলে রাখি-তোমাকে আমি কখনও মরা মাছ ভাববো না। আমরা দুজনেই মারাত্মক চাপে আছি, তাই এই প্রসঙ্গে আর কথা না বলি। এবার যাও, লাঞ্চ সেরে আসো। সদর দরজার চাবি রেখে যাও। খাওয়া শেষে একটা মুভিও দেখে নিয়ো।’
জ্যাকেট গায়ে চড়িয়ে বাইরে পা রাখল মোটকু চার্লি। বাড়ির চাবিটা রেখে দিল সিঙ্কের পাশে। তাজা বাতাস দারুণ লাগছে, যদিও দিনটা ধূসর; গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। পড়ার জন্য একটা খবরের কাগজ কিনে নিলো, চিপ্পিতে[১৬] থেমে কিনল বড়োসড়ো একটা ব্যাগ; সেটাই দুপুরের খাবার। বৃষ্টি থেমে গেছে, তাই চার্চের প্রাঙ্গণের একটা বেঞ্চে বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে আরাম করে খেল সদ্য কেনা স্যাভেলয়[১৭] আর চিপস।
[১৬. ফিস-অ্যান্ড-চিপসের দোকান।
১৭. প্রচুর মসলাযুক্ত শুয়োরের মাংসের সসেজ।]
ছবি দেখার তীব্র একটা ইচ্ছা জন্ম নিয়েছে মনে।
ঘুরতে ঘুরতে ওডিয়োনে চলে এলো সে, প্রথম যে মুভিটা দেখানো হচ্ছিল সেটারই টিকেট কিনল। অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার মুভি, ও ভেতরে যাবার আগেই শুরু হয়ে গেছে সেটা। অনেক কিছু ফেটে ফুটে গেল, বিস্ফোরণ হলো বহুবার।
মন্দ না।
তবে মুভির মাঝপথে এসে ওর মনে হতে লাগল, কিছু একটা ভুলে যাচ্ছে। মাথার কোথাও আছে সেই তথ্য লুকিয়ে, বাইরে আসার জন্য মাঝে-মাঝে খোঁচাচ্ছে। সামনের পর্দায় মন বসাতে দিচ্ছে না।
অবশেষে শেষ হলো ছবিটা।
মোটকু চার্লি উপলব্ধি করতে পারল, উপভোগ করেছে বটে মুভিটা; কিন্তু যা দেখেছে তার অধিকাংশই মনে নেই ওর। তাই পপকর্নের বড়োসড়ো একটা ব্যাগ কিনে, বসে বসে আবার দেখতে লাগল। দ্বিতীয় বার আরও বেশি ভালো লাগল মুভিটা।
তৃতীয় বারে আরও বেশি।
তারপর ভাবলো: বাসায় যাওয়া উচিত ওর। কিন্তু লেট-নাইট শোতে ইরেজারহেড আর ট্রু স্টোরিজ দেখাচ্ছে। একটাও আগে দেখা হয়নি ওর, তাই বসে বসে দুটোই দেখে নিলো। এতক্ষণে অবশ্য অনেকটাই ক্ষুধার্ত হয়ে গেছে বেচারা। অর্থাৎ, ইরেজারহেড-এ আসলে কী দেখানো হচ্ছে, সেটাই ধরতে পারেনি! কিংবা ধরতে পারেনি রেডিয়েটর নিয়ে কী করছে মেয়েটা। আরেকবার দেখার কথা ভাবল ও; কিন্তু কর্তৃপক্ষ পরম ধৈর্যের সঙ্গে বোঝাল ওকে রাতের মতো থিয়েটার বন্ধ করে দেবে। জানতেও চাইল, ওর কি যাওয়ার মতো কোনো বাড়ি নেই? যদি থাকে, তাহলে কি এখন ঘুমানোর সময় হয়নি?
তা তো হয়েছেই, তবে এতক্ষণ ভাবেনি ব্যাপারটা নিয়ে। ধীরে পায়ে ফিরে এলো সে ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনসে, অবাক হয়ে আবিষ্কার করল: তার শোবার ঘরের কামরায় এখনও আলো জ্বলছে।
বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখে, পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে। জানালার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে অবয়ব, ঘোরা-ফেরা করছে।
অবয়ব দুটো চিনতে পারল সে।
কাছাকাছি হলো অবয়ব দুটো… তারপর হয়ে গেল মিলেমিশে একাকার।
গভীর এক ভয়াবহ একটা গর্জন ছাড়ল মোটকু চার্লি।
.
মিসেস ডানউইডির বাড়িতে প্লাস্টিকের খেলনা পশুর কোনো অভাব নেই। এখানে বাতাসে ভেসে ধীরে ধীরে সরে যায় ধুলো, ভাবখানা এমন যেন ধীরে- সুস্থে নড়তে চায় তারা সূর্যের আলোর শক্তিতে বলীয়ান হয়ে; আধুনিক অন্যান্য আলোর উৎস খুব একটা পছন্দ না। সোফা ঢেকে রেখেছে স্বচ্ছ একটা প্লাস্টিকের কাভার, বসলে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে ওঠে।
মিসেস ডানউইডির বাড়িতে ব্যবহৃত হয় পাইনের গন্ধঅলা টয়লেট পেপার—জ্বলজ্বলে, অস্বস্তিকর ওগুলো। মিসেস ডানউইডি বিশ্বাস করে, খরচ যত কমানো যায় ততই ভালো। পাইনের গন্ধঅলা ওই টয়লেট পেপার তার সেই প্রচেষ্টারই অংশ। যথেষ্ট সময় খরচ করে খুঁজলে, আর পয়সা খরচ করলে ওই রকমের টয়লেট পেপার আজও পাওয়া যায়।
ভদ্রমহিলার বাড়ি থেকে ধুনোর গন্ধ আসে। পুরাতন একটা বাড়ি ওটা। লোকে ভুলে যায়, ফ্লোরিডাতে যে সেটলাররা এসে পা রেখেছিল প্লাইমাউথ রকে, তাদের বাচ্চা-কাচ্চাদেরও ততদিনে বেশ বড়ো হয়ে গেছিল। তবে এই বাড়িটা সেই সময়কার না; বানানো হয়েছিল ১৯২০-এর দিকে। ফ্লোরিডার নগর-উন্নয়ন প্রকল্পের একটা অংশ হিসেবে। ওটা আসলে নিদর্শন হিসেবে বানানো হয়েছিল যাতে খদ্দেররা জমি কেনার পর কোন ধরনের বাড়ি বানাতে পারবে তা দেখানো যায়। যদিও ওই জলাভূমিটায় দিন শেষে আর কোনো বাড়িই বানানো হয়নি। অনেকগুলো হারিকেনের ধাক্কা সামলেছে মিসেস ডানউইডির বাড়ি, ছাদ না হারিয়েই।
দরজার ঘণ্টি যখন বাজল, তখন মিসেস ডানউইডি একটা ছোট্ট টার্কি রান্নার জন্য প্রস্তুত করছ। জিভ দিয়ে টুট-টুট শব্দ করে, হাত ধুয়ে ফেলল মহিলা। তারপর করিডর ধরে এগিয়ে চলে এলো সদর দরজার সামনে। পুরু গ্লাসের পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে চাইল বিশ্বটাকে, বাঁ-হাতটা
ওয়ালপেপারের ওপর ঘোরা-ফেরা করছে।
দরজা একটু খুলে ফেলেছে সে।
‘লোয়েলা? আমি এসেছি।’ কেলিঅ্যান হিগলার দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
‘ভেতরে এসো।’ মিসেস ডানউইডির পিছু পিছু রান্নাঘরে চলে এলো মিসেস হিগলার। মিসেস ডানউইডি নিজের হাত ধুয়ে নিলো, তারপর বলল— অন্যজনও যেন হাত ধুয়ে ভুট্টার দানা দিয়ে বানানো রুটির টুকরো টার্কির ভেতর ঢোকাতে সাহায্য করে।
‘কেউ আসবে নাকি?’
এমন আওয়াজ করল মিসেস ডানউইডি, যাতে হ্যাঁ-না কিছুই না বোঝা যায়। ‘প্রস্তুত থাকতে তো আর মানা নেই,’ বলল সে। ‘এবার বলো, কী ব্যাপার?’
‘ন্যান্সির ছেলে। মোটকু চার্লি।’
‘ওর আবার কী হলো?’
‘আসলে, ছেলেটাকে ওর ভাইয়ের কথা বলেছিলাম। গত সপ্তাহে এসেছিল না? তখন।’
টার্কির ভেতর থেকে হাত বের করে আনল মিসেস ডানউইডি। ‘তো? কী হয়েছে তাতে? দুনিয়া তো আর ধ্বংস হয়ে যায়নি।’
‘কীভাবে ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, সেটাও জানিয়েছি।’
‘আহ,’ মাত্র এক শব্দে নিজের অসন্তোষ বুঝিয়ে দিল মিসেস ডান উইডি। ‘তারপর?’
‘হিংল্যান্ডে দেখা দিয়েছে ছেলেটা, তারপর থেকে মোটকু চার্লির মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
ভেজা ভুট্টার রুটি হাতের মুঠোয় নিয়ে টার্কির অনেকটা ভেতর সেঁধিয়ে দিল মিসেস ডানউইডি; বেঁচে থাকলে, ব্যথার চোটে কেঁদেই ফেলত টার্কিটা। ‘এখন তাড়াতে পারছে না?’
‘না।’
পুরু লেন্সের ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মিসেস ডানউইডি বলল, ‘আগে একবার করেছি, দ্বিতীয়বার হবে না। মানে ওভাবে করা যাবে না।’
‘তা আমি জানি। কিন্তু কিছু একটা তো করতেই হবে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিসেস ডানউইডি। ‘লোকে সত্যি কথাই বলে। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে, একসময় না একসময় সব পাখিরই নীড়ে ফেরা দেখা যায়।’
‘আর কোনো উপায় নেই?’
মিসেস ডানউইডি টার্কি প্রস্তুতির কাজ শেষ করল। এর পর একটা স্কিউয়ার তুলে নিয়ে, খোলা চামড়াটা লাগিয়ে দিল দেহের সঙ্গে। তারপর পাখির পুরো দেহটাই ঢেকে দিল রুপোলি ফয়েল দিয়ে।
‘আমার মনে হয়,’ বলল সে। ‘আগামীকাল সকালে রান্নার জন্য তুলে রাখব। বিকেল হতে হতে রান্না শেষ হয়ে যাবে, তারপর যদি হট ওভেনে রাখি তো গরম গরম খাওয়া যাবে ডিনারে।’
‘আসছে কে ডিনারে?’ জানতে চাইল মিসেস হিগলার।
‘তুমি,’ জানাল মিসেস ডানউইডি। ‘আর জোরাহ বাস্টামন্টে, বেলা নোলস…এবং মোটকু চার্লি ন্যান্সি। ছেলেটা এখানে আসতে আসতে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়বে।’
মিসেস হিগলার প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘এখানে আসছে?’
‘সেটাই তো বললাম, শুনতে পাওনি, বাছা?’ মিসেস ডানউইডি বলল। একমাত্র সে-ই মিসেস হিগলারকে বাছা ডেকেও পার পেতে পারে। ‘এখন এসো, টার্কিটাকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।’
.
এ কথা বললে ভুল হবে না যে সে রাতটা ছিল রোজির জীবনের সেরা রাত: জাদুময়, নিখুঁত, অসাধারণ। হাসি এক মুহূর্তের জন্যও ওর মুখ ছেড়ে যায়নি, এমনকী চাইলেও হাসি থামাতে পারত না। খাবারটাও ছিল দারুণ সুস্বাদু, খাওয়া শেষে মোটকু চার্লি ওকে নিয়ে যায় নাচতে। একেবারে সত্যিকারের ডান্স হলে যায় ওরা, ছোট্ট একটা অর্কেস্ট্রা বাজাচ্ছিল ওখানে। মেঝেতে যেন উড়ে বেড়াচ্ছে হালকা রঙের পোশাক পরা মানুষজন। রোজির মনে হচ্ছিল যেন একসঙ্গে সময় ভ্রমণ করে তুলনামূলক নম্র একটা সময়ে এসে পড়েছে! পাঁচ বছর বয়েস থেকে নাচের পাঠ নিচ্ছে রোজি, কিন্তু এতদিন নাচার মতো সঙ্গী মেলেনি।
‘জানতাম না যে তুমি নাচতেও পারো।’ মোটকু চার্লিকে বলল সে।
‘আমার ব্যাপারে এমন অনেক কিছু আছে, যা তোমার জানা নেই।’ বলল সে।
জবাবটা রোজির আনন্দ বাড়িয়ে দিল আরও। অতিসত্বর বিয়ে হতে যাচ্ছে ওর সঙ্গে এই মানুষটার। অথচ তারপরেও ‘জানার আছে অনেক কিছু? অসাধারণ। একটা জীবন তো হাতে থাকছেই সব জানার জন্য।
অন্য নারী, এবং অন্য অনেক পুরুষও, তাকাচ্ছে মোটকু চার্লির দিকে; ছেলেটার পাশে হাঁটতে হাঁটতে সেই নজরগুলো পরিষ্কার ধরা পড়ল রোজির চোখে। ছেলেটার বাহুডোরে থাকা নারীটি ও নিজে, এই কথা ভেবে আনন্দ পেল খুব।
লেইচেস্টার স্কয়ারের ভেতর দিয়ে হাঁটল ওরা। রোজি দেখতে পেল, মাথার ওপরে তারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে; স্ট্রিটলাইটের আলোর হুমকি সামলে।
একটা মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য ভাবল, আগে কেন কখনও মোটকু চার্লির সঙ্গে এমন অনুভূতি হয়নি ওর? মাঝে মাঝে, মনের অনেক গহিনে রোজির মনে হতো—একমাত্র মা মারাত্মক অপছন্দ করে বলেই মোটকু চার্লির সঙ্গে প্রেম করছে সে। বিয়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলার একমাত্র কারণ: মা চাইত ও না বলুক…
একবার ওয়েস্ট এন্ডে গেছিল ও মোটকু চার্লির সঙ্গে, থিয়েটার দেখতে। জন্মদিনের উপহার হিসেবে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল মোটকু চার্লি। কিন্তু টিকেট নিয়ে ঝামেলা হয়ে যায়। পরে আবিষ্কার হয়, আসলে আগের দিনের টিকেট ছিল ওদের কাছে। অবশ্য কর্তৃপক্ষ ছিল আন্তরিক, একটা স্টলের থামের পেছনে মোটকু চার্লির জন্য আসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আর রোজি পেয়েছিল ওপরের সার্কেলের একটা আসন, সামনেই বসেছিল নরউইচ থেকে আসা ও মুরগির মতো খিলখিল করতে থাকা একটা দল। সফল সন্ধ্যা বলা যাবে না কিছুতেই।
কিন্তু আজকের সন্ধ্যাটা…এক কথায় জাদুময়!
জীবনে নিখুঁত মুহূর্ত খুব একটা আসেনি রোজির, কিন্তু তার সংখ্যা যত কমই হোক না কেন…আজ একটা বেড়ে গেল।
ছেলেটার সঙ্গে যখন থাকে, তখন দারুণ একটা অনুভূতি খেলা করে রোজির বুকে।
নাচ শেষ হলে, রাতের রাস্তায় আবার পা ফেলল ওরা। শ্যাম্পেন আর নাচের কারণে মাথাটা হালকা লাগছে। তারপর মোটকু চার্লি—এতটুকু ভাবতেই বদলে গেল চিন্তার গতিপথ। এখনও ছেলেটাকে মোটকু চার্লি নামে ভাবছে কেন? একদম মোটা না তো সে। যাই হোক, সঙ্গী ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এখন তুমি আমার সঙ্গে বাসায় ফিরবে।’
এতটাই গভীর ছিল সেই কণ্ঠ যে কাঁপুনি তুলল রোজির পেটে। পরেরদিন কাজে যাবার কথা বলতে ভুলে গেল। ভুলে গেল বিয়ের পর এসব করার অনেক সময় পাওয়া যাবে—এই কথাটা বলতেও। বলল না কিছুই, শুধু ভাবল: এই রাত যদি কভু না ফুরোত! ভাবল, কতটা তীব্র ভাবে চাইছে—উহু, কতটা তীব্র ভাবে ওর দরকার এই মানুষটার ঠোঁটে চুমু খাওয়া…
…এবং সেই চুমু ফেরত পাওয়া।
আচমকা মনে পড়ে গেল, জবাবে কিছু একটা বলার দরকার। তাই বলল—ঠিক আছে।
ফ্ল্যাটের ফেরার ক্যাবে উঠে, ছেলেটার হাত আঁকড়ে ধরে রইল ওর নিজের হাত; নিজের দেহের ভার চাপিয়ে দিল তার দেহে; পাশ দিয়ে যেতে থাকা গাড়ি আর রাস্তার ল্যাম্পের আলোয় আলোকিত চেহারাটার দিকে রইল তাকিয়ে।
‘কানের লতি ফুটো করা দেখছি,’ বলল রোজি। ‘আগে খেয়াল করিনি কেন?’
‘আরে,’ হাসল ছেলেটা; ওর কণ্ঠ যেন কোনো ঢোলের বাড়ির মতো গমগমে। ‘কথাটা শুনে আমার কেমন লাগল, তা ভেবেছ? এতদিন ধরে প্রেম করছি আমরা, অথচ… আচ্ছা কত দিন হলো?’
‘আঠারো মাস,’ জানাল রোজি।
‘আঠারো মাস ধরে প্রেম করার পরেও…’ বলল ওর বাগদত্ত।
প্রেমিকের গায়ে হেলান দিল মেয়েটা, শ্বাস টেনে বুক ভরে নিলো তার গন্ধ। ‘তোমার গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে,’ বলল মেয়েটা। ‘সুগন্ধি মেখেছ?’
‘নাহ, আমার গায়ের গন্ধই,’ জানাল ছেলেটা।
‘তাহলে তো বোতলে ভরে বিক্রি করা উচিত তোমার!’
সাদর দরজা খুলতে ব্যস্ত ছেলেটা, সেই সময়ে ট্যাক্সির ভাড়া বুঝিয়ে দিল রোজি। তারপর একসঙ্গে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। একদম ওপরে ওঠে দেখা গেল, করিডরের শেষ মাথার দিকে এগোচ্ছে ছেলেটা; যেখানে বাড়তি কামরাটা আছে।
‘আরে, শোবার ঘর তো এখানে, বোকা। তুমি যাচ্ছটা কই?’
‘তা তো আমি জানি,’ জবাব দিল ছেলেটা। তারপর মোটকু চার্লির শোবার ঘরে প্রবেশ করল ওরা একত্রে। পর্দা টেনে দিল মেয়েটা। তারপর শুধু চেয়ে রইল ছেলেটার দিকে, মনটা আনন্দে ভরে উঠেছে।
‘দেরি করছ কেন?’ কিছুক্ষণ পর বলল মেয়েটা। ‘আমাকে চুমু খাবে না?’
‘অবশ্যই খাবো,’ বলল ছেলেটা, করলও। সময় যেন গলে গেল, হলো প্রসারিত…নিলো বাঁকানো পথ। চুম্বনের স্থায়িত্ব এক মুহূর্ত হতে পারে, কিংবা একটা ঘণ্টা…অথবা একটা জীবন। তারপর-
‘কীসের শব্দ?’
জবাব দিল ছেলেটা। ‘কিচ্ছু শুনিনি।’
‘মনে হলো, তীব্র কষ্ট পেয়ে কেউ চেঁচিয়ে উঠেছে।’
‘হয়তো বিড়ালের মারামারি?’
‘মানুষের কণ্ঠই তো মনে হলো।’
‘শহুরে শেয়াল হতে পারে, কণ্ঠ মানুষদের মতোই।’
একপাশে মাথা কাত করে দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা, মন দিয়ে শুনছে। ‘এখন আর পাচ্ছি না,’ বলল সে। ‘উম, অদ্ভুত ব্যাপারটা কী জানো?’
‘উ-হু,’ বলল সে, ঠোঁট ঘষছে রোজির ঘাড়ে। ‘বলো, অদ্ভুত ব্যাপারটা কী? তবে ওটাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। আর বিরক্ত করবে না তোমাকে।’
‘অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো,’ জানাল রোজি। ‘শুনতে তোমার কণ্ঠের মতোই মনে হলো।’
.
রাস্তা ধরে হাঁটছে মোটকু চার্লি, মাথাটা পরিষ্কার করা দরকার। এখন যেটা করা উচিত তা হলো: সদর দরজায় ধাক্কা মেরে স্পাইডারকে নিচে নামতে বাধ্য করা। তারপর ভেতরে ঢুকে ইচ্ছেমতো দুকথা শুনিয়ে দেওয়া স্পাইডার আর রোজিকে।
এটাই যে করা উচিত, তা তো পরিষ্কার বুঝতে পারছে। একেবারে…জলবৎ তরলং।
ফ্ল্যাটে ফিরে সব কথা রোজিকে খুলে বলা উচিত ওর। স্পাইডারকে লজ্জা দিয়ে ভাগাতে হবে। কাজটা তেমন কঠিন কিছু হবার কথা না…
কিন্তু কঠিন যে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। কেন ফ্ল্যাট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমেই, সেটা জানে না ও। এমনকী ফেরার পথও খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। যেসব রাস্তা ও চিনত, কিংবা চিনত বলে ভাবত, সেই রাস্তা যেন ভোল পালটাচ্ছে। কানাগলিতে আবিষ্কার করছে নিজেকে, এসে পড়ছে কাল-ডে- স্যাকে। লন্ডনের রেসিডেনশিয়াল এরিয়ার গলি-ঘুপচিতে মাথা কুটে মরছে।
কখনও কখনও মূল সড়কটা নজরে পড়ছে বটে। ট্রাফিক লাইট জ্বলছে, জ্বলছে বিভিন্ন ফাস্ট ফুডের দোকানের আলোও। জানে, একবার মূল সড়কে পা রাখতে পারলে পথ চিনে নিজের বাড়িতে ফিরতে পারবে। কিন্তু যখনই ওদিকে পা বাড়াচ্ছে, ততবার অন্য কোথাও এসে পড়ছে।
পায়ে ব্যথা শুরু হয়েছে মোটকু চার্লির। পেট গুড়গুড় করছে, মাথা আচ্ছন্ন হয়ে আছে রাগে। যতই হাঁটছে, ততই বাড়ছে সে রাগ।
তবে রাগের কারণে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে জাল, তা উবে যেতে ধরেছে। রাস্তার যে জালিকা ধরে হাঁটছে, সেটাও ক্রমে সরল হয়ে আসছে। একটা বাঁক ঘুরতেই নিজেকে আবিষ্কার করল মূল সড়কে। পাশেই ‘নিউ জার্সি ফ্রাইড চিকেন’ আউটলেট, সারা রাত খোলা থাকে। বড়োসড়ো একটা বাকেট অর্ডার দিল সে, ফ্যামিলি প্যাক আরকী। তারপর, পরিবারের কারও সাহায্য ছাড়াই, পুরোটা খতম করে ফেলল। খাওয়া শেষে এসে দাঁড়াল ফুটপাতে। কমলা রঙের ‘খালি’ লেখা পরিচিত আলোটা নজরে পড়লে হাত নেড়ে ডাকল বড়ো, কালো ক্যাবটাকে। ওর পাশে এসে গাড়িটা থামিয়ে, জানালা নামাল ক্যাবি।
‘কই যাবে?’
‘ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনস,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘গাঁজা ফুঁকেছ নাকি?’ জিজ্ঞেস করল ক্যাব ড্রাইভার। ‘রাস্তার মোড়েই তো জায়গাটা।’
‘নিয়ে যাবে কি না বলো? পাঁচ পাউন্ড বেশি পাবে, সত্যি বলছি।’
দাঁতে দাঁত চেপে শব্দ করে শ্বাস নিলো ক্যাবি। আওয়াজটা শুনে মনে হলো যেন কোনো গাড়ির মেকানিক জিজ্ঞেস করছে—প্রায় নষ্ট ইঞ্জিনটাকে মালিক স্মৃতিবিজটির কোনো কারণে কারণে ভালোবাসে কি না। ‘তোমার পয়সা, যেমনে খুশি খরচ করো,’ জবাব দিল ক্যাবি। ‘উঠে পড়!’
তাই করল মোটকু চার্লি। ক্যাবি ইঞ্জিন চালু করে দিল, অপেক্ষা করল আলো বদলাবার। তারপর মোড় ঘুরেই জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যেন যেতে চাচ্ছিলে?’
‘ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনস,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘৩৪ নম্বর বাড়ি। মদের দোকানটা পেরিয়েই।’
গতকালের পোশাকটাই পরে আছে, বদলাতে পারলে খুশিই হতো। মা সবসময় বলত: পরিষ্কার অন্তর্বাস পরে থাকতে, পাছে যদি গাড়ির ধাক্কা খেয়ে মারা যায়? আর দাঁত ব্রাশ করতে, কারণ ওর লাশ শনাক্ত করার জন্য ডেন্টাল রেকর্ডের দরকার হতে পারে।
‘চিনি আমি,’ জানাল ক্যাবি। ‘পার্ক ক্রিসেন্টে ঢোকার ঠিক আগে আগে।’
‘ঠিক বলেছ,’ জানাল মোটকু চার্লি, হেলান দিল পেছনের সিটে।
‘হয়তো ভুল পথে ঢুকে পড়েছি,’ বলল ক্যাবি, বিরক্ত শোনাল ওকে। ‘মিটারটা বন্ধ করে দিলাম, ঠিক আছে? পাঁচ পাউন্ড দিলেই হবে।’
‘ঠিক আছে,’ বলল মোটকু চার্লি। আরাম করে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ল ও। সারা রাত ট্যাক্সি চালাল ক্যাবি, ঠিক সামনের ঠিকানায় পৌঁছুবার জন্য।
.
ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডে ফ্রড স্কোয়াডে আছে এখন, বারো মাসের জন্য। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পৌঁছল গ্রাহাম কোটস এজেন্সির অফিসে। তার জন্য রিসেপশনে অপেক্ষা করছিল গ্রাহাম কোটস, অফিসে ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো লোকটা।
‘কফি বা চা কিছু নেবেন?’
‘না, ধন্যবাদ। আমি ঠিক আছি।’ একটা নোটবুক বের করে, আগ্রহের সঙ্গে তাকাল লোকটার দিকে।
‘আপনার এই অনুসন্ধানের গোপনীয়তা কতটা জরুরি, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। স্বচ্ছতা আর সততার জন্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সি বিখ্যাত। আমাদের এখানে, মক্কেলের টাকা-পয়সাকে মহাপবিত্র বস্তু বলে ধরে নেওয়া হয়। আরেকটা কথা জানাই আপনাকে, প্রথমে যখন মনের ভেতর চার্লস ন্যান্সির ওপর সন্দেহ দানা বাঁধছিল, তখন নিজেকেই বিশ্বাস করতে চাইনি। ভেবেছি, এমন ভালো একজন মানুষ আর কঠোর পরিশ্রমীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলাটা উচিত হচ্ছে না। এক হপ্তা আগে যদি কেউ আমাকে চার্লস ন্যান্সির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করত তাহলে বলতাম–একেবারে মাটির মানুষ সে।’
‘বুঝলাম। তা কখন থেকে সন্দেহ হলো যে মক্কেলের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা অন্য কোথাও যাচ্ছে?’
‘আসলে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। আন্দাজে কথা বলতে চাচ্ছি না। এমনিতেও অহেতুক কারও দিকে সন্দেহের তির ছুঁড়তে চাই না। কেননা জানেনই তো—ইট ছুড়লে, পাটকেল খেতে হয়।’
টেলিভিশনের পুলিসরা বলে, ভাবল ডেইজি। দরকারি তথ্যগুলোই শুধু জানাও। একই কথা বলার ইচ্ছা ওরও হচ্ছে, কিন্তু বলল না।
এই লোকটাকে ওর আসলে পছন্দ হচ্ছে না।
‘যেসব লেনদেন নিয়ে আমার সন্দেহ হয়েছে, সেগুলো প্রিন্ট করে এনেছি,’ জানাল লোকটা। ‘দেখতেই পাচ্ছেন, সবগুলো করা হয়েছে ন্যান্সির কম্পিউটার থেকে। আরও একবার জোর দিয়ে বলতে চাই: আমাদের গোপনীয়তা পরম কাম্য। গ্রাহাম কোটস এজেন্সির মক্কেলদের তালিকায় অনেক বিখ্যাত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি আছেন। আপনার সুপিরিয়রকেও বলেছি, যতটা সম্ভব গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। যদি কোনো ভাবে মাস্টার ন্যান্সিকে চাপ দিয়ে তার কাছ থেকে সব টাকা-পয়সা ফেরত নেওয়া যায়, তাহলেই আমি খুশি। এর চাইতে বেশি কিছু চাই না। কেস-টেসের ঝামেলায় জড়াবার ইচ্ছে আমার নেই।’
‘আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করব। তবে দিনশেষে আমরা শুধু তথ্য সংগ্ৰহ করি, সেসব তুলে দিই ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের হাতে।’ একবার ভাবল, আসলে চিফের ওপর এই লোকটার প্রভাব আসলে কতটুকু? ‘সন্দেহ জন্মাল কেন?’
‘আহ, একেবারে সরাসরি বলতে বললে বলব— লোকটার আচরণগত গড়মিলের কারণে। কুকুরটা ডাকেনি বলে, কিংবা পার্সলি মাখনে ডুবে গেছে বলে…আমরা, গোয়েন্দারা খুব ছোটো ছোটো জিনিসও দেখতে পাই, তাই না? নাকি ভুল বললাম, ডিটেকটিভ ডে?’
‘আসলে ওটা ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডে হবে। যাক, দয়া করে আমাকে প্রিন্টআউটগুলো দিন,’ জানাল ডেইজি। ‘সেই সঙ্গে দরকারি অন্যান্য কাগজ আর ব্যাঙ্ক রেকর্ডও। হয়তো তার কম্পিউটারটাও জব্দ করতে হতে পারে, হার্ড ডিস্ক খুঁজে দেখতে হবে।
‘অবশ্যই।’ জানাল লোকটা। বেজে উঠল ডেস্কের ফোন। ‘একটু ক্ষমা করবেন,’ কানে লাগাল রিসিভার। ‘তাই নাকি? হায় ঈশ্বর। আমার জন্য রিসেপশনে অপেক্ষা করতে বলো। এক মুহূর্ত পরেই আসছি।’ ফোন রেখে দিল সে। ‘পুলিসি সার্কেলে একে বলে,’ ডেইজিকে জানাল সে। ‘বমাল ধরা পড়া।’
ভ্রু কুঁচকে গেল ডেইজির।
‘একটু আগে যাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেই চার্লস ন্যান্সি খোদ এসে উপস্থিত। আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ভেতরে আসতে বলব? চাইলে আমার অফিসটাকে আপনি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারেন। চাইলে একটা টেপ রেকর্ডারও ধার করতে পারেন, আছে আমার কাছে।’
ডেইজি বলল, ‘তার দরকার হবে না। আগে দরকার এই কাগজগুলো ঘাঁটা।’
‘ঠিক আছে,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘কী বোকা আমি। মানে, আপনি কী… দেখা করবেন তার সঙ্গে?’
‘তাতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।’ জানাল ডেইজি।
‘ওহ, তাকে নিয়ে যে অনুসন্ধান চলছে তা জানাব না,’ আশ্বস্ত করল গ্রাহাম কোটস। ‘নইলে দেখা যাবে, লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। সত্যি বলতে কী, আমি বর্তমান সময়ের পুলিসের কষ্টটা ভালো ভাবেই বুঝি। তাদের প্রতি সহানুভূতিও আছে।’
ডেইজির কেন যেন মনে হলো, এই লোকের কাছ থেকে যে টাকা চুরি করে সে খুব একটা খারাপ হতে পারে না। অবশ্য এটাও জানে সেই সঙ্গে, একজন পুলিস অফিসারের এভাবে চিন্তা করা উচিত না।
‘বাইরে দিয়ে আসি,’ তাকে বলল গ্রাহাম কোটস।
ওয়েটিং রুমে বসে আছে একটা লোক। দেখে মনে হচ্ছে, এই পোশাক পরেই ঘুমিয়েছিল রাতে। দাড়ি কামায়নি, খানিকটা বিভ্রান্তও দেখাচ্ছে। ডেইজিকে হালকা খোঁচা দিয়ে গ্রাহাম কোটস দেখিয়ে দিল লোকটাকে। ‘চার্লস, হায় ঈশ্বর, এ কী অবস্থা তোমার। ভয়াবহ দেখাচ্ছে তোমাকে!’
ঝাপসা দৃষ্টিতে মোটকু চার্লি চেয়ে রইল তার দিকে। ‘গত রাতে বাড়ি ফিরিনি।’ জানাল সে। ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার ভুল করে ফেলেছে।’
‘চার্লস,’ বলল গ্রাহাম কোটস, ‘ইনি ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডে, মেট্রোপলিটান পুলিসের। কিছু রুটিন কাজে এসেছেন।’
মোটকু চার্লি বুঝতে পারলে, এখানে কোথাও কিন্তু আছে। নিজেকে সামলে নিলো সে, দেখতে পেল কিছু ভদ্রস্থ পোশাক, যেটাকে ইউনিফর্মও বলা চলে। তারপর নজর পড়ল চেহারায়। ‘উম,’ বলল সে।
‘শুভ সকাল,’ বলল ডেইজি, অন্তত মুখে। তবে মাথার মধ্যে শুধু বলেই যাচ্ছে- ধ্যাত, ধ্যাত, ধ্যাত, ধ্যাত।
‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম,’ বলল মোটকু চার্লি। হতভম্ব হয়ে এমন একটা কাজ করে বসল যা আগে কখনও করেনি: সাদা পোশাকের পুলিস অফিসারকে কল্পনা করতে লাগল পোশাক ছাড়াই! আবিষ্কার করল, কল্পনা হতাশ করেনি ওকে। পিতার মৃত্যুর শোক পালনের সেই রাতের ঠিক পরের দিনেই যে যুবতীকে ঘুম থেকে উঠে পাশে আবিষ্কার করেছিল, তাকেই যেন দেখতে পাচ্ছে। ভদ্রস্থ পোশাকে অবশ্য তাকে খানিকটা বয়স্ক, আরও অনেক গম্ভীর ও ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
তবে মেয়েটা যে সে-ই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই!
অন্য সব বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন প্রাণির মতোই, মোটকু চার্লিরও অদ্ভুত ব্যাপার হজম করার একটা সীমা আছে। কয়েকদিন হলো সেই অদ্ভুত ব্যাপার- স্যাপার এত বেশি হচ্ছে যে সহ্যের কাঁটা ঘোরাফেরা করছে লাল ঘরের আশপাশে। এখন সেই বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে গেল। এই মুহূর্তটার পর থেকে, ভাবল সে, আর কিছুই আমাকে কখনও অবাক করবে না। মাথার তার ছেঁড়ার আর কোনো হুমকি বা সম্ভাবনা নেই। অনেক হয়েছে।
কিন্তু ধারণাটা যে পুরোপুরি ভুল ছিল, তা তো বলাই বাহুল্য।
ডেইজিকে চলে যেতে দেখল মোটকু চার্লি, তারপর গ্রাহাম কোর্টসের পিছু পিছু প্রবেশ করল তার অফিসে।
শক্ত করে দরজা বন্ধ করে দিল গ্রাহাম কোটস, তারপর নিতম্বটা রাখল ডেস্কের ওপর। রাতের বেলা নিজেকে মুরগির খোঁয়াড়ে আবিষ্কার করলে নেউলে যেভাবে হাসত, হাসল ঠিক সেভাবেই।
‘সরাসরি কাজের কথায় আসা যাক,’ বলল সে। ‘হাতের তাস দুজনেই দেখাই। ঠারেঠোরে কথা বলে লাভ নেই। এসো আমরা,’ ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাইল লোকটা। ‘দিনকে দিন আর রাতকে রাতই বলি।’
‘ঠিক আছে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘তাই করা যাক। আপনি কীসব কাগজ সই করার কথা বলছিলেন?’
‘এখন আর তার দরকার নেই, মন থেকে সেই চিন্তা বের করে দাও। কয়েকদিন আগে আমাকে যে ব্যাপারটা জানিয়েছিলে, সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। বলেছিলে, এমন কিছু লেনদেন দেখতে পেয়েছ যা তোমাকে সন্দিহান করে তুলেছে।’
‘বলেছিলাম নাকি?’
‘এক মাঘে, চার্লস ন্যান্সি, শীত যায় না। যাই হোক, প্রথমেই ভেবেছিলাম যে অনুসন্ধান করব। সেজন্যই আজ সকালে ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডে-এর আগমন হলো অফিসে। যা আমি আবিষ্কার করেছি, তা শুনে যে চমকে যাবে না সেটা তো জানিই।’
‘যাবো না?’
একদম না। আসলেও আমাদের এখানে নয়-ছয় হচ্ছে, চার্লস। তবে আফসোসের কথা, সন্দেহের তির কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে বিঁধছে কেবলই একটা লক্ষ্যে; যা নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দে নেই।’
‘সন্দেহ নেই?’
‘একদম না।’
মোটকু চার্লি দিশেহারা বোধ করছে। ‘কী সেই লক্ষ্য?’
চোখ-মুখে দুশ্চিন্তা ফুটিয়ে তুলতে চাইল গ্রাহাম কোটস, অন্তত সেই চেষ্টাটা করল। কিন্তু ফলাফল হলো ঢেকুর তোলার প্রয়োজন হলে বাচ্চাদের যেমন চেহারা হয় তেমন। ‘কী না, কে। চার্লস, পুলিস তোমাকেই সন্দেহ করছে।’
‘তা তো করবেই,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আজকের দিনটাই যে এমন!’
তারপর ফিরে গেল সে বাড়িতে।
.
সদর দরজা খুলল স্পাইডারই। বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেছে, ভেজা মোটকু চার্লি দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
‘এখন,’ বলল সে। ‘নিজের বাড়িতেই আমি অনাকাঙ্ক্ষিত, তাই না?’
‘তোমার বাড়িতে তুমি আসবে, আমি বাধা দেওয়ার কে?’ বলল স্পাইডার। ‘সারা রাত কই ছিলে?’
‘সেই প্রশ্নের জবাব তোমার ভালোভাবেই জানা আছে। বাড়িতে আসতে পারছিলাম না। জানি না, আমার ওপর কী জাদু চালিয়েছিলে!’
‘জাদু বোলো না,’ আহত শোনাল স্পাইডারের কণ্ঠ। ‘বলো অলৌকিক কাণ্ড।’
ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে, সিঁড়ি ভেঙে ওপরে চলে এলো মোটকু চার্লি। বাথরুমে ঢুকে, বাথটাবে প্লাগটা লাগিয়ে চালু করে দিল কল। তারপর হলে উঁকি দিয়ে বলল। ‘নামে কী যায়-আসে? যেটাই হোক না কেন, আমার বাড়িতে তুমি সেটাই করছিলে। এবং কাল রাতে যেন বাড়ি ফিরতে না পারি, সেই ব্যবস্থা করেছ।’
দুই দিনের বাসি পোশাক ছাড়ল ছেলেটা, তারপর আবার উঁকি দিল দরজার ওপাশে। ‘পুলিস এখন আমার পেছনে লেগেছে, অফিসের ঝামেলার জন্য। গ্রাহাম কোটসকে লেনদেন সংক্রান্ত জটিলতার কথা কিছু বলেছ?’
‘অবশ্যই বলেছি,’ জানাল স্পাইডার।
‘হাহ! এখন আমাকেই সন্দেহ করছেন তিনি।’
‘আমার তা মনে হয় না,’ জানাল স্পাইডার।
‘তোমার মনে হওয়ার…’ নিজেকে সামলে নিলো মোটকু চার্লি। ‘নিজে কথা বলেছি তার সঙ্গে, পুলিসও জড়িয়ে পড়েছে। তার ওপর রোজির ব্যাপারটাও আছে। মেয়েটার ব্যাপারে লম্বা আলোচনা আছে তোমার সঙ্গে; গোসল থেকে বেরিয়েই শুরু করব। তবে সবার আগে বাথটাবে যেতে হবে আমাকে। গতরাত ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেরিয়েছি, ঘুমিয়েছি একটা ট্যাক্সির পেছনের সিটে বসে। ঘুম থেকে উঠে দেখি, ভোর পাঁচটা বাজে! এদিকে আমার ক্যাবি বিড়বিড় করে নিজেকেই কিছু বলছে আর ঘুরছে ট্রাভিস বিকেল রাস্তায়। ওকে বললাম, ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনস খোঁজা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো হবে ওর জন্য; আজকের রাত ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনস খুঁজে পাওয়ার রাত না। একমত হয়ে গেল ও, তাই আমরা নাস্তা করতে গেলাম এমন এক জায়গায় যেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভাররা নাস্তা করে। ডিম, সবজি, সসেজ, টোস্ট আর চা…শেষেরটা এত ঘন যে ওতে চামচ ডুবানোও কঠিন। অন্য ট্যাক্সি ড্রাইভারদেরকে আমারটা জানাল, সারা রাত খুঁজেও ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনসের দেখা পায়নি…তখন তো মনে হচ্ছিল হাতাহাতি শুরু হয়ে যাবে। তবে হয়নি। অবশ্য খুব কাছাকাছি চলে গেছিল পরিস্থিতি।’
একটু থেমে শ্বাস টানল মোটকু চার্লি। স্পাইডারকে অপরাধী মনে হচ্ছে।
‘পরে,’ কথা বলতে পারে ওর ভাই, ভেবে থামিয়ে দিল মোটকু চার্লি। ‘আমি আগে গোসলটা সেরে নিই,’ বলে বন্ধ করে দিল বাথরুমের দরজা।
তারপর উঠে বসল বাথটাবে।
কুই কুই আওয়াজ করে পরক্ষণেই আবার নেমে এলো।
কল বন্ধ করে একটা তোলায়ে পেঁচিয়ে নিলো দেহে, তারপর দরজা খুলে হাঁক ছাড়ল। ‘গরম পানি নেই,’ শান্ত স্বরে বলল সে, একটু বেশিই শান্ত স্বরে। ‘কেন নেই, তা জানতে পারি?’
স্পাইডার তখনও হলওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে, নড়েনি এক বিন্দুও। সব আমার হট টাবে,’ জবাব দিল সে। ‘দুঃখিত।’
বলল মোটকু চার্লি। ‘যাক, অন্তত রোজি তো আর…মানে সে নিশ্চয়ই…’ স্পাইডারের চেহারা দেখে থেমে গেল সে। ‘এখুনি বেরিয়ে যাও এখান থেকে আমার জীবন থেকে… রোজির জীবন থেকে!’
‘কিন্তু আমার তো জায়গাটা পছন্দ হয়েছে,’ জানাল স্পাইডার।
‘তুমি আমার জীবন ধ্বংস করছ!’
‘মন্দ কপাল তোমার,’ হলওয়ের শেষ মাথায় গিয়ে মোটকু চার্লির বাড়তি কামরার দরজা খুলল স্পাইডার। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সোনালি আলো ভাসিয়ে নিয়ে গেল হলওয়েটাকে। তবে মাত্র এক মুহূর্তের জন্য, তারপরই আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
ঠান্ডা পানিতেই চুল ধুলো মোটকু চার্লি। দাঁত ব্রাশ করে লন্ড্রির স্তূপ হাতড়িয়ে বের করে আনল একটা জিনস আর টি-শার্ট। একেবারে নিচে ছিল বলে, এক হিসেবে ধোয়াই বলা চলে। পরে নিলো ওগুলো, সেই সঙ্গে বেগুনি একটা সোয়েটারও চড়াল গায়ে। মায়ের উপহার ছিল ওটা, ঠিক মাঝখানে একটা টেডি বিয়ার বসে আছে। কখনও পরেনি আগে, আবার বিলিয়ে দেওয়াটাও ঠিক হয়ে ওঠেনি।
এরপর করিডরের শেষ মাথার দিকে অগ্রসর হলো সে।
দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে বুম-চাগা-বুম আওয়াজ। হ্যান্ডেল ধরে খানিকক্ষণ ঝাঁকাল মোটকু চার্লি। ‘যদি দরজাটা না খোলো,’ হুমকি দিল ও। ‘তাহলে ভেঙে ফেলব।’
ঝট করে খুলে গেল দরজা, হুমড়ি খেয়ে ভেতরে চলে গেল মোটকু চার্লি। জানালার বাইরে এখন দেখা যাচ্ছে তার পেছনের বাড়িটাকে। বৃষ্টির চোটে বলতে গেলে অবশ্য কিছুই নজরে পড়ছে না।
তারপরেও, মনে হচ্ছে যেন দেওয়ালের ওপাশ থেকেই প্রবল শব্দে বাজছে একটা স্টেরিয়ো: কামরার সবকিছু কাঁপছে বুম-চাগা-বুম শব্দে।
‘আশা করি বুঝতে পারছ,’ মোটকু চার্লি আলোচনা করার ভঙ্গিতে বলল। ‘এর মানে—যুদ্ধ।’ সহ্যের একেবারে শেষ মাত্রায় পৌঁছে গেলে সাধারণত এভাবেই চিৎকার করে খরগোশরা …আর অনেক জায়গায় আনানসিকে মানুষ চালাক খরগোশ হিসেবেই চেনে। তবে ভুল হয়েছে ওদের, আসলে সে ছিল মাকড়শা। হয়তো ভাবছেন, এমন আলাদা দুটো প্রাণির মাঝে কেউ কীভাবে গুলিয়ে ফেলে? কিন্তু গোলায় যে, তা তো বলাই বাহুল্য।
শোবার ঘরে চলে এলো মোটকু চার্লি, বিছানার ঠিক পাশের টেবিলের ড্রয়ারে থাকা পাসপোর্টটা বের করে নিলো। আবিষ্কার করল, ওয়ালেট ফেলে এসেছে বাথরুমে। সেটা নিয়ে পা রাখল মূল সড়কে। বৃষ্টির মাঝে ডাকল একটা ট্যাক্সি।
‘কোথায় যাবে?’
‘হিথরো,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি।
‘কোনো সমস্যা নেই,’ জানাল ক্যাবি। ‘কোন টার্মিনালে?’
‘জানি না,’ বললেও মোটকু চার্লি জানে, জানাটা ওর উচিত ছিল। হাজার হলেও, মাত্র কদিন আগেই তো ব্যবহার করেছিল। ‘ফ্লোরিডা যাওয়ার জন্য কোন টার্মিনালে যেতে হয়?’
.
জন মেজর যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই গ্রাহাম কোটস এজেন্সিকে পেছনে ফেলে পালাবার পরিকল্পনা করেছিল গ্রাহাম কোটস। হাজার হলেও, যা ভালো…তা তো আর চিরকাল টিকে থাকে না। আগে হোক বা পরে— গ্রাহাম কোটস সবাইকে যে কথাটা আনন্দের সঙ্গেই বোঝায়—সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকেও কেটে-কুটে রান্না করা হয়। পরিকল্পনাটা ভালোই ছিল—এক মুহূর্তের নোটিশে কখন পালাতে হবে, তা কেউ বলতে পারে না – তাছাড়া জানাও ছিল না ওর যে ঘটনাবলী আস্তে আস্তে জমে ক্ষীর হচ্ছে; দিগন্তে জড়ো হতে থাকা কালো মেঘের মতো। তারপরেও একেবারে শেষ মুহূর্তের আগে পালাবার কোনো ইচ্ছেই নেই গ্রাহাম কোটসের।
তবে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হলো, অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রাহাম কোটস—শুধু পালাবে না, একেবারে উধাও হয়ে যাবে; কোনো সূত্র না রেখেই মিশে যাবে বাতাসে।
অফিসের লুকোনো সেফের—গোপন যে কামরাটা নিয়ে গর্ব করে সে— একটা বাড়তি তাক নিজ হাতে লাগিয়েছে। কদিন আগে খুলে যাওয়ায় আবার নতুন করে লাগাতে হয়েছে। যাই হোক, সেই তাকে রয়েছে একটা চামড়ার ভ্যানিটি কেস; যার ভেতরে আছে দুটো পাসপোর্ট। একটায় নাম লেখা বাসিল ফিনেগান, অন্যটায় রজার ব্রনস্টেইন। দুজনেই প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে জন্মেছে, ঠিক গ্রাহাম কোটসের মতো। তবে মারা গেছে বয়েস এক হবার আগেই। দুটো পাসপোর্টেই মালিকের জায়গায় আছে গ্রাহাম কোটসের ছবি।
ওই একই কেসে আছে দুটো ওয়ালেট, প্রত্যেকটায় আলাদা আলাদা ক্রেডিট কার্ড আর পাসপোর্টের মালিকের নামানুসারে ফটো আইডি। আবার দুটো নামেই আলাদা আলাদা ফানেল অ্যাকাউন্ট আছে কেইম্যানসে, যেগুলোর সঙ্গে আবার যোগাযোগ আছে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড আর লিখেনস্টাইনের ফানেল অ্যাকাউন্টের।
পঞ্চাশতম জন্মদিনের দিন হাওয়া হয়ে যাবার পরিকল্পনা ছিল গ্রাহাম কোটসের, বছরখানেকের মতো বাকি আছে এখনও। কিন্তু মোটকু চার্লির কারণে খানিকটা ঝামেলায় পড়েছে।
মোটকু চার্লি গ্রেফতার হবে কিংবা জেলে যাবে—সেই আশা করছে না গ্রাহাম কোটস। তবে দুটোর যেকোনো একটা ঘটলেও আপত্তি করবে না। লোকটাকে ভয় পাইয়ে, অপমান করে, তাড়িয়ে দিতে চায় সে।
গ্রাহাম কোটস আক্ষরিক অর্থেই গ্রাহাম কোটস এজেন্সির মক্কেলদের কাছ থেকে টাকা সরাতে পছন্দ করে, কাজটায় সে দারুণ দক্ষও। এই পেশায় আসার পর খুশি হয়েই আবিষ্কার করেছে: সেলিব্রিটি আর শিল্পীরা টাকা-পয়সার ব্যাপারে কিচ্ছু বোঝে না, তাই সাবধানতার সঙ্গে মক্কেল বেছে নিলেই হলো। কেউ তাদের প্রতিনিধি হলে এবং আর্থিক দিকটা সামলে দিলে, তারা চরম খুশি হয়। যদি কখনও চেক সময়মতো না পৌঁছে, কিংবা যে অঙ্কের হবে বলে মক্কেলরা ভেবেছিল তা নাহয়, অথবা অ্যাকাউন্ট থেকে যদি সরাসরি কেউ টাকা তোলে তাহলে…সেজন্যই গ্রাহাম কোর্টসের এজেন্সিতে কর্মী আসে আর যায়। বিশেষ করে হিসাবরক্ষণ বিভাগের কর্মীরা। তাই সহজেই প্রাক্তন কোনো কর্মীর অদক্ষতার ঘাড়ে চাপানো যায় সেটা। খুব বেশি দরকার হলে এক বোতল শ্যাম্পেন আর ক্ষমাপ্রার্থনা করে চেক লিখে দিলেই হলো!
মানুষ যে গ্রাহাম কোটসকে পছন্দ করে, কিংবা ভরসা করে… তা কিন্তু না। এমনকী মক্কেলরাও ভাবে, সে একটা ধূর্ত নেউলে। তবে এটাও ভাবে যে সে তাদের নেউলে…
…ভুলও করে সেখানেই।
গ্রাহাম কোটস ভাবে শুধু নিজেকে নিয়েই।
ডেস্কে থাকা ফোনটা বেজে উঠল আচমকা, কানে ঠেকাল সে রিসিভার। ‘কী?’
‘মিস্টার কোটস? মেইভ লিভিংস্টোন ফোন করেছেন। বলেছিলেন, ওনার কলগুলো যেন মোটকু চার্লিকে দেওয়া হয়। কিন্তু এই সপ্তাহে ছুটি নিয়েছে সে, তাই কী বলব ভদ্রমহিলাকে তা বুঝতে পারছি না। আপনি নেই, এই কথা বলব?’
গ্রাহাম কোটস ভাবল। আচমকা হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবার আগে মরিস লিভিংস্টোন, যিনি একটা খাটো কিন্তু বিখ্যাত একজন ইয়র্কাশায়ারিয়ান কমেডিয়ান, অনেকগুলো টিভি সিরিজের স্টার ছিলেন। নিজের একটা ভ্যারাইটি গেম-শোও পরিচালনা করতেন যার নাম – মরিস লিভিংস্টোন, আই প্রিজিউম; শনিবার রাতে দেখানো হতো। এমনকী আশির দশকে তার একটা গান টপ- টেন চার্টেও এসেছিল: ইট’স নাইস আউট (বাট পুট ইট অ্যাওয়ে)। হাসিখুশি, খোশমেজাজি মানুষটা কেবল গ্রাহাম কোটস এজেন্সির হাতে তার অর্থনৈতিক দিকটা সামলাবার দায়িত্বটাই দেননি, সেই সঙ্গে—অবশ্যই গ্রাহাম কোর্টসের বুদ্ধি অনুসারে—নিজের এস্টেটের ট্রাস্টিও বানিয়েছেন তাকে।
এমন রসালো ফলে কামড় না বসানোটাই হতো বিশাল বড়ো বোকামি।
ঝামেলা হয়ে দাঁড়াল মেইভ লিভিংস্টোন। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, মহিলা বহু বছর গ্রাহাম কোর্টসের একান্ত ব্যক্তিগত কল্পনার জগতে ঝড় তুলেছে!
জবাব দিল লোকটা, ‘নাহ, আমার কাছেই পাঠিয়ে দাও কলটা।’ তারপর খানিকটা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ‘মেইভ, অনেক দিন পর তোমার কণ্ঠ শুনে খুবই ভালো লাগছে। আছ, কেমন?’
‘ঠিক জানি না।’
মরিসের সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন মেইভ লিভিংস্টোন নাচত। ছোটোখাটো মানুষটার পাশে তাকে পাহাড় মনে হতো। একে-অন্যকে অন্তর
থেকে ভালো বাসতেন তারা।
‘সব খুলে বলছ না কেন?’
‘কয়েক দিন আগে চার্লসের সঙ্গে কথা হলো। ভাবছিলাম, আসলে আমি না আমার ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ভাবছিল আরকী, মরিসের এস্টেট থেকে টাকাটা আসেনি। আমাদেরকে বলা হয়েছিল, দুই-একের মাঝে চলে আসবে।’
‘মেইভ,’ শুরু করল গ্রাহাম কোটস, এমন কণ্ঠে যেটাকে ওর নিজের কাছে খুব মোলায়েম মনে হয়। লোকটার বিশ্বাস, এই কণ্ঠে কথা বললে মহিলারা খুব সহজে তাতে সাড়া দেয়। ‘টাকা যে নেই—সেটা কিন্তু বলছি না। সমস্যা হয়েছে ওটার তারল্য নিয়ে। আগেও বলেছি তোমাকে, মরিস জীবনের সায়াহ্নে এসে বেশ কিছু অজায়গায় টাকা লগ্নি করেছিল। আমার পরামর্শ অনুসরণ করে কিছু টাকা ভালো জায়গায় খাটিয়েওছিল অবশ্য। সেগুলোকে আমাদের খানিকটা সময় দিতে হবে, নইলে লাভ তোলা যাবে না। শুধু তাই না, এখন টাকা চাইতে গেলে আমাদের আসলটাই খুইয়ে বসতে হতে পারে। তবে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই, একদম না। ভালো একজন মক্কেল এবং বন্ধুর জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি আছি। নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে তোমাকে চেক লিখে দিচ্ছি। আশা করি তা দিয়ে তুমি ওই টাকা হাতে আসার আগপর্যন্ত আরামেই দিন কাটাতে পারবে। এখন বলো, কত চাচ্ছে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার?’
‘বলছে, আমার দেওয়া চেকগুলো ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হবে অচিরেই, ‘ জানাল মহিলা। ‘এদিকে বিবিসি আমাকে বলেছে, তারা পুরাতন শোগুলোর ডিভিডি থেকে প্রাপ্য টাকা ঠিকই পাঠাচ্ছে। ওগুলো তো আর কোথাও লগ্নি করা হয়নি, তাই না?’
‘বিবিসি এই কথা বলেছে! অথচ আমরা টাকার জন্য হন্য হয়ে তাদের পেছনে ঘুরছি! দোষটা অবশ্য পুরোপুরি বিবিসি ওয়ার্ল্ডওয়াইডের না। আমাদের হিসেবরক্ষক গর্ভবতী, তাই সবকিছু একটু অগোছালো হয়ে আছে। এদিকে চার্লস ন্যান্সি—যার সঙ্গে তোমার কথাও হয়েছে—বিপর্যস্ত; বাবা মারা গেছে বেচারার। আজকাল প্রায়শই দেশের বাইরে থাকে-
‘শেষবার যখন কথা হয়েছিল,’ জানাল মেইভ। ‘তখন নতুন কম্পিউটার সিস্টেম স্থাপন করছ বলেছিলে।’
‘তা তো করছিলামই, ওই প্রসঙ্গ আর তুলোই না দয়া করে। লোকে বলে না? মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কিন্তু সব লেজেগোবরে করতে হলে, কম্পিউটারের বিকল্প নেই। এমন একটা ব্যাপারে আমি নিজে অনুসন্ধান করবো, দরকার পড়লে কঠোর হতেও দ্বিধা করব না। টাকা দ্রুতই পেয়ে যাবে, মরিস বেঁচে থাকলে সেটাই চাইত।’
‘ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলছে, চেক বাউন্স না করাতে চাইলে যত দ্রুত সম্ভব দশ হাজার পাউন্ডের ব্যবস্থা করতে।’
‘দশ হাজার পাউন্ডের ব্যবস্থা এখুনি করছি, আসলে কথা বলতে বলতেই একটা চেক লিখে ফেলেছি তোমার জন্য।’ নোটপ্যাডে বৃত্ত আঁকছে লোকটা, ওপরে একটা দাগসহ। দেখতে অনেকটা আপেলের মতো লাগছে।
‘আমি কৃতজ্ঞ,’ জানাল মেইভ। ‘আশা করি বেশি ঝামেলা করছি না।’
‘তুমি আর ঝামেলা?’ জানাল গ্রাহাম কোটস। ‘কক্ষনো না!’
ফোন রেখে দিল সে। একটা ব্যাপার সবসময়ই মজার মনে হয়েছে ওর কাছে। তা হলো: মরিস যে চরিত্রে অভিনয় করে লোক হাসাত, তা ছিল এক মালদার, একগুঁয়ে ইয়র্কশায়ারিয়ানের, যে কিনা তার প্রতিটি পাইয়ের হিসেব রাখে!
খেলাটা মন্দ ছিল না, ভাবল গ্রাহাম কোটস। আপেলের ছবিতে আঁকল একজোড়া চোখ আর কান। এখন দেখা যাচ্ছে, সিদ্ধান্ত নিলো সে, অনেকটা বিড়ালের মতো। অচিরেই সেলিব্রিটিদের মন জেতার জীবন বাদ দিয়ে, এমন এক জীবন যাপন করতে যাচ্ছে সে যেখানে আছে শুধু সূর্যালোকের উষ্ণতা, সুইমিং পুল, স্বাদু খাবার, সেরা মানের মদ এবং যদি পাওয়া যায়, তাহলে উদ্দাম শারীরিক আনন্দ। জীবনের সেরা উপকরণগুলো, অন্তত গ্রাহাম কোটসের কাছে, সেগুলোই যা টাকা দিয়ে খরিদ করা যায়।
বিড়ালের চেহারায় একটা মুখ এঁকে দিল সে, তারপর তাতে যোগ করল তীক্ষ্ণ দাঁত। এখন দেখতে পাহাড়ি সিংহের মতো লাগছে। আঁকতে আঁকতেই সে গান জুড়ে দিল, কাঁপা কাঁপা স্বরে:
‘যখন ছিলেম কিশোর আমি, তখন বলত বাবা
বাহিরটা কী সুন্দর, খেলতে কখন যাবা?
কিন্তু এখন হয়েছে বয়েস, মেয়েরা দেখে বলে,
বাইরে দেখতে ভালোই লাগছে, আরও লাগত ঢাকলে…’
কোপাকাবানায় গ্রাহাম কোটসের যে পেন্টহাউজটা আছে, সেটা কেনার টাকা এসেছে মরিস লিভিংস্টোনের পকেট থেকেই; সেই সঙ্গে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ দ্বীপে একটা সুইমিংপুল বসাবার প্রয়োজনীয় অর্থও। তাই গ্রাহাম কোটসকে অকৃতজ্ঞ বলা যাবে না কোনোভাবেই!
‘বাইরে দেখতে ভালোই লাগছে, আরও লাগত ঢাকলে…’
.
অদ্ভুত লাগছে স্পাইডারের।
কিছু একটা ঘটছে: অপরিচিত একটা অনুভূতি, ছড়িয়ে পড়ছে কুয়াশা মতো চারিপাশে; ওর দিনটার দফা রফা করে ছাড়ছে। চিনতে পারছে না স্পাইডার…
…আর তাই, ব্যাপারটা ওর পছন্দও হচ্ছে না।
তবে একটা অনুভূতি, যেটা ও জানে যে মনের ভেতর নেই, তা হলো: অপরাধবোধ। এই জিনিসটা আসলে জীবনে কখনওই অনুভব করেনি। ভালো লেগেছে আগে, নিজেকে মনে হয়েছে অসাধারণ। কিন্তু অপরাধ বোধ? কক্ষনো না! এমনকী ব্যাঙ্ক ডাকাতির সময় অস্ত্র হাতে ধরা পড়লেও ওই বোধটা তার হতো না।
কিন্তু আজ, ওর চারপাশটা ঘিরে, যেন জমা হয়েছে অস্বস্তির ভারী মেঘ।
আজকের আগপর্যন্ত স্পাইডারের বিশ্বাস ছিল, দেবতারা অন্যরকম: তাদের বিবেক নেই, বিবেকের দরকারও নেই। পৃথিবীর সঙ্গে দেবতার যে সম্পর্ক—এমনকী সেই পৃথিবী যদি ওর বাসস্থানও হয়—তার তুলনা করা হয় কোনো কম্পিউটার গেমারের সঙ্গে তার গেমের; যে গেমের আগা-পাশ-তলা সম্পর্কে গেমারের ধারণা তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে সবকটা চিটকোডও!
নিজেকে আনন্দে ডুবিয়ে রাখে স্পাইডার, এটাই ওর একমাত্র কাজ। একমাত্র এই কাজটাই গুরুত্বপূর্ণ। একদম হাতে-কলমে শেখানোর গাইডসহ অপরাধ-বোধ এসে ওর হাতে ধরা দিলেও, তাকে চিনতে পারত বলে মনে হয় না। ঠিক অপরাধ-বোধহীন বলা যায় না ওকে, আসলে বলতে হবে: যেদিন ওই অনুভূতির বণ্টন হচ্ছিল, সেদিন স্পাইডার ব্যস্ত ছিল অন্য কোনো কাজে।
কিন্তু কিছু একটা বদলে গেছে—ভেতরে না বাইরে তা জানে না যদিও- এবং ব্যাপারটা ওর ভালো লাগছে না। নিজের জন্য আরেক পাত্র ড্রিঙ্ক ঢালল সে, হাত নেড়ে বাড়িয়ে দিল গানের আওয়াজ। জানা তারপর মাইলস ডেভিসকে থামিয়ে চালু করল জেমস ব্রাউন। তাতেও কোনো লাভ হলো না।
হ্যামোকে শুয়ে আছে সে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সূর্যের আলো মাখছে দেহে আর শুনছে গান। ভাবছে, স্পাইডার হতে পারাটা কতটা সৌভাগ্যের…কিন্তু এই প্রথম বারের মতো মনে হচ্ছে, শুধু স্পাইডার হওয়াটাই যথেষ্ট না… আরও কিছু চাই।
হ্যামোক থেকে নেমে দরজার দিকে এগোল সে। ‘মোটকু চার্লি?’
জবাব পেল না কোনো। ফ্ল্যাটটা খালি মনে হচ্ছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের দৃশ্য, ধূসর একটা দিন…সেই সঙ্গে বৃষ্টি। স্পাইডারের বৃষ্টি খুবই পছন্দ। কেন যেন মনে হয়, সব খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে।
আচমকা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল টেলিফোন। রিসিভার তুলল স্পাইডার।
বলল রোজি, ‘তুমি নাকি?’
‘হ্যালো, রোজি।’
‘গত রাতে,’ বলল মেয়েটা, তারপর চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর ছুড়ে দিল প্রশ্ন, ‘আমার যেমন দারুণ লেগেছে, তোমারও কি তেমনই লেগেছে?’
‘তা তো নিশ্চিত করে বলতে পারব না,’ জানাল স্পাইডার। ‘আমার বেশ লেগেছে। তাই, সম্ভবত হ্যাঁ।’
‘হুম,’ বলল রোজি।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে রইল উভয়েই।
‘চার্লি?’ আবার শুরু করল মেয়েটা।
‘হ্যাঁ?’
‘কিছু না বলে চুপ করে থাকতেও ভালো লাগছে। কেননা জানি, ওপাশে তুমি আছ।’
‘আমারও,’ জানাল স্পাইডার।
আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে কথা না বলে সান্নিধ্য উপভোগ করল ওরা।
‘আজ রাতে আমার এখানে আসতে চাও?’ জিজ্ঞেস করল রোজি। ‘আমার ফ্ল্যাটমেটরা ক্লেয়ার্নগর্মসে থাকছে রাতে।’
‘এই বাক্যটা,’ জানাল স্পাইডার, ‘ইংরেজি ভাষার সবচাইতে সুন্দর বাক্য হবার দাবিদার। আমার ফ্ল্যাটমেটরা ক্লেয়ার্নগর্মসে থাকছে রাতে—নিখাদ বাক্য বই আর কিছু না!’
খিলখিলিয়ে হাসল মেয়েটা। ‘ঠিক ঠিক। উম। টুথব্রাশ নিয়ে এসো…’
‘ওহ…ওহ! ঠিক আছে।’
এরপর কয়েক মিনিট চলল ‘তুমি রাখো’
‘না, তুমি রাখো’-এর খেলা; যদিও তা হরমোনের প্রাবল্যে মত্ত, পনেরো বছর বয়সী বাচ্চাদেরই বেশি মানায়। যাই হোক, অবশেষে দুই পক্ষই রেখে দিল ফোন।
সন্তের ভঙ্গিমায় হাসল স্পাইডার। এই পৃথিবীটা, যদি রোজি তাতে থাকে তো, সর্বশ্রেষ্ঠ পৃথিবী হিসেবে স্বীকৃতি পাবার যোগ্য। জেঁকে বসতে থাকা কুয়াশা উবে গেল, আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল জীবন।
মোটকু চার্লি কোথায় গেছে, সেটা ভাবল না পর্যন্ত স্পাইডার। এসব ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে ভাববার সময় কোথায় ওর? রোজির ফ্ল্যাটমেটরা ক্লেয়ার্নগর্মসে থাকছে রাতে…
…এবং আজ রাতে ওকে টুথব্রাশ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে!
.
মোটকু চার্লির দেহটা ফ্লোরিডাগামী বিমানে বসা; পাঁচ জন যাত্রী বসেছে এক সারিতে, ওর আসনটা তাদের ঠিক মাঝখানে। তবে ঘুমুচ্ছে দেহটা। ভালোই হয়েছে তাতে, কেননা বিমান বাতাসে ভাসার সঙ্গে সঙ্গে গণ্ডগোল পাকিয়েছে পেছন দিকে থাকা টয়লেটগুলো। কেবিনের অ্যাটেনডেন্টরা দরজায় ‘আপাতত নষ্ট’ লেখা সাইন ঝুলিয়েছে। কিন্তু তাতে কি আর গন্ধ বাধা মানে? কেমিক্যাল কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছে তা বাথরুম থেকে। বাচ্চারা কাঁদছে, বড়োরা ঘোঁত ঘোঁত করছে আর শিশুরা করছে ঘ্যান ঘ্যান। যাত্রীদের একটা দল, ডিজনি ওয়ার্ল্ডে যাচ্ছে তারা, সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বিমানে উঠেছে মানেই: ছুটি শুরু। তাই ক্রমাগত গান গেয়ে চলছে! প্রথমে গাইল ‘বিবিডি-বাবিডি-বু’ তারপর ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল থিং অ্যাবাউট টিগারস’, ‘আন্ডার দ্য সি’, ‘হাই হো, হেই হো, ইটস অফ টু ওয়ার্ক উই গো’…এবং সব শেষে ডিজনির লেখা গান ভেবে ‘উই আর অফ টু সি দ্য উইজার্ড’!
বিমান বাতাসে ভাসার পর আরও জানা গেল, কেটারিঙের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গের ভুলের কারণে, কোচ-ক্লাসের যাত্রীদের জন্য দুপুরের খাবার তোলা হয়নি। আছে শুধু নাস্তা, তারমানে প্রত্যেক যাত্রীকেই আলাদা আলাদা ভাবে সিরিয়ালের প্যাকেট আর কলা দেওয়া হবে। সেগুলো আবার খেতে হবে তাদের প্লাস্টিকে চাকু ও কাঁটাচামচ দিয়ে; কারণ চামচ তোলা হয়নি। অবশ্য সেটাও মন্দের ভালো বলেই প্রমাণিত হলো, যখন অচিরেই জানা গেল যে সিরিয়াল ভেজাবার জন্য দুধও নেই।
নরকে যাবার বিমানে উঠেছি, ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো মোটকু চার্লি: ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেবে পুরোটা সময়।
.
স্বপ্নে মোটকু চার্লি নিজেকে আবিষ্কার করল পেল্লাই একটা হলে, পরে আছে মর্নিং স্যুট। পাশে দাঁড়িয়ে আছে রোজি, মেয়েটার পরনে বিয়ের সাদা পোশাক। তার অন্য পাশে, মঞ্চের ওপরেই, আছে রোজির মা; ভদ্রমহিলা নিজেও, দেখে নাড়া খেল মোটকু চার্লি, পরে আছে বিয়ের পোশাক; যদিও তার পোশাকটা ধুলো আর মাকড়শার জালে ভরতি। অনেকটা দূরে, দিগন্ত রেখার কাছে- যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে হলটা গুলি ছোড়ায় আর সাদা পতাকা নাড়ায় ব্যস্ত মানুষের দল।
জ-টেবিল লোকজন, জানাল রোজির মা। ওদের পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই।
রোজির দিকে ফিরল মোটকু চার্লি, মেয়েটা হাসল একটা নরম ও মিষ্টি হাসি। তারপর ঠোঁট চেটে নিলো এক দফা!
কেক, স্বপ্নের রোজি বলল।
যেন এই সিগন্যালের অপেক্ষায় ছিল অর্কেস্ট্রা, বাজাতে শুরু করল এখন। নিউ অর্লিয়ন্স ধাঁচের জ্যাজ ব্যান্ড একটা, বাজাচ্ছে শোকসঙ্গীত।
শেফের সহকারী হলো একজন পুলিস অফিসার। হাতকড়া উঁচু করে ধরে আছে মেয়েটা। এদিকে কেকটাকে একটা ট্রলির ওপর রেখে, টেনে মঞ্চের কাছে নিয়ে এলো শেফ।
এবার, স্বপ্ন-রোজি বলল স্বপ্ন-মোটকু-চার্লিকে। কেকটা কাটো।
খ-টেবিলের লোকজন—আসলে লোক না বলে মানব-আকৃতির ইঁদুর আর গোলাঘরের পশু বলাই ভালো যাদের—আনন্দ করতে লাগল ডিজনি কার্টুনের গানগুলো গেয়ে। সে-ও যে ওদের সঙ্গে যোগ দিক, এটাই চাচ্ছে এই পশুর দঙ্গল—জানে মোটকু চার্লি। ঘুমন্ত অবস্থাতেও মানুষের সামনে গান গাইবার চিন্তায় কাঁপছে ওর হাত-পা, শুকিয়ে আসছে ঠোঁট।
তোমাদের সঙ্গে গাইতে পারব না, তাদের জানিয়ে দিল সে। প্রাণপণে খুঁজছে অজুহাত, পেয়েও গেল। আমাকে কেক কাটতে হবে।
কথাটা শোনামাত্র পুরো হলে নেমে এলো নীরবতা। সেই নীরবতার মাঝেই ভেতরে প্রবেশ করল এক শেফ, একটা ছোট্ট ট্রলি এনেছে সঙ্গে; তার ওপর রেখেছে কিছু একটা। শেফের চেহারাটা গ্রাহাম কোটসের মতো, ট্রলিতে দেখা যাচ্ছে মারাত্মক সাদা একটা বিয়ের কেক; অলঙ্কার-সমৃদ্ধ, কয়েক স্তরের একটা বস্তু। একদম ওপরের স্তরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটা বর আর ছোট্ট একটা কনে। ওদের দেখে মনে হচ্ছে, চিনি আর ফ্রস্টিং দিয়ে বানানো ক্রাইসলার দালানের ওপরে দাঁড়িয়ে দুইজন মানুষ চেষ্টা করছে তাদের ভারসাম্য বজায় রাখার।
টেবিলের নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা বড়ো, কাঠের হাতলের ছুরি বের করে আনল রোজির মা-আকারে প্রায় ম্যাচেটির সমান হবে—যার ধারাল প্রান্তে জং পড়ে গেছে। রোজিকে সেটা এগিয়ে দিল মহিলা; মেয়েটা মোটকু চার্লির ডান হাত টেনে ধরে নিজের হাতের ওপর স্থাপন করল। একসঙ্গে জং ধড়া ছুরিটা ওরা সেঁধিয়ে দিল কেকের একেবারে ওপরের স্তরের পুরু, সাদা আইসিঙে; বর-কনের ঠিক মাঝখানে। প্রথমে খানিকক্ষণ ছুরিটাকে বাধা দিল বটে কেকটা, কিন্তু মোটকু চার্লি নিজের প্রায় পুরো ওজন ছুরির ওপর চাপিয়ে দিলে হাল ছেড়ে দিতে লাগল। ব্যাপারটা টের পেয়ে জোর বাড়াল মোটকু চার্লি।
বিয়ের কেকের একেবারে ওপরের স্তর কেটে ফেলল ছুরি, তারপর নেমে যেতে লাগল নিচে। প্রত্যেকটা স্তর কেটে ফেলল সে, খুলে গেল কেকটা…
স্বপ্নে দৃশ্যটা দেখে মোটকু চার্লি ধরে নিলো: কেকের ভেতরটা কালো পুঁতিতে ভরা। হতে পারে ওগুলো কাচের, কিংবা পালিস করে জেটের[১৮] পুঁতি। কিন্তু যখন ওগুলো কেক থেকে বাইরে বেরোল তখন বুঝতে পারল: প্রত্যেকটার পা আছে, একটা না… আট-আটটা। কালো স্রোতের মতো বেরিয়ে আসছে পুঁতিগুলো!
[১৮. কালো খনিজ পদার্থ।]
কালো মাকড়শার দল বেরিয়ে এসে সাদা টেবিলক্লথকে দখল করে নিলো পুরোপুরি। তারপর রোজির মা আর খোদ রোজিকে ঢেকে ফেলে সাদা পোশাকগুলোকে পুরোপুরি কালো বানিয়ে দিল। পরক্ষণে—যেন কোনো অশুভ মগজের নির্দেশ মেনে—স্রোতের মতো ভেসে এগোতে লাগল মোটকু চার্লির দিকে। পালাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল সে, কিন্তু ওর পা দুটোকে কেউ বুঝি রবারে পরিণত করেছে! মেঝেতে আছড়ে পড়ল বেচারা।
ওকে ধরে ফেলে মাকড়শার স্রোত। ছোট্ট ছোট্ট পাগুলো এখন ঘোরাফেরা করছে তার নগ্ন চামড়ার ওপর দিয়ে। উঠে দাঁড়াতে চাইল, কিন্তু পারল না। মাকড়শার স্রোত দিল না পারতে…
চিৎকার করতে চাইল মোটকু চার্লি, কিন্তু মুখটাও যে ভরে আছে কালো মাকড়শায়। ধীরে ধীরে ওর চোখও ঢেকে দিল তারা, কালো হয়ে গেল মোটকু চার্লির দুনিয়া…
.
চোখ খুলল মোটকু চার্লি, অন্ধকার বাদে আর কিছুই পড়ল না নজরে। চেঁচিয়ে উঠল বেচারা… চেঁচাতেই লাগল… চেঁচাতেই লাগল। তারপর টের পেল, বাতি নেভানো; জানালার পর্দাও নামানো। কেননা লোকজন এখন মুভি দেখছে।
এমনিতেই নরকের পথে যাত্রা করছে ওরা, মোটকু চার্লির চেঁচানি বাকিদের অবস্থা আরও খারাপ করে ফেলেছে।
উঠে দাঁড়িয়ে আইলে যাওয়ার চেষ্টা চালাল সে, যাবার পথে মাড়িয়ে দিল অনেকের পা। গ্যাঙওয়ের কাছে পৌঁছে, সোজা হওয়ার চেষ্টা করতে যেতেই মাথাটা ধাক্কা খেল লকারের সঙ্গে। ধাক্কার চোটে খুলে গেল লকার, যাত্রীদের হ্যান্ড লাগেজ বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ল বেচারার ওপর।
ধারে-কাছে থাকা মানুষজন, যারা দেখছিল ওর কর্মকাণ্ড, হেসে ফেলল। স্ল্যাপস্টিক কমেডির আদর্শ উদাহরণ দেখতে পেয়ে, আনন্দের সীমা রইল না তাদের।