অধ্যায় চোদ্দো – যেটায় মিলল অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব

অধ্যায় চোদ্দো – যেটায় মিলল অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব 

দরজায় ঘুসি পড়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল চার্লির। চারপাশে নজর বুলাল সে: একটা হোটেলের কামরায় আছে; অনেকগুলো অভাবনীয় ঘটনা ঘুরপাক খেতে লাগল ওর মাথায়, যেভাবে আগুনের দিকে ছুটে আসে পতঙ্গ। সেগুলোর অর্থ কী হতে পারে তা ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়িয়ে হোটেলের দরজার দিকে পা বাড়াল। দরজার পেছনে থাকা একটা নক্সার দিকে তীব্র মনোযোগের সঙ্গে তাকাল সে, জানাচ্ছে ওটা–আগুন লাগলে কোথায় যেতে হবে। গতরাতের ঘটনাবলী ভাবতে লাগল সে। ছিটকিনি খুলে, দরজা টেনে ধরল সে। 

ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে ডেইজি। জিজ্ঞেস করল মেয়েটা, ‘হ্যাট পরেই ঘুমিয়েছিলে?’ 

মাথাটা হাত দিয়ে স্পর্শ করল চার্লি। আসলেই হ্যাট আছে ওখানে। ‘হ্যাঁ,’ বলল সে। ‘তাই তো দেখা যাচ্ছে।’ 

‘তাও অন্তত ভালো যে,’ বলল মেয়েটা। ‘জুতো খুলে শুয়েছিলে। উত্তেজনাকর সব মুহূর্তই যে মিস করে বসেছ, সেটা জানো? কাল রাতের কথা বলছি।’ 

‘তাই নাকি?’ 

‘দাঁত মেজে,’ ডেইজি বলল। ‘শার্ট বদলে নাও। হুম, মিস করেছ। গেছিলে কই…’ বলতে বলতেই থেমে গেল মেয়েটা। চক্রে বসে উধাও হয়ে গেছিল চার্লি, ব্যাপারটা এখন নিজেরই বিশ্বাস হতে চাইছে না। এই ধরনের ঘটনা খুব একটা ঘটে না, অন্তত বাস্তব জীবনে না। ‘তুমি তো ছিলে না। তবে আমি পুলিস চিফকে নিয়ে গ্রাহাম কোটসের বাড়িতে গেছিলাম। ওই পর্যটকদের সে-ই আটকে রেখেছিল।’ 

‘পর্যটক…?’ 

‘ডিনারের টেবিলে একটা কথা বলেছিল লোকটা-এই যে আমরা ওর বাড়িতে দুজনকে পাঠিয়েছি। তোমার বাগদত্তা আর তার মাকে সে আটকে রেখেছিল বেজমেন্টে।’ 

‘ওরা সুস্থ আছে?’

‘হাসপাতালে ভর্তি।’ 

‘ওহ।’ 

‘মায়ের অবস্থা খারাপ, নাও টিকতে পারে। তবে তোমার বাগদত্তা সুস্থ হয়ে যাবে।’ 

‘বারবার বাগদত্তা-বাগদত্তা বলা বন্ধ করবে? বাগদান ভেঙে দিয়েছে রোজি।’ 

‘হুম, কিন্তু তুমি তো আর ভাঙোনি, তাই না?’ 

‘আমাকে ভালোবাসে না মেয়েটা।’ জানাল চার্লি। ‘যাক গে, দাঁত মেজে পোশাক বদলাতে গেলাম। তবে এজন্যই খানিকটা হলেও গোপনীয়তা আমার লাগবে।’ 

‘গোসলও করে নাও,’ বলল ডেইজি। ‘হ্যাটটা থেকে সিগারের গন্ধ আসছে।’ 

‘পারিবারিক স্মৃতি জিনিসটা, ওকে জানাল চার্লি। তারপর বাথরুমে ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজা। 

.

হোটেল থেকে মিনিট দশেক হাঁটার দূরত্বেই হাসপাতাল। স্পাইডার বসে আছে ওয়েটিং রুমে, হাতে ধরে আছে এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি ম্যাগাজিনের একটা কপি। যদিও পড়ছে না। 

ওর কাঁধে টোকা দিল চার্লি, লাফিয়ে উঠল স্পাইডার। ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকাল ওপরের দিকে, ভাইকে দেখে শান্ত হলো। তবে খুব একটা না। ‘আমাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলেছে কর্তৃপক্ষ,’ জানাল স্পাইডার। কারণ আমি ওদের আত্মীয়-টাত্মীয় কিচ্ছু না।’ 

বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে বসল চার্লি, ‘বললেই তো পারতে যে তুমি আত্মীয়…কিংবা একজন ডাক্তার!’ 

অপ্রস্তুত দেখাল স্পাইডারকে। ‘আসলে যেসব বিষয়ের গুরুত্ব নেই নিজের কাছেই, সেগুলোর ব্যাপারে মিথ্যে বলা সহজ। আমি ভেতরে গেলাম না বাইরে থাকলাম তাতে কিছু যদি না আসে-যায়, তাহলে মিথ্যে বলে ভেতরে যাওয়াটা সহজ। কিন্তু এখন যেহেতু যায়-আসে, তাই বাগড়া বাধাতে কিংবা ভুল কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে বড়ো কথা, যদি চেষ্টা করতে যাই আর না বলে দেয় কর্তৃপক্ষ, তাহলে…হাসছ কেন?’ 

‘কোনো কারণ নেই,’ জানাল চার্লি। ‘তবে শুনে কথাগুলো খুব পরিচিত মনে হলো। যাক গে, চলো রোজিকে খুঁজে বের করি। একটা ব্যাপার জানো?’ শেষের প্রশ্নটা করল সে ডেইজিকে, সামনে যে করিডর পড়েছে সেটায় ঢুকে পড়েছে ওরা। ‘হাসপাতালে হাঁটার দুটো উপায় আছে। হয় ভান ধরতে হবে যে আসলে তুমি এখানকারই কেউ—এই নাও, স্পাইডার। দরজার পেছনে সাদা অ্যাপ্রোন ছিল, তোমার দেহে আঁটবে। পরে ফেলো—অথবা এমন ভান ধরতে হবে যে কোথায় এসেছ তা কিছুতেই বুঝতে পারছ না, তাই কেউ তোমার অবস্থান নিয়ে প্রশ্নই তুলবে না। অন্য কারও ঝামেলা ভেবে মাথা থেকে বের করে দেবে।’ গুনগুন করতে লাগল চার্লি। 

‘নাম হলো—হলদিয়া পাখি,’ জানাল স্পাইডার। 

মাথায় আবার হ্যাটটা পরে নিলো চার্লি, রোজির হাসপাতাল কামরায় ঢুকে পড়ল ওরা। 

বিছানায় বসে ছিল রোজি, পড়ছিল একটা ম্যাগাজিন। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ওদের তিনজনকে একত্রে কামরায় ঢুকতে দেখে বেড়ে গেল দুশ্চিন্তা। একবার স্পাইডার, আরেকবার চার্লির দিকে তাকাল সে। 

‘তোমরা দুজনেই বাসা থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছ দেখি,’ কেবল এতটুকু বলল মেয়েটা। 

‘অবশেষে এক হলাম আমরা সবাই,’ জানাল চার্লি। ‘স্পাইডারের সঙ্গে তো তোমার দেখাই হয়েছে। আর ও হলো ডেইজি, পুলিসে আছে।’ 

‘এখনও চাকরিটা আছে কি না, জানা নেই,’ বলল ডেইজি। ‘বোধহয় অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।’ 

‘গত রাতে তো তুমিই পাহাড়ে গেছিলে? দ্বীপের পুলিসকে বাধ্য করেছিলে ওই বাড়িতে যেতে?’ থমকে গেল রোজি। একটু পর জানতে চাইল, ‘গ্রাহাম কোটসের কী খবর?’ 

‘ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে, তোমার মায়ের মতোই।’ বলল রোজি। 

‘যদি আগে আমার মায়ের জ্ঞান ফেরে,’ বলল রোজি। ‘তাহলে সে-ই কোটসকে খুন করবে,’ তারপর যোগ করল। ‘মায়ের অবস্থা আমাদেরকে ডাক্তাররা জানাচ্ছে না। শুধু বলছে, অবস্থা সঙ্গিন, বলার মতো কোনো উন্নতি- অবনতি হলে জানাবে আমাকে।’ পরিষ্কার দৃষ্টিতে তাকাল সে চার্লির দিকে। ‘মাকে তুমি যতটা খারাপ ভাবো, সে কিন্তু ততটা খারাপও না। আসলে মিশতে হয় ওর সঙ্গে, নইলে বোঝা মুশকিল। সেই সুযোগ আর সময়টা আমরা পেয়েছি, সেলারে আটকে থাকা অবস্থায়। মা আমার মানুষ খারাপ না।’ 

নাক ঝাড়ল মেয়েটা। তারপর বলল, ‘ডাক্তারদের ধারণা—বাঁচবে না মা। সরাসরি কথাটা বলেনি বটে, তবে ঢারেটোরে বুঝিয়েছে। ব্যাপারটা হাস্যকর, আমার তো ধারণা ছিল—যেকোনো পরিস্থিতি কেটে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা মায়ের আছে!’ 

চার্লি বলল, ‘আমার তাই ধারণা ছিল। ভাবতাম – পারমাণবিক যুদ্ধ বাধলেও অন্তত তেলাপোকা আর তোমার মা বেঁচে যাবে।’ 

ওর পায়ে নিজের পা দিয়ে চাপ দিল ডেইজি। বলল, ‘মাকে কীসে আহত করেছে, এই ব্যাপারে কিছু জানা গেছে?’ 

‘কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি,’ বলল রোজি। ‘বাড়িটায় কোনো এক ধরনের পশু ছিল। হয়তো সব কিছু একা গ্রাহাম কোটসই করেছে। মানে, অনেকটা ওর মতোই মনে হলো; কিন্তু পুরোপুরি সে ছিল না ওখানে, ছিল অন্য কেউ। আমার ওপর থেকে ওটার নজর সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল মা, তারপর…’ যতটা পরিষ্কার ভাবে সম্ভব, পরিস্থিতির বর্ণনা দ্বীপের পুলিসকে সেদিন সকালেই বলেছে সে। তবে সোনালি-চুলো ভূতুড়ে নারীর কথাটা অনুহ্য রেখেছে। মাঝে-মধ্যে চাপে পড়ে অনেকের বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ওর-ও যে সেই অবস্থা হয়েছিল, তা মানুষজনকে জানাতে চায় না। 

তাই বলতে বলতেই থেমে গেল রোজি। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে স্পাইডারের দিকে, যেন কেবল যুবকটার কথা মনে পড়ছে। বলল সে, ‘তবে তোমাকে এখনও ঘৃণা করি, বুঝলে?’ 

জবাবে কিছুই বলল না স্পাইডার, তবে করুণ মুখাবয়ব হলো বেচারার। এখন আর ওকে দেখতে ডাক্তার মনে হচ্ছে না: দেখাচ্ছে এমন এক লোকের মতো যে চুরি করে সাদা অ্যাপ্রোনটা গায়ে জড়িয়ে এখন ভয় পাচ্ছে, কেউ হয়তো ওকে দেখে ফেলবে! স্বপ্নিল একটা আবহ কণ্ঠে যোগ করে বলল রোজি, ‘তবে, যখন অন্ধকারে ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল যে আমাকে তুমি সাহায্য করছ। ওই পশুটাকে সরিয়ে রাখছ দূরে। তোমার চেহারার এ কী হাল? ছড়ে গেছে দেখি।’

‘একটা জন্তু আক্রমণ করেছিল,’ জানাল স্পাইডার। 

‘ভালো কথা,’ বলল রোজি। ‘তোমাদেরকে পাশাপাশি দেখার পর বুঝতে পারছি, চেহারায় একদম মিল নেই!’ 

‘দুজনের মাঝে, আমিই সুদর্শন,’ বলল চার্লি। কিন্তু দ্বিতীয় বারের মতো ডেইজির পায়ের চাপ খেয়ে চুপ করে গেল। 

‘চুপ,’ নিচু কণ্ঠে বলল ডেইজি। তারপর কণ্ঠ উঁচু করে যোগ করল, ‘চার্লি, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। বাইরে চলো, এখুনি।’ 

হাসপাতালের করিডরে চলে এলো ওরা দুজন, স্পাইডার রয়ে গেল ভেতরে। 

‘কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করল চার্লি। 

‘কী মানে কী?’ পালটা প্রশ্ন করল ডেইজি। 

‘কথা বলার জন্য না বাইরে ডাকলে? কী বলবে?’ 

‘কিচ্ছু না।’ 

‘তাহলে বাইরে কী করছি? রোজির কথা তো শুনলে, স্পাইডারকে ঘৃণা করে সে। ওদেরকে একই কামরায় একা ছেড়ে আসা উচিত হয়নি। এরমধ্যে হয়তো আমার ভাইকে মেরেই ফেলেছে মেয়েটা!’ 

যদি যিশুর দেওয়া মাছ আর রুটি দেখে কেউ তাকে বলত, এই দুটোয় অ্যালার্জি আছে বলে চিকেন সালাদ দিলে ভালো হয়, তাহলে যিশুর চেহারার যে দশা হতো…সেই একই চেহারা বানিয়ে ওর দিকে তাকাল ডেইজি: সেই দৃষ্টিতে মিশে আছে করুণা, সেই সঙ্গে সীমাহীন সমবেদনাও। 

ঠোঁট আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে, দরজার কাছে চার্লিকে টেনে আনল মেয়েটা। কামরার ভেতরে উঁকি দিল চার্লি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, স্পাইডারকে খুন করছে না রোজি…যা করছে তা খুনের পুরো বিপরীত বলা চলে। ‘ওহ,’ বলল সে। 

আশ্লেষে একে-অন্যকে চুমু খাচ্ছে রোজি আর স্পাইডার। যদি আপনি ভেবে থাকেন, চুম্বনটা একদম গতানুগতিক তাহলে আপনাকে দোষ দেওয়া যায় না। তবে ধরে নিতে হবে যে আপনি স্পাইডারের হাসি দেখতে পাচ্ছেন না, দেখতে পাচ্ছেন না কীভাবে জ্বলজ্বল করছে তার চোখজোড়া। চুমুর পর যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে তা দেখে মনে হয়, সে এইমাত্র শিখেছে যে কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়! 

…সেটাও পৃথিবীর অন্য যে কারও চাইতে ভালোভাবে! 

ঘুরে দাঁড়িয়ে করিডরে আবার নজর দিল চার্লি। ডেইজি ব্যস্ত কিছু ডাক্তার আর পুলিস অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে। শেষের জনের সঙ্গে গত রাতেই কথা হয়েছে ওদের। 

‘সত্যি বলতে কী, সেই প্রথম থেকেই লোকটার গতিবিধি আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল,’ পুলিস অফিসার ডেইজিকে বলল। ‘একমাত্র বিদেশিদের কাছেই এহেন আচরণ পাওয়া যায়। আমরা, মানে স্থানীয়রা, এমন কিছু কখনওই করতাম না।’ 

‘তা তো বটেই,’ জানাল ডেইজি। 

‘অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি,’ পুলিস চিফ জানাল, ডেইজির কাঁধে এমন ভাবে চাপড় বসাল যে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল মেয়েটা। ‘এই লিটল লেডিই ওই নারীর জীবন বাঁচিয়েছে,’ চার্লিকে জানাল সে, ওর কাঁধেও চাপড় দিল। তারপর ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে লাগল করিডর ধরে। 

‘কী অবস্থা?’ জিজ্ঞেস করল চার্লি। 

‘উম, গ্রাহাম কোটস মারা গেছে,’ জানাল মেয়েটা। ‘রোজির মায়েরও বাঁচার আশা নেই ডাক্তারদের।’ 

‘বুঝলাম,’ জানাল চার্লি। একটু ভেবে নিলো সুযোগ বুঝে, তারপর সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। বলল, ‘ভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে কিছু মনে করবে? ওর সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার।’ 

‘এমনিতেও হোটেলে ফিরছিলাম। ই-মেইল চেক করতে হবে। ফোনে বহুবার ক্ষমা চাইতে হবে। দেখা যাক, ক্যারিয়ার বলতে কিছু আছে নাকি আমার।’ 

‘কিন্তু তুমি তো দারুণ কাজ দেখিয়েছ, তাই না?’ 

‘মনে হয় না এই কাজ করার জন্য আমাকে বেতন দেওয়া হয়,’ জানালো মেয়েটা, খানিকটা দুর্বল কণ্ঠেই। ‘কাজ শেষে আমার সঙ্গে হোটেলে দেখা কোরো।’ 

.

স্পাইডার আর চার্লি হাঁটছে উইলিয়ামসটাউনের রাস্তায়, সকালের সূর্যালোক গায়ে মেখে। 

‘হ্যাটটা কিন্তু দারুণ,’ বলল স্পাইডার। 

‘তোমার তাই মনে হয়?’ 

‘হ্যাঁ। আমি পরতে পারি?’ 

স্পাইডারকে ওর সবুজ ফেডোরাটা দিন চার্লি। মাথায় দিল স্পাইডার, নিজের প্রতিবিম্ব দেখল দোকানের আয়নায়। চেহারা বিকৃত করে ফিরিয়ে দিল চার্লিকে। ‘আসলে,’ হতাশ শোনাল ওর কণ্ঠ। ‘তোমার মাথাতেই বেশি মানায়।’ 

ফেডোরাটা আবার মাথায় গলাল চার্লি। কিছু কিছু হ্যাট এমন আছে, যেগুলো পরার পূর্বশর্তই হলো স্ফূর্তি। ওগুলো মাথায় দিয়ে একটু বাঁকিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পথ চলতে হয়, ভাবখানা হয় এমন যে আরেকটু হলেই নাচতে শুরু করে দেবেন। ওগুলো পড়তে হলে, নিজেকে অনেক কিছু করতেই বাধ্য করতে হয়। চার্লি যেটা পরে আছে, সেটা ওরকম একটা হ্যাট; আর ওটার জন্য অনেক কিছুই করতে রাজি সে। বলল, ‘রোজির মা মারা যাচ্ছে।’ 

‘হুম।’ 

‘আমি আসলে মহিলাকে কখনও পছন্দ করতে পারিনি।’ 

‘তোমার মতো করে তো তাকে চিনি না…তবে সময় পেলে সন্দেহ নেই যে আমিও তাকে অপছন্দই করতাম।’ 

চার্লি এবার বলল, ‘আমাদের মহিলার জীবন বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে, তাই না?’ আগ্রহের সঙ্গে বলল কথাটা। 

‘মনে হয় না এমন কিছু করার ক্ষমতা আমাদের আছে।’ 

‘মায়ের জন্য কিন্তু এমন কিছু একটা করেছিল বাবা, খানিকক্ষণের জন্য ভালো হয়ে গেছিল মা।’ 

‘সেটা বাবা পেরেছে। মনে হয় না আমাদের পক্ষে সম্ভব।’ 

চার্লি বলল, ‘ওই জায়গাটার কথা মনে আছে? পৃথিবীর শেষে? গুহাঅলা জায়গাটা?’ 

‘শেষে না, শুরুতে। কী হয়েছে ওটার?’ 

‘আমরা কি চাইলেই যেতে পারি ওখানে? মোম-টোম আর জড়িবুটি-টুটি ছাড়াই?’ 

চুপ করে রইল স্পাইডার, তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘তাই তো মনে হয়।’

একসঙ্গে ঘুরল ওরা, বাঁক নিলো এমন এক স্থানে এসে যেখানে আসলে মোড় থাকার কথা ছিল না। উইলিয়ামসটাউনের রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তায় পা রাখল তারা। 

সূর্য উদয় হতে শুরু করেছে, চার্লি আর স্পাইডার হাসছে খুলিতে ভরে থাকা একটা সৈকত ধরে। ওগুলো আসলে ঠিক মানুষের খুলি বলা যায় না। সৈকতটাকে হলদে নুড়ির মতো ঢেকে রেখেছে ওগুলো। যতটা সম্ভব খুলি এড়িয়ে পা ফেলতে চাচ্ছে চার্লি, কিন্তু স্পাইডারের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সৈকতের শেষ মাথায় এসে, স-ব কিছু পেছনে ফেলে বাঁ দিকে ঘুরল সে। পৃথিবীর শুরুতে যে পাহাড়-সারি আছে, সেটা দেখা দিল ওদের সামনে। 

গতবার এখানে আসার স্মৃতি ভালোভাবেই মনে আছে চার্লির, যদিও মনে হচ্ছে সেটা হাজার বছর আগের কথা। ‘কই গেল সব?’ উচ্চকণ্ঠে বসল সে, পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার শব্দগুলো ওর কাছেই ফিরে এলো। জোরেশোরে বলল, ‘হ্যালো?’ 

সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল সবাই, দেখছে ওকেই। সবাই বলতে স-ব্বা-ই। তাদেরকে বিশাল দেখাচ্ছে এখন, তবে মানুষের মতো খুব একটা না; বরঞ্চ পশুর সঙ্গেই মিল দেখা যাচ্ছে বেশি, অনেকটাই বুনো। বুঝতে পারল চার্লি, গতবার এদেরকে দেখে মানুষের মতো লাগছিল কারণ তেমনটাই ভেবে এখানে পা রেখেছি সে। কিন্তু আসলে তো এরা মানুষ না। পাথরের ওপর বসে-দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে সিংহ, হাতি, কুমির, সাপ, খরগোশ আর বিচ্ছু…সেই সঙ্গে অন্য সব প্রাণী। সংখ্যায় তারা শত শত, আমোদহীন চোখের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওকে: পশুগুলোকে চিনতে পারছে চার্লি, যদিও এদেরকে অন্য কোনো জ্যান্ত মানুষ চিনতে পারবে না। গল্পে যত পশুর কথা শুনেছে মানুষ, তাদের সবাই উপস্থিত হয়েছে এখানে। আছে এমন সব পশু যাদেরকে তারা কল্পনায় দেখেছে, যাদের পুজো করেছে কিংবা পোষ মানিয়েছে। 

সবাইকে দেখতে পেল চার্লি। 

জানের ভয়ে গান গাওয়া এক কথা, ভাবল সে। কামরা ভরতি মানুষের সামনে, মূহূর্তের উন্মাদনায়। কেননা শয়তান এক লোক বন্দুক ঢেকিয়ে রেখেছে এমন এক মেয়ের পেটে যাকে… 

যাকে… 

ওহ। 

থাক, ভাবল চার্লি। সেই চিন্তা পরে করা যাবে। 

এই মুহূর্তে ও চায় হয় কাগজের বাদামি ব্যাগে শ্বাস ফেলতে-নিতে, কিংবা উধাও হয়ে যেতে। 

‘সংখ্যায় হাজারো হবে,’ সম্ভ্রম মিশ্রিত কণ্ঠে বলল স্পাইডার। 

আচমকা বাতাসে জন্ম নিলো বাতাসের নাচন। কাছের একটা পাথরে সেই বাতাস ঘনীভূত হয়ে পরিণত হলো পাখি-মানবীতে। হাত বুকের ওপর বেঁধে, ওদের দিকে চেয়ে রইল মহিলা। 

‘যাই করতে চাও না কেন,’ বলল স্পাইডার। ‘দ্রুত করো, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করবে না এরা। চুপচাপ থাকবে বলে মনে হয় না।’ 

চার্লির মুখ শুকিয়ে গেছে। ‘ঠিক বলেছ।’ 

স্পাইডার শুরু করল, ‘এখন, মানে, আমরা করবটা কী?’

‘ওদেরকে গান গেয়ে শোনাব,’ চার্লি কেবল এতটুকুই বলল।

‘কীহ?’ 

‘ঝামেলা সামলাবার এটাই উপায়। অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি। তুমি আর আমি মিলে গাইব ওদের জন্য।’

‘বুঝতে পারলাম না। কী গাইব?’ 

জবাব দিল চার্লি। ‘গান…বিশেষ সেই গান। ওটা গাইলেই, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ মরিয়া শোনাল যুবককে। ‘ওই গানটা।’

রসগোল্লার মতো বড়ো বড়ো দেখাচ্ছে স্পাইডারের চোখ। সেই চোখে এমন অনেক কিছু দেখতে পেল চার্লি যা আগে কখনও দেখেনি: ভালোবাসা, সেই সঙ্গে বিভ্রান্তি… এবং ক্ষমা প্রার্থনা। ‘কী বলছ, বুঝতেই তো পারছি না!’ 

পাথরের এক পাশ থেকে উঁকি দিল সিংহ। বানর ওদেরকে দেখছে গাছের ওপর থেকে। আর বাঘ… 

বাঘকে দেখতে পেল চার্লি। চার পায়ে পা টিপে টিপে হাঁটছে সে, চেহারা ফুলে গেছে; তবে চোখে অদ্ভুত একটা আভা খেলা করছে, যেন প্রতিশোধ নিতে পারলে খুবই খুশি হতো। 

চার্লি মুখ খুলল। গোঙানির মতো একটা আওয়াজ বেরোল শুধু ওর মুখ থেকে, যেন নার্ভাস কোনো ব্যাং ঢুকে গেছে ওর গলায়। ‘কাজ হচ্ছে না,’ স্পাইডারকে ফিসফিসিয়ে বলল ও। ‘বুদ্ধিটা আসলে বেকার, তাই না?’ 

‘হ্যাঁ।’ 

‘আচ্ছা, আবার পালিয়ে যেতে পারব এখান থেকে?’ চার্লি নার্ভাস ভঙ্গিতে পাহাড়ের ঢাল আর গুহামুখের ওপর নজর বুলাল। সৃষ্টি-জগতের শুরু থেকে যত ধরনের পশু জন্ম নিয়েছে, দেখল তাদের সবাইকে। গত বার দেখেনি, এমন একজনও ছিল তাদের মাঝে: ছোট্ট একজন মানুষ, হাতে লেবুর মতো হলদে দস্তানা আর পেন্সিলের মতো পাতলা গোঁফ। তবে পাতলা চুল ঢেকে রাখার মতো ফেডোরা নেই মাথায়। 

চার্লির চোখে চোখ পড়লে, নিজের চোখ টিপল বৃদ্ধ লোকটা। 

দেখা গেল, সেটাই যথেষ্ট! 

ফুসফুস ভরে বাতাস টানল চার্লি, তারপর শুরু করল গান গাওয়া। ‘আমি চার্লি,’ গাইল সে। ‘আমি আনানসির ছেলে। শোনো আমার গান, শোনো আমার জীবনের গল্প।’ 

গেয়ে গেয়ে একটা গল্প শোনাল চার্লি; শোনাল এমন এক ছেলের কথা যে আসলে আধা-দেবতা, যাকে রাগের বশবর্তী হয়ে এক বৃদ্ধা মহিলা দুই অংশে ভাগ করে দিয়েছিল। গেয়ে শোনাল ভাইয়ের কথা, শোনাল মায়ের গল্প। 

গানে যোগ করল নামগুলো, যোগ করল নানা শব্দ। যোগ করল বাস্তবতা যে খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার আখ্যান; যে দুনিয়াগুলো তৈরি করে অন্য দুনিয়াগুলো—সেগুলোও বাদ গেল না। সব কিছুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্য শোনাল শ্রোতাদের; জানিয়ে দিল, যারা ওকে কিংবা ওর নিজের এমন কিছুর ক্ষতি করবে তার উচিত সাজা কী হবে। 

এক কথায়, নিজের গানে পুরো দুনিয়াটাকে উপস্থাপন করল চার্লি। 

গানটা বেশ ভালো, আর সেটা ওর নিজের গান। কখনও কখনও গাইতে হলো কলি ব্যবহার করে, কখনও বা কোনো কথার দরকারই পড়ল না। 

ওর গান শুনতে শুনতে হাততালি দিতে লাগল সবগুলো প্রাণী, পা ঠুকে তাল মেলাল ওর সঙ্গে। চার্লির মনে হলো, ওদের সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছে এমন একটা গানের মাধ্যমে সে। পাখির কথা বলল সে, বলল চোখ তুলে তাদের উড্ডয়নের মাঝে থাকা জাদুর গল্প। দিনের আলোতে তাদের পালকে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে ঝিকিয়ে ওঠার আখ্যান রইল গানে। 

টোটেম[৩৭] প্রাণিগুলো নাচতে শুরু করে দিয়েছে, যার যার নিজস্ব নাচ। এমনকী পাখি-মানবীও নাচছে পাখিদের মতো চক্রাকার নাচ। লেজের পালকগুলো ছড়িয়ে পড়ছে, পেছনে হেলিয়েছে চঞ্চ। 

[৩৭. এমন কোনো প্রাণী কিংবা বস্তু, যা কোনো বিশেষ ধারণা কিংবা আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে।] 

পাহাড়ের ঢালে রয়েছে মাত্র একটা প্রাণী যে নাচছে না 

লেজ দাপাচ্ছে বাঘ। হাততালি, গান গাওয়া কিংবা নাচ—কোনোটাই করছে না সে। চেহারা মারের চোটে বেগুনি হয়ে গেছে, কামড়ের দাগ আর ফোলায় দেহটা ভরে আছে। পাথরের ওপর দিয়ে একেক বারে এক পা ফেলে কাছিয়ে এসেছে বাঘ। চার্লির একদম কাছে আসার আগে থামেওনি। ‘গানগুলো তোমার না,’ গর্জে উঠল সে। 

ওর দিকে তাকাল চার্লি; এরপর গাইতে শুরু করল। প্রথমে বাঘকে নিয়ে, তারপর তাতে যোগ করল গ্রাহাম কোটসের কথা, শোনাল নিরীহদের শিকার বানায় এমন পাষণ্ডদের আখ্যান। ঘুরে যখন দাঁড়াল, তখন স্পাইডারের চোখে ওর জন্য দেখতে পেল সম্ভ্রম। রাগে গর্জে উঠল বাঘ, সেটাকে গানের অংশ বানিয়ে নতুন করে কলি সাজাল চার্লি। তারপর গর্জে উঠল নিজেই, ঠিক যেভাবে বাঘ গর্জেছিল। 

তবে গর্জনটা পুরোপুরি বাঘের গর্জন হলো না। শুরুটা হলো ওভাবেই, কিন্তু একটু পরেই সেটাকে নিজের মতো বানিয়ে নিলো চার্লি। তাই হাস্যরসের উদ্রেককারী একটা গর্জনে পরিণত হলো সেটা। যত প্রাণী দেখছিল, সবাই 

হাসতে শুরু করল। অবশ্য ওদেরকেও দোষ দেওয়া যায় না, হাসতে বাধ্য হলো বলা চায়। চার্লি সেই আমোদ মেশানো গর্জন শোনাল আবার। অন্যকে নকল করার ভান করল, যাকে প্রায় নিখুঁত ক্যারিকেচার বলা চলে; যে ব্যাপারটা আনন্দ-ফূর্তিকে একেবারে বোঝার বাইরের বস্তুতে পরিণত করেছে, সেই জিনিসটা মিশে রইল গর্জনের সঙ্গে। আর কখনও কেউ বাঘের গর্জন শুনলে, তাতে মিশে থাকা চার্লির গর্জন ধরতে ব্যর্থ হবে না। ‘বোকা-বোকা গর্জন,’ বলবে তারা। 

চার্লির দিকে পিঠ ফেরাল বাঘ, লাফ দিল ভিড়ের মধ্যখান দিয়ে। যেতে যেতে গর্জন করল একটা। শুনে উপস্থিত সবার হাসি বেড়ে গেল আরও। রাগের সঙ্গে গুহায় ফিরে গেল বাঘ। 

হাত দিয়ে ভঙ্গী করল স্পাইডার, আলতো একটা ভঙ্গী। 

আচমকা চারপাশ থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ ভেসে এলো, সঙ্গে সঙ্গে পাথর ধসের কারণে আটকে গেল বাঘের গুহা। স্পাইডারকে সন্তুষ্ট দেখাল। এদিকে গান চালিয়ে গেল চার্লি। 

রোজি নোয়াহ ও তার মায়ের গান গাইল ওরা; গাইল মিসেস নোয়াহের লম্বা জীবনের গান, সেই সঙ্গে যেসব আনন্দ তার প্রাপ্য…সেগুলোও। 

নিজের জীবনের গান গাইল সে, গাইল ওদের সবার জীবনের গান; সেই গানে দেখতে পেল মাকড়শার একটা জাল, যাতে আটকে গেছে একটা মাছি; সেই মাছিটাকে গানের মাঝে পেঁচিয়ে নিলো চার্লি, নিশ্চিত করল যে ওটা পালাতে পারবে না। তারপর ছিঁড়ে যাওয়া জালটাকে নতুন করে আবার সুতো দিয়ে বাঁধল। 

গানটা অবশেষে তার শেষে পৌঁছে গেল। 

চার্লি টের পেল, অবাক না হয়েই, যে গান গেয়ে দারুণ আনন্দ পেয়েছে সে। টের পেল, বাকি জীবনটা এই কাজ করেই কাটিয়ে দিতে চায়। গান গাইবে সে: নাহ, এমন বড়ো বড়ো আর জাদুময় গান গাইবে না যা দুনিয়া সৃষ্টি করে কিংবা বাস্তবতাকে মোচড়াবে না। ছোটো ছোটো গান গাইবে যা অল্প সময়ের জন্য হলেও আনন্দ দেবে মানুষজনকে, তাদেরকে মনোজগতে আলোড়ন তুলবে, খানিকক্ষণের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেবে তাদের দুঃখকে। বুঝতে পারছে, গান গাইবার আগে সবসময়ই আতঙ্কে ভুগবে সে; মঞ্চে দাঁড়াবার ভয়টা ওকে ছাড়বে না কখনওই। তবে এটাও বুঝতে পারছে—ব্যাপারটা হবে সুইমিং পুলে ঝাঁপ দেওয়ার মতো—প্রথম কয়েকটা মুহূর্ত অস্বস্তি লাগলেও, তারপর উপভোগ করার মতোই হবে অভিজ্ঞতাটা… 

কিন্তু এত উপভোগ্য হবে না। অবশ্য যা হবে তা যথেষ্টই। 

তারপর শেষ হয়ে গেল গানটা। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল চার্লি। গানের রেশ ফুরিয়ে গেলে গান বন্ধ করে দিল প্রাণিগুলোও, বন্ধ হয়ে গেল তাদের হাততালি-নাচ-পা ফেলা। বাবার সবুজ ফেডোরাটা হাতে নিয়ে চেহারায় বাতাস করতে লাগল সে। 

নিচু কণ্ঠে বলল স্পাইডার। ‘দারুণ দেখালে।’ 

‘কাজটা তুমিও করতে পারতে,’ জানাল চার্লি। 

‘আমার তা মনে হয় না। শেষের দিকে এসে এটা কী হলো? টের পাচ্ছিলাম যে কিছু একটা করছ তুমি, কিন্তু সেটা যে কী তা ধরতে পারছি না।’ 

‘কিছু সমস্যার সমাধান করলাম,’ জানাল চার্লি। ‘মানে আমার সেটাই মনে হয়, ঠিক নিশ্চিত নই। 

আসলেও তাই। গান এখন শেষ, কলিগুলোর সত্যতা তাই আস্তে আস্তে ভোরের আলোর মতোই ছড়িয়ে পড়বে। পাথর ধসে বন্ধ হয়ে যাওয়া গুহার মুখটার দিকে ইঙ্গিত করল ও। ‘কাজটা তোমার?’ 

‘হ্যাঁ,’ জানাল স্পাইডার। ‘এতটুকু তো আমি করতেই পারি। অবশ্য একসময়-না-একসময় ঠিকই বেরিয়ে আসবে বাঘ। সম্ভব হলে ওর অবস্থা আরও খারাপ করতাম।’ 

‘ভেবো না,’ বলল চার্লি। ‘আমি করেছি, অনেক খারাপ কিছুই করেছি।’ 

প্রাণিগুলোকে ছত্রভঙ্গ হতে দেখল চার্লি। ওর বাবাকে দেখা গেল না কোথাও, ব্যাপারটা অবাক করল না ওকে। ‘চলো,’ বলল সে। ‘আমাদের ফেরা দরকার।’ 

.

ভিজিটিং টাইমে রোজির সঙ্গে দেখা করতে গেল স্পাইডার। চকলেটের একটা বাক্স নিয়ে এসেছে সে, হাসপাতালের গিফট শপে এর চাইতে বড়ো বাক্স আর ছিল না। 

‘তোমার জন্য,’ বলল ছেলেটা। 

‘ধন্যবাদ।’ 

‘ডাক্তাররা জানাল,’ বলল মেয়েটা। ‘মা নাকি সুস্থ হয়ে যাবে। চোখ খুলেই নাকি পরিজ খেতে চেয়েছে। সবাই বলছে: অলৌকিক কাণ্ড ঘটে গেছে!’ 

‘হুম, তোমার মা…আর খাবার চেয়েছে! অলৌকিক কাণ্ডই বটে।’ 

আদর করে ওর হাতে চাপড় বসাল রোজি, তারপর আর হাত সরাল না।

‘হয়তো শুনে হাসবে,’ বলল মেয়েটা, বেশ খানিকক্ষণ পর। ‘কিন্তু অন্ধকারে যখন মায়ের সঙ্গে ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল যে তুমি আমাকে সাহায্য করছ। যেন পশুটাকে দূরে সরিয়ে রেখেছ। যদি কাজটা তুমি না করতে, তাহলে হয়তো আমাদেরকে ওটা মেরেই ফেলত!’ 

‘উম, সম্ভবত তোমার ধারণাই সঠিক।’ 

‘তাই নাকি?’ 

‘জানি না, সম্ভবত। আমিও বিপদে পড়েছিলাম, তখন তোমার কথা ভেবেছি।’ 

‘বড়ো কোনো ঝামেলা?’ 

‘হ্যাঁ, বিশাল বড়ো।’ 

‘আমাকে এক গ্লাস পানি দেবে, প্লিজ?’ 

তাই করল স্পাইডার। মেয়েটা বলল, ‘স্পাইডার, কী করো তুমি?’ 

‘কী করি? মানে?’ 

‘পেশা কী তোমার?’ 

‘যখন যা করতে মন চায়।’ 

‘আমার ধারণা,’ বলল মেয়েটা। ‘এখানে, এই হাসপাতালে আরও কিছুদিন থাকব। নার্সরা আমাকে জানিয়েছে, ওদের নাকি কিছু শিক্ষক দরকার। আমি দেখতে চাই, এখানে কোনো পরিবর্তন আনতে পারি কি না।’ 

‘কাজটা মজার হতে পারে।’ 

‘ধরো আমি রয়ে গেলাম, তাহলে তুমি কী করবে?’ 

‘উম, তুমি যদি এখানে থাকো তো আমারও নিজেকে ব্যস্ত রাখার মতো কাজ খুঁজে নিতে হবে।’

একজনের আঙুল আঁকড়ে ধরল অন্য জনেরগুলো। 

‘কী মনে হয়, আমাদের সম্পর্কটা টিকবে?’ জানতে চাইল মেয়েটা। 

‘তাই তো মনে হয়,’ আন্তরিক ভাবেই বলল স্পাইডার। ‘যদি কখনও একঘেয়ে লাগতে শুরু করে, তাহলে হয়তো অন্য কিছু করতে চলে যাবো। তাই দুশ্চিন্তা কোরো না।’ 

‘ওহ,’ বলল রোজি, ‘তা করছি না।’ আসলেও করছে না মেয়েটা। ওর কণ্ঠের নম্রতার নিচে ঢাকা পড়েছে ইস্পাতের দৃঢ়তা। 

বোঝাই যাচ্ছে, ওর মা এত কঠিন কেন! 

.

ডেইজিকে সৈকতের একটা ডেক চেয়ারে শোয়া অবস্থায় খুঁজে পেল চার্লি। দেখে মনে হলো, রোদ পোহাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। কিন্তু ওর ওপর চার্লির ছায়া পড়তেই মেয়েটা বলল, ‘হ্যালো চার্লি।’ তবে চোখ খুলল না। 

‘আমিই যে এসেছি, তা বুঝলে কীভাবে?’ 

‘তোমার হ্যাট থেকে সিগারের গন্ধ আসছে। ওটা কবে ফেলে দেবে?’ 

‘কখনও না,’ জানাল চার্লি। ‘আগেও বলেছি, পারিবারিক স্মৃতিচিহ্ন এটা। আশা করি, মরার সময়ও এই হ্যাট আমার মাথায় থাকবে। যখন মারা যাবো, তখন দিয়ে যাবো সন্তানকে। যাই হোক, পুলিসের চাকরি এখনও আছে?’ 

‘আছে বলা যায়,’ জানাল মেয়েটা। ‘আমার বস জানিয়েছে—অতিরিক্ত কাজের চাপে মানসিক বৈকল্যে ভুগছিলাম আমি। তাই এই ছুটিটাকে বিশ্রাম হিসেবে দেখা হচ্ছে, ফিরে যাওয়ার আগপর্যন্ত সেই হিসেবেই দেখা হবে।’ 

‘আহ। কবে যাচ্ছ?’ 

‘জানি না,’ বলল মেয়েটা। ‘সানট্যানের তেলটা একটু দেবে।’ 

পকেটে একটা বাক্স নিয়ে এসেছে চার্লি। ওটা বের করে, ডেক চেয়ারের হাতলে রাখল। ‘তার আগে আরেকটা কথা,’ বলল সে। ‘হয়েছে কী, বিব্রতকর কাজটা তো বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে একবার করেই ফেলেছি।’ বাক্সটা খুলল সে। ‘এটা তোমার জন্য, আমার তরফ থেকে। মানে, রোজি ফিরিয়ে দিয়েছে। যদি চাও তো এটার বদলে তোমার পছন্দসই অন্য একটা নিতে পারি। এটা আঁটবে বলে মনে হয় না। তবে জিনিসটা তোমার। মানে যদি ওটাকে…আর আমাকে চাও আরকী!’ 

বাক্সের ভেতর হাত ঢুকিয়ে, বাগদানের আংটিটা বের করে আনল ডেইজি।

‘হুম, ঠিক আছে,’ বলল মেয়েটা। ‘আশা করি, কাজটা তুমি ওই লেবু ফেরত পাওয়ার জন্য করছ না!’ 

.

রাগে পায়চারী করছে বাঘ, বিরক্তির সঙ্গে নাড়ছে লেজখানা। ওর গুহার মুখের এমাথা-ওমাথা করছে শুধু। চোখগুলো অন্ধকারে পান্নার মশালের মতো জ্বলছে। 

‘সারা বিশ্ব, এবং তার সবকিছু আমার ছিল,’ বলল বাঘ। ‘চাঁদ-তারা- সূর্য-গল্প…সব কিছুর মালিক ছিলাম আমিই।’ 

‘বলতে বাধ্য হচ্ছি,’ গুহার পেছন দিক থেকে একটা অনুচ্চ কণ্ঠ বলে উঠল, ‘কথাটা আগেও বলেছ।’ 

পায়চারী থামিয়ে দিল বাঘ; তারপর ঘুরে চলে এলো গুহার শেষ প্রান্তের দিকে, নড়া-চড়া দেখলে মনে হবে: হাইড্রোলিক স্প্রিঙের ওপর পশমের গালিচা বেছানো হয়েছে। পিছিয়ে আসতে আসতে দেখতে পেল ষাঁড়ের লাশ। নিচু কণ্ঠে বলল, ‘কী বললে?’ 

লাশের ভেতর থেকে কিছু একটা নড়া-চড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। ওটার বুকের খাঁচার ভেতর থেকে দেখা গেল একটা নাক। ‘আসলে,’ বলল ওটার মালিক। ‘আমি তোমার সঙ্গে একমত হচ্ছিলাম। আর কিছু না।’

ছোটো ছোটো দুটো হাত দুই পাঁজরের মাঝে থাকা শুকনো মাংস টেনে ছিঁড়ল, পরক্ষণেই দেখা গেল ময়লা তুষার-রঙা একটা ছোট্ট প্রাণী। অ্যালবিনো নেউলে হতে পারে, কিংবা কোনো এক চালাক বেজি যে তার শীতের কোট গায়ে চড়িয়েছে। চোখে তার শবভোজীর দৃষ্টি। 

‘সারা বিশ্ব, এবং তার সবকিছু আমার ছিল, চাঁদ-তারা-সূর্য-গল্প… সব কিছুর মালিক ছিলাম আমিই।’ সঙ্গে যোগ করল। ‘আবার আমার হবে। 

ছোট্ট প্রাণিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাঘ। তারপর, সতর্ক হবার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে, থাবার আঘাতে গুঁড়িয়ে দিল লাশের বুকের খাঁচা। দুর্গন্ধময় অনেকগুলো খণ্ডে পরিণত হলো ওটা, কিন্তু থাবার নিচে আটকে গেল ছোট্ট প্রাণিটা। ছাড়া পাবার জন্য দেহ মোচড়াতে লাগল বটে, কিন্তু লাভ হলো না। 

‘মন দিয়ে শোনো,’ বলল বাঘ, ওর বিশাল নাকটা ছোট্ট প্রাণিটার নাকের সঙ্গে ঠেকাল প্রায়। ‘আমার গুহায় এসেছ তুমি। তাই সাবধান, যদি বিরক্তিকর কিছু বলো তো কামড়ে মাথা ছিঁড়ে ফেলব।’ 

‘হুমফ,’ বেজির মতো প্রাণিটা বলল। 

‘মাথা কামড়ে খেলে ব্যাপারটা পছন্দ হবে না, তাই না?’ 

‘নাহ,’ বলল ছোট্ট প্রাণিটা। চোখ দুটোও হালকা নীল, বরফের দুটো টুকরোর মতো; বিশাল, ওজনদার থাবার নিচে অস্বস্তির সঙ্গে জ্বলছিল ওগুলো। 

‘তাই নিশ্চয়ই কথা দিচ্ছ, ভদ্র আচরণ করবে? চুপ করে থাকবে?’ গড়গড় করে জানতে চাইল বাঘ। থাবার কেবল এতটুকু তুলল, যেন কথা বলতে পারে ছোট্ট প্রাণিটা। 

‘অবশ্যই,’ পরম ভদ্রতার সঙ্গে বলল ছোট্ট, সাদা প্রাণিটা। পরক্ষণেই, একেবারে খাঁটি বেজির মতো, দাঁত বসিয়ে দিল বাঘের থাবায়। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল বাঘ, সরিয়ে নিলো থাবা; ছোট্ট প্রাণিটাকে ছুড়ে দিল বাতাসে। পাথুরে ছাদে আছড়ে পড়ল ওটা, ওখানে বাড়ি খেয়ে আবার পড়ল একটা পাথরের ধারে। সেখান থেকে দৌড়ে পালাতে লাগল ওটা, নোংরা সাদা স্রোতের মতো ছুটে গেল গুহার পেছন দিকে। ওদিকটায় ছাদ নিচু, মেঝের অনেক বেশি নিকটে। তাই ছোট্ট একটা প্রাণির লুকোবার মতো জায়গার অভাব নেই। তুলনামূলক বড়ো আকারের কেউ সেদিকে যেতেও পারবে না। 

তাও, যতটুকু সম্ভব ওদিকে গেল বাঘ। ‘ভাবছিস, আমি অপেক্ষা করতে পারব না?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘কখনও না কখনও তো তোকে দেখা দিতেই হবে। আমিও কোথাও যাচ্ছি না।’ মেঝেতে শুলো বাঘ। চোখ বন্ধ করে নাক ডাকাতে লাগল, ভান করলেও বিশ্বাসযোগ্য হলো তা। 

বাঘ নাক ডাকাতে শুরু করার প্রায় আধ ঘণ্টা পর, ওই ধূসর প্রাণিটা বেরিয়ে এসে ছায়ায় ছায়ায় এগোতে লাগল। একটা বড়ো পাথরের গায়ে তখনও অনেকটা মাংস লেগে আছে, বেজিটার লক্ষ্য সেটাই। হালকা দুৰ্গন্ধ ছড়াচ্ছে বটে, তবে বেজির তা নিয়ে আপত্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে ওটার কাছে পৌঁছুতে হলে, প্রকাণ্ড বিড়ালটাকে অতিক্রম করতে হবে। ছায়ায় লুকিয়ে, ছোট্ট ও নীরব পা ফেলে এগোতে লাগল আবার। 

ঘুমন্ত বাঘটাকে অতিক্রম করে ফেলেছে প্রায়, এমন সময় ছোবল বসাল তার সামনের থাবা। বেচারা নেউলের লেজে বিধল তার নখর। আরেকটা থাবা বসল ওটার ঘাড়ের ওপর। প্রকাণ্ড পশুটা চোখ খুলল। ‘দেখা যাচ্ছে,’ বলল সে। ‘সঙ্গী বলতে এখন আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুধু আমাদেরকেই পাবো। তাই চাইব, তুমি খানিকটা হলেও সমঝদারের মতো আচরণ করো। আমাদের দুজনকে সেই চেষ্টা করে যেতে হবে। মনে হয় না কখনও বন্ধুত্ব হবে আমাদের মাঝে, তবে হয়তো একে-অন্যকে সহ্য করতে পারব।’ 

‘তোমার কথা বুঝতে পারছি,’ বেজির মতো জীবটা বলল। ‘ভিক্ষার চাল, কাঁড়া আর আকাঁড়া!’ 

‘আমি তো এই কথাটাই বলছি,’ বলল বাঘ। ‘কখন চুপ করে থাকতে হবে, সেটা তোমার শিখতে হবে।’ 

‘দোষ বাজে হাওয়ার,’ বলল ছোট্ট প্রাণিটা। ‘যা কারও কাজে আসে না।’ 

‘আবার বিরক্ত করছ আমাকে,’ বলল বাঘ। ‘সাবধান করে দিলাম একটু আগে, আমাকে বিরক্ত কোরো না। আমিও বিনিময়ে তোমার মাথা চিবিয়ে খাবো না।’ 

‘বারবার একই কথা বলছ, আমার মাথা খাবে। ধরে নিচ্ছি, রূপক অর্থে বলছ কথাটা? বোঝাতে চাচ্ছ যে হয় চিল্লাচিল্লি করবে, কিংবা রাগ করবে…তাই তো?’ 

‘উঁহু, প্রথমে মাথাটা ছিঁড়ব। তারপর সেটা চিবিয়ে চিবিয়ে নরম করে গিলে খাবো,’ জানাল বাঘ। ‘আনানসির সন্তানদের আগে ভুলে যেতে হবে যে আমরা এখানে আছি, তারপর মুক্তি পাবো। ওই হারামজাদা যেভাবে সব সাজিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে–তোমাকে যদি সকালে হত্যাও করি, তাহলে বিকেলের আগেই পুনর্জন্ম হবে এই নারকীয় গুহায়। তাই বলছি, বিরক্ত কোরো না আমাকে।’ 

ছোট্ট, সাদা প্রাণিটা বলল। ‘আহ, ঠিক আছে। দিন আসে—’

‘যদি দিন যায় বলো,’ সাবধান করে দিল বাঘ। ‘তাহলে খুবই বিরক্ত হবো। তার ফলাফল হবে খুবই মারাত্মক। তাই… বিরক্তিকর… কিচ্ছু… বোলো… না। বুঝতে পারলে?’ 

দুনিয়ার শেষ মাথায় অবস্থিত গুহায় নেমে এলো ক্ষণিকের নীরবতা। সেটা ভাঙল নিচু একটা কণ্ঠে, ‘পুবশ্যই।’ 

‘আউ!’ বলতে শুরু করল ওটা। কিন্তু শব্দটা শুরু হবার আগেই থেমে গেল। 

তার জায়গায় শোনা গেল কচকচ করে চিবানোর গল্প। 

.

বইপত্রে আর গল্প-উপন্যাসে কফিনের ব্যাপারে যে ব্যাপারটা লেখা থাকে না – কেননা লিখলেও সেটা যাদের জন্য কেনা হচ্ছে তাদের কিছু যায় আসে না— তা হলো: ওগুলো আসলে কতটা আরামদায়ক। 

নিজের কফিন নিয়ে দারুণ সন্তুষ্ট মি. ন্যান্সি। উত্তেজনা ফুরিয়ে গেছে বলে, এখন আবার কফিনে ফিরে এসে আরামসে ঘুমাচ্ছে সে। যখনই ঘুম ভেঙে যায় আর মনে পড়ে কোথায় আছে, তখনই আবার ঘুমিয়ে পড়ে। 

কবরটা, যার কথা আগেই বলা হয়েছে, দারুণ একটা জায়গা। সেই সঙ্গে বেশ নির্জনও। তাই বিশ্রাম নেওয়ার স্থান হিসেবে আদর্শ। মাটির ছয় ফুট নিচের সঙ্গে অন্য কোনো জায়গার তুলনা হয় না। আরও বছর বিশেক এভাবেই কাটিয়ে দেবে, ঠিক করল সে। তারপর বাইরে বেরোবার কথা ভাবা যাবে। 

যখন শেষকৃত্যানুষ্ঠান শুরু হলো, তখন এক চোখ খুলল সে। 

ওপরে উপস্থিত মানুষদের কণ্ঠ ভেসে আসছে : কেলিঅ্যান হিগলার, বাস্টামন্টে আর ওই পাতলা-সাতলা মহিলাটা। সেই সঙ্গে নাতি-নাতনী, পর- নাতি এবং পর-পর-নাতির দঙ্গল। মিসেস ডানউইডির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে বেচারারা। 

মি. ন্যান্সি একবার ভাবল, কবরের ভেতর থেকে হাত বের করে কেলিঅ্যান হিগলারের গোড়ালি আঁকড়ে ধরবে কি না। প্রায় বছর তিরিশেক আগে, একটা ড্রাইভ-ইনে ক্যারি[৩৮] দেখার পর থেকেই কাজটা করার ইচ্ছে জন্মেছিল তার মনে। কিন্তু এখন সুযোগ পেয়েও সামলে রাখল নিজেকে। সত্যি বলতে কী, কাজটা করার আগ্রহই পাচ্ছে না। করলে কী হবে? চেঁচাবে মহিলা, হার্ট অ্যাটাক করে মরেও যেতে পারে। তাতে দ্য গার্ডেন অভ রেস্টে ভিড় বাড়বে বই কমবে না। 

[৩৮. স্টিফেন কিং-এর বিখ্যাত অনুসারে বানানো মুভি।]

কাজটা করতেও কষ্ট হবে। মাটির নিচে ঘুমিয়ে দেখার মতো অনেক স্বপ্ন আছে। বিশ বছর, ভাবল সে। কিংবা হয়তো পঁচিশ। ততদিনে তার নাতি- নাতনিও জন্ম নিতে পারে। নাতিরা মানুষ হিসেবে কেমন হয়, তা দেখাটা মজারই হবে। 

কেলিঅ্যান হিগলারের বিলাপ আর কান্না শুনতে পাচ্ছে পরিষ্কার। তবে কান্নাটা বেশ খানিকক্ষণের জন্য থামিয়ে ঘোষণা করল, ‘তারপরেও, ওর জীবনটা যেমন লম্বা ছিল তেমনই ছিল ভালো। আমাদের কাছ থেকে যখন বিদেয় নেয়, তখন তার বয়েস হয়েছিল একশো তিন!’ 

‘একশো চার!’ মি. ন্যান্সির পাশ থেকে বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল একটা কণ্ঠ। 

মি. ন্যান্সি বিমূর্ত একটা হাত বাড়িয়ে টোকা দিল নতুন কফিনের এক পাশে। ‘মুখ বন্ধ করো, মেয়েমানুষ,’ গর্জে উঠল সে। ‘কেউ কেউ ঘুমাতে চাইছে!’ 

.

পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে রোজি; ওর ইচ্ছা: স্পাইডার একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে নিক। এমন কোনো চাকরি যেখানে সকালে উঠতে হয়, যার উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎ আছে। 

তাই একদিন সকালে, রোজি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার আগে, সকাল সকাল উঠে শহরের লাইব্রেরিতে চলে গেল স্পাইডার। লাইব্রেরির কম্পিউটার ব্যবহার করে ইন্টারনেটে ঘোরা-ফেরা করতে লাগল সে। পরম সাবধানতার সঙ্গে গ্রাহাম কোটসের যে অ্যাকাউন্টের নাগাল বেশি কিছু দেশের পুলিস পায়নি, সেগুলো ফাঁকা করে দিল। আর্জেন্টিনার স্টাড-ফার্মটা[৩৯] বিক্রি করে দিল সে, তারপর একটা ছোটোখাটো কোম্পানি কিনে নিয়ে তাতে টাকাগুলো ঢালল। দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওকে গণ্য করার জন্য আবেদন জানাল সরকারের কাছে। একটা ই-মেইল পাঠাল তারপর, রজার ব্রনস্টেইন নামে। এক উকিলকে ভাড়া করল সদ্য প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনটার দেখভাল করার জন্য। পরামর্শ দিল—সেই উকিলের উচিত হবে লন্ডনের মিসেস রোজি নোয়াহ, যে বর্তমানে সেন্ট অ্যান্ড্রুজে আছে, তাকে ভালো কিছু করার জন্য কাজে লাগানো। 

[৩৯. যেখানে পোষা প্রাণির প্রজনন বেছে বেছে করা হয়।]

রোজিকে চাকরি দেওয়া হলো, তার প্রথম কাজ হলো অফিসের জন্য জায়গা খোঁজা। 

পরবর্তী চারটা দিন স্পাইডার কাটিয়ে দিল হেঁটে (আর রাতে ঘুমিয়ে), দ্বীপটাকে প্রায় পুরোটা ঘিরে রেখেছে যে সৈকত সেটায়। পথে যতগুলো খাবারের দোকান পড়ল, সবগুলোর স্বাদ নিলো সে। ডসন’স ফিস শ্যাক-এ এসে, প্রথমে খেল ভাজা ফ্লাইং ফিশ। তারপর সিদ্ধ করা সবুজ ডুমুর, গ্রিলড চিকেন আর নারিকেলের পিঠা। অতঃপর রান্নাঘরে গিয়ে খুঁজে বের করল রাঁধুনিকে। দোকানের মালিকও সেই লোকটিই। তাকে দোকানের অংশীদারিত্ব আর রান্না-বান্না শেখার জন্য পয়সা দেবার প্রস্তাব দিল স্পাইডার। 

ডসন’স ফিশ শ্যাক এখন রেস্তোরাঁ হয়ে গেছে, মি. ডসনও অবসর নিয়েছে। কখনও কখনও রেস্তোরাঁ সামলায় স্পাইডার, কখনও আবার কিচেনে সময় কাটায়: আপনি যদি ওখানে গিয়ে স্পাইডারের খোঁজ করেন, তাহলে অবশ্যই পাবেন। দ্বীপের মাঝে শ্রেষ্ঠ খাবার পাওয়া যায় ওখানে। আগের চাইতে একটু মুটিয়ে গেছে স্পাইডার; যদি নিজের রান্না করা সব খাবার চেখে দেখা বন্ধ না করে, তাহলে আরও মোটা হবে। 

তাতে অবশ্য রোজির কোনো আপত্তি নেই। 

কখনও শিক্ষকতা করে সে, কখনও অন্যদেরকে সাহায্য করে। তবে ভালো কাজ করে অনেক। লন্ডনের অভাব বোধ করলেও, তা প্রকাশ করে না। রোজির মা অবশ্য তা চেপে রাতে পারে না। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ উঠলেই সেটাকে ধরে নেয় ষড়যন্ত্র হিসেবে, তাকে তার জন্ম-না-নেওয়া (এবং আসলে মায়ের গর্ভেই না আসা) নাতি কিংবা নাতনির কাছ থেকে দূরে সরাবার। 

এই লেখক যদি আপনাকে জানাতে পারত যে রোজির মা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে নতুন মানুষে পরিণত হয়েছে, তাহলে তার চাইতে বেশি খুশি আর কেউ হতো না। কিন্তু মহিলা না হাসিখুশি মানুষে পরিণত হয়েছে, আর না তার মুখ থেকে মানুষের জন্য দয়ার্দ্র শব্দ বেরোয়। এমনকী খাবারের প্রতিও রুচি বৃদ্ধি হয়নি তার। আফসোসের কথা হলো, পরিপূর্ণ সততার সঙ্গে কথা বলতে গেলে বলতে হবে—রোজির মা হাসপাতাল থেকে যখন বেরোয় তখন সে রোজির মা-ই ছিল; আগের মতোই সন্দিগ্ধ। তবে হ্যাঁ, আগের চাইতে দুর্বল হয়ে গেছে অনেক; আর আজকাল ঘুমানোর সময় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয় তাকে। 

সে ঘোষণা করেছে: লন্ডনের ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দেবে। দুনিয়ার যেখানেই স্পাইডার আর রোজি যাক না কেন, সঙ্গী হবে তাদের; থাকবে নিজের নাতি- নাতনির কাছে। কিছু দিন কেটে গেলে, ধীরে ধীরে নাতি-নাতনি না হওয়ার ব্যাপারটা খোঁচা দিতে লাগল সে মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে। প্রশ্ন তুললে স্পাইডারের শুক্রাণুর স্বাস্থ্য, ওদের মেলামেশার ব্যাপারে; এমনকী ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনে যে খরচ আজকাল বেশি হয় না, সেটাও বলতে পিছ পা হলো না। মাঝে মাঝে তো এতটাই বিরক্তি পেয়ে বসত স্পাইডারকে, যে কেবল শাশুড়িকে খেপাবার জন্য হলেও আলাদা বিছানায় শোবার চিন্তা ভর করত তার মাথায়। এক বিকেলে এগারো সেকেন্ডের জন্য ভাবল কথাটা; রোজির মা তখন ওকে দেখাচ্ছিল ম্যাগাজিনের একটা প্রবন্ধের ফটোকপি, যেটায় লেখা— রোজির আসলে রতিক্রিয়ার পর মাথায় ভর দিয়ে আধ ঘণ্টা থাকা উচিত। রাতে যখন ব্যাপারটা রোজিকে সে বলল, তখন মেয়েটা হেসে বলল—ওদের শোবার ঘরে মায়ের প্রবেশের অনুমতি নেই। তাছাড়া, প্রেমের খাটাখাটুনির পর আধ ঘণ্টা ওভাবে থাকার কোনো ইচ্ছেই তার নেই! 

উইলিয়ামসটাউনে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে মিসেস নোয়াহ, স্পাইডার আর রোজির বাড়ির কাছেই। সপ্তাহে দুইবার কেলিঅ্যান হিগলারের অগণিত ভাতিজি যায় ওখানে। ময়লা পরিষ্কার করে, মুছে রাখে কাচের ফলগুলো (দ্বীপের প্রচণ্ড গরমে মোমের ফল গলে যায়), রান্না-বান্না করে খাবার রেখে দেয় ফ্রিজে। 

কখনও কখনও রোজির মা তা খায়… আবার কখনও খায় না। 

.

চার্লি আজকাল গান গেয়ে দিন কাটায়। দেহের নরম মেদের অনেকটাই ঝরে পড়েছে, এখন একেবারে পোক্ত দেহের অধিকারী ও। ফেডোরা হ্যাট ওর প্রতীকে পরিণত হয়েছে। নানা রকম ফেডোরা আছে ওর, নানা রঙের; যদিও ওর পছন্দের রং সবুজ। 

একটা ছেলে হয়েছে চার্লির। মার্কাস নাম ওর, বয়েস সাড়ে চার। শুধুমাত্র ছোটো ছোটো বাচ্চা পাহাড়ি গরিলারা যে ভারিক্কী ভাব ধরে রাখতে সক্ষম হয়, সেটা ওর মাঝে পুরোপুরিই আছে। 

কেউ আর এখন চার্লিকে ‘মোটকু চার্লি’ বলে ডাকে না। সত্যি বলতে কী, ডাকটা ও মিসই করে। 

গ্রীষ্মের এক সকালের কথা, ততদিনে দিনের আলো ছড়াতে শুরু করেছে। পাশের কামরা থেকে আওয়াজ আসছে। ডেইজিকে ঘুমুতে দিল চার্লি, বিছানা থেকে নেমে পরে নিলো টি-শার্ট আর শর্টস। দরজা দিয়ে বেরিয়ে ছেলের কামরায় ঢুকতেই দেখতে পেল: মেঝেতে বসে কাঠের একটা ছোট্ট ট্রেন সেট নিয়ে খেলছে মার্কাস, ন্যাংটো হয়ে। একসঙ্গে টি-শার্ট, শর্টস আর ফ্লিপ ফ্লপ জুতো পরে সৈকতে রওনা হলো ওরা। 

তবে তার আগে মাথায় হ্যাট গলাতে ভুল করল না চার্লি। 

‘ড্যাডি,’ বলল ছেলেটা। ওর চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে বসে গেছে, কিছু একটা ভাবছে। 

‘বলো, মার্কাস।’ 

‘সবচাইতে ক্ষীণ রাষ্ট্রপতি কে ছিল?’ 

‘লম্বায়?’ 

‘নাহ, দিনের হিসেবে। মানে সবচাইতে কম সময়ের জন্য রাষ্ট্রপতি হয়েছিল কে?’ 

‘হ্যারিসন। শপথ গ্রহণের সময় নিউমোনিয়া হয় তার, তারপর মারা যান। চল্লিশ দিনের কিছু বেশি সময় ছিলেন ক্ষমতায়, তার মাঝে বেশিরভাগ দিন কেটেছে বিছানায় শুয়ে।’ 

‘তাহলে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কে ছিল?’ 

‘ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট। পুরো তিন টার্ম দেশ চালিয়েছেন তিনি। চতুর্থ টার্ম চলাকালীন সময়ে মারা যান। আমরা এখন জুতো খুলে ফেলব।’ 

একটা পাথরে জুতো রেখে, ঢেউয়ের দিকে হাঁটতে লাগল ওরা। পায়ের আঙুলগুলো দিয়ে খেলতে লাগল ভেজা বালু ব্যবহার করে। 

‘প্রেসিডেন্টদের ব্যাপারে এত কিছু কীভাবে জানো?’ 

‘কেননা আমার বাবার ধারণা ছিল—ছেলেবেলায় আরকী—তাদের সম্পর্কে জানলে পরে কাজে দেবে।’ 

‘ওহ!’ 

পানিতে নামল ওরা, এগোল একটা পাথরের দিকে। একমাত্র ভাটার সময় দেখা যায় ওটাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর, ছেলেটাকে তুলে নিয়ে কাঁধে বসাল চার্লি। 

‘ড্যাডি?’

‘হ্যাঁ, মার্কাস।’ 

‘পু’চনা বলে, তুমি নাকি বিখ্যাত?’ 

‘পেটুনিয়া কে?’ 

‘আমার প্লে-গ্রুপে আছে। সে বলে, ওর মায়ের কাছে নাকি তোমার সব সিডি আছে। এমনকী তোমার গানের বড়ো ভক্ত সে।’ 

‘আহ।’ 

‘তুমি আসলেই বিখ্যাত?’ 

‘অল্প একটু, খুব বেশি না।’ মার্কাসকে পাথরের ওপর বসিয়ে দিল সে। তারপর নিজেও উঠে এলো ওটার ওপরে। ‘যাক, গান গাওয়ার জন্য প্রস্তুত?’ 

‘হ্যাঁ।’ 

‘কোন গানটা গাইতে চাও?’ 

‘আমার সবচাইতে পছন্দের গানটা।’ 

‘গানটা ওর পছন্দ হবে কি না, সেটাই তো আমরা জানি না!’ 

‘পছন্দ করবে।’ পাহাড় কিংবা দেওয়ালের মতোই নিরেট মার্কাসের আত্মবিশ্বাস। 

‘বেশ তাহলে। এক, দুই, তিন…’ 

একসঙ্গে ‘হলদিয়া পাখি’ গাইল ওরা, ওই সপ্তাহের জন্য সেটাই মার্কাসের পছন্দের গান। তারপর গাইল ‘জোম্বি জাম্বুরি’, যেটা ছেলেটার পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় নাম। এরপর শুরু করল তৃতীয় পছন্দ—সি উইল বি কামিং রাউন্ড দ্য মাউন্টেন। মার্কাসের দৃষ্টিশক্তি চার্লির চাইতে প্রখর। তাই গানটা শেষ হবার আগেই দেখতে পেল মেয়েটাকে, হাত নাড়তে লাগল। 

‘ওই যে সে, ড্যাডি।’ 

‘তুমি নিশ্চিত?’ 

সকালের আলো ভালো মতোই ছড়াতে শুরু করেছে, তাই সাগর আর আকাশ মিলিত হয়েছে দিগন্তে; পাণ্ডুর সাদা একটা রেখার মতো করে। সেদিকে চোখ পিটপিট করে চাইল চার্লি, ‘আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না!’ 

‘পানির নিচে ডুব দিয়েছে। আবার দেখা দেবে।’ 

পানি ছলকানোর আওয়াজ হলো একটা, পরক্ষণেই ওদের নিচে দেখা দিল মেয়েটা। একটু লাফিয়ে, দেহটাকে একটু মোচড় খাইয়ে আর একটা পাক খেয়ে ওদের পাশের পাথরে বসে পড়ল সে। মৎস্য কন্যাটার রূপালি লেজ আটলান্টিকের পানিতে নাড়ছে, পানির বিন্দু ভিজিয়ে দিচ্ছে আঁশগুলোকে। লম্বা, কমলা-লাল চুল তার। 

একসঙ্গে গান গাইতে লাগল ওরা: পুরুষ, বাচ্চা ছেলে আর মৎস্য-কন্যা। গাইল ওরা ‘দ্য লেডি ইজ আ ট্রাম্প’ এবং ‘হলদে সাবমেরিন’। অতঃপর মৎস্য-কন্যাকে ফ্লিনস্টোন শুরু হবার গানের পঙক্তি শোনাল মার্কাস। 

‘ওকে দেখতে তোমার কথা মনে পড়ে যায়,’ চার্লিকে বলল মৎস্য-কন্যা। ‘মানে যখন তুমি ছোটো ছিলে।’ 

‘আমাকে চিনতে তখন?’ 

হাসল মেয়েটা। ‘সৈকত ধরে হাঁটতে তুমি আর তোমার বাবা। তোমার বাবা,’ যোগ করল সে। ‘ভদ্রলোক ছিল।’ মৎস্য কন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, অন্য যে কারও চাইতে কাজটা সে ভালো পারে। ‘এখন ফিরে যাও, জোয়ার শুরু হবে।’ লম্বা চুলগুলো পেছনে সরিয়ে, ঝাঁপ দিল সে সাগরে। ঢেউয়ের ওপর মাথা তুলে, আঙুল দিয়ে স্পর্শ করল ঠোঁট। তারপর মার্কাসের দিকে একটা চুমু ছুড়ে দিয়ে, ডুব দিল পানিতে। 

ছেলেকে আবার কাঁধে বসাল চার্লি। সাগরের পানির ভেতর দিয়েই ফিরতি পথ ধরল সে, সৈকতে ফিরে এলে ওর কাঁধ থেকে পিছলে বালুতে নামল মার্কাস। চার্লি ওর মাথা থেকে ফেডোরা হ্যাটটা খুলে, পরিয়ে দিল ছেলেকে। বাচ্চাটার মাথার তুলনায় আকারে অনেক বড়ো ওটা, তবে হাসি ফুটে উঠল মার্কাসের মুখে। 

‘একটা জিনিস দেখতে চাও?’ প্রশ্ন করল চার্লি। 

‘দেখাও, তবে খিদে লেগেছে। নাস্তায় প্যানকেক চাই। নাহ, ওটমিল খাবো। থাক থাক, প্যানকেকই সই।’ 

‘এই দেখো,’ খালি পায়েই বালু-নাচ শুরু করল চার্লি। 

‘আমিও পারব,’ জানাল মার্কাস। 

‘তাই নাকি?’ 

‘দেখো, ড্যাডি।’ 

আসলেও পারল ছেলেটা। 

একসঙ্গে বাপ আর বেটা মিলে বালুর ওপর নাচতে নাচতে বাড়ি ফেরার পথ ধরল। যেতে যেতে ওরা গাইল শব্দহীন গান, যেটা চলতে চলতেই বানাচ্ছে। 

ওরা নাস্তা খেতে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেও বাতাসে ভেসে রইল সেই গানের রেশ। 

—সমাপ্ত— 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *