অধ্যায় এগারো – যেখানে রোজি অপরিচিতদের না বলতে শিখল এবং মোটকু চার্লি পেল সময়

অধ্যায় এগারো – যেখানে রোজি অপরিচিতদের না বলতে শিখল এবং মোটকু চার্লি পেল সময় 

বাপের কবরের দিকে চাইল মোটকু চার্লি। ‘আছো তো ভেতরে?’ উচ্চকণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিল সে। ‘যদি থাকো, তাহলে বেরিয়ে এসো। কথা বলা দরকার তোমার সঙ্গে।’ 

কবর ফলকের কাছে গিয়ে নিচের দিকে চাইল ছেলেটা। কী ঘটবে বলে আশা করছে তা নিজেই জানে না—মাটির নিচ থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে ওর পা আঁকড়ে ধরবে? তেমন কিছু তো ঘটছে না! 

অথচ সম্ভাবনাটা যথেষ্ট জোরাল মনে হয়েছিল ওর কাছে। 

দ্য গার্ডেন অভ রেস্ট থেকে বেরিয়ে যাবার সময়, নিজেকে বোকার হদ্দ মনে হলো মোটকু চার্লির। তাও আবার এমন এক বোকা, যে গেম শোতে গিয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেছে: আমাজনের চাইতে মিসিসিপি নদী বড়ো! শুধু তাই না, প্রশ্নটা ছিল মিলিয়ন ডলার জেতার জন্য! ওর আসলে আগেই বুঝতে পারা উচিত ছিল, বহু আগেই মরে ভূত হয়ে গেছে ওর বাবা; স্পাইডারের পয়সা খরচ করেছে মরীচিকার পেছনে ছুটে! বেবিল্যান্ডের বায়ুকলের পাশে বসে কাঁদতে লাগল বেচারা, মরিচা পড়তে থাকা খেলনাগুলোকে ওর স্মৃতির চাইতে অনেক বেশি বিষণ্ণ আর একাকী মনে হতে লাগল। 

মহিলা ওর জন্যই অপেক্ষা করছে, পার্কিং লটে। গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অস্বস্তিতে ভুগছে মহিলা। 

‘হ্যালো, মিসেস বাস্টামন্টে,’ বলল মোটকু চার্লি 

সিগারেটে শেষ একটা টান দিয়ে, ওটাকে অ্যাঙ্কল্টে ফেলে দিল মহিলা; তারপর ফ্ল্যাট জুতা দিয়ে চেপে আগুন নেভাল। কালো পোশাক পরে আছে সে, ক্লান্তি ভর করেছে চোখে-মুখে। ‘হ্যালো চার্লস।’

‘মিসেস হিগলার, কিংবা মিসেস ডানউইডি আসলেও অবাক হতাম না। কিন্তু তুমি?’ 

‘কেলিঅ্যান অনেক দূরে কোথাও গেছে। মিসেস ডান উইডি আমাকে পাঠাল, তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’ 

মাফিয়ার মতো, ভাবল মোটকু চার্লি। বুড়িদের মাফিয়া। ‘আমাকে এমন একটা প্রস্তাব দেবে, যা মেনে নিতে বাধ্য হব?’ 

‘সন্দেহ আছে, ওর শরীর ভালো যাচ্ছে না।’ 

‘ওহ।’ 

নিজের ভাড়া করা গাড়িটায় উঠে বসল সে, অনুসরণ করল মিসেস বাস্টামন্টের ক্যামরি গাড়িটাকে; ফ্লোরিডার রাস্তা ধরে। বাবার বেঁচে থাকার ব্যাপারে বলতে গেলে নিশ্চিতই ছিল সে। ভেবেছিল তাকে জীবিত দেখতে পাবে। সাহায্য পাওয়া যাবে তার কাছে… 

মিসেস ডানউইডির বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করল ওরা। প্রাঙ্গণের দিকে তাকাল মোটকু চার্লি। ঝলসে যাওয়া প্লাস্টিকের ফ্ল্যামিঙ্গো, পুতুল, আর লাল রঙা কাচের তৈরি বলটা বসে আছে একটা ছোট্ট, কংক্রিটের বেদি মতো স্থানে। ক্রিসমাসের সময় এভাবে গাছ সাজানো হয়। বলটার দিকে এগিয়ে গেল সে, 

এমনই একটা ভেঙেছিল ছেলেবেলায়। আয়নার কাচ দিয়ে বানানো বলে নিজের বিকৃত একটা রূপ দেখতে পেল ওতে। 

‘এইটা দিয়ে লাভ কী?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস বাস্টামন্টেকে। 

‘এমনিতেই রাখা, কোনো কারণ নেই। পছন্দ করে জিনিসটাকে।’ 

বাড়ির ভেতরে ধুনোর গন্ধ ভারী হয়ে ভাসছে। মোটকু চার্লির দূর- সম্পর্কের আত্মীয়া অ্যালান্না, হ্যান্ডব্যাগে সবসময় ধুনোর ক্যান্ডি রাখতেন; মোটাসোটা আর চকলেটপ্রেমী খুদে মোটকু চার্লিও ওসবের দিকে বাধ্য না হলে হাত বাড়াত না। বাড়িটা থেকে ওই ক্যান্ডিগুলোর মতো গন্ধ ভেসে আসছে। বিগত বিশ বছরে ‘ওই ক্যান্ডির কথা ভাবেনি সে একবারও; এখন ভাবছে– আজও কি কোম্পানিটা বানায় ওগুলো? তার চাইতে বড়ো প্রশ্ন, আগে কেন বানাতো…? 

‘হলের শেষ মাথায় ওর ঘর,’ মিসেস বাস্টামন্টে জানাল। সেই সঙ্গে ইঙ্গিতে দেখিয়েও দিল। মিসেস ডানউইডির শোবার ঘরে পা রাখল মোটকু চার্লি। 

বিছানাটা খুব একটা বড়ো না, কিন্তু তাতে শুয়ে থাকা মিসেস ডানউইডিকে ফোলানো পুতুল বলে মনে হচ্ছে। চোখে চশমা আছে মহিলার, তার ওপরে আছে লেস লাগানো একটা হলদে টুপি যাকে বলে—নাইটক্যাপ। জীবনে এই প্রথমবারের মতো নাইটক্যাপ দেখল মোটকু চার্লি। মহিলা একগাদা বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে, মুখটা খোলা। নাকটাও হালকা ডাকাচ্ছে। 

কাশল মোটকু চার্লি। 

ঝট করে মাথা তুলে ধরল মিসেস ডানউইডি, চোখ খুলে তাকাল ওরই দিকে। বিছানার পাশে থাকা নাইটস্ট্যান্ডটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতেই, মোটকু চার্লি তাতে থাকা পানির গ্লাসটা তুলে এগিয়ে দিল মহিলার দিকে। দুই হাত দিয়ে গ্লাসটা ধরল মহিলা, যেভাবে বাদাম ধরে কাঠবেড়ালি। তাতে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে আবার ফিরিয়ে দিল। 

‘গলা একেবারে শুকিয়ে গেছিল,’ জানাল মহিলা। ‘বয়েস কতো হয়েছে, তা জানো?’ 

‘উম,’ অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো মোটকু চার্লি—এই প্রশ্নের সঠিক কোনো জবাব নেই। ‘নাহ।’ 

‘একশো হয়ে আরও চার।’ 

‘তাই নাকি? অথচ দেখে মনে হয় না। মানে বলতে চাচ্ছি যে—’

‘চুপ করো, মোটকু চার্লি।’ 

‘দুঃখিত।’ 

‘ওভাবে ক্ষমা চাওয়ারও কিছু হয়নি। রান্নাঘরের মেঝেতে হাগু করলে কুকুর এভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে চায়। মাথা উঁচু করে রাখো, সরাসরি তাকাও দুনিয়ার চোখে। শুনলে আমার কথা?’ 

‘হ্যাঁ। দুঃখিত। মানে বলতে চাচ্ছিলাম, ঠিক বলেছেন।’ 

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহিলা। ‘সবাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চায়। ওদেরকে বললাম, একশো চার বছর বেঁচে থাকার পর, নিজের বিছানায় মরার অধিকার আপনা-আপনি জন্মে যায়। বহু বছর আগে এই বিছানায় বাচ্চা পয়দা করেছি, অনেক বাচ্চাকে এনেছি দুনিয়াতে। তাই অন্য কোথাও মরার প্রশ্নই ওঠে না। আরেকটা কথা…’ কথা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করল সে। তারপর লম্বা শ্বাস নিলো একটা। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে মোটকু চার্লি যখন ধরেই নিয়েছিল যে মহিলা ঘুমিয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই চোখ খুলে বলল মিসেস ডান উইডি। ‘মোটকু চার্লি, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে যে তুমি একশো চার বছর বয়েস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চাও কি না, তাহলে জবাবে না বলো। সব কিছু ব্যথায় জর্জরিত…সব কিছু। এমন সব জায়গায় ব্যথা লাগছে, যেসব জায়গা কেউ আবিষ্কারই করেনি!’ 

‘পরামর্শটা মাথায় রাখব।’ 

‘মুখে মুখে কথা বলবে না।’ 

সাদা, কাঠের বিছানায় শুয়ে থাকা ছোটোখাটো মহিলার দিকে তাকাল মোটকু চার্লি। ‘দুঃখ প্রকাশ করব?’ জানতে চাইল সে। 

অন্য দিকে নজর ফেরাল মিসেস ডানউইডি। ‘আমি তোমার সঙ্গে অবিচার করেছি,’ বলল সে। ‘অনেক অনেক আগের কথা বলছি।’ 

‘তা জানি,’ বলল মোটকু চার্লি। 

হয়তো মরতে বসেছে মিসেস ডানউইডি, কিন্তু এমনভাবে তাকাল মোটকু চার্লির দিকে যে নজরের সামনে পড়লে পাঁচ বছরের নিচের যেকোনো বাচ্চা কেঁদে-কেটে মায়ের কোলে আশ্রয় নিত! ‘জানি মানে কী?’ 

জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘দুইয়ে দুই মিলিয়েছি। হয়তো সব বুঝতে পারিনি, কিন্তু বুঝেছি অনেকটাই। আমি বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী নই!’ 

পুরু কাচের চশমার ওপাশ থেকে ছেলেটাকে মন দিয়ে দেখল মহিলা। ‘না, তা তুমি নও।’ কুঁচকে যাওয়া একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে। ‘পানিটা আবার দাও।’ গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিল তাতে, ছোট্ট-বেগুনি জিভ দেখা দিল। ‘আজ তুমি এখানে এসেছ, তাতে ভালোই হয়েছে। কাল এই বাড়িটা ভরে উঠবে নাতি-পুতিতে। আফসোসের সঙ্গে সবাই বোঝাতে চাইবে, হাসপাতালে মরা উচিত আমার। চাইবে আমাকে ভজিয়ে-ভাজিয়ে জিনিসপত্র বাগাতে। কিন্তু ওরা আমাকে চেনে না। আমার নিজের পেটের বাচ্চা-কাচ্চারা মরে গেছে, কিন্তু আমি বেঁচে আছি।’ 

মোটকু চার্লি বলল, ‘অবিচারের প্রসঙ্গে কিছু বলবেন?’ 

‘আমার বাগানের আয়নার বলটা ভাঙা তোমার উচিত হয়নি।’ 

‘আমিও তাই মনে করি।’ 

ঘটনাটা মনে করল মোটকু চার্লি, যেভাবে মানুষ ছোটোবেলার স্মৃতি স্মরণ করে: খানিকটা স্মৃতি, খানিকটা স্মৃতির স্মৃতি। টেনিস বলকে অনুসরণ করে 

মিসেস ডানউইডির প্রাঙ্গণে পা রাখা, তারপর কৌতূহলী হয়ে আয়নার বলটাকে উঠিয়ে তাতে নিজের বিকৃত চেহারা দেখা, পরক্ষণেই টের পাওয়া যে হাত ফসকে ওটা নিচে পড়ে যাচ্ছে, বলটাকে শত শত ভাগ হয়ে যেতে দেখা। বুড়ো, কিন্তু শক্তিশালী আঙুলগুলোর চাপ অনুভব করল কানে; টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে বাড়ির দিকে… 

‘স্পাইডারকে তুমিই ভাগিয়েছিলে,’ বলল সে। ‘তাই না?’ 

যান্ত্রিক বুলডগের মতো শক্ত হয়ে এঁটে বসল মহিলার চোয়াল। মাথা নেড়ে বলল সে, ‘হ্যাঁ, আমি বিতাড়নের একটা জাদু চালিয়েছিলাম। কিন্তু এত কিছু হয়ে যাবে তা ভাবিনি। তখনকার দিনে সবাই একটু-আধটু জাদু জানত। ডিভিডি, সেল ফোন আর মাইক্রোওয়েভের জমানা ছিল না ওটা, তবে যা ছিল তাও কম না। তোমাকে একটা শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল শুধু। খুবই অহংকারী ছিলে, দুষ্টামি করতে; কথার পিঠে তর্কও করতে। তাই স্পাইডারকে তোমার ভেতর থেকে বের করে আনি, তোমাকে মজা বোঝাতে।’ 

শব্দগুলো শুনল বটে মোটকু চার্লি, কিন্তু অর্থ ধরতে পারল না। ‘আমার ভেতর থেকে বের করে এনেছ…মানে?’ 

‘তোমাকে ওর কাছ থেকে মুক্তি দেই। ও তোমার ধূর্ত সত্তা, তোমার ভেতরকার সব অন্যায়… বুঝতেই পারছ, ‘ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহিলা। ‘আমারই 

ভুল। কেউ বলেনি যে তোমার বাবার বংশধরের মতো কারও ওপর জাদু করলে, সেটার মাত্রা ও গভীরতা অনেক গুণে বেড়ে যায়। সব কিছু পায় চরম রূপ!’ আরেক চুমুক পানি পান করল সে। ‘তোমার মা কখনও বিশ্বাসই করেনি আমার কথা। কিন্তু ওই স্পাইডার, তোমার তুলনায় হাজারগুণে খারাপ। স্পাইডারকে আমি তাড়িয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তোমার বাবা কিছুই বলেনি। তারপর এই প্রসঙ্গ উঠলেই বলত: এই সমস্যার সমাধান যদি তুমি করতে না পারো, তাহলে আসলে তুমি ওর ছেলেই নও! 

তর্ক করতে চাইল মোটকু চার্লি, বলতে চাইল—অর্থহীন কথা বলছে মহিলা, স্পাইডার ওর অংশ হতেই পারে না। যেমন সে নিজে সাগর কিংবা অন্ধকারের অংশ নয়। কিন্তু বলতে পারল কেবল এতটুকুই, ‘পালকটা কই?’ 

‘কীসের পালক?’ 

‘আমি যখন ওই জায়গা থেকে ফিরে আসি…মানে ওই পাহাড় আর গুহামুখঅলা জায়গাটা থেকে, তখন হাতে একটা পালক ছিল। ওটা কই?’ 

‘আমার মনে পড়ছে না,’ বলল মহিলা। ‘বুড়ো হয়ে গেছি, বয়েস হয়েছে একশো চার!’ 

আবার জানতে চাইল মোটকু চার্লি, ‘কোথায় ওটা।’

‘ভুলে গেছি।’ 

‘দয়া করে বলো।’ 

‘আমার কাছে নেই।’ 

‘কার কাছে আছে?’ 

‘কেলিঅ্যান।’ 

‘মিসেস হিগলার?’ 

সামনে ঝুঁকে ষড়যন্ত্রীর সুরে বলল, ‘অন্য দুজনের বয়েস খুবই কম। নাক টিপলে দুধ বেরোয়! 

‘আসার আগে মিসেস হিগলারকে ফোন করেছিলাম, কবরস্থানে যাওয়ার আগে তার বাসায় থেমেওছি। মিসেস বাস্টামন্টে বলল, কোথায় যেন গেছে সে।’ 

মিসেস ডানউইডি ধীরে ধীরে দোল খেতে লাগল বিছানায়, যেন নিজেকে নিজেই ঘুম পাড়াচ্ছে। বলল, ‘আর বেশিক্ষণের অতিথি আমি নই এই রঙ্গমঞ্চে। গত বার যে এসেছিলে, তারপর থেকেই তরল খাবার খাচ্ছি। আমার সময় শেষ, পানি ছাড়া আর কিছুই গলা দিয়ে নামে না। অনেকে বলবে, তোমার বাবাকে হয়তো তারা ভালোবাসত। কিন্তু আমি তাকে ওদের আরও আগে থেকেই চিনতাম। তখন দেখতেও খারাপ ছিলাম না, নাচের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেত আমাকে। আমাকে নিতে আসত, কোলে তুলে ঘোরাত খানিকক্ষণ। এমনকী তখনও বয়েস অনেক হয়েছিল তার, তারপরও যেকোনো মেয়েকে খুশি করতে পারত। অন্য কারও সঙ্গে…’ বলতে বলতেই থেমে গেল মহিলা, পানিতে চুমুক দিল আরেকবার। কাঁপছিল তার হাতটা। ‘একশো চার হলো বয়েস, প্রসবকালীন জটিলতা ছাড়া দিনের বেলা কখনও বিছানা নিইনি। অথচ এখন সব শেষ।’ 

‘সন্দেহ নেই, একশো পাঁচের দেখা পাবেন আপনি,’ অস্বস্তি ভরে বলল মোটকু চার্লি। 

‘এসব বলো না,’ বলল মহিলা, সতর্ক দেখাল ওকে। ‘একদম না! তোমার পরিবার এমনিতেই কম ঝামেলায় ফেলে না, দয়া করে আরেকটা ঝামেলার জন্ম দিয়ো না।’ 

‘আমি আমার বাবার মতো নই,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘জাদু জানি না, সব ক্ষমতা স্পাইডার পেয়েছে, ভুলে গেলে?’ 

মনে হলো না মিসেস ডানউইডি কিছু শুনেছে। মহিলা বলল, ‘যখন নাচতে যেতাম, সেটাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেকার সময়ে, তোমার বাবা ব্যান্ডলিডারের সঙ্গে কথা বলত। অনেকবার এমন হয়েছে যে ব্যান্ডটা ওকে ডেকেছে সঙ্গে গান গাইতে। সবাই হাসত, জয়ধ্বনি দিত। ও এমনই ছিল, গান গেয়ে সব সত্যি করত।’

‘মিসেস হিগলার কই?’ 

‘বাড়ি গেছে।’ 

‘কিন্তু তার বাড়ি তো খালি, গাড়িও নেই। 

‘বাড়িতে গেছে!’ 

‘মানে কী… মারা গেছে?’ 

সাদা বিছানার চাদরে শুয়ে থাকা বৃদ্ধা শনশন আওয়াজে শ্বাস নিলো খানিকক্ষণ, ফুসফুস তার নির্দেশ মানতে চাইছে না। কথা বলার সামর্থ্যও আর বাকি নেই বলেই মনে হচ্ছে। ইঙ্গিতে নিজের কাছে ডাকল মোটকু চার্লিকে। 

‘সাহায্যের জন্য লোক ডাকব?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। 

মাথা নেড়ে সায় জানাল মিসেস ডান উইডি। মিসেস বাস্টামন্টের খোঁজে মোটকু চার্লি বেরিয়ে যাবার আগেও ঠিক হলো না তার শ্বাসকষ্ট। রান্নাঘরে বসে ছিল মহিলা, ছোট্ট একটা কাউন্টারটপ টেলিভিশনে দেখছিল অপেরা উইনফ্রের অনুষ্ঠান। ‘তোমাকে খুঁজছে,’ তাকে বলল মোটকু চার্লি। 

বাইরে বেরিয়ে গেল মিসেস বাস্টামন্টে। খালি পানির পাত্রটা নিয়ে ফিরে এলো সে। ‘এমন কী বললে যে বেচারির হাল খারাপ হয়ে গেছে?’ 

‘হাঁপানি-টাপানির আক্রমণ হলো নাকি?’ 

চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল মিসেস বাস্টামন্টে। ‘না, চার্লস। হাসছিল ও, তুমি নাকি ওকে চরম আমোদ দিয়েছ।’ 

‘ওহ। বলেছিল যে মিসেস হিগলার বাড়িতে গেছে, তাই জানতে চাচ্ছিলাম যে মারা গেছে বোঝাচ্ছে নাকি!’ 

মিসেস বাস্টামন্টেও হেসে ফেলল। ‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজ, জানাল সে। ‘কেলিঅ্যান গেছে সেন্ট অ্যান্ড্রুজে। সিঙ্কে গিয়ে ভরে নিলো পানির পাত্র। 

মোটকু চার্লি এবার বলল, ‘ঝামেলা শুরু হবার পর আমি ভেবেছিলাম, স্পাইডারের বিপক্ষে আছি কেবল আমি। তারপর তোমরা চারজন আমার পক্ষ নিলে। অথচ এখন স্পাইডার অপহৃত হয়েছে, আর তোমরা চারজন আমার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছ।’ 

পানি বন্ধ করে, বিষণ্ন চোখে ওর দিকে তাকাল মহিলা। 

‘এখন আর কারও কোনো কথাই বিশ্বাস করি না,’ জানাল মোটকু চাি ‘মিসেস ডানউইডি সম্ভবত অসুস্থ হবার ভড়ং ধরেছে। আমি এখান থেকে চা গেলেই বিছানা ছেড়ে কামরা জুড়ে নাচতে শুরু করবে! 

‘ও অনেকদিন হলোই কিছু খাচ্ছে না। বলছে, ভেতরে নাকি খার লাগে। তাই শক্ত কিছুই মুখে তুলছে না, শুধু পানি।’ 

‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজের কোথায় গেছে মিসেস হিগলার,’ মোটকু চার্লি। 

‘যাও ওখানে,’ বলল মিসেস বাস্টামন্টে। ‘তোমার পরিবার, আর তুমি… এখানকার অনেক ক্ষতি করেছ!’ 

দেখে মনে হলো, মোটকু চার্লি হয়তো কিছু একটা বলবে। কিন্তু মুখ খুলল না, একটা কথাও না বলে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। 

পানি ভরতি পাত্রটা মিসেস ডান উইডির কাছে নিয়ে গেল মিসেস বাস্টামন্টে, পরেরজন চুপচাপ শুয়ে আছে বিছানায় 

‘ন্যান্সির ছেলে আমাদেরকে ঘৃণা করে,’ জানাল মিসেস বাস্টামন্টে। ‘ওকে বলেছটা কী?’ 

জবাবে কিছুই বলল না মিসেস ডানউইডি। খানিকক্ষণ মন দিয়ে শুনল মিসেস বাস্টামন্টে, যখন বুঝতে পারল যে মিসেস ডানউইডি শ্বাস নিচ্ছে, তখন তার ভারী কাচের চশমাটা চোখ থেকে খুলে রেখে দিল বিছানার পাশে। চাদর টেনে ঢেকে দিল মিসেস ডানউইডিকে। 

তারপর, শুরু হলো সব ফুরিয়ে যাবার অপেক্ষা। 

.

গাড়ি চালাচ্ছে মোটকু চার্লি, যদিও জানে না ওর গন্তব্য কোথায়! দুই হপ্তায় তৃতীয় বারের মতো আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছে সে, স্পাইডারের দেওয়া টাকাও প্রায় শেষ। একা বসে আছে গাড়িতে, একাকীত্ব কাটাতেই যেন গুনগুন করে গাইতে শুরু করল। 

অনেকগুলো জ্যামাইকান রেস্তোরাঁ পেরোবার পর একটা দোকানের জানালায় দেখতে পেল নোটিশ: দ্বীপে যান কম খরচে। সেখানেই গাড়ি থামিয়ে ভেতরে ঢুকল সে। 

‘এ-ওয়ান ট্রাভেলে স্বাগতম, আমরা আপনার ভ্রমণ সংক্রান্ত সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’ বলল ট্রাভেল এজেন্ট। কণ্ঠটা তার অদ্ভুত শোনাল। ডাক্তাররা যখন কাউকে বলে, তার হাত বা পা কেটে ফেলতে হবে, তখন এমন ফিসফিসানি কণ্ঠ ব্যবহার করে। 

‘উম, ধন্যবাদ। জানতে চাচ্ছিলাম, সেন্ট অ্যান্ড্রুজে যাবার সবচাইতে কম খরুচে উপায় কোনটা?’ 

‘ছুটিতে যাচ্ছেন?’ 

‘ঠিক তা না, হয়তো এক…বড়োজোর দুই দিন থাকব।’ 

‘কখন যেতে চাচ্ছেন?’ 

‘আজ বিকেলেই।’ 

‘আশা করি ঠাট্টা করছেন আমার সঙ্গে?’ 

‘একদম না!’ 

একটা কম্পিউটারের পর্দায় এরপর নজর রাখল এজেন্ট, টোকা দিল কী- বোর্ডের কিছু চাবিতে। ‘বারোশো ডলারের চাইতে কম খরচ হবে, এমন কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছি না।’ 

‘ওহ।’ হতাশ হলো মোটকু চার্লি। 

আরও খানিকক্ষণ কী-বোর্ড চাপাচাপির পর শক্ত হয়ে গেল লোকটা। ‘এ আমি কী দেখছি!’ তারপর যোগ করল, ‘একটু দাঁড়ান।’ ফোন করল যেন কাকে। ‘দাম ঠিক আছে?’ একটা প্যাডে কিছু টুকে নিয়ে তাকাল মোটকু চার্লির দিকে। ‘যদি আপনি এক হপ্তা কাটান, আর ওঠেন দ্য ডলফিন হোটেলে, তাহলে পাঁচশো ডলার খরচে ঘুরিয়ে আনতে পারি। খাবার হোটেল থেকেই দেবে, বিমানের খরচ বলতে শুধু বিমানবন্দরের কর দিতে হবে বাড়তি।’ 

চোখ পিটপিট করল মোটকু চার্লি। ‘কোনো শর্ত আছে?’ 

‘পর্যটনের জন্য বিশেষ ছাড়। গানের অনুষ্ঠান আছে একটা। জানতাম না যে এখনও সেই অফার বলবত আছে। তবে হ্যাঁ, যদি বাইরে কোথাও খাওয়া- দাওয়া করেন তো তার খরচ আপনার।’ 

লোকটাকে একশো ডলারের পাঁচটা কোঁচকানো নোট দিল মোটকু চার্লি। 

.

ডেইজির মনে হচ্ছে: ও যেন রূপালি পর্দায় দেখা পুলিস বনে গেছে। কঠিন, রুক্ষ আর সিস্টেমের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। যারা জানতে চায়, অপরাধীরা নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছে কি না[৩০], অথবা তারা কেউ ওর দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চায় কি না[২৯]…বিশেষ করে যে ধরনের অফিসাররা বলে ‘বুড়ো হাড়ে এই জিনিস আর সইবে না’[২৯] তাদের মতো একজন বলে মনে হচ্ছে নিজেকে। অথচ বয়েস ওর মাত্র ছাব্বিশ, অথচ ‘এসব জিনিস’ ওর হাড় আর সইতে পারছে না। তবে দাবিটা যে হাস্যকর শোনাবে, সেটা ও নিজেও ধরতে পারছে। 

[৩০. যথাক্রমে ডার্টি হ্যারি, ডার্টি হ্যারি এবং লিথাল ওয়েপন মুভির বিখ্যাত ডায়লগ।]

এই মুহূর্তে ও বসে আছে ডিটেকটিভ সুপারিন্টেনডেন্ট ক্যাম্বারওয়েলের অফিসে। বলছে, ‘জি, স্যার, সেন্ট অ্যান্ড্রুজের কথাই বলছি।’ 

‘কয়েক বছর আগে ছুটি কাটাতে গেছিলাম ওখানে, প্রাক্তন মিসেস ক্যাম্বারওয়েলের সঙ্গে। ভালো জায়গা। রাম কেকটা অসাধারণ।’ 

‘তেমন জায়গাই হবার কথা, স্যার। গ্যাটউইকের ক্লোজ সার্কিট ফুটেজে যাকে দেখেছি, সে অবশ্যই গ্রাহাম কোটস। ব্রনস্টেইন ছদ্মনামে ভ্রমণ করছে। রজার ব্রনস্টেইন প্রথমে বিমানে গেছে মিয়ামি, সেখানে বিমান পালটে নেমেছে সেন্ট অ্যান্ড্রুজে।’ 

‘তুমি নিশ্চিত যে ভুল হচ্ছে না?’ 

‘শতভাগ নিশ্চিত।’ 

‘তাহলে তো,’ বললেন ক্যাম্বারওয়েল। ‘হারামিটা আমাদেরকে ঘোল খাইয়েছে। ওদের সঙ্গে বন্দি-বিনিময় চুক্তি নেই। 

‘কিছু একটা তো আমাদের করতে হবে।’ 

‘উম, ওর অবশিষ্ট সব অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দিতে পারি, বাজেয়াপ্ত করতে পারি সব সম্পদ। সেটা করবও, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হবে না। নিশ্চয়ই এমন কোথাও টাকা জমিয়ে রেখেছে যার খোঁজ আমাদের কাছে নেই। 

বা থাকলেও যার নাগাল আমরা পাবো না।’ 

‘কিন্তু,’ বলল ডেইজি। ‘এটা তো অবিচার, ধোঁকাবাজি!’ 

এমনভাবে ওর দিকে তাকালেন ক্যাম্বারওয়েল যেন অষ্টমাশ্চর্য দেখছেন। ‘আমরা এখানে ছেলেখেলা খেলছি না। যদি লোকটা আইন মেনে চলত, তাহলে তো আমাদের পক্ষেই থাকত। যদি কখনও ফিরে আসে, তাহলে চট করে ধরে ফেলব।’ বলেই প্লাস্টিসিনের টুকরোটাকে ছোট্ট একটা বলের আকৃতি দিয়ে এক চাপে সমতল বানিয়ে দিলেন। ‘আগেকার দিনে,’ বললেন তিনি। ‘ব্যাটারা চার্চে গিয়ে আশ্রয় চাইতে পারত। যতক্ষণ চার্চে থাকত, ততক্ষণ আইন ওদের স্পর্শও করতে পারত না; এমনকী মানুষ খুনের অপরাধে অভিযুক্ত হলেও না। তবে হ্যাঁ, কাজটা করলে চলা-ফেরা অনেক বেশি সংকীর্ণ হয়ে যেত।’ 

ডেইজির দিকে তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন এতটুকু যথেষ্ট, এখন ওর চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটির। সে বলল, ‘মেইভ লিভিংস্টোনকে সে খুন করেছে, বছরের পর বছর ধরে প্রতারণা করে আসছে মক্কেলদের সঙ্গে।’

‘তো?’ 

‘ওকে বিচারের কাঠগড়ায় খাড়া করানো উচিত আমাদের।’ 

‘নিজেকে এতটা প্রভাবিত হতে দিয়ো না।’ বললেন ক্যাম্বারওয়েল।

ডেইজি ভাবল, বুড়ো হাড়ে এইসব আর সইছে না। মুখ বন্ধ করে রাখল তারপরেও, কিন্তু বাক্যটা মাথার ভেতর কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে। 

নিজেকে এতটা প্রভাবিত হতে দিয়ো না।’ 

হতে দিয়ো না।’ আবারও বললেন ক্যাম্বারওয়েল। প্লাস্টিসিনের টুকরাটাকে এবার ঘনকের মতো করে সাজালেন, তারপর দুই আঙুলের মাঝে ফেলে পিষলেন ইচ্ছেমতো। ‘আমি অন্তত দিই না। নিজেকে ট্রাফিক ওয়ার্ডেন ভাবো। গ্রাহাম কোটস আসলে একটা গাড়ি যেটা ভুল জায়গায় পার্ক করলেও, তুমি টিকেট দেবার আগেই ভেগে গেছে। বুঝলে?’ 

‘জি, আচ্ছা,’ বলল ডেইজি। ‘আমারই ভুল, দুঃখিত।’ 

‘কোনো অসুবিধে নেই,’ জানালেন ওর বস। 

ডেস্কে ফিরে এসে, পুলিসের আন্তঃবাহিনী ওয়েব সাইটে ঢুকল সে। কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা ঠিক করতে। অবশেষে ফিরল বাড়িতে। ক্যারোল বসে ছিল করোনেশন স্ট্রিটের সামনে, খাচ্ছে সে চিকেন কোর্মা। 

‘ছুটিতে যাচ্ছি, ওকে জানাল ডেইজি। 

‘ছুটি তো বাকি নেই, সব কাটিয়ে ফেলেছ,’ যুক্তি দিয়ে ওকে বোঝাতে চাইল ক্যারোল। 

‘খুব খারাপ খবর,’ বলল ডেইজি। ‘কিন্তু আমার বুড়ো হাড়ে যে এইসব আর সইছে না!’ 

‘ওহ, কই যাচ্ছ?’ 

‘অপরাধীকে ধরতে,’ জবাব দিল ডেইজি। 

.

‘ক্যারিবেয়ার’-কে দারুণ পছন্দ হয়েছে মোটকু চার্লির। হতে পারে তারা আন্তর্জাতিক বিমান কোম্পানি, কিন্তু আচরণে লোকাল বাস কোম্পানির মতো। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টরা ওকে ডাকল ‘সোনা’ বলে; সেই সঙ্গে এটাও বলল: যেখানে ইচ্ছা বসতে পারে। 

তিনটা সিট দখল করে ঘুমিয়ে পড়ল মোটকু চার্লি। স্বপ্নে দেখল: তামাটে আকাশের নিচে হাঁটছে সে, পুরো দুনিয়া নীরব আর স্থির। এগিয়ে যাচ্ছে একটা পাখির দিকে, আকারে যেটা শহরের চাইতে বড়ো; ওটার ঠোঁট খোলা, মোটকু চার্লি সেই খোলা ঠোঁটের ভেতর দিয়ে হেঁটে গলা অবধি পৌঁছে গেল। 

স্বপ্নে যেমন হয়, তেমনি আচমকা নিজেকে সে আবিষ্কার করল একটা কামরায়, নরম পালক আর চোখ দিয়ে ভরতি ওটার দেওয়াল; চোখগুলো গোলাকার, পেঁচার মতো পলকহীন দৃষ্টিতে। 

কামরার ঠিক মাঝখানে রয়েছে স্পাইডার, হাত-পা ছড়িয়ে। হাড় দিয়ে বানানো শিকল আটকে রেখেছে তাকে; কামরার প্রতিটা কোনা থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই শিকল, এমন শক্ত করে আটকে ধরে আছে যেভাবে মাকড়শার জালে আটকা পড়ে মাছি। 

ওহ, বলল স্পাইডার। তুমি এসেছ! 

হ্যাঁ, স্বপ্নেই জবাব দিল মোটকু চার্লি। 

হাড়ের শিকলটা আচমকা টান-টান হয়ে স্পাইডারের মাংস কেটে বসল। ভাইয়ের চেহারায় কষ্টের ছাপ পরিষ্কার দেখতে পেল মোটকু চার্লি। 

মানে, বলল মোটকু চার্লি। পরিস্থিতি আরও ভয়ানকও হতে পারত। 

আমার মনে হয় না এই শেষ সাজা, জবাব দিল ওর ভাই। সম্ভবত আমাকে নিয়ে অন্য কিছু করার চিন্তা আছে তার। আমাকে নিয়ে না, আমাদেরকে নিয়ে। কিন্তু কী করতে চায়, সেটা জানি না। 

এরা তো নিছক পাখি, বলল মোটকু চার্লি। খারাপ হলেও, কত খারাপই বা হবে? 

প্রমিথিউসের নাম শুনেছ কখনও? 

মানে… 

মানুষকে আগুন উপহার দিয়েছিল সে। শাস্তি পেতে হয়েছিল সেজন্য। দেবতারা ওকে একটা পাথরে বেঁধে রাখে। প্রতিদিন সকালে একটা ইগল এসে খুবলে খেত ওর কলিজা। 

কত্ত বড়ো কলিজা ছিল? শেষ হয়নি? 

রাতের বেলা নতুন করে একটা গজাত। দেবতাদের কাজ-কারবার বলে কথা।

ক্ষণিকের নীরবতা, দুই ভাই চেয়ে রইল একে-অন্যের দিকে। 

ভেবো না, জানাল মোটকু চার্লি। আমি সব ঠিক করে দেব। 

যেভাবে এতদিন নিজের জীবন ঠিক করেছ? হাসল বটে স্পাইডার, তবে তাতে আমোদের ছোঁয়াও নেই। 

আমি দুঃখিত। 

উঁহু, দুঃখ প্রকাশ তো আমার করা উচিত। দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্পাইডার। কোনো পরিকল্পনা আছে তোমার? 

পরিকল্পনা? 

তাহলে না বলেই ধরে নিলাম। যা ইচ্ছে হয় করো, কিন্তু আমাকে মুক্ত 

করো এখান থেকে। 

তুমি আছ কই? নরকে? 

জানি না কই আছি। হয়তো পাখিদের নরকে। আমাকে তোমার এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে হবে। 

কীভাবে? 

তুমি তো আমাদের বাবারই সন্তান, তাই না? তুমি আমার ভাই। কিছু একটা ফন্দি আঁটো। যাই হোক করো…আমাকে বাঁচাও। 

ঘুম ভেঙে গেল মোটকু চার্লির, কাঁপছে প্রবল ভাবে। ফ্লাইট অ্যাটেন্ড্যান্ট ওর জন্য কফি নিয়ে এলে, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা পান করল সে। পুরোপুরি জেগে উঠেছে এখন, আবার ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছেও নেই। তাই ক্যারিবেয়ারের ম্যাগাজিনটা হাতে নিয়ে সেন্ট অ্যান্ড্রুজের ব্যাপারে চটকদার সব জ্ঞানার্জনে মন দিল। 

ওখান থেকেই জানতে পারল–সেন্ট অ্যান্ড্রুজ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মাঝে সবচাইতে ছোটো দ্বীপ না। তবে তালিকা করার সময় সাধারণত এই দ্বীপের কথা ভুলেই যায় সবাই। স্প্যানিশরা সেই ১৫০০ সনের দিকে আবিষ্কার করেছিল সেন্ট অ্যান্ড্রুজকে; তখন দ্বীপটা ছিল আগ্নেয় লাভা জমে তৈরি হওয়া কিছু পাহাড়ের সমষ্টি, অবশ্য পশু-পাখির অভাব ছিল না এখানে। সেই সঙ্গে জন্মেছিল প্রচুর গাছপালাও। বলা হতো: সেন্ট অ্যান্ড্রুজে যা-ই বপন করা হোক না কেন, তা বড়ো হবেই। 

প্রথমে মালিকানা ছিল স্প্যানিশদের কাছে, তারপর এলো ব্রিটিশরা। এরপর ডাচদের হয়ে আবার ব্রিটিশদের হাতে; ১৯৬২ সালে যখন স্বল্প সময়ের জন্য স্বাধীন হয়েছিল, তখন মালিক ছিলেন মেজর এফ.ই. গ্যারেট; ভদ্রলোক সরকার বানিয়ে, অন্য সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন…ব্যতিক্রম শুধু আলবেনিয়া আর কঙ্গো। শক্ত হাতে কয়েক বছর দেশ শাসনের পর, দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুবরণ করে নিতে হয়। এমন ভাবে বিছানা থেকে পড়ে যান তিনি যে কয়েকটা হাড় ভেঙে যায়! কামরার ভেতরে তখন ছিল সৈন্যদের পুরো একটা দল, যারা কসম কেটে বলে: আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তারা মেজর গ্যারেটের পতন রুখতে পারেনি। দ্বীপের একমাত্র হাসপাতালে পৌঁছাবার আগেই মারা যান বেচারা। তারপর পর থেকে সেন্ট অ্যান্ড্রুজের শাসন পরিচালিত হয় নির্বাচিত সরকারের দ্বারা, আবার চালু হয় বৈশ্বিক কূটনীতি। 

মাইলকে মাইল লম্বা বালুময় সৈকত আছে দ্বীপের, সেই সঙ্গে ঠিক মধ্যখানে অবস্থিত একটা ছোট্ট রেইনফরেস্ট; দ্বীপে জন্মায় প্রচুর পরিমাণে কলা আর আখ; ব্যাংকিং সিস্টেম এমন যে বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং অন্যান্য দেশের কর্পোরেশনরা আকৃষ্ট হয়। কারও সঙ্গেই বন্দি-বিনিময় চুক্তি নেই তাদের, সম্ভবত কঙ্গো আর আলবেনিয়া ছাড়া। 

যদি সেন্ট অ্যান্ড্রুজের খ্যাতির একটা কারণ বলতে হয়, তাহলে ওখানকার খাবারের কথা বলতেই হবে: জ্যামাইকানদের আগেই নাকি এখানকার অধিবাসীরা মুরগিকে জার্কি বানাবার পদ্ধতি জানত, ত্রিনিদাদিয়ানদের আগে শিখেছে ছাগল রান্নার উপায়, বাজানদের আগেই কাবাব বানাতে শিখেছে উডুক্কু মাছের 

সেন্ট অ্যান্ড্রুজে মোট দুটো শহর: উইলিয়ামসটাউন, যেটা অবস্থিত দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে; এবং আরেকটা হলো উত্তর দিকের নিউক্যাসল। দ্বীপে আছে অস্থায়ী বাজার যেখানে কেনা যায় এমন সবকিছু যা ওখানে জন্মায়। আছে কয়েকটা সুপারমার্কেট, যদিও ওখানে সেই একই পণ্যগুলো কিনতে দ্বিগুণ খরচ করতে হয়। একদিন আসলেও আন্তর্জাতিক একটা বিমানবন্দর পাবে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ। 

উইলিয়ামসটাউনের জেটিটা অবশ্য উপকারী না অপকারী, এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। ক্রুজ শিপের আগমনের জন্য ওই রকমের গভীর জেটির দরকার আছে, তাতে সন্দেহ নেই। এতে করে সেন্ট অ্যান্ড্রুজের মতো দ্বীপরাষ্ট্রের অর্থনীতির পালে মারাত্মক হাওয়া লাগে। মৌসুম চলাকালীন প্রায় আধ ডজন ক্রুজ শিপ আসে উইলিয়ামসটাউন বে-তে। হাজারো মানুষ নিচে নামে, হাত-পা খেলিয়ে নেয়; তারা এটা-সেটা খরিদও করে। সেন্ট অ্যান্ড্রুজের অধিবাসী ওপরে ওপরে ঘোঁত-ঘোঁত করলেও, পর্যটকদের বরণ করে নেয় সহাস্যে। তাদের কাছে জিনিসপত্র বিক্রি করে, একেবারে গলা পর্যন্ত খাইয়ে ফিরিয়ে দেয় জাহাজে। 

ক্যারিবেয়ারের বিমানটা ল্যান্ড করার সময় ঝাঁকি খেল, যার চোটে মোটকু চার্লির হাত থেকে পড়ে গেল তার ম্যাগাজিন। সামনের সিটের পেছনে ওটা রেখে দিল সে, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে, হেঁটে টারম্যাকের অন্য পাশে চলে এলো। 

শেষ বিকেল চলছে তখন 

এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিযোগে মোটকু চার্লি চলে এলো তার হোটেলে। পথে এমন কয়েকটা জিনিস জানল যা ক্যারিবেয়ারের ম্যাগাজিনে ছিল না। এই যেমন জানল: গান, সত্যিকারের আর আদর্শ গান, হলো কান্ট্রি আর ওয়েস্টার্ন। সেন্ট অ্যান্ড্রুজের রাস্তারাও[৩১] তা জানে। জনি ক্যাশ? এক কথায় গানের ঈশ্বর ছিল সে। উইলি নেলসন? ডেমিগড। 

[৩১. এখানে রাস্তাফারিয়ানিজমের অনুসারীদের বোঝানো হচ্ছে। যা ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন। বব মার্লে যার উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন।]

এটাও জানতে পারল, সেন্ট অ্যান্ড্রুজ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার কোনো কারণই নেই। ট্যাক্সি ড্রাইভার নিজেও কখনও সেন্ট অ্যান্ড্রুজ ছাড়ার কোনো কারণ খুঁজে পায়নি, বহুবার ভেবেও। দ্বীপে আছে একটা গুহা, একটা পাহাড় আর একটা রেইনফরেস্ট। হোটেল? আছে খান বিশেক। রেস্তোরাঁ? কয়েক ডজন তো হবেই। একটা নগরী, তিনটা শহর আর বেশ কিছু গ্রামও আছে। খাবার? এখানে কী জন্মায় না! কমলা, কলা, জায়ফল। এমনকী, জানাল ট্যাক্সি ড্রাইভার, লেবুও পাওয়া যায়! 

মোটকু চার্লি শেষ বাক্যটা শুনে ‘না!’ বলে দিল, তবে মুখ খুলতে হয় বলে খোলা। কিন্তু ড্রাইভার ব্যাপারটাকে নিলো অন্য ভাবে, ধরে নিলো ওর কথা বিশ্বাস করছে না মোটকু চার্লি। ট্যাক্সির ব্রেক কষল শক্ত করে, আরেকটু হলেই রাস্তার বাইরে চলে যেত গাড়ি। তারপর গাড়ি থেকে নেমে, একটা বেড়ার ওপাশে হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়ল কিছু একটা গাছ থেকে। মোটকু চার্লির জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই দেখুন! আমি মিথ্যেবাদী, এ অপবাদ কেউ দিতে পারবে না! বলুন, এটা কী?’ 

‘লেবু?’ কোনোমতে বলল মোটকু চার্লি।

‘ঠিক বলেছেন!’ 

গাড়িটাকে আবার রাস্তায় তুলল ট্যাক্সি ড্রাইভার। মোটকু চার্লিকে জানাল, দ্য ডলফিন হোটেল হিসেবে বেশ ভালো। জানতে চাইল, দ্বীপে কি মোটকু চার্লির আত্মীয় থাকে? কাউকে চেনে সে? 

‘আসলে,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘আমি একজনের…এক নারীর খোঁজে এসেছি এখানে।’ 

ট্যাক্সি ড্রাইভার জানাল, দারুণ বুদ্ধি। কেননা নারীর খোঁজ করার জন্য সেন্ট অ্যান্ড্রুজের চাইতে ভালো জায়গা আর হয় না। কারণ: সেন্ট অ্যান্ড্রুজের মেয়েদের দেহের বাঁক, জ্যামাইকার মেয়েদের দেহের বাঁকের চাইতে কড়া। তারা ট্রিনিদাদিয়ান মেয়েদের চাইতে কম ঝামেলা করে। তাছাড়া ডমিনিকার চাইতে সুন্দরী বেশি। এবং সারা বিশ্বে তাদের চাইতে ভালো রাঁধুনি খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদি মোটকু চার্লি আসলেও নারীর খোঁজে এখানে এসে থাকে, তাহলে একদম ভুল করেনি। 

‘আমি আসলে বিশেষ এক নারীর খোঁজে এসেছি,’ জানাল মোটকু চার্লি। 

সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি ড্রাইভার আশ্বস্ত করল মোটকু চার্লিকে। বুঝিয়ে দিল যে ভাগ্যদেবী তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন, কেননা এই দ্বীপের প্রত্যেক অধিবাসীকে ট্যাক্সি ড্রাইভার চেনে। যদি কোথাও সারাটা জীবন অতিবাহিত করে কেউ, জানাল সে, তাহলে তেমনটাই হয়। অবশ্য মোটকু চার্লি যে ইংল্যান্ডের সবাইকে চেহারা দেখা মাত্রই চিনতে পারে না, সেটা বাজি ধরে বলতে পারে। মেনে নিলো মোটকু চার্লি, জানাল যে চালকের কথা সত্যি! 

‘আমাদের পারিবারিক বন্ধু সে,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘তার নাম: মিসেস হিগলার। কেলিঅ্যান হিগলার। চেনো?’ 

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ট্যাক্সি ড্রাইভার, ভাবছে লোকটা। তারপর বলল, নাহ, এমন কাউকে চেনে না সে। দ্য ডলফিন হোটেলের সামনে থামল গাড়ি, ভাড়া চুকিয়ে দিল মোটকু চার্লি। 

ভেতরে পা রাখল মোটকু চার্লি। রিসেপশনে এক যুবতী বসা, তাকে নিজের পাসপোর্ট আর রিজার্ভেশন নম্বর দেখিয়ে দিল সে; লেবুটাকে রাখল ডেস্কের ওপর। 

‘সঙ্গে লাগেজ আছে?’ 

‘না,’ ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল মোটকু চার্লি। 

‘কিচ্ছু না?’ 

‘না, শুধু এই লেবু।’ 

বেশ কয়েকটা ফর্ম পুরণ করতে হলো ওকে, তারপর একটা চাবি দিল ওকে রিসেপশনের মেয়েটা; ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল কামরা। 

দরজায় যখন টোকার আওয়াজ হলো, তখন গোসল করছে মোটকু চার্লি। কোমরে একটা তোয়ালে জড়িয়ে নিলো সে। বেলম্যান এসেছে। ‘রিসেপশনে আপনার লেবু ফেলে এসেছেন,’ বলে ওটাকে এগিয়ে দিল মোটকু চার্লির দিকে। 

‘ধন্যবাদ,’ জানাল মোটকু চার্লি, দরজা লাগিয়ে আবার গোসলে মন দিল। এরপর সরাসরি আশ্রয় নিলো বিছানায়, দেখতে লাগল অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন। 

.

পাহাড় শীর্ষের বাড়ির নরম বিছানায় শুয়ে, অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে গ্রাহাম কোটসও। সেগুলো যেমন অশুভ, তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিতও। তবে অপছন্দনীয় বলা যাবে না। জেগে ওঠার পর, পুরোপুরি মনে পড়ে না সেই স্বপ্নগুলো। যদিও ঘুম থেকে ওঠার পর মনে হয়, আগের রাতটা কেটে গেছে বড়ো বড়ো ঘাসের ভেতর দিয়ে বুকে হেঁটে ছোটো প্রাণিদের পিছু ধাওয়া করার মধ্য দিয়ে। থাবার আঘাতে তাদের শিকার করেছে সে, কামড়ে ছিঁড়েছে মাংস। 

স্বপ্নে, ওর দাঁতগুলো ছিল ধ্বংসের অস্ত্র। 

ঘুম থেকে উঠেই বিভ্রান্ত লাগল ওর নিজেকে, দিনটাকেও অদ্ভুত ঠেকছে। প্রতিদিন সকাল নতুন একটা দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে। আগের জীবনটাকে পেছনে ফেলে আসার মাত্র এক হপ্তা পরেই, ফেরারি-জীবনের একঘেয়েমি পেয়ে বসেছে ওকে। সুইমিং পুল আছে বাড়িতেই, আছে কোকো- আঙুর-জায়ফলের গাছ; সেলার ভরতি মদের বোতল, মাংসের সেলারটা ফাঁকা, মিডিয়া সেন্টারটা অত্যাধুনিক। স্যাটেলাইট টেলিভিশন, ডিভিডির বিশাল একটা সংগ্রহ, সেই সঙ্গে দেওয়ালে ঝুলতে থাকা হাজারকে হাজার ডলার মূল্যের শিল্পকর্মের মালিক সে। রাঁধুনি প্রতিদিন সকালে এসে ওর জন্য খাবার প্রস্তুতিতে লেগে পড়ে; গৃহপরিচারিকা আর দারোয়ান-কাম- মালী-কাম- পরিচর্যাকারী অপেক্ষা করে তার প্রত্যেকটা আদেশের (বিবাহিত দম্পতি ওরা, প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য আসে)। খাবার সুস্বাদু, আবহাওয়া —যদি কারও উষ্ণ, রৌদ্রজ্জ্বল দিন পছন্দ হয় তো—একেবারে নিখুঁত। কিন্তু কোনো কিছুই যেন গ্রাহাম কোটসকে ঠিক তৃপ্তি দিতে পারছে না। 

ইংল্যান্ড থেকে বেরোবার পর, দাড়ি কামায়নি সে; কিন্তু তাই বলে ঘন দাড়িও গজায়নি চিবুকে, যা আছে তাকে পাতলা দাড়ি বাদে অন্য কিছু বলা যায় না; পুরুষ মানুষের গালে অমন দাড়ি থাকলে তাকে প্রতারক-প্রতারক দেখায়। চোখগুলো বসে আছে, পান্ডাদের মতো লাগে দেখতে; চোখের নিচে জন্ম নিয়েছে থলে, রং এতটাই কালো যে দেখে ক্ষত মনে হয়! 

প্রতিদিন পুলে গোসল করে সে, দিনের বেলায়। এছাড়া সূর্যের আলো বলতে গেলে এড়িয়েই চলে; এতো কিছু করে…দিনশেষে ত্বকের ক্যান্সারের কাছে খোয়ানোর জন্য টাকা জমাইনি—বলে নিজেকেই। কিংবা অন্য কিছুর কাছে খোয়ানোর জন্যও না! 

লন্ডনের কথা খুব মনে পড়ে। ওখানে ওর পছন্দের যতগুলো রেস্তোরাঁ আছে, প্রত্যেকটার মেইটার ডি তথা প্রধান ওয়েটার ওকে আলাদা নামে ডাকত। নিশ্চিত করত, গ্রাহাম কোটসের মনোরঞ্জনের জন্য যেন সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। লন্ডনে এমন অনেক মানুষ আছে, যাদের কাছ থেকে কিছু-না- কিছু পায় সে; তাই যেকোনো প্রদর্শনীর একদম প্রথম রাতের টিকেট পাওয়া ছিল খুবই সহজ। তার চেয়ে বড়ো কথা, লন্ডনে এমন অনেক থিয়েটার আছে যেখানে রিলিজের দিনই মুভি-নাটক দেখা যায়। ভেবেছিল, নির্বাসনে গেলেও অসুবিধে হবে না; ঠিক নিজেকে উপভোগ করতে পারবে… 

…কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ভুল ছিল ধারণাটা। 

দোষারোপ করার মতো কাউকে না কাউকে তো চাই, তাই সিদ্ধান্ত নিলো গ্রাহাম কোটস—সব দোষ আসলে মেইভ লিভিংস্টোনের। সেই ওকে চরম পদক্ষেপটা নিতে বাধ্য করেছে, আরেকটু হলেই সব লুটে নিত ওর কাছ থেকে। মহিলা ছিল শেয়ালের মতো ধূর্ত, বনবেড়ালের মতো নৃশংস আর সেই সঙ্গে… ছলনাময়ী। যা পেয়েছে, তা ওর প্রাপ্যই ছিল। উঁহু, আসলে এর চাইতেও অনেক বেশি কিছু প্রাপ্য ছিল মেইভের। টেলিভিশনে গ্রাহাম কোটসের সাক্ষাৎকার দেখানো উচিত ছিল। কল্পনার চোখে শুনতে পেল, নিষ্পাপ কণ্ঠে বোঝাতে চাইছে কীভাবে এক পাগলির কাছ থেকে নিজেকে আর নিজের সম্পদকে রক্ষা করতে চেয়েছিল সে। সত্যি বলতে কী, ওই অফিস থেকে যে বেঁচে ফিরতে পেরেছে, সেটা অলৌকিকের চাইতে কম কিছু না! 

গ্রাহাম কোটস নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু দ্বীপে যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ সে বাসিল ফিনেগান; ব্যাপারটা ওকে খোঁচাচ্ছে। নিজেকে বাসিল বলে মনে হয় না ওর; বাসিলত্বের এই ব্যাপারটা ওকে অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়েছে—আসল বাসিল মারা গেছে সেই অল্প বয়সে, ওর আর গ্রাহামের জন্মতারিখ কাছাকাছিই ছিল। জন্মসনদের একটা কপি, সেই সঙ্গে এক কাল্পনিক যাজকের লেখা চিঠি ব্যবহার করে গ্রাহাম কোটস এই পাসপোর্ট আর পরিচয়টা বাগিয়েছে। পরিচয়টা টিকিয়ে রাখতে কষ্টও কম করেনি— নিরেট একটা ক্রেডিট হিস্টোরি আছে বাসিলের, এখানে-সেখানে ভ্রমণ করেছে সে, সেন্ট অ্যান্ড্রুজে না দেখেই কিনেছে বিলাস-বহুল একখানা বাড়ি। কিন্তু গ্রাহামের মনে——অন্তত এতদিন বাসিল আসলে ওর হয়ে কাজ করছিল, অনেকটা কর্মচারীর মতো। কিন্তু এখন কর্মচারীই বনে গেছে মনিব। গ্রাহাম কোটসকে গিলে খেয়েছে বাসিল ফিনেগান। 

‘এখানে যদি থাকতে হয় আর কিছুদিন,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘তাহলে পাগল হয়ে যাবো।’ 

‘কী বললেন?’ গৃহপরিচারিকা জানতে চাইল, হাতে ধরে আছে ডাস্টার। শোবার ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে আছে সে। 

‘কিচ্ছু না,’ জানাল গ্রাহাম কোটস। 

‘পাগল হয়ে যাবেন বললেন মনে হচ্ছে। বাইরে হেঁটে আসুন। তাজা বাতাসে ভালো লাগবে।’ 

তাজা বাতাসের ধার ধারে না গ্রাহাম কোটস, কর্মচারীরাই তার হয়ে তাজা বাতাস খেয়ে নিত। তবে ভাবল, হয়তো বাসিল ফিনেগানের একটু হেঁটে আসা দরকার। তাই চওড়া রিমের একটা টুপি পড়ে, স্যান্ডেলের জায়গায় পায়ে দিল হাঁটার জুতো। সেল ফোনটা নিলো সঙ্গে, মালীকে নির্দেশ দিল, যেন ফোন পেলে ওকে এসে নিয়ে যায়। তারপর হাঁটতে শুরু করল সবচাইতে কাছের শহরটার দিকে। 

পৃথিবী একেবারেই ক্ষুদ্র। নিজের সম্পর্কে জানতে, এখানে বেশিদিন বাস করতে হয় না। একটা তত্ত্ব বলে: সারা বিশ্বে আসলে মাত্র পাঁচশো জন সত্যিকারের মানুষ বাস করে (অন্য ভাবে বলতে গেলে নাটকে অভিনেতা- অভিনেত্রী তারাই, বাকির—-তত্ত্বমতে—এক্সট্রা)। তারচেয়ে বড়ো কথা, এরা সবাই সবাইকে চেনে। দাবিটা আসলে সত্য, মানে যতটুকু সত্য হওয়া সম্ভব আরকী। আসল সত্যি হলো: এই পৃথিবী এমন পাঁচশো মানুষের হাজারো দলের বিভক্ত। প্রত্যেকেই তাদের জীবন কাটিয়ে দেয় এই বাকি দলগুলোকে এড়িয়ে চলার চেষ্টায় রত হয়ে। কিন্তু দেখা যায়, হয়তো ভ্যানকুভারের কোনো চায়ের দোকানে দেখা হয়ে যাচ্ছে ওদের! পদ্ধতিটা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবী; আসলে এটাকে কাকতালও বলা যায় না। পৃথিবী এভাবেই কাজ করে, স্বতন্ত্রতা কিংবা একজন মানুষের সম্পত্তি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা তার নেই। 

তাই উইলিয়ামসটাউনের রাস্তায় একটা ছোট্ট ক্যাফেতে যে গ্রাহাম কোটস কোমল পানীয় কেনার জন্য পা রাখবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অবশ্য মালীকে ফোন করে ওকে নিতে আসতে বলাও ক্যাফেতে ঢোকার একটা কারণ। 

ফান্টা দিতে বলে, টেবিলে বসে পড়ল গ্রাহাম কোটস। দোকানটাকে খালিই বলা চলে: দূরের কোনায় বসে আছে কেবল দুইজন নারী, একজন বয়স্ক ও অন্যজন যুবতী। কফি পান করছে আর পোস্টকার্ডে লিখছে তারা। 

বাইরের দিকে তাকাল গ্রাহাম কোটস, সৈকতে যাওয়ার রাস্তার দিকে। জায়গাটাকে স্বর্গই বলা চলে, ভাবল সে। হয়তো স্থানীয় রাজনীতিতে নাক গলালে মন্দ হয় না –শিল্প-সংস্কৃতির পেছনে পয়সা খরচ করে। এমনিতেও দ্বীপের পুলিস বাহিনীকে বেশ কিছু টাকা অনুদান হিসেবে দিয়েছে সে। ব্যাপারটাকে তার নিজের জন্য জরুরিও বলা চলে… 

পেছন থেকে ভেসে এলো একটা কণ্ঠ, উত্তেজিত শোনাল ওটাকে। ‘মিস্টার কোটস?’ শুনেই লাফিয়ে উঠল ওর অন্তর। যুবতী মেয়েটা এসে বসল গ্রাহাম কোটসের পাশে। উষ্ণ হাসিতে ভরে উঠল তার চেহারা। 

‘এখানে আপনাকে দেখতে পেয়ে অবাক হলাম,’ বলল মেয়েটা। ‘আপনিও ছুটিতে এসেছেন নাকি?’ 

‘তেমনই কিছু একটা।’ মেয়েটা কে, সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই গ্রাহাম কোর্টসের। 

‘আমার কথা মনে নেই আপনার? রোজি নোয়াহ। আমি মোটকু, মানে চার্লি ন্যান্সির প্রেমিকা ছিলাম। মনে পড়েছে?’ 

‘ওহ, রোজি। অবশ্যই।’ 

‘আমি ক্রুজে আছি, মায়ের সঙ্গে। সে কিছু পোস্টকার্ড পাঠাচ্ছে বাড়িতে।’ 

মাথা ঘুরিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল গ্রাহাম কোটস, ফ্লোরাল ড্রেস পরিহিত দক্ষিণ আমেরিকার মমির মতো দেখতে এক মহিলার ওপর নজর পড়ল। 

‘সত্যি বলতে কী,’ বলে চলছে রোজি। ‘ক্রুজ-টুজ আমার পছন্দ না। এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে গিয়ে দিন দশেক কাটানো…তাই পরিচিত চেহারা খুঁজে পেয়ে দারুণ লাগছে। তাই না?’ 

‘পুবশ্যই।’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘তা তোমার আর চার্লসের বাগদান কি ভেঙে গেছে বলে ধরে নেব?’ 

‘হ্যাঁ,’ জানাল মেয়েটা। ‘তা ধরে নিতে পারেন। মানে, ভেঙে গেছে আরকী।’ 

গ্রাহাম কোটস সহানুভূতি প্রদর্শনের ভঙ্গিতে হাসল। ফান্টাটা হাতে নিয়ে গিয়ে বসল কোনার টেবিলে, রোজিকে সঙ্গে নিয়ে। পুরাতন, লোহার রেডিয়েটর যেভাবে একটা কামরায় শীতলতার বিচ্ছুরণ করে, রোজির মায়ের কাছ থেকেও সেভাবে ঘৃণা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কিন্তু গ্রাহাম কোটস খুবই অমায়িক আচরণ করল, সাহায্য করতে চাইল সব ধরনের কাজে। শুধু তাই না, রোজির মায়ের প্রতিটা কথায় মাথা নেড়ে সায় জানাল। আসলেও, ক্রুজ কোম্পানিরা আজকাল যা ইচ্ছে তাই করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাও একেবারে জঘন্য। এসব দ্বীপে করার মতো বলতে গেলে কোনো কিছুই নেই! আর যাত্রীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ ধৈর্যের প্রত্যাশা করা হয়, তা এক কথায় নিন্দনীয়: বাথটাব ছাড়া দশ দিন, ছোট্ট একটা গোসলখানা! 

ছিহ! 

কিছু আমেরিকান যাত্রীর সঙ্গে সফলতার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়েছে রোজির মা, যাদের মূল অপরাধ হলো— অন্তত গ্রাহাম কোটস যা বুঝল সে অনুসারে—দ্য স্কুইক অ্যাটাকের বুফে লাইনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমতো খাবার প্লেটে তোলা আর অ্যাফট ডেকের পুলের সেই জায়গায় রোদ পোহাতে যাওয়া যেটাকে প্রথম দিন থেকেই রোজির মা নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মনে করে। 

মাথা নাড়ল গ্রাহাম কোটস, সহানুভূতির সঙ্গে আওয়াজ করল মুখ দিয়ে; চুপচাপ শুনল ভয়ানক কথাগুলো। রোজির মায়ের প্রত্যেকটা কথায় সহমত হলো লোকটা; ফলে ভদ্রমহিলা ভুলে গেল যে অপরিচিতদের অপছন্দ করে সে, অপছন্দ করে মোটকু চার্লির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সবাইকে। সব ভুলে কথা বলেই চলল তো বলেই চলল সে। এদিকে বলতে গেলে কোনো কথাই শুনছে না গ্রাহাম কোটস। ভাবছে শুধু… 

যদি কেউ এই অবস্থায় লন্ডনে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানায় যে সেন্ট অ্যান্ড্রুজে দেখা গেছে গ্রাহাম কোটসকে——তাহলে ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক হবে। সন্দেহ নেই, একদিন না একদিন ওর অবস্থান অবশ্যই জেনে যাবে সবাই, তবে সেটা যত দেরিতে হয় ততই ভালো। 

‘অন্তত একটা সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘অবশ্যই আপনার অনুমতিক্রমে। এই রাস্তা ধরে খানিকদূর এগোলেই আমার বাড়ি, ছুটি কাটাবার নিমিত্তে কিনেছিলাম। সবমিলিয়ে ব্যবস্থা মন্দ নয়-ই বলব। আর একটা জিনিস যদি বেশি বেশি থেকে থাকে তো সেটা হলো–গোসলখানা। চলুন নাহয় আমার সঙ্গে, সদ্ব্যবহার করতে পারবেন।’ 

‘আরে না, তবে প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ,’ জানাল রোজি। তবে হ্যাঁ, রাজি হলে ওর মা-ই মনে করিয়ে দিত যে সেদিন বিকেলেই উইলিয়ামসটাউনের জেটিতে থাকতে হবে ওদেরকে, ক্রুজ শিপে ফিরে যাওয়ার জন্য। তারপর প্রায় অপরিচিত একজনের প্রস্তাবে সারা দেওয়ার জন্য বকাবকিও করত। 

কিন্তু রোজি যে ‘হ্যাঁ’ বলেনি! 

‘আপনার অনেক দয়া,’ বলল রোজির মা। ‘আমরা সঙ্গে যেতে পারলে খুশিই হবো।’ 

খানিকক্ষণের মাঝেই একটা কালো মার্সিডিজে চড়ে উপস্থিত হলো মালী। রোজি আর ওর মায়ের সম্মানার্থে পেছনের দরজা খুলে দিল গ্রাহাম কোটস। আশ্বস্ত করল, ক্রুজ শিপে পুবশ্যই সময়মতো ওদেরকে পৌঁছে দেবে। 

‘কই যাবো, মিস্টার ফিনেগান?’ জিজ্ঞেস করল মালী। 

‘বাড়িতে,’ জানাল গ্রাহাম কোটস। 

‘মিস্টার ফিনেগান?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল রোজি। 

‘পুরাতন, পারিবারিক নাম,’ জবাব দিল গ্রাহাম কোটস, মিথ্যে বলেনি অন্তত। কারও না কারও বংশের নাম ‘ফিনেগান’ তো বটেই। পেছনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজে বসল সামনে। 

.

দিশেহারা ভূতে পরিণত হয়েছে মেইভ লিভিংস্টোন। শুরুটা দারুণ হয়েছিল অবশ্য: বাড়িতে, মানে পন্টেফ্রাক্টে যেতে চেয়েছিল সে। একটু ঝাপসা হয়ে, বাতাস বইয়ে আর একটু আঁতকে উঠে নিজেকে সে বাড়িতেই আবিষ্কার করে। শেষ বারের মতো পুরো দালানটা ঘুরে দেখে, পা রাখে শরতের আলোতে। রেই-এ বোন থাকে ওর, তাকে দেখার কথা মাথায় আসতেই নিজেকে আবিষ্কার করল রেই-এর বাগানে। ওখানে তার বোন একটা স্প্রিংগার স্প্যানিয়েল নিয়ে হাঁটছে। 

এভাবে ভ্রমণ করাটা খুব সহজ ঠেকল মেইভের কাছে। 

ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিলো যে গ্রাহাম কোটসকে দেখতে চায়। পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করল তখন থেকে। মুহূর্তখানেকের জন্য অলডউইচের অফিসে আবিষ্কার করল সে নিজেকে, তারপর পার্লির একটা খালি বাসায়। মনে পড়ে গেল, প্রায় এক দশক আগে এখানে ওদেরকে দাওয়াত দিয়েছিল গ্রাহাম কোটস। তারপর… 

কোথায় যে আছে তা বুঝতেই পারছে না। অন্য কোথাও যেতে চাইল, আর তাতেই আরও বড়ো ভজকট গেল পেকে 

যেখানে আছে, সেখানে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় ভিজে গেল চারপাশ; অবশ্যই মেইভ লিভিংস্টোন বাদে। মাটি থেকে বাষ্প উঠছে, তার মানে অন্তত ইংল্যান্ডে নেই। এদিকে চারপাশ দখল করে নিতে শুরু করেছে অন্ধকার। 

মাটিতে বসে নাক টানতে শুরু করল বেচারি। 

আরে আরে, নিজেকে বলল। মেইভ লিভিংস্টোন, সামলাও নিজেকে। কিন্তু তাতে কাজ হলো না, বরঞ্চ নাক টানার পরিমাণ বেড়ে গেল। 

‘টিস্যু দিব?’ জিজ্ঞেস করল কেউ একজন। 

চোখ তুলে চাইল মেইভ। পেন্সিলের মতো সরু গোঁফঅলা এক বয়স্ক ভদ্রলোক, সবুজ হ্যাট পরে তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে ধরেছে। 

মাথা নেড়ে সায় জানাল সে। তারপর বলল, ‘কিন্তু মনে হয় না লাভ হবে, ধরতেই পারব না!’ 

লোকটার হাসিতে সহানুভূতি ঝরে পড়ল, টিস্যুটা মেইভকে ধরিয়ে দিল সে। কী আশ্চর্য, ভদ্রমহিলার আঙুল গলে ওটা পড়ে গেল না। তাই নাক ঝেরে, চোখও মুছে নিলো মেইভ। ‘ধন্যবাদ। এসব দেখতে হলো বলে দুঃখিত। একটু বেশিই বেশি হয়ে গেছে।’ 

‘এমনটা হয়ই,’ বলে প্রশংসার দৃষ্টিতে মেইভের আগা-পাশ-তলা দেখল লোকটা। ‘আপনি কে? ডাপ্পি?’ 

‘না,’ জানাল মেইভ। ‘আমার তা মনে হয় না… কিন্তু এই ডাপ্পি আবার কী?’

‘প্রেতাত্মা, ভূত,’ লোকটা জবাব দিল। পেন্সিলের মতো গোঁফের কারণে ক্যাব ক্যালোওয়ে কিংবা ডন অ্যামেচির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে মেইভের। এই ধরনের মানুষরা বয়েস হলেও, ঠিকই স্টার বনে থাকে। বয়সী লোকটা যে-ই হোক না কেন, স্টার যে তাতে সন্দেহ নেই। 

‘হ্যাঁ, আমি ওরকমই একজন। কিন্তু… আপনি?’ 

‘বলা যায়,’ জানাল লোকটা। ‘মারা যে গেছি, তাতে সন্দেহ নেই।’

‘ওহ। আমি এখন কোথায় আছি, জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবেন?’

‘ফ্লোরিডায় আছি আমরা,’ তাকে বলল লোকটা। ‘কবরস্থানে, এখন এসে ভালোই করেছেন। হাঁটতে যাবো, যাবেন সঙ্গে?’ 

‘কিন্তু… আপনার না কবরে থাকার কথা?’ ইতস্তত করে অবশেষে প্রশ্নটা করেই বলল মহিলা। 

‘একঘেয়েমিতে পেয়েছে,’ প্রশ্নের জবাবে লোকটা জানাল। ‘ভাবলাম, একটু হেঁটে আসি। সুযোগ পেলে মাছও ধরা যাবে।’ 

আবারও ইতস্তত করল মহিলা, তারপর মাথা নেড়ে সায় জানাল। কথা 

বলার মানুষ পেয়ে, ছাড়তে চাচ্ছে না। 

‘একটা গল্প শুনতে চান?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল বৃদ্ধ। 

‘খুব একটা না,’ সত্যিটাই জানাল মেইভ। 

ওকে খাড়া হতে সাহায্য করল লোকটা, তারপর দ্য গার্ডেন অভ রেস্ট থেকে হেঁটে বেরোল একসঙ্গে। ‘বেশ তাহলে, অল্প কথাতেই বলি; বেশি বড়ো করব না। তবে কিনা চাইলে আমি এমন গল্পও শোনাতে পারি যে ফুরাতে হয়তো হপ্তার পর হপ্তা লেগে যায়। আসল রহস্যটা হলো: বিশদ বিবরণ—কী বলবেন, কী বলবেন না…এসব ঠিক করে নিতে হয়। সত্যি বলতে কী, আবহাওয়া আর পোশাকের বর্ণনা বাদ দিলে তো গল্পের অর্ধেকই নাই হয়ে যায়। একবার একটা গল্প বলেছিলাম—’  

‘দেখুন,’ বলল মেইভ। ‘গল্প যদি বলতেই চান তো সরাসরি শুরু করে দিন, ঠিক আছে?’ এমনিতেই অন্ধকারে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে ভালো লাগছে না। বার বার নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে, মাতাল কারও গাড়ির নিচে পড়ার সম্ভাবনা নেই তার। তারপরেও স্বস্তি পাচ্ছে না। 

এবার হালকা গানের সুরে গল্প বলতে লাগল বুড়ো মানুষটা। ‘যখন বলি ‘বাঘ’,’ শুরু করল সে। ‘তখন বুঝতে হবে, ওটা ভারতীয় দাগকাটা বিড়াল- প্রজাতির প্রাণী না। বড়োসড়ো সব বিড়ালকেই লোকে এই নামে ডাকে-পুমা, ববক্যাট, জাগুয়ার, সবাইকেই। বুঝতে পারলেন?’ 

‘অবশ্যই।’ 

‘ভালো। তো…অনেক অনেক আগের কথা,’ কথা চালিয়ে গেল সে। ‘তখন বাঘের দখলেই ছিল সব গল্প। জগতে যত গল্প ছিল, সব ছিল বাঘকে নিয়ে। যত গান ছিল, সব ছিল বাঘের গান। পারলে বলতাম, সব কৌতুকও ছিল বাঘকে নিয়ে। কিন্তু সে এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন ঠাট্টা- কৌতুক চলত না। বাঘের গল্পের আলোচ্য বিষয় ছিল—দাঁত কত শক্ত, কত তীক্ষ্ণ; ছিল কীভাবে শিকার করতে হয়, কীভাবে করতে হয় হত্যা। বাঘের গল্পে নম্রতার স্থান ছিল না, ছিল না চালাকি কিংবা শান্তির স্থানও! 

বিশাল একটা বিড়াল কেমন গল্প বলতে পারে তা কল্পনা করতে চাইল মেইভ। ‘নৃশংস ছিল এত?’ 

‘মাঝে-মধ্যে। তবে খারাপ ছিল সবসময়ই। যখন সব গান আর গল্প ছিল বাঘের, তখন সবার অবস্থাই ছিল মন্দ। চারপাশ থেকে ঘিরে রাখা গান আর গল্পের আদল গ্রহণ করত মানুষজন, বিশেষ করে তারা যাদের নিজস্ব গান ছিল না। বাঘের আমলে সব গানই ছিল অশুভ। শুরু হতো অশ্রুবিসর্জন দিয়ে, শেষ হতো রক্তে; এই পৃথিবীর মানুষরা অবশ্য আর কোনো গান জানত না। 

‘তারপর এলো আনানসি। আশা করি আনানসির ব্যাপারে সব জানেন– ‘মনে হয় না!’ জানাল মেইভ। 

‘তাই নাকি? তা থাক, আনানসি কতটা বুদ্ধিমান আর সুদর্শন আর চালাক ও মনোহর, যা জানাতে শুরু করলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গল্প চলতেই থাকবে।’ বোঝা গেল, শুরু করতে চাচ্ছে বুড়ো। 

‘তাহলে থাক,’ মেইভ জানাল। ‘আপনার কথাই মেনে নিলাম। তা এই আনানসি কী করল?’ 

‘সব গল্প জিতে নিলো। নাহ, জিতে নেওয়া বলাটা ঠিক হবে না; অর্জন করল। বাঘের কাছ থেকে কেড়ে নিলো সব, তারপর এমন ব্যবস্থা করল যেন বাঘ সত্যিকারের দুনিয়ায় আর প্রবেশ করতে না পারে; অন্তত শরীর নিয়ে নয়। মানুষ এরপর যে গল্পগুলো করল, তা হয়ে গেল বাঘের গল্প থেকে আনানসির গল্প। সে প্রায় পনেরো হাজার বছর আগের কথা বলছি। 

‘আনানসির গল্পগুলোতে আছে ধূর্ততা, আছে মজা আর জ্ঞান। পৃথিবীর সবগুলো প্রাণ তখন আর শিকার করা কিংবা শিকারি হওয়ার চিন্তায় আটকে থাকত না। তারা ভাবতে শুরু করল সমস্যার কথা—কখনও-সখনও সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে পড়ল নতুন ও বড়ো সমস্যায়। তবে পেট ভরাতে তো তাদের হয়ই, তবে এখন তারা ভাবতে শুরু করল: কীভাবে পরিশ্রম না করে কাজটা করা যায়—তখন থেকেই মানুষ তাদের মাথা খাটাতে শুরু করে। অনেকেই ভাবে, প্রথম যে যন্ত্রটা বানানো হয় তা হলো অস্ত্র। কিন্তু ব্যাপারটা পুরো উলটো। গদার আগে এসেছে ক্র্যাচ, বুঝলে? আনানসির গল্প যখন প্রচলিত হতে শুরু করল, তখন সবাই এটা-সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করল। ভাবল: কীভাবে চুমু পাওয়া যায়, কীভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে অর্জন করা যায় এটা সেটা। ওই চিন্তা-ভাবনা থেকেই শুরু হলো দুনিয়াকে সাজানো।’ 

‘সবই তো শোনা কথা, জানাল মহিলা। ‘গল্পের শুরু তো মানুষের কাছ থেকেই হয়। 

‘তাতে কি কিছু যায় আসে?’ জিজ্ঞেস করল বুড়ো লোকটি। ‘হয়তো আনানসি কোনো একটা গল্পের অংশ; পায়ের ক্ষতে মাছি ভনভন করছে, এমন কোনো ছেলে হয়তো ক্র্যাচে হাঁটতে হাঁটতে বানিয়েছিল এই গল্পগুলো; পৃথিবীর শুরু দিকে। আশপাশের সবাইকে শুনিয়েছিল আলকাতরা দিয়ে বানানো মানুষের গল্প। কিন্তু তাতে কি কিছু যায় আসে? মানুষের গল্পের দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়। গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়ল, বদলে দিল গল্প-কথকদেরই। কেননা এতদিন যারা শুধু এটাই ভাবত: কীভাবে সিংহের কাছ থেকে পালাতে হয়, কিংবা কুমিরের খাবার হতে না চাইলে পানি থেকে কত দূরে থাকা উচিত, তারা আরও আরামদায়ক একটা আবাসস্থলের কল্পনায় দিন কাটাতে শুরু করল। দুনিয়া হয়তো একই আছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি তো বদলে গেছে, তাই না? মানুষের জীবনের সেই গল্পই আছে—সে জন্মায়, এটা-সেটা করে আবার মরে যায়। কিন্তু এখন গল্পগুলো সেই জীবনকেই দান করল আলাদা একটা মাত্রা!’ 

‘তারমানে, আনানসির গল্পগুলোর আগে দুনিয়াটা ছিল নৃশংস আর জঘন্য?’ 

‘হ্যাঁ, অনেকটা তেমনই।’ 

কথাটা হজম করল মেইভ। ‘তাহলে তো,’ আনন্দের সঙ্গে বলল সে। ‘গল্পগুলো আনানসি অর্জন করায় ভালোই হয়েছে।’ 

বুড়ো মানুষটা মাথা নাড়ল। 

‘বাঘ গল্প ফেরত চায় না?’ জিজ্ঞেস করল মহিলা। 

মাথা নাড়ল লোকটা। ‘হুম, দশ হাজার বছরেরও আগে থেকে চেষ্টা করছে।’ 

‘কখনও পাবে না তো?’ 

জবাবে কিছুই বলল না বুড়ো মানুষটা, চেয়ে রইল দিগন্তের দিকে। বেশ খানিকক্ষণ পর শ্রাগ করে বলল, ‘পেলে তো ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে।’ 

‘আনানসির কী হবে?’ 

‘আনানসি মারা গেছে,’ জানাল বুড়ো লোকটা। ‘ডাপ্পিরা তেমন কিছু 

করতে পারে না।’ 

‘আমি নিজেও ডাপ্পি, তাই ব্যাপারটা ভালো লাগল না।’ 

‘কী আর করা, ডাপ্পিরা যে জ্যান্ত কাউকে স্পর্শ করতে পারে না তা ভুলে গেলেন? 

এক মুহূর্ত ভাবল মহিলা। ‘তাহলে কী স্পর্শ করতে পারব?’ জানতে চাইল সে। 

লোকটার বয়স্ক চেহারায় যে অনুভূতি খেলে গেল তাকে একই সঙ্গে দুষ্টুমিতে ভরা আবার চাতুর্যপূর্ণও বলা চলে। ‘উম,’ বলল সে। ‘আমাকে স্পর্শ করতে পারবেন। 

‘আগেই বলে রাখছি,’ জানাল মেইভ। ‘আমি বিবাহিতা।’ 

জবাবে হাসি ফুটল লোকটার চেহারায়। মিষ্টি আর নরম একটা হাসি, যেমন উষ্ণ তেমনি বিপজ্জনক। ‘এক হিসেবে কিন্তু, মৃত্যু বিয়ের সম্পর্ককে ছিন্ন করে দেয়।’ 

কথাটাকে পাত্তা দিল না মেইভ। 

‘আপনি অবস্তুগত সত্তায় পরিণত হয়েছেন,’ তাকে বলল লোকটা। ‘তাই স্পর্শ করতে পারবেন শুধু অবস্তুগত জিনিসই। এই যেমন আমাকে। মানে, আপনি চাইলে আমরা হাতে হাত ধরে নাচতেও পারব। রাস্তার শেষ মাথায় নাচের একটা জায়গাও আছে। ড্যান্স ফ্লোরে দুইজন ডাপ্পিকে কেউ দেখতেও পাবে না। 

ভাবল মেইভ, অনেক দিন হলো নাচে না। ‘আপনি নাচতে জানেন? ‘ জিজ্ঞেস করল সে। 

‘আগে তো কেউ কখনও ভিন্ন কিছু বলেনি,’ বুড়ো লোকটা জবাব দিল।

‘আমি একজনকে খুঁজছি—একজন জ্যান্ত মানুষকে–নাম তার গ্রাহাম কোটস,’ বলল মহিলা। ‘সাহায্য করতে পারবেন?’ 

‘কোনদিকে গেলে পাওয়া যাবে, তা জানাতে পারব,’ বলল বুড়ো। ‘তাহলে বলুন, নাচবেন?’ 

ঠোঁটে হাসি খেলে গেল মহিলার। ‘পার্টনার কে? আপনি?’ 

.

স্পাইডারকে যে শিকল বেঁধে রেখেছিল, তা খসে পড়ল। দাঁতে ব্যথার মতো তীব্র, নিরবচ্ছিন্ন যন্ত্রণাটা সারা দেহ জুড়ে অনুভব করছিল বেচারা। এখন তা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। 

এক পা সামনে ফেলল স্পাইডার। 

ওর সামনে যা আছে, তাকে আকাশে চিড় ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। সেদিকেই এগিয়ে যেতে লাগল স্পাইডার। 

সামনে পড়ল একটা দ্বীপ। দ্বীপের ঠিক মাঝখানে আছে একটা ছোট্ট পাহাড়। এখন নিখাদ নীল দেখাচ্ছে আকাশটাকে; বাতাসে দুলছে গাছ, অনেক উঁচুতে ভাসছে একটা সাদা সিগাল। কিন্তু ওর চোখের সামনেই যেন ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে দুনিয়াটা, অনেকটা টেলিস্কোপের উলটো প্রান্তে চোখ রাখার মতো। ছোটো হতে হতে ওটা সরে যাচ্ছে ক্রমেই, যতই জোরে দৌড়াচ্ছে ততই বেড়ে যাচ্ছে দূরত্ব। 

দ্বীপটা পানির ডোবায় প্রতিফলনে পরিণত হলো মুহূর্তেই, পরক্ষণেই গেল মিলিয়ে। 

নিজেকে সে আবিষ্কার করল একটা গুহায়। প্রত্যেকটা বস্তু ওর অনেক বেশি ধারালো ঠেকছে; এমন কোথাও আগে কখনও পা রাখেনি স্পাইডার। একেবারে ভিন্ন একটা বিশ্ব এটা। 

একটা গুহার মুখে দাঁড়িয়ে আছে পাখি-মানবী; বাধা হয়ে আছে ওর আর খোলা বাতাসের মাঝে। মহিলাকে চেনে স্পাইডার, দক্ষিণ লন্ডনের একটা গ্রিক রেস্তোরাঁয় এই চেহারাটাই দেখেছিল সে, যখন পাখি-মানবীর মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল পাখির ঝাঁক। 

‘একটা কথা বলতেই হচ্ছে,’ শুরু করল স্পাইডার। ‘তোমার আতিথেয়তার সংজ্ঞা খুবই অদ্ভুত। আমার দুনিয়াতে এলে, তোমার জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করতাম; এমনকী ওয়াইনের বোতলও খুলে, নরম গান শুনিয়ে এমন এক সন্ধ্যা উপহার দিতাম যে কখনও ভুলতে না!’ 

পাখি-মানবীর চেহারায় কোনো অনুভূতি নেই, কালো পাথরে খোদাই করা মুখ যেন। বাতাস মাঝে-মধ্যে ছোবল বসাচ্ছে জীর্ণ, বাদামি আলখাল্লার প্রান্তে। মুখ খুলল মহিলা, কণ্ঠ উঁচু…যেন দূর থেকে একটা সিগাল কথা বলছে, ‘তোমাকে আমি হরণ করেছি,’ জানাল সে। ‘এখন ওকে ডাকো।’ 

‘ডাকব? কাকে?’ 

‘তুমি ভয়ে ভ্যা ভ্যা করে ছাগলের মতো কাঁদবে,’ বলল পাখি-মানবী। ‘গোঙাবে, আর তোমার আতঙ্ক উত্তেজিত করবে তাকে।’ 

‘মাকড়শারা ভয়ে কাঁদে না,’ স্পাইডার জানাল, মোটামুটি নিশ্চিত যে ভুল বলছে না। 

অবসিডিয়ানের টুকরোর মতো কালো, চকচকে চোখ তাকাল তার দিকে। চোখগুলো যেন কৃষ্ণগহ্বর, কোনো কিছুই বাইরে বেরোচ্ছে না। এমনকী তথ্যও না। 

‘যদি আমাকে খুন করো,’ জানাল স্পাইডার। ‘তাহলে আমার অভিশাপ তোমার ওপর পতিত হবে।’ আসলেও অভিশাপ দেওয়ার কোনো ক্ষমতা আছে কি না ওর, তা জানে না। থাকার কথা। আর না থাকলেও, ভড়ং ধরতে সমস্যা নেই। 

‘আমি তোমাকে খুন করব না,’ বলেই হাত তুলল পাখি-মানবী; আসলে হাত না ওটা, র‍্যাপটরের নখর। সেই তীক্ষ্ণ নখর দিয়ে স্পাইডারের চেহারায় আঁচড় কাটল মহিলা, তারপর কাটল বুকে। নিষ্ঠুর নখরগুলো কামড় বসাল স্পাইডারের মাংসে, চিঁড়ে ফেলল ত্বক। 

ব্যথা লাগল না বটে, তবে স্পাইডার জানে যে অচিরেই ব্যথার ঢেউটা আসবে। 

পুঁতির মতো রক্তের ফোঁটা দেখা দিল ওর বুকে, ফোঁটা হয়ে ঝরতে শুরু করল চেহারা থেকে। জ্বালা করে উঠল বেচারার চোখজোড়া, স্পর্শ করল ওর ঠোঁট। স্বাদটা টের পেল স্পাইডার, নাকে পেল লোহার গন্ধ। 

‘এবার,’ দূর থেকে ভেসে আসা পাখির কণ্ঠে বলল পাখি-মানবী। ‘তোমার মৃত্যুর ক্ষণ শুরু হলো।’ 

স্পাইডার বলল, ‘আমরা উভয়ে যুক্তি মেনে চলি। তাই এসো, তোমাকে আরেকটা সম্ভাবনার কথা শোনাই যা আমাদের উভয়ের জন্য লাভজনক হবে।’ মিষ্টি হেসে, বিশ্বাস করানোর মতো ভঙ্গিতে বলল সে। 

‘বেশি কথা বলো,’ বলে মাথা নাড়ল মহিলা। ‘আর কোনো কথা হবে না।’ 

তীক্ষ্ণ নখর স্পাইডারের গলার ভেতর ঢুকিয়ে দিল সে, তারপর মুচড়ে বের করে আনল জিহ্বাটা। 

‘কাজ শেষ,’ বলল পাখি- মানবী। তারপর মনে হলো যেন দয়া করেই স্পাইডারের চেহারা স্পর্শ করে বলল, ‘ঘুমাও।’ 

তাই করল স্পাইডার। 

.

রোজির মা, গোসল-টোসল সেরে যেন নতুন উদ্যম ফিরে পেয়ে জ্বলজ্বল করছে! 

‘আপনাদেরকে উইলিয়ামসটাউনে ফিরিয়ে দেবার আগে, একবার আমার বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাতে পারি?’ অনুমতি চাইল গ্রাহাম কোটস। 

‘আমাদের যে জাহাজে ফেরার সময় হয়ে গেছে, তবে প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ,’ জানাল রোজি। এখনও গ্রাহাম কোটসের বাড়ির গোসলখানায় গা ভেজাতে সায় দিচ্ছে না ওর মন। 

ঘড়ি দেখল ওর মা। ‘আমাদের হাতে নব্বই মিনিটের মতো সময় আছে,’ জানাল সে। ‘জেটিতে ফিরতে মিনিট পনেরোর বেশি সময় লাগবে না। অভদ্রতা কোরো না, রোজি। আমরা আপনার বাড়ি ঘুরে দেখতে পারলে খুশিই হবো।’ 

তাই প্রথমে বসার ঘর থেকে শুরু করল গ্রাহাম কোটস; এরপর একে একে লাইব্রেরি, টেলিভিশন রুম, খাবার ঘর, রান্নাঘর হয়ে দেখাল সুইমিং পুল। রান্নাঘরের সিঁড়ির নিচে থাকা একটা দরজা খুলল সে, যেটা মূলত কাপবোর্ডের হবার কথা। কিন্তু দেখা গেল, ওখানে আসলে পাথুরে দেওয়াল বিশিষ্ট ওয়াইন সেলারে যাবার রাস্তা! ওয়াইনও দেখাল সে মা-বেটিকে, অধিকাংশই এই বাড়িটা কেনার সময় পেয়েছে। সেলারের একদম শেষ মাথার খালি কামরা, যেটা ফ্রিজ আবিষ্কার হবার আগে মাংস রাখার ভাঁড়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো, সেটাও দেখাল। এসব কামরা সবসময়ই ঠান্ডা হয়, বানাবার সময়ই ছাদ থেকে শেকল ঝোলাবার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। শিকলের শেষ মাথার নগ্ন হুক দেখে বোঝা যাচ্ছে, একসময় পশুর দেহ ঝুলানো হতো ওটা ব্যবহার করে। মেয়েরা যখন ভেতরে ঢুকছে, তখন ভদ্রতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে লোহার ভারী দরজাটা ধরে রাখল গ্রাহাম কোটস। 

‘ইসসিরে,’ বলল সে। ‘এই মাত্র মনে পড়ল, বাতির সুইচ আছে ওপরে। একটু অপেক্ষা করুন।’ বলেই মেয়দেরকে ভেতরে আটকে রেখে দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা, তারপর তালাও লাগিয়ে দিল! 

ধুলো পড়া, ১৯৯৫ চ্যাবলিস প্রিমিয়ার ক্রু-এর একটা বোতল তুলে নিলো র‍্যাক থেকে। 

এরপর প্রায় লাফাতে লাফাতে চলে এলো ওপরের তলায়, তিন কর্মচারীকে জানাল: বাকি সপ্তাহটা তাদের ছুটি। 

স্টাডির দিকে যেতে যেতে মনে হলো, ওর পাশে কিছু একটা নিঃশব্দে হাঁটছে। কিন্তু ঘুরে তাকাতেই দেখল…কেউ নেই! তারপরও কেন যেন স্বস্তি পেল না মনে। বোতল খুলে নিজের জন্য হাত খুলে ঢালল ধূসর মদ। আয়েশ করে পান করল সেটুকু; আগে রেড ওয়াইন খুব একটা খাওয়া না হলেও আবিষ্কার করল, ঘনত্ব আর স্বাদটা ঠিক মনপুত হচ্ছে না। রঙটাও হওয়া উচিত ছিল, ভাবল সে, রক্তের মতো। 

দ্বিতীয় গ্লাস শেষ করতে গিয়ে বুঝতে পারল: আসলে তার বর্তমান অবস্থার জন্য ভুল মানুষকে দায়ী করছে। মেইভ লিভিংস্টোন বাচ্চার হাতের পুতুল বই আর কিছু না। সব দোষ আসলে –এবং নিঃসন্দেহে—মোটকু চার্লির। সে নাক না গলালে, এবং গ্রাহাম কোর্টসের অফিসের কম্পিউটারে বেআইনি অনুপ্রবেশ না করলে, গ্রাহাম কোটসকে এই নির্বাসন বরণ করে নিতে হতো না। এমনকী নিজেরই ভাঁড়ার ঘরে দুই মহিলাকে আটকেও রাখতে হতো না। 

মোটকু চার্লি যদি এখানে থাকত, ভাবল সে, তাহলে কামড়ে ওর গলা ছিঁড়ে ফেলতাম। পরমুহূর্তেই চমকে গেল নিজের ভাবনায় নিজেই উত্তেজিত হয়ে উঠছে বলে। 

গ্রাহাম কোর্টসের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়ার ফলাফল কখনওই শুভ হয় না। 

সন্ধ্যা এলো, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দ্য স্কুইক অ্যাটাক-কে অলস ভঙ্গিতে সূর্যোদয়ের দিকে এগিয়ে যেতে দেখল গ্রাহাম কোটস। দুইজন যাত্রী যে নেই, তা টের পেতে কত সময় লাগতে পারে ওদের? 

জাহাজটার দিকে চেয়ে হাত নাড়তেও ভুলল না সে! 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *