অধ্যায় এক – যেটা মূলত নাম আর পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে
শুরুটা হলো—যেভাবে অধিকাংশের হয় শুরু—একটা গান দিয়ে।
হাজার হলেও, সব কিছুর শুরুতে ছিল শব্দের গুচ্ছ; যা ছিল সুরে গাঁথা। দুনিয়ার সৃষ্টিও সেভাবে, সেভাবেই ভরে উঠেছিল শূন্যতা; আর সেভাবেই অস্তিত্ব পায় স্থলভূমি, তারকা, স্বপ্ন, ছোট্ট ছোট্ট দেবতা আর প্রাণিরা।
গান থেকে পায় ওদের অস্তিত্ব!
বিশাল সব প্রাণির জন্ম? সেটাও গান থেকে। গায়ক অবশ্য ততক্ষণে গ্রহ- নক্ষত্র, পাহাড়, গাছ, সমুদ্র আর ছোট্ট সব প্রাণির একটা হিল্লে করে ফেলেছে। পৃথিবীকে যে পাহাড়গুলো শক্ত করে বেঁধে রেখেছে, তাদেরকেও জন্ম দেওয়া হয়েছে গানের মাধ্যমে। শিকারের ময়দান আর আঁধার?
তারাও নিজেদের অস্তিত্বের জন্য গানের কাছে কৃতজ্ঞ!
গান রয়ে যায়, টিকে থাকে তারা। দরকার শুধু উপযুক্ত গানের, তাতেই পরাক্রমশালী এক সম্রাট পরিণত হয় হাস্যরসে; রাজবংশের আর কোনো হদিস থাকে না! কোনো একটা ঘটনা, তাতে অংশ নেওয়া কুশীলব, তাদের স্বপ্ন- সব ধুলোয় মিশে যাবার পরেও টিকে যেতে পারে সেই ঘটনাকে নিয়ে বাধা গান…সেটাই তার শক্তি।
গানের সাহায্যে কিন্তু আরও অনেক কিছু করা যায়। শুধু দুনিয়া-গঠন বা পুনর্গঠনেই ওদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ না। মোটকু চার্লি ন্যান্সির বাবার ব্যাপারটাই ধরা যাক। সে ভেবেছিল, এবং প্রত্যাশাও করেছিল, যে গানের সাহায্যে দারুণ একটা রাতের জন্ম দিতে পারবে।
মোটকু চার্লির বাবা যখন বারে পা রাখে, তখন বারম্যানের অবস্থা খারাপ। বেচারা ধরেই নিয়েছে ‘ক্যারিয়োকি-সন্ধ্যা’ নামের আয়োজনটা একেবারে মাঠে-মারা যাচ্ছে। কিন্তু এহেন মুহূর্তে কামরায় পা রাখা ছোটোখাটো অবয়বটা, গুনগুন করতে করতে; পর্যটকের হাসি মুখে আর সূর্যের আলো গায়ে মেখে তামাটে ত্বক বানানো কিছু স্বর্ণকেশীর টেবিলের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় সে, যে টেবিলটা ছিল জোড়াতালি দিয়ে বানানো ছোট্ট মঞ্চটার এক কোনায়। যেতে যেতে হ্যাটের কোনা একটু নিচু করে সে মেয়েদের দিকে চেয়ে; নিদাগ, সবুজ ফেডোরা, লেবুর মতো হলদে দস্তানা পরিহিত লোকটা এরপর এগিয়ে যায় ওই টেবিলের দিকে।
ওকে আসতে দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে মেয়েরা।
‘সন্ধ্যেটা উপভোগ করছ তো, মেয়েরা?’ জিজ্ঞেস করে সে।
খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতেই মেয়েরা জানায়, দারুণ উপভোগ করছে ছুটিটা। ওদেরকে তখন লোকটা বলে: একটু অপেক্ষা করতে, আনন্দ কয়েকগুণ হতে চলছে!
বয়সে অনেক বড়ো সে, অনেক…অনেক বড়ো। কিন্তু ‘আকর্ষণীয়’ শব্দটা মানুষ হলে সম্ভবত মোটকু চার্লির বাবার রূপই ধারণ করত। মনে হয় যেন সুদূর অতীতের পাতা থেকে উঠে এসেছে, যে যুগে ভদ্রতা আর সুনিপুণ আচরণকে মূল্য দেওয়া হতো। কালো মেঘ সরে গেল বারম্যানের চেহারা থেকে।
এমন কেউ যখন বারে পা রাখে, তখন রাতটা নিঃসন্দেহে ভালোই যায়! ক্যারিয়োকির ব্যবস্থা আছে, আছে নাচের ব্যবস্থাও। বুড়ো মানুষটা মঞ্চে সে সন্ধ্যায় উঠেছিল গান গাইতে…তাও একবার না, দুবার! দারুণ কণ্ঠ তার, মুখের হাসিটা যে কাউকে গলিয়ে দেবে। আর নাচার সময় তো মনে হয় পাগুলো যেন ঝকমক করছে! প্রথমবার সে গাইল: হোয়াট’স নিউ পুসিক্যাট?
দ্বিতীয়বার গানের জন্য যখন মঞ্চে উঠল, ঠিক সেই মুহূর্তেই লোকটা ধ্বংস করে দিল মোটকু চার্লির জীবন।
.
মোটকু চার্লি মোটা ছিল বটে, তবে হাতেগোনা কয়েক বছর মাত্র। তাও সেটা ওর বয়েস দশ থেকে—যে বয়সে ওর মা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিল: যদি দুনিয়াতে মাত্র একটা ব্যাপার নিয়ে ভদ্রমহিলা বিতৃষ্ণার সঙ্গে আর ভাবতে না চায় (যে ভদ্রলোক ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত, আপত্তি থাকলে ব্যাটা সেই আপত্তি… বাকিটা বুঝতেই পারছেন), তো সেটা হলো ওই বুড়ো হাবড়ার সঙ্গে তার বিয়ে; যেটার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে…এবং পরেরদিন সকালেই সব ছেড়ে-ছুঁড়ে চার্লির মা দূরে কোথাও চলে যাবে, নিজের ভালো চাইলে যেন হাবড়া তার পিছু না নেয়—চোদ্দ পর্যন্ত; তখন মোটকু চার্লি খানিকটা লম্বা হয়, বাড়তি ব্যায়ামও শুরু করে।
তখনও ও ঠিক মোটা ছিল না। সত্যি বলতে কী, ওকে একটু নাদুস-নুদুস বলা যেত; মানে দেহের এখানে সেখানে হালকা মেদ ছিল আরকি। কিন্তু মোটকু চার্লি নামটা ওর সঙ্গে এমন ভাবে সেঁটে গেল, যেমনটা টেনিস জুতোর সোলের সঙ্গে চিউয়িং গাম লেগে থাকে। নিজেকে সে পরিচয় দিত চার্লস নামে—বয়েস যখন বিশের ঘরে তখন কখনও কখনও চ্যায বলে, লেখার সময় লিখত সি. ন্যান্সি—কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। কোনো-না-কোনো ভাবে নামটা ফিরে আসবেই! পুরো বাসা পরিষ্কার করলেও, তেলাপোকা কীভাবে কীভাবে যেন ফিরে এসে ফ্রিজের পেছনে বাসা বাধে না? অনেকটা সেভাবেই।
আর তাই, মোটকু চার্লি নামেই আবার পরিচিত হতে হতো ওকে।
ছেলেটা জানে, এর কারণ – যদিও যুক্তিটা অযৌক্তিক-ডাকনামটা ওর বাবার দেওয়া; যে নাম ওর বাবা দেয়, সেটা আর কখনও ঝেড়ে ফেলা যায় না।
মোটকু চার্লি বড়ো হয়েছে ফ্লোরিডা স্ট্রিটে, সেখানকারই সামনের একটা বাড়িতে একটা কুকুর পোষা হতো। চেস্টনাট রঙের বক্সার ছিল ওটা, পা লম্বা, সুচালো কানের জন্য চেহারাটা অদ্ভুত দেখাত; মনে হতো যেন বাচ্চা বয়সে সরাসরি দেয়ালে মুখ থুবড়ে আছড়ে পড়েছিল প্রাণিটা। মাথাটা একটু উঁচু, লেজ টান-টান হয়ে থাকত। বেশ কয়েকটা পুরষ্কার পেয়েছিল ওটা——বেস্ট অভ ব্রিড, বেস্ট ইন ক্লাস…এমনকী বেস্ট ইন শো-ও। নাম দেওয়া হয়েছিল সপ্তম ক্যাম্পবেল’স ম্যাকিনরয় আরবাথনট। তবে মালিকরা, যখন মন ভালো থাকত, তখন ডাকত কাই বলে। কিন্তু একদিন সব বদলে যায়। সেদিন মোটকু চার্লির বাবা তাদের জীর্ণ দেহলিতে বসে বিয়ার গেলার ফাঁকে দেখতে পায় কুকুরটাকে। বেচারা প্রাণিটা তখন প্রতিবেশীর সামনের প্রাঙ্গণে দৌড়াদৌড়ি করছে, গলায় বাঁধা রশিটা একটা গাছে থেকে শুরু করে বেড়ার খুঁটি পর্যন্ত লম্বা।
‘বোকা কুকুর,’ বলল মোটকু চার্লির বাবা। ‘ডোনাল্ড ডাকের বন্ধুর মতো, কী যেন নাম ওটার? গুফি!’
এর পর থেকেই যে কুকুরটা একদা ‘সবার সেরা ছিল, সেটার আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেল। মোটকু চার্লির মনে হতে লাগল, কুকুরটাকে সে এখন তার বাবার চোখ দিয়ে দেখছে! আর আসলেও, ব্যাটা বোকাই।
নামটা ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা সময় লাগল না। সপ্তম ক্যাম্পবেল’স ম্যাকিনরয় আরবাথনটের মালিকদের ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হলো বেশ। তবে নামটার ছড়িয়ে পড়া থামানো আর হারিকেনের সঙ্গে তর্ক করা একই কথা! এমনকী অচেনা-অজানা মানুষরাও একদা গর্বিত বক্সারটাকে আদর করে বলতে শুরু করল, ‘হ্যালো, গুফি সোনা, কেমন আছ?’ মালিকরা এরপর থেকে সব ধরনের শোয়ে নাম লেখানোই বন্ধ করে দিল। বিচারকদের মুখ থেকে ‘বোকা-বোকা কুকুর’ শুনতে শুনতে হতাশ হয়ে পড়েছিল তারা।
তাই সূর্য যেমন পুবে ওঠে, তেমনি মোটকু চার্লির বাবার দেওয়া নাম টিকে যায়—এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই।
তবে কি না, মোটকু চার্লির বাবার সমস্যা আরও অনেক।
বেড়ে ওঠার সময় মোটকু চার্লিকে বললে, বাবার বাজে দিকগুলোর একটা বিশাল তালিকাই করে দিতে পারত সে সর্বক্ষণ এদিক-ওদিক করতে থাকা চোখ, একই রকম অস্থির হাতনিদেনপক্ষে এলাকার যুবতীদের মতে, যারা প্রায়শ এসে অভিযোগ জানাত মোটকু চার্লির মায়ের কাছে—যা জন্ম দিত ঝামেলার; ছোট্ট, কালো সিগারিল্লো, যেগুলোকে বাবা নাম দিয়েছিল চুরুট, ধরালে এমন গন্ধ জন্ম নিত যা লোকটার স্পর্শ করা সবকিছুতে লেগে থাকত; বিশেষ এক ধরনের ট্যাপ ড্যান্সিঙের প্রতি আকর্ষণ যা—মোটকু চার্লির ধারণা মোতাবেক—— ১৯২০ সালের হার্লেমে বড়োজোর আধ-ঘণ্টার জন্য জনপ্রিয় ছিল; বর্তমান বিশ্বের ব্যাপারে চরম অজ্ঞতা; সিটকমগুলোতে আধ-ঘণ্টার মাঝে সত্যিকারের মানুষের জীবন ও সমস্যার ব্যাপারে আসলেও আলোকপাত করা হয়—এই দৃঢ় বিশ্বাস…এমন আরও অনেক কিছু ছিল সেই তালিকায়। সত্যি বলতে কী, মোটকু চার্লির কখনও মনে হয়নি এসব কারণে কোনো একটা ওর বাবার সবচাইতে খারাপ দিক। কিন্তু সবগুলো একত্রিত হয়ে, বিশাল আকার ধারণ করেছিল।
তাই যদি মোটকু চার্লির বাবার সবচাইতে খারাপ দিকটার কথা জানতে চাওয়া হয় তো উত্তর হবে: লোকটা বড়োই বিব্রতকর ছিল!
তবে কি না সবার বাবা-মা-ই বিব্রতকর। বাবা-মা হবার শর্তই যেন এটা; একটা বিশেষ বয়সের বাচ্চারা যেমন সবার সামনে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতেই বিব্রত, লজ্জিত এবং মর্মাহত হয়, তেমনি বাবা-মায়ের অস্তিত্বের একমাত্র কারণ যেন তাদের সন্তানকে বিব্রত করা!
মোটকুর চার্লির বাবা, বলাই বাহুল্য, ব্যাপারটাকে পুরো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায়; কাজটা করে আমোদও পেত। ঠিক যেমনটা পেত অন্যদের প্র্যাক্টিক্যাল জোকের শিকার বানিয়ে, তা সেটার মাত্রা ছোটো বা বড়ো…যেটাই হোক না কেন।
‘যেমন?’ জিজ্ঞেস করেছিল রোজি, মোটকু চার্লির বাগদত্তা। তখন সন্ধ্যা। মোটকু চার্লি এমনিতেও বাবার প্রসঙ্গে খুব একটা কথা বলতে চায় না। তবে সেদিন তোতলাতে তোতলাতে বোঝাতে চাইছিল প্রেমিকাকে কেন ওর বাবাকে বিয়ের দাওয়াত দেওয়াটা মস্ত বড়ো বোকামি হবে। সাউথ লন্ডনের একটা ছোট্ট ওয়াইন বারে বসে ছিল তখন। অনেক আগে থেকেই মোটকু চার্লি নিজেকে বলে আসছে: চার হাজার মাইল আর আটলান্টিক মহাসাগর, বাবার সঙ্গে ওর এই দূরত্বটা বজায় রাখাই ভালো।
‘আসলে…’ শুরু করেছিল মোটকু চার্লি, আর সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে পড়ে যায় একের-পর-এক লজ্জাদায়ক স্মৃতি। একেকটা ওর অজান্তেই, পায়ের নখ কুঁচকাবার জন্য যথেষ্ট! তবে একটা স্মৃতিকে আলাদা করে বলতে শুরু করল সে। ‘যখন ছোটো ছিলাম, তখনকার কথা…নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম। বাবা বারবার আমাকে বলল, প্রেসিডেন্টস’ ডে উদযাপনের জন্য সে উন্মুখ হয়ে আছে। যখন সে নিজে ছোটো ছিল, তখন আইন করেই বাচ্চাদেরকে স্কুলে তাদের পছন্দের প্রেসিডেন্টের সাজে যেতে হতো। বিনিময়ে তারা পেত এক বাক্স চকলেট।’
‘ওহ, আইনটা তো ভালো!’ বলল রোজি। ‘এমন কিছু ইংল্যান্ডে থাকলে আরও ভালো হতো।’ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কখনও পা রাখেনি মেয়েটা; অবশ্য এ- কথা বলার সময় হিসেবের বাইরে রাখতে হয় ১৮-৩০ দিনের একটা ছুটির অভিজ্ঞতা…যখন-রোজির মতে— ভূমধ্যসাগরের কোথাও গিয়েছিল সে। বাদামি চোখ মেয়েটার, তাতে উষ্ণতা মাখা দৃষ্টি; সঙ্গে আছে উন্মুক্ত একটা অন্তর; তবে ভূগোলে কাঁচা।
‘নাহ, ভালো আইন না।’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘আসলে ওটা কোনো আইনই না। পুরোটাই বাবার বানানো। অধিকাংশ স্টেটে ওই দিনে স্কুল খোলাই থাকত না, যেগুলো থাকত সেগুলোতেও পছন্দের প্রেসিডেন্টের বেশে যাবার কোনো প্রথা ছিল না। এমন বেশে যারা যেত, তাদের ভাগ্যে চকলেটে ভরতি বাক্স তো মিলতই না, উলটো জনপ্রিয়তা একেবারে তলানিতে চলে যেত! অথচ আমাকে বলা হয়েছিল—এই একটা ব্যাপারের ওপরেই নির্ভর করছে ভবিষ্যতের ক্লাসগুলোতে আমার জনপ্রিয়তা! যারা জনপ্রিয়-অজনপ্রিয় কোনোটাই হতো না, তারা লিঙ্কন বা ওয়াশিংটন অথবা জেফারসন সেজে যেত। কিন্তু যাদের ভবিষ্যতে জনপ্রিয়তা লেখা আছে, তারা সাজত জন কুইন্সি অ্যাডামস কিংবা ওয়ারেন গামালিয়েল হার্ডিং-এর মতো কারও সাজে। তাছাড়া এই ব্যাপারে আগে-ভাগে কারও সঙ্গে আলোচনাও করা যাবে না, তাহলে দুর্ভাগ্য সঙ্গী হবে! এসব কার কাছে শুনেছি, জানো? বাবার কাছে!’
‘ছেলে-মেয়ে সবাই প্রেসিডেন্টের সাজে সাজত?’
‘আমাকে তো সেটাই বলা হয়েছিল! তাই প্রেসিডেন্ট’স ডেয়ের আগের সপ্তাহটা কাটিয়ে দিলাম দি ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোপিডিয়ায় নাক গুঁজে; যতটা সম্ভব জেনে নিলাম তাদের ব্যাপারে। কাকে বাছব, সেই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য।’
‘ঠাট্টা করছে, এই সন্দেহ হয়নি একবারের জন্যও?’
মাথা নাড়ল মোটকু চার্লি। ‘কেন হবে? বিশেষ করে বাবা যখন তার খেল দেখাতে শুরু করে, তখন কেউ-ই তা ভাবে না। এমন মসৃণ মিথ্যুক তুমি আগে কখনও দেখোনি। তার কথা কেউ অবিশ্বাস করতেই পারে না!’
শার্ডোন্যে[১]-এর গেলাসে চুমুক দিল রোজি। ‘তা কোন প্রেসিডেন্ট সেজে স্কুলে গেলে?’
[১. এক ধরনের মদ]
‘ট্যাফট, আমেরিকার সাতাশতম প্রেসিডেন্ট ছিল সে। কোত্থেকে যেন একটা বাদামি স্যুট জোগাড় করেছিল বাবা, সেটা পরেছিলাম। প্যান্ট গুটিয়ে, তার সামনে একটা বালিশ গুঁজে চলে যাই স্কুলে। এমনকী একটা গোঁফ পর্যন্ত এঁকেছিলাম! সেদিন বাবাই আমাকে স্কুলে নিয়ে যায়, গর্বের সঙ্গে পা রাখি ক্লাসে। অন্য শিক্ষার্থীরা আমাকে দেখে চিৎকার করে, যারা দেখেনি তাদেরকে ডেকে ডেকে দেখায়। ছেলেদের বাথরুমের একটা কিউবিকলে আশ্রয় নিয়ে, কেঁদে-কেটে সব ভাসিয়ে দিই আমি। পোশাক বদলাবার জন্য বাসায় ফেরার অনুমতি পর্যন্ত পাইনি! সারা দিন ওভাবেই থাকতে হয়েছে। নরক যন্ত্রণা বোধ করেছিলাম সেদিন!’
‘কিছু একটা বানিয়ে বলা উচিত ছিল তোমার,’ বলল রোজি। ‘বলতে পারতে, ক্লাসের পর কস্টিউম পার্টিতে যাচ্ছ…অথবা সত্যিটাও বলে দিতে পারতে!’
‘হুম,’ স্মৃতিটা মনে করায় বিষণ্ণ হয়ে গেছে মোটকু চার্লি।
‘বাসায় ফেরার পর, তোমার বাবা কিছু বলেনি?’
‘বলেনি, কেবল হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছে। নাকের জল-চোখের জল এক করে ফেলেছিল। তারপর বলল: হয়তো আজকাল আর ওসব করা হয় না প্রেসিডেন্টস’ ডে উপলক্ষে। যাক সে কথা, সৈকতে গিয়ে মৎস্য- কন্যাদের খুঁজলে কেমন হয়?’
‘মৎস্য কন্যা?’
‘আমরা চলে যেতাম সৈকতে, হাঁটতাম পাশাপাশি। দুনিয়ার বুকে এমন একজনকে ভাবো যে তোমাকে সবচাইতে বেশি বিব্রত করতে পারে। বাবা সেই মানুষটার চেয়েও বেশি দক্ষ ছিল একাজে। দুম করে গাইতে শুরু করত, এক ধরনের বালু-নাচ নাচত সৈকতে। যেখানেই যেত, মানুষের সঙ্গে কথা বলত; তাদের চিনুক বা না-চিনুক। ব্যাপারটা আমার একদম পছন্দ হতো না। আমাকে দেখিয়ে দিত, মৎস্য-কন্যারা আটলান্টিকের কোথায় বাস করে। আর বলত, ঝট করে যদি চোখ পাকিয়ে দেখি, তাহলে হয়তো এক মৎস্য-কন্যা আমার চোখে ধরা দেবে!
‘ওই যে!’ বলল সে। ‘দেখেছ? বড়োসড়ো লালচুলো একটা, সবুজ লেজ।’ আমিও তাকাতাম সেদিকে। খুঁজতাম খুব করে, কিন্তু কোনোদিন দেখতে পাইনি।’
মাথা নাড়ল মোটকু চার্লি, তারপর সামনের টেবিলে থাকা বাটি থেকে এক মুঠো বাদাম তুলে পুড়ে দিল মুখে। এমনভাবে চাবাতে লাগল যেন ওগুলোই বিশ বছরের জমানো-অবমাননা যা কখনওই ভোলা সম্ভব না!
‘আমার কিন্তু মনে হচ্ছে,’ চেহারা উজ্জ্বল হয়ে গেল রোজির। ‘তোমার বাবা বেশ মজার মানুষ, অন্যরকম একটা চরিত্র! বিয়েতে তাকে আনতেই হবে, পার্টির জান বনে যাবে সে!’
কথাটা শুনে, ব্রাজিলিয়ান বাদাম আটকে গেল মোটকু চার্লির গলায়। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জানাল বিয়ের পার্টিতে বরের বাবা কেন পার্টির ‘জান’ হতে যাবে? সন্দেহ নেই: ওর বাবার মতো, দুনিয়ার বুকে আর কেউ মোটকু চার্লিকে অপদস্থ করতে পারবে না। এটাও যোগ করল: বুড়োকে বহু বছর হলো দেখে না, এবং তাতে কোনো আপত্তি নেই তার। ওর মায়ের জীবনের অন্যতম সেরা কাজ হলো বাবাকে পরিত্যাগ করে ইংল্যান্ডে, মায়ের খালা অ্যালান্নার সঙ্গে ওঠা। জোর দিয়ে বলল— দুনিয়া ধ্বংস করে, নতুন করে বানিয়ে আবার ধ্বংস করে আবারও নতুন করে বানানো হলেও বাবাকে দাওয়াত দিতে যাবে না। সত্যি বলতে কী, বলে কথা শেষ করল মোটকু চার্লি, এই বিয়েটার সবচাইতে ভালো দিকটা হচ্ছে—বাপকে তাতে দাওয়াত না দেওয়া!
পরক্ষণেই রোজির ওপর নজর পড়ল মোটকু চার্লির। সাধারণত মেয়েটার চোখের দৃষ্টিতে বন্ধুত্বই থাকে, কিন্তু এখন চেহারাটা বিকৃত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে হিম-শীতলতা। সঙ্গে সঙ্গে শুধরে নিলো সে নিজের বক্তব্য: দ্বিতীয়-সেরা দিক। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
‘তোমাকে আসলে প্রস্তাবটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে হবে, তাহলেই আর মেনে নিতে আপত্তি থাকবে না।’ জানাল রোজি। ‘হাজার হলেও, বিয়ের অনুষ্ঠান অসাধারণ একটা উপায়…যে উপায়ে ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগানো যায়, মিটে যায় সম্পর্কের মাঝে সৃষ্ট ফাটল। তুমি যে ওকে ক্ষমা করে দিয়েছ, তা বোঝাবার এর চাইতে ভালো সুযোগ আর পাবে না।’
‘কিন্তু,’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি। ‘ক্ষমা তো করিনি!’
‘তোমার বাবার ঠিকানা জানো?’ জিজ্ঞেস করল রোজি। ‘কিংবা তার ফোন নম্বর? তোমার বোধহয় ফোন করাই ভালো হবে। চিঠি পাঠানোটা কেমন আনুষ্ঠানিক হয়ে যায়, হাজার হলেও…তার একমাত্র ছেলের বিয়ে হতে যাচ্ছে। তুমি একমাত্র সন্তানই তো? ই-মেইল আছে নাকি তার?’
‘হ্যাঁ, আমিই তার একমাত্র ছেলে। আর জানি না ই-মেইল আছে কি না। সম্ভবত নেই।’ বলল মোটকু চার্লি। চিঠি পাঠানোই ভালো হবে, ভাবল সে। কেননা ডাক বিভাগ অনেক চিঠি হারিয়ে ফেলে!
‘ঠিকানা কিংবা ফোন নম্বর তো আছে?’
‘নেই,’ জানাল মোটকু চার্লি, এক বিন্দু বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলছে না। হয়তো ওর বাবা এখন আর আগের ঠিকানায় নেই। ফ্লোরিডা ছেড়ে এমন কোথাও গেছে যেখানে টেলিফোনই নেই…
…কিংবা নেই ঠিকানাও!
‘তাহলে, কার কাছে আছে?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল রোজি।
‘মিসেস হিগলার,’ জানিয়ে দিল মোটকু চার্লি, প্রেমিকার সঙ্গে ঝগড়া করার স্পৃহা আর নেই।
মিষ্টি হাসি হাসল রোজি। ‘কে এই মিসেস হিগলার?’ জানতে চাইল মেয়েটা।
‘পারিবারিক বন্ধু,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘আমি যখন বাচ্চা, তখন পাশের বাড়িতে থাকত।’
বেশ কয়েক বছর আগে একবার মিসেস হিগলারের সঙ্গে কথা হয়েছিল ওর, মা তখন মৃত্যুশয্যায়। তার অনুরোধেই, মিসেস হিগলারকে ফোন করে কথাটা বাবাকে জানিয়ে দিতে বলেছিল মোটকু চার্লি। সম্ভব হলে মানুষটা যেন দেখা করে। তারও কয়েক দিন পর, মোটকু চার্লির আনসারিং মেশিনে একটা মেসেজ আসে; তখন ও অফিসে ছিল। বার্তাটা পাঠিয়েছিল ওর বাবা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কণ্ঠ একই আছে। তবে খানিকটা বুড়োটে আর মাতাল শোনাচ্ছিল।
বার্তায় লোকটা জানাল, এখন পারবে না আসতে। কিছু কাজের জন্য আমেরিকায় আটকে আছে। অবশ্য যোগ করতে ভোলেনি যে মোটকু চার্লির মাকে সে ‘অসাধারণ এক মহিলা’ বলেই ভাবে। তারও বেশ কিছুদিন পর, ফুলের একটা তোড়া উপস্থিত হয় হাসপাতালের ওয়ার্ডে। সঙ্গে যে কার্ডটা ছিল সেটা পড়ে নাক সিঁটকায় মোটকু চার্লির মা।
‘এত সহজে আমাকে ভজিয়ে ফেলবে ভাবছে?’ বলে সে। ‘উঁহু, আমাকে পটানো এতটাও যে সহজ না তা বুঝিয়ে দিব।’ তবে নার্সকে দিয়ে বিছানার পাশেই রাখে তোড়াটা। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করে মোটকু চার্লিকে— লোকটা কি তাকে দেখতে আসার ব্যাপারে কিছু জানিয়েছে? সব কিছু শেষ হয়ে যাবার আগে?
মোটকু চার্লি জানাল, এমন কিছু জানায়নি। প্রশ্নটাকে ঘৃণা করতে শুরু করে সে এক পর্যায়ে, উত্তরটাকে আরও বেশি। আর জবাব শোনার পর মায়ের চেহারার যে হাল হয়, তা সহ্য হতে চায় না।
সবচাইতে বাজে দিনটা ছিল, অন্তত মোটকু চার্লির মতে, যেদিন ডাক্তার এসে ওকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে জানাল — আর বেশিদিন সময় নেই ওর মায়ের হাতে, দ্রুতই খারাপ হচ্ছে অবস্থা। এখন অন্তিম সময়ের অপেক্ষা করা আর মহিলাকে আরাম দেওয়ার প্রয়াস চালানো বাদে আর কিছুই করার নেই।
ছোটোখাটো, বদমেজাজি লোকটার কথা শুনে কেবল মাথা দুলিয়েছিল চার্লি। তারপর মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে মা জিজ্ঞেস করেছিল—গ্যাসের বিল চুকিয়েছে কি না। ঠিক সেই সময় করিডোর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসে—একই সঙ্গে যেন আছড়ে পড়ার, অর্গানের মতো বাদ্যযন্ত্র বাজার, পা ঠোকার, ড্রাম বাজাবার শব্দ মিশে আছে তাতে। এই ধরনের আওয়াজ আর যেখানেই হোক, হাসপাতালে শুনতে পাবার কথা না; যেখানে দেয়ালের সঙ্গে সাঁটানো আছে নির্দেশ—নীরবতা বজায় রাখুন; হিমশীতল চোখের দৃষ্টিতে নার্সরা যেই নির্দেশ পালন হচ্ছে কি না তা দেখে।
আস্তে আস্তে বেড়ে যাচ্ছে আওয়াজ।
এক মুহূর্তের জন্য মোটকু চার্লির মনে হলো, সম্ভবত জঙ্গি হামলা-টামলা হয়েছে! কিন্তু শ্রুতিকটু শব্দ সত্ত্বেও হেসে ফেলল ওর মা। ‘হলদে পাখি,’ ফিসফিসিয়ে বলল সে।
‘কী?’ প্রশ্ন করল মোটকু চার্লি, মা আবোল-তাবোল বকা শুরু করেছে ভেবে ভয় পাচ্ছে।
দরজা দিয়ে মোটকু চার্লি উঁকি দিল বাইরে।
হাসপাতালের করিডোর ধরে দৃঢ় পায়ে, সব নার্সের আপত্তি অগ্রাহ্য করে, পায়জামা পরা রোগী ও তাদের পরিবারদের মুখ হাঁ করে দিয়ে, এগিয়ে আসছে নিউ অর্লিয়ান্সের খুবই ছোট্ট একটা জ্যাজ ব্যান্ড! স্যাক্সোফোন, সউসাফোন, ট্রাম্পেট—কী নেই তাদের কাছে! আরও আছে বিশালদেহী এক লোক, দেখে মনে হচ্ছে ডাবল বেজ নামের একটা বাদ্যযন্ত্র ধরে রেখেছে গলার কাছে। আরও একজন আছে, বেজ ড্রামসহ; বাজাচ্ছে ইচ্ছে মতো। দলের একদম সামনে ফেডোরা হ্যাট, লেবু রঙের দস্তানা আর একটা স্মার্ট চেক স্যুট তার পরনে—চার্লির বাবা। তার হাতে কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই, তবে নরম জুতো পরা পা-দুটো দিয়ে হাসপাতালের পালিশ করা লিনোলিয়ামের মেঝেতে নাচছে। মেডিক্যালের কর্মচারীদের দিকে তাকিয়ে হ্যাট তুলে সম্মান জানাচ্ছে, কেউ কথা বলার কিংবা আপত্তি জানাবার জন্য কাছে এলেও করমর্দন করছে তার সঙ্গে!
মোটকু চার্লি ঠোঁট কামড়ে ধরল, প্রার্থনা করল—দুনিয়া যেন দুই ভাগ হয়ে যায়, আর লোকটাকে গিলে খায়; অথবা স্বল্প সময়ের, বিনা কষ্টের কিন্তু প্রাণঘাতী হার্ট অ্যাটাক হয়ে মরে যায়! সেই প্রার্থনা বিশেষ কারও উদ্দেশ্যে না, যেকেউ শুনলেই হবে! কিন্তু কপাল মন্দ, তেমন কিছু হলো না। লোকটা বেঁচেই রইল আর বাদ্যযন্ত্রও বেজেই চলল। নাচতে-নাচতে সামনে যে-ই পড়ল, তার সঙ্গেই হাত মেলাল হাসিমুখে।
এই পৃথিবীতে যদি সুবিচার বলতে কিছু থাকে, ভাবল মোটকু চার্লি। তাহলে আমার বাবা করিডর ধরে হেঁটেই যাবে, তারপর আমাদেরকে অতিক্রম করে ঢুকে পড়বে জেনিটো-ইউরিনারি ডিপার্টমেন্টে; কিন্তু…অচিরেই গেল বুঝে— সুবিচার বলে কিচ্ছু নেই দুনিয়ায়। অঙ্কোলজির[২] সামনে এসে থমকে গেল সে।
[২. ক্যান্সার-সংক্রান্ত চিকিৎসা হয় যে বিভাগে]
‘মোটকু চার্লি,’ এমন স্বরে বলল সে যে পুরো ওয়ার্ড—এবং পুরো মেঝে—আর সম্ভবত পুরো হাসপাতাল বুঝে ফেলল, এই মানুষটা মোটকু চার্লিকে চেনে। ‘মোটকু চার্লি, পথ ছাড়ো; তোমার বাবা হাজির হয়েছে।’
পথ ছেড়ে দিল মোটকু চার্লি।
ব্যান্ড দলটা, মোটকু চার্লির পিছু নিয়ে, এঁকে-বেঁকে ঢুকে গেল ওর মায়ের কামরায়; দাঁড়াল তার বিছানার পাশে। চোখ তুলে তাদের দিকে চাইল মহিলা, হাসি খেলে গেল তার চেহারায়।
‘হলদে পাখি’, ‘ দুর্বল কণ্ঠে বলল সে। ‘আমার পছন্দের গান।’
‘সেটাই যদি ভুলে যাই, তাহলে আমি কেমন মানুষ হলাম?’ মোটকু চার্লির বাবা মন্তব্য করল।
ধীরে ধীরে মাথা দোলাল মহিলা, হাত বাড়িয়ে নিজের হাতে নিলো মোটকু চার্লির বাবার লেবু রঙা হলদে দস্তানা পরা হাত।
‘এক্সকিউজ মি,’ ছোটোখাটো একটা সাদা মেয়ে হাতে ক্লিপবোর্ড নিয়ে ঢুকল ভেতরে। ‘এরা কি তোমাদের সঙ্গে?’
‘না,’ গাল লালচে হয়ে গেছে মোটকুর। ‘আমাদের সঙ্গে না।’
‘কিন্তু রোগিণী তো তোমার মা, তাই না?’ ব্যাসিলিস্কের[৩] মতো দৃষ্টি হেনে মেয়েটা বলল। ‘এদেরকে এখুনি ওয়ার্ড ছেড়ে দিতে বলো, আর যেন কোনো ঝামেলা না হয়।’
[৩. পৌরাণিক সাপ, যে চোখের দৃষ্টিতে কাউকে পাথর বানাতে সক্ষম]
বিড়বিড় করে উঠল মোটকু চার্লি।
‘কী বললে?’
‘তা করার ক্ষমতা যে আমার নেই, সেটাই বললাম।’ বলল মোটকু চার্লি। নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল সে, ভাবছিল -পরিস্থিতি এর চাইতে খারাপ হতেই পারে না! ঠিক তখনই ড্রামারের কাছে থাকা প্লাস্টিকের ক্যারিয়ার ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের করে আনল ব্রাউন এলের অনেকগুলো ক্যান। ব্যান্ড দলের সবাইকে দিল একটা একটা করে; এমনকী নার্সিং স্টাফ কিংবা রোগীরাও বাদ গেল না। তারপর ধরাল চুরুট।
‘এক্সকিউজ মি,’ ধোঁয়া দেখে আবার বলল ক্লিপবোর্ড হাতে রাখা মেয়েটা। মোটকু চার্লির বাবার দিকে স্কাড মিসাইলের মতো ছুটে এলো সে।
সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেল মোটকু চার্লি, ওই মুহূর্তে এটাই সেরা কাজ বলে মনে হলো।
সে রাতটা মোটকু চার্লি কাটিয়ে দিয়েছিল নিজ বাড়িতে বসে; অপেক্ষা করছিল ফোন বেজে ওঠার… কিংবা দরজায় টোকার শব্দ শোনার। গিলোটিনে গলা ঢুকিয়ে, গলায় ব্লেডের চুমু টের পাবার অপেক্ষায় থাকা মানুষের যে অবস্থা হয়, ওর-ও সেটাই হয়েছিল; কিন্তু না, কেউ বিরক্ত করতে এলো না ওকে।
রাতে ঘুমায়নি বললেই চলে, পরেরদিন বিকেলে যখন হাসপাতালে পা রাখে তখন খারাপ খবর শোনার জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু ওর মাকে, শয্যাশায়ী অবস্থাতেই, বিগত কয়েকমাসের তুলনায় অনেক বেশি আনন্দিত আর স্বচ্ছন্দ দেখাচ্ছে। ‘চলে গেছে ও,’ মোটকু চার্লিকে জানাল সে। ‘থাকতে পারেনি। তবে একটা কথা বলতেই হচ্ছে, চার্লি, তুই ওভাবে চলে না গেলেই পারতি! রাতে তো আনন্দ উৎসব হয়ে গেল এখানে! ভালোই কেটেছে সময়টা।’
ক্যান্সারের ওয়ার্ডে পার্টি? এর চাইতে বাজে আর কী হতে পারে, তা মোটকু চার্লি কল্পনাও করতে পারে না। তাও কি না ওর বাবার আয়োজনে, জ্যাজ ব্যান্ডের সঙ্গে! তবে কিছুই বলল না সে।
‘মানুষটা ও খারাপ না,’ বলল মোটকু চার্লির মা, মহিলার চোখ জ্বলজ্বল করছে। পরক্ষণেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ‘আসলে, কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। মানুষটা সে ভালোও না। তবে গত রাতে আমার অনেক উপকার করেছে।’ হাসল মা, সত্যিকারের হাসি; এক মুহূর্তের জন্য হলেও, তাকে কমবয়েসী দেখাল।
দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ক্লিপবোর্ড হাতের মেয়েটা, আঙুল বাঁকিয়ে ইঙ্গিতে ডাকল মোটকু চার্লিকে। সেদিকে এগিয়ে গেল ছেলেটা, দূরে থাকতেই ক্ষমা চাইতে শুরু করল। কিন্তু কাছে গিয়ে টের পেল, মেয়েটাকে দেখে এখন আর পেটে ব্যথায় কাতর ব্যাসিলিস্ক বলে মনে হচ্ছে না! বরঞ্চ আদুরে বিড়ালের মতো দেখাচ্ছে। ‘তোমার বাবা,’ বলল সে।
‘আমি দুঃখিত, বলল মোটকু চার্লি। যেকোনো প্রসঙ্গে, ওর বাবা জড়িত থাকলে, ওই শব্দ দুটো উচ্চারণ করেই কথা শুরু করে সে।
‘আরে, না-না।’ প্রাক্তন ব্যাসিলিঙ্ক বলল। ‘ক্ষমা চাইবার মতো কিছু হয়নি। জানতে চাচ্ছিলাম… তোমার বাবা… মানে যদি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার দরকার পরে তো আরকি ফাইলে তার ফোন নম্বরটা নেই। গত রাতে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, তবে মনেই পড়েনি একদম!’
‘মনে হয় না সে ফোন-টোন ব্যবহার করে,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘তার নাগাল পাবার সেরা উপায় হচ্ছে ফ্লোরিডা গিয়ে, হাইওয়ে এ১এ ধরা। রাস্তাটা সৈকতবর্তী, ওই প্রদেশের প্রায় পুরো পূর্ব দিকের সমান লম্বা। বিকেলের দিকে তাকে পাওয়া যাবে কোনো একটা সেতুর ওপর মাছ ধরতে ব্যস্ত অবস্থায়। আর সন্ধেয় পাবে বারে।’
‘খুবই আকর্ষণীয় মানুষ,’ প্রগলভ সুরে বলল মেয়েটা। ‘কী করে?’
‘বললাম তো…ওসবই করে। অলৌকিকের ওপর বেঁচে আছে।’
শূন্য দৃষ্টিতে ওকে দেখল মেয়েটা, নিজেকে বোকা ঠেকল মোটকু চার্লির। অথচ ওর বাবার মুখ থেকে কথাটা শুনলে, সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়। ‘উম, বাইবেলে উল্লেখ আছে—যিশু একবার অলৌকিক ভাবে অল্প মাছ আর রুটি দিয়ে সবাইকে খাইয়েছিলেন। বাবা বলল, সে-ও তেমন অলৌকিক উপায়েই কামায়। ঠাট্টা আরকি।’
স্বপ্নালু দৃষ্টি দেখা গেল মেয়েটার চোখে। ‘হ্যাঁ, মজার মজার সব কৌতুক সে জানে বটে।’ একটু হেসে আবার পেশাদার ভঙ্গি ধারণ করল। ‘তোমাকে আবার ঠিক সাড়ে পাঁচটায় দেখতে চাই।’
‘কেন?’
‘তোমার মাকে, তার সব জিনিসপত্রসহ ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ডা. জনসন বলেননি?’
‘বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছ মাকে?’
‘হ্যাঁ, মি. ন্যান্সি।’
‘তাহলে…ক্যান্সারের কী হবে?’
‘যা বুঝলাম: অহেতুক দুশ্চিন্তা করছিলেন ডাক্তার সাহেব!’
কিছুই বুঝতে পারছে না মোটকু চার্লি। গত সপ্তাহেও ওর মাকে বিশেষায়িত সেবা পাওয়া যায় এমন কোথাও ভর্তি করার কথা হচ্ছিল। এই ‘ডাক্তার সাহেব’ বলছিলেন ‘এখন শুধু শেষ সময়ের অপেক্ষা’ আর ‘অন্তিম মুহূর্ত আসার আগে তাকে যতটা সম্ভব আরামে রাখার চেষ্টা বলতে পারেন’ টাইপের কথা-বার্তা।
সেটা কীভাবে অহেতুক দুশ্চিন্তা হয়?
তবে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় হাসপাতালে ফিরে এসে মাকে নিয়ে যেতে ভুল করল না মোটকু চার্লি। অবশ্য মাকে দেখে কেউ বলবে না— আচমকা নতুন জীবন পেয়ে মহিলা অবাক হয়েছে। বাড়ি ফেরার পথে সে জানাল মোটকু চার্লিকে; যা জমিয়েছে এই জীবনে, সব খরচ করে সে বিশ্বটাকে ঘুরে দেখতে চায়।
‘ডাক্তাররা যখন বলেছিল, আর মাত্র মাস তিনেক বাঁচব,’ জানাল মহিলা। ‘তখন ভেবেছিলাম: যদি কোনোভাবে এই হাসপাতালের বিছানা ছাড়তে পারি তো প্যারিস-রোম আর এমন সব শহরে ঘুরে বেড়াব। বারবাডোজ আর সেন্ট অ্যান্ড্রুজে যাবো, এমনকী আফ্রিকাতেও যেতে পারি। আর চীন তো যাবোই, চাইনিজ খাবার আমার খুব পছন্দ।’
কী হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না মোটকু চার্লি। কিন্তু যা-ই ঘটুক না কেন, তার দায় যে পুরোপুরি ওর বাবার—তা জানে। বোঝাই একটা স্যুটকেসসহ মাকে সে হিথরো বিমানবন্দরে বিদেয় দিল। আন্তর্জাতিক বহির্গমন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল চার্লি। ভদ্রমহিলা আকর্ণ-বিস্তৃত হাসি হেসে, ঢুকে গেল ভেতরে; এক হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে পাসপোর্ট আর টিকেট;
অনেকগুলো বছর পর—তাকে দেখে মনে হচ্ছে—এক ধাক্কায় বয়েস কমে গেছে অনেকটা।
প্যারিস থেকে, রোম থেকে আর অ্যাথেন্স থেকে মোটকু চার্লিকে পোস্টকার্ড পাঠায় মা। এমনকী লাগোস আর কেপ টাউন থেকেও। নানকিং থেকে পাঠানো কার্ড থেকে মোটকু চার্লি জানতে পারল—ওখানে চাইনিজ নাম দিয়ে যে খাবার বিক্রি হচ্ছে, তা তার পছন্দ হয়নি! তাই লন্ডনে ফিরে সত্যিকারের চাইনিজ খাবার খাওয়ার তর সইছে না মহিলার।
সেন্ট অ্যান্ড্রুজ নামের ক্যারিবিয়ান এক দ্বীপের, হোটেল উইলিয়ামসটাউনের একটা কামরায়, ঘুমের মধ্যে মারা যায় মোটকু চার্লির মা।
শেষকৃত্যানুষ্ঠানটা ছিল দক্ষিণ লন্ডনের একটা ক্রিমেটোরিয়ামে। মোটকু চার্লির কেবলই মনে হচ্ছিল—এই বুঝি উদয় হলো ওর বাবা! হয়তো জ্যাজ একটা ব্যান্ডকে সঙ্গে নিয়ে আসবে, অথবা পেছনে থাকবে ক্লাউনদের একটা দল…এমনকী সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে ট্রাই-সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে আসতে থাকা শিম্পাঞ্জির দলও থাকতে পারে সঙ্গে; বলা যায়: যাজকের বক্তৃতায় মন না দিয়ে, বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে একরকম বাধ্যই হয়েছে মোটকু চার্লি; দেখেছে চ্যাপেলের ঢোকার দরজাটা বন্ধ আছে কি না। তবে না, মোটকু চার্লির বাবা সেদিন দেখা দেয়নি। চ্যাপেলে ছিল কেবলই ওর মায়ের বন্ধু-বান্ধব আর দূর-সম্পর্কের আত্মীয়রা। অধিকাংশই বিশালদেহী নারী, বারবার নাক টেনে চোখ মুছে নিচ্ছিল তারা রুমালে। মাথাটা নাড়ছিল উভয় পাশে।
শেষ স্তবগানের সময়, যখন বোতাম চেপে মোটকু চার্লির মায়ের লাশটাকে পোড়ার জন্য শুইয়ে রাখা কনভেয়ার বেল্টটা চালু করা হয়েছিল, তখন চ্যাপেলের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সমবয়সী মানুষটা নজরে এলো মোটকু চার্লির। লোকটা যে ওর বাবা না, তা তো বলাই বাহুল্য। বরঞ্চ এমন একজন, যাকে সে চেনে না; হয়তো অন্ধকারে, ছায়ায় তাকে দেখার কথাও ওর ছিল না… বাবার খোঁজে বারবার আশপাশে না তাকালে হয়তো নজরে পড়ত ও না…দারুণ একটা কালো স্যুট পরে আছে অচেনা লোকটা, মাথা নিচু; হাত বাঁধা।
প্রয়োজনের চাইতে এক মুহূর্ত বেশিই তাকে দেখল মোটকু চার্লি; চোখাচোখি হয়ে যেতেই হাসল অচেনা লোকটা, আনন্দহীন হাসি; কিন্তু সেই হাসি এমন যা হেসে মানুষ বুঝিয়ে দেয়—এই শোক যে হাসছে ও যাকে দেখে হাসছে, একমাত্র তারাই বয়ে চলছে! অচেনা-অজানা কারও চেহারায় এমন হাসি দেখতে পাবার কথা না। কিন্তু তারপরেও মানুষটাকে চিনতে পারল না মোটকু চার্লি। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল সামনের দিকে। তখন ‘সুইং লো, সুইট চ্যারিয়ট’ গাইছে চ্যাপেলের লোকরা। মোটকু চার্লি প্রায় শতভাগ নিশ্চিত— গানটা ওর মা একদম পছন্দ করত না। গান শেষে রেভারেন্ড রাইট সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন, মোটকু চার্লির নানি অ্যালান্নার বাড়িতে কিছু মুখে দেওয়ার জন্য।
অ্যালান্নার বাড়িতে অবশ্য অচেনা কাউকে দেখতে পেল না সে। মা মারা যাবার পরের বছরগুলোতে, মাঝে-মধ্যে ওই অজ্ঞাতনামা লোকটাকে নিয়ে ভেবেছে মোটকু চার্লি: লোকটা কে ছিল, কেন এসেছিল। কখনও কখনও তো মনে হয়: হয়তো কল্পনাই করেছে ব্যাটাকে!
‘তাহলে,’ শার্ডোন্যের গ্লাস খালি করে বলল রোজি। ‘তুমি মিসেস হিগলারকে ফোন করে তাকে আমার মোবাইল নম্বর জানাচ্ছ। মহিলাকে আমাদের বিয়ের কথা জানাবে, জানাবে তারিখও। ভালো কথা: তাকে দাওয়াত দেওয়ার দরকার আছে?’
‘চাইলে দিতে পারো,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘তবে মনে হয় না আসবে। পারিবারিক বন্ধু যদিও, বহু আগে থেকেই চেনে বাবাকে।’
‘হুম, তাহলে আগে কথা বলে দেখো। দরকার হলে পরে দাওয়াত দেওয়া যাবে।’
রোজি খুবই ভালো একটা মেয়ে। রবিন হুড, অ্যাসিসির ফ্রান্সিস[৪], বুদ্ধ আর গ্লিন্ডা দ্য গুডের[৫] মতো কিছু একটা তার মাঝেও আছে। মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে: মোটকু চার্লির সঙ্গে ওর বাবার সম্পর্কটা মেরামত করতে পারলে, ওদের বিয়েতে আলাদা একটা আঙ্গিক যোগ হবে। তখন আর ব্যাপারটা নিছক বিয়ে থাকবে না, হয়ে যাবে মানবিক এক মিশন; রোজিকে যতটুকু চেনে মোটকু চার্লি তাতে চোখ বন্ধ করে বলতে পারে—ওর বাগদত্তা নিজের আর অন্যের ভালো করার মাঝে কোনো কিছুকেই বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেবে না।
[৪. সেন্ট ফ্রান্সিস নামেও পরিচিত, খ্রিষ্টধর্মের অন্যতম সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।
৫. ফ্রাঙ্ক বমের ‘উইজার্ড অভ ওজ’ বা ‘ওজের জাদুকর’ বইয়ের একটা চরিত্র যে মানুষের ভালো করে।]
‘আগামীকাল ফোন দেব মিসেস হিগলারকে,’ বলল সে।
‘এক কাজ করো,’ নাক কুঁচকে বলল রোজি, মেয়েটাকে এই অবস্থায় ভালোই লাগে দেখতে। ‘আজ রাতেই ফোন করে দেখো। হাজার হলেও, আমেরিকাতে এখন গভীর রাত না!’
মাথা নেড়ে সায় জানাল মোটকু চার্লি। একসঙ্গে বার থেকে বেরোল ওরা। রোজির পায়ে যেন কেউ স্প্রিং লাগিয়ে দিয়েছে, কিন্তু মোটকু চার্লিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ফাঁসির আদেশ পাওয়া অপরাধী। নিজেকে ধমক দিল সে, শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। হয়তো মিসেস হিগলার অন্য কোথাও চলে গেছে, কিংবা হয়তো ফোনটাই আর কানেক্টেড নেই।
হতেও পারে…
এই দুনিয়াতে সবই সম্ভব।
.
মোটকু চার্লির বাড়িটা ব্রাইটন রোড পেরিয়ে একটু সামনেই, ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনসে; একটা ছোট্ট বাড়ির ওপর তলার অর্ধেকটা দখল করেছে সে।
‘ফ্লোরিডায় এখন কয়টা বাজে?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল রোজি।
‘বিকেলের শেষের দিক,’ মোটকু চার্লি জবাব দিল।
‘তাহলে ফোন করো।’
‘খানিক পর করি, হয়তো মহিলা বাইরে আছে।’
‘অথবা হয়তো এখনই ফোন করতে হবে, মিসেস হিগলার রাতের খাওয়া সেরে নেবার আগেই।’
পুরাতন অ্যাড্রেস বুকটা খুঁজে বের করল মোটকু চার্লি, ‘এইচ’ লেখা পাতায় একটা খাম খুঁজে পেল ও; মায়ের হাতের লেখা চিনতে পারল প্রথম দেখাতেই, সঙ্গে একটা টেলিফোন নম্বর। তারও নিচে লেখা: কেলিঅ্যান হিগলার।
কিন্তু বার বার রিং বাজলেও কেউ তুলল না রিসিভার।
‘বাড়িতে নেই মনে হয়,’ রোজিকে বলল সে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই রিসিভার তুলে একটা নারী-কণ্ঠ বলে উঠল। ‘কেন?’
‘উম, মিসেস হিগলার বলছ?’
‘কে জানতে চায়?’ মিসেস হিগলার প্রশ্ন ছুড়ে দিল। ‘টেলিমার্কেটার নাকি? এখুনি ফোন রাখো, নইলে কেস ঠুকে দেব। নিজের অধিকার আমি জানি।’
‘না, আমি চার্লস ন্যান্সি। আগে আমরা প্রতিবেশী ছিলাম।’
‘মোটকু চার্লি? একেই বলে ভাগ্যের খেল। সারা সকাল জুড়ে তোমার নম্বর খুঁজে বেড়াচ্ছি। পুরো বাসা তছনছ করে ফেললাম, তারপরেও পেলাম না! ভেবেছিলাম, হয়তো পুরাতন অ্যাকাউন্টস বুকে লিখেছিলাম নম্বরটা। সেটার খোঁজে বাসা উলটে ফেললাম। বললাম—নিজেকে, কেলিঅ্যান, হাঁটু গেঁড়ে বসে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা শুরু করে দাও; যদি তাতে কাজ হয়। কিন্তু বয়সের চোটে হাঁটুর অবস্থা খারাপ, তাই হাত বেঁধে প্রার্থনা শুরু করলাম আরকি। যদিও তাতে লাভ হলো না, খুঁজেই পেলাম না নম্বর। কিন্তু দেখো, এখন তুমিই আমাকে ফোন করলে। একদিক থেকে চিন্তা করলে সেটা আরও ভালো। আমার তো আর টাকার গাছ নেই। কারণ যা-ই হোক না কেন, বিদেশে ফোন করার সামর্থ্য আমার নেই। তবে পরিস্থিতি এমন যে ওই নম্বরটা পেলে ফোন করতামই—’
বলতে বলতেই থেমে গেল মহিলা; হয়তো শ্বাস নিতে, অথবা হয়তো সবসময় বাঁ-হাতে যে গরম কফির মগ থাকে তাতে চুমুক দিতে। কিন্তু সেই এক মুহূর্তের সুযোগটা নিয়েই মোটকু চার্লি বলল। ‘আমি বাবাকে খুঁজছিলাম। বিয়ে করছি, অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতে চাই।’
ওপাশ থেকে ভেসে এলো নীরবতা।
‘তবে বিয়েটা এই বছরের শেষের দিকে।’ জানাল সে। তারপরেও ওপাশ থেকে কোনো শব্দ ভেসে এলো না। ‘মেয়েটার নাম রোজি,’ কণ্ঠে আশা নিয়ে বলল মোটকু চার্লি। সন্দেহ হতে লাগল ওর—লাইন কেটে গেছে নাকি? মিসেস হিগলারের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা আছে আগে থেকেই, সাধারণত শুধু শুনতে হয়…বলতে পারে না সঙ্গী। এমনকী নিজেই তার হয়ে কথা বলে দেয় মিসেস ভদ্রমহিলা। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, বিনা বাধায় ওকে কথা বলতে দিচ্ছে মহিলা! কথা বাড়াবার সিদ্ধান্ত নিলো মোটকু চার্লি। ‘চাইলে তুমিও আসতে পারো।’
‘খোদা, খোদা, খোদা, বলল মিসেস হিগলার। ‘কেউ তোমাকে বলেনি, না?’
‘কী বলেনি?’
তাই ওকে সব জানাল মহিলা, বিস্তারিত বর্ণনার সঙ্গে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব শুনল মোটকু চার্লি, বলল না কিছুই। কথা শেষে শুধু এতটুকু বলল, ‘ধন্যবাদ, মিসেস হিগলার।’ কাগজে খচখচ করে কিছু একটা লিখল সে। ‘ধন্যবাদ, সত্যি বলছি…ধন্যবাদ।’ রেখে দিল রিসিভার।
‘কী হলো?’ রোজি জিজ্ঞেস করল। ‘ফোন নম্বর পেয়েছ?’
মোটকু চার্লি বলল, ‘বিয়েতে বাবা আসতে পারবে না।’ একটু পর যোগ করল। ‘আমাকেই ফ্লোরিডা যেতে হবে।’ একেবারে নিষ্প্রাণ, অনুভূতিহীন শোনাল ওর কণ্ঠ। ‘নতুন একটা চেকবুক লাগবে, ‘–এ কথা যদি বলত, তাহলেও এমনই শোনাত।
‘কখন?’
‘কালকেই।’
‘কেন?’
‘শেষকৃত্যানুষ্ঠান, বাবার। মারা গেছে।’
‘ওহ, আমি দুঃখিত। আমি অত্যন্ত দুঃখিত!’ মোটকু চার্লিকে জড়িয়ে ধরল রোজি। দোকানে দাঁড়িয়ে থাকে যেভাবে পুতুল, সেভাবে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটা। ‘কীভাবে মারা… অসুস্থ ছিল?’
মাথা নাড়ল মোটকু চার্লি। ‘এই প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।’
শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরল রোজি, মাথা নাড়ল একবার সহমর্মিতার সঙ্গে। তারপর ছেড়ে দিল। ধরেই নিয়েছে, শোকের প্রাবল্যে কথা বলতে পারছে না ছেলেটা।
তবে…সত্যিটা হলো…শোক অনুভব করছে না মোটকু চার্লি…
…কথা বলতে না পারার কারণ: লজ্জা।
.
মারা যাবার এক হাজার একটা সম্মানজনক উপায় আছে নিশ্চয়ই। একটা ছোট্ট বাচ্চাকে ডুবে মরার হাত থেকে বাঁচাতে নদীর বুকে ঝাঁপ দিয়ে মরতে পারে কেউ। কিংবা সন্ত্রাসীর আখড়ায় আক্রমণ করতে গিয়ে কচুকাটা হয়েও মরণ আসতে পারে। মরার এসব উপায় নিঃসন্দেহে সম্মানজনক।
সত্যি বলতে কী, এমনও অনেক কম সম্মানজনক উপায় আছে যেভাবে মরলে খুব একটা অসুবিধে হতো না। উদাহরণ: দুম করে গায়ে আগুন লেগে মারা যাওয়া, যদিও হাওয়া থেকে এভাবে কারও গায়ে আগুন লাগাটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অস্বাভাবিক। তারপরও অনেকেই ছাই হয়ে যায়, পেছনে ফেলে যায় সিগারেট ধরে রাখা একটা পোড়া হাত; একটা ম্যাগাজিনে এমনটা পড়েছিল মোটকু চার্লি! বাবা ওভাবে মারা গেলে আফসোস করত না। এমনকী ছিনতাইকারীর হাত থেকে মদ খাওয়ার টাকা উদ্ধারের জন্য রাস্তায় দৌড়াতে দৌড়াতে হার্ট অ্যাটাক করে মরলেও না।
কিন্তু তার মৃত্যুর গল্পটা ভিন্ন:
বারে আগে আগেই উপস্থিত হয় লোকটা। ক্যারিয়োকি-সন্ধ্যার সূত্রপাত ঘটায় ‘হোয়াট’স নিউ পুসি ক্যাট?’ গেয়ে। মিসেস হিগলারের মতে—যদিও মহিলা তখন সেখানে উপস্থিত ছিল না-এমন ভাবে বাবা গেয়েছিল গানটা যে ওখানে টম জোনস থাকলে মেয়েলি অন্তর্বাসের সাগরে ডুবে যেত! যাই হোক, অন্তত একটা বিয়ার পাঠিয়েছিল কিছু সোনালি-চুলো পর্যটক। মিশিগান থেকে আগত মেয়েদের সেই দলটার কাছে মনে হয়েছিল—মি. ন্যান্সির মতো মিষ্টি কিছু আগে কখনও দেখেনি।
‘দোষ মেয়েদের না,’ ফোনেই তিক্ত কণ্ঠে বলছিল মিসেস হিগলার। ‘মানুষটাকে উৎসাহ দিতে চাচ্ছিল কেবল!’ এই মেয়েগুলো আঁটোসাঁটো টপস পরে ছিল; রোদে পুড়ে গেলে শুরুর দিকে যেমন হয়, তেমন ছিল তাদের ত্বক। প্রত্যেকেরই বয়েস এমন যে মিস্টার ন্যান্সির মেয়ে বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে!
ক্ষণিকের মাঝেই মেয়েদের টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় লোকটা, চুরুট টানতে টানতে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয়—যুদ্ধের সময় আর্মির ইন্টেলিজেন্সে ছিল; যদিও কোন যুদ্ধের সময়, তা স্থির করে বলেনি। খালি হাতে কাউকে হত্যা করার এক ডজন উপায় নাকি তার জানা, আর সেজন্য ঘামও ঝরাতে হবে না!
পর্যটকদের মাঝে সবচাইতে স্বর্ণকেশী, আর সবচাইতে বিদ্রোহী বক্ষের মালকিনকে নিয়ে ড্যান্স ফ্লোরে পা রাখে সে। এদিকে সেই মুহূর্তেই আরেক পর্যটক মঞ্চে উঠে গাইছিল—স্ট্রেঞ্জারস ইন দ্য নাইট। সময়টা দারুণ উপভোগ করছিল বুড়ো লোকটা, সঙ্গিনী তার চাইতে লম্বা হলেও… ন্যান্সির হাসিমুখ ঘোরা-ফেরা করছিল মেয়েটার বুকের উচ্চতায়।
নাচ শেষ হলে সে ঘোষণা করল, আবার তার গান গাইবার সময় হয়েছে। মোটকু চার্লির যে মেয়েমানুষ পছন্দ, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তারপরেও ‘আই অ্যাম হোয়াট আই অ্যাম’ গেয়ে শোনাল সে উপস্থিত জনতাকে; যদিও বিশেষ করে লক্ষ্য ছিল মঞ্চের ঠিক সামনের টেবিলে বসা সেই স্বর্ণকেশী মেয়েটা। সবটুকু দরদ ঢেলে গানটা গাইল সে। গাইতে গাইতে গানের সেই পর্যায়ে এসেছিল যখন জোর গলায় সবাইকে জানাচ্ছিল: যদি নিজের সত্তাকে সবার সামনে তুলে ধরতে না পারে, তাহলে বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন; আচমকা বিকৃত হয়ে যায় মানুষটার চেহারা, এক হাতে চেপে ধরে বুক; অন্য হাতটা বাড়িয়ে ধরে আছড়ে পড়ে মেঝেতে। তবে ধীরে এবং যতটা সম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে। মঞ্চ থেকে সরাসরি স্বর্ণকেশীর ওপর পড়ে যায় সে, মেয়েটাকে নিয়ে মেঝেতে পাতে শয্যা।
‘এভাবেই যেন মরতে পারে, সেই কথা বলতে ওকে বহুবার শুনেছি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানিয়েছিলেন মিসেস হিগলার।
তারপর মোটকু চার্লিকে মহিলা জানাল: ওর বাবা তার জীবনে সর্বশেষ কোন কাজটা করেছে। মঞ্চ থেকে মেঝেতে পড়ার সময়, হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরতে চায় সে; সক্ষমও হয়! আর জিনিসটা হলো—স্বর্ণকেশী পর্যটকের টিউব টপ। প্রথম প্রথম দর্শকরা ভাবে লালসা চরিতার্থ করতেই মঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে পড়েছে সে; অবাধ্য স্তনজোড়াকে মুক্তি দিতে চেয়েছে পোশাকের আবরণ থেকে। কেননা মেয়েটাও আবক্ষ নগ্ন হয়ে, লজ্জা আর আতঙ্কে চেঁচাতে শুরু করে দিয়েছিল। এদিকে তখনও বেজে চলছে ‘আই অ্যাম হোয়াট আই অ্যাম’-এর সুর, যদিও গাইছে না কেউ।
যখন দর্শকরা বুঝতে পারল যে আসলে কী হয়েছে, তখন দুই মিনিট ব্যাপী নীরবতা পালন করল সবাই। মোটকু চার্লির বাবাকে বয়ে নিয়ে তুলে দেওয়া হলো একটা অ্যাম্বুলেন্সে। এদিকে চিৎকাররত স্বর্ণকেশীর আশ্রয় হলো লেডিজ রুমে।
মোটকু চার্লি কেন যেন ওই স্তনজোড়ার কথা মাথা থেকে বের করতে পারল না। ওগুলো যেন অভিযোগের সঙ্গে দেখছে ওকে, যেভাবে কোনো ছবির চোখজোড়া তাকিয়ে থাকে। বারবার এমন একদল লোকের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে সে মনে মনে, যাদেরকে কখনও দেখেওনি! ওর বাবা পুরো ব্যাপারটায় চরম মজা পেত—এই জ্ঞানটাই মোটকু চার্লিকে আরও বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছে। নিজে উপস্থিত ছিল না, এমন কোনো ঘটনা নিয়ে লজ্জা বোধ করা ছোটোখাটো ব্যাপার না–বারংবার সেই ঘটনায় ফিরে যায় মন, নেড়ে চেড়ে দেখে।
অন্তত আর সব মানুষের না গেলেও, মোটকু চার্লির মন যায় বটে!
সেই শুরু থেকেই, মোটকু চার্লি প্রথমে লজ্জা অনুভব করে দাঁতে; তারপর পাকস্থলীতে। এমনকী টেলিভিশনের পর্দাতেও যদি বিব্রতকর কিছু দেখানো হবে বলে মনে হয়, তখন মোটকু চার্লি উঠে দাঁড়িয়ে সেটা বন্ধ করে দেয়। যদি কামরায় অন্য কেউ থাকে আর যন্ত্রটা বন্ধ করতে না পারে, তাহলে অজুহাত দেখিয়ে বেরিয়ে যায় বাইরে; বিব্রতকর মুহূর্তটা ফুরিয়ে যাবার আগে ফেরে না।
দক্ষিণ লন্ডনে বাস করে মোটকু চার্লি। দশ বছর বয়সে এসেছে সে এখানে, কথায় ছিল আমেরিকান টান; কটু কথা কম শুনতে হয়নি ওকে সেজন্য। অনেক চেষ্টা করে টানটা ঝেটিয়ে তাড়িয়েছে কণ্ঠ থেকে। ষোলো বছর বয়সে সফল হয় তাতে, কিন্তু ততদিনে পালটে গেছে পাশার দান। মোটকু চার্লির বন্ধুরা আবিষ্কার করেছে— তারা আসলে কথায় আমেরিকান টান আনতে চায়। অচিরেই দেখা গেল: মোটকু চার্লি যখন আমেরিকা থেকে আসে, তখন যে টান আর শব্দগুলো ব্যবহার করত, সেভাবেই কথা বলছে ছেলেটার বন্ধুরা! অবশ্য কানমলা না খেয়ে, ওই শব্দগুলো মায়ের সামনে কখনওই ব্যবহার করতে পারেনি মোটকু চার্লি।
সে যাই হোক, বাবার মৃত্যু-সম্পর্কিত ঘটনার কারণে সৃষ্ট লজ্জা যখন বিদেয় নিলো ওর মন থেকে, তখন সেই স্থান দখল করে নিলো শূন্যতা।
‘আমার কোনো পরিবার নেই,’ প্রায় অনুযোগের সুরে বলল সে রোজিকে। ‘কেন? আমি আছি না?’ বলল মেয়েটা। শুনে হাসি ফুটল মোটকু চার্লির ঠোঁটে। ‘আমার মা-ও আছে,’ রোজি যোগ করতেই, মিলিয়ে গেল হাসিটা। ওর গালে চুমু খেল রোজি।
‘আজ রাতটা থেকে যাও,’ প্রস্তাব দিল মোটকু চার্লি। ‘সান্ত্বনা দাও আমাকে।’
‘থাকা যায় বটে,’ বলল রোজি। ‘তবে থাকছি না!’
বিয়ে আগে মোটকু চার্লির সঙ্গে শোবে না রোজি। সেই পনেরো বছর বয়সেই নাকি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল; মোটকু চার্লির সঙ্গে পরিচয় ছিল না বটে তখন, তবে সিদ্ধান্তটা যে দৃঢ় ছিল তা পরিষ্কার। আরেকবার ওকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা, এবার আরও লম্বা সময়ের জন্য। বলল, ‘বাবার ব্যাপারে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে তোমাকে, বুঝলে?’
এই বলে নিজের বাড়ির পথে রওনা দিল মেয়েটা।
অস্থির একটা রাত কাটল মোটকু চার্লির। এই ঘুমুচ্ছে, এই করছে পায়চারী, আবার এই ঘুরে-ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ছে।
সূর্যোদয়ের সময় উঠে পড়ল সে। কর্ম-ঘণ্টার শুরুতেই ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করে জেনে নেবে—শোকসন্তপ্ত এই পরিস্থিতিতে, ফ্লোরিডার ভাড়ায় ছাড় পাওয়া যাবে কি না। তারপর ফোন করবে গ্রাহাম কোটস এজেন্সিতে। তাদেরকে জানাবে: পরিবারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটায়, কয়েকদিনের ছুটি নিতে হচ্ছে ওকে। এটাও বলবে, এই কদিন যে ওর জমানো ছুটি থেকে কর্তন করে রাখা হবে, কিংবা ফেলা হবে ‘অসুস্থতা-জনিত ছুটির’ কাতারে—তা-ও জানে। কিন্তু এই মুহূর্তে, এখন…বিশ্ব নীরবতা পালন করছে বলে, মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠছে ওর।
বাড়ির পেছন দিকে অবস্থিত ছোট্ট, বাড়তি কামরাটায় এসে পা রাখল ও করিডর ধরে এগিয়ে এসে। ওখান থেকে তাকিয়ে রইল নিচের বাগানটার দিকে। ভোরের কিচির-মিচির শুরু হয়ে গেছে। কালো পাখি, চড়ুইসহ একটা সারিল পাখিও দেখতে পেল সে এক গাছের ডালে। ভাবল: যে পৃথিবীতে ভোরের ঘুম ভাঙে পাখির গান শুনে, সেটা সাধারণ একটা পৃথিবী; যে পৃথিবীতে দুইয়ে দুইয়ে সব সময় চার হয়…এ এমন এক পৃথিবী যার অংশ হতে ওর কোনো আপত্তি নেই!
পরে, যখন পাখি দেখলেই আতঙ্কে কেঁপে উঠতে শুরু করে ওর মন, তখনও এই সকালটাকে ভালো আর দারুণ কিছু একটা ভাবত মোটকু চার্লি। তবে উপলব্ধি করত: তখন থেকেই শুরু…
এই পাগলামির…
…আর এই আতঙ্কের!