অধ্যায় আট – যেখানে খেল দেখাল একটা কফি-তরতি পাত্র
ওকে তাড়াবার জন্য যে এত কিছু হচ্ছে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি স্পাইডার। এই বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই তার। উলটো আরও বেশি আনন্দে দিন কাটাচ্ছে সে মোটকু চার্লির বেশ ধরে। অবস্থা দেখে মোটকু চার্লি ভাবতে বসল—স্পাইডার আরও আগেই ওর নাম-পরিচয় দখল করার জন্য ছুটে আসেনি কেন? পিপা ভরতি বানরের নাচুন-কুঁদন দেখার চাইতেও বেশি মজা পাচ্ছে সে এখন[২৯]।
[২৯. অবশ্য কয়েক বছর আগে, পিপে ভরতি বানর স্পাইডারকে হতাশ করেছিল। একদম মজা পায়নি ওদেরকে পিপেতে ভরে। প্রথম কিছুক্ষণ কৌতূহল্লোদীপক আওয়াজ বেরোচ্ছিল ভেতর থেকে, কিন্তু খানিকপরেই একেবারে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। বানরগুলো কিছুই করছিল না—–হয়তো কোষীয় পর্যায়ে তখনও কাজ চলছিল টুকটাক—রাতের আঁধারে পুরো পিপেটাই ফেলে দিতে হয় স্পাইডারকে (লেখক)।]
মোটকু চার্লির সাজার যে সুবিধাটা পেয়ে স্পাইডার সবচাইতে বেশি আনন্দিত, তা হলো: রোজি।
এই কদিন আগেও মেয়েমানুষের ব্যাপারে স্পাইডারের মন্তব্য ছিল বড়োই সরল: একটা হলেই হলো। বিদায়ের সময় তাদেরকে কখনও আসল নাম- ঠিকানা দিত না…আর যে ফোন নম্বরটা দিত, সেটার আয়ু যে কয়েক দিনের বেশি না সেটা তো বলাই বাহুল্য। মেয়েমানুষের সঙ্গ পছন্দই করে সে; তাদেরকে অলংকার হিসেবে দেখে, দেখে দারুণ এক ‘অতিরিক্ত দ্রব্য’ হিসেবে। কিন্তু এমন জিনিসের কি আসলে কোনো অভাব আছে? কনভেয়ার বেল্টের ওপর বসে যেমন একের-পর-এক গুলাশের পাত্র আসতেই থাকে, মেয়েমানুষ তেমনই; একটার কাজ ফুরুলে, আরেকটা তুলে নিলেই হলো।
কিন্তু রোজি…
…রোজি পুরোপুরি অন্যরকম।
হাজার বার সুযোগ দিলেও, মেয়েটা আসলে কতটা ভিন্ন গতানুগতিকের চাইতে তা বলে বোঝাতে পারবে না স্পাইডার। চেষ্টা করে দেখেছে, পারেনি! রোজির সঙ্গে যখন থাকে, তখন অদ্ভুত এক অনুভূতি জেগে ওঠে মনে… যেন মেয়েটার চোখে দেখতে পেয়ে আরও ভালো একজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়…সেটা একটা কারণ হতে পারে। তবে অনেকগুলো কারণের মাঝে একটা।
কখন ওকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, রোজি যে তা জানে—এই ব্যাপারটা স্পাইডারের ভালো লাগে; আলাদা একটা স্বস্তি পায়। মেয়েটার দেহের বাঁকগুলো উপভোগ করে মজা পায়, আনন্দে ভরে ওঠে তার হাসি, এবং পৃথিবীর কেবল ভালো করার মানসিকতা। রোজির মাঝে খারাপ কিছুই নেই, শুধু ওর থেকে আলাদা থাকার সময়টা ভালো লাগে না একদম।
অবশ্য আজকাল ‘রোজির মা’ নামের প্রাণিটার উপস্থিতির যন্ত্রণা একটু- একটু করে বোধ করতে শুরু করেছে সে!
আজকের এই বিশেষ সন্ধ্যায়, যখন মোটকু চার্লি চার হাজার মাইল দূরের একটা বিমানবন্দরে বসে ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী হিসেবে পদোন্নতির জন্য অপেক্ষা করছে, স্পাইডার তখন দাঁড়িয়ে আছে রোজির মায়ের উইম্পোল স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। মহিলার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জন করছে, যেটাকে কোনো ভাবেই সুখকর বলা যায় না।
বাস্তবতাকে নিজের চাহিদা মোতাবেক খানিকটা বাঁকিয়ে নিতে অভ্যস্ত স্পাইডার। ওই খানিকটাতেই সাধারণত কাজ চলে যায়। বাস্তবতাকে বুঝিয়ে দিতে হয়, কার কথায় সে নাচে–এই যা। কিন্তু আগে এমন কারও সঙ্গে দেখা হয়নি, যে রোজির মায়ের মতো দৃঢ়ভাবে নিজের বাস্তবতায় শেকড় গেড়ে বসে আছে!
‘কে এ?’ জিজ্ঞেস করল মহিলা। ওদেরকে ঢুকতে দেখেই সন্দিহান হয়ে পড়েছে।
‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি,’ জবাব দিল স্পাইডার।
‘এই কথা বলছে কেন ব্যাটা?’ আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল রোজির মা। ‘কে এই ব্যক্তি?’
‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি, আপনার ভবিষ্যৎ মেয়ে-জামাই। আমাকে আপনি পছন্দ করেন,’ দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বলল স্পাইডার।
কেঁপে উঠল রোজির মা, চোখ পিটপিট করে কিছুক্ষণ দেখল ওকে। ‘মোটকু চার্লি তুমি হতে পারো,’ অনিশ্চয়তার সঙ্গে বলল সে। ‘কিন্তু তোমাকে আমি পছন্দ করি না।’
‘হয়তো,’ জানাল স্পাইডার। ‘তবে পছন্দ আপনার করা উচিত। আমাকে সবাই পছন্দ করে। আসলে আমার মতো পছন্দসই মানুষ, পৃথিবীর বুকে খুব একটা নেই। আমাকে কতটা পছন্দ করে, সেই আলোচনা করার জন্য সভার আয়োজন করে লোকে। বেশ কিছু অ্যাওয়ার্ড পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকার একটা দেশ আমাকে মেডেল পর্যন্ত দিয়েছে, কেবল মাত্র আমাকে তারা পছন্দ করে বলে। সঙ্গে নেই যদিও, মেডেলগুলো আমি মোজার ড্রয়ারে রাখি।’
নাক টানল রোজির মা। কী যে হচ্ছে, তা বুঝতে পারছে না। কিন্তু যাই হোক না কেন, সেটা পছন্দ হচ্ছে না তার। এতদিন পর্যন্ত ভাবত, মোটকু চার্লির ভাবগতিক সে ঠিক ধরতে পেরেছে। হ্যাঁ, অন্তত নিজের কাছে স্বীকার করে, শুরুর দিকে পরিস্থিতি আরেকটু ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেত: যদি মোটকু চার্লির সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের পরপরই সে নিজে ওভাবে সম্পর্কটার বিপক্ষে কথা না বলত, তাহলে মনে হয় না রোজি এমন আঠার মতো সেঁটে যেত ছেলেটার সঙ্গে। বাজে ছেলে, বলেছিল রোজির মা। কিন্তু রোজিকে হাজারো বুঝিয়েও মোটকু চার্লিকে পরিত্যাগ করাতে পারেনি। তাই এখন মহিলার মূল লক্ষ্য হলো বিয়ের পরিকল্পনা নিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে, মোটকু চার্লির নাকের পানি আর চোখের পানি এক করা। আজকাল বারবার সে দেশের তালাকের পরিসংখ্যান দেখে, আর মুচকি মুচকি হাসে আত্মতৃপ্তির হাসি।
কিন্তু এখন ভিন্ন কিছু ঘটছে, এমন কিছু যা তার পছন্দ হচ্ছে না। মোটকু চার্লিকে এখন আর নিরীহ শিকার মনে হচ্ছে না। এই নতুন, চাল্লু ব্যক্তিটি মহিলাকে ভাবিয়ে তুলছে।
এদিকে স্পাইডারও বুঝতে পারছে, আঙুল ওকে বাঁকা করতেই হবে।
অধিকাংশ মানুষই, মন দিয়ে অন্যকে দেখে না। কিন্তু রোজির মায়ের নাম সেই তালিকায় খুঁজে পাওয়া যাবে না, সব কিছুই মনোযোগের সঙ্গে দেখে সে। একটা চীনেমাটির কাপ থেকে গরম পানি পান করল মহিলা; ভালো করেই বুঝতে পারছে যে এই মাত্র একটা খণ্ড যুদ্ধে হার মেনেছে। কিন্তু যুদ্ধটা কেন বা কী নিয়ে হলো, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তার। তারপরেও সিদ্ধান্ত নিলো, লড়াই করতে হলে উঁচু জায়গা থেকে করাই ভালো।
‘চার্লস, সোনা,’ বলল মহিলা। ‘তোমার আত্মীয়া, ডেইজির কী খবর? ভাবছি, তোমার দিককার আত্মীয়স্বজনদের ওপর বিয়ের অনুষ্ঠানে যথেষ্ট আলোকপাত হচ্ছে না। তা ওকে বড়োসড়ো কোনো কাজ দেবে নাকি?’
‘কাকে?’
‘ডেইজিকে,’ মিষ্টি করে বলল রোজির মা। ‘সেদিন বিকেলে, প্রায় ন্যাংটো হয়ে যে মেয়েটা তোমার বাড়িতে ঘোরাফেরা করছিল, তার কথা বলছি। সে তোমার আত্মীয়া না?
‘মা! চার্লি যদি বলে থাকে যে মেয়েটা ওর দূরসম্পর্কের বোন…’
‘নিজের কথা ওকে নিজেই বলতে দাও, রোজি,’ বলে আরেক চুমুক গরম পানি পান করল ওর মা।
‘ওহ,’ বলল স্পাইডার। ‘ডেইজি!’
নারী, মদ আর গানের রাতের কথা মনে করতে চাইল সে: সবচাইতে সুন্দরী আর সবচাইতে আমুদে মেয়েটাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছিল সে। সেদিনও বাস্তবতাকে একটু বাঁকিয়ে মেয়েটার মাথায় ঢুকিয়েছিল, বুদ্ধিটা তার নিজেরই; আধা-অচেতন মোটকু চার্লির বড়োসড়ো দেহটাকে ধরে ওঠাতে সাহায্য করতে চায় সে।
রাতভর বেশ কিছু সুন্দরীর আগ্রহের কেন্দ্রবস্তু ছিল স্পাইডার। তাই ছোটোখাটো, আমুদে মেয়েটাকে রেখেছিল রাতের জন্য; যেভাবে অনেকে রাতের খাবারের পর মুখে দেবার জন্য মিন্ট সরিয়ে রাখে। অথচ রাতে মোটকু চার্লিকে পরিষ্কার করে বিছানায় শুইয়ে দেবার পর স্পাইডার আবিষ্কার করে: খিদেটা আর নেই।
সেই মেয়েটাই হবে…
‘আমার মিষ্টি, ছোট্ট বোন ডেইজি,’ না থেমেই বলে চলল সে। ‘বিয়ের কাজে অংশ নিতে পারলে খুশিই হতো, কিন্তু দেশে তো থাকতে হবে সেজন্য। মেয়েটা এটা-সেটা বহন করে একদেশ থেকে অন্য দেশে। সবসময়ই চলার ওপরেই থাকে। এই আমার বাড়িতে আছে তো এই একটা গোপনীয় কাগজ নিয়ে ছুটে গেছে মুরমানস্কে।’
‘ওর ঠিকানা নেই? কিংবা ফোন নম্বর?’
‘আপনি আমি মিলে খুঁজে দেখার চেষ্টা করতে পারি,’ জানাল স্পাইডার। ‘কিন্তু ও শুধু আসে আর যায়।’
‘তাহলে,’ মহান আলেক্সান্ডার যেভাবে কোনো পারসিয়ান গ্রামে হামলা করার নির্দেশ দিতেন, ঠিক সেভাবেই আদেশ দিল রোজির মা। ‘পরেরবার যখন মেয়েটা দেশে আসবে তখন এখানে নিয়ে এসো। মেয়েটা খুবই মিষ্টি, ওর সঙ্গে দেখা হলে রোজি খুশিই হবে।’
‘অবশ্যই,’ রাজি হলো স্পাইডার। ‘অবশ্যই দাওয়াত দিব।’
.
প্রত্যেকটা মানুষ, যে অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, আর ভবিষ্যতে থাকবে…একটা করে গানের মালিক। কিন্তু এটা অন্য সবার লেখা গতানুগতিক গানের মতো না, এই গান অনন্য। তার আছে নিজস্ব সুর, আছে নিজস্ব শব্দ। হাতেগোনা অল্প কজন নিজের সেই গান গাইতে পারে। যদি গাওয়াটা ঠিকঠাক না হয়—এই ভেবে অধিকাংশ পিছিয়ে আসি। কিংবা ভাবি, আমাদের পঙতিমালা হয়তো অনেক বেশি বোকামিতে ভরে, কিংবা একটু বেশিই কাঠখোট্টা অথবা অদ্ভুত। তাই আমরা না, আমাদের গানগুলোকে বাস্তবায়ন করে অন্য কেউ।
এই যেমন ডেইজির কথাই কথা ধরা যাক; ওর নিজস্ব গানটা ওরই জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ধরে মাথার পেছনে বেজেছে…অনেকটা আশ্বস্ত করার মতো করে, এগিয়ে যাবার প্রণোদনা জোগাতে। শব্দগুলো ছিল দুর্বলকে রক্ষা করার উৎসাহদায়ী। শুরুতেই আছে কোরাস, ‘অপরাধীরা সাবধান!’ তাই উচ্চকণ্ঠে গাইবার মতো গান ওটা না। তবে গোসল করার সময় বাথরুমে ঢুকে আপনমনে গেয়েছে বটে ডেইজি।
ডেইজির ব্যাপারে কেবল এতটুকুই জানাই যথেষ্ট, বাকিটাকে বলা চলে মেদ।
মেয়েটার বাবা জন্মগ্রহণ করে হংকং-এ। ওর মা আবার ইথিয়োপিয়ান; নানার পরিবার গালিচা রপ্তানি করে বহুত পয়সা কামিয়েছিল। এমনকী আদ্দিস আবাবায় একটা বাড়ি পর্যন্ত ছিল তাদের, আরেকটা ছিল নাজরেতের ঠিক বাইরে; ওখানে জমিও ছিল বেশ খানিকটা। ক্যামব্রিজে দেখা হয় ডেইজির বাবা-মায়ের–বাবা পড়তে এসেছিল ‘কম্পিউটিং’, তখনও পেশা হিসেবে ওটাকে জাতের কিছু মনে করা হতো না। এদিকে মায়ের বিষয় ছিল মলিকুলার কেমিস্ট্রি আর ইন্টারন্যাশনাল আইন।
এই দুই যুবক-যুবতী ছিল সমান মেধাবী, বইয়ে নাক গুঁজে রাখতে ভালোবাসত; স্বাভাবিকভাবেই, তারা ছিল লাজুক আর আত্মকেন্দ্রিক। বাড়ির পরিবেশে অভ্যস্ত মানুষ দুজনের উভয়েই খুব করে সেই অভাবটা বোধ করছিল। তবে হ্যাঁ, দাবা খেলতে পছন্দ করত দুজনেই। এক বুধবার বিকেলে, দাবা ক্লাবে দেখা হয় তাদের। নবিস বলে একে-অন্যের বিরুদ্ধে খেলতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওদের। প্রথম খেলায় আরামসে ডেইজির বাবাকে হারিয়ে দেয় ওর মা।
ব্যাপারটা হজম করতে পারেনি ডেইজির বাবা, তাই পরবর্তী বুধবারে ফিরতি ম্যাচ খেলার প্রস্তাব দেয় সে। এর পরের দুটো বছরের প্রত্যেক বুধবার (ছুটির দিন বাদে), বিকেলে দাবা খেলে ওরা একে-অন্যের সঙ্গে।
সামাজিকভাবে মেলামেশার দক্ষতা আর ইংরেজি বলার ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে তাল দিয়ে বাড়তে থাকে সামাজিকতাও। একসঙ্গে, হাতে হাত ধরে তারা মানবশিকল বানিয়ে মিসাইল ভরতি বড়ো বড়ো ট্রাকের আগমনের প্রতিবাদ জানায়। একসঙ্গে, আরও বড়ো একটা দলের অংশ হয়ে, বার্সেলোনায় পা রাখে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে; কর্পোরেশনগুলোর আগ্রাসন রুখতে হয়ে ওঠে উচ্চকণ্ঠ। মাঝে মাঝে অবশ্য ওদেরকে কাঁদুনে গ্যাসের শিকার হতে হয়, স্প্যানিশ পুলিসের হাতে মার খেয়ে আহত হয় মি. ডে-এর কবজি।
তারপর এক বুধবার বিকেলে, তখন ক্যামব্রিজে তাদের পা রাখার তৃতীয় বছর চলছে, ডেইজির মাকে দাবায় পরাজিত করল ওর বাবা। বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়েছে, সাহসের ডানায় ভর করে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাবই দিয়ে বসে লোকটা। এদিকে ডেইজির মা, যে অন্তরে অন্তরে এই ভয়ে ছিল যে
একটা ম্যাচ জিতলেই ওর প্রতি ডেইজির বাবার সব আগ্রহ উবে যাবে, হ্যাঁ বলতে তাই কালক্ষেপণ করেনি।
ইংল্যান্ডেই রয়ে যায় তারা, লেখাপড়া শেষ করে। একটা কন্যাসন্তান আসে ওদের ঘর আলো করে, আর নাম রাখে ডেইজি। কারণ সেই সময় ওদের ছিল (যেটায় পড়ে খোদ ডেইজিও চরেছিল) একটা ট্যান্ডেম বাইসাইকেল – যাতে দুইজন চড়ার মতো ব্যবস্থা ছিল! পুরো ব্রিটেনের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়াত এই জোড়া: ডেইজির বাবা পড়াত কম্পিউটার সায়েন্স, আর ও মা লিখত ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেট হেজেমনি নিয়ে বই… যা কেউ পড়তে চাইত না। আরও লিখত দাবার ইতিহাস, খেলার পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে…যেটা আবার অনেকেই পড়ত! তাই কোনো কোনো বছর দেখা যেত, স্বামীর চাইতে বেশি আয় করছে স্ত্রী; যদিও স্বামীর আয় কখনওই তেমন বেশি কিছু ছিল না। বয়েস হতে শুরু করলে, রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাও কমতে শুরু করল। মাঝবয়সে পা দেওয়ার পর দেখা গেল তারা পরিণত হয়েছে হাসিখুশি এক দম্পতিতে…যাদের কিনা একে-অপরের প্রতি, দাবার, ডেইজির আর ভুলে যাওয়া অপারেটিং সিস্টেম বাদে অন্য কিছুতে আগ্রহ নেই!
সমস্যা হলো, দুজনের কেউই ডেইজিকে কখনও বুঝতে পারেনি…একদম না।
একদম গোড়াতেই কেন পুলিসের প্রতি ডেইজির আগ্রহের একটা ব্যবস্থা করেনি, সে আক্ষেপ করে উভয়ে। কথা বলা যখন শিখেছে মেয়েটা, তখন থেকেই পুলিস কেন যেন ওকে আকৃষ্ট করেছে। অন্য বাচ্চা মেয়েরা যেখানে উত্তেজিত ভঙ্গিতে পোনি ঘোড়া দেখাত, সেখানে ডেইজি সমান উত্তেজনা নিয়ে দেখাত পুলিসের গাড়ি। সপ্তম জন্মদিনের পার্টিতে ছিল যেমন-খুশি-তেমন- সাজার সুযোগ। বলাই বাহুল্য, মেয়েটা সেজেছিল জুনিয়র পুলিস। এখনও ওর বাবা-মায়ের চিলেকোঠায় সেই জন্মদিনের ছবি আছে। ওতে দেখা যাচ্ছে, সাত- বছর-বয়সী মেয়েটা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে কেক দেখে: সাতটা মোম আছে ওই কেকে, যেগুলো জ্বলছে নিভছে উজ্জ্বল নীল আলোর জন্ম দিয়ে।
টিনেজ বয়সে ডেইজি ছিল ভদ্র, অনুগত আর বুদ্ধিমান এক ছাত্রী। বাবা- মা উভয়কে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে নাম লিখিয়েছিল লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে, ল অ্যান্ড কম্পিউটিং পড়তে। বাবা স্বপ্ন দেখত–মেয়ে তার হবে আইনের প্রভাষক; মায়ের মেয়ে নিয়ে বুনত স্বপ্নের জাল। ভাবত—তার মেয়ে হবে দুদে উকিল, এমনকী বিচারকও হতে পারে…যখনই বড়ো বড়ো কর্পোরেশন তার সামনে আসবে, হাতুড়ির আঘাতে তাদের আগ্রাসন থামিয়ে দেবে ডেইজি।
কিন্তু সব স্বপ্ন ভণ্ডুল করে দিয়ে পুলিস ফোর্সে নাম লেখাল ডেইজি। সানন্দে তাকে স্বাগত জানাল পুলিস বাহিনী: নারীর সংখ্যা বাড়াবার, সেই সঙ্গে বাহিনীর সদস্যদের মাঝে বৈচিত্র্য আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাদের। অন্য দিকে আবার কম্পিউটার-সংক্রান্ত অপরাধ এবং প্রতারণার সংখ্যাও বাড়ছিল দিন-কে-দিন। ডেইজিকে দরকার ছিল ওদের…
…আরও ঠিক করে বলতে গেলে—একটা না, অনেকগুলো ডেইজি তাদের প্রয়োজনে পরিণত হয়েছিল!
সেই দিনের চার বছর পর, আজ পেছন ফিরে তাকালে মোটামুটি নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায়: ক্যারিয়ার যেমন হবে বলে আশা করেছিল ডেইজি, তেমনটা হয়নি। পুলিস বাহিনী মারাত্মক বর্ণবাদী এবং যৌন-অধিকার বিষয়ে অসচেতন, তাই ওতে যোগ দিলে ডেইজি নিজেকে হারিয়ে ফেলবে, এমনকী আত্মারও বারোটা বাজিয়ে ক্যান্টিনে পাওয়া ইনস্ট্যান্ট কফির মতো গতানুগতিক বানিয়ে দেবে—বাবা-মায়ের এই সতর্কতা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়নি যদিও। সমস্যা যেটা ভোগ করতে হয়েছে তা হলো: অন্য পুলিসকে বোঝানো যে সে নিজেও একজন পুলিস। অনেক চেষ্টা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে— অধিকাংশ অফিসারের কাছেই, পুলিসগিরি করার অর্থ হলো ইংল্যান্ডের মধ্যভাগকে জঘন্য সামাজিক অবস্থানের বাজে লোকদের হাত থেকে রক্ষা করা; যারা ওঁত পেতে থাকে নিদেনপক্ষে হলেও কীভাবে পুলিসের ফোন চুরি করা যায়, সেই সুযোগের। কিন্তু ডেইজির কাছে ব্যাপারটা আলাদা। ও জানে, জার্মানির বাড়িতে বসে নাক টিপলে দুধ বেরোয় বয়সি একটা ছেলেও এমন ভাইরাস পাঠাতে পারবে যা পুরো একটা হাসপাতালকে বন্ধ করে দিতে পারে। আস্ত বোমার চাইতেও বেশি ক্ষতি হবে তাতে।
ডেইজির মতে, আজকালকার অপরাধীরা খুব ভালো করেই এফটিপি সাইট, উচ্চমানের এনক্রিপশন আর চাইলেই ফেলে দেওয়া যায় এমন প্রি- পেইড সেলফোনের প্যাঁচঘোচ মাথায় নিয়ে চলে…
…কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাদের থামাবার দায়িত্ব যে ভালোমানুষদের ওপর, তারাই সেসব জানে না!
প্লাস্টিকের একটা কাপে চুমুক দিয়েই মুখ-চোখ কুঁচকে ফেলল মেয়েটা; অনেকক্ষণ ধরে পর্দায় নজর রাখছে সে, এদিকে ঠান্ডা হয়ে গেছে ওর কফি।
গ্রাহাম কোর্টসের দেওয়া যাবতীয় তথ্য ঘেঁটে দেখেছে সে। প্রথম দেখাতেই মনে হয়, কোনো-না-কোনো ঘাপলা আছেই। আর কিছু না হলেও, ঠিক গত হপ্তাতেই নিজের নামে লেখা চার্লস ন্যান্সির সইসহ দুই হাজার পাউন্ডের চেকটাই কেস খাড়া করার জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু… মন যে কেবলই বলছে: ডাল ম্যায় কুছ কালা হ্যায়!
করিডোরের শেষ মাথায় অবস্থিত সুপারিন্টেনডেন্টের অফিসের দরজায় টোকা দিল ডেইজি।
‘এসো!’
গত তিরিশ বছর হলো নিজের ডেস্কে বসেই পাইপ ফুঁকেছেন ক্যাম্বারওয়েল, কিন্তু দালানে ‘ধূমপান নিষেধ’ আইন জারি হবার পর থেকে আর পারেন না। এখন কাজ চালান প্লাস্টিসিনের[২২] একটা টুকরো দিয়ে। সেটাকে বলের আকৃতিতে গুটিয়ে চাপ দিয়ে সমান করে ফেলেন, কিংবা করেন দলাই-মালাই। যখন মুখে পাইপ থাকত, তখন হাসিখুশি আর নরম মেজাজের মানুষ ছিলেন; এমনকী অধস্তনরা তাকে ‘মাটির মানুষ’ বলতেও দ্বিধা করত না। কিন্তু হাতে প্লাস্টিসিন থাকা অবস্থায় তিনি খিটখিটে মেজাজের হয়ে যান।
[২২. মূর্তি বা ভাস্কর্য গড়া শেখাবার সময় ব্যবহৃত কাদার মতো পদার্থ যা দীর্ঘদিন নরম থাকে।]
‘কী?’
‘দ্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সির কেসটা…’
‘কী হয়েছে ওই কেস নিয়ে?’
‘আমার মন মানছে না।’
‘মন মানছে না? মনের আবার এখানে মানামানির কী আছে?’
‘নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইছি কেসটা থেকে।’
মনে হলো না কথাটা শুনে খুশি হয়েছেন ক্যাম্বারওয়েল। ডেস্কের নিচে, ডেইজির নজরের আড়ালে, তার হাতগুলো নীলচে প্লাস্টিসিনকে পাইপের আকৃতি দান করছে। ‘কেন?’
‘সন্দেহভাজনের সঙ্গে আমার সামাজিকভাবে পরিচয় আছে।’
‘তো? ওর সঙ্গে ছুটি কাটাতে গেছিলে? নাকি ওর বাচ্চাদের গডমাদার তুমি? অ্যাঁ?’
‘কিছুই না, আমাদের একবার মাত্রা দেখে হয়েছে। রাতে ওর বাড়িতে ছিলাম।’
‘মানে ইটিস পিটিস করেছ?’ লম্বা একটা নিশ্বাস নিলেন ক্যাম্বারওয়েল, যেটা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন তার ভেতরে একইসঙ্গে কাজ করছে ক্লান্তি, বিরক্তি আর খানিকটা ধোঁয়া পাবার আকাঙ্ক্ষা।
‘না, স্যার। তেমন কিছু না। শুধু ঘুমিয়েছিলাম ওর বাড়িতে।’
‘এছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই ওর সঙ্গে?’
‘না, স্যার।’
প্লাস্টিসিনের পাইপটাকে হাতের মুঠোয় মিশিয়ে দিলেন তিনি। ‘আমার সময় নষ্ট করছ, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ তো?’
‘জি, স্যার। দুঃখিত, স্যার।’
‘যা ইচ্ছা করো, শুধু আমাকে বিরক্ত কোরো না।’
মেইভ লিভিংস্টোন একাই লিফটে চড়ে উঠে এলো ষষ্টতলায়। ধীর গতির, কাঁপতে থাকা লিফটটা ওকে সময় দিল–গ্রাহাম কোটসকে কী বলবে তা মাথায় সাজিয়ে নেবার।
একটা পাতলা, বাদামি ব্রিফকেস আছে তার সঙ্গে; ওটার মালিক ছিল মরিস: একেবারে পুরুষালী দেখতে ওটা। একটা সাদা ব্লাউজ পরে আছে সে, সঙ্গে নীল ডেনিম স্কার্ট… ধূসর কোট চড়িয়েছে গায়ে। অনেক লম্বা পা তার, ত্বক ধূসর; চুলের রং আজও সেই বিশ বছর আগের, মরিসের সঙ্গে তার বিয়ের রাতের মতোই সোনালি, রঙটা ধরে রাখতে খুব অল্প পরিমাণ কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হয়।
মরিসকে অন্তর থেকে ভালোবাসত মেইভ। ভদ্রলোক মারা যাওয়ার পরেও ফোন থেকে তার নম্বরটা ডিলিট করেনি, এমনকী মরিসের ফোনটা ফিরিয়ে দেবার পরেও। মরিসের একটা ছবি ফোনে তুলে দিয়েছিল তার ভাগনে, সেটা হারাতে চায় না মেইভ। এই মুহূর্তে স্বামীকে ফোন করতে পারলে, আর কিছু চাইত না; তার পরামর্শ এখন ওর খুবই দরকার।
স্পিকারফোনে নিজের পরিচয় দিতে হয়েছে মহিলাকে, তারপর ওপরে ওঠার অনুমতি পেয়েছে। যখন রিসেপশনে পা রাখে, তখন গ্রাহাম কোটস অপেক্ষা করছিল তার জন্য।
‘কেমন আছ তুমি, মাই গুড লেডি?’ জিজ্ঞেস করল গ্রাহাম কোটস।
‘আমি তোমার সঙ্গে গোপনে কথা বলতে চাই, গ্রাহাম,’ বলল মেইভ। ‘এখুনি।’
মুচকি হাসল গ্রাহাম কোটস; গোপনে যত নষ্ট-কল্পনা করে মেইভকে নিয়ে, তাদের অধিকাংশই এই লাইনটা দিয়েই শুরু হয়! তবে সেসব কল্পনায় মেইভ বলে, ‘তোমাকে আমার দরকার, গ্রাহাম, এখুনি।’ অথবা ‘ওহ গ্রাহাম, আমি খুব খুব খুব খুব খারাপ মেয়ে; আমাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে’। বিরল কল্পনাগুলোতে হয়তো বলত, ‘গ্রাহাম, একটা মাত্র নারী তোমার জন্য যথেষ্ট না। তাই এসো, আমার নগ্ন যমজ বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এই হচ্ছে মেইভ দুই।’
গ্রাহাম কোটসের অফিসের দিকে রওনা দিল তারা।
অফিসে পৌঁছেও মেইভ কিছু বলল না দেখে, গ্রাহাম কোটসের খানিকটা মন খারাপই হলো। এমনকী কোটটা পর্যন্ত খুলল না মহিলা। উলটো ব্রিফকেস খুলে ভেতর থেকে এক তাড়া কাগজ বের করে এনে রাখল ডেস্কের ওপর।
‘গ্রাহাম, আমার ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের পরামর্শ মোতাবেক, গত এক দশক ধরে আমাকে যেসব হিসেব দিয়েছ তা স্বাধীন একটা কোম্পানিকে দিয়ে অডিট করিয়েছি। মরিস যখন বেঁচেছিল, তখনকার সময়ের অনেক হিসাবও। দেখে নাও, যেভাবে ইচ্ছা দেখ। কিন্তু সংখ্যাগুলোর যোগফল তোমার দেওয়া হিসেবের সঙ্গে মেলে না। একদমই না। ভাবলাম, পুলিসের হাতে এসব তুলে দেওয়ার আগে একবার কথা বলা যাক। মরিসের স্মৃতির খাতিরেই এই সুযোগটা দেওয়া উচিত তোমাকে।’
‘তা তো উচিতই,’ বলল গ্রাহাম কোটস, সাপের মতো মসৃণ ভাবে। ‘অবশ্যই উচিত।’
‘আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলবে না?’ নিখুঁত একটা ভ্রু উঁচু করল মেইভ লিভিংস্টোন। দৃশ্যটা ভালো লাগল না গ্রাহাম কোর্টসের, ওর কল্পনার মেইভ অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
‘বহুদিন হলো দ্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সিতে এক অসৎ কর্মচারী কাজ করে আসছে, মেইভ। আসলে আমি নিজেই পুলিসকে খবর দিয়েছি গত হপ্তায়, যখন বুঝতে পারলাম যে কোথাও কোনো ঘাপলা আছে। আইনের লম্বা হাত এরইমাঝে কাজে লেগে পড়েছে। আমাদের এজেন্সির মক্কেলদের ওজন ও সম্মানের খাতিরে—যাদের মাঝে তুমিও আছ—পুলিস গোপনে অনুসন্ধান করছে। ওদেরকে সেজন্য ধন্যবাদ,’ দেখে মনে হলো না মেইভ সন্তুষ্ট হয়েছে তার কথায়। তাই ভিন্ন পথ ধরতে চাইল সে। ‘কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পুরোটা না হলেও, লুণ্ঠিত অর্থের অধিকাংশই তারা উদ্ধার করতে পারবে।’
মাথা নাড়ল মেইভ, শান্ত হলো গ্রাহাম কোটস। তবে খুব একটা না….
‘কোন কর্মচারী, তা জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘চার্লস ন্যান্সি। স্বীকার করে নিচ্ছি—ওকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস
করতাম। প্রচণ্ড নাড়া খেয়েছি ব্যাপারটা আবিষ্কার করে।’
‘ওহ, ছেলেটা তো খুবই মিষ্টি ছিল।’
‘প্রথম দেখায়,’ মন্তব্য করল গ্রাহাম কোটস। ‘কে কার আসল রূপটা ধরতে পারে, বলো?’
হাসল মেইভ, মিষ্টি একটা হাসি। ‘এসব কথায় চিঁড়ে ভিজবে না, গ্রাহাম। বহু বছর ধরেই হিসেবে গরমিল হয়ে আসছে, চার্লস ন্যান্সি চাকরি নেবারও আগ থেকে। সম্ভবত আমার বিয়েরও আগে থেকে হবে! মরিস তোমাকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করত, তার কাছ থেকে পয়সা চুরি করেছ তুমি। এখন তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, কর্মচারীদের একজনকে ফাঁসাতে চাচ্ছ! কিংবা দায় চাপাচ্ছ সহযোগীদের ঘাড়ে। এসব বলে কাজ হবে না!’
‘নাহ,’ বলল গ্রাহাম কোটস, অনুতপ্ত ভঙ্গিতে। ‘দুঃখিত।’
কাগজের তাড়া আবার গুছিয়ে নিলো মহিলা। ‘জানার কৌতূহল হচ্ছে বলে জিজ্ঞেস করছি,’ জানতে চাইল মেইভ। ‘আমার আর মরিসের কাছ থেকে কত টাকা চুরি করেছ? আমার হিসেবে তিন মিলিয়নের মতো হবে।’
‘আহ,’ এখন আর হাসছে না লোকটা। আসল অঙ্কটা অনেক বেশিই হবে। ‘মোটামুটি তেমনই হবে।’
একে-অন্যের দিকে তাকাল ওরা, মাথার ভেতর ঝড়ের গতিতে হিসেব কষছে গ্রাহাম কোটস। সময় লাগবে ওর, এছাড়া আর কিছুই দরকার নেই। ‘যদি আমি,’ প্রস্তাব দিল সে। ‘তোমাকে পুরো টাকা ফেরত দেই, নগদে এবং সুদসহ…এই ধরো মোট অঙ্কের ৫০ শতাংশ, তাহলে চলবে?’
‘আমাকে সাড়ে চার মিলিয়ন পাউন্ড দেবে তুমি? তাও নগদে?’
এমন ভাবে হাসল গ্রাহাম কোটস, যেভাবে ছোবল হানার আগে কোবরা হাসে! ‘পু-বশ্যই। যদি তুমি পুলিসের কাছে যাও, তাহলে সব অভিযোগ অস্বীকার করে ভাড়া করব দুদে সব উকিলকে। ভাগ্য যদি খারাপ হলে লম্বা সময় ধরে চলবে বিচার। তখন আমি বাধ্য হবো মরিসের সুনামকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে। যদি আমাকে জেলে যেতেও হয়, তাহলে যেতে হবে দশ থেকে বারো বছরের জন্য। যার মাঝে বড়োজোর পাঁচ বছর চোদ্দো শিকের পেছনে থাকতে হবে। কিন্তু অনুগত কয়েদি হলে এরপর ছাড়া পেয়ে যাবো। এদিকে কয়েদির সংখ্যা অনেক বেশি বলে, সম্ভবত খোলা কয়েদখানায় কাটাতে হবে সময়টা। এসবের কোনোটাই খুব একটা কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরেকটা কথা বলে দিই—পুলিসের কাছে গেলে তুমি মরিসের পয়সার ঝনঝনানিও তুমি শুনতে পাবে না। তারচেয়ে বরং মুখ বন্ধ রাখো, পয়সা তো পাবেই…ক্ষতিপূরণও পাবে। আমাকে একটু সময় দাও, তাহলে ঠিক কাজটাই করব। আশা করি আমার কথা বুঝতে পারছ!’
মেইভ ভাবল প্রস্তাবটা নিয়ে। ‘তোমাকে জেলে পচে মরতে দেখে খুশি হতাম,’ জানাল সে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। ‘ঠিক আছে, টাকাই দাও। কিন্তু তারপর আর তোমার চেহারা দেখতে চাই না, তোমার সঙ্গে আমার চুক্তিও আর বহাল থাকবে না। এরপর থেকে সম্মানীর সব চেক যেন সরাসরি আমার কাছেই আসে।’
‘অবশ্যই, সেফটা ওদিকে,’ ইঙ্গিতে দেখাল গ্রাহাম কোটস।
দূরের দেওয়ালে দেখা যাচ্ছে একটা বইয়ের তাক। চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা ডিকেন্সের বই দেখা যাচ্ছে ওখানে। সঙ্গে আছে থ্যাকারে, ট্রোলোপ আর অস্টিনের বইও; একটাও সম্ভবত খুলে দেখা হয়নি। একটা বই ধরে গ্রাহাম কোটস টান দিতেই, বইয়ের তাক সরে গেল এক পাশে। দেখা গেল, ওটার পেছনে রয়েছে একটা দরজা; রং করা হয়েছে এমনভাবে যেন দেওয়ালের রঙের সঙ্গে মিলে যায়।
মেইভ ভাবল, সেফের কম্বিনেশন কী হতে পারে? কিন্তু না, কম্বিনেশনের দরকার নেই। একটা গর্ত আছে ওতে, যেটায় গ্রাহাম কোটস বড়োসড়ো একটা পেতলের চাবি ঢুকিয়ে দিল। হাঁ করে খুলে গেল দরজা।
ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বালাল লোকটা। ছোট্ট, সরু একটা কামরা; ভেতরে যে তাকগুলো আছে তা নবিসের হাতে লাগানো। একদম দূরের কোনায় রয়েছে একটা ছোট্ট, অগ্নিরোধক ফাইলিং ক্যাবিনেট।
‘চাইলে নগদ টাকায় নিতে পারো, কিংবা রত্নের মাধ্যমে… অথবা দুটো মিলিয়েও নিতে পারো,’ সরাসরি জানাল লোকটা। ‘আমি পরামর্শ দেব, শেষেরটাই করো। এখানে কিছু অ্যান্টিক সোনা আছে, বহনযোগ্যও।’
বেশ কয়েকটা স্ট্রংবক্স খুলে, ভেতরের জিনিসও দেখাল গ্রাহাম কোটস। আংটি, চেইন আর লকেট ঝিকিয়ে উঠল ভেতর থেকে।
হাঁ হয়ে গেল মেইভের মুখ। ‘দেখো, ওকে বলল গ্রাহাম কোটস। লোকটার পাশ দিয়ে ভেতরে পা রাখল মহিলা।
এক কথা বলা যায়–ভেতরটা যেন গুপ্তধনের খনি!
চেইনঅলা একটা সোনার লকেট হাতে তুলে নিলো মেইভ, উঁচু করে অবাক হয়ে চেয়ে রইল ওটার দিকে। ‘অসাধারণ সুন্দর,’ বলল সে। ‘দাম কম করে হলেও তো—’ বলতে বলতেই থেমে গেল বেচারি, কেননা পালিশ করা সোনার লকেটে দেখতে পেয়েছে—কিছু একটা নড়ছে ওর পেছনে। ঘুরে দাঁড়াল সে ঝট করে, তাই হাতুড়িটা ওর মাথার ঠিক পেছনে লাগল না; যদিও গ্রাহাম কোটসের ওখানেই আঘাত হানার ইচ্ছে ছিল।
হাতুড়ির বাড়িটা লাগল গালের এক পাশে, তাও আলতো করে।
‘হারামজাদা!’ চেঁচিয়ে উঠে লোকটাকে লাথি বসালো মহিলা। পায়ে মেইভের যথেষ্টই শক্তি আছে, কিন্তু তার আর আক্রমণকারীর মাঝে তেমন একটা দূরত্ব নেই বলে ঠিকমতো লাগাতে পারল না।
মেইভের লাথিটা লাগল গ্রাহাম কোটসের পায়ের সামনের দিকে। সেই সঙ্গে লোকটার হাতে থাকা হাতুড়ির দিকে ঝুঁকল মহিলা। আবার আঘাত হানল গ্রাহাম কোটস, এবার লাগল জায়গামতোই; টলে উঠে এক পাশে পড়ে গেল মেইভ, তার চোখে দেখা গেল ঘষা কাচের দৃষ্টি। আবার আঘাত হানল লোকটা, এবার সরাসরি মাথার ওপর দিকটায়… তারপর মারল আবার, তারপর আবারও!
একটা অস্ত্রের অভাব খুব করে বোধ করছে গ্রাহাম কোটস। একটা সুন্দর, ভালো হ্যান্ডগান হলে বেশ হতো। আর চলচ্চিত্রের মতো সাইলেন্সারঅলা হলে তো সোনায় সোহাগা। আসলে যদি কখনও ভাবত যে অফিসে কাউকে হত্যা করতে হবে, তাহলে সেই ব্যবস্থা করে রাখত। এমনকী বিষের ব্যবস্থাও রাখত হয়তো। নিঃসন্দেহে, ওই কাজটা করলেই ভালো হতো। তাহলে এখন হাতে রক্ত মাখাতে হতো না।
হাতুড়ির সঙ্গে লেপটে আছে রক্ত আর সোনালি চুল। ঘৃণার সঙ্গে মেঝেতে ফেলে দিল ওটা, তারপর সাবধানে মেইভের লাশটাকে ঘুরে অতিক্রম করল। ওর মনোযোগ এখন অলঙ্কারে ভরতি সেফ বক্সের দিকে। ডেস্কের ওপর থেকে সব কিছু আবার বক্সে ভরে ফিরিয়ে দিল সেফে। ওখান থেকে একশো ডলার আর পাঁচশো ইউরোর নোটে ভরতি একটা অ্যাটাশে কেস আর অকাটা হীরে দিয়ে ভরতি কালো, ভেলভেটের ব্যাগ বের করে নিলো। ফাইলিং ক্যাবিনেট থেকে কিছু ফাইলও সরালো গ্রাহাম কোটস। সব শেষে নিলো সবচাইতে দামি জিনিসটা—গোপন কামরা থেকে বের করে নিলো ছোট্ট, চামড়ার ভ্যানিটি কেসটা; যার ভেতরে আছে দুটো ওয়ালেট আর দুটো পাসপোর্ট।
ভারী দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল লোকটা, তারপর তালা লাগিয়ে বইয়ের তাকটা আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনল।
তারপর দাঁড়িয়ে রইল ওভাবেই, হাঁপাল কিছুক্ষণ; দম ফিরে পেতে চাইছে। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা গর্ব করার মতো করেই সামাল দিয়েছে-সিদ্ধান্ত নিলো অবশেষে। ভালোই দেখালে খেল, গ্রাহাম। বেশ ভালো। হাতে থাকা জিনিসপত্র কাজে লাগিয়ে, গাড্ডা থেকে বেরিয়ে এসেছে: ধোঁকা দিয়েছে, তবে সেটা দক্ষতার সঙ্গে আর মাথা খাটিয়ে; কথা যেমন আছে: হয় ছক্কা, নয় অক্কা। বাজি ধরে ছিল সে, ছক্কাই মেরেছে। এক দিন গ্রীষ্মমণ্ডলের কোনো একটা স্বর্গীয় দ্বীপে শুয়ে, নিজের আত্মজীবনী লিখবে সে। লোকেরা জানবে— কীভাবে এক বিপজ্জনক মহিলার বিরুদ্ধে নেমেও জয়লাভ করেছে। অবশ্য, ভাবল লোকটা, মেইভের হাতে বন্দুক থাকলে নাটকীয়তা আরও বাড়ত।
সম্ভবত, ঘটনা আবার ভাবতেই মনে হতে লাগল গ্রাহাম কোর্টস, মেইভ আসলেও অস্ত্র তাক করেছিল ওর দিকে। মোটামুটি নিশ্চিত মনে হচ্ছে এখন নিজেকে—মহিলাকে অস্ত্রের দিকে হাত বাড়াতে দেখেছে। হাতুড়িটা যে ওখানে ছিল, সেজন্যই কপালকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। মাঝে মধ্যে টুকিটাকি মেরামতির দরকার পড়ে যায়, তাই কামরার ভেতরেই রেখেছিল ওটাকে; নইলে এত সহজে আর এত দ্রুত আত্মরক্ষা করতে পারত না।
এতক্ষণে মাথায় এলো ওর—অফিসের দরজাটা লাগিয়ে দেওয়া উচিত।
শার্ট আর হাতে রক্ত লেগে আছে, জুতোর তলাতেও। শার্ট খুলে ওটা দিয়েই জুতো মুখে নিলো সে। তারপর ডেস্কের পাশের ময়লা ফেলার বাক্সে ছুড়ে মারল শার্টটাকে। নিজেকেই অবাক করে দিয়ে হাতটা মুখের কাছে এনে, রক্তের দাগ চেটে পরিষ্কার করল… অনেকটা বেড়ালের মতো…
…রক্তাক্ত জিভ দিয়ে!
তারপর হাই তুলল একটা। মেইভের কাগজপত্র ডেস্ক থেকে তুলে শ্রেডারে ফেলে ফালি ফালি করে কাটল। ব্রিফকেসে আরেক সেট কাগজ এনেছিল মহিলা, সেগুলোরও হলো একই দশা। এরপর ফালিগুলো এক করে আবার ফেলল শ্রেভারে।
অফিসের এক কোনায় একটা ক্লজেট আছে তার, সেখানে ঝুলছে বাড়তি স্যুট। এছাড়াও শার্ট, মোজা, অন্তর্বাসসহ পরিধেয় সবকিছুই আছে। অফিস থেকে কখন সরাসরি কোথাও যেতে হয়, তা কে বলতে পারে?
তাই…সাবধানের মার নেই।
সতর্কতার সঙ্গে পোশাক পালটে নিলো গ্রাহাম কোটস।
ক্লজেটে আরেকটা জিনিস আছে, ছোট্ট একটা সুটকেস; তাও চাকাঅলা। বিমানে, মাথার ওপরের বাক্সে সাধারণত যে ধরনের সুটকেস তোলা হয়, অনেকটা তেমন। ভেতরে আগে থেকেই এটা-সেটা ছিল, এবার তাতে ভরে নিলো কিছু জিনিস।
রিসেপশনে ফোন দিল এরপর। ‘অ্যানি,’ বলল সে। ‘একটা স্যান্ডউইচ এনে দেবে? নাহ, প্রেট-এর স্যান্ডউইচ ভালো না। ব্রিউয়ার স্ট্রিটের নতুন দোকানটা চেনো? ওখান থেকে আনো তাহলে। মিসেস লিভিংস্টোনের সঙ্গে কাজ প্রায় শেষ। এরপর তাকে নিয়ে খেতে যেতে পারি, তারপরেও ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই।’
কম্পিউটারের সামনে কাটল আরও কিছু মুহূর্ত; ভেতরের সব ফাইল ঝেড়ে-পুঁছে পরিষ্কার করে, এমন একটা প্রোগ্রাম চালালো। ওটা সব তথ্য গুছিয়ে নিয়ে তাতে এলোপাথাড়িভাবে ‘o’ আর ‘১’ লেখে। তারপর ওগুলোকেও ছোটো ছোটো ভাগ করে শেষ পর্যন্ত মুছে ফেলে পুরোপুরি। থেমসের মধ্যখানে কাউকে কংক্রিটের জুতো পরিয়ে ছেড়ে দিল যেমন চিরতরে ডুবে যাবে, অনেকটা তেমনই। কাজ সেরে পা রাখল সে হলে, সঙ্গে টেনে আনছে তার সুটকেস।
একটা অফিসের ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, ‘একটু বাইরে যাচ্ছি। তিনটের মাঝে ফিরব, কেউ জানতে চাইলে বলে দিয়ো।’
রিসেপশনে নেই অ্যানি। ভালোই হলো, ভাবল লোকটা। অধিকাংশই ভাববে–মেইভ লিভিংস্টোন এরইমাঝে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে, আর গ্রাহাম কোর্টসও ফিরে আসবে যেকোনো সময়। খোঁজ শুরু হবার আগেই, অনেক দূর চলে যেতে পারবে ও!
লিফট ধরেই নিচে নামল গ্রাহাম কোটস। পরিকল্পনায় এত দ্রুত সব ঘটনা ঘটার কথা ছিল না, ভাবল সে। আরও বছরখানেক পর ওর বয়েস পঞ্চাশ হবে। কিন্তু যা হবার, তা তো হবেই। খেলাও মাঠে গড়িয়েছে। ব্যাপারটা ধরে নিতে হবে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক[২৩]… কিংবা এই ক্ষেত্রে গোল্ডেন প্যারাসুট হিসেবে।
[২৩. সময়ের আগেই যারা অবসরে যায়, কিংবা যাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হয়, তাদেরকে দেওয়া অর্থ।]
তারপর, পেছনে চাকাঅলা সুটকেসটাকে টানতে টানতে, অলডউইচের রৌদ্রজ্জ্বল রাস্তায় পা রাখল গ্রাহাম কোটস…
…চিরতরে পেছনে ফেলে এলো দ্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সি।
.
নিজের প্রকাণ্ড বিছানাটায় আরামসে ঘুমিয়ে রাত পার করেছে স্পাইডার, মোটকু চার্লির বাড়ির বাড়তি কামরাটায়। একবার মাথায় ভাবনা এসেছিল বটে ওর: মোটকু চার্লি কি সবসময়ের জন্য চলে গেছে ওর জীবন থেকে? পরে কখনও সময়-সুযোগ হলে এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবে, সিদ্ধান্ত নিলো সে।
উঠতে দেরি হয়ে গেছে। একেবারে লাঞ্চ খেতে রোজির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে সে। ফ্ল্যাট থেকে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে, ভালো কোথাও বসবে। শরতের শুরুর দিকের একটা সুন্দর দিন; স্পাইডার যেখানেই যাচ্ছে, সেখানেই যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে আনন্দে। কারণ, একটু বাড়িয়ে বলা হলেও, স্পাইডার আসলে দেবতা। আর দেবতাদের মনের অবস্থার প্রভাব আশপাশে তো পড়বেই! স্পাইডার যেদিন ফূর্তিতে আছে, সেদিন ওর আশপাশের মানুষজনের কাছে দিনটাকে আরও একটু উজ্জ্বল মনে হয়। যদি সে কোনো গান গায়, তাহলে ওই আশপাশের লোকজনও গুনগুন করতে শুরু করে; অনেকটা মিউজিক্যাল মুভির মতো। যদি হাই তোলে, তাহলে বোধহয় আরও শখানেক লোকও তাই করবে। যখন বিষণ্ণ থাকে, তখন সেই বিষণ্ণতা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে কুয়াশার মতো। তাই সেই আশপাশের লোকজনও ডুব দেয় বিষণ্ণতার সাগরে। এজন্য কিছু করতে হয় না ওর…
…ও যা, সেজন্যই হয়ে যায় সব।
এই মুহূর্তে ওর আনন্দের সাগরে বিষণ্নতার একমাত্র ঢেউ খেলা করার কারণ: রোজিকে সব সত্যি বলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে!
সত্যি বলাটা স্পাইডারের ঠিক আসে না। ওর কাছে সত্য হলো, অবয়বহীন একটা জিনিস যাকে ইচ্ছেমতো দলা-মোচড়ানো যায়। বলতে গেলে, অনেকটা মন্তব্যের মতো… একজনের মন্তব্যের সঙ্গে অন্যজনের মন্তব্যের কোনো মিলই পাওয়া যাবে না। যখন দরকার পড়ে, তখন স্পাইডার নিজের কাজে লাগাবার মতো ‘মন্তব্য’ করতে পারে বটে!
অন্যের রূপ ধারণ করতে আপত্তি নেই কোনো ওর, বরঞ্চ কাজটা ভালোই লাগে। এ কাজে বেশ দক্ষও। পরিকল্পনার সঙ্গে মিলেও যায়। এই পর্যন্ত যত পরিকল্পনা এঁটেছে সবই এক ধাঁচের: ক) কোনো এক জায়গায় যাও, খ) উপভোগ করো নিজেকে, এবং গ) বিরক্তি পেয়ে বসার আগে পালাও।
অন্তরাত্মা জানাচ্ছে ওকে—এখান থেকেও পালাবার সময় হয়ে গেছে। সারা পৃথিবী ওর জন্য লবস্টার, গলায় বেঁধেছে ন্যাপকিন, হাতের কাছে পড়ে আছে লবস্টারের খোলস ভেঙে ভেতরের সুস্বাদু মাংস খাওয়ার নানা যন্ত্রপাতি।
কিন্তু…
কিন্তু ওর যে যেতে ইচ্ছে করছে না!
কেন যেন চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠছে সে, ব্যাপারটা ওকে ভাবাচ্ছেও! সাধারণত কোনো কিছুই সে আগে ভেবে দেখে না। কোনো কিছু না ভেবেই জীবন কাটিয়ে দেওয়াটা এতদিন বেশ আনন্দময়ই লেগেছে— অন্তরাত্মা, অন্তজ্ঞান এবং প্রচণ্ড রকমের সৌভাগ্য এই পর্যন্ত ভালোই কাজে এসেছে ওর। কিন্তু অলৌকিকের ডানায় ভর দিয়ে আর কত দূর এগোনো যায়? রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্পাইডার, লোকজন হাসছে ওর দিকে চেয়ে।
রোজির সঙ্গে ওর ফ্ল্যাটে দেখা করার ব্যাপারে একমত হয়েছিল ওরা। তাই মেয়েটাকে রাস্তার শেষ মাথায়, ওরই জন্য অপেক্ষা করতে দেখে একইসঙ্গে অবাক আর খুশি হলো স্পাইডার। কিছু একটার খোঁচা অনুভব করল সে, যেটা এখনও অপরাধবোধে রূপ নেয়নি। হাত নেড়ে ডাকল, ‘রোজি? হাই!’
ফুটপাত ধরে ওর দিকে এগোল মেয়েটা, এদিকে ততক্ষণে হাসি ফুটেছে স্পাইডারের মুখে। সব ঠিক হয়ে যাবে, যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। ‘ডানাকাটা পরী দেখাচ্ছে,’ বলল ও। ‘হয়তো দুই পরীর মতো সুন্দরী! কী খাবে?’
হেসে শ্রাগ করল কেবল রোজি।
একটা গ্রিক রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছে ওরা। ‘গ্রিক চলবে?’ মাথা নেড়ে সায় জানাল মেয়েটা। কয়েক কদম হেঁটে ভেতরে পা রাখল ওরা। অন্ধকার, খালি একটা রেস্তোরাঁ। এই মাত্র খুলেছে। পেছন দিকের একটা জায়গা দেখিয়ে দিল মালিক।
মুখোমুখি বসল ওরা, টেবিলটা দুজনের জন্যই। স্পাইডার বলল, ‘তোমাকে একটা কথা বলতে চাই,’ শুনেও কিছু বলল না মেয়েটা। ‘দুঃসংবাদ না, আবার ভালো কথাও না।’ যোগ করল স্পাইডার। ‘তবে তোমার কথাটা জানা থাকা উচিত।’
অর্ডার দেবে কি না, জানতে চাইল মালিক। ‘কফি,’ জানাল স্পাইডার। রোজিও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দিল। ‘দুটো কফি,’ অর্ডার দিল স্পাইডার। ‘আরেকটা কথা, আমাদেরকে মিনিট পাঁচেক সময় দিন। আমরা একটু গোপনীয়তা চাইছি।’
সরে গেল মালিক।
চোখে প্রশ্ন নিয়ে স্পাইডারের দিকে চাইল রোজি।
লম্বা করে দম নিলো ছেলেটা। ‘ঠিক আছে, বলছি। শুরুতেই জানিয়ে দিই, কাজটা সহজ না। তাই শেষ পর্যন্ত কী বলব… যাক, বলেই ফেলি—আমি মোটকু চার্লি না। জানি, তুমি আমাকে সেটাই ভাবো। কিন্তু আসলে আমি ওর ভাই, স্পাইডার। আমরা কাছাকাছি দেখতে বলে আমাকে মোটকু চার্লি বলে ধরে নিয়েছ তুমি।’
কিছুই বলল না রোজি।
‘আসলে দেখতে খুব যে মিল, তাও না। কিন্তু, হয়েছে কী, আসলে…কথাগুলো বলতে পারছি না গুছিয়ে। বলেই ফেলি—তোমার কথাই সবসময় আমার মাথায় ঘুরতে থাকে। তাই জানি যে তুমি আমার ভাইয়ের বাগদত্তা, কিন্তু আমিও তোমাকে প্রস্তাব দিচ্ছি আরকি…তুমি কি, মানে ওকে ছেড়ে আমার সঙ্গে…মানে, বুঝতেই পারছ? অন্তত…ভেবে দেখবে একবার?’
কফির পাত্র চলে এলো তখন, একটা ছোট্ট রূপালি ট্রেতে করে; সেই সঙ্গে আছে দুটো কাপ।
‘গ্রিক কফি,’ মালিক নিজেই এনেছে, জানাল সে।
‘ধন্যবাদ, কিন্তু কয়েক মিনিটের গোপনীয়তা চেয়েছিলাম…’
‘খুব গরম,’ বলল মালিক। ‘অনেক বেশি গরম। আর কড়া। গ্রিক। তুর্কি না।’
‘খুব ভালো। শুনুন, মিনিট পাঁচেকের জন্য একা থাকতে দিন।’
শ্রাগ করে চলে গেল মালিক।
‘তুমি বোধহয় আমাকে ঘৃণা করছ,’ বলল স্পাইডার। ‘তোমার জায়গায় আমি থাকলে বোধহয় নিজেও তাই করতাম। কিন্তু মন থেকে বলছি তোমাকে, জীবনে এত তীব্র ভাবে কিছু চাইনি।’ এদিকে ওর দিকে নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে আছে রোজি। ‘দয়া করে কিছু একটা বলো।’
নড়ে উঠল মেয়েটির ঠোঁট, যেন বলার মতো শব্দ খুঁজছে।
অপেক্ষায় রইল স্পাইডার।
খুলে গেল মেয়েটার মুখ।
প্রথমেই ভাবল স্পাইডার, মেয়েটা বুঝি কিছু খাচ্ছে। কেননা ওর দুই দাঁতের ফাঁকে দেখা গেল বাদামি কিছু একটা, যেটাকে কোনোভাবেই জিভ বলা যায় না। তারপর ওই জিনিসটা মাথা ঘোরাতেই দেখা দিল চোখজোড়া, আর তাতে থাকা ছোট্ট ও কালো পুঁতির মতো চোখ। অস্বাভাবিক রকমের বড়ো একটা হাঁ করল রোজি।
ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো পাখির ঝাঁক!
‘রোজি?’ আঁতকে উঠল স্পাইডার। বাতাস যেন দখল করে নিলো চঞ্চু, পালক আর নখর। একের পর এক পাখি বেরোতে লাগল মেয়েটার ভেতর থেকে, প্রত্যেকটা বেরিয়েই কান ফাটানো স্বরে চিৎকার করছে স্পাইডারকে লক্ষ্য করেই।
চোখ রক্ষার জন্য হাত তুলে আড়াল করতে চাইল স্পাইডার, সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা পেল কবজিতে। ওটাকে হটাবার জন্য হাত ছোড়ার চেষ্টা করতেই, সরাসরি ওর চোখ আক্রমণ করে বসল কিছু একটা। মাথা ঝট করে পিছিয়ে সরিয়ে নিয়ে, চিবুকে আঘাতটা নিলো বেচারা।
আচমকা পরিষ্কার হয়ে গেল সামনের দৃশ্য, তবে মাত্র এক মুহূর্তের জন্য — সামনে বসে আছে এক মহিলা, ঠিক স্পাইডারের বিপরীতে। একে কীভাবে রোজি বলে ভুল করেছিল, তা বুঝতে পারল না স্পাইডার। মহিলা রোজির চাইতে অনেক বয়স্কা, তাছাড়া নীল-কালো চুলের এখানে-সেখানে লেগে আছে রূপালি ছোপ। রোজির চামড়ার মতো উষ্ণ বাদামি না তার ত্বক, বরঞ্চ কালির মতোই কালো। একটা জীর্ণ রেইনকোট পরে আছে মহিলা, হেসে মুখটাকে আরও বড়ো করল সে; ভেতরে দেখা যাচ্ছে অগণিত সিগালের নিষ্ঠুর ঠোঁট আর পাগলাটে চোখ…
নিজেকে ভাববার সময় দিল না স্পাইডার। তার আগেই নেমে পড়ল কাজে। হাত বাড়িয়ে কফির পাত্রের হ্যান্ডেলটা ধরে ফেলল, অন্য হাতে সরিয়ে ফেলেছে ডালা। তারপর ভেতরের গরম তরলটা ছুড়ে দিল মুখোমুখি বসা মহিলার দিকে। মারাত্মক গরম, কালো কফি যেন ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল পাখি-মানবীর ওপর।
ব্যথায় হিসিয়ে উঠল মহিলা।
রেস্তোরাঁর ছাদে ধাক্কা খাচ্ছে পাখির ঝাঁক, ডানা ঝাপটাচ্ছে প্রবল বেগে। কিন্তু এখন আর মুখোমুখি বসে নেই কেউ, উদ্দেশ্যহীন ভাবে উড়ছে পাখিগুলো। এমনকী উন্মত্তের মতো আছড়েও পড়ছে দেওয়ালে।
মালিক এগিয়ে এসে জানতে চাইল, ‘স্যার, আপনি ব্যথা পাননি তো? আমি দুঃখিত, বোধহয় রাস্তা থেকে ভেতরে এসে পড়েছিল…’
‘আমি ঠিক আছি,’ জানাল স্পাইডার।
‘আপনার চেহারা রক্তাক্ত,’ বলল লোকটা, এগিয়ে দিল একটা ন্যাপকিন। সেটাকে গালের সঙ্গে ঠেসে ধরল স্পাইডার। জ্বলে উঠল কাটা জায়গাটা।
পাখিদের তাড়াতে মালিককে সাহায্য করতে চাইল স্পাইডার। দরজা খুলে দিল সে, কিন্তু ভেতরটা এখন পুরোপুরি পাখি-শূন্য! যখন ভেতরে পা রেখেছিল, তখনকার মতোই।
পাঁচ পাউন্ডের একটা নোট বের করে আনল স্পাইডার। ‘এই যে, কফির দাম। আমাকে যেতে হবে।’
মাথা নাড়ল মালিক, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলল, ‘ন্যাপকিন রেখে দিন।’
থমকে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভাবল স্পাইডার। ‘আমি যখন ভেতরে আসি, ‘ জানতে চাইল সে। ‘তখন সঙ্গে কোনো মেয়েমানুষ ছিল? দেখতে পেয়েছিলেন?’
বিহ্বল দেখাল মালিক লোকটাকে, এমনকী আতঙ্কিতও বলা চলে—ঠিক নিশ্চিত না স্পাইডার। ‘মনে নেই,’ আচ্ছন্নের মতো করে বলল লোকটা। ‘আপনি একা আসলে, ওই টেবিলে আপনাকে বসাতাম না–কেবল এতটুকুই বলতে পারি। তবে আপনার প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়তার সঙ্গে দিতে পারছি না –
রাস্তায় পা রাখল স্পাইডার। দিনটা এখনও উজ্জ্বল। কিন্তু সূর্যের আলো আর আশ্বস্ত করছে না ওকে। চারপাশে তাকাল একবার, দেখতে পেল একটা কবুতর; কারও ফেলে যাওয়া আইসক্রিমে ঠোকর মারছে। জানালার ধারে বসে আছে একটা চড়ুই; মাথার অনেক ওপরে, সূর্যকে মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য ঢেকে দেওয়ার প্রয়াসে ডানা মেলেছে একটা সিগাল।