অচ্যুতম্ রাক্ষসম্
সূত্রপাত পর্ব:
৩২২ খ্রিস্টপূর্ব। স্থান মগধের রাজধানী পাটলিপুত্র।
চন্দ্রগুপ্ত তার সেনাসহ প্রবেশ করছে নন্দর রাজমহলে। তার পাশে চলেছেন তার গুরু বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য।
পৌরবরাজ পুরুর সেনা মগধের উত্তর-পশ্চিমে আক্রমণ করে একমাস আগে। চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে সন্ধি হয়েছে মহারাজ পুরুর। তারা সমবেত শক্তিতে উৎখাত করবে নন্দকে। দখল করবে মগধের সিংহাসন। মগধের শাসক মহারাজ ধনানন্দ উত্তর-পূর্বে আক্রমণের সংবাদ পেয়েই ক্রোধোন্মত্ত হয়ে আদেশ দেন তাঁর সেনাকে, অবিলম্বে উত্তর-পূর্বের দিকে রওনা হতে। পুরুর সেনাকে পর্যুদস্ত করে যেন তারা প্রমাণ করে দেয় আরও একবার যে, এই গোটা আর্যাবর্তয় মগধের থেকে শক্তিশালী কেউ নেই! মগধের বিরোধিতা করার উচিত শিক্ষা পাবে বৃদ্ধ পুরু!
এই আদেশ দিতে ধনানন্দকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর প্রধানামাত্য রাক্ষস। তিনি বলেছিলেন যে, এই মুহূর্তে রাজধানীর সুরক্ষার বেশি প্রয়োজন। রাজধানী থেকে সেনা সরিয়ে তাদের উত্তর-পূর্বে পাঠানো উচিত নয়। কিন্তু, ক্রোধে অন্ধ হয়ে তাঁর কথা শোনেননি ধনানন্দ।
.
অমাত্য রাক্ষসের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করেই, রাজধানী থেকে সেনা চলে যাওয়ার পর দশম দিনে পাটলিপুত্র আক্রমণ করে চন্দ্রগুপ্ত ও তার সেনাবাহিনী। রাজধানীতে থাকা নন্দর মুষ্টিমেয় সেনা তার দুর্ধর্ষ বাহিনীর সামনে সহজেই পরাজিত হয়েছে। বাকিরা আত্মসমর্পণ করেছে চন্দ্রগুপ্তর কাছে। প্রায় বিনা প্রতিরোধে মগধ অধিকার করল চন্দ্রগুপ্ত। গোটাটাই ঘটেছে চাণক্যর পরিকল্পনা মতো। পুরুর সেনার এই আক্রমণ আসলে চাণক্যর চতুরঙ্গর একটি দান ছিল মাত্র।
চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্য দাঁড়িয়ে আছে নন্দর রাজসভায়। তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি সিংহরণ এসে তাঁকে জানাল,
—মহারাজ চন্দ্রগুপ্তর জয়।
—বলুন, আর্য। কী সংবাদ?
—গুপ্তপথে রাজপরিবারের অনেকেই পলায়ন করেছে। কিন্তু, আমরা ধনানন্দ ও তাঁর প্রধানামাত্যকে বন্দি করেছি।
চন্দ্রগুপ্তর ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা গেল। গুরুর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বলল, —তাঁদের হাজির করুন।
কিছুক্ষণ বাদেই একদল সৈনিকের মধ্যে বন্দি অবস্থায় হাজির করা হল সদ্য সিংহাসনচ্যুত মহারাজ ধনানন্দ ও তাঁর প্রধানমন্ত্রী রাক্ষসকে। চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে দেখে বলে উঠল, —তোমার অত্যাচারের আজ শেষ হল, ধনানন্দ। বহু নিরীহ মানুষের রক্তে রাঙা তোমার ওই হাত, এই সিংহাসন। আজ তার মূল্য দেওয়ার সময় এসেছে। আজই সূর্যাস্তের সময়ে তোমার প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হবে।
চাণক্য ততক্ষণে নেমে এগিয়ে গিয়েছেন দুই বন্দির দিকে। ধনানন্দ উন্মাদের মতো চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তর উদ্দেশে অশ্রাব্য ভাষায় কটূক্তি করে চলেছেন। কিন্তু অমাত্য রাক্ষস স্থির, শান্ত। তাঁর মুখে ভয়, আশঙ্কা, কোনো কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। তাঁর সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন আচার্য চাণক্য। দু-জন মুখোমুখি হতে অমাত্য রাক্ষস খুব ধীরস্বরে বললেন, —নিজের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যাবেন না, চাণক্য।
চাণক্য কিছুক্ষণ স্থির হয়ে চেয়ে রইলেন তাঁর দিকে। তারপর চন্দ্রগুপ্তর দিকে ফিরে বললেন, —না, চন্দ্রগুপ্ত। তোমার আদেশ প্রত্যাহার করো। ধনানন্দ, তার পরিবারের কোনো সদস্য, বা, তার কোনো অমাত্যকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে না। সবাইকে নিঃশর্ত মুক্তি এবং নির্বাসনের আদেশ দেওয়া হবে।
বিস্মিত হয়ে মুহূর্তে চুপ হয়ে গেল গোটা রাজসভা। চাণক্যর কথায় সবাই এতটাই বিস্মিত হল যে, ধনানন্দও কিছুক্ষণের জন্যে শাপশাপান্ত করতে ভুলে গেল।
চন্দ্রগুপ্ত বলল,
—এ আপনি কী বলছেন, আচার্য? সমস্ত স্ত্রীদের আমরা মুক্তি দিয়েছি। আত্মসমর্পণ করা অমাত্যদেরও মুক্তি দিয়েছি। কিন্তু, তাই বলে সবাইকে মুক্তি দিতে বলছেন?
—হ্যাঁ, চন্দ্রগুপ্ত।
চাণক্যর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর আর এক শিষ্য জীবসিদ্ধি। সে নীচুস্বরে বলল, —আচার্য। এ আপনি কী বলছেন? এদের মুক্তি দিলে এরা পুনরায় আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে!
চন্দ্রগুপ্ত নেমে এসে চাণক্যর পাশে দাঁড়িয়েছে। সেও বলল,
—এ আপনি কী বলছেন, আচার্য! সবাইকে মুক্তি দেওয়া হবে? এমনকী ধনানন্দ ও রাক্ষসকেও? কিন্তু… কিন্তু কেন?
চাণক্য চন্দ্রগুপ্তর কাঁধে হাত রেখে বললেন,
—কারণ, আমি চাই না মৌর্য সাম্রাজ্যের শুরুটা রক্তাক্ত হোক। এই পর্যন্ত পৌঁছোতে আমি অনেক পাপ করেছি, চন্দ্রগুপ্ত। আমি চাই তুমি এক নতুন শুরু করো। মগধের দীর্ঘ ইতিহাসের এই হিংসার অতীত মুছে যাক তোমার হাত ধরে।
—অন্তত ধনানন্দকে কি হত্যা করা উচিত নয়, আচার্য?
—মনে দ্বিধা রেখো না, বৎস। বিশ্বাস রাখো আমার ওপর। ভবিষ্যতে এই সিদ্ধান্ত আমাদের জন্যে লাভজনক হবে। প্রজা ও অন্যান্য রাজাদের কানে যখন সেই সংবাদ পৌঁছোবে যে মগধের তরুণ রাজা তাঁর শত্রুদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, তখন তোমার প্রতি তাদের আস্থা বাড়বে।
—কিন্তু…
—কোনো কিন্তু নয়, চন্দ্রগুপ্ত। আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর কোনো প্রশ্ন আমায় এই মুহূর্তে কোরো না। কিন্তু, যদি আমাকে নিজের গুরু বলে মেনে থাকো, তবে জেনো এইই আমার গুরুদক্ষিণা।
এরপর আর আপত্তি করল না চন্দ্রগুপ্ত। হাঁটু গেড়ে বসল চাণক্যর সম্মুখে। চাণক্য তাঁর শিষ্যর মস্তকে হাত রেখে বললেন,
—যাও! ইতিহাস সৃষ্টি করো মুরাপুত্র চন্দ্রগুপ্ত!
চন্দ্রগুপ্ত আবার সভার মঞ্চে উঠে আদেশ দিলেন,
—ধনানন্দসহ সবাইকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হল। নির্বাসন দেওয়া হল তাদের। সবাইকে সুরক্ষিত সীমানা পার করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন, সেনাপতি সিংহরণ।
সামরিক ভঙ্গিতে তাকে অভিবাদন জানালেন সিংহরণ। সভায় উপস্থিত প্রতিটি সৈনিক একই কায়দায় নতমস্তক হল চন্দ্রগুপ্তর সামনে।
চাণক্য বলে উঠলেন,
—জয়! সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর জয়! মগধাধিপতি সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর জয়! সবাই একসঙ্গে বলে উঠল,
—সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর জয়! মগধাধিপতি সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর জয়! পতন হল নন্দ সাম্রাজ্যর। এবং, পত্তন হল মৌর্য সাম্রাজ্যর। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, যিনি হবেন অখণ্ড আর্যাবর্তর প্রথম সম্রাট।
.
এর পরের কাহিনি সকলের জানা। ইতিহাসের পাতায় রয়েছে তার বর্ণনা। কিন্তু, কোন প্রতিশ্রুতির কথা সেদিন বলেছিলেন চাণক্যকে অমাত্য রাক্ষস? কেন নিজের সবথেকে বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বীকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দিতেন স্বয়ং চাণক্য? এর উত্তর পেতে আমাদের ফিরে যেতে হবে অনেক বছর আগের অতীতে। যেখান থেকে সব কিছুর সূত্রপাত হয়েছিল।
১.
‘এই কুরূপ ব্রাহ্মণের চুলের শিখা ধরে বের করে দাও মহল থেকে!’
এই কথাগুলোর মূল্য কোন মাত্রায় দিতে হতে পারে, তা উপলব্ধি করতে পারেননি মগধ নরেশ ধনানন্দ। সেদিন সভায় উপস্থিত কেউই উপলব্ধি করতে পারেনি এর সুদূরপ্রসারী প্রতিধ্বনি। শুধু একজন বাদে— অমাত্য রাক্ষস।
হ্যাঁ। এই নামটাই তাঁর সর্বজনবিদিত। তাঁর পিতৃদত্ত নাম বহুদিন পূর্বেই ভুলে গিয়েছে গোটা আর্যাবর্ত।
সেদিন মগধের রাজসভায়, তিনি ধনানন্দকে সাবধান করে বলেছিলেন এই পাপ করা থেকে বিরত থাকতে। কিন্তু, মদিরার নেশায় ডুবে থাকা ব্যক্তিকে যুক্তি বোঝানো অতি কঠিন কাজ। তার সঙ্গে যদি ক্ষমতার দত্ত জুড়ে যায়, তবে সেই কাজ হয় অসম্ভব। অতএব, সেদিন আচার্য বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যকে অপমানিত হওয়া থেকে আটকাতে পারেননি রাক্ষস।
তিনি জানতেন এর ফল হতে পারে মারাত্মক। কারণ, তিনি নিজেও চাণক্যর একসময়ের সহপাঠী ছিলেন তক্ষশিলায়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও বহুবার একাধিক তর্কসভায় দেখেছেন চাণক্যকে। দেখেছেন কীভাবে তিনি তাঁর ক্ষুরধার যুক্তির জোরে পরাজিত করতেন দেশ-বিদেশের মহামতি পণ্ডিতদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে পণ্ডিত শিক্ষক ভদ্রভট্ট, যিনি পরবর্তীতে প্রধানাচার্য হয়েছেন, তাঁর শিষ্য ছিলেন চাণক্য। তাঁর মতো ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে নিয়মিত রাজনীতির আলোচনা করতেন চাণক্য। রাক্ষস দেখেছিলেন অল্প বয়সেই চাণক্যকে যেতে হত বিভিন্ন দেশে, সেখানকার শাসকদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরামর্শ দিতে।
এই ব্যক্তি যে এত সহজে নিজের চরম অপমান হজম করবেন না, তা জানা ছিল অমাত্য রাক্ষসের।
তাই ধনানন্দ চাণক্যর কথা ভুলে গেলেও অমাত্য রাক্ষস ভোলেননি। তিনি খোঁজ রেখেছিলেন চাণক্যর গতিবিধির।
কয়েক বছর পর হঠাৎ একদিন ধনানন্দর সঙ্গে কথার মাঝখানে তক্ষশিলার নাম উঠতে ধনানন্দ তাচ্ছিল্যর সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
—তক্ষশিলার কথায় মনে পড়ল। ওই কুরূপ ব্রাহ্মণকে মনে আছে? যে আমাকে জ্ঞান দিতে এসেছিল আমারই সভায়? কী জানি নাম ছিল মূর্খটার…
গম্ভীর ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে অমাত্য রাক্ষস উত্তর দিলেন,
—আচার্য বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই চাণক্য। তার কী খবর? বেঁচে আছে?
—হ্যাঁ, মহারাজ। তিনি এখনও তক্ষশিলায় শিক্ষকতা করছেন।
—ও বাবা! তুমি তো দেখি আবার তার খোঁজ রাখো হে, রাক্ষস। তোমার কি কাজের অভাব পড়েছে নাকি? এত বৃথা সময় পাও কোথা থেকে?
কোনো উত্তর দিলেন না রাক্ষস। উত্তর না পেয়ে ধনানন্দ আবার বলে উঠলেন,
—শুনেছি সে নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, আমার পতন না ঘটিয়ে সে জল স্পর্শ করবে না। তো, সে কি জল না খেয়ে দুধ খেয়ে এত বছর বেঁচে?
—আপনি ভুল শুনেছেন, মহারাজ। চাণক্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, নন্দরাজ্যের পতন না ঘটিয়ে তিনি নিজের কেশশিখা বাঁধবেন না।
—ও, হ্যাঁ। ভুলে গিয়েছিলাম। তা, তুমি তো দেখছি তার অনেক খবর রাখো। সেও তো তোমার সঙ্গেই ওই বিশ্রী বিদ্যালয়ে পড়ত। তোমার তো লজ্জিত হওয়া উচিত রাক্ষস, যে, তোমার মহান বিশ্ববিদ্যালয় এই কুরূপটির মতো এরকম একজন মূর্খ স্নাতক সৃষ্টি করেছে।
রাক্ষস নন্দর এই ধরনের অপমানজনক কথাবার্তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে শিখে গিয়েছে গত কয়েক বছরে। তাই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কাজের প্রসঙ্গে ফিরে যায়,
—মহারাজ, দক্ষিণ সীমানার থেকে কর এই বছর কম আসবে। কারণ, সেখানে তীব্র অনাবৃষ্টি…।
তাঁকে অগ্রাহ্য করায় আরও বেশি রেগে যান ধনানন্দ। তার কথার মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন,
—এই! এই কারণেই তোমাকে “রাক্ষস” নাম দিয়েছি, মহামাত্য! কারণ, তুমি আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছ। কোথায় এই সুন্দর সন্ধ্যায় সোমরস গলাধঃকরণ করে নর্তকীদের নৃত্য দেখব ভেবেছিলাম। তা নয়, তুমি আমায় কাজে বসালে জোর করে! তুমি একজন রাক্ষসের ন্যায় আমার জীবন থেকে সমস্ত সুখ ভক্ষণ করে ফেলেছ! কার আদেশে তুমি আজকের নৃত্যশিল্পীদের অনুষ্ঠান পণ্ড করলে?
—মহারাজ। এই কাজ জরুরি। নৃত্য, গীত তো এই দরবারে প্রাত্যহিক লেগেই আছে। কিন্তু, দক্ষিণের প্রজাদের…
—শুনে রাখো তবে আমার আদেশ। কোনো করে ছাড় দেওয়া হবে না! হয় তাদের সম্পূর্ণ রাজকর দিতে হবে, অথবা, তাদের মস্তক ধড় থেকে ছিন্ন হবে!
—মহারাজ। কর তারা এই বছর দিতে পারবে না এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কিন্তু, তাদের যদি হত্যা করা হয়, তাহলে আগামী বছরেও আপনি কর পাবেন না। প্রজাই না থাকলে, রাজস্ব আসবে কোথা থেকে?
খানিকটা দমে গেলেন ধনানন্দ। রাক্ষসের কথায় যুক্তি আছে। আর কিছু না হোক, ধনানন্দ এই পৃথিবীতে স্বর্ণমুদ্রা সবচেয়ে অধিক ভালোবাসেন। রাক্ষসের কথায় তাঁর রাগ হয়, মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে এখুনি তার মুণ্ডু কেটে ফেলার নির্দেশ দিতে। কিন্তু, ধনানন্দ বুদ্ধিমান। তিনি জানেন যে, এই রাজ্য চালাতে গেলে অমাত্য রাক্ষসকে তাঁর প্রয়োজন। অমাত্যর যত না তাঁকে প্রয়োজন, তাঁর প্রয়োজন অমাত্য রাক্ষসকে অনেক বেশি।
—যা খুশি করো! কিন্তু, আমার রাজস্ব যেন এক কার্ষাপণ কম না হয়!
বলে গজগজ করতে করতে আবার মদিরার পাত্রে চুমুক দিলেন ধনানন্দ। কটাক্ষে রাক্ষসের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন তার মনের ভাব।
কিন্তু, তার এই মুখ যেন প্রস্তর খোদাই করে নির্মিত। তাতে কোনো অভিব্যক্তি নেই।
ধনানন্দ মনে মনে ভাবলেন যে, একজন মানুষের মুখ সর্বদা এরকম ভাবলেশহীন থাকে কীভাবে? এত বছরে বারংবার চেষ্টা করেও তার মুখ দেখে তিনি বুঝতে পারেননি লোকটা কী ভাবছে। মাঝে মাঝে চিন্তিত হন ধনানন্দ। কোনোদিন তাঁর মহামাত্য তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না তো? যেমন তাঁর পিতার পূর্ব মহামাত্য শাখতারের হয়েছিল।
পরক্ষণেই মনে মনে হেসে উঠলেন ধনানন্দ। নাহ্, অমাত্য রাক্ষস কখনো এ কাজ করবে না। অমাত্য রাক্ষস মাত্রাতিরিক্ত সম্ভ্রান্ত ও চরিত্রবান। বিশ্বাসঘাতকতা এমন মানুষের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। বা, বলা ভালো, নিম্নে। অমাত্য রাক্ষস মগধের প্রতি সম্পূর্ণভাবে নিবেদিতপ্রাণ!
মাঝে মাঝে ধনানন্দর মনে হয় তাঁর মহামাত্যটি আসলে হয়তো কোনো মানুষ নয়। কোনো এক জাদুবলে পরিচালিত একটি জ্যান্ত পুতুল! তার মধ্যে কোনোরকম আবেগ নেই! কাম নেই, ক্রোধ নেই, মোহ নেই। সব পরিস্থিতিতে সে অবিচল এক পব্বত!
কোনো মানুষ কি আবেগহীন হতে পারে?
নিজের মনেই দু-বার বিড়বিড় করে ওঠেন মগধাধিপতি ধনানন্দ,
—-রাক্ষস। রাক্ষস!
২.
—গুরুদেব।
চিন্তায় ডুবে ছিলেন বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। শিষ্য চন্দ্রগুপ্তর ডাকে তাঁর চিন্তাজালে ছেদ পড়ল। চন্দ্রগুপ্তর দিকে ফিরে বললেন,
—বলো, চন্দ্রগুপ্ত।
—যদি আজ্ঞা দেন, তবে একটি কথা আপনাকে বলতে চাই।
চাণক্য ইশারায় তাকে বসতে বললেন। চন্দ্রগুপ্ত গুরুর পায়ের কাছে মাটিতে বসল। এখন সময় দুপুর, তৃতীয় প্রহর শেষের দিকে। তক্ষশিলা প্রাঙ্গণের এককোণে, চাণক্যর আশ্রমটি এমনিতেই নিরিবিলি। বসন্ত উৎসব উপলক্ষে বেশিরভাগ ছাত্রই নিজ নিজ গৃহে গিয়েছে ছুটিতে। তাই এখন বিদ্যালয় খালি।
চাণক্য জানতে চাইলেন,
—কী বলতে এত দ্বিধা করছ হে, চন্দ্রগুপ্ত?
একটু থেমে চন্দ্রগুপ্ত বলল,
—ক্ষমা করবেন, আচার্য। কিন্তু, অনেকেরই মনে আমাদের উদ্দেশ্যের সাফল্য নিয়ে সংশয় আছে। তারা বিশ্বাস করে না যে, আর্যাবর্তর সবথেকে বড়ো সাম্রাজ্যর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আমাদের পক্ষে জয় সম্ভব।
চাণক্য চন্দ্রগুপ্তর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেন,
—হুমম। আর তোমার নিজের কী মনে হয়? চন্দ্রগুপ্তও তাঁর চোখে চোখ রেখেই উত্তর দিল,
—এই পৃথিবীর অন্য কোনো ব্যক্তি যদি আমায় বলত যে, আমরা স্বয়ং মগধাধিপতি ধনানন্দকে সিংহাসনচ্যুত করব, তবে নিঃসংশয়ে আমি তাকে কথায় পরিহাস করে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু, এই কথাটা যখন আমার আচার্য আমায় বলছেন, তখন আমি নিশ্চিত তিনি আমায় অলীক স্বপ্ন দেখাচ্ছেন না। কারণ, তিনি আচার্য চাণক্য! আপনার শিষ্য হিসেবে অনেকগুলো বছর ধরে আমি আপনাকে কাছ থেকে দেখেছি, আচার্য। আমি বহুবার দেখেছি আপনাকে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। সৈনিক ও অন্যান্য লোকেদের মনে ওঠা সংশয় ক্ষমা করবেন, কারণ তারা আপনাকে চেনে না! আমি ও আমার গুরুভ্রাতারা যেভাবে আপনাকে জেনেছি, তাদের সে-সুযোগ হয়নি। তাই তাদের মনে সংশয় থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু, আমার মনে কোনো সংশয় নেই, আচার্য। আমি জানি যে, আপনার বুদ্ধিবলে আমি ঠিকই একদিন মগধকে পরাস্ত করব!
চাণক্যর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। বললেন,
—সংশয় রেখো না হে, চন্দ্রগুপ্ত। মনে রেখো, রাজার মনে সংশয় দেখা দিলে তা তাঁর সেনাপতির মনে দ্বিগুণ এবং তাঁর সেনাদের মনে চতুর্গুণ সংশয় সৃষ্টি করে। মনে রেখো অলকশেন্দ্রকে। যতদিন সে তার বিজয় নিয়ে নিঃসংশয় ছিল, ততদিন তার সেনা ছিল অপ্রতিরোধ্য। যেদিন তার মন দুর্বল হল, সেদিনই তার সেনার দিগবিজয়ের রথ থেমে গেল। সিংহ রাজা দ্বারা পরিচালিত একদল মেষের সেনা, একজন মেষ রাজার সিংহ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম! সেনাবাহিনীর শক্তি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে তাদের রাজা কতটা শক্তিশালী তার ওপর।
—যথার্থ বলেছেন, গুরুদেব। আমি আপনাকে নিশ্চিত করছি যে, আমি নিজের লক্ষ্যে অবিচল আছি। কিন্তু, সেনাবাহিনীর মনেও সেই আস্থা আনতে আমাদের কি কিছু করা উচিত নয়?
—হুমম। তুমি কি করতে চাইছ, চন্দ্রগুপ্ত?
—আমাদের এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটা “জয়”।
—মগধ জয়ের মতো পরিস্থিতি ও শক্তি এই মুহূর্তে আমাদের নেই, চন্দ্রগুপ্ত।
—মগধ জয় এই মুহূর্তে সম্ভব নয় তা না বোঝার মতো অর্বাচীন আমি নই, আচার্য। আমি মগধ জয়ের কথা বলছিও না। আমি বলছি অন্য কোনো, ক্ষুদ্র রাজ্য বা ছোটোখাটো কোনো যুদ্ধজয়ের কথা। একটা ক্ষুদ্র জয়ও এই মুহূর্তে আমার বাহিনীর মনের সংশয়ের মেঘ অনেকটা কাটিয়ে দিতে সক্ষম হবে।
চাণক্যর ললাটে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তিনি বললেন,
—তোমার কথা যথাযথ এবং সম্পূর্ণ যৌক্তিক, বৎস। কিন্তু, সমস্যাটা কোন রাজ্য? মগধের কোনো ছোটো প্রদেশ আক্রমণ করে দখল করা সহজ, আমরা আগেও তা করেছি। কিন্তু, তার ফলাফল কী হয় তা তোমার জানা। অমাত্য রাক্ষসের কানে সে-সংবাদ পৌঁছোতেই তিনি পাটলিপুত্র থেকে বিশাল সেনা পাঠিয়ে আমাদের রাজ্য ত্যাগ করতে বাধ্য করেন।
অস্থির ভঙ্গিতে চন্দ্রগুপ্ত বলল,
—রাক্ষস! রাক্ষস! রাক্ষস! এই… এই অমাত্য রাক্ষস নামটাই প্রতিবার আমাদের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়!
—হুমম। চন্দ্রগুপ্ত, তুমি একটু আগে বলছিলে না যে, এই মুহূর্তে মগধ দখল করা অসম্ভব। কথাটা ঠিক নয়। মগধ দখল মোটেই কঠিন কাজ হওয়ার কথা নয়। কারণ, তাদের রাজা একজন লোভী, মদাসক্ত, কামার্ত, মূর্খ। যতই বড়ো সেনা হোক, এরকম একজন রাজা থাকলে সেই সেনা দুর্বল। কিন্তু, সমস্যা রাজা বা সেনা নিয়ে নয়। সমস্যা হল যে, মগধকে ও তার সেনাকে পরিচালনা তাদের মূর্খ রাজা করে না। তা করেন তার অসম্ভব বুদ্ধিমান ও স্থিরচিত্ত মহামাত্য কাত্যায়ন। তাঁর বজ্রমুষ্টিতে কোনো ফাঁক নেই! তিনি বাস্তবিকই আমার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। এ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, তিনি আমাদের বিপক্ষে আছেন। তিনিই মগধজয়ের পথে আমাদের এক এবং একমাত্র বাধা!
—তাহলে উপায়?
—ভাবছি, চন্দ্রগুপ্ত। ভাবছি। চাণক্যর ললাটে গভীর ভ্রূকুটি।
তাঁদের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই কক্ষে প্রবেশ করল প্রধানাচার্যর ভগিনী সুভাষিণী। তার হাতে একটি মাটির পাত্র ও দুটি কলাপাতা। একদৃষ্টে চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তর দিকে দেখে নিয়ে বিনা একটিও বাক্যব্যয়ে তাঁদের সামনে কলাপাতা দুটি নামিয়ে রেখে তাতে মাটির পাত্র থেকে খিচুড়ি বেড়ে দিতে শুরু করল। চন্দ্রগুপ্ত দুই হাত জোড় করে প্রণাম করল সুভাষিণীকে। সুভাষিণীকে দেখলেই চন্দ্রগুপ্তর নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। তার মা-ও তাকে এভাবে যত্ন করে খাওয়াত।
খিচুড়ি দিয়ে মাঝখানে কিছুটা ঘি ঢেলে দিল সুভাষিণী। দুটি মাটির ঘটিতে জল ঢেলে কলাপাতার পাশে রেখে বলল,
—আমি নিশ্চিত সকাল থেকে তোমাদের দু-জনের কিছু আহার হয়নি। তোমরা আর দেরি না করে শুরু করো।
চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত জল ছিটিয়ে খেতে বসলেন। খিচুড়ি আর ঘিয়ের সুবাসে তাঁরা দু-জনই টের পেলেন যে, তাঁদের পেটে প্রচণ্ড খিদে।
খিচুড়ির মধ্যে, যেখানে ঘি দেওয়া, সেখানে হাত দিতেই দু-জন প্রায় একইসঙ্গে হাত সরিয়ে নিলেন গরম ছ্যাঁকা লাগায়। তাঁদের কাণ্ড দেখে হেসে উঠল সুভাষিণী। হাসতে হাসতেই বলল,
—গুরু-শিষ্য দু-জনই যে এত লোভী, তা জানা ছিল না।
চন্দ্রগুপ্ত হেসে বলল,
—আমরা ক্ষুধার্ত হতে পারি, আর্যা। তাই বলে লোভী অপবাদ দেবেন?
—কেন নয়? দেখো, তোমরা দু-জনেই প্রথমে ঘিয়ের লোভে খিচুড়ির মাঝখানে হাত দিলে। এবং, ছ্যাঁকা খেলে! এ তো তোমাদের লোভ বটেই। প্রথমেই ঘি পাওয়া যায় না, চন্দ্র।
—তাই বুঝি?
—হ্যাঁ। তোমার আচার্য তোমায় অনেক কিছু শিখিয়েছেন, কিন্তু খিচুড়ি খাওয়ার সঠিক পদ্ধতিটা শেখাননি দেখে আমি যারপরনাই অবাক হলাম। যদিও এখন দেখছি তিনি নিজেও সেই পদ্ধতিতে সড়োগড়ো নন।
চন্দ্রগুপ্ত আবারও হেসে বলল,
—কিন্তু, খিদে যে আর বশ মানছে না, আর্যা! তবে, আপনিই বলে দিন কী পদ্ধতি খিচুড়ি খাওয়ার।
সুভাষিণী একবার চাণক্যর দিকে কটাক্ষ হেনে কৌতুকের ছলে চন্দ্রগুপ্তকে বলল, —শেনো তবে মন দিয়ে। খিচুড়ি খেতে শুরু করতে হয় সবসময় ধার থেকে। চারদিক থেকে অল্প অল্প করে অন্ন ভেঙে খেতে হয় ধীরে ধীরে। ততক্ষণে মাঝখান ঠান্ডা হয়ে এলে, তখন ঘি মেখে নেওয়া যায়। প্রথমেই মাঝখানে হাত দিলে ছ্যাঁকা তো খেতেই হবে।
—বেশ, বেশ। তবে, তাই হোক।
চন্দ্রগুপ্ত ও সুভাষিণী দুইজনই হেসে উঠল। কিন্তু, তাদের দৃষ্টি চাণক্যর দিকে পড়তেই হাসি থেমে গেল। চাণক্যর ললাটের ভ্রূকুটি মিলিয়ে গিয়েছে। তাঁর চোখের মণি জ্বলজ্বল করছে। স্থিরদৃষ্টিতে তিনি চেয়ে আছেন তাঁর সামনে ছড়িয়ে থাকা খিচুড়ির দিকে। চাণক্যর চোখের এই বিদ্যুৎদৃষ্টি সবার চেনা। এ অন্ধকারে আলো খুঁজে পাওয়ার দৃষ্টি।
—চন্দ্রগুপ্ত!
—বলুন, আচার্য।
—সুভাষিণী ঠিকই বলেছে। আমরা দু-জনই মূর্খ।
সুভাষিণী লজ্জিত ভঙ্গিতে প্রতিবাদ করে উঠে বলল,
—আমি কখনোই তেমন কিছু…
চাণক্য সুভাষিণীর দিকে চোখ তুলে তাকাতেই তার কথা মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল। দ্রুত সুভাষিণী সলজ্জ ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে নিল। চন্দ্রগুপ্ত সেদিন সুভাষিণীর চোখের দৃষ্টি পড়তে পারলে অনেক কিছুই অনুমান করতে সক্ষম হত তার আচার্য ও সুভাষিণীর সম্বন্ধে। কিন্তু, তা উপলব্ধি করার মতো মননশীলতা তার সেই বয়সে তখনও আসেনি। তাই চোখ আচার্যর মুখের ওপর নিবদ্ধ থাকায় সুভাষিণীর সেই লজ্জিত ভঙ্গি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল। সে উত্তেজিতভাবে চাণক্যকে জিজ্ঞেস করল,
—আপনার চোখের এই দৃষ্টি আমার চেনা, আচার্য। কী হয়েছে, আচার্য?
চাণক্য খিচুড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন,
—এই খিচুড়িটি হল মগধ। ঘি যুক্ত মাঝের অংশটুকু পাটলিপুত্র। প্রথমেই যদি ঘিয়ের লোভে মগধে আক্রমণ করা হয়, তবে ছ্যাঁকা খেয়ে ফিরে আসতেই হবে, চন্দ্রগুপ্ত! তাই মগধ দখলের উপায় হল, আগে মগধকে চারিদিক থেকে আক্রমণ করতে হবে! আমরা ভুল করছিলাম, চন্দ্রগুপ্ত। আমাদের একসঙ্গে আক্রমণ করতে হবে যাতে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা যায় মগধকে! আমাদের দখল করতে হবে মগধের সীমানা বরাবর থাকা ছোটো ছোটো জনপদ রাজ্যগুলোকে!
চাণক্যর উত্তেজনা চন্দ্রগুপ্তর মধ্যে সঞ্চারিত হতে একমুহূর্ত লাগল। দু-জনেই একসঙ্গে আহার ছেড়ে উঠে পড়ছিলেন। কিন্তু, বাধা দিল সুভাষিণী।
—মগধ কোথাও চলে যাচ্ছে না, আচার্য বিষ্ণুগুপ্ত। তাই আহার শেষ না করে কেউ উঠবেন না।
কিছুক্ষণ নিষ্পলক সুভাষিণীর দিকে চেয়ে থেকে আবার খেতে বসলেন চাণক্য।
৩.
—মহামাত্য, প্রণাম নেবেন।
নর্তকের বেশধারী এক ব্যক্তি এসে অভিবাদন জানাল অমাত্য রাক্ষসকে। তাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে রাক্ষস জিজ্ঞেস করলেন,
—কী সংবাদ এনেছ, গুপ্তচর?
—শোনা যাচ্ছে দক্ষিণের সীমান্ত রাজ্য প্রতাপগড়ের পতন হয়েছে। রাজা প্রতাপকুমারকে সরিয়ে সিংহাসনের দখল নিয়েছে অন্য এক রাজা।
—আর সেই নতুন রাজার নাম নিশ্চয়ই চন্দ্রগুপ্ত?
—হ-হ্যাঁ। কিন্তু, আপনি কীভাবে জানলেন? এই সংবাদ আমার পূর্বে কেউ আপনার অবধি পৌঁছে দিয়েছে, তা কীভাবে সম্ভব?
একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের ইশারায় গূঢ়পুরুষকে বিদায় দিলেন রাক্ষস। সম্মুখে রাখা ভূর্জপত্রগুলোর দিকে আর তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না তাঁর। যদিও কাজগুলো জরুরি, তবু তাঁর মনে এখন অন্য একটি দুশ্চিন্তা ঢুকেছে। এই দুশ্চিন্তা তাঁর গত কয়েক মাস ধরেই রয়েছে যদিও।
কারণ, গত ছ-মাসের মধ্যে, মগধের সীমান্ত অঞ্চলে অন্তত তেরোটি ছোটো রাজ্য দখল করা হয়েছে। এবং, প্রতিবারই দুটি নাম উঠে এসেছে তাতে — চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্য।
রাক্ষস জানেন, চাণক্য আর তাঁর শিষ্য সেনাবাহিনী গঠন করেছেন গত কয়েক বছর ধরে। তাঁর বাহিনীর অধিকাংশই অলকশেন্দ্রর সেনার ভারতীয় সৈনিক দ্বারা গঠিত। এ ছাড়া রয়েছে মগধের কিছু বিদ্রোহী সৈনিক ও সেনানায়ক। তাদের মধ্যে যে প্রধান সে হল মগধের পূর্বতন সেনাপতি সিংহরণ, যা রাক্ষসের কাছে চিন্তার বিষয়। কারণ, তিনি জানেন যে, সিংহরণ একজন দুর্ধর্ষ সেনানায়ক এবং নির্ভীক যোদ্ধা। তাঁর নাম গোটা আর্যাবর্ত জানে। সেই ব্যক্তি চাণক্যকে সাহায্য করছেন সেনাবাহিনী গঠন করতে।
মহারাজ ধনানন্দর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁর সেনা যুদ্ধ করে। মগধের কাছে পরাজিত হয়ে, তারা পলায়ন করেছিল। এত বছর তারা আত্মগোপন করে ছিল। চাণক্য কীভাবে তাঁকে খুঁজে পেলেন এবং কীভাবে তাঁর মতো একজন দুর্দম যোদ্ধাকে এক নামগোত্রহীন যুবকের বশ্যতা স্বীকার করাতে রাজি করলেন তা দৈবের অজানা। কিন্তু, সিংহরণের মতো যোদ্ধা যদি কোনো তরুণ সেনানায়কের বশ্যতা স্বীকার করে, তবে সেই তরুণ সেনানায়কটির বিষয়ে সতর্ক থাকতেই হয়।
চন্দ্রগুপ্ত নামের এই যোদ্ধাটিও যেন এক রহস্য। তার পিতৃপরিচয়, বংশ, অতীত, এমনকী তার সঠিক চেহারার বর্ণনা, সব কিছুই অজানা। সে নিজেকে ক্ষত্রিয় এবং মগধের ভূমিপুত্র বলে পরিচয় দেয়। তবে, সেও শুধুই তার মুখের কথা। কিন্তু, একটা বিষয়ে নিশ্চিত যে, এই চন্দ্রগুপ্ত একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা এবং রণকৌশলে পারদর্শী! বিভিন্ন সূত্র থেকে চন্দ্রগুপ্তর চেহারার ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা আসে রাক্ষসের কাছে। রাক্ষসের অনুমান, চাণক্য তাঁর একাধিক শিষ্যকে চন্দ্রগুপ্ত পরিচয়ে লোকসম্মুখে এনেছেন। অন্তত ছ-জন ভিন্ন ব্যক্তির বর্ণনা রাক্ষস পেয়েছেন যারা নিজেদের কোনো-না-কোনো সময়ে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ বলে পরিচয় দেয়।
এদের মধ্যে আসল কে, তা জানা অসম্ভব।
চাণক্যর উদ্দেশ্য কী, সেটাও সঠিক অনুমান করতে পারছেন না রাক্ষস। তিনি মগধে আক্রমণ করছেন না। তিনি মগধের বাইরের রাজ্য দখল করছেন। কিন্তু, কেন?
ছাদের দিকে তাকিয়ে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অমাত্য রাক্ষস। তাঁর মনে পড়ল, তক্ষশিলা থেকে স্নাতক হওয়ার সময় তিনি খোঁজ নিয়েছিলেন যে, চাণক্য কী করতে চলেছেন আগামীতে। চাণক্য কোনো রাজার অমাত্য হতে ইচ্ছুক নয়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করবেন, এই কথাটা জানতে পেরে রাক্ষস কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করেছিলেন। কারণ, রাক্ষস কখনোই চাননি যে, চাণক্যর মতো কোনো ব্যক্তি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হোক। তাতে তাঁর নিজের পেশাগত দিক থেকেও সুবিধা হবে। কারণ, রাক্ষস জানতেন তাঁরই মতো, চাণক্য চাইলেই মগধ বা পৃথিবীর যেকোনো সাম্রাজ্যের অমাত্য হতে পারতেন। বেশ কিছু রাজা তাঁরা স্নাতক হওয়ার আগেই তাঁদের নামে পত্র লিখেছিলেন প্রধানাচার্যর কাছে। তাঁরা চাণক্য বা কাত্যায়নকে তাঁদের সভার অমাত্যরূপে চান। কিন্তু, কাত্যায়ন ফিরে যেতে চেয়েছিলেন নিজের দেশে। মগধ—তাঁর নিজের দেশ।
রাক্ষস জানতেন যে, দেশের অবস্থা ভালো নয়। রাজযন্ত্রের প্রতিটা স্তরে পচন ধরেছে। পণ্ডিত ব্রাহ্মণরা দেশত্যাগ করছে। কিন্তু, রাক্ষস মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, পালিয়ে যাওয়াটা কখনো উত্তর হতে পারে না। রাজতন্ত্রে বদল আনতে গেলে তা একমাত্র ভেতর থেকেই আনা সম্ভব। তাই সবার, এমনকী তাঁর সম্মানিত প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টর নিষেধ উপেক্ষা করেই তিনি ধনানন্দর অমাত্যরূপে যোগদান করেন। এরপর খুব প্রত্যাশিতভাবেই, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি অতি দ্রুত ধনানন্দর প্রধানামাত্য পদে পৌঁছে যান।
বর্তমানে তিনিই মগধ চালাচ্ছেন। তিনি অবস্থার উন্নতি করার নিরঙ্কুশ প্রয়াস করে চলেছেন। কিন্তু, তিনি কতটা উন্নতি করতে পেরেছেন দেশের? কতটা দূর হয়েছে সাধারণ মানুষের দুর্দশা? না, নিজের কাজে একদিনের জন্যেও সন্তুষ্ট হননি রাক্ষস। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন ধনানন্দকে ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখতে। কিন্তু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি বিফল হন। জনগণের করের বোঝা বাড়ছে। প্রজা ও সেনা প্রত্যেকেই অসন্তুষ্ট। বিদ্রোহ দানা বাঁধছে আনাচকানাচে। গুপ্তচর মারফত সংবাদ পেলেই সেনা পাঠিয়ে শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমন করেন রাক্ষস। কারণ, তিনি মগধকে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ!
কিশোরীকণ্ঠের খিলখিলে হাসির শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়ল রাক্ষসের। দৌড়ে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করল রাজা ধনানন্দর অষ্টমবর্ষীয়া কন্যা দুর্ধরা। ছুটে এসে তাঁর কোলে উঠে বসল সে।
তার পেছনে ছুটে আসতে থাকা একদল দাসী কক্ষের দ্বার অবধি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রধানামাত্য রাক্ষসকে দেখে তারা যেন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে দ্রুত নতশির হল। দুর্ধরা আনন্দের সঙ্গে রাক্ষসের কোলে বসে তাঁকে বলল,
—ওরা আমায় খেলতে দিচ্ছে না, আমাতা! ওদের চলে যেতে বলো।
সস্নেহে দুর্ধরার মস্তকে হাত রেখে রাক্ষস বললেন,
—কিন্তু, এখন যে অধ্যয়নের সময় রাজকুমারী। খেলা আবার পরে হবে।
মুখে ভেংচি কেটে দুর্ধরা বলল,
—অধ্যয়ন করতে আমার ভালো লাগে না। পিতাও তো বলে ওসব পড়ে লাভ নেই। খালি তুমিই জোর করো।
ততক্ষণে দ্বারের বাইরে রাজকুমারীর নবনিযুক্ত ব্রাহ্মণ আচার্যটিও এসে হাজির হয়েছে। তাকে দেখে আরও একবার দুর্ধরা বলল,
—ওই পণ্ডিত বাজে। ওর কাছে পাঠ পড়ব না!
নিরীহ ব্রাহ্মণটিকে দেখে মনে হল, এই বুঝি তার প্রাণ গেল। হাতজোড় করে অমাত্যর প্রতি মিনমিন করে উঠল,
—আ— আমি কিছু করিনি, আর্য! আমি… আমি বিশ্বাস করুন, আপ্রাণ চেষ্টা…।
তার অবস্থা দেখে মনে মনে হাসি পেল রাক্ষসের। যদিও মুখে তার রেশ দেখা দিল না। তিনি দুর্ধরাকে প্রশ্ন করলেন,
—বেশ। তবে, আমার কাছে পাঠ অধ্যয়ন করবে তো?
খুশিতে ঝলমল করে উঠল রাজকুমারীর মুখ।
—হ্যাঁ, করব।
অমাত্য রাক্ষস বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পণ্ডিতের উদ্দেশে বললেন,
—আপনি আজ গৃহে ফিরে যান, আচার্য। আর, কেউ একজন রাজকুমারীর কক্ষ থেকে তার পাঠের পুস্তকাদি এখানে এনে দাও।
দ্রুত প্রস্থান করল সবাই।
অমাত্য রাক্ষসের কোলে বসে নিজের মনেই খেলতে শুরু করল দুর্ধরা। তার মাথায় আরও একবার হাত রেখে মনে মনে রাক্ষস ভাবলেন,
—মায়া বড়ো বিষম বস্তু। এই কন্যাসমা মেয়েটি বড়ো মায়ায় বেঁধে ফেলেছে। রাজনীতি, যুদ্ধ, সব কিছু থেকে দূরে রাখতে হবে এই নিষ্পাপ প্রাণটিকে। তার জন্যে সব কিছু করতে আমি প্রস্তুত!
8.
—মহারাজ।
অর্ধনিমীলিত চোখে প্রধানামাত্যর দিকে চেয়ে দেখলেন মগধাধিপতি ধনানন্দ। এই মুহূর্তে তাঁর হাত ও পা টিপে দিচ্ছে চারজন দাসী। তাঁর সামনে বরাবরের মতোই সুস্বাদু খাদ্য ও সোমরস রাখা। ধনানন্দ বললেন,
—এসো, অমাত্য। যখনই আমার সামান্য আমোদের শখ মনে জাগে, তখনই তুমি এসে যাও। আজই-বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? এসো এসো, অমাত্য রাক্ষস!
বক্রোক্তি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রাক্ষস হাতের ইশারায় কক্ষে উপস্থিত রমণীদের বিদায় দিলেন। তারা ভয়ে ভয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করল। রাক্ষস এগিয়ে এসে রাজার সম্মুখে বসে বললেন,
—মহারাজ। একটা সংবাদ আপনার জানা উচিত। আমাদের সীমান্তবর্তী বেশ কিছু ছোটো রাজ্য গত কয়েক মাসে আক্রান্ত হয়েছে তা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়।
—হ্যাঁ, জানি। তাতে কী?
—সেইসমস্ত আক্রমণের অন্তরালে যে ব্যক্তির নাম উঠে আসছে সে হল চাণক্যশিষ্য চন্দ্রগুপ্ত।
—কী? কে?
—চাণক্যশিষ্য চন্দ্রগুপ্ত। আশা করি, মহারাজের স্মরণে আছে আচার্য চাণক্যর নাম।
—হ্যাঁ, সেই কুরূপকে ভুলি কীভাবে? তার এত সাহস যে আমায়, সম্রাট ধনানন্দকে অপমান করে!
—হ্যাঁ মহারাজ, সেই চাণক্য।
—তো, তাতে কী হয়েছে? এতে আমার বা তোমার বিচলিত হওয়ার কারণ দেখি না। সে তো অন্য সব ক্ষুদ্র জনপদ দখল করছে শুনলাম। মগধের সীমানা পার করার সাহস আর তার নেই। খেলতে দাও তাকে আর তার শিষ্যকে একটু “যুদ্ধ-যুদ্ধ” খেলা।
—মহারাজ। আমার কিন্তু ধারণা বিষয়টা নিয়ে আমাদের ভাবিত হওয়া উচিত। আমি নিশ্চিত সে যা করছে তা কোনোমতেই “খেলা” নয়। বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নিয়ে সে এগোচ্ছে। আমি এও নিশ্চিত তার আসল লক্ষ্য মগধ।
—পঞ্চনদের থেকে শুরু করে আর্যাবর্তর দক্ষিণ অবধি প্রতিটা রাজার লক্ষ্যই হল মগধ। তাতে মগধের কীই-বা আসে যায়? তাদের কারুরই ক্ষমতা নেই আমাদের কেশাগ্র স্পর্শ করে। স্বয়ং যবনদের সম্রাট অলকশেন্দ্র মগধের ভয়ে পলায়ন করেছে। তো, সেখানে ওই ব্রাহ্মণ কী করে নেবে?
—প্রথমত, অলকশেন্দ্রর ফিরে যাওয়ার জন্যে মগধভীতি দায়ী, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। দ্বিতীয়ত, আশা করি, আপনি চাণক্যর প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে যাননি। কারণ, আমি নিশ্চিত যে, তিনিও ভোলেননি নিজের প্রতিজ্ঞা।
—তো? তুমি কি এখন মগধাধিপতি ধনানন্দকে বলছ চাণক্যকে ভয় পেতে? এই আর্যাবর্তর সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাটকে এখন এক ব্রাহ্মণ শিক্ষককে ভয় পেতে হবে?
মনে মনে রাক্ষস ভাবলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভয় পেতেই বলছি তোমায়, নন্দ!’, কিন্তু তিনি বুদ্ধিমান, জানেন একথা বললে হিতে বিপরীত হবে। তাই রাক্ষস উত্তর দিলেন, —ভয় পেতে বলিনি, মহারাজ। কিন্তু, আমার মনে হয় আমাদের সতর্ক থাকা উচিত।
—হাস্যকর! আর, এতই যদি তোমার আশঙ্কা, তবে কয়েক বছর আগে সেইদিন কেন আমায় বাধা দিয়েছিলে ওই অভদ্র ব্রাহ্মণকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া থেকে? সেইদিনই শেষ করে দিতাম আমি ওই চাণক্যকে!
—কারণ, আমি চাইনি যে, আপনার হাতে অন্যান্য সব কিছুর সঙ্গে ব্রহ্মহত্যার পাপও যুক্ত হোক।
নেশার কারণেই হোক বা নিজের মনে মগ্ন থাকার কারণেই হোক, ধনানন্দ তার মহামাত্যর কথার মাঝখানে থাকা শ্লেষটুকু ধরতে পারলেন না। তিনি বললেন,
—আচ্ছা রাক্ষস, তুমি মগধের সমস্ত কিছুর কেন্দ্রে আছ। তুমি আমার চেয়েও ভালোভাবে মগধের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত। তুমি বলো তো, এই মুহূর্তে মগধে আক্রমণ করে কি কোনো সেনাবাহিনীর ক্ষমতা আছে আমাদের পরাজিত করা?
—না। দেবরাজ ইন্দ্রর দেবসেনা বা অসুররাজ বালির রাক্ষসসেনা ব্যতীত কোনো সেনার ক্ষমতা নেই মগধকে পরাজিত করা।
পুনরায় পালঙ্কে রাখা উপাধানে গা এলিয়ে দিয়ে ধনানন্দ বললেন,
—তাহলে আর চিন্তা কী? আমার মনে হয় তুমি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে ফেলছ ওই ব্রাহ্মণকে। মগধের সামনে সে ও তার শিষ্য পতঙ্গসমান। তাদের চাইলেই আমি পিষে ফেলতে পারি একমুহূর্তে। এত ভাবনার কিছু নেই অমাত্য। তুমি যতটা তার বিষয়ে বল, সে বাস্তবে ততটা বুদ্ধিমান হলে, একসময় সে ঠিকই উপলব্ধি করবে যে, মগধ অজেয়! তার এই প্রতিজ্ঞা হাস্যকর ও দিবাস্বপ্নসম অলীক। সেইদিন সে হাল ছেড়ে দেবে।
দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে অমাত্য রাক্ষস বললেন,
—তাই যেন হয়, মহারাজ। তাই যেন হয়।
৫.
অমাত্য রাক্ষসের দূরদৃষ্টির প্রমাণ কয়েক বছরের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল। চাণক্যর পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি একটি করে ছোটো রাজ্য জয় করে চলেছিল চন্দ্রগুপ্তর নেতৃত্বাধীন সেনা। হয় যুদ্ধের দ্বারা বা মৈত্রী চুক্তির দ্বারা একের পর এক রাজ্যে নিজের শাসন স্থাপন করে চলল। এবং, প্রতিটি জয়ের সঙ্গেই তার বাহিনীর ক্ষমতাবৃদ্ধি হতে থাকল।
অমাত্য রাক্ষস বুঝতে পারলেন যে, চাণক্য ধীরে ধীরে গোটা মগধকে ঘিরে ফেলছেন। যথারীতি রাজা ধনানন্দ তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি। তাঁর টনক নড়ল যেদিন মহামাত্য এসে খবর দিলেন যে, বিভিন্ন রাজ্য থেকে একাধিক বাণিজ্য পথ রোধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে বিষয়টায় গুরুত্ব না দিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ফলে মগধের অর্থনীতিতে এর প্রভাব দেখা দিল। এমনিতেই যেখানে অত্যধিক করের বোঝায় রাজ্যবাসীরা জর্জরিত ছিল, তার ওপর তাদের আয় কমতে শুরু করল। কারণ, মগধের সঙ্গে ভিন দেশের বেশিরভাগ বাণিজ্যপথই ছিন্ন করে দিয়েছেন চাণক্য। ক্রমেই মগধের প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকল। রাজ্যের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল।
.
ধনানন্দর রাজসভায় বসে রয়েছেন ধনানন্দ। মহামাত্য রাক্ষস প্রবেশ করলেন। —মহারাজের জয় হোক। আমায় স্মরণ করেছিলেন, মহারাজ?
তাঁর কথার উত্তর না দিয়ে ধনানন্দ সভায় উপস্থিত অন্য সবাইকে ইশারায় স্থান ত্যাগ করতে বললেন। অমাত্য রাক্ষস বাদে আর কাউকেই ধনানন্দ সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন না। সভাঘরে যখন শুধুই তাঁরা দু-জন রইলেন তখন ধনানন্দ বললেন,
—তুমি আমার সমস্ত নর্তকী, সেবাদাসীদের আমার অন্দরমহলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছ শুনলাম।
—হ্যাঁ, মহারাজ।
—জানতে পারি কার আদেশে তুমি এ কাজ করলে?
রাজার রুক্ষ প্রশ্নের উত্তরে তাপউত্তাপহীন ভঙ্গিতে অমাত্য উত্তর দিলেন,
—আমার আশঙ্কা যে, আমাদের অন্দরে শত্রুদের গুপ্তচর প্রবেশ করেছে। কারণ, তারা আমাদের অনেক গোপন তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। তাই আমি আপনার ও রাজ্যের সুরক্ষার স্বার্থে এই নির্দেশ দিয়েছি।
—তোমার কেন ধারণা হল যে, এই সুন্দরী, কোমলহৃদয় নারীরা গুপ্তচর হবে?
‘কারণ, তোমাকে যারাই চেনে, তারাই জানে যে নারী আর মদিরা তোমার দুই দুর্বলতা। তোমার মুখ খোলাতে এর চেয়ে সহজ উপায় কিছুই নেই।’ মনে মনে ভাবলেন অমাত্য রাক্ষস। কিন্তু মুখে বললেন, —কারণ, আপনার অঙ্গরক্ষক, অমাত্যাদিদের আমি নিজে পরীক্ষা করে, তাদের কুলপরিচয় নির্দিষ্টভাবে জেনে তবেই নিযুক্ত করেছি। কিন্তু, বহু নর্তকী তথা অন্যান্য নারীকে আপনি শুধুমাত্র তাদের লাস্য ও সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে নিজের অন্দরে স্থান দিয়েছেন। তাই তাদের মধ্যেই কারুর গুপ্তচর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাদের বিরহে যে আপনি অত্যধিক পীড়াভোগ করছেন, তা বুঝতে পারছি। কিন্তু, যতদিন না সঠিকভাবে সেই গুপ্তচরদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে, ততদিন এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়ার অনুরোধ রইল।
আজকাল ধনানন্দ তাঁর মহামাত্যর কথার শেষটুকু ধরতে পারলেও তার উত্তর দেন না। কারণ, তিনি জানেন যে, এই একজনই আছে যে তাঁকে এবং তাঁর রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম এবং বদ্ধপরিকর।
ধনানন্দ প্রসঙ্গ পালটে বললেন,
—বেশ। কাজের কথায় আসি। এ আমি কী শুনছি, রাক্ষস? দূত এসে সংবাদ দিল যে, চন্দ্রগুপ্তর সেনা নাকি মগধের সীমানা পেরিয়ে আমাদের বেশ কিছু সীমান্তবর্তী জনপদের দখল নিয়েছে। একথা কি সত্যি?
—হ্যাঁ।
—তাহলে তুমি সেইসব জনপদ পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা কেন নিচ্ছ না?
মাথা নেড়ে রাক্ষস বললেন,
—এই মুহূর্তে তা সম্ভব হচ্ছে না, মহারাজ। কারণ, গোটা মগধ জুড়ে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়েছে। সেই বিদ্রোহ দমন করতে আমাদের সেনারা ব্যস্ত। ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত করে আমি তাদের মগধের ভিন্ন ভিন্ন অংশে পাঠিয়েছি সেখানকার বিদ্রোহ রুখতে।
—কিন্তু, আমাদের তো সেনার অভাব নেই। বাকি সেনাদের কেন ব্যবহার করছ না?
—রাজধানী পাটলিপুত্রকে সবার আগে সুরক্ষিত রাখতে হবে, মহারাজ। বেশিরভাগ সেনা এই কাজে নিযুক্ত। কারণ, আমি চাই না যে, সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতির সুযোগে কেউ রাজধানী আক্রমণ করুক। মনে রাখবেন মহারাজ, দেশের সীমান্তভূমি দখল হয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার সম্ভব। কিন্তু, একবার রাজধানীর পতন হলে কিন্তু তা সহজে ফিরে পাবার নয়।
নিজের সিংহাসনে নড়েচড়ে বসলেন ধনানন্দ। বললেন,
—তুমি কি সে-আশঙ্কাও করছ, অমাত্য?
—না। রাজধানী সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত, সেটা আমি নিশ্চিত করেছি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন ধনানন্দ। খানিক ভেবে বললেন,
—প্রজাদের মধ্যে বিদ্রোহ নতুন কিছু নয়। তা কম-বেশি বরাবরই ছিল মগধে। তবে, এইবার সেই বিদ্রোহ দমন করতে এত বেগ পেতে হচ্ছে কেন?
এই প্রশ্নটা আমারও মনে এসেছে, মহারাজ। আমি এ বিষয়ে গুপ্তচর মারফত সংবাদ পেয়েছি যে, মগধের বিদ্রোহীদের পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে কৌটিল্য নামে এক ব্রাহ্মণ। এই কৌটিল্য আসলে আর কেউ নয়, স্বয়ং চাণক্য।
—আবার! আবার সেই চাণক্য!
—হ্যাঁ, মহারাজ। একটা বিষয় কিছুতেই আমি বুঝতে পারছি না যে, চাণক্যর কাছে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ এল কীভাবে। সেনাবাহিনী, ঘোড়া, অস্ত্র, ধর্ম ইত্যাদির খরচা কম নয়। তার ওপর সে অর্থ ও উশকানি দ্বারা ইন্ধন দিচ্ছে আমাদের রাজ্যের বিদ্রোহীদের। সাধারণ কৃষকরাও হাতে অস্ত্র তুলেছে মগধের বিরুদ্ধে। সাধারণ প্রজা ক্ষোভকে অত্যন্ত সুকৌশলে পরিচালিত করে তাকে সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ দেওয়া হয়েছে।
—তোমার কী অনুমান এই বিষয়ে?
—আমি জানি না, মহারাজ। গোপন সূত্রে খবর নিয়েও কিছুই জানা যায়নি। লোকমুখে নাকি একথাও প্রচলিত হয়েছে চাণক্য একজন ভয়ংকর ঐন্দ্রজালিক। তার নাকি এমন এক জাদুবিদ্যা জানা আছে যার দ্বারা সে একটি স্বর্ণমুদ্রাকে আটটি স্বর্ণমুদ্রায় পরিবর্তন করতে সক্ষম। এইসব কাহিনি ভিত্তিহীন।
কিছুক্ষণ বসে রইলেন ধনানন্দ। বললেন,
—ওই কূট ব্রাহ্মণের পিতা চণককে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তাকেও সেভাবেই ওইদিন রাজসভাতেই হত্যা করা উচিত ছিল আমার! সব রক্তের দোষ! বাপও দেশদ্রোহী ছিল, এখন তার পুত্রও তাই হয়েছে। কৌটিল্য! হ্যাঁ, এটাই সঠিক নাম তার। কুটিল ব্রাহ্মণ কৌটিল্য!
কিছু বলতে গিয়েও বললেন না অমাত্য রাক্ষস। বলে লাভ নেই। আজকাল তিনি রাজাকে সুপরামর্শ দেওয়া ছেড়েছেন। নিজেই প্রয়োজনমতো সিদ্ধান্ত নেন।
ধনানন্দ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর বললেন,
—তুমি ঠিকই বলেছিলে, রাক্ষস। এই কুটিল ব্রাহ্মণকে অবমূল্যায়ন করে প্রথম থেকে উপেক্ষা করা উচিত হয়নি। এবার তবে তুমিই বলো হে, প্রধানামাত্য কাত্যায়ন। কী উপায় এখন? আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?
অনেক বছর পর ধনানন্দর মুখে নিজের আসল নামটা শুনে চমকালেন অমাত্য রাক্ষস। তিনি বুঝলেন, এটা মহারাজের তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করার পরোক্ষ ভঙ্গি। মুখের ভাবে কিছুই প্রকাশ করলেন না তিনি।
নিজের আসনে সামান্য ঝুঁকে বসলেন অমাত্য রাক্ষস। হাঁটুর ওপর দুই কনুই ভর দিয়ে দুটি হাতের আঙুলগুলো একে অপরের ডগা স্পর্শ করল। ধনানন্দ আগেও এভাবে বসতে দেখেছেন তাঁর মহামাত্যকে। একদিন জিজ্ঞেসও করেছিলেন এই মুদ্রার অর্থ কী। উত্তরে রাক্ষস বলেছিলেন যে, এই মুদ্রার নাম ‘হাঁকিনী মুদ্রা’। এই মুদ্রা মানুষের মস্তিষ্কের একাগ্রতা বৃদ্ধি করে তার চিন্তাশক্তির ক্ষমতা বাড়ায়।
কিছুক্ষণ সেই ভঙ্গিতে বসে থাকলেন রাক্ষস। কোনো কথা বললেন না। অধৈর্য হলেও অপেক্ষায় রইলেন ধনানন্দ। বেশ কিছুক্ষণ বাদে রাক্ষস বললেন,
—মহারাজ, আমার মনে হয় সময় এসেছে গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আশা করি, আপনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, আচার্য চাণক্য গোটা রাজ্যের জন্যে এক বিপজ্জনক ব্যক্তি। এতদিন সে-ই আমাদের ওপর আঘাত হেনে গিয়েছে। আমার মনে হয় এইবার আমাদের প্রতি-আঘাত করার সময় আসন্ন।
—তুমি কী করতে চাইছ, অমাত্য?
—বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য- কৌটিল্যকে রাজদ্রোহী ঘোষণা করুন!
—কিন্তু… কিন্তু, এক সাধারণ ব্রাহ্মণকে গোটা মগধের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলে লোকে কী বলবে? তারা কি বলবে না যে, আমি এক সাধারণ ব্রাহ্মণকে ভয় পেয়েছি।
—মহারাজ, এটা অহং-এর সময় নয়। সত্য এটাই যে আমরা আক্রান্ত, মহারাজ। এখন নিজের রাজ্যকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার সময়। আক্রমণই হল রক্ষণের সেরা উপায়।
কিছুক্ষণ ভেবে ধনানন্দ উত্তর দিলেন,
—বেশ। তবে, তাই হোক।
ধন্যবাদ, মহারাজ। কালকে প্রভাতেই গোটা দেশে দূত প্রেরণ করব মগধের রাজ-আদেশসহ। চাণক্যর মস্তকের মূল্য ধার্য করে, তাকে খুঁজতে সারাদেশের সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করা হবে। যে বা যারা তার খোঁজ দিতে পারবে, তাদের জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করা হবে। অন্য রাজ্যের কাছেও একই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হবে যে, তাকে কেউ স্থান দিলে সেই রাজ্যও মগধের শত্রু বলে বিবেচিত হবে। চাণক্যকে চাই, জীবিত অথবা মৃত!
ধনানন্দ তাঁর অমাত্যর চোখের দিকে চেয়ে তাঁর মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করলেন। এবারও বিফল হয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
—এই কৌটিল্য তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। একদিন তুমিই এর প্রাণ রক্ষার্থে আমায় বাধা দিয়েছিলে। আজ তুমি তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিতে বলছ?
—মহারাজ, আমার আনুগত্য সেদিনও মগধের প্রতি ছিল, আজও তাই আছে। কিন্তু, সেদিন চাণক্য মগধের জন্যে বিপদ ছিল না। আজ সে মগধের জন্যে কাল রূপে দাঁড়িয়ে আছে। অতএব, সে এখন আমার প্রতিপক্ষ।
ধনানন্দ উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গিয়ে তেপায়ার ওপর রাখা পানাহারের আয়োজন থেকে দুটি পাত্র নিলেন। একটিতে সোমরস ঢাললেন, অন্যটিতে ডালিমের রস। এগিয়ে এসে দ্বিতীয় পাত্রটি প্রধানামাত্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, —পান করো, কাত্যায়ন। এ মদিরা নয়। আমার সঙ্গে পান করো আজকে। আজকে প্রথমবার এই মহারাজ নন্দর সঙ্গে পরিচিত হলেন অমাত্য রাক্ষস। আজ প্রথমবার নিজের হাতে তাঁর হাতে পানপাত্র তুলে দিচ্ছেন মহারাজ।
পানপাত্র হাতে নিয়ে দু-জন একসঙ্গে চুমুক দিলেন। বিনা বাক্যব্যয়ে দু-জন তাঁদের পাত্র শেষ করলেন। রাক্ষস উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
—মধ্যে।
—বিদায় দিন, মহারাজ। অনেকগুলো আদেশপত্র তৈরি করতে হবে আজকের।
—হ্যাঁ। যাও, অমাত্য কাত্যায়ন।
বেরিয়ে যাওয়ার আগে পেছন ফিরলেন মহামাত্য। বললেন,
—মহারাজ।
—বলো, অমাত্য?
—আপনি আমায় “রাক্ষস” নামে সম্বোধন করলেই আমি খুশি হব। মগধের এই মুহূর্তে রাক্ষসকে প্রয়োজন। নন্দ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার ক্ষমতা এই মুহূর্তে শুধুমাত্র একজন রাক্ষসের আছে। চাণক্য যদি “কৌটিল্য” হয়, তবে তার সঙ্গে এই যুদ্ধে কাত্যায়নকে “রাক্ষস” হতে হবে।
মহারাজ ধনানন্দকে অভিবাদন জানিয়ে সভা ত্যাগ করলেন অমাত্য রাক্ষস।
৬.
— পাখি! পাখি!
নজরদার চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে দলপতি বলে উঠল,
—তিরন্দাজরা প্রস্তুত হও!
দুর্গের সবথেকে উঁচু মিনারের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা চার তিরন্দাজ ধনুকে বাণ চড়িয়ে প্রস্তুত হল। নজরদার হাত তুলে ইঙ্গিত করে দেখাল,
—ওই যে! উত্তর-পূর্ব থেকে আসছে উড়ে!
দুর্গর ওপর পাখিটা আসতেই দুটো তির বিদ্ধ করল তাকে। তিরবিদ্ধ পাখির মৃতদেহটা এসে পড়ল বাগানের মাটিতে।
একজন সৈনিক ছুটে গিয়ে মরা পাখিটাকে তুলল। গলায় বা পায়ে সুতো দিয়ে কোনো চিরকুট বাঁধা আছে কি না পরীক্ষা করল। তারপর সেটাকে একটা মুখ ঢাকা বড়ো মাটির জালায় ফেলে দিল। আজ সকাল থেকে এভাবেই হত্যা করা অন্য আটানব্বইটি পাখির মৃতদেহও ওখানেই আছে। আর একটি হলেই এক-শো হবে। মনে মনে ভাবল সৈনিক।
ছাদ থেকে অন্য একজন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল,
—কিছু ছিল নাকি?
—নাহ্।
চিৎকার করেই উত্তর দিল সৈনিক।
হ্যাঁ, এভাবেই পাটলিপুত্রে রাজমহল থেকে ওঠা, বা, সেদিকে আসা প্রতিটা পাখিকে হত্যা করা হচ্ছে গত দশদিন ধরে। সারাদিন ধরে এই কাজ করছে একদল সৈনিক পাটলিপুত্রর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে। এটাই মহামাত্য রাক্ষসের নির্দেশ। তিনি সন্দেহ করছেন যে, রাজমহলের অন্দরে বা রাজধানীর বুকে শত্রুর কোনো গূঢ়পুরুষ আছে। সেই গুপ্তচরই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পৌঁছে দেয় চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্য অবধি।
অনেকবার চেষ্টা করেও কিছুতেই সেই গূঢ়পুরুষকে ধরা যায়নি। বহুবার তার পিছু নিয়ে প্রাণ হারিয়েছে মগধের সৈনিকরা। রাক্ষসের নিজের গুপ্তচররা জানিয়েছে যে, এই পাটলিপুত্রর বুকে চাণক্যর একজন বিশেষ গূঢ়পুরুষ আছে। শোনা যায়, সে ছদ্মবেশে এতটাই পটু, যে তার আসল রূপ সে নিজেই ভুলে যেতে বসেছে। কেউই তার আসল মুখ চেনে না।
এগুলোই ভাবতে ভাবতে মহলের প্রাঙ্গণে পদচালনা করছিলেন অমাত্য রাক্ষস। হঠাৎ দক্ষিণের দ্বারে কোলাহল কানে গেল তার। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন একদল সৈনিক ও দাসরা দ্বারের সম্মুখে ভিড় করে আছে।
—কী ব্যপার?
সেদিকে এগোতে এগোতে প্রশ্ন করলেন অমাত্য রাক্ষস। তাঁকে দেখেই তটস্থ হয়ে অভিবাদন জানাল সৈনিক ও দাসরা। একজন সৈনিক বলল, প্রণাম, মহামাত্য। এই যে, একটা নোংরা ভবঘুরে কোথা থেকে জানি মহলের দ্বারে এসে বসে আছে। কথা বুঝতে পারছে না আমাদের। যেতে বললেও যাচ্ছে না।
এগিয়ে যেতেই বিশ্রী দুর্গন্ধ পেলেন অমাত্য। গন্ধটা লোকটির শরীর থেকে আসছে। লোকটিকে নোংরা বললেও কম বলা হয়। কালো, জটধরা চুলে মুখের অর্ধেক ঢেকে। মুখ থেকে লালা ঝরছে ক্রমাগত। পরনে শুধু একটা শতচ্ছিন্ন কাপড়ের টুকরো যা কোনোভাবে কোমরের নীচ থেকে জড়িয়ে লজ্জা নিবারণ করেছে। যদিও এই লোকটির শূন্য দৃষ্টি দেখে তার লজ্জা বোধ আছে বলে মনে হয় না। কোনো সহৃদয় ব্যক্তি সম্ভবত নিজেই লজ্জার খাতিরে তার কোমরে কাপড়টা জড়িয়ে দিয়েছে। তাও সম্ভবত কয়েক মাস অতিক্রান্ত হয়েছে।
—তাড়াও একে। তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? লোকটা এতদূর এল কীভাবে?
আসলে লোকটার শরীর এতটাই নোংরা যে সৈনিকরা তার গায়ে হাত দিচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে রাক্ষস বললেন,
—এইক্ষণে বের করো একে! নাহলে একে এতদূর আসতে দেওয়ার জন্যে প্রহরীদের দণ্ডাদেশ দেব!
দু-জন সৈনিক তরবারি বের করে লোকটাকে খোঁচা দিল। তাতে কিছুটা লাভ হল। লোকটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। সবাই মিলে সমবেত চিৎকার করে তাকে ভাগাতে লাগল। অমাত্য রাক্ষস দেখলেন ভবঘুরে একপায়ে খোঁড়া। বাম পা টেনে টেনে চলছে লোকটা। ভ্রূ কুঁচকে রাক্ষস সেদিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। পায়ের নীচটা চোখে পড়ল তাঁর। হঠাৎই তাঁর মনে কী যেন একটা খটকা লাগল। কিন্তু সেটা যে কী, তা ভেবে পাওয়ার পূর্বেই আকাশে আবার একটা পাখি দেখা যেতে মিনারের ওপর থেকে নজরদার চেঁচিয়ে উঠল। রাক্ষস সেদিকে এগিয়ে গেলেন।
.
রাজমহলের দৃষ্টিসীমার বাইরে পৌঁছে একবার পেছন ফিরে রাজমহলের দিকে দেখল ভবঘুরে। পরিবর্তন এল তার চলার ভঙ্গিতে। এতক্ষণ ধরে যে বাম পা-টা ব্যাঁকা পড়ছিল, সেটা যেন জাদুবলে সোজা হয়ে গেল। এতক্ষণের মন্থর গতি ত্যাগ দিয়ে জোরে হাঁটা শুরু করল লোকটা।
মুখের ওপর থেকে নোংরা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে নিল জীবসিদ্ধি। তার শূন্যদৃষ্টি এখন প্রখর হয়েছে। তাকে যেভাবেই হোক যোগাযোগ করতে হবে গুরুদেবের সঙ্গে। জানাতেই হবে এই সংবাদ যা একটু আগেই সে প্রত্যক্ষ করেছে রাজমহলের প্রাঙ্গণে।
ওরা মহলের ওপর দিয়ে উড়তে থাকা প্রতিটা পাখিকে তির মেরে নামাচ্ছে! পাটলিপুত্রর চারিদিকে যুদ্ধকালীন সতর্কতায় প্রহরা দিচ্ছে রাক্ষসের সৈনিকরা। একটি পিপীলিকাও তাদের নজর এড়িয়ে নগরে প্রবেশ করতে বা নগর থেকে বেরোতে পারবে না। এই মুহূর্তে প্রশিক্ষিত পাখি ব্যবহার করে গোপন সংবাদ লেনদেন বন্ধ করতে হবে। কারণ, একটিও গুপ্তবার্তা যদি রাক্ষসের হাতে পড়ে যায়, সে ঠিকই সেটা থেকে কোনো-না-কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেই ফেলবে। আচার্য চাণক্য ঠিকই বলেন। অমাত্য রাক্ষস একজন ভয়ংকর ব্যক্তি! আকাশের প্রতিটা পাখিকে কেউ তির মেরে নামানোর কথা ভাবতে পারে, তা জীবসিদ্ধির ধারণার অতীত। অথচ, একটু আগে সে ঠিক তা-ই চাক্ষুষ করে এসেছে।
সাবধান করতে হবে আচার্যকে! অমাত্য রাক্ষস বড়োই বিপজ্জনক।
* * *
অমাত্য রাক্ষসের মনে সন্দেহটা হতে কিছুটা সময় লেগেছিল। ভবঘুরে লোকটার পায়ের নীচে ধুলো, ময়লা লেগে থাকলেও সেখানে কোনো কড়া দেখতে পাননি তিনি। খালি পায়ে কেউ বরাবর হাঁটলে তাদের পায়ের নীচের চামড়ায় কাঠিন্য দেখা দেয়। শক্ত কালো কড়া পড়ে যায়। যেকোনো সাধারণ ভিক্ষুক বা ভবঘুরের পায়েই তা থাকে। কিন্তু, এই লোকটির ছিল না। অর্থাৎ, সে পায়ে পাদুকা পরতে অভ্যস্ত!
দ্রুত দু-জন সৈনিক নিয়ে, নিজেই ঘোড়া করে ধাওয়া করেন অমাত্য রাক্ষস। মাটির ওপর পায়ের ছাপ তখনও রয়ে গিয়েছিল। কিছুদূর গিয়েই দেখলেন এতক্ষণ যে পায়ের ছাপ ব্যাঁকা পড়ছিল, তা হঠাৎই সোজা পড়তে শুরু করেছে। তবে, বেশিদূর নয়। খানিক বাদেই মানুষের পায়ের ছাপ আর দেখা গেল না। তার পরিবর্তে ঘোড়ার খুরের ছাপ পড়েছে মাটিতে। অর্থাৎ, ঘোড়া এখানেই লুকিয়ে রেখে ভবঘুরের ছদ্মবেশে মহলে গিয়েছিল লোকটা।
গুপ্তচরটি একটুর জন্যে তার হাত থেকে ফসকে যাওয়ায় হতাশ হলেন অমাত্য রাক্ষস। যদিও রাক্ষসের মুখে তার চিহ্নও দেখা গেল না।
৭.
দক্ষিণ আর্যাবর্তর কোনো এক ছোট্ট গ্রাম। এখানেই একটি কুটিরে অস্থায়ীভাবে গত কয়েক দিন ধরে আছেন চাণক্য। মাত্র কয়েক জন তাঁর বর্তমান অবস্থান জানে। গোটা দেশ জুড়ে তাঁর সন্ধান চলছে। তাঁকে জীবিত বা মৃত খুঁজে দেওয়ার জন্যে পুরষ্কার ঘোষণা করেছে মগধ কুটিরের বাইরে থেকে পরিচিত কণ্ঠে ডাক এল।
—আচার্য।
—জীবসিদ্ধি? এসো, এসো।
কুটিরে প্রবেশ করল জীবসিদ্ধি। কুটিরে আসবাব বলতে কিছুই নেই। এককোণে একটি কাপড়ের ঝোলা। ঘরের মাঝে একটি কাপড় বিছিয়ে তাতে উপবিষ্ট হয়ে আছেন চাণক্য। তাঁর সম্মুখে একটিমাত্র মৃৎপ্রদীপ জ্বলছে।
চাণক্য জীবসিদ্ধিকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
—তুমি এখানে কেন? তোমার তো পাটলিপুত্রতে থাকা উচিত।
মেঝেতেই উপবিষ্ট হল জীবসিদ্ধি। তার পরনে এখন এদেশি সৈনিকের বেশ। ঠোঁটের ওপর পুরু গুল্ফ যা তার সামরিক সাজের সঙ্গে মানানসই। জীবসিদ্ধি উত্তর দিল,
—আপনার সঙ্গে দেখা করতেই বহুদিনের পথ অতিক্রম করে আসতে হল, আচার্য। আমরা সকলেই আপনার সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কিত, গুরুদেব। দয়া করে অন্তত আমাকে আপনার সঙ্গে থাকতে দিন। চন্দ্রগুপ্তরও তাই অভিমত। এভাবে একাকী অজ্ঞাতবাসে আপনি কতদিন ঘুরে বেড়াবেন?
—আমার পক্ষে একাই লুকিয়ে থাকা সবচেয়ে সহজ, জীবসিদ্ধি। একা আমি সহজে যাতায়াত করতে পারি।
—অন্তত আমাকে আপনার সঙ্গী হতে দিন?
ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলেন চাণক্য,
—অসম্ভব! তোমার স্থান অন্যত্র! পাটলিপুত্র থেকে গোপন সংবাদ সরবরাহ এবং গোটা দেশের গুপ্তচরচক্র পরিচালনার ভার তোমারই ওপর, তা কি ভুলে গেলে, হে জীবসিদ্ধি? কী ভেবে তুমি এই সময়ে মগধ ছেড়ে এখানে আসার ঝুঁকি নিলে?
—কারণ, সেখানে থেকেও কোনো লাভ নেই। আমার গুপ্তচরচক্র সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে অমাত্য রাক্ষসের কারণে। গুপ্তচর সন্দেহে রোজ একাধিক মানুষকে বন্দি করছে মগধের বাহিনী। তাদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে না পারলেই তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করছে! যাদের এখনও অবধি বন্দি করেছে, তাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ। আমার কয়েক জন গূঢ়পুরুষও তাদের মধ্যে আছে বটে।
—তোমার ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা উচিত ছিল। পাটলিপুত্রর ওপর দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন।
—এই মুহূর্তে আমাদের কাছে আপনার সুরক্ষা অগ্রাধিকার।
—তুমি কেন এখানে এসেছ, জীবসিদ্ধি?
—আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, আচার্য?
চাণক্য চোখ বন্ধ করে বললেন,
—অপেক্ষা।
—কতদিন?
—যতদিন না মগধের সৈনিকরা ক্লান্ত হয়ে রাক্ষসের বিরুদ্ধে চলে যায়।
—তাদের ক্লান্তি দূর করার মোক্ষম ঔষধ রাক্ষসের জানা আছে। সে উত্তরোত্তর পুরস্কার মূল্য বৃদ্ধি করবে। এ ছাড়া কি অন্য কোনো উপায় নেই, আচার্য?
চোখ না খুলেই চাণক্য বললেন,
—আছে।
—আছে? কী সে-উপায়, আচার্য?
—অমাত্য রাক্ষস যা চাইছেন, তা যদি তিনি পেয়ে যান, তবে এই দেশব্যাপী চলতে থাকা দক্ষযজ্ঞে ইতি দিতেন।
বিস্মিত হয়ে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,
—অর্থাৎ? আপনি কি ধরা দিতে চাইছেন নাকি?
চোখ খুলে মৃদু হাসলেন চাণক্য। উত্তর না দিয়ে, উঠে গিয়ে কাপড়ের ঝোলা থেকে একটা নারকেল বের করে এনে জীবসিদ্ধিকে দিয়ে বললেন,
—এইটি দিয়েই আজকে রাত্রে আমাদের দু-জনের উদরপূর্তির ব্যবস্থা করো। তোমার ওই বামন তরবারিটি ব্যবহার করো। আজ এ ছাড়া আর কিছু নেই গৃহে।
জীবসিদ্ধি নারকেল ভেঙে, দু-টুকরো করে একটুকরো চাণক্যর হাতে দিল এবং অন্যটায় নিজে কামড় বসাল। টের পেল সেও বড়োই ক্ষুধার্ত ছিল এতক্ষণ।
—আপনি উত্তর দিলেন না তো? কী উপায় আছে রাক্ষসকে প্রতিরোধ করার? চাণক্য তৃপ্তির সঙ্গে নারকেলের টুকরো মুখে দিয়ে চর্বণ করতে করতে বললেন,
—এত মাস ধরে, সারাদেশ জুড়ে এই অশ্বমেধ চালাতে মগধেরও কম ক্ষতি হচ্ছে না। আর্থিকভাবে বিপুল ব্যয় হচ্ছে মগধের। তাদের যা কাম্য, তা পেলেই তারাও থামবে।
—তাদের কাম্য আপনি! জীবিত অথবা মৃত!
—হুমম। আমরা তাদের যদি সেটাই দিই? যদি তারা আমার মৃতদেহ খুঁজে পায়, তবে?
তাঁর কথায় খাওয়া থামিয়ে চাণক্যর মুখপানে চেয়ে রইল জীবসিদ্ধি। চাণক্য বলে চললেন,
—মগধের সৈনিকরা চাণক্যকে খুঁজছে। তারা আমার সম্বন্ধে কী জানে? তারা কি আমায় চেনে? না। তারা কি জানে আমায় কেমন দেখতে? না।
তাহলে কে চাণক্য? একজন ব্রাহ্মণ। তাকে চেনার উপায় কী? তার ব্রাহ্মণের বেশ এবং তার খোলা কেশশিখা। এ ছাড়া তারা বড়োজোর জানে আমার উচ্চতা, মুখের গড়ন, বর্ণ, চোখের মণির রং ইত্যাদি। এই অস্পষ্ট বর্ণনার ওপর ভিত্তি করেই তারা আমার সন্ধান করছে।
জীবসিদ্ধির দু-চোখ ছোটো হল। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। সে আচার্যর পরিকল্পনার আভাস পাচ্ছে। চাণক্য আর কিছু বললেন না। মৌন হয়ে অপেক্ষায় রইলেন জীবসিদ্ধির প্রতিক্রিয়ার। জীবসিদ্ধি বলল,
—আপনার অনুরূপ উচ্চতার ও শারীরিক গঠনের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়াটা কঠিন কিছু নয়। কোনো মৃতদেহকে ব্রাহ্মণবেশে সাজিয়ে, মাথায় খোলা শিখা প্রতিস্থাপন করাটাও হয়ে যাবে। কিন্তু, তারপর? মগধের সৈনিকরা না-হয় আপনাকে চেনে না। কিন্তু, অমাত্য রাক্ষস তো চেনেন। ধনানন্দ তো চেনেন। তাঁদের চোখে কীভাবে আমরা ধুলো দেব, আচার্য?
—সে-উপায়ও আমি ভেবেছি, হে জীবসিদ্ধি। অমাত্য রাক্ষস পাটলিপুত্বতেই বসে গোটা বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করছেন, যাতে রাজধানীর সুরক্ষা সুনিশ্চিত থাকে এত কিছুর মধ্যেও। অতএব, আমার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যেতে হবে এমন কোনো স্থানে, যেখান থেকে পাটলিপুত্রর দূরত্ব অনেক। যাতে তিনি রাজধানী থেকে সেখানে আসতে, বা, মৃতদেহ তাঁর কাছ অবধি নিয়ে যেতে অন্তত একমাসের অধিক সময় লাগবে।
জীবসিদ্ধি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—কেন? তাতে লাভ কী হবে?
—ওহে জীবসিদ্ধি, ভেবে দেখো। এর ফলে রাক্ষস আমার মৃতদেহ অবধি পৌঁছোনোর পূর্বেই মৃতদেহে পচন শুরু হবে। যতই সংরক্ষণের চেষ্টা হোক, আর্যাবর্তর এই গ্রীষ্মকালীন আর্দ্রতায় ততদিনে মৃতদেহ এতটাই পচে যাবে যে, তার শনাক্তকরণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
—দুর্দান্ত! দুর্দান্ত পরিকল্পনা আপনার, আচার্য!
চাণক্য হাত তুলে শিষ্যকে শান্ত হতে বললেন,
—তিষ্ঠ হে জীবসিদ্ধি, তিষ্ঠ! এই গোটা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গেলে কিন্তু আমাদের খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেন ঘুণাক্ষরেও অমাত্য রাক্ষস আভাস না পায় যে, গোটা বিষয়টাই সাজানো জীবসিদ্ধি দৃঢ়স্বরে বলল,
—সে-ভার আপনি আমার এবং আমার গুপ্তচরদের ওপর ছেড়ে দিন, আচার্য।
৮.
ভোজ রাজ্যের প্রায় শেষপ্রান্তে, গোদাবরী নদীর তীরে গভীর অরণ্য। সূর্যের আলো গভীর অরণ্যে ঠিকভাবে প্রবেশ করতে পারে না বলে, দিনের এই দ্বিতীয় প্রহরেও এখানটা কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। সাধারণত সেখানে বন্যপশুদের রাজত্ব চলে। তাই লোকজন খুব গভীরে প্রবেশ করে না। এখানে জঙ্গল ও পর্বত একসঙ্গে অবস্থান করে। সাতটি পর্বত থাকার কারণে অনেকে এই স্থানের নাম সপ্ত-পুর বলে।
সেই অরণ্যপথ ধরে কিছুটা গভীরে গেলেই, একটি গুহা আছে। দেখে বোঝা যায় অরণ্যের অন্য প্রতিটি বস্তুর মতো এটাও প্রাচীন। কিন্তু, তা সহজে চোখে পড়বার নয়। কারণ লতা, জঙ্গলে তার প্রবেশপথ প্রায় অদৃশ্য। শুধুমাত্র যারা এই গুহার অবস্থান জানে, তারাই এই গুহা খুঁজে পায়।
এই জঙ্গলের নিঃসঙ্গ চিত্রপটে ফুটে ওঠা রোজকার দৃশ্যর সঙ্গে আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, খানিক পূর্বেই অরণ্যে প্রবেশ করেছে জনা পঞ্চাশ মগধ সৈনিকের একটি দল। তারা এই মুহূর্তে গাছের আড়াল থেকে নজর রাখছে গুহার প্রবেশমুখে।
দলের সেনাপতির পাশেই যে ব্যক্তি রয়েছে সে সৈনিক নয়। আগেও বেশ কয়েক বার তাকে প্রশ্নটা করেছেন সেনাপতি, আবারও তিনি ফিসফিস করে সেই লোকটিকে প্রশ্ন করলেন, —তোমার তথ্য নির্ভুল তো? তুমি নিশ্চিত এ-ই সেই স্থান?
লোকটি হাতজোড় করে বিগলিত কণ্ঠে বলল,
—আজ্ঞে, একদম নিশ্চিত মহাশয়! একেবারে বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে এই খবর পেয়েছি আমি। ওই চন্দ্রগুপ্তর দলেরই কিছু বিদ্রোহী, মদিরালয়ে নেশার ঘোরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল। সেইসময় আমি সেখানে ছিলাম এবং তাদের কথা নিজের কানে শুনেছি। তাদের মুখেই জানতে পারি কৌটিল্য কোথায় আত্মগোপন করে আছে। তারপর গোপনে অনেক সন্ধান করে এই গুহার সন্ধান পেয়েছি আমি। এ অনেক কষ্টসাধ্য কাজ, আর্য। আপনি শুধু দেখবেন পুরস্কারটা যেন…।
—আহ্! বার বার একই কথা বল কেন? বলেছি তো, কৌটিল্যকে ধরতে পারলে আমি যা পাব তার অংশ তুমিও পাবে। কিন্তু মনে রেখো, যদি তোমার খবর ভুল হয়, যদি দেখা যায় যে, তোমার ভুল কথার ওপর নির্ভর করে আমরা এতদূর এসেছি, তবে আমরা পঞ্চাশজন মিলে তোমায় ভল্ল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করব।
ঢোঁক গিলে দুর্বলভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল গুপ্তচরটি। কিন্তু, তার আগেই যেন তার কথার সত্যতা প্রমাণ করতে একটি বাণ উড়ে এল গুহার অন্ধকার প্রবেশদ্বার থেকে। তিরটি বিদ্ধ করল একজন সৈনিককে।
পরমুহূর্তে ছুটে এল আরও একটি বাণ। এবারও সেটি অন্য এক সৈনিককে বিদ্ধ করল।
এতক্ষণে মগধের সৈনিকরা সতর্ক হয়ে গিয়েছে। দ্রুত তারাও শর বর্ষণ করল গুহামুখ লক্ষ করে। এভাবেই কিছুক্ষণ শরযুদ্ধ চলল দু-পক্ষের। কিন্তু, ক্রমেই বিপক্ষ থেকে উড়ে আসা তিরের সংখ্যা কমল। একসময় সৈনিকদের তিরের আর একপ্রস্থ বর্ষণ হতেই ভেতর থেকে পুরুষকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে এল।
কিছুক্ষণ আর কোনো শব্দ এল না। এতক্ষণে দু-জন সৈনিক বেশ কয়েকটা মশাল জ্বেলে ফেলেছে। সেনাপতি ইশারা করতেই একটি মশাল ছুড়ে দিল গুহামুখে। তাতে প্রবেশপথ কিছুটা আলোকিত হল।
ওদিক থেকে আর বাণ উড়ে না আসায় এইবার সৈনিকরা ধীরে ধীরে এগোল গুহার দিকে। তারপরে কোনো প্রতিরোধ না পেয়ে সবাই প্রবেশ করল গুহার ভেতর।
কিছুটা এগোতেই তারা সেখানে মানুষের উপস্থিতির চিহ্ন দেখতে পেল। কিছু তৈজসপত্র এদিক-ওদিক ছড়ানো। একজায়গায় এখনও নিভু নিভু একটা আগুন জ্বলছে। কিন্তু, যারা ছিল তারা পালিয়েছে।
একদল সৈনিক আরও গভীরে ঢুকে গেল। তারা চিৎকার করে জানাল,
—ওদিকে গুহার আর একটা মুখ আছে। কয়েক জন ওই পথে পালিয়েছে! আমরা তাদের পিছু নিচ্ছি!
তখনই আরও একজন গুহার ভেতর থেকে চিৎকার করে বলল,
—এখানে একটা মৃতদেহ!
সেনাপতিসহ কয়েক জন দ্রুতপায়ে সেখানে পৌঁছে আবিষ্কার করল একটি শরবিদ্ধ মৃতদেহ। মৃতদেহর অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে সম্ভবত নিহত লোকটি গুহার মুখে তিরবিদ্ধ হয়েছে। সেই অবস্থাতেই পালানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু এতদূর এসে আর পারেনি। এখানেই সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছে।
মশালের আলোয় দেখা যাচ্ছে নিহত ব্যক্তির পরনে ব্রাহ্মণের বেশ। বুকে উপবীত। মুণ্ডন করা মাথায় বন্ধনহীন দীর্ঘ কেশশিখা!
সেনাপতির চোখে বিজয়োল্লাস ফুটে উঠল। চিৎকার করে তিনি অন্য সৈনিকদের বললেন, —পলাতকদের পিছু নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই! আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে! কৌটিল্য মৃত!
সেইসময়েই গুহার উলটোদিকের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দ্রুত এগোতে থাকা পুরুষদত্ত মনে মনে ভাবছিল, আশা করি মৃতদেহ কতটা পুরোনো, সে-পরীক্ষা করার মতো জ্ঞান সৈনিকদের নেই। এই জায়গায় আচার্য চাণক্যর মতো কেউ থাকলে তিনি একদৃষ্টিতেই বলে দিতে পারতেন যে, এই মৃতদেহ পুরোনো। বাণের ক্ষতচিহ্ন, রক্তের পরিমাণ, মৃতদেহর কাঠিন্য প্রভৃতি আরও অনেক কিছু থেকেই বিষয়টা অনুমান করে ফেলতেন খুব সহজেই।
কিন্তু, সৌভাগ্যের বিষয় যে, মগধের সৈনিকরা কেউই চাণক্য নয়।
৯.
নাকে কাপড় বেঁধেও দুর্গন্ধটা নাকে প্রবেশ করাটা আটকানো যাচ্ছে না। ছোট্ট লোহার সিন্দুকটা তবুও সেই সপ্তপুরের জঙ্গল থেকে পাটলিপুত্র অবধি বয়ে নিয়ে এসেছেন সেনাপতি।
প্রায় একমাসেরও অধিক সময় কেটে গিয়েছে। কৌটিল্যর মৃত্যুসংবাদ পাখির মারফত পাটলিপুত্রতে প্রেরণ করার কয়েক দিনের মধ্যেই রাজধানী থেকে উত্তর আসে। পত্রে স্বয়ং মহামাত্য রাক্ষসের মুদ্রা দেখে বিষয়টার গুরুত্ব আরও একবার উপলব্ধি করতে পারেন সেনাপতি। তাতে সংক্ষিপ্ত আদেশ:
‘মৃতদেহর পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া অবধি সন্ধান বন্ধ হবে না। চাণক্যর মস্তকটি আমার চাই।’
আদেশ পড়ে বিস্মিত হয়েছিলেন সেনাপতি। মস্তক? ধড় থেকে মস্তক ছিন্ন করে তা রাক্ষসের সম্মুখে হাজির করতে হবে প্রমাণস্বরূপ? এ আবার কেমন আদেশ? ব্রাহ্মণের মৃতদেহ নিয়ে এইসব করলে কি পাপ হবে না? মৃতদেহতে এমনিতেই পচন ধরেছে। ওই মস্তক পাটলিপুত্র পৌঁছোনো অবধি কিছুই যে বাকি থাকবে না! তা শনাক্তকরণের অনুপযুক্ত একটি নরকরোটি মাত্র রয়ে যাবে। কী করবেন রাক্ষস সেই করোটিটি নিয়ে? নিজের কক্ষের দেওয়ালে সাজিয়ে রাখবেন? নাকি… নাকি ব্রাহ্মণের করোটি নিয়ে কোনো গুপ্ততন্ত্র ক্রিয়া করবেন? এই অমাত্য রাক্ষসের বিষয়ে অনেক কথা শোনা যায়। লোকটি নাকি খুবই ক্রূর ও ভয়ংকর। হতে পারে তিনি এইসব মন্ত্র-তন্ত্রও করেন।
সে যাই হোক, এই আদেশের কারণ ভেবে লাভ নেই। মহামাত্যর আদেশ যখন, তখন তা পালন করতেই হবে। তা ছাড়া, পুরস্কার মূল্যটাও নেহাতই কম নয়। তাই সে নিজেই নিয়ে যাবে বলে ঠিক করে কৌটিল্যর ছিন্ন মস্তকটি।
যাত্রাপথ সুগম হয়নি। দিনে দিনে দুর্গন্ধ বেড়েছে। দীর্ঘ যাত্রার পর অবশেষে মগধের রাজধানী পাটলিপুত্বতে পৌঁছেছে সে।
ওদিকে অমাত্য রাক্ষস তখন মগধের রাজকোষের হিসেব পরীক্ষা করতে বসেছিলেন। তাঁর ললাটে চিন্তার ভাঁজ। কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে, কিন্তু সেটা যে কোথায়, তা রাক্ষস ধরতে পারছেন না। দেশের অর্থনীতি যেন দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই তার কারণ উদ্ধার করতে পারছেন না অমাত্য রাক্ষস। রাজকোষের হিসেবের থেকেও অনেক অধিক মুদ্রা যেন দেশে রয়েছে। কিন্তু, তা কীভাবে সম্ভব?
সম্মুখে খুলে রাখা গাদাখানেক ভূর্জপত্রের মধ্যে ডুবে ছিলেন অমাত্য রাক্ষস।
তখনই এক ভৃত্য এসে জানাল কৌটিল্যর মস্তকসহ এক সেনাপতি এসেছে। সে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী।
উঠে দাঁড়ালেন অমাত্য রাক্ষস। একমাস আগে যখন পারাবতের মাধ্যমে প্রথমবার চাণক্যর মৃত্যুসংবাদ এসেছিল তাঁর কাছে, তখন থেকেই তিনি ভারি বিষণ্ণ হয়ে রয়েছেন। বিষয়টা অদ্ভুত হলেও সত্যি।
তাঁরই আদেশে এই কাজ করা হয়েছে। তিনিই চেয়েছিলেন চাণক্যর ষড়যন্ত্রর অস্ত হোক। যে মগধকে রক্ষা করতে তিনি বদ্ধপরিকর, চাণক্য কি সেই মগধেরই সবথেকে বড়ো শত্রু নন? তবে কেন তাঁর মৃত্যুসংবাদে খুশি হতে পারছেন না অমাত্য রাক্ষস? পুরোনো সহপাঠীর প্রতি সহানুভূতি? নাকি, একজন বিদ্বান পণ্ডিতকে হারানোর গ্লানি? নিজের মনের অনুভূতি নিয়ে নিজেই বিহ্বল বোধ করছেন তিনি।
ভৃত্যর পিছু পিছু চলতে চলতে এই মুহূর্তে তাঁর মনে ঝড় চলছে। কী হবে যদি এখন তিনি গিয়ে দেখেন যে ছিন্ন মস্তকটি বাস্তবিকই বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যর? তিনি কি বিজয়োল্লাস অনুভব করবেন? নাকি, একজন ব্রাহ্মণের মৃতদেহ অশুদ্ধ করার অপরাধে নিজেকে দোষী ভাববেন? ঈশ্বর কি তাঁকে পাপের জন্যে ক্ষমা করবেন? কিন্তু, তিনি তো নিজের কর্তব্য পালন করেছেন মাত্র। ইতিহাস তাঁকে ক্রূর, অনুভূতিহীন বলে জানবে হয়তো আগামীতে। এই কালিমা তিনি স্বেচ্ছায় নেবেন, কিন্তু নিজের কর্তব্যে তিনি অবিচল থাকবেন। হ্যাঁ, ইতিহাস যদি কাত্যায়নকে ‘রাক্ষস’ রূপে চেনে, তবে তাই হোক!
প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই অমাত্য রাক্ষসের নাকে দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। দুর্গন্ধর উৎস খুঁজতে গিয়েই চোখে পড়ল লোহার পেটিকাটি। মাটিতে রাখা রয়েছে সেটা। বেশ খানিকটা দূরত্বে একজন সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে নাকে-মুখে কাপড় বেঁধে। আশেপাশে সমস্ত ভৃত্যও নাক চাপা দিয়েছে। কেউই জিনিসটার ধারে-কাছে আসছে না।
হৃদয় ভারী হয়ে এল রাক্ষসের। হায় রে চাণক্য! এই ছিল তোমার শেষ পরিণতি? তিনি নিজেও শোকাহত বোধ করছেন। তাঁর এই আদেশ যে বড্ড নির্মম! কিন্তু, এ ছাড়া যে তাঁর কাছে মৃতদেহ শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই।
ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি লোহার ছোটো সিন্দুকটির কাছে। সেনাপতিকে আদেশ দিলেন,
—খোলো।
সেনাপতি নাকের কাপড়টি আরও একবার শক্ত করে বেঁধে নিয়ে এগিয়ে এলেন। পেটিকার ডালাটি খুলেই সরে দাঁড়ালেন।
বন্ধ সিন্দুকে যেটুকু দুর্গন্ধ চাপা ছিল, এইবার সেটাও বেরিয়ে ছড়িয়ে গেল। ভেতরে দেখা গেল একটা গলিত নরমুণ্ড। হ্যাঁ, তা শনাক্ত করার অবস্থায় নেই।
কীট অনেক আগেই খেয়ে ফেলেছে চামড়া, মাংস, দুটি চোখ। সে-দৃশ্য দেখে ভৃত্যটি দুই হাতে মুখ চেপে বমন করা থেকে নিজেকে কোনোভাবে বিরত রেখে ছুটে পলায়ন করল সেই স্থান থেকে।
রাক্ষস ঝুঁকে পড়লেন পেটিকাটির দিকে। নিজের শিখার থেকে একটা কাঁটা নিয়ে নরমুণ্ডর যেটুকু ঠোঁটের অংশ অবশিষ্ট আছে, সেটা সরিয়ে দেখলেন অমাত্য। সেনাপতি ভেবে পেলেন না, কী দেখছেন অমাত্য রাক্ষস। এই লোকটার কি ঘৃণাবোধও নেই? নাকে হাত চাপা পর্যন্ত দেননি তিনি। লোকে সত্যিই বলে, অমাত্য রাক্ষসের মধ্যে অনুভূতি বলে কোনো বস্তু নেই!
হাতের কাঁটাটি মাটিতে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন অমাত্য। তিনি যেন এইবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। এতক্ষণ যেন একটা নিশ্বাস আটকে ছিল তাঁর বুকে। এতক্ষণে নিজেকে অনেকটা ভারমুক্ত মনে হল তাঁর। নিজের এই প্রতিক্রিয়ায় রাক্ষস নিজেই অবাক হলেন।
সেনাপতিটিকে ইঙ্গিতে নির্দেশ দিলেন সিন্দুকের ডালা বন্ধ করতে। তারপর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, —এ চাণক্য নয়।
বলেই উলটোদিকে ফেরার পথ ধরলেন রাক্ষস। বজ্রাহতর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন সেনাপতি। এ চাণক্য নয়! এই করোটি দেখে কীভাবে জানলেন অমাত্য? সন্দেহ হল সেনাপতির। এমন নয় তো, যে, পুরস্কারের স্বর্ণমুদ্রা যাতে দিতে না হয়, তাই মিথ্যা বলছেন অমাত্য? কিন্তু, একথা মুখে বলার সাহস তাঁর হল না। দুর্বলকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, —কিন্তু… কিন্তু আপনি কীভাবে এত নিশ্চিত হচ্ছেন?
হাঁটা থামালেন অমাত্য রাক্ষস। ঘাড় ফিরিয়ে উত্তর দিলেন, —চাণক্যর দত্তপাটি অসম, বক্র। মৃতদেহ সম্পূর্ণ গলিত হয়ে গেলেও দাঁত একই থেকে যায়। এই করোটি চাণক্যর নয়। সমস্ত অনুসন্ধানকারী দলকে সংবাদ প্রেরণ করে জানিয়ে দাও যে, চাণক্য এখনও জীবিত!
১০.
চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত আলোচনায় ডুবে আছেন। প্রায় এক বছর পর তাঁদের সাক্ষাৎ হল। এখন তাঁদের দু-জনের নামেই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তাই তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে আত্মগোপন করে বিগত বেশ কয়েকটি মাস অতিবাহিত করেছেন। দু-জনের একস্থানে থাকা বিপজ্জনক। তাই চাণক্য ও তাঁর শিষ্যরা ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছেন। গোপন সূত্রের মাধ্যমে তাঁদের যোগাযোগ হয়।
যোগাযোগ স্থাপনের এক অভিনব পদ্ধতি জীবসিদ্ধি আবিষ্কার করেছে।
দিনের বেলা পাখিদের ওপর নজরদারি শুরু করার পর থেকেই যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। গুপ্তচর বৃত্তির মূল শিরদাঁড়াটাই হল যোগাযোগ ব্যবস্থা। অমাত্য রাক্ষস সঠিক স্থানেই আঘাত করেছিলেন বটে। তাই জীবসিদ্ধির নির্দেশে, চন্দ্রগুপ্তর শিবিরে একঝাঁক নিশাচর পাখিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। কয়েক মাস সময় লেগেছে বটে সেই কাজে, কিন্তু পুনরায় যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। সাধারণত যেখানে পারাবত জাতীয় পাখি ব্যবহার হয়, সেখানে পেচককে পত্রবাহক করার কথাটা স্বয়ং অমাত্য রাক্ষস ও অনুমান করতে পারেননি।
কিন্তু, তাতেও অসুবিধা কম হয়নি। চারিদিকে খোঁজ চলছে চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তর। অনেক ছোটো ছোটো জনপদের রাজারা, যাঁরা একদা চন্দ্রগুপ্তকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা বেশিরভাগই মগধের ভয়ে পিছু হটেছেন। অমাত্য রাক্ষসের প্রভাব এই গোটা আর্যাবর্তয় এতটাই প্রবল। তাঁর নির্দেশ অমান্য করার সাহস বেশিরভাগ রাজারই নেই। অতএব, অনেক জনপদের শাসক, যাঁদের সঙ্গে একদা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, তাঁরা চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেছেন।
অতএব, কিছুটা মরিয়া হয়েই এখন চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যকে নতুন রাজাদের থেকে সমর্থন খুঁজতে হচ্ছে। সেই নিয়েই আলোচনায় ব্যস্ত তাঁরা।
—কলিঙ্গর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা বিফল হয়েছে। বারংবার পত্র প্রেরণ করেও কলিঙ্গরাজ উত্তর দিচ্ছেন না। ওদিকে অঙ্গরাজ জানিয়েছেন যে, এই মুহূর্তে আমাদের জন্যে কিছু করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, কারণ মগধের চর চারিদিকে। তাঁর আশঙ্কা তাঁর দরবারেও মগধের সমর্থক আছে। তবে, তিনি আমাদের সহমর্মী।
চন্দ্রগুপ্তর কথার উত্তর দিলেন চাণক্য,
—সহমর্মিতা দ্বারা যুদ্ধ জয় হয় না। আমাদের প্রয়োজন সেনাবল। তা যখন তিনি আমাদের দিতে অক্ষম, তখন আর তাঁর সহমর্মিতা আমাদের বিশেষ কোনো প্রয়োজনে লাগবে না। সমর্থন প্রার্থনা করে পত্র প্রেরণ করতে থাকো বিভিন্ন রাজ্যের কাছে, চন্দ্রগুপ্ত। আমাদের এই মুহূর্তে তা প্রয়োজন। প্রয়োজনে তোমার প্রতিনিধি হয়ে আমি যাব ভিন্ন রাজ্যে, যদি তারা আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে উৎসাহ দেখায়। আর বিদর্ভ থেকে কোনো উত্তর আসেনি?
—এখনও নয়। তবে, আশা করি, চিত্তসেনের থেকে উত্তর আসবে। সে শুধুই বিদর্ভর রাজা নয়, আমার বাল্যবন্ধুও বটে। পূর্বেও সে নানান প্রয়োজনে আমাদের সাহায্য করেছে। সে নিশ্চিতভাবেই আমাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেবে। কিন্তু, বাকি রাজাদের ক্ষেত্রে তা বলা যায় না।
চাণক্য মেঝের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে বললেন,
—হুমম।
চন্দ্রগুপ্ত কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—ভেবেছিলাম আমাদের পরিকল্পনা কাজে আসবে। আপনার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ প্রচার করতে পারলে মগধ তাদের এই বজ্রমুষ্টি কিছুটা শিথিল করবে। আপনার মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করতে আমাদের স্বয়ং প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টর কাছেও মিথ্যা সংবাদ প্রেরণ করতে হয়েছে। জীবসিদ্ধিও বিভিন্ন সূত্র মাধ্যমে সেই খবর প্রচার করেছিল। কিন্তু, আমাদের এত প্রচেষ্টার ওপর অমাত্য রাক্ষস এত সহজে জল ঢেলে দেবেন, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল।
চাণক্য মৃদু হেসে বললেন,
—হুমম। আমায় শনাক্ত করতে আমার দাঁতের পাটি নিরীক্ষণ করার বুদ্ধিটি অভিনব বই কী। অমাত্য রাক্ষসের থেকে অবশ্য এটাই প্রত্যাশিত। তাই তো আমি বরাবরই বলে আসছি যে, মগধের পথে তোমার একমাত্র কাঁটার নাম— অমাত্য রাক্ষস।
চন্দ্রগুপ্ত তার গুরুর দিকে তাকিয়ে বলল,
—আচার্য, আপনি বরাবরই অমাত্য রাক্ষসের প্রশংসা করেন কেন? মাঝে মাঝে মনে হয় তার পদক্ষেপে আপনি যেন খুশিই হন। সে কি আমাদের পরম শত্রু নয়?
চাণক্য তাঁর সামনে রাখা কদলীপত্র থেকে একটুকরো গুড় তুলে মুখে দিলেন।
বললেন,
—শত্রুকে সর্বদা উচ্চ আসন দিতে শেখো হে, চন্দ্রগুপ্ত। সে শত্রু হলেও অমাত্য রাক্ষসকে আমি সম্মান করি, কারণ আমাদের সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা সে রাখে। তার মতো ধীর, স্থির, কর্তব্যে অবিচল একজন ব্যক্তি আজকের এই ঘোর কলিযুগে খুঁজে পাওয়া বিরল। আফশোসের কথা এটাই যে, সে এখন আমাদের শত্রুপক্ষ। তাকে শত্রুর চেয়ে মিত্ররূপে পেলে আমাদের কণ্টকাকীর্ণ পথ অনেকটা সুগম হয়ে যেত। দুঃখের বিষয়, এই মুহূর্তে সে-ই আমাদের পথের সবথেকে বড়ো কণ্টক রূপে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে চাণক্য আবার বললেন,
—আমার হিসেব যদি ঠিক হয়, তবে এতদিনে মগধের অর্থনীতির অবস্থা টলায়মান। রাজকোষে টান পড়েছে এই প্রায় এক বর্ষব্যাপী দেশজোড়া সন্ধানকার্য চালানোর ফলে। তাই আমরা বিপর্যস্ত ঠিকই, কিন্তু মগধও এখন দুর্বল। আমার মনে হয় এটাই সঠিক সময়, আঘাত করার।
কিছুটা হতাশ ভঙ্গিতে চন্দ্রগুপ্ত বলল,
—কিন্তু, তার জন্যে প্রয়োজন সেনাবল, যা কোনো রাজ্য আমাদের এই মুহূর্তে দিতে প্রস্তুত নয়। তারা সবাই ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে মগধের, বা বলা ভালো, অমাত্য রাক্ষসের ভয়ে। তাহলে এখন উপায় কী? মগধের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কে দেবে আমাদের সমর্থন?
চাণক্য কিছুক্ষণ উত্তর না দিয়ে তৃপ্তি সহকারে গুড়ের পুরো টুকরোটা সময় নিয়ে উদরস্থ করলেন। তারপর বললেন,
—আমার একটা পরিকল্পনা আছে। একজন শক্তিশালী রাজা আছেন, যিনি আমাদের সমর্থন করতে পারেন। যিনি মগধের বিরুদ্ধে যেতে ভয় পান না।
—কার কথা বলছেন আপনি?
—পঞ্চনদের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা। পৌরবরাজ পর্বতেশ্বর পুরু!
—পৌরবরাজ? কিন্তু, তিনি আমাদের সমর্থন কেন করবেন? তা ছাড়া তিনি এখন প্রায় বৃদ্ধ।
—হুমম। করবেন, যদি আমরা তাঁকে, তাঁর সমর্থনের বদলে, মগধের যুগ্ম সম্রাট করার প্রলোভন দেখাই। পৌরবের সঙ্গে গান্ধারের শত্রুতা আজকের নয়, তা বহু যুগের। যেহেতু গান্ধাররাজ অম্বিকের সঙ্গে তোমার শত্রুতা সর্বজনবিদিত, অতএব আমার ধারণা পুরু আমাদের “শত্রুর শত্রু বন্ধু” রূপেই দেখবেন।
চন্দ্রগুপ্ত কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে চাণক্যর দিকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
—আর তারপর? তাঁর সমর্থনে যুদ্ধজয়ের পর আমরা কি তাঁর হস্তে অর্ধেক দেশ সমর্পণ করব?
চাণক্য মৃদু হেসে বললেন,
—ভবিষ্যৎ কে দেখেছে হে, মৌর্য? তুমি তো নিজেই বললে, তিনি বৃদ্ধ। তাঁর আয়ুষ্কাল ফুরিয়েই এসেছে। এই শেষ বয়সে এসে যুদ্ধের ধকল নেওয়াটা খুব একটা সহজ কথা নয়। মানসিক ও শারীরিকভাবে তা বড়ো খারাপ প্রভাব ফেলে কিনা।
কথা শেষ করে আরও একটুকরো গুড় তুলে মুখে দিলেন চাণক্য। তৃপ্তির একটা শব্দ করলেন তিনি।
বিস্ময়ের দৃষ্টিতে নিজের আচার্যর দিকে চেয়ে রইল চন্দ্রগুপ্ত। তিনি চন্দ্রগুপ্তকে যা করতে বলছেন, একভাবে দেখতে গেলে তা ছলনা ছাড়া কিছুই নয়। রাজ্যের লোভ দেখিয়ে পুরুর মতো এক প্রবীণ, সম্মানিত রাজাকে প্রতারিত করতে বলছেন এমন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে।
অমাত্য রাক্ষস আর আচার্য চাণক্য ঠিক কতটা ভিন্ন? প্রশ্ন জাগে চন্দ্রগুপ্তর মনে।
১১.
গভীর রাত্রি। অমাত্য রাক্ষস তাঁর কক্ষে শয্যায় শায়িত। কিন্তু, তাঁর চোখে নিদ্রা নেই। কক্ষের একমাত্র প্রদীপটি অনেক আগেই তেলের অভাবে নিভে গিয়েছে। তাই কক্ষটি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। দূরে রাজপ্রাসাদের অন্য মহল থেকে ভেসে আসছে মৃদু সংগীত ও সুরের মূর্ছনা। অর্থাৎ, মহারাজ ধনানন্দ এখনও তাঁর রাত্রিকালীন আসরে ইতি টানেননি।
অন্যদিকে, অমাত্য রাক্ষস চেয়ে আছেন ছাদের অন্ধকারের দিকে। তিনি চিন্তিত। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। আসন্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তিনি কিছুতেই যেন শাস্তি পাচ্ছেন না। কোথাও যেন কিছু ঠিক নেই। আর কেউ টের না পেলেও তিনি টের পাচ্ছেন যে, পরিস্থিতি ক্রমশই যেন তাঁর হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।
চাণক্যকে ও চন্দ্রগুপ্তকে কোণঠাসা করা গিয়েছে বটে, কিন্তু তাঁদের ধরা যায়নি। তাঁদের গুপ্তচর চক্র আবারও সক্রিয় হয়েছে। ভয় দেখিয়ে এই মুহূর্তে তিনি ছোটো ছোটো জনপদের রাজাদের মগধের বিরুদ্ধে, চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে জোট বাঁধা থেকে আটকাতে পেরেছেন ঠিকই। কিন্তু রাক্ষস জানেন, তা সাময়িক মাত্র।
এই ছোটো ছোটো জনপদের রাজারা হল বনের শৃগালের মতো। এরা শক্তিশালী সিংহর পশ্চাদ্ধাবন করে। কিন্তু, অপেক্ষায় থাকে সিংহ ও বৃষর যুদ্ধের। যে পক্ষ পরাজিত হয়, সে সিংহ হোক বা বৃষ, তার পতিত শরীরে দংশন করে মাংস ছিঁড়ে খেতে তিলমাত্র বিলম্ব করে না। যদি চন্দ্রগুপ্ত পরাজিত হয়, তবে তার রাজ্য দখল নিতে শুরু করবে। আর, যদি শেষমেষ মগধ পরাজিত হয়, তবে এরা মগধের অঙ্গরাজ্য দখলে নেমে পড়বে। মাৎস্যন্যায়! এই দেশের উন্নতি ততদিন সম্ভব নয় যতদিন এই ছোটো ছোটো জনপদ নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করতে থাকবে।
সেই কারণেই কি তিনি এত কিছু সহ্য করেও মগধকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলছেন না? কারণ, অমাত্য রাক্ষস জানেন যে, যতদিন শক্তিশালী মগধের রক্তচক্ষু আছে, ততদিনই অন্য রাজারা ভয়ে যুদ্ধ শুরু করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু, মগধের পতন হলেই গোটা দেশে ছড়িয়ে যাবে বিশৃঙ্খলা! তাই মগধে থাকতেই হবে! এই দেশের স্বার্থেই থাকতে হবে।
নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে অমাত্য রাক্ষসের।
চাণক্য কি এই সারসত্যটি বুঝতে অক্ষম? অবশ্যই নয়। তিনি সবই বুঝতে পারছেন। তাঁর চেয়ে বেশি ভালোভাবেই বুঝছেন। কিন্তু, তবুও তিনি মগধের পতন ঘটাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন। নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তিনি যে গোটা দেশকে অস্থির করে দিচ্ছেন। তাই তো তাঁকে প্রতিহত করতেই হবে!
কিন্তু, কীভাবে? এত সন্ধান করেও তাঁকে ধরা যায়নি। যতবারই তাঁর মৃত্যু বা ধরা পড়ার সংবাদ এসেছে, তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে পরবর্তীতে। চাণক্যর মৃত্যুর সংবাদ ইচ্ছে করে প্রচার করছে শত্রুশিবির। মগধের সেনাদেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে এবার। যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে এই কাজে, তা রাজকোষে প্বভাব ফেলছে। তা ছাড়া, মগধ জুড়ে চলতে থাকা এই অব্যাখ্যাত অর্থনৈতিক পতন। অমাত্য রাক্ষস নিশ্চিত এর পেছনেও নিহিত আছেন স্বয়ং চাণক্য। কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে তিনি মগধের অর্থনীতিকে ভেঙে ফেলছেন ধীরে ধীরে।
অতএব এই দেশজোড়া সন্ধানকার্য আর বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। আর বড়োজোর একমাস! তার মধ্যেই কিছু একটা করতে হবে অমাত্য রাক্ষসকে।
একটা উপায় আছে। সেটা যদি…
চিন্তায় ছেদ পড়ল অমাত্য রাক্ষসের। কেউ তাঁর দ্বারে মৃদু টোকা দিচ্ছে বলে মনে হল। তিনি কি ভুল শুনলেন? এই সময়ে কে আসবে? কিন্তু, তার পরেই আবারও টোকা দিল কেউ। বাইরে থেকে রক্ষীর ভীত কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
—আর্য! আর্য।
বাতায়ন দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলে রাক্ষস বুঝলেন যে, ভোর হতে আর বেশি বিলম্ব নেই। খেয়াল করলেন যে, মহারাজের রাত্রির আসর কখন যেন শেষ হয়েছে। আর কোনো সংগীতের সুর তিনি শুনতে পাচ্ছেন না। আবারও গোটা রাত্রি তিনি নিদ্রাহীন ব্যয় করেছেন।
নিজের জায়গায় উঠে না বসেই তিনি উত্তর দিলেন,
—কী হয়েছে?
বাইরে থেকে প্রহরী উত্তর দিল,
—একজন আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছে, মহামাত্য।
—এই সময়ে? কে?
—লোকটির নাম আপনাকে বলতে বলেছে নিপুণক। আমি তাকে বাধা দিয়েছি, আর্য। কিন্তু, সে বলছে আপনার সঙ্গে তার জরুরি দরকার। সে জরুরি সংবাদ নিয়ে এসেছে।
নিপুণক নামটা শুনে উঠে বসলেন অমাত্য। নিপুণক তাঁর একজন গূঢ়পুরুষ।
এই কাজে সে সত্যিই দক্ষ। প্রদীপে তেল ঢেলে, দুটি চকমকি ঠুকে তাতে অগ্নি সংযোগ করতে করতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
—কী বিষয়ে সংবাদ এনেছে সে?
প্রহরী উত্তর দিল,
—বলল চাণক্যর বিষয়ে।
অঙ্গবস্ত্র টেনে নিয়ে তা গায়ের ওপর ফেলতে ফেলতে রাক্ষস বললেন,
—তাকে অপেক্ষা করতে বলো। আমি এখুনি আসছি।
বাইরের একটা কক্ষে রাক্ষসের অপেক্ষায় বসে ছিল নিপুণক। রাক্ষস প্রবেশ করতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল। রাক্ষস সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
—কী সংবাদ এনেছ, নিপুণক?
—মহামাত্য, সংবাদ গুরুতর। বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে খবর এসেছে, চন্দ্রগুপ্ত পৌরবরাজ পুরুর কাছে সাহায্যের আবেদন করে, দূত মাধ্যমে পত্র পাঠিয়েছে পার্বত্য প্রদেশে।
আরও চিন্তিত হলেন অমাত্য রাক্ষস। কণ্ঠে তার প্রতিফলন না করেই বললেন,
—পুরু? তাঁর সঙ্গে জোট বাঁধতে চায় চন্দ্রগুপ্ত? কিন্তু, পুরু কেন তাকে সাহায্য করবেন? তাঁর তো এখন অবসর নেওয়ার আয়ু।
ঘাড় নেড়ে নিপুণক বলল,
—তা আমার জানা নেই। পত্রে কী লেখা আছে তা জানা যায়নি।
—পত্রবাহক দূতটিকে পার্বত্য প্রদেশ অবধি পৌঁছোতে দেওয়া যাবে না। তার আগেই তাকে বন্দি করতে হবে।
আবারও ঘাড় নেড়ে নিপুণক জানাল,
—তা সম্ভব নয়, অমাত্য। কারণ, এই দূত সাধারণ কেউ নয়, সে চাণক্যর গুপ্তচরদের প্রধান। শোনা কথা অনুযায়ী সে-ই এতদিন পাটলিপুত্বতে থেকে গুপ্তচরবৃত্তি করত। তার আসল মুখ কেউ কোনোদিন দেখেনি। তার পরিচয় কারুর জানা নেই। শোনা যায়, সে ছদ্মবেশ গ্রহণ করতে এতটাই পটু যে, নিজের আসল চেহারা তার নিজের কাছেই বিস্মৃত হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই পথ চলাকালীন সে একাধিকবার নিজের রূপ পরিবর্তন করবে। অতএব যাকে কেউ চেনেই না, যার চেহারার বর্ণনা দেওয়াই সম্ভব নয়, তাকে ধরবে কীভাবে?
রাক্ষসের মনে পড়ে গেল কয়েক বছর পূর্বের সেই নোংরা ভিক্ষুকটির কথা। তাকে সেই একবারই হাতের মধ্যে পেয়েও হারিয়েছিলেন তিনি। চাণক্যর হাতের অন্যতম সেরা অস্ত্র তার এই গূঢ়পুরুষ। চন্দ্রগুপ্ত, এই অচেনা গূঢ়পুরুষ প্রধান, এ ছাড়াও কে জানে আরও কতগুলো অস্ত্র আছে চাণক্যর হাতে!
অতীতের সেই ঘটনার স্মৃতিতে ডুবে গিয়েছিলেন অমাত্য রাক্ষস। নিপুণকের কথায় তিনি বর্তমানে ফিরে এলেন।
—আমার জন্যে এবার কী আদেশ, মহামাত্য?
কিছুক্ষণ ভাবলেন অমাত্য রাক্ষস। নাহ্, আর বিলম্ব করা যাবে না। পুরুকে কীসের লোভ দেখাচ্ছে চাণক্য, তা জানা নেই। কিন্তু, পুরু শক্তিশালী রাজা। অলকশেন্দ্র আর্যাবর্ত থেকে ফিরে যাওয়ার পূর্বে অনেকগুলো বিজিত রাজ্যের ক্ষমতা পুরুর হাতে সমর্পণ করে দিয়ে গিয়েছে। অতএব, পুরুর ক্ষমতা কম নয়। তার সেনাবলও নেহাতই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। পুরু বৃদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু তাঁর সেনার নিয়ন্ত্রণ চন্দ্রগুপ্তর হাতে এলে তার ফল হবে মারাত্মক। অতএব, এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
অমাত্য রাক্ষস একটি ভূর্জপত্র, কালী ও কলম টেনে নিয়ে নিপুণককে বললেন,
—অপেক্ষা করো। আমার এই পত্র নিয়ে যেখানে আমি বলছি সেখানে সত্বর যাত্রা করতে হবে তোমায়। মনে রেখো, আমি এখন যা লিখব এই পত্রে, যা বলব, তা অত্যন্ত গোপনীয়।
আর সময় ব্যয় না করে প্রদীপের আলোয় পত্র লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অমাত্য রাক্ষস।
১২.
বিদর্ভরাজের থেকে পত্রের উত্তর পেয়ে উৎফুল্ল হল চন্দ্রগুপ্ত। অনেকদিন ধরে আশা নিয়ে বসে ছিল সে। তার ভরসা ছিল যে, আর যাই হোক, চিত্তসেন তাকে ফেরাবে না। কারণ, বিদর্ভরাজ চিত্তসেন একসময়ে তার সহপাঠী ও মিত্র ছিল তক্ষশিলায়। তাদের মধ্যে সেইসময় থেকেই সুসম্পর্ক ছিল। চিত্তসেনের পিতা, তৎকালীন রাজা ভীমসেন তাঁর একমাত্র পুত্রকে পাঠিয়েছিলেন সুদূর গান্ধারে তক্ষশিলার সেরা শিক্ষকদের থেকে শিক্ষালাভ করতে।
চিত্তসেন রাজকুমার হলেও অন্যান্য রাজকুমারদের মতো দাম্ভিক ছিল না। বরং, রাজপাঠের শিক্ষার চেয়ে তার মন কাব্যচর্চায় বেশি উৎসাহী ছিল। তাই বোধ হয় খুব সহজে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সে। চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গেও সেইসময়েই তার বন্ধুত্ব।
পিতা বৃদ্ধ বয়সে সিংহাসন ত্যাগ দেওয়ায় বর্তমানে চিত্তসেন বিদর্ভ রাজ্যের রাজা। সে শান্তিপ্রিয় রাজা। ছোটোবেলার ভালোবাসা সে আজও ভুলে যায়নি। তার দরবারে কবিদের নিত্য আনাগোনা।
চন্দ্রগুপ্ত প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে নিজেই যাবে বিদর্ভে। কিন্তু, আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতি তাকে নিতে হচ্ছে। সেনাদের একত্রিত করতে হবে এইবার। মগধের সৈনিকরা হাল ছেড়ে দিয়েছে। অমাত্য রাক্ষসের আদেশ এখনও বহাল থাকলেও, সৈনিকরা ক্লান্ত। তাই চন্দ্রগুপ্তর কাছে এটাই সুযোগ পুনরায় শক্তি একত্রিত করার। অতএব, সে আচার্য চাণক্যকে পত্র লিখে অনুরোধ করল যেন তার প্রতিনিধি হয়ে আচার্য বিদর্ভ যাত্রা করেন। তাঁর সুরক্ষার জন্য সঙ্গে আর এক শিষ্য শশাঙ্ক যাবে।
চাণক্য সেসময়ে বিদর্ভ রাজ্য থেকে প্রায় দশদিন দূরত্বে অবস্থান করছিলেন। এইটুকু পথ চাণক্য একাই যাত্রা করার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু, শশাঙ্ক তাঁর আপত্তি কানে তুলল না। পূর্বনির্ধারিত তিথিতে সে চাণক্যর সঙ্গে যাত্রা করল।
নবম দিনের যাত্রাশেষে তারা গোদাবরী নদীর তীরে বিশ্রাম নিতে দাঁড়াল। পরের দিনই তারা রাজধানীতে প্রবেশ করবে।
শশাঙ্ক তার গুরুর সম্মুখে কিছু ফল একটা কদলীপত্রে এনে রাখল। নিজেও কিছু ফল নিয়ে মুখোমুখি বসল। কোমর থেকে একটি ছুরি বের করে ফল কাটতে কাটতে চাণক্যকে প্রশ্ন করল,
—আচ্ছা আচার্য, মগধ জয় করার পর কী হবে? আমরা সবাই আনন্দে উৎসব করব বাকি জীবন?
চাণক্য মৃদু হাসলেন তাঁর শিষ্যর এই বালখিল্য কথায়। চাণক্য লক্ষ করেছেন তাঁর শিষ্যদের মধ্যে শশাঙ্ক সবচেয়ে সরল। এত কিছুর পরেও বালকসুলভ সারল্য তার মধ্যে থেকে এখনও সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়নি। মুখে কোনোদিন স্বীকার না করলেও চাণক্য তাঁর ছয় শিষ্যকেই বড়ো স্নেহের চোখে দেখেন। তিনি শশাঙ্কর কথায় উত্তর দিলেন,
—তাহলে যে আমরাও কয়েক বর্ষের মধ্যেই নন্দ হয়ে যাব হে, শশাঙ্ক। যেমন রাজা ধনানন্দ উৎসব আর আমোদেই ডুবে বসে রয়েছেন আজীবন।
—তাহলে আমরা কী করব, আচার্য?
—সিংহাসন জয় করার থেকেও কঠিন কাজ কী জানো? সিংহাসন ধরে রাখা।
—কিন্তু আচার্য, এত বড়ো দেশ আমাদের এই আর্যাবর্ত। কীভাবে তা একসঙ্গে জুড়ে রাখব? এ কি সম্ভব?
—একজন রাজার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। চন্দ্রগুপ্তর একার পক্ষে ও সম্ভব নয়। আর, তাই তো তোমরা আছ। তুমি, জীবসিদ্ধি, পুরুষদত্ত, অক্ষয়, আদিত্য। তোমরাই হবে গোটা আর্যাবর্তর বিভিন্ন অংশের শাসক। চন্দ্রগুপ্ত থাকবে জনসমক্ষে, পালন করবে রাজধর্মের গুরুদায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবে, লোকচক্ষুর আড়াল থেকে দেশের শাসনভার সামলাবে তোমরা। আর্যাবর্তর সম্রাট একজন হবে, কিন্তু তার শাসক থাকবে ছয়জন।
শশাঙ্ক কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
—জীবসিদ্ধি তো বলে তার রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ নেই। সত্যি বলতে আমারও নেই।
চাণক্য একটুকরো ফল তুলে নিয়ে বললেন,
—জীবসিদ্ধির ভূমিকা সাম্রাজ্যের জন্যে হবে অপরিহার্য। তাকেই গড়ে তুলতে হবে একান্নবর্তী আর্যাবর্তর গুপ্তচর চক্র। তাকেই হতে হবে চন্দ্রগুপ্তর চক্ষু-কর্ণ।
তোমরা হবে তার বাহু। যাক সেকথা, শশাঙ্ক। মগধ লাভ করতে এখনও আমাদের কিছুটা ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু, তুমি কী বলছিলে নিজের কথা? তোমার দাবি কী এই জীবন থেকে বৎস?
শশাঙ্ক নির্দ্বিধায় বলল,
—আমি তো সাধারণ জীবন চাই। স্ত্রী, কন্যা নিয়ে সুখী গৃহস্থজীবন। সবাই পুত্র কামনা করে, আমি কিন্তু কন্যাসন্তান কামনা করি। আমার কন্যা হবে। তাকে বড়ো হতে দেখব। সময়মতো তাকে বিবাহ দিয়ে স্বামীর হাতে সমর্পণ করব। ব্যস, এইটুকু।
এই কথাগুলো অন্য কেউ হলে গুরুর সামনে এমন অকপটে স্বীকার করত না। কিন্তু, শশাঙ্কর মনে এত ভাবনা নেই। নিজের মনেই হাসলেন চাণক্য।
তাঁর এখন ভাবতে অবাক লাগে তাঁর শিষ্যর মতোই তিনিও একসময় সাধারণ সুখের গৃহস্থ জীবনের কামনা করেছিলেন। তা অতি অল্প সময়ের জন্যে হলেও করেছিলেন। এক নারী তাঁর হৃদয়ে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিল। মনে হয় যেন সে কোনো এক অন্য জন্মের কথা। আর সেই নারী… সুভাষিণী … সে জীবনের মায়া কাটিয়েছে তাঁরই শোকে। হায় সুভাষিণী! যে না পাওয়ার বেদনা তুমি বুকে নিয়ে মৃত্যুকে বেছে নিলে, সেই একই বেদনা বুকে নিয়ে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। এই আমার অভিশাপ। এই আমার প্রায়শ্চিত্ত!
কীভাবে দাঁড়াবেন তিনি গিয়ে আচার্য ভদ্রভট্টর সামনে? তাঁর চোখে চোখ রাখতে পারবেন তিনি কোনোদিন? একমাত্র তিনিই বোধ হয় উপলব্ধি করতে পারেন তাঁর শিষ্য বিষ্ণুগুপ্তর মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা সেই বেদনা। তাই তো কোনোদিন তিনি ভুলেও কখনো কোনো পত্রে উল্লেখ করেন না সুভাষিণীর। তাঁরা দু-জনই সজ্ঞানে এড়িয়ে যান ওই নামটা। কিন্তু, নাম না নিলেই কি সব কিছু বিস্মৃত হওয়া যায়? একদিন, একমুহূর্তের জন্যেও কি চাণক্য ভুলতে পেরেছেন তাঁর বিষ্ণুপ্রিয়াকে?
চাণক্য টের পেলেন তাঁর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁকে উঠে দাঁড়াতে দেখে শশাঙ্ক বলে উঠল,
—আরে, আরে, উঠছেন কেন, আচার্য? কিছুই তো আহার করলেন না! চাণক্য উত্তর দিলেন, খিদে নেই, শশাঙ্ক। তুমি আহার করে নাও। আমি ক্লান্ত। বড্ড ক্লান্ত।
১৩.
বিদর্ভের দুর্গে নিজেদের ছদ্মনামে পরিচয় দিতেই সিংহদ্বার খুলে গেল চাণক্য ও শশাঙ্কর জন্যে। কোন ছদ্মনাম তাঁরা গ্রহণ করেছেন তা পূর্বেই জানিয়ে রাখা ছিল চিত্তসেনকে। সেই অনুযায়ী প্রধানদ্বারের রক্ষীদের নির্দেশ দেওয়াই ছিল যে, দু-জন ব্যক্তি দ্বারে এসে এই দুটি নাম বললেই যেন তাঁদের প্রবেশানুমতি দেওয়া হয়।
দুর্গটি খুব প্রাচীন নয়। চিত্তসেনের পিতা এই দুর্গ গড়েছিলেন তাঁর রাজত্বকালের গোড়ার দিকে। দুর্গটি সুবিশাল না হলেও, সুরক্ষিত বটে।
এই দুর্গে চাণক্য পূর্বেও এসেছেন। প্রথম এসেছিলেন বহু বছর আগে, তক্ষশিলার শিক্ষক হিসেবে এক তর্কসভার আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি হয়ে। পরবর্তীকালে চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে আরও দু-বার এসেছেন।
অমাত্য মিহিরায়ণ তাঁদের অভ্যর্থনা করে দু-জনকে তাঁদের কক্ষে পৌঁছে দিলেন। বললেন,
—মহারাজ চিত্তসেন একটি জরুরি সভায় গিয়েছেন বলে তিনি নিজে আপনাদের অভ্যর্থনা করতে আসতে পারলেন না। আপনাদের সঙ্গে আজ সন্ধ্যার পরেই তিনি সাক্ষাৎ করবেন। আপনারা ততক্ষণ বিশ্রাম নিন।
চাণক্য নিজের আসনে উপবিষ্ট হয়ে প্রশ্ন করলেন,
—মহারাজ কোথায় গিয়েছেন?
—প্রতিবেশী রাজ্য নলপুরে।
সে কী! একটু পূর্বেই সৈনিক যে বলল মহারাজ দুর্গেই আছেন?
মুহূর্তের জন্যে মন্ত্রীর মুখে ফুটে ওঠা কালো মেঘ চোখ এড়াল না চাণক্যর।
মিহিরায়ণ দ্রুত সামলে নিয়ে বললেন,
—প্রহরীরা কি আর রাজার গতিবিধির খবর রাখে, আচার্য? ভুল বলেছে সে। আপনারা বিশ্রাম করুন।
—বেশ, বেশ। ধন্যবাদ, আর্য।
মিহিরায়ণ বিদায় নিলেন তাঁদের প্রণাম জানিয়ে। শশাঙ্ক ততক্ষণে সোনার থালায় সাজানো সুস্বাদু খাবারে মনোনিবেশ করেছে। মিহিরায়ণকে দ্বার অবধি এগিয়ে দিতে গিয়ে চাণক্য দ্রুত বাইরের বারান্দায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। দ্বার বন্ধ করে কক্ষের বাতায়ন দিয়ে বাইরে দেখলেন। তাঁদের দু-জনকে পাশাপাশি দুটো কক্ষ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এখন আছেন চতুর্থ তলে। বাতায়ন দিয়ে নীচে তাকাতে প্রাঙ্গণে আরও কয়েক জন সশস্ত্র প্রহরী চোখে পড়ল।
শশাঙ্ক জিজ্ঞেস করল,
—আচার্য, আপনি একটু পূর্বে অমাত্যকে হঠাৎ বললেন কেন যে, কোনো এক প্রহরী বলেছে চিত্তসেন এখানেই আছে? আমাদের সঙ্গে তো কোনো প্রহরীর আলাপ হয়নি।
চাণক্য বাতায়ন থেকে সরে এসে নিজের আসনে আবার উপবিষ্ট হলেন। শশাঙ্কর কথার উত্তর দিলেন না। শশাঙ্ক ভাবল যে, আচার্য নিশ্চয়ই ক্লান্ত। তাই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
—আপনি বিশ্রাম নিন। আমি আমার কক্ষে যাই তবে এখন।
চাণক্য হাত তুলে তাকে দাঁড়াতে ইঙ্গিত করলেন। বললেন,
—উপবিষ্ট হও, শশাঙ্ক। আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আর, প্রস্তুত হও।
—প্রস্তুত? কীসের জন্যে?
চাণক্যর ললাটে গভীর ভ্রূকুটি দেখা দিয়েছে। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন,
—আমি অন্য রাজাদের সমর্থন পেতে এতটাই মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি অসতর্ক হয়ে গিয়েছি। আমার এই ভুল আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনতে চলেছে!
শশাঙ্ক বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—সর্বনাশ? কেন আচার্য? কী হয়েছে?
—আমরা ফাঁদে পা দিয়েছি, শশাঙ্ক। আমার অনেক পূর্বেই সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল।
—কী বলছেন আপনি, আচার্য?
চাণক্য শাস্তস্বরে বললেন,
—এই দুর্গে আমি পূর্বেও এসেছি। প্রতিবারই আমাদের রাখা হয়েছে প্রধান অতিথিশালায়। যেটা অন্য মহলের দ্বিতলে অবস্থিত। আজকে আমাদের সেখানে না নিয়ে গিয়ে, এখানে আনতেই আমার মনে প্রথম প্রশ্ন জাগে। প্রধান অতিথিশালায় কেন আমাদের রাখা হল না? তবে কি প্রধান অতিথিশালা ইতিমধ্যে অধিকৃত? তাই যদি হয়, তবে কে সেই ব্যক্তি যাকে প্রধান অতিথিশালায় রেখে আমাদের অন্যত্র রাখা হল? অর্থাৎ, সে আমাদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কেউ।
—কে? কে রয়েছে প্রধান অতিথিশালায়?
উত্তর না দিয়ে চাণক্য বলে চলেন,
—দ্বিতীয়ত, চিত্তসেনের অনুপস্থিতি। সেটাও অর্থপূর্ণ। আমাদের আগমনের সংবাদ পূর্বেই তাকে জানানো হয়েছে। তবে কী এমন প্রয়োজনে তাকে আজকে অনুপস্থিত থাকতে হল? সন্দেহ হতে আমি ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথাটা বললাম মন্ত্রী মিহিরায়ণকে। জানতাম তিনি যদি মিথ্যে বলে থাকেন, তবে একমুহূর্তের জন্যে হলেও তা তিনি মুখের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করে ফেলবেন। আর, তিনি ঠিক তাই করলেন। যার ফলে আমি নিশ্চিত যে, চিত্তসেন এখানেই আছে।
—কিন্তু, তিনি আমাদের অযথা মিথ্যা বলবেন কেন?
—কারণ, চিত্তসেন আমাদের মুখোমুখি হতে চায় না। আমাদের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানোর সৎ সাহস তার নেই। সে চন্দ্রগুপ্তর মিত্রতার সুযোগ নিয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে একটি পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে।
—আপনি… আপনি বলতে চাইছেন চিত্তসেন আমাদের সঙ্গে…
—হ্যাঁ, শশাঙ্ক। সে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই দুর্গে আমরা অতিথি নই শশাঙ্ক, আমরা এখানে বন্দি। বাইরে বারান্দায় অন্তত চারজন সশস্ত্র প্রহরী রয়েছে। তাদের দৃষ্টি, শরীরী ভাষা পড়তে জানলে তুমিও বুঝবে যে, তারা অতিথিদের সুরক্ষা দিতে নেই। তারা রয়েছে বন্দিদের ওপর নজর রাখতে। নীচে প্রাঙ্গণে আরও কিছু সৈনিক সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে আমাদের দুটি কক্ষের ওপর। আমাদের এই চতুর্থ তলে রাখার কারণ যাতে আমরা বাতায়ন দিয়ে পলায়ন করতে না পারি।
শশাঙ্ক হাতে ধরা আপেলটি রাগে চেপে দুমড়ে দিল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—আমি ওই ভীরু, নীচ, বিশ্বাসঘাতক চিত্তসেনকে হত্যা করব! নিজের হাতে ওর গলা টিপে মারব!
চাণক্য হাত তুলে শিষ্যকে বললেন,
—শান্ত হও, শশাঙ্ক। বিপৎকালে ক্রোধ মানুষকে বুদ্ধিভ্রষ্ট করে। এখনও সুযোগ আছে। আমি যা যা করব, তোমায় শুধু আমায় সমর্থন করে যেতে হবে।
—কী পরিকল্পনা আপনার, আচার্য?
—চতুরঙ্গর এই খেলায় একটা প্রায় অসম্ভব দান খেলতে চলেছি আমি, শশাঙ্ক। আমাদের জেতার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
নিজের মনেই কথাটা বললেন চাণক্য। শশাঙ্ক জিজ্ঞেস করল,
—অতিথিশালায় কে আছে, আচার্য? মগধের কেউ?
—হুমম। এবং, সেই ব্যক্তি পদমর্যাদায় অতি শক্তিশালী কেউ। হয় ধনানন্দ অথবা…
—অথবা?
—না, ধনানন্দ হবে না। এই মুহূর্তে রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে রাজা বেরোবে না। আর বেরোলেও সে-সংবাদ চাপা থাকত না। কারণ, আমোদপ্রিয় ধনানন্দ কয়েকশো দাস-দাসী, নর্তকী ইত্যাদি ছাড়া কোথাও যেতে অভ্যস্ত নয়।
—তবে? তবে কে?
—সেই ব্যক্তি যে আমাদের জন্যে এই ষড়যন্ত্রর জাল বিছিয়েছে। তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার সময় এসেছে।
উঠে দাঁড়ালেন চাণক্য। কক্ষের একটি মেজের ওপর রাখা একখণ্ড ভূর্জপত্র ও কলম তুলে দ্রুত কিছু লিখলেন। চাণক্য দ্বার খুলে বেরিয়ে একজন প্রহরীকে কাগজটি দিয়ে তার কানে কানে কিছু একটা বললেন। তাঁর কথা শুনে প্রহরী কিছুক্ষণ বজ্রাহতর মতো দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কোনো কথা না বলে ভূর্জপত্রটি নিয়ে চলে গেল।
চাণক্য নিজের জায়গায় ফিরে এসে শান্ত ভঙ্গিতে পদ্মাসনে বসলেন। কোনো কথা না বলে চোখ বুজে ধ্যানস্থ হলেন।
বেশিক্ষণ তাঁদের অপেক্ষা করতে হল না। কিছুক্ষণ বাদেই দ্বার খুলে গেল। যদিও শশাঙ্ক ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছিল যে, তৃতীয় অতিথিটি কে, তবুও কক্ষের খোলা দ্বারে দাঁড়ানো সেই ব্যক্তিকে দেখে ঢোঁক গিলল।
ধীর পদক্ষেপে কক্ষে পা রাখলেন প্রধানামাত্য রাক্ষস।
১৪.
চাণক্য চোখ খুলে সামনে অমাত্য রাক্ষসকে দেখে মৃদু হাসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত জোড় করে বললেন,
—প্রণাম, অমাত্য কাত্যায়ন।
রাক্ষসের মুখে হাসি দেখা গেল না। কিন্তু, তিনিও একই ভঙ্গিতে প্রতি-নমস্কার জানালেন।
—প্রণাম, আচার্য চাণক্য।
কৌটিল্য আর রাক্ষস উভয়েই কিছুক্ষণ কোনো কথা বললেন না। একে অপরকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। তারপর চাণক্য বললেন,
—অনেককাল পর আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল, আর্য। পরিচয় করিয়ে দিই, এ আমার শিষ্য শশাঙ্ক।
শশাঙ্কর অপ্রতিভ ভঙ্গি তখনও কাটেনি। সে কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে নমস্কার জানাল। শশাঙ্কর কোমরে তরবারি আছে, আর রাক্ষস নিরস্ত্র। কিন্তু, রাক্ষসকে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হল না। তার দিকে একবার দেখে নিয়ে মৃদু ঘাড় নেড়ে পুনরায় চাণক্যর দিকে চাইলেন। যেন তার অস্তিত্বর কোনো গুরুত্বই নেই রাক্ষসের কাছে।
বললেন,
—প্রথমে আমাকে বলুন আচার্য, আপনি কী করে জানলেন যে, আমি এখানে উপস্থিত? সরাসরি আমায় উদ্দেশ করে লেখা আপনার পত্র পেয়ে আমি বিস্মিত হয়েছি বই কী! আমি নিশ্চিত করেছিলাম যেন আমাদের উপস্থিতি গোপন থাকে। তবে? কীভাবে অনুমান করলেন আপনি এটা?
—অনুমান? অনুমান নয়, অমাত্য। আপনারই মতো, একটি সক্রিয় গুপ্তচরচক্র যে আমারও আছে তা নিশ্চয়ই আপনার অজ্ঞাত নয়। তারা অনেক পূর্বেই আমায় আপনার বিষয়ে সাবধান করেছিল। আপনি আর বিদর্ভরাজ মিলে যে এই পরিকল্পনা করছেন তা আমার অজ্ঞাত ছিল না।
চাণক্য বড়ো সহজে মিথ্যা সাজিয়ে বলতে পারেন তা শশাঙ্ক পূর্বেই প্বত্যক্ষ করেছে। আচার্য চাইছেন রাক্ষসকে বিভ্রান্ত করতে। তাঁর মনে সংশয় সৃষ্টি করতে। রাক্ষস জানেন যে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ তাঁর নিয়ন্ত্রণে। চাণক্য তাঁর সেই নিশ্চয়তার জায়গায় মানসিকভাবে আঘাত করতে চাইছেন। অমাত্য রাক্ষসের মনে এই ধারণা ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন যে, আসলে পরিস্থিতি তাঁর নয়, বরং চাণক্যর নিয়ন্ত্রণে।
রাক্ষস ঘাড় নেড়ে বললেন,
—ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমি আপনার কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না, আচার্য। এখানে আমার উপস্থিতির কথা স্বয়ং মহারাজ নন্দও জানেন না। আপনার পক্ষে তা পূর্বেই জানা প্রায় অসম্ভব। তবে, যদি তর্কের হেতু ধরেও নিই যে, আপনি পূর্বেই আমার পরিকল্পনার আভাস পেয়েছিলেন, সেক্ষেত্রে বলব আপনি এখানে উপস্থিত হয়ে খুব বড়ো ভুল করেছেন, আচার্য। এই মুহূর্তে আমি আপনাকে বন্দি করলাম।
বন্দি তো আমরা এই নগরের দ্বার দিয়ে প্রবেশ করার মুহূর্ত থেকেই হয়েছি, অমাত্য। এত তাড়া কীসের? আমি এখানে এসেছি আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে। আমাদের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হওয়াটা খুবই দরকার ছিল। তাই আসুন, আমরা দু-জন মুখোমুখি উপবিষ্ট হই এবং দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় লিপ্ত হই। ব্রাহ্মণ হিসেবে এটাই কি আমাদের কর্তব্য নয়?
রাক্ষসের উত্তরের অপেক্ষা না করেই চাণক্য পুনরায় নিজের আসনে ফিরলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে অমাত্য রাক্ষসও তাঁর মুখোমুখি আসন গ্রহণ করলেন।
শশাঙ্ক ভেবে পেল না কী করতে চলেছেন আচার্য চাণক্য। চাণক্যর কথায় রাক্ষস বিশ্বাস করেননি, তা স্পষ্ট। তবে, কী আলোচনা তিনি করবেন রাক্ষসের সঙ্গে?
রাক্ষস আসন গ্রহণ করতে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,
—মগধের পরিস্থিতি কেমন বুঝছেন, অমাত্য?
—মগধ বরাবরই শক্তিশালী ছিল, আছে এবং থাকবে, আচার্য। তার সীমান্তর কিছু ছোটো ছোটো জনপদ দখল করে তার বিন্দুমাত্র শক্তিক্ষয় হয়নি তা আপনিও জানেন। আর এইবার, মগধের সবথেকে বড়ো শত্রু যখন ধরা পড়েই গিয়েছে, তখন সেই হারানো সীমান্ত অঞ্চলগুলোও উদ্ধার করে নেওয়া যাবে।
—এইবার আপনার কথা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না, অমাত্য। সত্যিটা হল মগধের অবস্থা শোচনীয়। আপনার সৈনিকরা ক্লান্ত, বিরক্ত। আপনাদের রাজ্যবাসী, প্রতিটি সাধারণ নাগরিক রাজার ওপর ক্ষুব্ধ। স্থানে স্থানে বিদ্রোহ চলছে এবং দিনে দিনে তা আরও বাড়বে। তা ছাড়া, এই মুহূর্তে মগধের অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। আপনি বিদ্রোহ, সৈনিকের ক্ষোভ, মাৎস্যন্যায় হয়তো বলপূর্বক দমন করলেও করতে পারেন। কিন্তু, অর্থনৈতিক এই সংকটের উত্তর আপনার কাছেও নেই। আপনি চেষ্টা করেও তা প্রতিরোধ করতে পারবেন না।
অমাত্য রাক্ষস কিছুক্ষণ চোখ কুঁচকে চাণক্যর দিকে চেয়ে থেকে বললেন,
—তাহলে আমার ধারণাই ঠিক ছিল। এই অর্থনৈতিক সংকট আপনারই সৃষ্টি করা। অর্থশাস্ত্রের পণ্ডিত মহামতি চাণক্যর থেকে এরকম কিছুই প্রত্যাশিত ছিল।
—আপনি এই আঘাতের সম্বন্ধে অবগত হলেও, তা প্রতিরোধের উপায় আপনার জ্ঞাত নয়, অমাত্য। তাই আমার মনে হয় আমার পরামর্শ আপনার শোনা উচিত।
—দেশের সবথেকে বড়ো শত্রুর সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন আমি বোধ করছি না, আচার্য। আমি জানি না এইসব বলে আপনি ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইছেন। এই মুহূর্তে এটাই সত্যি, যে, আপনি পরাজিত হয়েছেন। আপনি আমার হাতে বন্দি।
চাণক্য মৃদু হেসে বললেন,
—তাই কি? সত্যিই কি আমি পরাজিত? আমার তা মনে হয় না। সেকথা থাক। আপাতত আমি এই আলোচনা থেকে আপনাকে এটাই বোঝাতে চাইছি, যা ইতিমধ্যে আপনি নিজেও জানেন। আমি নিশ্চিত আপনি ইদানীংকালে নিজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছেন সত্যটা।
—কোন সত্যের কথা বলছেন, আচার্য?
—সত্য এটাই যে, মগধের পতন অবশ্যম্ভাবী! আজ নয়তো কাল, নন্দর পতন হবেই। তার জন্যে যতটা না চাণক্য দায়ী থাকবে, তার থেকে অনেক বেশি দায় নন্দর। বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে সে এই দেশের রক্তক্ষরণ করে চলেছে। আজ যা ঘটছে সেটা তারই ফল। আপনি বহুদিন ধরে একটি ডুবন্ত তরীকে ভাসিয়ে রাখার প্রচেষ্টা করে চলেছেন কাত্যায়ন। কিন্তু, আপনার সেই তরীর মাঝি নিজেই যে বহুকাল পূর্বে হাল ছেড়ে দিয়েছে। চেয়ে দেখুন অমাত্য, চারিদিকে ছিদ্র হয়েছে আপনার তরিতে। সেগুলো দিয়ে জল প্রবেশ করছে আপনার নৌকায়!
রাক্ষস অবিচলিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন,
—সেই ছিদ্রর মধ্যে একটা অন্তত আজকেই মেরামত হয়ে গিয়েছে। মগধের সবথেকে বড়ো শত্রুর সঙ্গে মগধের হিত আলোচনা করতে আমি বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক না, আচার্য।
—মগধের সবথেকে বড়ো শত্রু কে, অমাত্য কাত্যায়ন? আমি? চন্দ্রগুপ্ত? না অমাত্য, না। মগধের সবথেকে বড়ো শত্রু মহারাজ ধনানন্দ। আপনি বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি। আপনি সবই জানেন। নিজের তরি ডুবতে থাকলে বুদ্ধিমান ব্যক্তি অন্য তরিতে চড়ে।
—আপনি কী বলতে চাইছেন, আচার্য চাণক্য?
—আমি বলতে চাইছি যে, আপনি এইবার অধর্মের পক্ষ ত্যাগ করে ধর্মের পক্ষ নিন। আপনি আমাদের পক্ষে আসুন, অমাত্য। আপনাকে আমরা বন্ধু ও সহযোদ্ধা হিসেবে কামনা করি।
শশাঙ্কের ওপর এই মুহূর্তে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলেও বোধ হয় এতটা বিস্মিত হত না যতটা সে চাণক্যর এই প্রস্তাব শুনে হয়েছে। সে নিশ্চিত অমাত্য রাক্ষসও বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু, তাঁর মুখে কোনো বিকার দেখা গেল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অমাত্য রাক্ষস বললেন,
—আপনি আমায় হাসালেন, আচার্য। এই? এই আপনার পরিকল্পনা? এই আপনার নিজেকে রক্ষা করার অস্তিম প্রচেষ্টা? প্রচেষ্টাটা বড্ড দুর্বল হয়ে গেল না কি? আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আচার্য, আমি হতাশ হলাম। আমি আপনার মতো প্রতিপক্ষর থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করেছিলাম, আচার্য। এই আলোচনার যে কোনো প্রয়োজন বা পরিণতি নেই, তা আমি আগেই জানতাম।
চাণক্য মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
—কিন্তু তবুও, আপনি এখানে আমার সামনে এখনও বসে আছেন, কাত্যায়ন। কারণ, আপনি জানেন যে, আমার প্রতিটি কথা সত্য।
—আপনি আমায় রাজদ্রোহ করতে বলছেন, আচার্য। আপনি জানেন, এই কথাটা বলার জন্যে আমি এই মুহূর্তে বাইরে দাঁড়ানো সৈনিকদের আদেশ দিয়ে আপনাকে হত্যা করতে পারি? এই মুহূর্তে আপনাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকার কোনো কারণ আছে কি, আচার্য?
চাণক্য দৃঢ়কণ্ঠে বললেন,
—হুমম। একদম নয়। আমাকে হত্যা না করার কোনো কারণ নেই, অমাত্য। আপনার আদেশে সৈনিকরা আমায় হত্যা করবে ঠিকই, কিন্তু তার পূর্বেই এই যে শশাঙ্ক, সে আপনাকে হত্যা করবে।
অমাত্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন,
—তো? আপনি কি মনে করেন যে, আমি মৃত্যুকে ভয় পাই?
—আমি জানি, আপনি নিজের মৃত্যু নিয়ে চিন্তিত নন, অমাত্য। নিজের মৃত্যু নিয়ে আমারও কোনো ভীতি নেই। তাই তো জেনে-শুনেও আমি এখানে আপনার কাছে এসেছি এই আলোচনা করতে। কিন্তু, একটা বিষয়ে ভেবে দেখবেন অমাত্য কাত্যায়ন, আমার মৃত্যুর পরেও কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত থেকে যাবে। সে আমার সুযোগ্য শিষ্য। সে মগধের ওপর আক্রমণ চালিয়েই যাবে। আর এই মুহূর্তে আমি আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি যে, আমায় ছাড়াও সে পূর্বপরিকল্পিত পথ অনুসরণ করে, ঠিকই মগধ অধিকার করবে।
—আমার সে-বিষয়ে সন্দেহ আছে, আচার্য। আমার ধারণা আপনি নিজের শিষ্যের প্রতি একটু বেশিই আস্থা রাখছেন।
চাণক্য দু-হাত মেলে ধরে বললেন, হয়তো তাই। হয়তো আমার পরামর্শ ছাড়া আমার রাজা চন্দ্রগুপ্ত মগধের রাজসিংহাসন অধিকার করতে সক্ষম হবে না। আবার সে হতেও পারে। সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিন্তু, আপনার অনুপস্থিতিতে, আপনার রাজা ধনানন্দ যে কোনোভাবেই মগধের সিংহাসন রক্ষা করতে পারবে না, তা কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়!
রাক্ষস আবার বললেন,
—আপনাকে হত্যা করার প্রয়োজন আমার নেই। সৈনিকদের বললে তারা আপনাকে এখুনি বন্দি করবে।
—বন্দি করে কী করবেন, অমাত্য? কতজন সৈনিক আছে আপনার? পঞ্চাশ? একশো? নিশ্চয়ই তার বেশি নয়। কারণ, এর চেয়ে বেশি সংখ্যক সৈনিক নিয়ে আপনি গোপনে এখানে আসতে পারতেন না। সঙ্গে যদি বিদর্ভর সেনাও ধরি, তাও কত হবে, অমাত্য? জেনে রাখুন, এই গোটা রাজ্য ঘিরে রেখেছে চন্দ্রগুপ্তর ত্রিশ হাজার সেনা! আপনি আমায় বন্দি করতে পারবেন ঠিকই, কিন্তু বিদর্ভর সীমানা আপনি অতিক্রম করতে পারবেন না। আপনার কি আমাকে এতটাই নির্বোধ মনে হয় যে, আমি ব্যবস্থা না নিয়েই জেনে-শুনে শত্রুর ফাঁদে পা দেব?
আরও একটি মিথ্যা। মনে মনেই ভাবল শশাঙ্ক। এইবার কি বিশ্বাস করলেন রাক্ষস?
১৫.
শশাঙ্কর ললাটে স্বেদবিন্দু জমেছে। এই মুহূর্তে সে যেন দুই মহারথীর যুদ্ধের সাক্ষী হচ্ছে। এই যুদ্ধ অস্ত্রের নয়, এই যুদ্ধ আসলে স্নায়ুর। এই যুদ্ধে কোনো সেনা নেই, নেই কোনো সৈনিক। তবুও আজকের এই স্নায়ুযুদ্ধর ওপর নির্ভর করছে গোটা দেশের ভবিষ্যৎ।
কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বললেন না। দু-জন একে অন্যের চোখে চোখ রেখে স্থির রয়েছেন। দুটি প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধে মেতেছে আজকে এই কক্ষে। দু-জনই অপেক্ষা করছে কখন প্রতিপক্ষর অদৃশ্য বর্মে একটি সামান্য হলেও ছিদ্র খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু, কেউই এখানে নতিস্বীকার করতে রাজি নন। শশাঙ্ক লক্ষ করল তাঁরা পলক ফেলতেও ভুলে গিয়েছেন।
অমাত্য রাক্ষস এবার একটু ঝুঁকে বসলেন। তাঁর দুই হাত কাছাকাছি এসে, আঙুলের ডগা একে অন্যকে স্পর্শ করে হাঁকিনী মুদ্রা সৃষ্টি করেছে। চাণক্যর চোখ থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই তিনি বললেন,
—আমি কখনোই মহারাজ ধনানন্দর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না, আচাব্য চাণক্য।
—কেন অমাত্য কাত্যায়ন? কেন এই আনুগত্য আপনার তার প্রতি?
—আমার আনুগত্য এই দেশের প্রতি, আচার্য। আমার আনুগত্য মগধের প্রতি।
—আমারও আনুগত্য এই দেশেরই প্রতি, অমাত্য। তাই তো আমি তাকে এই দৈনন্দিন শোষণের থেকে মুক্তি দিতে চাই।
—কিন্তু, কীসের মূল্যে, আচার্য? আপনি কি জানেন না যে, শুধুমাত্র মগধের কারণেই এখনও আর্যাবর্তর ছোটো ছোটো জনপদরা নিজেদের মধ্যে মাৎস্যন্যায়তে লিপ্ত হয়নি? আপনি যে নিজের উদ্দেশ্য সফল করতে গোটা আর্যাবর্তকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছেন, আচার্য!
—ভুল, অমাত্য। আমি চিরকালের জন্যে আর্যাবর্তর এই অন্তর্বর্তী যুদ্ধ পরিস্থিতির ইতি করতে চাইছি। শুধুমাত্র ভীতি প্রদর্শনের দ্বারা মাৎস্যন্যায় আটকে রাখা যায় না। এর একটি স্থায়ী সমাধান দরকার।
—কী সেই সমাধান?
—অখণ্ড আর্যাবর্ত! আমি ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষ নির্মাণ করতে চাই! একমাত্র যদি এক দক্ষ, সুশাসকের ছত্রছায়ায় গোটা দেশ নিয়ন্ত্রিত হয়, তবেই তা আগামীতে শক্তিশালী হবে। এই ভারতভূমির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে। অন্যথায় বারংবার অলকশেন্দ্রর মতো বিদেশি শক্তি এই দেশমাতৃকায় অনুপ্রবেশ করবে, তাকে লুণ্ঠন করবে!
—আর, আপনি মনে করেন সেই সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত?
—আমি বিশ্বাস করি, আমি জানি সেই সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত!
রাক্ষস কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। চুপ থাকলেন। চাণক্য আবার বললেন, —আগামীকে আটকানো যায় না, অমাত্য। পরিবর্তনে ভয় পাবেন না। আপনি কতদিন আগলে রাখবেন সাম্রাজ্যকে? ধনানন্দ একদিন-না-একদিন ঠিকই আপনার সুপরামর্শ উপেক্ষা করে, এমন কিছু হঠকারী ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন, যার ফলে তাঁর নিজের ও তাঁর রাজ্যের সর্বনাশ হবে। এ শুধুই সময়ের অপেক্ষা। আপনি জানেন যে, নিকট ভবিষ্যতে নন্দরাজ্যের পতন হবেই। কিন্তু, মগধের পতন হবে না! নন্দর শেষের সঙ্গেই মগধের প্রকৃত উত্থান শুরু হবে। তা ছাড়া…
—তা ছাড়া?
—তা ছাড়া, মগধের অর্থনীতিকে এই মুহূর্তে একমাত্র আমি বাঁচাতে পারি। আমরা দু-জনই আচার্য ভদ্রভট্টর শিষ্য ছিলাম এককালে। তিনি সর্বদা বলতেন, সময়ের দাবি মেনে নিতেই হয়, নাহলে, কালচক্র তাকে বিলুপ্ত করে দেয়। সময়ের দাবি কান পেতে শ্রবণ করুন, কাত্যায়ন। আমি জানি, আপনি তার পূর্বাভাস পেয়েছেন। আগামীর পদধ্বনি আপনার কানেও গুঞ্জরিত হয়েছে। অন্যথায় আপনি কখনোই আমার সঙ্গে আজকের এই আলোচনায় সময় ব্যয় করতেন না। আপনি অনেক পূর্বেই আমায় বন্দি করতেন বা হত্যা করার নির্দেশ দিতেন। কিন্তু, আপনি তা করেননি, অমাত্য কাত্যায়ন। কেন তা করেননি, অমাত্য কাত্যায়ন?
অমাত্য রাক্ষস উঠে দাঁড়ালেন। কক্ষের একমাত্র বাতায়নের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর দৃষ্টি চলে গিয়েছে বহুদূরে। শশাঙ্কর মনে হল সে যেন আর একটু হলেই রাক্ষসের মস্তিষ্ক চালনার যান্ত্রিক শব্দ হয়তো শুনতে পাবে।
চাণক্যর দিকে না ফিরেই রাক্ষস বললেন,
—আমি যদি আজকে আপনাদের যেতে দিই, তবে তা মহারাজ ধনানন্দর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হবে।
—আজকে যদি আপনি আমাকে যেতে না দেন, তবে সেটা এই আর্যাবর্তর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হবে। আপনি কার প্রতি অনুগত, কাত্যায়ন? ধনানন্দ, নাকি, দেশমাতৃকা?
উত্তর না দিয়ে রাক্ষস প্রশ্ন করলেন, —আপনাকে আজ যেতে দিলে তা আপনাকে জীবনদান হবে।
—হুমম।
—তার বদলে আমি কী পাব, মহামতি?
—আপনি কী চান আমার থেকে, আর্যশ্রেষ্ঠ?
—প্রতিশ্রুতি! আমি আপনার থেকে প্রতিশ্রুতি চাই।
—বলুন, অমাত্য। কী প্রতিশ্রুতি চান আপনি?
অমাত্য ঘাড় ফিরিয়ে চাণক্যকে বললেন,
—কথা দিন আচার্য, আগামীতে যদি এমন কোনো পরিস্থিতি আসে যে, ধনানন্দ ও রাজপরিবারের প্রাণসংশয় দেখা দিল, তখন আপনি তাঁদের রক্ষা করবেন। ঠিক যেভাবে আজ আমি আপনাদের মুক্তি দিচ্ছি, ঠিক সেভাবেই আপনিও তাঁদের মুক্তি দেবেন।
চাণক্য কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এই প্রথমবার চাণক্যকে অপ্রতিভ মনে হল শশাঙ্কর। আরও কিছুক্ষণ কৌটিল্য ও রাক্ষস একে অন্যের চোখে চোখ রেখে একে অপরের অন্তর পাঠ করার চেষ্টা করলেন। তাঁরা তাতে সফল হলেন কি না জানা নেই। কিন্তু, চাণক্য একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—বেশ। তাই হবে।
রাক্ষস পুনরায় ঘাড় ফিরিয়ে বাতায়ন দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। চাণক্য উঠে দাঁড়িয়ে শশাঙ্ককে ইশারা করলেন তৈরি হয়ে নিতে। অর্থাৎ, তাঁদের এখুনি এই রাজ্য ত্যাগ করতে হবে। শশাঙ্ক এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যা ঘটেছে। রাক্ষস কি সত্যিই তাদের ছেড়ে দিলেন? নাকি, এই কক্ষের দ্বার দিয়ে বেরোতে গেলেই তরবারি নিয়ে একদল সশস্ত্র সৈনিক ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের ওপর। তাদের মস্তক ছিন্ন করবে অথবা বন্দি করে নিয়ে যাবে মগধে?
চাণক্য নিজের কাপড়ের ঝোলা তুলে নিতে নিতে বললেন,
—কিন্তু, চিত্তসেনের কী হবে? আজকে যে আমাদের সাক্ষাৎ হবে, সেকথা সে ও তার মন্ত্রী জানে। আশা করি, আপনি বুঝতে পারছেন অমাত্য যে, তাদের জীবিত রাখাটা…।
চাণক্যকে কথা শেষ করতে না দিয়েই অমাত্য রাক্ষস বললেন,
—তাঁদের ব্যবস্থা আমি করব। যে একপক্ষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, সে অপরপক্ষের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
মৃদু হেসে চাণক্য ও শশাঙ্ক দ্বারের দিকে এগোলেন। দ্বারের কাছে এসে চাণক্য ফিরে দাঁড়ালেন। প্রশ্ন করলেন,
—অমাত্য কাত্যায়ন, আপনি চাইলে আমার কৌতূহল নিবারণ নাও করতে পারেন। কিন্তু, তবুও মনে একটা প্রশ্ন জাগছে। আপনি আমার থেকে আজকে এই প্রতিশ্রুতি নিলেন কাকে রক্ষা করতে? শুধুই ধনানন্দর জন্যে কি?
রাক্ষস জানলার দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই উত্তর দিলেন,
—ধনানন্দর কন্যা দুর্ধরা। সে আমার কন্যাসমা। আমি বিশ্বাস করি পিতৃপুরুষের লোভ, পাপ সব কিছুর ছায়া থেকে দূরে, নিজের মতো করে বেড়ে ওঠার অধিকার এই পৃথিবীর প্রতিটি শিশুর আছে।
নিঃশব্দে কক্ষ ত্যাগ করলেন আচার্য চাণক্য ও শশাঙ্ক।
* * *
বিদর্ভের দুর্গর সীমানা পার করে প্রথমবার স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল শশাঙ্ক। পাশাপাশি দুটি অশ্বে আরোহণ করে চলছিলেন তাঁরা। শশাঙ্ক এতক্ষণে প্রথমবার প্রশ্ন করল,
—আচার্য, ত্রিশ হাজার দূরে থাক, বাস্তবে ত্রিশজন সৈনিকও আমাদের সঙ্গে নেই। বিদর্ভ রাজ্য ঘিরে রাখার কথাটা যদি রাক্ষস বিশ্বাস না করত, তখন আমরা কী করতাম?
চাণক্য শিষ্যর দিকে কটাক্ষপাত করে বললেন,
—মনে ভুল ধারণা পালন কোরো না হে, শশাঙ্ক। অমাত্য রাক্ষস একমুহূর্তের জন্যেও আমার কথা বিশ্বাস করেননি। তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমি তাঁকে মিথ্যে বলছি।
চাণক্যর কথায় শশাঙ্ক কিছুক্ষণ মুখ হাঁ করে রইল। তার বিস্ময় কাটতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। সে প্রশ্ন করল,
—কিন্তু… কিন্তু, তাহলে রাক্ষস আমাদের হাতে পেয়েও ছেড়ে দিলেন কেন?
—কারণ, অমাত্য কাত্যায়ন একজন বুদ্ধিমান, দক্ষ রাজনীতিবিদ। তিনি জানেন রাজনীতির প্রথম শর্ত হল যে, রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা মিত্র বলে কিছু হয় না। তিনি আমাদের নিঃশর্ত মুক্তি দেননি। আমাদের মুক্তির বিনিময়ে তিনি একজন আদর্শ অমাত্যর মতোই নিজের রাজা ও রাজপরিবারের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করেছেন। এইরকম একজন অমাত্যর সহযোগিতায় ধনানন্দ গোটা দেশকে শাসন করতে পারত। কিন্তু হায়, সেই মূর্খ যে তার নিজের রত্নভাণ্ডারের সবচেয়ে অমূল্য রত্নটিকেই চিনতে পারল না। শাসনের চেয়ে শোষণের পথ তার বেশি কাম্য। এমন একজন অমাত্য যদি আগামীতে চন্দ্রগুপ্তর অধীনে এই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়, তবে আমি নিশ্চিত হতে পারি যে, আর্যাবর্তর ভবিষ্যৎ আগামী কয়েক যুগের জন্যে সুরক্ষিত থাকবে।
শশাঙ্ক কিছু বলতে পারল না। তার মস্তিষ্ক রাজনীতির এত গভীর আলোচনা নিতে অভ্যস্ত নয়। চাণক্য আবারও বললেন, —আজকের এই ঘটনার কথা যেন কোনো তৃতীয়
ব্যক্তি জানতে না পারে, শশাঙ্ক। কেউ নয়। এমনকী চন্দ্রগুপ্তও নয়। আর, আজকের এই দিনটা সর্বদা মনে রেখো, শশাঙ্ক। আজকে একটি বিশেষ দিন।
—কী দিন, আচার্য?
—আজকের এই দিনে চণক পুত্র “কৌটিল্য” চাণক্য, অমাত্য কাত্যায়ন “রাক্ষস”-এর কাছে পরাজিত হয়েছে।
***
অমাত্য রাক্ষসের চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় বিশাখদত্ত কৃত প্রাচীন ঐতিহাসিক নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’-এ। যা আনুমানিক চতুর্থ থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যেকার সময়কালে রচিত। তিনি ছিলেন চাণক্যের মগধজয়ের পথে সবচেয়ে বড়ো কাঁটা। যদিও পরবর্তীতে তিনি চন্দ্রগুপ্তের প্রধানামাত্য হয়েছিলেন, চাণক্যের অনুরোধে।
[সে কাহিনি বিস্তৃত লেখা আছে ‘শর-শাস্ত্র’-তে।]
অনেক ইতিহাস উৎসাহী ও চাণক্য সিরিজের পাঠকের মনে প্রশ্ন উঠেছে যে কেন চাণক্য তার এই একদা দুর্ধর্ষ শত্রুটিকে পরবর্তীতে এতটা বিশ্বাস করেছিলেন। আশা করি এই ইতিহাস আশ্রয়ী কল্পকাহিনির মাধ্যমে সে প্রশ্নের উত্তর পাঠকরা পাবেন।
***
ওরাকেল — গ্রীক ভবিষ্যৎবক্তা