পরিশিষ্ট
১৯ জুন, ২০১৮, চন্দননগর, রাত্রি ১১.৪৫
১।
অপলক দৃষ্টিতে লাশটার দিকে চেয়ে থাকে বাসু। মনে হয় এইমাত্র খুনটা যে করল সে অন্য কেউ। ঠিক এইভাবে তো আজকে অন্য একজনের খুন হবার কথা ছিল। সেই যার বিরাট বড়ো বাড়ি, সেই যাকে শুরু থেকে মাস্টার বলে ডেকে এসেছে সে। দেবাশিস তাকে নিজের শর্তে চালাতে চেয়েছিল। ভেবেছিল আজ থেকে তাকেই মাস্টার বলে মানবে বাসু। এমন আবার হয় নাকি? বাসু মানতে চায়নি। দেবাশিস সজোরে একটা থাপ্পড় মেরেছিল তার গালে। বলেছিল, “পোষা কুত্তা, কুত্তার মতো থাকবি। ট্যাঁ ফুঁ করবি তো সোজা নরকে পাঠিয়ে দেব। আর বেরোতে পারবি না।”
দেবাশিসকে কথায় পেয়েছিল। বলে চলেছিল, কতদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে আজকের দিনটার জন্য। তার শেষ বাধা, সেই মাস্টার আজ দূর হবে। বাসু তাকে সাহায্য করবে। তবে বাসুর কিছু হবে না। তুর্বসুকে পুলিশ ধরবে খুনের পায়ে। আর সেই খুনের সহকারী নিশীথ দত্ত। সবকিছু দেবাশিস ঠিক করে রেখেছে। বাসুকে শুধু তার ইচ্ছেমতো চলতে হবে। এই প্রথম বাসু আদেশ মানতে অস্বীকার করল। আরও একটা চড়। আরও একটা। বাসু দুহাত দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করল। দেবাশিস মেরেই চলে। শেষবার বাসু হাত বাড়িয়ে দেবাশিসের কবজি চেপে ধরল ইস্পাতকঠিন হাতে।
বাসু প্রথমে ভদ্রভাবে ভূতের বাক্সটা চেয়েছিল। পায়নি।
“অসম্ভব!!” বলেছিল দেবাশিস।
এই ঘরটা বাসুর খুব চেনা। বাসু জানে কোথায় ক্লোরোফর্ম থাকে, কোথায় ইথার। এই দেবাশিস নামের লোকটার গায়ে বিশেষ জোর নেই। নেতিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই। অবিরাম মাথার ভিতরে কে যেন বলে চলেছে, “লিং চি”…. “লিং চি”… “ডেথ বাই থাউজেন্ড কাটস।” লোকটা বেঁচে থাকতে কাউকে শাস্তি দেয়নি। দেবাশিসের প্রতিটা নোংরা পাপ, প্রতিটা নষ্টামির কথা সে জানে। সে জানে দেবাশিস এখন মরিয়া। খ্যাপা কুকুরের মতো সে যাকে পাবে কামড়াবে। একটাই অস্ত্র তার। ভূত। এই ভূত যতক্ষণ তার বশে আছে, সে সবাইকে বশে রাখবে। বাসুকেও। বাসু আর তার বশে থাকবে না।
বাধ্য হয়ে বাসুকে অন্য পথ নিতে হল। দেবাশিস নিজেও হয়তো ভাবতে পারেনি এমনটা হবে। সে বাসুকে চিনতে পারেনি। বাসু কি নিজেকে চেনে? মুখের স্কি মাস্কটা খুলে নিজেকে বারবার আয়নায় দেখবার চেষ্টা করল বাসু। চেনা চেনা লাগছে কি? লাগছে। যেন গতজন্মে কোথায় দেখেছিল। সময় নেই আর বিশেষ।সে বুঝতে পারছে আবার তলিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারে। সে জানে এরপর সে ঘুমিয়ে পড়বে। কবে কখন আবার জেগে উঠবে কেউ জানে না।
এখন একটা পদক্ষেপে ভুল মানেই সব গণ্ডগোল। প্রথমেই সে কাঁপা হাতে হাতের ছেঁড়া কাগজটার একটা ছবি তুলে নিল দেবাশিসের ফোনে। হোয়াটসঅ্যাপ করুন তুর্বসু রায়ের নম্বরে। তুর্বসু এখনও এসবের কিচ্ছু জানে না। তুর্বসুর জানা উচিত। বারবার সে ভেবেছে তুর্বসুকে জানাবে। পারেনি। এবার হয়তো পারবে। দেবাশিসের ফোনের ফ্লিপ কভার খুলে গুঁজে রাখল সেই কাগজ। টয়লেটের একপাশে রেখে দিল মোবাইলটা। আয়না ঠেলে ঢুকল পিছনের ঘরে। এই ঘর তার সাজাঘর। এই ঘরে ঢুকলে সে বদলে যায়। তার মাথা, হাত, পা, চিন্তা, চেতনা কিছুই ইচ্ছেমতো কাজ করে না। যেন অন্য একজন লোক দখল নিয়েছে শরীরের। মাথার। বাসু এসব পছন্দ করে না। বাসু এতদিনে নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছে। সে বুনসেন বার্নার জ্বালায়। একে একে ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলতে থাকে প্রিয়নাথের পাণ্ডুলিপি, তার নিজের হাতে লেখা ডায়রি। প্রথম প্রথম লোকটা তাকে এই ডায়রি দিয়েছিল। সে যা বলবে লিখে লিখে মনে রাখার জন্য। ঘুম পাচ্ছে। কোনওমতে সব পুড়িয়ে আয়নাটা বন্ধ করে দিল। ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল তার। ঘুম…. যা সব চিন্তা, সব দুঃখ, সব কষ্ট নিমেষে ভুলিয়ে দেয়… ঘুমাবার আগে অস্ফুটে সে শুধু বলল, “মাস্টার” ….
.
২।
একটু বাদেই সামান্য খুঁড়িয়ে সেই বাড়িতে ঢুকলেন ফতুয়া পায়জামা পরা, ঝোলা ব্যাগ কাঁধে এক ভদ্রলোক। তাঁর কাছে খবর ছিল, দেবাশিস বাসুকে ব্যবহার করে চরম কোনও অনিষ্ট ঘটাতে চায়। বিশেষ করে আজকে দুপুরে যে ঘটনা ঘটেছে, তা শুনে তিনি শান্তিতে থাকতে পারছেন না। মাস্টারের মুখে সন্ধেবেলা ঘটনাটা শুনে এত রাতে তিনি নিজে আসতে বাধ্য হয়েছেন দেবাশিসকে বোঝাতে। এত কিছুর পরেও। বসার ঘরে ঢুকে চমকে গেলেন তিনি। সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। ভূত নিজের খেলা দেখিয়েছে। আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত ভাবে।
দেবাশিস চেয়ারে বসা।
মৃত।
অণ্ডকোশ ছিন্ন হয়ে লুটাচ্ছে। কোন এক সুতীব্র ঘৃণায় বাসু খুন করে বসেছে দেবাশিসকে। সারা ঘর আলুথালু। ঘরের এক কোণে সোফা জুড়ে কাঠের একটা অদ্ভুত বাক্স পরম মমতায় জড়িয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে একজন। বাসু। এ বাসু ছাড়া কেউ হতেই পারে না….
দেবাশিসের শয়তানি বুদ্ধিতে শিউরে উঠলেন নিশীথ দত্ত।
সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন মাস্টারকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন লোক এসে দাঁড়াল পিছনের খিড়কির দরজায়। বেহুঁশ বাসুকে নিয়ে মাঠ পেরিয়ে গাড়ি ছুটল কলকাতার দিকে। এই প্রথম তিনি মাস্টারকে মিথ্যে বললেন। জানালেন ভূতের বাক্সের কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। হাতে এখন অঢেল সময়। বেশ কয়েকবার বাক্সটায় হাত বোলালেন। এই সেই বাক্স! এর জন্যেই কতগুলো প্রাণ গেছে! পাশাপাশি খুলে দেখলেন চারটে তরল ভরা বোতল আর একটায় কিছু সাদা বড়ি।
রাত একটা বেজে গেছে। রাস্তায় জনমানব নেই। গাড়ি ছুটল গঙ্গার দিকে। ওপারের বাতিস্তম্ভের আলো নদীতে ধাক্কা খেয়ে যেন ভ্যান গঘের ছবি। ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন গঙ্গার পাড়ে। ঠান্ডা জোলো হাওয়ায় চুল উড়ে যাচ্ছে এলোমেলো। ঝোলাব্যাগ থেকে বাক্স বার করে এক- একটা বোতলের কর্ক খুলে ভিতরের তরল ঢেলে দিলেন গঙ্গায়। একশো বছরের পাপ এতদিনে দূর হল। একদম শেষে বাকি সেই অগ্নিনিরয়। হেল ফায়ার। বোতলে চকচক করছে কটা সাদা বড়ি। ভূতের বড়ি।
অজর।
অমর।
অক্ষয়।
ছুড়ে নষ্ট করে ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারলেন না। ঢুকিয়ে নিলেন ফতুয়ার পকেটে। এটা থাক। যদি ভবিষ্যতে কাজে লাগে। কাউকে বলবেন না এটার কথা। মাস্টারকেও না। বাকি রইল গণপতির বাক্স। ওটাকে জলে ফেলতেই সামান্য ভেসে টুপ করে ডুবে গেল সেটা। খানিক সেদিকে চেয়ে গাড়িতে ফিরে এলেন। এবার একটাই কাজ। প্লাস্টিকে মোড়া সেই অণ্ডকোশ। তিনি খুব ভালো জানেন এটা কোথায় ফেলে আসতে হবে। বাড়ি ফিরতে প্রায় ভোর। ভেজানো দরজা দিয়ে উকি মেরে নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন তিনি। বাসু ঘুমাচ্ছে। ভালো করে ঘুমাক ছেলেটা। ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
.
৩।
ওর ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। মাথাটা কেমন ঝিম মেরে আছে। উঠেই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল দেবাশিস গুহ আগের দিন অনেক রাতে একটা হোয়াটসঅ্যাপ করেছেন। প্যাড থেকে ছেঁড়া একটা কাগজের টুকরোর ছবি। কাঁপা কাঁপা হাতে তোলা। স্পষ্ট কিছু নয়। অনেক চেষ্টা করে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, কোনও ছড়া বা কবিতা জাতীয় কিছু। রুলটানা পাতায় বাংলা অক্ষরে লেখা।
সে এবার দেবাশিস গুহের নম্বরে ফোন করল। ফোন বাজতে থাকল
পিঁক…. পিঁক পিঁক… পিক পিক …
সমাপ্ত