1 of 3

অগস্ত্যযাত্রা

অগস্ত্যযাত্রা

বেদ ও পুরাণে উল্লিখিত স্বনামখ্যাত মুনি অগস্ত্য। ইনি বেদের একজন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। ঋকবেদে আছে যে, তিনি মিত্র (তেজোময় সূর্য) ও বরুণের (পশ্চিম দিকের দিপাল ও জলের দেবতা) পুত্র। ঋগ্বেদমতে (বৃহদ্দেবতা) সূর্যের উপাসনা-সূচক আদিত্যযজ্ঞে মিত্র ও বরুণ দেবতা স্বর্গের অপ্সরা উর্বশীকে দেখে বিমোহিত হয়ে পড়েন। তাদের কামস্পৃহা এত বেশি হয় যে, বাসতীবর নামক যজ্ঞকলসে তাদের বীর্যপাত ঘটে। সেই বীর্য থেকে মুহূর্তের মধ্যে অগস্ত্য ও বশিষ্ঠ নামে দুই মহাঋষির জন্ম হয়।

অগস্ত্যমুনির স্ত্রীর নাম লোপামুদ্রা (সমস্ত জীবের সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ অংশ লোপ করে নিজে ধারণ করেছেন বলে তার এই নাম) এবং পুত্রের নাম দৃঢ়স্যু। দৃঢ়স্যুর অন্য নাম ইধবাহ কারণ ছোটবেলা থেকে তিনি ইন্ধন বা যজ্ঞের জ্বালানি সংগ্রহ করতেন। নানান স্থানে ছিল অগস্ত্যের আশ্ৰম। কখনো গয়ার কাছে আবার কখনো দণ্ডকারণ্যে। কারো কারো মতে তিনি নাকি তিব্বতের লোক।

অগস্ত্যমুনি বাতাপি নামের এক ভয়ঙ্কর অসুরকে খেয়ে ফেলেন। ভাগবতমতে গল্পটি এরকম-

বাতাপি ও ইল্বল নামে হিংসাপরায়ণ দুই অসুর ছিল। এই দু’ ভাই একসাথে বাস করতো। বাতাপি ভেড়া-ছাগলের ছদ্মবেশে থাকতো। তাদের বাড়িতে কোনো অতিথি গেলে ছাগরূপী বাতাপিকে হত্যা করে অতিথিকে খাওয়াতো ইল্বল। খাওয়া শেষ হবার পর ইল্বল সঞ্জীবনী মন্ত্রে অতিথির উদরস্থ বাতাপিকে জীবিত করে তাকে বের হতে বলতো। অতিথির পেট বিদীর্ণ করে বাতাপি বেরিয়ে আসতো। ফলে অতিথির মৃত্যু ঘটতো। একদিন অগস্ত্য ঐ বাড়িতে অতিথি হন এবং যথারীতি রান্না করা ছাগরূপী বাতাপিকে ভক্ষণ করেন। ইল্বল বাতাপিকে আহ্বান করলেও অগস্ত্যের তপোবলে বাতাপি আর তার পেটের মধ্যে থেকে বের হতে পারেনি। এভাবেই বাতাপির মৃত্যু ঘটে (মহাভারত, বনপর্ব)।

দধীচি মুনির হাড় দিয়ে তৈরি বজ্রাস্ত্রের সাহায্যে দেবরাজ ইন্দ্র বধ করেছিলেন অনাবৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দানব বৃত্রাসুরকে। বৃত্রাসুর বধের পর তার অনুচর কালকেয় নামক অসুররা (কশ্যপমুনির ঔরসে কালকার গর্ভে জন্ম এই দুর্দান্ত দানবদের। এদের সংখ্যা ৬০,০০০) দেবতাদের ভয়ে আশ্রয় নেয় সাগরের তলদেশে। গভীর রাতে সমুদ্র থেকে উঠে এসে এরা দেবতাদের ওপর অত্যাচার চালাতো। অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা যান নারায়ণের কাছে। নারায়ণের পরামর্শে দেবতারা অগস্ত্যের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাদের অনুরোধে অগস্ত্যমুনি সমুদ্র পান করে ফেললেন। দানবরা আশ্ৰয়শূন্য হয়ে পড়লো। দেবলোকে অস্ত্রশিক্ষায় প্রশিক্ষিত অর্জুনকে আহ্বান করলেন ইন্দ্র। রৌদ্র নামক পাশুপাত অস্ত্র দিয়ে অর্জুন বধ করলেন সেই দানবদের (মহাভারত-বনপর্ব)।

বনবাসে থাকাকালে রাম দণ্ডকারণ্যে অগস্ত্যের আশ্রমে গিয়েছিলেন। সে সময় রাবণবধের জন্য অগস্ত্য রামকে দান করেছিলেন বৈষ্ণবধনু, ব্রহ্মদত্ত তীর, অক্ষয় তূণীর (তীর রাখার আধার) ও খড়গ

দেবরাজ ইন্দ্র (এটি দেবতাদের প্রধানের পদ। যেমন প্রেসিডেন্ট। সেজন্য ইন্দ্র একজন নন–বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জন) একবার ব্রহ্মহত্যার পাপে এবং মিথ্যাচারে বৃত্রাসুরকে বধ করার পর সমুদ্রের ভিতর বাস করছিলেন শ্রান্ত ও অচেতন অবস্থায়। সেই সময় ধার্মিক রাজা নহুষকে স্বর্গের ভারপ্রাপ্ত রাজা করা হয়। সিংহাসন লাভ করেই ভারপ্রাপ্ত ইন্দ্র নহুষ ইন্দ্ৰপত্নী শচীকে হস্তগত করতে চান। দেবগুরু বৃহস্পতির (ইনি আবার ইন্দ্রের মন্ত্রীও পরামর্শে শচী জানালেন, রাজা নহুষ যদি সপ্তর্ষিচালিত রথে আরোহণ করে তার কাছে আসেন, তবেই তিনি তাকে গ্রহণ করতে পারেন।

যথাসময়ে রাজা নহুষ সপ্ত-ঋষিচালিত রথে চললেন। রথের একজন বাহক ছিলেন অগস্ত্য। হঠাৎ নহুষের পা অগস্ত্যের শরীরে লাগে। এতে রেগে গিয়ে তিনি রাজাকে সাপে পরিণত করেন অভিশাপ দিয়ে। পরে ক্ষমা প্রার্থনা করায় অভিশাপটি কিছুটা পরিবর্তন করেছিলেন অগস্ত্য। তিনি বলেছিলেন যে, একমাত্র যুধিষ্ঠিরই তাকে শাপমুক্ত করতে পারেন (বনপর্ব)!

অগস্ত্য ছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের গুরু। বিন্ধ্য হলো মধ্যভারতে পূর্বপশ্চিমে বিস্তৃত একটি পর্বতশ্রেণী। গঙ্গার অববাহিকাভূমি বা সংক্ষেপে আর্যাবর্ত থেকে দাক্ষিণাত্যকে এই পর্বতমালা পৃথক করেছে। পুরাণমতে দেবতারা (আসলে অভিজাত সম্প্রদায়) বসবাস করতেন এই পর্বতের নানা স্থানে। দূর অতীতে তাপ্তি ও নর্মদার মধ্যবর্তী সাতপুরার সুরম্য ও সুদৃশ্য পার্বত্যভূমিই বিন্ধ্যপর্বত নামে পরিচিত ছিল।

দেবীভাগবত থেকে জানা যায় যে, বিন্ধ্যপর্বত সকল পর্বতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মাননীয়। এখানে দেব, দানব, গন্ধর্ব (স্বর্গীয় গায়ক, এরা ছিল স্বর্গের সম্মানিত উপদেবতা), কিন্নর (কুৎসিৎ মানুষ হলেও এরা স্বর্গের গায়ক। এদের অন্য নাম কিম্পুরুষ। গন্ধর্বদের মতো এরা সৌন্দর্যের অধিকারী নয়। মনে হয় গন্ধর্বরা অভিজতা শিল্পী এবং কিন্নররা সাধারণ লোক-সংস্কৃতির। ) এখানকার নদ-নদীতে আনন্দে জলবিহার করতো :

আমরা জানি যে দেবর্ষি নারদ ছিলেন দ্বন্দ্ব বাধাতে দক্ষ। একদিন তিনি বিন্ধ্যের কাছে এসে বললেন, ‘তুমি যতই শ্রেষ্ঠ বা মাননীয় হও না কেন, ওদিকে সুমেরুকে দেখে আমার মনঃপ্রাণ জুড়িয়ে গেছে। স্বয়ং সূর্যদেব সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রসহ এই সুমেরুকে প্রদক্ষিণ করেন। তাই সুমেরু বেশ গর্বিত।’

নারদের মুখে সুমেরু পর্বতের প্রশংসা শুনে বিন্ধ্য প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। সুমেরুর গর্ব খর্ব করার জন্য বিন্ধ্য তার চূড়াগুলি উঁচু করতে আরম্ভ করে। ফলে সূর্যের গতি রোধ হতে থাকে। বিন্ধ্যের পশ্চিম ও দক্ষিণে অন্ধকার এবং পূর্ব ও উত্তরে প্রখর সূর্যতাপ দেখা দেয়। হাহাকার পড়ে গেল সর্বত্র। দেবতারা ভয় ও ভাবনায় অস্থির।

সূর্যের পথ বন্ধ হওয়ায় দেবপুরীতে শুরু হলো নানা রকম গোলযোগ চিত্রগুপ্ত সময়-নির্ণয় করতে পারছেন না। হোম, যজ্ঞ, শ্রাদ্ধতর্পণ ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান বিলুপ্ত হতে থাকলো। পশ্চিম ও দক্ষিণদিকে সবসময় রাত্রি থাকায় দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত হলো। আবার পূর্ব ও উত্তরদিকের অধিবাসীরা প্রচণ্ড সূর্যতাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। দেবরাজ ইন্দ্র পর্যন্ত সমস্যা সমাধানে প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অন্য সব রাজকর্ম ফেলে। দেবতারা মহাদেবের দ্বারস্থ হলেন সাহায্যের জন্য। মহাদেবের পরামর্শে আবার তারা চললেন পালনকর্তা বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু তাদের পরামর্শ দিলেন অগস্ত্যের কাছে যেতে। মহাদেব ও বিষ্ণু বিন্ধ্যকে নত করতে ব্যর্থ বলে অবশেষে অগস্ত্যের শরণাপন্ন হলেন দেবতারা। সে সময় অগস্ত্য অবস্থান করছিলেন কাশীতে। দেবতারা তার কৃপাভিক্ষা করায় তিনি যাত্রা করলেন শিষ্য বিন্ধ্যের উদ্দেশে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি স্ত্রীসহ সেখানে উপস্থিত হলেন।

গুরুদেবকে দেখে বিন্ধ্য নত হয়ে প্রণাম করলেন। বিন্ধ্যকে নত দেখে খুশি হলেন অগস্ত্য। তিনি শিষ্যকে বললেন যে, তিনি দাক্ষিণাত্যে যাচ্ছেন। যতদিন তিনি ফিরে না আসেন ততদিন যেন বিন্ধ্য এরূপ নত হয়েই থাকে। কারণ উঁচু পাহাড় ডিঙ্গানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। অতঃপর অগস্ত্য দক্ষিণদিকে অগ্রসর হলেন এবং মলয়পর্বতে আশ্রম স্থাপন করে সেখানে রয়ে গেলেন।

গুরু-আজ্ঞা শিরোধার্য করে বিন্ধ্যপর্বত আর মাথা উঁচু করেনি। কারণ অগস্ত্যমুনিও আর ফিরে আসেননি। দেবীভাগবত, কাশীখণ্ড ও বামনপুরাণে এই কাহিনী রয়েছে। স্ত্রী লোপামুদ্রাসহ মহামুনি অগস্ত্য ভাদ্রমাসের ১ তারিখে দাক্ষিণাত্যে যাত্রা করেছিলেন বলে কথিত আছে। এই গল্প অনুযায়ী ভাদ্রমাসের ১ তারিখ অগস্ত্যযাত্রার দিন। সংস্কারবশত মানুষ সাধারণত ঐদিন বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও যাত্রা করতে চায় না। এজন্য বাংলায় অগস্ত্যযাত্রা প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে শাস্ত্র ও সংস্কারের কল্যাণে। প্রবাদটি অগস্ত্যদোষ নামেও পরিচিত।

অগস্ত্যের সমুদ্র পান করাকে কেন্দ্র করে অগস্ত্যের পিপাসা প্রবাদের জন্ম হয়েছে। দ্রাবিড়দেশের লোকেরা অগস্ত্যের কাছে নানা প্রকার বিদ্যা অধ্যয়ন করেছিল। লাঙ্গলের জোয়ালের আকৃতির মতো অগস্ত্যমুনি এখন আকাশের দক্ষিণদিকে নক্ষত্ররূপে অবস্থান করছেন। সৌর ভাদ্রমাসের ১৭ দিবসে ঐ নক্ষত্রের উদয় হয়। ভাদ্রমাসের তিনদিন বাকি থাকতে অগস্ত্য ও লোপামুদ্রাকে ব্রাহ্মণরা ফুলজল দিয়ে অর্ঘ্য দেয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *