১১. এম. এ পাশ করে বেকার

১১.

 এম. এ পাশ করে আমিও বেকার হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার বেকারি আর সজলের বেকারিতে অনেক তফাত। সজলের মুখ সবসময়ই বিষণ্ণ। গান করা ভুলে গিয়েছে। কিন্তু পড়াশোনা করছে খুব। জীবনে যা পড়েনি, তাই পড়ছে।

ইতিমধ্যে কয়েকটি বছর কেটে গিয়েছে। মামা মাসের অধিকাংশ সময় দিল্লিতে থাকেন। রমুদাও প্রায়ই দিল্লি যায়। সেখানে, দিল্লির শহরতলিতে নতুন কারখানা তৈরি হচ্ছে। দিল্লিতে আলাদা বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, নতুন গাড়ি কেনা হয়েছে। মামিমাও দিল্লিতে কয়েক বার ঘুরে এসেছেন। আমি এক বারও যাইনি। কলকাতার কারখানা যেমন ছিল, তেমনি পড়ে আছে।

হরিশদার কথাই সত্যি। আগের সম্মিলিত মন্ত্রিসভা ভেঙে গিয়েছিল। আবার হয়েছিল, আবারও ভেঙে গিয়েছে। আবার নির্বাচন আসন্ন। হরিশদা, সুবীর এঁরা সকলেই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছেন। সজলকে বাইরে থেকে কাজ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ওর সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ওকে অবিশ্যি খুব সাবধানে থাকতে হয়। যে কোনও মুহূর্তেই অ্যারেস্ট হতে পারে। জানাজানি হলে, খুনও হতে পারে। খুন এখন রাজনীতির এক মুখ্য অঙ্গ। বহু ছেলে জেলে পচছে। নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি, তার সঙ্গে পুলিশের খুন করা, এবং পুলিশও খুন হচ্ছে।

এক বছর আগে সজল আমাকে প্রথম সুবীরকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, চলো, একজন সব্যসাচীর সঙ্গে তোমাকে দেখা করিয়ে দিই। আগে নাম বলেনি, জায়গাও বলেনি৷ অবিশ্যি আমাকে নিয়ে যাবার অনুমতি ছিল বলেই নিয়ে গিয়েছিল। সত্যি, সব্যসাচীকেই দেখেছিলাম। অজ্ঞাতবাসী অর্জুন, কিন্তু দু চোখে তার আগুনের ঝিলিক। দৃঢ়বদ্ধ দুই ঠোঁটে কঠিন প্রতিজ্ঞা, প্রশস্ত কপাল যেন বিদ্যুতের চিকুর হানা। সমস্ত মূর্তিটাই যেন আগুনের মতো লকলক করছে। সেই আগুনের তাপ যেন আমার গায়ে লাগছে, মনে লাগছে। অথচ সুবীরের চোখের কোল বসা, গালে চিবুকে কয়েকদিনের দাড়ি।

আমি তাকিয়েছিলাম দেখে, খাপ থেকে খোলা ছুরির ঝিলিকের মতো হেসে বলেছিল, আমি কিন্তু ক্লাউন নই যমুনা।

আমি চমকে উঠে বলেছিলাম, আমি তা মোটেই ভাবিনি৷ কত দিন যে আপনাকে দেখবার ইচ্ছে ছিল।

সুবীর বলেছিল, আমাকে দেখে কী হবে! তুমি কিছু করে দেখাও। তুমি কী হতে চাও, তাত্ত্বিক না যোদ্ধা? আমাদের এখন যোদ্ধার দরকারই বেশি। মারের বদলা মার না, বহুকালের মার খেয়ে, এখন কেবল মার। প্রতিদিন নতুন নতুন শত্রু গজাচ্ছে, সবাইকেই মার। পারবে?

সুবীরের কথা শুনে মনে হয়েছিল, পারব। কিন্তু থমকে গিয়ে বলেছিলাম, ভেবে দেখিনি কখনও।

সুবীর বলেছিল, ভাববার সময় এসেছে। সূর্য এখন আমাদের রক্তেই লাল, আমাদের তেজেই প্রখর।

সজল বলেছিল, তেজের কথা বলব না, কিন্তু আরও অনেকের রক্তেই লাল নয় কি?

সুবীর প্রায় চাপা গর্জনের স্বরে বলে উঠেছিল, না। পাপের রক্তে আর পুণ্যের রক্তে তফাত আছে। আমাদের রক্ত পুণ্যের। সজল অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সুবীরের কথাগুলো আমার মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। তুলনায় সজলকে আমার কেমন যেন নিষ্প্রভ মনে হয়েছিল। ফিরে আসবার সময় সুবীর আমাকে বলেছিল, রমু সজল এরা আমার বন্ধু, ওদের তুমি তুমি করে বলল, আমাকেও বোলো। আর এখানে আসবার সময়, তোমার শ্রেণীশত্ৰু মামার গাড়ি চেপে, বড়লোকের মেয়ে হয়ে এসো, কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।’সজলকে বলেছিল, তুই যেন মাসখানেক ধরে কেমন দোদুল্যমান চরিত্রের মতো কথা বলছিস।

সজল বলেছিল, তোকে তো বলেছি, মূল নীতিতে আমার কোনও অবিশ্বাস নেই। পদ্ধতিটা ঠিক কি না, মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়।

সুবীর বলেছিল, সন্দেহ জিনিসটা বিষের মতো। শহরের সংগ্রামের পদ্ধতি আমরা ঠিকই নিয়েছি। সন্দেহটা ঝেড়ে ফেলিস। আমরা যে সার্থক, তা দেশের চেহারা দেখে কি কিছুই বোঝা যায় না! এভাবেই আমরা সমস্ত কিছু, ধাপে ধাপে কোলাপস করে দেব।

আমি স্পষ্টই দেখেছিলাম, সজলের চোখে দ্বিধা, পুরোপুরি বিশ্বাসের ছাপ নেই।

 ফেরার পথে সজল নিশূপ আচ্ছন্নের মতো ছিল। আমি কেবল সুবীরের কথাই ভেবেছিলাম। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, যাবার সময় সজল জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন দেখলে সুবীরকে।

আমি এক কথায় বলেছিলাম, আগুন! তারপরে বলেছিলাম, সুবীর আমার মনে গেঁথে গেছে। সজল বলেছিল, অসম্ভব ক্ষমতা আছে ওর।

.

তারপরেও আমি অনেক বার সুবীরের ওখানে গিয়েছি। আমাকে যেন কেউ ঠেলে নিয়ে যেত। কখনও একলা, কখনও সজলের সঙ্গে। অনেকক্ষণ ধরে সুবীরের কথা শুনেছি। সজলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে, আমি সুবীরের কথাই বারে বারে বলেছি। জানতাম না, আর একজনকে কোথায় ঠেলে দিচ্ছি। কোন অন্ধকারে। সুবীরের ওখানে অদ্ভুত অদ্ভুত ছেলেকে দেখেছি, যারা আমার সঙ্গে বিশেষ কথা বলত না। সুবীর তাদের যা নির্দেশ দেয়, তারা তা-ই করে। সুবীরকে যেন ক্রমেই, খাঁচায় বন্দি বাঘের মতো অস্থির মনে হচ্ছিল। চারদিক থেকে সব বিচ্ছিন্ন হয়ে, এক-একটা জায়গায় আবদ্ধ হওয়ার মতো অবস্থা দেখা যাচ্ছিল। হরিশদার ছেলে হিরণ, আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে। কলেজ ছেড়ে পার্টির কাজে চলে এসেছে। হরিশদা বলেছেন, ওর যদি ইচ্ছা হয়ে থাকে, করুক। হিরণ সুবীরের সঙ্গেই থাকে। ওর হাতে আমি সবসময়েই কোনও না কোনও অস্ত্র দেখেছি।

সুবীরের সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে, সজল প্রায়ই আমাকে চিঠি লিখত। এই যে সেই সব চিঠি, আমার টেবিলে ছড়ানো। ওর মধ্যে ভাবান্তর এবং পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল। পার্টি বা মূলনীতি বিষয়ে বোধ হয় নিরুৎসাহ ছিল না, পদ্ধতির বিষয়ে ওর সন্দেহ যেন স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছিল। এক দিন সুবীরকে বলেছিল, আমরা খুব ছোটখাটো চ্যালেঞ্জের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছি বলে মনে হচ্ছে। তাতে কি মনে হয় না, আমরা আমাদের নীতি আর আদর্শের ইমেজ নষ্ট করছি?

সুবীর বলেছিল, সংগ্রাম থাকলেই চ্যালেঞ্জ থাকবে। বৃহত্তর চ্যালেঞ্জের সময় এলেই তা করা হবে। আপাতত এমনকী, আমাদের কেউ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়েও তার কাজ করতে পারে।

এক দিন হিরণ বলেছিল, সজলদা আমাদের সাধারণ খুনির মতো মনে করেন!’ সজল বলেছিল, কথা তৈরি কোরো না হিরণ। কিন্তু অনেক অশুভ হাতের সঙ্গে কি আমাদের হাত মিলিয়ে খেলো করা। হচ্ছে না?

সুবীর জ্বলন্ত চোখে, সজলের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কাকে তুমি অশুভ হাত বলো?

সজল শান্তভাবেই বলেছিল, যা সমাজের পক্ষে, প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে অশুভ, তাকেই আমি অশুভ বলছি। যারা আমাদের সংগ্রামের সুযোগ নিয়ে, নিজেদের স্বার্থে রক্তপাত করছে, অত্যন্ত নিচু স্তরের খুনি, গুণ্ডা, বদমাইশ, ওয়াগন ব্রেকার্স, ছিনতাই পার্টি, এক কথায় স্যোকন্ড মস্তান, আর যে দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায় আসার জন্য সবরকম সর্বনাশের রাস্তা ধরেছে, তারা আমাদের ছায়ায় নিজেদের। আড়াল করছে। তাতে দিনের পর দিন আমাদের ইমেজের ক্ষতি হচ্ছে।

সুবীরের চোখ বাঘের মতোই জ্বলছিল, কিন্তু সজলের কথা শুনে সে আগুনের ঝিলিকে বিদ্রূপ করে হেসে উঠেছিল; বলেছিল, সজলবাবু, আপনার যদি বৈপ্লবিক শিক্ষা থাকত, তা হলে এ ভয়টা আপনি পেতেন না।

পরমুহূর্তেই তার হাসি মিলিয়ে গিয়ে, মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল, বলেছিল, তুমি যাদের গুণ্ডা মস্তান বলছ, আমাদের ভাষায় তারা হল লুম্পেন প্রলেটারিয়েট। তাদের বাদ দিয়ে আমাদের চলবে না। তাদের অশুভ হাতকে শুভ করে তোলার দায়িত্ব আমাদের। তাদের অস্ত্র আর ঘৃণাকে লেলিয়ে দিতে হবে। আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে, ভবিষ্যতে তারাই হয়ে উঠবে আমাদের পার্টির এক একটি হিরার টুকরো, বুঝেছ?

আমার মনে হয়েছিল, সুবীরের প্রতিটি কথা, নিচ্ছিদ্র যুক্তি দিয়ে ঠাসা। বুঝি বা না বুঝি, তার বলার মধ্যে এমন একটা প্রত্যয় আর দৃঢ়তা ছিল, তার জ্বলন্ত মুখকে এমন অগ্নিশুদ্ধ মনে হয়েছিল, আমার ভিতরটাই যেন দপদপ করছিল। কিন্তু আশ্চর্য, সজল যেন কেবল আগুনে জল ঢালতেই চাইছিল। ও উত্তেজিত হয় না, রেগে ওঠে না, ওর স্বরের মধ্যে গর্জন বেজে ওঠে না। ও শান্তভাবে একটু হেসে বলেছিল, সংশোধনবাদী আর দক্ষিণপন্থী অনুচরদেরও লুম্পেন প্রোলেটারিয়েট বলতে হবে? কোনও ফরমুলাই চিরদিন কার্যকরী হয় না। দেশ আর কালচারের মধ্যে, তার অনেক অদলবদল হয়ে যায়।

সুবীর ছুরি ছুঁড়ে মারার মতো জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার নতুন ফরমুলাটা কী, শুনি?

সজল বলেছিল, নতুন ফরমুলা দেবার মতো ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি আমার নেই। তবে একটা কথা নিশ্চিত জানি, পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের লেখা বইয়ে যাদের লুম্পেন প্রোলেটারিয়েট বলে উল্লেখ করা হত, তাদের সঙ্গে আমাদের দেশের মস্তান খুনিদের কোনও মিল নেই। আমার মতে, এরা আসলে ক্ষমতাশালী পার্টিগুলোর এজেন্ট, যারা জনসাধারণের মনে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে, আর পার্লামেন্টারি মতবাদে বিশ্বাসী, বুর্জোয়া, আধবুর্জোয়া দলগুলো তার সুযোগ নেয়। নিচ্ছে, নেবে। লুম্পেন প্রোলেটারিয়েট এরা কখনওই নয়। কাঁচকে হিরার টুকরো ভাবা হচ্ছে।

সুবীর আবার বিদ্রুপে ঠোঁট বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার মতে লুম্পেন প্রোলেটারিয়েট কারা? নয়া লেনিনের মুখ থেকেই সেটা শুনি?

হিরণ হেসে উঠে বলেছিল, নয়া লেনিন!

সজলও হেসেছিল, বিষণ্ণ শান্ত হাসি, বলেছিল, লেনিনিজমকে বিকৃত করা আমার কাজ না, যা করছে আজকের নয়া লেনিনরা। তা ছাড়া সত্যি বলতে কী, লেনিন তাঁর সময়ে যা বলে গেছলেন, সেই তুলনায় পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। লেনিনিজমকে কাজে লাগাতে হলে, আজকের ভারতবর্ষের অবস্থার সঙ্গে, উপযুক্ত ভাবে তাকে প্রয়োগ করার প্রশ্ন আছে। যে সব দেশে বিপ্লব হয়েছে, সে সব দেশের বিশেষ কোনও ফরমুলাই যে আমাদেরও কাজে লাগবে বা লাগাতে হবে, আমি তা বিশ্বাস করি না। আমাদের অবস্থা বুঝে উপায় উদ্ভাবন করতে হবে।

সুবীর তীক্ষ্ণস্বরে জিজ্ঞেস করেছিল, আমরা কি অবস্থা বুঝে, ঠিক নীতি আর কৌশল নিয়ে চলছি না?

সজল শান্ত মুখে চুপ করে ছিল। সুবীর ঝাঁজালো স্বরে জবাব দাবি করে বলেছিল, কথা বলো সজল, এভাবে চুপ করে থাকলে চলবে না। আমরা একই পার্টিতে আছি, অথচ আমাদের মধ্যে মতভেদ থাকবে, তা চলতে পারে না।

সজল জিজ্ঞেস করেছিল, থাকলে?

সুবীর দৃঢ়স্বরে বলেছিল, মতভেদ থাকলে তোমাকে পার্টি ছাড়তে হবে।

সজল আবার জিজ্ঞেস করেছিল, সেই মতভেদ যদি নীতি আর কৌশলের দিক থেকে সত্যি আর ঠিক হয়, তবু আমাকে পার্টি ছাড়তে হবে?

সুবীর সজলের সেই বিষণ্ণ গাম্ভীর্যের মধ্যে, শান্তভাবে কথা বলা সহ্য করতে পারছিল না। আমিও পারছিলাম না। সজলকে আমার যেন প্রাণহীন মনে হচ্ছিল। হতাশ, বিষণ্ণ, অথচ ও ওর বক্তব্য থেকে সরছিল না, নিজেকে সমর্পণও করছিল না, নতি স্বীকারের কোনও লক্ষণই ছিল না। সুবীরের অসহিষ্ণুতা তাই আমার কাছে উপযুক্ত মনে হয়েছিল। সুবীর যেন জ্বলে উঠে বলেছিল, তোমার কোনও ফরমুলা নেই। আমরা ব্যক্তিগতভাবে কোনও পদ্ধতি স্থির করে কাজ করি না, মনে রেখো, আমাদের একটা পার্টি আছে, আর পার্টি যাদের দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে নীতি আর কৌশল স্থির হয়েছে, আমরা সেই নীতি আর কৌশল নিয়ে চলেছি। এক্ষেত্রে মতভেদ থাকলে, তোমাকেই পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হবে।

হিরণ বলে উঠেছিল, পার্টি থেকে বের করে দেবার কোনও নিয়ম আমাদের নেই।

হিরণের চোখে আমি হিংস্রতা দেখেছিলাম। আমি জানতাম, পার্টি থেকে বের করে দেবার কোনও নিয়ম নেই, শ্রেণীশত্রু রূপে তার অস্তিত্বকে বিলোপ করাই পার্টির নীতি। সুবীর হিরণের কথার কোনও প্রতিবাদ করেনি। জানি না, বুঝতে পারিনি, হিরণের চোখের হিংস্রতা দেখে কি আমার বুকের মধ্যে এক বার কেঁপে উঠেছিল? আমি কেবলই চাইছিলাম, সজল তর্ক বন্ধ করুক, সুবীরের কাছে নতি স্বীকার করুক। পার্টির নীতি ও কৌশলের কথা আমার মনে হয়নি, আমি সুবীর ছাড়া কিছুই বুঝিনি, সেইজন্য নতি স্বীকার বলতে, সুবীরের কাছে নতি স্বীকারই বুঝেছিলাম।

সজল একভাবেই বলেছিল, মতভেদের কথা আমি বাইরের লোকের সঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছি না, আমি আলোচনা করছি পার্টির মধ্যেই। পার্টির মধ্যে পার্টির নীতির সমালোচনা কি অপরাধ যে পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হবে?

সুবীর দৃঢ় তীব্র স্বরে বলেছিল, না, পার্টির কোনও সমালোচনাই সহ্য করা হবে না। ১৬০

সজল বলেছিল, একে তো আমি ব্যুরোক্রাসি বলেই জানি। আর তার পরিণতি কী, আমি তাও জানি।

সুবীর যেন হঠাৎ শান্ত হয়ে গিয়েছিল, বরফের মতো জমাট আর শীতল; বলেছিল, সজল, তুমি বড় বেশি জেনে ফেলেছ।

সজল বলেছিল, আর জানাটা খুব ভাল লক্ষণ না, সে অভিজ্ঞতা তথাকথিত বিপ্লবী দেশগুলো থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতা জিনিসটা বড় মারাত্মক অবসেশনের মতো, তারা মনে করে, তারা যা বলছে, সেটাই শেষ কথা, অথচ তত্ত্ব দিয়ে তা প্রমাণ হয় না, অতএব ক্ষমতা প্রয়োগই শেষ কথা। আচ্ছা সুবীর, তুমি কি মনে কর না, মানুষই সব থেকে বড় শক্তির উৎস, একমাত্র উৎস?’

সুবীর বাঘের মতো গর্জন করে উঠেছিল, কোন মানুষ? যারা কৃষক মজুরদের শোষণ করে, তারা? তাদের প্রতিনিধিরা, পাহারাদারেরা, চ্যালাচামুণ্ডারা? শুধু কথার জন্যই, ভেগ কোনও কিছু বলা চলবে না সজল।

সজল বলেছিল, ভেগ আমি কিছুই বলছি না। সেই সব মানুষদের কথা হচ্ছে, জীবিকার খাতিরে। ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রতম যে সব কোটি কোটি মানুষ আছে, তারা কি আমাদের শত্রু?

সুবীর দৃঢ় স্বরে বলেছিল, তারা যদি আমাদের সঙ্গে না আসতে চায়, তবে শত্রু।

সজল শান্তভাবে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের সঙ্গে তাদের আসবার উপায়?

সংগ্রামের সঙ্গে সামিল হওয়া। সুবীর বলেছিল, আমরা সংগ্রামের যে পদ্ধতিতে চলেছি, তাতেই তারা আমাদের সঙ্গে আসবে, নিজেদের প্রয়োজনে। যাদের না আসবার, তারা আসবে না।

সজল আবার জিজ্ঞেস করেছিল, আমরা যে পদ্ধতিতে চলেছি, তাতে কি তারা আমাদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসবে?

সুবীর আবার দীপ্ত আর প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল; বলেছিল, আসবে, আসতে হবে। ইতিমধ্যেই কি তার প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি? শ্রেণীশত্রুদের আমরা ভীত আর সন্ত্রস্ত করে তুলেছি।

আমাকে পর্যন্ত অবাক করে দিয়ে সজল হো হো করে হেসে উঠেছিল, কিন্তু সে হাসির মধ্যে, পুরনো সজলের প্রাণবন্ত সুর ছিল না। ছিল বিদ্রূপ আর একটা অস্বাভাবিক উন্মাদনার ভাব, অগভীর হালকা যাকে বলে, যা ওর শান্ত বিষণ্ণতার সম্পূর্ণ বিপরীত।

হিরণ বলে উঠেছিল, সজলদা যাত্রার অভিনয় করছেন!

সজলের হাসিটা আমারও ভাল লাগেনি। আলোচনার বিষয় এবং পরিবেশের সঙ্গে বেখাপ্পা কেবল না, গুরুত্বকে হাস্যকর করে তোলার অভিসন্ধি মনে হয়েছিল। সুবীর ওর দিকে তাকিয়েছিল তীক্ষ্ণ প্রজ্জ্বলিত চোখে।

সজল হাসি একেবারে না থামিয়ে, প্রায় হাসতে হাসতেই বলেছিল, কাদের সন্ত্রস্ত করে তুলেছ? ক্লাস এনিমিদের? পশ্চিমবাংলার দিকে–মানে কলকাতার দিকে তাকিয়ে তোমার কি তা-ই মনে হচ্ছে?

সুবীর যেন কেমন জ্বলন্ত অঙ্গারের রূপ ধারণ করছিল, লেলিহান শিখার মতো অস্থিরতা দেখা যাচ্ছিল না। বলেছিল, কিছু না জিজ্ঞেস করে তোমার মতামতটাই বলো।

যেখানে কোনও সমালোচনাই সহ্য করা হবে না বলা হচ্ছে, সেখানে মতামত ব্যক্ত করাও অন্যায়। সজল বলেছিল, তথাপি না বলে পারছি না। রিয়্যাল ক্লাস এনিমিদের আমরা যেমন একটু গায়ে হাতও দিতে পারিনি, তেমনি তাদের সন্ত্রস্তও করতে পারিনি। আমরা দক্ষিণপন্থীদের পথ পরিষ্কার করে দিচ্ছি, অবিশ্যিই না জেনে, পরোক্ষে, আর বামপন্থী সংশোধনবাদী পার্টিগুলোকে আমাদের সমালোচনার সুযোগ দিচ্ছি, কেননা, ওদের দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদের বিপরীত আমরাও বামপন্থী সংশোধনবাদের পথে চলেছি। কিছু ইনডিভিজুয়াল ছাড়া, জনতার কোনও অংশই আমাদের সঙ্গে নেই।

এই পর্যন্ত বলেই, সজল কী মনে করে হঠাৎ থেমে গিয়েছিল এবং এক পলক চুপ করে থেকে আবার বলেছিল, অবিশ্যি আমার এ সব বলার কোনও মানে হচ্ছে না। তুমি আগেই বলেছ, যারাই তোমার সঙ্গে আসতে না চাইবে, তারাই শত্রু। অতএব, তোমার রাস্তা তো খোলা, চালিয়ে যাও।

চালিয়ে যাও, মানে কী?’ সুবীর যেন চাপা গর্জনের স্বরে জিজ্ঞেস করেছিল, আর তোমার সঙ্গে মানেই বা কী? আমি কি একলা নাকি?

সজল বলেছিল, চালিয়ে যাও বলতে বলছি, যা করছ, তোমার নীতি অনুযায়ীই যখন করছ, করে যাও। তোমার বলতে আমি তোমাদের কয়েকজনের কথা বলছি। তা ছাড়া, তুমি নিজেই বলেছ, পার্টি এরকম নীতির কথা বলেছে, আপাতত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়েও, কেউ অ্যাকশন নিতে পারে। তার মানে, প্রত্যেকেই একটা পার্টি।

বুঝেছি, এখন সবটাই তুমি বিকৃত করে দেখাচ্ছ। সুবীর বলেছিল, আর এটা কাদের পদ্ধতি, তাও আমরা জানি।

সুবীরের চোখের দুই জ্বলন্ত অঙ্গারের দিকে তাকিয়ে, আমি যেন ভিতরে ভিতরে আবার কেঁপে উঠেছিলাম। মনে হয়েছিল, তৎক্ষণাৎ একটা ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে। হিরণ যেন একটা হিংস্র প্রত্যাশা নিয়ে সুবীরের দিকে তাকিয়েছিল। আশা করেছিলাম, অতঃপর সজল নিজেকে গুটিয়ে নেবে। নেয়নি। এক বার হেসে উঠলেও, ও আবার আগের মতো শান্তভাবে বলেছিল, আর তোমার জানা মানেই শেষ জানা।

বলে সজল নিঃশব্দে হেসেছিল। সুবীরও হেসেছিল, অঙ্গারের গায়ে খোঁচা লাগার মতো, বলেছিল, আমি আরও কিছু শেষ জানি। তোমার এখন দরকার কোনও এঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে একটা ভাল চাকরি, আর সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী একটি বউ।

সুবীরের দৃষ্টি পলকে আমাকে এক বার ছুঁয়ে গিয়েছিল। জানি না, আমার মুখে রক্ত ছুটে এসেছিল কি না, একটা তপ্ত ঝলক অনুভব করেছিলাম। আমি ঘাড় ফিরিয়ে সজলের দিকে তাকিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সুবীরের কথার ও প্রতিবাদ করবে। সুবীরের কথায় স্পষ্টতই আমার প্রতিও ইঙ্গিত ছিল।

সজল হেসে বলেছিল, ক্লাস এনিমির সঠিক ভূমিকা হয়তো সেটাই, কিন্তু আমার পোড়াকপালে তা আর ঘটছে কই!

সজলের ও রকম কথা আমি আশা করিনি। ভেবেছিলাম, সে তীব্রভাবে, তার জীবন উৎসর্গের কথাই ঘোষণা করবে। সে যে সুবীরের থেকে কোনও অংশে কম সংগ্রামী না, এ কথাই সে জোর গলায় বলবে। কিন্তু সজলের কথায়, দশজন সাধারণ বেকার যুবকের কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, যা শুনে আমি কুপিত হয়েছিলাম, রুষ্ট হয়েছিলাম, ওর ভাবী স্ত্রী হিসাবে নিজেকে হীন মনে হয়েছিল। আমি আর বসে থাকতে পারছিলাম না। বিশেষ কারোকে উদ্দেশ না করে শুধু বলেছিলাম, আমি যাচ্ছি।

বলেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম, পিছনে সজলের গলার স্বর শুনতে পেয়েছিলাম, দাঁড়াও, আমিও যাচ্ছি।’

ফেরার পথে, সজলের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।