বাথরুমের দরজা খুলে এক অচেনা ঘরে পা দিল রেমি। বিশাল জানালা দিয়ে সকালের রোেদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে ঘরে। মস্ত ঘর। আলোয় ঝলমল। কিন্তু অচেনা। রেমির কেমন ভয়-ভয় করল, কেমন অনিশ্চিত হয়ে গেল হাত-পা। কার ঘর? কে থাকে এখানে? তাকে দেখে কেউ কি চেঁচিয়ে উঠে বলবে, কে? কে তুমি? এখানে কেন?
রেমির মুখ থেকে, মাথা থেকে টপটপ করে জল পড়ছে মেঝেয়। মুখ মুছতে ভুলে গেছে সে। কিন্তু তোয়ালেটা হাতে ধরা আছে এখনও। ভ্রু কুঁচকে সে মস্ত তোয়ালেটার দিকে তাকায়। সাদা জমির ওপর আবছা গোলাপি ফুল। খুব দামি, নরম তোয়ালে। কিন্তু কার? অন্য কারও ব্যবহার করা নয় তো! অন্যের ব্যবহার করা ভোয়ালে বা গামছায় মুখ মুছতে বড় ঘেন্না তার।
একটা টাইমপিস টিকটিক করছে নিচু টেবিলের ওপর। বাইরে কাকের ঝগড়া। একটা-দুটো গাড়ির শব্দ। রেমি ঘরের মধ্যে আরও এক পা এগোল। তারপর ফের দাঁড়িয়ে তোয়ালেটা দুহাতে বুকে চেপে ধরে রইল প্রাণপণে। ভয়। ভ্রু কুচকে মনে করার চেষ্টা করল। কিছু মনে পড়ল না। মাথার ভিতরে খুব ঘন কুয়াশা। কিন্তু বিছানার ওপর পাতা মণিপুরি এই ঢাকনাটা তার চেনা। তার ওপর পাতা একটা সবুজ অয়েল ক্লথ। দুটো খুদে পাশবালিশ, একটা ছোট্ট মাথার বালিশ, কথা। কোনও শিশু নেই অবশ্য। এসব খুব অবাক চোখে দেখল রেমি। কিছু মনে পড়ছে না।
বউদি! ও বউদি! জলে যে মেঝে ভিজে গেল গা! ওম্মা!
রেমির বিস্মৃতি এক ঝটকায় কেটে গেল। ঝম করে যেন মাটিতে পড়ল পা। স্বপ্ন থেকে চোখ মেলল জাগরণে। একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে। তারপর লজ্জায় তাড়াতাড়ি মুখ মুছতে মুছতে বলল, বাচ্চাটা কোথায় গেল রে, রাধা?
কোথায় আবার? বড়বাবু তাকে টেবিলে শুইয়ে পেট বুক চোখ কান সব দেখছেন মন দিয়ে। দেখো গে যাও। আর তোমার বাচ্চাও বটে দাদুকে চিনেছে। অমন আঁতুড়ে ছেলে যে এমন শেয়ানা হয়!–বলতে বলতেই রাধা একটা ন্যাকড়া বের করে মেঝেটা মুছে ফেলল। তোয়ালেটা রেমির হাত থেকে নিয়ে বাথরুমে রেখে এলা
রেমি দুর্বল শরীরে বিছানায় বসল একটু। রাধা একটা মস্ত চিনেমাটির ঢাকনা দেওয়া সুপ বউল এনে রেখেছে টেবিলের ওপর। ওতে আছে গরম দুধ-সাগু। খেতে হবে। বাধ্যতামূলক এই দুধ-সাগু দেখলেই রেমির ভয় করে, বমি আসতে চায়। কিন্তু তার শ্বশুরের আদেশ খুব কড়া। খেতেই হবে। এতে স্বাস্থ্য ভাল হবে। বুকে দুধ আসবে।
খেয়ে নাও গো বউদি।
আজ অর্ধেকটা খাই, বাকি অর্ধেক বাথরুমে চুপি চুপি ফেলে দে।
চাকরিটা খেতে চাও আমার? গর্দানটাও না যায় সেই সঙ্গে।
উঃ, কী যে জ্বালা।
খেয়ে নাও না নাক চোখ বুজে! খারাপ জিনিস তো নয়। পোয়াতিদের খেতে হয়।
রেমি ঢাকনা খুলে দুহাতে সাদা বউলটা তুলল মুখের কাছে। সহনীয় করার জন্য রাঁধুনি খানিকটা ভ্যানিলা মিশিয়ে দিয়েছে। ছড়িয়ে দিয়েছে এলাচের গুঁড়ো। তবু গা গুলিয়ে ওঠে। খুব ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে খায় রেমি৷ তার শাশুড়ি নেই, মা কাছে থাকে না, কিন্তু একজন তার সব অভাব পূরণ করে চলেছেন। কী আপ্রাণ চেষ্টা! এই দুধ-সাগুর অরুচিকর পদার্থটির মধ্যেও শ্বশুরমশাইয়ের গভীর স্নেহ মিশে আছে।
রেমি বেঁচে ওঠার পর আনন্দে কৃষ্ণকান্ত ঘণ্টা দুয়েক কেঁদেছেন। সেকথা ভাবলে আজও চোখ ভরে জল আসে রেমির। কষ্ট হয় বটে, তবু সে নিঃশেষে দুধ-সাগুটা খেয়ে নেয়।
কেন তার মাঝে মাঝে মাথাটা এমন কুয়াশায় ঢেকে যায় সেটা সে কিছুতেই ভেবে পায় না। কী হয় তার? কেন হয়?
রেমি এখনও কাউকে বলেনি তার সমস্যার কথা বলার মতো কে-ই বা আছে তার। একমাত্র কৃষ্ণকান্ত। কিন্তু বুড়ো মানুষকে নতুন করে উদ্বেগে ফেলতে চায় না রেমি। ধ্রুবর সঙ্গে তার বড় একটা দেখাই হয় না। ছেলে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর থেকেই রেমি থাকে দোতলায়, ধ্রুব ওপরে আসে না। যতদূর খবর পায়, ধ্রুব আজকাল মদ খাচ্ছে না। একটু রোগা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে অফিসের কাজ নিয়ে বাইরে যাচ্ছে। কিন্তু রেমিকে বা বাড়ির আর কাউকেই সে কিছু বলে যায় না।
রেমির এখন কাউকে দরকার। সব কথা তো সবাইকে বলা যায় না। ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসযোগ্য একজন আপনজন দরকার। ধ্রুব ছাড়া আর কেউ তো নেই সেরকম। পরের মতো ব্যবহার বটে তার, কিন্তু রেমির তো আর কেউ নেই।
রেমি অন্যমনস্কভাবে সুন্দর পাত্রটির দিকে চেয়ে ডাকল, রাধা!
কী বলতেছ?
তোর কাকাবাবুর খবর কী রে?
বাড়িতেই তো ছিলেন সকালবেলায়।
এখন নেই?
দেখছি।
তাড়াতাড়ি দেখ। থাকলে একটু ওপরে আসতে বল।
রাধা বউলটা নিয়ে চলে গেল। রেমি প্রত্যাশ্যাহীন অপেক্ষা করতে লাগল। হয়তো আসবে। হয়তো আসবে না। ধুবর তো কিছু ঠিক নেই।
কিন্তু একটু বাদেই সিঁড়িতে হাওয়াই চপ্পলের চেনা শব্দ পেল রেমি। ধক করে উঠল তার বুক। আজও বুকটা এরকম করে! কেন করে তা কে বলবে?
ধ্রুব দরজার ফ্রেমে এসে দাঁড়াতেই রেমি দুর্বল শরীরে ওঠে। ভাল করে চেয়ে দেখে মানুষটার দিকে। কীরকম মেজাজে আছে? রাগ না স্বাভাবিক? ঘেন্না নয় তো?
না, ধ্রুবর মুখে ঘেন্না নেই। বরং একটু উজ্জ্বল হাসির পূর্বাভাস তার ঠোঁট ছুঁয়ে আছে।
রেমি আশ্বস্ত হল। বলল, এসো, ঘরে এসো।
চটি খুলে, না না-খুলে?
তার মানে?
শুনলাম ওপরতলাটা নাতির সম্মানে তোমার শ্বশুরমশাই পুরো স্টেরিলাইজ করে রেখেছেন, যার-তার যে-কোনও অবস্থায় ওপরে আসার অধিকার নেই।
আমি তো অতসব জানি না।
আমরা ভুক্তভোগীরা জানি।
তোমাকে ওপরে আসতে কি উনি বারণ করেছেন?
ডাইরেক্টলি করেননি। তবে ফরমান জারি আছে যে, হাত-পা সাবান দিয়ে না ধুয়ে এবং পরিষ্কার জামাকাপড় না পরে কেউ যেন ওপরে না আসে।
তাই বুঝি তুমি আসো না?
অনেকটা তাই। কাজ কি বড়লোকদের সঙ্গে মাখামাখি করে? নীচের তলার লোক আমরা নিচুতেই বেশ থাকি।
বড়লোকের তুমি বুঝি কেউ নও?
আমি! আমি আবার কে? এ লায়াবিলিটি।
তোমার ছেলের জন্যই এসব প্রিকশন নেওয়া হচ্ছে, পরের জন্য তো নয়।
ছেলে? বাপ রে! ও আমার ছেলে নাম-কো-বান্তে। ওর আসল পরিচয় হল, কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীর নাতি।
রেমি হেসে ফেলে। বলে, খুব ইয়ার্কি শিখেছ! এসো তো, তোমার সঙ্গে কথা আছে। চটিটা বাইরেই রাখো বরং।
ধ্রুব চটি ছেড়ে ঘরে আসে। চারদিকে উৎসুক চোখে তাকায়। তারপর বলে, সে ব্যাটা কোথায়? সেই খাঞ্জা খায়ের নাতি?
কার কথা বলছ? ছেলে?
তাই না হয় হল।
তাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করে তা হলে?
ইচ্ছে তো করে মাঝে মাঝে ভাই। তবে কী জানো, আমার তো মোহর নেই যা দিয়ে মুখ দেখব।
ছেলের মুখ দেখতে বাপের বুঝি মোহর লাগে?
তাই তো শুনছি। দাদু নাকি পাঁচ মোহর ডাউন করেছে।
দাদুর ছিল তাই দিয়েছে। তোমার নেই, তুমি দেবে না।
ভরসা দিচ্ছ?
রেমি খুব হাসল। বলল, আসল কথাটা বললেই তো হয়। ছেলে, বউ, সংসার এসবের ওপর তোমার কোনও টান নেই। খামোকা শ্বশুরমশাইকে দুষছ কেন?
ধ্রুব বিছানায় বসে। তারপর পেঁয়ো লোকের মতো চারদিকে চেয়ে চেয়ে ঘরের আসবাবপত্র দেখতে থাকে। স্ট্যান্ডে ছোট্ট দোলনা, ঘরের কোণে পাথরের টেবিলে নতুন কেনা একটা স্টেরিলাইজার, নানারকম ওষুধপত্র, জীবাণুনাশক, একটা ওজন নেওয়ার যন্ত্র, তোয়ালে ন্যাপকিন, বাচ্চার জামাকাপড়ের ছড়াছড়ি। ধ্রুব একটা খাস ফেলে বলে, এত আয়োজন মাত্র একজনের জন্য?
রেমি একটু লজ্জা পেয়ে বলে, শ্বশুরমশাই ওকে বড় ভালবাসেন।
তা বাসুন। কিন্তু ফুটপাথেও বাচ্চা জন্মায় এবং বেঁচে থাকে।
ওসব কথা থাক। প্লিজ!
ধ্রুব হাসল। মাথা নেড়ে বলল, থাক। এখন কেন ডেকে বলো।
আমার একটা বিদঘুটে অসুখ হয়েছে।
কী অসুখ?
মাঝে মাঝে আমি সব ভুলে যাই। এই ঘর, এই বাড়ি, কিছুই চিনতে পারি না। আজ একটু আগেও হল। বাথরুম থেকে ঘরে পা দিয়েই মনে হল, এ ঘর তো আমার নয়। অন্য কার ঘরে ঢুকে পড়লাম আমি। বেশিক্ষণ থাকে না ব্যাপারটা, কিন্তু প্রায়ই হয়।
ধ্রুব মুখ গম্ভীর করে শুনছিল। বলল, মানুষজনকেও চিনতে পারো না?
না।
নিজের ছেলেকেও না?
রেমি একটু ভাবল। তারপর বলল, যখন ওরকম হয় তখন মিনিটখানেকের জন্য মাথাটাই ফাঁকা হয়ে যায়। কিছুই স্মৃতি থাকে না। ছেলেকেও তখন চেনা লাগে না।
ডাক্তারকে বলেছ?
না। ভাবলাম আগে তোমাকে বলি।
ডাক্তার তো রোজই আসে।
আসে।
আজ ডাক্তারকে বোলো। আমরা লে ম্যান, অসুখের কী বুঝি?
আমার কি মাথার গণ্ডগোল হবে গো?
তা কেন? এটা কোনও ডেফিসিয়েন্সি থেকেও হতে পারে। খুব সিরিয়াস কিছু বলে মনে হয় না।
আমার ভীষণ ভয় করে, মনে হয় পাগল হয়ে যাব না তো! সেই ভয়ে ডাক্তারকেও কিছু বলি না।
ডাক্তারকে ভয় কী?
যদি বলে, আপনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন!
দূর বোকা। ডাক্তাররা কখনও ওরকমভাবে বলে না।
রেমি মাথা নেড়ে বলে, আমি পারব না। তুমি ডাক্তারকে বলো।
আমি! আমি কেন?
তুমি আমার স্বামী না?
নাম-কো-বাস্তে।
সে তো জানিই। তবু স্বামী তো। তুমিই বলো।
দায়িত্বে জড়াচ্ছ?
না হয় জড়ালাম। হাত দিয়ে তো পারলাম না, যদি দায়িত্ব দিয়ে পারি।
ডাক্তার কখন আসে?
দশটা নাগাদ।
এখন মোটে আটটা! দুঘণ্টা দেরি।
রেমি একটু নাকি সুরে আবদার করে বলে, তা হোক, আজ না হয় অফিসে একটু দেরিই হবে।
ধ্রুব একটু হাসল। আজ সকালে পরিষ্কার করে দাড়ি কামিয়েছে, চুল আঁচড়েছে, পরনে একটা ধবধবে সাদা পায়জামা, গায়ে পিত্তি রঙের একটা র-সিল্কের পাঞ্জাবি। চেহারাটা বড় বেশি ধারালো দেখাচ্ছে আজ। একটু শীর্ণতায় ওর লাবণ্য নষ্ট তো হয়ইনি, বরং শক্তপোক্ত দেখাচ্ছে। হাসির বিদ্যুৎ মুখখানায় এক দারুণ সৌন্দর্যের আলো ফেলল।
হয়তো-বা ধ্রুবকে এত সুন্দর দেখে রেমি একাই। বারবার এক বিভোর তন্ময়তা পেয়ে বসে। পেয়ে বসে মুগ্ধতা, কাম, তীব্র আকর্ষণ, আজও বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে গেল রেমির। হঠাৎ সে ঘন শ্বাস ছেড়ে বলল, তুমি কি জানো তোমার মতো সুপুরুষ আর-একজনও নেই?
এরকম কথা রেমি কখনও বলে না। ধ্রুব অবাক হয়ে রেমির দিকে চাইল। তারপর বলল, তাই নাকি?
কথাটা কি তোমাকে আর কেউ বলেছে?
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, না। কারণ কথাটা সত্যি নয়।
বটে!–বলে রেমি ধ্রুবর কাছ ঘেঁষে বসল। আলতো করে হাত রাখল কাঁধে।
ধ্রুব বলল, সত্যি হলে কেউ না কেউ বলতই। তাছাড়া আর-একটা কথা। আমার শরীরে জমিদারের রক্ত আছে। ব্লু ব্লাড়। জমিদাররা সব সময়ে সুন্দরী মহিলাদের বিয়ে করতেন। ফলে বংশানুক্রমে তাদের বাচ্চারাও সুশ্রীই হত। আমার সেই উত্তরাধিকার থাকতেই পারে। কিন্তু কেবল শারীরিক সৌন্দর্য দিয়ে পুরুষের বিচার চলে না। তার মধ্যে আরও কিছু থাকা চাই।
সেটা কী?
পৌরুষ এবং চরিত্র। আমার তা নেই। এক রকমের চেহারা আছে যা দিয়ে কেবল মেয়ে পটানো চলে। পুরুষের সত্যিকারের সৌন্দর্য ওটা নয়। চেহারা হবে এমন যার সামনে পুরুষ নারী নির্বিশেষে মাথা নোয়াবে।
রেমি শুনছিল না। ধ্রুবর খুব কাছে বসে, তার কাঁধে থুতনি রেখে মুখের দিকে অপলক চোখে চেয়ে ছিল। আফটার-শেভ লোশনের মৃদু গন্ধ আসছিল নাকে। মুগ্ধ, সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছিল। এতসব কথার পর হঠাৎ মৃদু স্বরে বলল, আমার সঙ্গে এক ঘরে থাকতে কি তোমার খুব অসুবিধে হয়?
ধ্রুব একটু হাসল। বলল, থাকিনি কি? কিন্তু তোমার মাননীয় শ্বশুরমশাই তো তা হতে দিচ্ছেন না।
উনি বিবেচক বলেই দোতলায় রেখেছেন আমাকে। উনি ভাবেন, বাচ্চা থাকলে সে তো রাতে কদবে, বিছানা ভেজাবে, তুমি হয়তো বিরক্ত হবে।
তাই বুঝি?
তা নয়? একা আমাকেই তো তুমি সইতে পারো না। মাঝরাতে ছেলে রোজ কাঁদলে পারবে?
পারব বললে কি বিশ্বাস করবে? আমাকে তো ট্রায়াল দিয়ে দেখোনি।
ট্রায়াল দেব না হয়। আজই নীচের ঘরে ব্যবস্থা করছি।
ধ্রুব একটু তটস্থ হয়ে বলল, আজ থাক।
কেন? থাকবে কেন?
একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট আবার পালটানো অনেক হাঙ্গামার ব্যাপার। পরে হবে।
রেমি একটু হেসে বলে, ভয় পেলে?
ভয় না।
রেমি হাসল। করুণার হাসি। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বলল, জানি গো জানি। আমি মরলে তুমি বাঁচতে।
ধ্রুব খুব গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলে, না। তুমি মরলে আমার কোনও লাভ হত না, রেমি। আমি যদি অন্য কোনও মেয়েকে চাইতাম তা হলেও না হয় হত। আমার সেরকম কেউ নেই।
কিন্তু আমি তো তোমাকে বেঁধে রেখেছি।
তা রেখেছ। তবু প্রথমে যতটা খারাপ লাগত এখন ততটা লাগে না। আচ্ছা, দরজা-ফরজা খোলা রেখে এমন গা ঘেঁষাঘষি করছ আজ কোন সাহসে বলল দেখি? কেউ দেখে ফেলবে না?
দেখুক গে। পরপুরুষ তো নও।
খুব সাহস হয়েছে তো আজকাল?
রেমি একখানা হাত বাড়িয়ে ধ্রুবর মুখ চাপা দিল। বলল, তুমি কাছে থাকলে আমার শরীর-মন সব অন্যরকম হয়ে যায়। কত ভালবাসি তা তো বুঝলে না।
ধ্রুব কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু আচমকাই ঘরের বাতাস প্রকম্পিত করে একটা বাজ পড়ল। বউমা!
সচকিত রেমি ছিটকে উঠে দাঁড়াল। ধ্রুব একা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দেখল, দরজার অতি সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ পর্দার ওপাশে কৃষ্ণকান্ত দাঁড়িয়ে আছেন। কোলে কাঁথায় সযত্নে মোড়া নাতি। ঘরের ভিতরটা তিনি খুব স্পষ্ট ও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন।
ধ্রুব বা রেমি কেউ একটাও শব্দ করতে পারেনি বিমূঢ়তায়।
কৃষ্ণকান্ত পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ধ্রুবর দিকে দৃপাত করলেন না। রেমির দিকে চেয়ে বললেন, বাপের বোধহয় এখনও ছেলের মুখ দেখার সময় হয়নি, না মা?
রেমি ঘোমটায় ঢাকা মুখ নত করে থাকে। জবাব দেয় না।
কৃষ্ণকান্ত তপ্তস্বরে বললেন, যদি বাপের সময় বা ইচ্ছে হয় অন্তত তা হলে তাকে একবার আমার দাদাভাইয়ের মুখখানা দেখিয়ে রেখো। অন্তত মুখচেনাটা হয়ে থাক।
এবারও ঘরে স্তব্ধতা।
কৃষ্ণকান্ত নাতিকে রেমির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, শরীরটা একটু লালচে দেখাচ্ছে আজ। বুঝলে! হাম-টাম হতে পারে। আজ আর গায়ে জলস্পর্শ কোরো না। তেল-টেলও দিয়ো না। ডাক্তার এলে একবার ভাল করে দেখতে বোলো।
রেমি ছেলেকে কোলে নেয়।
কৃষ্ণকান্ত নাতির ঘুমন্ত মুখখানার দিকে মায়াভরে একটুক্ষণ চেয়ে থাকেন। তারপর ধীরে ধীরে দরজার কাছে যান। একটু থেমে পিছন ফিরে বলেন, পৌরাণিক অভিধান আর কয়েকটা বই থেকে গোটা দশেক নাম বেছে রেখেছি। কোনটা খাপ খাবে তা বুঝতে পারছি না। লিস্টটা পাঠিয়ে দেব, ছেলের বাপকেও বোলো একটু দেখে রাখতে।-বলে কৃষ্ণকান্ত চলে গেলেন।
রেমি ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে স্ট্যান্ডের মশারি দিয়ে ঢাকা দিল। তারপর চাপা স্বরে বলল, ওগো।
কী বলছ?
ছেলে দেখো।
দেখছি।-বলে ধ্রুব হাসল। আড়চোখে গোলাপি নাইলনের মশারির মধ্যে শোয়ানো ছেলের টুলটুলে মুখখানা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে দেখল সে।
রেমি বলল, কী মনে হচ্ছে?
কী আবার মনে হবে?
নিজেকে বাবাবাবা লাগছে না?
ধুর! কে কার বাবা? জন্মানোর জন্য ওর আমাকে এবং তোমাকে দরকার ছিল মাত্র।
ও আবার কীরকম কথা?
দুনিয়াটা ঠিক ওরকমই প্রকৃতির নিয়মে চলে, রেমি।
চুপ করো তো। অত জ্ঞানের কথা ভাল নয়।