বজ্রনির্ঘোষের মতো কণ্ঠস্বরটি শুনে হেমকান্ত স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ তার শরীরে সাড় রইল না, মনটা থমকে গেল। তার যে নিজস্ব জগৎ সেখানে উচ্চকিত কোনও ঘটনা ঘটে না, শব্দ হয় না। সবকিছুই সেখানে কোমল, ন, মৃদু। এরকম একটা পারিপার্শ্বিক তিনি তৈরি করে নিয়ে সেখানে নির্বাসিত করেছেন নিজেকে। পৃথিবীর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সব মায়া সেখানে শিল্পের মতো তন্তুজাল বিস্তার করে। বাইরের শব্দময়, ঘটনাবহুল পৃথিবীর সেখানে প্রবেশ নিষেধ। তাই এই কর্কশ, সুরহীন, হিংস্র কণ্ঠস্বরটি তার ভিতরে সব স্পন্দন যেন কয়েক নিমেষের জন্য স্তব্ধ করে দিল। যেন বা থেমে গেল রক্তের প্রবহমানতা, বন্ধ হয়ে গেল হৃৎপিণ্ড।
তারপর খুব ধীরে ধীরে হেমকান্ত মুখ ফেরালেন। যা দেখলেন তা আরও চমকে দেয় তাকে। জটাজুটধারী এবং সামান্যমাত্র রক্তাম্বর পরিহিত এক সাধু কটমট করে চেয়ে আছে তার দিকে। সাধুটি বয়স্ক, কেননা জটার চুল সবই প্রায় সাদা, গায়ে লোলচর্ম, দেহটি কৃশকায় এবং তোক্লিষ্ট। শুধু চোখ দুটি ভয়ংকর রকমের উজ্জ্বল।
হেমকান্ত অনুমান করলেন, লোকটির বয়স আশির কাছাকাছি। এই বয়সে কৃশ শরীরের ভিতর থেকে এরকম বাজখাই স্বর কী করে বেরোয় সেটাই রহস্য।
হেমকান্তর বিস্ময়বোধ স্তিমিত হলে তিনি বললেন, কারও থাকার কথা নয় কেন? কোথায় গেছে সব?
লোকটা আবার একটা পিলে-চমকানো হুংকার দিল, পেন্নাম করেছিস? সাধু সন্ত দেখলে পেন্নাম করতে হয় জানিস না?
হেমকান্ত দ্বিধায় পড়লেন। সাধুসঙ্গ বড় একটা করেননি জীবনে। প্রণামের পাটও বহুকাল চুকে গেছে। অভ্যাসই নেই। একটু ইতস্তত করে প্রণামের জন্য এগিয়ে যেতেই সাধু ফের হুংকার দিল, ছুঁতে নেই। দূর থেকে গড় কর।
হেমকান্ত মাটির ওপর হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নোয়ালেন। উঠে বললেন, আমি আমার ছেলের খোঁজে এসেছি। শুনেছি সে বীরুবাবুর দলের সঙ্গে ছিল।
সাধু দাঁত কিড়মিড় করছিল। রাগে না কোনও শারীরিক কারণে তা কে বলবে! তবে এবার একটু গলার পর্দা নামল। বলল, তারা এখানে থাকবে কেন? বোকা নাকি? পুলিশ আসবে খবর পেয়ে কালই সব সরে পড়েছে।
শুনলাম গুলিগোলা চলেছে।
ওই উত্তরে আরও মাইল দুই দূরে একটা পাটখেত আছে। সেখানে খুব লড়াই হয়েছে। দুটো মরেছে। এ পক্ষের একটা, ও পক্ষের দুটো।
দারোগাবাবু ছাড়া আর কে?
তা জানি না। তোর ছেলে কত বড়?
বেশি বড় নয়।
বাচ্চা নাকি?
ঠিক তাও নয়।
খোঁজ নে। নাম কী বল তো।
কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী।
তোর নাম কী?
হেমকান্ত চৌধুরী।
অ! তোরা সেই জমিদার বুঝি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তা তোর বংশের ছেলে স্বদেশি করছে কী রে! আঁ। এ যে দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ! দে, কিছু প্রণামী দে।
হেমকান্ত বিরক্ত হলেন। মাগুনে লোককে দুচোখে দেখতে পারেন না। তাই চুপ করে রইলেন।
সাধু একটা গা-জ্বালানো হাসি হেসে বলল, তুই কৃপণ নাকি?
হেমকান্ত গম্ভীর মুখে বললেন, প্রণামী কীসের? আমি প্রণামী-টনামী দিই না।
হাড়-কেপ্পন কোথাকার! কৃপণের বড় কষ্ট তা জানিস! টাকার ওপর বসে থেকেও ভোগ করতে পারে না। জ্যান্ত যম। তুই কৃপণ কেন?
কৃপণ কে বলল?
তবে প্রণামী দিচ্ছিস না কেন? দে, দে, দিয়ে ফেল। যত দিবি তত বাঁচবি।
সাধু বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিল। হেমকান্ত বিরক্ত বোধ করলেন। লোকটার হাবভাব সন্দেহজনক এবং ব্যবহার অপমানকর। তাঁকে তুই করে বলে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। অন্য সময় হলে তিনি লোকটাকে উপেক্ষা করে স্থানত্যাগ করতেন। কিন্তু এখন ছেলের জন্য চিন্তায় তার বুক শুকিয়ে আছে। এ লোকটা কিছু খবর দিতে পারে বলেই মনে হয়। এ পক্ষের দুজন মরেছে, তাদের মধ্যে কৃষ্ণ নেই তো?
হেমকান্ত পকেট থেকে একটা টাকা বের করে লোকটার হাতে দিয়ে বললেন, স্বদেশিদের মধ্যে যে দুজন মারা গেছে তাদের নাম কী?
সাধু টাকাটা কাঁধের একটা গেরুয়া ঝোলায় রেখে বলল, তোর ছেলে মরেনি। ভয় নেই। তবে মরবে।
তার মানে?
দারোগাটাকে ওই মেরেছে কিনা।
ও মেরেছে?–হেমকান্ত হাঁ করে রইলেন।
মেরেছে বলতে মেরেছে! একেবারে সাক্ষাৎ নিজের হাতে।
বাজে কথা।
আমি নিজের চোখে দেখেছি, বুঝলি ব্যাটা!
হেমকান্ত তবু চেয়ে রইলেন। চোখে অবিশ্বাস। কিছুক্ষণ কথাই এল না মুখে। তারপর বললেন, আমার ছেলে এ কাজ করতে পারে না।
সাধু চারপাশটা একটু দেখে নিল। তারপর মৃদু একটু হেসে বলল, সংসারী মানুষের অনেক দোষ রে শালা। একটা দোষ কী জানিস? বড় মায়ায় জড়িয়ে পড়ে। ওই মায়ার চোখ দিয়ে দেখে বলে ছেলেপুলে সম্পর্কে সত্যি কথাটা মানতে চায় না। ভাবে, লোকে বানিয়ে বলছে।
আপনি দেখেছেন?
বলছি না, নিজের চোখে দেখেছি।
কী দেখেছেন?
সে তোকে বলব নে? একটা টাকা দিয়ে কি মাথা কিনেছিস নাকি?
হেমকান্ত ভারী অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, টাকা দিয়ে মাথা কিনব কেন?
তোদের চিনি না ভেবেছিস? টাকাটা দিলি, কিন্তু ঘেন্না করে দিলি, দিয়েই নানারকম খোঁজ খবর করতে লাগলি। ভাবছিস টাকা যখন দিয়েছি তখন এই জন্তুটা সব গড়গড় করে বলে দেবে!
হেমকান্ত আসলে তাই ভেবেছিলেন। কিন্তু লোকটা তা বুঝল কী করে? হেমকান্ত লজ্জিত হয়ে বললেন, তা ভাবছি না। আমি আমার ছেলের জন্য বড় দুশ্চিন্তায় আছি।
তোর ছেলে। তোর ছেলে হবে কেন? ছেলে কি তোর নিজের হাতে গড়া? ছেলে ভগবানের, তুই নিমিত্তমাত্র। বাড়ি যা, গিয়ে কথাটা বসে বসে ভাব। শান্তি পাবি।
ঘটনাটা বলবেন না?
খটমটে এবং খিটখিটে সাধুটা হঠাৎ ফোকলা একটা হাসি হাসল। বলল, খুব জানতে ইচ্ছে করছে?
জানা দরকার। ছেলেটার কী হল, না জানলে স্বস্তি বোধ করছি না।
তা হলে আর-একটা টাকা দে। দেখিস অবহেলায় দিস না।
হেমকান্ত বিনাবাক্যে আর-একটা টাকা বের করে সাধুর বাড়ানো হাতে দিলেন।
সাধু সেটা ঝোলায় পুরে বলল, আমি কিন্তু স্বদেশিদের দলের নই। দেখিস বাবা, পুলিশ লেলিয়ে দিস না। ওরা বড় মারে শুনেছি।
না, আপনি বলুন। আমি বড় অশান্তিতে আছি।
বলছি। আয়, ওই সর্ষেখেতের মধ্যে গিয়ে বসি। এ জায়গায় লোকজন এসে পড়বে।
হেমকান্ত রাজি হলেন। সাধু তাদের সর্ষেখেতের মধ্যে নিয়ে এল। এবড়ো খেবড়ো জমির ওপর গাট হয়ে বসে সাধু বলল, আমি ওই পাটখেতের ধারে একটা বটগাছের তলায় থাকি। স্বদেশিরা ছিল দশ বারো জন। সকলের মুখ চিনি। কাল মাঝরাতে ঘুমিয়ে ছিলাম, এমন সময় গুলিগোলার আওয়াজ শুনে উঠে পড়ি। ধুনিটা উসকে দিয়ে মজা দেখি, পাটখেতের মধ্যে কুরুক্ষেত্তর হচ্ছে। অন্ধকারে ভাল দেখা না গেলেও দৌড়ঝাপ হুড়োহুড়ি খুব বোঝা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ এরকম চলার পর একটা দশাসই লোক, তার গায়ে পুলিশের পোশাক, দৌড়ে পালিয়ে আসছিল। তার ডান হাত দিয়ে খুব রক্ত গড়াতে দেখেছি।
তারপর?
তার হাতে একটা খেটে বন্দুক ছিল, কিন্তু মনে হয় তাতে গুড়ুল ছিল না। লোকটা ছুটতেও পারে তেমন। ইয়া লাশ, খেয়ে দেয়ে শরীরে খুব ননী লাগিয়েছে। হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাফাচ্ছিল। এসে সটান পড়ল আমার ধুনির সামনে, বাবা গো, বাঁচাও।
আপনার কাছে?
তবে আর বলছি কী? আমি বুঝতে পারছিলাম, ব্যাটার আয়ু বেশিক্ষণ নয়। লোকটা পড়তেই পাটখেত থেকে বড় একটা দা হাতে একটা ভারী সুন্দর চেহারার ছেলে বেরিয়ে এল। পরনে ধুতি, গায়ে একটা বালাপোশের কোট। খুব ফরসা, লম্বা আর মজবুত তার চেহারা।
হেমকান্ত ড়ুকরে উঠলেন, কৃষ্ণ!
তা আর বলতে।
তারপর কী হল?
নিজের চোখে দেখেছি বললাম না। আমার চার হাতের মধ্যে ঘটনা। সেই ছোড়া এসে এক কোপে ঘাড়টা অর্ধেক নামিয়ে দিয়ে এক দৌড়ে চলে গেল।
হেমকান্ত শিউরে চোখ বুজলেন। দৃশ্যটা তিনি মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছিল। খুন এ বংশের রক্তে নেই। যতদূর তিনি জানেন, তাঁর পূর্বপুরুষেরা কেউই খুন করেননি বা কাউকে লাগিয়ে অন্য কাউকে খুন করাননি। লেঠেল বা পোষা গুন্ডা থাকা সত্ত্বেও। তা হলে কৃষ্ণ এ কাজ করল কী করে? তার ছেলে হয়ে তিনি যে পিপড়ে মারতেও মায়া বোধ করেন!
সাধু হেমকান্তর মুখের ভাব লক্ষ করছিল। কথা বলল না। কিন্তু মৃদু-মৃদু হাসতে লাগল।
হেমকান্ত চোখ খুলে সাধুর মুখের সেই হাসি দেখে কোঁচকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, তারপর?
আর কী? অন্ধকারে তেমন কিছু দেখারও ছিল না। টর্চের আলো পড়ছিল খুব এধার ওধার। শেষ অবধি কয়েকটা পুলিশ কাঁকাতে কাঁকাতে পাটখেত থেকে বেরিয়ে এসে আমার ওপর হামলে পড়ল। দারোগাকে কে খুন করেছে, তা তাদের বলতে হবে।
আপনি বললেন?
পাগল নাকি? বললে স্বদেশিরা এসে কেটে রেখে যাবে না আমাকে? তাই আমি সাফ বলে দিয়েছি ভয়ে ভিরমি খেয়ে পড়ে ছিলাম, কিছু দেখিনি।
তারা বিশ্বাস করল?
সে তারাই জানে। তবে সাধু দেখে আর ঘটায়নি।
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তারা হিন্দু বলে সাধু দেখে ছেড়ে দিয়েছে। ধর্মান্ধ ভিতু জাত তো। কিন্তু এরপর সাহেব আসবে। তারা ছেড়ে কথা কইবে না। দরকার বোধ করলে বেঁধে থানায় নিয়ে বেত মারবে। তখন কী করবেন?
সাধু বড় বড় চোখে চেয়ে বলল, তাই করে নাকি ম্লেচ্ছগুলো?
করে। ওদের অত ধর্মভয় নেই।
তা হলে তো ঝুলিয়েছিস আমাকে।
আপনি বরং এক কাজ করুন। কিছু টাকা দিচ্ছি, এখান থেকে সরে পড়ুন। কাউকে কিছু বলবেন না।
সাধু তৎক্ষণাৎ হাতটি পেতে বলে, দে তা হলে।
যাবেন?
যাব বলেই তো বেরিয়ে পড়েছি। আমি কি বোকা? দে, তাড়াতাড়ি দে।
হেমকান্ত পকেটে হাত দিয়ে বললেন, পাচটা টাকা দিলে হবে তো?
তুই খুব কৃপণ। দে, তাই দে। কৃপণের বড় টাকার কষ্ট রে।
হেমকান্ত টাকাটা দিয়ে বললেন, স্বদেশিরা কোনদিকে গেছে জানেন?
সেটা জেনে কী হবে? তারা কি কোথাও বসে থাকবে? যে যেদিকে পারে পালিয়েছে। বাড়ি যা।
কোনও হদিশ দিতে পারেন না?
ছেলের জন্য ভাবছিস তো! পাগল। ছেলে যে তোর নয় এটা বুঝবার চেষ্টা কর গে। যখন ছোট ছিল তখন পেলেছিস, পুষেছিস, এখন দুনিয়ার হাতে ছেড়ে চলে যা।
ছেলেটা যে বড় ছোট।
আমি কত বছর বয়সে সন্ন্যাস নিই জানিস?
কত বছর?–বলে হেমকান্ত বিস্মিত চোখে তাকালেন।
শুনলে হাসবি। মায়ের বুকে দাগা দিয়ে বাবাকে কাঁদিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তাও এ জন্মে বুঝি সিদ্ধি হল না। ফের আসতে হবে।
দার্শনিক কথাবার্তা হেমকান্তর এখন সহ্য হচ্ছিল না। সাধুদের তিনি দুচোখে দেখতেও পারেন না। বিরস মুখে বললেন, না জানলে বলবেন না। কিন্তু পুলিশের হাতেও পড়বেন না যেন।
সাক্ষী রাখতে চাস না তো! আমিও কি সাক্ষী থাকতে চাই রে? কী যে সব হুড়যুষ্টু বাবা, মানেই খুঁজে পাই না।
এই বলে সাধু উঠল। বলল, তোদের তো নৌকো আছে।
আছে।
তবে আমাকে শম্ভুগঞ্জে পৌঁছে দে। ওখান থেকে হাঁটা দেব।
কোনদিকে যাবেন?
ওরে তোর ভয় নেই। আমি গারো পাহাড় পেরিয়ে হিমালয়ের দিকে চলে যাব। সাহেব আমাকে খুঁজে পাবে না।
না পাওয়াই দরকার। আপনি যদি সাক্ষী দেন তবে আমার ছেলের ফাঁসি হবে।
জানি। আমি কারও নিমিত্ত হতে চাই না, এবার ওঠ। বেলা হল।
হেমকান্ত উঠলেন।
সাধুকে শম্ভুগঞ্জে এক আঘাটায় নামিয়ে দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে ফিরে এলেন বাড়িতে। যখন এলেন তখন সারা শহর থমথম করছে। রাস্তায় লোজন নেই। বাচ্চারা পর্যন্ত চলাফেরা করছে না।
রঙ্গময়ি অপেক্ষায় ছিল। হেমকান্ত বাড়িতে পা দিতে না দিতেই ছুটে এল।
কোথায় গিয়েছিলে?
হেমকান্তর ভিতরটা দুশ্চিন্তায় কেমন বোবা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ রঙ্গময়ির দিকে চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বললেন, পাওয়া গেল না।
তুমি ওকে খুঁজতে গিয়েছিলে?—রঙ্গময়ি রীতিমতো ধমক দেয়।
কেন? তাতে দোষ হয়েছে?
খুঁজতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবে যে!
তার মানে?
স্বদেশিরা যদি কৃষ্ণকে নিয়ে গিয়ে থাকে তবে ওরাই ওকে দেখবে। কিন্তু তোমাকে কেউ দেখবে না।
তার মানে?
তোমাকে রক্ষা করার কেউ তো নেই।
আমার কী হবে?
কী হয়েছিল মনে নেই?
হেমকান্ত একটু চুপ করে থেকে বললেন, এর চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি এই মনের ভার আর বইতে পারব বলে মনে হয় না।
পারতে হবে। কৃষ্ণর জোরই তো তুমি। কত ভালবাসে তোমাকে।
এই কি ভালবাসার লক্ষণ?
নয় কেন?
একবার বলেও গেল না কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে।
ঠিক কাজই করেছে। এ তুমি বুঝবে না। তবে একথা জেনো, ও তোমাকে যত ভালবাসে তত আর কাউকে নয়।
ভালবাসা নিয়ে জোর জবরদস্তি দাবি তর্ক কিছু চলে না, ভালবাসার বিচারও বোধহয় এক জীবনে শেষ হয় না। হেমকান্ত তাই তর্ক করলেন না। খুব সংশয়পূর্ণ এবং বিষণ্ণ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন রঙ্গময়ির দিকে। তার আজ মনে হচ্ছিল, কৃষ্ণর সবই ভাল, কিন্তু ওর মনটা বড় নিষ্ঠুর প্রকৃতির। মায়া দয়া কিছু কম।
হেমকান্ত নিজের ঘরে এসে চুপচাপ বসে রইলেন। মাথার মধ্যে চিন্তার একটা ঘূর্ণিঝড়। সাধুর কথা কি তিনি বিশ্বাস করবেন? এ কি সম্ভব?
বাড়িটা আজ খুবই নিস্তব্ধ। কিন্তু হেমকান্ত আজ তাঁর পুত্রকন্যা পুত্রবধূ এবং নাতিনাতনিদের কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছিলেন না। সম্ভবত তাদের কানেও গুজবটা পৌঁছে গেছে। হেমকান্ত অস্থির হলেন না। খুব সামান্য বিপদ ঘটলেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি বড় অস্থির হয়ে উঠতেন, অসহায় বোধ করতেন। আজ তা হচ্ছিল না। একটা বিষাদ অনুভব করছিলেন তিনি। খুব গভীর বিষাদ।
দুপুরে বিশাখা খুব ভয়ে ভয়ে তার কাছে এসে বলল, সকাল থেকে কিছু মুখে দেননি। এবার দুটো খাবেন চলুন।
খাওয়ার কথায় হেমকান্ত খুব বিস্মিতভাবে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। তারপর বললেন, তোমরা খেয়েছ?
বিশাখা মাথা নাড়ল, নাড়তে গিয়ে তার চোখ থেকে অবাধ্য জল খসে পড়ল গাল বেয়ে। ফোঁপানির শব্দ হল। ঠোঁট দাঁতে কামড়ে কান্না সামলানোর চেষ্টা করল সে।
হেমকান্ত মেয়ের মুখ লক্ষ করে শান্ত কণ্ঠে বললেন, কাঁদছ কেন? কান্নার কিছু নেই। সে বেঁচে আছে খবর পেয়েছি।
বিশাখা চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে চেয়ে বলল, বেঁচে আছে? কার কাছে খবর পেলেন?
তোমরা কি ধরে নিয়েছিলে যে সে মারা গেছে?
আমরা কী ভাবব তা বুঝতেই পারছি না। কত লোক এসে কত কী বলে যাচ্ছে।
কী বলছে?
একজন বলে গেল, গুলি লেগেছে। হাসপাতালে। হাসপাতালে খবর নিয়ে জানা গেল, বাজে কথা। আবার একজন এসে বলল, নদীতে লাশ পাওয়া গেছে। কেউ বলছে, স্বদেশিদের দলের সঙ্গে চলে গেছে।
হেমকান্ত চাপা একটা সতর্কতাসূচক শব্দ করে বললেন, যে যা বলুক শুনে যাও। নিজেরা কারও কাছে কিছু কবুল কোরো না। তবে সে যে বেঁচে আছে এটা বোধহয় বিশ্বাস করা যায়।
কোথায় আছে?
সেটা বলা যাবে না। তাছাড়া তার এখন এ বাড়িতে পা না দেওয়াই ভাল।
কিন্তু বাবা, তার যে ভাল জামাকাপড় সঙ্গে নেই। কী খাচ্ছে, কোথায় শুচ্ছে, তা কি জানেন?
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, কিছুই জানি না। জানার উপায়ও নেই। এমনকী সে যে বেঁচে আছে এটাও খুব সূক্ষ্ম সূত্রে খবর পেয়েছি। সুতরাং কারও কাছে কিছু বোলো না। বললে তার বিপদ, আমাদেরও বিপদ।
বাড়ির সবাই যে দুশ্চিন্তায় কণ্ঠায় প্রাণ নিয়ে বসে আছে।
থাকুক। বাড়ির লোককেও বলা ঠিক হবে না। সকলের মনের জোর তো সমান নয়।
কিন্তু কেউ খেতে চাইছে না, শুতে চাইছে না, কাঁদছে।
এক কাজ করে তা হলে। সবাইকে জানিয়ে দাও যে, একজন এসে জানিয়ে গেছে কৃষ্ণ অন্যত্র চলে গেছে। কিন্তু কথাটা যেন বাইরের লোক জানতে না পারে। কেউ জিজ্ঞেস করলে সবাই বলবে, জানি না।
বিশাখা এই হেঁয়ালিতে খুশি হল না। কিন্তু মেনে নিল। মাথা নেড়ে বলল, আপনাকে কিছু খেতে দিই।
বেঁচে থাকতে হলে খেতে তো হবেই। কিন্তু আজ আর অন্নব্যঞ্জন গলা দিয়ে নামবে না। আমাকে বরং একটু সরবত দিতে বলো। আর তোমরা যা পারো একটু খাও।
বিশাখা ধীর পায়ে চলে গেল। হেমকান্ত আবার চোখ বুজলেন এবং প্রিয় পুত্রটির কথা চিন্তা করতে লাগলেন।