ধ্রুব আধবোজা চোখে নোটনের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই চেয়ে থাকে।
বলতে নেই নোটনের মুখখানা ভারী ছমছমে সুন্দর। আভিজাত্য নেই ঠিকই, কিন্তু চটক আছে, যৌন আবেদন আছে। নোটনের মুখে আভিজাত্যের ছাপ থাকার কথাও নয়। কিন্তু একটু পবিত্রতা আশা করা যেত। কারণ ওর দাদু আর দাদুর বাবা দুই পুরুষ ধরে ধ্রুবদের দেশের বাড়ির বাঁধা পুরুত ছিল। গুরুগিরি করত। নোটন মনু ঠাকুমার দাদার সাক্ষাৎ নাতনি। ওই তেজস্বিনীর রক্তের উত্তরাধিকার এর মধ্যে কিছুটা থাকার কথা ছিল।
নোটনের মুখের দিকে চেয়ে এইসবই বোধহয় খুঁজছিল ধ্রুব।
কিন্তু নোটন সেই চোখের অন্যরকম মানে করে সিটিয়ে গিয়ে বলল, ওরকম তাকিয়ে আছ কেন?
আমার চোখকে ভয় পাস?
পাই না আবার? যা রাগী তুমি!
রাগী বলে ভয় পাস, না কি নিজের মনে পাপ আছে বলে?
একথায় নোটনের চোখ ছলছল করতে লাগল। কতটা অভিনয়, কতটা সত্যিকারের অভিব্যক্তি তা ধরা মুশকিল। ধ্রুব সেটা বোঝার জন্যই নোটনের ক্রন্দনোন্মুখ মুখখানার দিকে ফের একদৃষ্টে চেয়ে থাকে।
নোটন হাঁটু জড়ো করে বসেছে, দুহাতে জড়ানো দুই হাঁটু, তার ওপর থুতনি ছিল। এখন মুখটা সরিয়ে আঁচলে চোখ মুছে বলল, আজ কেবল বকবেই বুঝি?
বকেছি নাকি? কই, বুঝতে পারিনি তো?
বকেছ। বকতে তোমরা পারো, কিন্তু আমাদের অবস্থাটা তো জানতে না!
মুকুল এখন কোথায়?
নোটন তার কচি ঠোঁট ভারী সুন্দর ভঙ্গিতে উলটে বলল, কী জানি কোথায়? আগে ভাবতাম ঠিক একদিন ফিরে আসবে, সংসারের দায়িত্ব নেবে। এখন আর ওসব ভাবি না। কোথাও আছে বোধহয়, হলে মরেটরে গেছে।
তোরা খোঁজ করিসনি। ঠিকমতো খোঁজ করলে পাত্তা পাওয়া যেত।
পেয়ে লাভ কী? শুধু মা একটু ঠান্ডা হত, আর কী হবে বলো? বেকার ছেলেরা বাড়ি বসে বসে কেবল গার্জিয়ানি করে ছোটদের ওপর। গেছে ভাল হয়েছে।
ধ্রুব স্থির দৃষ্টিতে দেখছিল নোটনকে। মায়ের পেটের দাদা সম্পর্কে এত ঔদাসীন্য খুব স্বাভাবিক নয়। তবে বোধহয় অস্বাভাবিকতাই আজকাল স্বাভাবিক। মানুষের মন আজকাল এরকমই।
ধ্রুবর শরীর এখন ততটা খারাপ লাগছিল না। শুধু গলা পর্যন্ত অম্বলের একটা জ্বালা। অম্বল আজকাল সবসময়কার সঙ্গী। এর ভয়ে সে মদ খায় না, তবু হচ্ছে। শরীরে ঝিমুনির ভাবটাও আছে। কিন্তু নোটনের সামনে বসে থেকে শরীরকে খুব একটা টের পাচ্ছিল না সে। নোটনের এই অধঃপতন তার নিজেরও ব্যক্তিগত অপমান বলে মনে হচ্ছে। তেমন কোনও কারণ নেই মনে হওয়ার। সামান্য যে কারণটা ছিল তাকে কারণ বলে না ভাবলেই হয়। বেশ কয়েক বছর আগে নোটনের সঙ্গে তার একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল নোটনের মা। কৃষ্ণকান্ত তাদের ওই স্পর্ধায় এমন চটে গিয়েছিলেন যে শুধু হাতে-মারা বাকি ছিল। কিন্তু কৃষ্ণকান্ত শেষ অবধি ভাতে ওদের ঠিকই মেরেছেন। নোটনের দাদা মুকুল কৃষ্ণকান্তর ওকালতি ব্যাবসার কেরানি ছিল। ডালহৌসির অফিসে বসত। একটু কুঁড়ে ছিল ছেলেটা, কামাই করত। এছাড়া তেমন কোনও দোষের কথা ধ্রুব জানে না। কৃষ্ণকান্ত মুকুলকে তাড়ালেন তো বটে, তার আগে যথেষ্ট অপমান করলেন। সম্ভবত মুকুলের আত্মসম্মান জ্ঞান কিছু প্রখর ছিল। সে সেই যে পালাল আর কখনও ফিরে আসেনি। নোটনদের অবস্থা খারাপই ছিল, আরও খারাপ হতে লাগল। মনু ঠাকুমা ওদের আশ্রয় দিতে পারত, দেয়নি। মনু ঠাকুমার অন্ধ এক মেহ আছে কৃষ্ণকান্তর ওপর। তার ধারণা কৃষ্ণ সাধারণ ছেলে নয়, দেবতার অংশ। কৃষ্ণ কখনও ভুল করে না, অন্যায় করে না।
কৃষ্ণকান্ত সম্পর্কে এরকম হঠকারী ধারণা আরও অনেকেরই আছে। যেমন ছিল ধ্রুবর দাদু হেমকান্তর। তার ধারণা ছিল, কৃষ্ণকান্ত ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হবে। দেশের আরও অনেক আহাম্মকেরই সম্ভবত এরকম কোনও ধারণা ছিল। কৃষ্ণকান্ত প্রধানমন্ত্রী না হলেও ভারতবর্ষের রাজনীতিতে নিজস্ব একটা জায়গা করে নিতে পেরেছেন এইসব ধারণাকে ভাঙিয়েই।
ধ্রুবর স্থির ও অনুসন্ধানী চোখের ওপর চোখ রাখতে পারল না নোটন। মুখ নামিয়ে নিল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, আমাদের তোমরা শেষ করে দিতে চেয়েছিলে, ধ্রুবদা। দেখো, আমরা শেষ হয়ে গেছি।
ধ্রুব একটা বড় রকমের শ্বাস ছেড়ে বলল, নাটক-ফাটক করিস নাকি?
চকিতে একবার মুখের দিকে চেয়ে নোটন বলল, করি। করব না কেন?
তাই বেশ সাজানো ডায়ালগ দিচ্ছিস।
সাজানো হবে কেন? কথাটা খারাপ শোনাতে পারে, কিন্তু সত্যি কি না বলো!
আমি তোদের শেষ করতে চেয়েছি একথা কে বলল?
তোমার কথা তো বলিনি। বলেছি তোমরা।
আমরা বলতে কে কে?
ধরো জ্যাঠামশাই।
জ্যাঠামশাই থার্ড পার্সন সিংগুলার নাম্বার। তোমরা বলতে তাকে বোঝায় না।
ও বাবা, অত কথা আমি জানি না। শুধু জানি তোমরা সব একরকম।
খুব জানিস তো!
রাগ কোরো না, ধ্রুবদা। আমি তোমাদের নিন্দে করছি না।
ভয় পাচ্ছিস কেন? রাগ করলেও আমি তো কোনও ক্ষতি করব না। করার সাধ্য নেই।
নোটন মাথা নিচু করে বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, দাদার দোষ থাকতেই পারে। কিন্তু আমরা তো কোনও অন্যায় করিনি। মনু ঠাকুমা পর্যন্ত আমাদের দূর দূর করে খোল।
ধ্রুব একটু হাসল। নোটন বোধহয় জানে না ওদের ওপর কৃষ্ণকান্তের এত রাগের প্রকৃত কারণটা কী। তাই সে বলল, তোর দাদার দোষটাই বড় নয় রে, নোটন। আরও একটা ব্যাপার আছে।
নোটন একটু চমকে উঠে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলল, কী বলল তো!
তুই কি জানিস না?
নোটন কী ভেবে হঠাৎ ফের মাথা নিচু করে বলে, সে তো জানি। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব তো?
তবে জানিস।
সেটা মার খুব ভুল হয়ে গিয়েছিল।
ভুল! ভুল কীসের?
মা তোমাকে দেখে একেবারে মুগ্ধ। তারপর মা-মরা ছেলে বলে বোধহয় মায়াও ছিল খুব। আমাকে অনেক অল্প বয়েস থেকে মা শিখিয়েছিল, ওই ধ্রুবই তোর বর।
বটে! তুইও তাই ভাবতি?
ভাবব না! শিবরাত্তিরে শিবের মাথায় জল ঢালতে পর্যন্ত তোমাকে ভাবতে হয়। এক সময়ে সেটাই তো বিশ্বাস করতাম।
ধ্রুব হাসতে গিয়েও একটু লাল হল লজ্জায়।
নোটন একটু বিষণ্ণ গলায় বলে, মা তো বোকা, তাই ওই কাণ্ড করেছিল। মনু ঠাকুমা মাকে বহুবার বলেছে, ও কাজ করতে যেয়ো না, কৃষ্ণ খেয়ে ফেলবে। তবু মা কেমন বেহেড হয়ে গেল। কিন্তু সেইজন্যই কি জ্যাঠামশাইয়ের এত রাগ!
ধ্রুব একটা শ্বাস ফেলে বলে, সামন্ত রক্ত তো, চট করে গরম হয়। শোন নোটন, তোরা ফুর্তি কর। আমি চুপি-চুপি কেটে পড়ি।
নোটন একটু কাছে সরে এসে বলে, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে শরীর ভাল নেই। কী হয়েছে বলল তো!
অম্বল। আজকাল হচ্ছে খুব।
এখনও কি ড্রিংক করো?
করি। ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
আমার বাবা বলত তোমাদের বংশে নাকি মদের চলন নেই। কেউ কখনও খায়নি। তাই বাবার ধারণা ছিল, তুমি বোধহয় মদ খেয়ে মরেই যাবে। সহ্য হবে না।
ধ্রুব একথাটায় হাসল না। তবে মাথা নেড়ে বলল, মদ খেতে হলে হেরিটেজ দরকার হয় না। তবে একথাটা ঠিক যে আমার নেশাও নেই। জোর করে খাই। না খেলে কিছু ফিল করি না।
জোর করে খাও কেন?
তোকে কেন বলব?
কেন বলবে না?
সব কথা তোর জানার দরকার নেই।
নোটন আচমকা লঘু গলায় বলে, ভুলে যাচ্ছ কেন আমি তোমার বউ হলেও হতে পারতাম।
এই প্রগভতা ধ্রুব নীরবে সহ্য করল। তবে একটু বাদে তেতো গলায় ছোট্ট করে বলল, ভাগ্য ভাল যে হোসনি।
কেন? ভাগ্য ভাল কেন বলছ?
বড্ড দুনম্বরি হয়ে গেছিস রে, নোটন।
বিয়ে হলে হতাম?
যারা হয় তাদের মধ্যে বীজাণু থাকে।
নোটন হঠাৎ খামচে ধরল ধ্রুবর হাত। প্রবল শ্বাসের সঙ্গে তীব্র স্বরে বলে, কক্ষনও নয়! কিছুতেই নয়। বরং বিয়ে করেনি বলেই আজ আমি এরকম। এখনও তোমার ওপর রাগে অভিমানে আমি অনেক সময় একা ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি।
ভুল করিস।
করি তো। কিন্তু কী করব? মা কেন ভুল শিখিয়েছিল?
সে তোর মা জানে আর তুই জানিস। শোন এখন সিন ক্রিয়েট করে লাভ নেই। তোর একটা ছোটভাই আছে না?
আছে। চঞ্চল।
তার বয়স বোধহয় পনেরো-যোলো হল!
বেশি। আঠারো।
আমার কাছে চঞ্চলকে আসতে বলিস।
চাকরি দেবে?
দিতে পারি।
কত টাকা মাইনের চাকরি?
হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
নোটন একটু হাসে, আমাকে এসব করতে দেবে না তো? কিন্তু এসব করে আমি যা রোজগার করি, চঞ্চল তার অর্ধেক টাকাও মাইনে না পেলে তো হবে না।
ধ্রুব ফের স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে, স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং খুব বেড়েছে তা হলে! আঁ!
একটু বেড়েছে। আর শোনো, আমার ভাল করতে চেয়ো না।
তোর ভাল করতে কে চাইছে! ভালই তো আছিস। আমার আবার বেশি সতীপনা ভালও লাগে। চঞ্চলকে চাকরি দিতে চাইছি তোর জন্য নয়। অন্য কারণে।
কী কারণ সেটা তো বলবে।
একটা প্রায়শ্চিত্ত করতে।
কীসের প্রায়শ্চিত্ত?
আমার বাবা বিনা দোষে তোর দাদাকে তাড়িয়েছিল। আমি বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।
নোটন খানিকক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইল। তারপর হঠাৎ মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
ধ্রুব খুব ধীরে ধীরে উঠল। কিছু না বলে আস্তে আস্তে পিছনের ফটকের দিকে এগোতে লাগল। বেলা পড়ে এসেছে। সামনের দিক থেকে মাতাল গলার কিছু স্তিমিত কোলাহল আসছে। এখন কেউই আর স্বাভাবিক নেই।
কয়েক পা এগোতেই নোটন ডাকল, কোথায় যাচ্ছ?
চলে যাচ্ছি।
একটু দাঁড়াও। আমার দরকার আছে।
আমার সঙ্গে তোর আর দরকার কীসের?
আছে। শোনো, আমি তোমার সঙ্গে যাব।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, পাগল? ওরা তোকে পয়সা দিয়ে এনেছে। ছাড়বে কেন?
নোটন উঠে এসে ধ্রুবর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, সবাই ডেড-ভ্রাংক। কেউ টের পাবে না।
ড্রাংকদের আমি চিনি রে, নোটন। ঠিক টের পাবে।
তাছাড়া টাকা আমি সবটা আগাম নিয়ে নিয়েছি।
কত দিয়েছে?
হাজার।
বাঃ, তোর রেট তো ভাল।
নোটন মাথা নামায়।
ধ্রুব বলে, দিনে হাজার হলে তোর মাসের রোজগার ত্রিশ হাজার।
মোটেই নয়। এরা বেশি দিয়েছে। তাছাড়া সব দিন এসব হয় নাকি?
এরা তোকে বেশি দিল কেন?
জেদাজেদি করে।
সেটা কীরকম?
আমি ফিলমে ছোটখাটো রোল করি, জানো?
শুনেছিলাম। তোর ছবি আমি দেখিনি। একটাও।
দেখবে কী? রিলিজই হয়েছে মাত্র দুটো। একটা সুপার ফ্লপ।
তারপর বল রেট বেশি পেলি কেন?
আজ আমার শুটিং ডেট ছিল। ডিরেক্টর ছাড়বেন না, এরাও ছাড়বে না। টানাটানিতে হাজার টাকা পেয়ে গেলাম।
বাঃ, ব্যাবসার মাথা তো পরিষ্কার।
ঠাট্টা করছ?
না। শুধু ভাবছি এত টাকা পেয়েও যদি পালিয়ে যাস তবে পরে এরা বদলা নেবে কি না।
নিলে নেবে। কিন্তু তোমাকে দেখার পর আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
কেন? আমি কী দোষ করলাম?
কী করেছ তা জানি না। কিন্তু আমাকে নিয়ে চলো।
নিয়ে যাওয়ার কী আছে! হেঁটে বা রিকশায় স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চাপলেই কলকাতা।
আমাকে এত ঘেন্না করো কেন, ধ্রুবদা?
ঘেন্না কেন হবে? ওয়ার্কিং গার্লদের ঘেন্না করার কী আছে? তবে তোকে বলি, যা তোর রেট বলছিস তার দশ ভাগের এক ভাগ মাইনেও চঞ্চলকে কেউ দেবে না।
নোটন একটু হাসল। বলল, তোমার প্রেস্টিজে লাগছে, না?
লেগেছে একটু। এসব করে রোজগার করছিস তারও আবার দেমাক কীসের?
দেমাক তোমাকে দেখাব না তো কাকে দেখাব? তোমার ওপরেই যে আমার সবচেয়ে বেশি রাগ।
সে তো বুঝলাম, রাগ থাকতেই পারে। কিন্তু এদের কেন বঞ্চিত করবি? পরে হয়তো ঝামেলা করবে।
করবে না।
কেন করবে না?
আমি বলব, ধ্রুব চৌধুরী আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
তাতে কী হবে? ওরা মানবে?
খুব মানবে। তোমাকে ওরা ভীষণ ভয় খায়।
তা বলে আমার বদনাম দিবি?
বদনাম একটু নাও ধ্রুবদা, আমার জন্য নাও। বিয়ে করোনি আমাকে, তোমার জন্য কম দুঃখ সইতে হয়নি, তার বদলে এটুকু বদনাম সহ্য করবে না?
কিন্তু এই নাটকটারও দরকার ছিল না।
ছিল। আজ শুধু তোমার সঙ্গে অনেকটা পথ ফিরব। আর-কোনওদিন হয়তো সুযোগ হবে না।
ধ্রুব ‘হা!’ জাতীয় একটা শব্দ করে বলল, চল তা হলে। আর দুটো মেয়ে কোথায়?
খুব খেয়ে পড়ে আছে।
বাগানের চোরাপথে গাছপালার আড়ালে ফটকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ধ্রুব হঠাৎ কী ভেবে একটু চোখ ফেরাল। দেখল, প্রশান্ত উঠোনের পাশটায় দাঁড়িয়ে সোজা তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
একজন দেখছে।–নোটন চাপা গলায় বলল, বলেই ঘোমটা তুলে মুখ আড়াল করল।
ধ্রুব বলল, ভয় নেই। ও প্রশান্ত। আমার খুব ইন্টিমেট ফ্রেন্ড।
ওকে ডেকো না তা বলে। আজ শুধু তুমি আর আমি।
এ যে আধুনিক গানের লাইন রে। ভ্যাট।
প্লিজ ধ্রুবদা, পায়ে পড়ি।
ডাকব কেন? প্রশান্ত এখন অনেক খাবে। যাবে না। তোর ভয় নেই।
দুজনে নিঃশব্দে রাস্তায় এসে পড়ল। ধ্রুব একটা রিকশার জন্য এদিক ওদিক চাইছিল। নোটন বলল, রিকশা না।
কেন রে?
একটু হাঁটব। পাশাপাশি।
ও বাবা! তুই যে বাড়াবাড়ি করছিস, নোটন।
মোটেই বাড়াবাড়ি নয়।-বলে নোটন তার হাতব্যাগ খুলে একটা অ্যান্টাসিডের স্ট্রিপ বের করে দুটো বড়ি ছিঁড়ে ধ্রুবর দিকে বাড়িয়ে বলল, আমারও ভীষণ অম্বল হয়। সঙ্গে রাখি। খাও।
খুব ড্রিংক করিস নাকি নোটন?
খুব করলে কি চলে? কাজ করে খেতে হয় না? অল্পস্বল্প খাই।
তবে অম্বল হয় কেন?
কী যে বলো না! অম্বল বুঝি শুধু ডিংক করলেই হয়? আমার ওপর দিয়ে কত অনিয়ম যাচ্ছে, খাওয়ার সময় অসময় নেই, রাতে ঘুমোনোর সময়ও হয়তো হল না। এসব থেকে হয়।
কতদূর নষ্ট হয়েছিস, নোটন?
নষ্ট! নষ্ট কীসের?
ও তাই তো! আমিও তো নষ্টামিকে খারাপ ভাবি না। সরি!
তুমি ভাবো। ভাবো বলেই বললে। বরং আমার কাছেই আর ওসব নীতির মূল্য নেই।
আমার কাছেও নেই রে। ঘোমটাটা এবার ফেলে দে।
কেন দেব?
আর তো কেউ দেখছে না।
তুমি তো দেখছ।
আমি কী দেখব?
নোটন একটু ঝিলিক দিয়ে হাসে, আজ ঘোমটাটা থাক। ঠিক এইভাবে একদিন তোমার পাশে পাশে হাঁটব বলে সেই শিশুকাল থেকে স্বপ্ন দেখেছি। আজ সত্যিই হাঁটছি তো, তাই ঘোমটাটা থাক।
তোর এখনও এইসব রোমান্টিক ইচ্ছে হয়?
হয়। কেন হবে না? ওই যে বয়ঃসন্ধিতে তোমাকে বর বলে মনে হয়েছিল, তাইতেই সর্বনাশ হয়ে গেল আমার। কখনও কোনও মেয়েকে বিয়ের আগে বলতে নেই, ওই তোর বর। ভীষণ খারাপ ওটা, জানো?
বুঝলাম।
কোনওদিনই বুঝবে না, ধ্রুবদা। মনে মনে হাসছ।
হাসছি তোর ঘোমটা দেখে লোকে কী ভাবছে?
ভাবাতেই তো চাইছি। বড়ি দুটো খাও।
হাতের বড়ি দুটো মুখে ফেলে চিবোয় ধ্রুব। বলে, শীতের কিছু গায়ে দিলি না। এখানে খুব ঠান্ডা।
আমার বেশ লাগছে।
হুইস্কি খেয়েছিস নাকি?
না। আজ খাইনি।
আমার সম্মানে নাকি?
বলতে পারো।
ধ্রুব আড়চোখে তাকাল। খুব কাছ ঘেঁষে ঘোমটা মাথায় হাঁটছে নোটন। গা থেকে সুন্দর গন্ধ আসছে। একটু বিভ্রমের মতো। একটু মায়া। পৃথিবীটা এরকম একটা মায়াই। ক্ষণস্থায়ি সম্পর্ক, ক্ষণস্থায়ি তার তাৎপর্য।