ফেরার পথে ঘোড়ার গাড়ি যথাসাধ্য দ্রুত বেগেই চলছিল, তবু হেমকান্তর মনে হচ্ছিল, গাড়ি যথেষ্ট দ্রুত চলছে না। বড় ধীর, বড় শ্লথ। দুবার বে-খেয়ালে তিনি হক মারলেন, জোরে! জোরে!
গাড়োয়ান সপাসপ চাবুকের শব্দ করল। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় গাড়িটা বিপজ্জনকভাবে নাচতে থাকে।
কালীবাড়ির সামনে গাড়ি দাড় করালেন হেমকান্ত। তার ঈশ্বরবিশ্বাস খুব জোরদাব নয়, কালীবাড়িতে তিনি আসেনও না। আজ উদভ্রান্তের মতো নেমে দ্রুত পায়ে গিয়ে ঢুকলেন মন্দিরের চাতালে।
বেশ রাত হয়েছে, আরতি শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মন্দিরের দরজা বন্ধ করার তোড়জোড় হচ্ছে। হেমকান্তকে দেখে পুরোহিত শশব্যস্ত এগিয়ে এলেন।
আজ্ঞে, আপনি! আসুন আসুন।
হেমকান্ত স্থির দৃষ্টিতে বিগ্রহের দিকে চেয়ে ছিলেন। মন্দিরের বড় বাতি নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু প্রদীপ জ্বলছে। সেই স্তিমিত আলোয় কালীর মুখ ভাল দেখা যাচ্ছে না।
হেমকান্ত বিগ্রহের দিকে নিবিষ্ট চোখে চেয়ে পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার এই বিগ্রহ কতটা জাগ্রত?
এরকম প্রশ্ন বড় একটা কেউ করে না। পুরোহিত শম্ভুচন্দ্র শর্মা একটু অবাক হয়ে বললেন, আজ্ঞে, মা বড় জাগ্রত।
কিছু কামনা করলে পাওয়া যায়?
মায়ের অদেয় কিছু নেই।
আমার বিশ্বাস-টিশ্বাস কিছু নেই কিন্তু। নাস্তিকও বলতে পারেন। তবু আজ আমার বড় বিপদ। চাইলে পাব?
ভক্তি করে একটু চেয়ে দেখুন না, চৌধুরীমশাই।
চাইব? বলছেন!
পুরোহিত একটু হাসলেন।
হেমকান্তকে চেষ্টা করতে হল না। আপনা থেকেই বুকটা থরথর করে কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। চোখ বুজতেই চোখের কোল ভরে গেল জলে। মনটা দীন হয়ে গেল, মাথা নুয়ে এল আবেগে। নিজেকে মনে হল, কত তুচ্ছ, কত নশ্বর, কী অসহায়।
একেই কি ভক্তি বলে? কে জানে! তবে দীন নম্র হৃদয়ে ভিখিরির মতো নিজের প্রিয় পুত্রের মঙ্গল প্রার্থনা করলেন তিনি। অস্ফুট স্বরে ডাকলেন, মা, মাগো!
পকেট থেকে কয়েকটা কাঁচা টাকা বের করে পুরোহিতকে দিয়ে হেমকান্ত বললেন, প্রণামী।
একটা মানসিক করে যান, চৌধুরীমশাই।
মানসিক!–বলে হেমকান্ত ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা, করা যাবে। আজ থাক। প্রথম দিনেই এতটা সইবে না।
পুরোহিত মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক আছে।
হেমকান্ত গাড়িতে এসে উঠলেন। কোঁচা দিয়ে চোখের কোল ভাল করে মুছে নিয়ে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে বসে রইলেন।
বাড়িতে এসে শুনলেন, এখনও কোনও খবর নেই। হেমকান্ত রাত্রে আর জলগ্রহণ করলেন না। বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে রইলেন। রিভলভারটা বালিশের পাশে রাখলেন। জানেন এটা কোনও কাজে লাগবে না।
বাড়িতে বাচ্চারা ছাড়া কেউই শুতে গেল না। কনক আর জীমূত বার বার বেরিয়ে গিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আনছিল। অর্থাৎ খবর নেই। মেয়েরা হেমকান্তর পাশের ঘরে বসে নিচু স্বরে কথাবার্তা বলছিল।
সময় কত দীর্ঘ ও মন্থরগামী! হেমকান্ত অনুভব করছিলেন। রাত যেন কাটতেই চায় না। ছেলেটা কোথায় গেল? কেন গেল? একবারও বলে গেল না কেন?
এমনও হতে পারে, স্বদেশিরা হেমকান্তর ওপর আক্রোশবশত কৃষ্ণকান্তকে মেরে ফেলেছে। এমনও হতে পারে, কৃষ্ণকে ধরে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। খুব সম্ভব ছেলেটা বিপদের মধ্যে আছে। কীরকম বিপদ, কতটা সাংঘাতিক বিপদ তা হেমকান্ত কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছেন না। বার-বাড়িতে এক দুই করে কর্মচারী এবং প্রজারা জড়ো হয়েছে, টের পাচ্ছেন হেমকান্ত। অনেক লোকের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে।
হেমকান্ত উঠে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
হরি!
হরি জেগে ছিল। হেমকান্তর ডাক শুনে দৌড়ে এল, আজ্ঞে।
ওরা কোনও খবর এনেছে?
না। খবর কিছু পাওয়া যায়নি।
পুলিশ বাড়ি সার্চ করবে বলে কথা ছিল। তাদের খবর কী?
এখনও পুলিশ আসেনি।
আসবে। শেষ রাত্রে। তৈরি থাকিস।
তৈরি আছি। তবে–
তবে কী?
আপনার বিছানার ওটা কি সরিয়ে নেব?
না। রিভলভার আমার কাছেই থাকবে।
যে আজ্ঞে।
হেমকান্ত দুর্বল বোধ করছিলেন। একটু তেষ্টা পাচ্ছে কিন্তু কেন যেন জলের গেলাস ঠোঁটে ছোঁয়াতেও প্রবৃত্তি হল না। তেষ্টা নিয়েই হেমকান্ত শুনে. পড়লেন। চোখ বুজতেই কৃষ্ণর নরুণকাটা মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ভেসে উঠল সামনে। হেমকান্ত আত্মবিস্মৃতির মতো দুখানা হাত সামনের দিকে প্রসারিত করে দিয়ে বললেন, এসো কৃষ্ণ, কোলে এসো।
মিহি স্বরে কে যেন ডাকল, বাবা!
কে?–বলে একটু চমকে চাইলেন হেমকান্ত।
বিশাখা মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, কাকে ডাকছিলেন? কৃষ্ণকে?
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। লজ্জাও পেলেন। স্তিমিত গলায় বললেন, তার কি কোনও খবর এল?
না, তবে চিন্তার কিছু নেই।
তার মানে? সারা সন্ধে রাত অবধি ছেলেটার খবর নেই, চিন্তা হবে না? বলো কী?
বিশাখা শিয়রে বসল। হেমকান্তর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে বলল, কৃষ্ণ ধারেকাছেই কোথাও আছে। আমার মনে হয় পুলিশ বাড়ি সার্চ করবে বলে ভয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে।
বিশাখা খুব কেঁদেছে নিশ্চয়ই। তার গলার স্বর ভারী। শ্বাসে এখনও কম্পন। হেমকান্ত বললেন, সে তত ভীরু ছেলে নয়। যাওয়ার সময় তোমাকে কিছু বলেনি তো!
আমাকে!–বিশাখা মাথা নেড়ে বলল, তেমন কিছু বলেনি। বিকেলবেলায় একবার ওপরে এসেছিল। লালটুকে একটু আদর করল। তারপর চলে গেল।
লালটু!
মেজদার ছেলে।
বুঝেছি। কিছু বলেনি তা হলে?
না। আমার ধারণা চেনাজানা কারও বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে আছে।
থাকলে ভাল। কিন্তু ভয়টা আমার যাচ্ছে না।
মশারিটা টাঙিয়ে দিই, একটু ঘুমোন।
না। মশারি টাঙালে দমবন্ধ লাগবে আজ। তোমরা বরং গিয়ে ঘুমোও।
আমাদের কাবও আজ ঘুম হবে না, বাবা।
আমারও হওয়ার কথা নয়। কটা বাজল?
রাত তিনটে।
ওঃ। তা হলে তো ভোর হয়েই এল। বাইরে ওরা এখনও আছে?
আছে। বারবাড়িতে সবাই বসে আছে।
ওদের কিছু খাওয়াও তো হয়নি!
হয়েছে। চিঁড়ে গুড় কলা দেওয়া হয়েছে সবাইকে।
শচীন সব খবর জানে?
বিশাখা হঠাৎ কথা বলতে পারল না। লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। হেমকান্ত প্রথমটায় মেয়ের এই প্রতিক্রিয়ার কারণটা বুঝলেন না। পরে বুঝলেন। বললেন, বড় যোগ্য ছেলে। বিপদে নির্ভর করা যায়। সে কি খবরটা পেয়েছে জানো?
পেয়েছেন।–খুব কুণ্ঠার সঙ্গে বলে বিশাখা, থানায় গিয়ে বসে আছেন।
হেমকান্ত মেয়ের ব্রীড়াবনত মুখের দিকে চেয়ে ক্ষণেকের জন্য একটা সুখের অনুভূতি বোধ করলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। এ বাড়িতে আসতে সে বোধহয় এখন লজ্জা বোধ করছে। বিবেচক ছেলে। আমি জানি কৃষ্ণর জন্য তার উদ্বেগ কম নয়।
আমি যাই, বাবা?
লজ্জা পেয়ো না, মা। বোসো। এমনি করে মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। মনু কোথায় বলতে পারো?
মন্দিরের দালানে বসে আছেন। হরিকাকাও আছেন। কেউ ঘুমোয়নি।
চেনাজানা সব বাড়িতে খোঁজ নেওয়া শেষ হয়েছে?
হয়েছে। দূরে যারা গেছে তারা সকলে এখনও ফেরেনি। এই অস্ত্রটা আপনি কাছে রেখেছেন কেন, বাবা?
কেন রেখেছি!–হেমকান্ত এটুকু বলে সামান্য ভাবলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, কেন যে রেখেছি তা জানি না। মনে হল একটা অস্ত্র কাছে রাখা ভাল। আজ সব উলটো-পালটা ঘটনা ঘটছে।
এতে কি গুলি ভরা আছে?
আছে। এক কাজ করো এটা ওই দেরাজে রেখে দাও। সাবধানে নাও, ট্রিগারটায় আঙুল দিয়ে।
বিশাখা উঠে রিভলভারটা দেরাজে রেখে আসে।
হেমকান্ত মেয়ের দিকে চেয়ে বলেন, তুমি এখন যাও, মা। ঘুমোতে না পারো অন্তত একটু বিশ্রাম নাও। আমি বরং শুয়ে শুয়ে একটু কৃষ্ণর কথা ভাবি।
বিশাখা হেমকান্তর গায়ে একটা ঢাকা দিল। তারপর নিঃশব্দে চলে গেল।
হেমকান্ত একা ঘরে জেগে থেকে কৃষ্ণর কথা ভাবতে লাগলেন। যত ভাবেন তত বুকটা আনন্দে বিষাদে উথাল-পাথাল করে আর চোখ বার বার ভরে যায় জলে।
চোখের ওপর দিয়ে একটি অন্তহীন রাত বড় মন্থর গতিতে কেটে গেল। হেমকান্ত ক্লান্তিতে চোখ বুজে শুয়ে থেকে বহুবার টের পেলেন তার বড় দুই ছেলে, মেয়ে এবং বউরা বার বার নিঃশব্দে ঘরে এসে তাকে দেখে গেল। বোধহয় ওদের আশঙ্কা হেমকান্ত শোকে না মরেটরে যান।
ভোরের সামান্য ফরসা ভাব দেখা দিতেই হেমকান্ত উঠে পড়লেন।
হরি!
একডাকে হরি এসে সামনে দাঁড়ায়, যে আজ্ঞে।
হরির গলার স্বরও ভারী। অর্থাৎ কৃষ্ণর জন্য সেও সম্ভবত কেঁদেছে। হেমকান্ত জিজ্ঞেস করলেন, পুলিশ কি এসেছে?
আজ্ঞে না।
আসার কথা ছিল, এল না কেন?
হরি চুপ করে থাকে।
হেমকান্ত ফের জিজ্ঞেস করলেন, কোনও খবর পাওয়া গেল ছেলেটার?
আজ্ঞে না। বলতে গিয়ে হরি সামান্য ফুঁপিয়ে ওঠে।
হেমকান্ত বিরক্ত হয়ে বলেন, কাঁদছিস কেন? তার তো এখনও কোনও খারাপ খবর আসেনি!
আজ্ঞে না।
তবে?
আপনার বড় কষ্ট হচ্ছে যে!
কষ্ট!–বলে হেমকান্ত খুব ফ্যাকাসে একটু হেসে বলেন, সারাটা জীবন পায়ের ওপর পা দিয়ে অন্যের খেটে-খাওয়া পয়সায় আরামে দিন কাটিয়েছি। এখন ভগবান একটু কষ্ট দেবেন না? ধর্ম বলে যদি কিছু থাকে তবে তার একটা বিচারও তো আছে।
হরি চুপ করে রইল।
হেমকান্ত প্রাতঃকৃত্য সারতে আজ বেশি সময় নিলেন না। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এসে বেরোনোর পোশাক পরতে পরতে হরিকে ডেকে বললেন, গাড়ি জুততে বল।
গাড়ি তৈরিই আছে।
আমি একটু থানায় যাচ্ছি। এদিকটা সব দেখেশুনে রাখিস।
আপনি চিন্তা করবেন না।
যদি এর মধ্যে সার্চ করতে চলে আসে তবে সব দেখাবি, যা দেখতে চায়। কিন্তু সব সময়ে সঙ্গে থাকিস।
আজ্ঞে।
হেমকান্ত সিঁড়ির মুখেই দাঁড় করানো ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বললেন, থানা। তাড়াতাড়ি চালা। গাড়ি ছুটল। সকালে ব্রহ্মপুত্রের ধার-ঘেঁষা রাস্তায় চলন্ত গাড়ি থেকে হেমকান্ত এই দুঃখের। মধ্যেও মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রকৃতির রূপ দুটো ক্লান্ত, অনিদ্রাজনিত জ্বালাভরা চোখে দেখছিলেন আর স্নিগ্ধ হচ্ছিলেন। মানুষের কত বিপদ, কত উদ্বেগ, কত অশান্তি, কিন্তু প্রকৃতি কেমন শান্ত, নির্বিকার, বৈরাগী! ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যের মধ্যে এরকম প্রকৃতি বীক্ষণের বড় আবেগময় অভিজ্ঞতার কথা আছে। গাছপালা, নদী, আকাশ, পাহাড়, সমুদ্র, ফুল, পাতা, পাখি, প্রজাপতি, কীটপতঙ্গের যে জীবন সেই জীবনে এই দ্বন্দ্ব নেই, এই উদ্বেগ নেই।
থানার সামনে এত ভোরেও ভিড় দেখে ভারী অবাক হলেন হেমকান্ত। ভিড়ের জন্য তাঁর গাড়ি একটু দূরেই থামল।
গাড়োয়ান নেমে এসে বলল, কিছু একটা হয়েছে কর্তাবাবু।
কী হয়েছে খোঁজ নিয়ে আয়।
গাড়োয়ান গেল। হেমকান্ত দুরু দুরু বুক হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। কৃষ্ণর কোনও কিছু হয়নি তো! ভিড়টা তার জন্যই নয় তো! কৃষ্ণকান্ত পকেটে গুলিভরা রিভলভারটা নিয়ে এসেছেন। কেন তা তিনি বলতে পারবেন না। বুড়ো বয়সে ছেলের জন্য উদ্বেগে মনটা যেন কেমন হয়ে গেছে। নইলে যে জিনিসকে তিনি সর্বদা এড়িয়ে চলেছেন সেই আগ্নেয়াস্ত্র স্পর্শ করে ভরসা পাচ্ছেন কেন আজ? এক হাত বুকে চেপে রেখে অন্য হাত পকেটে ভরে তিনি রিভলভারটা ধরে রইলেন।
গাড়োয়ান খুব উত্তেজিতভাবে ছুটে এল।
কর্তা সর্বনাশ!
কী হয়েছে?
দারোগাবাবুকে গুলি করেছে আজ্ঞে।
হেমকান্ত দরজাটা খুলে নামলেন, বলিস কী?
আজ্ঞে। শচীনবাবুও আছেন ভিড়ের মধ্যে দেখলাম।
শচীন! ছুটে গিয়ে ডেকে আন তো?
গাড়োয়ান যায়। কয়েক মিনিট পরেই শচীন শশব্যস্তে এসে বলে, আপনি এসেছেন।
কী ব্যাপার বলো তো?
শচীন ইতস্তত করে বলে, সঠিক ঘটনা জানি না, আমি কাল রাত থেকেই থানায় বসে আছি। আপনাদের বাড়ি রেড হবে খবর পেয়েই চলে আসি। তারপর শুনলাম, কৃষ্ণ মিসিং। সেজন্য রামকান্ত রায়ের সঙ্গে কথা বলার দরকার ছিল।
তারপর কী হল?
উনি খুব ব্যস্ত ছিলেন। রাত বারোটা নাগাদ একজন ইনফর্মার এসে নাকি খবর দেয় যে, কেওটখালির দিকে স্বদেশিদের একটা ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেই শুনেই উনি ছোটখাটো ফোর্স নিয়ে রওনা হন। তারপর আর ফেরেননি। একটু আগে খবর এল শট ডেড।
ডেড? ঠিক জানো?
তা জানি না। তবে গুজব ছড়িয়ে গেছে। খুব স্ট্রং গুজব। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নিজে অ্যাকশনে নামছেন। প্রচুর ধরপাকড় হবে।
ডেডবডি এসেছে?
শচীন শুকনো মুখে মাথা নেড়ে বলে, না।
কৃষ্ণর কোনও হদিশ করতে পেরেছ?
না। আর সেইটেই চিন্তার বিষয়।
হেমকান্তর বুকটা কেঁপে উঠল আবার। বললেন, চিন্তার কারণ তো বটেই। একটু কোনও খবরও পাওয়া যায় না?
শচীন খুব সোজাসুজি হেমকান্তর দিকে চেয়ে থেকে বলল, একটা খবর আমার কাছে আছে।
হেমকান্ত কাঁপা গলায় বললেন, খারাপ খবর?
একদিক দিয়ে দেখতে গেলে খারাপই।
এসো গাড়িতে গিয়ে বসি। প্রকাশ্যে রাস্তায় এসব কথা না হওয়াই ভাল।
গাড়িতে দুজনে মুখোমুখি বসার পর হেমকান্ত জানালা দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর খানিকক্ষণ দম নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে বললেন, এবার বলো।
শচীন মৃদুস্বরে বলল, কৃষ্ণ বোধহয় স্বদেশিদের খপ্পরে পড়েছে।
খপ্পরে বলতে কী বোঝাতে চাইছ? গুম করেছে?
না। আমি বলতে চাইছি, স্বদেশিদের সঙ্গে কোনও সূত্রে ওর যোগাযোগ হয়েছে। ওকে কাজে লাগানো হচ্ছে।
স্বদেশি বলতে কোন দল? কার দল?
বীরু সেনের দল।
হেমকান্ত চুপ করে গেলেন। বীরু সেন কে তা তিনি জানেন না। তবে জানতে চাইলেনও না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কৃষ্ণকে দিয়ে ওদের কী কাজ হবে বলো তো! ও তো নেহাত বাচ্চা ছেলে।
বাচ্চাদের দিয়েই কাজ হয়। বিশেষ করে কৃষ্ণর মতো ব্রাইট ছেলে পেলে তো কথাই নেই।
কিন্তু যদি খুনখারাপি কয়?
শচীন মুখটা নামিয়ে নিল। কিছু বলল না।
হেমকান্তব হঠাৎ মনে হল, শচীন কিছু গোপন করতে চাইছে। তিনি একটু ঝুঁকে বললেন, কোথায় রেখেছে ওকে জানো?
শচীন মুখ তুলল। চোখের দৃষ্টি করুণ। বলল, যতদূর জানি কেওটখালিতে।
যেখানে রামকান্ত রায়কে মারা হয়েছে?
তাই তো গুজব।
হেমকান্ত শচীনের হাতটা চেপে ধরে বললেন, যাবে? চলো একবার গিয়ে ছেলেটাকে দেখে আসি।
শচীন স্তিমিত গলায় বলল, কী করে যাবেন? পুলিশ গোটা এলাকা ঘিরে ফেলেছে।কাউকে ওই অঞ্চলে ঢুকতে দেবে না।
ঠিক দেবে। আমরা ঠিক পথ করে নেব।
পুত্রের জন্য উদ্বেগে পাগল বাপের পাগলামি শচীনের অজানা নয়। সে ম্লান একটু হেসে বলল, আমি সে চেষ্টা আগেই করেছি। ওই অঞ্চলে যাওয়ার কোনও উপায় নেই।
পুলিশ কি অ্যাকশন নিচ্ছে ওখানে?
নেওয়ারই তো কথা।
যদি কৃষ্ণর কিছু হয়?
শচীন জানে, কৃষ্ণ একা নয়, বীরু সেনের গোটা দলটাকেই পুলিশ হয় ধরবে, নয়তো পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দেবে। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নিজে সেখানে হাজির আছে। তবে শচীন সেকথা বলল না, বরং বলল, না তেমন ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্বদেশিরা কি অত বোকা? নিশ্চয়ই পালিয়ে গেছে।
কিছু খবর পেয়েছ?
এটুকু জানি যে, এখনও কেউ ধরা পড়েনি বা মরেওনি।
হেমকান্তর হাত পা বুক সবই কাঁপছে। তিনি অস্থির বোধ করতে লাগলেন। বললেন, ঠিক আছে। তুমি এখন কী করবে?
আমি থানায় আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। খবর যা আসার তা থানাতেই আসবে।
খবর পেলে আমাকে জানাবে সঙ্গে সঙ্গে।
নিশ্চয়ই। আপনি চিন্তা করবেন না।
শচীন নেমে গেল। হেমকান্ত গাড়ি ছুটিয়ে ফিরতে লাগলেন।
কিন্তু ফিরলেন না। নদীর ধারে গাড়ি দাড় করিয়ে নামলেন। গাড়োয়ানকে বললেন, গঙ্গা মাঝি ঘরে আছে কি না দেখ তো! থাকলে ডাক।
গঙ্গা মাঝি তলব পেয়ে ছুটে আসে।
কর্তা ডাকছেন?
নৌকোটা আছে?
আছে। যাবেন?
যাব। চল।
নিঃশব্দে হেমকান্ত নৌকোয় গিয়ে ওঠেন। মাঝারি নৌকো। গঙ্গা মাঝি বৈঠা ধরতেই হেমকান্ত হাত বাড়িয়ে বলেন, আমাকেও একটা দে।
দুই সবল হাতের বৈঠার তাড়নায় নৌকো কেওটখালির দিকে ছুটতে থাকে। রোদে ঝকঝক করছে নদী। চমৎকার শান্ত শ্রী ছড়িয়ে আছে চারদিকে।
হেমকান্ত ডাকলেন, গঙ্গা।
আজ্ঞে, কর্তা।
কাল রাতে এই রাস্তা দিয়ে পুলিশ গেছে দেখেছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ, কর্তা।
কতজন?
মেলা পুলিশ।
গুলিগোলার শব্দ শুনেছিস?
আজ্ঞে না।
পুলিশ কেওটখালিতে কেন গেছে জানিস?
গঙ্গা মাথা নাড়ল, না কর্তা।
কৃষ্ণকে কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না, জানিস?
গঙ্গা দুঃখিত মুখে বলে, সব ওই স্বদেশিদের কাজ! আমি তো সারা রাত ছোটকর্তাকে খুঁজতে নৌকো বেয়ে এখানে সেখানে গেছি।
সারা রাত! তবে তো তোর নৌকো বাইতে কষ্ট হচ্ছে এখন!
না কর্তা, কষ্ট কী? গতরের কাজে কষ্ট নাই।
অনেকক্ষণ নৌগে চলল। শহর শেষ হল। নির্জন নদীর ধার। নিরবচ্ছিন্ন গাছপালায় শ্যামলিমা।
এই কেওটখালি। ওই শ্মশান।–-গঙ্গা অস্ফুট স্বরে বলে।
দুইজনে নৌকো ভেড়ায়। পাড়ে কাদা, কাঁটাগাছ, আগাছার জঙ্গল। নিস্তব্ধতা।
গঙ্গা একটা খুঁটো পুঁতে নৌকো বাঁধে। হেমকান্ত নেমে চারদিকে চেয়ে দেখেন। একটু ইতস্তত করে খাড়াই বেয়ে উঠতে থাকেন ওপরে। গঙ্গা নৌকোর খোল থেকে একটা লম্বা লাঠি টেনে নিয়ে হেমকান্তর পিছু পিছু উঠতে থাকে।
শ্মশানের ঘাটে মস্ত বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে হেমকান্ত চারদিকে তাকিয়ে কিছু খোঁজেন। এসব দিকে তার বড় একটা আসা হয় না। সামনে একটা সুড়কির লাল রাস্তা। তার ওপাশে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে কিছু টিনের চাল দেখা যাচ্ছে।
গঙ্গা নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, এদিকটায় নয়।
তবে কোনদিকে?
আরও দক্ষিণে।
তুই জায়গাটা চিনিস?
চিনি। বীরুবাবুরা আমার নৌকোয় অনেকবার এসেছেন।
তা হলে তুই চিনিস। ওরা লোক কেমন?
ভদ্রলোক।
দলে কয়জন আছে?
বেশি না। দশ বারোজন হবে।
প্রতুল ওদের দলে আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। উনিই চিনিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে।
কৃষ্ণকে কি তুই এখানে এনেছিস কাল?
আজ্ঞে না। ছোটকর্তা আসতে চাইলেও আনতাম না।
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়িয়ে বললেন, চল।
চলুন।
রাস্তাটা ধরে পুবদিকে খানিকটা এগোনোর পর ডানহাতে একটা সরু পথ পাওয়া গেল। গঙ্গা সেইদিকে দেখিয়ে বলল, এই কাছেই।
কয়েক রশি পথ। চারদিকে ঘন গাছপালা, আগাছা, বসতিহীন জমি। সেসব ডিঙিয়ে খানিকদূর এগোবার পর একটা খোছড়া ঘর নজরে পড়ল। চারদিকটায় ফাঁকা পোড়ো জমি। নির্জন।
কেউ তো এখানে নেই বলে মনে হচ্ছে।-হেমকান্ত সভয়ে বললেন।
থাকবার কথাও নয়।—এক বজ্ৰগভীর গলা পিছন থেকে বলে উঠল।