লিফটে একাই ছিল চয়ন, দরজা বন্ধ করার সময়ে খুচ করে একটা লোক এসে ঢুকে পড়ল। লোকটার পরনে হাকুচ ময়লা প্যান্ট আর শার্ট, লম্বা রুক্ষ চুল, গালে বিজবিজ করছে দাড়ি। লোকটা অবিরল বিড়বিড় করে কী বকে যাচ্ছে। চেহারাটা একসময়ে খারাপ ছিল না। কিন্তু অযত্নে বা রোগে বা অভাবে শুটিকো মেরে গেছে। এইসব মানুষকে দেখলে চয়ন তার নিজের ভবিষ্যতের চেহারা কল্পনা করে নিতে পারে। সে হয়তো বয়সকালে এরকমই আধপাগলা, ভ্যাবলা, বিড়বিড় করে লোক হয়ে যাবে।
হঠাৎ লোকটা তার দিকে চেয়ে বলল, আচ্ছা কৃষ্ণজীবন বিশ্বাস যেন কোন তলায় থাকে? জানতাম, কিন্তু ভুলে গেছি।
আপনি তার ফ্ল্যাটে যাবেন?
হ্যাঁ, আমার দাদা। কোন তলা জানেন?
জানি। আমিও তাদের ফ্ল্যাটেই যাচ্ছি।
অ। আপনি কে?
আমি মোহিনীকে পড়াই।
লোকটা আর উচ্চবাচ্য করল না। সাততলায় পৌঁছে তার পিছু পিছু নেমে এল। এ লোকটা কৃষ্ণজীবনের ভাই বলে বিশ্বাস করবে কে? বয়সে যেন কৃষ্ণজীবনের চেয়ে বছর দশেকের বড়, আর পোশাক একেবারেই কৃষ্ণজীবনের ভাইয়ের মতো নয়।
ডোরবেল বাজিয়ে অপেক্ষা করার সময় লোকটা ফের জিজ্ঞেস করল, বউদিকে এখন পাওয়া যাবে?
জানি না। সাধারণত এ সময়ে থাকেন।
দরজা খুলল মোহিনী। তার দিকে চেয়ে হেসে লোকটার দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। যেন চিনতেই পারল না।
চয়ন তাড়াতাড়ি বলল, তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চান।
লোকটা খুব বিনয়ের গলায় বলল, আমি বামাচরণ। তোমার কাকা হই। চিনতে পারছি না? আগেও বার দুই এসেছি।
বাইরের ঘরে বামাচরণকে বসিয়ে সে তার মাকে খবর দিতে গেল।
কলেজ থেকে ফিরে রিয়া এ সময়ে একটু শুয়ে থাকে। বেশিক্ষণ নয়। আধাঘন্টা। তাকে একজন ডাক্তার বলেছিল, আফটার ডেজ ওয়ার্ক আধাঘন্টা মনটাকে শূন্য রেখে শুয়ে থাকবেন। বালিশ ছাড়া। হেলপস টু ষ্টে ইয়ং। বলতে নেই, রিয়া নিজের শরীরে বয়সের লক্ষণ টের পাচ্ছে। একটু মেদের সঞ্চার ঘটছে। মুখের চামড়া সামান্য শ্লথ। বয়সের ব্যাপারটা তাকে ইদানীং একটু টেনশনে রাখছে। অথচ পাশাপাশি তার স্বামী কৃষ্ণজীবন এখনও কী টগবগে, প্ৰাণবান। ওকে বয়সে পায় না কেন? সবসময়ে তো পড়ছে, লিখছে, দুনিয়া নিয়ে ভাবছে, এ-দেশ সে-দেশ দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তবু ওকে বয়সে পায় না কেন? ও কি গোপনে প্রেম করে? কে জানে! অনু প্রায়ই ফোন করে ওকে। একদিন এক্সটেনশন লাইনে ফোন ধরে কিছুক্ষণ শুনে রেগে গিয়েছিল। রিয়া। চেপে ধরেছিল কৃষ্ণজীবনকে, ওইটুকু মেয়ে তোমার সঙ্গে অত পাকা পাকা কথা বলে কেন? কী চায় ও? কৃষ্ণজীবন অবাক হয়ে বলেছিল, পাকা? তা হবে হয়তো। আমি ঠিক বুঝতে পারি না। বেশ করে বকে দিয়েছিল। রিয়া। সেই থেকে অনু মেয়েটাকে দেখতে পারে না সে। তবে জানে, অনুপ্রায়ই কৃষ্ণজীবনকে ফোন করে, বাড়িতে এসে আড্ডা মারে, কোথাও দেখা হলে গা ঘেষে থাকে। ওইটুকু মেয়েকে সন্দেহ করার মানেই হয় না। কিন্তু পাকামি দেখলে গা জ্বলে যায় তার। কালকেও চারুশীলার বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল, এমন ন্যাকামি করছিল কৃষ্ণজীবনের সঙ্গে যে একটা চড় কষাতে ইচ্ছে হয়েছিল তার।
শুয়ে শুয়ে বিষাক্ত মনে অনুর কথাই ভাবছিল সে।
মোহিনী এসে বলল, মা, শিগগির এসো। আমাদের সেই কাকা এসেছে। বামাচরণ না কী যেন নাম! কী নোংরা আর ময়লা, দেখা গিয়ে।
বামাচরণ! বলে অবাক হয়ে চোখ মেলে রিয়া, সে আবার কী চায়?
দেখ না গিয়ে!
উ, এরা জ্বালিয়ে খাবে। টাকা পয়সা চাইতে এসেছে বোধ হয়।
রিয়ার পরনে একটা নাইটি। টোকিও থেকে এনে দিয়েছিল কৃষ্ণজীবন। জাপানি প্রিন্টের দারুণ জিনিস। তবে এটা পরে বাইরের বিশিষ্ট লোকজনের সামনে বেরোয় না। রিয়া। কিন্তু বামাচরণকে অতটা সম্মান দেখানোর প্রয়োজন বোধ করল না সে। উঠে চুলটা বেঁধে নিল এলো খোঁপায়। বাথরুমে গেল। তার পর শ্লথ পায়ে এসে ড্রয়িং রুমের পর্দা সরিয়ে যে দৃশ্যটা দেখল তাতে মনটা বিরক্তিতে আরও ভরে গেল তার। একটা হাড়-হাভাতে ভিখিরির মতো পোশাকে বামাচরণ সোফায় বসে আছে গ্যাট হয়ে। বসে আপনমনে বিড়বিড় করছে আর বাতাসে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে। দেখলেই বোঝা যায়, মেন্টাল পেশেন্ট।
রিয়া খুব নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বামাচরণকে দেখে নিল। তারপর গলাটা সংযত করেই বলল, বামাচরণ, কেমন আছ?
বামাচরণ টপ করে উঠে এসে পদধূলি নিয়ে হেঁ-হেঁ করে হেসে বলল, বউদি, ভাল আছ?
শত হলেও আপন দেওর, একে তাড়ানো যায় না। রিয়া বলল, বোসো, তোমার খবর কী?
আর খবর! আমাকে তো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, জানো না?
রিয়া অবাক হয়ে বলে, না তো! কি করে জানব? কেউ তো খবর দেয় না!
অনেকদিন যাও না দেশে। আমরা গরিব বলে?
রিয়া মুখটা গভীর করে বলে, নিয়ে গেলে যেতে পারি। কিন্তু তোমার দাদারই তো সময় হয় না।
দাদা। তবু মাঝে মাঝে যায়।
জানি। কিন্তু আমাকে তো নিয়ে যায় না।
বামাচরণ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল, তোমাকে একটা খবর দিতে এলাম বউদি।
খবর!
হ্যাঁ। দাদা তো দেশে তিনতলা বাড়ি করছে। জানো?
রিয়া অবাক হয়ে বলে, না তো! তিনতলা বাড়ি?
হ্যাঁ। দারুণ ব্যাপার। ইট সিমেন্ট সব এসে গেছে। আমি তো ওখানে এখন থাকি না। রামজীবন শুণ্ডা লাগিয়ে আমাকে মেরে ধরে তাড়িয়ে দিয়েছে। দিন কুড়ি আগে হঠাৎ গিয়ে পড়েছিলাম। তখন দেখি, এই কাণ্ড। এলাহি ব্যাপার হচ্ছে।
কই, আমাকে বলেনি তো!
বামাচরণ মুচকি হেসে বলল, তোমাকে গোপন করেই হচ্ছে বলে শুনলাম।
গোপন করার কী আছে?
তা তো জানি না। কিন্তু অন্যায়টা দেখ। আমাকে ভিটে থেকে তাড়িয়ে তবে সব হচ্ছে।
রিয়ার মুখচোখ লাল হয়ে যাচ্ছিল রাগে। সে বলল, বাড়ি কার জন্য হচ্ছে?
মা আর বাবার জন্য। রামজীবনেরও ভাগ আছে।
বাঃ, বেশ কথা তো! অদ্ভুত ব্যাপার।
সবার জন্যই হচ্ছে, শুধু আমি বঞ্চিত। অবিচারটা দেখ।
রিয়া মুখ গভীর করে বসে রইল। তারপর বলল, চা খাবে?
তা খেতে পারি। দাদা কোথায়?
তার ফিরতে রাত হবে।
আমি যে খবরটা দিয়েছি তা দাদাকে বোলো না।
কেন, দাদাকে ভয় পাও?
কী দরকার বলে? আমার ওপর রাগ করবে।
ঠিক আছে, বলব না। কিন্তু খবরটা সত্যি তো?
বিশ্বাস না হয়। কালকেই আমার সঙ্গে বিষ্টুপুর চলো, দেখে আসবে। ঠিকাদার দু-চারদিনের মধ্যেই কাজ শুরু করে দেবে।
তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে বলছিলে, তা তুমি এখন কোথায় আছ?
বামাচরণ দুঃখের গলায় বলল, কোথায় আর থাকব? প্রথমটায় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম। তা সেখানে সুবিধে হল না। একটা ভাড়াবাড়িতে আছি।
সেটা কি বিষ্টুপুর থেকে দূরে?
তিন চারটে গ্রামের তফাতে।
তাড়াল কেন?
সে অনেক কথা। তবে আমাকে তাড়িয়ে সব গাপ করে নিল ওই রামজীবন।
সে তো শুনি মদটদ খায়।
সব দোষ আছে বউদি। গুণের অন্ত নেই।
ছিঃ ছিঃ। বলে চুপ করে থাকল রিয়া। মনটা বিরক্তি আর রাগে খিচড়ে গেল। উঠে গিয়ে কাজের মেয়েটাকে চা করতে বলে ফের এসে মুখোমুখি বসে বলল, তোমার দাদা সব টাকা পয়সা দিয়ে ফেলেছে বুঝি বাড়ি করার জন্য?
তা জানি না। তবে ঠিকাদার লাগিয়েছে। বাড়ি করাটা যদি আটকাতে পারো। তবে বড় ভাল হয়। বাড়ির ভাগ আমিও পাবো না, দাদার তো কথাই নেই।
তোমার দাদা তো বলেন রিটায়ার করে দেশে গিয়েই থাকবেন।
আর থেকেছে! তুমিও যেমন। দাদা এখন একজন ডাকসাইটে লোক। সে গিয়ে ওই ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে থাকে কখনও? টাকাটা জলে দিচ্ছে। আটকাতে পারবে না বউদি ঃ
রিয়া রাগ-রাগ মুখ করে বলে, আটকানো হয়তো সহজ হবে না। টাকা হয়তো দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আমরা বড়লোক নই বামাচরণ। আমার মেয়ের বিয়ে বাকি। ছেলের পড়ার খরচ আছে। দোলনও তো বড় হচ্ছে। তোমার দাদা কোন আক্কেলে যে বাড়ির টাকা দিতে গেল তা বুঝতে পারছি না।
আমিও সেই কথাই বলি। এ বাজারে এতগুলো টাকা! না হোক দেড় দুলাখ তো খসবেই।
আমি যদি বিষ্টুপুর যেতে চাই নিয়ে যেতে পারবে?
কবে যাবে বলো, আমি এসে নিয়ে যাবো।
সামনের রবিবার তোমার সময় হবে?
খুব হবে। মাঝখানে তো দুটো দিন।
সকালের দিকে চলে এসো। আমি যাবো।
ঠিক আছে।
বসে বসে আরাম করে চা খেল বামাচরণ। বিকুট খেল চায়ে ভিজিয়ে।
আর কিছু খাবে?
ক্যাবলার মতো একটু হাসল বামাচরণ। খুব সংকোচের সঙ্গে বলল, সকাল থেকে আজ তেমন কিছু খাওয়া হয়নি।
তা হলে বোসো। বলে রিয়া উঠে গেল। ফ্রিজ থেকে মাখা ময়দা আর তরকারি বের করে কাজের মেয়েটাকে পরোটা ভেজে দিতে বলে এল। তার মাথাটা উত্তেজিত। এইসব লোককে আত্মীয় বলে স্বীকার করা বা পরিচয় দেওয়াটাই এক লজ্জার ব্যাপার। কৃষ্ণজীবনের মতো একজন বিশিষ্ট এবং বিখ্যাত লোকের ভাই বলে একে কে বিশ্বাস করবে? কৃষ্ণজীবন ছাড়া তার ভাইবোন বা বাপ-মাও ভদ্র শ্রেণীর মধ্যেই আসে না। গরিব বলে কথা নয়, কোনও কালচার বা শিক্ষাও তো নেই এদের। একজনও কোনও ভদ্র পেশায় নিযুক্ত নেই। জীবন থেকে, মন থেকে এদের সম্পূর্ণ বর্জন করে দিয়েছিল। রিয়া। কৃষ্ণজীবনকেও চেয়েছিল ওদের সঙ্গে সম্পর্করহিত করে দিতে। এ কাজটা পেরে ওঠেনি। সে। কৃষ্ণজীবন তাকে না জানিয়ে মাঝেমাঝে বিষ্ণপুর যায়। রিয়া ধরে ফেলেছিল, কৃষ্ণজীবনের ছাড়া শার্টের বুক পকেটে ট্রেনের টিকিট পেয়ে। এখন দেখা যাচ্ছে, শুধু সম্পর্ক নয়, দায়দায়িত্বও ঘাড়ে নিচ্ছে এইসব আপোগণ্ডদের।
তোমার বউয়ের নাম না?
হ্যাঁ। তোমার মনে আছে?
আছে। সে কেমন মেয়ে?
গায়ের মেয়ে, যেমন হয়। আর কি।
বিয়ের সময় দেখেছিলাম। একবার, ভাল করে আলাপ হয়নি।
চাও তো নিয়ে আসবখন একদিন।
প্ৰমাদ গুনাল রিয়া। এ সব লোকের সঙ্গে সম্পর্ক প্ৰলম্বিত করার কোনও ইচ্ছেই। তার নেই। সে বলল, এখনই এনো না। আমরা সব সময়ে তো থাকি না। উনি বোধ হয়। কয়েক বছরের জন্য আমেরিকায় চলে যাবেন। আমরাও যাবো।
উরিব্বাস! আমেরিকা!
এখনও ঠিক হয়নি। তোমার দাদা তো দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চান না। কিন্তু ও সব দেশে না গেলে উন্নতিই বা করবে কি করে!
আরও উন্নতি? দাদা তো শুনি এখন একজন মস্ত মানুষ।
হওয়ার কি শেষ আছে? তোমার দাদার যা কোয়ালিফিকেশন, যা ক্ষমতা তার কতটুকু দাম এ দেশে পায় বলো? সাহেবরা খাতির করে বলেই যা দাম।
এ সব উঁচু উঁচু কথার খেই ধরতে পারে না বামাচরণ। সবেগে মাথা নেড়ে বলে, তা বটে। আমেরিকা গেলে এ ফ্ল্যাটটা কি করবে?
কি করব মানে? আমরা তো পার্মানেন্টলি যাচ্ছি না। কয়েক বছরের জন্য। এই ফ্ল্যাট থাকবে।
যেন একটু হতাশ হয়ে বামাচরণ বলল, অ।
গরম পরোটা আর তরকারি এসে যাওয়ার পর লোভীর মতো ক্ষুধার্ত বামাচরণ বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে খেতে লাগল। খাওয়ার মধ্যেও কোনও কালচারের প্রকাশ নেই। হাপুস হুপুস শব্দ করছে। খাওয়ার আগে নোংরা হাতটা ধুয়েও নিল না। ঘেন্নায় মুখ কোঁচকাল রিয়া।
খেয়েদেয়ে উঠে পড়ল বামাচরণ, আজ তা হলে আসি বিউদি।
এসো।
সামনের রবিবার আমি সকালের দিকেই চলে আসবো।
ঠিক আছে।
আবার একটা প্ৰণাম করে বামাচরণ চলে গেল। রিয়া দরজাটা বন্ধ করার আগে দেখল, বামাচরণ লিফটের চেষ্টা করল না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিয়া। এই একটা আনকালচার্ড, গেয়ো অসভ্য পরিবারের সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্কটাই তার জীবনের একটা কলঙ্ক হয়ে থাকবে চিরকাল।
ঘরে এসে আর একবার শুলো বটে রিয়া, কিন্তু বিশ্রামটা আর হল না। মন অস্থির, উত্তেজিত থাকলে শরীরের বিশ্রামও হতে চায় না।
রাত দশটার পর কৃষ্ণজীবন ফিরে এল। হাতে মস্ত ফুলের বোকে। রিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ধরে।
রিয়া ফুলটা নিয়ে ক্যাবিনেটের অভ্যস্ত জায়গায় রাখল। রাখতে রাখতে তার মনে হল, কৃষ্ণজীবনের বয়স কত হল? এ বাড়িতে কৃষ্ণজীবনের জন্মদিন পালন করার রেওয়াজ নেই। ছেলেমেয়েদের একটু শখ হয় বটে, কিন্তু কৃষ্ণজীবন তাতে জল ঢেলে দেয়। রিয়ার হিসেব থাকে না, কিন্তু আন্দাজ পয়তাল্লিশ ছাড়িয়ে গেছে। তবু আদ্যন্ত যুবক চেহারার অক্লান্ত এই মানুষটির নাগাল বয়স বা সময় আজও পায়নি। সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও দিনান্তে সে যখন ফেরে তখন কোনওদিনই তাকে শ্ৰান্ত-ক্লান্ত মনে হয় না। কোন ধাতুতে গড়া ও?
রাতের খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পার হতে দিল রিয়া। দোলনকে ঘুম পাড়োল। বড় দুই ছেলেমেয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ কৃষ্ণজীবনের ঘরে হানা দিল রিয়া। কৃষ্ণজীবন রাত জেগে রোজই কাজ করে। পড়ে, লেখে। মার্কিন দেশ থেকে তার আরও একটা বই বেরোনোর প্রস্তুতি চলছে।
শোনো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
ভীষণ অন্যমনস্ক, দূরলগ্ন দুটি চোখ তুলে তার দিকে চেয়ে কৃষ্ণজীবন যেন প্রথমটায় চিনতেই পারল না। তারপর একটু সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, এসো, বোসো। কিছু বলবে?
হ্যাঁ। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
কৃষ্ণজীবন কী বুঝল কে জানে, হঠাৎ একটু হেসে বলল, তোমার মুড দেখে মনে হচ্ছে প্রশ্নটা খুব প্যালেটেবল নয়।
কী জিজ্ঞেস করবে?
আমি শুনলাম, তুমি বিষ্টুপুরে তিনতলা বাড়ি করে দিচ্ছ ওদের। সত্যি নাকি?
কৃষ্ণজীবনের হাসিটা হারিয়ে গেল। বলল, কে বলেছে?
সেটা অবান্তর কথা। খবর চাপা থাকে না।
কৃষ্ণজীবন হাতের বইটা একটা মার্কার দিয়ে বন্ধ করে রাখল। তারপর তার ধীর স্বভাবসিদ্ধ গলায় বলল, হ্যাঁ। মাবাবা খুব কষ্ট করে থাকে। বর্ষায় ঘর জলে ভেসে যায়। পোকামাকড়ের উৎপাত। সাপও ঢোকে শুনেছি।
তোমার টাকা খুব সস্তা হয়েছে? তিনতলা বাড়ি মানে এক কাঁড়ি টাকা। আমাদের কি এত বাড়তি টাকা আছে উড়িয়ে দেওয়ার মতো?
উড়িয়ে দেওয়া কি একেই বলে?
তা ছাড়া কী?
আমার তো মনে হয় টাকা দিয়ে এর চেয়ে ভাল কাজ আমি আর অল্পই করেছি।
এটা ভাল কাজ? তোমার মা-বাবার জন্য তিনতলা বাড়ির কোনও দরকার ছিল কি? বুড়োবুড়ি থাকবেন, তার জন্য একখানা পাকা ঘরা হলেই তো যথেষ্ট। সামান্য টাকায় হয়ে যেত। তিনতলা বাড়ি ওদের কোন কাজে লাগবে? শেষ অবধি তো বাড়ি ভোগ করবে ওই মাতাল আর লম্পট রামজীবন।
কথার যৌক্তিকতায় একটু মিইয়ে গেল কৃষ্ণজীবন। কথাটা মিথ্যে নয়। সে এ কথার জবাব খুঁজে পেল না। একটু উদাস থেকে বলল, ভেবেছিলাম। একটা ভাল বাড়ি করলে কখনও-সখনও আমরাও গিয়ে থাকতে পারব।
তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? আমি বিষ্টুপুরে গিয়ে থাকব?
আমি আউটিং-এর কথা বলছি।
আউটিং-এর জন্য অনেক সুন্দর জায়গা আছে। বিষ্টুপুরে মরতে আউটিং-এ যাবো কেন?
কৃষ্ণজীবন একটা অসহায় শ্বাস মোচন করে বলল, ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে বলে ওরা বিষ্টুপুর যেতে চায়। বিশেষ করে দোলন।
ওদের আমি যেতে দেবো না।
তা হলে আর কী করা যাবে! তোমরা কেউ না গেলেও আমি তো যাবো। তারা তোমাদের কেউ না হলেও, আমার তো আপনজন!
সেটা নিয়েও আমার কিছু কথা আছে। ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা রাখছি কেন?
কৃষ্ণজীবন একটু অবাক হয়ে বলে, তার মানে কি রিয়া?
তোমার হয়তো আত্মসম্মান বোধ একেবারেই নেই, কিন্তু আমার আছে। তোমার এক ভাই মাতাল, আর একটার পাগলামির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বোন যাত্ৰাদলের নটী। সম্পর্ক রাখার মতো মানুষ কি ওরা?
কৃষ্ণজীবন যেন ঘুষি খেয়ে কুঁকড়ে গেল। ছোট হয়ে গেল। মুখে একটা ব্যথাতুর বিষণ্ণতা ফুটে উঠল। হঠাৎ। হাফ-ধরা গলায় সে বলল, আমার পাপ বড় কম নয় রিয়া, তাদের জন্য আমিই দায়ী।
তুমি দায়ী? তুমি কেন দায়ী হবে?
কৃষ্ণজীবন দুহাতে মুখ ঢাকা দিল। তারপর অস্ফুট একটা গোঙানির শব্দ করে মাথা নেড়ে বলল, আজ আর কিছু বোলো না রিয়া। আর বোলো না।
আমি কিছু বলতে চাইও না। আমি শুধু চাই, বাড়িটা তুমি করবে না। শুনেছি ইট আর সিমেন্ট কেনা হয়ে গেছে। গেছে যাক। এবার ওরা যা করার করুক। তুমি আর একটা পয়সা দিতে পারবে না। পয়সা তোমার এল কোত্থেকে?
কৃষ্ণজীবন মুখ ঢেকে রেখেই বলল, শোনো রিয়া, এটা আমার প্রায়শ্চিত্ত। আমার যে কাজ করা উচিত ছিল তা আমি করিনি। আমি টেনে তুলিনি আমার ভাইবোনদের। তারা নষ্ট হয়ে গেছে অবস্থার চাপে। আমি পারতাম, করিনি। এখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
আমি তা মানি না। তুমি ওদের জন্য কী করতে?
কৃষ্ণজীবন মুখের ঢাকাটা খুলল না বলে ভৌতিক শোনাল তার গলা, তুমি জানো না রিয়া, আমার ভাইবোনরা কতটা আমার মুখাপেক্ষী হয়ে ছিল। কতটা আশাভরসা করত। বামা, রেমো, বীণা, সরস্বতী এরা তো কেউ খারাপ ছিল না। কেউ না। আমি মন দিলেই, চেষ্টা করলেই ওদের দাড় করাতে পারতাম। চেষ্টাই করলাম না। বিয়ে করে আলাদা হয়ে এলাম।
দোষটা কি বিয়ের? তার মানে কি আমাকেই ইনডাইরেক্টলি দায়ী করতে চাও? ভুলে যেও না, ওরা তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
মাথা নেড়ে কৃষ্ণজীবন বলল, তুমি বুঝবে না, ওই তাড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে রাগ নয়, ছিল অভিমান। বড় ভেঙে পড়েছিল ওরা।
আহা, কী কথা! একটা মানুষ চলে এল বলে সংসারের বাকি সবাই নষ্ট হয়ে যাবে? তুমি কি কল্কি অবতার নাকি?
না। তবে ওদের কাছে আমি যে কতটা সেটা কি তুমি বুঝতে পারবে?
বুঝবার দরকার নেই। তুমিও বোঝোনি। তোমার মাথায় ওরা কাঁঠাল ভাঙছে। তোমার বোধ বুদ্ধি নেই বলেই গলা বাড়িয়ে দিচ্ছি। কত টাকা দিয়েছ বলো তো! টাকাটা এল কোথা থেকে?
টাকাটা আমেরিকা থেকে এসেছে। বইয়ের রয়্যালটি।
সে কি অনেক টাকা! কই আমাকে তো বলোনি?
কৃষ্ণজীবন কী বলবে ভেবে পেল না। এ কথা সত্যি যে পাবলিশারের দেওয়া বেশ কয়েক লক্ষ টাকার কথা সে রিয়ার কাছে প্ৰকাশ করেনি। জানে, রিয়া জানতে পারলেই টাকাটার ওপর একটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে। কিছু টাকা হিসেবের বাইরে রাখা দরকার ছিল।
কত টাকা পেয়েছ?
আপাতত পনেরো লাখ। তার মধ্যে ইনকাম ট্যাক্স যাবে।
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রিয়া বলল, পনেরো লাখ? অথচ আমাকে বলোনি!
বলতাম। একটু সময় নিচ্ছিলাম।
কবে থেকে গোপন করা শিখলে?
কৃষ্ণজীবন এ কথারও জবাব জানে না। মুখ ঢেকে সে বসে রইল চুপ করে।
রিয়া অবিশ্বাসের গলায় আপনমনে কয়েকবার আওড়াল, পনেরো লাখ! প-নে-রো লা-খ!
জীবন একা শ্বাস ফেলে বলল, টাকাটা একটু আন এক্সপেক্টেড। তাই মা-বাবার জন্য বাড়িটা করে দিচ্ছি রিয়া।
রিয়া শক্ত হয়ে বলল, না। শুধু একটা ঘর পাকা করে দিতে পারো। আর কিছু নয়। রবিবার আমি বিষ্টুপুর যাচ্ছি। কৃষ্ণজীবন চমকে ওঠে, বিষ্টুপুর যাচ্ছ?
হ্যাঁ। তাদের একটু শিক্ষা হওয়ার দরকার।