সে আর সে। ধ্রুব আর ধ্রুব। না, ধ্রুব একা নয়। কখনওই আর সে সম্পূর্ণ একা নয়। একজন ধ্রুবকে সে চেনে। মোটামুটি স্বাভাবিক আচরণশীল, একটু ভাবুক, খানিকটা প্রথাবিরোধী, সামান্য উদাসীন। কিন্তু এই ধ্রুবর মধ্যে ব্যাখ্যার অতীত কিছু নেই। কিন্তু গত রাতে ধারার ফ্ল্যাটে যে ধ্রুব আচমকা বেরিয়ে এসেছিল তার ভিতর থেকে সে সম্পূর্ণ আলাদা। সে অচেনা। আগন্তুক।
কৃষ্ণকান্ত অপসৃত হওয়ার পর ফাঁকা দরজাটার দিকে বেকুবের মতো তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ধ্রুবর এইসব মনে হল। একটু গা-শিরশির করছিল তার।
আজ ধ্রুব অনেকক্ষণ ঠান্ডা জলে স্নান করল। হ্যাংওভার কাটানোর সবচেয়ে সহজ উপায় ঠেসে খাওয়া। যতখানি সম্ভব আজ পেট পুরে খেয়ে নিল ধ্রুব। অনেকটা স্বাভাবিক বোধ করতে লাগল সে।
নার্সিংহোম-এ যাবে বলে তৈরি হয়ে বসে ছিল সে। এমন সময় চাকর এসে খবর দিল, আপনার টেলিফোন।
ফোন ধরতেই ধারার গলা পাওয়া গেল, ধ্রুব?
একটু কুণ্ঠার সঙ্গে ধ্রুব বলে, হ্যাঁ।
তুমি কেমন আছ?
ধ্রুব অবাক হয়ে বলে, তার মানে?
আমি জানতে চাই তুমি কেমন আছ?
আমার কি খারাপ থাকার কথা?
আমি কাল সারা রাত তোমাকে নিয়ে খারাপ সব স্বপ্ন দেখেছি। বলো না কেমন আছ!
ভালই আছি তো!
ধারা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল, তুমি আমার একটা কথা বিশ্বাস করবে?
কী কথা?
আই অ্যাম রিয়েলি সরি!
ধ্রুবর একটু ওলট-পালট লাগছিল ব্যাপারটা। কাল রাতে যা ঘটে গেছে তাতে ধারার দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। দুঃখিত হওয়ার কথা তো তার।
ধ্রুব বলল, সরি ফর হোয়াট?
আমি পুলিশে খবর দিয়েছিলাম।
ধ্রুব একটু হাসল। বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ। আজ সকালে উঠে তাই ভীষণ খারাপ লাগছে।
খবর দিয়ে তো ঠিক কাজই করেছ।
পুলিশকে কী বলেছি জানো?
কী করে জানব?
বলেছি, হি ট্রায়েড টু মার্ডার মি।
কথাটা কি মিথ্যে?
যাঃ! কী যে বলো! আজ সকালে আমার মাথা পরিষ্কার হয়ে গেছে। কাল আমি ভীষণ বোকার মতো কাজ করেছি।
কেন? বোকার মতো কেন?
আমি তো জানতাম তোমার ভিতরে একজন স্যাডিস্ট আছে। যাকে তুমি ভালবাসো বা পছন্দ কররা তাকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাও। আজ সারাদিন ধরে এসব ভেবেছি আর হেসেছি। কাল রাতে যে কী ছেলেমানুষি কাণ্ড করেছি! আচ্ছা, পুলিশ তোমার কাছে যায়নি?
ধ্রুব মৃদু একটু হাসল। বলল, না। তবে কাল রাতেই সল্ট লেক-এর রাস্তায় আমি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলাম।
সত্যি?
তারা আমাকে একরকম গ্রেফতারও করেছিল।
তারপর?
তুমি তাদের কাছে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছিলে তার কথাও শুনেছি।
পুলিশগুলো ভীষণ অসভ্য, জানো?
কেন? কী করেছে?
এমন ছোঁক ছোঁক করে তাকাচ্ছিল। আর কেবল ব্যক্তিগত প্রশ্ন। কবার বিয়ে করেছি, কী করে চলে, কারা কারা ফ্ল্যাটে আসে। আশ্চর্য কী জানো, তোমার সম্পর্কে কোনও প্রশ্নই করছিল না।
তাই নাকি?
কেন বলো তো!
ওরা যে আমাকে চেনে।
তাই মনে হচ্ছিল। যে লোকটা আমার ফ্ল্যাটে এসেছিল সে বার বার বলছিল, কী করে বুঝলেন যে উনি আপনাকে খুন করতেই চেয়েছিলেন। আমি বললাম, বাঃ, আমার গলা টিপে ধরেছিল যে। তখন কী বলল জানো?
কী বলল?
বলল, গলায় আঙুলের দাগ তো দেখছি না! আমি তখন ওকে দাগ দেখালাম। তখন বলল, এ তো আপনি নিজেই নিজের গলা চেপে ধরে তৈরি করে থাকতে পারেন! বোঝো কাণ্ড!
সদানন্দর কথা ভেবে ধ্রুব আপনমনে হাসছিল। বলল, তুমি বোধহয় কাল রাতে আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলে!
ফোনে ধারার একটু উচ্ছ্বসিত হাসি শোনা গেল, বললাম তো কাল রাতে আমার মাথাটা ভারী বোকা-বোকা ছিল। একটুও বুদ্ধি খেলছিল না।
আজ খেলছে তো!
আজ বুদ্ধিও খেলছে আর লজ্জাও লাগছে।
ফ্ল্যাটের সবাই বোধহয় ঘটনাটা জেনে গেছে!
ভারী লাজুক গলায় ধারা বলে, কী করব বলো! বললাম যে, কাল রাতে ভারী বোকার মতো কাণ্ড করেছি সব। পাশের ফ্ল্যাটে টেলিফোন করতে গিয়েছিলাম। তাইতেই জানাজানি হয়ে গেল কিছুটা।
এরপর আর তোমার ওখানে যাওয়াটা নিরাপদ রইল না, ধারা। দেখলেই সবাই ধরে ঠ্যাঙাবে।
না, না। এরা কেউ সেরকম নয়। কেউ কারও ব্যাপারে নাক গলায় না।
ভাল।
পুলিশ তোমাকে অ্যারেস্ট কবে কী করল বললে না তো!
কী আবার করবে! বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল। বলল, ওরা তোমাকে বুঝিয়ে দেবে যে, গলা টেপার ব্যাপারটা ছিল নিছক রসিকতা। তার বেশি কিছু নয়।
তাই বলল! ও মা!
ধ্রুব একটু হেসে বলে, আমার বাবার কথা ভুলে যাচ্ছ কেন, ধারা? জানো না হি ওয়াজ এ মিনিস্টার? তোমাকে খুন করলেও আমার কিছু হত না।
হত না?
একেবারে রেড-হ্যান্ডেড ধরলে বা আই-উইটনেস থাকলে একটু ঝামেলা হত ঠিকই। কিন্তু তা নইলে কিছুই হত না।
আর এদিকে আমি ভেবে ভেবে মরছি যে, ধ্রুবকে পুলিশ বাধহয় হ্যারাস করে মারছে।
না। বরং কাল তারা আমার অশেষ উপকার করেছে। সল্ট লেকের মরুভূমি থেকে জিপে করে পোঁছে দিয়ে গেছে।
বাঁচলাম। ওরা ঠিক কাজই করেছে।
তুমি কেমন আছ, ধারা?
ভালই তো।
আজ অফিসে যাওনি?
না। শরীরটা ভাল নেই। গলায় ব্যথা।
খুব ব্যথা?
তেমন কিছু নয়। ডাক্তার দেখিয়েছি। হয়তো একটা কলার নিতে হবে।
আই অ্যাম সরি।
সরি? যাক, তোমার মুখ থেকে যে কথাটা বেরিয়েছে সেই আমার ভাগ্য। তবে সরি হওয়ার দরকার নেই।
কেন?
আই অ্যাম এনজয়িং দা পেইন।
বটে! ব্যথা কেউ এনজয় করে?
আমি তো করছি। ব্যথাটা যেন তুমিই। সারাক্ষণ সঙ্গে আছ। ভাল লাগছে ধ্রুব, বিশ্বাস করো।
করলাম! আজকাল পাগলের সংখ্যা খুব বেড়ে যাচ্ছে।
আমি একাই পাগল? তুমি নও?
আমিও বোধহয়। কিন্তু আমি আমার সম্ভাব্য হত্যাকারীর সঙ্গে তোমার মতো এরকম আকুলতা নিয়ে কথা বলতে পারতাম না। এ যে এক গালে মারলে আর-এক গাল পেতে দেওয়ার চেয়েও মারাত্মক মনোভাব!
ইয়ার্কি কোরো না। আজ একবার আসবে?
আজ! কী যে বলো! আজ আসতে আমার লজ্জা করবে না?
প্লিজ!
কেন?
কী জানি! আজই তোমাকে দেখার জন্য পাগল-পাগল লাগছে। কোনও কাজ নেই তো!
একটু আছে।
ওঃ সরি। তোমার বউ যে নার্সিংহোমে তা একদম খেয়াল ছিল না। কেমন আছে রেমি?
খবর পেয়েছি ভালই।
আর বাচ্চাটা?
সেও ভাল।
তা হলে আসতে পারবে? কাল খেতে চেয়েছিলে। খাওনি। আজ এসো, খাওয়াব।
তুমি নিজেই তো এক খাদ্য। অন্য খাবার লাগবে না।
আমি খাদ্য না অখাদ্য তা তো কখনও চেখে দেখোনি। বুঝবে কী করে ব্রহ্মচারীমশাই?
আজ থাক, ধারা। আর-একদিন হবে।
কেন সংকোচ করছ? কালকের ঘটনায় তোমার চেয়ে আমার লজ্জা ঢের বেশি। বিশ্বাস করো।
তুমি প্রলাপ বকছ কি না জানি না। কিন্তু যদি সত্যিই তোমার এরকম অদ্ভুত ইচ্ছে হয়ে থাকে তবে শিগগির একদিন যাব। কিন্তু আজ নয়। আজ আমার ধ্রুবর সঙ্গে একটু বোঝাপড়া আছে।
কার সঙ্গে?
ধ্রুব অর্থাৎ নিজের সঙ্গেই।
কী যে সব অদ্ভুত কথা বলো না!
কাল রাতে আমার ভিতর থেকে যে অদ্ভুত লোকটা বেরিয়ে এসেছিল তার সঙ্গে আগে আর কখনও দেখা হয়নি। তাকে দেখার পর থেকেই আমার একটা প্রবলেম শুরু হয়েছে। ওই যে কী একটা সিনেমা আছে না ক্র্যামার ভারসাস ক্র্যামার! এ অনেকটা তাই। ধ্রুব ভারসাস ধ্রুব একটা খিচান চলছে।
আমি একটা কথা বলব, ধ্রুব?
বলো না।
লোকটা তোমার অচেনা হলেও আমার অচেনা নয়। তাকে আমি বহুবার বহু অকেশনে দেখেছি।
বটে! তা হলে সাবধান করোনি কেন?
তুমি স্যাডিস্ট, সাবধান করে কী হবে? আর ওই স্যাডিজমই তোমার অ্যাট্রাকশন। তুমি তো বর্বর নও, একটু নিষ্ঠুর মাত্র।
খুব পোয়েটিক্যাল ডায়ালগ দিচ্ছ যে!
আজ যেন কেমন একটা লাগছে গো। এসো না, খুব মজা করব দুজনে।
মজা আজ জমবে না, ধারা। দুজনে মজা হয়, কিন্তু তিনজনে মজা হয় না। তৃতীয় লোকটা বাগড়া দেবে।
তিনজন আবার কে?
তুমি, আমি আর ধ্রুব!
ফের সেই হেঁয়ালি!
হেঁয়ালি নয়। তুমি বুঝবে না।
তা হলে সারাদিন বই পড়ে কাটাতে হবে আজ?
বই পড়ো, গান শোনো, রাধে, খাও। যা খুশি করো। সময় কেটে যাবে ঠিক।
ধ্রুব ফোন নামিয়ে রাখল।
জগা খুব কাছ থেকে আচমকা জিজ্ঞেস করল, কে বলো তো মেয়েটা!
ধ্রুব একটু চমকে গিয়েছিল। জগাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, তোমার সে খবরে কী দরকার?
জগার মুখে হাসি বা অমায়িক ভাব নেই। একটা হিংস্রতাই আছে ববং। বলল, দরকার একটু আছে। আজ যখন তুমি ঘরে ঘুমোচ্ছিলে তখন খুব সকালে কর্তাবাবুর কাছে পুলিশ ফোন করেছিল।
ধ্রুব একটু অবাক হয়। পুলিশের তো ফোন করার কথা নয়। সদানন্দ বলেছিল সেটা ডিসমিস হয়ে গেছে। সে জিজ্ঞেস করে, কী বলল পুলিশ?
তুমি সল্ট লেক-এ একটা মেয়ের ফ্ল্যাটে কাল নাকি হুজ্জোতি করেছ! সত্যি নাকি?
করে থাকলে কী?
খুব গুণধর ছেলে হয়েছ তা হলে! আঁ! আর যে দোষই থাক এ দোষটা তোমার ছিল না কখনও। এখন এটাও অভ্যাস করলে?
ধ্রুবর রাগ হল না। জগার ওপর রাগ করে লাভও নেই। এক সময়ে এবং এখনও জগা কৃষ্ণকান্তর ডান হাত ছিল বা আছে। যত লাঠিবাজি বা গা-জোয়াবির ব্যাপার আছে তাতে জগাই নেতৃত্ব দেয়। শরীরে অসীম ক্ষমতা, মনে অগাধ সাহস, প্রভুভক্তি তুলনাহীন। শুধু তাই নয়, প্রভুর
পরিবারভুক্ত সকলকেই সে আত্মীয়সমান জ্ঞান করে। সেই বোধ থেকেই সে কৃষ্ণকান্তর ছেলেমেয়েকে প্রয়োজনে শাসন বা ভৎসনা করতে পিছপা হয়নি। ধ্রুব জানে, জগার ওপর কর্তৃত্ব ফলিয়ে লাভ নেই, সে তাকে পরোয়া করে না। ধ্রুব তাই জগার চোখের দিকে গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, করলাম না হয়।
ওসব না হয় টা হয় ছাড়ো। সত্যি কথাটা কী?
ওটাই সত্যি কথা। মেয়েটির ফ্ল্যাটে আমি যাই।
কর্তাবাবু আজ চোখের জল ফেলেছেন তা জানো? শত দুঃখ পেলেও আমরা তার চোখে জল দেখিনি কখনও।
কাঁদলেন নাকি?
কাঁদবারই কথা। ফোন যখন ধরেন তখন আমি সামনে ছিলাম। ফোনটা নামিয়ে রেখে অনেকক্ষণ দুহাতে মুখ ঢেকে বসে ছিলেন। তখন আমি জল গড়াতে দেখেছি।
ব্যাপারটা এমন কিছু নয় যে কাঁদতে হবে।
তুমি সদ্য বাবা হয়েছ। এখনই ঠিক বুঝবে না। তবে পরে বুঝবে বাপ হলে কেমন লাগে বুকের ভিতরটা।
ধ্রুব চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলল না।
জগাও একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছিল কাল ওখানে?
তেমন কিছু নয়।
মেয়েটাকে তুমি মারধর করেছিলে? না হলে পুলিশ জানল কী করে?
একটু ঝগড়া হয়েছিল।
ঝগড়া নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। যদি বলো তা হলে গিয়ে সাফ করে দিয়ে আসতে পারি।
ধ্রুব একটু চমকে উঠে বলে, না না। ওসব কে বলেছে?
জগা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর চাপা গলাতেই বলে, যদি মেয়েমানুষের কাছে যেতেই হয় তো যাবে। পুরুষমানুষের একজনকে নিয়ে চলে না। কিন্তু সেটা একটু বুদ্ধি খাটিয়ে যেতে হয়। তুমি হুজ্জতি করে বেড়াও কেন? মাল খেয়ে সারা শহরে জানান দিয়ে বেড়াচ্ছ, মেয়েমানুষ নিয়ে হইচই ফেলে দিচ্ছ। তুমি ওরকম কেন?
তবে কীরকম হতে হবে?
যে রকম হলে লাঠিও ভাঙে না আবার সাপও মরে! তোমার তো অত বুদ্ধি, আর এই সামান্য ব্যাপারটা বোঝো না?
ধ্রুব একটা হতাশার শ্বাস ছাড়ল।
জগা বলল, মেয়েটা কে?
মেয়েটাকে ভুলে যাও, জগাদা।
ভুলব কেন? একটু কড়কে দেব।
কড়কানোর দরকার নেই।
আছে। জাতসাপের লেজ দিয়ে কান চুলকানো যে ভাল নয় সেটা তাকে বুঝিয়ে দেব।
ও কিছু করেনি।
আর কিছু না করুক পুলিশের কাছে তোমার নামে নালিশ করেছে। লোক জানাজানি হয়েছে। সেটা কি কম? তুমি তো জানোই কর্তাবাবু পলিটিক্যাল লিডার। তার ছেলেকে নিয়ে বদনাম রটলে ভোটের ক্ষতি হয় না? ইমেজ নষ্ট হয়ে যায় না?
এসব কথা জগা শিখেছে দীর্ঘকাল কৃষ্ণকান্তর সঙ্গ করে করে। ধ্রুব জানে, জগার মাথায় একমাত্র কৃষ্ণকান্তর ইমেজ রক্ষা ছাড়া অন্য চিন্তা নেই। কৃষ্ণকান্তর ইমেজ রক্ষা করতে গিয়ে সে এক-আধটা লাশও নামিয়ে দিয়েছে। ধ্রুব জগার দিকে আবার অসহায়ভাবে খানিকটা চেয়ে থেকে বলে, ওকে আমিই সাবধান করে দেব।
দিলে ভাল। মেয়েছেলের গণ্ডগোলে আমি নাক গলাতে চাই না। তবে বেশি বেগড়বাঁই দেখলে আমাকে বোলো। এখন চলল, নার্সিংহোম-এ যাবে তো!
ধ্রুব আবার বড় একটা শ্বাস ফেলে বলে, হুঁ।
রেমির জ্ঞান ছিল না। অপারেশনের পর এখনও অ্যানাস্থেশিয়ার ঘোর কাটেনি। তাছাড়া অপরিসীম দুর্বলতা তো আছেই। নাকে নল, হাতে উঁচ নিয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে আছে সে।
ধ্রুব মুখের দিকে চেয়ে ছিল। নার্স রেমিকে ডাকল, শুনুন! এই যে মিসেস চৌধুরী! দেখুন কে এসেছে। আপনার হাজব্যান্ড।
রেমি শুধু উ, উ বলল বার দুয়েক। একবার দুটি চোখের পাতা একটু কাঁপল।
খুব কষ্ট হচ্ছে ভেবে ধ্রুব বলল, থাক থাক।
নার্স বলে, ভিতরে কনশাসনেস আছে।
কেমন আছে ও?
ভাল। এখন অনেক ভাল। শুধু ইউরিনে এখনও ব্লাড আসছে।
সেটা কি খারাপ লক্ষণ?
একটু ডেঞ্জার আছে এখনও। বিকেলে একজন ইউরোলজিস্ট এসে দেখবেন।
ধ্রুব ডাক্তারি শাস্ত্রের কিছুই জানে না। তাই শুধু মাথা নাড়ল।
ছেলেকে দেখবেন না?
ছেলে!—ধ্রুব যেন ঠিক বিশ্বাস করছে না এমনভাবে বলো।
দাঁড়ান, আয়াকে বলছি নিয়ে আসতে।
থাকগে।
থাকবে কেন? বাবা হয়েছেন, দেখুন। খুব সুন্দর বাচ্চা।
ধ্রুব আর জগা গাড়লের মতো পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আয়া একটা বাচ্চাকে নিয়ে আসে। ন্যাকড়ায় জড়ানো একটুখানি রাঙা একটা ইঁদুরছানা। হাতে নম্বরের টিকিট বাঁধা।
ধ্রুব নিস্পৃহ চোখে দেখল।
জগা বলল, চৌধুরীবাড়ির ছেলে দেখলেই চেনা যায়।
কী করে চিনলে?
রং দেখছ না? হাড়ের কাঠামোটাও দেখো। কত বড় হয়েছে দেখেছ? সাড়ে আট পাউন্ড।
ধ্রুব বিশেষ উৎসাহ বোধ করল না এই সংবাদে। সে জানে, এ বাচ্চা সে সৃষ্টি করেনি। তার ভিতর দিয়ে সৃষ্ট হয়েছে মাত্র। মানুষ একটা সূত্র ধরে জন্মায়। সে এই শিশুর জন্মের কারণ, স্রষ্টা নয় সে এর রক্ষণাবেক্ষণকারী, কিন্তু নিয়ন্তা নয়। যেমন কৃষ্ণকান্ত নন ধ্রুবর নিয়ন্তা। কিন্তু কৃষ্ণকান্ত এ তত্ত্ব কি কোনওদিন বুঝবেন?