দাদার সঙ্গে সম্পর্কটা কি খারাপ হয়ে গেল। অয়ন তার চরিত্র নিয়ে তাকে আর অনিন্দিতাকে জড়িয়ে কুৎসিত ইঙ্গিত করেছে, চড় মেরেছে—এ সবই যেন এই চিলেকোঠায় বাস করার বিনিময়ে সে ভুলে যেতে পারে। চয়নের মনে হয় এ বাসা থেকে উৎখাত হলে তার আর আশ্রয় বলে কিছু থাকবে না।
অনিন্দিতাদের সঙ্গে বউদির আজকাল একটু-আধটু ঝগড়া হচ্ছে প্রায়ই। জল নিয়ে, ময়লা ফেলা নিয়ে, ছাদে যাওয়া নিয়ে। ঝগড়ার জন্য খুব গুরুতর কারণের দরকারও হয় না। ঝগড়াটাই যখন আসল তখন কারণ একটা বের করে নিলেই হয়।
অনিন্দিতা আজকাল ছাদে আসে না। চয়নের সঙ্গে দেখাও হচ্ছে না। গত কয়েকদিন। একদিক থেকে ভালই। সম্পর্কট এইভাবে শেষ হয়ে যাক। সম্পর্ক ছিলও না তেমন, একটা ক্ষীণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠছিল মাত্র। তার মধ্যে একটু বৈদ্যুতিক ঘটনা ঘটেছিল তাকে নিয়ে অনিন্দিতার তুমি বলানো, কিন্তু সেটাও গুরুতর কিছু নয়। অনিন্দিতা তো পাগল নয় যে, তার সঙ্গে প্রেম করতে চাইবে।
তবু অবস্থাটা একটু অনিশ্চিত, অয়ন তাকে বাসা ছাড়তে বলেছে। কিন্তু রাগের মাথায় বলা, সেটাকে গুরুত্ব দেওয়ার মানে হয় না। ছাদের এই চিলেকোঠা নিশ্চয়ই ভাড়া দেবে না। ওরা। হয়তো রাগ পড়ে গেলে কথাটা মনেও থাকবে না অয়নের। তবু এতসব ভেবেও নিশ্চিত হতে পারে না চয়ন। দুশ্চিন্তার একটা কাটা সর্বদা খচখচ করে।
একদিন বিকেলে টিউশনিতে বেরোচ্ছিল চয়ন, সদর দরজার বাইরে গলির মধ্যে অনিন্দিতার বাবার সঙ্গে দেখা।
ভারাক্রান্ত মুখ, হাসি নেই। ওর মধ্যেই জোর করে একটু হেসে বললেন, বেরোচ্ছ নাকি?
চয়ন বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
বড় অশান্তি চলছে, বুঝলে?
অশান্তি যে চলছে তা চয়ন জানে। কিন্তু তার তো কিছু বলার নেই।
ভদ্রলোক চয়নের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল চয়ন। সময় হবে?
চয়ন মৃদুস্বরে বলল, হবে। বলুন না!
কোথায় বেরোচ্ছিলে যেন, দেরি হয়ে যাবে না তো!
তাড়া নেই। টিউশনিতে যাচ্ছিলাম।
অনিন্দিতার বাবা গলির মুখ অবধি কথাটা ভাঙলেন না। বড় রাস্তায় অসংখ্য লোক চলাচল ও ট্রামবাসের শব্দের মধ্যে এসে নিশ্চিন্ত মনে বললেন, এখানে বলা যায়।
বাস্তবিকই তাই, কলকাতার রাজপথই গোপন কথা বলার সবচেয়ে ভাল জায়গা। চয়ন দাঁড়িয়ে বলল, বলুন।
কথাটা জিজ্ঞেস করতে একটু সঙ্কোচ হচ্ছে। অলিম্বিতার কাছ থেকে কথা বের করার উপায় নেই। বড্ড ভয় পাই ওকে।
কি কথা?
তোমার দাদা-বউদি আকারে ইঙ্গিতে বলতে চাইছে যে, তোমার সঙ্গে অনিন্দিতার একটা সম্পর্ক হয়েছে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
চয়ন মৃদু হেসে বলল, না মেসোমশাই। ওসব কথা মিথ্যে করে রটানো হচ্ছে। সত্যি নয়।
ভদ্রলোক তার মুখের দিকে স্তিমিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, আজকাল ছেলেরা আর মেয়েরা তো আখছার মেলামেশা করে। এটাকে একটা ইসু করে তোলাটা কি ঠিক? তোমার দাদা এই কারণ দেখিয়ে আমাদের তুলে দিতে চাইছে।
চয়নের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভদ্রলোকের অবস্থা সে জানে। বাসা বদলানো এর পক্ষে শক্ত ব্যাপার। সে মৃদু স্বরে বলল, আপনারা বুঝিয়ে বলুন যে ওঁদের সন্দেহটা সত্যি নয়।
মাথা নেড়ে অনিন্দিতার বাবা বললেন, মানুষ যখন গো ধরে তখন কিছুই বুঝতে চায় না। তোমাকে নাকি একদিন চড়ও মেরেছে শুনলাম। অত্যন্ত অন্যায়। ছিঃ।
চয়ন বলে, আমার জন্য ভাববেন না! আমি তো ভুলেই গেছি।
ভদ্রলোক ঘন ঘন মাথা নেড়ে বললেন, অনিন্দিতারও উচিত হয়নি তোমাকে বিপন্ন করা। তোমার অসুখের সময় যখন মা-মেয়ে সেবা করতে এল তখনও আমি বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম, চয়নের দাদা-বউদ্দি থাকতে তোমরা আগ বাড়িয়ে ওদের ডিঙিয়ে এসব করছি কেন? কিন্তু ফ্যামিলিতে আমার তো ভয়েস নেই। আমার মতামত বুদ্ধি পরামর্শকে ওরা গ্রাহ্যই করল না।
যা হওয়ার হয়ে গেছে, ও নিয়ে ভেবে আর কী করবেন?
ভাবনা কি ছাড়ে? দুখানা স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরের জন্য মাসে আটশো টাকা ভাড়া দিচ্ছি। তাও সস্তাই। এর কমে ভদ্রস্থ বাসা তো পাওয়া যাবে না। আমার হার্ড আনড মানি। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের সামান্য টাকা আর নামমাত্র পেনশন ভরসা। তা ভেঙেই চলছে। দিন দিন ব্যাঙ্কের টাকা কমছে। বড় ভয় হয়।
আপনি অত ভাববেন না, বরং বাড়িটা করে ফেলুন।
বাড়ি! বাড়ি করতে সব টাকা বেরিয়ে যাবে। খাবো কি? আমি তো তোমার মাসিমাকে বলেছিলাম, টিনের ঘর তুলে থাকি চলো। তা তাতে মা-মেয়ের ঘোর আপত্তি। পাকা বড়ি ছাড়া নাকি তাদের হবে না। মেয়েটার বিয়েরও তো খরচ আছে?
চয়ন ভেবে পেল না, এই ভদ্রলোককে সে এবার কী পরামর্শ দেবে।
সে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
উনি বললেন, তোমার মাসিমা বা আমার শরীরও ভাল নয়। টুকটাক ডাক্তার বদ্যি ওষুধবিসুধের জন্যও টাকা বেরিয়ে যায়। আয় কমেছে, কিন্তু ব্যয় তো আর কমছে না।
চয়ন চুপ করে রইল, স্বগতোক্তির তো জবাব দেওয়ার দরকার হয় না।
ভদ্রলোক চশমাজোড়া চয়নের দিকে তাক করে ময়োনো গলায় বললেন, সব সমস্যার সমাধান হয় না জানি। তবু যখন যেটা দেখা দেয় সেটাই যেন আজকাল বড্ড কহিল করে ফেলে আমাকে। এই যে বাড়ি ছাড়ার জন্য হুড়ো দিচ্ছে, আমার রাতে ভাল ঘুম হচ্ছে না, প্রেসার বেড়ে গেছে, খাওয়ায় রুচি নেই। অথচ কত ভাড়াটে তো বাড়িওলার সঙ্গে যুঝে আছে। আমি কাটা হয়ে আছি।
চয়ন এ কথারও জবাব খুঁজে পেল না।
শুনলাম, তোমাকেও নাকি তাড়াবে! সত্যি নাকি;
চয়ন অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করে বলল, বলেছিল একবার।
তাহলে এখন তুমি কি করবে?
কী করব তা তো জানি না, ঠিক করিনি।
তোমার মাসিমা আর অনিন্দিতা তো বলছে, তারা ছেড়ে দেবে না। দরকার হলে মামলা-মোকদ্দমা অবধি করবে। আমি এসব শুনে বড় ভয় পাচ্ছি। স্ত্রী-বুদ্ধি বড় ভয়াবহ।
এবার চয়ন খুব সাবধানে বলল, অনিন্দিতা কিন্তু বেশ সাহসী মেয়ে। আপনি ওর ওপর নির্ভর করতে পারেন।
নির্ভর করব? বলো কি? এ যুগে সাহসের কোনও দাম আছে?
চয়ন একটা শ্বাস ফেলে বলে, আমি বড় ভীতু। মেসোমশাই, আপনার চেয়েও ভীতু। কিন্তু কারও সাহস দেখলে আমার বড় ভাল লাগে।
ভদ্রলোক কথাটা শুনে সন্তুষ্ট হলেন না। মাথা নেড়ে বললেন, মেয়েদের সাহস ভাল জিনিস নয়। অনিন্দিতার সাহসের কথা বলছ! ওকে সাহস বলে না, অনিন্দিতা বেপরোয়া। ওতেই তো অশান্তি হয়। কাউকে মান্যগণ্য না করা কি ভাল?
চয়ন ফের সতর্কভাবে বলল, মেসোমশাই, আপনাদের যা অবস্থা আমারও তো তাই, ভেবে কী হবে? আপনারাও শুনেছি বউদির আত্মীয়।
ভদ্রলোক মুখটা একটু বিকৃত করে বললেন, আত্মীয়তা যেটুকু সেটুকু না ধরলেও হয়। আজকাল কেউ আত্মীয়তা মানে নাকি? তোমাকে আর একটা কথা বলার ছিল, বলতে একটু লজ্জা পাচ্ছি।
বলুন না, আমাকে লজ্জা কিসের?
ভদ্রলোক একটু কাছে এগিয়ে এসে চাপা গলায় বললেন, আমার একটা কথা মনে হয়, বলব?
চয়নের বুকটা এবার একটু কেঁপে উঠল, মৃদু একটা শ্বাসকষ্টও টের পেতে লাগল সে। বোধ হয় এ কথাটা বলার জন্যই এত ভূমিকা, হঠাৎ চয়নের মাথার ভিতর একঝলক আলোর উদ্ভাস যেন তাকে জানিয়ে দিল, কথাটা কী। তবু সে অপেক্ষা করল, বিনয় এবং ধৈর্যের সঙ্গে।
ভদ্রলোক মুখটা তার কানের খুব কাছাকাছি। এনে বললেন, আমার মনে হয় তোমাকে অনিন্দিতার খুব পছন্দ।
চয়নের কান গরম হল, শ্বাসকষ্ট বাড়ল। তবু সে নিপাট ভোলমানুষের মতো বলল, হ্যাঁ। অনিন্দিতা আমাকে বন্ধু বলে মনে করে।
ভদ্রলোক এ জবাবে খুশি হলেন না। ঘন ঘন মাথা নাড়া দিয়ে বললেন, সে ব্যাপার নয়। ওর ছেলে বন্ধু তো আরও ছিল; তোমার প্রতি ওর মনোভাব একটু ডিপ। বুঝছি না?
না তো! চয়ন খুবই বিস্ময় প্রকাশ করে।
ওর বোধ হয় ইচ্ছে তোমার সঙ্গেই ঘর বাধে।
সয়ন জোর করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে, কিছুটা সফলও হয়, মৃদু হেসে বলে, অনিন্দিতা বুদ্ধিমতী, এরকম চিন্তা সে স্বপ্নেও করবে না।
কেন বলে তো! দোষোটা কোথায়?
ঘর বাধা তো বিলাসিতা নয় মেসোমশাই। তার পেছনেও অনেক ব্যাপার থাকে। আপনি তো নিজেই জানেন কত সমস্যায় আমরা দিন কটাই। আমার চালচুলো নেই, টিউশনি সম্বল, আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিতান্ত আহাম্মকেও দেখবে না। আপনি ভুল বুঝেছেন মেসোমশাই।
ভদ্রলোক কথাটা স্বীকার করতে চাইলেন না, বললেন, ওটা কোনও কথা নয়। তোমার মধ্যে গুণও কিছু কম নেই, একদিন দাঁড়িয়ে যাবে। আর ফিটের ব্যামো? ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলে, ওতে বিয়ে সাদী চলতে পারে।
আপনারা অনেক দূর ভেবে ফেলেছেন, কিন্তু ওসব ভাবতেই আমার সংকোচ হয়, লজ্জাও হয়।
অনিন্দিতার বাবা মুখখানা কানের কাছ বরাবর রেখেই বললেন, আমি তো এর মধ্যে লজ্জার কিছু দেখছি না। অনিন্দিতার ভাবগতিক দেখে মনে হয়, ওর আগ্রহ আছে। তোমার শুধু একটু আত্মবিশ্বাসের দরকার।
মুনি একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপনি বাড়ি যান মেসোমশাই, এ নিয়ে আর ভাববেন না। আমি বড় অপদাৰ্থ।
দাঁড়াও। কথাটা এখনও শেষ হয়নি। আমার পরিবার তো দেখেছি। তিন জনের সংসার। আমার ছেলেও নেই। আমার খুব মনে হয়, সংসারটা যেন অসম্পূর্ণ, আর একজন কাউকে যেন দরকার ছিল ফাকাটা ভরাট করতে। এদিকে তোমারও তো আসলে কেউ নেই। তোমারও একটা স্থায়ী এবং নিরাপদ আশ্রয় দরকার। যদি অনিন্দিতাকে বিয়ে করো তাহলে আমরা চার জন মিলেমিশে বেশ থাকতে পারব। আমাদের বড় জনের অভাব। যদি এর মধ্যে ঘরজামাই প্রথার কথা মনে হয় তাহলে সেটা ভুল হবে। অস্তিত্বের সংকটেই আমাদের একসঙ্গে থাকাটা দরকার। তোমাকেও দেখাশোনা করার লোক হবে। যদি রাজি থাকো তাহলে আমি হাতের পাতের যা আছে সব দিয়ে জমিতে একখানা বাড়ি তুলি। তারপর চার জন নিশ্চিন্তে গিয়ে সেখানে থাকি।
চয়ন ম্লান একটু হেসে বলল, আপনি কি অনিন্দিতার সঙ্গে কথা বলেছেন?
সরাসরি নয়। তবে হাবেভাবে বুঝেছি।
আপনি আরও একটু ভাবুন। অনিন্দিতার সঙ্গে কথাও বলুন।
সে না হয় বলব, কিন্তু তোমার মনোভাবটা আগে জানা দরকার।
আমাকেও একটু সময় দিন।
আমার মনে হয় কি জানো? তোমাদের বিয়ে হলে সব সমস্যার সুষ্ঠু একটা সমাধান হয়ে যায়।
সমস্যার সমাধান! কি জানি, হয়তো নতুন সমস্যাই হবে একটা।
না না, কোথাও সমস্যা হবে না। তুমি একটু পজিটিভলি ভাবো। নেগেটিভ ভাবলে কিছুই হতে চায় না।
ভাবিব, এখন তবে আমি যাই?
এসো গিয়ে।
একা হতে পেরে চয়ন হাঁফ ছাড়ল। তারপর গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ল।
তার চিন্তান্বিত মুখ দেখে আজ মোহিনীও জিজ্ঞেস করল, চয়নদা, আপনার শরীর আবার খারাপ করেনি তো!
না, ঠিক আছে।
তবে মুখ অত শুকনো কেন?
চয়ন একটু হেসে বলল, দুনিয়াটা একটা পাগলা, না?
বাঃ রে, তার মানে কী হল?
মানে! না, এর কোনও মানে নেই।
আপনি ঠিক আমার বাবার মতো হয়ে যাচ্ছেন। বাবাও মাঝে মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলে।
চয়ন একটু লজ্জা পেয়ে বলে, তাই নাকি?
মোহিনী হেসে ফেলে বলল, কাল রাতেই তো, খাওয়ার টেবিলে সবাই চুপচাপ বসে খাচ্ছি, বাবা হঠাৎ বলে উঠল, আজকে আমার মনের মাঝে ধাই ধপাধপ তবলা বাজে। আমরা তো অবাক!
চয়ন লজ্জিত মুখে চুপ করে রইল। কিন্তু পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তার বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে মাঝে মাঝে। একটু যেন শ্বাসকষ্ট হয়। বারবার আনমনা হয়ে যায় সে। তাকে নিয়ে এসব কী হচ্ছে?
পড়ানোর এক ফাঁকে চয়ন হঠাৎ বলল, ভীতু আর দুর্বলদের একটা অসুবিধে কি জানো? তারা ঘটনাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাদের দিয়ে যে যা-খুশি করিয়ে নেয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ওরে ভীরু, তোর ওপরে নেই ভুবনের ভার।
মোহিনী হেসে ফেলল, চয়নদা, আজ নিশ্চয়ই একটা সিরিয়াস ঘটনা ঘটেছে, তাই না? আজ আপনি ভীষণ আনমাইণ্ডফুল, কী হয়েছে?
চয়ন মাথা নেড়ে বলল, বলা যায় না।
তাহলে বলবেন না, কিন্তু রাস্তায়-ঘাটে আজ একটু সাবধান থাকবেন। অত আনমাইণ্ডফুল হলে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।
না, তা হবে না। তবে আজ আমি একটু চঞ্চল ঠিকই।
চয়ন উঠতে যাচ্ছিল, মোহিনী বলে উঠল, দাঁড়ান চয়নদা, আপনাকে যে চা দেওয়া হয়নি।
তাতে কি? আজি থাক।
না না, বসুন, আজ মা বাড়ি নেই, বাবার সঙ্গে একটা রিসেপশনে গেছে। আমাকে বলে গেছে যেন আপনাকে চা-টা দিই। দেওয়া হয়নি শুনলে মা ভীষণ বকবে। বসুন।
মোহিনী উঠে গেলে চয়ন চুপ করে বসে রইল। মনের ভিতরে একটা উথালিপাথাল হচ্ছে। ভয় হচ্ছে, তার ভয়, সে প্রতিরোধহীন, বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু অনিন্দিতার বাবা যদি জোরজবরদস্তি শুরু করে, যদি নানারকম কৌশলের আশ্রয় নেয়, তাহলে? যদি প্রতিরোধ ভেঙে যায় তার?
ডোরবেল বাজাল। দরজা খুলল। করিডোরে পায়ের শব্দ আর একঝলক বিদেশি পারফিউমের সুবাস ভেসে এল। পড়ার ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল রিয়া উঁকি দিয়ে বলল, চয়ন একা বসে কেন?
তটস্থ হয়ে চয়ন বলে, মোহিনী বসিয়ে রেখে গেল।
রিয়ার পিছনে কৃষ্ণজীবন, হাতে মস্ত ফুলের তোড়া আর একটা বড়সড় ঝলমলে সোনালি রঙের বাক্স। বলল, চয়ন নাকি? কী খবর তোমার? অনেকদিন দেখা নেই।
চয়ন শশব্যাস্তে উঠে দাঁড়াল, আজ্ঞে ভালই।
কৃষ্ণজীবন আর রিয়া ঘরে ঢুকল, কৃষ্ণজীবন চারদিকটা চেয়ে দেখে অকারণেই বলে উঠল, বাঃ!
কেন বাঃ, কিসের বাঃ, তা বুঝতে পারল না চয়ন। কৃষ্ণজীবন হঠাৎ ফুলের তোড়া আর বাক্সটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও, এগুলো তোমার।
চয়ন প্ৰচণ্ড অবাক হয়ে বলে, আমার!
নাও নাও।
আজ্ঞে আমি! বলে সঙ্কুচিত হাতে ফুলের তোড়া আর প্যাকেটটা নিল চয়ন। রীতিমতো ভারী দুটোই!
কৃষ্ণজীবন উদার হাসি হেসে বলল, উপহারে উপহারে আমি জর্জরিত। আর উপহার রাখার জায়গা নেই। ওটা তুমি নিয়ে যাও। কোনও সুইটহার্ট থাকলে ফুলের তোড়াটা তাকে দিও। আর বাক্সের মধ্যে কী আছে তা আমিও জানি না। বাড়িতে গিয়ে খুলে দেখো, উইস ইউ এ গুড লাক।
রিয়া বলল, নাও চয়ন। লজ্জার কিছু নেই। চা-টা কিছু খাওনি এখনও?
মোহিনী চা করতেই গেল।
তাহলে বোসো একটু। ওগো তুমি একটু চয়নের সঙ্গে কথা বলো, আমি একটু দেখে আসি মেয়েটা কী করছে।
কৃষ্ণজীবন বসল। এই সুপুরুষ, মহাপণ্ডিত এবং বিখ্যাত মানুষটির সামনে চয়ন বরাবরই অস্বস্তি বোধ করে। সে শুনেছে, ঐর একখানা বই ডারলিং আর্থ খুব হইচই ফেলে দিয়েছে বিদেশে। তাতে সে আরও সংকুচিত বোধ করে। নিজের সামান্যতা নিয়ে সে সর্বদাই বিব্রত।
কৃষ্ণজীবন বলল, তোমার একটা পারিবারিক অশান্তি ছিল না? ডিটেলস ভুলে গেছি, বোধ হয় তোমার দাদার সঙ্গে গণ্ডগোল। সেটা কি এখনও আছে?
চয়ন লজ্জায় মরে গিয়ে বলল, মা মারা যাওয়ার পর থেকে সম্পর্কটা ততটা খারাপ নেই।
ভাল। খুব ভাল। তাহলে মা ছিল দি স্টােম্বলিং ব্লক? বলে খুব হাঃ হাঃ করে হাসল। হাসি থামিয়ে বলল, চারদিকে খুব ভাগাভাগির হুজুগ পড়েছে, দেখেছ? সবাই ভাগ হতে চায়। স্ত্রী চায়, মা-বাপের সঙ্গে সন্তান ভাগ হতে চায়, ভাইয়ে বোনে ভাগ হতে চায়। এমন কি দেশের নানা মানবগোষ্ঠীও চায় ভাগাভাগি করে আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করতে। হাওয়ায় এ এক নতুন জীবাণু ঢুকেছে। সম্প্রীতি সংহতির কথা বলে আর কী লাভ বলো তো! ওসব কথায় কেউ কানই দিচ্ছে না। মেয়েরাও বোধ হয় ভাগ হতে চাইছে। নারী স্বাধীনতা নিয়ে কী বিরাট হইচই!
চয়ন মাথা নেড়ে বলে, যে আজ্ঞে।
কৃষ্ণজীবন খানিকক্ষণ আনমনে একটা ক্যাবিনেটের দিকে চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল, মানুষ ধীরে ধীরে বড় চিন্তা করতে ভুলে যাবে। চিন্তারাজ্যও খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে তার। সে ছোট করে ভাবতে শুরু করবে। ছোট ছোট কথা ভাববে। মানুষ কি খুব স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে চয়ন?
চয়ন একটু বিব্রত হয়ে বলে, যে আজ্ঞে।
কৃষ্ণজীবন হতাশায় একটু মাথা নাড়া দিয়ে বলে, আমার সংসারেও অনেক অশান্তি, আমার মা-বাবা এখনও বেঁচে আছেন। কিন্তু সে এক অদ্ভুত বেঁচে থাকা। দু ভাইয়ের প্রচণ্ড ঝগড়া। এক ভাই আলাদা হয়ে গেছে—কেন এসব হয় বলো তো!
কঠিন প্রশ্ন। চয়ন বিনীতভাবে চুপ করে থাকে।
কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বলে, কি মনে হয় জানো? মানুষের কোনও গন্তব্য নেই, শুধু গতি আছে। সে কোথায় চলেছে তা সে জানেই না।
যে আজ্ঞে।
এরপর এক গভীর অন্যমনস্কতায় ড়ুবে রইল কৃষ্ণজীবন। চয়নকে ভুলেই গেল বোধ হয়। মিনিট পাঁচেক এই মানসিক অনুপস্থিতির পর স্বপ্লোখিতের মতো মাথা তুলে কৃষ্ণজীবন তার দিকে চেয়ে বলল, ওঃ হো, তোমাকে একটা কথা বলাই হয়নি। আমার এক ছাত্র মস্ত এক কোম্পানির বড় কর্তা, তাকে তোমার কথা বলেছিলাম। সে তোমাকে দেখা করতে বলেছে। কিন্তু সে তো বোধ হয় মাস দুই আগের কথা। ভুলেই গিয়েছিলাম।
চয়নের বুক দুরুদুরু করে উঠল। কিছু বলল না।
কৃষ্ণজীবন একটা শ্বাস ফেলে বলল, দেখ, আমার কাছে তোমার চাকরিটা এতই সামান্য ব্যাপার যে মনেই ছিল না। অথচ তোমার কাছে ব্যাপারটা বড় গুরুতর। কেন যে আজকাল আমার এমন সব ভুল হয়!
চয়ন বিনয়ের সঙ্গে বলল, তাতে কি? আমি না হয় তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করব।
হ্যাঁ হ্যাঁ, বোধ হয় খুব দেরি হয়ে যায়নি। খুব বড় কোম্পানি! সবসময়ে লোক দরকার হয়। তুমি বোসো, আমি একটা চিঠি দিয়ে দিচ্ছি। তোমাকে। কালই দেখা কোরো।
যে আজ্ঞে।
বিশাল উপহারের বাক্স, ফুলের তোড়া এবং পকেটে কৃষ্ণজীবনের চিঠি নিয়ে চয়ন যখন বাড়ি ফিরল। তখনও সে বুঝতে পারছিল না, আজকের দিনটা তার ভাল গেল না খারাপা! এক দিনে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সে একটু বেসামাল বোধ করছে। মাতালের মতো।
তালা খুলে ঘরে ঢুকে সে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ঘটনাগুলো বাস্তব কি না একটু সন্দেহ হচ্ছিল তার।
স্টোভ জ্বেলে যখন রান্না করতে বসেছে চয়ন, তখনই হঠাৎ মনে হল, অন্ধকার ছাদে জলের ট্যাঙ্কের পাশে কেউ দাঁড়িয়ে, তার দিকেই মুখ।
চয়ন তাকাতেই অনিন্দিতা চাপা গলায় বলল, অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। চয়নের হাত পা হিম হয়ে গেল আজ। অনিন্দিতাকে তার তো ভয় পাওয়ার কথা নয়।
অনিন্দিতা এগিয়ে এল। কাছে। বলল, বাবা তোমাকে আজ কী বলেছে বলো তো?
চয়ন লজ্জায় গুটিয়ে গিয়ে বলল, ও কিছু নয়।
বাবার মাথাটাই গেছে। কী সব আবোল-তাবোল ভাবে, প্ল্যান করে, তার ঠিক নেই। তুমি বাবাকে সিরিয়াসলি নিও না।
চয়ন চুপ করে রইল।
এ কথাটা বলার জন্যই আজ রিস্ক নিয়েও ছাদে এসেছি। তোমার দাদা-বউদি আমাদের ছাদে আসা বন্ধ করেছে, জানো তো?
জানি।
তবু বাবার জন্যই আসতে হল। বাবাকে নিয়ে আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। কিছু মনে কোরো না।
চয়ন হঠাৎ বলল, অনিন্দিতা, একটা জিনিস নেবে? বলেই ফুলের তোড়া আর উপহারের বাক্সটা ঘর থেকে এনে তাকে দিয়ে বলল, নিয়ে যাও।
এ কী? এ দিয়ে কি হবে?
নাও। নিলে আমার ভাল লাগবে।
অনিন্দিতা তার সুন্দর দাঁতে চমৎকার হাসল, আচ্ছা নিলাম।