কত সহজভাবে একটা হত্যাকাণ্ড এবং মৃত্যু সংঘটিত হতে পারে! কত সহজ! কত সামান্য শারীরিক আয়াস! আর সামান্য একটু ইচ্ছা।
ধারা একবারও নিজেকে সরিয়ে নেয়নি। একটুও চেষ্টা করেনি ধ্রুবর হাত ছাড়িয়ে দিতে। যেন বা খেলাচ্ছলে মৃত্যু তার আকাঙিক্ষত।
কিন্তু ধ্রুব কেন মারবে ধারাকে? তার ইচ্ছাশক্তির যে তেমন জোর নেই। তার আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে বসেছিল ধারার গলায়, কিন্তু ততদূর কঠিন হতে পারেনি। দুহাতের ভিতর সে অনুভব করল ধারার শ্বাসের কম্পন, রক্তের মৃদু সঞ্চালন, কণ্ঠমণির ওঠাপড়া। ধারার দুই চোখ তার চোখে নিবদ্ধ। গলার সামান্য চাপে চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল। মুখখানা একটা অতিরিক্ত ফোলানো লাল টুকটুকে বেলুন। মুখখানা সামান্য হাঁ। জিব কাঁপছে। বার দুই খঃ খঃ শব্দ করল ধারা। ভাষাহীন এক রুদ্ধ আর্তনাদ।
একটু এলিয়ে পড়ছিল ধারার শরীর। হাঁটুর কাছ থেকে ভাঙছিল। ধ্রুব এই পর্যন্ত দেখল। তারপর প্রশ্ন করল নিজেকে, কেন? ওকে মেরে কী হবে তোমার?
নিজেই জবাব দিল, কিছুই কি নয়? দেখা যাক, আমার ভিতরে কোনও বিস্ফোরণ ঘটে কি না।
কীসের বিস্ফোরণ? তোমার বারুদ ভিজে গেছে কবে! শত স্ফুলিঙ্গও আর বিস্ফোরণ ঘটাবে না।
দেখা যাক। কিছু করা তো হবে। একটা অন্যরকম কিছু, যা রোজকার কৃতকর্মের মতো নয়। যা অন্যরকম।
ফাঁসির দড়ি আছে। আছে যাবজ্জীবন গরাদের ভিতরে থাকার কষ্ট। কিংবা ছদ্মবেশে পালিয়ে বেড়ানো। ভয় নেই?
ভয়ই তো দরকার। আমার জীবন যে বড় নিরাপদ, বড় ঘটনাহীন। আমার প্রায় সব পথই নির্বিঘ্ন করে রেখেছে আমার জন্মদাতা। তার সব ক্ষমতা প্রয়োগ করে আমাকে দীপশিখার মতো আড়াল করতে চেষ্টা করছে। আমি সেই সিকিউরিটি ভেঙে দেব। দিই?
শুধু নিজের কথা ভেবে ওকে মারবে? তোমার জীবনে ওর ভূমিকা কতটুকু? এ তো তোমার দর্শন নয়।
নয়? আমার দর্শন বলতে আছেই বা কী? আমার ভিতরে এক চিরঘুমন্ত আমি। কিছুতেই তাকে জাগাতে পারছি না যে! কতবার চেষ্টা করেছি। হেরে যাচ্ছি। কী যে করতে চাই কিছুই জানি না। অস্থিরতা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। মনে হয় খুব মহৎ কিছু হওয়ার কথা ছিল আমার। এই দ্বন্দ্বে আমি বারবাব মাতাল বা লম্পট হওয়ার চেষ্টা করেছি। হতে পারিনি তো তাও।
ধারাকে খুন করে কি কিছু হতে পারবে?
ওকে খুন করার পিছনে আমার কোনও মোটিভ নেই। অকারণ এই হত্যা সংঘটিত হলে আমার একসময় না একসময় অনুতাপ আসবে। আসবেই। তীব্র সেই অনুতাপের দহনে যদি দপ করে জ্বলে উঠতে পারি কখনও!
কোনওদিন ওইভাবে হিসেব করে তো জাগেনি মানুষ। ঘৃণা থেকে যা জাগে তা তীব্রতর ঘৃণাই। হননেচ্ছা থেকে আরও তীব্রতর হননেচ্ছা জন্ম নেয়। মৃত্যু কত সহজ দেখছ না? পদ্মপাতায় জলের মতো টলমল করে এই দেহের ভিতরে প্রাণবিন্দু। একটুতেই খসে যায়। মেরো না। মেরো না। পারো তো মৃত্যুকে অবলুপ্ত করো। মা ম্রিয়স্থ। মা জহি। শক্যতে চেৎ মৃত্যুমবলোপয়ঃ।
বড় ক্লান্তি লাগল ধ্ৰুবর। একটি মৃত্যুর পর আছে দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া। অত প্রতিক্রিয়া সে সামলাতে পারবে না। সামলাবে তার বাবা কৃষ্ণকান্ত। সেটাও ভারী অপমানকর হবে। লোপাট করা হবে প্রমাণ এবং সাক্ষীসাবুদ। দাঁড় করানো হবে মিথ্যা সাক্ষী। রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হবে। প্রচ্ছন্ন হুমকিতে কেঁপে যাবে বিচারকের রায় লেখা হাত। ধারার হত্যাকারী কিছুতেই ধরা পড়বে না। তার ধরা পড়তে নেই।
ধ্রুব খুব ধীরে হাত দুটো সরিয়ে নেয়।
ধারার জ্ঞান ছিল না বললেই হয়। একটা মৃদু গোঙানির শব্দ করে এবং প্রকাণ্ড শ্বাস ফেলে সে পড়ে গেল মেঝেয়। ফাঁকা ঘরে পতনের শব্দটা হল ভীষণ।
ধ্রুব হার্স্ট-এইড জানে না। কিন্তু একটুও না ঘাবড়ে সে হাঁটু গেড়ে বসে নিচু হয়ে ধারার মুখে মুখ দিয়ে প্রাণপণে বাতাস টেনে আবার তা সঞ্চারিত করতে থাকল ভিতরে। অনেকক্ষণ ধরে। প্রচণ্ড পরিশ্রমে তার ঘাম হতে লাগল। এক ফাঁকে উঠে গিয়ে সে পাখাটা চালিয়ে দিয়ে এল ফুলম্পিডে। বাথরুম থেকে জল এনে মুখে ঝাপটা দিল কয়েকবার।
আধঘণ্টা বাদে বিভ্রান্ত, কম্পমান, দুর্বল ধারা উঠে বসতে পারল। প্রচণ্ড কাশছে, কাঁদছে। তার। মুখের লালা আর চোখের জল এক হয়ে যাচ্ছে। একটিও কথা নেই মুখে। শুধু হিকার মতো শব্দ উঠে আসছে বুক থেকে। তা কান্নাও হতে পারে বা অবরুদ্ধ খাস।
ধ্রুব পালাল না। বসে রইল মুখোমুখি। পাথরের মতো চুপ।
আরও অনেকক্ষণ বাদে, যখন সময়ের হিসেব হারিয়ে ফেলল ধ্রুব, ধারা ভাঙা গলায় বলল, কী চেয়েছিলে তুমি? মারতে?
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু পারলাম না।
কিন্তু কেন? তুমি কি পাগল?
ধ্রুব মাথা নাড়ল, বোধহয়। আমাকে বিশ্বাস করা তোমার ঠিক হবে না, ধারা।
ধারার চোখে আতঙ্ক, ঘৃণা, বিদ্বেষ। ধ্রুবর দিকে একদৃষ্টে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, আমার কোনও সিকিউরিটি নেই, পুরুষ সঙ্গী নেই, তাই?
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, না।
থাকলে সাহস করতে?
করতাম। কিন্তু ও কথা কেন? আমি তো পারিনি দেখছই!
পারোনি! কে বলল পারোনি। জাস্ট নাউ ইউ হ্যাভ কিলড সামথিং ইন মি। আমি আর সেই আগের মানুষটা নেই। জানো সেটা?
ধ্রুবর ভিতরে প্রতিক্রিয়াটা শুরু হল এখন, এই মুহূর্তে। নিজের ভিতরে একটা কাঁপুনি টের পাচ্ছিল সে। ভারী অবশ লাগছে শরীর। শরীরের ভিতরে একটা যন্ত্রণার মতোও কিছু টের পাচ্ছে সে। মাথাটা ঘোলাটে। সে একজন মানুষকে অল্পের জন্য খুন করতে করতে বেঁচে গেছে।
ধ্রুব একটু হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে, তুমি আমাকে অফারটা দিয়েছিলে।
ধারা নিজের মুখটা দুহাতে চেপে ধরে যেন অবিশ্বাস ভরে মাথাটা নাড়ে। বলে, আমি যে বিশ্বাস করতে পারছি না। উঃ। তোমাকে ঠাট্টা কবে কী বলেছি আর তুমি সত্যিই তা করবে?
চেষ্টা করে দেখলাম পারা যায় কি না।
তুমি যাও। প্লিজ! তুমি চলে যাও।
আর আসব না তো?
না। আমি তোমাকে সহ্য করতে পারছি না। আর-একটু হলেই তুমি আমাকে মেরে ফেলতে! উঃ।
ধ্রুব তার শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করল। পারল না। তার জিবও খড়ের মতো শুকনো। মৃদু স্বরে সে বলল, মেরে ফেলতাম ঠিকই। কিন্তু তবু তোমাকে বাঁচাল কে বলল তো!
কে বাঁচাল? কী বলতে চাও?
তোমাকে যে মারতে চেয়েছিল সেও ধ্রুব, যে বাঁচাল সেও ধ্রুব।
আমি ওসব কথা বুঝতে চাই না। প্লিজ! যাও।
ধ্রুব উঠল। নেমে এল রাস্তায়।
অনেক রাত হয়েছে। লবণহ্রদ এলাকায় যানবাহন নেই। সে রাস্তাও ভাল চেনে না। হাঁটাপথ কোথা দিয়ে কোথায় চলে গেছে। উদোম, বিশাল এক জায়গা। ছড়ানো ছিটোনো ঝুঁ-চকচকে নতুন সব বাড়ি।
কিছুদুর চেনা পথে গিয়ে আচমকা পথের নিশানা হারিয়ে ফেলে সে। কিন্তু চিন্তিত হয় না। আজ সে বড় অন্যমনস্ক। বড় অন্যরকম।
হাঁটতে হাঁটতে ধ্রুব বেশ কিছুদূর চলে গিয়ে এক জায়গায় দাঁড়ায়। লোকবসতি প্রায় শেষ। সামনে প্রান্তরের মতো কিছু অন্ধকারে ভয়াল ও বিশাল হয়ে আছে।
শহুরে ধ্রুব একবার পা বাড়িয়েও টেনে নেয়। অচেনাকে আজ তার ভয় করে। তার ভিতরে যে একজন হত্যাকারী আছে তা অনেকদিন ধরে জানে ধ্রুব। কিন্তু সেই হত্যাকারীর অস্তিত্ব সম্পর্কে এত নিঃসংশয় ছিল না সে। আজ হল।
পিছনে রাস্তার শেষ আলোটি জ্বলছে। তার ছায়া প্রলম্বিত হয়ে সামনে প্রান্তরের অন্ধকারে গিয়ে মিশে গেছে। ভৌতিক সেই ছায়ার দিকে ধ্রুব অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে। কিছু মনে হয়, একটু ভয়-ভয় করে। কেমন যেন নিজেকে অবিশ্বাস হতে থাকে, নিজের সঙ্গে সহবাস করতে অস্বস্তি হয়।
ধ্রুব ফেরে এবং ফের হাঁটতে থাকে। শরীর ক্লান্ত, ঘুম পাচ্ছে, খিদেয় জ্বলে যাচ্ছে পেট। সেই ব্যথাটা ধীরে ধীরে চাগাড় দিচ্ছে।
আচমকাই দুটো হেডলাইট তাকে ঝলসে দেয়। ধ্রুব চোখ আড়াল করে দাঁড়ায়। তারপর হাত তোলে, রোখকে!
গাড়িটা পার্ক করাই ছিল। পুলিশের একটা জিপ। দুজন লোক নেমে এগিয়ে আসে। খুব শ্লথ এবং সতর্ক ভঙ্গি।
ধ্রুব চৌধুরী না? উই মিট এগেন।
ধ্রুব দেখতে পায়, একজন ইন্সপেক্টর বা ওইজাতীয় লোক। মুখটা চেনা। সে বলল, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।
আপনি তো প্রায়ই বাস্তা হারান। কিন্তু এখানকার গভর্নমেন্ট হাউসিং এস্টেটের এক মহিলাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে থানায় একটা টেলিফোন গেছে। কী ব্যাপার বলুন তো!
টেলিফোন! বলে ধ্রুব অবাক হয়। ধারার টেলিফোন নেই। যদি করে থাকে তবে অন্য কারও ফ্ল্যাট থেকে। সেক্ষেত্রে খবরটা ধারা গোপন রাখেনি বলেই ধরে নিতে হবে।
সে বলল, কী করবেন? অ্যারেস্ট?
উপায় কী?
তা হলে চলুন।
আপনি জিপে উঠে বসুন। আমাদের লোক ভদ্রমহিলার স্টেটমেন্ট আনতে গেছে। এলে আমরা রওনা হব।
ধ্রুব আপত্তি করে না। পুলিশের জিপ একটি চমৎকার নিরাপদ আশ্রয়। সে ঠিক যথাস্থানে পৌঁছে যাবে। ঘটনাগুলো সে স্পষ্টই অনুমান করতে পারে। তাকে থানায় নিয়েই পুলিশ কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীকে ফোন করবে। কিছু সাংকেতিক বা আধা-সাংকেতিক কথা হবে তাদের। তারপর পুলিশ সামান্য একটু আদর মেশানো শাসন করে নিজেদের গাড়িতে করে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।
ধ্রুব জিপগাড়িতে উঠে বসল। চোখ বুজে মৃদু হেসে আপনমনে বলল, ধারা, তুমি পারবে না। সহজাত কবচ কুণ্ডল নিয়ে জন্মেছি আমি! আমি অবধ্য, অপরাজেয়।
কতক্ষণ বসে মশার কামড় খেতে খেতে ঢুলেছে ধ্রুব, তা খেয়াল নেই। আচমকা একটা হাত তার কাধ ধরে কাঁকাল। ধ্রুবদা! এই ধ্রুবদা!
কে?–ধ্রুব চোখ মেলে।
আরে আমি। আমি সদানন্দ।
সদানন্দকে চেনে ধ্রুব। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর। কৃষ্ণকান্ত একে চাকরি করে দেন। সদানন্দ ধ্রুবর পাশে উঠে বসে বলে, কী করেছিলেন বলুন তো! ভদ্রমহিলা সাংঘাতিক আপসেট।
ধ্রুব জবাব দেয় না। চারদিকে চেয়ে দেখে। ধারার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বহু দূর চলে গিয়েছিল সে। আবার কী করে যে ফিরে এল।
ধ্রুব সদানন্দর মুখের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটা কী স্টেটমেন্ট দিল?
সে সাংঘাতিক। অ্যাটেম্পটেড মার্ডার।
তা হলে ও বেঁচে আছে কী করে?
সেটা পয়েন্ট নয়। পয়েন্ট হল, কী হয়েছিল তা উনি জানেন না।
তা হলে?
আমিও জানতে চাই কী হয়েছিল! বলবেন?
ধ্রুব একটা হাই তুলে বলে, আমিই কি জানি! না জানলে বলবটা কী?
গলা টিপে ধরেছিলেন নাকি?
ধরেছিলাম। তবে মারার জন্য নয়। জাস্ট ফান।
মহিলা কে হন আপনার?
ধ্রুব একটু চুপ করে থেকে বলে, বন্ধু।
কতদিনের চেনা?
জেরা করছ নাকি সদানন্দ?
আরে না। কেস তো ডিসমিস হয়েই গেছে। আপনার কেস কি টেকে! তবে মার্ডার হয়ে গেলে একটু ঝঞাট ছিল। মেয়েটা কি হাফ-গেরস্ত?
তা নয়। এমনিতে শি ইজ গুড। হাই কানেকশনস। তবে একটু অ্যাডভেনচারাস টাইপের।
বুঝেছি। সুশীল, কী করছ! গাড়ি ছাড়ো।
দুজন রাস্তার ধারে পেচ্ছাপ করতে করতে গল্প করছিল। ডাক শুনে প্যান্টের চেন টানতে টানতে এসে জিপে উঠল।
তাদের একজন বলল, আসামী তো ধরা পড়েছে। এবার কী করবেন, সদানন্দদা?
সোজা কালীঘাট চলো। বাড়িতে পৌঁছে দিই আগে।
গাড়ি চলতে লাগল।
সদানন্দ ধ্রুবর দিকে ফিরে বলল, বাড়ি গিয়ে একটা ট্রাংকুলাইজার খেয়ে শুয়ে পড়ুন।
তোমরা কেসটা নেবে না, সদানন্দ?
কীসের কেস?
এই ধারা যে নালিশ করল।
সদানন্দ হেসে ওঠে, নিয়েছি তো। কেস নেব না কেন?
বাজে বোকো না। কেস নিলে আমাকে তোমার অ্যারেস্ট করা উচিত।
করেছি তো। ফর্মালিটি মেইনটেনড টু দি লাস্ট। এই তো আপনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু লক-আপে নিচ্ছ না।
লক-আপ সকলের জন্য নয়। আপনার লক-আপ লাগবে না।
কেন লাগবে না?
যেহেতু আপনি পালাবেন না।
কে যদি ওঠে এবং আমাকে যদি খুঁজে না পাও?
সদানন্দ খুব হাসে। তারপর বলে, সাত মন ঘিও পুড়বে না দাদা, রাধাও নাচবে না।
তার মানে?
বাড়ি গিয়ে আগে ঘুমোন তো! কাল আমি বিকেলের দিকে গিয়ে দেখা করবখন। তখন কথা হবে।
আমি কিন্তু আজ এক ফোঁটাও মদ খাইনি, সদানন্দ।
খাননি!–বলে সদানন্দ যেন খুব সতর্ক ভাবে বাতাসটা শোকে। তারপর বলে, তাতেই-বা কী প্রমাণ হয়? আপনি খুন করতে চেয়েছিলেন?
প্রাইমা ফেসি কেস তো তাই!
জিপের সামনে বসা দুজনের একজন মুখ ফিরিয়ে বলে, আপনি তো বলেছিলেন ইট ওয়াজ এ ফান।
তাও বটে।
তা হলে আবার কী? আমরা ভদ্রমহিলাকে কাল বুঝিয়ে দেব ইট ওয়াজ রিয়েলি ফান। আর কিছু নয়।
ধ্রুব একটু চুপ করে থেকে সদানন্দকে চাপা স্বরে বলে, আমাকে লক-আপে নিয়ে চলো।
সে কী?
নিয়ে চলো, সদানন্দ। ধারা যে কমপ্লেন করেছে তা অনেকটা সত্যি।
রাখুন তো দাদা। ওসব মেয়েছেলেকে আমরা চিনি। দুবার ডিভোর্স করেছে, ছেলেছোকরাকে নাচিয়ে বেড়ায়। ওসব আমরা জানি।
ডিভোর্সের খবর জানলে কী করে?
বাঃ, এতক্ষণ ধরে তদন্ত করতে হল না?
লোকজন জমেছিল?
দু-চারজন। ও নিয়ে ভাববেন না। সাক্ষী কেউ দেবে না।
কেসটা হাস-আপ করবে, সদানন্দ?
কেই নয় তার আবার হাস আপ! এটা কেস নাকি? যেসব মেয়েছেলের পিছনে চোদ্দোটা পুরুষ ঘোরে তাদের ওরকম কেস দু-চারটে হয়ই। আপনি এর সঙ্গে আর মিশবেন না।
লবণহ্রদ ছাড়িয়ে জিপ বেলেঘাটা পেরোচ্ছে। নির্জন রাস্তাঘাট।
কটা বাজল বলো তো, সদানন্দ।
সাড়ে বারোটা।
বাকি রাস্তাটা ধ্রুব চুপচাপই রইল। শুধু সদানন্দর নানা কথার জবাবে হুঁ হাঁ করে ঠেকা দিয়ে গেল।
খুব নিরাপদে এবং ঘটনাহীন ভাবেই বাড়ি পৌঁছে যায় ধ্রুব। ডাইনিং হল-এ ঢুকে ঢাকা-দেওয়া খাবার গোগ্রাসে খায় সে। তারপর ঘরে এসে সিগারেট ধরায়।
বড় ভয় করছে তার। একা ঘরে ততটা ভয় হত না। আজ তারা দুজন। সে আর সে। ধ্রুব আর ধ্রুব।
উঠে আলমারি খুলে হুইস্কি বের করে ধ্রুব। তারপর অন্তহীন জলস্রোতে ভেসে যেতে থাকে। একসময়ে বোতল এবং সে একই সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে মেঝেয়। অচেতন অবস্থায় রাত কেটে যায়।
ধ্রুবর ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়, তীব্র মাথার যন্ত্রণা, পেটে গোলান, মুখ তিক্ত কষায় শুষ্কতায় ভরা। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে।
কে যেন ডাকছে, ধ্রুব, ধ্রুব!
কে?
আমি।
গলার স্বরটা চিনতে পারে ধ্রুব। ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো উঠে বসে মেঝের ওপর। দরজায় কৃষ্ণকান্ত দাঁড়িয়ে।
কিছু বলছেন?
বলছিলাম তৈরি হয়ে একবার নার্সিংহোম-এ যাও।
যাচ্ছি।
বউমা আর বাচ্চা ভালই আছে। চিন্তা নেই। তোমার একবার যাওয়া কর্তব্য বলে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।
ধ্রুব উঠল। টলে পড়ে যেতে যেতে দাঁড়াল।
কৃষ্ণকান্ত চলে গেছেন। তবু ফাঁকা দরজাটার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকে সে। গত দুমাসের মধ্যে বোধহয় এই প্রথম তার সঙ্গে কথা বললেন কৃষ্ণকান্ত।
কিন্তু কেন বললেন? ব্যাপারটা কী?