যারা টিউশনি করে তাদের কিন্তু টিউশনির একটা নেশা ধরে যায়, তা জানেন? তখন আর চাকরিবাকরি করতে চায় না। আমার মনে হয় আপনারও নেশা ধরে গেছে।
কথা হচ্ছিল ছাদে। দুপুরবেলা। আজ অনিন্দিতার ছুটি। চয়ন আরও পরে বিকেলের টিউশনিতে বেরবে। শীতের রোদ ছাদময় ছড়িয়ে রয়েছে। কিছু লেপ, কম্বল, বালিশ রোদে দিয়েছে অনিন্দিতা। এ সময়টায় নিজের দুর্বল শরীরটাকে রোদে একটু সেঁকে নেয় চয়ন। মুখখামুখি দুজন একটা তোশকের ওপর বসে আছে।
যে যা বলে চয়ন তা মোটামুটি মেনে নেয়। তর্ক করে না, তেমন আপত্তিকর কথা হলেও আপত্তি তোলে না। ফলে সকলের সঙ্গেই তার সম্পর্কটা বজায় থাকে। সে অনিন্দিতার কথায় সায় দিয়ে বলে, বোধ হয় ঠিকই বলেছেন। তবে টিউশনিতে ছোটাছুটির পরিশ্রম বেশি।
ছোটাছুটিই তো ভাল। ইন্টারেস্টিং। একঘেয়েমি থাকে না।
চয়ন একটু হাসল, তা হলে কি আপনি টিউশনির পক্ষে?
অনিন্দিতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, মোটেই তা নই। টিউশনি দু-একটা করা খারাপ নয়। কিন্তু সারাক্ষণ ছেলেমেয়ে পড়িয়ে বেড়ানো মোটেই ভাল নয়।
চয়ন কথাটায় সায় দিয়ে বলল, অনেকটা বাড়ির কাজের লোকের মতো, তাই না? প্রাইভেট টিউটরের তেমন সম্মান নেই।
অনিন্দিতা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, সে তো হল, কিন্তু টিউশনি করেই কি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন ভেবেছেন? আচ্ছা কুঁড়ে লোক আপনি!
চয়ন একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার কি কোনও ক্যারিয়ার থাকার কথা? মা কী বলত জানেন? বলত, শুধু বেঁচে থাক বাবা, তোর কাছে আমি আর কিছু চাই না। আমি ছেলেবেলা থেকেই তাই জেনে এসেছি, আমাকে শুধু কোনওরকমে বেঁচে থাকতে হবে।
এটা পুরুষমানুষের মতো কথা হল?
পুরুষমানুষ কথাটা একটা মস্ত কথা। সবাই তো সমান হয় না, হয় বলুন।
অনিন্দিতা তার দিকে স্পষ্ট চোখে চেয়ে বলল, নিজের সম্পর্কে আপনার ধারণা এত খারাপ কেন বলুন তো! আত্মবিশ্বাস নেই একটুও?
আজ্ঞে না।
কী যে করি আপনাকে নিয়ে! সবসময়ে যেন জুজুর ভয়ে জড়সড় হয়ে আছেন।
চয়ন একটু হাসল। তারপর মৃদু গলায় বলল, সত্যিই, আমার মতো ভীতু বোধ হয় দুটো নেই।
আমি রোজ আপনাকে একটু একটু করে ইনস্পিরেশন দেওয়ার চেষ্টা করি সেটা কি বুঝতে পারেন?
চয়ন লজ্জিত হয়ে বলল, আজ্ঞে, তা পারি।
কিন্তু আপনি একটুও ইনম্পায়ার্ড হন না। তাই না?
চয়ন মাথা নিচু করে হাসতে লাগল। তারপর বলল, কেউ আমার জন্য ভাবছে এটা জেনে আমার একটু উৎসাহ হয়।
আহা, কী কথা! একটু উৎসাহ হয়! কেন, গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সব ওলটপালট করতে ইচ্ছে হয় না?
ও বাবা! কী ওলটপালট করব?
সব কিছু।
চয়ন হাসতে লাগল।
হাসছেন কেন? আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি।
আপনি অত সিরিয়াস হবেন না।
কেন হব না? আমি আপনার জন্য ভাবি, কষ্ট পাই, তা জানেন?
অপ্ৰতিভ হয়ে চয়ন বলল, কেন ভাবেন? ভেবে কিছু তো লাভ নেই। আমার ভিতরে কোনও ঘুমন্ত বীরপুরুষ নেই যে তাকে জাগিয়ে তোলা যাবে। এমন ছাইচাপা আগুনও নেই যাকে আবার খুঁচিয়ে গগনে করে তোলা যাবে।
নিজের সম্পর্কে কারোই পরিষ্কার ধারণা থাকে না। আপনারও নেই।
চয়ন লাজুক হেসে বলল, আপনার কথা খুব ঠিক। কিন্তু আমি অনেক দিন ধরে নিজেকে লক্ষ করছি। কখনও বন্ধুর মতো, কখনও শত্রুর মতো। কিন্তু নিজের মধ্যে আমি কিছু খুঁজে পাই না। মনে হয় ধ্বংসাবশেষে বৃথা গুপ্তধন খুঁজে লাভ নেই।
আপনি আজকাল অঙ্ক ছেড়ে কবিতা ধরেছেন দেখছি। কথায় কথায় উপমা আসছে কেন?
চয়ন ভীষণ লজ্জা পায়। একটু হেসে বলে, তাই তো! আজ যেন কেন আমার খুব উপমা চলে আসছে মাথায়।
আপনার ভিতরে যে এত উপমা আছে, তা কি এতদিন জানতেন?
না। আজ কি সব হচ্ছে।
তেমনি আপনার ভিতরে আরও কি আছে তাও আপনি জানেন না।
ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো? হঠাৎ জেগে উঠব?
এবার অনিন্দিতা হেসে ফেলল, নাঃ, আপনি সত্যিই এর পর হয়তো কবিতা লিখতে শুরু করবেন।
একটু তটস্থ হয়ে চয়ন বলে, আর হবে না।
অনিন্দিতা স্মিত মুখে বলে, হচ্ছে হোক না। বোল ফুটছে, এ তো ভাল লক্ষণ। এমনিতে তো কথা বলতেই কাঁটা হয়ে থাকেন।
আমি এরকমভাবে কখনওই কথা বলি না। আজ একটু প্রগভতায় পেয়েছে আমাকে।
প্ৰগলভ? আপনি কি আজকাল গোপনে ডিকশনারি পড়েন নাকি?
চয়ন একটু ম্লান হাসল। বলল, না।
রাগ করলেন?
রাগ করার মতো কিছু তো হয়নি। আমার রাগই নেই।
একটু রাগ থাকা কিন্তু ভাল।
আমার কখনও রাগ হয় না।
শুধু ভয় আর লজ্জা?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
অনিন্দিতা চোখ বড় করে তার দিকে একদৃষ্টে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, আজ একটা সাহসের কাজ করবেন? নাটক দেখতে যাওয়া? না, আজ কিন্তু সত্যিই সময় নেই।
না, নাটক নয়।
আর কী সাহসের কাজ?
আমাকে আজ থেকে তুমি করে বলবেন!
চয়ন প্ৰায় আঁতকে উঠে বলে, আপনাকে?
কেন, আমি তো আর গুরুজন নই। বাধা কিসের?
তুমি করে?
হ্যাঁ। আমিও তোমাকে তুমি করে বলতে চাই। বলো চয়ন।
খুব অপ্রস্তুত হল। একটু লালও হয়ে গেল। তারপর বলল, আচ্ছা। চেষ্টা করব।
ওটা আবার কী হল? এখনই বলতে হবে। চেষ্টা করব বললে ছাড়ছি না। বলো শিগগির!
বলছি। তুমি।
অনিন্দিতা খিলখিল করে হাসল। তার শাখ-সাজা চমৎকার দাঁতের সারি ঝিকিয়ে উঠল রোদে। বলল, বাঃ, এই তো বেশ হয়েছে।
একটা মস্ত পরিশ্রমের কাজ করে যেমন অবসাদের মতো হয়, অনিন্দিতাকে এই তুমি বলার পরিশ্রমে তেমনই অবসাদ বোধ করল চয়ন। মুখে হাসি টেনে বলল, এটা খুব সাহসের কাজ বুঝি?
তোমার পক্ষে আমাকে তুমি বলতে গিয়ে তোমার মুখ-চোখের যা অবস্থা হল! উঃ কি একটা মানুষ তুমি! মধ্যযুগে বাস করছ এখনও?
চয়ন ধাতস্থ হতে একটু সময় নিল। তারপর বলল, মেয়েদের সঙ্গে আমার বেশি মেলামেশা হয়নি তো। তাই একটু দূরত্ব ছিল।
তোমার কবে ছুটি বলো তো! রবিবার, না?
মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে চয়ন বলল, সব রবিবার দুটি নয়। মানিকতলায় একটি ছাত্র শুধু শনি আর রবিবারই পড়ে।
তোমাকে নিয়ে আর পারি না। রবিবারটা ফাঁকা রাখতে পার না? তোমার বোধ হয় ছুটি ভাল লাগে না, না?
চয়ন বলে, এ টিউশনিটা নতুন হল। আগে তো রবিবারটা ছুটিই থাকত।
টিউশনিটা কখন?
সন্ধেবেলায়।
সকালটা তো ফ্রি?
হ্যাঁ।
তা হলে সকালে যদি একটা প্রোগ্রাম করি?
কিসের প্রোগ্রাম?
দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার?
দক্ষিণেশ্বর! বলে অকূলপাথারে পড়ে গেল যেন চয়ন। সে কেন দক্ষিণেশ্বর যাবে? তার তে ইচ্ছে করছে না! কেন অন্যেরাই তাকে সবসময়ে চালাবে? কেন সে কঠিনভাবে কাউকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না।
ও কি, একদম স্পিকটি নট হয়ে গেলে কেন? মাকে নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে। দক্ষিণেশ্বর তোমার ভাল লাগে না?
চয়ন মাথা নেড়ে বলে, ভালই। তবে ইচ্ছে করে না।
আচ্ছা, তা হলে থাক। তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, এটা তোমার পছন্দ হচ্ছে না। যদি অন্য কোনও প্ল্যান করি।
কি রকম প্ল্যান?
ধরো, যদি একটা গানের অনুষ্ঠানে যাই? কিংবা একটা নৃত্যনাট্য?
চয়ন একটু হেসে বলে, ওসব আমি ভাল বুঝি না।
তবে তোমার কী ইচ্ছে?
ইচ্ছে? বলে চয়ন চুপ করে থাকে।
আবার চুপ করে আছ? এবার কিন্তু চিমটি দেব।
আমার যে কিছুই ইচ্ছে করে না।
কিছুই না?
কিছুই না।
ধীরে ধীরে অনিন্দিতা একটু গম্ভীর আর বিষণ্ণ হয়ে গেল। তারপর বলল, তোমাকে এসব বলাই আমার ভুল হয়েছে। তুমি আমাকে পাত্তাই দাও না।
না না। বলে চয়ন একটা অস্পষ্ট আপত্তি করল।
অনিন্দিতা বলল, তুমি আমাকে ভয় পাও না তো? না কি ঘেন্না?
হতভম্ব চয়ন বলে ওঠে, কী যে বলেন তার ঠিক নেই!
আবার আপনি?
ও, তুমি! কী সব বলছ ভয়! ঘেন্না! পাগল নাকি?
তা হলে অ্যাভয়েড করতে চাও কেন?
চয়ন কিছুতেই বলতে পারবে না একে যে, মানুষ যে তাকে উদ্বুদ্ধ করতে চায়, তাকে প্রেরণা দিতে চায়, তাকে টগবগে করে তুলতে চায়, সেটা চায় তাদের নিজেদের তাগিদেই। তারা তাকে ব্যবহার করে গিনিপিগের মতো। সে যে নিজের মতো করে একটা গুটিপোকার খোল বানিয়ে নিয়ে তার মধ্যে বাস করছে সেখানে এসবের কোনও দাম নেই। সে নিজের মতো করে বেঁচে আছে, অন্যের পছন্দমতো সে বাঁচতে যাবে কেন? তার তো দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার হতে ইচ্ছে। করে না। মানুষকে এটা যদি সে বোঝনোর চেষ্টা করে তা হলে মানুষ অবধারিত অপমান বোধ করবে।
চয়ন বলল, অ্যাভয়েড করতে চাই না তো। তবে আমার কোথাও না যেতে যেতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে, কোথাও যাওয়ার কথা উঠলেই অস্বস্তি হয়।
তুমি কিন্তু সুন্দরবনেও গেছ। এবং একা।
ওঃ, হ্যাঁ।
সেটা কি করে পারলে?
দায়ে পড়ে।
মোটই নয়। একা যেতে তোমার অস্বস্তি হয় না, কিন্তু কারও সঙ্গে যেতে হয়। তাই না? যদি সেই কেউটা হয় অনিন্দিতা।
তুমি রাগ করছ?
না। তবে আমার একটু অভিমান হয়েছে। যদিও সেটার কোনও দাম নেই তোমার কাছে।
কথাবার্তার হওয়া কোন দিকে ঘুরছে তা বুঝতে পারছিল না চয়ন। কিন্তু তার বুক একটু কাঁপছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল।
সে বলল, আমি গুছিয়ে কথাটাও বলতে পারি না। ঠিক আছে, রবিবার কোথাও একটা যাওয়া যাবে।
অনিন্দিতা মাথা নাড়ল, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। আমি একটু মজা করছিলাম।
তার মানে?
মানে হল, তোমাকে আমার মতো কেউ জানেও না, বোঝেও না। তুমি যে একা একা আপনমনে নিজের ছোট গণ্ডির মধ্যে থাকতে ভালবাসো তা আমি বুঝি। দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার কথা বলে তোমাকে একটু চমকে দিলাম। কিছু মনে কোরো না।
চয়ন একটু হাসল।
কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। সকালে, দুপুরে বা বিকেলে অনিন্দিতার সঙ্গে তার রোজই দেখা হয়। কথা হয়। আর এসবের ভিতর দিয়ে অনিন্দিতা তার খুব কাছাকাছি এসে পড়তে থাকে। যেন বন্ধ দরজায় ঘা দিচ্ছে এক আগন্তুক।
বাস্তবিকই ভয় পেয়ে যেতে থাকে চয়ন।
একদিন টিউশনি সেরে বেশ একটু রাতের দিকেই ফিরে সব স্টোভ ধরানোর চেষ্টা করছিল চয়ন। এমন সময় ছাদে উঠে এল তার দাদা অয়ন। দাদার সঙ্গে তার দেখাসাক্ষাৎ হয় না। দেখে একটু অবাক হল সে।
অয়ন বলল, তোর সঙ্গে একটু কথা আছে।
চয়ন সভয়ে দাঁড়িয়ে বলল, বলো।
অয়ন একটু রুক্ষ গলায় বলল, কী সব কাণ্ড হচ্ছে বল তো! ব্যাপারটা কী তোর?
চয়ন অবাক হয়ে বলল, কিসের ব্যাপার?
কী সব শুরু করেছিস ওই মেয়েটার সঙ্গে?
চয়ন হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনও কথা খুঁজেই পেল না।
শুনছি নাকি প্রায়ই ছাদে আসে। খুব মাখামাখি তোর সঙ্গে।
চয়ন এত ভয় পেল যে কথা বলতে গিয়ে তার গলা কাঁপতে লাগল। কোনওরকম বলল, আসে তো, কিন্তু আমি কী করব?
বাড়িতে একটা নোংরা ব্যাপার হচ্ছে, এটা কি ভাল? আশপাশের বাড়ি থেকেও শোনা যাচ্ছে তোরা নাকি রীতিমতো মাখামাখি শুরু করেছিস!
চয়ন কঁপা গলাতেই বলে, না না, সেরকম তো কিছু নয়।
তাহলে কি বানিয়ে বলছি নাকি? তোর তো এসব দোষ আগে ছিল না। হঠাৎ পাখা গজাল নাকি?
চয়ন আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো উপর্যুক্ত কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, আমাকে কী করতে বলছ?
সে কথা পরে। আগে জানতে চাই, ব্যাপারটা কতদূর গড়িয়েছে?
চয়ন শুধু বোবার মতো মাথা নেড়ে জানাতে চেষ্টা করল যে ব্যাপারটা এগোয়নি।
অয়ন সেটা বিশ্বাস করল না। বলল, ওই ধুমসি মেয়েটাও তো কম নয়। অত্যন্ত ঝগড়াটে টাইপের, বারমুখো। তুই ওর পাল্লায় পড়লি কেন?
চয়ন তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমি তো কিছু করিনি।
ও আসে কেন? ছাদে কাপড় শুকোতে আসে বা চুল শুকোতে আসে, ঠিক আছে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে, তোর বউদি পর্যন্ত ছাদে আসতে গিয়ে কতদিন দরজা থেকে ফিরে গেছে! ঝি-মেয়েটা অবধি নালিশ করে যে তোরা ছাদে থাকলে ওর আসতে নাকি লজ্জা করে।
চয়নের মাথা চক্কর দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ হাত মুঠো করে, দাঁতে দাঁত চেপে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, দাদা, আমার কোনও দোষ নেই। তুমি বিশ্বাস করে।
দোষ নেই! বেশ কথা তো! দোষ নেই মানে? একটা বয়সের মেয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করছিস আর বলছিস দোষ নেই? মেয়েটা তোর ঘরেটরে যায় না?
না তো!
মিথ্যে কথা। শুধু যায় তাই নয়, সেবা-টেও করে বলে শুনলাম। এসব নোংরামি তো এখানে চলবে না।
চয়ন বিমূঢ় হয়ে বলল, আমি কি করব?
বাড়ি ছেড়ে দে। দু মাস সময় দিচ্ছি, অন্য ঘর দেখে উঠে যা।
উঠে যাব?
আমরা ওদেরও উঠবার নোটস দিয়েছি। এসব এ বাড়িতে চলবে না। বুঝেছিস?
অয়নের দিকে চেয়ে ছিল চয়ন। এই দাদা তাকে চ্যাঙাব্যাঙা করে মেরেছে, মাকে সুষ্ঠু তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছে, এবং এ বাড়িতে তাকে আর মাকে একঘরে করে ফেলে রেখেছে। সত্যি কথা, বাড়িটা ওর। কিন্তু মানুষগুলোও কি ওর নয়? মা বা ভাই? একটা বাড়ির অধিকারের জন্য মা বা ভাইকে এতটা অবহেলা অনাদর করা যায়।
চয়ন হঠাৎ দাদার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আমাকে বাড়ি ছাড়ার নোটিস দিচ্ছ?
হ্যাঁ।
যে কারণে বাড়ি ছাড়তে বলছ সেটা সত্যি কিনা তা যাচাই করে দেখবে না?
যাচাই! যাচাই করার কী আছে? সবাই দেখছে, বলাবলি করছে।
অনিন্দিতাকেও কি কথাটা বলেছ?
অয়ন কখনও চয়নকে মুখে মুখে কথা বলতে দেখেনি। আজ বোধ হয় এইসব কথা শুনে অবাক এবং বিরক্ত হল। বলল, সেটা আমরা যা ভাল বুঝব করব। অনিন্দিতা পরের মেয়ে, তাকে এসব কথা বলা যায় না।
চয়ন হঠাৎ বলল, আর আমি?
তুই কী?
আমিও তো পরের ছেলে।
পরের ছেলে। তার মানে।
আমি তোমার কে?
তার মানে? এসব কথার অর্থ কী?
আমি কি তোমার ভাই? ভাই বলে মনে করো?
অয়ন এত রেগে গেল যে মুখখানা আচমকা রক্তাভ হয়ে গেল তার। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তারপর একেবারেই আচমকা ঠাস করে একটা চড় কষাল চয়নের গালে, অসভ্য! ইতর! জানোয়ার! দুধকণা দিয়ে কালসাপ পুষেছি এতদিন।
এসব কথা অবশ্য চয়নের কানেই গেল না। চড়টা খেয়ে সে নিজের শরীরটা একটা বোয্যর মতো নিয়ে পড়ে গেল শানের ওপর। রিমঝিম করছে মাথা। কানে কোনও শব্দ আসছে না।
কিন্তু তবু অজ্ঞান হল না চয়ন। ঝিম ধরে পড়ে রইল।
অয়ন কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ চলে গেল।
সামলে নিয়ে উঠে বসতে অনেকটা সময় লাগল চয়নের। কিছুক্ষণ বোকা-মাথায় সে বসে রইল শানের ওপর। দুটো চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে। চড়ের জায়গাটা জ্বালা করছে। ঘাড়টা যেন শক্ত হয়ে উঠছে ক্ৰমে।
আরও কিছুক্ষণ পর চয়ন উঠল। স্টোভটা নিবিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
এ বাড়ি ছেড়ে সে কোথায় যাবে? বুকের মধ্যে অচেনা ভয় যেন পাকিয়ে উঠছে তার। অচেনাকে তার বড় ভয়।
চোখের জলে বালিশ ভিজে গেল তার। অথচ সে কাঁদছে না তো! কাঁদছে না। আপনা থেকেই তার চোখ তবে কেঁদে যাচ্ছে কেন? এর কোনও মানেই যে হয় না।
একটু রাতে সে শুনতে পেল, নিচে অয়নের সঙ্গে অনিন্দিতার বাবার একটা কথা কাটাকাটি হচ্ছে যেন! সঙ্গে বউদির গলা। তবে অনিন্দিতা বাড়িতে নেই। তার ইভনিং ডিউটি, চয়ন জানে।
শরীরটা এত দুর্বল লাগল চয়নের যে, সে রাতে কিছু খেল না। দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
অনিন্দিতা এল সকালে। খুব সকালেই।
কী হয়েছে তোমার বলো তো!
চয়ন মাথা নেড়ে বলল, বলার কিছু নেই।
আমি সব শুনেছি।
চয়ন একটা শ্বাস ফেলে বলল, সব ভুলে যাও।
তোমাকে কি অয়নদা মেরেছে?
চয়ন চুপ করে থাকে।
অনিন্দিতা শান্ত গলায় বলে, তোমাকে মারা তো সোজা। মারলেও তুমি কিছু করবে না, সবাই জানে।
ভুলে যাও অনিন্দিতা। আমার কিছু হয়নি।
তোমার হয়নি। আমার হয়েছে।
তোমার কী হয়েছে?
তোমার জন্য দুঃখ হয়েছে। আমার জন্যই তোমাকে এত অপমান সহ্য করতে হল তো!
আমার অভ্যাস আছে।
একটা কথা বলবে? দুর্বলকে সবাই কেন এমন করে মারে, অপমান করে। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কি করে?
চয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না।
অনিন্দিতা বলল, পাল্টে যেও না চয়ন। তুমি তোমার মতোই থেকো। তুমি খুব ভাল। আমি বলছি, তুমি খুব ভাল।
বলতে বলতে অনিন্দিতার ঠোঁট কাপল। গলা বুজে এল কান্নায়।