০৬. হানিফাকে পিজিতে ভর্তি

মিসির আলি হানিফাকে পিজিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, মেয়েটি একা-একা থাকতে ভয় পাবে। কিন্তু হানিফা ভয় পেল না।

‘থাকতে পারবি তো?’

‘হুঁ।’

‘অনেক রকম পরীক্ষা-টরীক্ষা করবে ডাক্তাররা। ভয়ের কিছু নেই।’

‘আমি ভয় পাই না।’

তিনি ভেবে দেখলেন, মেয়েটির ভয় না পাওয়ারই কথা। যে জীবন শুরু করেছে রাস্তায়, তার আবার ভয় কিসের?

‘হানিফা।’

‘জ্বি?’

‘আমি দু’ দিনের জন্যে ঢাকার বাইরে যাব। মোহনগঞ্জ যাব। তুই থাকতে পারবি তো?’

‘পারব।’

‘দু’ দিন পরই এসে পড়ব। এর মধ্যে ডাক্তাররা পরীক্ষা-টরীক্ষা যা করবার করবেন। তা ছাড়া আমি আমাদের বাড়িওয়ালাকে বলে যাব, তিনি খোঁজখবর করবেন।

‘খোঁজখবরের দরকার নাই।’

‘দরকার থাকবে না কেন? দরকার আছে। যাই তাহলে, কেমন?

‘জ্বি আচ্ছা।’

মিশির আলি বিমর্ষ মুখে বের হয়ে এলেন। মেয়েটির অসুখ তাঁকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন ডাক্তারের পরামর্শে। ডাক্তারের ধারণা, হার্টসংক্রান্ত কোনো সমস্যা। ইসিজি টিসিজি করাতে হবে। হার্ট-বিট খুবই নাকি ইরেগুলার।

তাঁর ট্রেন রাত ন’টায়। তিনি ঠিক করলেন, রওনা হবার আগে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে যাবেন। পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদ হোসেন তাঁর কলেজজীবনের বন্ধু। খুব-একটা পরিচয় তখন ছিল না। এখন হয়তো চিনতেই পারবে না। তবু পুরানো পরিচয়ের সূত্র টানা যেতে পারে—গরজটা যখন তাঁর।

সাজ্জাদ হোসেন তাঁকে চিনলেন। শুধু যে চিনলেন তাই নয়, উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। জড়িয়ে-টড়িয়ে ধরে একটা কাণ্ড করলেন। পুলিশের লোকদের মধ্যে এতটা আবেগ থাকে, তা মিসির আলি ভাবেন নি। তাঁর ধারণা ছিল, দিন-রাত ক্রাইম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এরা আবেগশূন্য হয়ে পড়ে। সেটাই স্বাভাবিক।

সাজ্জাদ হোসেন বললেন, ‘ফ্যানটার নিচে আগে আরাম করে বস্, তারপর বল কী দরকারে এসেছিস। পুলিশের কাছে কেউ বিনা প্রয়োজনে আসে না।’

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ। পুলিশ এবং ডাক্তার–এই দু’ধরনের মানুষের কাছে কেউ বিনা প্রয়োজনে যায় না। এখন তুই বল, কী ব্যাপার? আত্মীয়স্বজন কাউকে পুলিশে ধরেছে?’

‘না, সে-সব কিছু না।’

‘নে, সিগারেট নে। নিশ্চিন্তে খা। ঘুষের পয়সায় কেনা নয়। নিজের কষ্টে উপার্জিত রোজগার থেকে কেনা। হা হা হা!’

মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। সাজ্জাদ বললেন, ‘বিয়েটিয়ে করেছিস?’

‘না।’

‘জানতাম করবি না। তুই হচ্ছিস একটা অড-বল। আমি বিয়ের পাট চুকিয়েছি আট বছর আগে। বাচ্চা-কাচ্চা কিছু হয় নি। হবেও না।

সাজ্জাদ হোসেনের চোখে-মুখে ক্ষণিকের জন্য একটা ছায়া পড়ল। কিন্তু তিনি তা নিমিষেই কাটিয়ে উঠলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘জেসমিন চৌধুরী।’

মিসির আলি চিনতে পারলেন না। সাজ্জাদ হোসেন অবাক হয়ে বললেন, ‘সত্যি চিনতে পারছিস না? ও তো টিভিতে অভিনয় করে। মারাত্মক। তাকে কেউ চেনে না, এটা তো আমি ভাবতেই পারি না!’

‘টিভি নেই আমার বাসায়।

‘বলিস কী! বাসায় খাট-পালঙ্ক আছে তো? নাকি মেঝেতে পাটি পেতে ঘুমাস? হা হা হা। এখন বল তোর সমস্যা।’

‘আমার একটি কাজের মেয়ে আছে–হানিফা।’

‘জিনিসপত্র নিয়ে ভেগে গেছে?’

‘না, তা না। আমি এই মেয়েটির অতীত ইতিহাস খুঁজে বের করতে চাই। সেটা কীভাবে করা সম্ভব, তাই জানার জন্যে তোর কাছে আসা।’

‘পাস্ট হিস্ট্রি জানতে চাস কেন?’

‘মেয়েটি জানে না, তার বাবা-মা কে। আত্মীয়স্বজন কে কোথায়, তাও বলতে পারে না। জ্ঞান হবার পর থেকেই সে দেখেছে যে, সে ভাসছে। আমি ওর বাবা-মাকে ট্রেস করতে চাই।’

সাজ্জাদ হোসেন গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘খামোকা চেষ্টা করছিস। কিছুই ট্রেস করা যাবে না। সম্ভবত জন্ম হয়েছে বেশ্যাপল্লীতে। তারপর হারিয়ে গেছে সেখান থেকে।’

‘আমার তা মনে হয় না।’

‘কেন মনে হয় না?’

মিসির আলি তার জবাব না দিয়ে বললেন, ‘আমার মনে হয় মেয়েটির শৈশব কেটেছে বিদেশে।’

‘চোখ নীল? ব্লন্ড চুল?’

‘না। মেয়েটি বাঙালিই, কিন্তু বাবা-মা হয়তো বিদেশে ছিলেন।’

‘কেন বলছিস এ সব? তোর লজিক কী?’

মিসির আলি আরেকটা সিগারেট ধরালেন। এবং থেমে থেমে বললেন, ‘হানিফা মেয়েটি গত পরশু রাতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড জ্বর। জ্বরের ঘোরে সে বিড়বিড় করে বলছিল–’ইট হার্টস,ইট হার্টস।

সাজ্জাদ হোসেন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন। মিসির আলি বলে চললেন, ‘আমার মনে হয়, খুব ছোটবেলায় মেয়েটি যখন অসুস্থ ছিল, তখন সে তার মাকে বলত—মামি ইট হার্টস। পরশু রাতে প্রচণ্ড জ্বরের মুখে অতীতের চাপা-পড়া কথাগুলো বের হয়ে এসেছে। অবচেতন মন সেই সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ-জাতীয় ব্যাপারগুলো ঘটে।’

সাজ্জাদ হোসেন শুধু বললেন, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং!’

মিসির আলি বললেন, ‘হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে বাবা-মা নিশ্চয়ই থানায় ডায়েরি করান। সেখান থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না? ধর্, আমি যদি জানতে চাই, পাঁচ থেকে আট বছর আগে কোন কোন বাচ্চা নিখোঁজ হয়েছিল জানা যাবে কি?’

‘না, এত পুরনো রেকর্ডপত্র কে বের করবে, বল্? এটা তো ইংল্যাণ্ড আমেরিকা না যে, সব কম্পিউটারে ঢোকানো আছে, বোতাম টিপলেই বেরিয়ে আসবে।’

‘পুরনো রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা নেই?’

‘নতুন রেকর্ড রাখারই জায়গা নেই, আর পুরনো রেকর্ড! একটা মিসিং পার্সন ব্যুরো আছে, সেখানে কোনো কাজ হয় না। তা ছাড়া সেন্ট্রালি ইনফরমেশন রাখার কোনো ব্যবস্থা আছে বলে আমার মনে হয় না। প্রতিটি থানায়ও আলাদা-আলাদাভাবে খোঁজ করতে হবে। সেটা একটা বিশাল ব্যাপার।’

‘বিশাল হলেও নিশ্চয়ই অসম্ভব না?’

‘কিছুটা অসম্ভবও।’

‘তোর পক্ষে কিছু করা সম্ভব না?’

সাজ্জাদ হোসেন গম্ভীর হয়ে রইলেন। মিসির আলি বললেন, ‘আমি নিজে সমস্ত পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে পারি।’

‘সেটা মন্দ না, গুড আইডিয়া।’

‘না, আইডিয়াটা খুব গুড নয়।’

‘নয় কেন?’

‘অন্য এক সময় বলব, কেন নয়। আজ উঠতে হবে। ময়মনসিংহ যাচ্ছি একটা জরুরি কাজে। ফিরে এসে তোর সাথে যোগাযোগ করব।

মিসির আলি উঠে পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *