2 of 3

০৬৯. শচীন কাশী রওনা হওয়ার আগের দিন

শচীন কাশী রওনা হওয়ার আগের দিন চৌধুরী বাড়িতে এসেছিল বিদায় নিতে। শরৎকাল শুরু হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের ওপাড়টা কাশফুলে সাদা। আকাশ গভীর নীল। মাঝে মাঝে সাদা মেঘ এসে ক্ষণস্থায়ী বর্ষা দিয়ে যায়। ভারী মোলায়েম একটা হাওয়া বয়। নদীতে পালতোলা নৌকোর গতিতে লেগেছে এক খুশিয়াল চঞ্চলতা। শচীনের মন প্রকৃতির এই স্নিগ্ধতায় কিছু প্রসন্ন। ভিতরকার ক্ষত ও রক্তপাত সে ভুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কামনার বস্তু চোখের সামনে না থাকলে কামনা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। ইংরিজি একটা প্রবাদবাক্যও আছে না, আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড! চপলাকে যথার্থ ভোলেনি অবশ্য শচীন। কিন্তু কোথায় যেন একটা স্বপ্নভঙ্গও ঘটেছে তার।

ওই যে সেদিন চড় মেরেছিল বিশাখাকে, সেই থেকে তীব্র আত্মগ্লানি দিনরাত তাকে দগ্ধ করেছে। কয়েকটা দিন সে প্রায় পাগলের মতো বিড়বিড় করত। নিজের গলা টিপে ধরত। ডান হাতে আঁতি চেপে ধরেছে, পিন ফুটিয়েছে বহুবার। সে যে এত নীচ হতে পারে তা সে নিজেও জানত না।

আজ বড় সংকোচের সঙ্গে সে বার বাড়িতে সাইকেল থেকে নামল। তারপর সাইকেলটা দাড় করিয়ে রেখে সে বারান্দায় উঠে সোজা গিয়ে কৃষ্ণকান্তর দরজায় ধাক্কা দিল। দরজা ভেজানো ছিল, খুলে গেল।

কৃষ্ণকান্তকে প্রায় রোজই দেখে শচীন। কিন্তু এতদিন এক অবৈধ প্রেমের জ্বলন্ত আবেগ তাকে এমন অন্ধ করে রেখেছিল যে, দেখলেও কিছুই লক্ষ করেনি সে। আজ কৃষ্ণকান্তর চেহারার মধ্যে ঋষিবালকসুলভ উজ্জ্বলতা দেখে সে একটু অবাক হয়।

শচীন একটু হেসে বলল, ব্রহ্মচর্য করছ শুনলাম! সত্যি নাকি?

কৃষ্ণকান্ত স্মিত হেসে উঠে দাড়িয়ে বলল, ঠিক ব্রহ্মচর্য নয়।

তবে কী? স্বদেশি?

কৃষ্ণকান্ত একথার জবাব দিতে পারল না। মৃদু হাসল মাত্র।

শচীন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, আমাদের দিয়ে তো কিছু হবে না। আমরা স্বার্থপর সংসারী হয়ে গেছি। তোমাদের মতো ছেলেরা যদি পারে।

কৃষ্ণকান্ত একথা শুনে একটু উজ্জ্বল হয়। তারপর বলে, বিপিনদার সঙ্গে আমার একটু যোগাযোগ করিয়ে দেবেন শচীনদা?

বিপিন এই অঞ্চলের চিহ্নিত স্বদেশি। কংগ্রেসের মস্ত পান্ডা। তবে আজকাল তাকে বড় একটা কেউ দেখতে পায় না। শোনা যায়, গ্রেফতারের ভয়ে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

শচীন কথাটা শুনে কৃষ্ণকান্তকে খুব স্থির চোখে অনেকক্ষণ লক্ষ করে বলে, তোমার বয়স এখনও খুব কম। এখনই কেন ওসব করতে চাইছ?

আমার যে ভীষণ ইচ্ছে।

তা আমি খানিকটা জানি। এই বুদ্ধিটা তোমাকে কে দিয়েছিল বলো তো!

তেমন কেউ নয়।

আরে আমি তো আর সরকারের স্পাই নই, আমাকে বলতে ভয়টা কী?

শশীদাকে দেখার পর থেকে–

শচীন হাসল। বলল, বুঝেছি। কিন্তু দেখলে তো পরাধীন দেশে বাস করলে দেশপ্রেমের কীরকম দণ্ড নিতে হয়! জেল, দ্বীপান্তর, ফাঁসি, গুলি।

জানি।

ভয় করে না?

কৃষ্ণকান্ত উজ্জ্বল মুখে বলল, একটুও না।

শচীন চিন্তিত মুখে বলে, তোমার ভিতরে একটা ব্রাইটনেস আছে। স্বদেশি করতে গিয়ে সেটা নষ্ট করবে কেন? বরং আরও তৈরি হও। লেখাপড়া শেখো, জ্ঞানার্জন করে। স্বদেশি করা মানে তো সবসময়ে সাহেব মারা নয়।

আর কীরকম স্বদেশি আছে?

দেশের সুসন্তান হয়ে উঠলে তাতেও দেশের কাজ হয়। যারা প্রতিভাবান তাদের উচিত প্রতিভার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা। তাতে আমাদের আখেরে দেশের ভালই হয়।

বাবাও এরকম কী একটা বলেন।

ঠিকই বলেন। উনি জ্ঞানী মানুষ।

আমার খুব শশীদার মতো হতে ইচ্ছে করে।

কার মতো হবে সেটা কি এখনই স্থির করা উচিত? সেইজন্যই একটু বয়স হওয়া দরকার।

কত বয়স?

সময় হলে আমিই তোমাকে বলে দেব।

খুব বাধ্য ছেলের মতো কৃষ্ণকান্ত ঘাড় নেড়ে বলে, আচ্ছা।

শচীন একটু সংকোচ বোধ করছিল। ইতস্তত করে বলল, বিশাখা কেমন আছে?

ছোড়দি! ছোড়দি তো ভালই আছে।

শচীন খুব লজ্জা-লজ্জা ভাব করে পকেট থেকে একটা মুখ-আঁটা খাম বের করে বলল, বিশাখাকে এই চিঠিটা দিয়ে দেবে?

হ্যাঁ।–বলে হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নেয় কৃষ্ণকান্ত।

শচীন মৃদুস্বরে বলে, রাগ জিনিসটা মানুষের মস্ত শত্রু। কত বড় শত্রু তা সেদিন বুঝেছি। কেলেঙ্কারির আর কিছু বাকি রাখিনি। ছিঃ ছিঃ।

কৃষ্ণকান্ত খুব লাজুক একটু হাসল। তারপর বলল, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।

শচীন একটু থমকে চেয়ে থাকে। তারপর আচমকাই তার মুখটা লাল হয়ে ওঠে। বিশাখাকে চড় মারার চেয়েও ঢের বেশি কেলেঙ্কারি সে ঘটাতে যাচ্ছিল। ফাঁড়াটা কেটেছে এমন নয়। চপলার কথা মনে পড়লেই তার বুক ব্যথিয়ে ওঠে, খাস দ্রুত হয়, আবার একটা তিক্ত হতাশায় খাঁ খাঁ করতে থাকে চারধার। তবে সেইসঙ্গে স্বাভাবিক বুদ্ধি, বিবেচনা ও বোধ ফিরে এসেছে শচীনের। দুই ছেলের মা, পরস্ত্রী একজনকে গ্রহণ করার যেসব অন্ধকারময় দিক আছে সেগুলোও তার মনে আসে।

শচীন মাথা নেড়ে বলে, ঠিকই বলেছ। তুমি খুব ঈশ্বর-বিশ্বাসী, তাই না?

কৃষ্ণকান্ত লজ্জায় মাথা নুইয়ে বলে, আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী হতে চাই।

শচীন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমারও অনেক সাধ ছিল জীবনে। এক-এক বয়সে এক-একরকম। সবশেষে দেখো উকিল হয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে।

ওকালতি তো খুব ভাল। খুব বুদ্ধি লাগে।

তা লাগে। তবে বড় মিথ্যে কথা বলতে হয়।

কৃষ্ণকান্ত একটু হেসে বলে, তা হোক। আমিও কিন্তু আইন পড়ব।

পড়ো। আইন জানা থাকা ভাল।

শশীদার কী হবে শচীনদা? ফাঁসি?

কী করে বলি! অপরাধ তো বেশ গুরুতর। প্রমাণ হলে—

আপনি শশীদার হয়ে মামলা লড়বেন না?

লড়ে লাভ নেই। শশী সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল অন্য ব্যাপারে। উনি আমাকে ওঁর ডিফেন্সে নামতে বলেছিলেন।

আমাদের বিরুদ্ধেও কি কেস হবে?

কে জানে! পুলিশ মুচলেকা চেয়েছিল, তোমার বাবা দেননি। সেই রাগে কেন্স করতেও পারে পুলিশ। রামকান্ত রায় নোক ভাল নন। স্বদেশিদের ওপর খুব রাগ।

ওকে কেউ মারতে পারে না?

শচীন একটু চমকে ওঠে। তারপর বলে, ওসব কথা মনেও স্থান দিয়ো না।

কিন্তু মারা তো উচিত। বাঙালি হয়ে উনি কেন স্বদেশিদের ধরিয়ে দেবেন?

সব বাঙালি যদি তোমার মতো ভাবতে পারত তা হলে ইংরেজ নিজে থেকেই পালাত। কিন্তু সেকথা থাক। রামকান্ত রায় কিন্তু ভয়ংকর লোক।

কৃষ্ণকান্ত চুপ করে থাকে।

শচীন খানিকক্ষণ বসে থাকে, তারপর উঠতে উঠতে বলে, কাল আমি কিছুদিনের জন্য কাশী যাচ্ছি। ফিরে এলে দেখা হবে। তোমার ছোড়দিকে চিঠিটা মনে করে দিয়ে কিন্তু।

দেব।

ইচ্ছে ছিল বিশাখার সঙ্গে দেখা করে মাপ চেয়ে নেব। কিন্তু ভেবে দেখলাম সেটা না করাই ভাল। রাগী মেয়ে, হয়তো চটে যাবে। তীর্থযাত্রার সময় মনটা খামোকা ভার হবে। তাই ওই চিঠি।

ছোড়দি কিন্তু রাগত না।

রাগত না?—শচীন অবাক হয়ে বলে, তুমি কী করে জানলে?

আমি জানি।

শচীন ক্ষীণ একটু হাসে, কিন্তু রাগের তো কারণ ছিল।

কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বলে, তাও না। ছোড়দিটা বড্ড বোকা। ভীষণ আদুরে তো। একটু শাসনে ওর ভালই হয়।

শচীন খুব হাসল, তুমি তো খুব পাকা মাথার মানুষ! বাঃ! তোমার উন্নতি হোক। আজ আসি, হ্যাঁ?

শচীন চলে গেলে কৃষ্ণকান্ত চিঠিটা নিয়ে ভিতর-বাড়িতে আসে।

দোতলার ঘরে চুপ করে বসে আছে বিশাখা। কিছু শীর্ণ হয়েছে ইদানীং। তবু সেই শীর্ণতায় তার সৌন্দর্য হয়েছে আরও ক্ষুরধার। আজকাল সে ঘর থেকে বড় একটা বেরোয় না। চুপচাপ বসে বসে ভাবে।

ছোড়ছি, কী করছিস?

আচমকা কৃষ্ণকান্তর ডাকে বিশাখা চমকে ওঠে। সে কিছু করছে না। ভিতরে, খুব গভীরে সে একটা গোপন ও গোলাপি স্বপ্ন দেখে। কিন্তু তার মনে হয়, স্বপ্নটা যে-কোনওদিন যে কারও কাছে ধরা পড়ে যাবে।

কী রে! আয়।বলে ভাইকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে বসায় বিশাখা। আজকাল একটু তফাত হয়ে থাকে বলেই কৃষ্ণর ওপর তার প্রগাঢ় মায়া।

কৃষ্ণকান্ত দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে, তোর বা গালে এখনও চড়ের দাগটা ফুটে আছে।

যাঃ।-বলে বিশাখা নিজের গালে হাত বোলায়, ফাজিল!

তোকে চড় মেরে শচীনদার যা অনুশোচনা হয়েছে বলার নয়।

বিশাখা লজ্জায় লালবর্ণ হয়ে বলে, ওসব কথা তোকে কে বলতে বলেছে!

বলবে কেন। জানি।

কী জানিস?

শচীনদা কাশী চলে যাচ্ছে।

কাশী!–বলে ক্ৰ কেঁচকায় বিশাখা, কাশী কেন?

কাশীবাসী হয় না তোক বুড়ো বয়সে!

সে কি বুড়ো হয়েছে?

না, তবে বৈরাগ্য এসেছে।

কবে এল?

সেই চড় মারার পর থেকে। কাশী গিয়ে শচীনদা সন্ন্যাস নেবে।

কৃষ্ণকান্ত এত গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলে যে বিশাখা ধন্ধে পড়ে যায়। চারদিকে টালুমালু করে তাকিয়ে বলে, সত্যি কথা বলবি?

সব সত্যিই তো বলছি।

কী হয়েছে ওর?

বললাম তো, অনুশোচনা।

সুফলাটা অনেকদিন আসে না। এলে জিজ্ঞেস করতাম।—চিন্তিত মুখে বিশাখা বলে।

কী জিজ্ঞেস করতি? শচীনদার কথা?

হ্যাঁ।

কেন? শচীনদার খোঁজে তোর কী দরকার?

বিশাখা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমার জন্য কেউ কষ্ট পাক তা আমি চাই না। শুনেছি, সেই ঘটনার পর ও তিনদিন নাকি উপোস ছিল। জল অবধি খায়নি।

তোকে চড় মেরেছে বলে?

তাই তো শুনেছি। তবে রাগলে মানুষ অনেক কাণ্ড করে। সেগুলো ধরতে নেই।

তোর কিন্তু একটু ওরকম কিছু হওয়ার দরকার ছিল।

কেন রে দুষ্ট? ও আবার কী কথা?

খুব বাড় বেড়েছিল যে তোর।

কবে বাড় দেখেছিস! এমন থাপ্পড় মারব না!

যখন বিয়ের কথা হয়েছিল তখন কী বলতিস মনে নেই?

বিশাখা লাল হয়ে হাসতে লাগল। তারপর বাঁ গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, বেশ করতাম বলতাম।

আর এখন?

এখন কী?

এখন বিয়ের কথা উঠলে কী বলবি?

তা জেনে তোর কী হবে?

শুনিই না।

ভাগ পাজি কোথাকার!

কৃষ্ণকান্ত ছোড়দির মুখের ভাব খুব মন দিয়ে লক্ষ করল। যা দেখল তাতে খুশিই হল সে। জামার পকেট থেকে চিঠিটা বের করে বলল, এই নে। শচীনদা দিয়ে গেছে।

বিশাখা প্রথমটায় যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এভাবে চেয়ে রইল। তারপর কুষ্ঠিত হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে বলে, কখন এসেছিল?

এইমাত্র। ঘণ্টাখানেক আগে।

এত সকালে আসে না তো!

চিঠিটা বিশাখা খুলল না। হাতে নিয়ে বসে রইল। চোখটা অল্প বোজা। কিছুক্ষণ যেন স্পর্শের একটা আনন্দ অনুভব করল। তারপর ভাইয়ের দিকে চেয়ে বলল, কাশী যাওয়ার কথা কী বলছিল? সত্যি নাকি?

সত্যি। শচীনদা কাল কাশী যাচ্ছে। তবে ফিরবে।

বিশাখা একটা শ্বাস ছাড়ল। বালিশের তলায় খামটা রেখে দিয়ে বলল, একবার সুফলাকে ডেকে আনতে পারবি?

সুফলাদি! কেন?

দরকার আছে।

একটু ভাবল কৃষ্ণকান্ত। তারপর বলল, বিকেলে।

তা হলেই হবে।

কৃষ্ণকান্ত চলে যাওয়ার পর বিশাখা খুব সাবধানে খামের মুখ ছিড়ল। নীল রঙের বিলিতি মসৃণ কাগজে লেখা:

সুচরিতাসু, তোমাকে কোন মুখে এই চিঠি লিখিতেছি তাহা জানি না। কিন্তু না লিখিয়া শান্তি পাইতেছি না। আমাকে তোমাব নিশ্চয়ই রাক্ষস বলিয়া বোধ হইতেছে। অতি হীন চরিত্রের, অতি কাপুরুষ বলিয়া বোধ হইতেছে। এইরূপ হওয়াই স্বাভাবিক।

সেদিন আমার মাথার মধ্যে কী যে হইয়া গেল! ক্রোধ মানুষের কত বড় রিপু তাহা সেদিন বুঝিলাম। আমার অপরাধের ক্ষমা নাই। তোমার নিকট ক্ষমা চাহিব না। কারণ, আমি নিজেও যে নিজেকে ক্ষমা করিতে পারিতেছি না। তবে তোমাকে একটা কথা বলি। পুরুষমানুষের অভিমানে বড় আঘাত দিয়াছিলে। অন্য কেহ হইলে আমার ওইরূপ উত্তেজনা হইত না। তোমার মুখ হইতে ওইসব কথা শুনিয়া যেন আমার ভিতরে এক বিস্ফোরণ ঘটিয়া গেল।

কেন এইরূপ হইল তাহা লইয়া অনেক ভাবিয়াছি। নিজেকে ইচ্ছামতো শাস্তি দিয়াছি। কিন্তু ভিতরের গ্লানি আজও মরে নাই। যখন তোমাকে ধরিয়া দোতলায় তুলিতেছিলাম তখন তোমার দেহ স্পর্শ করিয়া আমার মনে হইতেছিল, এই পবিত্রা দেবীদেহ স্পর্শ করিবার অধিকার আমার মতো কাপুরুষের নাই। এই কলঙ্কিত হাতে তোমাকে স্পর্শ করাও যে পাপ।

এ সকল আবেগের কথা ভাবিয়া উড়াইয়া দিয়ো না। একদা আমাকে এবং আমার পরিবারকে তুমি ঘৃণা করিতে। তাহা আমি ভুলি নাই। তোমার উপর আমার কিছু আক্রোশ থাকিবারই কথা। কিন্তু সেদিন সব আক্রোশ দূর হইয়া গেল। আক্রোশ আসিল নিজের উপর।

কিছুদিন যাবৎ আমি কেবল তোমার কথাই ভাবিতেছি। ভাবিতেছি, তুমি এখন আমাকে আরও কত ঘৃণা করিতেছ, আরও কত হীন চক্ষুতে দেখিতেছ। এই জন্মে আর তোমার কাছে নিজেকে পুরুষ বলিয়া পরিচয় দেওয়ার কোনও উপায় রহিল না।

কিছুদিনের জন্য আমি তীর্থভ্রমণে বাহির হইতেছি। সঙ্গে আমার মা-বাবাও যাইবেন। ফিরিয়া আসিয়া হেমকান্তবাবুর কাছে আমার সকল অপরাধই স্বীকার করিব। তোমাদের এস্টেটের কাজটিও ছাড়িয়া দিব। আর কোনও কারণেই তোমাকে এই কলঙ্কিত মুখশ্রী দেখাইতে পারিব না।

আমার গ্লানির আরও কারণ আছে। একটি অতি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ভাগ্যের দোষে এবং নিজের দুর্বলতাবশে জড়াইয়া পড়িয়াছিলাম। সেই নাগপাশ আজও কাটে নাই। তবে আমি তোমাকে এইটুকু বলিতে পারি দায় সবটুকু আমারই ছিল না। অপরপক্ষেরও ছিল। সাফাই গাইতেছি না। আজ মনে হইতেছে আমার আর বাঁচিয়া থাকা বৃথা। এই জীবন লইয়া কী করিব? যখন মানুষ নিজের উপর শ্রদ্ধা হারায়, যখন আত্মবিশ্বাস চলিয়া যায় তখন আয়ু বড় দুর্বল বলিয়া বোধ হয়।

স্থানান্তরে গমন বা ভ্রমণ আমার এই অস্থিরতার কতক উপশম করিতে পারে বলিয়া বাহির হইতেছি। যদি হয় ভাল, নচেৎ অন্য উপায় চিন্তা করিব।

তোমার নিকট এই পত্র দেওয়ার আর একটি কারণ আছে। আমি তোমার কাছ হইতে একটি জবাব চাই। আমি জানি আমাকে তুমি ক্ষমা করিতে পারিবে না। ক্ষমা প্রার্থনা করিবার অধিকারও আমার নাই। আমি শুধু তোমার অকপট মনোভাবটুকু জানিতে চাই। যদি পত্রে আমাকে যথেচ্ছ ভর্ৎসনা করো তবে বোধহয় কিছু জ্বালা জুড়াইবে। কারণ আমি তোমাকে সেদিন যে চূড়ান্ত অপমান করিয়াছি তাহার প্রতিশোধ লইবার সুযোেগ তুমি পাও নাই।

এই পত্রে তোমাকে সেই সুযোেগ লইতে অনুরোধ করিতেছি।

একদা তুমি আমার নিকট দেবীদুর্লভ ছিলে। পরে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটায় আমি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করি। জীবন কী বিচিত্র ! ঘটনারও কী আকস্মিক পরিবর্তন! আজ আবার তুমি যেন স্পর্শাতীত এক দুর্লভ আসনে সমাসীনা মহামহিম দেবীমূর্তি! আমি আর তোমার নিকটবর্তী হইতে পারিব না।

যে প্রলাপ বকিলাম তাহাতে বিরক্ত হইয়ো না। আজ আমি বড় ভগ্নহৃদয়, বড় হতাশ, বড় যন্ত্রণাবিদ্ধ। তোমার ভর্ৎসনা আমার ভিতরে গ্লানির অবসান ঘটাইবে। আমাকে সঞ্জীবনী মন্ত্র দিবে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

ভগ্নহৃদয়
শচীন

চিঠি পড়ে বিশাখা হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *