সেদিন আপিস থেকে ব্রজরাখাল ফিরলো একটা মস্ত বড় বাণ্ডিল নিয়ে। বললে—তোমার ও জামা-কাপড়ে চলবে না বড় কুটুম—ভদ্রলোকের কাছে চাকরি করতে গেলে একটু ভদ্র হয়ে যেতে তো হবে–
একেবারে তৈরি কামিজ নিয়ে এসেছে। ধুতিও একজোড়া। লাট্ট মার্কা রেলির ধুতি। যেমন মিহি তেমনি খাপি।
-আর এই নাও জুতো—এ তো ফতেপুরের রাস্তা নয়। এখানে খোয়ার রাস্তা, খালি পায়ে চললে পা ছিঁড়ে যাবে একেবারে।
ভূতনাথ জুতো জোড়া পায়ে দিলে। ব্ৰজরাখাল নিজের হাতে ফিতে বেঁধে দিলে। বললে—পছন্দ হয়েছে তো। টেরিটি বাজারের খাস চিনে-বাড়ির জুতো।
সেই বিকেল বেলা ভূতনাথকে জুতা জামা কাপড় পরিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারদিক থেকে দেখলে ব্রজরাখাল। তারপর বললে–এইবার সব ছেড়ে রাখখা, পরশু আমার ছুটি আছে আপিসের, ওইদিন আবার পরতে হবে।
-কেন?
ব্ৰজরাখাল উত্তর দিলে না। কিন্তু খেতে বসে কথাটা বললে ব্ৰজরাখাল। বললে—চাকরি তো কখনও কয়রানি বড়কুটুম চাকরির শতেক জ্বালা—এক-একবার ভাবি ছেড়ে দেবো-আমার কিসের দায়। না-আছে বাপ-মা, না-আছে বউ-ছেলে,—কিন্তু ঠাকুর বলতেন—
ভূতনাথ মুখে ভাত পুরে বললে—কোন্ ঠাকুর?
—আমার ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব-গেঁয়ো ভূত, নাম শোনননি তুমি—দেখবে, বলে রাখছি তোমাকে—ওই ঠাকুরের ছবিই একদিন দেশের ঘরে ঘরে থাকবে—আমার চোখ খুলিয়ে দিয়েছেন ঠাকুর। তোমার বোন যখন মারা গেল বড়কুটুম, সে বড় কষ্টের মধ্যে কাটাতে লাগলাম—সে যে কী কষ্ট কী বলবো। বড় ভালোবাসতাম রাধাকে—বলে ভাত খেতে খেতে হো হো করে হেসে উঠলো ব্রজরাখাল।
ব্ৰজরাখাল হাসলো না কেঁদে উঠলো দেখবার জন্যে ভূতনাথ ব্ৰজরাখালের মুখের দিকে তাকালে। কিন্তু ব্রজরাখাল কোনো দিকেই যেন চেয়ে নেই।
আবার বলতে লাগলো বজ্ররাখাল—তোমার বোন আমায় একদিন কী বলেছিল জানো–
ভূতনাথ বললে—কী।
-এই অসুখ হবার কিছুদিন আগে, আমি শনিবার দিন বাড়ি গিয়েছি। রাধা বললে—তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল— বললাম—কী কথা বলো। রাধা বললে-আমার ভূতোদাদার বড় ইচ্ছে কলকাতা দেখবার। আমায় কতবার বলেছে-তুমি চাকরি করে কলকাতায়, ওকে একবার কলকাতা দেখাতে পারো না? বললাম—পারি। পারি তো বললাম, কিন্তু তার কিছুদিন পরেই ও মারা গেল। আমার মনের অবস্থা তখন তত বুঝতে পারছো—ফতেপুর থেকে ফিরে এসে লম্বা ছুটি নিয়ে দিনরাত কেবল দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে পড়ে থাকতাম। বেশ ভালো লাগতো। মনে হলো দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে আর সংসারে ফিরে যাবো না কিন্তু ফিরে এলাম ভাই,ঠাকুরই আমায় ফিরিয়ে দিলেন—কেমন করে দিলেন সেই কথা বলি–
সেদিন সব ভক্তরা বসে আছি। নরেন আছে, লাটু আছেগিরিশও ছিলো বোধহয়। আমি বললাম—ঠাকুর আমি আর সংসারে ফিরে যাবো না।
ঠাকুর জানতেন সব। রাধার মারা যাওয়ার খবর শুনে খুব কেঁদেছিলেন। জানতেন আমার কেউ নেই সংসারে—সংসারে কারো ওপর কোনও দায়িত্ব নেই। কার জন্যেই বা চাকরি করছি, কার জন্যেই বা টাকাকড়ি—একটা পেট, সে-জন্যে ভাবিনে। ঠাকুর শুনলেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, একটা গল্প শোন। বললেন-দেখ নারদ মুনির ভারি অহঙ্কার ছিল যে, ত্রিভুবনে তাঁর মতন ভক্ত আর কেউ নেই। বিষ্ণু শুনে বললেন—তোমার চেয়েও আর একজন বড় ভক্ত আমার আছে হে—সে এক চাষী, যাও তাকে গিয়ে দেখে এসো নারদ। নারদ গেলেন দেখতে। গরীব চাষা। সারাদিন ক্ষেতে খামারে কাজ করে—ফুরসুৎ নেই মরবার। কেবল সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাত্রে শুতে যাবার আগে দু’বার মাত্র হরির নাম করে। নারদ কিছু বুঝতে পারলেন না। এলেন বিষ্ণুর কাছে। বললেন-দেখে এলাম তোমার ভক্তকে—কী এমন তার ভক্তি যে এতো বড়াই করছে। বিষ্ণু তাকে একটা বাটিতে টইটুম্বুর তেল দিয়ে বললেন—যাও নারদ, এই বাটিটা নিয়ে একবার সারা শহরটা ঘুরে এসো—কিন্তু সাবধান, তেল যেন একফোঁটাও না পড়ে। নারদ চললেন। অনেকক্ষণ পরে ফিরে এলেন আবার বাটিভর্তি তেল নিয়ে। তেল এক ফোটাও পড়েনি। বিষ্ণু জিজ্ঞেস করলেন—নারদ, আমার কথা ক’বার স্মরণ করেছো তুমি? নারদ বললেন,—প্রভু, আপনার নাম স্মরণ করবার সময় পেলাম কই। আমি তো সারাক্ষণ তেল নিয়েই ব্যস্ত। তখন বিষ্ণু নারদকে বুঝিয়ে দিলেন–সেই সামান্য চাষার ভক্তি কেন নারদের চেয়েও বড়। সেই চাষা হাজার কাজের মধ্যেও দু’বার তো অন্ততঃ হরিকে স্মরণ করে—
ঠাকুর এমনি কথায় কথায় কেবল গল্প বলতেন। গল্প শুনে চুপ করে রইলাম। তখনও যেন বিশ্বাস হলো না। ঠাকুর বুঝলেন। বুঝে হাসলেন এবার। বললেন–ওই গিরীশকে জিজ্ঞেস করে দেখ—ওকে বলেছিলাম যখন প্রথম ও এসেছিল—শুধু দিনের মধ্যে দু’বার নাম-জপ করতে, একবার খাবার আগে, আর একবার শোবার আগে। ও শেষ পর্যন্ত পেরেছে। তুই-ই বা পারবি না কেন। তার বেশি তোকে কিছু করতে হবে না। মা তোর কাছে আর কিছু চায় না রে বোকা ছেলে। তারপর হাসি থামিয়ে নৱেনের দিকে চেয়ে বললেন–ওরে দেখ, ব্ৰজরাখালের বিশ্বাস হচ্ছে না। ওরে এ-সংসারে যত মত তত পথ যে,—কোনও মতটাই নিখুত নয়। তা ভেবে তোর কী দরকার। তুই যা করছিস করে যা-সংসারের সমস্ত জীবের মধ্যেই শিবকে পাবি। আর যদি না-ই পাস তাতেই বা কী। মা তো তোর মনের কথা জানে রে। এই দেখ না, সবাই ভাবে তার হাতঘড়িটাই ঠিক সময় দেয় কিন্তু কোনও ঘড়ির সঙ্গে কোনও ঘড়ির তো মিল নেই—অথচ আসলে সঠিক সময়টা যে কী তা কেউ জানে না—তা নাই বা জানলো, তাতে কারো কোনও কাজের ক্ষতি হচ্ছে?
গল্প করতে করতে কখন যে খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে কারোর খেয়াল ছিল না। ভূতনাথ একমনে ব্রজরাখালের কথা শুনছিল। হঠাৎ চমক ভেঙে ব্ৰজরাখাল বললে—যা হোক—রাধার কাছে সেই কথা দিয়েছিলুম তার ভূতোদাদাকে কলকাতা দেখাবে। তা
এন্তোদিন মনে ছিল না, তোমার চিঠি পেয়ে মনে পড়লো।
রাত্রে ভূতনাথ বললো-ও বাঁয়া তবলা কার ব্রজরাখাল।
ব্ৰজরাখাল বিছানা পাততে পাততে বললেও আমারই, এককালে আমিই বাজাতাম—-তারপর এখন বাজাই খোল, দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সামনে খোল বাজিয়ে আর তবলা ভালো লাগে না।
শোবার আগে ব্রজরাখাল বললে–ঠাকুরকেই দেখলে না বড়কুটুম, কলকাতার আর কী দেখলে তবে…তা হলে পরশুদিন যাওয়া মনে রেখো, আবার ভুলে যেও না যেন—আমার ছুটি আছে সেদিন।
—কোথায়? ভূতনাথ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে।
—এরই মধ্যে ভুলে বসে আছো, তোমার চাকরি হে—মাইনে এখন পাবে সাত টাকা করে, আর এক বেলা ওখানেই খাবে। বেশ নিষ্ঠাবান ধার্মিক লোক সুবিনয়বাবু। নববিধান সভার ব্রাহ্ম ওঁরা—
—সে কী ব্ৰজরাখাল।
—সে তুমি বুঝবে না এখন—ব্রজরাখাল পাশের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলে।
পাশের ঘরে শুয়ে অনেকক্ষণ ভূতনাথের ঘুম এল না। সেই কালকের মতো ঘোড়ার পা ঠোকার শব্দ, অনেক চাকরের গোলমাল। তারপর রাত্রি বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে সেই তন্দ্রার মধ্যে কালোয়াতি গানের সঙ্গে তবলার ঠেকা। অনেক রাত্রে লোহার গেট খোলার ঘড় ঘড় শব্দ। আর তারপর…তারপরের কথা আর ভূতনাথের মনে থাকবার কথা নয়।
শেষ পর্যন্ত চাকরি হলো ভূতনাথের। সাত টাকা মাইনে আর এক বেলা খাওয়া। তা সাত টাকাই কি কম।
ব্ৰজরাখাল বললে—সাত টাকাই কি কম। আমি তো এল.এ. পাশ করে দশ টাকায় ঢুকেছিলাম। তুমি লেখাপড়া-জান ছেলে, বিদ্যে রয়েছে পেটে—দেখবে, ও সাত টাকাই শেষে সতেরো টাকায় গিয়ে দাঁড়াতে দেরি হবে না। তুমি কিছু দ্বিধা করে না তা বলে।
দ্বিধা নাকি ভূতনাথের আছে! দ্বিধা কিসের। ব্রজরাখালের বিনাভাড়ার ঘরে থাকা আর একবেলা খাওয়া আবার সাত টাকা নগদ মাস গেলে। জলখাবার, জামাকাপড় নিয়ে মাসে তিন টাকাই খরচ হোক—তারপর চার টাকা করে জমা! কত বাবুয়ানি করবে করো না!
ব্ৰজরাখালের কেনা নতুন জামা-কাপড় জুতো পরে রওনা দিলে ভূতনাথ ব্ৰজরাখালের সঙ্গে। রাস্তায় বেরিয়ে ব্রজরাখাল বললেখুব মন দিয়ে কাজ করবে বড়কুটুম—দেখো আমার বদনাম না হয়। ওরা আবার ব্রাহ্ম কিনা।
–ব্রাহ্ম মানে? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।
—এই তোমরা যেমন হিন্দু, উনি তেমনি ব্রাহ্ম—অর্থাৎ এই দুর্গা কালী গণেশ ও-সব পূজো টুজো করেন না-বলেন পুতুল পূজো, তা সে-সব নিয়ে তোমার কী দরকার—তুমি চাকরি করবে মন দিয়ে-ফাঁকি দেবে না, ব্যস চুকে গেল ল্যাঠা।
ভূতনাথ বললে—আমাকে আমার হিন্দুধর্ম ছাড়তে যদি বলেন–
–তা তো বলবেনই—ব্রজরাখাল বললে।
—তা হলে?
—তুমি ছাড়বে না।
—তাতে যদি চাকরি যায়?
–যাবে, যাবে। তা বলে তো আর রাতারাতি ধর্ম বদলাতে পারে না। ধর্ম হলে তোমার মনের বিশ্বাসের ব্যাপার–আর যদি মনে করো সাত টাকাই তোমার কাছে বড় তা হলে হবে ব্রাহ্ম, ব্রাহ্মসমাজে গিয়ে নেবে দীক্ষা।
ভূতনাথ উত্তর দিলে না। চুপ করে ভাবতে ভাবতে চললো। খানিক পরে বললে—এ-চাকরিতে তোমার মত আছে তো ব্রজরাখাল—তোমার মত না থাকলে দরকার নেই চাকরির। শেষে হয় তো গরু-শোর খেতে বলবে।
ব্ৰজরাখাল বললে—না না ওসব ভয় তোমার নেই। সুবিনয়বাবু লোক খুব ভালো, আমার চেয়েও ভালো, তবে একটু গোঁড়া। তাতেই বা তোমার কী! ওর ধারণা কেশববাবু যা বলেন তাই-ই ঠিক তাই-ই ধ্রুব আর কারোর কথা কিছু নয়। না হয় তাই-ই বললেন, তাতে তোমারই বা কী আর আমারই বা কী।
ভূতনাথ ব্ৰজরাখালের কথা কিছু বুঝতে পারলে না।
ব্ৰজরাখাল বলেই চললো—অথচ দেখো বড়কুটুম, আমার ঠাকুর বলতেন—ও হিন্দুধর্মই বলো আর খৃস্টধর্ম কিম্বা ইসলামধর্মই বলো, সব চর্চা করে দেখেছি—দেখলাম আসলে সেই ভগবানকেই সবাই ডাকে—শুধু বিভিন্ন নামে। একটা পুকুরের যেমন অনেকগুলো ঘাট থাকে তার এক ঘাটে হিন্দুরা ঘড়ায় করে ‘জল’ তোলে। আরেক ঘাটে মুসলমানেরা মশকে করে পানি তোলে, আর একটা ঘাটে খৃস্টানরা তোলে ‘ওয়াটার’—আসলে সেই জলই তো সবাই-এর লক্ষ্য—শুধু নামটা নিয়ে মারামারি।
বউবাজার স্ত্রীট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাধববাবুর বাজার পেরিয়ে সোজা উত্তরে চলতে লাগলো দুজনে।
এক ঘণ্টা সময় লাগলো পৌঁছতে।
বাড়ির সামনে বড় সাইনবোর্ডের ওপর লেখা-মোহিনী-সিন্দুর কার্যালয়।
দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে ছোটখাটো আপিসের মতন। চেয়ার-টেবিল সাজানো। কাগজ-পত্র গোছানো রয়েছে। পরিপাটি পরিচ্ছন্ন।
কে একজন এগিয়ে এল সামনে। এসে বললে—বাবু আপনাদের বসতে বলেছেন, আপনারা কি বনমালী সরকার লেন থেকে আসছেন—
খানিক পরে আবার ফিরে এল লোকটা। এসে ব্রজরাখালকে বললে—আপনাকে ওপরে ডাকছেন।
ভূতনাথকে বসতে বলে ব্রজরাখাল ওপরে চলে গেল। ঘরটার চারধারে চেয়ে দেখলো ভূতনাথ। আপিস ঘর। দেয়ালের গায়ে অনেকগুলো ফটো টানানো। ভূতনাথ কাউকে চেনে না। অনেকগুলো সাহেব মেমদের ছবি। সোনালি ফ্রেমে বাঁধা। সদর দরজার মাথার ওপর দেয়ালের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে— “ব্ৰহ্মকৃপাহি কেবলম।
সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ। ভূতনাথ চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে রইলো। খানিক পরে কোথা থেকে যেন গানের শব্দ কানে এল।
ধন্য ধন্য তুমি বরেণ্য নমি হে জগত বন্দন
প্রণতজনে কৃপাবিধানে ঘুচাও কলুষ বন্ধন।
সত্যসার নির্বিকার সৃজন পালন কারণ
জীবনে মরণে শ্মশানে ভবনে জীবনের অবলম্বন
পূর্ণ পরম অনাদি চরম, অনন্ত জ্ঞান নয়ন
ওতপ্রোত তোমাতে চিত জগত-চিত্তরঞ্জন।
অযাচিত দয়ার সিন্ধু, দুঃখ দারিদ্র ভঞ্জন,
পবিত্র পাপনাশন পতিতজন পাবন।।
গান গাইছে একজন মহিলা। ভূতনাথ অভিভূতের মতন সমস্ত গানটা শুনলে। তারপর আবার সব নিস্তব্ধ। একা একা বসে থাকতে ভূতনাথের কেমন অসহ্য লাগছিল।
খানিক পরে আবার সেই লোকটা ঘরে এসে বললেআপনাকে ওপরে ডাকছেন বাবু।
ভূতনাথ লোকটার পেছন পেছন গিয়ে হাজির হলে ভেতরের বারান্দায়। সেখানে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠবার রাস্তা। ওপরে উঠে লোকটা পাশের একটা ঘরের দরজা খুলে বললে—ভেতরে যান।
দরজা খুলতেই ভূতনাথ দেখলে। প্রকাণ্ড এক ঘর। মাঝখানে এক গোল টেবিলের চারপাশে নিচু নিচু চেয়ারে বসে আছেন সবাই। আর সব মুখ অচেনা। কেবল ব্রজরাখালের দেখা পেলে। একপাশে।
ভূতনাথকে নিজের পাশের চেয়ারে বসিয়ে ব্রজরাখাল বললে— এই হলো আমার বড়কুটুম, এখন আপনার হাতেই এর ভার দিলাম। নেহাৎ গ্রাম্য সরল ছেলে—এখনও শহরের হাওয়া গায়ে লাগেনি।
সামনের ভদ্রলোক একমুখ দাড়ি গোঁফ নিয়ে হাসতে লাগলেন। হা হা করে হাসি। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন—বেশ নামটি। ভূতনাথ-ভূতনাথ। কয়েকবার নামটা উচ্চারণ করলেন মুখে। তারপর বললেন—শিবের আর-এক নাম ভূতনাথ। উপনিষদে পড়েছি ‘ন বিত্তেন তর্পণীয়ো মনুষ্যঃ–ওই শিবেরও বিত্ত নেই— বিভব নেই—ভোলানাথ।
ভূতনাথ বললেবামুনগাছির পঞ্চানন্দের দোর ধরে হয়েছি কি না, তাই পিসীমা আমার নাম রেখেছিল ভূতনাথ….
খুক খুক করে পাশ থেকে হাসির শব্দ এল।
ভদ্রলোক বললেন—ছি মা, হাসতে নেই, এ-হাসি তোমার চাপল্যের লক্ষণ মা–ভূতনাথবাবু ঠিকই বলেছেন—সেই ব্রহ্মেরই কত নাম—পঞ্চানন্দও এক নাম তার—আপনি কী বলেন ব্ৰজরাখালবাবু
ভূতনাথ ব্ৰজরাখালের উত্তরের দিকে কান না দিয়ে দেখলে যে হাসছে সে একটি মেয়ে। অনেকটা রাধার বয়সী। কিম্বা হয় তত রাধার চেয়েও কিছু বড়। কিন্তু বড় সুন্দর দেখতে। তখনও হাসিটা মুখে লেগে রয়েছে তার। ভূতনাথের চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি আবার হাসিতে ফেটে পড়তে যাচ্ছিলো—কিন্তু কেন জানি না বোধহয় বাবার মুখ চেয়েই চেপে গেল। মেয়েটির পাশে আরেকজন মহিলা বসে আছেন। বোধ হয় মেয়েটির মা। দুই হাতে কী একটা বুনছেন। সেই দিকেই নজর তার। মাঝে মাঝে এক-একবার সুবিনয়বাবুর দিকে তাকাচ্ছেন।
-আমার বাবা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু বুঝলেন ব্রজরাখালবাবু–
সুবিনয়বাবু দাড়িতে হাত বুলোত বুলোতে গল্প করতে লাগলেন।—ভারি গোঁড়া হিন্দু—কালীভক্ত—প্রতি শনিবার মধ্যরাত্রি পর্যন্ত কালীপূজো করে রোববার দিন জল গ্রহণ করতেন—আমার এই খুকু যখন হলে উনি নাম রাখলেন জবাময়ী কালীর যেমন জবা—শিবের তেমনি ধুতুরা—তুমি হাসছিলে মা, কিন্তু ভূতনাথবাবুর নামটা আমার ভারি পছন্দ হয়েছে-সেই গানটা গাও তো মা–
এতক্ষণে মহিলাটি হাতের বোনা বন্ধ করে চোখ তুললেন একটু।
–আর তুমি গাইতে বলল না ওকে–এখনি যদি গলা ভাঙিয়ে বসে থাকে, আসছে শনিবার দিন গাইতেই পারবে না যে একেবারে।
ব্রজরাখাল জিজ্ঞেস করলে—আসছে শনিবার গান-বাজনা আছে নাকি?
সুবিনয়বাবু বললেন—আসছে শনিবার আমার জবার জন্মদিন কিনা—তা হলোই বা জন্মদিন—জবার গলায় এ-গানটা আমার ভারি মিষ্টি লাগে ব্ৰজরাখালবাবু-খাটি জয়জয়ন্তীর ধ্রুপদগাও—গাও না মা-বলে সুবিনয়বাবু নিজেই হাতে তাল দিতে দিতে ধরলেন—
–নাথ, তুমি ব্ৰহ্ম, তুমি বিষ্ণু, তুমি ঈশ, তুমি মহেশ, গান থামিয়ে ব্রজরাখালবাবুর দিকে চেয়ে বললেন—চৌতালে তাল দিয়ে যান তো-বলে আবার আরম্ভ করলেন
—নাথ, তুমি ব্ৰহ্ম, তুমি বিষ্ণু, তুমি ঈশ, তুমি মহেশ,
তুমি আদি, তুমি অন্ত, তুমি অনাদি, তুমি অশেষ—
হঠাৎ এক সময় ভূতনাথের মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত কোকিল যেন এক সঙ্গে গান গেয়ে উঠলো। আকাশ বাতাস অন্তরীক্ষের সমস্ত অশ্রুত সুর এক সঙ্গে ধ্বনিত হয়ে উঠলো। মধুকামারের পাল-যাত্রায় শ্রীকণ্ঠ হাজরাও বুঝি খেদের গান এমন করে গাইতে পারে না। অবাক হয়ে ভূতনাথ দেখলে, বাবার সঙ্গে জবাও গলা মিলিয়ে গাইছে—মুখে তার সে বিদ্রূপের হাসি আর নেই, চোখ অর্ধমুদ্রিত—স্থির মূর্তিতে এক অলোকসামান্য জ্যোতি বেরুচ্ছে। সেই মুহূর্তে জবাকে যেন আরো সুন্দর দেখাতে লাগলো।
–জল স্থল মরুত ব্যোম, পশু মনুষ্য দেবনোক
তুমি সবার সৃজনকার, হৃদাধর ত্রিভুবনেশ।
তুমি এক, তুমি পুরাণ, তুমি অনন্ত সুখ সোপান,
তুমি জ্ঞান, তুমি প্রাণ, তুমি মোক্ষধাম…
পাশের ব্রজরাখালের দিকে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। হাতে তাল দিচ্ছে আর লম্বা লম্বা চুল ভর্তি মাথাটা মাতালের মতো দুলছে–আর চোখ দিয়ে অঝোরধারে জল গড়িয়ে পড়ছে। সুবিনয়বাবুরও সেই অবস্থা। কিন্তু আশ্চর্যজবার মা আপন মনে মাথা নিচু করে একমনে বুনে চলেছেন, সঙ্গীত তার কানে যাচ্ছে। কিনা কে জানে।
এক সময়ে গান থামলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
সুবিনয়বাবু নিস্তব্ধতা ভাঙলেন। বললেন—তাল কেটেছি নাকি ব্ৰজরাখালবাবু——? আপনি ভালো খোল বাজিয়ে—আর চৌতালটা আপনার ঠিক ধরতেও পারি না আমি-সুরের দিকে নজর দিতে গেলে আমার তালটা ওদিকে আবার গোলমাল হয়ে যায়। তারপর জবার দিকে চেয়ে বললেন—দেখলে তো মা, তুমি ভূতনাথ নাম শুনে হাসছিলে—যে ভূতনাথ সে-ই মহেশ, সে-ই ব্ৰহ্ম, সে-ই বিষ্ণু—সবই সেই এক ধ্রুব নিবিকার অনন্ত জ্ঞান-স্বরূপ পরমাত্মা—উপনিষদ বলেছে ‘একং রূপং বহুধা যঃ কবোতি’—যিনি এক রূপকে বহুপ্রকার করেন—
এবার মহিলাটি আবার মুখ তুললেন, বললেন—কেন তুমি বার বার জবাকে বকছো বলো তো-ও তো হাসেনি।
জবা বললে—না বাবা, আমি হেসেছিলাম।
সুবিনয়বাবু দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন—কেন হেসেছিলে মা, ভূতনাথবাবুকে দেখে, ঠিক বললো তো।
এবার ভূতনাথ কথা কইলে। বললে হাসলেনই বা উনি, আমি তো সে-জন্যে কিছু মনে করিনি–রাধাও হাসতো।
—রাধা কে? প্রশ্ন করলেন সুবিনয়বাবু।
–নন্দজ্যাঠার মেয়ে—ভূতনাথ জবাব দিলে।
ব্ৰজরাখাল বুঝিয়ে দিলে—আমার পরলোকগতা স্ত্রীর কথা বলছে বড়কুটুম।
—রাধা হাসতো, রাধার সই হরিদাসী হাসত, হরিদাসীর বর হাসতো, আন্না হাসতে, রাধার বিয়েতে বাসর ঘরে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিল—তোমার মনে আছে ব্ৰজরাখাল? তা হাসুক গে—আমি কিছু মনে করি না—বলে ভূতনাথ নিজেই হাসলো।
কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। জবা হাসলো, সুবিনয়বাবু হা হা করে হাসলেন, ব্ৰজরাখালও হেসে উঠলো। জবার মা হাসলেন কিনা দেখা গেল না। তিনি নিজের মনেই বুনতে লাগলেন, মুখ নিচু করে।
সুবিনয়বাবু হাসতে হাসতে বললেন-জরাখালবাবু, আপনার বড়কুটুমটি বেশ লোক—ভূতনাথবাবুকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।
অতদিনের কথা। এখন সব মনে নেই। কিন্তু সুবিনয়বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরবার পথে ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিল—তুমি বলছিলে ওঁরা ব্রাহ্ম, কিন্তু বেশ লোক ওঁরানা ব্ৰজরাখাল?
আমি তো ওঁকে খারাপ লোক বলিনি বড়কুটুম—লোক খুব ভালল, বেশ আমুদে মানুষ, ওঁদের সমাজের একনিষ্ঠ সভ্যও বটেন টাকাও আছে অনেক, কিন্তু মনে ওঁর শান্তি নেই।
—কেন?
–মাঝে মাঝে ওঁর ওই স্ত্রীর মাথা খারাপ হয়ে যায়, তখন ওঁকে ঘরে বন্ধ করে রাখতে হয়—যখন ভালো থাকেন তখন কেবল আপন মনে একটা কিছু নিয়ে বুনে যান—তা ওসব নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই তুমি তোমার চাকরিটা মন দিয়ে করে যাবে।
রাস্তায় আসতে আসতে ভূতনাথ কেবল সেই কথাটাই ভাবছিল—অমন প্রাণখুলে হা হা করে হাসতে পারেন কী করে সুবিনয়বাবু!