পৃথিবীর মানুষকে কিছুতেই সব কথা বোঝাতে পারবে না রেমি। মানুষেরা ভীষণ অবুঝ।
পদ্মপাতায় এক ফোঁটা জল গড়িয়ে যাচ্ছে এধার ওধার। কখন চলকে পড়ে কে জানে! ওই। ফেঁটাটুকু রেমির প্রাণ। নিঃশেষিত চেতনার একটু তলানি অবশিষ্ট আছে মাত্র। সেই চেতনাটুকুও নানারকম আজগুবি দৃশ্যে আবিল। রেমি এখন অনেক কিছুই মনে করতে পারছে না। এমনকী নিজেকেও তার সবটুকু মনে পড়ে না। কিন্তু তার আবছায়া চেতনার গভীর কুয়ার মধ্যে ঘোলা জলে বারবার যে মুখটা ছায়া ফেলছে সে মুখ সে অনেক দুঃখের মূল্যে চিনেছে। সহজে ভোলা যাবে না। সে মুখ ধ্রুবর।
তুমি কি নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নও, রেমি?
হ্যাঁ, ভীষণ বিশ্বাসী।
তুমি কি ডিভোর্সের পক্ষপাতী নও?
নিশ্চয়ই পক্ষপাতী। অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার অধিকার কোন মেয়ে না চায়?
তুমি মদ্যপ, চরিত্রহীন, নিষ্ঠুর বা উদাসীন স্বামীদের সমর্থন করে না তো!
না। কক্ষনও নয়।
তা হলে ধ্রুবর ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্ত কী?
আমি ওকে জানতে চাই। জানতে চাই বলেই ওকে ছেড়ে যাইনি।
জানার কি কিছু বাকি ছিল আর?
ছিল। তোমরা বুঝবে না। ছিল। আমি বহুবার টের পেয়েছি, ওর মদের কোনও নেশা নেই সত্যিকারের। ওর মধ্যে সত্য কোনও নিষ্ঠুরতাও নেই।
তোমাকে কি ও কখনও ভালবেসেছে?
কী জানি! হয়তো বাসেনি। আমাকে কতবার অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রেখে কোথায় চলে গেছে। এমনকী অন্য পুরুষের সঙ্গে প্রেম করার জন্য উৎসাহ পর্যন্ত দিয়েছে।
এই কি স্বামীর কাজ? এটা কি ভালবাসা?
না। স্বীকার করছি, না।
তা হলে আর জানার বাকি ছিল কী? ও তোমার স্বামী হতে পারেনি কোনওদিন।
বলছি তো এসবই ঠিক। তবু ওর মধ্যে কী ছিল বলো তো, আমি যতক্ষণ ওর কাছে থাকতাম, মানে ও যতক্ষণ আমার কাছে থাকত ততক্ষণ আমি ভারী নিরাপদ বোধ করতাম। মনে হত, এবার আমি নিশ্চিন্ত।
ভুল রেমি। ওটা তোমার মনে হওয়া মাত্র। সত্যি নয়। ধ্রুব কোনওদিন তোমার নিরাপত্তার কথা ভাবেনি।
তা হলে আমার মনে হত কেন? ভুল? তা হোক না। এরকম কিছু ভুলই যদি আমার সারা জীবন অটুট থাকত তা হলেই আমার ছোট্ট জীবনটা কেটে যেত কোনওরকমে।
কাটল না তো!
না, ঠিক তা নয়। কেটে গেল। এই তো আমার বুক জুড়িয়ে যাবে একটু পরেই। কতই বা বয়স আমার! কেটে গেল তো!
মৃত্যুর আগে একবারও সত্যকে জানতে চাও না?
না। আমি কোনওদিন খুব বেশি জানতে চাইনি। না জানলেও চলে যায়।
তোমার সম্পর্কেও কিছু অপপ্রচার রয়ে গেল যে রেমি। রাজার সঙ্গে তোমার সেই প্রেম!
উঃ কী যে বলো না তোমরা!
কে বিশ্বাস করবে রেমি যে, নিতান্তই ধ্রুবকে আকর্ষণ করার জন্য তুমি রাজাকে অত প্রশ্রয় দিয়েছিলে!
কেউ করবে না। আমি মস্ত একটা ঝুঁকি নিয়েছিলাম।
তার ফল কী হল?
সবাই বিশ্বাস করল, রাজা আর আমি প্রেমে পড়েছি। কিন্তু যার বিশ্বাস হওয়ার কথা তারই হল না।
কে বলো তো! ধ্রুব?
হ্যাঁ। সারাজীবন সে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কষ্ট কী জানো?
অবহেলা?
ঠিক। অবহেলা। সে বিশ্বাসই করল না যে, আমি রাজার প্রেমে পড়েছি। কিংবা বিশ্বাস করলেও পাত্তা দিল না তেমন। পুরুষ মানুষের দখলদার মন থাকে, দখলের জায়গায় অন্য কেউ হাত বাড়ালে সে গর্জে ওঠে। তবু ও গর্জাল না। আমাকে দখল করতে চায়নি তো কখনও, তাই। একেই তো অবহেলা বলে, না?
তুমি বড় নির্লজ্জ, রেমি। এই নারী স্বাধীনতার যুগে ওই মদ্যপ, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর ও অপ্রকৃতিস্থ ধ্রুবর সম্মোহন কাটাতে পারলে না। অবোধ মুগ্ধ হয়ে বইলে।
তা নয়। তা নয় গো। আমি জানতে চেয়েছিলাম, ওর মধ্যে কোনও রহস্য আছে কি না। ছেড়ে গেলে তো জানা হত না।
ছেড়ে তো যাওনি। জানতে পারলে কি?
না। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেল। ছদ্মবেশ কিছুতেই খুলতে পারলাম না।
ছদ্মবেশ নয় রেমি। ধ্রুবকে সবাই জানে। ও যা, ও তাই। তুমি খামোকা ধানখেতে বেগুন খুঁজতে নেমেছিলে। ওর মধ্যে কোনও রহস্য নেই। ছদ্মবেশও নেই।
তবে কেন ওর চোখের মধ্যে আমি এক-এক সময়ে খুব গভীর একটা কিছু লক্ষ করতাম।
তোমার মনের ভুল, রেমি। যার প্রতি আমাদের দুর্বলতা থাকে তার মধ্যে আমরা নানা কাল্পনিক গুণ আরোপ করে নিই।
না, আমি মানি না। আমি যত বেশি ওকে টের পেতাম তেমন তো কেউ টের পেত না ওকে। তোমরা বুঝবে না গো।
অপাত্রে তোমার সব ভালবাসা গেল রেমি, তার চেয়ে রাজাকে একটু ভালবাসলে পারতে।
রাজাকে তো বহু মেয়ে ভালবাসত। কত রূপ, কত গুণ।
তুমি কেন পারলে না?
আমিও বাসতাম। তবে প্রেমিকের মতো নয়।
তবে কেমন?
যেমন ভাইয়ের ওপর বোনের ভালবাসা।
রাজা কিন্তু–
জানি। বোলো না গো।
তুমি টের পেতে রেমি?
পেতাম। প্রথম দিন থেকেই।
আর ধ্রুব তোমাকে পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম করার উদার অনুমতি দিয়েছিল। তবু পারলে না?
বোকার মতো কথা বোলো না। মেয়েমানুষ কোনওদিন কখনও একজন ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষকে ভালবাসতে পারে না। এমনকী এই নারী স্বাধীনতার যুগেও। যাদের দেখো অনেক পুরুষের সঙ্গে ঢলাঢলি করে বা একটা ছেড়ে তিনটে-চারটে বিয়ে করে তারা কাউকেই ভালবাসতে পারেনি কখনও ওরকম হয় না।
বলছ একথা বিশ্বাস করতে?
বলছি। ভালবাসলে দোষঘাট অত ধরতে চায় না মানুষ। তুমিই না একটু আগে বললে যার ওপর দুর্বলতা থাকে তার ওপর মানুষ কাল্পনিক গুণ আরোপ করতে থাকে!
বলেছি।
তা হলে? স্বামীর শতেক দোষ থাক। বিবাহ মানে তো বহন। ঠিক সওয়া যায়, বয়ে নেওয়া যায়।
তুমি তো পারলে না।
কে বলল পারিনি! মরে যাচ্ছি বলে বলছ? সে তো মরতে হতই একদিন।
ধ্রুবকে তা হলে তুমি ভালবাসতে রেমি?
কী জানি! অত গর্ব করে বলতে পারব না যে, বাসতাম। তবে চেষ্টা করেছি। অন্য কোনও পুরুষকে ভাববার সময় যখন হল না, তখন বুঝে নাও, বাসতাম।
আর তার জন্য আর-একটা পুরুষকে ডোবালে?
না তো। রাজা ড়ুববে কেন? ভালবাসলেই কি ডোবে?
তুমি যে ড়ুবেছ।
আমি! সে ঠিক ডোবা নয়। তুমি বুঝবে না গো। আর যদি ড়ুবেই থাকি তা হলে বুঝে নিয়ে আমি ড়ুবতেই চেয়েছিলাম।
নানা তরঙ্গ আজ রেমিকে ওলটপালট করে দিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে তার শেষ কয়েকটি মুহূর্ত বয়ে যাচ্ছে। কৃপণের ধন। আর-একবার চেতনা ফিরল রেমির। মুখোশ পরা একটা লোক নিবিড় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।
রেমি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতে গেল। গলার স্বর ফুটল না। অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ হল শুধু। তারপর অন্ধকার হয়ে গেল চেতনা!
কেউ বাধা দিল না রাজা আর রেমিকে। ঠিক সদ্য প্রেমে পড়া উদ্দাম দুটি তরুণ তরুণীর মতো তারা বেরিয়ে পড়েছিল আনন্দের হাট লুট করতে। ছিল নৈকট্যের শিহরন, ছিল নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রাকৃত আকর্ষণ, ছিল সুন্দরের প্রতি মুগ্ধতা। সব ছিল। ধ্রুবও ছিল নিষ্ক্রিয় ও উদার প্রশ্রয়দাতা।
তবু একদিন রাজা বলেছিল, বউদি, এক কোটি বছর তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরলেও বোধহয় কেউ তোমার মন পাবে না।
রেমি অবাক হয়ে বলল, একথার মানে?
তুমি রিমোট কন্ট্রোলড এক রোবট মাত্র। তোমার নিজস্ব সত্তা নেই।
ও বাবা! কী সব ইংরিজিতে গালাগাল দিচ্ছ গো!
গালাগালই বটে। তোমার গায়ে লাগে?
গালাগাল দিলে লাগারই তো কথা।
না, লাগার কথা নয়। চৌধুরীবাড়ির বউদের চামড়া মোটা হয়ে যায়। তোমারও হয়েছে।
কেন বলল তো!
কী করে যে এত সহ্য করো জানি না।
রেমি মুখ টিপে হাসল একটু।
ব্যান্ডেলে বেড়াতে গিয়েছিল তারা। রাজার ফাংশন ছিল। একটু আগেই পৌঁছে তারা বিখ্যাত চার্চ দেখে গঙ্গার ধারে বসেছিল একটু। শীতকালের মন্দস্রোত নদী। আকাশে সাদা রোদ। ফাংশনের কিছু ছেলে পিছু পিছু ঘুরঘুর করছিল প্রথম থেকেই। রাজা তাদের অনেক করে বুঝিয়ে ভাগাল। তারপর হঠাৎ রেমির কাছে ঘন হয়ে বসে বলল, কেন বুঝতে চাইছ না রেমি?
কী বুঝতে চাইছি না?
এরকম ভাবে চলে না।
কীরকম হলে চলবে?
তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কী করে বুঝলে?
ধ্রুবদা তোমাকে ভালবাসে না।
তবে কাকে বাসে?
তা জানি না। তবে তোমাকে বাসে না।
আমার তা মনে হয় না।
তার মানে! তোমার কী মনে হয়?
রেমি একটু লাল হয়ে বলে, তোমার কুট্টিদা যদি আমাকে না-ই ভালবাসে তবে অন্য কাউকেও বাসে না। কিন্তু যদি কোনওদিন কাউকে তার ভালবাসবার ইচ্ছে হয় তবে আমাকেই বাসবে।
এটা কি তোমার অন্ধ বিশ্বাস নয়?
না।
এই যে আমার সঙ্গে এত মিশছ ধ্রুবদার জেলাসি লক্ষ করেছ কখনও?
না। ও আমাকে লক্ষই করে না। অন্য কী যেন ভাবে।
তা হলে আমাকে স্কেপগোট বানিয়ে যে প্ল্যানটা তুমি কবেছিলে সেটা ফেল করল তো!
মনে তো তাই হচ্ছে।
তা হলে এসো একটা কাজ করি।
কী কাজ?
কুটিদার একেবারে মূলে একটা নাড়া দিই।
কীভাবে?
আজ বাড়ি ফিরে তুমি অ্যানাউন্স করো যে, কুট্টিদাকে ডিভোর্স করবে। তারপর আমাকে বিয়ে করতে চাও।
উদাসীন রেমি কিছুক্ষণ নদী দেখল।
তারপর মাথা নিচু করে বলল, বলব।
বলবে?
বলব। দেখো, ঠিক বলব। তবে তাতে কাজ হবে না।
তবু বোলো।
রাত্রে যখন রেমি ফিরল তখন ধ্রুব নীচের ঘরের বিছানায় আধশোয়া। এক পলক তাকিয়ে দেখল।
বলল, হঠাৎ এ ঘরে যে?
রেমি বলল, কেন? আসতে নেই?
তা আছে। তবে তোমার মান্যবর শ্বশুর দোতলায় যখন তোমার ঘর ঠিক করে রেখেছেন তখন সেখানেই তোমার থাকা ভাল।
আমি তোমাকে একটা কথা বলেই চলে যাব।
বলে ফেলো।
আমি ডিভোর্স চাইলে দেবে?
এক্ষুনি। কিন্তু হঠাৎ চাইছ কেন?
তুমিও তো চাও!
আমি!—ধ্রুব অবাক হয়ে বলে, কখনও চাইনি তো! তোমাকে বলেছি, ডিভোর্স নাও। নিজে চাইনি।
রহস্যময় এক আনন্দে শিহরিত রেমি তবু ঘাড় শক্ত করে বলল, এবার আমি চাইছি।
ধ্রুব একটু ঘরের বাতাসটা শুকল যেন। তারপর রেমির দিকে অপলক চোখে চেয়ে বলল, কথাটা কে শিখিয়ে দিয়েছে?
কে শেখাবে! আমিই তো বলছি!
বলছ, কিন্তু আন্তরিকতা নেই, ইচ্ছা নেই, আগ্রহ নেই। মুখস্থ করা বুলি।
রেমি খুব অবাক হল। ঠিক, ডিভোর্সের কোনও তাগিদ বা আগ্রহ তার ভিতরে নেই। সে মোটেই ধ্রুবকে ছেড়ে যেতে চায় না। রাজা কৌশলটা শিখিয়েছিল, সে সেইমতো আচরণ করে গেছে, কিন্তু সেটা ধ্রুবর বুঝবার কথা নয়। তা হলে বুঝল কী করে?
রেমি বলল, বুঝলে কী করে? তুমি কি অন্তর্যামী?
অন্তর্যামী সকলের ক্ষেত্রে নই। কিন্তু তোমার মতো বোকা আর দুর্বল মনের মেয়েকে বোঝা কিছু শক্ত নয়। কে শিখিয়েছে বলে তো! রাজা?
তাতে তোমার কী যায় আসে?
ধ্রুবর মুখটা আস্তে আস্তে রক্তিম হয়ে উঠছিল। কপালের দুপাশে দুটো শিরা ফুলে উঠল। রাগলে ওর ওরকম হয়, রেমি বহুবার দেখেছে। হাতের বইটা রেখে ধ্রুব সোজা হয়ে বসে বলল, ডিভোর্স দিলে রাজাকে বিয়ে করবে?
রেমি ক্রুদ্ধ ধ্রুবর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না। পুরুষ মানুষ, বিশেষ করে ধ্রুবর মতো ধারালো চেহারার পুরুষ যখন আমূল রেগে ওঠে তখন তাদের স্পর্শ করে অলৌকিক কিছু। রেমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, ধ্রুবর শরীরের চারদিকে সেই ফেটে পড়ার আগের দুরন্ত রাগ একটা ছটা বিকীর্ণ করছে। রূপ যেন দেহের সীমানা ভেঙে ফেলতে চাইছে। রেমির বাকরোধ হয়ে গেল। সে চোখ ফেরাতে পারছিল না।
ধ্রুব দাঁতে দাঁত পিষে বলল, শোনো। কেষ্ট চৌধুরীর মতো নোংরা লোক যা করতে পারে তাই করছে। তার হাতের সুতোর টানে তোমরা নাচছ। কিছু না জেনে, না বুঝে।
রেমি স্খলিত গলায় বলে, কেষ্ট চৌধুরীটা আবার কে?
কেন? তোমার শ্বশুর কৃষ্ণকান্ত! চেনো না!
উনি কী করেছেন?
কী না করেছেন? একজন ভদ্রলোকের পক্ষে যা কিছুতেই সম্ভব নয়, তা উনি অনায়াসে করতে পারেন। হাসিমুখে। বোধহয় পলিটিক্স না করলে কোনও মানুষ এরকম ভয়েড অফ সেনটিমেন্টস হতে পারে না। লোকে জানে উনি পুরনো মূল্যবোধে বিশ্বাসী, রক্ষণশীল। লোকেরা গাড়ল।
রেমি শঙ্কিত হয়ে বলে, উনি কী করেছেন তা বলবে তো?
তোমাকে বলে লাভ নেই। তুমি বিশ্বাস করবে না। রাজাকে তোমার সঙ্গে জুটিয়ে দিয়েছেন উনিই।
উনি?
তুমি বোকা। তোমাকে ঠকানো বা ভোলানো খুব সোজা।
রেমি বিশ্বাস করতে পারছিল না। বারবার ঠোঁট কামড়ে শুকনো মুখে আপনমনে বলছিল, উনি! উনি!
ধ্রুব একটা পাগলা রাগের চোখে রেমির দিকে চেয়ে থেকে বলল, তুমি এখন আমাকে বলো, রাজাকে বিয়ে করতে চাও?
রেমি এক পা পিছিয়ে গিয়ে অসহায় গলায় বলে, তুমি আমাকে ভালবাসো না কেন?
সেটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। কাউকে ভালবাসা আমার পক্ষে অসম্ভব। কথাটার জবাব দাও। ওকে বিয়ে করবে?
আমি জানি না।
কেন জানো না?
ভেবে দেখিনি।
ধ্রুব কোনওদিন যা করেনি, হঠাৎ রেমিকে দুহাতে ধরে প্রচণ্ড দুটো ঝাঁকুনি দিল। সেটা মার নয় ঠিকই, কিন্তু মারের চেয়েও বেশি। সেই অসম্ভব জোরালো কঁকুনিতে মাথা ঘুরে চোখে অন্ধকার দেখল রেমি।
ধ্রুব তাকে ছুড়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে বলল, আমি তো তোমাকে পাসপোর্ট দিয়েই রেখেছি। যার সঙ্গে খুশি প্রেম করো, ডিভোর্স চাও তো তাও সই। সব ঠিক। কিন্তু তার মধ্যে ফাঁকিবাজি আমার সহ্য হয় না। ইউ মাস্ট বি অনেস্ট। ভেরি অনেস্ট।
আমি কী করেছি?—রেমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে জিজ্ঞেস করে।
তুমি রাজাকে নষ্ট করেছ। ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিয়েছ। ওকে লোভ দেখিয়ে নাচিয়ে, আশা দিয়ে তারপর একদিন ছোলাগাছি দেখাতে চাইছ।
তোমাকে কে বলেছে এসব?
আমি জানি। যে দু-একজন লোকের আমি আগাপাশতলা জানি, যাদের চোখের দিকে তাকালেই সব বুঝতে পারি, সেই অল্প কয়েকজনের মধ্যে তুমিও পড়ে।
রেমি কাঁদছিল। কিন্তু কে জানে কেন, তার বুকে একটুও দুঃখ বা জ্বালা ছিল না। বরং কান্নার সঙ্গে তার গা শিহরিত হচ্ছিল বারবার। সে বলল, আমি কী করব তুমি বলে দাও।
আমি! আমি কেন বলতে যাব?
আমি যে কিছু বুঝতে পারি না। বড্ড বোকা।
কে বোকা?
আমি। আমাকে তো তুমি সবসময় বলল, বোকা।
ধ্রুব একটুও হাসল না। মুখটা যেমন থমথমে ছিল তেমনি থমথমেই হয়ে রইল। কয়েক পলক রেমির দিকে স্থির চেয়ে থেকে সে বলল, বোকা সেটা বড় অপরাধ নয়। বড় অপরাধ হল ডিজঅনেস্টি। তুমি অসৎ হয়ে যাচ্ছ। চালাকি করছ। ধ্রুব চৌধুরীকে পটানোর জন্য রাজার সর্বনাশ করছ।
ওর সর্বনাশ হবে না।
অলরেডি হয়ে গেছে। কাল ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। জলে ডোবা মানুষের মতো ফ্যালফ্যালে মুখ, ভীষণ আনমনা, বোগা। লক্ষণগুলো আমি চিনি। ফঁদ পাততে গিয়ে বেচারা নিজেই ফঁদে পড়ে গেছে।
আমি ওর সঙ্গে কখনও সেভাবে মিশিনি। যেভাবেই মেশো, তুমি যুবতী এবং বলতে নেই বোধহয় সুন্দরীও। তোমার সঙ্গটাই তো যে-কোনও পুরুষের পক্ষে বিপজ্জনক। এখন কেসটা অত্যন্ত সিরিয়াস দাঁড়িয়ে গেছে। তোমাকে এবার একটা ডিসিশন নিতে হবে।
আমি পারব না। তোমার পায়ে পড়ি।
নিজে না পারো কেষ্ট চৌধুরীর পরামর্শ নাও। সেই তো তোমার গার্ডিয়ান অ্যানজেল।
আমি পারব না।
পারতে হবে, রেমি। আমাকে জব্দ বা বশ করার জন্য তোমরা তিনজন জেনে বা না জেনে যা করেছ তার সমাধানও তোমাদেরই করতে হবে।
কী সমাধান?
উকিলের কাছে যাও। ডিভোর্সের মামলা করো। আমি ছেড়ে দেব। তারপর তোমাকে বিয়ে করতে হবে। রাজাকেই।
রেমি উথলে উঠে বলে, এ জীবনে পারব না। তার চেয়ে আমাকে মেরে ফেলো। পায়ে পড়ি, মেরে ফেলল।
তুমি কি ওয়ান-ম্যান উওম্যান, রেমি?
আমি আর কাউকে চাই না, আর কিছু চাই না। শুধু তোমাকে।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, তুমি কী চাও বা না চাও সেটা বড় কথা নয়। ইউ মাস্ট ফিনিশ ইয়োর কেস।
আমাকে তাড়িয়ে দেবে?
না। তোমাকে রাজার হাতে ছেড়ে দেব। তোমাকে আমি অনেস্ট হতে শেখাব।
আমি তো ওকে চাই না।
চাইতে হবে, রেমি। ওকে পাগল করলে কেন তবে?
সারা রাত কত কাতর অনুনয়-বিনয়, কত পায়ে ধরাধরি। ধ্রুব এক ইঞ্চি জমি ছাড়ল না।