ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে একটু আড়াল থেকে রাজা কয়েক পলক কৃষ্ণকান্তকে দেখল। লোকটাকে কি সে ঘেন্না করে? না পছন্দ করে? তাও না। লোকটার ওপর কি তার রাগ আছে? থাকারই কথা। কিন্তু বাস্তবিক কোনও রাগও রাজা অনুভব করে না। সে খুব ভাল করে জানে, কৃষ্ণকান্তের চারপাশে যে দেশ কাল পরিস্থিতি তা তার কাছে একটা দাবার ছক এবং তারা সবাই খুঁটি মাত্র। ওই অতিশয় সুপুরুষ, কান্তিমান মানুষটির আর সব কিছুই আছে, কিন্তু হৃদয়বত্তা নেই। মানুষকে তিনি ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজনে। ওঁর জীবনটাই কিছু উদ্দেশ্য সাধনের সমন্বয় মাত্র। আর কিছু নয়।
শুধু একটা মাত্র জায়গায় তাঁকে দ্রব হতে দেখা গেছে। সে ওই রেমি। রেমির জন্য তিনি অনেক কিছু করেছেন। এমনকী তার নিঃসঙ্গতায় রাজাকে লেলিয়ে দেওয়ার মতো নীতিবোধহীন যড়যন্ত্রেও
তার অরুচি হয়নি।
ব্যাপারটা বুঝতে রাজার একটু সময় লেগেছিল। ধ্রুব বা কুট্টিদা বাড়ি-ছাড়া। রেমি অর্থাৎ কুট্টিবউদি একা। সুতরাং তাকে সঙ্গ দিতে গিয়ে রাজা একটা সূক্ষ্ম তন্তুর মায়াজালে জড়িয়ে পড়েছিল।
সেই প্রথম দিন রেমি তেমন স্বচ্ছন্দ ছিল না। বার বার উচাটন হয়ে ধ্রুবর খোঁজ করছিল। বলছিল, আমাকে ওর অফিসে একবার নিয়ে চলল।
কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। ব কতটা বিপজ্জনক সে ধারণা বোধহয় কচি মেয়েটার নেই। কিন্তু তারা, অর্থাৎ ধ্রুবর আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধুরা জানে অস্থিরচিত্ত ধ্রুবর পক্ষে সব রকম কাজই সম্ভব। রেগে গেলে খুব স্থির বুদ্ধিতে মানুষকে খুন করা তার কাছে কিছুই নয়। তার বন্ধুদের মধ্যে লোজ্জা, বদমাশ, গুন্ডা, মস্তানদেরও অভাব নেই। বরং তাদের সংখ্যাই বেশি। এক দুর্বোধ্য কারণে এইসব বদখত লোকেরা ধ্রুবর জন্য জান কবুল করতে পারে। উপরন্তু ধ্রুব যখন খুশি যার-তার সঙ্গে যেমনতেমন ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। এক দূরসম্পর্কে কাকা আসতেন তাদের বাড়িতে। প্রীতিনাথ। ওরকম মানুষ বড় একটা দেখা যায় না। ব্রিটিশ আমলের সন্ত্রাসবাদী। জেল তো খেটেছেনই, অত্যাচার নিপীড়নও বড় কম সহ্য করেননি। শোনা যায়, তাঁর সহ্যশক্তি ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য। প্রীতিনাথ কার্যত ছিলেন ধুবর গুরু। তাকে যত শ্রদ্ধা করত ধ্রুব এমনটা আর কাউকে করত না। নির্লোভ, উদাসীন, পরোপকারী ও ব্যক্তিত্বশালী এই মানুষটি বেঁচে থাকলে আজ কৃষ্ণকান্তের চেয়ে অনেক বড় নেতা হতে পারতেন। ধ্রুব তার এমনই ভক্ত হয়ে পড়ে যে, একসময়ে প্রীতিনাথের খপুরের আস্তানাতেই সে মাসের মধ্যে বিশ-পঁচিশ দিন পড়ে থাকত। প্রীতিনাথ রাজনীতি করতেন, ধ্রুব তার সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরত। কৃষ্ণকান্তর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ছিলেন প্রীতিনাথ। তার একটা দোষ ছিল, শরীর সম্পর্কে অবহেলা। একবার গ্রামের রাস্তায় বর্ষাকালে পড়ে গিয়ে তার পা মচকায়। সেই মচকানো পায়ের ব্যথায় শয্যা নিলেন। অনেক ডাক্তার দেখল, কিছু করতে পারল না। অবশেষে প্রীতিনাথের ভক্তরা কলকাতা থেকে এক বড় ডাক্তারকে ধরে নিয়ে গেল। তিনি দেখেশুনে গাদাগুচ্ছের অত্যন্ত কড়া জাতের ব্যথার ওষুধ খাওয়ালেন। এমনিতেই ব্যথাহরা বড়ি খেতে গেলে কিছু বেছেগুছে এবং ভালরকম প্রতিষেধক নিয়ে খাওয়া উচিত, তার ওপর অতগুলো বড়ি। প্রীতিনাথ অম্লানবদনে খেয়ে গেলেন। একশো পঁচিশটা বড়ির একটা কোর্স শেষ হওয়ার পর পায়েব ব্যথা কমে গেল। কিন্তু তখন পেটে একটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। কলকাতায় এসে সেই ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করলেন প্রীতিনাথ। ডাক্তার পেটের ব্যথা শুনে অভয় দিয়ে এক শিশি অ্যান্টাসিড খেতে বলে দিল। কিন্তু তাতে কাজ হল না। বড় দেরি হয়ে গেছে তখন। পেটের রহস্যময় সেই ব্যথাটা বাড়তে লাগল ক্রমে ক্রমে। অসহ্য হয়ে উঠল। পাক্কা দুবছর প্রীতিনাথ অমানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করলেন। অসুখ ধরা পড়ল একেবারে শেষ অবস্থায়। ক্যানসার। সেই ব্যথার সময় ধ্রুব প্রায় একটানা তার কাছে থেকেছিল। কিন্তু তাঁর মুখ-চোখে কোনও বিষণ্ণতা বা উদ্বেগের কোনও ভাব দেখেনি বাজা। ধ্রুবর চোখদুটো নিবিষ্টভাবে লক্ষ করত প্রীতিনাথকে। একবার সে মৃত্যুপথযাত্রী প্রীতিনাথকে বলে বসল, আপনার ওপর আমার আর শ্রদ্ধা নেই। আমি ভাবতাম আপনি পৃথিবীর সব ব্যথা সহ্য করতে পারেন। কিন্তু এখন বুঝেছি, আপনি আমাদের মতোই সাধারণ।
প্রচণ্ড যন্ত্রণা ভুলে প্রীতিনাথ তাঁর একনিষ্ঠ ভক্তটির দিকে অনেকক্ষণ অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে থেকে বলেছিলেন, এমন ব্যথা যেন আমার শত্রুরও না হয়। তুমি বুঝবে না, কী সাংঘাতিক…! ওঃ! কিন্তু ধ্রুব তার যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছিল। প্রীতিনাথকে কাতর অবস্থায় সে লক্ষ করত। টেপরেকর্ডারে তুলে নিত তার নানারকম যন্ত্রণার শব্দ। সেই ক্যাসেট বোধহয় আজও সযত্নে রেখে দিয়েছে ধ্রুব। প্রীতিনাথ মারা যাওয়ার পর কলকাতায় ফিরে এসে সবাইকে শুনিয়েছিল সেই ক্যাসেট। বলেছিল, আমি জানতাম, এইসব বিপ্লবীরা অল বোগাস। এরা কেউ ব্যথা-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না। মোস্ট অর্ডিনারি পিপল। প্রীতিকাকাকে আমার এক সময় মনে হয়েছিল সুপারম্যান। দেখলাম, দূর! কিচ্ছু না। লোকটা মোস্ট এক্সপেন্ডেবল।
এইসব সিদ্ধান্তে আসার পর ধ্রুবকে বেশ সুখীই দেখিয়েছিল। প্রীতিনাথের মধ্যে অতিমানবকে খুঁজে না পেয়ে যেন সে নিশ্চিন্তই হয়েছে।
অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে এই ঘটনার মধ্যে যে বিকট নিষ্ঠুরতা আছে তা ধ্রুব খেয়ালই করল না। শোনা যায় প্রীতিনাথের মৃত্যুর কিছু আগে ধ্রুব তাঁকে আত্মহত্যা করার পরামর্শ দেয়। সে নাকি বলেছিল, আপনার উচিত কাপুরুষদের পন্থা গ্রহণ করা। যন্ত্রণা যদি না-ই সইতে পারেন, দেন হোয়াই ডোন্ট ইউ কমিট সুইসাইড?
রাজা এরকম কিছু কিছু ঘটনার ভিতর দিয়ে ধ্রুবকে চিনেছে। তাই সে সহজে তাকে ঘাটাতে চায়।
রেমি বউদি এত ঘটনার কথা জানে না। ধ্রুবকে চিনতে তার সময় লাগবে। বেচাবা বড মানসিক কষ্টের মধ্যে এখন দিন কাটছে ওর।
বিকেলে নাটকটা চুপ করে বসেই দেখেছিল রেমি। একটু খুশিই হয়েছিল। ফেরা পথে বলল, নাটকটা তো খুব খারাপ নয়, কিন্তু তোমার মিউজিক তো তেমন কিছু শুনলাম না।
মিউজিক মানেই কি গান বা কনসার্ট?
তবে কী?
আধুনিক নাটকে বা সিনেমায় ওরকম মিউজিক কম থাকে। ব্যাকগ্রাউন্ডে নানারকম সাউন্ড তৈরি করাও মিউজিক ডিরেক্টরের কাজ।
ছাই কাজ!
মুখে যাই বলুক রেমি, রাজা সম্পর্কে তার সেদিন একটু মনোযোগও এসে থাকবে।
সেই শুরু একটা অদ্ভুত, ঘন, প্রগ সম্পর্কের।
রাজার রেকর্ডিং-এ রেমি রেডিয়ো স্টেশনে যেত। রাজার প্রোগ্রাম থাকলে গিয়ে শুনে আসত।
আরও মাসখানেক নিরুদ্দেশ থাকার পর কৃষ্ণকান্ত কলকাঠি নাড়তে লাগলেন। পুলিশকে সংবরণ করলেন। ধ্রুব ফিরে এল।
সেই সময়টা কৃষ্ণকান্তর ভাল যাচ্ছিল না। একটা ফালতু কেলেঙ্কাবিতে জড়িয়ে পড়ায় তাকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়। প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুই কমেনি, কিন্তু একটা ধাক্কা খেতে হল। একটানা দীর্ঘদিন তিনি মন্ত্রিত্ব করতে পারেননি। কখনও মন্ত্রী হয়েছেন, কখনও বাদ গেছে। কিন্তু মন্ত্রীর পদ থেকে এভাবে কখনও সরে দাঁড়াতে হয়নি।
সেই দুঃসময়ে ধ্রুব ফিরল। কৃষ্ণকান্ত মন্ত্রিত্ব হারানোয় যখন সমস্ত পরিবারটাই কিছু বিষণ্ণ, তখন একমাত্র ধ্রুবই আনন্দে ঝলমল।
বাড়িতে ফিরেই রেমিকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমাকে মাঝে মাঝে এখানে সেখানে একটা ছোকরার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। কে বলল তো?
রেমি ঘাবড়ে গিয়েছিল একটু। চোখ-মুখ লাল করে বলল, ছোকরা আবার কে? ও তো রাজা।
ধ্রুব জবাবটা শুনল, তবু কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল রেমির দিকে। কোনও অভিযোগ করল, সন্দেহ প্রকাশ করল না, এমনকী তাকানোর মধ্যেও কোনও কুটিলতা ছিল না। বরং সহজ সরল এক তাকিয়ে থাকা যার কোনও মানে নেই।
কিন্তু সেই দৃষ্টির সামনে রেমি ঘামতে লাগল, লাল হয়ে যেতে লাগল লজ্জায়।
ধ্রুব রেমির প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে করতে মৃদু স্বরে বলল, তোমাকে আমি অনেকবারই বলেছি তোমার একজন সঙ্গী দরকার। যাকে প্রকৃত সঙ্গী বলা যায়। আমি তো তোমাকে কিছুই দিতে পারি না, না সঙ্গ, না হৃদয়।
রেমি হঠাৎ রেগে গিয়ে বলে, কী যা-তা বলছ?
ধ্রুব উদাস গলায় বলে, রাজা বড় ভাল ছেলে।
রেমি দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ভাল ছেলেই তো। ওরকম ভাল তুমিও হতে পারো না?
না।–ধ্রুব খুব গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলে, আমি তা হতে পারি না। এ জীবনে আর তা হবেও। কিন্তু আমার রিফর্মেশন নিয়ে অত ভেবো না। ধ্রুব যদি রাজার মতোই হয় তবে ধ্রুবর মতো কেউ যে থাকবে না। ধ্রুব রাজা সবাইকে নিয়েই তো দুনিয়া।
রেমি আর কোনও কথা বলেনি।
ধ্রুব নিজেই জিজ্ঞেস করল, রুস্তম কী বলছে?
কে রুস্তম?–রেমি ভ্রু কুঁচকে পালটা প্রশ্ন করে।
আরে রুস্তম! মহান রুস্তম। তোমার শ্বশুর এবং প্রাক্তন মন্ত্রী।
উনি রুস্তম হতে যাবেন কেন?
বীরদেরই রকের ছেলেরা রুস্তম বলে। খারাপ কথা কিছু নয়। তোমার শ্বশুরের প্রশংসাই করছি।
ওরকম রকবাজদের ভাষায় কথা বলছ কেন?
ধ্রুব একটু হাসল। বিষণ্ণ হাসি। তার চেহারাটা সেবার একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তবু শীর্ণ চেহারার ভিতর দিয়েও একটা ক্ষুরধার বুদ্ধির আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল।
ধ্রুবর সঙ্গে সেই সাক্ষাৎকারের বিবরণ বিস্তারিতভাবে রেমি শুনিয়েছিল রাজাকে।
রাজা বলল, বউদি, ধ্রুবদার স্পাই সর্বত্র। আমাদের সব চলাফেরা কুট্টিদা লক্ষ রেখেছে।
রাখুক না। খারাপ কিছু তো নয়।
খারাপ নয়। ধ্রুবদা যদি সন্দেহ করে যে, আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করছি?
রেমি খুব অবাক হয়ে সরল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল রাজার দিকে। তারপর বলল, সন্দেহ করবে? ওমা! সন্দেহের কী? আমরা প্রেমই তো করছি রাজা! আরও করব। ইচ্ছামতো ঘুরব তোমার সঙ্গে, সিনেমায়, থিয়েটারে, গানের জলসায় যাব দুজনে।
সর্বনাশ বউদি! কুট্টিদা যখন ভাল তখন ভাল। কিন্তু যখন খারাপ–
রেমি সেই কথাটায় কান না দিয়ে বলল, তুমি অত ভেবো না। আমরা এমন বিহেভ করব যাতে ও সত্যিই ভেবে নেয় যে, আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করছি। তখন ও এত জেলাস হয়ে উঠবে যে, জ্বলতে জ্বলতে এসে একদিন সারেন্ডার করবে!
রেমির এই কথায় রাজার চোখ থেকে একটা পরদা সরে গেল। একথা ঠিকই যে, রেমির সঙ্গে তার একটা দেওর-বউদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বরং আরও কিছু ঘনিষ্ঠতর ভালবাসা। প্রায় সর্বত্রই রাজার সহচরী রেমি বউদি এবং রেমি বউদির সহচর রাজা। এটা নিয়ে লোকে কিছু বলাবলি করলেও অবাক হওয়ার নেই। রাজাও এরকমই ভাবত। কিন্তু হঠাৎ বুঝতে পারল, রেমি হাজার বছর ধরে তার ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়ালেও কোনওদিন কুট্টিদার দিক থেকে মন ফেরাতে পারবে না। রেমিও তাকে ঘুটি বানিয়ে একটা প্রেম-প্রেম ভাব গড়ে তুলতে চাইছে, স্রেফ ধ্রুবর জন্যই।
একবাব তাকে খুঁটি বানিয়েছেন কৃষ্ণকান্ত। দ্বিতীয়বার বানাল রেমি। অথচ কেবলমাত্র খুঁটি হওয়াব কথা তো নয় তার। সে অতীব সুপুরুষ। উঁচু দরের গায়ক। নামকরা সঙ্গীত পরিচালকও। যে কোনও মেয়ের পক্ষেই তার প্রেমে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক।
রাজা সেই প্রথম পরাজয়ের স্বাদ টের পেল। ব্যর্থতা আর তেতো বোধে ভরে গেল তার অভ্যন্তর। সে বলল, আমি ওসব খেলার মধ্যে নেই, বউদি। আমাকে রেহাই দাও।
রেহাই চাইছ? কেন? আমি কী করলাম?–বড় অভিমান ভরে রেমি বলো।
বউদি, তুমি ছেলেমানুষ। সব বুঝবে না।
আমার জন্যে তোমার মায়া নেই?
ভীষণ মায়া, বউদি।
তা হলে! আমার জন্য এটুকু করো। পায়ে পড়ি।
কোনটুকু বউদি! ধ্রুবদাকে তোমার অনুগত করে ভোলা?
হ্যাঁ, রাজা। ও কেন আমাকে একটুও পাত্তা দেয় না?
দেবে বউদি। কুটিদার জন্ম নভেম্বর মাসে। সায়ন মতে বৃশ্চিক রাশি। বড় সাংঘাতিক লোক। এ রাশির লোকেরা কোনও কালে মেয়েদের বশ হয় না।
তুমি জ্যোতিষ জানো নাকি?
ঠিক জানা একে বলে না। একটু-আধটু বইপত্র ঘেঁটেছি। কুট্টিদা আমার কাছে চিরকালই এক রহস্যময় মানুষ।
আমার কাছেও। কী করবে বলো তো!
কী বলব? শুধু বলি, মেনে নাও।
তুমি ওকে অত ভয় করো কেন?
শুধু ভয় নয় বউদি, কুট্টিদাকে ভালবাসি।
রেমি ভারী অসহায় ভাবে মুখখানা একটু হাঁ করে চেয়ে থেকে বাচ্চা বয়ঃসন্ধির মেয়ের মতো বলল, আমিও বাসি। কিন্তু কেন যে বাসি তা বুঝতে পারি না।
সেটাই তো বৃশ্চিকের রহস্য। ও রহস্য ভেদ হওয়ার নয়।
তা হোক। তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়ো না। তোমাকে আমার যে ভীষণ দরকার।
আচ্ছা, আসব। কিন্তু আগের মতো যখন-তখন ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারব না। কুট্টিদা ব্যাপারটা পছন্দ না করতে পারে।
কাঁদো-কাঁদো হয়ে রেমি বলল, তা হলে তো বাঁচতাম, রাজা। কিন্তু ও নিজেই আমাকে অন্যের সঙ্গে প্রেম করার পরামর্শ দেয়।
ঠাট্টা করে!
মোটেই নয়। আমি কি এতই বোকা যে ওর ঠাট্টাটাও বুঝতে পারব না?
রাজা একটু হেসেছিল মাত্র।
সেইসময় একদিন কৃষ্ণকান্ত ডেকে পাঠালেন রাজাকে। গভর্নমেন্ট প্লেস-এ কৃষ্ণকান্তর একটা পুরনো চেম্বার আছে। যখন রাজনীতি করেন না তখন মাঝে মাঝে তার ল প্র্যাকটিস করার কথা মনে হয়। ওকালতি করলে তার আয় ভালই হত। এক সময়ে একটা এটনি ফার্মও খুলেছিলেন। সেগুলো সব লাটে উঠেছে। তবে গভর্নমেন্ট প্লেস-এ চেম্বারটা তার এখনও আছে। সেখানেই দেখা হল।
রাজা, কী খবর রে?
ভাল।
বউমাকে গান-টান কিছু শেখালি?
গান! কই গান শেখানোর কথা কিছু বলেননি তো!
বলিনি! তবে কী বলেছিলাম?
জাস্ট কমপ্যানি দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
এমনি-এমনি আবার কমপানি কী রে! কিছু একটা কাজ নিয়ে থাকবি তো!
বউদিও গানের কথা কিছু বলেনি।
বউমার কি এখন সেরকম মন আছে? দামড়াটার পাল্লায় পড়ে ওর হাড়মাস কালি হয়ে গেল। বড় দুঃখী মেয়ে। একটু গান-টান করলে মনটা ভাল থাকত। ওর গলা কেমন?
একটু ভেবে রাজা বলল, বোধহয় খারাপ হবে না।
তা হলে একটু শেখাস।
যদি শিখতে না চায়?
এমনিতে চাইবে না। গরজটা তুই-ই দেখাবি।
ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন, দেখব।
কৃষ্ণকান্ত একটু গম্ভীর হয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তবে অনারেবল ডিসট্যান্স বজায় রেখে যা করার করবে।
অনারেবল ডিসট্যান্স! তার মানে?
মেয়েদের সঙ্গে, বিশেষ করে গেরস্ত বউদের সঙ্গে একটা সম্মানজনক দূরত্ব থাকা ভাল।
রাজা রেগে উঠতে যাচ্ছিল।
কৃষ্ণকান্ত মৃদু হেসে বললেন, এগুলো ভাল কাস্টম। কাজ হয়।
রাজা মনে মনে ভাবল, খচ্চর বুড়ো, এই অনারেবল ডিসট্যান্সের কথা এখন কেন? আগে তো বলোনি কখনও ঘুঘু!
গান শিখতে রেমি অবশ্য একটুও আপত্তি করল না। কারণ সে তখন যেমন করেই হোক রাজাকে হাতে রাখতে চায়।
সপ্তাহে দুদিন-তিনদিন গিয়ে রেমিকে তালিম দিত বাজা। রেমির গলা ভাল। অনভ্যাসে বসে গিয়েছিল। তালিম পেয়ে গলা খুলল। তবে এমন কিছু উঁচুদরের গায়িকা রেমি নয়। শোনা যায়।
সেই সংগীত শিক্ষার আসরে মাঝে মাঝে ধ্রুবও থাকত। ধ্রুবর গান বা অন্য কিছুতেই আসক্তি নেই। সে শুধু লক্ষ করত দুজনকে।
একদিন গান শিখিয়ে বেরিয়ে আসছে রাজা, ধ্রুব তার সঙ্গ ধরল।
রাজা! একটা কথা বলবি?
বলল কুট্টিদা।
কেসটা কী?
কীসের কেস?
এই তোর আর রেমির।
তা আমি কী করে বলব?
তোকে ওর সঙ্গে ভেড়াল কে?
হ্যাঁ। সবই তো জানো।
না, জানি না। ভেড়ানোর ব্যাপারটায় একটু খটকা ছিল। মন্ত্রীমশাই তোকে কী বলেছিল?
কমপ্যানি দিতে। তুমি নেই, বউদি একা। তাই।
মতলবটা কী?
তা জানি না কুট্টিদা।
মন্ত্রীমশাই আর-একটা চাল চেলেছে। কিন্তু চালটা বুঝতে পারছি না রে রাজা।
আমিও বুঝতে পারছি না।
তবে ভেড়ার মতো যা বলছে তাই করছিস কেন?
কিছু ক্ষতি তো নেই!
তোর নেই, কিন্তু রেমির আছে।
তার মানে?
তোর অনেক গার্লফ্রেন্ড আমি জানি, একে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে বেড়াস, তার ওপর লালটুমার্কা চেহারা। তোর ফ্যান অনেক। কিন্তু রেমি বোকা মেয়েমানুষ। ওর বয়ফ্রেন্ড কেউ নেই।
ওসব বলছ কেন?
বলছি, তোর আর রেমির মধ্যে যদি কোনও সফটনেস দেখা দেয় তা হলে সেটা কোনও পরিণতিতে যাবে না। রেমির সঙ্গে তুই লাইফটা কাটাতে চাইলেও পারবি না। কৃষ্ণকান্ত তোকে কেটে ফেলবে। সুতরাং–
রাজা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল।
কিন্তু ধ্রুব বাধা দিয়ে বলল, আগে শোন। কে যদি বিলা হয়ে যায় তবে তুই সইতে পারবি। কারণ তোর মেয়েছেলে অনেক দেখা আছে। রেমি পারবে না। কারণ ও সিরিয়াস টাইপের মেয়ে।
তুমি কি আমাদের সন্দেহ করো, কুট্টিদা?
করি। কারণ কেসটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
তবে আমাকে ছুটি দাও।
দূর পাগলা! তুই ভাবছিস আমি রাগ করেছি। মোটেই না। আমি চাই রেমি আমাকে ছেড়ে অন্যদিকে একটু ইন্টারেস্ট নিক। কিন্তু আমি চাইলেই তো হবে না। কেষ্ট চৌধুরী রেমির চামচা। তাই বলছি খুব সাবধান।
উনিই তো আমাকে বলেছেন।
কেন বলেছেন সেইটেই তো বুঝতে পারছি না রে গাড়ল। তাই ভাবছি রেমির জন্য উনি একটা নরবলির ব্যবস্থা করেছেন কি না।
কী বলি?
নরবলি। আমার মনে হচ্ছে তোকে উৎসর্গ করা হচ্ছে।
রাজা হেসে ফেলেছিল, ঠাট্টা করছ, কুট্টিদা?
রে। ঠাট্টা নয়। কিন্তু তোকে নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন?
কই নার্ভাস?
তোর ভয় নেই। আমি কিছু বলব না। ক্যারি অন। শুধু কেষ্ট চৌধুরীর দিকে নজর রাখিস।